বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪৪
ইশরাত জাহান
ঘরে এসে শোভা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইল। বাইরে জঙ্গলের দিকে বটগাছ দেখে মনটা আরও ভারী হয়ে গেল।দর্শন দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই শোভা শুকনো মুখে বলে,“আমার জামাকাপড় তো দিজার ঘরে।যেকোনো একটা পেলে ভালো হতো।”
দর্শন শান্ত স্বরে জানাল,“আমি তো অনেক আগেই দিজার কাছে ওর ঘরের চাবি দিয়ে রেখেছিলাম।দিজা ঢাকায় যাওয়ার দিন ওর ঘরে তালা মেরে চাবি নিজের কাছে রেখেছিল।তাড়াহুড়োয় অত খেয়াল করিনি।চাবিটা ওর কাছেই আছে,আমার কাছে এখন নেই।”
শোভা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,“দুদিন ধরে এক শাড়িতেই আছি।গা বারবার ঘামে নোংরা হয়ে আছে।অস্বস্তি লাগছে খুব।মাথাটাও চিনচিন করছে ব্যাথায়।”
দর্শন একটু কাছে এসে নরম স্বরে বলে,“গোসলে যাবে?”
শোভা কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকল।জানালার ধারে আঙুল দিয়ে অকারণে নখ ঘষল।তারপর আস্তে বলে,“ভালো হতো যদি গোসল করতে পারতাম।জ্বালাপোড়া কমতো।”
একটু থেমে আবারও বলে,“আসলে পিঠের দিকে চাবুকের আঘাত যেখানে করা হয়েছিল ওই জায়গাগুলোতে বেশি জ্বালাপোড়া করে।ঘেমে গেছি তো তাই কেমন….
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
আর বলল না শোভা।দর্শনের সাথে কথা বলতেও কেমন অসস্তি লাগছে।এমনিতেও গুণে রেখেছে হাতে আর মাত্র বারোদিন আছে।এই কয়দিন হয়েগেলে একমাস শেষ হবে।দর্শন নিজেই তখন ওকে দিয়ে আসবে।এখন সে দর্শনের দায়িত্বে বলেই দর্শন তাকে যা খুশি তাই বলছে।এমনকি জোর করে নিয়েও এসেছে।সবকিছু এই চুক্তির জন্য।এমনটাই ধারণা শোভার।নাহলে দর্শন তাকে এভাবে অধিকার দেখানোর চেষ্টা করবে কেন?তাও আবার শুধু রাগ দেখিয়ে!শোভা ভালো কোনো ধারণা রাখতে পারছে না।এমন কিছু ওর নজরে আসেনি।আসতে নিয়েছিল কিন্তু সব দর্শন নিজ হাতে নষ্ট করে দিলো।
দর্শন কিছুক্ষণ ভেবে ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি টেনে বলে,“তাহলে একটা ব্যবস্থা করে দিই?”
শোভা কপাল কুঁচকে প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকাল।দর্শন আলমারির দিকে গিয়ে সযত্নে একটা নতুন সাদা শার্ট বের করল।হাতে নিয়ে শোভার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,“গোসল সেরে এটা পরতে পারো।”
শোভা হঠাৎ চমকে তাকাল।মুহূর্তেই মুখ ফিরিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বলে,“ইয়ার্কি করছেন আপনি?”
দর্শন ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু ভঙ্গিতে হেসে ফেলল।বলে,“ইয়ার্কি না ম্যাডাম।গোসলের পর পরার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা তো করলাম।”
শোভা থমথমে মুখে তাকাল।থেমে থেমে বলে,“তাই বলে আপনার শার্ট?”
দর্শন নির্দ্বিধায় জবাব দিল,“হুমম,কেন?এতে কী কোনো সমস্যা আছে?আমারই তো শার্ট।একদিনও ব্যবহার করিনি।একেবারে নতুন আছে।”
শোভা বিরক্ত মুখে বলে,“তাই বলে আমি শার্ট পরব?”
দর্শন ভ্রু উঁচিয়ে চোখে দুষ্টু ঝিলিক নিয়ে বলে,“কেন?শার্ট পরলে সমস্যা কি?আমিও তো শার্ট পরি।”
শোভা হঠাৎ কিছু বলার আগেই দর্শন শার্টটা তার হাতে গুঁজে দিল।মৃদু স্বরে ফিসফিসিয়ে বলে,“পরপর দুদিন এই এক শাড়িতে থাকার চেয়ে এটা পরে আসো।”
শোভা আমতা আমাতা করতে শুরু করে।দর্শন ভ্রু কুঁচকে তাকায়।শোভা জানায়,“শুধু শার্ট দিচ্ছেন তো।প্যান্ট?”
দর্শন ঠোঁট চেপে হেসে আলমারি থেকে ট্রাউজার দিলো।শোভা দ্রুত চলে গেলো গোসলের জন্য।দর্শন তাকিয়ে আছে সেদিকে।দুষ্টু হেসে বিছানা ঝাড়তে শুরু করে।বিছানা ঠিক করে একটা বই নিয়ে বসলো দর্শন চেয়ারে।
গোসল শেষে শোভা ধীরে ধীরে ঘরে ঢুকল।ভেজা চুল হাঁটু ছাড়িয়ে আছে।চুলের নিচ থেকে বিন্দু বিন্দু পানি পড়ছে।সাদা শার্ট ভিজে যাচ্ছে।শার্টের ভিতর থেকে অনেক কিছুই স্পষ্ট ভেসে আসছে।আকর্ষণীয় লাগছে শোভাকে।
দর্শন বইয়ের ওপর ঝুঁকে বসেছিল কিন্তু চোখ এক মুহূর্তেই শোভার দিকে আটকে গেল।বুকের ভেতর হঠাৎ যেন কিছু থমকে দাঁড়াল।হা হয়ে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ।শোভা বিরক্ত মুখে ভ্রু কুঁচকে বলে,“এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন?”
দর্শন চমকে বইটা বন্ধ করল।চোখ সরাতে চাইলেও পারল না।নিচু স্বরে বলে,“তাকানোটা হয়তো আমার দোষ কিন্তু চোখ ফেরানোও সহজ না।”
শোভা গাল শক্ত করে নিল,“এই ঘরে আমার নিজের কাপড় না থাকায় এটা পড়তে হলো।ছেলেদের পোশাকে খুব বাজে দেখাচ্ছে!”
দর্শন ধীর কণ্ঠে জবাব দিল,“বাজে নয় বরং অন্য এক শোভাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে।”
শোভা চুপ করে গেল।ঠোঁট শক্ত করে রেখেও বুঝতে পারল বুকের ভেতর হালকা কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ছে।দর্শন আর কিছু বলল না।শুধু চেয়ার থেকে উঠে জানালার দিকে হেঁটে গেল।বাইরে অন্ধকার বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে।তার নীরবতা যেন শোভার দিকে অদৃশ্য এক স্বীকারোক্তি ছুড়ে দিল।যা মুখে বলা যায় না,তা চোখে আর নীরবতায় বোঝা যায়।শোভা চোখ নামিয়ে নিল।অভিমান থাকলেও বুকের ভেতর গোপন এক উষ্ণতা খেলে গেল।
শোভা চলে গেলো আয়নার সামনে।হাতে চিরুনি নিয়ে যেই হাতটা উচু করে শার্টের শেষ প্রান্ত উচু করে শোভার নাভি দেখা দেয়।যেটা আয়নায় দেখামাত্র জিহ্বা কামড়ে সাথে সাথে ঢেকে দেয় হাত নামিয়ে।আয়নার দিকে তাকিয়ে দেখে যাচ্ছে দর্শন জানালার গা ঘেষে দাড়িয়ে বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে।শোভা ফুসে উঠে বলে,“একেতো চুরি করে আমাকে দেখছেন আবার আমাকে দেখেই হাসছেন?”
দর্শন অবলীলায় বলে দিলো,“চুরি করে দেখার কি আছে,যেখানে তুমি নিজেই আমার সামনে উপস্থিত?”
শোভা মুখ ঘুরিয়ে আবারও চুল আঁচড়াতে চাইলে পারল না।শার্ট উচু হয়ে পেট বের হয়ে আসতে নেয়।কান্না পাচ্ছে মেয়েটার।দুদিন হয়েগেলো মাথায় চিরুনি চালায়নি।এমনকি জট পাকিয়ে আছে চুলে।মায়ের যত্নে এই লম্বা চুল শোভার স্মৃতি।এটা মেয়েদের একটা আবেগ। আর যাই হোক লম্বা চুল প্রেমী মেয়েরা কখনোই নিজেদের চুলের বেহাল দশা দেখতে পারে না।শোভা মুখটা মেঝেতে রেখে ভাবনায় পড়েছে।এর মধ্যেই দর্শন ধীর পায়ে এগিয়ে এসে শোভার পিছনে অতি নিকট হয়ে দাড়ালো।দর্শনের উপস্থিতি অনুভব করে শোভা সরে যেতে নিলে দর্শন দুইহাত দিয়ে শোভার কাধ ধরে দাড় করায়।শোভা চমকে চেয়ে আছে আয়নার দিকে।দর্শনের এই ছোঁয়াটা মেয়েটার মধ্যে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করায়।শুকনো ঢোক গিলে তুতলিয়ে বলে, “ক কি করছেন?”
“হাসব্যান্ড মেটেরিয়াল হবার ট্রাই।”
“সেটা আবার কি?”
“ইংলিশ জানো না?”
শোভার মুখটা হা হয়ে এলো।এতবড় অপমান!শোভা পিছন ঘুরতেই নাকের সাথে দর্শনের বুকে ঘষা লাগে।নাকে হাত দিয়ে শোভা ক্ষিপ্ত মুখ করে বলে,“আমি লেখাপড়া মন দিয়েই করি এমনকি যতটুকু পড়েছি তাতে ইংলিশ বইয়ের অর্থগুলোও মনোযোগ দিয়েই পড়েছি কিন্তু আপনার এই হাসব্যান্ড মেটেরিয়াল শব্দ আমার সিলেবাসের মধ্যে নেই।এই শব্দ আজকে প্রথম শুনেছি।”
দর্শন মৃদু হেসে দেয়।আগের শোভা ফিরে এসেছে।যে ছিল দর্শনের সামনে বাধ্য মেয়ে।আগের শোভা ঠিক যেমন নিজের সম্মান বাঁচানোর চেষ্টা করলেও দর্শনকে ছেড়ে চলে যাবার উপায়ন্তর না পেয়ে কাছে থেকে তর্ক জুড়ে দিতো ঠিক তেমন।এই শোভাকেই তো চায় দর্শন।শোভাকে ঘুরিয়ে দিয়ে চিরুনি হাতে নিয়ে দর্শন বলে,“বুঝতে হবে না এটা।ফোন তো আছে।কোনো এক সময় সার্চ দিয়ে দেখে নিও।”
শোভা কথা ঘুরিয়ে বলে,“চিরুনি নিলেন কেন?আমার চুলের জট ছাড়াতে?”
“হুমমম।”
শোভা ভয়ে আবারো সরে যেতে নিলে দর্শন আবারও আঁকড়ে ধরে বলে,“কি হলো?”
“আপনি পারবেন না।ছেড়ে দিন আমাকে।আপনি উল্টো জট পাকাবেন।”
“আমি পারবো।”
“না না,এত লম্বা চুল তারমধ্যে ভেজা।আপনি রাখুন।আমি কালকে আঁচড়াবো।”
দর্শন চোখ রাঙিয়ে বলে,“বললাম না পারবো।”
শোভা চুপ হয়েগেলো ভয়ে।এখানে দর্শন রেগে গেলে তাকে বাঁচানোর কেউ নেই।এই বুদ্ধি শোভার আছে।এই লোক যখন মানুষের সামনে তাকে শাস্তি দেয় একা পরিবেশেও খুব ভালোভাবে দিবে।তার ছেরাকে রাগাকে ভয় পাচ্ছে শোভা।চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।দর্শন চুলের অল্প অল্প করে অংশ নিয়ে আস্তে আস্তে আঁচড়ে দেয়।ব্যাথা পায়না শোভা।অবাকের সাথে দেখছে।শোভার চুল আঁচড়ানো হলে দ্রশন চিরুনি ড্রেসিং টেবিলের সামনে রাখলে শোভা প্রশ্ন করে,“আপনি লম্বা চুল আঁচড়াতে জানেন?”
দর্শন আয়নায় এক পলক শোভাকে দেখে বলে,“হুমমম,দাদাজানকে দেখতাম আমার দাদীজানের চুল এভাবে আঁচড়ে দিতো।”
“আপনি দাদাজানের থেকে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন নাকি?”
“বলা চলে তাই।”
“দাদাজানের মত রসিক হতে পারেননি হয়েছেন উল্টো উগ্র স্বভাবের।”
দর্শন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মনে মনে বলে,“আমার নজরে একা দাদাজানের জীবনী আসেনি এসেছে আমার আব্বাজানের জীবনীও।তাই তো আমার মধ্যেকার সবকিছু উলট পালট হয়েগেলো।”
শোভা সমস্ত চুল সামনে এনে বিনুনি করতে শুরু করে।দর্শন বিছানায় বসে দেখছে।শোভা আলো নেভানোর আগে দর্শনের উদ্দেশে বলে,“আপনার মোবাইলের আলো জ্বালাবেন?এই অন্ধকারে ভয় পাবো।”
দর্শন মোবাইলের আলো জ্বালালো।শোভা সুইচ অফ করে দিতেই দর্শন ইচ্ছা করেই মোবাইলের আলো নিভিয়ে দেয়।সাথে সাথে ভয়ে দেয়ালের গা ঘেষে শোভা বলে,“কি হলো?”
দর্শন বিছানা থেকে নেমে বলে,“আলো নিভে গেলো।”
শোভা আয়াতুল কুরসী পাঠ করে বুকে ফু দিয়ে বলে,“এবার কি হবে?”
দর্শন ধীর পায়ে মৃদু হেসে এগিয়ে এসে বলে,“কি হলে ভালো হয়,ওয়াইফি?”
শোভা তুতলিয়ে বলে ওঠে,“আমার ভয় করছে।অন্ধকারে আমি ভয় পাই।”
দর্শন শোভার কাছে এসে দাড়ালো।শোভার সামনে দাঁড়িয়ে শোভার মুখ বরাবর মুখ রাখে।শোভা বুঝতে পারে।এই অন্ধকারেও দর্শনের উপস্থিতি বোঝা যায়।শোভা চায় দর্শনকে স্পর্শ করতে কিন্তু লজ্জায় পারছে না অথচ এর আগেও পড়তে গিয়ে দর্শনের বুকে মাথা রাখতে হয়েছিল এই মেয়ের।একসিডেন্টলি কিছু ঘটে যাওয়া ও ইচ্ছাকৃত কিছু করতে চাওয়ার মধ্যে আলাদা কাজ করে।শোভার দিকটাও ঠিক তাই।দর্শন শোভার গা ঘেষে দাড়িয়ে বলে,“আমার উপস্থিতিও কি তোমার ভয় কাটাতে পারেনি,ওয়াইফি?”
শোভা শুকনো ঢোক গিলে বলে,“এতটা কাছে এসেছেন কেন?একটু দূরে সরুন।”
শোভার কানের কাছে ঠোঁট ছুঁয়ে দর্শন বলে,“কেন?দূরে সরলে কি তুমি ঠিক থাকবে?”
শোভার বুকের মধ্যে যেনো কেউ হাতুড়ি পেটাচ্ছে।হালকা কেশে উঠে বলে,“এভাবে কথা বলবেন না।”
“বললে কি হবে?”
“আ আমার কেমন যেনো লাগছে!”
“কেমন লাগছে?”
“জানি না আমি।শুধু জানি আপনি সরলেই ভালো লাগবে।”
“সত্যিই কি আমি সরে গেলে তোমার ভালো লাগবে?”
শোভা উত্তর দেয়না।তবে দর্শন সরে গেলো।ধীরে ধীরে শোভার কাছ থেকে দর্শনের উপস্থিতি দূর হয়েগেলো।শোভা এতক্ষণ ভয় কাটিয়ে লাজুকতায় মিশে ছিল।এখন আবার একাকীত্ব বোধ করে।দেয়াল থেকে পিঠ সরিয়ে বিছানার দিকে এগিয়ে আসতে নেয়।কিন্তু হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো।শোভার চুল থেকে পড়া পানিতেই পা পিছলে পড়ে শোভা।খুব জোরে চিৎকার না করলেও শোভার আর্তনাদ আসে।দর্শন ছুটে এলো।শোভার সামনে বসে বলে,“দেখে হাটবে না?”
শোভা কান্না কণ্ঠে বলে,“দেখা যাচ্ছে না তো।”
“কে বলেছে?আমি তো দেখতে পাচ্ছি।জানালা দিয়ে আসা আবছা চাঁদের আলোয় অনেক কিছুই দেখা যাচ্ছে।”
“এতটাও স্পষ্ট না যতটা আপনি বলছেন।আর আমার চোখ ছিল বিছানার দিকে।মনে মনে ভাবছিল বিছানার নিচ দিয়ে মনে হয় কোনো ভূত টুত আসবে।”
দর্শন অবাকের সাথে বলে,“বিছানার নিচ দিয়ে ভূত!”
“হ্যাঁ,আসে তো এমন।”
“কোনোদিন দেখেছো আসতে?”
“না কিন্তু শুনেছি।”
“কোথায়?”
“ভাবী ভূতের উপন্যাস পড়েছে।ওখানেই শুনেছি।এছাড়াও আমাদের প্রতিবেশী এক দাদী বলেছে অন্ধকার ঘরে বদজ্বীন এসে মেয়েদের ঘাড়ে ভর করে।পরীরা এসে সুন্দর ছেলেদের ঘাড়ে ভর করে।”
দর্শনের হাসি পেলো।উচ্চস্বরে হেঁসে বলে,“এগুলো রূপকথার গল্প।এগুলোতে বিশ্বাস করো?”
শোভা মুখটা শুকনো করে বলে,“আহামরি বিশ্বাস হয়না কিন্তু এমন অন্ধকার পরিবেশে কিভাবে যেনো মনের মধ্যে এগুলোই ঘোরে।”
“ভালকিছু ঘোরে না মনের মধ্যে?”
“না কিন্ত আমার পায়ে ব্যথা করছে।”
“ব্যাথা তো করবেই।এভাবে হোঁচট খেলে ব্যাথা করবে না?”
শোভা অসহায় নজরে তাকালো কিন্ত্ত মুখ দেখা যায়না দর্শনের।অন্ধকারে শুধু আবছা গঠন বোঝা যায়।দর্শন আচমকা বলে ওঠে,“হেল্প করতে পারি কিন্তু আমার একটা শর্ত আছে।”
শোভা অবাক হয়ে বলে,“কি শর্ত?”
“শর্ত হলো এই যে,আমার কোনো কথার দ্বিমত পোষণ করা চলবে না।আমি যখন যেটা করতে বলব তুমি তখন সেটাই করবে।”
শোভা ভ্রু কুঁচকে আছে।দর্শন আবারও বলে,“আমি কারো সাথে মিশতে বারণ করলে,তুমি তার সাথে মিশতে পারবে না।”
শোভা শুনছে দর্শনের কথা।দর্শন আবারও বলে,“আমি অতিরিক্ত রেগে গেলে রাগানোর মত কথাগুলো এড়িয়ে যাবে।আমাকে দ্বিগুণ রাগিয়ে দিবে না।তাহলে ক্ষতিটা আমাদেরই হবে।”
শোভা মনে মনে বলে,“এটা আমার জানা হয়েগেছে।”
দর্শন আবারও বলে,“তোমার জীবনে কোনো দ্বিতীয় পুরুষের অস্তিত্ব থাকবে না।”
শোভার বলতে ইচ্ছা করলো,“কেউ তো আমার জীবনে।”
বলল না ভয়ে।শোভার বন্ধু-বান্ধবী কেউই নেই।তবুও দর্শন এমন কথা বলল কেন মাথায় আসছে না।এবার শেষ শর্ত দিলো দর্শন,“তোমাকে আমার নিয়মে চলতে হবে।আমার নিয়মের ব্যতিক্রম হতে পারবে না তুমি।”
শোভা পাল্টা প্রশ্ন করে,“যদি ব্যতিক্রম হই?”
“নিজেও জানি না কি করবো আমি!শুধু বলতে পারি সবকিছু ওলট পালট হয়ে যাবে,ওয়াইফি।”
শোভার কাছে ভয়ংকর হুমকি লাগলো এই কথাগুলো।শোভা নীরবে দর্শনের চোখ দেখার চেষ্টা করছে কিন্তু এই যে অন্ধকার আর দর্শন আছে জানালার উল্টোদিকে তাকিয়ে।তাই চোখের ভঙ্গি বোঝা গেলো না।তবে গম্ভীর কণ্ঠের হুমকি স্পষ্ট বোঝা গেলো।শোভার থেকে উত্তর না পেয়ে দর্শন শোভার হাত ধরে আলতো নাড়া দিয়ে বলে,“রাজি আছো,ওয়াইফি?”
শোভা হালকা কেঁপে উঠে বলে,“হ্যাঁ?হ্যাঁ হ্যাঁ রাজি।”
মনে মনে বলে,“এমনিতেও নিয়মের বাইরে চলতে দেন কোথায়?আর আমার তো কোনো বাইরের বন্ধু-বান্ধবী নেই।”
শোভা রাজি হবার সাথে সাথেই দর্শন শোভাকে কোলে তুলে নেয়।শোভা চমকে ওঠে।শোভাকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে দর্শন পাশে বসে।শোভা জানালার দিকে সরে গেলো।দর্শন মৃদু হেসে পাশে শুয়ে পড়ল।শোভা মাঝেমাঝে আড়চোখে তাকাচ্ছে দর্শনের দিকে।দর্শন একহাত কপালে রেখে চোখ বুজে আছে।শোভার নজর সেদিকেই।দর্শনের শর্ত মানতে যেনো রাজি শোভা।শুনে তার কাছে ভালোই লাগলো।এরমধ্যে যে দর্শনের মানসিক অবস্থা বুঝিয়ে দেওয়া এটা বুঝতে পারল না মেয়েটা।জানালা দিয়ে আসা বাতাসে শোভার গায়ে শীত বাড়িয়ে দিচ্ছে।দর্শন নিজেও ঠান্ডা বাতাস উপভোগ করছে।শোভার চোখে জানালার দিকে গেলেই বটগাছ দেখতে পায়।শোভা ভয়ে জানালা থেকে সরে দর্শনের দিকে এগিয়ে যায়।দর্শন চোখ মেলে তাকায়।প্রশ্ন করে,“কি হলো?”
“ব বটগাছ!”
দর্শন ঘুরে শোভার আরো কাছে আসে।শোভাকে একহাতে আঁকড়ে নিয়ে বলে,“এবার ঠিক আছে, ওয়াইফি?”
শোভার গায়ে দর্শনের ভার।শোভা কেঁপে উঠছে।দর্শন বলে,“কালকে মলম এনে তোমার পায়ে আর পিঠে দেওয়া হবে।এখন একটু কষ্ট করে ঘুমাও।”
শোভা মনে মনে বলে,“এভাবে জড়িয়ে ধরলে ঘুম আসে নাকি?”
দর্শন ইচ্ছা করেই আবারও প্রশ্ন করে,“কি হলো?ঘুমাও।”
শোভা চোখ বুঝলো।দর্শন মুচকি হেসে বলে, “গুড নাইট, ওয়াইফি।”
বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪৩
বলেই শোভাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ঘুমের অভিনয় করে।এদিকে শোভার শার্টের অবস্থা খারাপ।পেটের দিকে দলা পাকিয়ে উপরে উঠে এসেছে।সেখানেই হাত আছে দর্শনের।শোভা এক পলক জানালার বাইরে রেখে ওমনি কাপা কাপা চোখজোড়া বন্ধ করে দর্শনের দিকে ফিরে থাকে।সুযোগ বুঝে দর্শন চোখ মেলে শোভাকে দেখে ঠোঁট প্রসারিত করে।মনে মনে বলে,“তুমি আমার বন্দী খাঁচার পাখি,ওয়াইফি।আমি কখনোই তোমাকে আমার থেকে দূরে যেতে দিবো না,কখনোই না।নিয়তি আমাকে বারবার বুঝিয়ে দেয় আমরা একে অপরের।আমাদের দূরত্ব হওয়াটা অসম্ভব।তুমি দূরে থাকলেই আমি অসুখে আক্রান্ত হয়ে উঠব।তুমিই আমার সুখে থাকার মেডিসিন।এই মেডিসিন আমি ধীরে ধীরে সেবন করবো তবুও দূরে সরতে দিবো না।”