বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ শেষ পর্ব 

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ শেষ পর্ব 
রানী আমিনা

বেলকনির দরজার পাশের জানালা ধরে দাঁড়িয়ে বাইরের রাতের দৃশ্য দেখছে আনাবিয়া। সফেদ চুল গুলো পিঠময় ছড়ানো, চিরুনীর ছোয়া লাগেনি তাতে গত দুদিন ধরে।
এ জানালায় পূর্বে কোনো রক্ষাবেষ্টনি ছিলোনা, কিন্তু দুদিন আগে ওকে প্রাসাদে নিয়ে আসার আগেই মীর লোক লাগিয়ে জানালায় শক্তপোক্ত গ্রিল তুলে দিয়েছে৷ বেলকনির দরজা সিলগালা, যেন আনাবিয়া চাইলেও পালিয়ে যেতে না পারে, যেতে চাইলেও যেন ওরা সতর্ক হয়ে যায়!

আনাবিয়ার মুখখানা শুকনো, কাল থেকে কিছুই মুখে তোলেনি ও, পানিটুকু পর্যন্ত নয়! ইয়াসমিনের পরিবর্তে যে মেয়েটিকে ওর দেখাশোনার জন্য রাখা হয়েছে সে মেয়েটি বাহির দরজার নিকট এক কোণায় চুপচাপ, জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ে দুরুদুরু করে কাঁপছে তার বুক।
বিগত কিছু বছরে শেহজাদীর করা নির্মম খুন গুলো সম্পর্কে প্রাসাদের কারো জানতে বাকি নেই, তিনি রেগে গেলে যে কাউকে ছেড়ে দেননা সেটা সম্পর্কে এখন সকলেই জ্ঞাত। ভয়ে তাই চুপসে আছে সে, কখন না জানি শেহজাদী রেগে গিয়ে ওর ওপরই চড়াও হন!

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

শেহজাদী কাল থেকে কিছুই খাননি, কিন্তু ভয়ের চোটে শেহজাদীকে খাওয়ার জন্য অনুরোধও করতে পারছেনা সে, কিছু বলতে গেলেই গলায় আটকে যাচ্ছে কথা৷
কিন্তু আনাবিয়া নির্বিকার৷ মীর তাকে শেকলে বেধে প্রাসাদে ফিরিয়ে নিয়ে আসার পর থেকেই সে নির্বিকার। চোখে পানির রেশটুকুও নেই, নেই কোনো অনুভূতি!
নিষ্প্রাণ শুষ্ক চোখে সে তাকিয়ে আছে বাইরে। কতখানি সময় ধরে সে এখানে দাঁড়িয়ে আছে হিসেব নেই, হয়তো সকাল থেকেই!

রাত টুকুও বিছানায় কাটায়নি সে, মেঝেতেই নির্ঘুমে, আধোঘুমে পার করে দিয়েছে।
এমন সময় বাইরে শোনা গেলো কারো পদশব্দ, আনাবিয়ার চিনতে বেগ পেতে হলোনা পদশব্দের মালিক কে। কিন্তু আজ সে নির্বিকার রইলো, দাসী গিয়ে দরজা খুলে দিলেও সামান্যতম বাধা দিলোনা সে, পাগলামি করলোনা, ক্রোধে উন্মাদ হলোনা। যেভাবে দাঁড়িয়ে ছিলো সেভাবেই রইলো, নড়লোনা পর্যন্ত!
দাসীটি দরজা খুলে মীরকে দেখা মাত্রই আনুগত্য জানিয়ে এক পাশে জড়বৎ দাঁড়িয়ে গেলো, এতদিন ধরে হেরেমের হাসি তামাসার ভেতর কাটিয়ে এসে হঠাৎ এই ক্ষমতাধরদের ভেতরে ঢুকে পড়ে প্রচন্ড অসহায় লাগছে ওর, চারদিকে শুধু অন্ধকার দেখছে।

মীর কামরায় ঢোকার পরও মেয়েটি বেরিয়ে যাচ্ছেনা দেখে মীর বিরক্তি নিয়ে তাকালো ওর দিকে। কিন্তু আনত নয়নে থাকায় সেটা দৃষ্টিগোচর হলোনা মেয়েটির, কিন্তু কৌতুহল বসত দৃষ্টি সামান্য ওপরে উঠাতেই মীরের অমন বিধ্বংসী দৃষ্টি দেখে বুকের ভেতর ধড়াস করে উঠলো তার, পড়ি কি মরি মরে ছুটে বেরিয়ে গেলো সে বাইরে!
আনাবিয়া তখনও ওভাবেই দাঁড়িয়ে, পেছনে ফিরে দেখার প্রয়োজনটুকু বোধ করলোনা৷ মীর ধীর পায়ে হেটে গেলো সেখানে।
রাতের খাবার নিয়ে ঢুকেছিলো দাসীটা, কিন্তু আনাবিয়া ছোয়নি কিছুই। গতকাল থেকে যতবারই খাবার নিয়ে আসা হয়েছে ততবারই আবার ফিরে গেছে কিচেনে।
মীর আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে এগিয়ে গেলো। আনাবিয়ার পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে আদেশের সুরে, মৃদুকন্ঠে বলল,

“খেয়ে নিবে এসো।”
আনাবিয়া কর্ণপাত করলোনা মীরের কথায়, তাকিয়ে রইলো দূর আকাশের পানে৷ ওকে কোনো রেসপন্স করতে না দেখে মীর তাড়া দিলো আবারও। কিন্তু কোনো হেলদোল হলোনা আনাবিয়ার।
ধৈর্যহারা হলো মীর এবার, আনাবিয়ার কোমর ধরে এক ঝটকায় ওকে নিজের দিকে ঘোরালো মীর, আনাবিয়া কঠিন চোখে একবার ওর দিকে তাকিয়ে ঘুরে আবার জানালার দিকে ফিরতে নিলো, কিন্তু মীর ফিরতে দিলোনা ওকে।
দুহাতে নিজের সাথে জাপ্টে ধরে নির্বিকার ভঙ্গিতে ওকে তুলে নিয়ে এলো মেঝেতে পেতে রাখা চাদরের ওপর।
আনাবিয়া কিয়ৎক্ষণ ছাড়া পাওয়ার জন্য ধস্তাধস্তি করলেও তাতে বিশেষ কোনো লাভ হলোনা, মীরকে এক বিন্দু পরিমাণ টলাতেও সক্ষম হলোনা সে, বরাবরের মতোই মীরের শক্ত থাবা থেকে নিজেকে ছাড়াতে ব্যর্থ হলো!
মীর ওকে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে এসে বসলো সেখানে। কোলের ভেতর আনাবিয়াকে রেখে এক হাতে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে চেপে রেখে অন্য হাতে সামনে থাকা নকশাদার চারপায়ার ওপরের খাবারের ট্রের এক কোণায় রাখা পাতলা রুটির একাংশ ছিড়ে সবজি মিশিয়ে পুরে দিলো আনাবিয়ার মুখের ভেতর।

আনাবিয়া জিভ দিয়ে ঠেলে ফেলে দিলো সেটাকে, কিন্তু নিচে পড়ার আগেই মীর ধরে ফেললো গ্রাসটুকু।
তারপর আবার সেটাকে জোর করে ঢুকিয়ে দিলো আনাবিয়ার মুখের ভেতর, আনাবিয়া আবারও ফেলে দিতে চাইলে মীর ধমকে বলে উঠলো,
“এক কুচি পরিমাণ খাবারও বাইরে এলে মেরে ফেলবো একদম! চুপচাপ খাও।”
মীরের ধমকে আনাবিয়া খাবার মুখে পুরেই বসে রইলো, চিবোলো না। মীর সেটা লক্ষ্য করে ফোস করে শ্বাস ছাড়লো। এই মেয়েটাকে নিয়ে ও কোথায় যাবে?
কড়া গলায় বলল,

“চিবিয়ে গিলে ফেলো, নইলে কিন্তু মুহসিন কে দিয়ে খুন্তি আনিয়ে খাবার সব গুতিয়ে পেটে চালান করবো।”
আনাবিয়া হাত জোড়া মুষ্টিবদ্ধ করে নিয়ে কোনো রকমে চিবিয়ে গিলে ফেললো সেটুকু। মীর এবার একের পর এক রুটি ছিড়ে খাওয়াতে লাগলো ওকে। বলে দিলো, পুরোটা শেষ না করলে ছেড়ে দিবেনা।
খাওয়া শেষে বাইরে চলে যাওয়া দাসীটিকে ডেকে খাবার ট্রেটা নিয়ে যেতে বলল মীর। দাসীটি কাঁপতে কাঁপতে এসে সেগুলো গুছিয়ে নিয়ে মেঝে থেকে চাদর উঠিয়ে গোছগাছ করেই পালালো।
মীর তখনও আনাবিয়াকে কোলে নিয়েই বসে রইলো মেঝেতে, আনাবিয়া একবার উঠে যেতে চাইলো, কিন্তু মীর তৎক্ষণাৎ ওকে ধরে আবার বসিয়ে দিলো কোলে। দুহাতে ওর কোমর পেচিয়ে পিঠটা ঠেকিয়ে নিলো নিজের বুকের সাথে।

তাকালো মীর আনাবিয়ার দিকে, পার্শ্ব থেকে দৃষ্টিগোচর হচ্ছে আনাবিয়ার শুভ্র, পাতলা চোয়াল। কানের কাছে কয়েকটি শুভ্র চুল এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে আছে, বাকি চুলগুলো পিঠ থেকে সরিয়ে আনাবিয়ার বুকের ওপর দিয়ে দিয়েছে মীর।
কানের কাছের চুলগুলোও এবার আলতো হাতে সরিয়ে কানের পেছনে গুজে দিলো মীর, কোমল গলায় বলল,
“এসব ভুলে যাও শিনজো! ভেবে নাও এসব কিছুই হয়নি। সবকিছু আগের মতোই আছে। আদতে সত্যিই তাই আছে। তুমি আমার কাছে আগেও যতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিলে এখনো ঠিক ততটাই আছো। তোমার গুরুত্ব আমার কাছে এতটুকুও কমেনি। কারো আগমন বা প্রস্থান কোনো কিছুতেই তোমার প্রতি আমার গুরুত্ব, ভালোবাসা, যত্ন কিছুই কখনো কমবে না।

আর সে সামান্য একজন দাসী, সন্তানটা পাওয়া মাত্রই সে এই পৃথিবী ছাড়বে! ছোট্ট প্রাণটা তোমার সন্তান বলেই পরিচিত হবে, তুমিই হবে তার আম্মা। আমি জানি তুমি তাকে যথেষ্ট মাতৃস্নেহ দিয়ে বড় করে তুলবে।”
আনাবিয়া এতক্ষণ চুপ করে শুনলেও এখন আর শুনতে পারলোনা, মীরের আলিঙ্গন থেকে নিজেকে এক ঝটকায় ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাড়ালো ও। মুহুর্তেই ভেঙে গেলো ওর গত দুদিনে করা ক্রোধের সংযম, ঘুরে মীরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে চরম আক্রোশে ও বলে উঠলো,
“আপনার সন্তান ধারণের অধিকার শুধুমাত্র আমার আছে, আমার! কেন অন্য কারো গর্ভের সন্তানকে আমি নিজের বলে পরিচয় দেবো? কোন কারণে?

হাজারবার বলেছি আপনাকে, একটিবার চেষ্টা করে দেখুন! অতীত সবসময় সত্য নাও হতে পারে, নিজে পরখ করে যাচাই করুন! কিন্তু আপনি আমার কথা শোনেননি, শোনার প্রয়োজনটুকু মনে করেননি!
আমি থাকবোনা আপনার সাথে, একমুহূর্তও থাকবোনা। আমাকে যেতে দিন আপনার জীবন থেকে, রেহায় দিন! আমি আপনার মুখ দেখতে চাইনা, ঘেন্না করি আমি আপনাকে!”
ভীষণ ক্রোধে হাঁপাতে লাগলো আনাবিয়া, রোষে পরিপূর্ণ বিস্ফোরিত চোখজোড়া দিয়ে তাকিয়ে রইলো ও মীরের দিকে।
মীর শ্বাস নিলো জোরে, তারপর আনাবিয়ার দিকে ডান হাতখানা বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“এদিকে আসো।”
“কখনোই আসবোনা!”
ঝাঝিয়ে বলল আনাবিয়া। মীর উঠে দাঁড়িয়ে এগিয়ে গেলো ওর কাছে, আনাবিয়াও পেছালো সাথে সাথে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ওর তখনও নিবদ্ধিত মীরের মুখের ওপর।
মীর এবার বিদ্যুৎ গতিতে এগিয়ে গিয়ে খপ করে ধরে ফেললো ওর কোমর, তারপর আগের মতোই করেই নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে আবার মেঝেতে এসে বসলো। বিছানার সাথে পিঠ ঠেকিয়ে দিয়ে কোলের ভেতর ছাড়া পাওয়ার জন্য হাত-পা ছুড়তে থাকা আনাবিয়াকে নিজের সাথে চেপে ধরে বলল,
“শান্ত হয়ে বসো, লাফালাফি কোরোনা।”

আনাবিয়া তবুও শান্ত হতে না চাইলে মীর এক হাতে আনাবিয়ার দুহাতের কবজি একত্রে নিয়ে চেপে ধরলো নিজের বুকের ওপর। অন্য হাতে আনাবিয়াকে জড়িয়ে নিয়ে চেপে ধরলো নিজের সাথে।
আনাবিয়া মীরের শক্তমুষ্ঠির ভেতর থেকে নিজের হাত ছাড়ানোর জন্য মুখ বাড়িয়ে নিয়ে তড়িতে কামড়ে ধরলো মীরের হাত, দাঁত বসালো গায়ের জোরে। কামড়ে ধরেই রইলো!
মীর কিছুই বলল না ওকে, চুপচাপ দেখে গেলো আনাবিয়ার কামড়ানো, দাঁত বসে গিয়ে চামড়া ভেদ করতে নিলেও টু শব্দটি করলো না!

আনাবিয়া এত জোরে কামড়ে ধরে থাকার পরও যখন দেখলো মীর কিছুই বলছেনা, বাধাও দিচ্ছেনা, তখন শান্তভাবে, মন্থরগতিতে মীরের হাত থেকে মুখ সরিয়ে সোজা হয়ে বসলো। ঠোঁটের কোণে লেগে রইলো ওর কামড়ে ক্ষত হয়ে যাওয়া মীরের হাতের রক্ত।
মীর নির্বিকার চোখে হাত বাড়িয়ে ঠোঁটের কোণ থেকে মুছে দিলো সেটুকু, স্নিগ্ধ কন্ঠে বলল,
“তুমি মানো বা না মানো, আমি তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি শিনজো।
তোমার প্রতি আমার ভালোবাসাটা অনেক কমপ্লিকেটেড৷

তোমাকে আমি নিজের হাতে করে বড় করেছি, তাই সেদিক থেকে তোমার প্রতি আমার একটা পিতৃসুলভ ভালোবাসা আছে। অন্যদিকে তুমি আমার স্ত্রী, তোমার সাথেই আমার সব রকমের ঘনিষ্ঠতা— শারীরিক, মানসিক।
তাই আমার ভালোবাসা নিয়ে কখনো তুমি প্রশ্ন তুললে সেটা আমার জন্য খুবই যন্ত্রণাদায়ক হয়।
ভালোবাসা বলতে আমি কেবল তোমাকেই বুঝি, আর সারাজীবন ভালোবাসার কথা এলে আমি শুধুমাত্র তোমাকেই স্মরণ করবো। কারণ তুমিই আমার প্রথম এবং শেষ ভালোবাসা।”
আনাবিয়া কিছুই বললোনা, নিশ্চুপে তাকিয়ে রইলো মীরের দাঁত বসে যাওয়া হাতের দিকে৷ মীরের কথায় মন গলছেনা ওর, গলবেনা।

মীর ওকে টেনে নিয়ে এলো আরও কাছে, ওর কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দিয়ে বলল,
“রাগ করে থেকোনা আমার ওপর, তুমি রাগলে যে আমি শান্তি পাইনা! বিগত তিন বছরের খুব কম রাতই আমি তোমাকে ছাড়া কাটিয়েছি।
এক্সিডেন্টের পর থেকে তুমি ঘুমোতে পারোনা রাতে, তোমাকে স্লিপিং পিল নিতে হয়। তুমি আমাকে দেখতে পারোনা, রেগে যাও। দরজাটাতো বন্ধ করেই রেখেছো, যেন আমি হুটহাট আসতে না পারি! তাই আমাকে অনেক রাতে আসতে হয়, যখন তুমি ঘুমিয়ে যাও!

তুমি পাশে না থাকলে আমি ঘুমোতে পারিনা, তোমার বুকের ঘ্রাণ না পেলে শান্তি পাইনা আমি! তুমি নিজেও জানো আমি তোমাকে কতখানি ভালোবাসি, কিন্তু তবুও অবিশ্বাস করো আমাকে।
তুমি ছাড়া অন্য কারো প্রতি বিন্দুমাত্র অনুভূতি নেই আমার, শারীরিক বলো বা মানসিক! আর কতবার এ কথা বোঝাবো তোমাকে বলো? আর কতভাবে বললে তুমি বুঝবে?”
শেষোক্ত প্রশ্নদ্বয় ব্যাকুল কন্ঠে শুধালো মীর। আনাবিয়া নিরুত্তর রইলো। ও জানে মীর রোজ রাতেই আসতো ওর কাছে, রোজ সকালে ঘুম ভেঙে নিজের পাশের ফাঁকা জায়গাটা উষ্ণ পেতো ও, গায়ে লেগে থাকতো মীরের ঘ্রাণ। কিন্তু সে কেন ও ঘুমিয়ে গেলে আসতো? ও জেগে থাকতে কি আসতে পারতোনা? একটাবার কি জড়িয়ে ধরে বলতে পারতোনা যে ওর ব্যাথায় সে নিজেও ব্যাথিত?
আনাবিয়ার অভিমান কমলোনা এতটুকুও, উত্তরোত্তর বেড়েই চলল, মীরের দিকে দৃষ্টি না দিয়েই সে ঝাঝালো গলায় বলে উঠলো,

“আপনি ভুল বলেছেন, আমার কোনো গুরুত্বই নেই আপনার কাছে। আপনি শুধুমাত্র আমাকে ব্যাবহার করছেন নিজের ভালো থাকার জন্য। আমার ভালো থাকা না থাকা নিয়ে আপনার বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। নিজের এমন মিথ্যাচার বন্ধ করুন!”
আনাবিয়ার এমন কথাতে মনোক্ষুণ্ণ হলো মীর, মুখখানা থমথমে হয়ে এলো। কন্ঠে কিছুটা রুক্ষতা মিশিয়ে ও বলল,
“কি আপনি’ আপনি’ লাগিয়ে রেখেছো, ভালোভাবে কথা বলো৷ তোমার মুখ থেকে আপনি’ শুনতে বিশ্রী লাগছে, তুমি’ করে বলো, নাম ধরে ডাকো আমাকে।”
“পারবোনা।”
কাঠকাঠ গলায় উত্তর দিলো আনাবিয়া। মীর কিয়ৎক্ষণ ওর মুখের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকিয়ে থেকে অতঃপর বলল,
“বুঝেছি, তোমার মূলত আদর প্রয়োজন, আদর না খেয়ে খেয়ে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। তাই কথায় কথায় ক্ষেপে যাচ্ছো।”

বলে আনাবিয়াকে কাছে টেনে নিতে চাইলো, কিন্তু সেই মুহুর্তেই ফোস করে উঠে মীরের কোল থেকে ছিটকে দূরে সরে গেলো আনাবিয়া। মীরের বিপরীতে ঘুরে বসে ক্ষিপ্ত কন্ঠে বলে উঠলো,
“একদম আমার কাছে আসার চেষ্টা করবেনা! তুমি একজন স্বার্থপর, তুমি শুধু নিজেরটাই বুঝো। অন্য কারো জন্য তোমার বিন্দুমাত্র প্রেম, ভালোবাসা, দরদ, সহানুভূতি নেই। তুমি একটা পশু, অনুভূতিহীন পশু— যে শুধুমাত্র, খাওয়া, ঘুম, ক্ষমতা আর কাম ছাড়া কিছুই চোখে দেখেনা!”
মীর শব্দ করে শ্বাস টেনে নিয়ে দাঁতে দাঁত চাপলো, চোয়াল শক্ত হয়ে এলো ওর৷ চোখ বুজে নিয়ে বাহাতের তর্জনী আর মধ্যমা দিয়ে বাপাশের ভ্রুটা কচলালো ও কিছুক্ষণ, কচলাতে কচলাতে বলে উঠলো,
“বাজে কথা বোলোনা শিনজো। আমি কি করছি সে সম্পর্কে আমি ভালোভাবেই জ্ঞাত, আমাকে আমার জাত চেনাতে এসোনা। আমিও যে জাতের তুমিও সে জাতেরই! অকারণে রেগো না আমার ওপর, ক্রোধ কখনো ভালো কিছু বয়ে আনেনা, ক্রোধ শুধুমাত্র ধ্বংস বয়ে আনে।”

“তো আমাকে যেতে দিননা, কেন আটকে রেখেছেন? আপনার চাহিদা মেটানোর জন্য তো সমস্ত হেরেমটাই পড়ে আছে, তবে কেন আমার কাছে এসেছেন? তারা আপনাকে শান্তিও দিবে, সন্তানও দিবে। আমি তো কোনোটাই দিতে সক্ষম হচ্ছিনা, তাইনা?”
ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো মীর, উঠে দাড়াতে দাড়াতে শক্ত গলায় বলল,
“ঠিক আছে। আমার সন্তানের মা কে তবে আমি রেখেই দিবো, রয়্যাল ফ্লোরে, তোমার কামরার পাশেই।”
“আমার পাশেই কেন? তোমার এই বিশাল প্রাসাদে তো কামরার অভাব নেই তাইনা?”
“অভাব নেই ঠিকই, কিন্তু সে যেহেতু আমার সন্তানের মা সেহেতু তাকে তোমার চোখের আড়ালে রাখার কোনো প্রয়োজন দেখিনা। সে এই মুহুর্ত থেকে তোমার সামনেই থাকবে!”
বলেই কামরা ছাড়লো মীর। আনাবিয়া শূন্য চোখে তাকিয়ে রইলো মীরের যাওয়ার পানে৷ এই মুহুর্ত থেকে মানে কি? সে কি তবে প্রাসাদেই আছে? সে কি এই প্রাসাদেই ছিলো এতদিন? ও কি এতটুকুও বুঝতে পারেনি কখনো! তবে মীরের কিমালেবে কি কাজ পড়েছিলো?
তবে কি সেদিন সে কিমেলেব থেকে ওই মেয়েকেই নিয়ে আসতে গেছিলো? তাকে কি তবে সে প্রাসাদে নিয়ে এসেছে!

নিঃশ্বাসের গতি বাড়লো আনাবিয়ার, মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজনায় মাথার ভেতরটা ঘুরে উঠলো আচমকাই, চোখ জোড়াতে নেমে আসতে চাইলো আঁধার! ঘুরে পড়ে যেতে নিয়েও নিজেকে তৎক্ষনাৎ সামলে নিলো ও।
তবে… তবে সত্যিই সে মেয়ে এই প্রাসাদে? এই দেমিয়ান প্রাসাদে? ওরই আশেপাশে?
দুর্বল হাতে ভর দিয়ে মেঝে থেকে কোনোরকমে উঠে দাড়ালো আনাবিয়া। বুকের ভেতরের এতক্ষণের দামামা বাজিয়ে চলা যন্ত্রণা আর অসহায়ত্ব এক হয়ে ভয়ানক ক্রোধে পরিণত হলো ওর!
এতদিন এতকিছু করেও মীরের শান্তি হয়নি, এখন সে ওই মেয়েকে প্রাসাদে নিয়ে এসেছে ওরই সামনে দিয়ে, অথচ ও কিচ্ছুটি টের পায়নি!

ওকে… ওই মেয়েকে রয়্যাল ফ্লোরে রাখবে, ওরই কামরার পাশে! ওই মেয়ে আনাবিয়ার চোখের সামনে দিয়ে ঘুরবে বারান্দায়, খেলা করবে নিজের বাচ্চার সাথে! আর মীর? মীর কি করবে?
বাচ্চার সাথে খেলা করবে সেও, ওই মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিবে! নিয়ে যাবে নিজের কামরায়, ওরা তিনজনে… তিনজনে থাকবে আনাবিয়ার পাশের কামরায়, কতইনা খুশি থাকবে ওরা, কতইনা হাসি আনন্দে মেতে থাকবে! রাত হলে কতইনা আদরের শীৎকার ধ্বনি শোনা যাবে ও কামরা থেকে!
আনাবিয়া আর ভাবতে পারলোনা, দম আঁটকে আসতে চাইলো ওর, জোরে জোরে দম ফেলেতে লাগলো ও!
দাঁতে দাঁত চেপে গেলো, চোয়ালদ্বয় শক্ত হয়ে এলো মুহুর্তেই! অসম্ভব, অসম্ভব……! এই প্রাসাদে হয় ও থাকবে নয়তো ওই মেয়ে।
মেঝে থেকে তৎক্ষনাৎ উঠে দাড়ালো ও, তারপর কামরার বা দিকের দেয়ালে থাকা ওয়াল আলমিরার থেকে নিজের নকশাদার ধারালো খঞ্জরটা নিয়ে এগোলো ইয়াসমিনের কামরার দিকে৷ একমাত্র সে-ই জানবে মেয়েটিকে কোথায় রাখা হয়েছে!

মীর ছিলো রয়্যাল ফ্লোরের অন্য কোণায় থাকা দ্যা রয়্যাল জ্যু কামরায়। সেখানে এখন চারজন সদস্য আছে। লিও কাঞ্জি, কোকো আর ফ্যালকন। বাকিরা সবাই যে যার কাজে৷
কোকো ফ্যালকন যদিও সবসময় প্রাসাদে থাকেনা, রোজ গিয়ে শিরো মিদোরির প্রধান প্রধান সীমানা রেখায় একবার করে চোখ বুলিয়ে আসে৷
ফ্যালকনের ঝামেলা কম, তার সব কাজ তাকে টেকনোলজির সাহায্যে করতে হয়, বসে বসে সারাক্ষণ স্ক্রিনে চোখ রাখা ছাড়া তার অন্য কোনো কাজ নেই। পঞ্চদ্বীপের বর্ডারের গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলোর সিসি ক্যামের সমস্ত ফুটেজের ওপর নজর রাখতে হয় তাকে।

মীর এসেছিলো কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা করতে। কানে ওর লিসনিং ডিভাইস। আনাবিয়ার আচরণ অস্বাভাবিক হওয়ার পর থেকে এতটুকু সময়ের জন্যেও ডিভাইসটা কান থেকে খুলেনি ও। কোনো সর্বনাশ হওয়ার আগেই আনাবিয়ার সমস্ত কথাবার্তা, সমস্ত পদক্ষেপ যেন মুহুর্তেই ধরতে পারে তার জন্যই এই ব্যাবস্থা।
নইলে তার বউ রেগে গেলে যা কিছু করে ফেলতে পারে। সেদিন কোকোকে সময় মতো না পাঠালে হয়তো ইয়াসমিনকেও মেরেই ফেলতো!

আলোচনার এক পর্যায়ে মীর হঠাৎ শুনতে পেলো আনাবিয়ার পায়ের শব্দ, ছুটছে সে কোথাও যাওয়ার উদ্দ্যেশ্যে!
মীর কথা বলতে বলতেই থেমে গেলো হঠাৎ, কান পেতে রইলো শোনার জন্য যে ঠিক কি হচ্ছে৷ আনাবিয়া ছুটে কোথাও যাচ্ছে সেটা টের পাওয়া মাত্রই বসা থেকে উঠে দাড়ালো মীর৷ দ্রুত পায়ে এগোলো আনাবিয়ার কামরার দিকে, ও কি পালিয়ে গেলো? সিলগালা বেলকনি ভেঙে কি লাফিয়ে জঙ্গলে চলে গেলো?
মীর দ্রুত গতিতে এসে খুললো আনাবিয়ার কামরার দরজা। কামরায় নেই আনাবিয়া, বেলকনির দরজাও আগের মতোই আছে, তবে? কোথায় গেলো সে?
মীর ছুটে এলো নিজের কামরায়৷ দ্রুত টেবিলে রাখা পাতলা স্বচ্ছ ল্যাপটপের স্ক্রিন ওপেন করলো আনাবিয়ার অবস্থান কোথায় দেখার জন্য।
আর স্ক্রিন ওপেন করে আনাবিয়ার অবস্থান পাশের ফ্লোরে দেখা মাত্রই বুক কেঁপে উঠলো মীরের৷ শ্বাস আঁটকে এলো!
ওর বাচ্চা…… ওর বাচ্চাটা!

মীর ছুটে বেরিয়ে এলো বাইরে, তারপর নিজেও ছুটলো পাশের ফ্লোরে। কোকো লিও রা কামরার বাইরের দাঁড়িয়ে ছিলো, মীরকে এভাবে বেরিয়ে ছুটে যেতে দেখে একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে ছুটলো ওরাও!
আনাবিয়া এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে আছে ইয়াসমিনের পাশের কামরায়। হাতে ওর খঞ্জর। ইয়াসমিনকে খুঁজতে এসে সে দেখে ফেলেছে এক অপ্রিয় তিক্ত সত্য!
সে যাকে খুজে চলেছিলো, যার কাছে এসেছিলো সন্ধানে, সেই পরমযত্নে আগলে রেখেছে তাকে!
আনাবিয়াকে এভাবে মেয়েটির দিকে, মেয়েটির স্ফিত উদরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রচন্ড ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে গেলো ইয়াসমিন। ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো আনাবিয়ার পা জোড়া, ফুপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
“শেহজাদী, দয়া করে এমন কিছু করবেন না! হিজ ম্যাজেস্টি সহ্য করতে পারবেন না, রেগে যাবেন তিনি, ভেঙে যাবেন! দয়া করুন!”

আনাবিয়া শুনতে পেলোনা ইয়াসমিনের কোনো কথা, অপলকে তাকিয়ে রইলো সিয়ারার দিকে। সিয়ারা মেয়েটা কথা বলছেনা কোনো, নিজের আয়তলোচনের বিস্মিত, মুগ্ধ দৃষ্টি দিয়ে দেখে চলেছে আনাবিয়াকে।
ইয়াসমিন তখনও আনাবিয়ার পা জড়িয়ে ধরে করে চলেছে অনুনয়, যেন এই ভুল সে না করে। আনাবিয়া পা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো ইয়াসমিনকে। পা বাড়িয়ে এগোলো সিয়ারার দিকে। সিয়ারা মেয়েটা তখনো এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আনাবিয়ার দিকে।

আনাবিয়া কিয়ৎক্ষণ মেয়েটির মিষ্টি মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো, তারপর হঠাৎ করেই কাঠকাঠ গলায় শুধোলো,
“আমার স্থান কেড়ে নেওয়ার খুব শখ তোমার?”
সিয়ারা মেয়েটার হুশ ফিরলো আনাবিয়ার প্রশ্নে, থতমত খেয়ে সে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে, প্রশ্নটা বুঝতে সময় লাগলো। কি উত্তর দিবে ভেবে পেলোনা।
আনাবিয়া আরও একটু এগিয়ে এসে কড়া গলায় বলল,
“চুপ করে আছো কেন? উত্তর দাও!”

মেয়েটি ঢোক গিললো, প্রচন্ড ভয়ে চুপসে গিয়ে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে। বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ করছে তার, এই বুঝি হাতের ধারালো খঞ্জরটা চালিয়ে দেয় তার পেটে!
ইয়াসমিন অবস্থা ভালোনা দেখে পেছন থেকে হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে এলো আবারও, পেছন থেকেই আনাবিয়ার পা জড়িয়ে ধরে ভীতসন্ত্রস্ত গলায় বলল,
“শেহজাদী, কামরায় ফিরে যান প্লিজ! সিয়ারার গর্ভের সন্তানের কোনো ক্ষতি হলে হিজ ম্যাজেস্টি শেষ করে দিবেন সবকিছু, দয়া করে কামরায় ফিরে যান!”
আনাবিয়া স্থীর হয়ে তাকিয়ে রইলো সিয়ারার দিকে, সিয়ারা ভয়ে দুহাতে আকড়ে ধরলো নিজের পেট! এই পেটে একটু একটু করে বড় করেছে ও হিজ ম্যাজেস্টির সন্তানকে। হিজ ম্যাজেস্টি তো আর তাকে ভালোবাসেন না! আজ পর্যন্ত কখনো একটি বারের জন্যও জিজ্ঞেস করেননি যে সিয়ারা কেমন আছে, যতবারই দেখা হয়েছে জিজ্ঞেস করেছেন বাচ্চা কেমন আছে, এর বাইরে আর কিছুইনা।
তবুও শেহজাদীর এত কিসের আক্রোশ তার ওপর!

আনাবিয়ার ক্রোধ যেন কমার বদলে উলটো বেড়েই গেলো! যে বিশ্বাসঘাতকতা এতদিন সে শুধুই শুনতো, অনুভব করতো— আজ সেটা বাস্তব হয়ে ধরা দিয়েছে ওর চোখে! কিভাবে পারলো মীর এমনটা করতে? কিভাবে অন্য কাউকে নিজের কাছে ঘেঁষতে দিলো!
মুহুর্তেই আনাবিয়ার কল্পনায় ভেসে উঠলো মীরের সাথে এই মেয়েটির ঘনিষ্ঠ হওয়ার দৃশ্য, মীরের প্রচন্ড আদরে সিক্ত হয়ে তৃপ্ত হওয়ার দৃশ্য!

দেখতে পারলোনা ও আরকিছুই, চোখ খিচে বন্ধ করে নিলো সঙ্গে সঙ্গে, আর তার পরমুহুর্তেই ঘুরে দাঁড়িয়ে তড়িৎ গতিতে নিজের বা হাতে চেপে ধরলো সিয়ারার গলা, চোখ মুখ শক্ত হয়ে এলো ওর।
সিয়ারার শ্বাসনালি আটকে এলো এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণে, শ্বাস নেওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে আনাবিয়ার হাতখানা নিজের গলা থেকে ছাড়ানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলো সে, কিন্তু ব্যর্থ হলো!
আনাবিয়ার ঝলমলে চোখে চোখ রেখে অস্ফুট জড়ানো স্বরে কোনো রকমে বলে উঠলো,
“আম-মার কিছু হ-হলে হিজ ম-ম্যাজেস-টি আপ-নাকে চ-ছেড়ে দ-দিব-বেন নাহ!”
সিয়ারার মুখনিঃসৃত বাক্যটা আনাবিয়ার ক্রোধের আগুনে ঘী হয়ে পড়লো যেন! রাগে রিরি করে উঠলো ওর শরীর, মীরের ওপর জমা সমস্ত ক্রোধ, সমস্ত অভিমান এই মুহুর্তে রুপান্তরিত হলো ঘৃণায়!
সিয়ারার গলা থেকে ঝড়ের গতিতে হাত সরিয়ে নিয়ে সে ডান হাতের মুঠিতে ধরে রাখা খঞ্জরটা দিয়ে বিদ্যুৎ গতিতে চালিয়ে দিলো সিয়ারার গলার নলি বরাবর।

আর ঠিক সেই মুহুর্তেই হুড়মুড়িয়ে কামরায় ঢুকলো মীর! সিয়ারা নিজের ফোয়ারার ন্যায় রক্ত বের হওয়া গলা চেপে ধরে ঢলে পড়লো মেঝেতে, পেটের এক পাশে লাগলো শক্ত মেঝের তীব্র আঘাত, চোখ উল্টে বন্ধ হয়ে এলো সাথে সাথেই!
মীর অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার দিকে, এক ক্রোধিত আর্তনাদ বেরিয়ে এলো ওর বুক চিরে,
“কি করলে তুমি শিনজো!”
মীরের পেছনে সেই মুহুর্তেই এসে উপস্থিত হলো লিও, কাঞ্জি, কোকো আর ফ্যালকন! সিয়ারাকে এভাবে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখে প্রমাদ গুনলো ওরা! কি হবে এবার! এবারই কি শেষ হয়ে যাবে সবকিছু?

প্রাসাদের মেডিক্যাল জোনের বাইরের বারান্দা জুড়ে তাজা রক্তের ছোপ। ভেতরে শোনা যাচ্ছে শোরগোল। বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে কোকো ফ্যালকন লিও কাঞ্জি। চিন্তায় ওরা শেষ হয়ে যাওয়ার জোগাড়।
মেডিক্যাল জোনের রয়্যাল ওটির ভেতর সিয়ারার গর্ভের বাচ্চাটাকে নিয়ে চলছে টানা হ্যাচড়া৷ কিছুক্ষণ আগেই সিয়ারার পেট চিরে বের করা হয়েছে বাচ্চাটাকে। সবাই মনে মনে প্রার্থনা করে চলেছে বাচ্চাটা যেন জীবিত থাকে!
সিয়ারা মারা যাওয়ার মিনিট দশেকের ভেতরেই তাকে মেডিক্যাল জোনে নিয়ে আসা হয়েছে, বাচ্চাটার ব্রেইন ড্যামেজ হয়ে গেছে কিনা বোঝা যাচ্ছেনা৷

কর্তব্যরত চিকিৎসক দ্রুত তাকে এনআইসিইউ তে নিয়ে গেছে, অক্সিজেন সাপোর্টে রাখা হয়েছে তাকে৷
মীর বসে আছে মেডিক্যাল জোনের ভেতরে রাখা সোফায়, হাত জোড়া ভিজে আছে সিয়ারার রক্তে। হাতটা কাঁপছে ওর থরথর করে, চোখ জোড়া স্থির হয়ে আছে মেঝের দিকে!
ওর বাচ্চাটা… ওর এতটুকুন বাচ্চাটা সাত মাসে পড়েছিলো। আর কয়েকটা দিন, আর দুটো তিনটে মাস, তারপরেই ওর বুকে এসে পড়তো তুলতুলে বাচ্চাটা! কিন্তু… কিন্তু এখন কি হবে সেটা শুধু সৃষ্টিকর্তাই জানেন!
এনআইসিইউ থেকে ডাক্তার বেরিয়ে এলো হন্তদন্ত হয়ে, মীরের কাছাকাছি এসে বলল,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, শেহজাদার অবস্থা বেশি ভালো নয়, সিয়ারাকে নিয়ে আসতে একটু বেশিই দেরি হয়ে গেছে। অক্সিজেনের অভাবে শেহজাদার ব্রেইন ড্যামেজ হয়ে গেছে। এদিকে ফুসফুস এখনো পুরোপুরি গঠিত না হওয়ার কারণে উনি শ্বাস নিতে পারছেন না, তাঁকে ইনকিউবেটরে অক্সিজেন সাপোর্ট দিয়ে রাখা হয়েছে, হাইপোথার্মিয়া থেরাপি দেওয়ার ব্যাবস্থা করে হয়েছে। কিন্তু উনি কতক্ষণ সার্ভাইব করবেন বলা যাচ্ছেনা! তাঁর ব্রেইন ড্যামেজ কতখানি সিভিয়ার সেটাও এখনো আমরা জানিনা, গুরুতর হলে তাঁকে বাঁচানো সম্ভব হবেনা। আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি।”

হেকিম দাঁড়িয়ে রইলো মীরের আদেশ বা কোনো উত্তরের অপেক্ষায়। কিন্তু মীর কিছুই বলছেনা দেখে সে আনুগত্য জানিয়ে আবার ছুটলো এনআইসিইউ এর ভেতর।
মীর ঠাঁই বসে রইলো সেখানে। নিষ্পলক চোখে মেঝের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করে শুধু সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করতে লাগলো যেন এবার আর তার বুক খালি না হয়, এবারের মতো নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে যেন ওর কোলে ফিরিয়ে দেন তিনি!

রেড জোনের ভেতরে, দেমিয়ান প্রাসাদের পাদদেশে বিরাট এরিয়া জুড়ে দেমিয়ানদের পারিবারিক কবরস্থান। সেখানে ভিড় জমিয়েছে সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তিবর্গ।
এই মুহুর্তে মৃত শেহজাদাকে কবরে শায়িত করা হচ্ছে।
বাচ্চাটাকে গতকাল এনআইসিইউ তে নেওয়ার চব্বিশ ঘন্টা পরই শ্বাসক্রিয়ায় ব্যাঘাত জনিত কারণে মারা গেছে সে৷
কবরস্থানের বাতাস আজ যেন অত্যন্ত ভারী। চারপাশের নিস্তব্ধতা এনে দিয়েছে অদ্ভুত বিষণ্ণতা। সূর্য হেলে পড়েছে পশ্চিমে, তার শেষ রশ্মিগুলো হালকা কমলা রঙ ছড়িয়ে দিয়েছে আকাশজুড়ে।
মীর জড়বৎ দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সদ্য খোড়া কবরটার দিকে, গায়ে ওর এখনো গতকালের পোশাক, হাত জোড়া রক্তমাখানো। নিজেকে পরিষ্কার করার ফুরসত টুকুও সে পায়নি। সারাটাক্ষন বসে থেকেছে নিজের জীবন মফণের সন্ধিক্ষণে থাকা সন্তানের শিওরে!

ওর চোখের সম্মুখে মাটি ধীরে ধীরে ঢেকে দিচ্ছে ছোট্ট কাফন-মোড়ানো দেহটি। মীর অনুভব করছে, প্রতি মুঠো মাটি যেন তার বুকের ওপর পড়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে তাকেই!
ধীরে ধীরে মাটির গহীনে হারিয়ে যাচ্ছে তার রক্ত, তার নিঃশ্বাসের অংশ, তারই ঔরসজাত সন্তান!
জায়ান আর নওয়াস দাঁড়িয়ে আছে মীরের পাশে, জায়ান কাঁধে হাত রেখে স্বান্তনা দিচ্ছে ওকে, নওয়াস দাঁড়িয়ে আছে চুপচাপ!
জায়ান স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে মীরকে, কিন্তু সে শুনছে না কোনো কিছুই! নিরব হয়ে আছে সম্পুর্ন। বুকের ভেতর তার আজ এক আকাশ শূন্যতা!

তার ছোট্ট সন্তানটিকে মাটির নিচে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে, পৃথিবীর স্পর্শ থেকে চিরতরে বিচ্ছিন্ন করে। এখানে, এই ছোট্ট কবরে কখনো আর আলো পৌঁছাবে না। এই পৃথিবীর বুকে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ হলোনা তার বাচ্চাটার, দেখতে পেলোনা সে এই পৃথিবীর অসাধারণ সৌন্দর্য!
জনমানুষের ভিড় সরে গেলো ধীরে ধীরে। আস্তে আস্তে ফাঁকা হয়ে এলো কবরস্থানের এরিয়াটা। নওয়াস জায়ানও একসময় চলে এলো মীরকে রেখে, সুযোগ করে দিলো শোক সামলানোর!

মীর দাঁড়িয়ে রইলো একা, নিঃসঙ্গ হয়ে! হাত জোড়া ওর মুষ্টিবদ্ধ, অধরদ্বয় শক্তকরে চেপে রাখা একত্রে। এতক্ষণ মরুভূমির ন্যায় শুষ্ক ছিলো তার চোখ। কিন্তু এবার ধীরে ধীরে তরলে ভর্তি হতে শুরু করলো সে জোড়া।
ভেতরে তার যে বিশাল সমুদ্র গর্জন করছে তা থামানোর সাধ্য যে কারো নেই!
দূর আকাশের পানে তাকিয়ে একটি ঝড়ো দীর্ঘশ্বাস ফেললো মীর, চোখ জোড়া থেকে গড়িয়ে পড়লো দুফোটা লোনা পানি। গভীর শূন্যতার মাঝে এক অদৃশ্য আকুতি নিয়ে চেয়ে রইলো ও অপলক!

আনাবিয়া বসে আছে নিজের কামরার মেঝেতে। গায়ের পোশাক খোলেনি সেও। গতকাল সেইযে এসে বসেছে এখানে আর নড়েনি এতটুকুও!
হাতে ওর এখনো ধরা রক্তমাখা খঞ্জরখানা। শুভ্র ত্বকে লেগে আছে সিয়ারার রক্তের দাগ, শুকিয়ে আঁটকে গেছে চামড়ার সাথে। এলার্জির কারণে র‍্যাশ বেরিয়ে গেছে মুখে। নিঃস্তব্ধ হয়ে বসে আছে সে চুপচাপ।
ইয়াসমিন দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে, গত চব্বিশ ঘন্টায় শতবার অনুরোধ করা হয়ে গেছে তার, যেন সে একটু উঠে গিয়ে নিজেকে পরিষ্কার করে নেয়, নয়তো ইয়াসমিনকে অনুমতি দেয় পরিষ্কার করে দেওয়ার। কিন্তু আনাবিয়া কোনো রেসপন্স করেনি। ইয়াসমিন ওর কাছে যেতে চাইলেও নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে, স্পর্শ কর‍তে দেয়নি একটুও!
বাহিরে এমন সময় শোনা গেলো কারো ধীর, ভারী, শোকে পরিপূর্ণ পদশব্দ! চিরচেনা ব্যাক্তিটির উপস্থিতি টের পেয়ে শিউরে উঠলো আনাবিয়া। বুকের ভেতর ভীষণ ভয় ফণা তুলে উঠে বাড়িয়ে দিলো হৃৎপিণ্ডের গতি!
ইয়াসমিন তখনো শুনতে পায়নি মীরের পদশব্দ। মীর দরজার কাছে এলে বুঝতে পারা মাত্রই দরজা খুলে দিলো ও। চকিতে একবার মীরের মুখপানে চেয়ে চোখ নামিয়ে নিলো মুহুর্তেই।

তাকানো যাচ্ছেনা তাঁর দিকে, তীব্র শোক আর ক্রোধে বজ্রকঠিন হয়ে আছে তার মুখোশ্রি!
ইয়াসমিন শুকনো ঢোক গিলে ঝড়ো পায়ে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে। মীর কামরায় ঢুকেই দরজা দিয়ে দিলো ভেতর থেকে, আর তারপর নিজের ভারী পদযুগল ফেলে আনাবিয়ার সম্মুখে গিয়ে দাঁড়িয়ে ইস্পাত কঠিন কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন করলে এমন?”
ইয়াসমিন বাইরে বেরিয়ে ভয়ে, শঙ্কায় দিশেহারা হয়ে ছুটলো কোকো দের কামরার দিকে। দরজার সামনে গিয়ে দ্রুত হাতে সজোরে কড়া নেড়ে ডেকে উঠলো,
“কোকো ভাইয়া, লিও ভাইয়া, দরজা খুলো!”
কোকো লিওরা চারজনে বসে নিজেদের ভেতর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়েই আলোচনা করছিলো চাপাসুরে। ইয়াসমিনের এমন ভয়ার্ত কন্ঠ শুনে সাথে সাথেই এসে দরজা খুলে দিলো কোকো, শুধালো,
“কি হয়েছে আপা? আপনি এমন করছেন কেন?”
“ভাইজান, হিজ ম্যাজেস্টি ফিরে এসেছেন। শেহজাদীর কামরায় আছেন, ভেতর থেকে দরজা দিয়ে দিয়েছেন! আমার অনেক ভয় করছে, আপনারা চলুন!”
কথা শেষ করেই ফুপিয়ে কেদে উঠলো ইয়াসমিন। কোকোর বুক কেঁপে উঠলো৷ সকলে মিলে ছুটলো সাথে সাথেই৷ আনাবিয়া আর মীরের কামরার সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে রইলো চুপচাপ, স্পষ্ট শুনতে পেলো মীরের কঠিন স্বর!

মীর হাটু মুড়ে বসে আছে আনাবিয়ার মুখোমুখি, আনাবিয়া চুপ হয়ে আছে, তিরতির করে কাঁপছে ঠোঁট জোড়া, চোখ জোড়া টলমল করছে।
মীর আবারও কঠিন স্বরে প্রশ্ন করলো,
“জবাব দাও আমার কথার, কেন করলে এমন? কেন মারলে আমার বাচ্চাটাকে? কি ক্ষতি করেছিলো ও তোমার?”
আনাবিয়া নিরুত্তর রইলো, টলমল চোখ জোড়া ভার সইতে না পেরে ফোটায় ফোটায় ভিজিয়ে দিলো ওর চোয়াল। ওকে চোখের পানি ফেলতে দেখে মীর যেন ক্রোধে উন্মাদ হয়ে গেল এবার, বজ্র কন্ঠে হুঙ্কার দিয়ে বলে উঠলো,
“এই কিসের জন্য কাঁদছো তুমি? কি খোয়া গেছে তোমার? আমার বাচ্চাটাকে খুন করে এসে তুমি কেন চোখের পানি ফেলছো? কিসের শোক তোমার?”

জোরে শ্বাস নিলো মীর, গা কাঁপছে ওর ভীষণ ক্রোধে! দাঁতে দাঁত চেপে নিজেকে সামলে নিচ্ছে ও, নইলে কখন কোন অঘটন ঘটে যাবে ও নিজেও জানেনা।
বাইরে দাঁড়ানো বাচ্চাগুলো কেঁপে উঠেছে মীরের এমন হুঙ্কারে, ফ্যালকন কোকোর কাছাকাছি সরে এসে কোকোর পেশিবহুল বাহু জড়িয়ে ধরে ভয়ার্ত কাঁপা গলায় বলে উঠলো,
“কোকো ভাইয়া, হিজ ম্যাজেস্টি কি শেহজাদীকে……”
বাকি টুকু ওকে শেষ করতে দিলোনা কোকো, চাপা ধমকে বলে উঠলো,
“বাজে কথা বলিস না ফ্যালকন, হিজ ম্যাজেস্টি কখনোই এমন কিছু করবেন না৷ আমি তাঁকে ভালো ভাবেই চিনি, এমনটা করার কথা উনি কখনো ভাববেনও না!”
কোকো বলল ঠিকই, কিন্তু ফ্যালকনের ভয়টা এবার জেঁকে ধরলো ওকে। যদি ওর চেনা হিজ ম্যাজেস্টি আজ অচেনা হয়ে যান! অজানা আতঙ্কে শিউরে উঠলো কোকো।
পাশে ওর বাহু আকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা ফ্যালকনকে হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে নিলো নিজের সাথে৷ সামনের দিকে দৃষ্টি রেখেই জড়ানো গলায় বলে উঠলো,

“ওরকম কিছু হলে আমি হিজ ম্যাজেস্টিকে কোনোদিনও ক্ষমা করবোনা!”
ফ্যালকন ফুপিয়ে উঠলো, দ্রুততার সাথে মুখে হাত চাপা দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করলো নিজের কান্নার শব্দ!
ভেতর থেকে তখনো ভেসে আসছে মীরের হিংস্র গর্জন! আনাবিয়ার সামনে বসে উঁচু, তীক্ষ্ণ গলায় সে বলে উঠলো,
“খুন করেছো তুমি আমার বাচ্চাটাকে! পৃথিবীর আলো দেখতে দাওনি তুমি ওকে।
আরে আর তিনটা মাসই তো ছিলো, এতটুকু কি তুমি একটু ধৈর্য ধরতে পারতে না? সহ্য করে নিতে পারতে না? কিসের কমতি রেখেছিলাম আমি তোমার? উত্তর দাও আমাকে!”
প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো মীর, ওর এখনো বিশ্বাস হচ্ছেনা, ওরই শিনজো ওর অনাগত বাচ্চাটাকে শেষ করে দিয়েছে! অবিশ্বাস্য অসহায় চোখে ও তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার মুখের দিকে।
আনাবিয়া ঠোঁট ভেঙে কেঁদে উঠলো এবার, অস্ফুটস্বরে একবার বলল,
“ক্ষমা করে দাও আমাকে!”

“তোমাকে আমি কখনো পরিবারের অভাব বুঝতে দেইনি, বুঝতে দেইনি বাবার অভাব, বুঝতে দেইনি মায়ের অভাব। ছোটবেলায় রাজ্যের কাজ ফেলে তোমাকে কোলে নিয়ে হেটে হেটে ঘুম পাড়িয়েছি। রাতে যেন ঘুম ভেঙে তুমি ভয় না পাও তার জন্য সমস্ত রাত বুকে নিয়ে ঘুমিয়েছি তোমাকে! কখনো কোনো আঁচড় লাগতে দেইনি তোমার গায়ে, কখনো ধমক দেওয়ার আগে শ’বার ভেবেছি, যাতে তুমি কষ্ট না পাও!
আদরে আদরে রেখেছি তোমাকে সর্বক্ষণ যেন তুমি কখনো অভিযোগ করতে না পারো, যে তোমার বাবা নেই বলে তোমার জীবনে কোনো কমতি থেকে গেছে!
সর্বদা ভেবেছি সালিম বেঁচে থাকলে তোমাকে সে কতটা ভালোবাসতো, কতটা যত্নে রাখতো, কতটা আদরে রাখতো— সেভাবেই আগলে রাখার চেষ্টা করে গেছি আমি!

বলতে পারবে কখনো যে আমি তোমার অযত্ন করেছি? বলতে পারবে আমি তোমার খেয়াল রাখিনি? বলতে পারবে তুমি না খেলে আমি কখনো খেয়েছি কিনা? তুমি অসুস্থ হলে আমি কখনো ঘুমিয়েছি কিনা?
আমার বুকে হাজার ক্ষত হলেও তোমাকে কখনো সেসবের আঁচটুকু পর্যন্ত লাগতে দেইনি, মাথায় করে রেখেছি তোমাকে, নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করেছি তোমার মুখে হাসি রাখার, তোমাকে প্রটেক্ট করার!
এত ভালোবাসা, এত যত্নের বিনিনয়ে তুমি আমাকে কি দিয়েছো বলো! কি দিয়েছো তুমি? খুন করেছো আমার বাচ্চাকে! এটাই দেওয়ার ছিলো তোমার আমাকে?”
আনাবিয়া বললনা কিছুই, মাথা নিচু করে ঠোঁট কাপিয়ে কেদে উঠলো আবারও৷ মীর দাঁতে দাঁত চেপে এগিয়ে গেলো ওর কাছাকাছি, আনাবিয়ার কান্নায় ভেসে যাওয়া নিচু করে রাখা মুখটাকে দুহাতে উঁচু করে আক্রোশ মেশানো জড়ানো গলায় বলল,

“এই আমার দিকে তাকাও, এদিকে তাকাও। আমার স্থানে আজ তুমি আর তোমার স্থানে আমি থাকলে তুমি কি করতে বলো। বলো, তুমি যদি আজ বাদশাহ হতে, আমি যদি তোমার স্ত্রী হতাম তবে কি করতে তুমি?
গর্ভে সন্তান এনে মরতে দিতে আমাকে?”
“তুমি তো চেষ্টা করতে পারতে একটাবার!”
ফুপিয়ে বলল আনাবিয়া, মীর শক্ত করে ওর বাহু ধরে বলল,
“চেষ্টা করতে গিয়ে আমি মরলে তখন কি কর‍তে তুমি? খুশি হতে? বলো খুশি হতে কিনা!”
আনাবিয়া ডুকরে কেদে উঠলো, মীর অধৈর্য হয়ে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“উত্তর দিতে পারছোনা কেন? কেন এত সময় লাগছে বলো! তুমি যে প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে থেমে যাচ্ছো সেই সিচুয়েশন আমি পার করে এসেছি বুঝেছো? বুঝেছো তুমি?”

মীর চুপ থেকে কিয়ৎক্ষণ আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে আবার বলল,
“প্রথম বার যখন আমি অন্য কারো কাছে গেছিলাম তখন সে যদি সন্তানসম্ভবা হতো, তুমি যদি তাকে মেরে না ফেলতে তবে আমি কি কখনো আর অন্য কারো কাছে যেতাম? বলো যেতাম কিনা!
আরে আমার যদি নারী শরীরের ওপর লোভ থাকতো তবে আমি তোমার তোয়াক্কা করতাম বলে তোমার মনে হয়? কখনোই করতাম না!”
কিয়ৎক্ষণ চুপ থেকে মীর দাঁতে দাঁত চেপে কান্না জড়ানো অসহায় গলায় বলল,

“যখনি আমি কোনো ব্যাথা পেয়েছি তোমার কাছে এসেছি, তোমার বুকে ঝাপিয়ে পড়ে স্বান্তনা খুজেছি।
আজ আমার সন্তান হারানোর যন্ত্রণায় কার কাছে স্বান্তনা খুজবো আমি? যে আমার সন্তানকে নিজের হাতে খুন করেছে তার বুকে কিভাবে স্বান্তনা খুজবো আমি?”
মীর ভেজা চোখে আশাহত হয়ে তাকিয়ে আছে ঠোঁট ভেঙে ফুপিয়ে কাদতে থাকা আনাবিয়ার দিকে৷ কি বলবে ও? আনাবিয়াকে কিভাবে আর কি বলবে? আর কিই বা বলার বাকি আছে ওর? কিই বা বোঝানোর বাকি আছে?
ওর মন চাইছে এখন আনাবিয়ার কোলের ভেতর মুখ ডুবিয়ে দিয়ে চিৎকার করে কাঁদতে, কিন্তু নিজের সন্তানের হত্যাকারীর কোলে কিভাবে মুখ ডোবাবে ও, কোন বিবেকে?
আচমকাই আনাবিয়ার বাহুদ্বয় ছেড়ে দিলো মীর, চোখ মুছে উঠে দাঁড়িয়ে কামরা ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে নির্জীব গলায় বলল,
“পোশাক বদলে নিজেকে পরিষ্কার করে নাও, অন্যের ব্লাডে তোমার এলার্জি।”

নিজের কামরায় জানালার দিকে মুখ করে বসে আছে আনাবিয়া। জানালা দিয়ে মিষ্টি রোদ আসছে সকালের, ফিরফিরে বাতাসে উড়ছে রেশমি পর্দা৷
ইয়াসমিন চুল আঁচড়ে দিচ্ছে ওর সযত্নে। আনাবিয়ার ঝলমলে সফেদ চুলগুলোতে হাত বুলিয়ে আচড়ে দিতে ভালো লাগে ইয়াসমিনের, প্রচন্ড মনোযোগ দিয়ে কাজটা করে চলেছে সে৷
আনাবিয়ার মুখে হাসি নেই, নিষ্প্রাণ চোখে তাকিয়ে আছে সে বাইরে, দেখছে রেড জোনের জঙ্গল।
সেদিনের পর থেকে ঘরবন্দী ও, মীর ওর বাইরে বের হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দিয়েছে। নিজেও সেদিনের পর থেকে আর দেখা করতে আসেনি; না দিনে, না রাতে। কোথায় আছে কি করছে কিছুই জানেনা আনাবিয়া।
ইয়াসমিন চুল গুলো বেধে দিতে দিতে বলল,

“এবার সকালের খাবারটা খেয়ে নিবেন শেহজাদী? আনাতে বলবো?”
ইয়াসমিন জানে কোনো উত্তর আসবেনা, তবুও শুধালো। সেদিনের পর থেকে একটা কথাও বলেনি সে। নিশ্চুপ হয়ে গেছে। কোকোর থেকে শুনেছে হিজ ম্যাজেস্টিও অনেক নিরব হয়ে গেছেন। অতিরিক্ত প্রয়োজন ছাড়া কথা বলেননা তিনি।
সন্তানের শোক কাটিয়ে উঠতে পেরেছেন কিনা বলা দুষ্কর। কিন্তু শেহজাদীর সাথে বিরহের শোক যে কাটিয়ে উঠতে পারেননি সেটা তার বাহির থেকে কামরায় ফেরার সময়ে শেহজাদীর কামরার দরজার দিকে অধীর আগ্রহে তাকানো দেখলেই টের পাওয়া যায়৷

কিন্তু দুজনেই জেদী, বুক পুড়বে তবুও মুখ খুলবে না৷ অন্য সময় হলে হিজ ম্যাজেস্টি ঠিকই আনাবিয়াকে নিজে থেকেই কাছে টেনে নিতেন, কিন্তু আজ এতদিন হয়ে গেলো তবুও কারো সাথে কারো দেখা নেই, কথা নেই!
অথচ হিজ ম্যাজেস্টি বারান্দা দিয়ে শেহজাদীর কামরা পেরিয়ে যাওয়ার সময় শেহজাদী ঠিকই শিউরে উঠেন। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে তার বুক চিরে৷
ইয়াসমিন নিজেও দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো।
রাজপরিবারের কোনো সদস্যকে হত্যার চেষ্টা করলেও তার শাস্তি মৃত্যুদন্ড৷ কিন্তু হিজ ম্যাজেস্টি শেহজাদীকে কিছুই বলেননি। ঘরবন্দী করে রেখে দিয়েছেন৷ প্রতিবার খাবারের সময় এখনো জিজ্ঞেস করতে ভোলেননা তার শিনজো খেয়েছে কিনা! অথচ শিনজোর ওপর তার ভীষণ অভিমান, দেখাও দিতে চান না!
ইয়াসমিন নেমে চলে গেলো বাইরে, শেহজাদীকে জোর করে হলেও খাওয়াতে হবে, নইলে হিজ ম্যাজেস্টিও খাবেন না৷ দুজন দুজনকে ছেড়ে থাকতে পারেননা, আবার অভিমানও তাদের কম না। এদের দুজনের অভিমানের চাপে ওরা নিরিহ কজন ভয়ে মরে!

ইয়াসমিন চলে গেলেও ঠাঁই বসে রইলো আনাবিয়া। মানসিক ভাবে সম্পুর্ন বিধ্বস্ত সে। সকলেই ভাবছে অভিমানে সে কথা বন্ধ করে ফেলেছে, কিন্তু আদতে সে ভালো নেই, একটুও ভালো নেই!
অন্য সময় যত কিছুই হোকনা কেন মীর কখনো ওর সঙ্গ ত্যাগ করেনি। হাজার ঝগড়া, হাজার ঝামেলা, হাজার মনোমালিন্য সত্বেও মীর দিনশেষে ওর বুকেই ফিরে এসেছে৷ প্রতি রাতেই আনাবিয়াকে নিজের উষ্ণ আলিঙ্গনে টেনে নিয়েছে সে, ঘুমন্ত বা জাগ্রত৷
কিন্তু এখন? মীরকে দেখেনি ও কতদিন! এক মাস, বা তারও বেশি! মীরের কি একবারও ইচ্ছা করেনি ওকে দেখতে? একবারও মনে বলেনি যে তাকে ছাড়া মেয়েটা কিভাবে দিন কাটাবে!
এই এক মাসে আনাবিয়া বদলে গেছে। শোধরানোর পরিবর্তে ফিরে এসেছে তার ছোটবেলার হারানো ক্রোধ, তুমুল অসংবরণীয় ক্রোধ— যাকে সে কোনোভাবেই বাগে আনতে পারছেনা৷ ইচ্ছে করছে সবকিছু শেষ করে দিতে, সবাইকে শেষ করে দিতে, ভেঙে গুড়িয়ে দিতে!

হাতের মুঠিতে বিছানার চাদর খামচে ধরলো আনাবিয়া, দাঁতে দাঁত পিষে গেলো মুহুর্তেই। মীরকে না পেলে যে সে ঠিক থাকেনা এটা কি মীর জানেনা?
ও জানে ও ভুল করেছে, কিন্তু ও তো অনুতপ্ত! ও কি ক্ষমা চায়নি? তবুও কেন ওকে ক্ষমা করা হচ্ছেনা? তবুও কেন মীর আসছেনা ওর কাছে?
রাগে ক্ষোভে চোখ ভরে এলো ওর। মীরকে একটিবার জড়িয়ে নেওয়ার জন্য হাহাকার করে উঠলো ওর বুক!
এমন সময় দরজায় কড়া নেড়ে ভেতরে ঢুকলো কেউ, আনাবিয়া ইয়াসমিনের পরিবর্তে অন্য কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো পেছনে।

ওকে দেখাশোনা করার জন্য মীরের রাখা মেয়েটি এসেছে, হাতে খাবারের ট্রে। ইয়াসমিনের বদলে একে দেখে আনাবিয়ার মেজাজ গরম হলো ভয়ানক! বিছানা থেকে নেমে মেয়েটির দিকে দুকদম এগিয়ে ও তীর্যক কন্ঠে শুধালো,
“তুমি কেন এসেছো? ইয়াসমিন কোথায়?”
আনাবিয়ার গলা শুনে আর ওকে এভাবে এগিয়ে আসতে দেখে ভড়কালো মেয়েটা, কেঁপে উটলো ওর হাতের ট্রে৷ কাঁপা, জড়ানো গলায় বলল,
“ই-ইয়াসমিন আপা কে হ-হিজ ম্যাজেস্টি ডেকে পাঠিয়েছেন!”
“কেন?”

আরও দু কদম এগিয়ে মেয়েটির কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে ঝাঝালো গলায় শুধোলো আনাবিয়া। মেয়েটি এতে ভয় পেলো আরও, আতঙ্কিত হয়ে কেঁপে উঠলো ও, কিন্তু এই কাঁপা-কাঁপির কারণে অসাবধানতাবসত আচমকাই হাত থেকে ট্রে টা পড়ে গেলো তার, খাবার গুলোর অধিকাংশ গিয়ে পড়লো আনাবিয়ার পোশাকে।
ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো মেয়েটির, বুকটা কেঁপে উঠলো আসন্ন শঙ্কায়! তড়িঘড়ি করে এগিয়ে এসে ও কান্না জড়ানো ভয়ার্ত, কাতর সুরে বলল,
“আমি এখুনি পরিষ্কার করে দিচ্ছি শেহজাদী, দয়া করে আমাকে মারবেন না!”
আনাবিয়া এতক্ষণ না রাগলেও মেয়েটির শেষোক্ত কথায় ভয়ানক রেগে গেলো। ও কি শুধু মারতেই পারে? ও কি ভালোবাসতে পারে না?

মীরকে কি ও ভালোবাসেনি? কোকো, ফ্যালকন, লিও কাঞ্জি, ইয়াসমিন, ওর বাকি বাচ্চারা— তাদেরকে কি ও ভালোবাসেনি? ও কি শুধুই আঘাত করতে জানে? সবাই কি মীরের মতো ওকে শুধু একজন নিষ্ঠুর খুনীই ভাবে?
মুহুর্তেই ওর কানে বেজে উঠলো সেদিনে মীরের বলা কথা গুলো,— ‘এত ভালোবাসা, এত যত্নের বিনিনয়ে তুমি আমাকে কি দিয়েছো বলো! কি দিয়েছো তুমি? খুন করেছো আমার বাচ্চাকে! এটাই দেওয়ার ছিলো তোমার আমাকে?’
ও খুনী, ও শুধু খুনই করতে পারে, ও কি আর কিছুই করতে পারেনা? এত নিষ্ঠুর ভাবে ওকে সবাই?
হঠাৎ করেই ক্রোধে লাল হয়ে গেলো আনাবিয়া, মেঝেতে নিচু হয়ে দ্রুত হাতে খাবার পরিষ্কার করতে থাকা মেয়েটির গলা ধরে ছো মেরে উপরে তুললো ও, তারপর গলা ধরেই শূণ্যে তুলে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“কি বললে তুমি? তোমাকে কি করবো না?
আমাকে খুনী মনে করো তুমি? মীরের মতো তোমরাও আমাকে খুনী মনে করো? আমি কি ভালোবাসতে পারিনা কাউকে? খুনী আমি?”

মেয়েটি আনাবিয়ার হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য হাতপা ছুড়তে ছুড়তে দুদিকে তড়িতে মাথা নাড়িয়ে না বোঝালো, ভয়ে আর যন্ত্রণায় ছটফট করে উঠে চোখ ছাপিয়ে বেয়ে পড়লো তার কান্না।
আনাবিয়ার শক্তিশালী হাতের ভীষণ চাপে ক্রমেই দম বন্ধ হয়ে এলো তার।
ওপাশ থেকে টের পেয়ে মীর ইয়াসমিনকে দ্রুত যেতে বলল আনাবিয়ার কামরায়। ইয়াসমিন মীরের কামরা ছেড়ে ছুটে বেরিয়ে আনাবিয়ার কামরায় এলো তখনি, কিন্তু ইয়াসমিন এসে পৌছানোর ঠিক আগ মুহুর্তেই প্রাণপাখি উড়াল দিলো মেয়েটার, নিঃসাড় শরীরটা তখনো ঝুলে রইলো আনাবিয়ার হাতের ভরে। বিস্ফোরিত চোখে, কয়েক ইঞ্চি জিভ বেরিয়ে যাওয়া মুখের ছোট্ট বোচা নাকটা দিয়ে বেয়ে পড়তে লাগলো সরু রক্তের স্রোত!
আনাবিয়া তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারলো রাগের বশে সে কি করে ফেলেছে! তড়িতে মেয়েটির গলা ছেড়ে দিলো ও, সাথে সাথেই শব্দ করে মেঝেতে আছড়ে পড়লো মেয়েটির নিথর দেহ৷ আনাবিয়া অসহায় চোখে তাকিয়ে রইলো ইয়াসমিনের দিকে, শ্বাস নিতে থাকলো জোরে। প্রাণপণে বলতে চাইলো যে সে ইচ্ছে করে কিছুই করেনি, ভুল করে হয়ে গেছে।

করুণ চোখে চেয়ে ও এগিয়ে যেতে নিলো ইয়াসমিনের দিকে, কিন্তু একটু আগের দৃশ্য অবলোকন করে মারাত্মক রকম ভড়কে যাওয়া ইয়াসমিন ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পিছিয়ে গেলো কয়েক কদম!
থমকে দাঁড়িয়ে গেলো আনাবিয়া, আর বাড়ালোনা কদম। সবাই ওকে ভয় পায়! ও যে খুনী, নিষ্ঠুর! কেউ ওর কাছে থাকতে চায়না। সবাই পালিয়ে যেতে চায়, ওর আচরণে অতিষ্ঠ হয়ে ওর থেকে পরিত্রাণ চায় সকলে!
সেই মুহুর্তেই মীর ঢুকলো কামরায়, মেঝেতে পড়ে থাকা দাসীটির নিঃসাড় দেহের ওপর দৃষ্টি গেলো তার প্রথমেই, পরক্ষণেই সে চোখ তুলে তাকালো আনাবিয়ার স্থীর অবয়বের পানে।
হতাশার চোখে আনাবিয়ার দিকে কিয়ৎক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফোস করে শ্বাস ছাড়লো ও একটা, ভয় পেয়ে মীরের পেছনে চলে যাওয়া ইয়াসমিনকে ইশারায় বলল মেয়েটির লাশটাকে এখনি বাইরে নিয়ে যেতে।
ইয়াসমিন কাঁপতে কাঁপতে ভেতরে ঢুকে তড়িঘড়ি করে টেনে বাইরে নিয়ে চলে গেলো মেয়েটির নিথর দেহ।
মীর ধীরপায়ে আনাবিয়ার দিকে এগিয়ে এসে দাঁড়ালো ওর সম্মুখে, আনাবিয়ার মুখের ওপর পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে ও শান্ত গলায় শুধালো,

“কেন করলে এমন? কি দোষ ছিলো বাচ্চা মেয়েটার?”
আনাবিয়ার মুখে কোনো উত্তর এলোনা, ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইলো শুধু। প্রচন্ড ইচ্ছে হলো একবার মীরের বুকে ঝাপিয়ে পড়তে, বলতে মন চাইলো ও ইচ্ছে করেই কিছুই করেনি, রাগের মাথায় হয়ে গেছে!
খুব করে চাইলো একবার যেন মীর ওর অসহায়ত্ব টের পেয়ে ওকে বুকে টেনে নেয়, ওকে স্বান্তনা দেয় একবার, ওকে জড়িয়ে রাখে নিজের প্রশস্ত বুকের সাথে; একবার বলে যে কিছুই হয়নি সব ঠিক আছে, তুমি ভয় পেয়োনা, আমি আছি তো!
অদম্য বাসনাটাকে প্রাণপণে নিজের ভেতর চেপে ধরে রইলো আনাবিয়া। মীর এগিয়ে এলো কয়েক কদম আরও, আনাবিয়ার একদম কাছাকাছি হয়ে দাঁড়িয়ে ডান হাত বাড়িয়ে আনাবিয়ার থুতনি ধরলো ও আলতো করে, অতঃপর স্থীর, স্নিগ্ধ কন্ঠে বলল,

“তুমি জানো? তুমি এখনো সেই ছোট্টটিই আছো, ভীষণ জেদী, ভীষণ উগ্র, ভীষণ উন্মাদ, ভীষণ অভিমানী সেই ছোট্ট শিনজোই রয়ে গেছো; বড় হতে পারোনি। আমি তোমাকে সুশিক্ষা দিতে ব্যর্থ হয়েছি।
তোমাকে শাসন করতে পারিনি কখনোই, প্রশ্রয় দিয়ে গেছি সর্বক্ষণ। এটা হয়তো আমারই দুর্বলতা। তোমার বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো আজ এমন কিছু দেখতে হতোনা আমাকে।”
আনাবিয়া চোখ ভরা আকুলতা নিয়ে তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে, ঠোঁট ফুলে উঠতে চাইলো বার বার, শক্ত করে ঠোঁট জোড়া চেপে ধরে রইলো ও, চোখ ভর্তি হয়ে যেতে লাগলো যন্ত্রণাদায়ক তরলে।
মীর হাত সরিয়ে নিলো ওর থুতনি থেকে, তারপর বলল,

“এই প্রাসাদে তোমার উপস্থিতি নিরাপদ নয় শিনজো। তুমি দেখেছো নিশ্চই, যে ইয়াসমিনকে তুমি কোলে পিঠে করে মানুষ করেছো সেই এখন তোমাকে দেখলে ভয়ে কাঁপে, তোমার কাছে ঘেঁষতে চায়না!
নিষ্ঠুর হয়ে গেছো তুমি, নিষ্ঠুরতা তোমাকে মানায় না শিনজো। তুমি কয়েকজন নিষ্পাপের রক্তে নিজের হাত রাঙিয়ে নিয়েছো, সেখানে আমার অনাগত সন্তানও অন্তর্ভুক্ত!”
মীর কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে বলে উঠলো,
“তোমার ভয়ঙ্করতম অপরাধ সত্বেও আমি তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিলাম৷ কিন্তু তুমি নিজেকে কখনো শোধরাবে না আমি জানি।
তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি তুমি আর এ প্রাসাদে থাকবে না। এখন থেকে তুমি থাকবে শিরো মিদোরির সেইফ জোনে থাকা ওয়ার্কার্স দের সাথে।

আগামী দুবছর তুমি সেখানেই থাকবে৷ দেখবে সাধারণ মানুষের জীবন কেমন হয়, কতটা স্ট্রাগল করে প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকে তারা, কতখানি ত্যাগ স্বীকার করে একে অপরের সাথে হাত মিলিয়ে চলে!
তোমাকে এসব শিখতে হবে, নিজেকে শোধরাতে হবে, ধৈর্য ধরতে জানতে হবে, পরিস্থিতির সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে।”
আনাবিয়ার ঠোঁট জোড়া ভীষণ অভিমানে থরথর করে কেঁপে উঠলো। যে মানুষটিকে ও জান প্রাণ দিয়ে ভালোবাসে, যে মানুষটিকে ছাড়া নিজের জীবন ও কল্পনাও করতে পারেনা সে আজ ওকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে! এটা ও কিভাবে মেনে নিবে? এটা কিভাবে সহ্য করবে? শেষ পর্যন্ত ওকে অপরাধীর কাতারে ফেলে দিলো মীর?

হ্যা, ও খুনী, ও খুন করেছে, কিন্তু ও তো অনুতপ্ত! নিষ্পাপ বাচ্চাটিকে খুন করেছে ও, দেখতে দেয়নি পৃথিবীর আলো, ছুতে দেয়নি পৃথিবীর মাটি। ও তো ক্ষমা চেয়েছে তার জন্য! ওকে কি আর ক্ষমা করা যায় না?
ও যে ভালো নেই, ও যে শুধুই মীরকে কাছে চায় আর কিছুই চায়না! এটা মীর কেন বোঝেনা? কেন সে অভিমান ভরে ওকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে?
মীর আনাবিয়ার নিরবতা খেয়াল করে বুক ভরে দম নিয়ে ছেড়ে দিলো আবার বাতাসে, তারপর বলল,
“আগামীকালই সেখানে রেখে আসা হবে তোমাকে।”
তারপরই গটগটিয়ে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে, রেখে গেলো হতভম্ব হয়ে সেখানে জড়বৎ দাঁড়িয়ে থাকা আনাবিয়াকে।

কালো রঙা অফসাইজের একটা ঢিলেঢালা হুডি আর ছাই রঙা ঢিলেঢালা একটা ট্রাউজার পরে কামরায় বসে আছে আনাবিয়া। সফেদ চুলগুলো এই মুহুর্তে ছেয়ে আছে কালো রঙে, বেণী করে খোপা করে দিয়েছে ইয়াসমিন। সেগুলো ঢেকে আছে হুডির হুডের নিচে। ঝকমকে চোখ জোড়া কালো রঙা লেন্সে আবৃত; লুকিয়ে গিয়েছে সেই অভূতপূর্ব, অসম্ভব সৌন্দর্যে মোড়া নয়নযুগল!
বর্তমানে মেঝের ওপর বসে আনাবিয়ার স্যুটকেস গুছিয়ে দিচ্ছে ইয়াসমিন। ধীর গতিতে হাত চালাচ্ছে যেন শেহজাদী আরও কিছু সময় তার সাথে থাকে। বাইরে কোকো দাঁড়িয়ে আছে, মীর তাকেই দায়িত্ব দিয়েছে আনাবিয়াকে সেইফজোনে রেখে আসার।
আনাবিয়া অনুভূতিহীন শুষ্ক চোখে তাকিয়ে আছে শূন্যে। মুখ শুকনো, চোখের নিচে ফোলা। মুখে তোলেনি কাল থেকে কিছু, ঘুমায়নি সারারাত! সমস্ত রাত বিছানার ওপর ওভাবেই বসে থেকেছে।
ঘন্টাখানেক ধরে স্যুটকেস গোছালো ইয়াসমিন। তারপর উঠে দাড়ালো ধীরে ধীরে, আনাবিয়ার কাছে গিয়ে মৃদু, করুণ স্বরে বলল,

“শেহজাদী, হয়ে গেছে!”
আনাবিয়া কিছুই বলনা। উঠে দাঁড়ালো সাথে সাথেই। মেঝে থেকে তুলে নিলো স্যুটকেসের লম্বা হাতল৷ ইয়াসমিন দ্রুত পায়ে এগিয়ে গিয়ে ওর হাত থেকে সেটা নিতে গেলো, কিন্তু দিলোনা আনাবিয়া, আলতো করে সরিয়ে দিলো ইয়াসমিনের হাত। তারপর ধীর পায়ে বেরিয়ে গেলো কামরা থেকে৷
ওর মনে পড়ে গেলো বহুবছর আগে ওকে বোর্ডিংয়ে পাঠিয়ে দেওয়ার দিনটির কথা। সেদিনও ও এভাবেই বেরিয়ে গেছিলো, মীরের সাথে সামান্যতম কথা না বলেই, বিদায় না জানিয়েই!
কিন্তু সেদিন ওর সাথে নওয়াস চাচাজান আর ফারিশ ভাইয়া ছিলো, আজ ওর সাথে কেউ নেই! আজ ও একা, সম্পুর্ন একা!

বাইরে বেরোতেই ওর চোখ পড়লো বারান্দায় পেছনে হাত বেধে দাঁড়িয়ে মীরের ওপর। কঠিন মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে সে! আনাবিয়া এক পলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিলো সাথে সাথেই। মীরের এমন কঠিন দৃষ্টি যেন বিশ্বাস করতে কষ্ট হলো ওর! এক ফোটাও মায়া নেই সেখানে ওর জন্য, একটুও না!
এই প্রাসাদ, এই দেমিয়ান প্রাসাদ ওর রক্তে মিশে আছে! এ স্থান ছেড়ে ও কিভাবে চলে যাবে? কিভাবে থাকবে ও সেখানে গিয়ে?

পা চলতে চাইলোনা আনাবিয়ার, কিন্তু মীরের কঠিন চোখের দৃষ্টি মনে পড়তেই পাহাড়ের ন্যায় ভারী হয়ে যাওয়া পা জোড়া বাড়িয়ে ও হেটে চলল প্রাসাদের এক্সিটের দিকে।
বুকের ভেতরটা চুরমার হয়ে যাচ্ছে ওর, প্রতিটা পদক্ষেপে হৃদয় ছিড়ে যাওয়ার উপক্রম তবুও পা বাড়িয়ে চলেছে থমকে থমকে!
চোখের কোণে জমতে শুরু করেছে অশ্রুকণা, প্রাণপনে সেগুলো গিলে ফেলার চেষ্টা করলো ও এক শুকনো ঢোকে। নিরবে শুধু বুকের ভেতর একটাই আকুতি রইলো ওর, একটাবার মীর ওকে ডাকুক, বলুক ওকে থেকে যেতে। একটাবার শিনজো ডেকে বলুক যে আনাবিয়াকে ও ক্ষমা করে দিয়েছে! একটা বার বলুক, তোমাকে কোথাও যেতে হবেনা, তুমি আমার কাছেই থাকো!

কিন্তু এমন কিছুই হলোনা। একটা টু শব্দ এলোনা পেছন থেকে। ঠোঁট ভেঙে এবার কান্না আসতে চাইলো আনাবিয়ার, ধীর ভারী পায়ে ও এগিয়ে গেলো সামনের দিকে!
মীর তাকিয়ে রইলো আনাবিয়ার যাওয়ার পানে। দৃষ্টি হয়ে রইলো কঠোর, কিন্তু ভেতরে ভেতরে ভেঙে গুড়িয়ে যেতে লাগলো ও! বুকের ভেতরটা ছেয়ে গেলো এক আকাশ পরিমাণ শূন্যতায়। শ্বাস আঁটকে যেতে লাগলো ক্রমেই!
ওর শিনজো একপা একপা করে দূরে সরে যাচ্ছে ওর থেকে, চোখের সামনে ধোঁয়াশা হয়ে যাচ্ছে ওর পৃথিবী!
বুক ফেঁটে আর্তনাদ বেরিয়ে আসতে চাইলো ওর, কিন্তু ঠোঁট কামড়ে মুহুর্তেই সামলে নিলো নিজেকে। চেষ্টা করলো নিজেকে শক্ত রাখার, কিন্তু হৃদয় জুড়ে ছড়িয়ে পড়লো ভীষণ হাহাকার, দলা পাকিয়ে সেগুলো উঠে আসতে চাইলো গলা বেয়ে, ঢোক গিলে সেটাকে আবার বুকে পাঠিয়ে দিলো মীর।
চলে যাচ্ছে, চলে যাচ্ছে ওর শিনজো— অথচ ও কিছুই করতে পারছে না! ওর নিষ্পাপ বাচ্চাটার ছোট্ট তুলতুলে মুখখানা ভেসে উঠছে ওর চোখের পরে বারবার! এ কেমন পরিস্থিতিতে পড়েছে ও, সৃষ্টিকর্তা ওকে কেমন দোটানায় ফেলেছেন?

ওর শিনজোর স্পর্শ ব্যাতিত, শিনজোর অস্তিত্ব ব্যাতিত ও কিভাবে থাকবে? দিন শেষে কার বুকে গিয়ে আশ্রয় নিবে?
প্রচন্ড আকুতি ভরা চোখে খুব করে চাইলো একটাবার ওর শিনজো পেছন ফিরে দেখুক ওর দিকে, একটাবার বলুক আমাকে যেতে দিও না, নিজের কাছেই রাখো। একটাবার ওর নাম ধরে ডেকে উঠুক! ওকে একবার মীরি বলে ডাকলে মীর কি ফিরিয়ে দিতে পারবে ওকে? কখনো ফিরিয়ে দিবে?
একবার মন চাইলো সব অহংকার ভেঙে, সব অভিমান ভুলে ছুটে গিয়ে ওকে জড়িয়ে নিতে বুকের সাথে, একবার বলতে, যেওনা আমাকে ছেড়ে! তুমি ছাড়া আমি অসম্পূর্ণ!

একটা মাত্র বাক্য! কিন্তু এটা বলতে এত জড়তা কেন কাজ করছে, কেন ওর মস্তিষ্ক বাধা দিচ্ছে!
ভুল হচ্ছে কোথাও ভীষণ ভুল, এই দুরত্বে ওদের জন্য নয়, কখনোই নয়!
আনাবিয়া পৌঁছে গেলো দরজার কাছে, মুঠি করে ধরলো নিজের হাত, দম নিলো একবার। ভেতর থেকে কেউ যেন চিৎকার করে বলে উঠলো—ফিরে যাও, তোমার স্থান শুধুমাত্র ওরই পাশে। ঝাপিয়ে পড়ো ওর বুকে! সেই চিৎকারের তোপে শিউরে উঠলো আনাবিয়া।

বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩৯+৪০

কিন্তু ভীষণ অভিমানে নিজেকে শক্ত করে নিলো ও। কোকোর সাথে চুপচাপ বেরিয়ে গেলো রয়্যাল ফ্লোর থেকে। দুফোটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়লো ওর চোয়ালে, কিন্তু মুহুর্তেই হাতের উপরিভাগ দিয়ে সেগুলো মুছে নিলো ও। কাঁদবে না ও একটুও, একফোটাও না!
ও দূরে চলে যাবে একদিন, খুব দূরে; যেখানে মীরের অস্তিত্বের ছায়াটুকুও পড়বে না!

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here