বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩১+৩২
রানী আমিনা
সকালের ঝরঝরে সোনালি আলো এসে পড়ছে কিমালেবের সারি সারি পাহাড়ের চুড়ায়৷ রিসোর্টের চারপাশে থাকা গাছ গুলোর পাতায় পাতায় জমে আছে শিশির, টুপ টুপ শব্দ করে মাঝে মাঝে পড়ছে সেগুলো মাটিতে৷ শিরো মিদোরির সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের গর্জন ভেসে আসছে দূর থেকে, সেই সাথে চায়ের ঝাঁঝালো গন্ধ মিলেমিশে একাকার হয়ে আছে।
রিসোর্টের সামনে, খোলা আকাশের নিচে রাখা বড়সড় টেবিলের চারপাশ ঘিরে বসে আছে বাচ্চারা সকলে। চায়ে চুমুক দিচ্ছে ওরা অল্প অল্প করে৷
কোকো হাইনা আর লিও রিসোর্টের পিছে ব্যাস্ত আছে মীরের দেওয়া কাজে৷ ফ্যালকন টেবিলের এক কোণায় চুপটি করে বসে আছে, এসব খুনোখুনির ভেতর ও যেতে পারেনা কখনো। ওর দুর্বল হৃদয়, এসব দেখতে পারেনা ও, চোখ মুখ ওর উলটে আসে!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
রিসোর্টের বারান্দায় স্তব্ধ হয়ে বসে আছে অলিভার, ইব্রাহিম, জারা, গ্রেস আর লেইলা। দলের দশ জনের এক জনকে তো ভারডানশিয়ায় সওদা করে এসেছে কোনো বর্বরের নিকট, আর এখানে এসে অন্য চারজন হাওয়া৷
রাতের বেলা কোকো নামক লম্বা চওড়া ভয়াবহ শরীরের অধিকারী ছেলেটা এসে দফায় দফায় নিয়ে গেছে বাকিদের। প্রথমে ইসাবেলা আর ইথান, তারপর এলিজা আর এরপর জিবরান। কোথায় নিয়ে গেছে জানেনা ওরা। তবে ওরা আর ফিরে আসেনি।
নূরেরও কোনো পাত্তা পাওয়া যায়নি, সেই যে বিশালাকার লোকটার কাছে ওকে সোপর্দ করে দিয়ে ওরা ভালোয় ভালোয় কেটে পড়েছিলো তারপর থেকে নূরের কোনো খোঁজ আর জানেনা ওরা৷
কোকো নামক ছেলেটার কাছে নূরের কথা একবার সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলো জারা, কিন্তু ছেলেটা উত্তরে শুধু খেয়ে ফেলা চোখে তাকিয়েছে ওর দিকে।
ভয় পেয়ে জারা আর দ্বিতীয় শব্দ করার মতো স্পর্ধা করেনি। নূরকে সবাই মিলে কিভাবে ফাসিয়ে ওই অজানা অচেনা লোকটির কাছে বিকিয়ে এলো সেটা মাথায় আসছেনা ওর এখনো, ও নিজেও পরিস্থিতির চাপে পড়ে মুখ ফুটে কিছু বলতে পারেনি! নূরকি তেমন মেয়ে? ও বা গ্রেস হলেও মানা যেতো, অফারটা তো ও-ই দিয়েছিলো লোকটিকে, সেটা কিভাবে ঘুরে যে নূরের দিকে গেলো! এখন কিভাবে কি হবে সেই ভাবনা ভেবে অজানা আশঙ্কায় জড়সড় হয়ে উঠলো জারা!
টেবিলে বসে ওকামি আর কাঞ্জি চা খেতে খেতে চুটিয়ে গল্প করছিলো, বাকিরা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো ওদের কথা। এমন সময় চুপচাপ বসে থাকা ফ্যালকন ওর পাশে বসে গল্প এনজয় করতে থাকা আলফাদকে রিসোর্টের বারান্দায় বসে থাকা জারা ইব্রাহিম দের দেখিয়ে শুধোলো,
“অজগর ভাই, কোকো ভাইয়া ওগুলোকে ছেড়ে দিলো কেন?”
সবাই আলফাদকে আলফাদ ডাকলেও ফ্যালকনের সাথে ওর একটু বেশি খাতির হওয়ায় আলফাদকে ও অজগর বলে ডাকে, আলফাদ যদিও তাতে খুব বেশি খুশি হয়না, কিন্তু শেহজাদীর ছোট পোলা বলে ও কিছু বলেনা।
“হিজ ম্যাজেস্টি যা আদেশ করেছেন তাই পালন করা হচ্ছে। উনি ওগুলোকে কেন ছেড়ে দিতে বলেছেন সেটা আমি জানিনা, কারোরই জানা নেই। হয়তো শেহজাদী অনুরোধ করেছিলেন, এত দিনের বন্ধুত্ব, দুর্বলতা থাকতেই পারে, দ্যাটস ইট! নইলে হিজ ম্যাজেস্টি যেমন ব্যাক্তি তাতে একটাকেও বাঁচিয়ে রাখার কথা নয়, সবগুলোকে ওপারে পাঠিয়ে দেওয়ার কথা। শেহজাদীর বিশ্বাস নিয়ে ছিনিমিনি খেলা বের হয়ে যাবে এবার সবগুলোর!”
ওদের কথার মাঝেই রিসোর্টের পেছন থেকে বীরদর্পে বেরিয়ে এলো কোকো হাইনা আর লিও। সবকটারই বুকের বোতাম খোলা শার্টের ওপর ছিটে ছিটে রক্ত, মুখে পৈশাচিক তৃপ্তির হাসি। কোকোর হাতে একটা রামদা, রক্ত টপটপিয়ে পড়ছে সেটা থেকে।
টেবিলে বসা জোভি সেদিকে তাকিয়ে ভ্রু নাচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো,
“খবর কি?”
কোকো ভ্রু তুলে মাথা নাড়িয়ে বুঝিয়ে দিলো,
“দিসি সাটিয়ে।”
ভাই বেরাদাররা ইশারায় কথা বলেই খুব মজা পেলো, দ্বিতীয় বার হৈ-হুল্লোড় শুরু হলো ওদের।
কিন্তু কোকো দের এমন কসাই মূর্তি দেখে জারা লেইলা রা ভয় পেলো প্রচন্ড, এরা কাদেরকে মেরে এলো? কোনো জন্তুজানোয়ার নাকি……!
কোকো টেবিলের দিকেই এগোচ্ছিলো, কিন্তু জারা লেইলাদেরকে এভাবে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে কোকো দিক বদলে ভারী পায়ে হেলেদুলে এগিয়ে গেলো সেদিকে। বারান্দার কাছে পৌছে হাতের রামদাটা দক্ষ কায়দায় ঘুরিয়ে কাঁধের ওপর তুলে বারান্দার পিলারে হাত ঠেকিয়ে ওদেরকে উদ্দ্যেশ্য করে হিসহিসিয়ে বলল,
“আমার আম্মার একটা সুরমাদানি কেউ ভুলবসত ভেঙে ফেললেও আমরা তার হাত ভেঙে দিই, আর সেখানে তোরা ভেঙেছিস আমার আম্মার বিশ্বাস! তোদেরকে এই রামদা দিয়ে কোপানোর জন্য আমার হাতের ভেতর নিশপিশ করছে! নেহাতই হিজ ম্যাজেস্টি বলেছেন বলে তোদেরকে আজ ছেড়ে দিচ্ছি। তবে হ্যাঁ, যদি দ্বিতীয়বার কখনো তোদেরকে সামনে পেয়েছি তবে সেদিন যেখানে যে অবস্থায় পাবো সেখানেই একদম গলা নামিয়ে দেবো, মনে রাখিস!”
কথা শেষ করে কোকো ওদের দিকে কিছুক্ষণ দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে থেকে আবার ফিরে এলো আগের মতো করে। আর কোকোর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ওরা হতভম্ব হয়ে বসে রইলো সেখানে৷
এলিজা ইথানদের কি তবে মেরে ফেলেছে ওরা! আর হিজ ম্যাজেস্টি বলতে কাকে বুঝিয়েছে কোকো! সত্যি সত্যিই কি হিজ ম্যাজেস্টির কোনো কিছুতে বাগড়া দিয়ে ফেলেছে ওরা? তবে নূর কি হয় তাঁর? নূর কি তার খুব কাছের কেউ?
বুক কেঁপে উঠলো ওদের, একে অপরের দিকে তাকিয়ে তড়িতে ভাব বিনিময় করলো ওরা, নূরের চেহারাটা মনে পড়লো ওদের, কার হাতে ভুল করে তুলে দিয়েছে ওরা নূরকে? আর এদের সাথে কোকো দেরই বা কি সম্পর্ক?
মস্তিষ্কে চলা প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে নিজেদের ভেতর অত্যন্ত চাপা স্বরে কথা বলল ওরা কিছুক্ষণ! মনে করার চেষ্টা করলো গত রাতের অদ্ভুত ব্যাক্তিটার অবয়ব!
কে সে? কি তার পরিচয়! নূরের সাথেই বা তাঁর কি সম্পর্ক? আর আম্মা বলতে কোকো কাকে বুঝিয়েছে? নূরকে? কিন্তু নূরকে কোকো আম্মা বলে সম্বোধন করবে কেন? নূরকে কি সে আগে থেকে চিনতো? যদি চিনবেই তবে ওই লোকটার হাতে তুলে দিলো কেন? আর নূর নিজেও কিছু বলল না কেন? নানা প্রশ্নে জর্জরিত হয়ে উঠলো ওদের মস্তিষ্ক। ভাব বিনিময় করেও মনমতো কোনো উত্তর না পেয়ে আতঙ্কে সিঁটিয়ে গিয়ে ওরা বসে রইলো একে অপরের গা ঘেঁষে। এখান থেকে কিভাবে বের হনে সেই চিন্তা জেঁকে বসলো ওদের মাথায়।
সেই মুহুর্তেই রিসোর্টের বিশাল গেইট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো মীর। এক হাতে আনাবিয়াকে পেছন থেকে টেনে সামনে নিয়ে এসে এগিয়ে দিলো ও বাচ্চাদের দিকে যেতে।
শব্দ শুনে তাকালো সকলে সেদিকে। বারান্দায় বসে থাকা জারা ইব্রাহিমেরাও চকিতে নজর দিলো সেদিকে। তাকাতেই ওর চোখ জোড়া থমকে গেলো ওদের!
মীরের স্বর্ণাভ চোখ জোড়ার দিকে নজর গেলো ওদের সাথে সাথেই, ওর রাজকীয় হাটার ভঙ্গিমা, প্রভাবশালী পা ফেলার দৃশ্য, শারীরিক গঠন, সম্পুর্ন টাই গতকালের লোকটির সাথে মিলে যায় যেন! তবে কি এই স্বর্ণাভ দ্যুতি ছড়ানো চোখ জোড়ার মালিক স্বয়ং হিজ ম্যাজেস্টি?
আনাবিয়াকে চিনতে সময় লাগলো ওদের, ওর অসম্ভব স্নিগ্ধতা মেশানো শুভ্র চেহারাটা বেশ কিছুক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করার পর ওরা টের পেলো নূরই!
কাজল কালো চোখ জোড়ার সেই রাতের আঁধারের ন্যায় তারা দুটি এখন হীরকখন্ডের ন্যায় ঝলমল করে উঠে জ্যোতির্ময় সৌন্দর্য ছড়িয়ে দিচ্ছে। এই নূর কে?
আনাবিয়া একটিবারের জন্যেও ফিরে তাকালোনা ওদের দিকে। মীরের হাত ধরে ও এগিয়ে গেলো বাচ্চাদের দিকে। মীরের মুখে আনাবিয়ার মান ভাঙাতে পারার গর্বিত হাসি, বউ তার অবশেষে রাগ ঝেড়েছে!
মীরের এই এক সুবিধা, বউ তার এক পশলা আদরেই সমস্ত রাগ ভুলে যায়, আর কোনো কিছুই মনে রাখেনা!
আনাবিয়াকে এক হাতে আগলে নিয়ে ও এলো টেবিলের নিকট। কোকো আর লিও হুড়ুমদুড়ুম করে চেয়ার ছেড়ে উঠে ছুটে গিয়ে আনাবিয়া আর মীরের জন্য চেয়ার নিয়ে এলো, বাচ্চারা দ্রুত হাতে এতক্ষণ ওদের ফেলানো খাবার দাবারের গুড়োগাড়া গুলো সাফ করতে লেগে গেলো।
আনাবিয়া ওদের এমন তাড়াহুড়ো দেখে হেসে ফেললো। বাচ্চাগুলো খুব দায়িত্বশীল হচ্ছে দিনে দিনে৷ মীর যতক্ষণ আশেপাশে না থাকে ততক্ষণ এরা সকলে মিলে ওকে মীরের মতো করেই আগলে রাখে!
মীর অবশ্য যাওয়ার আগে ওদের দিকে এমন দৃষ্টি দিয়ে যায় যার অর্থ হচ্ছে ‘বউ রেখে গেলাম, সহিহ্ সলামতে রাখবি নইলে কুপিয়ে দেবো!’
তবে আনাবিয়া বিশ্বাস করে বাচ্চাগুলো ওর এত খেয়াল রাখা মীরের থেকেই শিখেছে। ওর কি লাগবে না লাগবে, ওর কখন খেতে হবে, কি খেতে হবে, কি করতে হবে সবকিছু মীরের মাথায় যেন গেঁথে থাকে সর্বক্ষণ! বাচ্চাগুলোও তাই শিখেছে। ওদের শেহজাদীর কখন কি প্রয়োজন সেগুলো সে মুখ ফুটে বলার আগেই হাজির!
কোকো আর লিও চেয়ার নিয়ে এসে রাখলো টেবিলের মাঝখান ঘেঁষে। হাইনা ওকামি আর আলফাদ মিলে ছুটলো রিসোর্টের কিচেন থেকে খাবার নিয়ে আসতে। সকাল বেলা উঠে সকলে মিলে রান্না করেছে, কি যে করেছে নিজেরাও জানেনা। হিজ ম্যাজেস্টি এমন বিশ্রি খাবার খেয়ে আজ ওদের গর্দান না নিলেই হলো!
ওরা খাবার নিয়ে এসে টেবিলে রাখলে কোকো খাবারের প্লেট নিয়ে এসে দক্ষ ডাইনিং সার্ভার এর মতো করে সাজিয়ে দিলো ওদের সামনে, আনাবিয়া আর মীর তাকালো একে অপরের দিকে, চোখা চোখ হতেই আনাবিয়া হাসলো মিষ্টি করে যেন বোঝাতে চাইলো, দেখো! কাদেরকে তুমি জঙ্গলে ফেলে আসতে চাইছিলে।
মীর ওর গাল টিপে দিলো দু আঙুলে। কোকো ওদের প্লেটে খাবার তুলে দিতে দিতে বলল,
“আম্মা, খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে। যদি ভালো হয় ক্রেডিট আমার, ভালো না হলে দোষ জোভি আর কাঞ্জির। শুধু একবার বলবেন ভালো হয়নি, দুইডার হাত নামিয়ে দিবো কনুই থেকে! জীবনে আর রান্না করবেনা।”
আনাবিয়া হেসে উঠলো খিলখিল করে। ওপাশ থেকে জোভি আর কাঞ্জি বেজার মুখে বলল,
“হ্যাঁ তাইতো! ভালো জিনিসগুলোর সব ক্রেডিট তো তোমার! শুধুমাত্র শেহজাদীর আদরের বড় ছেলে বলে তোকে কেউ কিছু বলেনা, যদি ওই পঁচা ডোবায় বড় হতি তবে দেখতি তোরে কি করতাম!”
“হোই, কি বলতে চাস তুই? আমি একটা সলট ওয়াটার ক্রোকোডাইল, সমুদ্রে থাকি! তোদের মতো……”
কোকো আরও কিছু বলতে নিচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই মীরের শক্ত দৃষ্টি দেখে চুপ মেরে গেলো ও। আনাবিয়া ওকে টেনে নিয়ে বসালো নিজের পাশের চেয়ারে, বলল,
“চুপচাপ খা, বেশি বকিস না।”
খাবারটা বেশ মজাই হয়েছে। যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলো ততটা হয়নি। আনাবিয়া কয়েকবার ওদের রান্নার প্রশংসাও করে ফেলেছে।
এখনো পর্যন্ত মীরের মুখ থেকে কোনোদিন ‘জানোয়ারের পাল’ ছাড়া কোনো সুন্দর বাক্যগুচ্ছ বের হয়নি ওদের উদ্দ্যেশ্যে, তাই আজও ওরা কিছু আশা করলোনা ওর থেকে৷ তিনি একমাত্র তাঁর বউয়ের রান্নাই পছন্দ করেন।
কোকো একটু একটু করে এটা সেটা তুলে দিতে লাগলো আনাবিয়ার প্লেটে, এই কাজ সে মীরের থেকে শিখেছে। মীর রোজ খাওয়ার সময় আনাবিয়ার প্লেটে ওর পছন্দের খাবার গুলো তুলে দেয় নিজের ভাগ থেকে। আনাবিয়া না চাইলেও জোর জবরদস্তি করে দিয়ে দেয়। আজও দিচ্ছে।
একপাশ থেকে মীর, অন্যপাশ থেকে কোকো, দুজন দুপাশ থেকে ওর প্লেটে ওর পছন্দের খাবার গুলো তুলে দিচ্ছে থেকে থেকে। আনাবিয়ার মুখে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠলো এই দুই পুরুষের যত্নের তৃপ্তিতে। খেতে খেতে ও কোকোর উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“কোকো, আমার মেয়ে হবেনা জানি। তবে আমার যদি কখনো মেয়ে হতো তবে আমি তাকে তোর সাথে বিয়ে দিয়ে দিতাম।”
ও পাশ থেকে মীর এ কথা শুনতে পেয়ে আনাবিয়াকে ডিঙিয়ে কোকোর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“তোর মতো জানোয়ারের সাথে মেয়ে বিয়ে দিবো আমি? নেভার!”
কোকো মীরের কথা পাত্তা না দিয়ে আনাবিয়ার দিকে এগিয়ে এলো আরেকটু, এসে উৎসাহী গলায় শুধোলো,
“সত্যি আম্মা? কিন্তু কেন আম্মা?”
মীর ওপাশ থেকে নির্বিকার গলায় বলে উঠলো,
“অতো খুশি হয়ে লাভ নেই, আমার মেয়ে হবেনা। সব ছেলেই হবে।”
আনাবিয়া ওর দিকে একবার তাকিয়ে ভ্রুকুটি করে ফিরলো আবার কোকোর দিকে, তারপর নরম গলায় বলল,
“কারণ তোর ভেতরে আমি মীরের ছায়া খুঁজে পাই। আমার মেয়ে তার বাবার মতো কাউকে পেলেই সবচেয়ে বেশি ভালো থাকবে। তুই ছাড়া অন্য কেউ আমার মেয়েকে এতটা যত্নে রাখতে পারবেনা। এতটা কেয়ার, এতটা ভালোবাসা কখনো দিতে পারবেনা, তাই।”
কোকো প্রচন্ড খুশি হলো শুনে। চওড়া হাসলো ও। ওর আম্মা ওকে একটা বিশ্বাস করেন যে নিজের মেয়ে হলে তাকে ওর হাতে তুলে দিতেন, এতটা সৌভাগ্য নিয়ে জন্মেছে ও ভাবতেই ওর মন ভরে গেলো!
চোখের সামনে ভেসে উঠলো সেই ছোট্ট বেলার কথা, যখন সমুদ্রের ভেতর থেকে ওর ক্ষতবিক্ষত ছোট্ট দেহটা হাতে তুলে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলো এই শুভ্র সুন্দর মেয়েটি, যার ছায়াতলে কেটে গেলো ওর প্রায় চল্লিশটা বছর!
আনাবিয়া কথাগুলো বলে তাকালো একবার পেছনে, বারান্দায় বসে ওরই দিকে অবাক চোখে হা হয়ে তাকিয়ে আছে ওরই তথাকথিত বন্ধুরা। আনাবিয়া পরখ করে দেখলো ঠিক কে কে নেই সেখানে।
ওদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিলো আবার। মীর বেছে বেছে তাদেরকেই সরিয়ে দিয়েছে যাদেরকে আনাবিয়া বেশি বিশ্বাস করেছিলো, বেশি ভরসা করেছিলো।
ছোটখাটো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার খাওয়ায় মনোযোগ দিলো আনাবিয়া
বাচ্চারা সব ফেরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। মীরের আদেশ মতো জারা ইব্রাহিম দেরকে কিমালেবের রোডে নামিয়ে দিয়ে ওরা ফিরে যাবে শিরো মিদোরিতে। মীর আনাবিয়াকে নিয়ে কিছুদিন এখানেই সময় কাটাবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ওর প্রাণটার মন খারাপ, এই গুমোট মন নিয়ে ওকে প্রাসাদে ফিরিয়ে নেয়ার কোনো ইচ্ছা নেই মীরের। তাছাড়া বেশ কয়েকদিন ধরে আনাবিয়াকে সময় দেওয়া হচ্ছেনা ওর। তাই আনাবিয়াকে নিয়ে একটু হাওয়া বাতাস খাইয়ে প্রাসাদে ফিরবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে ও।
জারা ইব্রাহিম দেরকে বারান্দা থেকে এক প্রকার পিঠ মোড়া করে নামিয়ে নিয়ে এলো কোকো হাইনা আর লিও।
এই তিন বাচ্চা দলের দুর্ধর্ষ ব্যাক্তি। যত কাটাকাটি, কোপাকুপি সব এদের তিনজনকে দিয়েই করায় মীর। আনবিয়ার এই তিন সন্তান এক্কেরে দানবের মতো। চলার সময় এমন ভাবে পা ফেলে যেন পুরো শিরো মিদোরিকেই কাঁধে তুলে এগিয়ে নিতে পারবে।
মীর ওপরে ওপরে যতই জানোয়ার বলে গালাগাল করুক না কেন, ছেলেগুলোকে সেও ভালোবাসে অনেক৷ ছেলেগুলো পারলে জান দিয়ে দেয় ওর জন্য, আর আনাবিয়া তো ওদের প্রাণ! ওদের শেহজাদীর গায়ে একটা শিশির বিন্দুর ছোয়াও লাগতে দেয়না ওরা।
জারা ইব্রাহিমদেরকে নিয়ে যাওয়ার সময় ওরা করুণ দৃষ্টিতে তাকালো একবার আনাবিয়ার দিকে, ইতোমধ্যেই ওরা জেনে গেছে আনাবিয়ার পরিচয়! স্বার্থপরতার একটা নিদারুণ শিক্ষা পেয়েছে আজ ওরা প্রাণপ্রিয় সুহৃদদেরকে হারিয়ে।
চোখে আনাবিয়ার নিকট ক্ষমা প্রার্থনার আর্তি ফুটিয়ে তুলে ওরা তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার মুখপানে, কিন্তু আনাবিয়া ফিরেও তাকালোনা ওদের দিকে। চোখ মুখ শক্ত হয়ে রইলো ওর৷ বিশ্বাসঘাতকতা ব্যাপারটা ও নিতে পারেনা একেবারেই, ওর শরীরে ধারালো খঞ্জরের ন্যায় বিঁধে সেটা!
জারা দেরকে আনাবিয়ার দিকে তাকাতে দেখে কোকো হাইনা আর লিও মিলে ওদের ঘাড় ধরে মুখ টা ঘুরিয়ে আনাবিয়ার দিক থেকে অন্য দিকে দিয়ে দিলো। ওদেরকে গাড়িতে উঠিয়ে দিয়ে বাচ্চারা এসে বিদায় নিয়ে গেলো আনাবিয়া আর মীরের থেকে। তারপর চলল নিজেদের গন্তব্যের দিকে৷
বাচ্চারা চলে গেলে মীর তার প্রেয়সীকে নিয়ে চলল কিমালেবের আসমান ছুই ছুই পাহাড় গুলো চষে বেড়াতে।
নিস্তব্ধ রাত! শিরো মিদোরির রেড জোনের গাছপালা গুলোতে বইছে স্বর্ণাভ আলোকরশ্মিগুচ্ছের ঢল। ঢেউয়ের মতো সেগুলো বয়ে চলেছে শিরো মিদোরির আকাশের নিচ দিয়ে।
সমস্ত শিরো মিদোরি আজ নিশ্চুপ, কয়েক জাতের ছোট্ট বোবা প্রাণি ছাড়া সবাই এখন গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন! জেগে আছে শুধু কয়েকটি মুখ।
লাইফট্রির কোল ঘেঁষে মীরের বুকে মাথা দিয়ে ওর কোলের ভেতর বসে আছে আনাবিয়া। নিজের দায়িত্ব শেষ করতে গিয়ে এখন ও হাপিয়ে উঠেছে! মীর নুজের দুহাতে ওকে আগলে নিয়ে বসে আছে মাটিতে। লাইফট্রির কাছে ওর প্রাণকে একা ছাড়তে ওর মন সায় দেয়না কখনো, তাই নিজে নয়তো বাচ্চাদেরকে সবসময় আনাবিয়ার সাথে রাখে ও।
প্রতিমাসের নির্দিষ্ট এই দিনটাতে শিরো মিদোরির আবহাওয়া এবং অন্যান্য সমস্ত কিছুর ভারসাম্য রক্ষা আর সামান্য নতুনত্ব দেওয়ার জন্য ওকে লাইফট্রির জীবনীতে বর্ণিত কোডেড মিউজিক গুলোর সুর তুলতে হয়। এতে সমস্ত জঙ্গলটা পূর্বের তুলনায় সজীব হয়ে উঠে আরও, প্রাণীগুলোর জীবনীশক্তি বৃদ্ধি পায়, ঝলমলিয়ে ওঠে প্রকৃতি, রূপ টিকরে পড়ে তার!
এ রাতে ঝরে যায় গাছের সমস্ত পুরোনো শুকনো পাতা, খসে যায় মরে যাওয়া গাছ গুলো। শিরো মিদোরির মাটি সেগুলোকে গিলে নেয় আবারও, তারপর সেগুলোকে নিজের সাথে মিশিয়ে তৈরি করে আরও শক্তি।
আনাবিয়ার মুখনিঃসৃত সেই মোহনীয় সঙ্গীত শেষ হয়েছে মাত্রই। সবার চোখে ঝিমুনি। কোকো ফ্যালকন আর হাইনা এসেছিলো ওদের সাথে, ওরাও সামনে বস ঝিমুচ্ছে। ফ্যালকন বারবার গড়িয়ে পড়ছে কোকোর ওপর, আর কোকো ঝিমুনির ভেতরেই ধাক্কা দিয়ে বার বার সরিয়ে দিচ্ছে ওকে নিজের ওপর থেকে৷
আনাবিয়া উপভোগ করছে এ সমস্ত কিছু, মুখে লেপ্টে আছে ওর এক চিলতে হাসি। এমন সময় গলা খাকারি দিয়ে উঠলো ও, সাথে সাথেই ঝিমুনি কেটে গেলো সবার। মীর আনাবিয়াকে নিয়ে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল,
“প্রাসাদে ফিরেই ঘুমিয়ে যাবে শিনু, আগামীকাল অনেক কাজ।”
“কিসের কাজ? আর তুমি কোথায় যাচ্ছো, প্রাসাদে ফিরবেনা? ”
মীরের দিক ফিরে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধোলো আনাবিয়া। ওদের বিপরীত পাশে কোকো ফ্যালকন আর হাইনা নিজেদের ভেতর চুপিসারে বাকবিতন্ডা করছিলো, কোনো একটা ব্যাপার নিয়ে আজ কোকোর সাথে ঝামেলা বেধেছে ওদের দুজনেরই, কোকো বার বার ওদের দুজনকে এক্সপ্লেইন করে চলেছে কিছু একটা কিন্তু দুজনেই কোকোর ওপর ক্ষ্যাপা, ওরা কিছুতেই বুঝতে চাইছেনা!
মীর ফ্যালকনের নাম ধরে ডেকে উঠলো তখনি। ঝামেলার ভেতর থেকে নিজের নাম শুনে চমকে উঠে এদিকে ছুটে এলো ফ্যালকন। মীর আনাবিয়াকে ফ্যালকনের সাথে প্রাসাদে ফিরে যেতে ইশারা করে বলল,
“আমার কিছু কাজ আছে শিনু, তুমি গিয়ে ঘুমিয়ে যাও আমি কিছুক্ষণ বাদেই আসছি। ওকে?”
আনাবিয়া কিছুক্ষণ সন্দেহের দৃষ্টিতে মীরের দিকে তাকিয়ে থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে ফ্যালকনের সাথে এগোলো প্রাসাদের দিকে৷ মীর কোকো আর হাইনাকে ইশারায় ডেকে নিয়ে গেলো অন্যদিকে।
আনাবিয়া পেছন ফিরে ওদের তিনজনকে একসাথে গুজুরগুজুর ফুসুরফুসুর করতে করতে অন্যদিকে যেতে দেখে পাশে হেটে চলা ফ্যালকনকে জিজ্ঞেস করলো,
“কি ব্যাপার ফ্যালকন, তোরা আমার আড়ালে কি করছিস বলতো!”
“আমি কিছুই জানিনা শেহজাদী!”
মুখ ভার করে বলল ফ্যালকন। আনাবিয়া ওর মন খারাপ বুঝতে পেরে শুধালো,
“কি হয়েছে তোর? কোকো কিছু বলেছে?”
ফ্যালকন মাথা নাড়ালো দুদিকে, তারপর আগের মতোই মুখ ভার করে সামনে তাকিয়ে হেটে যেতে লাগলো। আনাবিয়া আর কিছু জিজ্ঞেস করলোনা ওকে।
এমনিতেই আজ ও অনেক ক্লান্ত! সারাদিনের দৌড়ঝাপ শেষে এখন আবার মাঝরাত পর্যন্ত জেগে ওকে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। এখন ওর দুচোখ ভর্তি ঘুম! মীরির বাচ্চা তো গেলো ওদিকে কোন রাজকার্যে! সবগুলো মিলে ওদিকে কি গোল পাকাচ্ছে কে জানে!
ঘুমের চোটে আর বেশি কিছু না ভেবে আনাবিয়া ফ্যালকনের সাথে সাথে এগোলো প্রাসাদের দিকে।
সকাল বেলা ইয়াসমিনের ডাকে ঘুম ভাঙলো আনাবিয়ার। চোখ মুখ কুচকে ও উঠে বসলো বিছানায়৷ ইয়াসমিন হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ওর বিছানার পাশে৷ আনাবিয়া চোখ ডলে ওর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কি ব্যাপার ইয়াসমিন? এত হাসছো কেন? গতরাতে আরমান কি খুব হার্ড ওয়ার্ক করেছে?”
ইয়াসমিনের হাসি দ্বিগুণ হলো, ও দাঁত কেলিয়ে বলে উঠলো,
“জ্বি শেহজাদী, তা তো করেছেই! কিন্তু হিজ ম্যাজেস্টিও গতরাতে অনেক হার্ড ওয়ার্ক করেছেন।”
আনাবিয়া হাই তুলতে নিয়েছিলো, ইয়াসমিনের এমন কথায় হাই বন্ধ হয়ে গেলো ওর, যে পর্যন্ত মুখটা খুলেছিলো সেই পর্যন্তই থেমে গিয়ে ইয়াসমিনের দিকে ভয়ানক চোখে তাকিয়ে ও জিজ্ঞেস করলো,
“কি বলতে চাইছো তুমি, কিসের হার্ড ওয়ার্ক?”
ইয়াসমিনের দাঁত কেলানি বেরিয়ে গেলো আনাবিয়ার অমন দৃষ্টিতে, অসহায় মুখে ও আমতাআমতা করে বলে উঠলো,
“ইয়ে মানে… শেহজাদী… আপনার লাগেজ!”
বলে সামনে থেকে সরে গেলো ও, সরতেই আনাবিয়া দেখতে পেলো ওর লাগেজ গোছানো। সেদিকে একবার তাকিয়ে আবার ইয়াসমিনের দিকে ফিরে ও শুধালো,
“লাগেজ কেন? কি কাজে লাগবে?”
“হি-হিজ ম্যাজেস্টি আপনাকে রেডি হতে বলেছেন, উনি আপনাকে নিয়ে বের হবেন বললেন!”
“কোথায় যাবে?”
“উনি এ বিষয়ে আমাকে কিছুই জানাননি শেহজাদী! উনি শুধু বললেন আপনার লাগেজ গুছিয়ে দিতে আর আপনাকে রেডি করে দিতে!”
আগের মতো করেই বলল ইয়াসমিন।
আনাবিয়া অবাক হলো কিছুটা। কোনো আগাম প্রস্তুতি ছাড়াই কালাভুনা ওকে নিয়ে কোথায় যাবে?
বিছানা ছেড়ে নেমে ফ্রেশ না হয়েই ও এগোলো মীরের কামরার দিকে। পেছন থেকে ইয়াসমিন তড়িঘড়ি করে বলে উঠলো,
“শেহজাদী, হিজ ম্যাজেস্টি ওনার কামরায় নেই!”
“কোথায় গেছে?”
পেছন ফিরে শুধালো আনাবিয়া।
“জানিনা শেহজাদী! আ-আরমানও গেছেন ওনার সাথে, কোকো ভাইয়ারাও গেছেন।”
আনাবিয়া ভ্রু কুচকে তাকালো ওর দিকে৷ এরা সবাই মিলে কিছু একটা গোল পাকাচ্ছে কাল রাত থেকে। কিন্তু ওকে বলছেনা।
আনাবিয়া ইয়াসমিনের দিকে কিছুক্ষণ কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে তাকিয়ে থেকে অতঃপর দুমদাম করে পা ফেলে ঢুকে গেলো ওয়াশরুমে!
মীরের কালো রঙা গাড়ির ভেতর বসে কোথাও চলেছে আনাবিয়া, ড্রাইভ করছে কাঞ্জি।
মীর ওকে নিয়ে ঘুরতে যাবে কোথাও, কিন্তু কোথায় যাবে সেটা এখনো বলেনি৷ ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে বেশ কিছুদিনের জন্যেই যাবে, নইলে তো ও ইয়াসমিন কে লাগেজ গোছাতে বলতো না!
কাঞ্জিকে কয়েকবার জিজ্ঞেসও করেছে কিন্তু সেও কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি৷ কাঞ্জি ওকে এখন ঠিক কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সেটাও বলছেনা।
কিছুক্ষণ গাড়ির উইন্ডো দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকার পর আনাবিয়া বুঝলো ওরা সমুদ্রের দিকে চলেছে।
আনাবিয়া এতক্ষণ জানালায় মাথা ঠেকিয়ে বসে ছিলো, কিন্তু কাঞ্জিকে সমুদ্রের দিকে এগোতে দেখে ও সোজা হয়ে বসে বলল,
“আমরা সমুদ্রের দিকে কেন যাচ্ছি কাঞ্জি?
“শেহজাদী, হিজ ম্যাজেস্টি বলেছেন আপনাকে নিয়ে সী পোর্টে যেতে।”
আনাবিয়া চিন্তায় পড়লো, হঠাৎ মীর ওকে সী পোর্টের দিকে কেন নিয়ে যেতে বলল? কোথায় যাবে ও?
কিমালেব বা ওয়ারদিচা তে গেলে তো তার জন্য পানি পথ আছে, তবে?
শালার কালাভুনাটা ফোনও তুলছেনা! এদের সবগুলোর সমস্যা কি? ওকে সবাই টেনশনে ফেলে রেখে বোধ হয় খুব মজা পায়!
খানিকক্ষণ পরেই ওরা পৌঁছে গেলো শিরো মিদোরির রয়্যাল সী পোর্টে৷ কাঞ্জি গাড়ি থামিয়ে বাইরে এসে আনাবিয়ার জন্য ডোর ওপেন করে দিলো।
স্নোফ্লেক ব্লু শেডের ফ্লাপি গাউন পরিহিতা ঝকঝকে আনাবিয়া বের হয়ে এলো গাড়ি থেকে। বের হতেই ওর চোখে পড়লো নীল রঙা পানিতে ডুবুডুবু শিরো মিদোরির বিশাল সমুদ্র।
সমুদ্রের নীলচে-সবুজ পানির ঢেউ আছড়ে পড়ছে বিশাল কাঠের ডকের গায়ে। সম্পুর্ন পোর্ট জুড়ে লোহার তৈরি ডক পাইল, তার মাঝে মাঝে ঢেউ খেলানো ভঙ্গিতে বাধা মোটা মোটা দড়ি৷ সেগুলোর মাথার ওপরে সেট করা ঝকঝকে বাতিগুলো তৈরি করে রেখেছে এক অভিজাত পরিবেশ।
বিশাল বিশাল বাণিজ্যিক জাহাজগুলো দূরে নোঙর করা, এগুলো সব যায় বহির্বিশ্বে। বহির্বিশ্বের সাথে সওদা করে সেখানের জিনিসপত্র বোঝাই করে এগুলো আবার ফিরে আসে শিরো মিদোরিতে। কিন্তু বহির্বিশ্বের মানুষ জানেইনা যে এই বাণিজ্যিক জাহাজ গুলো প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝখান থেকে এসে বিজনেস করে যায় তাদের সাথে৷
বাণিজ্যিক জাহাজ গুলোর পাশে, ডেকের কাছেই সমুদ্রের পানির ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে আলতো করে দোল খাচ্ছে একটি বিলাসবহুল প্রাইভেট ইয়ট, উজ্জ্বল রাদা রঙা ইয়টটির গায়ে সোনালী অক্ষরে খোদাই করে লেখা, ‘দ্যা দেমিয়ানস’।
আনাবিয়া অবাক হলো কিঞ্চিত। এর আগেও অনেকবার এইখানে এসেছে ও, কিন্তু আগে কখনো এই ইয়টটি ও দেখেনি। সমুদ্রে যাওয়ার ওদের প্রয়োজনই পড়েনা, পানি পথ দিয়েই কাজ চলে যায় তবে এখন ইয়ট কেন?
আনাবিয়া কিছুক্ষণ সেখানে দাড়াতেই কোত্থেকে ছুটে এলো কোকো, পরনে তার ফিটফাট পোশাক। এসেই আনাবিয়াকে এক প্রকার দুহাতে জড়িয়ে নিয়ে ও হেসে উঠে বলল,
“আম্মা! আপনাকে পরীর চাইতেও সুন্দর লাগছে। চলুন আম্মা!”
বলে আনাবিয়াকে এক প্রকার ঠেলে নিয়ে এগোলো ও ইয়টের দিকে। পেছন থেকে কাঞ্জি আনাবিয়ার লাগেজ গুলো বের করে নিয়ে আসতে লাগলো ওদের পেছন পেছন। আনাবিয়া এগোতে এগোতে সন্দেহের চোখে শুধালো,
“তোরা আমকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছিস বলতো? আর মীর কই? ওকে ফোনে পাইনা কেন?”
“আগে ইয়টে উঠবেন তারপর সব জানতে পারবেন, এখন চলুন আম্মা।”
কাঠের ডক পেরিয়ে ওরা উঠে পড়লো ইয়টের ওপর। আনাবিয়া ভালোভাবে তাকালো চারদিকে একবার। ইয়টের ডেকে বসার জন্য সাদারঙা তুলোর মতো নরম কুশন দেওয়া সোফা, একটি ছোট্ট সুইমিং পুল। কাঁচ দিয়ে ঘেরা ক্যাবিনের ভেতর কৃত্তিম আলো জ্বলছে মিটিমিটি করে।
সমুদ্রের ভেতর থেকে ভেসে আসা ঝড়ের ন্যায় বাতাসে নোনাজল আর কাঠের গন্ধ, আনাবিয়ার শুভ্র চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে বাতাসের ঝাপটা।
আনাবিয়া এগোলো আরও। ওর বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড়ের শব্দ কানে আসতে লাগলো কিছুটা সামনে থেকে।
দুহাতে গাউনের দুপাশ উঁচু করে ধরে ও এগোলো সেদিকে, চোখ জোড়া খুজে ফিরেছে মীরকে। সে লোক কাল রাত থেকে উধাও! ওকে দেখার জন্য বুকের ভেতরটা ছটফট করছে আনাবিয়ার।
সামনে এগোতেই কেবিনের সামনের খোলা অংশে রাখা চওড়া টেবিলের চারপাশে বাচ্চাদেরকে হল্লা করতে দেখলো আনাবিয়া, ফ্যালকনকে চিয়ার আপ করছে ওরা সকলে মিলে। তার খুব মন খারাপ!
আনাবিয়াকে দেখতেই ওরা হল্লা থামিয়ে সোজা হয়ে দাড়ালো সকলে। ফ্যালকন মুখ ভার করে নিচের দিকে তাকিয়ে থেকে ধীর গতিতে উঠে দাড়ালো চেয়ার ছেড়ে। আনাবিয়া ওকে এমন মন খারাপ করে থাকতে দেখে এগিয়ে গিয়ে ওকে দুহাতে আগলে নিয়ে শুধালো,
“কি হয়েছে তোর? কাল রাত থেকে তোকে এমন দেখছি ক্বন? কেউ কিছু বলেছে তোকে?”
পরক্ষণেই কোকোর দিকে তাকালো আনাবিয়া, তারপর আবার ফ্যালকনের দিকে ফিরে শুধালো,
“কোকো কিছু বলেছে নাকি তোকে?”
ফ্যালকন দুদিকে মাথা নেড়ে না বোঝালো, আনাবিয়া ওর মাথায়, চোয়ালে আদুরে হাত বুলিয়ে আবার একবার জিজ্ঞেস করলো কি হয়েছে৷
ফ্যালকনের চোখ জোড়া এবার ভর্তি হয়ে গেলো লোনা পানিতে, ঠোঁট ফুলিয়ে ফুপিয়ে উঠে ও বলল,
“আমাকে নিবেন না!”
“কোথায় নিবে না? কে নিবেনা?
চিন্তিত কন্ঠে শুধালো আনাবিয়া, ফ্যালকন নাক টেনে বলে উঠলো,
“আপনাদের সাথে নিবেন না, কোকো ভাইয়া কে নিবেন অথচ আমাকে নিবেন না!”
আনাবিয়া কি বলবে বুঝতে পারলোনা, ও এখনো জানেইনা কোথায় নিয়ে যাবে মীর আজ ওকে৷ তার ওপর বাচ্চাটা ওর মুখ ফুলিয়ে বসে আছে ওকে নিয়ে যাবেনা বলে!
এই মীর টাকে যে ও কি করে! একটাকে নিবে তো অন্যটাকে নিবেনা। এর স্বভাবই এমন।
আনাবিয়া ফ্যালকনকে আশ্বস্ত করে বলল,
“ঠিক আছে, আমি বলবো মীরকে তোকেও নিতে।”
কোকো পেছন থেকে সাথে সাথে অসম্মতি জানিয়ে বলে উঠলো,
“না শেহজাদী, হিজ ম্যাজেস্টি ওকে নিবেন না কারণ ও যেতে পারবেনা সেখানে, ওর স্বাস্থ্য ঝুঁকি আছে!”
কোকর কথা শুনে ফুপিয়ে কেদে উঠলো ফ্যালকন আবারও। আনাবিয়া অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। এই বাচ্চাটা ওর ভীষণ প্রিয়! হয়তো কথায় কথায় কেঁদে ফেলে বলেই এর জন্য আনাবিয়ার বুকে এত মায়া।
আনাবিয়া একটা চেয়ার টেনে বসালো ওকে, নিজেও আর একটা চেয়ার টেনে বসলো ওর পাশে। তারপর ফ্যালকনের কান্নারত চেহারাটা একহাতে উঁচু করে অন্যহাতে ওর চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
“এই জন্য মন খারাপ করতে হয়? মীর নিতে চাইছেনা যেহেতু, নিশ্চয় তার পেছনে কোনো কারণ আছে, নইলে কি ও তোকে কখনো ফেলে রেখে যায়, পাগল একটা!
এত বড় ছেলে, এখনো বাচ্চাদের মতো ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদে! আর কিছুদিন পর যখন আর আমার কাছে থাকবিনা, তোর সংসার হবে, বাচ্চাকাচ্চা হবে, তখন একটু কিছু হলেই যদি এমন ভ্যা করে কান্না করিস তখন বউয়ের সামনে তোর মানসম্মান থাকবে? তখনও কি এসে মায়ের কাছে এমন বিচার দিবি?”
ফ্যালকন কান্নায় ভেঙে পড়লো এবার! এই একটা নারী ওর জীবনের সবকিছু। এই নারীর মমতাভরা স্পর্শেই ওর জীবনের প্রায় সতেরোটি বছর কেটে গেলো।
আজ পর্যন্ত কখনো মায়ের অভাব বোধ করেনি ও! উড়তে গিয়ে পড়ে গেলে সে ছুটে এসে তার এই মায়ের কাছে, আঘাত পেলে গিয়ে লুকিয়েছে এই মায়েরই আচলের তলে! কেউ কিছু বললে এই মা’ই ওর পক্ষ নিয়েছে সবার আগে, ওকে আগলে নিয়েছে সমস্ত কষ্ট সমস্ত ব্যাথা থেকে। আর সে-ই কিনা বলে ফ্যালকন একসময় তার কাছে আর থাকবেনা!
ফ্যালকন ঝুঁকে লুটিয়ে পড়লো আনাবিয়ার কোলের ওপর, উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে বলল,
“আমি আপনাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যাবোনা শেহজাদী…… কোনোদিন যাবোনা! আপনি যেখানে যাবেন আমি সেখানেই যাবো। আমার মা আপনি, আমি যতবার আঘাত পাবো ততবারই আপনার কাছে ফিরে আসবো আম্মা! আপনি ছাড়া আমার আপন বলতে আর কেউ নেই…… কখনো আর কেউ হবেও না!”
আনাবিয়ার চোখের কোণে বাষ্প এসে ভীড় করলো, মুখে ফুটে উঠলো পরিপূর্ণতার হাসি। কোলের ওপর ফ্যালকনের লুটিয়ে পড়ে মাথার ঝাকড়া চুলগুলোতে আলতো করে হাত বুকিয়ে দিলো ও।
ওদেরকে চারপাশ থেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা বাচ্চাগুলো চোখ মুছলো একে অপরের অগোচরে!
কখনো এই মাতৃসম শেহজাদীকে ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যেতে হলে ওরা ওদের এই আম্মাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে? এত যত্নে, এত আদরে শেহজাদীর ছায়াতলে বড় হয়েছে ওরা। এই শুভ্র মায়াভরা মেয়েটি ওদেরকে রেড জোনের নিষ্ঠুর দুনিয়া থেকে দুহাতে তুলে আগলে না নিলে ওদের কি হতো আজ! ওরা রেড জোনে গুমরে গুমরে মরতো হয়তো, নয়তো খাবার হয়ে যেতো কোনো শক্তিশালীর পেটে!
কোকো দাঁড়িয়ে ছিলো ওদের পেছনে। চোখের কোণা মুছে ও এগিয়ে এসে আনাবিয়ার কোল থেকে ফ্যালকনের শার্টের কলার ধরে উঁচু করে বলে উঠলো,
“আম্মাকে এমনে জড়িয়ে ধরতে দেখলে হিজ ম্যাজেস্টি তোর টুটি টেনে ছিড়ে দেবেন, সর এইখান থেকে হাঁসের বাচ্চা!”
ফ্যালকন মুহুর্তেই ভুলে গেলো সব শোক, আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে নালিশের সুরে বলল,
“দেখলেন শেহজাদী, আপনার সামনেও আমাকে হাঁসের বাচ্চা বলছে!”
আনাবিয়া কটমটে চোখে তাকালো কোকোর দিকে, কোকো দাঁত কেলিয়ে তাড়াতাড়ি অন্য দিকে সটকে পড়লো। আনাবিয়া ফ্যালকনের মাথায় আর একবার হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
“তোদেরকে ছাড়া আমি কোথাও যাই বলতো?
মীর যেহেতু তোকে থেকে যেতে বলে গেছে তাহলে নিশ্চয় সেখানে কোনো সমস্যা আছে ফ্যালকন। ও কি আর শুধু শুধু তোকে মানা করবে বল!
এবার তুই তোর ভাইদের সাথে থেকে যা, পরের বার কোথাও যাওয়ার সময় তোকে অবশ্যই অবশ্যই সঙ্গে নিবো, ঠিক আছে?
ফ্যালকন সানন্দে মাথা নেড়ে সায় জানালো। আনাবিয়া এবার লিও হাইনা কাঞ্জিদেরকে ভালোভাবে বলে দিলো ফ্যালকনের যত্ন নিতে, একটুও যদি অযত্ন হয়েছে ওর এই ছোট বাচ্চাটার তবে ফিরে এসে সবগুলোকে ঝুলিয়ে রাখবে। ফ্যালকন খুশি মনে থেকে যেতে রাজি হলো ওদের সাথে।
ওদের এই কলকলে গল্পের ভেতর কোত্থেকে এসে হাজির হলো মীর। আর ওকে দেখা মাত্রই আনুগত্য জানিয়ে কোকো ছাড়া সবগুলো সুড়সুড় করে বেরিয়ে গেলো ইয়ট থেকে।
ওকে দেখে আনাবিয়া বসা থেকে উঠে ওর সামনে এসে অস্থির কন্ঠে শুধালো,
“কোথায় ছিলে তুমি? সেই কখন থেকে তোমাকে খুঁজছি জানা আছে তোমার?”
“জ্বি বেগম, আছে জানা।”
এরপর আনাবিয়াকে আপাদমস্তক একবার দেখে নিয়ে ও আবার বলল,
“আপনাকে আজ আমার বউয়ের মতো সুন্দর লাগছে।”
আনাবিয়া সেন্টি খাওয়া চোখে তাকালো মীরের দিকে। কোকো ঠোঁট টিপে হাসলো, কিভাবে বউয়ের রাগ থেকে সেইফ জোনে থাকতে হয় সেটা হিজ ম্যাজেস্টির থেকে শেখা উচিত ওদের।
কোকোকে মিচিমিচি হাসতে দেখে মীর গমগমে গলায় ডেকে উঠলো,
“কোকো!”
কোকোর হাসি থেমে গেলো মুহুর্তেই, তড়িঘড়ি করে আনুগত্য জানিয়ে ও ছুটলো ইয়টের কন্ট্রোল রুমের দিকে। আনাবিয়া কোকোর এমন অবস্থা দেখে হেসে উঠলো শব্দ করে৷ মীর ওর মুখখানাকে কোকোর দিকে থেকে ফিরিয়ে নিজের দিকে নিয়ে এসে বলল,
“তোমাকে তো সময় দেওয়া হয়না, তাই আগামী একটা বছর আমি শুধু তোমাকেই সময় দিবো।”
মীরের এমন কথায় আনাবিয়া বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ, তারপর শুধালো,
“কোথায় যাচ্ছি আমরা?”
মীর ওর নরম চোয়াল জোড়া নিজের দুহাতের ভেতর নিয়ে আদুরে চাপ দিয়ে উত্তর দিলো,
“আমাজন!”
আমাজনের গভীরতম প্রান্ত, সেখানে এখনো পর্যন্ত পড়েনি কোনো জনমানুষের পায়ের ছাপ। জঙ্গলের ভেতরে থাকা বিশাল, প্রাচীন বৃক্ষরাজি আকাশ ছুঁয়ে যাচ্ছে, তাদের মোটা শিকড়ে আচ্ছাদিত হয়ে আছে মাটির চারপাশ।
দূরথেকে ভেসে আছে অনবরত ঝরনার কলকল ধ্বনি, ঘন জঙ্গলের আড়াল থেকে ক্ষণে ক্ষণে ভেসে আসছে কোনো অজানা প্রাণীর রহস্যময় ডাক। লতাপাতা আর অর্কিডের বাহারি রঙ ছড়িয়ে আছে গাছ পালার গায়ে।
জঙ্গলের ভেতর বয়ে চলা বাতাসে এক গাঢ় সবুজ সুবাস, যেন পৃথিবীর আদিমতম ঘ্রাণ। আড়ালে আবডালে বয়ে চলা সরু নদী গুলোর পাড়ে বসে রোদ পোহানো অদেখা, অচেনা কোনো সরীসৃপ হঠাৎ করে নিজেদের টেরিটোরিতে নতুন কোনো প্রাণীর আবির্ভাব টের পেয়ে ঝপাৎ করে নেমে গেলো জলপথে।
গাছের ডালে বিশ্রাম নেয়া ঠোঁট লম্বা রঙিন টোকান পাখি ডেকে উঠলো সম্পুর্ন নতুন তিন দুপায়ী প্রাণীকে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সন্তর্পণে হেটে বেড়াতে দেখে। ডেকে সে সতর্ক করে দিলো তার আশেপাশের প্রাণীকুলকে।
অরণ্যের নিস্তব্ধতা ভেঙে, পিঠের ওপর ভারী ভারী দুটো ব্যাকপ্যাক নিয়ে, ঝোপ ঝাড়গুলোকে হাতের লম্বা ধারালো ম্যাশেটি দ্বারা কেটে কেটে সামনে এগিয়ে চলেছে মীর। ওর পেছন পেছন হেটে চলেছে আনাবিয়া, আর তার পেছনে কোকো।
তিনজনের পরনেই নাইলনের তৈরি ঢোলা ঢালা খাকি শার্ট আর সবুজ রঙা প্যান্ট, পায়ে ওয়াটার প্রুফ হাইকিং বুটস, মাথায় চওড়া ‘বুনি’ হ্যাট।
আনাবিয়ার হাত পিঠ সব খালি, ওর জিনিসপত্র সব বইছে মীর আর কোকো। আনাবিয়া বিন্দাস ভঙ্গিতে নেচে নেচে চারপাশটা ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে খুশি মনে এগোচ্ছে মীরের পেছন। ঠোঁটে ওর হাসি ধরেনা, পারলে এখানেই থেকে যায় ও বাকিটা জীবন!
সভ্যতার ছোঁয়া বিহীন এই জঙ্গলটাকে প্রকৃতি তার আদিম মহিমায় শাসন করে চলেছে এখনো। মাটির সেঁদো গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে বাতাসে। বিশাল বিশাল গাছের কান্ডের গায়ে গজিয়ে আছে রঙ বেরঙের বিষাক্ত ছত্রাক। নানা ধরণের ছোট বড় রঙিন পোকামাকড় অবাধে ঘুড়ে বেড়াচ্ছে সেসবের চারপাশ দিয়ে। বন্যপ্রাণীগুলো ছোটাছুটি করছে ওদেরকে দেখে, কেউ কেউ দাঁড়িয়ে কৌতুহলী চোখে পর্যবেক্ষণ করছে আনাবিয়াকে, এক অন্যরকম আকর্ষণ অনুভব করছে ওরা এই শুভ্র মেয়েটির প্রতি, কিন্তু জড়তার কারণে কাছেও আসতে চাইছেনা।
আমাজনের এসব বিরল সৌন্দর্য দেখতে দেখতে হাঁটতে হাঁটতে ওরা এক সময় এসে পৌছালো একটা খরস্রোতা নদীর ধারে। সন্ধ্যা নেমে যাবে কয়েক ঘন্টা পরেই। কিন্তু পৃথিবীতে যে সময়ে সন্ধ্যা নামে এখানে তার আরও আগেই নেমে যায়। সূর্যের আলো মাটি পর্যন্তই পৌঁছাতে পারেনা ঘন গাছপালার ভিড়ে।
মীর নদীর পাড়ের একটা মোটামুটি খোলা জায়গা দেখে সেখানটায় থেমে দেখে নিলো চারপাশটা, তারপর কোকোকে বলল জায়গাটা থাকার মতো পরিষ্কার করে ফেলতে। কোকো মীরের কথা মতো ওর হাতের ধারালো ম্যাশেটি দিয়ে সেখানের ঝোপঝাড় গুলো পরিষ্কার করে ফেললো মুহুর্তেই, তারপর দুজনে মিলে সেখানে তাবু খাটানোর কাজে লেগে পড়লো।
আনাবিয়া এগোলো নদীর দিকে। নদীর স্বচ্ছ পানির ওপর নীল আকাশের ছায়া পড়ে ধারণ করেছে এক রহস্যময় রূপ। আনাবিয়া নদীর পাড়ে গিয়ে সেখানে বসলো, হাত ডুবিয়ে দিলো নদীর স্বচ্ছ পানির ভেতরে, হাত টা নড়াচড়া করতে করতে ও ছোটখাটো একটা ঢেউ উঠালো পানিতে।
কিছুক্ষণ বাদেই সেখানে এসে জড়ো হলো এক ঝাক রঙ বেরঙের মাছ, ওর হাতের সরু আঙুল গুলোর ঘূর্ণনকে কেন্দ্র করে সাঁতরে বেড়াতে লাগলো চারপাশে। নিজেদের ছোটো ছোটো ঠোঁট দিয়ে টোকা দিতে লাগলো ওরা আনাবিয়ার হাতে, আনাবিয়া সুড়সুড়ি লেগে হেসে উঠলো খিল খিল করে।
সেই মুহুর্তেই পেছন থেকে ঝা করে একটা ধারালো কাটা যুক্ত বর্শা এসে আঘাত করলো সেখানটায়, বর্শার লোহার কাটায় বেধে গেলো রঙিন মাছ গুলোর বেশ কয়েকটি। আর বিধতেই সেটাকে উঠিয়ে নিয়ে মীর ছুড়ে দিলো কোকোর দিকে। কোকো সেটা ধরে ফেলে মাছগুলোকে নিয়ে কেটে কুটে পরিষ্কার করার তোড়জোড় শুরু করলো।
আনাবিয়া ভ্রু কুচকে মীরের উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“এটা কি হলো? মাছ গুলো আমার সাথে খেলছিলো!”
“মাছের সাথে পরেও খেলা যাবে, এখন পেট ভরে খেয়ে লম্বা একটা ঘুম দাও। নইলে তুমি কাল সকালে হাটার এনার্জি পাবেনা। বুঝেছো?”
বলতে বলতে তাবুর দিকে এগোতে লাগলো মীর৷ আনাবিয়া মুখ বেকালো, তারপর আবার নদীর দিকে ফিরে হাতে মুখে পানির ঝাপটা দিয়ে ও উঠে এলো সেখান থেকে।
মীর ততক্ষণে আগুন করে ফেলেছে একটা। আনাবিয়া এসে বসলো মীরের পাশে। কোকো নদী থেকে মাছগুলো ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার করে এনে রাখলো মীরের সামনে। তারপর আনাবিয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“আম্মা, আমি নদীতে যাচ্ছি। আপনি কি মাছ খাবেন বলুন, ধরে নিয়ে আসবো।”
“জানিনা আমি, যা ভাল্লাগে তাই নিয়ে আসিস। শুধু সাইজে যেন বড় হয়।”
“ওক্কে।”
বলে এক ছুটে নদীর ধারে গিয়ে মুহুর্তেই নিজের ক্রোকোডাইল ফর্মে এসে নদীতে ঝাপ দিয়ে গায়েব হয়ে গেলো কোকো। ওর বিশাল সাইজের কারণে নদীর ভেতর তুফান বয়ে গেলো যেন! দু’ধারে থাকা ব্যাঙ আর অন্যান্য প্রাণী গুলো লাফিয়ে সেখান থেকে ছুটে পালালো তখনি। মাছ গুলো লাফ দিয়ে উঠলো পানির ওপর। নিজেদের ছোট্ট বাসস্থানের ভেতর এমন বিশাল বপু ওরা আশা করেনি একটুও!
উভচর প্রাণীগুলোর ছোটাছুটিতে হুড়োহুড়ি বেধে গেলো নদীর কিনারে। আনাবিয়া এমন অবস্থা দেখে হেসে উঠলো। মীর পাশে বসে মাছ গুলোকে সরু ধাতব শিকে বিঁধে ফেলতে ফেলতে বলে উঠলো,
“ছোট বেলায় গণ্ডেপিণ্ডে না গেলালে আজ আর এই সাইজ হতো না তোমার ছেলের।”
“আমার ছেলেকে আমি গণ্ডেপিণ্ডে গেলাবো নাকি না খাইয়ে রাখবো সেটা আমার ব্যাপার। ইয়্যু ডোন্ট ট’ক।”
বলে মীরের পাশ থেকে উঠে তাবুর ভেতরে ঢুকে গেলো আনাবিয়া। হেটে হেটে পা দুটো এক্কেরে ঝালাপালা হয়ে গেছে। এত হাটার অভ্যাস নেই ওর। কিন্তু জঙ্গলটা এত্ত দারুণ! সবকিছু একদম কাছ থেকে না দেখলেও ভালো লাগছিলোনা ওর। কষ্টটাকে কষ্ট মনে হচ্ছিলোনা ওর এতক্ষণ, কিন্তু ওখন শরীর ভেঙে আসছে।
ওকে ভেতরের দিকে যেতে দেখে বাইরে থেকে মীর ওর উদ্দেশ্যে বলে উঠলো,
“তুমি একটু ঘুমিয়ে নাও শিনু, খাবার হয়ে গেলে তোমাকে ডেকে নেবো।”
আনাবিয়া তাই করলো।পোশাক আশাক খুলে আরামদায়ক পোশাক পরে ও শুয়ে পড়লো তাবুর ভেতরের নরম বিছানায়, আর শুতেই চোখ জোড়াতে ঘুম এসে ভর করলো ওর৷
আনাবিয়ার ঘুম ভাঙলো মীরের ডাকে। ঘুম থেকে আড়মোড়া ভেঙে উঠে তাবু থেকে বেরিয়ে আসলো ও৷ বের হয়ে আশেপাশে নজর যেতেই চোখ জোড়া জুড়িয়ে গেলো ওর৷
রাত নেমে গেছে, রহস্য আর মায়াবী সৌন্দর্যে মোড়ানো অন্ধকারে ডুবে গেছে আমাজন। চারপাশ তলিয়ে আছে এক অদ্ভুত নীরবতায়।
মাঝে মাঝে সেই নীরবতাকে ভেদ করে জঙ্গলের গহীন থেকে ভেসে আসছে নিশাচর প্রাণীদের ডাক। চারদিকে উড়ে চলেছে জোনাকি পোকার দল। আকৃতিতে বড় সেই জোনাকি পোকার ঝাকের মিটিমিটি হলদে সবুজ আলোতে নদীর পাড়টা সেজে উঠেছে যেন!
বিশাল বিশাল গাছের পাতা থেকে সশব্দে শিশিরবিন্দু পড়ছে মাটিতে টুপটাপ করে। আকাশে থালার মতো বিশাল চাঁদ, চাঁদের আলো পাতার ফাঁক গলিয়ে পড়ছে মাটিতে৷ নদী থেকে ভেসে আসছে পানির অলস ঢেউ খেলার শব্দ। রাতজাগা শিকারী পাখিদের হাড় হিম করা ডাক আর ডানা ঝাপটানোর শব্দ আসছে কিছুক্ষণ পর পর।
পৃথিবীর সব আলো থেকে দূরে, কেবল আকাশভরা তারা আর গভীর জঙ্গলের আনাচে-কানাচে লুকিয়ে থাকা জোনাকির ঝলকানিতে আলোকিত এই তীব্র সুন্দর রাতটি আনাবিয়ার কাছে একটি স্বপ্নের মতো ঠেকলো।
ওকে এভাবে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে মীর পেছন ফিরে তাকালো একবার, অর্ধাঙ্গিনীকে এভাবে মুগ্ধ চোখে জঙ্গলের দৃশ্য উপভোগ করতে দেখে ও সময় দিলো ওকে।
আগুনে ঝলসাচ্ছে কোকোর ধরে আনা বিরাট ক্যাটফিসের খন্ড খন্ড মাংস টুকরো। সন্ধ্যার পরপরই মাছটাকে কাধে তুলে নিয়ে এসেছে ও, তারপর সেটাকে কেটেকুটে দুজনে মিলে এখন ঝলসাতে দিয়েছে৷ লোভনীয় সুঘ্রাণে ভরে উঠেছে নদীর পাড়।
আনাবিয়া এসে বসলো মীরের গা ঘেঁষে, মীর ওকে এক হাতে টেনে নিজের কাছে নিয়ে নিলো। আনাবিয়া মাথা ঠেকালো ওর কাধে তারপর এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আগুনে ঝলসাতে থাকা ক্যাটফিসের টুকরো গুলোর দিকে।
ওর ক্ষিদে পেয়েছে টের পেয়ে মীর পাশ থেকে ওর বর্শা দিয়ে ধরা ঝলসানো মাছগুলো এনে রাখলো ওর সামনে, তারপর কাটা ছাড়িয়ে অল্প অল্প করে তুলে দিতে থাকলো আনাবিয়ার মুখে। পাশে বসে মাছ ঝলসানো আগুনের ভেতর কাঠ গুজে দিতে থাকা কোকো বলে উঠলো,
“আমি যে এতক্ষণ ধরে অভুক্ত আছি, আমাকে কারো চোখে পড়লো না! উলটো ঘুমন্ত মানুষকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে এনে খাওয়ানো হচ্ছে।”
আনাবিয়ার ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হলো কোকোর কথায়।মীরের দিকে তাকিয়ে ইশারা দিলো কোকোকে খাবার দেওয়ার জন্য। মীর কোকোর দিকে একবার কটমট করে তাকিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মাছগুলো থেকে একটা তুলে ছুড়ে দিলো কোকোর দিকে। কোকো সেটা হাত উঁচিয়ে ধরে ফেলে খেতে খেতে ফিচেল গলায় বলল,
“আমাকে তো কেউ মানুষই মনে করেনা, আমাকে মাছটা সুন্দর করে হাতে হাতেও দেওয়া যেতো। কিন্তু না, আমিতো জানোয়ার, আমাকে ছুড়ে না দিলে আমি কি খেতে পারি? হুহ!”
মীর নিজের হাতের মাছ থেকে আরো একটু ছিড়ে আনাবিয়ার মুখে পুরে দিতে দিতে বলল,
“চুপচাপ খা, বেশি কথা বললে যেটা দিয়েছি সেটাও নিয়ে নেবো।”
কোকো আর কথা বাড়ালো না, হিজ ম্যাজেস্টিকে দিয়ে ভরসা নেই, সত্যি সত্যিই কেড়ে নিতে পারেন। চুপচাপ বসে খাওয়া শেষ করলো ও৷
কিছুক্ষণ পরেই ওদের চারপাশে এসে ভিড় জমাতে লাগলো জঙ্গলের অন্যান্য প্রাণীরা৷ পোড়া মাছের ঘ্রাণ আর আনাবিয়ার প্রতি তীব্র আকর্ষণের কারণে ওরা সব এসে বসলো আনাবিয়ার থেকে কিছুটা দূরে, কিন্তু দ্বিধায় পড়ে কাছে এলোনা।
আনাবিয়া ওদের উপস্থিতি টের পেয়ে তাকালো একবার চারপাশে। কয়েকটা অসিলট বেড়াল এসে বসে আছে আনাবিয়ার প্রায় কাছাকাছি, গায়ে ওদের কালো বাদামী বর্ণের নকশা। পিটপিট করে ওরা তাকাচ্ছে আনাবিয়ার দিকে৷
ওদের থেকে কিছুটা দূরে কয়েকটা টায়রা দাঁড়িয়ে আছে দু পায়ে ভর দিয়ে, নাক নাড়িয়ে খাবারের গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা করছে ওরা।
খাবারের সুঘ্রাণে নদীর ধার ঘেষে উঠে এসেছে কয়েকটা মাঝারি সাইজের ব্লাক কেইম্যান কুমির। নদীর ধারে মাটিতে বুক ঠেকিয়ে শুয়ে ওরা চুপচাপ তাকিয়ে আছে এই সম্পুর্ন ভীনদেশী তিন প্রাণীর দিকে।
তখনি ওদের থেকে কিছুটা দুরত্বে থাকা গাছের ডালের শুকনো পাতায় শব্দ হলো খসখস। আনাবিয়া চোখ তুলে দেখলো সেদিকে। গাছের ডাল বেয়ে এক ঝলক ছায়া দ্রুত সরে গেলো সেখান থেকে। আনাবিয়া ভাবলো হয়তো সেখানে কোনো চিতা নয়তো কোনো নিশাচর সাপ লুকিয়ে আছে। আনাবিয়া তাকানোয় লুকিয়ে পড়েছে সে।
আনাবিয়া সেদিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে বসা অসিলেট গুলোকে হাত বাড়িয়ে ইশারায় কাছে ডাকলো, ডাকার সাথে সাথেই সেগুলো একে অপরের দিকে তাকিয়ে ভাব বিনিময় করে এগিয়ে এলো একত্রে।
আনাবিয়ার হাতের তলায় চলে এলো ওরা একেবারে, আনাবিয়া ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিতে লাগলো। আবেশে চোখ বুজে নিলো ওরা, ভয় চলে গেলো ওদের পুরোপুরি, আনাবিয়ার এক্কেবারে গা ঘেঁষে এসে ওমে বসলো সবগুলো।
ঝলসানো মাছ থেকে দুটো উঠিয়ে আনাবিয়া দিলো ওদের খেতে। মাছ দুটো পেয়ে লুফে নিলো ওরা এক প্রকার, তারপর আয়েশ করে খেতে লাগলো। আনাবিয়া হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলো একটাকে।
অসিলেটদের দেখা দেখি টায়রা গুলোও এবার এগিয়ে এলো একপা একপা করে। মীর ওদেরকে এগিয়ে আসতে দেখে এবার আনাবিয়ার উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“হা, দাওয়াত করে নিয়ে আসো এবার জঙ্গলের সবাইকে। আমার তো দায় ঠেকে পড়েছে সবগুলোকে খাওয়ানোর জন্য!”
“তুমি চুপ করো! পশুপাখিরা তোমাকে ভালোবাসে মানেই তুমি একজন ভালো মানুষ, যাকে পশুপাখিতে পছন্দ করেনা সে কোনো ভালো মানুষের কাতারে পড়েনা।”
মুখ ঝামটা মেরে বলল আনাবিয়া, তারপর আবার লেগে গেলো অসিলেট গুলোকে আদর করতে। মীর কিছুক্ষণ বিড়ালগুলোকে আনাবিয়ার আদর করা দেখলো তারপর বেজার মুখে বলল,
“আমিওতো তোমাকে ভালোবাসি, কই আমাকেতো এদের মতো করে কোলে নিয়ে আদর করোনা কখনো! বরঙ আমারই তোমাকে কোলে নেওয়া লাগে, হোয়াই?”
“কারণ আমি তোমার বউ, তোমার দায়িত্ব আমাকে আদর করা। তুমি এখন আমার বউ হয়ে যাও, দেখো আমি কোলে নেই কিনা!”
মীর ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে চোখ ঘুরিয়ে সামনে ফিরলো আবার, ক্যাটফিসটা প্রায় হয়ে এসেছে। এটাকে সাবাড় করে ঘুমোতে যেতে হবে ওরও।
কোকো খেতে খেতে এদের দুজনের ঝগড়া দেখে মিটিমিটি হাসছিলো, মীর সেটা দেখতে পেয়ে ওর মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল,
“খা জানোয়ার! এদিকে কি তোর?”
বেলা উঠেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে, এখন এদিকে শীতের বেলা, আগস্টের প্রায় শেষের দিকে৷ খুব বেশি শীত নেই যদিও, তবুও আশপাশ কুয়াশা মোড়ানো। জঙ্গলের ভেতরে আলো এসে পৌঁছায়নি এখনো, ছোপ ছোপ আঁধারে এখনো ছেয়ে আছে পুরোটা।
ব্যাকপ্যাক কাধে নিয়ে আবারও সামনে হেটে চলেছে ওরা তিনজন। গন্তব্য ওদের আমাজনের আরও গভীরে। সামনে মীর এগিয়ে চলেছে ম্যাশেটি দিয়ে ঝোপ ঝাড় কেটে কেটে, কোকো আছে সবার পেছনে। আনাবিয়া ওদের দুজনের মাঝখানে নেচে নেচে এগোচ্ছে।
কিন্তু কিছুদূর এগোতেই সচকিত হয়ে উঠলো মীর, ওকে হঠাৎ দাঁড়িয়ে যেতে দেখে ওর পেছনে থাকা আনাবিয়া কান খাড়া করে রইলো। সড়সড় শব্দ করে বেশ কয়েকটি সরিসৃপ বুকে ভর দিয়ে এগোচ্ছে জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। আনাবিয়া উচ্ছসিত হয়ে বলল,
“পাইথন ওগুলো আমি শিওর!”
বলে মীরকে পাশ কাটিয়ে একাই এগোতে নিলো ওদের দিকে। মীর পেছন থেকে সাবধান বাণী দিলো,
“আস্তে যেও, ঝোপঝাড়ে বেধে যেওনা যেন। আর ওদের চলার শব্দ শুনে মনে হচ্ছে ওরা বেশ অ্যাগ্রেসিভ এবিং ম্যেল পাইথন। তাই বেশি ঘাটাঘাটি করতে যেও না।”
মীরের কথা ও কানে নিলো বলে মনে হলোনা। দ্রুত পায়ে সামনে এগোতে এগোতে ওকে’ বলে ছুট দিলো। আর তারপর কিছু দূর গিয়েই ও উৎফুল্লতার সাথে জোরে চিৎকার দিয়ে বলে উঠলো,
“মীরি! এগুলো আমার আলফাদের সাইজের! ভীষণ বড়ো!”
মীর বুঝলো বউ তার আজ বেজায় খুশি। জঙ্গলের আজগুবি প্রাণী দেখে কোনো মেয়ে যে এত খুশি হতে পারে সেটা ওর জানা ছিলোনা। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে ও এগোলো সেদিকে৷ কোকো এগোলো ওর পেছন পেছন।
আনাবিয়া আলফাদকে পেয়েছিলো জঙ্গলের ভেতরেই, ওর মা মারা গেছিলো বন্য ষাঁড়ের পালের পায়ের নিচে পিষে। ডিম গুলো ছিলো জঙ্গলের অন্য কোণায়, সেখানে বাচ্চা ফোটার পর সবগুলোকে ঈগলে খেয়ে নিয়েছিলো, বাকি ছিলো শুধুই আলফাদ। ঈগলের পায়ের খোঁচা সেও খেয়েছিলো কিন্তু ঈগল জুৎ করতে পারেনি, তার আগেই আনাবিয়া এসে তুলে নেয় ওকে। আর তারপর নিয়ে আসে প্রাসাদে।
সেটার আস্তে আস্তে যা সাইজ হয় তাতে কোকোই ভড়কে যেতো মাঝে মাঝে। আলফাদ তাই ওদের সাথে দুষ্টুমি করতে হলেই চলে আসতো নিজের পাইথন ফর্মে তারপর উঠে যেত যার তার ঘাড়ের ওপর, চাপেই দম বেরিয়ে যাওয়ার অবস্থা হতো ওদের। ভয়ে ফ্যালকন তো ওর ধারে কাছেই যায়না এখন, কখন না জানি ওর পাটখড়ির মতো শরীরের ওপর আলফাদ তার হাতির মতো শরীর উঠিয়ে দেয়!
মীর কিছুদূর এগোতেই দেখলো আনাবিয়া এক স্থানে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মীর ওর কাছে এগিয়ে গিয়ে শুধালো,
“কি ব্যাপার? দাঁড়িয়ে গেছো কেন?”
“ওরা দল বেধে ফাইট করতে যাচ্ছে কারো সাথে। এখন ওদের ম্যেটিং সিজন চলছে না!
কিন্তু ওরা তো ম্যেটিং সিজনে পুরুষে পুরুষে লড়াই করে তবে ওরা এতগুলো ম্যেল মিলে একসাথে কোথায় যাচ্ছে?”
“ইন্টারেস্টিং, কিন্তু এখন ওসব দেখতে গেলে চলবে না শিনু। আমাদেরকে এগোতে হবে। ওরা যা পারে করুক, ন্যাচার কে ন্যাচারের মতো থাকতে দাও। ম্যুভ!”
বলে মীর পা বাড়ালো সামনের দিকে, কিন্তু আনাবিয়া পাইথন গুলোর গন্তব্যের দিকে চেয়ে ওখানেই ঠাই দাঁড়িয়ে রইলো।
আনাবিয়া এগোচ্ছেনা দেখে কোকোও দাঁড়িয়ে গেলো আনাবিয়ার পেছনে। মীর পেছন ফিরে ওদের দুজনকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে ভ্রু জোড়া কুচকে নিলো, বলে উঠলো,
“কি ব্যাপার, এগোও শিনু! এইখানে দাঁড়িয়ে থাকলে আমরা সময়ের ভেতর গন্তব্যে পৌঁছাতে পারবোনা।”
“কিছু একটা চলছে মীরি, কিছু একটা ঘটছে ওদিকে। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে সামথিং ইজ ফিশি।”
“নাথিং ইজ ফিশি শিনজো, আর তুমি যদি ভেবে থাকো ওরা কোনো হিউম্যানকে অ্যাটাক করতে চলেছে তবে ভুল ভাবছো। এদিকে যেসব ট্রাইব থাকে তারা সর্বক্ষণ দলবেধে থাকে, আর তারা এদের সম্পর্কে যথেষ্ট সচেতন। স্যো দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই। চলে এসো।”
আনাবিয়া তবুও দাড়িয়ে রইলো সেখানে, আর কিছুক্ষণ পরেই ওদের কানে ভেসে এলো কোনো মেয়েলি চিৎকার! আনাবিয়া চকিতে তাকালো মীরের দিকে, মীর নিজেও তাকালো আনাবিয়ার দিকে, আর এরপর কাউকে কিছু বলতে হলোনা, দুজনেই যেন পড়ে নিলো দুজনের মনের কথা। তারপর ঝড়ের গতিতে ছুটলো সেদিকে!
মুহুর্ত বাদেই ওরা এসে পৌছালো একটা খোলা জায়গায়, চোখে বাধলো একটা ছোট্ট কুড়েঘর। আর তার পাশেই দেখতে পেলো কিছুক্ষণ আগে এদিকে আসা পাইথনদেরকে অন্য আর একটা ম্যেল পাইথনের সাথে লড়তে।
কুড়েঘরটির ওপাশে নজর দিতেই মীরের চোখে বাধলো আর একটা পাইথনকে, যে কিনা তাড়া করে চলেছে একটা লম্বা চওড়া ছেলেকে, কোলে তার একটা ছোটখাট মেয়ে, ঢাউস পেট! মীর বুঝতে বাকি রইলোনা যে মেয়েটি সন্তানসম্ভবা!
দ্রুত আনাবিয়ার দিকে ফিরে ও তড়িৎ বেগে বলল,
“শিনু তুমি এদিকটা সামলাও আমি ওদেরকে দেখছি!”
আর তারপরেই ও বিদ্যুৎ বেগে ছুটে গেলো সেদিকে।
পাইথনটা বার বার চেষ্টা করছে ছুটে পালানো ছেলেটাকে ধরে ফেলার, একবার ধরতে পারলেই যে নিজের দানবীয় শরীরের কুণ্ডলীর চাপে ছেলেটার দম বের করে মেরে ফেলবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে গেলো মীর।
ছেলেটা ছুটছে, নিজের থেকেও তার কোলে থাকা অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটিকে বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য সে প্রচন্ড উৎকন্ঠিত! মেয়েটা নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে আকড়ে ধরে আছে ছেলেটাকে, বুকে মাথা চেপে রেখেছে শক্ত করে, যেন আজ এখানে জীবন শেষ হলেও এই ছেলেটার সাথে একত্রে সে মৃত্যুপথযাত্রী হতে পারে!
পাইথনটা ছুটছে সবেগে, আর একটু এগোলেই সে নাগাল পেয়ে যাবে ছেলেটার। পাইথনটা গতি বাড়ালো, আর এরপর ছেলেটাকে স্পর্শ করে ফেলার ঠিক আগ মুহুর্তে মীর ঝড়ের বেগে গিয়ে সটান দাঁড়িয়ে গেলো ছেলেটা আর তার পেছনে তাড়া করে চলা পাইথনটার ঠিক মাঝ বরাবর, পাইথনটা হঠাৎ নিজের সামনে অন্য কাউকে দেখে অকস্মাৎ নিজেকে থামাতে গিয়েও পারলোনা, সজোরে গিয়ে বাড়ি খেলো মীরের বুকের সাথে, তারপর ছিটকে থেমে গেলো।
শিকার হাত ফসকে যাওয়ায় ক্রোধে পাইথনটার যেন মাথা খারাপ হয়ে এলো এবার, দ্বিগুণ বেগে সে ছুটে এলো মীরকে আঘাত করতে, আর সে ছুটে আসা মাত্রই মীর এক হাতে সেটাকে উঁচু করে এক পাক ঘুরিয়ে বিদ্যুৎ বেগে ছুড়ে দিলো কুড়ে ঘরের অন্যদিকে লড়াই করতে থাকা সাপ গুলোর দিকে।
ধাম করে বিশাল পাইথনটা শব্দ করে পড়লো মাটির ওপর, কেঁপে উঠলো সমস্ত মাটি!
কিন্তু আনাবিয়ার কিছুই করা লাগলোনা। সে এসে অন্যপাশে লড়াইরত সাপগুলোর সামনে দাড়াতেই সাপগুলো কোনো এক অজানা কারণে হঠাৎ করেই থামিয়ে দিলো নিজেদের লড়াই, আনাবিয়ার ঝকঝকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে হিপনোটাইজড হয়ে স্থীর হয়ে গেলো সবগুলো, কমে গেলো তাদের হিংস্রতা।
সেগুলো সরে দাড়াতেই আনাবিয়া দেখলো এরা সবাই মিলে অন্য আর একটা ম্যেল পাইথন কে অ্যাটাক করছিলো।
পাইথনটার অবস্থা নাজেহাল, সমস্ত শরীরে ক্ষতের চিহ্ন! একে আর কিছুক্ষণ এভাবে রাখলে এর মৃত্যু নিশ্চিত। আনাবিয়া একপা একপা করে এগোলো মাটিতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে থাকা পাইথনটার দিকে। ওকে এগোতে দেখে সম্মোহিতের মতো পেছাতে শুরু করলো অন্য পাইথনগুলো, ভীতি আর আনুগত্যে নুইয়ে পড়লো ওরা।
আনাবিয়া এসে বসলো জ্ঞানহীন পাইথনটার কাছে, সমস্ত গায়ে ক্ষত তার, মাথাটা ফেটে রক্ত আসছে। নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য প্রাণপণে সংগ্রাম করে চলেছে সে যেন! পাইথনটাকে দেখা মাত্রই আলফাদের কথা মনে পড়লো আনাবিয়ার। মাথায় তড়িতে একবার হাত বুলিয়ে দিলো ও, তারপর খুজতে লাগলো কি দিয়ে এর চিকিৎসা করা যায়!
আমাজনের জঙ্গল ওষধি গাছপালা, গুল্ম দিয়ে ভর্তি! লাইফট্রির সুবাদে শিরো মিদোরির জঙ্গলের কোনো ওষধি গাছ সম্পর্কে জানতে ওর বাকি নেই, কিন্তু শিরো মিদোরির গাছপালা আর এখানের গাছপালার ভেতর অনেক পার্থক্য! তবুও নিজের শিরো মিদোরিয় জ্ঞান দিয়েই আনাবিয়া আশপাশে ছুটে গিয়ে কয়েকটা ওষধি গাছের লতাপাতা ছিড়ে নিয়ে এলো দ্রুত পায়ে।
পাইথনটার কাছে আবার ছুটে এসে কোলে তুলে নিলো তার মাথাটা। মীর ওই ছেলেমেয়ে দুটোর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলো, দেখছিলো ওর শিনজোর কান্ড কারখানা। আনাবিয়াকে ছোটাছুটি করতে দেখে ও চাপা গলায় বলে উঠলো,
“এই যে এসেছেন, মিসেস দয়ার সাগর, ডাক্তারনি অব শিরো মিদোরি।”
ছেলেমেয়ে দুটোর কানে মীরের মুখনিঃসৃত বাক্য গেলেও ওদের কোনো হেলদোল হলোনা, দুজনেই অবাক চোখে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে। রূপকথার কোনো রাজকন্যা ওদের সামনে দিয়ে ঘুরছে বলেই মনে হলো ওদের।
আনাবিয়া হাতে থাকা লতা গুল্ম গুলোকে হাতের ঘষায় রষ করে ফেললো মুহুর্তেই আর তারপর সেগুলো কোলে থাকা পাইথনটার মাথার ক্ষতস্থানে চেপে ধরে ও শুরু করলো ওর হ্যিলিং মেলোডি!
এখানে লাইফট্রি নেই, ও জানেনা কাজ হবে কিনা, তবুও গাইতে শুরু করলো ও। আর ওর মুখনিঃসৃত মোহনীয় নেশাক্ত সুরেলা কন্ঠস্বরের প্রভাব পড়লো আশেপাশের সকলের ওপর, ঝিমিয়ে পড়লো ওরা।
মীরের পাশে দাঁড়ানো ছেলে মেয়ে দুটো ঘুমের ভারে পড়ে নিতে যাচ্ছিলো, কিন্তু পড়ে যাওয়ার আগেই মীর ধরে ফেললো ওদেরকে। তারপর ধীর গতিতে নিচে নামিয়ে শুইয়ে দিলো সবুজ ঘাসের ওপর!
আনাবিয়া উবু হয়ে বসে আছে মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে। জ্ঞান ফেরেনি তার এখনো। মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা! মেয়েটির ফুলে থাকা পেটের আকার দেখে আনাবিয়া বুঝলো হয়তো খুব শিঘ্রই নতুন সদস্যের আগমণ ঘটবে।
জ্ঞান হারানো ছেলেটিকে পরখ করছে কোকো। জ্ঞান তার পুরোপুরি লোপ পায়নি ঠিকই কিন্তু সে হুশে নেই! চোখ মেলছে সে মাঝে মাঝে কিন্তু কোনো কিছু ঠাহর করতে পারছেনা৷
আনাবিয়ার একটু আগে শুশ্রূষা দিয়ে সারিয়ে তোলা পাইথনটা নিবিড় ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে আনাবিয়াদের থেকে কিছুটা দূরে মাটিতে বসে থাকা মীরকে। প্রচন্ড কৌতুহল নিয়ে সে ঘুরে ঘুরে দেখছে ওকে। মীর বিরক্ত হচ্ছে পাইথনটার কাজ কর্মে। কিন্তু অবুঝ জানোয়ারকে ও কিইবা বলবে!
কোকো কিছুক্ষণ ছেলেটিকে পরখ করে নিয়ে আনাবিয়ার দিকে ফিরে বলল,
“আম্মা, এর চোখ জোড়া দারুণ সুন্দর। সবুজ আর হলুদের মিশ্রণ বলা যায়।”
কোকোর কথা শুনে আনাবিয়া কৌতুহলী হয়ে এগিয়ে গেলো সেদিকে। কোকো জায়গা করে দিলো ওকে দেখার৷
মাটিতে শুয়ে থাকা ছেলেটার দিকে এগিয়ে আনাবিয়া ছেলেটার চোখের পাতা টেনে পরখ করলো ভেতরটা। মীর দূর থেকে ছেলেটার চোখ জোড়া দেখতে পেয়ে বলে উঠলো,
“এদিকে চোখের এমন শেড ভেরি রেয়ার! খুব সম্ভবত সিক্স টাইপের শেড দেখা যায় এদের ভেতরে, আর খুব বেশি হলে এক অথবা দুইটা রেয়ার শেড। বাট দ্যাট ওয়ান ইজ রিয়্যেলি ডিফরেন্ট!”
আনাবিয়া মীরের কথা শুনলো কিন্তু কোনো প্রতিউত্তর করলো না। ওর কৌতুহল এখন সম্পুর্ন হুশহীন ছেলেটার দিকে।
ছেলেটার জ্ঞান ফেরানোর জন্য ও এবার উদ্যত হলো। আশেপাশে তাকিয়ে খুজলো কিছু একটা। আর তারপর কাঙ্খিত গুল্ম টা পেতেই হাত বাড়িয়ে সেখান থেকে কয়েকটা পাতা ছিড়ে হাতের ভেতরে পিষে সে আলতো করে রাখলো ছেলেটার নাকের সামনে, আর রাখা মাত্রই ছেলেটা ভীষণ শব্দ করে একটা হাঁচি দিয়ে তড়াক করে উঠে বসলো। সন্ধানী চোখ জোড়া তড়িতে খুঁজে ফিরলো সাথে থাকা অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটিকে!
পাশে তাকাতেই তাকে দেখতে পেলো সে। দিন দুনিয়া ভুলে মেয়েটার ওপর এক প্রকার ঝাপিয়ে পড়ে তাকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করতে লাগলো ছেলেটা। মুখ থেকে অনর্গল একটা শব্দই বের হলো ওর, ‘রিমু!’
আনাবিয়া দেখলো ভারী বিপদ, এভাবে ঠেলাঠেলি করার কি আছে, এমন ধাক্কাধাক্কি করলে তো বাচ্চাটার ওপর প্রভাব পড়বে! এগিয়ে গিয়ে ছেলেটাকে দুহাতে হ্যাচকা টানে মেয়েটির থেকে সরিয়ে নিয়ে এসে ও ইংরেজিতে শাসনের সুরে বলে উঠলো,
“হোয়াট আর ইয়্যু ড্যুয়িং? ইয়্যু উইল হার্ট দ্যা বেইবি!”
ছেলেটা চকিতে একবার তাকালো পাশে, আনাবিয়াকে দেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলো কিছুক্ষণের জন্য। একে এমন সুন্দরী, তার ওপর গায়ে ডাইনোসরের মতো জোর! নইলে ওর মতো শরীরের ছেলেকে কিভাবে এক টানে সরিয়ে নিয়ে আসা যায়! ছেলেটা চোখে বিস্ময়, হতভম্বতা আর অসহায়ত্ব নিয়ে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে।
আনাবিয়া ছেলেটির মাথার ওপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে নরম গলায় বলে উঠলো,
“ইজি, ইজি; শী’জ অলরাইট! নাথিং ট্যু ওয়ারি অ্যাবাউট।”
ছেলেটা প্রচন্ড রকমের আস্বস্ত হলো যেন। এতক্ষণের জোরে জোরে চলা শ্বাস্টা শান্ত স্বাভাবিক হয়ে এলো।
ছেলেটি আনাবিয়ের থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার তাকালো মেয়েটির দিকে। আনাবিয়া ছেলেটির মুখের ওপর উঁকি মেরে ইংরেজি তে শুধালো,
“তোমার ওয়াইফ?”
ছেলেটি ওপর নিচে মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো, সেই মুহুর্তেই সামনে থেকে মীরেগমগমে কন্ঠে বলে উঠলো,
“তোমাকে দেখে তো অর্ডিনারি পিপল মনে হয়, তুমি এই জঙ্গলের ভেতর তোমার প্রেগন্যান্ট ওয়াইফ কে নিয়ে কি করছো?”
মীরের প্রশ্ন শুনে ছেলেটা চমকে উঠে তাকালো ওর দিকে, আর তাকিয়েই আশ্চর্য হয়ে আঁতকে উঠলো এক প্রকার। মীরের দিকে অবাক তাকিয়ে রইলো সে কিছুক্ষণ। ওর মেটালের মতো কালো রঙা চকচকা শরীর দেখে তব্দা খেলো সে।
মীর সেন্টি খাওয়া চোখে তাকিয়ে রইলো তার দিকে। কালো বলে সবাই এমনে তাকায় মনে হয় জীবনে প্রথমবার এমন ব্লাক শেড দেখছে।
ছেলেটার হুশ তখনো ভালোভাবে ফেরেনি, কিন্তু মীরকে দেখে যেন পুরোপুরি হুশে এলো সে। মীরের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে চমকে তাকালো আনাবিয়ার দিকে। আনাবিয়ার হীরকখন্ডের ন্যায় ঝিকিমিকি করতে থাকা চোখ আর সাদা রঙা ঝিলিমিলি চুল দেখে ছেলেটা চোখ রগড়ে আবার অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকালো আনাবিয়ার দিকে।
ছেলেটার কান্ডকারখানা দেখে আনাবিয়া হেসে উঠলো খিলখিল করে, তারপর ছেলেটার পিঠের ওপর জম্পেশ একটা থাবড়া মেরে বুঝিয়ে দিলো তার সামনে যা ঘটছে সবই সত্যি। থাবড়া খেয়ে ছেলেটা স্তম্ভিত হয়ে গেলো। তবে তার আশেপাশের এ মানুষ গুলো সত্যিকারের!
ছেলেটা এবার যেন শঙ্কিত হয়ে উঠলো কিছুটা। নিজের স্ত্রীর কাছে এগিয়ে গিয়ে ছোট্ট গোলগাল মেয়েটিকে আগলে নিলো ও নিজের দুহাতে, তারপর সতর্ক, শাণিত দৃষ্টিতে আনাবিয়া আর মীরের দিকে এক এক করে তাকিয়ে সে কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো,
“তোমরা কারা? আর এখানে কি করছো?”
জিজ্ঞেস করে উত্তরের অপেক্ষা করলোনা ছেলেটা, তড়িতে আশেপাশে তাকিয়ে পরিবেশটা দেখার চেষ্টা করলো। মনে করার চেষ্টা করলো জ্ঞান হারাবার আগে ঠিক কি হয়েছিলো!
সমস্ত কিছু মনে পড়তেই সে পাশ ফিরে তাকিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা পাইথন গুলোর দিকে দৃষ্টি দিলো। সব গুলোকে লেজে লেজে গিট্টু দিয়ে রেখেছে কারা জানি, নড়াচড়া করছেনা একটাও।
ছেলেটা সেদিকে একবার তাকিয়ে এক প্রকার আঁতকে ডেকে উঠলো,
“লিন্ডা!”
আনাবিয়া ছেলেটির কাছে এগিয়ে এসে কৌতুহল নিয়ে শুধালো,
“লিন্ডা কে?”
“আমার… আমার প্যেট পাইথন! ও- ওকি মরে গেছে?”
পাইথন গুলোর একটিকে দেখিয়ে অসহায় গলায় শুধালো ছেলেটা। আনাবিয়া উত্তর দিলো,
“ওদের একটাও মরেনি এখনো।”
ছেলেটা হাঁফ ছেড়ে বাচলো যেন। আনাবিয়া তাকিয়ে রইলো ছেলে টার দিকে। মীর ছেলেটাকে অর্ডিনারী পিপল বললেও ছেলেটা যে অর্ডিনারী পিপল নয় সেটা খুব ভালো ভাবেই খেয়াল করলো আনাবিয়া। ছেলেটার ক্যানাইন দাঁত জোড়া স্বাভাবিকের তুলনায় তীক্ষ্ণ, লম্বা, ধারালো! মুখের ভেতরটা সম্পুর্ন কালো, সাথে জিভটাও!
চমৎকৃত হলো আনাবিয়া। এদিকে এসে এমন কাউকে দেখতে পাবে সেটা ও কখনোই ভাবেনি। আনাবিয়া ওপাশে বসে থাকা মীর কে নিজেদের ভাষায় বলল,
“মীরি! এটা কোনো অর্ডিনারী পিপল নয়। হি ইজ অ্যা কাইন্ড অব হাইব্রিড।”
শেষোক্ত কথাটা ইংরেজিতে বলায় বুঝতে পারলো ছেলেটা। আনাবিয়ার দিকে শাণিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ও আবার শুধালো,
“আপনারা কারা? আর এখানে কেন এসেছেন?”
তারপর আনাবিয়ার শরীর, চোখ আর চুলের দিকে নির্দেশ করে শুধালো,
“ইজ দিস… সাম কাইন্ড অফ কস্টিউম?”
আনাবিয়া দুদিকে মাথা নেড়ে না বোঝালো। তারপর ছেলেটির দিকে এগিয়ে এসে ওকে এক প্রকার ঠেলে সরিয়ে দিলো মেয়েটির কাছ থেকে। তারপর নিজে লেগে পড়লো মেয়েটির জ্ঞান ফেরানোর কাজে।
ছেলেটিকে তার স্ত্রীর কাছ থেকে সরিয়ে দেওয়ায় ভয়ানক রেগে গেলো ছেলেটি, মগের মুল্লুক পেয়েছে নাকি? আনাবিয়ার উদ্দ্যেশ্যে কড়া করে কিছু বলতে যাচ্ছিলো কিন্তু তার আগেই পেছন থেকে মাটিতে বাবু দিয়ে সোজা হয়ে বসা মীর হিসহিসিয়ে বলে উঠলো,
“ড্যোন্ট… ইয়্যু… ডেয়ার!”
ছেলেটি ফিরে তাকালো পেছন দিকে, মীরের এমন রণমুর্তি দেখে তার রাগ দমে গেলো কিছুটা। আবার সামনে তাকিয়ে সে দেখতে লাগলো আনাবিয়া ঠিক কি করে।
আনাবিয়া বেশি কিছু করলো না। বিশেষ কায়দায় নিজের হাত জোড়া দিয়ে মালিশ করে দিলো মেয়েটির কপাল, মুখ, গলা আর বুক জুড়ে, আর তারপর কানের নিচে কোথাও ছোট করে একটা আঘাত করতেই চমকে জেগে গেলো মেয়েটি। জেগে উঠেই হাফাতে শুরু করলো সে! আনাবিয়া দুহাতে ধরে উঠিয়ে সোজা করে বসিয়ে দিলো তাকে। তারপর ছেলেটির দিকে তাকিয়ে আদেশের সুরে বলে উঠলো,
“পানি।”
ছেলেটি শোনা মাত্রই তড়িতে উঠে গিয়ে ঝড়ের বেগে পানি এনে দিলো আনাবিয়ার দিকে। আনাবিয়া ওর গতি দেখে চমকালো, মীরের দিকে ফিরে ভ্রু নাচিয়ে বোঝালো হাইব্রিড একটা পেয়ে গেছে!’
মীর যদিও পাত্তা দিলোনা, অন্যদিকে ফিরে বসে রইলো। বউয়ের ওমন মানবদরদী সত্তা ওর ভালো লাগেনা। এই ঝামেলায় না পড়লে এতক্ষণে কতদূর পর্যন্ত চলে যেতো ওরা! কিন্তু না, তার বউয়ের তো সমাজসেবা করা লাগবে!
আনাবিয়া মেয়েটিকে অল্প অল্প করে পানি খাইয়ে দিলে মেয়েটি ধাতস্থ হয়ে বসলো একটু, আর তারপর পাশে তাকিয়ে ওকে ধরে বসা আনবিয়াকে দেখেই স্তব্ধ হয়ে গেলো সে। চোখের পলক পড়লো না তার আর।
আনাবিয়া এসবে অভ্যস্ত, যেই ওকে দেখে সেই এভাবে স্থীর হয়ে যায়, এমনকি মীর ও মাঝে মাঝে হুটহাট করে স্থীর হয়ে তাকিয়ে থাকে ওর দিকে নির্নিমেষ চোখে। তাই ওর কোনো কিছু মনে হলোনা।
কিন্তু কিয়ৎক্ষণ বাদেই মেয়েটি নিজের দুহাত তুলে ছুয়ে দিলো আনাবিয়ার মাখনের মতো চোয়াল জোড়া, তারপর বিস্মিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি একদম পুতুলের মতো সুন্দর!”
আনাবিয়া অপ্রস্তুত হয়ে কেশে উঠলো। এটা মীর ছাড়া আর কেউ করেনা, হঠাৎ এই মেয়েটি এমন করায় লজ্জায় পড়ে গেলো ও৷ অপ্রতিভ দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ এদিকে ওদিক তাকিয়ে, মেয়েটিকে ভালোভাবে তার জায়গায় বসিয়ে দিয়ে নরম গলায় শুধালো,
“কেমন লাগছে এখন?”
“ভালো লাগছে, কিন্তু ক্ষিদে পেয়েছে!”
অসহায় গলায় বলে উঠলো মেয়েটি। পাশে দাঁড়ানো তার স্বামী সেটা শোনা মাত্রই দ্রুত বেগে হেটে চলে গেলো ওদের কুড়ে ঘরের ভেতরে। আনাবিয়া বুঝলো ছেলেটা খুব সম্ভবত খাবারের ব্যাবস্থা করতে গেছে।
আনাবিয়া মেয়েটির মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে শুধালো,
বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ২৯+৩০
“কি নাম তোমার?”
“রুমাইশা।”
“আর তোমার ওই গন্ডারের মতো হাজবেন্ডের নাম কি?”
নিযের স্বামীকে কারো থেকে গন্ডার উপাধি পেতে দেখে রাগলোনা রুমাইশা, উল্টো হেসে দিলো, বলল,
“ও আসলে গণ্ডার নয়, অজগর। ওর নাম সাফওয়ান।”
