বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২১+২২
রানী আমিনা
রাতের এখন প্রায় ন’টা। রেড জোন পুরোপুরি নিস্তব্ধ। শুধুমাত্র থেকে থেকে কয়েকটি নেকড়ের বিরহী চিৎকার ভেসে আসছে জঙ্গলের গভীর থেকে।
সমুদ্রের গভীর থেকে ভেসে আসা বাতাসের শীতল ঝাপটায় মৃদুমন্দ গতিতে উড়ছে আনাবিয়ার সফেদ চুল।
পাড়ের বালির ওপর বিছানো নকশাদার ম্যাটের ওপর বসে আনাবিয়ার মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে মীর, তৃপ্তির সাথে খাচ্ছে আনাবিয়া৷ খেতে খেতে ও বলল,
“রান্নাটা অনেক মজা হয়েছে মীরি।”
মীর স্নিগ্ধ হেসে ওর গালে আর একটু খাবার তুলে দিয়ে বলল,
“পেট ভরে খাবে৷ কাল থেকে এক্সাম তোমার। এই রাতটা রিল্যাক্সে কাটিয়েছো, এখন খেয়ে দেয়ে প্রাসাদে ফিরে লম্বা একটা ঘুম দেবে। চাপ নেওয়ার প্রয়োজন নেই একদম।গাড়িতে যাবে গাড়িতে আসবে, এদিক ওদিক একদমই যাওয়া যাবে না।
কারো সাথে কথা বলার প্রয়োজন হলে প্রাসাদে ফিরে ফোনে কথা বলে নিবে। লিলিয়ান আর ক্রিস্টিনা থাকবে তোমার সাথে সারাক্ষণ, ওদের নজরের বাইরে যাবেনা। ঠিক আছে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“এত গার্ড দেওয়ার কি প্রয়োজন মীরি? কিছু হবেনা আমার। আর ওরা সারাক্ষণ আমার পিছে পিছে থাকলে কেমন হবে বলোতো! সবাই অদ্ভুত ভাবে দেখবে আমাকে। আমি মোটেই কোনো এম্ব্যারেসিং মুহুর্তে পড়তে চাইনা!”
“ওরা তোমার সাথে সাথে থাকবেনা শিনু, আশেপাশেই থাকবে, তাই চিন্তা নেই। আর যা বললাম, একটা ফোটাও সময় নষ্ট করবেনা।
এক্সাম হল থেকে সোজা প্রাসাদ, এদিক ওদিক একদমই নয়। নওমি ফওমি কারো সাথে কোনো কথা নয়, যত কথা বলার প্রয়োজন প্রাসাদে ফিরে, ওকে?”
আনাবিয়া ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে ওপর নিচে মাথা নেড়ে সায় জানালো। মীর ওর মুখে খাবার তুলে দিলো আবার, আনাবিয়া সেটুকু মুখে পুরে নিয়ে চিবোতে চিবোতে সন্তুষ্টচিত্তে বলল,
“তুমি এত দারুন রান্না কোথায় শিখেছো মীরি?”
“সে অনেক কাহিনী। সালিম আর আমি বহির্বিশ্বের যেখানে যেখানে ঘুরেছি সবখানের কোনো না কোনো রান্না আমরা শিখেছি। বিশেষ করে যেগুলোর স্বাদ ভালো লেগেছে সেগুলো।
তোমার বাবা আমার থেকেও ভালো রান্না জানতো। ওর রান্না খেলে তুমি আর কারো হাতের রান্না খাইতেই চাইতে না!”
“বাবাকে তুমি অনেক ভালোবাসতে, তাইনা?”
আনাবিয়ার এমন প্রশ্নে স্নিগ্ধ হাসলো মীর, উত্তরে বলল,
“যখন সমস্ত পৃথিবী আমার বিরুদ্ধে ছিলো তখন মাত্র তিনজন ব্যাক্তিকে আমি সর্বক্ষণ আমার পাশে পেয়েছি শিনু! দাদাজান, আম্মা আর তোমার বাবা সালিম।
তোমার বাবা ছিলো আমার সমস্ত কাজের সঙ্গী, বলতে পারো পার্টনার ইন ক্রাইম। আমার থেকে বয়সে বড় ছিলো কিছু বছরের, কিন্তু ও ছিলো আমার ভাইয়ের থেকেও বেশি কিছু।
এমন কিছু নেই যা আমরা করিনি; শিরো মিদোরির জঙ্গল, পঞ্চদ্বীপ, বহির্বিশ্ব সমস্ত জায়গাতেই ও ছিলো আমার একমাত্র সঙ্গী, ছায়ার মতো বিশ্বস্ত! আমার ভাই বলো, বন্ধু বলো, সব ও-ই ছিলো।
তুমি ইনায়ার গর্ভে আসলে তোমার বাবা যে কত খুশি হয়েছিলো সেটা যদি তুমি জানতে শিনু! ও যেদিন প্রথম জানলো ওর মেয়ে হবে সেদিন সর্বপ্রথম ও আমাকেই জানাতে এসেছিলো, আমি সেদিন দেখেছিলাম ওর চোখের খুশির ঝিলিক, ওর মেয়ে হবে সেই খুশিতে ও আত্মহারা হয়ে গেছিলো! কিন্তু, ভাগ্য ওকে বঞ্চিত করলো সবকিছু থেকে, তোমার থেকে!”
নস্টালজিক হয়ে উঠলো মীর, চোখ জোড়া ওর ঝিলিক দিয়ে উঠলো। সেই সোনালি দিনগুলো, যেখানে সালিম আর ও চষে বেড়াতো সমস্ত জঙ্গল! মায়ের আদর, দাদাজানের শাসন, রাত হলেই লুকিয়ে জঙ্গলে পালানো সমস্তকিছু মুহুর্তেই ছবির মতো ফুটে উঠলো ওর চোখের সামনে!
বাবার কথা শুনতে শুনতে আনাবিয়ার মুখে খেলে চলা স্নিগ্ধ হাসিটা ক্রমে ক্রমে বিলীন হয়ে এলো, সেখানে এসে ভর করলো এক রাশ মন খারাপ।
বাবা থাকলে ওর জীবন কি অন্যরকম হতো? বাবা বেঁচে থাকলে এখন কি করতেন? নিশ্চয় আনাবিয়াকে নিয়ে তিনি কোথায় না কোথায় ঘুরতেন, কত্ত ভালোবাসতেন!
ওর আরও ভাইয়েরা থাকতো, তাদের সাথে ও কত্ত মজা করতো! কেমন হতো তখন?
ও একমাত্র শেহজাদী বলে বাবা হয়তো ওকে মাথায় করে রাখতেন, মীরের মতো মাথায় করে রাখতেন? নাকি আরও বেশি? হয়তো আরও ভালোবাসতেন! বাবা তো বাবাই!
বাবার কথা ভাবতেই চোখের কোণা জোড়া পূর্ণ হয়ে এলো আনাবিয়ার। মুহুর্তেই সমুদ্র পাড় জুড়ে শুরু হলো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি! চমকে আনাবিয়ার মুখ পানে তাকালো মীর, আনাবিয়ার চোখ থেকে তখনি এক ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো গাল বেয়ে।
মীর দ্রুত ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে ওর মুখখানা একহাতে তুলে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
“এই কি হয়েছে শিনু তোমার? কাঁদছো কেন তুমি?”
“আ-আমার বাবা নেই কেন?”
বলেই ঠোঁট ফুলিয়ে ফুপিয়ে কেদে উঠলো আনাবিয়া, তখনি ঝমঝমিয়ে নামলো বৃষ্টি! মীর ওকে বৃষ্টি থেকে বাচাতে দ্রুতহাতে টেনে নিয়ে এলো নিজের বুকের ভেতর, শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে ওর চুলের ওপর দিয়ে শব্দ করে চুমু খেয়ে ও নরম, স্নেহপূর্ণ কন্ঠে বলল,
“তোমার বাবা নেই তো কি হয়েছে শিনু, আমি তো আছি তোমার সাথে! সবাই কি আর সারাজীবন বেচে থাকে বলো? একদিন না একদিন তো সবাইকেই পরপারে পাড়ি জমাতে হয়! ভাগ্য তাকে আগেই নিয়ে গেছে!
এভাবে কান্না করতে হয়না শিনু, কান্না থামাও প্রাণ আমার! তুমি তো একা নও, আমি তো আছি তোমার সাথে এখানেই; সারাটা জীবন থাকবো শিনু! কেদোনা আর।”
আনাবিয়া কেদেই গেলো, আজ হঠাৎ করেই বাবা নামক মানুষটা বার বার ভেসে উঠছে ওর মানস্পটে! যে মানুষটার অনুপস্থিতি ও কখনো অনুভব করেনি আজ তাকেই ভীষণ মনে পড়ছে ওর। বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো ওর জীবন অন্যরকম হতো, সম্পুর্ন আলাদা এক জীবন; এই জীবনের সাথে যার কোনো তুলনা চলেনা!
হিঁচকি তুলতে তুলতে কান্নায় ভার হয়ে যাওয়া মাথাটা মীরের বুকে ঠেস দিয়ে বিশ্রাম দিলো আনাবিয়া, ফোপাতে ফোপাতে ক্লান্ত হয়ে একসময় মীরের বুকেই ঘুমিয়ে পড়লো ও। বৃষ্টির তোপ হ্রাস পেতে পেতে একসময় থেমে গেলো সম্পুর্ন, আবার স্বাভাবিক হয়ে এলো সমুদ্রপাড়।
মীর ঘুমন্ত আনাবিয়াকে কোলে নিয়েই সমুদ্রপাড় ছেড়ে সন্তর্পণে এগোলো প্রাসাদের দিকে। কামরায় ফিরে আনাবিয়ার পোশাক পালটে আলগোছে ওকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে বাকিটা রাত ওর স্বান্তনা হয়েই ঘুমন্ত আনাবিয়ার পাশে শুয়ে জেগে রইলো ও।
এক্সাম হল থেকে বেরিয়ে চোখ বন্ধ করে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লো আনাবিয়া৷ এক্সাম শেষ ওর আজ।
হলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে চারিপাশ টা দেখে নিলো একবার।
লিলিয়ান আর ক্রিস্টিনা ওর থেকে প্রায় বিশ হাত দুরত্বে, ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
সানগ্লাস পরিহিত স্যুটেড ব্যুটেড এই পুরুষ আর নারীকে নিয়ে এক্সাম শুরু হওয়ার পর থেকেই জল্পনা কল্পনার শেষ নেই!
যেখানে এক্সামের সময় শুধুমাত্র হলে গার্ড দেওয়া টিচার ব্যাতিত অন্য কোনো টিচারের ইম্পেরিয়ালে প্রবেশ নিষেধ সেখানে এই দুই আগন্তুক কেন এবং কিভাবে কলেজের ভেতর সর্বক্ষণ রোবটের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে সেটা ওদের মাথায় আসেনা।
আনাবিয়া এগোলো বিল্ডিং থেকে নামার সিড়ির দিকে, তখনি ওর পেছন পেছন ছুটে এলো নওমি। উচ্চস্বরে ডেকে বলে উঠলো,
“নূর! আরিশ তোকে খুজছিলো, তোদের নাকি কিসের মিটিং আছে!”
আনাবিয়া ওর জন্য না দাঁড়িয়েই কোনোদিকে না তাকিয়ে সামনে হেটে যেতে যেতে বলল,
“ওকে বলে দিস আমি বাসায় ফিরে গ্রুপ কল করবো। তখন মিটিং হবে, এখন নয়।”
নওমি কিছুক্ষণ ওর পিছু পিছু ছুটেও ওর হেটে যাওয়ার গতি দেখে থেমে গেলো আস্তে আস্তে। মেয়েটা এক্সাম শুরু হওয়ার পর থেকেই একদম বদলে গেছে, কারো সাথেই কথা বলেনা, ওর সাথেও না! যায় আর আসে। অথচ বাড়ি ফিরে ঠিকই ফোন দিয়ে খবর নেয়!
নওমি ওর যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠোঁট উলটে অন্যদিকে গেলো আরিশকে আনাবিয়ার বলা কথা গুলো জানাতে৷
আনাবিয়া সিড়ি বেয়ে নামার কয়েকমিনিট পর লিলিয়ান আর ক্রিস্টিনা নামলো। সোজা হেটে আনাবিয়া চলল গেইটের দিকে।
গেইট দিয়ে বের হতেই ওর চোখে পড়লো ফারিশকে। তার বিখ্যাত লাল রঙা গাড়িখানা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে ইম্পেরিয়ালের সামনে।
ঝকঝকে তকতকে সে আর তার গাড়ি। মেয়েরা দূর থেকে আগ্রহী চোখে পরখ করছে ওকে। নিজেদের ভেতর ফারিশকে নিয়ে জল্পনা কল্পনায় ব্যাস্ত তারা।
আনাবিয়াকে দেখা মাত্রই ফারিশ ওর ঝকঝকে দাঁত বের করে হাসলো, ইউনিফর্ম পরিহিতা আনাবিয়ার দিকে পকেটে হাত গুজে এগিয়ে এসে ও বলল,
“আপনাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে শেহজাদী, লেমন ড্রিংকস এর ব্যাবস্থা করবো?”
আনাবিয়া ঠোঁট গোল করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মাথা নেড়ে সায় জানালো। ফারিশ পাশে দৃষ্টি দিতেই ওর সাথের একজন ছেলে ছুটলো লেমন ড্রিংকস হাজির করতে।
“আমার গাড়িতে এসে বসুন শেহজাদী।”
বলে গাড়ির নিকট গিয়ে দরজা খুলে দিলো ফারিশ। আনাবিয়া ক্লান্ত পায়ে গিয়ে উঠে বসলো গাড়ির ভেতর, গা এলিয়ে দিলো সিটে। ফারিশ ভেতরে গিয়ে দরজা আটকে দিয়ে বসলো ওর পাশে।
চোখ বুজে পড়ে থাকা আনাবিয়ার শুভ্র মুখশ্রির পানে কিছুক্ষণ অপলকে তাকিয়ে থেকে ফারিশ বলল,
“আপনি জানেন শেহজাদী, আপনার চোখের চেন্সের কারণে অন্যরা আপনার চেহারা সম্পুর্ন অন্যরকম দেখে? এমনকি আমরাও!”
ফারিশের কথায় চোখ মেলে তাকালো আনাবিয়া, তারপর কৌতুহলী কন্ঠে শুধালো,
“সত্যি নাকি? কিন্তু আমি তো ঠিকই দেখি!”
“আপনি বদলে যান সম্পুর্ণ, আপনাকে এই লেন্সে দেখে যারা অভ্যস্ত তারা আপনাকে লেন্স ছাড়া দেখলে চিনতে অনেক সময় নিবে। বাস্তবে আপনি এর থেকে হাজারগুণ বেশি সুন্দরী৷”
এইজন্যই কি তবে মীর ওকে এই ব্লাক লেন্সে দেখতে চায়না, প্রাসাদে ফেরা মাত্রই পোশাকের আগে ওকে লেন্স খুলতে বলে! মীর বলে ওর নাকি অন্যরকম লাগে, অচেনা অচেনা। এই তবে কারণ?
কিন্তু ও তো আয়নাতে নিজেকে ঠিকই দেখে!
ভাবতে ভাবতে আনাবিয়া ফারিশের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো। এত গুলো বছরেও ফারিশের দৃষ্টিভঙ্গির কোনো পরিবর্তন হয়নি। মীর যদি কোনোদিন এর ওপর ক্ষেপে যায় তবে কি হবে সেটা বলার অপেক্ষা রাখেনা। আনাবিয়া জানালার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল,
“আমাকে ফিরতে হবে রুশি ভাইয়া, দেরি হলে মীর রেগে যাবে।”
“আজ আমি আপনাকে পৌছে দিই?”
আনাবিয়া নিজের মনে হাসলো, যাক মীরিকে একটু জ্বলতে দেখা যাবে। আনাবিয়া মুখে বলল,
“ না না, তার প্রয়োজন নেই ভাইয়া। তোমার তো কাজ আছে অনেক।”
“কোনো কাজ নেই শেহজাদী, আপনার জন্য সব কাজ স্থগিত। চলুন আপনাকে প্রাসাদে পৌছে দিই।”
উচ্ছসিত হয়ে বলল ফারিশ। আনাবিয়া আর না করলোনা, ফারিশের আনানো লেমন ড্রিংকসটা খেয়েই রওনা দিলো প্রাসাদের দিকে। ফারিশের গাড়ির পেছন পেছন একে একে এগোলো আরও পাঁচখানা গাড়ি, আনাবিয়াকে সর্বক্ষণ সবদিক থেকে প্রটেকশন দেওয়া গার্ডগুলো ফিরে চলল আবার প্রাসাদে।
প্রাসাদের রয়্যাল মিটিং রুমে এখন পিনপতন নিরবতা। সেখানে শুধুই শোনা যাচ্ছে মীরের গভীর, প্রতাপশালী কণ্ঠস্বর। বিশাল কামরাটার প্রতিটি প্রান্তে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে ওর গমগমে আওয়াজ।
পারিষদদের উদ্দ্যেশ্যে মীরের গুরুত্বপূর্ণ স্পিচ চলছে। পারিষদগণ পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে শুনছে মীরের মুখনিঃসৃত প্রতিটি শব্দ।
নিস্তব্ধ কামরার মধ্যমণি হয়ে কথা বলতে থাকা মীরের দিক থেকে সামান্য মনোযোগ সরানোর সাহস টুকুও কারো হচ্ছেনা। অসাবধানতাবসতও কেউ নড়াচড়া করছেনা। রোবটের ন্যায় স্থির হয়ে বসে আছে তারা।
এমন সময়ে এই নিস্তব্ধ কামরাটাকে সচকিত করে তুললো কামরার বাইরে দরজার নিকট থাকা রয়্যাল মেম্বার ইন্ডিকেটরটি, স্পিকারে রোবটিক ভয়েসে ধ্বনিত হলো,
“অ্যাটেনশন! অনারেবল বেগাম, আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান!”
মীরের গুরুত্বপূর্ণ কথা থেমে গেলো মুহুর্তেই, প্রবেশদ্বারের দিকে তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে তাকালো ও। পারিষদেরা যে যার জায়গা থেকে হুড়মুড়িয়ে উঠে তৎক্ষনাৎ সরে পড়লো সেখানে থেকে। মুহুর্তেই সম্পুর্ন ফাকা হয়ে গেলো মিটিং রুম, কিয়ৎক্ষণ বাদেই সেখানে এসে উপস্থিত হলো আনাবিয়া।
মীর স্বস্তির শ্বাস ফেলে বসে পড়লো নিজের চেয়ারে, হাত বাড়িয়ে আনাবিয়াকে টেনে নিয়ে বসালো নিজের কোলে, দুহাতে ওকে জড়িয়ে নিয়ে আনাবিয়ার বাহুতে ঠোঁট ছুইয়ে শুধালো,
“এক্সাম কেমন হলো?”
“ভালোই হয়েছে, চিন্তা নেই। রুশি ভাইয়া এসেছে আমার সাথে।”
মীরের মুখের হাসিতে ভাটা পড়লো, চোখ জোড়া টানটান করে ও শুধালো,
“ফারিশ হঠাৎ তোমার সাথে এলো কেন?”
“এমনিতেই, বলল আমাকে প্রাসাদে পৌছে দিতে চায় আজ, তাই। এখনো প্রাসাদেই আছে, তোমার সাথে দেখা করেই ফিরবে বলল।
আমি ভাবছি রুশি ভাইয়াকে আজকের রাতটা থেকে যেতে বলবো, বেচারা আমাকে নিয়ে এতদূর এলো এখন আবার কষ্ট করে ফিরে যাবে কিভাবে? তার চাইতে আজ রাতটা এখানেই থাকুক!
তাছাড়া এক্সাম শেষ হয়েছে যেহেতু, এখন তুমি নিশ্চই আমার জন্য কোনো স্পেশাল রিফ্রেশমেন্টের ব্যাবস্থা করবে। রুশি ভাইয়াও থাকুক, সেও এনজয়ে করবে। কি বলো?”
মীর এক ভ্রু উঁচু করে চোখা দৃষ্টিতে তাকালো আনাবিয়ার দিকে, ওর দৃষ্টি দেখে আনাবিয়া ঠোঁট টিপে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। মীর বলল,
“এক্সাম শেষ হয়েছে তোমার, ফারিশের রিফ্রেশমেন্টের তো কোনো দরকার নেই! ও প্রাসাদে বিশ্রাম করবে, তুমি থাকবে আমার সাথে।
আর ওর যদি রিফ্রেশমেন্টের খুব দরকার হয় তবে কোকোর পেছনে একটা চাটি মেরে পাঠিয়ে দেবো ওর কামরায়, ফারিশ পুরা চাঙ্গা হয়ে যাবে।”
আনাবিয়া গা কাঁপিয়ে নিঃশব্দে হাসলো মীরের কথায়, হাসি থামিয়ে মীরের শার্টের বোতাম গুলো বুকের কাছ থেকে খুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার মিটিং শেষ হবে কখন?”
“আমার বউ যখন শেষ করতে বলবে তখন।”
আনাবিয়ার চুলের এক গোছাকে নিজের হাতের মুঠিতে নিয়ে আঙুলে পেচিয়ে নিতে নিতে বলে উঠলো মীর। আনাবিয়া মীরের কোল থেকে নেমে দাঁড়িয়ে কামরা থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলল,
“তবে চলো এখন, আমি ঘুমোবো এক ঘন্টা, তোমার ওপর।”
“যথা আজ্ঞা মহারাণী!”
বলে নিজেও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো মীর। মিটিং রুম থেকে বেরিয়ে প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে থাকা হামদানের উদ্দেশ্যে বলল,
“পারিষদদের বলে দিও আজকের মিটিং এখানেই স্থগিত, আগামীকাল যথাসময়ে অবশিষ্ট অংশ শেষ করা হবে।”
“মীরি, তোমার মেইলে একটা ইনভিটেশন গিয়েছে দেখো, এইটার রিপ্লাই করো।”
মীর সবেমাত্র সাম্রাজ্যের কিছু কাগজপত্র দেখতে বসেছিলো। দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে বলা আনাবিয়ার কথায় ও প্রশ্ন করলো,
“কিসের ইনভিটেশন?”
“ইম্পেরিয়াল ক্রেস্টের ডোমিনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের আয়োজিত ইভেন্টে তোমাকে ইনভাইট করা হচ্ছে, এবং তুমি ইনিভিটেশন অ্যাক্সেপ্ট করে ফিরতি মেইল করবে আমাকে। করো এক্ষুণি।”
বলে আনাবিয়া আবার ঢুকে গেলো ওর কামরায়। মীর হাতের কাগজপত্র গুলো সরিয়ে রেখে নিজের ল্যাপটপ অন করলো। চোখে পড়লো ইম্পেরিয়াল ক্রেস্টের ডোমিনিয়ন অ্যাসোসিয়েশনের ক্যাপ্টেন নূরিয়া তাজদিনের মেইল।
মীর সেটা ওপেন করে পড়ে রিপ্লাই পাঠালো তখনি। আনাবিয়ার ফোনে টুং করে শব্দ হলো, মেইল ওপেন করতেই ও দেখলো মীরের অফিসিয়াল আইডি থেকে মেইল,
“I appreciate your invitation, but let me make this clear—
wherever I go, My Queen accompanies me. Without her, I do not step into any place.
If this invitation does not extend to My Queen consider my absence as certain.”
মীরের মেইলে আনাবিয়া সেন্টি খেলো। বিছানা ছেড়ে উঠে এসে আবার দরজা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তেজি গলায় বলল,
“সমস্যা কি তোমার? এত কাহিনী না করে ইনভিটেশন টা অ্যাক্সেপ্ট করলেই তো হয়!”
“বউ ছাড়া আমি কোথাও যাচ্ছিনা৷”
আনাবিয়ার দিকে না তাকিয়েই কাগজপত্র ঘাটতে ঘাটতে উত্তর দিলো মীর। আনাবিয়া ভ্রুকুটি করে বলে উঠলো,
“তো এখন কি আমি আমাকেই মেইল করবো নাকি?”
“কি করবে আমি জানিনা, তবে আমার বউয়ের অফিসিয়াল মেইলে ইম্পেরিয়াল ক্রেস্ট থেকে মেইল আসা চাই, অর এলস আ’ম নট অ্যাক্সেপ্টিং দ্যা ইনভিটেশন।”
আনাবিয়া রাগে বিড়বিড় করতে করতে এগলো আবার বিছানায়৷ তারপর সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে নিজেকে একটা মেইল লিখে সেন্ড করে দিলো নিজের অফিসিয়াল মেইলে। তারপর মীরের উদ্দ্যেশ্যে উচ্চস্বরে শুধালো,
“অ্যাই পাঠিয়েছি, এখন হবে?”
“আমার বউ ইনভিটেশন অ্যাক্সেপ্ট করে তোমাকে মেইল দিলে অবশ্যই হবে৷”
“কেন, তোমাকে যে বলছি তাতে হচ্ছেনা?”
“না।”
আনাবিয়া রাগে গজরাতে লাগলো, নাকের পাটা ফুলিয়ে আবার গুছিয়ে গাছিয়ে ফিরতি উত্তর লিখতে বসলো মেইলে।
লেখা শেষে নিজের মেইল আবার নিজেকেই পাঠিয়ে বিছানার ওপর ধাম করে শুয়ে পড়লো ও। উচ্চস্বরে আবার মীরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“তোমার বউ অ্যাক্সেপ্ট করেছে। এখন ইভেন্টের সমস্ত খরচ তোমার৷”
আনাবিয়ার কথা শেষ হতে না হতেই ওর কামরায় এসে ঢুকলো মীর। তড়িতে বিছানায় উঠে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে থাকা আনাবিয়ার ওপর ঝড়ের ন্যায় নিজের সমস্ত ভার ছেড়ে দিয়ে আনাবিয়ার শুভ্র নরম গলায় মুখ ডুবিয়ে বলে উঠলো,
“ফ’ দ্যা ফার্স্ট টাইম, বাদশাহ নামীর আসওয়াদ দেমিয়ানের স্ত্রীরূপে কোনো ইভেন্টে রয়্যাল গেস্ট হিসেবে উপস্থিত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিন, সম্মানিত বেগম!”
ডিনারের সময় ফারিশের ডাক পড়লো মীরের কামরায়। প্রাসাদের অতিথিশালা থেকে বেরিয়ে রয়্যাল ফ্লোরে এলো ফারিশ। হামদান দাঁড়িয়ে ছিলো বাইরে, ওকে দেখেই বলে উঠলো,
“হিজ ম্যাজেস্টি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছেন জনাব জাবিন, ভেতরে যান।”
ফারিশ হামদানের উদ্দ্যেশ্যে সৌজন্য মূলক মাথা নেড়ে দরজার কড়া নেড়ে ঢুকলো ভেতরে। মীর ওর কামরার বুক শেল্ফের বই গুলো নেড়ে চেড়ে দেখছিলো, ফারিশ ভেতরে ঢুকলে ওর দিকে এক পলক তাকিয়ে বলল,
“বসো ফারিশ।”
ফারিশ যন্ত্রের ন্যায় আদেশ পালন করে বসে পড়লো মীরের টেবিলের সামনে রাখা সোফায়।
হাতে বই নিয়ে মনোযোগী দৃষ্টিতে পরখ করতে থাকা মীরকে খেয়াল করে দেখলো ফারিশ, এই প্রথমবারের মতো মীরকে সে ফরমাল পোশাকের বাইরে দেখছে।
স্লিভলেস একটা টিশার্ট আর ট্রাউজার পরে ঘুরছে সে। বাহুর ইস্পাত-দৃঢ় পেশিগুলো হাতের প্রতিটি মুভমেন্টের সাথে সাথে ফুটে উঠছে প্রকট ভাবে, ঝাকড়া চুলের কিছু অংশ কপেলের ওপর এসে পড়ে আছে।
মীরের আসল চেহারাতে মীরকে খুব কমবারই দেখেছে ফারিশ, সেটাও খুব কম সময়ের জন্য।
বাবার কাছে শুনেছে আসল চেহারায় হিজ ম্যাজেস্টিকে ভয়ঙ্কর সুদর্শন দেখায়; একদিকে ভয়ঙ্কর, অন্যদিকে সুদর্শন!
মীরের দিকে আরও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিলো ফারিশ, বুকের ভেতর ওর হঠাৎ করেই উঁকি দিলো একটা চাপা হিংসা!
এই শ্যামবর্ণের ব্যাক্তিটা হাজার অবহেলা পেয়েও নিজের স্থানে অটল থেকেছে ইস্পাতের মতো। কেউ কোনোভাবেই তাকে তার জায়গা থেকে টলাতে পারেনি, আর আজ তার চরম অধ্যবসায়, ত্যাগ, ধৈর্য সবকিছুর পুরষ্কার হিসেবে পঞ্চদ্বীপে এককভাবে রাজ করে চলেছে সে!
ফারিশ ভাবলো কিছুক্ষণ, কি কমতি আছে এই ব্যাক্তির এখন? বিশাল সাম্রাজ্যের একচ্ছত্র অধিপতি, সবচেয়ে সুন্দরী রমণীটির হৃদয়হরণকারী, অত্যন্ত ক্ষমতাধর শক্তিশালী পুরুষ; আর কিসের কমতি থাকতে পারে একজন পুরুষের জীবনে!
ভাবনা থেকে ফিরে ফারিশ চকিতে একিবার তাকালো আনাবিয়ার কামরার দরজার দিকে। ভেতর থেকে আনাবিয়ার মেঝেতে পা ফেলার মৃদু সুমধুর আওয়াজ ভেসে আসছে, এই মৃদু আওয়াজ টুকুই ফারিশের বুকে ঝড় তুলতে যথেষ্ট! চোখের সামনে কল্পনা করে নিলো আনাবিয়ার শুভ্র মুখ খানা, শুভ্র চুল, হীরকখন্ডের ন্যায় চোখ জোড়া, ওর ঝলমলে হাসি, তীরের মতো ধারালো ঘায়েল করা চাহনি! মুহুর্তেই ওকে ভর করলো আনাবিয়ার প্রতি এক দৃঢ় কামনা।
ঢোক গিললো ফারিশ, নাতিশীতোষ্ণ স্থানে থেকেও ঘামতে শুরু করলো ওর কপাল! আনাবিয়ার দরজার দিকে আরও একবার গভীর দৃষ্টি দিয়ে চোখ ফিরিয়ে নিতেই ওর দৃষ্টি গেলী মীরের দিকে৷
শকুনের ন্যায় হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সে ফারিশের দিকে! ধারালো চোয়ালদ্বয়ের ওপর দিয়ে স্পষ্ট হয়ে আছে দাঁতে দাঁত পেষার দৃশ্য!
মীরের এমন চাহনিতে হৃৎপিণ্ড যেন থমকে গেলো ফারিশের, পরমুহূর্তেই দ্বিগুণ গতিতে রক্ত পাম্প করতে শুরু করলো যন্ত্রটা৷ নিমিষেই গলা শুকিয়ে এলো ফারিশের, ভয়ে উত্তেজনায় কান গরম হতে শুরু করলো ওর, মনে হলো যেন এখনি মাথা ঘুরে পড়ে যাবে ও এখানে।
মীর ওর দিকে দৃষ্টি রেখেই ধীর, ভারী পায়ে এগিয়ে এসে হাতের বইটা শব্দ করে রাখলো টেবিলের ওপর, ফারিশ কেঁপে উঠলো সে শব্দে।
মীর টেবিলের ওপাশ থেকে ঘুরে এসে দাঁড়ালো ফারিশের সামনে। টেবিলের ওপাশে রাখা নিজের চেয়ারটা এক হাতে উঁচু করে টেবিলের ওপর দিয়ে তড়িতে ঘুরিয়ে নিয়ে এসে শব্দ করে রাখলো ফারিশের বিপরীতে, ফারিশের বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠলো সে শব্দে!
মীর ফারিশের বিপরীতে চেয়ার রেখে বসলো ওর সামনে। ওপাশ থেকে এমন দুড়ুম দাড়াম শব্দ শুনে দরজা খুলে মাথা বের করে দিয়ে আনাবিয়া শুধালো,
“কি ব্যাপার, ভুমিকম্প শুরু করে দিয়েছো নাকি তুমি?”
মুহুর্তেই নিজের শক্ত খোলস থেকে বেরিয়ে এসে মুখে হাসি ফুটিয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে মীর বলল,
“আমি ফারিশের সাথে একটু জরুরি কথা বলছি শিনু, তুমি কামরাতেই থাকো। নোমান খাবার নিয়ে এলে আমি ডেকে নেবো তোমাকে।”
আনাবিয়া চকিতে একবার দেখে নিলো ফারিশকে, মুখ খানা ফ্যাকাসে হয়ে আছে ওর, চোখ জোড়ায় ফুটে আছে স্পষ্ট ভীতি।
আনাবিয়া ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মীরের দিকে আর একবার তাকিয়ে লাগিয়ে দিলো দরজা। মীর ঘুরে বসলো আবার ফারিশের দিকে।
“ফারিশ জাবিন!”
গমগমে কন্ঠে ডেকে উঠলো মীর, ফারিশ কেঁপে উঠলো আবারও! মীর ওর দিকে ঝুকে এসে চাপা হিসহিসে কন্ঠে বলে উঠলো,
“তোমাকে না বলা হয়েছিলো আমার স্ত্রীর থেকে দুরত্ব বজায় রাখার জন্য! তবুও তুমি আজ ইম্পেরিয়ালে কেন গেছিলে? হোয়াই ফারিশ?”
ফারিশ কোনো উত্তর দিতে পারলোনা মীরের কন্ঠে ভড়কে গিয়ে কাঁপতে লাগলো সুক্ষ্মভাবে! দম ধরে পড়ে রইলো নিচের দিকে তাকিয়ে। মীর একটুখানি বিরতি দিয়ে আবার আগের মতো করেই বলে উঠলো,
“তোমার বাবা আমার ভাই ফারিশ, ওকে আমি যথেষ্ট ভালোবাসি। তুমি তার একমাত্র পুত্র সন্তান। তাই কোনোদিকে পা ফেলানোর আগে শ’বার করে ভেবে নিবে ফারিশ, নইলে তোমার বাবা মায়ের কোল খালি হয়ে যাবে কবে!
না জানাজা হবে আর না কবর, শরীরের কোন অংশের গন্তব্য কোথায় হবে সেটা তোমার বডি পার্টসগুলোও হয়তো ঠাহর করতে পাবেনা। হতে পারে সম্পুর্ন পঞ্চদ্বীপ জুড়েই তোমার শরীর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে, শকুনের একবেলার খাবার হয়ে প্রকৃতিতে টিকিয়ে রাখার মতো মহৎ কাজে শামিল হয়ে যাবে তুমি!”
বলেই আবার সোজা হয়ে বসলো মীর, ফারিশ স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো ওর জায়গায়, শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলাটা ভেজানোর জন্য ঢোক গিললো একটা, কিন্তু গলা ভিজলোনা।
ফাকা ঢোক গিলে স্থীর হয়ে বসে রইলো ও। চোখ জোড়া ওর সামনের মেঝের দিকে স্থীর, সেখানে থেকে সরানোর সাহস হচ্ছেনা!
এমন সময় বাইরের দরজায় কড়া নেড়ে উঠলো কেউ, পরমুহূর্তেই শোনা গেলো নোমানের গলা,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, খাবার তৈরি। আপনি অনুমতি দিলেই সার্ভ করবো।”
“হ্যাঁ নোমান নিয়ে এসো, আমাদের অতিথির ক্ষিদে পেয়েছে।”
ফারিশের দিকে দৃষ্টি রেখেই শক্ত গলায় বলে উঠলো মীর৷ তারপর চেয়ার ছেড়ে উঠে গেলো ফারিশের সামনে থেকে, দৃঢ় পায়ে গিয়ে ঢুকলো আনাবিয়ার কামরায়।
মীর সেখান থেকে প্রস্থান করতেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো ফারিশ, দম ছাড়লো জোরে। এতক্ষণ ভয়ে দম আঁটকে আসছিলো ওর, নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো সাহসটাও যেন হচ্ছিলো না!
কয়েকবার জোরে জোরে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্ত করে নিয়ে স্থীর হয়ে বসলো ফারিশ। সেই মুহুর্তেই নোমান খাবারের ট্রে নিয়ে ঢুকলো ভেতরে, ওর পেছন পেছন এলো আরও কয়েকজন দাসী।
খাবার গুলো মেঝেতে ম্যাট আর কুশন পেতে তার ওপর একটা নকশাদার চারপায়া পেতে রেখে দিলো।
দাসী গুলোকে আগে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে নোমান এগোলো আনাবিয়ার কামরার দরজার নিকট, বাইরে থেকে বলে উঠলো,
“খাবার চলে এসেছে ইয়োর ম্যাজেস্টি।”
ভেতর থেকে মীর ভরাট গলায় উত্তর করলো,
“ঠিক আছে নোমান, তুমি এখন যেতে পারো।”
মীরের আদেশ পেতেই নোমান চলে গেলো বাইরে।
ফারিশ নার্ভাস হয়ে যেতে লাগলো আবার, ঘাম ছুটতে লাগলো ওর।
এখন ওকে হিজ ম্যাজেস্টির সামনে বসেই খেতে হবে, শেহজাদীও থাকবে ওর সামনে! ও কিভাবে নিজের দৃষ্টি সংযত করে রাখবে সেটাই ভেবেই অস্থীর হতে শুরু করলো! না চাইতেও যে আনাবিয়ার ভয়ঙ্কর আকর্ষণীয় চেহারাটার দিকে নজর চলে যায় ওর!
আর ওর চোখ জোড়া, ওই হীরকখন্ডের ন্যায় চোখ জোড়া যেন আষ্টেপৃষ্টে বেধে ফেলতে চায় ওকে, মনে হয় এই অদৃশ্য বন্ধনী থেকে ও নিজেকে মুক্ত করতে পারবেনা কখনোই!
কিছু মুহুর্ত বাদেই শব্দ করে খুলে গেলো আনাবিয়ার কামরার দরজা, ভেতর থেকে ভেসে এলো আনাবিয়ার রিনরিনে কণ্ঠস্বর, শোনা গেলো ওর পায়ের ছোয়ায় তৈরি হওয়া মৃদুমন্দ ঝংকার!
ফারিশের বুকে কম্পন ধরলো আবারও। প্রাণপণ চেষ্টা করলো সেদিকে চোখ তুলে না তাকানোর!
আনাবিয়া মিষ্টি শব্দে হেসে বেরিয়ে এলো ওর কামরা থেকে, ওর পেছন পেছন এলো মীর, মীর বেরিয়ে এসেই ফারিশের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“বসে পড়ো ফারিশ, ডিনার দ্রুত শেষ করতে হবে। আমার বেগমকে নিয়ে আজ না বের হলে আমার গর্দান থাকবেনা বলে হুমকি দিয়েছেন তিনি।”
মীরের কথা শোনা মাত্রই মৃদু হাসার চেষ্টা করে সোফা ছেড়ে উঠে এসে এসে ম্যাটের ওপর বসলো ফারিশ।
কালো রঙা জমিনের ওপর অফ হোয়াইটের একটা নকশাকার ঢিলাঢালা রোব পরিহিত আনাবিয়া মীরের কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তীর্যক চোখে তাকালো মীরের দিকে, মীরও তাকালো তখনি, মীরের সাথে চোখাচোখি হতেই আবার চোখ ফিরিয়ে নিয়ে ফারিশের বিপরীতে বসে পড়লো ও।
কালোয় মোড়ানো শুভ্র শরীরের অধিকারীনি আনাবিয়ার দিকে একটিবার তাকানোর জন্য ফারিশের বুকের ভেতর ঝড় বয়ে যেতে লাগলো, কিন্তু ফারিশ ভুলেও তাকালোনা, ঘাড় গুজে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো প্রাণপণে।
মীর বসলো আনাবিয়ার পাশে, কিছুটে বেঁকে। আনাবিয়ার খাবারটা হাতে নিয়ে ওকে খাইয়ে দেওয়ার প্রস্তুতি নিতেই আনাবিয়া ওকে গুতা মেরে চাপা গলায় বলে উঠলো,
“আমি নিজের হাতে খেতে পারবো, আমাকে খাইয়ে দিতে হবেনা এখানে।”
মনঃক্ষুণ্ন হলো মীর, হঠাৎ করেই ওর মুখে খেলে বেড়ানো মৃদু হাসিটা উধাও হয়ে গেলো। আনাবিয়ার দিকে বিষাদে পরিপূর্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ও, হাতের খাবারটা আবার জায়গায় রেখে দিয়ে শান্ত, মৃদুস্বরে বলল,
“ঠিক আছে, খাও৷”
আনাবিয়া খেয়াল করলো মীরের এমন দৃষ্টি, বিস্মিত হলো ও। এখনো পর্যন্ত মীরকে ওর দিকে কখনো এমন দৃষ্টি দিতে দেখেনি ও! তবেকি আজ ও মীরকে কষ্ট দিয়ে ফেললো? ওর মন খারাপ করে দিলো?
মুখখানা চুপসে গেলো আনাবিয়ার, অসহায় চোখে ও একবার তাকালো মীরের দিকে, মীর আর তাকাচ্ছেনা ওর দিকে।
ফারিশ এদের দুজনের এই হঠাৎ নিরবতার কারণ বুঝতে পারলোনা, আনত দৃষ্টিতে ও খাওয়ায় মনোযোগ দিলো।
মীর ওর খাবারের পাত্রটা হাত নিয়ে খাবারে হাত দিয়েও আর খেলোনা, নাড়াচাড়া করেই রেখে দিলো। মুখে ওর ভেসে উঠলো স্পষ্ট অবসন্নতা!
আনাবিয়া মীরের খাওয়া শুরু করার জন্য বসে রইলো কিছুক্ষণ, কিন্তু মীর খাচ্ছেনা দেখে ফারিশকে অস্বস্তি থেকে বাঁচাতে কোনো উপায় না পেয়ে মীরের দিকে আর একবার তাকিয়ে খেতে শুরু করলো আস্তেধীরে।
ফারিশের সামনে ওদের সম্পর্কের কোনো নেগেটিভ দিক যেন কোনোভাবেই না ফুটে ওঠে সেটার দিকে দৃঢ় মনোযোগ দিলো ও!
মীর খাবারের প্লেটটা এবার এক হাতে দুরে ঠেলে দিলো নিজের থেকে, পাশ থেকে ইয়োগার্টের বক্স উঠিয়ে সেখান থেকে এক চামচ ইয়োগার্ট উঠিয়ে মুখে পুরে বিষাদগ্রস্ত দৃষ্টিতে তাকালো আনাবিয়ার দিকে।
আনাবিয়া সবজি মুখে দিলো তখনি, কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত সব্জীর সাথে বেখেয়ালে উঠিয়ে নিলো সবজীর ভেতরে থাকা একটা আস্ত মরিচ।
কয়েকবার চিবোতেই ঝালে চোখ জোড়া বিস্ফোরিত হয়ে এলো ওর, মুহুর্তেই চোখ জোড়া ভর্তি হয়ে এলো পানিতে। পরমুহূর্তেই চাপা আর্তনাদ করে উঠে মুখের খাবারটা জিভ বের করে ফেলে দিলো নিচে, দিয়েই চোখ মুখ কুচকে মীরের নাম ধরে চিৎকার করে উঠে বলল,
“মীরিইই……. ঝায়ায়ায়ায়াল!”
মীর তখন সবেমাত্র আর এক চামচ ইয়োগার্ট মুখে দিয়েছে। আনাবিয়ার চিৎকার শুনে চমকে তাকালো ও ওর দিকে, তাকাতেই চোখে পড়লো আনাবিয়ার লাল হয়ে যাওয়া ঠোঁট জোড়া, ঝালের চোটে লালা চলে এসেছে ঠোঁটের দুকোণায়, চোখ জোড়া পানি ভর্তি, নাকের ডগা লাল।
ওকে এমন নাস্তানাবুদ অবস্থায় দেখা মাত্রই ঝড়ের গতিতে আনাবিয়াকে এক হাতে নিজের কাছে টেনে নিয়ে মীর ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো ওর ঠোঁটে, সবেমাত্র মুখে নেওয়া ইয়োগার্টের পুরোটা দিয়ে দিলো আনাবিয়ার গালের ভেতর!
মীরের এমন কাজে হতভম্ব হয়ে গেলো আনাবিয়া, বিস্ময় রুদ্ধ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলো ও!
চকিতে আড়চোখে একবার দেখে নিলো ও ফারিশকে, ফারিশের মাথা নিচের দিকে, যেন সে কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা, তার অস্তিত্বই নেই এখানে!
ফারিশটা কি ভাববে, ছিঃছিঃ! ঝালটা আর লাগার সময় পেলোনা, আর মীরির বাচ্চার ইয়োগার্টের বক্স থেকে এক চামচ না দিয়ে মুখেরটাই দিতে হলো!
ভ্রুকুটি করে মীরের পেটে শক্ত করে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো আনাবিয়া, ঘুষি খেয়ে মীর ছেড়ে দিলো ওকে। আবার এমন ভাবে ইয়োগার্টের বক্সটা হাতে নিলো যেন কিছুই হয়নি, একটু আগে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনাই ঘটেনি! নির্বিকার ভঙ্গিতে ও আবার আর এক চামচ ইয়োগার্ট তুলে মুখে দিলো।
ফারিশ পড়লো বিপদে, অস্বস্তিতে ওর মাথা খারাপ হওয়ার মতো অবস্থা। হিজ ম্যাজেস্টি যে ওর সামনেই কেন এমন করলেন সেটা ও খুব ভালোভাবেই বুঝতে পারছে। তিনি বোঝাতে চাইছেন অধিকারটা তাঁরই, শুধুমাত্র তার। সেখানে অন্যকারো প্রবেশ সম্পুর্ন নিষিদ্ধ!
আনাবিয়ার লজ্জা লাগলো প্রচন্ড, একটা ঢোক গিলে পানির গ্লাসটা উঠিয়ে নিয়ে ছোট্ট এক চুমুক পানি খেয়ে ও উঠে যেতে নিলো নিজের কামরায়, কিন্তু মীর এক হাতে আর এক চামচ ইয়োগার্ট উঠিয়ে মুখে পরে অন্য হাতে আনাবিয়ার কোমর ধরে ওকে আবার বসিয়ে দিয়ে ওর দিকে না তাকিয়েই শান্ত, গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো,
“খাওয়া শেষ না করে উঠবেনা৷”
আনাবিয়া বসে যাওয়ার পরও কোমর ছাড়লোনা মীর, নিজের শক্তপোক্ত হাতের থাবাটা আলতো করে বুলিয়ে দিতে লাগলো আনাবিয়ার কোমরের ওপর৷
অগত্যা আনাবিয়া ইতস্তত চোখে একবার ফারিশের দিকে তাকিয়ে খাওয়া শুরু করলো।
মীর হাতের চামচটা পাশে রেখে দিয়ে মুখখানা এগিয়ে নিয়ে গেলো আনাবিয়ার মুখের কাছে, নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“ঝাল কমেছে? নাকি আরও একটা চুমু খাবে?”
আনাবিয়ার মুখ শুকিয়ে গেলো, মীরের কন্ঠ নরম কিন্তু চোখ জোড়া ভয়ঙ্কর! এ কি হিংসার চোটে পাগল হয়ে গেলো নাকি?
চকিতে একবার ফারিশের দিকে তাকালো আনাবিয়া, ফারিশের মাথাটা আরও নিচে চলে গেছে, খাবার হাতে উঠছেনা, অজানা আতঙ্কে হাঁতটা সুক্ষভাবে কেঁপে চলেছে ওর!
কিন্তু আনাবিয়ার ফারিশের দিকে তাকানো মুখখানা টেনে আবার নিজের দিকে নিয়ে এলো মীর, দাঁতে দাঁত চেপে বলে উঠলো,
“তোমার সাথে আমি কথা বলছি শিনু! আমার দিকে তাকাও! চুমু খাবে আর একটা?”
আনাবিয়া ওর দিকে স্তব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো, ঢোক গিললো শুকনো একটা। ডিনারের আগ মুহুর্তে মীর আর ফারিশের ভেতর কিছু একটা হয়েছে, যেটা আনাবিয়া জানে না। আর এখন সেটার রেশ ধরেই মীরের এই রাগ! আর সে রাগের আগুনে ঘী ঢেলে দিয়েছে আনাবিয়ার মীরের হাতে খেতে না চাওয়া!
আনাবিয়া কি করবে বুঝতে পারলোনা, আজ ফারিশের সাথে ওর আসতেই হতোনা! ওর জন্য ফারিশটা বিপদে পড়ে গেলো শুধু শুধু।
আনাবিয়ার নিরবতা দেখে রাগের মাত্রাটা আরও বেড়ে গেলো মীরের, বজ্র কন্ঠে ও ডেকে উঠলো,
“হামদান!”
মীরের ডাকে কেঁপে উঠলো আনাবিয়া, ফারিশ দুজনেই! ফারিশের বুকের ভেতর ধক ধক করতে শুরু করলো! হামদানকে হিজ ম্যাজেস্টি কেন ডাকছেন? তবে কি হিজ ম্যাজেস্টি ওকে শাস্তি দিবেন?
প্রচন্ড চিন্তায় ঘামতে শুরু করলো ফারিশ। হামদান সেই মুহুর্তে দরজা ঠেলে ঢুকলো কামরায়, আনুগত্য জানিয়ে বলল,
“আদেশ করুন ইয়োর ম্যাজেস্টি!”
“ফারিশকে গেস্টরুমে পৌছে দিয়ে এসো।”
আনাবিয়ার দিকে তাকিয়েই বলে উঠলো মীর। মীরের আদেশে হামদান ফারিশের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“চলুন মিস্টার জাবিন।”
হামদান বলতেই ফারিশ উঠে দাঁড়ালো তৎক্ষনাৎ, তারপর কোনো রকমে মীরকে আনুগত্য জানিয়ে টালমাটাল পায়ে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে।
ফারিশ বেরিয়ে গেলে হামদান কামরার দরজা টেনে দিতেই মীর এক ঝটকায় আনাবিয়াকে টেনে নিলো নিজের কোলের ওপর, দাঁতে দাঁত পিষে হিংস্র কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমার হাতে খেলেনা কেন? কারণ বলো!”
আনাবিয়া প্রমাদ গুণলো, আতঙ্কিত হয়ে গেলো ও! বুকের ভেতর হাতুড়ি পড়তে লাগলো ভীষণ জোরে, ভীতসন্ত্রস্ত কন্ঠে ও আমতা-আমতা করে বলল,
“ফ-ফারিশ ছ-ছিলো সামনে ত-তাই!”
“ফারিশ ছিলো তো কি হয়েছে? তুমি কি কখনো কারো সামনে আমার হাতে খাওনি? খেয়েছো কিনা!”
চিবিয়ে চিবিয়ে বলল মীর, আনাবিয়া তড়িতে মাথা নাড়ালো ওপর নিচে, মীর ক্ষীপ্র গতিতে ওর চোয়াল জোড়া নিজের দু আঙুলের ভেতর চেপে নিয়ে বলল,
“তবে এখন কি হলো? এখন কেন খেলে না? উত্তর দাও!”
“আ-আমি ফারিশকে অস্বস্তিতে ফেলতে চ-চাইনি তাই!”
আনাবিয়াকে এবার নিজের সাথে আরও জোরে চেপে নিলো মির, ক্ষীপ্র গতিতে আনাবিয়ার চোয়ালে নিজের ঠোঁট জোড়া চেপে ধরলো ও, চোয়ালে ঠোঁট রেখেই ও হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
“শিনু, তুমি শুধু আমার! তোমার সমস্ত মনোযোগ, আগ্রহ, কৌতুহল, আবেগ, ভালোবাসা, রাগ, অভিমান সমস্ত কিছু আমার, শুধুমাত্র আমার।
তোমার শরীর, মন, মস্তিষ্ক সমস্ত কিছু আমার, শুধুই আমার! আমি সবকিছু সহ্য করলেও তোমার ইগনোরেন্স কোনোদিনও সহ্য করবোনা, আমাকে ভুলেও ইগনোর করবেনা, কোনো অবস্থাতেই না!
তোমার অবহেলা আমাকে আমার হিংস্র সত্তায় নিয়ে যেতে বাধ্য করে, তাই আমাকে ইগনোর করার আগে দশবার ভেবে নিবে, ঠিক আছে!”
আনাবিয়া মাথা নাড়লো তড়িতে, জিভ দিয়ে ভিজিয়ে নিলো শুকিয়ে যাওয়া ঠোঁট।
সেটা চোখে পড়া মাত্রই আনাবিয়ার চোয়াল থেকে ঠোঁট সরিয়ে আনাবিয়ার ঠোঁট জোড়া প্রবল চুম্বনে দখল করে নিলো মীর!
রাতের প্রায় একটা। বা হাতটা মাথার নিচে রেখে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে মীর। ওর বুকের ওপর উন্মুক্ত শরীরে ঘুমিয়ে আছে আনাবিয়া; ঠোঁট, গলা, বুক জুড়ে অজস্র চুম্বনের মেরুণ রঙা ছোপ ছোপ দাগ লেপ্টে আছে। শুভ্র চুলগুলো ছড়িয়ে আছে পিঠময়!
মীরের ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত, রাগ এখনো পড়েনি ওর। ফারিশের ওপরের রাগটা আনাবিয়ার আদরের সাথে মিশিয়ে দিয়েছে ও। মন চাইছে ফারিশটার চামড়া ছুলে ফেলে, কিন্তু সেটা আর হচ্ছেনা।
মীর ফারিশকে অনেক আগেই স্পষ্ট করে বলে দিয়েছে যেন মীর না বলা পর্যন্ত আনাবিয়ার সাথে কোনো রকম কমিউনিকেশন সে না করে, কিন্তু ফারিশ সে কথা শোনেনি। মীরের আদেশের বাইরেও বেশ কয়েকবার সে অকারণে বিভিন্ন অজুহাতে আনাবিয়ার সাথে দেখা করে গেছে। যেসবের আনাবিয়া কিছুই জানতো না!
আর আজ ফারিশের এতটা সাহস হয়েছে যে সে আনাবিয়াকে গাড়িতে করে শিরো মিদোরিতে পৌছে দিতে চলে এসেছে!
মীর ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো, পরক্ষণেই ওর বুকে ঘুমন্ত আনাবিয়ার চোয়ালে বৃদ্ধাঙ্গুলি বুলোতে বুলোতে নরম গলায় ডেকে উঠলো,
“শিনু, শিনজো! উঠো, বেরোতে হবে।”
আনাবিয়া ঘুম জড়ানো চোখে মুখ তুলে তাকালো ওর দিকে, দ্বিধান্বিত, জড়ানো গলায় শুধালো,
“কোথায়?”
“গেলেই দেখতে পাবে উঠো।”
বলে আনাবিয়াকে নিজের বুক থেকে নামিয়ে পাশে শুইয়ে দিয়ে উঠে পড়লো ও, বিছানা ছেড়ে উঠে নিজের কামরায় গিয়ে একটা পাতলা শার্ট এনে ও ঝটপট পরিয়ে দিলো আনাবিয়ার গায়ে, বোতাম গুলো আটকে দিলো দ্রুত হাতে। তারপর আনাবিয়াকে বুকের ওপর তুলে কোলে নিয়ে হেটে গেলো কামরার ব্যালকনিতে, আর তার পরমুহূর্তেই লাফিয়ে পড়লো সুউচ্চ প্রাসাদের একেবারেই তলে, রেড জোনের ভেতর।
আনাবিয়া মীরের গলা জড়িয়ে ধরে মীরের বুকে মাথা রেখে পড়ে রইলো সেখানে। মীর ঝড়ের গতিতে এগোলো ওর গন্তব্যের দিকে, ওর বুকের ধুকপুকানি কানে এসে বাড়ি খেতে লাগলো আনাবিয়ার।
বেশ কিছুক্ষণ পর ছোটা থামালো মীর, আনাবিয়া এতক্ষণে খেয়াল করলো চারপাশটা। ওদের বিয়ের দিনের সেই খোলা মাঠটা!
মীর এসে দাঁড়িয়েই হাঁক ছাড়লো,
“অ্যাবিসোরা!”
মুহুর্তেই একটা ঝড়ো বাতাস বয়ে গেলো ওদের চারপাশ দিয়ে। মীর অ্যাবিসোরার উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“আমার বিছানা চাই এখানে, এখনি।”
মীরের আদেশের সাথে সাথেই কাজে লেগে পড়লো অ্যাবিসোরা আর ওর ছেলেরা।
মুহুর্তের ভেতরেই ছোটাছুটি করে এদিক থেকে সেদিকে গিয়ে জিনিপত্র জোগাড় করে তৈরি করে ফেললো একটা বিছানা, আর তারপর বিছানার চারপাশ দিয়ে ঝুলিয়ে দিলো কয়েক পরতের পাতলা পাতলা পর্দা।
বিছানা তৈরি হলেই সেদিকে এগোলো মীর। অ্যাবিসোরার উদ্দেশ্যে আবার বলে উঠলো,
“আমার এই সম্পুর্ন এরিয়া ফাকা চাই অ্যাবিসোরা।”
অস্পষ্ট ছায়া মুর্তিটি মুহুর্তেই একটা সুক্ষ্ম শব্দ তুলে তার সমস্ত দলবল নিয়ে প্রস্থান করলো সেখান থেকে, সাথে করে নিয়ে গেলো ওই এলাকার সমস্ত ডিস্টার্বেন্স সৃষ্টিকারী প্রাণিকুলকে।
মীর বিছানার কাছে গিয়ে আনাবিয়াকে বসিয়ে দিলো সাদারঙা জমিনের ওপর টকটকে রক্তলাল গোলাপের পাপড়ি ছড়ানো বিছানায়।
আনাবিয়ার ঘুম উড়ে গেছে ততক্ষণে, বিছানার সাজসজ্জা দেখে ও শুকনো একটা ঢোক গিলে ভ্রু তুলে শুধালো,
“তুমি কি আমাকে এখানে বাসর করার জন্য নিয়ে এসেছো?”
“হ্যাঁ।”
কাঠকাঠ উত্তর দিলো মীর৷ আনাবিয়া ভীতিপূর্ণ চোখে তাকিয়ে ধীর গতিতে গুটিয়ে নিলো নিজের পা জোড়া, মীর সেদিকে দেখে বলল
“পা গুটিয়ে কোনো লাভ নেই।”
“তুমি আমাকে এখানে কেন নিয়ে এসেছো মীরি? প্রাসাদে কি হতো?”
মীর আনাবিয়ার সামনে মাটিতে হাটু গেড়ে বসতে বসতে বলল,
“কোনো ডিস্টার্বেন্স চাইনা তাই।”
মীর এগিয়ে এলো আনাবিয়ার একদম কাছে, আনাবিয়ার গুটিয়ে রাখা পা জোড়া নিজের শক্তহাতে সোজা করে মুখ ডোবালো ওর উরুতে।
আনাবিয়া ছিটকে সরে যেতে চাইলেও ওকে দুহাতে আটকে নিলো মীর, ওর মাংসল উরুতে নিজের ধারালো দাঁতের কিঞ্চিৎ ছোয়া বসিয়ে ও এবার মুখ নিয়ে গেলো আনাবিয়ার তলপেটে।
সেখানে নাক ডুবিয়ে শ্বাস টেনে নিলো ও। আনাবিয়া সিঁটিয়ে গেলো। মীর ওর তলপেটে থুতনি ঠেকিয়ে মুখখানা উচু করে আনাবিয়ার দিকে স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালো,
“ভয় লাগছে?”
আনাবিয়া অসহায় চোখে তড়িতে উপর নিচে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বোঝালো। মীর ওর ভীতসন্ত্রস্ত চেহারার দিকে এক পলক তাকিয়ে হাসলো মৃদু, তারপর আনাবিয়ার তলপেটে আর একটা গাঢ় চুম্বন দিয়ে উঠে দাঁড়ালো, ওর থুতনি ধরে নরম গলায় বলে উঠলো,
“ভয় পেতে হবেনা, করছি না বাসর। ঘুমিয়ে যাও।”
বলেই সেখান থেকে চলে যেতে নিলো ও, আনাবিয়া আঁতকে উঠে শুধালো,
“কোথায় যাচ্ছো তুমি?”
“সামনেই।”
অন্ধকারের দিকে এগোতে এগোত শান্ত কন্ঠে উত্তর দিলো মীর৷
“কতক্ষণে ফিরবে?”
ভ্রু তুলে অসহায় কন্ঠে শুধালো আনাবিয়া। মীর ওর দিকে না তাকিয়েই এগোতে এগোতে উত্তর দিলো,
“সকালেই ফিরে আসবো, তুমি ঘুমাও। চিন্তা কোরোনা, তোমাকে পাহারা দেওয়ার জন্য এখানে হাজার প্রহরী ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে, ভয় নেই।”
“তুমি আমার ওপর রাগ করেছো মীরি?”
ভ্রু তুলে অসহায় গলায় শুধালো আনাবিয়া। মীরের চলা থেমে গেলো মুহুর্তেই, আনাবিয়ার দিকে কিঞ্চিৎ ঘুরে ঘাড় ঘুরিয়ে ও গাঢ় কন্ঠে বলল,
“না শিনু, আমি রাগ করিনি তোমার ওপর। তোমাকে একটু রিল্যাক্সে রাখতে চাইছি। আমার মনে হচ্ছে আমার কাছে তুমি কম্ফোর্টেবল নও, তোমার স্পেস প্রয়োজন। তুমি আমাকে ছাড়াই হয়তো বেশি ভালো থাকো।”
মীরের কথা শুনে বিছানা থেকে তখনি নেমে এলো আনাবিয়া। দ্রুতপায়ে মীরের কাছে গিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে নিলো ওর পেশিবহুল পিঠখানা।
চোখ জোড়া বন্ধ করে মীরের পিঠে ওর চোয়াল ঠেকিয়ে ও বলে উঠলো,
“কেন এরকম করছো? আমি তো তোমার সাথেই সবচেয়ে বেশি কম্ফোর্ট ফ্যিল করি মীরি! এরকম কোরোনা দেখো! তোমার অনেক অভিমান হয়েছে আমার ওপর বুঝতে পারছি আমি, কি করলে কমবে বলো আমি তাই করবো তোমার জন্য, তবুও তুমি কোথাও যেয়োনা, আমার কাছেই থাকো প্লিজ!”
মীর ওর পেটের উপরিভাগে রাখা আনাবিয়ার হাত জোড়ার ওপর নিজের হাত রেখে বলল,
“তোমাকে কিছুই করতে হবেনা শিনু! তুমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে যাও। আমার একটু একা থাকা প্রয়োজন, নিজের ক্রোধ দমনের প্রয়োজন।”
আনাবিয়া ছাড়লোনা ওকে, আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে। ভয়ানক কান্না পেলো ওর, ফুপিয়ে উঠে বলল,
“তোমার যত রাগ আছে তুমি আমার ওপর মেটাও মীরি, তবুও আমার সাথেই থাকো! আমার কাছে থাকো। তোমার যা ইচ্ছা হয় করো তবুও তুমি আমার সাথেই থাকো, প্লিজ মীরি!”
ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে ছেয়ে গেলো খোলা মাঠটা। মীর আনাবিয়ার হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ঘুরে দাঁড়ালো ওর দিকে, আনাবিয়ার চোখের কোণে জমা পানিটুকু নিজের বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মুছে দিয়ে বলল,
“কান্না কোরোনা শিনু, বিছানা ভিজে যাবে তো! ঘুমোতে পারবেনা তখন।”
“আমি তোমার বুকে ঘুমাবো মীরি, তুমি এখানেই থাকো! আমার কাছেই থাকো মীরি! তোমার রাগ হলে তুমি আমার ওপর মেটাও তবুও আমার থেকে দূরে যেয়োনা প্লিজ!”
মীর আনাবিয়ার চোয়ালজোড়া নিজের দুহাতের ভেতরে নিয়ে এগিয়ে এলো আনাবিয়ার একদম কাছে, আনাবিয়ার কপালে কপাল ঠেকিয়ে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিয়ে তৃষ্ণার্ত কন্ঠে ও বলে উঠলো,
“তাহলে আদর করতে দাও আমাকে! তোমাকে পেলে আমি সব ভুলে যাবো শিনু, সব! দিবে না?”
শেষোক্ত প্রশ্নটা ব্যাকুল কন্ঠে শুধালো মীর। আনাবিয়ার শরীরে আসন্ন আতঙ্কের শিহরণ বয়ে গেলো তড়িৎ গতিতে। মাথা নেড়ে ও তৎক্ষনাৎ উত্তর দিলো,
“দিবো!”
মুহুর্তেই মীর কোলে তুলে নিলো ওকে, ভারী পায়ে এগোলো বিছানার দিকে। আনাবিয়া আদুরে বিড়াল ছানাটির ন্যায় লেপ্টে রইলো ওর বুকের ভেতর!
এই মুহুর্তে নিজের কানে নিজেরই হৃদপিণ্ডের অস্থির ধুকপুকানি শুনতে শুরু করলো ও!
বিছানায় নিয়ে গিয়ে ওকে শুইয়ে দিলো মীর, তারপর নিজেও বিছানায় উঠে ওর বিশাল শরীরের সমস্ত ভার টুকু ছেড়ে দিলো আনাবিয়ার ওপর!
আনাবিয়ার মুখের ওপর এসে পড়া ওর চিকচিকে সাদা চুলের এক গোছা আলতো হাতে সরিয়ে দিলো মীর।
সেই মুহুর্তেই দৃষ্টির মিলন ঘটলো ওদের!
আনাবিয়ার মাদকতাময় ঝকঝকে উজ্জ্বল দৃষ্টির ভেতর হারিয়ে যেতে লাগলো মীর! দুজন দুজনের দিকে তাকিয়েই কাটিয়ে দিলো অনেক অনেক ক্ষণ, হাজার শব্দে ভরা নীরব মুহুর্ত টা পার হলো আনাবিয়ার ললাটে মীরের তপ্ত চুম্বনে।
আনাবিয়ার হাতজোড়া ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগলো মীরের শক্তপোক্ত বাহুতে। মীর নিজের বাহুর ওপর থেকে আনাবিয়ার হাতখানা নিয়ে নিলো নিজের হাতের ভেতর, ওর নরম আঙুলগুলো ধরা পড়ল মীরের শক্ত, কর্কশ মুঠোয়!
আনাবিয়ার হাতখানা তুলে নিজের বুকের বা পাশে রাখল মীর, ওর উন্মত্তভাবে ধুকপুক করতে থাকা বুকের ওপর আনাবিয়ার হাতটা চেপে ধরে গভীর, ফিসফিসে কন্ঠে ডেকে উঠলো,
“শিনজো,”
“হু!”
আবেশে চোখ বুজে নিয়ে উত্তর দিলো আনাবিয়া। মীরের নিঃশ্বাস এসে ক্ষণে ক্ষণে মিশে যেতে লাগলো আনাবিয়ার নিঃশ্বাসের সাথে! মীর একটা ঢোক গিলে নেশালো কন্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি জানো না, এই হৃদয় শুধু তোমার জন্যই আজও রঙিন! এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে আমি দুঃখ, বেদনা, আর একাকিত্ব নিয়ে জন্মেছিলাম, কিন্তু তোমার এই চাহনিই আমার অস্তিত্বের সব শূন্যতা পূর্ণ করে দিয়েছে শিনু। আমার কোনো দুঃখ অবশিষ্ট নেই আর!
আমার সমস্ত কিছু তুমি; আমার জীবন, আমার আলো, আমার অনন্ত। আমার বুকের হৃদপিণ্ডের প্রতিটি ওঠানামা শুধুমাত্র তোমার নামেই।
তুমি ছাড়া আমি কিছুই নই শিনু, আমি কেবল এক কণা মাটি, আর তুমি আমার বিস্তৃত আকাশ।
আমার জীবনের সবটুকু ভালোবাসা, স্নেহ, অঙ্গীকার, সব কিছু শুধুমাত্র তোমারই।”
মীর আনাবিয়ার হাতটা নিজের বুকের ওপর থেকে তুলে নিজের ঠোঁটের কাছে এনে আলতো করে ঠোঁট ছোয়ালো!
মুহূর্তেই যেন থেমে গেল সময়, থেমে গেলো সমস্ত পৃথিবী!
এক হলো দুটি দেহ, দুটি আত্মা! দুই আত্মার এই প্রথম মীলন যেন মহাবিশ্বের সব শক্তিকে একত্রিত করলো এক বিন্দুতে! বাতাসে উঠলো গুঞ্জন, চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো ভালোবাসার সুমিষ্ট সুঘ্রাণ!
ক্রমে ক্রমে রাত বাড়লো, চাঁদের আলো গাঢ় হলো আরও!
বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ১৯+২০
আর সেই রাতে প্রকৃতি সাক্ষী হলো এই দুই অতৃপ্ত, অভিমানে ভরপুর কপোত-কপোতীর প্রেমের! সময়ের সাথে সাথে ঝুম বৃষ্টির ন্যায় অভিমান ঝড়ে পড়লো তাদের!
রেডজোন থেকে থেকে ভিজলো ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টিতে, খোলা মাঠটায় মুহুর্তে মুহুর্তে প্রতিধ্বনিত হতে থাকলো আনাবিয়ার মিষ্টি যন্ত্রণাযুক্ত আনন্দাশ্রু মিশ্রিত সুখধ্বনি!
