বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪
ইশরাত জাহান

কেবিনটা নীরব হয়ে আছে।বেডে শুয়ে আছেন দাদাজান।নাকে লাগানো অক্সিজেন মাস্ক চোখ আধো খোলা।পাশে মনিটরে হৃদস্পন্দনের তাল টালটাল দুলছে।দরজাটা ধীরে খুলে যায়।শোভা আর দর্শন একসঙ্গে ঢোকে।শোভা এগিয়ে গিয়ে নিচু গলায় বলে,“আসসালামু আলাইকুম,দাদাজান।কেমন আছেন?”
দাদাজান মাথা নেড়ে জানায় তিনি শুনতে পাচ্ছেন।ধীরে মাস্ক সরিয়ে হালকা কেশে বলে ওঠেন,
“আলহামদুলিল্লাহ,এখন একটু ভালো লাগছে তোমাদের দেখে।”
কিছুক্ষণ নীরবতা পালন হলো।দর্শন চেয়ারে বসে।তার মুখ গম্ভীর।শোভা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে।দাদাজান একটু হাসি টেনে বলেন,“তোমাদের দুজনকে একত্রে দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেলো।এখন দুজনের সংসার জীবন এগিয়ে নিয়ে যাও।আমি একটু শান্তি পাই দুজনের সুখী সংসার দেখে।”
দর্শন হঠাৎই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।তার গলায় দমচাপা ক্ষোভ,“দাদাজান প্লিজ!আবার সেই একই কথা?তোমার বিশ্রাম প্রয়োজন।”

দাদাজান শান্ত গলায় বলেন,“বিশ্রাম নিলেই আমি সুস্থ হব না।দুজনে দুদিকে কুড়ে কুড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছো এটা আমি সহ্য করতে পারছি না।শোভা মেয়েটা তোমার জন্য অপেক্ষা করেছে চারটে বছর।হাতে গুনলেই বছর শেষ হয় এমন কিন্তু ব্যাপার না।চারটে বছর জীবনের অনেকটা সময়।এতগুলো বছর কোনো মেয়েই অপেক্ষা করতে পারেনা যেটা ধৈর্য ধরে এই মেয়েটি ছিল।ওকে আর কষ্ট দিওনা।”
দর্শনের চোখে আগুন,“চারটে বছর আগে যেদিন আমি চলে যাই সেদিন কিন্তু চাইলেই ডিভোর্স দেওয়া সম্ভব হতো না দাদাজান।ডিভোর্স প্রোসেসিং হতে সময় লাগে।তাছাড়া আমাদের বিয়ে কাজী দিয়ে হয়।তালাকের ব্যাপারটা উঠালে এই মেয়েটার পরিবারও ফেঁসে যেতো।একটা পিচ্চি মেয়ের বিয়ের জন্য।আমি এই চারটে বছরে দেশেও আসিনি যে তাকে সম্পর্ক থেকে মুক্ত করব।অপেক্ষা শুধু সে একা না আমিও করেছি।তাহলে আমার একার দোষ আর ঐ মেয়েটার কষ্ট দেখছো কেন?”

আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন

“আমি তোমার দোষ দেখছি না।আমি দুজনের কথা ভাবছি।তুমি তোমার ক্যারিয়ার গড়েছো সব ভুলে ছিলে।মেয়েটা কিন্তু ভোলেনি।”
“ভুলে থাকাটা নিজের মাঝে আবদ্ধ।সে যদি মানসিকভাবে আমাকে মনে রেখে নিজের কষ্ট বাড়িয়ে তোলে এটা আমার দায় না।”
“এভাবে কথা বলো না দাদুভাই।শোভা তোমার পাশে আছে।এখনও তুমি ওকে কষ্ট দিয়ে যাচ্ছো।”
“আমি মুখ খুললেই তো দেখছি তোমাদের আঘাত করা।তাহলে এক কাজ করি আমিই চলে যাই আবারও।এবার মুক্তি দিবো এই মেয়েকে।”

শোভার বুক কেঁপে উঠলো।তাকে গাড়িতে অপমান আবার এখানেও!সহ্য ক্ষমতা তার আছে তাই বলে এভাবে সম্মানহানি করার জন্য না।দাদাজান কিছু বলতে নিবেন তার আগে শোভা মাথা তুলে তাকায়। গলাটা কেঁপে উঠলেও এবার সে থামে না।প্রতিবাদ সুরে জানায়,“দাদাজান আপনার নাতিকে জানিয়ে দিন আমি তাকে মুক্ত করতে রাজি।এভাবে কথায় কথায় আমাকে ইঙ্গিত যেনো না করে।তিনি যদি মনে করেন এই সম্পর্ক রাখবেন না আমার দায় পড়েনি কারো সাথে জোর করে সম্পর্ক ধরে রাখতে।ওনার টাকা আছে ওনার যোগ্যতা আছে বলে সম্মান ওনার একা আছে এমন ভাবলে উনি ভুল।আত্মসম্মানবোধ আমারও আছে।হ্যাংলামো আমিও করে বেড়াই না।”
দর্শন চোখ বড়বড় করে চাইলো পাশে।মুখ দেখতে না পেলেও কথার ধাঁচে রাগে যে শোভার গা জ্বলে উঠছে এটা বোঝা যাচ্ছে।ছোট্ট করে বলে,“ইডিয়ট।”

দাদাজান একটু হাসলেন কিন্তু দুজনকে এক করতে এবার একটু কাশেন।অক্সিজেন মাস্কটা ধরে মুখ থেকে আবারও সরান।অতঃপর জানান,“তোমরা যদি আমাকে ভালোবাসো,যদি আমার শেষ ইচ্ছাটা মেনে নিতে পারো তাহলে একটা অনুরোধ করছি।আমার শরীরটা এখন আর আগের মতো না।তোমাদের একসাথে সংসার করতে হবে।আমি তোমাদের সংসার দেখতে চাই।এখনই বাড়ি যেতে হবে তোমাদের দুজনকে একসাথে।আমি আর এখানে থাকতে পারছি না।কষ্ট হচ্ছে আমার।সবথেকে বড় কষ্ট দুজনকে আলাদা হতে দেখলে।আমার জন্য হলেও একসাথে থাকতে হবে তোমাদের।অন্তত একমাস সংসার করে দেখো।ভালো না লাগলে তখন আলাদা হবে।”

দর্শন কিছু বলবে কিন্তু না বলে থেমে যায়।শোভাও স্তব্ধ।পরে ব্যাপারটা সামলাবে।দাদাজান মুচকি হাসেন,“রাগ করে থাকো অভিমান করে থাকো সব ঠিক আছে কিন্তু আমি চাই তোমরা একসাথে থাকো।অন্তত কিছুদিন আমার জন্য।”
শোভা দাদাজানের চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে।অসুস্থতার ছাপ সেখানে কিন্তু ভালোবাসার শক্তি তারচেয়েও বড়।দর্শন চোখ ফিরিয়ে জানালার দিকে তাকায় মুখে দ্বিধা।তারপর ধীরে মাথা নেড়ে বলে,“ঠিক আছে।তোমার কথাতে রাজি হলাম কিন্তু একমাস পর আমরা যে সিদ্ধান্ত দিবো সেটাই যেনো মেনে নেওয়া হয়।”
দাদাজান হাসেন।ভাঙা শরীরের ভেতরেও যেন এক প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে।

বহু বছর পর আজ শশুর বাড়িতে পা রাখে শোভা।গাড়ি থেকে নেমেই শোভার পাশ কেটে নিজ ঘরের দিকে যেতে যেতে দর্শন বলে,“ভুলেও আমার ঘরে আসবে না তুমি।আমার ঘরে কাউকে এলাউ করিনা আমি।”
শোভা অপ্রস্তুত হলো।এই বাড়িতে কাউকেই পেলো না।হাতের থাকা ফোনটির দিকে চেয়ে ভাবলো দিজাকে কল দিবে।করলোও তাই।দিজা ধরতেই শোভা বলে,“আসসালামু আলাইকুম দিজা।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম,বলো?”
“আমি তোমাদের বাড়িতে আছি।”
দিজার চোখ কপালে।শোয়া থেকে উঠে বলে,“মজা করছো আমার সাথে?”
“বাইরে এসেই দেখো একবার।”

দৌড়ে বাইরে আসলো দিজা।শোভাকে দেখে হেসে দিয়ে বলে,“তুমি আসবে জানাওনি কেন?”
“হঠাৎ তোমার ভাই নিয়ে এলো।আসার কথা ছিল না।দাদাজান অনুরোধ করলেন তাই।”
দিজা এসে জড়িয়ে ধরে শোভাকে,“আমার খুব খুব খুব বেশি ভালো লাগছে।অনেক মিস করেছি তোমাকে।”
“আমিও কিন্তু আমাকে তোমার ঘরে আশ্রয় দিতে হবে।আশা করছি বুঝতে পারছো কেন বলছি?”
দিজা একটু ভেবে বলে,“হ্যাঁ,ভাইয়ার ঘরে আমরাও যাওয়ার সুযোগ পাইনা ভাবী।ভাইয়া আমাদেরকে এলাউ করেনা।একা একঘরে থাকতে ভালবাসে তাই।”

“আম্মা কোথায়?”
“আছে হয়তো নিজের ঘরে।তুমি যে আসবে এটা জানি না তো কেউ।”
বলেই গলা উঁচিয়ে ডাক দেয়,“আম্মু দেখে যাও তোমার বউমা এসেছে।আম্মু… আম্মু… আম্মু।”
কয়েকবার ডাক দিলে পারুল বেগম বাইরে আসেন।শোভাকে দেখে খুশিতে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরে বলেন,“কে নিয়ে আসলো তোকে?”
“তোমাদের ছেলে।”
“আগে তো জানতাম না।উন্নতি ঘটলো কিভাবে?”
“দাদাজান চেয়েছেন তাই।অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে দাদাজান এনেছেন আমাকে।”
“যাক তাও ভালো।ঘরে গিয়ে বোরকা খোল।আমি নাস্তা বানাই।”
“আমি খাবো না আম্মা।”

“আচ্ছা যা তাহলে একটু গল্প কর ননদ ভাবী মিলে।আমি দেখি আব্বার কি খবর।”
“দাদাজানকে কাল সকালে ছাড়বে।এখনও হাতে কেনোলা আছে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।দিজা ওকে একটু তোর ভাইয়ার ঘরে দিয়ে আয় তো।ছেলেটা আসার পর আজ প্রথম এক ঘরে যাবে।একটু সাহায্য কর।”
“কিন্তু আম্মা…
শোভা থেমে গেলেও দিজা বলে ওঠে,“তোমার রাগী ছেলে মানবে না।”
পারুল বেগম চোখ পাকিয়ে বলেন,“কেন মানবে না শুনি?”
“আমাদের কখনও ভাইয়া নিজের ঘরে যেতে দেয়?”
“তোরা আর ও কি এক?বউকে সেই সুযোগ দেওয়া হয় যেটা অন্য কাউকে না।যা এবার দিয়ে আয়।কাজ আছে অনেক।”

“কেন বাঘের খাঁচায় মেয়েটাকে ছাড়তে চাও?মেয়েটা আগে একটু বিশ্রাম নিয়ে মানসিকভাবে প্রস্তুত হোক।”
“এভাবে করতে করতে মেয়েটা কিছুই বুঝবে না।আমতা আমতা করে সংসার চলেনা।ও তো মাথামোটা তাই বলে জীবন থেমে থাকবে না।একটু একটু করে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।”
“ভাইয়া নিজেই নাকি নিষেধ করেছে যেতে।”
শোভা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো দিজার সাথে।পারুল বেগম কিছু ভেবে বলেন,“গিয়ে বলবি দাদাজানের আদেশ।আমি না মানলে ওদিক থেকে শাস্তি পাবো।”

“এত বড় মিথ্যা কথা বলব?”
“এটা আহামরি মিথ্যা না।কিছু মিথ্যা দিয়ে যদি সংসার বাঁচানো যায় তবে ওটা বলাতে কিছুই হবেনা।”
“ভাইয়া যদি ঠাস করে মেরে দেয়?সেদিন এসেই কিন্তু তোমার ছোট ছেলের গায়ে হাত তুলেছে।একটু রাগ করলেই তো মানুষ না মেনে মারধর চালিয়ে দেয়।”
শোভা আতঙ্কের সাথে তাকালো দিজা মুখটা শুকনো করে বলে,“ভাইয়া এমনই।আমাদের একটু ভুল হলেই মার দেয়।ক্লাস এইটে সমাজে আমি একশ এর মধ্যে সত্তর পাই।তাই ভাইয়া আমার হাতে বেত দিয়ে মারছিল।কারণ আমার পড়াশোনায় মনোযোগ কম ছিল।কোনো পরীক্ষায় মার্কস কম পাওয়া যাবেনা। দিদার ভাই নতুন নতুন একটা প্রেম করে বলে সেও খেয়েছে সেদিন।”

“এবার তোর কানের গোড়ায় আমি দিবো একটা।বড় ভাইয়ের নামে নালিশ করা?অন্যায় করলে তো মার খাবি।পরীক্ষার আগেরদিন যে সারারাত জেগে সিনেমা দেখেছিলি এটা কি অন্যায় না?বাবার টাকা খেয়ে বসে বসে কাটাবে আর বড় ভাই শাসন করলেই দোষ!বেয়াদপ একেকটা।যা ভাবীকে ভালোভাবে দিয়ে আয়।”
শোভার এবার বুকের মধ্যে দুরুদুরু করে কাপছে।না পেরে মুখ খুলে,“আমি ওনার ঘরে যাবো না।”
পারুল বেগম হতাশ চাহনি দিয়ে বলেন,“স্বামীকে নিজের করতে হলে একটু সহ্য করতে হয়।আর তাছাড়া এভাবে ভাঙ্গা সংসার কতদিন টিকবে?তুই কি চাস সংসার থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেকে সংসার ভাঙার একটা তকমা লাগিয়ে বাঁচতে?ভাই-ভাবী এদের কথা ভেবে দেখবি না?সমাজে লোকের থেকে কটু কথা শোনার থেকে ভালো কৌশলে স্বামীকে নিজের ভালোবাসায় বেঁধে রাখা।আধুনিক যুগের মান সম্মান নিয়ে যে বেঁচে থাকার যে আকাঙ্ক্ষা দেখানো হয় সমাজে ওটা কিন্তু মুখে মুখেই চলে বাস্তব ভিন্ন কিছু দেখিয়ে দেয়।বাস্তব এখনও মেয়েদের বিপক্ষে।একটা মেয়েই আরেকটা মেয়ের বিপক্ষে চলবে কিন্তু ছেলেদের বিপক্ষে কেউ চলেনা।তুই নিজের পায়ে দাঁড়াবার আগেই এই সমাজ তোকে কুড়ে কুড়ে খাবে।খেকশেয়ালদের পাল্লায় পড়ার থেকে একটা বাঘের সম্মুখীন হয়ে নে।অন্তত বাঘ একা তোকে থাবা দিবে একাধিক খেকশেয়ালদের মত খুবলে খাবেনা।”

পারুল বেগমের শক্তপোক্ত কথা দিজার ভালো লাগলো না।আধুনিক মেয়ে বলেই এমন হলো।শোভা নিজের পরিবারের কথা ভেবে বলে,“আচ্ছা আমি যাব ওনার ঘরে।”
“আমাদের ঘর।”
শোভা নীরব চাহনি দিলে পারুল বেগম বলেন,“বলতে শেখ ওটা আমাদের ঘর।ওনার ঘর আবার কেমন কথা?বিয়ের পর এই শশুর বাড়িটাই মেয়েদের আপন।লাল কাপড়ে এসেছিস আর সাদা কাপড়ে যাবি।এখানে যে স্থান তোর জন্য বরাদ্দ করা হবে ওটাই তোর চিরদিনের জন্য শুধু তোর।অন্য কারো দখলদারি সেখানে চলবে না।একটু শক্ত হবি কিন্তু ঘর ছাড়বি না।”

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৩

শোভা মাথা নাড়ালো।পিছন ফিরে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে নেয়।দিজা একটু কাপছে আর বলে,“আল্লাহই জানে বিনা মেঘের বজ্রপাত আজ কেমন রূপ ধারণ করে!”
ভয় পাচ্ছে শোভা।এসব শুনলে তো আত্মা কাপপেই।মনে মনে দোয়া দুরুদ পড়ে চলে যাচ্ছে নিজের জন্য ঠিক করা ঘরটায়।যেটাতে তার স্বামী থাকতো এখন দুজনে থাকবে।ভাবতেও যেনো গা শিউরে ওঠে।

বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here