বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪৫
ইশরাত জাহান
ফজরের আযানের সময় শোভা বুঝতে পারে এখন তার নামাজে ছুটি।এখন নিজের কিছু একটা ব্যাবস্থা নিতে হবে কিন্তু দিজার ঘরে তালা দেওয়া ও দোকানপাট বন্ধ। সেই থেকেই পেটে চিনচিনে ব্যথা করছে শোভার।ক্ষুধা লেগেছে বেশ।দুটো মিলে বমি আসছে।এখনও সুস্থ হয়নি শোভা।তার মধ্যেই কতকিছুর সম্মুখীন হতে হলো।এমন কথার সময় এর আগে আসেনি তার।জানালার কাছে হাঁটু গেড়ে বসে বাইরের দিকে চেয়ে কান্নারত চোখে পেটে হাত দিয়ে রেখেছে। কিচ্ছু ভালো লাগছে না তার।আটটার দিকে দর্শনের ঘুম ভাঙ্গে।আড়মোড়া দিয়ে উঠে বসে শোভাকে এভাবে নীরব বসে থাকতে দেখে জিজ্ঞাসা করে,“কি হয়েছে তোমার?”
শোভা মুখ ফিরিয়ে তাকায়।শোভার চোখমুখ দেখে দর্শন আতঙ্কে পড়ে এগিয়ে এসে শোভার মুখে হাত রেখে বলে,“এনিথিং রং,ওয়াইফি?”
শোভা মাথা উপর নিচ করে বোঝায় হ্যাঁ।দর্শন আবারও জিজ্ঞাসা করে,“কি হয়েছে বল আমাকে।আর কি করলে ঠিক হবে?”
শোভা কথা বলতে চায়না কারণ মাথা ভনভন করছে।ক্ষুধার সাথে পেটে ব্যথা বেড়ে তার মধ্যে অসস্তি বাড়িয়ে দেয়।কোনরকমে শুকনো ঢোক গিলে হা করে।দর্শন বুঝতে পারল শোভার কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে।অনেকক্ষণ ধরে চুপ ছিল তাই।দ্রুত এক গ্লাস পানি এনে শোভাকে পান করিয়ে দেয়।শোভা পানি পান করে গলা খাঁকারি দিয়ে বলে,
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
“আমার পেটে ব্যাথা করছে ভীষণ।গা গুলিয়ে আসছে।কান্না পাচ্ছে।”
দর্শন এই অসুস্থতার কারণ বুঝতে না পেরে বলে,“কিছু খাবে?আমি খাবার এনে দিচ্ছি।”
শোভা বাধা দিয়ে বলে,“খাবার তো ঠিক আছে কিন্তু আমার আরো কিছু লাগবে।”
দর্শন প্রশ্নবিত্ব নয়নে চেয়ে আছে।শোভা লজ্জায় বলতে না পেরে জানায়,“এটা মেয়েদের বিষয়।মাসে মাসে একটা সমস্যা দেখা দেয় মেয়েদের।যার জন্য এমনটা হয়।এখন কিছু জিনিস হলে ভালো হতো।”
দর্শন শোভার চোখমুখ দেখে বলে,“কি লাগবে,বলো আমাকে?আমি এখনই এনে দিবো।”
শোভা দেখছে দর্শনকে।দর্শনের মাঝে উতলা ভাব।ভাবাচ্ছে শোভাকে।একটু চুপ থেকে মুখ খুলল,“লিখে দেই?”
দর্শন ভাবান্তর চাহনি দিয়ে অতঃপর ছুটে গিয়ে কাগজ কলম আনলো।শোভা লিখে দিলো নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসের নাম।দর্শন পড়ে শোভার দিকে তাকায় এক পলক।অতঃপর বলে,“আমি এখনই যাচ্ছি বাইরে।”
শোভা মাথা উপর নিচ করে চুপচাপ বসে আছে।দর্শন যেতে নিলে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আবারও পিছন ফিরে বলে,“এই ঘর থেকে এক পাও যেনো বাইরে যাওয়া না হয়।যদি গেছো তো খবর আছে।”
বলেই দরজায় লক করে চলে যায় দর্শন।শোভা মুখটা শুকনো করে বলে,“ভালো করেও তো বলা যায়।হুমকি দেওয়ার কি আছে?আবার দরজায় লক করে দিল!”
প্রায় এক ঘন্টা পর দর্শন ফিরল।শোভার জন্য প্রয়োজনীয় প্যাকেট ও মলম নিয়ে এসেছে।সাথে কিছু বাজার।দর্শন শোভার সামনে দাঁড়িয়ে একটু ঝুঁকে বলে,“ওয়াশরুমে একা একা যেতে পারবে নাকি হেল্প লাগবে?”
শোভা চমকে তাকালো।দর্শন এখন রোমাঞ্চকর ভাবনায় নেই তবে ও চায় শোভার সুস্থতা।শোভার এমন চমকে তাকানোর দিকে গুরুত্ব না দিয়ে বলে,“রাতের বেলা পায়ে আঘাত পেয়েছিলে।এখনও তো ব্যাথা আছে তোমার পায়ে।”
শোভা জানায়,“ব্যাথা নেই।ঘুম থেকে উঠে ব্যাথা অনুভব করছি না।”
“মাথা তো ঘুরছে।”
“সমস্যা নেই।আমি যেতে পারব।শোভা নিজের মত হাঁটতে নিলে ক্ষুধা লাগার ঢেঁকুর দেয়।দিয়েই মাথার মধ্যে কেমন ব্যাথা অনুভব করে।দুর্বল হয়ে ঢলে পড়তে নিলে দর্শন আঁকড়ে ধরে।শোভার গলার কাছে বোতামটা দর্শনের হাতের টানে ছিটকে পড়ে যায়।বুকের ভাজ বের হয়ে আসে।শোভার সেদিকে চোখ নেই তবে নজরে আসে দর্শনের।শোভা কোনরকমে নিজেকে সামলে দর্শনের বাহু ধরে আছে।দর্শন মৃদু হেসে বলে,“আমাকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে হয়ে তুমি বরং আমাকে আরো বেশি আকৃষ্ঠ করছো,ওয়াইফি।”
শোভা হা হয়ে গেলো।দর্শন চোখ ইশারা করতেই শোভা তাকালো নিজের দিকে।বিশ্রী লাগছে নিজের কাছে।শোভা দুইহাত দিয়ে বুক ঢেকে রাখার চেষ্টা করে।দর্শন সেই হাতের মাঝে প্যাকেট দিয়ে শোভাকে পাঁজাকোলা করে নেয়।শোভা বলে ওঠে, “আরে করছেন কি?”
দর্শন কোনো কথা না বলে শোভাকে ওয়াশরুমে এগিয়ে দেয়।শোভাকে নামিয়ে দিয়ে দুষ্টু হেসে বলে,“বাকি হেল্পটুকুও করে দেওয়া লাগবে নাকি নিজে নিজেই পারবে?”
শোভা চোখ বড় করে দেখে দর্শনকে।দর্শন মৃদু হেসে বলে,“তুমি চেঞ্জ করো আমি ব্রেকফাস্ট রেডি করছি।”
দর্শন চলে যেতে নিলে শোভা আবারও ডাক দেয়,“শুনুন।”
দর্শন এগিয়ে এসে বলে,“হেল্প লাগবে?”
শোভা চমকে উঠে বলে, “হেল্প বলতে ব্যালকনিতে আমার শাড়ি আর কিছু জিনিস মেলে রাখা আছে।ওগুলো এনে দিতে পারবেন?”
দর্শন এনে দিলো।শোভা লজ্জায় দ্রুত দরজা লাগিয়ে দেয়।দর্শন নিচে চলে আসে।বাজার করে এনেছে সে।কিছু ফল কাটল।বেশি করে প্লেটে খেজুর নিলো।শোভার দুর্বলতা কাটাতে খেজুর খুব ভালো কাজে দিবে।ডিম সিদ্ধ করে তারউপর টমেটোর সালাদ দিয়ে সাজিয়ে নেয়।দুই প্লেট সাজিয়ে ঘরে এসে দেখে শোভা এখনও বের হয়নি।দর্শন হাতঘড়ি দেখে অপেক্ষা করতে থাকে।কিছুক্ষণ পর শোভা শাড়ি পরে ভেজা চুলে বের হয়।হয়ে ভেজা ট্রাউজার ও সাদা শার্ট।ট্রাউজার দিয়ে পানি পড়ছে।শোভার মধ্যেও আতঙ্ক কাজ করছে।যেনো দর্শনকে সে ভয় পাচ্ছে।মেঝেতে তাকিয়ে আছে চুপ করে।দর্শন ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞাসা করে বলে,“কি হলো?”
শোভা ভয় পাচ্ছে।দর্শন এর কারণ বুঝে উঠতে পারছে না।দর্শন এক পা এগোতে নিলে শোভা পিছিয়ে যায়।দর্শন সাথে সাথে বলে,“কি হয়েছে বলবে তো?”
শোভা আতকে উঠে বলে,“আ আপনার ট্রা ট্রাউজার নষ্ট হয়েছে।ধুতে পারিনি।ভে ভেজা অবস্থায় অনেক ভারী।ধু ধুতে কষ্ট হচ্ছিল।”
শোভার চোখ লাল হয়ে আছে।ভিজে আসছে প্রায়।দর্শন ট্রাউজারের পরোয়া করেনা।শোভার দিকে ছুটে আসে।শোভার দুইহাত নিজের মধ্যে আঁকড়ে নিয়ে বলে,“এর জন্য কান্না করছো?”
শোভা ভয়ে ভয়ে চোখের পাতা নাড়িয়ে তাকালো দর্শনের দিকে।কাপা কাপা গলায় বলে,“আপনি তো সুচিপায়ী।”
দর্শন শোভার চোখের কাপা কাপা পাতাদুটো দেখছে।মেয়েটা ঘাবড়ে আছে।হয়তো ভাবছে দর্শন তাকে শাস্তি দিবে।দর্শন এমন কিছুই করেনা।শোভার ভেজা শীতল মুখটায় হাত বুলিয়ে বলে,“আমার সব জিনিসে তো তোমার অধিকার আছে,ওয়াইফি।তুমি আমার জিনিসপত্র নষ্ট করলেও আমি কিছু বলব না।”
শোভা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে।বোঝার চেষ্টা করে দর্শনকে।দর্শন মৃদু হেসে শোভার হাত থেকে শার্ট ও ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে রেখে দেয়।শোভার হাত ধরে বিছানার দিকে টেনে আনে।দুজনে বসে একসাথে।দর্শন খাবারের প্লেট এগিয়ে নিয়ে শোভার সামনে পিস করা সিদ্ধ ডিম ধরে।শোভা দেখছে ডিমের উপর টমেটোর সালাদ আছে।একবার খাবারের দিকে আরেকবার দর্শনের দিকে তাকাতেই দর্শন বলে,“এগুলো স্বাস্থ্যকর খাবার।তোমার শরীরের জন্য উপকারী।নেও এবার খাও।”
শোভা মুখে নিয়ে নেয় খাবার।আহামরি কোনো স্বাদ পেলো না শোভা তবে খেতে মন্দ না।শোভার সাথে সাথে দর্শন নিজেও খাচ্ছে।ডিম খাওয়ার পর শোভা ফল ও শেষে পাঁচ-ছয়টা খেজুর খেয়ে পানি পান করে।এখন শরীরটা ভালো লাগছে মেয়েটার।
দর্শন প্লেটটা পাশের টেবিলে রেখে শোভার কাছে এসে বলে,“পিছনে ঘুরো।”
শোভা বুঝতে না পেরে মুখ বেকিয়ে বলে,“কি?”
দর্শন মলম দেখিয়ে বলে,“পিঠে মালিশ করতে হবে।ঐদিকে ঘুরে বসো।”
শোভার লজ্জা করলো।এতদিন দিজা নাহলে মৌলি লাগিয়ে দিয়েছে মলম।শোভার ঘুমের মধ্যে অবশ্য দর্শন দিয়ে দেয় যেটা মেয়েটা বুঝতেও পারেনা।শোভা ঘুরছে না দেখে দর্শন বলে,“কি হলো?”
শোভা বলে ওঠে,“আমি নিজে নিজে পারবো।”
দর্শন নাকজ করে বলে,“পারবে না তুমি।ওই অব্দি হাত পৌঁছবে না তোমার।আর পৌঁছালেও মলম সঠিক জায়গায় দিতে পারবে না।”
শোভা লজ্জায় পড়ল।চোখ টিপে টিপে বন্ধ করে ভাবনায় পড়ে।দর্শন বুঝতে পেরে ঠোঁট চেপে হেসে শোভাকে ঘুরিয়ে দেয়।শোভার মাথায় গামছা বেঁধে রাখা।উন্মুক্ত সাদা পিঠ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।সেখানেই কালো কালো দাগ হয়ে আছে।চাবুকের দাগগুলো পুরোপুরি শুকোয়নি।দর্শনের ওই ব্যক্তিদের আবারও খুন করতে ইচ্ছা করছে।তার বউকে আঘাত করেছে ওরা।কত বড় বুকের পাঠা!শোভার পিঠের উপর মলম দিয়ে আঙ্গুল নাড়িয়ে যাচ্ছে দর্শন।দর্শনের আঙুলের এই ছোঁয়ায় শিউরে উঠলো শোভা।পিঠ কুকড়ে উঠছে।শোভার পিঠে ছোট্ট একটা কালো তিল আছে।যে তিলের দিকে চোখ আটকে গেলো দর্শনের।আঙুল দিয়ে তিলটা টিপে ধরতেই শোভা চোখ খিঁচে বন্ধ করে।মেয়েটার মধ্যে দর্শনের প্রতি আকৃষ্ঠতা বৃদ্ধি হচ্ছে।এটা দর্শন ধরতে পারছে।তার ঠোঁটেও মৃদু হাসি।উন্মাদ দর্শন চায় শোভাকে তার প্রতি উন্মাদ করে তুলতে।ধীরে ধীরে শোভাকে নিজের প্রতি ভালোবাসা অনুভব করাতে।যদি কোনো বাধা-বিপত্তি না আসে তবে দর্শন তার কার্যে সফল হবে।
শোভার উন্মুক্ত পিঠের জায়গাগুলোতে মলম দিয়ে দর্শনের হঠাৎ বিনা অনুমতিতে ইচ্ছা পূরণের বাসনা জাগলো।শোভার পিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে দেয় দর্শন।শোভার চোখ বন্ধ ছিল।পিঠে ঠোঁটের ছোঁয়া পেতেই চোখ মেলে তাকায়।পিছন ফিরতে লজ্জাবোধ করে।তাই দ্রুত লজ্জায় দৌড়ে চলে যায় ব্যালকনিতে।বসে মুখ চেপে জোরে জোরে নিশ্বাস ছাড়ে।দর্শন ঠোঁট প্রসারিত করে সোফায় বসে গিটার হাতে নেয়।গিটার বাজিয়ে গাইতে শুরু করে,
“ইচ্ছে যত উড়িয়ে দেবো
হঠাৎ দমকা হাওয়াতে
দস্যু হয়ে তারা
ভাঙবে যে পাহারা
জাগাবে তোমায় রাতে
বলো না বলো শুনতে কী চাও
বলো না বলো শুনতে কী পাও
বলো না বলো আজকে আমায়…..”
দর্শন গিটার থামিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।ব্যালকনি থেকে উঁকি মারে শোভা।দর্শনের গান শুনে মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে।এমন সময় বাড়িতে গাড়ির হর্ন বাজার শব্দ ভেসে আসে।দর্শন ভ্রুকুটি করে বাইরে আসতেই সাক্ষাৎ হয় দাদাজানের সাথে।দাদাজান আশপাশ দেখে জিজ্ঞাসা করেন,“ভূতের সঙ্গে সংসার করতে চাও আগে বলবে তো!ভুলেও তোমাকে দেশে ফেরত আনতাম না।শুধু শুধু আমার নাতবউয়ের কপাল পুড়লো।”
অবাক বিরক্তির সাথে বলে,“এসব কি বলছো তুমি?”
দাদাজান মুখ ভেংচে জানান,“এই ভূতুড়ে পরিবেশে কেউ থাকে?অবশ্য তোমার মত ছোকরা থাকে।”
দর্শন বিরক্তির সাথে দিজার দিকে ফিরে বলে,“দিদারের সাথে যখন এসেছিস দাদাজানকে সাথে আনতে গেলি কেন?”
দাদাজান চোখ বড় করে বলেন,“আমি এখানে থাকতে আসিনি ছোকরা।আমার নাতবউকে নিয়ে যেতে এসেছি।”
দিদার কপাল চাপড়ালো দিজা মুখ চেপে হাসে।দর্শন বিরক্ত প্রকাশ করে জানায়,“নিয়ে যেতে পারবে তো?”
“কেন পারবো না?”
“দেখি তোমার কত বড় ক্ষমতা।”
বাবুই পাখির সুখী নীড় পর্ব ৪৪
দাদাজান গলা উঁচিয়ে ধমকে বলেন,“হতচ্ছাড়া!লজ্জা করে না নিজের বউকে কিডন্যাপ করে আনতে?”
দর্শন নিজের সাহসিকতা দেখিয়ে বলে,“ফর ইওর কাইন্ড ইনফরমেশন,বউটা লিগ্যালি আমার।সো আমি আমার বউকে কিডন্যাপ করে হোক আর কোলে করে হোক যেভাবে ইচ্ছা আনতে পারি।এখানে লজ্জার কোনো স্থান নেই।”
দাদাজান হেঁচকি তুলে বলেন,“লজ্জাসরমের মাথা খেয়েছে দেখছি!”