বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২৪
ইশরাত জাহান
রাত গভীর হয়ে এসেছে।দর্শন ঘরে ঢুকে বিছানায় এসে বসল।নতুন বিছানা,নতুন চাদর সাথে নতুন সাদা বালিশ সব আছে।শুধু নেই কেউ একজন।শোভা!
গত কয়েকদিন যশোরের একই ঘর, সেই এক বিছানায় শোভার নির্লিপ্ত উপস্থিতি এতটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে যে,আজ তার না থাকাটাই অসহ্য লাগছে।সে তো কোনোদিন দর্শনের দিকে ফিরে শুয়ে থাকেনি।মুখ ঘুরিয়ে থাকত চুপচাপ।কখনো কখনো জানালার বাইরে তাকিয়ে থাকত একা।কিন্তু সে ছিল। বিছানার ওপ্রান্তে একটা জীবন ছিল একটা হালকা নিঃশ্বাস, একটা শরীরের ঘ্রাণ ও এক ধরনের চুপচাপ অভিমানী উপস্থিতি।আজ সে নেই।
আজ এই ঢাকার বাড়িতে এই বিশাল ঘরে দর্শন একা।তার ঘুম আসছে না।বারবার পাশ ফিরে তাকাচ্ছে।যেন শোভা হয়তো শুয়ে আছে।যেন চোখ ফিরিয়ে দেখলেই পাওয়া যাবে।কিন্তু না!সে নেই।দর্শনের বুকটা হালকা ধাক্কা খেলো।দর্শন ভাবছে,“তবে কি আমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি মেয়েটার কাছে?নাকি এইটাই আসলে ভালোবাসা?”
আবার ভাবছে,“না না না এটা হতে পারেনা।ভালোবাসা এত দ্রুত হয়না।”
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আবার ভাবছে,“যে মানুষটা কখনো কাছে আসেনি, সে আজ না থাকায় বুকটা কেন এত শূন্য লাগছে?”
ঘরের নিস্তব্ধতা ভেঙে শুধু দর্শনের দীর্ঘশ্বাস শোনা যাচ্ছে।সে হয়তো এতদিনে বুঝে ফেলেছে শোভা না থাকলে ঘুম আসে না।না শুধু ঘুম নয় শান্তিটাই আসে না।আর এটাই কি ভালোবাসা নয়?
ব্যালকনিতে এসে ইজি চেয়ারে বসলো দর্শন।মাথাটা একেবারে এলিয়ে দিয়েছে চেয়ারের সাথে।পাশে থাকা গিটারটা হাতে ছুঁয়ে দেখলো।একা নিস্তব্ধ পরিবেশে প্রায়ই টুংটাং আওয়াজ করে গান গায়।কোনো দুঃখজনক মুহূর্ত মনে পড়লেই গিটারের সঙ্গী হয়ে যায় সে।আজও তাই হলো।গিটার হাতে নিয়ে বাজাতে থাকে।তারপর গান শুরু করে,
“বাহির বলে দূরে থাকুক
ভিতর বলে আসুক না।
ভিতর বলে দূরে থাকুক
বাহির বলে আসুক না।”
চার লাইন গেয়েই আবারো গিটারের শব্দে শান্ত ও নিরিবিলি পরিবেশকে এক আলাকা জগতে নিয়ে যায়।আসলেই এমনটা হয়।পরিস্থিতি যেমনই হোক একাকীত্বের মাঝে গিটারের শব্দে নিজেকে আটকে রাখলে আলাদা জগৎ সৃষ্টি হয় যেন।মনেই হয়না আমরা কোন পরিস্থিতি দিয়ে কাটাচ্ছি।দর্শনের এই গিটার বাজানোর শব্দ পায় শোভা।বিছানা থেকে উঠে দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালো।কান পেতে শুনতে থাকে ওপাশের গান।দর্শন আবারও শুরু করে,
“ঢেউ জানা এক নদীর কাছে
গভীর কিছু শেখার আছে।
সেই নদীতে নৌকা ভাসাই,
ভাসাই করে ভাসাই না।
না ডুবাই,না ভাসাই
না ভাসাই,না ডুবাই।
বাহির বলে দূরে থাকুক
ভিতর বলে আসুক না।
ভিতর বলে দূরে থাকুক
বাহির বলে আসুক না।”
গাইতে গাইতে দর্শনের চোখ ভিজে আসে।বুজে থাকা চোখটা ভিজে যায়।সেই ছোট্টবেলার স্মৃতি তাকে ভাবায়।যখন সে ছিল পাঁচ বছর বয়সী।তার স্কুল জীবনের প্রথম দিকের ঘটনা।এরপর থেকেই মেয়েতে এক প্রকার এলার্জি।
দেয়ালের ওপাশে থেকে শোভা শুনল গানটুকু।মনে মনে ভাবছে,“লোকটার মাঝে কি দোটানা কাজ করছে?কেন এত অবিশ্বাস আমাকে?শুধু তো একজনই ঠকালো।আমাকে বিশ্বাস করলে আমি তো ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখতাম।আমি তো চাই সংসার করতে তার সাথে।তবে কেন এত দ্বিধাদ্বন্দ্ব!”
ফজরের নামাজ পড়ে শোভা ও দিজা চলে যায় ছাদে।ছাদে অনেক ফুলগাছ আছে।এক জায়গায় বড় চারকোনা একটা টব ভর্তি আছে লেমনগ্রাস।দর্শনের এই গ্রাস খুব পছন্দ।বিশেষ করে লেবুর ফ্লেবার পাওয়া যায় তাই।চায়ের সাথে খুব খায়।দিজা আর শোভা ওগুলোই খুঁটিয়ে দেখছিল।কিছু পাতা ছিঁড়ে নিয়ে নিচে যেতেই শোভা কিছু শব্দ পেলো।দিজার উদ্যেশ্যে বলে,“শব্দ কিসের?”
“চলো গিয়ে দেখি।”
দুজনে গেলো সিঁড়ির অন্যদিকে।ফাঁকা একটি ঘর আছে।যেখানে রয়েছে জিমের যন্ত্রপাতি।খালি গায়ে কালো সেন্ডো গেঞ্জি পরে জিম করছে দর্শন।বড় বড় চোখ করে শোভা।দিজা দেখামাত্রই বের হয়।শোভাও বেশিক্ষণ অপেক্ষা করেনা।চলে গেলো দিজার কাছে।দুজনে রান্নাঘরে ঢুকে চা বানায়।শোভা বলে,“তোমার ভাই অনেকটা আধুনিক জীবন কাটায়।”
“বিদেশে থেকেছে।এটা তো স্বাভাবিক আর পুরুষ মানুষ খুব কম আছে যারা আধুনিকভাবে চলে না।”
“হুমমম,তাই তো আমার মত মেয়ে তার মনে জায়গা করতে পারেনি।আমি ব্যর্থ হলাম।”
“আমার কিন্তু মনে হয়না।আমার মনে হয় তুমি স্বার্থক শুধু একটু সময় লাগছে এই যা।”
“যাই হোক তুমি খালামনিদের বাসায় যাবে কখন?”
“বিকালে।”
“তোমার ভাইকে বলেছো?”
“না,দুপুরে খেতে আসলে বলব।”
“ওহ।”
চা বানানো শেষ হতেই দর্শন হাজির হয়।দিজা চায়ের কাপ দিলো দর্শনের হাতে।দর্শন চুমুক দিয়ে বলে,“হুমমম খুব সুন্দর হয়েছে।মায়ের থেকে শিখেছিস?”
“না,ভাবী।”
“ওহ।”
“ভাবী বানিয়েছে চা আমি না।”
দর্শন চায়ে চুমুক দিয়ে শোভার দিকে চেয়ে বলে,“ওহ।”
শোভা রান্নাঘরে চলে গেলো।দর্শন বলে,“আজকে দুপুরে আসতে পারবো না।তোরা নিজেদের মত খেয়ে নিস।”
“সে কি!তুমি দুপুরে আসবে না?তাহলে তো এখনই বলা লাগবে।আসলে ভাইয়া আমাকে খালামণি ডেকেছে।দুইদিন ওখানে থাকার জন্য।আম্মু বলল যেতে।তাই ঘুরতে যাচ্ছি দুদিনের জন্য।”
“পড়ালেখা?”
“বই নিয়ে যাচ্ছি।”
“ওই মেয়েটা যাবে?”
“ভাবীকে নিয়ে যাব?”
“সজীব আছে নাকি বাসায়?”
“না মনে হও আর রাকিব ভাইকে তো তুমিই চট্টগ্রামে পাঠিয়েছ শুনলাম।বাড়ি ফাঁকা কোনো পুরুষ মানুষ নেই।”
“তাহলে ও গেলে নিয়ে যা।আমি ব্যাস্ত থাকবো আজকে।”
“আচ্ছা।”
দিজা উঠে গেলো রান্নাঘরে।দুজনে মিলে রান্না করতে ব্যাস্ত।দর্শন একটু পর অফিসে যাবে।দুই ননদ ভাবী মিলে রান্না করছে।সবকিছু গুছিয়ে খেয়ে বিদায় দিলো দর্শনকে।ঘরে এসে দিজা তিন সেট জামা নিলো শোভার দিকে ফিরে বলল,“তোমার জন্য কি কি নিবো?”
“আমিও যাবো নাকি?”
“হ্যাঁ,কেন যাবে না?”
“তোমার ভাই যাবে?”
“না,ভাইয়া ওদের বাসায় যায়না।ওদেরকে চেনেই না।রাকিব ভাইকে ছাড়া।”
“কেন?”
“আসলে ওটা তো আমার খালামণিদের বাসা।তাও আম্মুর আপন বোন না।চাচাতো বোনের বাড়ি ওটা।যেহেতু ওই খালামনির কোনো ভাই বোন নেই তাই সেই সূত্রে আমাদের সাথেই বেশি ভালো সম্পর্ক।ভাইয়া এদিকে যাওয়াটা বেমানান মনে করে।”
“তাহলে আমিও যাবো না।”
“কেন?”
“হিসাবে তো ওখানে আমারও যাওয়াটা মানায় না।”
দিজা কিছুক্ষণ ভাবলো।তারপর বলল,“আচ্ছা,ঠিক আছে।কিন্তু তুমি একা থাকতে পারবে তো?”
“আমার অভ্যাস আছে।”
“এটা ঢাকা শহর তাই জিজ্ঞাসা করছি।”
“বাড়ির মধ্যে একা থাকতে অসুবিধা নেই আমার।তাছাড়া মোবাইল তো আছেই।”
“আমি কল দিলেই ধরবে ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।”
দুপুরের পর বিদায় নিলো দিজা।একা সময় কাটাতে কাটাতে দেখলো মাত্র ত্রিশ মিনিট হলো সে গেছে।ভালো লাগছে না তেমন তাই কল দিলো মিতুর কাছে।মিতু ধরতেই সালাম দিয়ে কথা বলতে শুরু করে।কথার এক সময়ে এসে শোভা বলে,“দিজা আপু আজ ওর খালামনির বাসায় গেছে।আমি একা আছি।এদিকে বৃষ্টি পড়ছে।”
“আমাদের এদিকেও বৃষ্টি।আমি তো আজ শাড়ি পরেছি।কিন্তু তোমার ভাই তো কাজে আছে।আমার মেয়েটাই আমাকে দেখে আদর করছে শুধু।”
শোভা হেসে দিয়ে বলে,“তুমি একদম আমার ভাইয়ের জন্য পাগল।”
“স্বামীর জন্য তো পাগল হবোই।একটা মাত্র স্বামী আমার নসিবে আল্লাহ লিখে রেখেছে।তার জন্য পাগল হব না?”
শোভা হেসে দিলো।মিতু আচমকা কিছু বুদ্ধি বের করে বলে,“আজকে তুমি শাড়ি পর।”
“কেন?”
“এই বৃষ্টিতে মনে আছে আমরা ননদ ভাবী কত মজা করতাম?শাড়ি পরে ভিজতাম উঠানে নেমে।বাসায় তো তুমি একা।তাহলে শাড়ি পরে ছাদে গিয়ে ভিজতে থাকো।আবার তো বললে আশেপাশে বাড়ি নেই।তারমানে কোনো পরপুরুষ দেখার সুযোগ নেই।তুমি তো শান্তিতে ভিজতে পারবে।”
“কিন্তু উনি যদি রাগ করে?”
“উনি বুঝবে কিভাবে?তুমি তো বললে উনি আসবে রাতে।তাহলে তার আগেই পাল্টে নিবে।”
“হ্যাঁ তাও ঠিক।আচ্ছা তাহলে শাড়ি পরে নেই।”
“হুম কয়েকটা ছবি তুলে আমাকে দিও।”
“ঠিক আছে।”
শোভা গেলো শাড়ি পরতে।এদিকে মিতু কল দিলো দিজার কাছে।দিজা ধরে সালাম দিয়ে ভালো মন্দ জিজ্ঞাসা করে নেয়।মিতুর সাথে আলাপ শেষ করতেই মিতু বলে,“আমি শোভাকে শাড়ি পরতে বলেছি।তুমি ভাইজানকে বাসায় যেতে বলো।”
“কিন্তু ভাইয়া কি বাসায় যাবে?”
“কেন যাবে না?”
“কারণ ভাইয়ার মিটিং আছে আর ভাইয়া জানে ভাবী আমার সাথে যাবে।”
“তাহলে জানাও শোভা তোমার সাথে যায়নি।দেখো কি করে।আজকে ভাইজানের একটা পরীক্ষা হয়ে যাক।”
“কেমন পরীক্ষা?”
“ভালোবাসার পরীক্ষা।যদি শোভার কথা শুনে এখনই বাসায় যায় তাহলে মনে করতে হবে এটা ভালোবাসার সূচনা,আর যদি সন্ধ্যার পর যায় তাহলে মনে করতে হবে এটা শুধুই দায়িত্ব।যেটা বুঝিয়ে দেয় বিচ্ছেদের অপেক্ষা।”
“তুমি বুঝে বলছো তো?’’
“একদম,সংসার জীবন দিয়ে অভিজ্ঞতা নিয়ে বলছি।”
“আচ্ছা তাহলে আমি বলছি ভাইয়াকে।”
দিজা এবার কল দিলো দর্শনকে।দর্শন ধরছে না।আগেই জানা ছিল সে মিটিংয়ে।দিজা কি করবে বুঝতে পারল না।শোভাকে হোয়াটসঅ্যাপ দিয়ে ম্যাসেজ দিলো,“সেজেছো নাকি?”
“হ্যাঁ,কিভাবে জানলে?”
“মিতু ভাবী জানালো।আমকে ছবি দিবেনা?”
“দিবো?”
“দেও,দেখি আমার ভাবীকে শাড়িতে কেমন লাগে।”
বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২৩
শোভা কয়েকটা ছবি তুলে দিলো দিজাকে।দিজা বুদ্ধি খাটিয়ে ওর মেসেঞ্জারের সকল বন্ধুকে হাইড করে শোভার ছবি স্টরি দিলো।যেটা শুধুমাত্র দর্শন একা দেখতে পাবে।স্টরি দিয়ে একটা কল দিবো দর্শনের আইডিতে।যেনো দিজার ম্যাসেঞ্জার আইডি আগে দেখা যায় এবং স্টোরি দেখে।সবকিছু ঠিক করে জানালার দিকে চেয়ে বৃষ্টি দেখে আর মনে মনে আনন্দের সাথে বলে,“আজকেই হয়তো ফুফু ডাক শোনার আহ্বান আসবে।”