বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২৬
ইশরাত জাহান
ঘরে ফিরে শোভা শাড়ি খুলে হালকা বাদামি রঙের সালোয়ার কামিজ পরে নিল।চুল খোলা রেখেই রান্নাঘরের দিকে এগিয়ে গেল।রাতের জন্য ডাল-সবজি ভাজি করার কথা ভেবেছে সে।সেগুলোর প্রস্তুতি নিতে থাকে।এই ফাঁকে দর্শন গোসল সেরে একপ্রকার চুপিচুপি রান্নাঘরে ঢুকল।শোভা অবাক হলেও কিছু বলল না।শুধু একবার তাকিয়ে দেখে নিল তারপর নিজের কাজে মন দিল।
“পেঁয়াজটা আমি কেটে দিই?”
দর্শনের স্বরটা শান্ত।শোভা একটু ইতস্তত করে বলল,“থাক,হাত কেটে ফেলবেন আবার।”
“আমি পারি।”
বলে দর্শন ছুরি তুলে নিল।শোভা কিছু না বলে পাশে একটু সরে দাঁড়াল।দুজনে পাশাপাশি রান্নায় ব্যস্ত।হঠাৎ একটা পাত্র নামাতে গিয়ে শোভা হাত ফসকে পড়ে যেতে নেয়।দর্শন চট করে তাকে সামলে নিল।সেই মুহূর্তে দর্শনের হাত গিয়ে ছুঁয়ে গেল শোভার গাল।শোভাকে উঠিয়ে দর্শন হঠাৎ থেমে গিয়ে কপালে হাত দিয়ে বলল,“তোমার তো শরীর গরম।জ্বর হচ্ছে না তো?”
শোভা কিছু বলতে গিয়ে থেমে গেল।চোখ নামিয়ে বলল,“ঠিক আছি।”
দর্শন কিছু না বলেই এক গ্লাস পানি এনে ধরিয়ে দিল সাথে নাপা।তারপর তার স্বাভাবিক গাম্ভীর্য রেখেই বলল,“তুমি বসো।বাকিটা আমি করে দিচ্ছি।”
শোভা মৃদু আপত্তি করতে গিয়েও কিছু বলল না।খাবার তৈরি হলে দর্শন নিজে হাতে তার প্লেটে খাবার বেড়ে দিল।তারপর বলল,“খাও, ঠান্ডা হয়ে যাবে।খাবার আমি মশলা কম দিয়ে রান্না করি কিন্তু তোমার জ্বর তাই ঝাল চড়া দিয়েছি।”
শোভা চোখ তুলে একবার দর্শনেরর দিকে তাকাল।তাতে কোনো প্রেমের ঘোষণা নেই কিন্তু ছিল এক রকম নিশ্চিন্ত ভালোবাসার প্রকাশ।দর্শনের মুখে কোনো শব্দ নেই কিন্তু তার ব্যবহারে যেন এক নিঃশব্দ প্রতিশ্রুতি।শোভা চাইছে খুশি হতে কিন্তু ভাবছে আবার কোন ঝড়ে তার সুখে উড়ে যায়!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
রাত ঘনও হতে চলেছে কিন্তু শোভার চোখে ঘুম নেই।বই পড়তে বসেও ভালো লাগছে না।এদিকে বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে বারবার।দর্শন তাকে বলেছিলো একবার,“ভয় করলে আমার ঘরে আসতে পারো।”
শোভা সাহস দেখিয়ে বলেছিলো,“আমি বাড়িতে একাই থাকতাম।”
“এটা তো নতুন পরিবেশ।”
“তো?”
দর্শন মুচকি হেসে বলে,“ওই ঘরের কাছেই বড় একটা বটগাছ আছে।”
শোভার গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।বটগাছ মানে যে ভূতের বাসা এটা শোভা মনেপ্রাণে বিশ্বাস করে।মাথায় ছিল না দিজার ঘরের পাশে এই গাছ আছে।যা একটু ভাবনার চিন্তায় পড়েছিল দর্শনের মুখের হাসি দেখে মিথ্যা সাহস দেখিয়ে বলে,“সমস্যা নেই আমি পারবো।”
দর্শন ভেবেছিল এই সুযোগ শোভাকে নিজের কাছে আনার।কিন্তু সে সোজা পথ অবলম্বন না করে বেকা রাস্তা দেখলে তার জীবনটাই তো বেকা যাবে,এটা ভুলে গেছে।মুখটা গম্ভীর করে বলে,“তোমার ইচ্ছা।”
এখন শোভা ভাবছে,“যা একটু জ্বর কমেছিল এখন আবার বাড়বে মনে হচ্ছে।আমার তো ভয় পেলে আরো জ্বর বাড়ে।আর রাগ করে লাভ নেই।দিজা আপু আসলে নাহয় রাগ দেখাবো।এখন যাই ওনার পাশে জায়গা করে ঘুমাই।”
কোনমতে উঠে দর্শনের ঘরের দিকে আসলো।এসে দরজায় কড়া নাড়তে চাইলে আবার হাত থেমে যায়।পিছন ফিরে চলে যেতে নিলে দরজা খুলে দর্শন বলে,“চলে যাচ্ছো কেন?”
শোভা থমকে গেলো।এমন ভাব যেন অপেক্ষায় ছিল দর্শন।পিছন ফিরে বলে,“আপনি জানলেন কিভাবে আমি এখানে?”
“কারণ আমি জানতাম তুমি আসবে এখানে।ভিতরে আসো।”
শোভা অবাক হলেও ভিতরে ঢোকে।দর্শনের ঘরটা একটু বেশিই সুন্দর।বড় ড্রেসিং টেবিল পাশে বড় আলমারি তারপাশে বুকশেলফ।সেখানে অনেক বই।যেগুলোতে চোখ আটকে যায় শোভার।তারপর বিছানায় চোখ রেখে বলে,“আমি কোথায় ঘুমাবো?”
“কেন?বিছানায়।”
“জায়গা কম তো।”
দর্শন বিছানার দিকে তাকাতেই ভাবনায় পড়ে কিছুক্ষণ এর জন্য।ভাবনা শেষ করে বলে,“আমরা তো তোমার বাসায় ছিলাম এর থেকেও ছোট্ট বিছানায়।”
“গুটিসুটি দেওয়ার কারণে পরদিন হাঁটু ব্যাথা করে।সেই হাঁটুতে আবার আপনিও লাথি মারেন।”
“ওমন কুংফু হয়ে দাঁড়িয়েছিলে কেন?”
“ভেবেছিলাম আপনি আবার থাপ্পড় দিবেন তাই অগ্রিম প্রস্তুতি নেই।কিন্তু গাল বাঁচাতে গিয়ে পা হারাই।”
দর্শন হেসে দেয় শোভার কান্ডে।শোভার মাথায় ঝিমঝিম দিচ্ছে।কপাল কেঁপে কেঁপে ব্যাথা উঠছে।এটা যখন হয় জ্বর আসেই আসে।এই জ্বর যদি আসে তাহলে তার অবস্থা শেষ।সারাদিন ঘুমের মধ্যেই তার দিন পড়ে থাকে।
দর্শন শোভাকে চিন্তা করতে দেখে ভাবলো মেয়েটা লজ্জায় পড়ে আছে।তাই বিছানার দিকে তাকিয়ে বলে,“বিছানাটা আরে ছয় ফুট লম্বায় সাত ফুটের।”
“তো?”
“আমি আড়াআড়ি দের ফুট আর তুমি আড়াআড়ি দের ফুট নেওয়ার পরেও মাঝখানে ফাঁকা থাকে তিন ফুট।ব্যালান্স করা যায়।আজকের রাতটা একটু কষ্ট করে ব্যালেন্স করো কাল নতুন খাট আনবো।”
শোভা জ্বর নিয়ে কষ্ট করে চোখ মেলে আছে আর মনে মনে দর্শনের গুষ্টি উদ্ধার করছে।কোনো কথা না বাড়িয়ে উঠে গেলো বিছানায়।চার ফুট জায়গা জুড়ে ইচ্ছা করে শুয়ে পড়ল।মানে দুই হাত মেলে দিয়ে।শুয়ে শুয়ে বলে,“এটা আপনার দাদাজানের আমল না যে বারো ফুট চৌদ্দ ফুটের খাট পাবেন।যেটা পেয়েছেন এটাই বেশি।”
“মানি ইজ পাওয়ার।তুমি দেখবে এটা?আমি কালকেই আনব।”
মেজাজ গরম করে শোভা জ্বর নিয়ে ধমক দিলো,“ওই মিয়া ঘুমান।”
শোভার খুব ঘুম পাচ্ছে।যেভাবে ধমক দিলো এটা শুনতে পায়নি দর্শন।লাইট বন্ধ করে আজ সে গুটিসুটি দিয়ে শুয়ে থাকলো।
ভোরের আলো এখনও পুরোপুরি ছড়িয়ে পড়েনি।মসজিদের আযান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগে।দর্শনের ঘুম ভেঙে গেছে।সে ওজু করে নামাজ পড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল হঠাৎ শোভার দিকে তাকিয়ে দেখে ও এখনও উঠেনি।সাধারণত ফজরের নামাজে শোভা নিজেই উঠে পড়ে।আজ কিছু একটা অস্বাভাবিক।
“শোভা?”
দর্শন নিচু গলায় ডাক দেয়।কোনও সাড়া নেই।সে কাছে গিয়ে কপালে হাত রাখে।একটু চমকে উঠে।আগুনের মতো গরম!
“জ্বর!”
দর্শন আলতো করে কাঁধে হাত দিয়ে নাড়া দেয়।ডাক দেয় স্নেহের সাথে প্রথমবার,“এই শোভা,উঠো তো।”
শোভা চোখ খুলে ক্লান্তভাবে বলে,“শরীর ভালো নেই।”
“জ্বর হয়েছে তোমার।নামাজ পড়ে একটু বিশ্রাম নাও।”
দুজনেই নামাজ পড়ে নিলো।শোভা কোনমতে ঝিমিয়ে পড়ে।নামাজ শেষে শোভা আর না পেরে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে।দর্শন ওর পাশে বসে।দুশ্চিন্তার সাথে বলে,“কোথায় কষ্ট হচ্ছে?”
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে শোভা জানায়,“মাথায় খুব ব্যথা।”
“বৃষ্টির পানি মাথায় লাগাতে এমন হয়েছে কি?”
“হুমমম।”
দর্শন নিজের হাতের তালু দিয়ে আস্তে আস্তে টিপে দেয় শোভার কপাল।দর্শনের চোখেমুখে আজ শোভার জন্য এক অনুভূতি।যেন শীতল পরশ হয়ে শোভাকে জড়িয়ে ধরে।
শোভা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন দেখে দর্শন উঠে রান্নাঘরে যায়।ফ্রিজে কী আছে দেখে দ্রুত হালকা খিচুড়ি রান্না করে।এক পাশে ডিম সিদ্ধ দেয় অন্য পাশে আদা,লবঙ্গ ও গোলমরিচ দিয়ে পানি ফুটিয়ে নিলো।এটা ঠান্ডা সর্দির সময় উপকারে আসে।মাথা ব্যাথা কমাতে খুবই উপকারী।খাবারটা গরম গরম করে এনে শোভার পাশে বসে।শোভার কপালে হাত দিয়ে ডাকে,“শোভা ওঠো।”
চোখ মেলতে চায়না শোভা।তাও দর্শনের বারংবার ডাকাতে ওঠে।বসতে কষ্ট হয় দর্শন হাত ধরে কাধ টেনে নিজের কাছে আনে।তারপর বলে,“চলো,একটু খেয়ে নাও।না খেলে জ্বর কমবে না।”
শোভা বসে পড়ে।দর্শন নিজেই এক চামচ করে খাইয়ে দেয়।শোভা কিছু বলার আগেই সে বলে,“আজ অফিসে যাচ্ছি না।ম্যানেজারকে বলে দিয়েছি।”
শোভার চোখে পানি চিকচিক করে ওঠে।অসুস্থ থাকলেও খেয়াল করছে রাগী এই লোক যে কিনা মেয়েদের সহ্য করতে পারেনা এক কথায় মেয়েতে এলার্জি সে আজ কতটা যত্ন নিয়ে তার বউকে সেবা করছে।এটুকু পেতেও যেনো ভাগ্য লাগে।দর্শন এই চাহনি দেখে হেসে বলে,“এইবার বিশ্রাম নাও।আমি আছি পাশে।তোমার কষ্টের সময় পাশ থেকে সরে যাচ্ছি না।”
শোভার মুখে একটু প্রশান্তির ছায়া নামে।দর্শনের কাঁধে মাথা রেখে ও আবার ঘুমিয়ে পড়ে।দর্শন চুপচাপ বসে থাকে পাশে যেন পুরো পৃথিবীটাকে রক্ষা করার দায়িত্ব তার কাঁধে।শোভার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।মেয়েটার মাথা দিয়েও তাপ বেরোচ্ছে।বোঝাই যাচ্ছে জ্বর অতি সহজে সারবে না।কল দিয়ে ডাকলো ডাক্তারকে।তিনি এসে শোভাকে চেক করে কিছু ঔষধ লিখে দেন।দর্শন পারছে না শোভাকে রেখে বাইরে যেতে।না পেরে কল দিলো তুহিনকে।তুহিন আসতেই নিচে নামে দর্শন।প্রেসক্রিপশন দিয়ে বলে,“এগুলো এনে দে দোস্ত।ওকে ছেড়ে আমি যেতে পারছি না।”
তুহিন দেখলো দর্শনের চোখমুখ।আলতো হেসে চলে গেলো প্রেসক্রিপশন নিয়ে।কিছুক্ষণ পর ঔষধ এনে কল দেয়।দর্শন নিচে গিয়ে দরজা খুলে ঔষধ নিয়ে বলে,“ভিতরে আয়।”
তুহিন ভিতরে ঢুকে খাবার টেবিলে বসে বলে,“একটু পরেই ক্লাস আছে।যেতে হবে রে।”
বলেই পানি পান করে বলে,“আজ আসি অন্যদিন কথা হবে।”
দর্শন থামালো না।সেও এখন শোভার কাছে থাকতে চায়।তুহিন বের হলে দর্শন দরজা দিতে নিবে এমন সময় তুহিন পিছন ঘুরে বলে,“একটা বিষয় খেয়াল করলাম।”
দর্শনের কপাল কুঁচকে এলো।তুহিন মৃদু হেসে বলে,“তুই ভাবীকে ভালোবেসেছিস।মেয়েতে এলার্জি থাকা দর্শন ফরাজি তার বউয়ের প্রেমে ফেঁসে গেছে।”
দর্শন উত্তর দিলো না।তুহিন চলে গেলো নিজের মত করে।টেবিলের উপর কিছু ফলের প্যাকেট।যেগুলো তুহিন রেখে গেছে শোভার জন্য।আঙ্গুর ধুয়ে নিলো ও শসা কেটে শসার উপর একটু লবণ দিয়ে নিয়ে গেলো।ট্রে টেবিলের উপর রেখে শোভার পাশে বসে।অসুস্থ মুখটায় চোখ বুলায় দর্শন।শোভার ঠোঁট দুটো শুকিয়ে আছে।চোখের কোণা দিয়ে পানি জমতে জমতে ময়লা জমেছে।এই প্রথম দর্শন ঘৃণা না করে নিজে তার রুমাল ভিজিয়ে এনে চোখমুখ পরিষ্কার করে দেয়।শোভার ঠোঁটে আঙুল ছুঁয়ে দিলো।এটা ইচ্ছাকৃত না কিন্তু ছোঁয়ার পর আর আঙুল সরাতেও পারল না।
শোভা চোখ বুজেই আছে।আঙ্গুর একটা নিয়ে শোভার ঠোঁটের উপর একটু চাপ দিলো যেনো মুখে পুরে নেয়।হলোও তাই।একবার মুখে পুড়তে পারলেই নিজের মত চিবিয়ে খাচ্ছে শোভা।এভাবে যেগুলো মুখে রুচি আনে ভরা পেটে খাইয়ে দিলো।খাওয়ানো শেষ করে শোভার পাশে বসে শোভার মুখের দিকে চেয়ে আছে।মাথায় হাত দিয়ে বুলিয়ে দিচ্ছে।শোভার বন্ধ চোখজোড়া দেখে বলে,“এই মেয়েটা আজ আমার অভ্যাস হয়ে গেছে।ও পাশে না থাকলে কিছু ঠিকঠাক চলে না।অথচ কেউ জানে না,এই মেয়েটাই আমার সবচেয়ে দুর্বল জায়গা।ও কষ্টে থাকলে আমার ভিতরটা ভেঙে যায়।আর সেটাও কাউকে বুঝতে দিই না এমনকি কোনোদিন দিবোও না।তোমাকেও বুঝতে দিবো না যে তুমি আমার জন্য কতটা দুর্বলতা হয়ে দাঁড়িয়েছ।”
বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ২৫
আসল কথা হলো দর্শন ভয় পায় শোভাকে হারানোর।নিজের মা যদি তার নাড়ি কাটা ধনকে ছাড়তে পারে শোভা তো বউ।আজকাল কাকে বিশ্বাস করা যায়?মা যেখানে বিশ্বাস ঘাতক সেখানে বউ তো পরের বাড়ির মেয়ে।দর্শন বুঝতে দিবে না কাউকে শোভার প্রতি তার অনুভূতি কি।কিন্তু আদৌ কি এই অনুভূতি গোপন থাকবে?কোনকিছুই তো গোপন থাকে না,তাহলে দর্শনের অনুভূতি কিভাবে গোপন থাকে?