বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৫+৬
রানী আমিনা
মীরের শরীরটা তেমন ভালো যাচ্ছে না। বেশ কিছুদিন ধরে ওর ওপর কাজের অনেক চাপ। সাম্রাজ্য জুড়ে সম্প্রতি কিছুটা অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে।
হঠাৎ করেই একটা অসাধু চক্র ছড়িয়ে পড়েছে পঞ্চদ্বীপ জুড়ে। এরা সিন্ডিকেট গঠন করেছে, জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলেছে হুহু করে।
এর ভেতরে আবার অন্যান্য দ্বীপ গুলো থেকে কুরো আহমারে মালামাল নিয়ে মালবাহী গাড়ি গুলো যাওয়ার সময় প্রতিনিয়ত অজ্ঞাত কোনো ছিনতাইকারী দলের আক্রমণের শিকার হচ্ছে, মালামাল গুলো এক প্রকার ডাকাতি করে নিয়ে যাচ্ছে ওরা, যার ফলে দাম বাড়ছে আরও বেশি।
সিকিউরিটি বাড়িয়েও কোনো লাভ হচ্ছে না, অজ্ঞাত ডাকাত দলটির লোকবল অনেক। এরা সুকৌশলে দিনে দুপুরে ডাকাতি করে নিয়ে চলেছে মালবাহি গাড়ি গুলোকে। সিকিউরিটিতে থাকা ব্যাক্তিবর্গদের ক্ষতবিক্ষত লাশের স্তুপ জমছে যেখানে সেখানে৷
পঞ্চদ্বীপের কন্ট্রোলার রা বারে বারে মীর কে ইনফর্ম করে চলেছে এসব ব্যাপারে। পরিস্থিতি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এখন।
নিরাপত্তার সুবিধার্থে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য গুলোকে অনলাইনে আদান প্রদানে কঠোর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মীর। গুরুত্বপূর্ণ ইনফরমেশন গুলো সবসময় বিশেষ সিকিউরিটির সাথে চিঠির মাধ্যমেই আসে ওর কাছে। তাই ওর টেবিলের ওপর কাগজের পাহাড় জমে আছে।
রাত এখন অনেক—গুরুগম্ভীর চেহারায় একটার পর একটা কাগজ দেখে চলেছে মীর। চোখ জ্বালা করছে ওর, গত তিনদিন ধরে রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে এসবই করে চলেছে ও।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সমস্ত ডকুমেন্টস গুলো দেখছে ও নিজে নিজেই। ব্যাক্তিগত কাজে অন্যকারো সাহায্য নেওয়া ওর খুবই অপছন্দের।
কিন্তু শরীরটা ভালো লাগছে না আজ, গায়ের তাপ বেড়ে চলেছে ক্রমাগত। একটানা একইভাবে বসে থাকার ফলে পিঠের ভেতরে একটা সুক্ষ্ম, চিনচিনে ব্যাথা ক্রমাগত বেড়ে চলেছে, পরতে পরতে।
রাতের খাবার টাও এখনো খাওয়া হয়ে ওঠেনি ওর। এই কয়দিনে খাওয়া দাওয়াতেও অনিয়ম হয়ে গেছে প্রচন্ড।
এমন সময়ে আনাবিয়ার কামরার ওপাশ থেকে মৃদু কড়া নাড়ার আওয়াজ পেলো মীর। চমকে দরজার দিকে তাকিয়ে চকিতে একবার ঘড়ি দেখে নিলো ও। দুইটা বেজে তেরো। এই মেয়েটা এখনো জেগে জেগে কি করছে? মীর নড়েচড়ে বসে দরজার দিকে তাকিয়ে হাঁক ছাড়লো,
“এসো”
মীরের অনুমতি পেতেই আনাবিয়ার কামরার দরজা মৃদু শব্দ তুলে ধীর গতিতে খুলে গেলো। তার পরমুহূর্তেই দৃষ্টি গোচর হলো ভোরের সদ্য ফোটা সাদা গোলাপের ন্যায় আনাবিয়া কে, একটা বালিশ আর গায়ের চাদরটা দুহাতের আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিয়ে নিষ্পাপ নয়নে সে তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে।
দরজাটা পুরোপুরি খুলে গেলে গুটিগুটি পায়ে ভেতরে ঢুকলো আনাবিয়া। তারপর মীরের দিকে তাকিয়ে সরল গলায় বলে উঠলো,
“আমি আজ এখানে একটু ঘুমাই? আমার কামরায় ভয়!”
মীর জানে এসব আনাবিয়ার বাহানা, মীরের কাছে ঘুমানোর বাহানা। এসবে ও অভ্যাস্ত।
মীর নড়েচড়ে উঠে ওকে কিছু বলতে নিবে তার আগেই আনাবিয়া অসহায় কন্ঠে তড়িঘড়ি করে বলল,
“আমি একদম দুষ্টুমি করবোনা, এক্ষুনি ঘুমিয়ে যাবো প্রমিস!”
মীরের কণ্ঠনালী দিয়ে উঠে আসা না’ শব্দটা মুখের ভেতরেই থেকে গেলো, ওই ঘায়েল করা চোখ জোড়ার ঝিকিমিকি চাহনির দিকে চেয়ে না’ শব্দটা উচ্চারণ করার মতো সাহস আর ওর হলো না। আনাবিয়ার দিকে কোমল দৃষ্টিতে চেয়ে মীর বলল,
“ঠিক আছে ঘুমাও এখানে, একটুও জেগে থাকবে না যেন।”
আনাবিয়ার মুখে মুহুর্তেই হাসি ফুটে উঠলো। প্রফুল্ল চিত্তে ও বালিশ আর চাদর নিয়ে ছুটে এসে লাফিয়ে উঠলো মীরের বিছানায়। ওর লাফালাফি দেখে মীর হাসলো মৃদু। এতক্ষণের কর্মব্যস্ততার ভেতর এই একটুখানি মিষ্টি বিরতি পেয়ে প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো ওর বুক।
আনাবিয়া নিজের বালিশ টা মীরের বালিশের পাশে ঠিকঠাক করে রাখতে রাখতে শুধালো,
“তুমি ঘুমাবে না?”
“আমার দেরি হবে শিনু, তুমি ঘুমিয়ে যাও।”
ক্লান্ত কন্ঠে উত্তর করলো মীর। আনাবিয়া তাকালো ওর দিকে। মীরের দৃষ্টি, চেহারা কোনোটাই ওর কাছে স্বাভাবিক মনে হলো না।
শোয়া বাদ দিয়ে বিছানা থেকে ধীরে সুস্থে নিচে নেমে মীরের কাছে গেলো ও, তারপর মীরের বিপরীতে থাকা চেয়ারটি টেনে, চেয়ারে বর দিয়ে টেবিলের ওপরে উঠে বসে মীরের মুখ খানা নিজের ছোট ছোট দুহাতের ভেতরে নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে তাকিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে শুধালো,
“কি হয়েছে তোমার? তোমাকে এমন লাগছে কেন?”
মীর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের শরীর টা এলিয়ে দিলো চেয়ারের বুকে তারপর নির্ঘুম, ক্লান্ত চোখে দুইবার দুর্বলভাবে পলক ফেলে ও উত্তর করলো,
“আমি অনেক ক্লান্ত শিনু!”
আনাবিয়া কিছুক্ষণ চিন্তা করলো, তারপর টেবিলের ওপর থেকে ধপ করে লাফিয়ে নেমে ছুটে গেলো নিজের কামরায়।
মীর ওর হঠাৎ ছুটে চলে যাওয়ার রহস্য বুঝতে না পেরে দরজার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
কিছুক্ষণ বাদেই আনাবিয়া হাতে করে এক গ্লাস দুধ নিয়ে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে এলো মীরের দিকে। তারপর দুধের গ্লাস টা মীরের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল,
“দুধ খাও, শক্তি হবে। তুমি না বলেছিলে দুধ খেলে আমি শক্তিশালি হবো! এখন এটা তুমি খাও, দেখবে আর ক্লান্ত লাগবে না। বেলিন্ডা এতে মধু দিয়ে দিয়েছে, মজা লাগছে অনেক।”
চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে থাকা মীর ঘাড় বাকিয়ে দেখলো আনাবিয়া কে। ওকে দুধের গ্লাস টা দিতে পেরে আনাবিয়ার চোখে মুখে খুশি ধরছে না। মীর চোখ ছোট ছোট করে ভারী গলায় বলে উঠলো,
“তুমি আজ এখনো দুধ খাওনি কেন?”
আনাবিয়া ঠোঁট উল্টালো, তারপর নেমে যাওয়া গলায় বলল,
“ভালো লাগছিলো না!”
পরক্ষণেই উচ্ছসিত হয়ে বলে উঠলো,
“তাতে তো ভালোই হয়েছে না! এখন তুমি খেতে পারছো যে; আমি খেয়ে নিলে তখন কি হতো! খেয়ে নাও এক্ষুনি, অনেক শক্তি হবে, তারপর তুমি সারারাত কাজ করতে পারবে।”
মীর ওর দিকে কোমল নয়নে তাকালো।
শেষ কবে ওর জন্য কেউ চিন্তা করেছে ওর মনে পড়ে না! আম্মা থাকতে চিন্তা করতো ওর জন্য অনেক, মুহুর্তে মুহুর্তে খবর নিতো ওর। ও খেয়েছে কিনা, সময় মতো ঘুমাচ্ছে কিনা, টো টো করে যেখানে সেখানে ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে কিনা! তাতে ও বিরক্তই হতো; তখন মর্ম বুঝেনি যে!
নারী ছাড়া পুরুষের ভালো মন্দের খবর হয়তো কেউ নেয়না!
আনাবিয়া তখনো আগ্রহী চোখে তাকিয়ে, কখন মীর ওর দুধের গ্লাসটা থেকে দুধ খাবে।
মীর দুধ না খেয়ে ড্যাবড্যাব করে ওর দিকে তাকিয়ে আছে দেখে এবার ভ্রু কুচকালো আনাবিয়া, তারপর শাসনের ছলে তেজি গলায় বলে উঠলো,
“কি হলো, খাচ্ছো না কেন?”
“বাবারে! শিনু কি আমাকে ধমকাচ্ছে?”
আনাবিয়ার দিকে ঝুকে এসে কৌতুক পূর্ণ হাসি হেসে বলল মীর৷
“হু, ধমকাচ্ছে, এখন তুমি দুধ খাও নইলে কিন্তু দুধও খাবে সাথে ধমকও খাবে!”
কোমরে হাত দিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল আনাবিয়া। ওর অ্যাকশন দেখে মীর শরীর দুলিয়ে হেসে খেয়ে নিলো দুধ টা।
“খেয়েছি, খুশি হয়েছো? এখন গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, আর একটুও যেন তোমাকে জেগে থাকতে না দেখি।”
মীরের আদেশে বিনা বাক্যব্যায়ে আনাবিয়া বেণী দুলিয়ে গটগটিয়ে বিছানার কাছে গিয়ে লাফিয়ে উঠলো বিছানায়, তারপর ধাম করে চিৎপাত হয়ে শুয়ে পড়লো। পরক্ষণেই আবার মাথা তুলে মীরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,
“আমি ঘুমিয়ে গেলে আবার আমাকে ওই কামরায় দিয়ে আসবে না কিন্তু! নইলে কিন্তু আমি ভীষণ রাগ করবো।”
মীর কপাল চাপড়ালো, এই মেয়ে সবসময় দুই লাইন আগে থাকে। ঘুমানোর আগে শর্ত দিয়ে ঘুমাইতেছে!
“ঠিক আছে বাবা! দিয়ে আসবো না।”
ক্লান্ত চোখে আনাবিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল মীর। মীরের উত্তর শুনে খুশি মনে লাফালাফি করতে করতে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লো আনাবিয়া। আর তার কিছুক্ষণ পরেই নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এলো ওর৷ এই বিছানার মতো শান্তির বিছানা আর নেই!
আর এই মায়ায় মোড়ানো স্নিগ্ধ, সুন্দর বিরতির পর মীর মিষ্টি হেসে আবার মন দিলো নিজের কাজে।
ঘুমের ঘোরে মীরের শরীরের সাথে স্পর্শ লাগতেই ঘুম ভেঙে গেলো আনাবিয়ার৷ ঘুম ছুটে গেলো ওর, তড়িঘড়ি করে উঠে বসে মীরের মুখের দিকে তাকালো ও৷
মীরের সমস্ত চেহারাটা জুড়ে ক্লান্তির ছাপ! রুক্ষ, কালো ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে আরও বেশি রুক্ষমূর্তি ধারণ করেছে। চোখের নিচে লালচে আভা! গায়ের ওপর থাকা চাদর টা সরে গেছে, খোলা জানালার পাতলা পর্দা ভেদ করে আসা ফিরফিরে ঠান্ডা হাওয়ায় থেকে থেকে কেঁপে কেঁপে উঠছে ওর শরীর।
মীরকে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে নিয়ে সন্তর্পণে নিজের হাত খানা মীরের কপালের ওপর রাখলো আনাবিয়া, পরক্ষণেই শিউরে উঠলো ও!
প্রচন্ড তাপ, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে! জ্বরের তোপে ঘুমের মাঝেই মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে শব্দ করছে মীর।
প্রমাদ গুনলো আনাবিয়া, কি করবে ও এখন!
কিছুক্ষণ চিন্তা করে মুহুর্তেই মীরের অভিভাবকের জায়গা নিয়ে নিলো ও।
বিছানা থেকে নেমে একটা বাটিতে ঠান্ডা পানি আর নিজের কামরা থেকে খুঁজে খুঁজে একটা সুতি কাপড় জোগাড় করে নিয়ে এলো ও। তারপর কাপড় টা ভিজিয়ে নিংড়ে নিয়ে ভাজ করে সযত্নে রাখলো মীরের জ্বরতপ্ত কপালের ওপর৷ ওর জ্বর হলে বেলিন্ডা আর ওর মীরি এভাবেই ওর মাথায় জলপট্টি দিয়ে দেয়।
মীরের টেবিলের অপর পাশে এখনো অবহেলায় পড়ে আছে ওর রাতের খাবার, যার একাংশও মুখে দেয়নি মীর। সেটা খেয়াল করে আনাবিয়া এবার ওর নিজের কামরায় ফিরে গিয়ে গায়ের ওপর একটা রোব জড়িয়ে নিলো। তারপর মীরের কাছে এসে ঘুমন্ত মীরের ঝাকড়া চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে কপালে একটা ছোট্ট চুমু দিয়ে বলল,
“তুমি একটু একা একা থাকো কিছুক্ষণ, আমি এক্ষুনি আসছি!”
কামরা থেকে বেরিয়ে আসলো ও৷ হামদান সহ আরও কিছু গার্ড তখনও জেগে। অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় তীক্ষ্ণ চোখে ওরা নজর রাখছে চারদিকে।
আনাবিয়া গুটিগুটি পায়ে গেলো হামদান দের দিকে। রাতের এখন প্রায় চারটা। এই অসময়ে শেহজাদী কে কামরার বাইরে দেখে ভড়কালো হামদান। ত্রস্ত ভঙ্গিতে আনাবিয়ার দিকে এগিয়ে এসে নত চোখে উদ্বিগ্ন কন্ঠে হামদান শুধালো,
“শেহজাদী! আপনি এত রাতে বাইরে কি করছেন? সব ঠিক আছে তো? আপনার কি কোনো অসুবিধা হচ্ছে?”
“আমার মীরির গায়ে অনেক জ্বর হামদান৷ তুমি এক্ষুনি গিয়ে ইউসুফ হেকিমকে খবর দাও, আর নোমানকে বলো রয়্যাল কুককে বলে মীরের জন্য তাজা ফলের স্যালাড, কিছু স্টিমড সবজি আর চিকেন স্যুপ রেডি করতে। মীর জাগলেই ওকে খাওয়াতে হবে, এক্ষুনি যাও!”
আদেশের সুরে বলল আনাবিয়া।
হামদান চকিতে খেয়াল করলো শেহজাদী কে। হঠাৎ করেই যেন বড় হয়ে গেছেন তিনি। চোখ মুখের বাচ্চা ভাবটা হুট করেই যেন উধাও হয়ে গেছে, সেখানে এসে ভর করেছে গুরুগম্ভীর এক দায়িত্বশীলতার ছাপ। কন্ঠেও যেন চলে এসেছে একটা বিরাট পরিবর্তন।
হামদান তৎক্ষণাত আনাবিয়ার প্রতি আনুগত্য জানিয়ে দুজন গার্ড পাঠিয়ে দিলো হেকিমকে ডাকতে। অন্য দুজনকে পাঠালো নোমানকে ডাকতে৷
প্রয়োজনীয় লোকজনের অতিসত্বর উপস্থিতি নিশ্চিত করে আনাবিয়া আবার কামরায় ফিরে এসে বিছানায় উঠে মীরের পাশে বসলো।
জলপট্টি টা এতটুকু সময়ের ভেতরেই শুকিয়ে এসেছে আগুনসম তাপে। সেটা কপাল থেকে নামিয়ে ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে আবার রাখলো মীরের তপ্ত কপালের ওপর। তারপর অপেক্ষা করতে থাকলো ইউসুফ হেকিমের জন্য।
.
মীরের যখন ঘুম ভাঙলো তখন পূব আকাশে সূর্য পুরোপুরি ভাবে দৃশ্যমান। লালচে-হলুদের প্রলেপে ছেয়ে গেছে আকাশ টা৷ পাখিগুলো নিজেদের ভেতর কিচিরমিচির করে তথ্যাদি আদানপ্রদানে অত্যান্ত ব্যাস্ত। মীরের কানে এসে বাড়ি খেলো ওদের সে ঝগড়া খুনসুটির তীক্ষ্ণ আওয়াজ।
চোখ কুচকে তাকালো ও ধীরে ধীরে। মাথাটা কেমন যেন ভারি হয়ে আছে, নাকটাও৷
চোখ মেলে আশেপাশে তাকাতেই ওর চোখে পড়লো বিছানার এক কোণায় গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে থাকা আলুথালুবেশী আনাবিয়াকে। আনাবিয়াকে নিজের পায়ের কাছে পড়ে থাকতে দেখে চিন্তিত ভঙ্গিতে ভ্রু কুচকালো মীর। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে আনাবিয়ার কাছে যেতে নিতেই হাতে টান পড়লো ওর,
স্যালাইন দেওয়া!
মীর এবার পুরোপুরি জাগ্রত হলো। আশপাশ টা খেয়াল করলো ভালোভাবে। সাইড টেবিলের ওপর গত রাতের জলপট্টি দেওয়ার পানি সুদ্ধ বাটি আর সুতির কাপড়টা রাখা। কিন্তু মীর রাতের কিছু ঝাপসা অস্পষ্ট দৃশ্যপট ছাড়া আর কোনো কিছুই মনে করতে পারলোনা।
দ্বিধান্বিত মনে ঝুকে এসে পায়ের কাছটায় এলোমেলো হয়ে ঘুমিয়ে থাকা আনাবিয়ার মুখের ওপর এসে পড়ে থাকা বেবি হেয়ার গুলো আলতো হাতে সরিয়ে দিলো ও। চুলগুলো সরাতেই দৃশ্যমান হলো আনাবিয়ার শুভ্র, নিষ্পাপ মুখোশ্রি। নিচের ঠোঁট টা অত্যান্ত আদুরে ভঙ্গিতে ফুলিয়ে রাখা।
মীরের স্পর্শ পেতেই ধড়মড়িয়ে ঘুম ভেঙে উঠে বসলো আনাবিয়া। মীরকে সুস্থ অবস্থায় উঠে বসে থাকতে দেখে তড়িঘড়ি করে হাটুতে ভর দিয়ে মীরের কোলের ভেতরে মীরের শরীরের সাথে মিশে গিয়ে বসলো ও।
তারপর মীরের মুখ খানা নিজের দুহাতের ভেতরে নিয়ে চিন্তিত কন্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি উঠেছো! কেমন লাগছে তোমার এখন?”
“ভালো লাগছে শিনু। কি হয়েছিলো আমার?”
একহাতে আনাবিয়ার সফেদ চুলের এক গোছা হাতের মুঠিতে নিয়ে পেচিয়ে নিতে নিতে বলল মীর৷ মীরের প্রশ্নে আনাবিয়া কিঞ্চিৎ উত্তেজিত হয়ে একদমে বলতে শুরু করলো,
” রাতে তোমার গায়ে খুব জ্বর ছিলো! আমার ঘুম ভেঙে গেছিলো, উঠে দেখি তোমার গা পুড়ে যাচ্ছে, তখন আমি গিয়ে পানি এনে তোমার মাথায় জলপট্টি দিয়েছিলাম, তারপর হামদানকে গিয়ে বললাম…..”
হামদানের কথা মাথায় আসতেই আনাবিয়ার মীরের জন্য তৈরি খাবারের কথা মনে পড়লো।
“তুমি অপেক্ষা করো, আমি এক্ষুনি আসছি”
বলেই মীর কে কোনোকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে এক লাফে বিছানা থেকে নেমে বাইরে ছুটে গেলো আনাবিয়া৷ পরমুহূর্তেই আবার ছুটে এলো কামরায়, তারপর আবার বিছানায় লাফিয়ে উঠে মীরের কোলের ভেতরে এসে আগের মতো করে বসেই বলা শুরু করলো,
” তারপর হামদান কে গিয়ে বললাম ইউসুফ হেকিম কে ডেকে নিয়ে আসতে, আর নোমান কে বলতে তোমার জন্য খাবার তৈরি করতে। তারপর ইউসুফ আসলে তোমাকে দেখেশুনে স্যালাইন দিলো, একটা ইয়া মোটা ইঞ্জেকশনও দিছে, বলেছে তোমার ওপর দিয়ে অনেক ধকল যাওয়ায় আর ভালো ঘুম না হওয়ায় তোমার জ্বর এসেছে। তোমাকে এখন রেস্টে থাকতে হবে কিছুদিন আর অনেক অনেক খেতে হবে, যাতে তুমি অনেক শক্তিশালি হয়ে যাও!”
“বাবাহ! আমার শিনু তো অনেক কাজ করে ফেলেছে! আমার খেয়াল রাখতেও শিখে গেছে দেখি! এত বড় কবে হলো আমার শিনু?”
বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনী দিয়ে আনাবিয়ার থুতনিটা ধরে নাড়িয়ে দিয়ে বলে উঠলো মীর৷
মীরের মুখে নিজের প্রশংসা শুনে খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেলো আনাবিয়া৷ বত্রিশ পাটি দাঁত মেলে হাসলো ও, তারপর আদেশের সুরে বলল,
” এখন নোমান তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসবে, তুমি সবটুকু খেয়ে নেবে৷ একদম নষ্ট করবে না। নইলে কিন্তু আমি তোমাকে খুব বকে দেবো, তুমি যেভাবে আমাকে বকাবকি করো না খেলে সেভাবে। তোমার কাল রাতের খাবারও তুমি খাওনি। এমন করলে কিভাবে চলবে?
তুমি কত্ত বড়ো! একদম ডাইনোসরের মতো বিশায়ায়ায়াল। তোমাকে অনেক অনেক খেতে হবে, নইলে তুমি দুর্বল হয়ে যাবে নোমানের মতো তখন আমাকে আর কোলে নিতে পারবে না।”
নোমান তখনই খাবারের ট্রে হাতে নিয়ে কামরায় আসার জন্য দরজায় দাঁড়িয়েছিল, শেহজাদীর মুখে এমন কথা শুনে চোয়াল নেমে গেলো ওর৷ পাশে হামদান ছিলো। নোমানের নেমে যাওয়া চোয়ালের দিকে তাকিয়ে ও খ্যাঁক খ্যাঁক করে হেসে উঠে বলল,
“দেখেছিস? তুই যে দুর্বল সেটা আমাদের ছোট্ট শেহজাদীও জানেন। শিরো মিদোরির কারো আর জানতে বাকি নেই।”
নোমান ওর দিকে ফিরে মুখ বেকিয়ে ভেঙচি কাটলো, তারপর মীরের অনুমতি পেতেই ঢুকে পড়লো কামরায়৷
নোমান কে খাবার সহ আসতে দেখে আনাবিয়া মীরের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে বলল,
“এখন তুমি এই সবকিছু খাবে, আমার সামনে বসেই। একটুও যদি বাদ রেখেছো তবে তোমার সাথে আমি আর কথা বলবো না, হুহ!”
আনাবিয়ার গাল ফুলানো দেখে শব্দ করে হাসলো মীর, তারপর ওর ফুলানো গাল দুটো টিপে দিয়ে কোমল গলায় বলল,
“ঠিক আছে বাবা! খাবো আমি সব, আর গাল ফুলাতে হবে না।”
“শিনজো খাবার খেয়েছে, নোমান?”
দুপুর বেলা ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে রয়্যাল মিটিং রুম থেকে ফিরে কামরায় ঢোকার আগ মুহুর্তে নোমান কে দেখে জিজ্ঞেস করলো মীর৷
“উনি এখনো খাননি ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনার জন্য অপেক্ষা করছেন।”
নোমানের কথা শুনে মীর কামরায় ঢুকতে নিচ্ছিলো, তখনি নত চোখে নোমান আবার ডেকে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি!”
নোমানের ডাকে মীর দাঁড়িয়ে গেলো, অতঃপর নোমানের দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কিছু বলবে?”
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, বেলিন্ডার মুখ পুড়ে গেছে!”
মৃদুস্বরে বলল নোমান। মীর ভ্রু কুচকে তাকালো ওর দিকে, তারপর শরীর ঘুরিয়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো নোমানের দিকে ফিরে, অতঃপর গুরুগম্ভীর স্বরে প্রশ্ন করলো,
“কিভাবে?”
“সকাল বেলা খাবার খাওয়ার সময় শেহজাদী রাগের মাথায় গরম স্যুপ ছুড়ে মেরেছিলেন!”
কাঁপা গলায় বলল নোমান। মীরের কুঞ্চিত ললাটটা সোজা হয়ে গেলো সাথে সাথেই। ফোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আবার কামরায় ঢুকে গেলো ও।
দিনে দিনে মেয়েটার ক্রোধ মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এভাবে চলতে দেওয়া যাবে না! রাগের মাথায় কখন কি করে বসবে তার কোনো ঠিক নেই!
মাথাভর্তি আনাবিয়ার চিন্তা নিয়ে বাইরের পোশাক ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে একটা পাতলা ফিনফিনা শার্ট আর একটা ট্রাউজার পরে নিলো মীর৷ তারপর নোমানকে ওর আর আনাবিয়ার জন্য খাবার দিতে বলে আনাবিয়ার কামরার দরজার কাছে গিয়ে নক দিলো দুবার।
ক্ষনিক বাদেই খট করে খুলে গেলো দরজার লক টা। কিন্তু আনাবিয়ার কোনো সাড়া শব্দ এলো না। মীর দরজা ঠেলে ধীর পায়ে ঢুকলো ভেতরে।
সমস্ত দরজা জানালা বন্ধ করে বিছানার ওপর হাটুতে থুতনি ঠেকিয়ে চুপচাপ বসে আছে আনাবিয়া৷ লম্বা চুল গুলো ওর শরীরটা ঢেকে দিয়ে বিছিয়ে আছে পার্ল রঙা রেশমের বিছানার ওপর।
মীর এসে স্লথ গতিতে বসলো ওর পাশে, তারপর কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু গলায় শুধালো,
“কাজ টা কি ঠিক হয়েছে শিনু?”
আনাবিয়া এক পলক মীরের দিকে তাকিয়ে আনত নয়নে অপরাধীর সুরে উত্তর করলো,
“বিশ্বাস করো মীরি, আমি বুঝতে পারিনি ওটা ওর মুখে গিয়ে লাগবে! রাগের মাথায় ছুড়ে দিয়েছি।
ওর কোনো দোষ ছিলো না। অন্য একটা দাসী কই থেকে এসে আমাকে খাইয়ে দিতে নিয়েছিলো।
আমি তাকে বললাম আমি বেলিন্ডার হাতে ছাড়া খাবো না, তবুও আমার মুখে জোর খাবার তুলে দিয়ে বলছিলো ওর হাতে অল্প একটু খেতে। তাই রাগ করে খাবারের বৌলটা ছুড়ে ফেলে দিয়েছিলাম!
তখন বেলিন্ডাও দরজা দিয়ে ঢুকেছে আর বৌলের স্যুপ ওর মুখে গিয়ে লেগেছে!”
আনাবিয়ার উত্তর শুনে মীর ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো একটা। তারপর বিছনার ওপর নড়েচড়ে বসে মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
“ওরা তোমাকে খাওয়াতে চায় কারণ ওরা তোমাকে ভালোবাসে। তোমাকে একটু খাওয়াতে পারলে, তোমার সামান্য কোনো কাজ করে দিতে পারলেও ওরা খুশি হয় অনেক!
ওই দাসীদের কারো কারো কাছে তোমাকে এক পলক দেখতে পাওয়াটাও চরম সৌভাগ্যের ব্যাপার শিনু, যার কারণে ওরা এমন করে৷ কিন্তু তাই বলে তুমি এমন রেগে যাবে, রেগে গিয়ে ওদের আঘাত করে ফেলবে! এমন করা কি ঠিক? বলো!”
“আমি পছন্দ করিনা, তবুও বারবার কেন ওরা আমার কাছে আসে! কেন আমাকে স্পর্শ করে? কেন আমাকে আদর করতে চায়? আমি তো ওদের আদর চাই না!”
অসহায় কন্ঠে বলে উঠলো আনাবিয়া। মীর ঠোঁট গোল করে একটা বড়সড় নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“ঠিক আছে, এখন থেকে তোমার কামরাতেও আর অন্য কেউ আসবে না, আমি সম্পুর্নরূপে মানা করে দেবো। শুধুমাত্র বেলিন্ডা আসবে। খুশি?”
আনাবিয়া ওপর নিচে মাথা নাড়ালো। মীর এবার বিছানা ছেড়ে উঠে দাড়াতে দাড়াতে বলল,
“চলো এখন, খেয়ে নেবে। নোমান বলল তুমি নাকি না খেয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছো!”
“হু। কিন্তু বেলিন্ডা এখন কেমন আছে, তুমি জানো?”
গলার স্বর খাদে নামিয়ে বিষণ্ণকন্ঠে শুধালো আনাবিয়া।
“উহু, নোমান জানে। আমি নোমানের থেকে শুনে তোমাকে জানিয়ে দেবো, হবে? এখন আর মন খারাপ করে থেকোনা, বেলিন্ডা খুব দ্রুতই সুস্থ হয়ে যাবে।
তুমি সময় করে এক ফাকে ওকে একটু দেখে এসো তাহলে ওর ভালো লাগবে অনেক। এখন উঠো ঝটপট, একটুও দেরি নয়। আমার প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে!”
শেষোক্ত কথা গুলো আনাবিয়ার নাকের ডগা টেনে তাড়া দিয়ে বলল মীর৷ আনাবিয়ার মুখে হাসি ফুটলো এতক্ষণে। বেলিন্ডার জন্য ওর খারাপ লাগছিলো ভীষণ! রাগের মাথায় ভুল করে ওই ভালো মেয়েটাকে ও আঘাত করে ফেললো!
মেয়েটা ওর কত্ত যত্ন নেয়, কত্ত আদর করে খাওয়ায়, তাকেই কিনা ও আঘাত করে বসলো।
অপরাধবোধে ওর ছোট্ট মনটা চুপসে ছিলো এতক্ষণ। এখন মীরের কথায় মনটা ওর মন এক্কেবারে ফুরফুরা হয়ে গেছে। খুশি মনে বিছানা থেকে নেমে মেঝেতে মৃদু মিষ্টি শব্দ তুলে নাচতে নাচতে ও এগোলো মীরের পেছন পেছন।
প্রাসাদের বিরাট বিশাল ছাদটির এক কোণায় সুসজ্জিত নকশাদার রেলিঙে ভর দিয়ে জঙ্গলমুখি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ট্রাউজার আর একটা ঢিলাঢালা রোব পরিহিত মীর।
রোবটার বুক খোলা; ওর ইস্পাত-দৃঢ়, বলিষ্ঠ বুকটা রোবের ভেতর দিয়ে দৃশ্যমান হয়ে আছে ভীষণ ভাবে। সকালের মিষ্টি রোদ এসে পড়ছে ওর শরীরের ওপর।
ছাদের অন্য কোণায় দাঁড়ানো দাসী গুলো তাদের চোরা চোখের দৃষ্টিতে এক প্রকার গিলে খাচ্ছ ওকে।
দাসী গুলো ছাদেই ছিলো। বাদশাহর আদেশে প্রাসাদের ছাদকে তাঁর শেহজাদীর জন্য বিশেষভাবে সজ্জিত করা হচ্ছে। শেহজাদী ছাদে আসার জন্য বায়না ধরেন আজকাল খুব, কিন্তু বাদশাহ তাঁর একমাত্র হবু বেগম কে কোনো সাধারণ কিছুর মাঝে রাখতে চাননা কখনো। তাই রাত দিন এক করে ছাদ টাকে বাদশাহর মনের মতো করে আভিজাত্যের সাথে সাজিয়ে চলেছে ওরা।
সাজানোর কাজটা বর্তমানে স্থগিত হয়ে আছে৷ বাদশাহ স্বয়ং এসে উপস্থিত হয়েছেন সেখানে৷ তাঁর সাথে আছেন পঞ্চদ্বীপের বাকি চার দ্বীপের কন্ট্রোলারগণ৷
কামরায় মীরের ভালো লাগছিলো না, আনাবিয়া ওস্তাদজীর কাছে পড়তে গেছে।
মেয়েটা যতক্ষণ আশেপাশে থাকে ততক্ষণ সময় গুলো কাটে ছটফটিয়ে চলা ঝর্ণার মতো।
মেয়েটা চোখের আড়াল হলেই অশান্তি শুরু হয় ওর, হাঁসফাঁস লাগে, দমবন্ধকর একটা আবহাওয়া সৃষ্টি হয় যেন ওর চারপাশে৷ ওই বদ্ধ পরিবেশ থেকে একটু খানি মুক্তি পেতে তাই ছাদে চলে এসেছে ও৷
চার দ্বীপের এই চারজন কন্ট্রোলার দেমিয়ান বংশের বিগত শেহজাদীর বংশধর। ওদের আয়ু দেমিয়ান বংশের পুরুষদের মতো এতটা বেশি না হলেও কাছাকাছি। চারজনই মীরের অত্যান্ত কাছের মানুষ। তন্মধ্যে জায়ান সাদি অন্যতম।
জায়ান কিমালেবের কন্ট্রোলার। বিগত শেহজাদীর বড় নাতির ছোট সন্তানের বড় ছেলে।
মীরের থেকে বছর দশেকের বড়। সালিম মারা যাওয়ার পর থেকে এই ভাই রূপি বন্ধুটি মীরের আরও বেশি কাছের হয়ে গেছে। বিপদে আপদে, যেকোনো বড় বড় বিষয়ে জায়ানের সাথেই আলোচনা করে সর্বদা স্বস্তি পায় মীর৷
জায়ান এক পলক অদূরে দাঁড়িয়ে মীরের দিকে অপলকে থাকিয়ে থাকা দাসী গুলোর দিকে তাকালো, তারপর মীরকে উদ্দ্যশ্য করে ইতস্ততভাবে আনুগত্যের সাথে মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, এইভাবে….. দাসী গুলোকে আপনার কাছে আসতে দেওয়ায় বাধা দেওয়াটা কেমন একটা হয়ে যাচ্ছে না! তাছাড়া, আপনারও তো একটা চাহিদা আছে! এইভাবে নিজেকে বিরত রাখাটা আপনার শরীরের ওপরেও তো বিরূপ প্রভাব ফেলবে!”
জঙ্গলের দিকে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মীর জায়ানের কথা শুনে হাসলো মৃদু, তারপর জায়ানের দিকে চোখ ফিরিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“এসব তোমার না ভাবলেও চলবে ভাইজান।”
জায়ান অপ্রস্তুত হলো, বাধো বাধো সুরে আনত দৃষ্টিতে লজ্জিত গলায় উত্তর করলো,
“অনধিকারচর্চা করে ফেললে ক্ষমা করবেন, ইয়োর ম্যাজেস্টি।”
মীর ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে রেলিঙের ওপর থেকে নিজের ভর সরিয়ে জায়ানের দিকে সোজা হয়ে দাড়ালো,
“জায়ান ভাইজান, আমি আমার শিনজোকে নিয়ে অনেক চিন্তিত। দিনে দিনে তার রাগ, জেদ বেপরোয়া ভাবে বেড়ে চলেছে। আমি ছাড়া অন্য কেউ তাকে শান্ত রাখতে অপারগ।
সর্বক্ষণ তার আশেপাশে থাকাও এইমুহূর্তে আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তার ওস্তাদজীও ব্যর্থ তাকে তার এই ক্রোধ থেকে বের করতে।
আমার শিনু এখনো ছোট, এখনো ভালোমন্দের পার্থক্য বোঝার মতো সময় তার আসেনি। আর আমিও তাকে চাপ প্রয়োগ করতে চাইনা, চাইনা বলতে পারবোনা ওর ওপর কোনো চাপসৃষ্টি করতে।
এখন বলো, ওর ক্রোধ কমানোর আর কোনো উপায় আছে কিনা!”
মীরের কথা মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো ওরা এতক্ষণ। মীরের অন্যপাশে দাঁড়ানো নওয়াস চকিতে একবার সকলের দিকে দৃষ্টি ফেলে গলা খাকারি দিয়ে ভীতি আর শ্রদ্ধাপূর্ণ কণ্ঠে বলে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, যদি অনুমতি দেন তবে আমি কিছু বলতে পারি!”
নওয়াস জাবিন, কুরো আহমারের কন্ট্রোলার, জায়ানের বড় দাদার বড় ছেলের একমাত্র ছেলে। সম্পর্কের দিক থেকে এরা সকলেই একে অপরের কাজিন।
জায়ান ছাড়া মীরকে ওর অন্য কাজিনরা প্রায় যমের মতো ভয় পেয়ে চলে।
ছোট বেলা থেকেই মীরের সাথে তাদের অন্যরকম একটা দুরত্ব। পূর্বে ইলহান, সালিমের সাথে তাদের ভালো সম্পর্ক থাকলেও মীরের সাথে সেইভাবে কখনোই কথা হয়নি তাদের।
তার ওপর মীরের এই ইউনিক ফিচার, অত্যান্ত বলিষ্ঠ শরীর তাদেরকে সবসময় মীরের থেকে অজানা আতঙ্কে দূরে রেখেছে। আর আজ সেই চিরচেনা আতঙ্কই বসে আছে পঞ্চদ্বীপের বাদশাহর আসনে!
নওয়াস কথা টা বলে শুকনো ঢোক গিললো একটা। মীর ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গম্ভীর মেঘমন্দ্র কন্ঠে বলল,
“হ্যাঁ বলো নওয়াস, কি বলতে চাও?”
মীরের এহেন গভীর কন্ঠে নওয়াস আর একবার ঢোক গিলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভেজালো, এক পলক তাকিয়ে আবার চোখ নামিয়ে নিলো।
মীরের স্বর্ণালি আভার শকুনি দৃষ্টির ওপর দৃষ্টি রাখা অত্যান্ত দুরূহ!
ইতস্তত করে অবশেষে বলল,
“কুরো আহমারে বেশ কিছু বছর আগে যে প্রাইভেট বোর্ডিং স্কুল অ্যান্ড কলেজের ব্যাপারে ঝামেলা হয়েছিলো, ওই বোর্ডিং স্কুল অ্যান্ড কলেজটা অনেক ভালো। বলা যায় কুরো আহমারের সবচেয়ে বেস্ট বোর্ডিং। ওরা এটিকেট অ্যান্ড ম্যানার্সের প্রতি খুব নজর দেয়। আমার ছেলে ফারিসও প্রথম থেকে ওখানেই আছে। ওখানের পড়াশোনাটাও অনেক উন্নতমানের। আপনি যদি ঠিক মনে করেন তবে শেহজাদীকে একবার সেখানে অ্যাডমিট করে দেখতে পারেন। আপনি আশাহত হবেন না আশা করি, ইয়োর ম্যাজেস্টি!”
মীর নওয়াসের দিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে থেকে ভাবলো কিছুক্ষণ। কিন্তু মীরের ওই তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নওয়াসের গলা শুকিয়ে এলো, বোর্ডিংয়ের কথা বলে আবার কোনো ভুল করে বসলো কিনা সেটা মনে হতেই বুক কাঁপতে শুরু করলো ওর৷
কিছুক্ষণ বাদে মীর ওর কুচকানো কপাল টাকে আবার স্বাভাবিক করে নিয়ে আদেশের সুরে বলে উঠলো,
“ঠিক আছে আমি ভেবে দেখবো নওয়াস, এখন তোমরা আসতে পারো। আর জায়ান ভাইজান, তুমি এখানেই থাকো কিছুক্ষণ।”
শেষোক্ত কথাটা জায়ানের দিকে ফিরে বলল মীর৷ জায়ান মাথা নেড়ে সায় জানালো। বাকিরা আনুগত্যের সাথে বিদায় জানিয়ে প্রস্থান করলো ছাদ থেকে৷
মীর নিরবতা পালন করলো কিছুক্ষণ, চোখ জোড়া ওর দূর জঙ্গলের মধ্যিখানে।
আজ ওর বিশেষ কোনো কাজ নেই, সারাদিন অবসর। শিনুটা প্রাসাদের অন্য কোণায় ওস্তাদজীর কাছে। ফিরে আসতে এখনো ঘন্টাখানেক সময়। মেয়েটা আজ কয়েকদিন ধরে বাইরে ঘুরতে যেতে চাইছে কিন্তু মীর সময় করে উঠতে পারছিলো না, অন্য কারো সাথে যে পাঠাবে সেটাও হবে না, মীর ছাড়া আর অন্য কেউ হলে ম্যামের চলবে না! তাই আজকের অবসর টা কাজে লাগানোর জন্য প্রস্তুতি শুরু করেছে ও।
কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর মীর জঙ্গলাভিমুখী থেকেই জায়ানের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“কি করা যায় বলোতো ভাইজান!
শিনুটা ছোট এখনো, বুঝতে চায়না কিছু। আর ভীষণ ভীষণ জেদী! ছোটবেলায় শুনেছিলাম আজলান চাচাজান এমন ছিলেন, কারো কথা শুনতেন না। পুরোপুরি দাদার স্বভাব পেয়েছে, একেবারে যা বলবে তাই।”
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনি হয়তো লক্ষ্য করেছেন অবশ্যই তবুও বলছি, আমাদের শেহজাদী অন্য দেমিয়ান শেহজাদী দের থেকে কিছুটা ভিন্ন হয়েছেন। এবং উনি এখন থেকেই অনেক বেশিই শক্তিশালী।
গতবার এখানে আসার পর উনি খেলাচ্ছলে আমাকে একটা থাপ্পড় মেরেছিলেন, আমি জাস্ট হতবাক হয়ে গেছিলাম! আমার আঘাতপ্রাপ্ত স্থানটা প্রচন্ড যন্ত্রণায় যেন অবশ হয়ে গেছিলো!”
মীর মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলল,
“তুমি ঠিক বলেছো ভাইজান। সেটা আমারও নজর এড়ায়নি। ও যে অন্য শেহজাদীদের মতো হয়নি সেটা আমি অনেক আগেই বুঝেছি ওর এই মাত্রাতিরিক্ত রাগ দেখে। আমি শেহজাদীদের সম্পর্কে যতটুকু পড়াশোনা করেছি তাতে আমি কোথাও কোনো শেহজাদীর বৈশিষ্ট্যে এত রাগ, জেদ দেখিনি। সামথিং ইজ ফিসি উইদিন হার!”
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আমি যেটা ধারণা করছি সেটা কি আপনাকে বলার অনুমতি দিবেন?”
আনুগত্যের সাথে শুধালো জায়ান। মীর ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে বলতে বলল। জায়ান জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
“আমাদের শেহজাদীর আম্মাজান ইনায়া বহির্বিশ্বের কেউ একজন। আপনারা তাকে সেখান থেকেই নিয়ে এসেছিলেন। আমি যতদূর জানি তাতে এর আগে কখনো কোনো দেমিয়ান বংশের সন্তান বহির্বিশ্বের কোনো নারীর গর্ভে জন্ম নেয়নি।
সকলে প্রাসাদের দাসীদের গর্ভেই জন্মেছেন; যাদের বেশিরভাগই পঞ্চদ্বীপের পিতৃ-মাতৃহীন, নাম পরিচয়হীন মেয়ে আর অন্যরা বিশেষভাবে ল্যাবে তৈরি।
আমার ধারণা শেহজাদীর এমন হওয়ার পেছনে ওনার আম্মাজান এবং বহির্বিশ্বের কোনো যোগসূত্র আছে।”
“হতে পারে ভাইজান। ইনায়া কে আমি চিনিনা সেভাবে, কখনো কথাও হয়নি তেমন। সে ব্যাক্তিগতভাবে কেমন চরিত্রের অধিকারী সেটা আমি জানিনা। সালিমের সাথে ওর বিয়ে দেওয়ার সময় মেয়েটিকে দেখেছিলাম আমি, আমার শিনজো বেশ অনেকটাই ওর মায়ের চেহারা পেয়েছে, যেটা দেমিয়ান বংশে খুবই রেয়ার, খুবই। দেমিয়ান বংশের সন্তানেরা মায়ের কোনো বৈশিষ্ট্যই পায়না, সম্পুর্ন পিতার বৈশিষ্ট্যই ধারণ করে আর সাথে অর্জন করে স্বতন্ত্র কিছু নতুন বৈশিষ্ট্য। কিন্তু শিনজোর ক্ষেত্রে সেটা ব্যাতিক্রম। ওর মুখে সালিম, ইনায়া দুজনের চেহারারই প্রতিফলন দেখি আমি।”
জায়ানের কথার প্রতিউত্তরে বলল মীর৷ জায়ান চুপ করে রইলো। মীর আবারও বলে উঠলো,
“সেটা নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাতে চাই না। বোর্ডিং এর ব্যাপার টা নিয়ে আমি চিন্তিত। শিনু কারো স্পর্শ পছন্দ করে না, বেলিন্ডা আর আমি ছাড়া অন্য কেউ ওর কোনো কিছুতে স্পর্শ করলে ও রেগে যায় প্রচন্ড।
শিনুকে যদি আমি বোর্ডিংয়ে দিইও, ও একা একা আমাকে ছাড়া কিভাবে থাকবে সেখানে? বাই এনি চান্স কেউ ওকে স্পর্শ করে ফেললে তো ও সেখানে লাশের বন্যা বইয়ে দিবে!
আর যেহেতু বোর্ডিং, সেখানে সবাইকে একসাথে থাকতে হবে! আমার শিনুর আমি ছাড়া অন্য কারো সাথে ঘুমানোর অভ্যাস নেই, মোলায়েম বিছানা ছাড়া ও ঘুমাতে পারবেনা কখনো। ওর একা থাকা অভ্যাস, ল্যাভিশ লাইফস্টাইলে ও অভ্যস্ত।কারো সাথে শেয়ারে থাকা ওর পক্ষে অসম্ভব!সর্বক্ষণ জার্ম ফ্রি হাইজেনিক জায়গাতে থাকা ওর অভ্যাস, সেখানের পরিবেশে গিয়ে ও কিভাবে থাকবে!”
“প্রথম প্রথম একটু অসুবিধা তো সবারই হয়! আমাদের শেহজাদী যথেষ্ট বুদ্ধিমতি, উনি মানিয়ে নিতে পারবেন অবশ্যই। যখন উনি দেখবেন এখন থেকে ওনাকে সেখানেই থাকতে হবে তখন উনি ঠিকই নিজেকে সামলে নিবেন।”
“তুমি ব্যাপার টা বুঝতে পারছোনা ভাইজান! ওকে আমি ওর জন্মের পর থেকে একা হাতে মানুষ করেছি, আমি জানি ও ঠিক কেমন। ওর থেকে আমার বেশি চিন্তা ওর আশেপাশে থাকা বাচ্চা গুলোকে নিয়ে।
শিনুর যে ক্রোধ তাতে ও এসব সহ্য করবে না কখনো। আর তাছাড়া ও এখনো জানেনা, বুঝেনা কিভাবে নিজের পাওয়ারকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয়!
তার চাইতে বড় কথা আমার কি হবে! ওর মুখখানা না দেখে আমি কিভাবে থাকবো! ওকে কিছুক্ষণ না দেখতে পেলে আমার অশান্তি হয় প্রচন্ড। এই যে এখন ও ওস্তাদজীর কাছে পড়া করতে গিয়েছে, এই যে এখন আমি ওকে আমার সামনে পাচ্ছিনা আমার দমবন্ধ লাগছে! আর সেখানে এতগুলো দিন ওকে না দেখে আমি কিভাবে থাকবো!”
জায়ান কি বলবে বুঝতে পারলোনা, সর্বাঙ্গে ব্যাথা ওষুধ দিবো কোথা অবস্থা হয়েছে এদের দুজনের৷ জায়ান মাথা চুলকে বলল,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, আপনি ভেবে দেখুন কি করবেন! তবে বোর্ডিং স্কুল টা আসলেই অনেক ভালো, আমিও এইটার অনেক নামডাক শুনেছি। সেখানে গেলে উনি অবশ্যই নিজের অ্যাঙ্গারমেন্ট ইস্যুকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারবেন আশা রাখি৷ সাথে নিজের সমবয়সী কিছু ফ্রেন্ডও পেয়ে যাবেন। সেল্ফ ইম্প্রুভের ক্ষেত্রে এইটা অনেক বেশি কার্যকর।”
“ঠিক আছে ভাইয়জান, আমি ভেবে দেখবো৷ আপনি এখন আসতে পারেন।”
জঙ্গলের দিকে ভাবুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে উঠলো মীর। জায়ান আনত দৃষ্টিতে আনুগত্য জানিয়ে চলে যেতে নিয়েও আবার থেমে গেলো, তারপর মৃদুস্বরে ডেকে উঠলো,
“ইয়োর ম্যাজেস্টি!”
মীর ঘাড় ঘুরিয়ে জায়ানের দিকে তাকালো,
“হ্যাঁ বলো ভাইজান।”
“শেহজাদী কখন ফিরবেন জানালে একটু উপকৃত হতাম। জানেনই তো উনি আমাকে কতটা পছন্দ করেন! উনি যদি শোনেন আমি কিমালেব থেকে এসেছি কিন্তু ওনার সাথে দেখা না করেই চলে গেছি তবে উনি তুলকালাম কান্ড বাধিয়ে দিবেন! তখন শিরো মিদোরি তে পা রাখাই আমার জন্য হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে!”
আমতা আমতা করে বলল জায়ান। জায়ানের কথা শুনে মীর শব্দ করে স্নিগ্ধ হাসলো।
ওর সে হাসিতে দাসীগুলোর ভেতর যেন শিহরণ বয়ে গেলো। অদ্ভুত কামুক ভঙ্গিতে ওরা তাকিয়ে রইলো মীরের দিকে৷
জায়ান সেটা খেয়াল করে ঠোঁট টিপে হাসলো। মীর সেটাকে পাত্তা না দিয়ে চোখে হেসে জায়ানের উদ্দ্যেশ্যে বলে উঠলো,
“একটা বাচ্চা মেয়েকে আমরা সবাই মিলে কতটা ভয় পাই সেটা খেয়াল করেছো ভাইজান!”
“ইয়োর ম্যাজেস্টি, ভবিষ্যতে আরও ভয় পাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। জানেনইতো বউকে ভয় পায়না এমন কোনো পুরুষ পৃথিবীতে এখনো জন্মায়নি! আর বউ যদি হয় দেমিয়ান বংশের শেহজাদী আর সেটাও শেহজাদী আনাবিয়া ফারহা দেমিয়ান, তবে নিজেকে সব রকম ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত করে রাখাই শ্রেয়।”
বলতে বলতে নিজের হাসি আটকে রাখতে পারলোনা জায়ান, না চাইতেও হেসে উঠলো গা কাঁপিয়ে! ওর হাসি দেখে মীর নিজেও আর নিজের গম্ভীর স্বভাব টা ধরে রাখতে পারলো না, ঠোঁট কামড়ে হেসে উঠলো সেও!
“ওস্তাদজী, আর ভালো লাগে না লিখতে! আমি মীরির কাছে যাবো।”
মিষ্টি অভিমানী গলায়, কিঞ্চিৎ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠলো আনাবিয়া।
“এইতো শেহজাদী আর অল্পই! এটুকু শেষ হলেই আপনি হিজ ম্যাজেস্টির কাছে যেতে পারবেন। আপনি যদি নিয়মিত পড়া না করেন তবে হিজ ম্যাজেস্টি আমাকে বকে দেবেন। একটু মন দিয়ে পড়াশোনাটা করুননা শেহজাদী!”
করুণ সুরে অনুরোধ করে বলে উঠলেন আনাবিয়ার ওস্তাদজী ইয়াহিয়া ইব্রাহিম। লোকটির বয়স ষাটের কিছুটা নিচে। চোখ মুখ জুড়ে জ্ঞান আর প্রজ্ঞার প্রতিফলন। কপাল জুড়ে তাঁর শান্ত ভাব। চোখের নিচে সামান্য ক্লান্তির রেখা। চুলদাড়ি গুলো বেশ পরিপাটি, জ্ঞান আর বয়সের ভারে সাদা হয়ে আসছে। পরনে একটি হালকা রঙের সুতির জুব্বা, মাথায় একটা সাদা পাগড়ি, চোখে একটা মোটা ফ্রেমের চশমা। চেহারাটা চিন্তার গভীরতায় পূর্ণ; বেশি চিন্তা তার সামনে বসা এই অত্যান্ত সুন্দরী পড়াচোর শেহজাদীকে নিয়ে।
ইয়াহিয়া ওস্তাদজীর ঘাম ছুটে যায় রোজ শেহজাদীকে পড়াতে গিয়ে। দুষ্টু শেহজাদীটা একটুও কথা শোনেন না, মেধা অত্যন্ত তীক্ষ্ণ, কিন্তু মনোযোগ আর অধ্যবসায় শূন্যের কোঠায়। যদিও এখন আগের থেকে একটু উন্নতি হয়েছে। বয়স বাড়ছে তো, বুঝতে শিখছেন আস্তে আস্তে৷
শেহজাদী পড়া না করলে তাকে হিজ ম্যাজেস্টি বকা না দিলেও ইয়াহিয়াকে ঠিকই কথা শুনতে হয়।
কেন সে হিজ ম্যাজেস্টির একমাত্র শেহজাদীকে পড়াতে ব্যর্থ সেটার কৈফিয়ত দিতে হয় হিজ ম্যাজেস্টি কে প্রতিনিয়ত।
অথচ হিজ ম্যাজেস্টি নিজেও ভালো করেই জানেন দুষ্টুটা আসলে কে। কিন্তু সেই আদুরে, মিষ্টি দুষ্টুটাকে কোনোদিন কিছু বললে তো! যত রোলার চলে সব এই মাসুম ভৃত্য গুলোর ওপর দিয়ে।
আরও কিছুক্ষণ স্থীর হয়ে লেখার পর আনাবিয়া এবার ধৈর্যহারা হয়ে ছুড়ে দিলো হাতের কলম টা কোনো এক দিকে। তারপর ইয়াহিয়ার দিকে চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে তেজি গলায় বলে উঠলো,
“আর পারছিনা আমি! আমাকে ছুটি দিন!”
ইয়াহিয়া হতাশার সাথে ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ছাড়লো, তারপর মৃদুস্বরে বলে উঠলো,
“ঠিক আছে শেহজাদী, আপনার এখন ছুটি। যে হোমওয়ার্ক গুলো আজ দিয়েছি সেগুলো অনুগ্রহ করে আগামীকাল করে আসবেন! নইলে হিজ ম্যাজেস্টি আমাকে খুব বকা দিবেন!”
শেষোক্ত কথাটা অসহায় কন্ঠে বললেন ইয়াহিয়া। আনাবিয়া তাকে আশ্বস্ত করে বলল,
“আমি কখনো হোমওয়ার্ক ইনকমপ্লিট রেখেছি ওস্তাদজী? রাখিনি তো! তাই আপনি নিশ্চিত থাকুন মীর আপনাকে কিচ্ছু বলবেনা, আপনাকে কিছু বললে ওকে আমি বকে দেবো।”
ইয়াহিয়া নিজের মনে বলে উঠলো,
“আপনিই পারবেন শেহজাদী এই অসম্ভব কে সম্ভব করতে!”
তারপর মুখে বলল,
“ঠিক আছে শেহজাদী, আমার ওপর দয়া করে হোমওয়ার্ক গুলো একটু ঠিকঠাক ভাবে করবেন, তাহলেই আর আমাকে ভয়ে ভয়ে থাকতে হবে না। আপনি এখন হিজ ম্যাজেস্টির কাছে যেতে পারেন শেহজাদী।”
ওস্তাদজীর থেকে ছুটি পাওয়া মাত্রই আনাবিয়া বসা থেকে উঠে মেঝেতে সুমধুর সুর তৈরি করে নেচে উঠে মৃদু গতিতে ছুটে বেরিয়ে গেলো বাইরে।
বেলিন্ডা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলো ওর জন্য। মুখের ফোস্কা পড়ে যাওয়া অংশটা এখনো দগদগে, কিন্তু বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ নেই! শেহজাদী যে অন্য কারো কাছে যাবেন না!
বেলিন্ডা এতেই খুশি যে প্রাসাদের হাজার হাজার দাসীদের ভেতরে শেহজাদী নিজের জন্য তাকে চ্যুজ করেছে। তাই এই অসুস্থতা তার অহংবোধের কাছে কিছুই না।
আনাবিয়া বের হয়ে গেলে বেলিন্ডা ভেতরে এসে ওর বই খাতা গুলো গুছিয়ে নিয়ে চলল ওর পেছন পেছন।
জায়ান অপেক্ষা করছিলো মীর আর আনাবিয়ার কামরার সামনের বিশাল বারান্দাটায়। সমস্ত দেমিয়ান প্রাসাদের ভেতরকার সবচেয়ে সুন্দর অংশ এটি, যেখানে একটিবার পা রাখলে আর যেতে ইচ্ছা করে না কোথাও। জায়ান কতশতবার এখানে এসেছে সেটা অজানা, কিন্তু প্রত্যেকবারই এই বারান্দাটার সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েছে ও। এখনো খুটিয়ে খুটিয়ে বারান্দা টার প্রতিটা অংশ দেখে চলেছে ও৷
প্রাসাদের রয়্যাল ফ্লোরের এই বিশাল আভিজাত্যপূর্ণ বারান্দাটা স্বপ্নের ন্যায় ঠেকে ওর কাছে।
বিশাল অফ হোয়াইটের মার্বেল পাথরে তৈরি মেঝে, যার ওপর সূর্যের সোনালি কিরণ পড়ে ঝলমল করছে চারদিকটা। ক্ষণে ক্ষণে এক অদ্ভুত সুন্দর আলোচ্ছটা খেলে চলেছে সমস্ত বারান্দাটা জুড়ে।
প্রাসাদের অবকাঠামোতে অতি সূক্ষ্ম নকশার মার্বেল পাথর যার উপর সোনালী প্যাটার্নে গড়া কৃষ্টির ছোঁয়া। প্রবেশদ্বারের দুই পাশে উঁচু, গাঢ় সোনালি রঙা কলামগুলো যেন দাঁড়িয়ে আছে রাজত্বের অহংকার হয়ে।
বারান্দার চারপাশে সুবিস্তৃত সাদা এবং ছাই রঙা পাথরের কলামগুলো মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সগর্বে। বারান্দার মধ্যখানে, রেলিঙের কাছটায় দীর্ঘ নকশাদার অফ হোয়াইটের সিল্কের পর্দা, যা বাতাসের সাথে খেলে চলেছে অবিরাম।
রেলিঙ টা জুড়ে পেচিয়ে আছে অনাদরে গজিয়ে ওঠা কিছু অদ্ভুত অথচ প্রচন্ড দৃষ্টিনন্দন বুনো ফুলের লতা।
বারান্দার এক কোণে সুসজ্জিত হয়ে আছে একটি ছোট্ট বাগান, যেখানে হরেক রঙা গোলাপ, লিলি আর কিছু বন্য অর্কিড ফুটে আছে অবলীলায়। তাদের অসাধারণ সুবাস বাতাসের স্নিগ্ধতার সাথে মিশে তৈরি করেছে এক অপরূপ মাদকতা।
তারই পাশে বিশাল ও আরামদায়ক সোফাগুলো সুদৃশ্য রেশমের কাপড় দিয়ে ঢাকা, যার সাদা রঙা জমিনের ওপর সোনালী রঙের সূক্ষ্ম নকশা ফুটে উঠেছে। সোফা সেটটির সামনে রাখা একটি চন্দন কাঠের কফি টেবিল, যার সুগন্ধি তে ম ম করছে চারদিক টা।
এখানে বসলে সূর্যোদয়ের দিকে পড়ে খোলা দৃষ্টি, যেখান থেকে দেখা যায় কিমালেব নামক দ্বীপটিকে, যেখানে নীলাকাশের সাথে মিশে গেছে সুউচ্চ সবুজ পাহাড়।
আর অন্যপাশে পাশে রয়েছে জলপ্রপাতের মত ঝর্ণা, যার স্রোতের ধ্বনি সঙ্গীতের মতো মৃদু গুঞ্জণে প্রতিনিয়ত মিশে চলেছে বাতাসে। ঝর্ণার পাশে থাকা বিশাল রেডউড গাছগুলোর চকচকা সবুজ পাতাগুচ্ছ ঝলমল করে উঠছে বাতাস আর সূর্যালোকের মিষ্টি খেলায়৷
জায়ান রেলিঙ ধরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে ছিলো কলকলিয়ে বয়ে চলা ঝর্ণাটার দিকে। তখনই রয়্যাল ফ্লোরের প্রবেশদ্বার দিয়ে, মিহি সুরেলা কন্ঠে আবোলতাবোল গান গাইতে গাইতে, ছন্দে ছন্দে লাফিয়ে ভেতরে ঢুকলো আনাবিয়া। ঢোকা মাত্রই তার চোখ গেলো রেলিঙের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা জায়ানের দিকে, যে কিনা তার দিকে তাকিয়েই মিটিমিটি হেসে চলেছে।
জায়ানকে দেখা মাত্রই আনন্দে উচ্ছসিত হয়ে চিৎকার দিয়ে চাচাজান’ ডেকে ছুটলো আনাবিয়া। জায়ান ওকে দূর থেকেই সাবধান বানী দিয়ে উদ্বিগ্ন কন্ঠে বলে উঠলো,
“আস্তে ছুটুন শেহজাদী, পড়ে যাবেন তো!”
কিন্তু কে শোনে কার কথা! আনাবিয়া নিজের ছোটায় মত্ত। জ্বলজ্বলে চোখ জোড়া জায়ানের মুখের ওপর নিবদ্ধ।
জায়ানের সাবধান বানী শুনে মীরও বেরিয়ে এলো নিজের কামরা থেকে, মেয়েটা ছুটতে গিয়ে ধপাস খায় কিনা সেই চিন্তায়।
ততক্ষণে আনাবিয়া জায়ানের কাছে ছুটে এসে ঝাপিয়ে পড়ে জায়ানের কোমর ধরে ঝুলে পড়েছে। জায়ান ওকে ধরে কোলে নিবে কিনা সেই দ্বিধায় তাকালো মীরের দিকে। মীর সম্মতি দিতেই দুহাতে আনাবিয়াকে কোলে তুলে নিলো, তারপর মিষ্টি কন্ঠে শুধালো,
“আমার আম্মাজানটা কেমন আছেন?”
“এত্ত ভালো”
দুহাত দুদিকে প্রসারিত করে নিজের ভালো থাকার পরিমাণ টা দেখালো আনাবিয়া। তারপর ঝিলিক দেওয়া বড় বড় চোখ জোড়া ঘুরিয়ে উৎসাহী কন্ঠে বলে উঠলো,
“তুমি কেমন আছো চাচাজান? আজকে থাকবে তো? আজ মীরি আমাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে। তুমিও থাকো মজা হবে অনেক। রাতের বেলা বার্বিকিউ পার্টি হবে জঙ্গলের ভেতর, মীরি আমাকে বার্বিকিউ করে খাওয়াবে বলেছে। তুমিও থাকোনা চাচাজান!”
জায়ান ঠোঁট উল্টালো, তার অনেক কাজ। আজ না ফিরলে হবেই না, কিন্তু এমন মিষ্টি আবদার ফেলার মতো সাধ্যও ওর নেই। মীরের দিকে ও আড়চোখে তাকালো মীর কি আদেশ দেয় সেটা জানার জন্য।
মীর আনাবিয়ার অগোচরে নিঃশব্দে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো ওকে থাকার। জায়ানের ঠোঁট জোড়া প্রসারিত হলো, আনাবিয়ার সরু নাক টা টিপে দিয়ে ও মাথা নুইয়ে জোর গলায় বলে উঠলো,
বাদশাহ নামা দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পর্ব ৩+৪
“অবশ্যই শেহজাদী, আপনার আদেশ শিরোধার্য। আজকের দিনে এই জায়ান সাদি আপনার সেবায় সর্বক্ষণ নিয়োজিত। শুধু আপনি তাকে আদেশ করুন!”
জায়ানের বলার ভঙ্গিতে আনাবিয়া মজা পেলো অনেক। খিলখিল করে হেসে উঠলো ও৷
