বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৫+২৬

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৫+২৬
রানী আমিনা

রেড জোনের বিশাল জঙ্গলের ভেতরের বিরাট খোলা মাঠের একপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে আনাবিয়া। হাতে ওর ক্রিকেট বল, সেটাকে ডান থেকে বা হাতে ছুড়ে বারবার স্থানান্তর করে চলেছে ও।
ওর বিপরীতে নির্দিষ্ট দুরত্বে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দীর্ঘদেহী মীর৷ মীরের বিপরীতে ওর ব্যাট পার্টনার জায়ান।
মাঠের মাঝে এসে পড়ছে পড়ন্ত বিকেলের নরম আলো, চারপাশের জঙ্গল থেকে মৃদুমন্দ হাওয়া এসে ছুয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওদের।

মীর আর জায়ান বর্তমানে ব্যাটে আছে, আনাবিয়া ছুড়ছে বল। মীর আর জায়ানকে চারপাশ থেকে নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়িয়ে ঘিরে রেখেছে ফারিশ, নওয়াস এবং কোকো।
বিশ বছরের তাগড়া যুবক কোকো নিজের হিউম্যান ফর্মে মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আনাবিয়ার দিকে, আনাবিয়া বলটা ছুড়লেই সতর্ক হয়ে যাবে ও।
কোকোর অন্যপাশে কিছুটা দুরত্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে শেহজান নামক এক বছর ত্রিশের পুরুষ, মীরের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সে প্রাসাদে যোগ দিয়েছে আজ প্রায় ন বছর। মাঠের পাশেই দাঁড়িয়ে, তার বিশ্লেষণমূলক চোখ দিয়ে সে দেখে চলেছে মীরের ব্যাট ধরার স্টাইল।
হিজ ম্যাজেস্টিকে ওরা এতগুল মিলেও কোনোভাবে টলাতে পারছেনা, এমন তুখোড় খেলাধুলা উনি কোথা থেকে শিখেছেন সেসব প্রশ্নই ঘুরে চলেছে ওর মাথায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মীরের থেকে কিছুটা দূরে স্ট্যাম্পের ঠিক পেছনে গ্লাভস হাতে বল ধরার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে আরমান নামক সম্প্রতি ত্রিশ পেরোনো এক শক্তিশালি পুরুষ।
হামদানের পরিবর্তে বর্তমানে মীরের প্রধান দেহরক্ষীর স্থানে বছর চার হলো অভিষেক হয়েছে তার।
সে অপেক্ষায় আছে আনাবিয়ার বল ছোড়ার, হিজ ম্যাজেস্টিকে এখনো কোনোভাবে আউট করা সম্ভব হয়নি বলে এরা কজন খুব বিপদে আছে।
আনাবিয়ার চোখে অগ্নি দৃষ্টি, ব্যাডাকে ব্যাটিং থেকে সরানোই যাচ্ছেনা। এতক্ষণ ধরে চেষ্টা করেও কেউ ওকে আউট করতে পারলোনা! হাতে বল নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে মীরের দিকে শকুনি দৃষ্টিতে তাকিয়ে ও প্রস্তুতি নিলো বল ছোড়ার।
মীরের মুখে ক্রুর হাসি, বউয়ের চোখে এমন শকুনি দৃষ্টি দেখে ওর মজাই লাগছে! একটু নড়েচড়ে ঠিক ঠাক হয়ে দাঁড়িয়ে মৃদু হাসি দিয়ে ও প্রস্তুত হলো আনাবিয়ার আক্রমণের।
ওর চোখে মুখে উপচে পড়া আত্মবিশ্বাস দেখে মেজাজ গরম হলো আনাবিয়ার, বিড়বিড়িয়ে ও বলে ওঠে,

“আত্মবিশ্বাসের সো*দনে অন্ধকার!”
তার পরমুহূর্তেই নিজের জায়গা থেকে ছুটে এসে মীরের পেছনের স্ট্যাম্প তাক করে ঝড়ের গতিতে বল ছুড়লো ও, হুড়মুড় করে বলটা গিয়ে রওনা হলো ব্যাটের দিকে।
বল আসা মাত্রই মীর সেটাকে প্রখর দক্ষতার সাথে হিট করলো ব্যাটে, মুহুর্তেই বল উড়ে গেলো আকাশে।
চোখ জোড়া চকচক করে উঠলো ওর, চকিতে তাকালো জায়ানের দিকে। জায়ান মীরের ছক্কা কষার আনন্দে চিৎকার করে নেচে উঠলো!

মাঠ উপস্থিত সকলের ভেতর ছড়িয়ে গেলো হতাশা, কোকো হাল ছেড়ে দিয়ে শেহজানের দিকে হতাশ চোখে তাকালো। শেহজান ওর এমন দৃষ্টিতে সায় জানিয়ে মাথা নেড়ে বোঝালো, ‘সম্ভব নহে!’
আনাবিয়া মীরের দিকে একবার তাকিয়ে ওর হাসি মুখ দেখে মুখ বেকিয়ে পেছন ঘুরিয়ে আবার নিজের স্থানে যেতে যেতে মনের দুঃখে বিড়বিড়িয়ে গেয়ে উঠলো,
“ছক্কা মাইরা দিলোরে আরহামের পোলায়!”

মীর সেটা শুনতে পেয়ে হেসে উঠলো শব্দ করে। আনাবিয়া নিজের জায়গায় গিয়ে দাঁড়ালে কোকো বল কুড়িয়ে এনে ছুড়ে মারলো ওর দিকে, আনাবিয়া দক্ষ হাতে সেটা ধরে ফেলে আবার প্রস্তুতি নিলো বল ছোড়ার।
মীর আবার ব্যাট হাতে দাঁড়ালো ওর পুরোনো স্টাইলে, মনোযোগ দিলো আনাবিয়ার দিকে, বউটা তার ওকে আউট করার প্রচেষ্টায় ঘেমে নেয়ে একাকার। এবার বউটাকে ছুটি দেওয়া উচিত ওর, নইলে রাতের ব্যাপারটা মিস হয়ে গেলে বিপদ!
আনাবিয়া আবার ছুটে এসে বল ছোড়ে, আর এবার সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলটা ঝড়ের গতিতে উড়ে এসে মীরের ব্যাটের মাথার ওপর দিয়ে এসে লাগে সোজা স্ট্যাম্পে। আর স্ট্যাম্পটাকে গুড়িয়ে দিয়ে সেটা গিয়ে লাগে স্ট্যাম্পিংয়ে থাকা আরমানের পেটে।

ব্যাথাতুর চিৎকার দিয়ে পেটে হাত দিয়ে বসে পড়ে সাথে সাথে, কিন্তু পরক্ষণেই মীরকে হারানোর আনন্দে লাফিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরে শেহজানকে, তারপর শুরু করে চিৎকার!
কোকো ওদিক থেকে ‘আম্মায়ায়া’ বলে চিৎকার দিয়ে ছুটে আসে আনাবিয়ার দিকে। আনাবিয়া এখনো ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারেনি, ওর বল তো কোনোভাবেই স্ট্যাম্পে গিয়ে লাগার কথানা, মীর চাইলেই ওটাকে ছক্কা মারতে পারতো, কিন্তু সে কোনো চেষ্টাই করেনি!
রাগে গা জ্বলে গেলো আনাবিয়ার, হতচ্ছাড়া কালাভুনাটা ওকে জিতিয়ে দিলো! এটা ও কিভাবে মেনে নেবে!
কোকো ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো ওকে, আনাবিয়া কোকোকে কিছু বুঝতে না দিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মীরের দিকে।

মীর মৃদু হেসে ব্যাট হাতে নিয়ে চলে যাচ্ছিলো মাঠ ছেড়ে। আনাবিয়ার দিকে চোখ যেতেই আনাবিয়ার এমন দৃষ্টি দেখে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত করলো ও, বুঝিয়ে দিলো আজকের দিনের মতো তোমার ছুটি।
আনাবিয়া ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে কোকোকে বলল,
“চল কোকো, আজকে আর খেলাধুলার মুড নাই৷ খেলবো না আমি আর এই balএর ক্রিকেট।”
কোকোর হাসি পেলো। ওর আম্মা রেগে আছে প্রচন্ড, হিজ ম্যাজেস্টিকে হারানোই গেলোনা! কোকো নরম, দৃঢ় সুরে বলল,

“মাথা ঠান্ডা করুন আম্মা! আমরা এর প্রতিশোধ নিবো, চলুন আমরা হিজ ম্যাজেস্টিকে না জানিয়ে নিরুদ্দেশ হয়ে যাই। এই হারের বদলা নিয়েই ছাড়বো!”
আনাবিয়া ওর দিকে তাকিয়ে ওর মাথায় একটা চাটি মারলো, তারপর ওর মাথার ঝাকড়া চুলগুলো নিজের হাতের মুষ্টির ভেতর নিয়ে একটা ঝাকি দিয়ে বলে উঠলো,
“বদলা পরে নিবো, এখন প্রাসাদে চল। পুচকে গুলো কি করছে কে জানে। আমাকে বেশিক্ষণ দেখতে না পেলে আবার কান্নাকাটি জুড়ে দেবে।”
কোকোর হাসি মুখ নিভে গেলো নিমিষেই। বহুবছর যাবৎ ও ওর আম্মার একমাত্র আদরের ভাগিদার ছিলো, কিন্তু বছর দশ হচ্ছে ওর আদরে ভাগ বসাতে চলে এসেছে গুটি খানেক জানোয়ার৷ কয়েকমাস আগে তো সেখানে আরও দুটো যোগ হয়েছে! সেদুটোর আদিখ্যেতা দেখলে ওর হয়ে যায়, আম্মাকে কাছে না পেলে আবার কান্নাকাটি করে, যত্তসব!

আনাবিয়া ওর হাত ধরে নিয়ে এগোতে লাগলো প্রাসাদের দিকে, মীরকে সম্পুর্ন উপেক্ষা করে ও চলে যেতে নিলো। ফারিশ আর নওয়াস গাছের ছায়ায় ঘাসের ওপর বসে বিশ্রাম নিচ্ছিলো, আনাবিয়াকে চলে যেতে দেখে নওয়াস শুধালো,
“শেহজাদী, আপনি আর খেলবেন না?”
“না”
কাঠকাঠ উত্তর দিয়ে আনাবিয়া এগোলো প্রাসাদের দিকে। মীর বোতল থেকে পানি খাচ্ছিলো, আনাবিয়াকে চলে যেতে দেখে মুখের পানিটা দ্রুত গিলে ফেলে ও বোতল হাতে নিয়ে ছুটলো ওর পেছনে। ছুটে আনাবিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে আনাবিয়াকে স্পর্শ করার চেষ্টা করা মাত্রই আনাবিয়া এক ঝটকায় ওর অন্য পাশ থেকে কোকোকে টেনে এনে দিয়ে দিলো মাঝখানে।

মীর হতাশ হয়ে কোকোর কাধের ওপর হাত রেখে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে কৌতুক পূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
“আমার ওপর রাগ করার কারণ কি? কি করেছি আমি?”
আনাবিয়া ঘাড় গুজে তাকয়ে রইলো সামনের দিকে, আনাবিয়ার থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে মীর কোকোর মাথায় চাটি মেরে বলে উঠলো,
“এই ধাঙড়, তোর আম্মা রাগ করছে কেন? হোয়াই?”
কোকো ওর মাথার চাটি মারা অংশে হাত বুলাতে বুলাতে বলল,
“আপনি ইচ্ছে করে তাঁকে জিতিয়ে দিয়েছেন যে!”
আনাবিয়া ওপাশ থেকে ক্ষেপে উঠে বলল,
“কোকো, তুই যদি তোর পাশের ওই ব্লাক শেডের ব্যাক্তির সাথে আরকোনো কথা বলেছিস তবে কিন্তু আমি তোকে আজ খেতে দেবোনা।”
ব্লাক শেড শুনে কোকো হেসে উঠতে নিয়েও নিজের মুখে হাত চাপা দিয়ে হাসি আটকালো। মীর ওপাশ থেকে ভ্রু উচিয়ে বলে উঠলো,

“কোকো, তোর পাশের হোয়াইট শেডের রমণীকে বলে দে এই ব্লাকশেডই তার ভূত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ! তাই এই ব্লাক শেডকে অপমান করে কোনো লাভ নেই। অপমান করলে ব্লাক শেড তার রঙ পরিবর্তন করবেনা। আ’ম অ্যা কিং নট গিরগিটি!”
কোকো পড়লো বিপদে, ও চুপ করে এই দুইটার ঝগড়া দেখতে লাগলো। ঝগড়ার ভেতর থার্ড পার্সন হলেই বিপদ, শেষ মেশ সব দোষ এসে পড়বে ওর ঘাড়ে!
ঝগড়া থামানোর প্রয়াসে ও ভেবেচিন্তে হঠাৎ মনে পড়ার ভঙ্গিতে বলে উঠলো,
“আম্মা, আপনি না কাঞ্জি জোভিদেরকে কাছে যেতে চাইছিলেন! দ্রুত চলুন নইলে ওরা আবার মারামারি বাধাবে।”
“হ্যাঁ, চল।”

বলে দ্রুত গতিতে পা বাড়ালো আনাবিয়া। মীর ওদের সাথে তাল মিলিয়ে হাটতে হাটতে পেছনে তাকিয়ে বাকিদের বলে দিলো আজকের মতো খেলাধুলা এখানেই ইস্তফা দিতে।
মীরের ইশারা পেয়ে আরমান আর শেহজান মিলে গুছিয়ে নিলো সবকিছু। তারপর নওয়াস ফারিশ আর জায়ানের সাথে আস্তে ধীরে ওরা এগোলো প্রাসাদের দিকে।

প্রাসাদের রয়্যাল ফ্লোরের অন্যপাশে এক বিরাট কামরা। কামরার সামনে, দরজার ওপরে মীরের হ্যান্ডরাইটিংয়ে লেখা ‘দ্যা রয়্যাল জ্যু’।
কামরার ভেতর পর পর সাতটা বিছানা পাতা। কামরায় ঢুকেই প্রথম আর সবেচেয়ে বড়সড় বিছানাটা কোকোর। দরজা ঠেলে কামরায় ঢুকেই কোকো গিয়ে ধাম করে শুয়ে পড়লো বিছানায়, শব্দ শুনে আঁতকে উঠে তাকালো সেখানে উপস্থিত অন্য বাচ্চা গুলো।
পরমুহুর্তেই ধীরপায়ে কামরায় ঢুকলো আনাবিয়া, ওকে দেখা মাত্রই কামরার শেষ প্রান্তে থাকা বিছানা দুটো থেকে লাফিয়ে নেমে ছুটে এলো দুইটা ছোট্ট ছোট্ট প্রাণী, একটা ছোট্ট হলুদের ওপর ডোরাকাটা বাঘের বাচ্চা, অন্যটা কুচকুচে কালো রঙা প্যানথার৷ আনাবিয়া দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে হেসে উঠে দুহাত বাড়িয়ে কোলে উঠিয়ে নিলো ওদের দুজনকে।

আনাবিয়ার গলায়, বুকে নিজেদের মাথা ঘষে ওরা দিয়ে দিলো একগাদা আদর, আনাবিয়া হেসে উঠলো খিলিখিলিয়ে। দুটোকে হাতে নিয়ে কোকোর কাছে গিয়ে ওর পেছনে নিজের ডানপা উঁচিয়ে একটা গুতা মেরে বলল,
“অ্যাই অসভ্য, বাইরে থেকে এসে ফ্রেশ না হয়ে বিছানায় গেছিস কেন? উঠ এখনি! উঠে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে তারপর বিছানায় যাবি।”

কোকো হতাশার শ্বাস ফেলে বালিশের ওপর মুখ গুজে দিয়ে কিছুক্ষণ ওভাবে থেকে অবশেষে উঠে পড়লো। এখন ফ্রেশ না হতে গেলে ওর আম্মা ওকে আর আস্ত রাখবে না। বিছানা থেকে নেমে ও তাড়াতাড়ি চলে গেলো ওয়াশরুমে।
বাকি চার বিছানার মালিকগুলো পড়তে বসেছে চুপচাপ, ওরা যে আনাবিয়াকে আসতে দেখেই এত মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করছে সেটা বুঝতে আর বাকি রইলো না আনাবিয়ার। কিন্তু কিছুই বললনা, পড়ছে যে এটাই অনেক।
এই বাচ্চাগুলোকে গত দশ বছর ধরে রেড জোনের ভেতর থেকে খুঁজে খুঁজে কুড়িয়ে নিয়ে এসেছে ও, মৃত্যু মুখে পতিত হতে হতে ওরা এসে ঠেকেছে আনাবিয়ার হাতে, আনাবিয়া ওদেরকে আগলে নিয়েছে মায়ের মতো করে, বুকে করে বড় করে তুলেছে, আদরে আদরে সেগুলো বাদর হলেও মীরের শাসনে জ্যেন্টেলম্যানে পরিণত হচ্ছে দিনে দিনে।
আনাবিয়া ওর কোলে থাকা বাচ্চা দুটোকে ওদের জন্য নির্ধারিত বিছনায়া রেখে উচ্চস্বরে হাঁক পাড়লো,

“ইয়াসমিন!”
আনাবিয়া ডাকতেই কামরায় ঢুকলো বছর পঁচিশের যুবতি ইয়াসমিন, এসে মুখে হাসি ফুটিয়ে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে আনাবিয়ার আদেশের অপেক্ষায় রইলো ও। আনাবিয়া ওর দিকে তাকিয়ে ওর হাসিমুখ খেয়াল করে শুধালো,
“কি ব্যাপার ইয়াসমিন, এত খুশি খুশি লাগছে কেন তোমাকে?”
আনাবিয়ার প্রশ্নে লজ্জা পেলো ইয়াসমিন, চোখ নামিয়ে নিয়ে লাজরাঙা মুখে উত্তর দিলো,
“আপনি কামরায় ফিরলে বলবো শেহজাদী!”
আনাবিয়া হাসলো। ইয়াসমিনের মনে প্রেম জেগেছে, আরমানের সাথে চুটিয়ে প্রেম করছে সে৷ মীর আর ওর ভেতরে ইয়াসমিন আরমানের প্রেম নিয়ে খুব জম্পেশ আলোচনা চলে যখন তখন।
আনাবিয়া বলল,

“ঠিক আছে বোলো। এখন কাঞ্জি আর জোভির জন্য দুধ গরম করে নিয়ে এসো তো! ওদেরকে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিই নইলে ওরা বিরক্ত করবে ওদের, পড়তে দিবেনা।”
ইয়াসমিন আনাবিয়ার কথায় মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে। কোকো বের হলো ওয়াশরুম থেকে তখনি, বের হয়েই পড়তে থাকা বাচ্চাগুলোর উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“এই তোদের বিছানার ওপর জামা কাপড় এভাবে ছড়ানো কেন? উঠে এখনি গুছিয়ে রাখবি তারপর পড়তে বসবি আবার। দ্রুত!”

কোকোর কথা কানে যেতেই সবগুলো উঠে পড়লো তড়িৎ গতিতে। কোকোকে ওরা ভয় পায় জমের মতো, কোকোর বিশাল শরীর দেখে ওরা উচ্চবাচ্য করার সাহস করেনা কখনো।
কোকো বুকে হাত গুজে দাঁড়িয়ে রইলো ওদের কাজ শেষ হওয়ার অপেক্ষায়, ওরা চারজন দ্রুত উঠে বিছানার ওপর থেকে শুকনো কাপড় গুলো তুলে সুন্দরমতো ভাজ করে রেখে দিলো যার যার আলমারিতে৷ তারপর আবার বসে গেলো পড়ার টেবিলে।
আনাবিয়া মৃদু হাসলো, এই বাচ্চাগুলোকে কোকো একাই ম্যানার্স শিখিয়ে দিলো। অথচ তার নিজের ম্যানার্সের কোনো খোঁজ নেই!

ইয়াসমিন ফিডারে দুধ ভরে দুহাতে নিয়ে ঢুকলো তখন কামরায়। এগিয়ে এসে আনাবিয়ার হাতে তুলে দিলে আনাবিয়া বিছানার ওপর হাতাহাতি করতে থাকা কাঞ্জি আর জোভির মুখে ফিডার ঢুকিয়ে শান্ত করে দিলো ওদের, তারপর ইয়াসমিনের উদ্দ্যেশ্যে বলল,
“বাচ্চাদের রাতের খাবার তৈরি করতে বলো মুহসিনকে। ওদের এক্সাম সামনে, এখন কোনো অনিয়ম করতে দেওয়া যাবেনা।”

ইয়াসমিন মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে আবার। কামরা থেকে বের হতেই তার সামনে পড়লো আরমান, আঁতকে উঠলো ইয়াসমিন। আরমানের মুখে লেগে রইলো মিটিমিটি হাসি।
আরমানকে হাসতে দেখে লাজুক ভঙ্গিতে মুখ নামিয়ে নিলো ইয়াসমিন। আরমান কিছুক্ষণ ইয়াসমিনের মুখপানে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে নিজের বা পাশে সরে গিয়ে জায়গা করে দিলো ইয়াসমিনের যাওয়ার।
ইয়াসমিন মুখ নামিয়ে লাজুক হেসে দ্রুত পায়ে ছুটে গেলো রয়্যাল ফ্লোরের অন্য কোণায় থাকা কিচেনের দিকে। এই লোকটার সামনে এখনি পড়তে হলো ওর! এখন কিচেনে গিয়ে মুহসিনকে ঠিকঠাক ভাবে গুছিয়ে শেহজাদীর বলা কথাগুলো বলতে পারলেই হলো!

কাঞ্জি আর জোভিকে খাওয়ানো শেষ করে ওদেরকে বিছানায় শুইয়ে দিলো আনাবিয়া, বাচ্চা দুটো খেতে খেতেই ঘুমিয়ে গেছে। ওদের গায়ের ওপর কাথা টেনে দিয়ে বিছানা ছেড়ে উঠে যেতে যেতে কোকোর উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“কোকো, ওরা ঘুমাচ্ছে। রাতে যদি ঘুম ভেঙে ডাকাডাকি করে তবে ইয়াসমিনকে বলে দুধ গরম করে খাইয়ে দিবি, ঠিক আছে?”
কোকো মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলল,
“ঠিক আছে আম্মা।”
আনাবিয়া এগিয়ে এসে কোকোর মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বেরিয়ে গেলো বাইরে। আনাবিয়া বেরিয়ে যেতেই কোকোর পাশের বিছানার মালিক ওকামি টেবিল থেকে মাথা উচিয়ে পাশের টেবিলে পড়তে থাকা লিও কে ফিসফিসিয়ে বলল,

“দেখেছিস, শেহজাদি কোকোকে আদর করে গেলো অথচ আমাদের আদর করলোনা।”
লিও ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে বলল,
“চুপচাপ পড়, বেশি বকিস না৷”
ওকামির মনটা খারাপ হয়ে গেলো, শেহজাদীর আদর কি শুধু কোকো পাবে? ওরা কি দোষ করেছে। ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে ও অন্যপাশে থাকা হাইনার দিকে তাকালো।
হাইনা ওর দু বছরের বড়ো। ওকামি চেয়ার ছেড়ে উঠে হাইনার বিছনায় গিয়ে বসলো।
হাইনা একমনে পড়ছিলো, ওকে দেখে একপলক ওর দিকে তাকিয়ে আবার বইয়ে মনোযোগ দিয়ে বলল,
“দ্রুত বল, সময় নেই৷”
“শেহজাদী আমাদের আদর করলেন না কেন?
ধরা গলায় শুধালো ওকামি, হাইনা ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বইটা সাময়িকের জন্য বন্ধ করে ওর দিকে ফিরে বলল,

“আমাদের এক্সাম চলছে তাই শেহজাদী আমাদেরকে আমাদের মতো ছেড়ে দিচ্ছেন, আমাদের পড়ায় ব্যাঘাত ঘটাতে চাচ্ছেন না। এটুকুও কি বলে দিতে হবে তোকে?”
শেষোক্ত কথাটা কিছুটা ধমকের সুরে বলল হাইনা, ইমোশনাল ওকামির ঠোঁট ফুলে গেলো তাতে,
“সবাই শুধু আমাকে বকে!”
বলে হাইনার পাশ থেকে উঠে ও চোখের কোণে জমা পানিটুকু মুছতে মুছতে আবার এগোলো নিজের টেবিলের দিকে।

কোকো ওর বিছানায় বসে বসে চিল করছিলো, পড়াশোনা আপাতত স্থগিত ওর ইম্পেরিয়াল থেকে ইন্টারমিডিয়েট শেষ করে ও এখন বিন্দাস সময় কাটাচ্ছে।
ওকামিকে নাক টানতে দেখে ও বলে উঠলো,
“হোই, কি হয়েছেরে তোর? কথায় কথায় মেয়েদের মতো কাঁদিস কেন? তুই নেকড়ের বাচ্চা নেকড়ের মতো থাকবি, তুই এত ইমোশনাল হবি কেন?”

ওকামি চোখ ফিরিয়ে কোকোর দিকে তাকালো একবার, তারপর আবার বইয়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে নিলো, চোখ থেকে দুফোটা পানি গড়িয়ে শব্দ করে পড়লো ওর বইয়ের পাতায়৷
কোকো কপাল চাপড়ালো, এসব ইমোশোনাল পোলাপাইন যে ওর আম্মা কিভাবে যোগাড় করেছে মাথায় এলোনা ওর৷ বিছানা ছেড়ে উঠে ও কামরা থেকে বেরিয়ে এগোলো আনাবিয়ার কামরার দিকে।
দরজায় নক দিতেই ভেতর থেকে ভেসে এলো আনাবিয়ার কন্ঠস্বর,

“এসো!”
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো কোকো। আনাবিয়া বিছানার ওপর বসে চাদরের নিচে শরীরের নিম্নাংশ ঢেকে কোলের ওপর বই নিয়ে পড়ছিলো। কোকো ভেতরে এসেই বলে উঠলো,
“ওকামি কাঁদছে আম্মা!”
“কেন? ওর আবার কি হলো?”
বইটা বন্ধ করতে করতে চিন্তিত কন্ঠে শুধালো আনাবিয়া।
“আপনি আমাকে আদর করলেন অথচ ওদেরকে করলেননা সেই কষ্টে কাঁদছে।”
আনাবিয়া ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো একটা, গায়ের ওপর থেকে চাদর সরিয়ে উঠে এলো ও। তারপর কোকোকে সাথে নিয়ে এগোলো বাচ্চাদের কামরার দিকে।

কামরায় ঢুকতেই ওর চোখে পড়লো ফুলে ফুলে নিঃশব্দে কান্না করতে থাকা ওকামির দিকে৷ ওর পাশে বসে ওকে স্বান্তনা দিতে ব্যাস্ত হাইনা,লিও আর আলফাদ।
আনাবিয়া ঢুকতেই ওরা সোজা হয়ে বসলো যে যার জায়গায়, ওকামি তাড়াতাড়ি চোখ মুছে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলো। আনাবিয়া গিয়ে ওর বিছানার পাশে বসে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে স্নিগ্ধ কন্ঠে শুধালো,
“কি হয়েছে তোর? কাঁদছিস কেন? তোকে কি আমি কারো থেকে কম ভালোবাসি? কোকোর মতো তোরাও তো আমারই সন্তান, আমি কখনো কাউকে অন্যচোখে দেখেছি বলতো!”
আনাবিয়ার এমন নরম কন্ঠ আর স্বল্প আদরে ফুপিয়ে কেদে উঠলো ওকামি, আনাবিয়া অপ্রস্তুত হলো। বাচ্চা গুলোর কান্না ও একেবারেই সহ্য করতে পারেনা।

ওর নিজের হাতে একটু একটু করে বড় করা এই বাচ্চাগুলোকে ও যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছে এতদিন! আর সেই বাচ্চা-ই নাকি এখন ওর ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ করে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে!
আনাবিয়া ওকে চেয়ার থেকে হাত ধরে নামিয়ে এনে দাড় করালো নিজের সামনে, তারপর ওর ছোট ছোট দুইহাত নিজের হাতের ভেতরে নিয়ে আদুরে গলায় শুধালো,
“আমার ভালোবাসা নিয়ে সন্দেহ আছে তোর?”
ওকামি এবার নিজেকে যেটুকু নিয়ন্ত্রণ করেছিলো সেটুকুও হারিয়ে ফেলে ঠোঁট ফুলিয়ে কেঁদে উঠলো উচ্চস্বরে। তারপরেই মেঝেতে বসে পড়ে জড়িয়ে ধরলো আনাবিয়ার পা জোড়া, তারপর আনাবিয়ার কোলের ওপর মাথা রেখে ফুপিয়ে কেদে কেঁদে ও হালকা কররতে লাগলো নিজের ভারাক্রান্ত মনকে। আনাবিয়া মিষ্টি হেসে হাত বুলিয়ে দিলো ওর চুলের ভেতর দিয়ে।
বাকি ছেলেগুলো সামনে দাঁড়িয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো ওদের দিকে। আনাবিয়া ওদের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“আপনারাও আসুন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”
মুহুর্তেই হাসি ফুটে উঠলো ওদের মুখে, হুড়মুড়িয়ে এসে বসে পড়লো ওরা ওকামির চারপাশ দিয়ে, মাথা পেতে দিলো আনাবিয়ার আদর পাওয়ার জন্য।
কোকো এই দৃশ্য দেখে মুখ বেকিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো, আনাবিয়া সেটা দেখে হেসে উঠে বলল,
“তুই ধামড়া হয়ে গেছিস, তোকে এরকম আদর আর দেওয়া হবে না।”
“হ্যাঁ, আমি তো বুড়ো হয়ে গেছি, হুহ!”
মুখ ভার করে বলল কোকো। নিচ থেকে হাইনা বলে উঠলো,
“তুমি অনেক আদর খেয়েছো কোকো ভাইয়া, তুমি এখন অফ যাও। এখন শেহজাদীর সব আদর আমরা খাবো।”
ওর কথায় দাঁত কেলিয়ে তড়িতে ওপর নিচে মাথা নাড়লো লিও, কোকো মুখ ভেঙচালো ওর দিকে।
ইয়াসমিন এলো এমন সময় ভেতরে ঢুকে বলে উঠলো,

“আপনার বাচ্চাদের খাবার তৈরি হয়ে গেছে শেহজাদী, আপনি অনুমতি দিলেই মুহসিনকে খাবার দিতে বলবো।”
আনাবিয়া মাথা নেড়ে সায় জানালে ইয়াসমিন চলে গেলো আবার বাইরে। আনাবিয়া ওদেরকে নিজের কোল থেকে সরিয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলে উঠলো,
“খাবার এলে সবগুলো চুপচাপ খেয়ে নিবি, একফোটা খাবারও যেন নষ্ট না হয়।
আর কোকো, এরা খেয়ে অল্প বিশ্রাম নিয়ে যেন আবার পড়তে বসে। রুলসের বাইরে গেলেই বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখবি। সারারাত বাইরে ঠান্ডার ভেতর দাঁড়িয়ে থাকবে।”
কোকো সোল্লাসে রাজি হলো, এসব কাজ সে খুব ভালোভাবেই করতে পারে। বরং তার মজাই লাগে! দুহাত মাস্তানি ভঙ্গিতে ঘষে ও বলে উঠলো,

“আপনি কোনো চিন্তা করবেন না আম্মা! রুলস ইজ রুলস, ব্রেক করলেই একদম প্রাসাদের কার্নিশে দড়ি বেধে ঝুলিয়ে রাখবো। ঠান্ডায় জমে যাবে, বাতাস লেগে ঠনঠন করবে। আপনি শব্দ পাবেন।”
আনাবিয়া হাসলো মিষ্টি করে, ওকামির মাথায় আর একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে ও বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে। ও বেরিয়ে যেতেই কোকো শার্টের হাতা গুটিয়ে বলে উঠলো,
“এই, সবগুলা গিলে উঠে পড়তে বসবি, নো বিশ্রাম! রেজাল্ট খারাপ হলে আমার দুহাত দিয়ে মুখের দুপাশ থেকে একসাথে থাবড়া দিবো, মুখটা একদম চিড়েচ্যাপ্টা হয়ে যাবে৷ পড়তে বস সব!”

নিজের কামরায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে আনাবিয়া। সদ্য প্রস্ফুটিত যৌবন উপচে পড়ছে ওর শরীর বেয়ে।
দক্ষ শিল্পীর নিখুঁত তুলির আঁচড়ে সৃষ্ট কোনো শিল্পকর্মের ন্যায় অসাধারণ সৌন্দর্যে মুড়িয়ে আছে ও। শ্বেতশুভ্র ত্বকে যেন মিশে আছে চাঁদের আলো।
সফেদ চুলগুলো কোমর ছাড়িয়ে নেমে গেছে উরুতে, কামরার কৃত্রিম আলোতে ঝিকিমিকি করছে সেগুলো।
শরীরের প্রতিটি মসৃণ ভাঁজ সিল্কের মতো মোলায়েম আর লাবণ্যময় হয়ে জাগিয়ে তুলছে ওকে স্পর্শ করতে চাওয়ার তীব্র ইচ্ছা!

চওড়া হাই হিপের ওপর সরু কোমর, আর মসৃণ পেটের উপরিভাগের পরিপূর্ণ সুডৌল স্তনযুগল সবকিছুই যেন কোনো ভাস্করের সুনিপুণ হাতে গড়া সুক্ষ্ম সুন্দর ভাস্কর্যটির ন্যায় সুগঠিত!
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের শুভ্র, রেশমি চুলগুলো আচড়ে নিতে ব্যাস্ত ও। পরনের লেইস ক্রপ টপ, আর লেট্যুস কাটের শর্টসের ওপর চড়িয়ে দেওয়া একটা স্যাটিনের রোব। মুখে সামান্য প্রসাধনীর ছোয়া।
এমন সময়ে কামরার দরজায় শোনা গেলো নকের শব্দ, আনাবিয়া অনুমতি দিতেই ভেতরে প্রবেশ করলো ইয়াসমিন। খোলা চুলের আনাবিয়ার দিকে এগিয়ে এসে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,

“আপনাকে একদম পরীর মতো সুন্দর লাগছে শেহজাদী!”
আনাবিয়া মৃদু হেসে বলে উঠলো,
“তুমি তখন কি বলতে চেয়েছিলে ইয়াসমিন?”
ইয়াসমিনের মুখখানাতে হঠাৎ করেই নেমে এলো লাজ, লাল হয়ে যাওয়া গালে আনত দৃষ্টিতে ও বাধো বাধো সুরে বলে উঠলো,
“আরমান তখন কোকোভাই দের রুমে যাওয়ার সময় জড়িয়ে ধরেছিলেন আমাকে!”
বলেই লজ্জায় চোখ খিচে নিলো ও। আনাবিয়া আয়নাতে ইয়াসমিনের এমন অবস্থা দেখে ফিক করে হেসে দিলো। চিরুনিটা ড্রেসিং টেবিলের সামনের অংশে রেখে ও এগিয়ে এলো ইয়াসমিনের দিকে, ইয়াসমিনের নিচু করে রাখা মুখ খানা থুতনি ধরে উচু করলো।
ইয়াসমিনের চোখ জোড়া তখনও বন্ধ, চোয়াল জোড়া লাল। আনাবিয়া হেসে বলল,

“তলে তলে এসব করছো তোমরা! দাঁড়াও তোমাদের বিয়ের ব্যাবস্থা করছি খুব শিগগিরই। তোমাকে জড়িয়ে ধরার অপরাধে শাস্তি হিসেবে আরমানের গলায় সারাজীবনের জন্য তোমাকে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে৷”
ইয়াসমিন লজ্জা পেলো আরও, লাজুক হাসিতে ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হলো ওর। গলা ঝেড়ে বলে উঠলো,
“হিজ ম্যাজেস্টি আজ দ্রুতই মিটিং শেষ করে দিয়েছেন, আরমান বলেছে। এতদিন পর প্রাসাদে ফিরে আপনাকে কাছে পাওয়ার জন্য ওনার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে! আরমান বলল হিজ ম্যাজেস্টি নাকি হাঁসফাঁস করছিলেন মিটিংয়ের পুরোটা সময়!”
বলেই দুষ্টু হাসলো ইয়াসমিন। আনাবিয়া কপট রেগে বলল,

“ওহ্‌ আচ্ছা! কাজ বাদ দিয়ে তবে আমাদের নিয়ে আলোচনা করো তোমরা?”
“না শেহজাদী! আপনাদের দুজনকে নিয়ে সবখানেই অনেক অনেক চর্চা হয়। আপনাদের দুজনের এই দুষ্টুমিষ্টি প্রেম, হিজ ম্যাজেস্টির আপনার প্রতি এই অবসেশন সবকিছুই প্রচন্ড চোখে পড়ার মতো।
এমনকি মিটিংয়ে উপস্থিত সকলেই জানে উনি কেন প্রত্যেকবার ভ্রমণ থেকে ফেরার পর ঝড়ের গতিতে মিটিং শেষ করেন! আর তারপর চাতক পাখির মতো তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে উনি ছুটে আসেন আপনার কাছে!”
বলে ঠোঁট টিপে হাসলো ইয়াসমিন৷ আনাবিয়া ওর গাল টিপে দিয়ে বলল,

“খুব দুষ্টু হয়েছো তুমি ইয়াসমিন! যাও এখন, নিজের কামরায় যাও। আমার কিছু কাজ আছে। আজ ক্রিকেট ম্যাচে আমাকে ইচ্ছাকৃত জিতিয়ে দেওয়ার শাস্তি দিতে হবে তোমাদের হিজ ম্যাজেস্টিকে।”
ইয়াসমিন চোখে হেসে আনাবিয়াকে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে। কামরা থেকে বের হতেই ওর চোখে পড়লো রয়্যাল ফ্লোরে প্রবেশের দরজা দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে ভেতরে প্রবেশ করতে থাকা মীরকে। সেই চাতক পাখির ন্যায় তৃষ্ণার্ত দৃষ্টি, স্বর্ণাভ চোখ জোড়ায় আনাবিয়াকে কাছে পাওয়ার তীব্র বাসনা!
পঞ্চদ্বীপের সেনানিবাস, পঞ্চদ্বীপের পাঁচ নম্বর দ্বীপ রামাদিসামাতে মাস খানেকের সফরে গিয়েছিলো মীর। আজই ফিরেছে, ফিরেই বাচ্চাগুলোর অনুরোধে চলে গেছিলো সোজা ক্রিকেট খেলতে। আর প্রাসাদে ফিরেই চলে গেছিলো সাম্রাজ্যের জরুরি মিটিংয়ে।

মিটিংটা কোনো রকমে শেষ করে ও ছুটেছে আনাবিয়ার কাছে। একটা মাস ধরে আনাবিয়াকে কাছে না পাওয়ায় সৃষ্টি হওয়া প্রবল তৃষ্ণা ওকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে হিংস্র, শিকারী জন্তুর ন্যায়!
ইয়াসমিন ওকে দেখা মাত্রই মাথা নত করে দাঁড়িয়ে গেলো এক পাশে। মীর ওর সামনে দিয়ে ঝড়ের গতিতে ছুটে ঢুকলো আনাবিয়ার কামরায়।
কিন্তু কামরায় ঢোকা মাত্রই কামরা ফাঁকা দেখলো ও। ভ্রু জোড়া কুচকে নিয়ে চারদিকে তড়িতে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে ও ডেকে উঠলো,

“শিনু!”
তখনি ব্যালকনির দরজার নিকট থেকে ভেসে এলো আনাবিয়ার প্রচন্ড আকর্ষণীয় কন্ঠস্বর,
“প্রেজেন্ট!”
মীর চকিতে তাকালো ব্যালকনির দরজার নিকট, আনাবিয়া ব্যালকনির দারজায় বাহু ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরই দিকে চেয়ে। চোখ জোড়ায় ওর খেলে চলেছে প্রচন্ড নেশা।
ওকে এমন পোশাকে এমন অবস্থায় দেখা মাত্রই মাথা ঘুরে গেলো মীরের, তড়িতে বেড়ে গেলো হৃদপিন্ডের গতি। শ্বাস প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেলো মুহুর্তেই, কেঁপে উঠলো গলা! তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে ও পা বাড়ালো আনাবিয়ার দিকে!
ওকে আসতে দেখে আনাবিয়া সাথে সাথেই হাত উঁচিয়ে ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,

“যেখানে আছো ওখানেই থাকো, আমার কাছে আসার চেষ্টা করবে না!”
“কেন?”
শুকনো ঢোক গিলে ভ্রু কুচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে শুধালো মীর। আনাবিয়া শোণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ডেভিল হেসে বলল,
“আজ ক্রিকেট ম্যাচে আমাকে ইচ্ছাকৃতভাবে জিতিয়ে দিয়েছো তাই।”
“তাই বলে তুমি আমাকে বঞ্চিত করবে? এটা আমি কোনোভাবেই মেনে নেবোনা শিনু! আমার তোমাকে চাই, এখনি!”
অধৈর্য কন্ঠে বলে উঠে মীর আবারও পা বাড়ালো ওর দিকে, কিন্তু দু কদম বাড়াতেই আনাবিয়া ওকে আবার থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলো,
“বঞ্চিত করবোনা, তবে তোমাকে একটা টাস্ক দেওয়া হবে। পূরণ করতে পারলেই আমি তোমার।”
“কিসের টাস্ক?”
ঝড়ো নিঃশ্বাস ফেলে আর একবার ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠলো মীর। ধৈর্যে কুলোচ্ছেনা ওর আর, চোখ জোড়া ঘুরে ফিরছে আনাবিয়ার মেদহীন পেট, কোমর, বুক, গলা, ঠোঁট, চোখ, সমস্ত স্থান জুড়ে!
আনাবিয়া ওর চোখের তৃষ্ণার্ত চাহনি খেয়াল করে তৃপ্তির হাসি হাসলো, তারপর একটু একটু করে পিছিয়ে যেতে যেতে বলল,

“আমি এখন নিরুদ্দেশ হবো, তোমার মতো! তোমার হাতে সময় ভোর হওয়া পর্যন্ত। ভোর হওয়ার আগেই আমাকে খুঁজে পেলে রাতের বাকিটা সময় আমি সমস্তটাই তোমার! আর খুঁজে না পেলে আগামী এক সপ্তাহ তোমাকে সংযম পালন করতে হবে!”
ভ্রু জোড়া কুচকে গেলো মীরের, হাত জোড়া অধৈর্য হয়ে উঠলো আনাবিয়াকে স্পর্শ করার জন্য, প্রচন্ড আক্রোশে মরিয়া হয়ে উঠে ব্যাকুল কন্ঠে ও বলে উঠলো,

“কখনোই না! আমার তোমাকে এখনি চাই শিনু, এই মুহুর্তেই চাই। তোমাকে গত একটা মাস ধরে আমি এতটুকু স্পর্শ করতে পারিনি, আমার অবস্থাটা বিবেচনা করো একবার! এরকমটা কোরোনা শিনু, আমার কাছে আসো।”
বলেই মীর দ্রুত পায়ে এগিয়ে এলো ওর দিকে। আর সেই মুহুর্তেই আনাবিয়া ঝড়ো গতিতে এগিয়ে এসে মীরের ভ্রমরকালো অধর‍ যুগলে একটা গভীর চুম্বন বসিয়ে দিয়ে ওর প্রবল তৃষ্ণাকে মাত্রাছাড়া করে দিয়ে তড়িৎ বেগে ঝাপিয়ে পড়লো ব্যালকনির ওপর থেকে, মুহুর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেলো রেড জোনের ভেতর!

মীরের মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিলো! আনাবিয়াকে কাছে না পাওয়ার ক্রোধে দাঁতে দাঁত পিষে গেলো ওর। দ্রুত পায়ে ব্যালকনির কিনারায় এসে রেলিং ধরে নিচে তাকিয়ে ও উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“শিনু! তোমাকে যদি আজ পেয়ে যাই তবে তোমাকে যেখানে পাবো সেখানেই আদর দিয়ে শেষ করে দেবো আমি, মাইন্ড ইট!

সেই মুহুর্তেই মীরের ঠিক মুখোমুখি, কিছুটা দুরত্বে থাকা একটা রেডউড ট্রির মাথার ওপর প্রচন্ড আবেদনময়ী ভঙ্গিতে উঠে এলো আনাবিয়া, গায়ের স্যাটিনের রোবটা খুলে ফেলে দিলো নিচে।
দূর থেকেই মীরের দিকে নিজের হীরকখন্ডের ন্যায় ঝলকানো দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে পৈশাচিক আনন্দে হেসে উঠলো ও, পরক্ষণেই জিভ দিয়ে ঠোঁট জোড়া ধীর গতিতে ভিজিয়ে নিয়ে গাছের ওপরে থেকেই মীরের সামনে ও খুলে ফেললো ওর টপটা।

রিভিলিং অন্তর্বাসটা দৃষ্টিগোচর হতেই মীরের সারা শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো! চোখ জোড়া মুহুর্তেই আবেশে বন্ধ করে নিয়ে উপরের দিকে মুখ করে নিয়ে শুকনো ঢোক গিললো ও একটা।
তার পরমুহূর্তেই ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে উপরের দিক থেকে মুখ নামিয়ে রেডউড গাছের ওপর ওর দিকে এক ভ্রু তুলে তাকিয়ে ক্রুর হাসতে থাকা আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে গমগমে কন্ঠে বলে উঠলো,
“চ্যালেঞ্জ অ্যাক্সেপ্টেড!”
এরপর মুহূর্তেই নিজের গায়ের পোশাকটা একটানে ছিড়ে খুলে ফেলে দিয়ে নিজেও লাফিয়ে পড়লো জঙ্গলের ভেতর।
আনাবিয়া প্রবল উচ্ছাসে ফেটে পড়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠে ঝড়ের ন্যায় পালিয়ে গেলো সেখান থেকে৷

রেড জোনের বিশাল জঙ্গলের ভেতরকার অর্কিডবাগানের লতাপাতার ভিড়ে নিজেকে লুকিয়ে নিয়ে স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আনাবিয়া। ঝড়ো নিঃশ্বাস পড়ছে ওর ঘন ঘন, বুকের ভেতর দুরু দুরু করছে। একদিকে প্রচন্ড উচ্ছাস, অন্যদিকে প্রচন্ড ভয় আর উত্তেজনায় টইটম্বুর হয়ে আছে ও!
ঢোক গিললো ও একটা শব্দ করে। মীর ওর আশেপাশেই কোথাও আছে। মীরের উপস্থিতি প্রচন্ডরকম অনুভব করছে ও। এতক্ষণ মীরের থেকে পালিয়ে বাঁচতে ছোটাছুটি করতে করতে হাপিয়ে গেছে ও প্রচন্ড, কিন্তু ওই অসভ্যটার সামান্যতম ক্লান্তিও নেই, কালাভুনাটা এখনো পূর্ণ উদ্যমে খুঁজে চলেছে ওকে।
চুলগুলো নিয়ে খুব বিপদে পড়েছে আনাবিয়া, কালো হলে কোনো অসুবিধাই ছিলোনা। কিন্তু ও আর ওর চুল দুটোর জন্যই আজ ধরা খাবে ও। আর কালাভুনা তো কালাভুনাই! ওকে অন্ধকার ঘরের কোণাতেই খুঁজে পাওয়া যায়না আর কোথায় জঙ্গল!

সোনা রঙের চোখ জোড়া না থাকলে আজ মীরের বাচ্চাকে ও কোনোভাবেই ট্রেস করতে পারতোনা। ভূতের মতো অন্ধকারের ভেতর থেকে হাত বাড়িয়ে ছিনিয়ে নিতো ওকে এই জগৎ থেকে৷
আকাশে থালার মতো বিশাল চাঁদ, চাঁদের আলো পড়ে ঝিকিমিকি করছে ওর চুল আর শরীর! কিযে বিপদে পড়েছে ও মীরের বাচ্চাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে। কালাভুনাটাকে ক্ষ্যাপাতে হতো না, শুধু শুধু বাঘের মুখ থেকে শিকার ছিনিয়ে নিয়ে এসেছে ও। আজ ওর কপালে দুঃখ আছে!

অর্কিড বাগানের অর্কিড গুলো সব ফকফকা সাদা, চাঁদের আলোয় প্রচন্ড মোহনীয় হয়ে সেজে আছে সেগুলো। এই সাদার ভেতরেই নিজেকে লুকিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় তখন থেকেই স্থীর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আনাবিয়া।
লতাপাতার ফাঁক থেকে একটুখানি চোখ বের করে ও দেখে নিলো আশেপাশের পরিবেশ। মীরের কোনো টিকিপাত্তাই নেই, থাকলেও ওর চোখে বাধবে কিনা সন্দেহ, ব্যাডা কাইল্লা।
প্রচন্ড সাহস নিয়ে আনাবিয়া ছোট্ট ছোট্ট পা ফেলে নিঃশব্দে, সন্তর্পনে বের হলো বাইরে। নাহ মীর নেই, ওর উপস্থিতিও আর টের পাচ্ছেনা ও। সে ব্যাডা এদিক থেকে অন্যদিকে চলে গেছে নিশ্চিত!
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আনাবিয়া, তারপর সাদারঙা অর্কিডের ভেতর দিয়ে নিঃশব্দে হেটে বের হওয়ার চেষ্টা করলো ও এই বাগান থেকে।

কিন্তু সেই মুহুর্তেই ওর পেছনে ঝড়ের গতিতে ছুটে এসে ক্ষিপ্রতার সাথে দাঁড়িয়ে গেলো কেউ, ওর কাছে প্রচন্ড কাছে, আনাবিয়ার কাঁধের ওপর এসে পড়লো তার প্রচন্ড ভারী, ঘন নিঃশ্বাস!
মুহুর্তেই আনাবিয়া জমে গেলো সম্পুর্ন, ভয়ে দুরুদুরু করতে থাকা বুকের ভেতরে লুকানো হৃদযন্ত্রের গতি বেড়ে গেলো দ্বিগুন!
পেছনে দাঁড়ানো কুচকুচে কালো রঙা ব্যাক্তি ওর কানের কাছে মুখ এগিয়ে নিয়ে এসে দাঁতে দাঁত পিষে হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,

“ইয়্যু… আর …ডেড!”
আনাবিয়ার মুখে ফুটে উঠলো এক অদ্ভুত তৃপ্তির হাসি, কিন্তু মীরের আসন্ন আদরের ঝড়ের কবল থেকে বাঁচতে ও শেষ বারের মতো মীরের এত্ত নিকটে থেকেও মুহুর্তের ভেতর ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালাতে নিলো!
কিন্তু ও দুকদম ফেলানোর সাথে সাথেই ওর শুভ্র চুলের মুঠিতে পড়লো মীরের ইস্পাত-দৃঢ় হাতের টান! আনাবিয়ার চুলের গোড়া ধরে হ্যাচকা টানে ওকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে এসে নিজের দিকে ঘুরিয়ে এনে আনাবিয়ার টেরাকোটা রঙা ঠোঁটে বসিয়ে দিলো এক প্রগাঢ় চুম্বন!

আর তার কিছুমুহুর্ত পরেই আনাবিয়াকে এই দম বের করা চুম্বন থেকে রেহাই দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে আনাবিয়ার শরীরের উর্ধাংশের অন্তর্বাসটা হ্যাচকা টানে ছিড়ে খুলে ফেলে দিয়ে ওকে অর্কিড বাগানের মাটির ওপর ছুড়ে ফেলে নিজেও ঝাপিয়ে পড়লো ওর ওপর, অতঃপর আনাবিয়ার পরিপূর্ণ বক্ষমঞ্জরীর মধ্যিখানে মুখ রেখে হিংস্র কন্ঠে বলে উঠলো,
“ন্যাও আ’ম গনা ডেস্ট্রয় ইয়্যু!”

ভোর সকালে গাছের পাতায় জমে থাকা শিশির ফোটার টুপ টুপ করে পড়া পানিতে ঘুম ভেঙে গেলো আনাবিয়ার। শীতে জমে যাচ্ছে ও! মীর ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে রেখেছে নিজের বুকের ভেতর। গায়ের ওপর শুধু মীরের দুইখান হাত আর একখান হাতির মতো বিশাল পা ছাড়া আর কিছুই নেই ওর।
রাতের কথা মনে পড়তেই ঠোঁটের কোণে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো আনাবিয়ার। ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুমন্ত মীরের মুখ খানা একবার দেখে নিয়ে ও শব্দ করে একটা চুমু খেলো মীরের কপালে। মীর ভ্রুজোড়া কুচকে নিয়ে নড়ে চড়ে উঠে আনাবিয়াকে নিজের সাথে আরও শক্ত করে জড়িয়ে নিয়ে ঘুমোতে নিলো আবার।
শীত লাগছে ওরও। কিন্তু দেখো, তার কোনো বিকার নেই!

মীরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে এবার আশেপাশে দৃষ্টি দিলো আনাবিয়া। অর্কিড বাগান শেষ!
লতানো গাছগুলো সব এমাথা থেকে ওমাথা পিষ্ট হয়েছে মাটিতে। শালার কালাভুনা সমস্ত রাত ওর সাথে ফুটবল খেলেছে কিনা সেটাই ভাবতে লাগলো ও শুয়ে শুয়ে।
বাগানের ভেতর দিয়ে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে মৃদুমন্দ, শীতল স্পর্শে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগলো আনাবিয়া। পাশ ফিরে ঘুমন্ত মীরের চোয়ালে ছোট্ট ছোট্ট করে চাপড় দিতে দিতে ও বলে উঠলো,
“মীর উঠো! শীত লাগছে আমার, প্রাসাদে চলো!”

আনাবিয়ার ডাকে চোখ কুচকে নিয়ে তাকালো মীর। তারপর আবার চোখ বন্ধ করে নিয়ে বলে উঠলো,
“প্রাসাদে ফিরে আর একবার আদর করতে দিলে এখনি ফিরে যাবো। আর না দিলে এখানেই আদর করে তারপর দুপুরে প্রাসাদে যাবো। চয়েজ ইজ ইয়োর্স।”
আনাবিয়া ফোস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ফার্স্ট অপশন।”
আনাবিয়া উত্তর দিতেই মীর তড়াক করে উঠে বসলো। আর তারপর আনাবিয়াকে কোলে উঠিয়ে নিয়ে এগোলো প্রাসাদের দিকে।

বাচ্চাগুলোর এক্সাম শেষ, আনাবিয়া ওদের কামরায় বসে সময় দিচ্ছে ওদের। অনেক দিন পর সবগুলো ওকে ধরে নিয়ে বসিয়েছে নিজেদের মধ্যিখানে, আজ ওরা ওদের শেহজাদীকে কিছুতেই ছেড়ে দিবেনা৷
রাতের এখন প্রায় এগারোটা। মীর নিজের কামরায় বসে সাম্রাজ্যের কাজ করতে করতে ওর কব্জিতে বাধানো ঘড়ির দিকে দেখলো একবার।
মেয়েটা এখনো বাচ্চাগুলোর কামরায় বসে আছে, ওর যে একটা স্বামী আছে সেটা ভুলে যাচ্ছে আজকাল। রাতের এগারোটা বাজতে চলল অথচ তার কোনো খোঁজ নেই! ওকে আজ রাতে সুন্দর মতো মনে করিয়ে দেবে যে ওর একটা স্বামী আছে৷
মীর কাজে মন দিয়ে উচ্চস্বরে ডেকে উঠলো,

“মুহসিন!”
মীর ডাকার কিয়ৎক্ষণ বাদেই কোমর দুলিয়ে ছোট ছোট পা ফেলে কামরায় ঢুকলো মুহসিন। অত্যন্ত নরম সুরে বলল,
“আদেশ করুন ইয়োর ম্যাজেস্টি!”
“শিনুকে এখনি কামরায় আসতে বলো।”
চোখ না তুলেই গমগমে কন্ঠে বলে উঠলো মীর। মুহসিন মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে। নোমান মারা গেছে আজ প্রায় পাঁচ বছর, তার পর থেকেই মুহসিন নোমানের পদে বহাল হয়েছে।
বেলিন্ডা, হামদান দুজনেই গত হয়েছে প্রায় বছর সাত হচ্ছে। প্রাসাদে এখন নতুন মুখের ছড়াছড়ি।
মীর দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো একটা, দীর্ঘজীবন প্রচন্ড কষ্টকর! আশেপাশের স্বল্প আয়ুর মানুষ গুলো, যাদের সাথে জড়িয়ে আছে ওর হাজারো স্মৃতি তারা একে একে পৃথিবী ছেড়ে বিদায় নিচ্ছে প্রতিনিয়ত, রোজ চেনাজানা কারো না কারো মৃত্যুসংবাদ!

এই জন্যইকি তবে ওর পরিবারের কোনো পুরুষ সদস্য বিয়ে করতে আগ্রহী নয়? এত এত ভালোবাসার পর ভালোবাসার মানুষকে ক্রমে ক্রমে শেষ বয়সে যেতে দেখা, চামড়া কুচকে যেতে দেখা, দৃষ্টি ক্ষীণ হতে দেখা, চোখের সামনে মৃত্যুবরণ করতে দেখাটা ঠিক কতখানি ধৈর্যের পরিচয়!
ওর মনে আছে ওর জন্মের পর ওর বাবা ওর মাকে কখনোই দেখতে আসতেন না, মাকে শুধু ও একাই দেখতে যেতো! ওর আদরের মা টা ওকে এক পলক দেখার জন্য হাপিত্যেশ করতেন, সারাটাক্ষন খোঁজ নিতেন কখন তার নাড়ী ছেড়া ধন দেখা করতে আসবে তার সাথে!

সালিমের মায়ের ক্ষেত্রেও তাই, চাচাজান সালিমের মাকে কখনোই দেখতে যেতেন না। এই কি তবে কারণ?
তারা কি মায়া বাড়াতে চাননি? নইলে নিজের সন্তানের মাকে কেন দূরে সরিয়ে দিবেন!
মীরের চোখের সামনে হঠাৎই ভেসে উঠলো আনাবিয়ার শুভ্র, সুন্দর চেহারাটা! কি হতো যদি ওর শিনজো আজ দেমিয়ান শেহজাদী না হয়ে সাধারণ কোনো মেয়ে হতো? যদি হামদান নোমানের মতো ওর শিনুও ওকে একটা সময়ে একা করে দিয়ে চলে যেতো? কি হতো তখন?

নাহ, ও ভালোবাসতো না, কখনোই ভালোবাসতো না ওকে। নিজের পূর্বপুরুষদের মতোই গতানুগতিক জীবনধারায় সঁপে দিতো নিজেকে। আনাবিয়ার মৃত্যুকালীন দৃশ্যটা কল্পনা করতেই গলা আঁটকে আসলো মীরের, নিঃশ্বাস বন্ধ হতে নিলো, কাঁপতে শুরু করলো ওর হাতের আঙুলের ডগা! তড়িতে টেবিলের ওপর থাকা পানি ভর্তি গ্লাসটা উঠিয়ে নিয়ে এক চুমুকে শেষ করে দিলো পানিটুকু।

আকাশের দিকে মুখ তুলে চোখ জোড়া বন্ধ করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মীর একটা। ওর চোখের সামনে ওর শিনুর মৃত্যু দেখার আগেই ওর নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাক, চোখজোড়া আর না খুলুক কখনো!
মীরের আর অপেক্ষা সহ্য হলোনা, মুহসিনের অপেক্ষায় না থেকে এবার নিজেই উঠে গেলো ওর নাম করণ করা ‘দ্যা রয়্যাল জ্যু’ কামরার উদ্দেশ্যে।
কিন্তু নিজের কামরার দরজা খুলে বের হতেই ওর সামনে পড়লো আনাবিয়া, ধাম করে আনাবিয়ার সাথে ধাক্কা খেলো ও, আনাবিয়া মীরের বুকে বাউন্স করে পিছিয়ে গেলো দুকদম।
নিজের আঘাত লাগা বক্ষে দুবার হাত বুলিয়ে মীরের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে ও ধমকের সুরে বলে উঠলো,
“দেখে চলতে পারোনা? হাতির মতো শরীর নিয়ে খাম্বার মতো দরজায় দাঁড়িয়ে আছো কেন?”
মীরের ওসব দেখার সময় হলোনা। ও দ্রুত পায়ে ছুটে এসে জড়িয়ে নিলো আনাবিয়াকে নিজের সাথে, তারপর জড়িয়ে ধরেই উচু করে নিয়ে গেলো কামরায়, আর এরপর বিছনায় নিয়ে গিয়ে চুমুতে চুমুতে ভরিয়ে দিলো ওর সমস্ত মুখ, বুক, শরীর!

সকালবেলা আনাবিয়ার যখন ঘুম ভাঙলো তখন ঘড়ির কাটা আটটা ছুই ছুই। এত বেলা কখন হলো সেটা ভেবেই কপাল চাপড়ালো ও।
মীর বরাবরের মতোই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে ওকে। মীরের শক্তপোক্ত বাহুবন্ধনী থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলো ও কিছুক্ষণ, কিন্তু পেরে উঠলোনা।
এই কালাভুনাটা এত্ত শক্ত করে ওকে জড়িয়ে রাখে রোজ যে প্রত্যেক সকালেই ওকে মীরের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হয় এক দফা৷ সারারাত এতটুকু মুহুর্তের জন্যেও আনাবিয়াকে নিজের থেকে দূরে যেতে দেয়না ও কখনো!

আরও কিছুক্ষণ নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও যখন পেরে উঠলোনা তখন হাল ছেড়ে দিয়ে আনাবিয়া এবার নিজেও ঘুরে মীরের দিকে ফিরে মীরের বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে ওকে জড়িয়ে নিয়ে শুয়ে রইলো।
মীরের মুখে ফুটে উঠলো হাসি, চোখ মেলে তাকিয়ে ও টুক করে একটা চুমু খেলো আনাবিয়ার চুলের ওপর দিয়ে।
আনাবিয়া ভ্রুকুটি করে ওর বুক থেকে মুখ তুলে তাকালো ওর দিকে, মীরের ঠোঁটে খেলে চলা হাসি প্রসারিত হলো আরও। আনাবিয়া তেজি কন্ঠে বলে উঠলো,
“ইচ্ছে করে এরকম করো প্রত্যেকদিন!”

মীর নির্বিকার চোখে তাকিয়ে উপর নিচে মাথা নেড়ে সায় জানালো। আনাবিয়া কিছুক্ষণ সেন্টি খাওয়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে, আর তার পরমুহূর্তেই ক্ষিপ্র গতিতে টিপে ধরলো মীরের গলা!
শব্দ করে হেসে উঠলো মীর, ওর শিনুর গলা টিপে ধরার অভ্যাস কোনোদিনও যাবেনা! এক হাতে আনাবিয়ার হাত জোড়া গলা থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আনাবিয়ার হাতের ওপর চুমু খেলো ও পরপর কয়েকটা।
আনাবিয়া হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ওর দিকে পাশ ফিরে শুয়ে থাকা মীরকে ঠেলে শুইয়ে দিলো সোজা করে তারপর নিজেও মীরের ওপর উঠে মীরের বুকে হাত ঠেকিয়ে ওর মুখের ওপর মুখ নিয়ে গিয়ে আদুরে গলায় বলে উঠলো,
“ঘুরতে নিয়ে চলো আমাকে, ভাল্লাগছেনা এভাবে ঘরবন্দী থাকতে!”
“কোথায় যেতে চাও তুমি?”

আনাবিয়ার কপালের ওপর এসে পড়া চুলগুলোকে সরিয়ে কানের গোড়ায় গুজে দিতে দিতে শুধালো মীর। আনাবিয়া ওর সমস্ত ভরটুকু মীরের ওপর ছেড়ে দিয়ে মীরের চোয়ালে চোয়াল ঠেকিয়ে বলে উঠলো,
“জানিনা আমি, যেখানে ভাল্লাগে নিয়ে চলো, তবুও নিয়ে চলো!”
“বাচ্চাদেরকে সাথে নেওয়া যাবেনা, রাজি থাকলে নিয়ে যাবো তোমাকে। ”
আনাবিয়ার চোয়ালে চোয়াল ঘষে দিয়ে বলল মীর। বাচ্চাদেরকে নেওয়া যাবেনা শুনে আনাবিয়া মীরের চোয়ালের ওপর থেকে সরে এসে ওর মুখোমুখি হয়ে হতাশ ভঙ্গিতে ভ্রু তুলে শুধালো,

“ওদের সাথে তোমার কিসের এত শত্রুতা বলোতো! ওদেরকে তুমি সহ্যই করতে পারোনা, কেন?”
“ওরা আমার সম্পদে ভাগ বসিয়েছে। তুমি আমাকে যে সময় দিতে তার সিংহভাগ এখন ওরইা পায়। তোমার মনোযোগ, ভালোবাসা, সময়, আদর, যত্ন, খেয়াল সমস্তকিছুতে ওরা এসে ভাগ বসিয়েছে। অথচ এসবের সমস্তটাই আমার পাওয়ার কথা ছিলো! কিন্তু আমি পাচ্ছিনা, তুমি আমাকে দিচ্ছোনা!”
“তুমি যে এত হিংসুটে সেটা আমার জানা ছিলোনা মীর! ছোট ছোট বাচ্চাদেরও তুমি হিংসা করো! আগে তো কোকোকে রোজ লেজ ধরে নিয়ে নোমানের গায়ে ছুড়ে দিয়ে আসতে, এখন তো তবুও একটু নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করো!”

“আমার অধিকারের জিনিসপত্র আর যদি একটুও এদিক ওদিক হয়েছে তবে সবগুলোকে এবার একেবারে বাইরে ছুড়ে দিয়ে আসবো, মাইন্ড ইট!”
“কথায় কথায় মাইন্ড ইট মাইন্ড ইট করবানা মীর! নইলে কিন্তু তোমার মাইন্ডে ইট মারবো বলে দিলাম।”
মীর চুপ হয়ে গেলো, আনাবিয়া কিছুক্ষণ ওর দিকে তেজি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে একটা শক্তপোক্ত চুম্বন বসালো ওর কালো রঙা পুরুষালি ঠোঁটের ওপর।
এমন সময়ে দরজায় কড়া নাড়লো কেউ। আনাবিয়া চমকে তাকালো সেদিকে, বিরক্ত হলো মীর। শালার মানুষ জন বিরক্ত করার আর সময় পায়না!
আনাবিয়া মীরের ওপর থেকে নেমে মীরের চুলগুলো হাতের মুঠিতে নিয়ে একটু টানাটানি করে বিছানা থেকে নেমে চলে গেলো নিজের কামরায়। মীর নিজেকে ঠিকঠাক করে নিয়ে বাইরের নক করা ব্যাক্তির উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,

“এসো!”
মীরের আদেশ পেতেই দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো আরমান, হাতে ওর প্রচন্ড নকশাদার একটা ইনভিটেশন কার্ড। মীর ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে উঠে দাড়ালো বিছানা ছেড়ে।
আরমান এগিয়ে এসে ওর দিকে হাতের খামটা দুহাতে বাড়িয়ে ধরে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, নওয়াস জাবিন পাঠিয়েছেন কুরো আহমার থেকে৷”
আরমানের হাত থেকে খামটা নিলো মীর, আরমানের দিকে ইশারা দিলো বাইরে যাওয়ার জন্য।
আরমান মীরের আদেশ পেয়েই বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে। মীর উলটে পালটে দেখলো সেটা; ইনভিটেশন কার্ড, সেটাও বিয়ের!

কার্ডটা খুলে দেখতে দেখতে ও এগোলো আনাবিয়ার কামরার দিকে। আনাবিয়া তখন গোসলের প্রস্ততি নিচ্ছে, ইয়াসমিন বাথটাবে ওর জন্য গোসলের পানি প্রস্তুত করছে। মীর কামরায় ঢুকতেই ইয়াসমিন দ্রুত পায়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এসে ওকে আনুগত্য জানিয়ে চলে গেলো বাইরে।
মীর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আনাবিয়ার দিকে এগিয়ে এসে কৌতুকপূর্ণ কন্ঠে বলে উঠলো,
“ফারিশের বিয়ে।”

মীরের কথায় প্রথমে চমকালেও মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আনাবিয়া। অবশেষে ছেলেটা বিয়ে করছে! এতগুলো দিন ধরে নওয়াস চাচাজান ওকে বিয়ে করাতে পারেননি৷ আনাবিয়ার প্রেমে দেউলিয়া হয়ে এত যাবৎকাল অবিবাহিত থেকেছে ও।

নওয়াসের বয়স হয়েছে বেশ, ছেলের একটা গতি না করে দিয়ে তিনি কোনোভাবেই স্থীর হতে পারছিলেন না। ওদিকে ফারিশও বিয়ে করতে রাজি নয়! তাকে এত মেয়ের খোঁজ দেওয়া হয় কিন্তু সে কাউকে দেখবেই না!
শেষমেশ নওয়াস এসে মীরের দারস্থ হলেন, যে ভাই তুমি ওকে একটু বুঝাও, তুমি বোঝালেই ও শুনবে এ ছাড়া অন্য কারো কথা শুনবে না। সেদিন মীর ফারিশকে নির্জনে ডেকে নিয়ে ঠিক কি বলেছিলো সেটা কেউ জানেনা, কিন্তু তারপরেই ফারিশ রাজি হয়ে গেলো বিয়ে করতে।
সেদিন মীরের কথার পর যে মেয়েটার সন্ধান নওয়াস প্রথমেই নিয়ে এলেন সেই মেয়েটাকেই বিয়ে করার জন্য এক বাক্যে রাজি হয়ে গেলো ফারিশ।

আনাবিয়া এগিয়ে এসে মীরের হাত থেকে কার্ডটা নিজের হাতে নিয়ে দেখলো, অবশেষে আপদ বিদায় হচ্ছে। মীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে। ওর মুখে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় কিনা সেটা পরখ করলো শকুনি দৃষ্টিতে।
আনাবিয়া কার্ডের ওপর থেকে চোখ তুলে ওর দিকে তাকিয়ে শুধালো,
“একটা সত্যি কথা বলোতো, ফারিশকে তুমি সেদিন কি বলেছিলে?”
“বলতেই হবে?”
আনাবিয়ার দিকে দুকদম এগিয়ে এসে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে জিজ্ঞেস করলো মীর। আনাবিয়া কার্ডটা বন্ধ করতে করতে বলল,

“বলার মতো হলে বলো, বলার মতো না হলে প্রয়োজন নেই৷”
“ওকে বলেছিলাম ও যদি তোমার প্রেমে দিওয়ানা থেকে বিয়ে করতে রাজি না হয় তবে মুহসিনের মতো ওকে খোজা করে প্রাসাদে রেখে দেবো, সারাদিন তোমার আশেপাশে থাকবে, চব্বিশ ঘন্টা তোমার সেবা যত্ন করবে।”
আনাবিয়া হেসে উঠে বলল,
“স্রিয়াসলি?”
“জ্বি আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান! ফারিশ জাবিন তার ভালোবাসার থেকে তার পুরুষত্বকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে!”
“ওহ আচ্ছা! তো তোমার সামনে যদি কখনো এমন অবস্থা আসে যে তোমার স্ত্রী নয়তো অন্যকিছু তবে তুমি কোনটাকে বেছে নেবে শুনি?”
“সাম্রাজ্য ছাড়া অন্য সকল ক্ষেত্রে তোমাকে।”

“ওহ আচ্ছা! তবে তোমার সাম্রাজ্যের প্রশ্ন আসলে তুমি সাম্রাজ্যকে বেছে নেবে আর আমাকে ফেলে দেবে?!”
“উহু, ফেলবোনা। আমি দুটোকেই আমার কাছে রাখবো, তাই সে যেভাবেই হোকনা কেন! বাই হুক অর বাই ক্রুক, দুটোর একটাকেও আমি ছাড়তে পারবোনা।
সাম্রাজ্য যদি আমার মস্তিষ্ক হয় তবে তুমি আমার হৃদপিণ্ড। তুমি আমার প্রাণের সুখ, তোমাকে ছাড়া আমি সাম্রাজ্য চালাতে পারবোনা, আর সাম্রাজ্য ছাড়া আমি নিজেকে চালাতে পারবোনা। আমি হবো মস্তিষ্কবিহীন, বিবেক বর্জিত কোনো প্রাণীর ন্যায়!”

মীরের কন্ঠস্বর দৃঢ়। আনাবিয়া কিছুক্ষণ ওর দিকে চোখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে পেছন ঘুরিয়ে গোসলে যেতে নিলো। মীর দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ওর হাত ধরে হ্যাচকা টানে নিজের বুকে আছড়ে ফেলে দিয়ে ওকে দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে ওর বক্ষবিভাজিকার দিকে নেশালো দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“যাওয়ার আগে আমাকে একটু আদর দিয়ে যাও প্লিজ! বেশি না, শুধু একটা ঘণ্টা সময় দাও প্লিজ প্লিজ!”
“এই চোখ কোথায় তোমার? আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা বলো। আমার মুখ ওখানে না এখানে, এদিকে।”
নিজের মুখের দিকে নির্দেশ করে তেজি গলায় বলল আনাবিয়া। মীর সেদিক থেকে চোখ না সরিয়েই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠলো,

“বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর জিনিস দেখছি, চোখ সরানো যাবেনা। তুমি এখন আমাকে আদর দিবে কিনা বলো!”
“একদমনা, সরোহ! আমি এখন গোসলে যাবো, আমাকে একদম বিরক্ত করবেনা। তোমার সাম্রাজ্যকে গিয়ে আদর করো যাও, সরো আমার সামনে থেকে!”
নিজেকে মীরের আলিঙ্গন থেকে মুক্ত করার জন্য হাতপা ছোড়াছুড়ি করতে করতে তেজি গলায় বলল আনাবিয়া। মীর হেসে উঠে বলল,
“আরে আরে, হিংসুটে মহিলা! আমি কি সাম্রাজ্যের সাথে বিছানায় যাই? যাই তো তোমার সাথে! এখনো যেতে চাচ্ছি, প্লিজ শিনু!”
“আমি গোসলে যাবো, দেরি হয়ে যাচ্ছে আমার, ছাড়ো বলছি!”
“তাহলে আমিও আসছি।”

“একদম না, তুমি আসলে আমার গোসল এই জীবনে আর হবেনা, আমি সেটা ভালোভাবেই জানি। স্যো সরো।”
মীর সরলোনা। হাতপা ছুড়তে থাকা আনাবিয়াকে কোলে তুলে নিয়ে ছুড়ে দিলো বিছানায়।
৫৬. আনাবিয়ার ঘুরতে যাওয়ার শখ পূরণ করতে ওকে নিয়ে রেড জোনের ভেতর ঘুরতে এসেছে মীর।
অ্যানিম্যাল টাউনের পাশেই শিকারী পাখিদের বিশাল বাসস্থান৷ গাছের ওপর ট্রি হাউজ বানিয়ে তাদের বসবাস৷ মীর আনাবিয়াকে এর আগে কখনো এখানে নিয়ে আসেনি, আজই প্রথম!
আনাবিয়া খুশিতে লাফালাফি করছে, মীর জানে এই মেয়েটির মন কিভাবে ভালো করতে হয়। তাকে নিয়ে এসে শুধু এই রেডজোনে ছেড়ে দিতে হবে, ব্যাস!

সে গিয়ে লাইফট্রির আশেপাশে কিছুক্ষণ ঘুরঘুর করে লাইফট্রির ডালপালার সাথে কিছুক্ষণ ঘষাঘষি করে পাশের ডোবাটায় ইচ্ছেমতো ডুবিয়ে গোসল করে, জঙ্গল ঘুরে, ব্যাঙ ছুড়ে সেই আনন্দ উচ্ছাস করে ফিরবে প্রাসাদে।
এখনো সে এগাছ থেকে ওগাছের তলায় ছুটে বেড়াচ্ছে। শুকনো পাতা দিয়ে ভর্তি হয়ে আছে সমস্ত এরিয়াটা, তারই ওপর দিয়ে অনাবৃত পায়ে ছুটে চলেছে ও।
মাঝে মাঝে আবার পিছু ফিরে ধীর পায়ে ওর আনন্দ উচ্ছাস দেখতে দেখতে হেটে চলা মীরের কাছে এসে মীরকে জ্বালিয়ে যাচ্ছে।

মীর উপভোগ করছে প্রচন্ড! এই মেয়েটির খিলখিলে হাসি ওর কর্ণকুহরে সুমধুর সঙ্গীতের ন্যায় ঠেকে, মুহুর্তেই ওর বুকের ভেতরে জমা সমস্ত পেরেশানি উধাও হয়ে যায়, হালকা হয়ে যায় ওর কাজের চাপে ভার হওয়া মস্তিষ্ক!
বিরাট বিরাট ডালপালা ওয়ালা গাছের ওপরে থাকা ট্রি হাউজ গুলো থেকে উৎসুক দৃষ্টি ফেলে ওদেরকে দেখে চলেছে সেখানের অধিবাসীরা। চোখে মুখে তাদের ভয় আর কৌতুহল, বাদশাহর আজ হঠাৎ করে এখানে আগমনের কারণ ঠাহর করতে পারলোনা ওরা।

সেখানের শিকারী পাখিগুলোর পুরুষ সদস্যেরা এই মুহুর্তে কেউই উপস্থিত নেই।
তাদের প্রধান কাজ হলো পঞ্চদ্বীপের সীমানা প্রদক্ষিণ করে চব্বিশ ঘণ্টা নজরদারি করা। বহির্বিশ্ব থেকে সামান্য কোনো কিছুর আভাস পেলেই সেটা কর্তব্যরত ব্যাক্তিকে জানানো।
ভেসে আসা কোনো ভাঙাচোরা যুদ্ধ জাহাজ, কোনো বেঁচে যাওয়া ব্যাক্তি, ঝড়ের কবলে পড়া কোনো মালবাহী জাহাজ, মাছ ধরার বিশাল ট্রলার; স্রোতের তোপে ভেসে আসা এ সমস্ত কিছুই তারা রাখে নখদর্পনে!
বাচ্চাহীনা মেয়ে সদস্যগুলোর কাজ শিরো মিদোরির সীমানা পাহারা দেওয়া। কেউ যদি কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত, নিয়মবহির্ভূত ভাবে শিরো মিদোরিতে প্রবেশের চেষ্টা করে তবে তাকে সেখানেই শেষ করে দিয়ে সমুদ্রের হাঙরের খাবার বানানো।

দিনেরবেলাটা তাই অধিকাংশ সদস্যই অনুপস্থিত, আর যারা উপস্থিত তারা বেশিরভাগই বাচ্চাপালনে ব্যাস্ত।
শুকনো পাতার ওপর দিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে হাটতে থাকা আনাবিয়া হাতের স্পর্শ দিয়ে সজিব করে চলেছে সেখানের নির্জীব হয়ে থাকা গাছগুলোকে। মুষড়ে পড়া লতাপাতা গুলো আবার মাথা তুলে খড়খড়িয়ে উঠছে ওর স্পর্শে!
মীর এমন সময় পেছন থেকে বলে উঠলো,
“এবার প্রাসাদে ফিরে চলুন ম্যাম, অনেক ঘোরাফেরা হয়েছে। প্রাসাদে ফিরে আপনাকে ঘুরতে নিয়ে আসার পুরষ্কার হিসেবে আমাকে কয়েকঘন্টা সময় দিবেন।”
মীরের কথায় লাফানো থেমে গেলো আনাবিয়ার, ভ্রু কুটি করে ঘুরে তাকিয়ে ও তেজি কন্ঠে বলে উঠলো,
“তোমার মাথায় কি চব্বিশ ঘণ্টা এসবই ঘোরে বলোতো!”

“উহু, যতক্ষণ জেগে থাকি ততক্ষণ ঘুরে।”
“বিশ্বাস করলাম না, কারণ তুমি ঘুমের ঘোরেও বহুকিছু করে ফেলো!”
নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল আনাবিয়া। মীর হোহো করে জঙ্গল কাপিয়ে হেসে উঠলো ওর কথায়, দৃশ্যমান হলো ওর তীক্ষ্ণ, ঝকঝকে দাঁত গুলো!
আনাবিয়া পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ওর হাসিমুখের দিকে, এই মানুষটা সবসময় এমন প্রাণখুলে হাসেনা কেন? ওর প্রতিটা হাসিতে যে ও ঘায়েল হয়!
আনাবিয়াকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে হাসি থামালো মীর। ঠোঁটের কোণে তখনো লেগে রইলো মিষ্টি হাসি, এক ভ্রু উঁচু করে ও বলল,

“তাহলে চব্বিশ ঘন্টাই, স্বীকার করলাম।”
এমন সময় আনাবিয়ার থেকে খানিকটা দূরে ধুপ করে শব্দ হলো কোনো কিছুর, ওপর থেকে পড়েছে কিছু একটা।
আনাবিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সেদিকে একবার, সেখানে খুব ক্ষীণ পরিমানে নড়ে উঠলো কিছু একটা।
আনাবিয়া মীরের দিকে এক পলক তাকিয়ে দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। মীরও এগোলো ওর পেছন পেছন।
আনাবিয়া গিয়ে দেখলো সেখানে পড়ে আছে একটা ছোট্ট বাজপাখির বাচ্চা। গায়ে পশম ওঠেনি এখনো তার, সমস্ত শরীরে আঘাতের চিহ্ন, আঘাত গুলো কয়েকদিনের পুরোনো। হয়তো কোনো শিকারী পাখি আক্রমণ করেছিলো একে।

আনাবিয়া নিচে ঝুকে হাতে তুলে নিলো বাচ্চাটা, কেঁপে কেঁপে উঠছে সেটা থেকে থেকে। চোখও ফোটেনি তার এখনো!
আনাবিয়া মায়াভরা দৃষ্টিতে দেখলো বাচ্চাটার দিকে একবার, তারপর তাকালো উপরের দিকে, ঠিক কোন গাছ থেকে বাচ্চাটা পড়ে গেছে সেটা ঠাহর করার চেষ্টা করলো।
মীর ওর পেছনে আসতেই ও বলে উঠলো,
“দেখো, বাচ্চাটা পড়ে গেছে বাসা থেকে, ওকে ওর বাসায় তুলে দিয়ে আসি?”
“ও পড়ে যায়নি, ওকে ফেলে দেওয়া হয়েছে।”
আনাবিয়ার মুখপানে তাকিয়ে বলল মীর, মীরের কথায় এক প্রকার আঁতকে উঠলো আনাবিয়া, অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালো,

“ফেলে দিয়েছে? কে ফেলে দেবে, এতটুকুন একটা বাচ্চা!”
“ওর মা ফেলে দিয়েছে শিনু, দেখছো না বাচ্চাটার অবস্থা! ওর শরীরে আঘাত পেতে কোথাও বাকি নেই। ও আর বাঁচবে না তাই ফেলে দিয়েছে।
শুধু শুধু একটা দুর্বল প্রাণীকে পেলেপুষে কেউ বড় করেনা শিনু! প্রাণিজগৎ বড়ই নিষ্ঠুর, এখানে দুর্বলদের কোনো স্থান নেই, এদেরকে সম্পুর্ন ত্যাগ করা হয় এবং ত্যাগ করে তার নিজেরই পরিবার।”
আনাবিয়া করুণ দৃষ্টিতে তাকালো হাতের বাচ্চাটার দিকে, বেঁচে থাকার আকুতি তার চোখে মুখে, একটু নড়াচড়া করার জন্য কি প্রাণপণ চেষ্টাটাই না সে করছে!
আনাবিয়া মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলো বাচ্চাটাকে, আর মীরের সামনে ভেসে উঠলো ওর শৈশবের দুর্বিষহ স্মৃতি গুলো!

তাকেও কি ত্যাগ করা হয়নি? সে স্বাভাবিক দেমিয়ান সন্তান ছিলোনা বলে তার বাবা আর কখনো ফিরেও তাকালোনা তার দিকে! এক মা আর দাদাজানের ছায়াতলে সে পার করে দিলো নিজের সমস্ত শৈশব, কৈশর, যৌবনের একাংশ!
কিন্তু সে যখনি শক্তিশালী হলো, দুর্গম হলো, হলো ইস্পাতের ন্যায় কঠিন তখনি তার কদর বাড়লো সবখানে! সে পেতে শুরু করলো তার বাবার মনোযোগ, সে আকর্ষণ করতে শুরু করলো অন্য সকলের দৃষ্টি!
সেদিন যদি ও নিজেকে পরবর্তন না করতো, স্রোতে গা ভাসিয়ে দিয়ে মেনে নিতো নিজের ওপর হওয়া সমস্ত অবিচার তবে ওর স্থান আজ কোথায় হতো? লাইফ ট্রি কি কখনোই তাকে বাদশাহ হিসেবে চ্যুজ করতো?
করতোনা, ওকে ওর মতো করেই মরতে দিতো, পঁচতে দিতো ডার্ক প্যালেসে!
আজ শুধুমাত্র নিজের দৃঢ় অধ্যাবসায়য়ের কারণে ও এখানে। আজ ওর কোনো অপূর্ণতা নেই; ওর এক হাতে বিশাল সাম্রাজ্য অন্যহাতে ওর পরমাসুন্দরী মমতাময়ী স্ত্রী, যার বুকে কেটেছে ওর শত সহস্র রাত, যার স্পর্শে উধাও হয় ওর সমস্ত ক্লান্তি, দুঃখ, হতাশা!

স্মৃতির পাতার ভেতর থেকে বের হয়ে এসে মীর তাকালো আনাবিয়ার দিকে, বলে উঠলো,
“বাচবেনা ও শিনু! ওকে ওখানেই ফেলে আসো। ওর আঘাত গুলো দেখছো? ওর নড়াচড়া করার মতো শক্তিটুকুও অবশিষ্ট নেই। ওকে ওর মতোই থাকতে দাও। কপাল জোরে বেঁচে গেলে যাবে, আর না গেলে মরবে। দ্যাটস দ্যা রুল অব ন্যাচার!”
আনাবিয়া এক পলক মীরের দিকে তাকিয়ে আবার পাখিটার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“না, আমি ওকে নিয়ে যাবো আমার সাথে। ওকে সুস্থ করে তুলবো, পরবর্তীতে মারা গেলে যাবে কিন্তু একে আমি এখানে কিছুতেই ফেলে রেখে যাবোনা!
ও কত্ত ছোট, ওকে এখানে রেখে গেলে খেয়ে ফেলবে পিপড়েতেই! ওর কত কষ্ট হবে বলো! ওকে আমি কিছুতেই এখানে রেখে যাবোনা।”

“ওর মায়ের তো কষ্ট হয়নি ওকে ফেলে দিতে শিনু! ওকে রেখে এসো, শুধু শুধু প্রাসাদে একটা জঞ্জাল বাড়ানোর কোনো প্রয়োজন নেই।
এমনিতেই তোমার জন্য আমার প্রাসাদে আমারই রয়্যাল ফ্লোরে আমাকে চিড়িয়াখানা দিতে হয়েছে, সেখানের আর কোনো সদস্য আমি বাড়াতে চাইনা!”
“তুমি ওই নাম টা দিয়েছো কেন? একটা সুন্দর নাম দিবে তা না, উনি নাম দিয়েছেন ‘দ্যা রয়্যাল জ্যু’! আমার বাচ্চাগুলোর সম্মান নিয়ে টানাটানি করার জন্য এমন নাম দিয়েছো তুমি!”
“ওহ আচ্ছা! তো জানোয়ার কে জানোয়ার ছাড়া কি বলতে হয়? পুতুল? তাহলে আজ গিয়ে লিখে দেবো দ্যা রয়্যাল ডল হাউজ!”

বলে ভ্রু নাচালো মীর, আনাবিয়া মুখ বেকালো ওর দিকে, তারপর দৃঢ় গলায় বলে উঠলো,
“আমি একে নিয়ে যাবোই! আমি কোনো কথা শুনবোনা, এটাই শেষ। আ’ সয়্যার মীরি, আর কোনো প্রাণিকে আমি প্রাসাদে তুলবোনা প্রমিজ।”
“এই একই কথা তুমি প্রত্যেকবারই বলেছো তাই আমি আর বিশ্বাস করছিনা।”
“ওফ্! মীর এবারই শেষ, এইটাই শুধু, একটা পাখিইতো!”
ঠোঁট উলটে ভ্রু তুলে বলল আনাবিয়া।
ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো মীর, এভাবে তাকালে আর কিভাবে না করা যায়! দীর্ঘশ্বাস ফেলে ও বলে উঠলো,
“ঠিক আছে, তবে এবারই শেষ! মাইন্ড ইট।”
“কথায় কথায় মাইন্ড ইট মাইন্ড ইট করবানা আগেই বলে দিয়েছি। তোমার মাইন্ডে কিন্তু এবার সত্যি সত্যিই ইট মারবো!”

৫৭. আজ ফারিশের বিয়ে। আনাবিয়া প্রস্তুত হচ্ছে ওর কামরায়, মীরের নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তৈরি করে নিয়ে আসা মেরুণ রঙা নকশাদার লেহেঙ্গায় নিজেকে সাজিয়ে তুলেছে ও।
ওর শুভ্র ত্বকের ওপর মেরুণরঙা লেহেঙ্গাটা রক্তগাঁদার ন্যায় ফুটে উঠেছে। চুলগুলোকে একটা বিরাট এলোমেলো খোপায় সাজিয়ে রেখেছে ও।
ইয়াসমিন প্রস্তুত হতে সাহায্য করছে ওকে। এমন সময় ওর কামরার দরজা ঠেলে ভেতরে এলো মীর, ও আসা মাত্রই ইয়াসমিন আনুগত্য জানিয়ে দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে।
আনাবিয়াকে দেখা মাত্রই থমকে গেলো মীর! মুগ্ধ, বিস্মিত দৃষ্টিতে ও তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে।
আনাবিয়া গায়ের পোশাকটা আর একটু ঠিকঠাক করে নিতে নিতে মীরের দিকে না তাকিয়েই শুধালো,
“কেমন লাগছে আমাকে?”
মীর ধীর পায়ে এগিয়ে এসে আনাবিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে ওর দিকে অপলক, তন্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে মোহনীয় গলায় বলে উঠলো,

“এক টুকরো জান্নাতের মতো! যার ওপর থেকে চোখ সরানো অসম্ভব, এক প্রকার দুঃসাহস!”
বলেই আনাবিয়ার কপালে ঠোঁট স্পর্শ করে একটা স্নিগ্ধ চুমু খেলো ও। আনাবিয়া স্নিগ্ধ হেসে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলো ভালোলাগায়!
মীর ওর কপাল থেকে ঠোঁট সরিয়ে আর একবার আপাদমস্তক দেখলো আনাবিয়াকে, আনাবিয়া এরই মাঝে মীরের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলে উঠলো,
“উয়িম্মা, কে দেখো পাঞ্জাবি পরেছে! সর্বনাশ!”
মীর হেসে উঠলো ওর কথায়, দুহাতে আনাবিয়ার কোমর স্পর্শ করে ওকে টেনে নিয়ে নিজের বুকে আছড়ে ফেলে বলল,

“আজ তোমাকে আর একবার বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে! করবে আমাকে আজ আবার বিয়ে?”
“তোমার কি ইচ্ছে করছে সেটা সরাসরি বললেই পারো, এত ভণিতা করার কিছু নেই৷”
নির্বিকার গলায় বলল আনাবিয়া, মীর হেসে উঠলো হোহো করে। তারপর ওর রুপোলি রঙা হাতাগোটানো পাঞ্জাবীর পকেট থেকে বের করলো একটা নকশাদার খাপ ওয়ালা খঞ্জর।
কামরার সোনালি আলো পড়ে ঝকঝক করে উঠলো খঞ্জরের খাপের গায়ে বসানো মহামূল্যবান সুসজ্জিত পাথরগুলো।
খঞ্জরটা আনাবিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে ও বলে উঠলো,

“এইটা তোমার৷”
আনাবিয়া সেটা হাতে নিয়ে মীরের দিকে দ্বিধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধালো,
“খঞ্জর! হঠাৎ খঞ্জর দিলে কেন?”
“ভালো লেগেছে কিনা সেটা বলো।”
“খুব ভালো লেগেছে। এটা কত্ত সুন্দর! তুমি কই থেকে আনিয়াছো?”
খঞ্জরটার গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে শুধালো আনাবিয়া, মীর আনাবিয়ার সন্তুষ্ট চেহারাটার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলো,

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৩+২৪

“এটা আমি তৈরি করেছি, তোমার জন্য। এইটা এখন থেকে সর্বক্ষণ নিজের কাছে রাখবে, ওকে?”
আনাবিয়া খঞ্জরটার দিকে নজর রেখেই উপর নিচে মাথা নাড়ালো। মীর ওর নরম চোয়াল দু আঙুলে টেনে দিয়ে বলল,
“চলুন বেগম, যাওয়া যাক আপনার পাত্তা না পাওয়া প্রেমিকের বিয়েতে।”

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৭+২৮

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here