বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৬
রানী আমিনা
হালকা রঙের একটা মলিন হুডি আর ট্রাউজার পরনে মেয়েটির। হুডির হুড দিয়ে মুখটা যথাসম্ভব ঢেকে লুকিয়ে রেখেছে সে। রোগা-পাতলা গড়ন, কিন্তু চোখে তার অদম্য উচ্ছ্বাস আর কিঞ্চিৎ ভয়। গার্ডদের নজর এড়িয়ে গুটিগুটি পায়ে নিঃশব্দে সে এগিয়ে এলো কাজে ব্যাস্ত থাকা ছেলেগুলোর দিকে।
হাতের নিচে লুকানো একটা ছোটখাটো প্যাকেট, পরিষ্কার কাগজের ভাজে মোড়ানো কিছু শুকনো খাবার। এটুকু সে প্রাণপণে লুকিয়ে লুকিয়ে নিয়ে এসেছে এই অবধি।
এদিক ওদিক সতর্ক দৃষ্টিতে তাকিয়ে, গার্ডদের নজর এড়িয়ে ঠোঁট কামড়ে সে এগোলো সামনের দিকে। নীল রঙা চোখ জোড়া দিয়ে দেখে নিলো চারপাশে থাকা গার্ডদের অবস্থান, যেন কেউ তাকে দেখে না ফেলে!
শ্রমিকদের ভিড়ের ফাঁক গলিয়ে সন্তর্পণে সে এগিয়ে গেলো আরও সামনে। ঘাম ঝরানো মুখ, আতঙ্কে নিঃশ্বাস দ্রুত উঠানামা করছে তার।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
লিও ডুবে আছে কাজের মধ্যে, ইটের স্তুপ থেকে একে একে তুলে নিয়েছে সে এক ঝুড়ি ইট। ইটভর্তি ঝুড়িখানার ভার পিঠের ওপর তুলে কনস্ট্রাকশনের দিকে যেতে নিতেই ওর কানে এলো মেয়েলি কাশির চাপা শব্দ।
থমকালো লিও, পিঠের ঝুড়িটা শক্ত করে ধরে রেখে চমকে তাকালো আবার পেছনে। ইটের স্তুপের পেছনেই দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। চোখ ভর্তি তার তীব্র মায়া!
কিঞ্চিৎ অবাক হয়ে আশেপাশে সতর্ক দৃষ্টি রাখলো লিও, তারপর দ্রুত পায়ে ইটের স্তুপের কাছে আবার ফিরে গিয়ে কপট রাগ দেখিয়ে চাপা সুরে বলে ওঠে,
“লিন্ডা! তুমি এখন এখানে কি করছো? ওরা দেখলে জানে মেরে ফেলবে! বলেছিনা দিনের বেলা আসবে না? এখনি চলে যাও এখান থেকে, রাতে এসো!”
লিন্ডা দ্বিধাভরে এগিয়ে এলো দ্রুত পায়ে, তড়িতে লিওর হাতের ভেতর খাবারের পুঁটলিটা গুঁজে দিলো। হাতে হাত স্পর্শ করা মাত্রই আঙুল কেঁপে উঠলো ওর, চোখে ফুটে উঠলো আকুতি, বলে উঠলো,
“কেউ দেখে ফেলার আগেই তাড়াতাড়ি খেয়ে নিও, বেশি করে এনেছি, ভাইয়াদেরও দিও!”
তারপর আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না, মুখ ফিরিয়ে ছুটে সরে পড়লো দ্রুত, চলে গেলো লিওর চোখের আড়ালে!
তারপর ছায়ার মতো মিশে গেলো কনস্ট্রাকশনের ভারী, যান্ত্রিক কোলাহলের ভেতর।
যাওয়ার আগে পেছনে ফিরে তাকালো আরও একবার। লিও তাকিয়ে আছে সেদিকে তখনো, হতভম্ব দৃষ্টিতে। চোখে ওর কৃতজ্ঞতা আর এক সমুদ্র ভালোবাসা!
মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো লিওর ঠোঁটে।
কিন্তু সে হাসি বেশিক্ষণ স্থায়ী হলোনা, কাজে ফাকি দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার অপরাধে মুহুর্তেই চাবুকের একটা বাড়ি শপাং শব্দে এসে আঘাত করলো ওর পিঠের নিম্নাংশে।
হাতে লিডারের চাবুকখানা নিয়ে দাঁড়িয়ে একজন গার্ড, লিওর দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে কণ্ঠে শাসনের তীব্রতা মিশিয়ে বলে উঠলো,
“কাজে ফাঁকি দিয়ে দাঁড়িয়ে আছো কোন সাহসে? চুপচাপ কাজে হাত লাগাও, নইলে আজকের দিনেও একফোটা পানি জুটবেনা তোমাদের কপালে!”
চাবুকের বাড়ির শব্দ আর গার্ডের কথাটা কানে যাওয়া মাত্রই ধৈর্যহারা হয়ে তখনি কাজ থামিয়ে দিয়ে গার্ডের দিকে তীর্যক চোখে তাকালো নির্মাণাধীন ফার্ম হাউজের ওপরের দিকে কাজ করতে থাকা আলফাদ, কাঞ্জি, আর জোভি। হাতে থাকা জিনিসপত্র গুলো ছুড়ে ফেলে দিয়ে এগিয়ে এসে দাড়ালো ওরা কাঁচা ইটের দেয়ালের ধার ঘেঁষে।
অন্য প্রান্তে কাজ করতে থাকা হাইনা হাত থেকে শব্দ করে ছুড়ে ফেলে দিলো ধাতব কড়াইটা। পেছন থেকে কয়েক কদম এগিয়ে সেও এসে দাড়ালো তার অন্য ভাইদের পাশে। তাকালো একবার গাছে ঝুলে থাকা ফ্যালকনের দিকে, তারপর আবার ফিরে তাকালো গার্ডটির দিকে৷ ওর দেখা দেখি ওকামিও কাজ ফেলে এগিয়ে এসে দাড়ালো ওদের পাশে।
শক্তপোক্ত শরীর, ধুলোমাখা মুখে বিক্ষোভের আগুন জ্বালিয়ে সবগুলো লাফিয়ে কনস্ট্রাকশনের ওপর থেকে নেমে এসে দাড়ালো গার্ডটির সম্মুখে৷ চোখ মুখ ভয়ানক রকম শক্ত, আজ এই অকারণ শাস্তির কৈফিয়ত ওরা নিয়েই ছাড়বে৷
চাবুকের আঘাত প্রাপ্ত লিও পিঠের ওপর থেকে ইটের বোঝা মাটিতে ফেলে দিলো সশব্দে। বড়সড় পেশিবহুল শরীরটা এগিয়ে নিয়ে এসে চাপা ক্রোধে পরিপূর্ণ স্বরে বুক উঁচিয়ে বলে উঠলো,
“কি ভেবেছিস কি তোরা? আমাদের সাথে যা খুশি তাই করবি? আমাদেরকে তোদের হাতের পুতুল মনে হচ্ছে?
আমার কোকো ভাইজানকে শক দিয়ে মেরে ফেলেছিস, ফ্যালকনকে ঝুলিয়ে রেখেছিস কাল বিকেল থেকে!
কিছু বলছিনা বলে কি আমাদেরকে তোদের দাস ভেবে নিয়েছিস? হাতের বাধন টা একবার খুলে দে শুধু, সবগুলোকে আজ এখানেই গেঁড়ে রেখে দেবো!”
লিওর ক্রুদ্ধ হুঙ্কারে ভয় পেলো যেন গার্ডটি।
এই ছেলে গুলো আজ পর্যন্ত কখনোই কিছু বলেনি, যা হয়েছে চুপচাপ মেনে নিয়েছে, টু শব্দটি করেনি কখনো। নিজেদের শেহজাদী আর বাদশাহর মৃত্যুশোকে মুহ্যমান হয়ে এতদিন এরা চুপচাপ ছিলো। কিন্তু গতকাল একটু বেশি বেশি করা হয়ে গেছে, কোকোকে এমন শাস্তি দিতে হতোনা, বেচারা শুধু শুধু মরলো, সামান্য কারণে। এখন এরা এভাবে ফুসে উঠলে কিভাবে সামাল দিবে ওরা?
চারপাশে একটা শীতল নীরবতা নেমে এলো মুহুর্তেই। অন্য শ্রমিকরাও কাজ ফেলে শঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো এদের দিকে। গার্ড গুলো চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো যে যার স্থানে, লিডার গার্ড নাস্তা করতে গেছে, সে থাকলে হয়তো একটু সাহস হতো ওদের। কিন্তু এই মুহুর্তে কারোরই সাহসে কুলোচ্ছে না এগিয়ে যেতে!
কিন্তু সেই মুহুর্তেই পেপার টাওয়েলে হাত মুছতে মুছতে জঙ্গলের ওপাশ থেকে সেখানে এসে উপস্থিত হলো লিডার গার্ডটি,
“তুই কি বললি?”
প্রশ্ন করে লিওর দিকে এগিয়ে গেলো সে কয়েক কদম।
“বলেছি একবার বাধন টা খুলে দিয়ে পুরুষত্ব দেখাতে আয়, পুরো পৌরুষ ছিড়ে কুকুর দিয়ে খাইয়ে দেবো।”
লিওর কথা শেষ হওয়া মাত্রই লিডার খপ করে চেপে ধরলো লিওর গলায় থাকা লোহার শেকল, টান দিয়ে নিজের দিকে টেনে নিয়ে এসে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দিতে চাইলো লিওকে, কিন্তু এক ইঞ্চি পরিমাণও টলাতে পারলোনা! বার কয়েক শক্ত হাতে গলায় বাধা বেড়িটা হ্যাচকা টেনে লিওকে টলানোর চেষ্টা করলেও লিওর মাথাটাকে সামান্যতম নত করাও সম্ভব হলোনা তার দ্বারা। লিও আগের মতোই মাথা উঁচিয়ে দাঁতে দাঁত পিষে তাকিয়ে রইলো লিডারের দিকে।
লিওর এমন অনড় স্বভাবে মেজাজ হারালো লিডার, ক্রোধান্বিত হয়ে ঘুরে লিওর পেছনে গিয়ে ওর হাটুর ঠিক পেছনে একটা শক্তপোক্ত লাথি হানিয়ে ওকে বসিয়ে দিলো ধুলোয়।
কিন্তু এতে ফুসে উঠলো লিও, গর্জে উঠে মুহূর্তেই বসা থেকে উঠে লিডারের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে হাতে বাধা লোহার শেকলে ঠন ঠন শব্দ তুলে সর্বশক্তি দিয়ে নিজের বজ্রমুষ্ঠি হাঁকালো লিডারের মুখে!
ঘুষির প্রচন্ড ধাক্কায় ঘুরে উঠলো লিডারের মাথা, ছিটকে গিয়ে পড়লো সে পাশের মাটিতে, নিমিষেই ঠোঁটের কোণ আর নাক দিয়ে ঝরতে শুরু করলো রক্ত।
চারপাশে শোরগোল তৈরি হলো মুহুর্তেই, গার্ডগুলো ছুটে আসতে চাইলো লিওর দিকে। কিন্তু ততক্ষণে বাকি বাচ্চা গুলো মাঠে নেমে এলো পুরোপুরিভাবে, মাটিতে পড়ে থাকা লোহা আর কাঠের সূচালো খন্ডাংশ গুলো তুলে নিলো ওরা হাতে, কড়া চোখে তাকালো আশেপাশে দাঁড়ানো গার্ডগুলোর দিকে, কেউ এগোলেই আজ তার কলিজা বের করে নিয়ে আসবে! অনেক হয়েছে, আর না!
লিডার গার্ডটি কথা বলতে পারলোনা কিছুক্ষণ, এক হাতে নাক চেপে ধরে অন্য হাতে পাশে থাকা গার্ড গুলোকে হাতের ইশারায় আদেশ দিলো অস্ত্র ব্যাবহার করে এদের ঘায়েল করে দিতে!
কিন্তু গার্ড গুলো থমকালো আজ, হাতে থাকা রাবার বুলেটের গান গুলো ধরে রইলো শক্ত করে। সরাসরি এদেরকে গুরুতর আঘাত করা বারণ, কিন্তু এই সামান্য অস্ত্র নিয়ে এদের সামনে যাওয়া মানে নির্ঘাত মৃত্যু!
ওদেরকে থমকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে লিডার গার্ডটি নাক চেপে ধরে খিচিয়ে বলে ওঠে,
“দাঁড়িয়ে কি দেখছো? তোমাদের নাড়িভুঁড়ি বের করে দিলে তখন হামলে করবে?”
গার্ডগুলো হাতের অস্ত্রগুলোকে আরও শক্ত করে ধরে দ্বিধাভরা পায়ে এগিয়ে যেতে নিলো লিওর দিকে, কিন্তু তার আগেই ওদের কানে এসে ঠেকলো একটি মেয়েলি বজ্রকন্ঠ,
“কি হচ্ছে এখানে?”
এই অসময়ে এখানে এমন কন্ঠ শুনে চমকে সেদিকে তাকালো সকলে, আর তাকানো মাত্রই চোখে পড়লো রাজসিক বিভার দাহক শিখার ন্যায় তীক্ষ্ণ, অভিজাত, অপরাজেয় এক শ্বেতশুভ্র নারীর অবয়ব!
ধরণীতল ছুই ছুই রক্তরঙা পাতলা ফেব্রিকের গাউন জড়িয়ে আছে তার শরীরে, হীরকখন্ডের ন্যায় ঝলমলে চোখ জোড়া তীক্ষ্ণ! অবিসংবাদিত বাঘিনীর ন্যায় সদর্পে দাড়িয়ে, রেড জোনের সমস্ত সৌন্দর্যকে ছাপিয়ে একটি তরতাজা লাল টকটকে গোলাপের ন্যায় ফুটে আছে সে।
আনাবিয়ার ভারী, স্থির, তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো সকলের, হতবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো তারা আনাবিয়ার দিকে।
বাচ্চাগুলো অবিশ্বাস্য চোখে চেয়ে রইলো ওদের মাতৃসম শুভ্র মেয়েটির দৃঢ় মুখটির পানে! বিশ্বাস হতে চাইলো না এই অসম্ভব দৃশ্য।
লিডারের দিকে ধারালো দৃষ্টি রেখেই ধীর কদমে লিওর দিকে এগিয়ে এলো আনাবিয়া, কাছে এসে হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করলো লিওর পিঠে খচিত হওয়া কতক পুরোনো কতক নবীন ক্ষতের নকশার ওপর।
পরমুহূর্তেই নিজের হাত উঁচিয়ে ক্ষিপ্র বেগে শুন্যে তুলে ধরলো আনাবিয়া, ওর হাতের নিঃশব্দ ইশারায় ফার্ম হাউজের তলের মাটি ফুড়ে বেরিয়ে এলো এক ঝাঁক বিশালাকৃতির তীক্ষ্ণ, ধারালো, লৌহসম শেকড়ের গুচ্ছ! সম্পুর্ন ফার্ম হাউজটাকে গুড়িয়ে দিয়ে ছিড়ে ফুড়ে বের হয়ে সেগুলো তছনছ করে দিলো সমস্ত বিল্ডিং খানা। ইটের ওপর ইট সেজে তৈরি হতে থাকা ইমারতটা মুহুর্তেই গমগমে শব্দে ধূলিসাৎ হলো মাটিতে।
“এই রেড জোন আমার, আমি একে য়্যোন করি! আমার রেড জোনে দাঁড়িয়ে আমারই সন্তানের গায়ে হাত তোলার মতো দুঃসাহস তোমাদেরকে কে দিয়েছে?”
আনাবিয়ার ক্রোধে পরিপূর্ণ বজ্রকণ্ঠে কেঁপে উঠলো লিডার গার্ডটি, তার সম্মুখে দন্ডায়নাম ঝলমলে চোখের শুভ্র মেয়েটি ঠিক কে সেটা বুঝতে ওর আর বাকি রইলোনা, কিন্তু এটা কিভাবে সম্ভব?
তিনি তো লাইফট্রির ভেতরে চলে গেছিলেন, নিজ ইচ্ছায়! তবে এখন তিনি জীবিত অবস্থায় এমন সুস্থ সবল ভাবে কিভাবে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছেন?
আনাবিয়া জঙ্গলের কিনারের দিকে উদ্দ্যেশ্য করে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লো আবার,
“সৌলজার্স…!”
বিগত তিন বছর ধরে রেড জোন এবং ব্লু জোনের সীমান্তে অকেজো অবস্থায় পড়ে থাকা অদৃশ্য রোবোটিক গার্ডগুলো নিজেদের মালকিনের আদেশপূর্ণ কন্ঠস্বরে অদ্ভুত মেটালিক শব্দ করে জেগে উঠলো আবারও, বাতাসের ভেতর দেখা গেলো তাদের আবছা অবয়ব৷ মুহুর্তেই যান্ত্রিক শব্দে সচল হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিজেদের নিরাপত্তা বেষ্টনী আবারও পূর্বের ন্যায় শক্তিশালী করে তারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে একের পর এক দাঁড়িয়ে গেলো অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায়! সীমানা রেখা টেনে দিলো রেড জোনের সমস্ত অংশটুকুতে৷
আনাবিয়া পা বাড়ালো, মাটিতে টেনে গেলো ওর রক্তলাল গাউনের বর্ধিতাংশ। লিডার গার্ডটির সামনে দিয়ে হেটে আরও সামনে এগিয়ে গিয়ে একজন অত্যন্ত নিরীহ গার্ডের সামনে টান টান হয়ে দাঁড়িয়ে বলে উঠলো,
“এই মুহুর্তে এখানের সমস্ত শ্রমিকদের নিয়ে রেড জোন ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। দ্বিতীয়বার কখনো এই রেড জোনে ঢোকার দুঃসাহস করবেনা!
আর তোমাদের শেহজাদা জাজিব ইলহানকে বলে দিবে, আমি আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান তাকে বাদশাহ মানিনা, এবং না কখনো মানবো!
এই সাম্রাজ্য শুধু এবং শুধুমাত্র আমার স্বামী, প্রয়াত বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ান য়্যোন করেন!
সুতরাং শেহজাদা যদি ভুল করেও আমার এবং আমার রেড জোনের ওপর কোনো ধরণের কোনো কর্তৃত্ব ফলাতে আসার চেষ্টাও করে তবে আমার স্বামী এবং পঞ্চদ্বীপের একচ্ছত্র অধিপতি বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানকে হত্যার অভিযোগে আমি নিজের হাতে তাকে মাটিতে মিশিয়ে দেবো! ন্যাও গেট লস্ট!”
শেষোক্ত শব্দটা উচ্চারণ করা মাত্রই সীমান্তে দন্ডায়মান অদৃশ্য রোবোটিক গার্ডগুলোর একাংশ তড়িতে এসে ঝড়ের গতিতে রেড জোনের ভেতর থাকা শ্রমিক গুলোকে তুলে নিয়ে গিয়ে ছুড়ে ফেলে দিয়ে এলো বাইরে, তারপর আবার দাঁড়িয়ে গেলো নিজেদের স্ব স্ব স্থানে৷ ভেতরে রয়ে গেলো লিডার সহ অবশিষ্ট গার্ড গুলো।
তারা সম্ভ্রমপূর্ণ, ভীতসন্ত্রস্ত, প্রশ্নাত্মক চোখে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে। সবাইকে ছাড়া হলেও তাদেরকে কেন ছাড়া হলোনা সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগলো ওদের মস্তিষ্কে।
আনাবিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো ওকামির দিকে, আনাবিয়ার এই নিরব আদেশ বুঝতে বাকি রইলো না ওকামির।
মুহুর্তেই নিজের অ্যানিম্যাল ফর্মে চলে এলো সে, আর তার পরেই ঘাড় বেকিয়ে আকাশের দিকে তুলতে তুলতে কন্ঠ থেকে বের করলো এক দীর্ঘ, হিংস্র, কর্কশ ধ্বনি…
“আউউউউউউউউ……”
ওকামির এই নিরবতা ছিন্ন করা আহ্বান শোনা মাত্রই দূর জঙ্গলের ঝোপঝাড়, গাছপালার ভেতর থেকে সমস্বরে সাড়া দিল একইসুরের এক ঝাঁক কান্না। মুহূর্তেই কান্নার দলেদের নিঃশব্দ পদধ্বনির কারণে দুলে উঠলো সেদিকের গাছপালা, ছুটে আসতে থাকলো বাকি সদস্যরা।
গার্ডগুলো মুহুর্তেই বুঝে গেলো ওদেরকে এখানে রেখে দেওয়ার কারণ, ভয়ে আতঙ্কে একবার আনাবিয়ার দিকে তো আর একবার ধেয়ে আসতে থাকা নেকড়ের ঝাকের দিকে তাকিয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠলো ওরা, অসহায় চোখে আনাবিয়ার দিকে তাকালো যেন আনাবিয়ার মনে একটু হলেও দয়া হয়!
কিন্তু ওদের আকুতি পূর্ণ দৃষ্টি কোনো কাজেই এলোনা! ওদের দিকে একবার তাকিয়ে আনাবিয়া ঘুরে দাড়ালো পেছন দিকে, তারপর রেড জোনের গভীরে যাওয়ার পথের দিকে এগোতে এগোতে বাচ্চাদের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“বয়েজ… ফলো ম্যি।”
ক্লান্ত পরিশ্রান্ত ধুলিমাখা শরীরে আনাবিয়ার পিছু পিছু ধীর পায়ে এগোলো ওরা, পেছনে ফেলে গেলো জীবিত শরীর থেকে মাংস ছিড়ে টুকরো টুকরো হওয়ার যন্ত্রণায় ছটফট করে চিৎকার তুলতে থাকা এক ঝাঁক মৃতপ্রায় অমানুষকে।
সন্ধ্যা নামতে চলেছে খুব শিগগিরই।
রেড জোনের ঘন জঙ্গলের গভীরে এক বিস্তৃত খোলা মাঠ, প্রকৃতি সেখানে এখন নিঃশ্চুপ হয়ে আছে সন্ধ্যার আগমনের অপেক্ষায়। চারপাশে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু উঁচু গাছ, তাদের শাখা-প্রশাখা গুলো ঘন হয়ে ঢেকে রেখেছে আকাশ, সরু ডালপালার ফাঁকফোকর দিয়ে মাটিতে পড়ছে শেষ বিকেলের রক্তিম আলো।
নিঃশব্দ জঙ্গলের নিরবতাকে ভেঙে দিয়ে ঘন ঝোপঝাড় মাড়িয়ে সামনে এগিয়ে চলেছে এক দল নারী পুরুষ, তাদের সম্মুখে নেতৃত্ব দিয়ে হেটে চলেছে রক্তিম পোশাক পরিহিতা এক শুভ্রা রমণী। আধার নামতে থাকা প্রকৃতির ভেতর শুক্লপক্ষের পূর্ণিমার চাঁদটির মতোন দ্যুতি ছড়াচ্ছে সে।
নিরব প্রকৃতিতে হঠাৎ মানব পদশব্দের আভাস পেয়ে দূরে কোনো অচেনা পাখি শেষবারের মতো ছুঁড়ে দিলো সাবধানী ডাক। গাছের আড়ালে কোথাও একটা দলছুট হরিণ সতর্ক চোখে দেখে নিলো চারপাশ।
আকাশের পশ্চিম প্রান্তে লালচে আভা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে আসছে, তার জায়গা নিচ্ছে অন্ধকারের গভীর ছায়া। নারী পুরুষের ঝাঁকটি এগোতে এগোতে একসময় কদম ফেলালো জঙ্গলের মধ্যিখানে অবস্থিত খোলা মাঠের ভেতর।
আনাবিয়া হাঁক ছাড়লো তখন,
“অ্যাবিসোরা……!”
মুহুর্তেই স্বল্প আলোতে বাতাসের ভেতর দিয়ে দ্রুত গতিতে হাজির হলো একটি দীর্ঘ লিকলিকে আবছা অবয়ব।
আনাবিয়ার ঠিক পেছনে থাকা শার্লট ভয়ে চাপা চিৎকার দিয়ে জড়িয়ে ধরলো ব্রায়ানকে, পারলে কোলে উঠে যায়! শার্লটের পেছনে থাকা ফাতমা ভয়ে জমে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সেখানেই, পরমুহূর্তেই ভয়ের চোটে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যেতে নিলো পেছনে।
ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা হাইনা আর আলফাদ হাত বাড়িয়ে দ্রুত ধরে ফেললো ওকে, তারপর দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হাসলো ঠোঁট টিপে।
আলফাদ জ্ঞানহীন ফাতমা কে ধরে ঠেলেঠুলে আবার সোজা করে দাঁড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো কিছুক্ষণ, কিন্তু ফাতমা এলিয়ে পড়ে যেতে নিলো আবার।
হাইনা হাত বাড়িয়ে ওকে তাড়াতাড়ি ধরে ফেলে কটমট করে তাকালো আলফাদের দিকে।
লিন্ডা পেছনেই ছিলো, লিওর গা ঘেঁষে। এদের দুজনকে এরকম কাহিনী করতে দেখে এগিয়ে এসে চাপা ধমক দিয়ে ফাতমাকে এক টানে ছাড়িয়ে নিলো হাইনার হাত থেকে। তারপর দাড়া করিয়ে দিলো নিজের শরীরের সাথে ভর দিয়ে।
“মধ্যরাতের আগেই আমি এখানে একটি মহল চাই।”
খোলা মাঠের দিকে চোখের দৃষ্টিতে ইশারা করে বলল আনাবিয়া। অ্যাবিসোরা মাথা নত করলো কিঞ্চিৎ, আর তারপর যেভাবে এসেছিলো সেভাবেই বাতাসে মিলিয়ে গেলো আবার৷
আর এরপরেই গা ছমছমে নীরবতার ভেতর হঠাৎই ভারী হয়ে উঠলো বাতাস, চারপাশে অনুভূত হলো এক অদৃশ্য শক্তির আনাগোনা।
পরমুহূর্তেই অন্ধকারের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো ধোঁয়ার মতো এক ঝাঁক অশরীরী— শরীর তাদের মেঘের ন্যায় অস্পষ্ট, চোখ জোড়ায় জ্বলছে নীলচে আগুন।
মুহুর্তেই বাতাসে ঘুরে উঠলো তাদের অদৃশ্য হাত, কোনো দিকনির্দেশনা ছাড়াই জঙ্গলের ভেতর থেকে বিশাল বিশাল গাছের মোটা গুঁড়ি গুলোকে শেকড় শুদ্ধ তুলে নিয়ে এলো তারা, হাওয়ায় ভেসে এসে সেগুলো যে যার নির্দিষ্ট স্থানে বসে গেলো কাঠামো তৈরির জন্য।
লতাপাতা, শিকড়, বাঁশ, কাঠের টুকরো—সব কিছুই এক অদৃশ্য সুতোর টানে জুড়ে যেতে থাকলো একের পর এক। ধোঁয়ার ন্যায় প্রাণি গুলো ঝড়ের গতিতে বয়ে নিয়ে আসতে থাকলো কালো রঙা পাথরের টুকরো, বাতাসে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে একের পর এক মেঝেতে বসিয়ে দিতে থাকলো সেগুলোকে, গড়ে তুললো এক শক্ত মজবুত কাঠামো।
কাঠের বিশাল বিশাল খিলান গুলোকে স্থাপন করলো ছাদের স্তম্ভ হিসেবে। লতাগুল্ম আর নরম শ্যামল পাতায় ঢেকে গেলো জানালাগুলো, তার ফাঁকফোকড় দিয়ে সন্তর্পণে দেয়ালে মৃদু আলো ফেলে ভেতরে ঢুকে পড়লো এক ঝাঁক জ্বলজ্বলে জোনাকি।
বাতাসে বয়ে ছুটে আসতে থাকলো ভারী ভারী পাথরের সিড়ি। অ্যাবিসোরা নিজে দাঁড়িয়ে তদারকি করতে থাকলো সমস্ত কাজের। শেহজাদীর মহলে কোনো খুত থাকা চলবেনা, হতে হবে একেবারে নিখুঁত!
কাজ পুরোদমে শুরু হলে আনাবিয়া সেদিক থেকে পেছন ফিরে তাকালো বাচ্চাদের দিকে, তারপর কাঞ্জি কে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো
“দুটো হরিণ চাই আমার, কাঞ্জি। আমি ফিরে আসার আগেই সেগুলোকে কেটে কুটে পরিষ্কার করে রাখবি সকলে মিলে, আমি এসেই রান্না করবো।”
“আপনি কোথায় যাচ্ছেন আম্মা?”
শুধালো কোকো, আনাবিয়া ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে পা বাড়িয়ে সে স্থান ছেড়ে চলে যেতে যেতে বলে উঠলো,
“প্রাসাদে।”
দেমিয়ান প্রাসাদের রয়্যাল ফ্লোরের পাশে থাকা গুরুত্বপূর্ণ রাজকর্মচারীদের ফ্লোরের প্রধান দুয়ার দিয়ে দ্রুত পায়ে প্রবেশ করলো ক্লান্ত ইয়াসমিন৷
এই মাত্র বাদশাহর খাস দাসীদের একজনকে সাজিয়ে গুছিয়ে পাঠিয়ে দিয়ে এলো বাদশাহর কামরায়, এখন ওর ছুটি। এবার একটু আরাম করে শরীরটা এলিয়ে দিবে বিছানায়৷
কিন্তু ফ্লোরে ঢুকতেই সামনে গুল বাহারকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকালো ইয়াসমিন, বাহারের উদভ্রান্ত চেহারার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি ব্যাপার, তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন বাহার? কিছু হয়েছে?”
“আপনাকে আমি সকাল থেকে খুঁজছি কালবী, কিন্তু সারাদিনে আপনার দেখা পাইনি!”
“কেন? কোনো অসুবিধা?”
“আমি আজ ভোর বেলা প্রাসাদের পশ্চিম দিকে হাটতে গেছিলাম, সেখানর বড় বেলকনিতে যখন আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম তখন বাইরে রয়্যাল গ্রেভইয়ার্ডে আমি কাউকে দেখেছি!”
চিন্তিত দেখালো ইয়াসমিনকে, বাহারের হাত ধরে টেনে নিজের কামরায় নিয়ে গিয়ে বসালো সে, তারপর ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কাউকে বলতে? কাকে দেখেছো তুমি?”
“একটা মেয়ে, ভীষণ লম্বা! উরু পর্যন্ত ভীষণ ঘন লম্বা চুল, সাদা রঙের। টকটকে লাল রঙের একটা মাটি ছুই ছুই গাউন ছিলো তার পরনে। কিন্তু পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে থাকায় তার মুখ দেখতে পাইনি আমি।
আপনি আমাদের শেহজাদীর যেমন বর্ণনা দিয়েছিলেন ওই মেয়েটি কিছুটা তেমনই।”
ইয়াসমিনের চিন্তিত চেহারা স্বাভাবিক হয়ে এলো মুহুর্তেই, ঠোঁটের কোণে এক ফালি হাসি ফুটিয়ে সে বলে উঠলো,
“দূর, কি যে বলো! উনি কোথা থেকে আসবেন? তুমি অন্ধকারে ভুল দেখেছো।
তাছাড়া ওটা কবরস্থান, অতো ভোরে ওদিকে আর যাবেনা। বলা যায় না, কখনো যদি খারাপ বাতাস টাতাস লেগে যায় তখন আবার ঝামেলায় পড়তে হবে৷”
বাদশাহ নামা তৃতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৫
“বিশ্বাস করো কালবি, আমি ভুল দেখিনি, একদম স্পষ্ট দেখেছি! একটা জ্বলজ্যান্ত মেয়ে মানুষ, সেটাও উ-উনার কবরের পাশে, দাঁড়িয়ে ছিলো চুপচাপ!
আ-আমি অবশ্য ভয় পেয়ে চলে এসেছিলাম সেখান থেকে, কিন্তু বিশ্বাস করো আমি স্পষ্ট দেখেছি, কোনো ভুল নেই!”
ওদের কথার মাঝেই সেখানে ছুটতে ছুটতে এসে পৌছালো মহসিন, শব্দ করে দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে হাফাতে হাফাতে কোনো রকমে বলে উঠলো,
“কাল-কালবি…. শেহজাদী……!”
