বিন্দু থেকে বৃত্ত সারপ্রাইজ পর্ব
জাওয়াদ জামী
তাহমিদ মেডিকেলে পেসেন্টের ফাইল চেইক করছে। ও গতকাল রাতে মেডিকেলে এসেছে এখন দুপুর গড়িয়ে গেলেও বাসায় যেতে পারেনি। এদিকে গত কয়েকদিন থেকে কুহুর শরীরটা ভালো যাচ্ছেনা। মেয়েটার শরীর ফুলে গেছে বিছানা থেকে নামতেই পারছেনা।
বিছানা থেকে নামতে গেলে কারও সাহায্য লাগছে। সেজন্য কেউ না কেউ ওর পাশে থাকছে।
সকাল থেকে কুহু কয়েকবার তাহমিদকে ফোন করেছে। বাসায় যাওয়ার জন্য মেয়েটা জোড়াজুড়ি করছে। কিন্তু তাহমিদ নিরুপায়। ও ইন্টার্নী শেষ করে কয়েকদিন আগেই মেডিকেলে জয়েন করেছে। রেজাল্ট ভালো হওয়ায় এখানেই সুযোগ পেয়েছে। জোড় করে কুহুর চিন্তা মন থেকে দূর করে পেসেন্টের দিকে নজর দেয় তাহমিদ।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
নীরা নাস্তা নিয়ে কুহুর রুমে এসেছে। কুহু তখন হাত-পা ছড়িয়ে বিছানায় শুয়ে ছিল। নীরা এসে কুহুকে ধরে তুলে বসায়। এরমধ্যে তাহমিনা আক্তারও কুহুর রুমে আসেন। নীরা এবং তাহমিনা আক্তার মিলে কুহুকে ওয়াশরুমে নিয়ে যান। কুহু ফ্রেশ হলে, তাহমিনা আক্তার নিজ হাতে কুহুকে খাইয়ে দেন।
তাহমিনা আক্তার রুম থেকে বেরিয়ে গেলে নীরা কুহুর কাছে বসে থাকে।
তূর ওর সিক্তা ফুপির কাছে পড়ছে। নীরা কুহুর দেখাশোনায় ব্যস্ত থাকার কারনে তূরের খেয়াল রাখতে পারছেনা। তাই সিক্তা আপাতত তূরের দেখাশোনা করছে। তূর না পড়তে বিভিন্ন টালবাহানা করছে। কিন্তু সিক্তা সেসব পাত্তা না দিয়ে তূরকে পড়াতে থাকে৷
” ফুপি, তুমি বিয়ের পর আনান চাচ্চুর কাছে তো চলেই যাবে, এই কয়েকটা দিন আমাকে নিয়ে বেড়ালেই পার। শুধু শুধু পড়াশোনার পেছনে সময় নষ্ট করছ। তুমি তো জানোই পড়াশোনা করতে আমার মোটেও ভালো লাগেনা। তবুও তুমি জোড় কর। ” গাল ফুলিয়ে বলে তূর।
” আমি যে কয়দিন এখানে আছি, তোমার পড়াশোনায় নিস্তার নেই বুঝলে? আগে হোম ওয়ার্ক শেষ কর। কালকে তোমাকে বেড়াতে নিয়ে যাব। আর পড়াশোনা করতে কারোই ভালো লাগেনা, জোড় করে ভালো লাগাতে হয়। ”
” জোড় করে আয়ত্ত করানো কোন কিছুই ভালো নয় ফুপি। এতে মেধার ক্ষয় হয়। তুমি কি চাও, তোমার এই গুল্টুমুল্টু সোনাটার মেধা ক্ষয় হতে হতে ফুরিয়ে যাক? ” তূরের পাকা পাকা কথা শুনে সিক্তার চোখ কপালে উঠে।
” আমার ভুল হয়েছে, আমাকে ক্ষমা কর, মা। আর জীবনেও তোমাকে পড়তে বলবনা। এই বয়সেই এত পাকা, ভাবা যায়! মেধাও নাকি ক্ষয় হয়! আবার শেষে ফুরিয়েও যায়! শোন তূর সোনা, তোমাকে দেখে আমার বাচ্চা নেয়ার সাধ মিটে গেছে। ”
” তাহলে আনান চাচ্চুকে বল, তুমি বাবু নিতে চাওনা। এতে অবশ্য আমার মন খারাপ হবে। তোমার একটা মেয়ে বাবু হলে, আমি তার সাথে খেলতে পারতাম। ”
সিক্তা তূরের কথা যতই শুনছে ততই টাস্কি খাচ্ছে। এতটুকু বাচ্চা এরকম কথা বলতে পারে!
” আমি বাবু না নিলে আনানকে বলতে হবে কেন! তুমি বেশি কথা না বলে চুপচাপ হাতের লিখা শেষ কর। ”
” পাপার সাথে মাম্মার বিয়ে হয়েছে জন্যই মাম্মা পাপাকে বলেছে একটা ছেলে বাবু নিবে। আবার তাহমিদ চাচ্চু বউমনিকে বলে তার একটা প্রিন্সেস লাগবে। তোমার সাথেও তো আনান চাচ্চুর বিয়ে হবে, তাই তুমি বাবু না নিলে চাচ্চুকেই তো বলতে হবে। ”
এবার সত্যি সত্যিই সিক্তার মাথা ঘুরাচ্ছে। এই ডেঁপো মেয়ে বলে কি! পড়াশোনার বেলায় এই পুচকি লবডঙ্কা, কিন্তু পাকনা পাকনা কথার বেলায় ষোলআনা।
এমন সময় আনানের ফোন আসে।
” কি বলবে তারাতারি বলে ফেল। আমার মাথায় টর্নেডো হচ্ছে। ”
” তুই ও তোর বাপের মতই পট্টিবাজ, তা কি তুই জানিস? একটা অসহায় ছেলের ওপর তোরা বাপ-মেয়ে মিলে কম অত্যাচার করছিসনা, বুঝলি? নেহাৎই আমি ভদ্রলোক তাই। তাছাড়া তোর বাটের ভুঁড়ি কবেই ধ্ব’স নামিয়ে দিতাম। ”
” তুমি আবার উল্টাপাল্টা কথা শুরু করেছ? আমি আছি আমার জ্বালায়, আর তুমি আজাইরা বকবক করতে ফোন দিছ! আমার বাবা আবার তোমার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে , শুনি ? ”
” তোর বাপ কি কৃষক, যে পাকা ধানে মই দিতে যাবে! তোর বাপ হচ্ছে কাঁচামরিচ আর এলাচ । বিরিয়ানির মধ্যে কাঁচামরিচ আর এলাচ তোর বাপ। তার অ’ত্যা’চা’রে আমি বিরিয়ানির ভেতর অবাধে বিচরণ করতে পারছিনা৷ আমার সামনে বিরিয়ানি ছুটাছুটি করছে, আমি ধরতে গেলেই তোর বাপ এলাচ আর কাঁচামরিচ রূপে এসে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে। তুই জানিসইতো বিরিয়ানি আমার কত পছন্দের। একটা জলজ্যান্ত বিরিয়ানির মালিক হওয়া স্বর্তেও ছুঁতে পর্যন্ত পারছিনা। এই কষ্ট মানা যায়? ” আনানের কথা শুনে সিক্তা হো হো করে হেসে উঠে।
” লু’চু ছেলের মুখে কিছুই আটকায়না। এত অস্থির হলে চলবে? আর কয়েকটা মাস। তারপর বিরিয়ানি তোমার বাড়িতে, তোমার মাথার ওপর উঠে নাচবে। তখন মনপ্রান ভরে ছুঁইয়ো ” সিক্তা কথা বলতে বলতে ভুলেই গেছিল তূর ওর পাশে আছে।
এদিকে তূর মনযোগ দিয়ে ওদের কথা শুনছে। সে আনানের কথাও শুনতে পাচ্ছে।
তাহমিদ রাতে বাসায় আসলে কুহুকে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখল। কুহুর পাশে নীরা বসে আছে। কুহুর পাশে বসে তূর খেলছে।
নীরা অনেক পাল্টে গেছে। তাওহীদকে হারানোর ভয় ওকে বদলে দিয়েছে। সে এখন পুরোদস্তুর গৃহিণী। শ্বাশুড়িদের সাথে মিলেমিশে সব কাজ করে। দিদুনের খেয়াল রাখে। আবার কুহুরও যত্ন করে।
” কুহু, তোমার যত্ন নেয়ার মানুষ এসে গেছে। এবার আমার ছুটি। এই যে দেবর, তোমার বউ সহিসালামতে তোমার হাতে তুলে দিলাম। সব ঠিকঠাক আছে কিনা তা দেখেশুনে নাও। ” নীরা তাহমিদকে দেখে বলে।
” তোমরা থাকতে আমার চিন্তা কি। আমি ভালো করেই জানি, কুহুর যত্নে কোন ত্রুটি তোমরা হতে দেবেনা। ” তূরকে কোলে নিয়ে বলে তাহমিদ।
” তূরকে এখন কোলে না নিয়ে, যাও ফ্রেশ হয়ে এস। আমি খাবার দিয়ে যাচ্ছি। দুজন মিলে এখানেই খেয়ে নিও। তূর তুমি চলে এস। চাচ্চু খুব টায়ার্ড, তাকে এখন রেষ্ট করতে দাও। ” নীরা তূরকে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।
” বউ, তোমার শরীর ঠিক আছে তো? আমার প্রিন্সেস কেমন আছে? কাজের প্রেশারে তোমাদের খোঁজ নিতে পারিনি। কিন্তু মনটা সর্বদা তোমার কাছেই ছিল। ” তাহমিদ কুহুর পুরো মুখ চুমুয় ভরিয়ে দিচ্ছে।
কুহুও চোখ বন্ধ করে তার প্রিয় মানুষটির আদর উপভোগ করছে। সে তাহমিদের কথার কোন উত্তর দেয়না। জড়িয়ে ধরে তাহমিদকে।
বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে যায়। কুহু তাহমিদের বুকে মাথা রেখে বসে আছে। তাহমিদ ওকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে।
” বউ, এবার উঠি। ফ্রেশ হয়ে এসে তোমাদের সাথে সময় কাটাব। দেখেছ, কেমন ঘামে শরীর ভিজে গেছে? তোমার সমস্যা হচ্ছেনা আমার ঘর্মাক্ত শরীর দেখে? ”
” উঁহু, আমারতো এভাবে থাকতে বেশ লাগছে। আপনার ঘামের সাথে আমার কোন শ’ত্রু’তা নেই যে, আমার সমস্যা হবে। আপনি অযথা আমাকে ছাড়ানোর বাহানা খুঁজছেন। ”
” দূর, পা’গ’লি বউ আমার। যে আমি তোমার সাথে সারাদিন চিপকে থাকতে চাই, সেই আমিই তোমাকে ছাড়তে চাইব কোন দুঃখে! আমি শুধু চাচ্ছিলাম আগে গোসলটা সেরে নিতে। এরপর সারারাত তোমাকে বুকে জরিয়ে রাখব। যাতে আমার প্রিন্সেসের কোন অসুবিধা না হয়।” তাহমিদ কুহুকে আলতোভাবে ছাড়িয়ে উঠে যায়।
কুহু হাসিমুখে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে থাকে।
গোসল সেরে এসে তাহমিদ দেখল নীরা খাবার নিয়ে এসেছে। আর সিক্তা কুহুকে ধরে ঠিকঠাক বসিয়ে দিচ্ছে।
নীরা টি টেবিলে খাবারগুলো সাজিয়ে রাখছে।
” কিরে বুঁচি, কি খবর তোর? পড়াশোনা ঠিকমত করছিসতো? নাকি আনানের সাথে কথা বলে সময় নষ্ট করছিস? ”
” ভাইয়া, তুমি খুব ভালো করেই জান, আমি ফাঁ’কি’বা’জ নই। পড়াশোনা ঠিক রেখেই আর সবকিছু করি। ”
” কি করছিস সেটা রেজাল্ট হলেই দেখা যাবে। মনে রাখিস, রেজাল্ট একটুও খারাপ হলে বিয়ে দুই বছর পিছিয়ে দিব। ”
” চাচ্চু, জান আনান চাচ্চু বলেছে বড় দাদুর ভুঁড়িতে ধ্ব’স নামাবে। ” তূরের কথা শুনে সবাই ওর দিকে হা করে তাকিয়ে থাকে।
আর সিক্তাতো পুরাই শকড। ও ভুলেই গেছিল আনানের সাথে কথা বলার সময় তূর সেখানে ছিল।
” তূর, কি বলছো এসব! তুমি আজকাল মিথ্যা বলা শিখেছ দেখছি! ” নীরা একটু রে’গে বলে।
” আমি সত্যি বলছি, মাম্মা। তুমি ফুপিকে জিজ্ঞেস করে দেখ। আনান চাচ্চু বলেছে, দাদু নাকি বিরিয়ানির মধ্যে এলাচ আর কাঁচামরিচ। বিরিয়ানির মালিক হওয়া স্বত্বেও ছুঁতে পারছেনা। ”
তূরের কথা শুনে সিক্তার লজ্জায় মাটিতে মিশে যাওয়ার মত অবস্থা। সে একদৌড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়।
এদিকে কুহু, নীরা আর তাহমিদ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তূরের দিকে তাকিয়ে আছে।
হঠাৎই অট্রহাসিতে ফেটে পরে। এবার তাহমিদ আর কুহুও হেসে উঠে।
” ও বউ , তোমার ভাই দেখছি বিয়ে পাগল হয়ে গেছে! বিয়ের নেশায় আমার নিরীহ ফুপা শ্বশুরকেও ছাড় দিচ্ছেনা! আজকালকার ছেলেরা বিয়ের জন্য শ্বশুরের ভুঁড়িকেও ছাড়ছেনা! ”
কুহু রে’গে তাহমিদের দিকে তাকিয়ে আছে।
” আপনিও কম যাননা। আপনিও তো ফুপাকে কম বিরক্ত করেননা। তিনি ভালো মানুষ বলেই আপনার সব অ’ত্যা’চা’র সহ্য করেন। সব একেকটা ফাজিল। আমি আজকেই ফুপুকে ফোন করে তার ছেলে কীর্তির কথা বলব। ”
এদিকে নীরা হেসেই যাচ্ছে । ওদের রুমে হাসির শব্দ শুনে তাহমিনা আক্তার আর আফরোজা নাজনীনও আসেন৷
ঘুমের মধ্যেই কুহুর দম বন্ধ হয়ে আসছে। ওর হাঁসফাঁস লাগছে। ও হাঁচড়েপাঁচড়ে ওঠার চেষ্টা করছে। কিন্তু শক্তিতে কুলাচ্ছেনা। এবার মনে হচ্ছে মাথাটা ফে’টে’ই যাবে। ঠিক তখনই ঘুম ভেঙে যায় কুহুর ।
” উফ, এভাবে ধরে রেখেছেন কেন! বাঁধন একটু আলগা করুন। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ” কুহু তাহমিদকে ঠেলে সরিয়ে দেয়ার বৃথা চেষ্টা করে।
” বউ, এভাবে ধাক্কাধাক্কি করছ কেন? একটু ঘুমাতে দাও। আমি ভিষণ টায়ার্ড। আজ দুপুর পর্যন্ত ঘুমাব। ” ঘুম জড়ানো গলায় বলে তাহমিদ।
” আপনি দুপুর পর্যন্ত কেন, পারলে সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুমান। আপনাকে কে বারণ করেছে! শুধু আমাকে ছাড়ুন। ”
” তুমি ভালো করেই জান, তোমাকে জড়িয়ে না ধরলে আমার ঘুম হয়না। তাই কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ শুয়ে থাক। ”
” আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। এবারতো ছাড়ুন। শেষে দেখবেন, আপনার চাপে আমি চ্যাপ্টা হয়ে গেছি। ”
তৎক্ষণাৎ তাহমিদ কুহুকে ছেড়ে দেয়।
” এরকম আজেবাজে কথা আর যেন না শুনি। আমি জ্ঞানত তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনা, আর তুমি কিনা বলছ আমার চাপে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে! বেয়াদব মেয়ে, আমার ভালোবাসা বুঝলনা! ”
তাহমিদের রা’গ দেখে কুহু হাসে।
” আমাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যান। একটু মাথায় পানি দেব। ভিষণ গরম লাগছে। ”
তাহমিদ কুহুকে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে যায়। কুহু বেশ কিছুক্ষণ শাওয়ার ছেড়ে তার নিচে দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর তাহমিদ কুহুকে রুমে নিয়ে আসে। কাপড় পাল্টিয়ে, ভালোভাবে চুল মুছে দেয় কুহুর। এরপর বিছানায় আধাশোয়া করে পায়ের নিচে বালিশ দেয়।
” তুমি একটু এভাবে থাক। আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসছি। ”
তাহমিদ একটা আপেল কে’টে, নুডলস রান্না করে নিজের রুমে আসে।
” বউ, এবার এগুলো খেয়ে নাওতো। এরপর বেশি করে পানি খাও। দেখবে গরম কম লাগবে। আমি এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়েছি৷ ”
কুহু ভিষণ ঘামছে। জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে।
” আমি কিছু খাবনা। এসিটা আরেকটু বাড়িয়ে দিন। আমার মাথায় পানি দিন। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। ” কুহু নেতিয়ে পরেছে।
তাহমিদ কুহুর অবস্থা দেখে ভয় পায়। জোড়ে জোড়ে মা, বড়মাকে ডাকতে থাকে।
ঢাকা মেডিকেলের করিডোরে সবাই বিষন্ন বদনে বসে আছে। সবাই দোয়া-দরুদ পাঠ করছে। কুহুকে অপারেশন থিয়েটারে নেয়া হয়েছে। তাহমিদও সেখানে আছে। মেয়েটার শারীরিক অবস্থা ততটা ভালো নয়। হঠাৎ ওর হার্টবিট বেড়েছে, সেই সাথে প্রেশারও। কয়েক ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন।
কায়েস আর শিহাব রক্ত দিবে। আনান কয়েকজন বন্ধুকে এনেছে, যারা রক্ত দিবে৷
হঠাৎই অপারেশন থিয়েটারের দরজা খুলে তাহমিদ বেরিয়ে আসে। ও টলছে। তাহমিদকে দেখে আনান দৌড়ে তার কাছে আসে।
” ভাই, তুমি ঠিক আছ? এভাবে টলছ কেন? কুহু কেমন আছে? আর তুমি বাইরে আসলে কেন? ”
আফরোজা নাজনীন উদ্বিগ্ন হয়ে তাহমিদের কাছে আসেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।
” বড়মা, আমি কুহুকে ঐ অবস্থায় দেখতে পারছিলামনা। ওর খুব কষ্ট হচ্ছে। ” তাহমিদ আর কিছু বলতে পারেনা। ধপ করে মেঝেতে বসে পরে।
রাশেদিন পরিবারে খুশির আমেজ। পরিবারে আরেকজন নতুন সদস্য এসেছে। রাজকন্যা এসেছে তাদের পরিবারে।
মেয়েকে দেখে তাহমিদ খুশিতে কেঁদে দিয়েছে। কাঁপাকাঁপা হাতে মেয়েকে কোলে নিয়ে আদরে ভরিয়ে দিচ্ছে।
তাহমিনা আক্তার ছেলের কাছ থেকে নাতনিকে কোলে নেন।
তাহমিদ যায় কুহুর কাছে।
কেবিনের সাদা বিছানায় শুয়ে আছে কুহু। শরীরটা বিছানার সাথে মিশে আছে। চোখের নিচে কালি পড়েছে। বেদনা ক্লিষ্ট মুখে খুশির পরশ। ঠোঁটের কোনে প্রাপ্তির হাসি।
তাহমিদ বিছানার পাশে এসে উপুড় হয়ে চুমু দেয় কুহুর কপালে। এরপর বসে পাশে পেতে রাখা উঁচু টুলটায়।
” বউ, আজকে তুমি আমাকে পরিপূর্ণ করেছ। নিজেকে দুনিয়ার সব থেকে সুখী মানুষ মনে হচ্ছে। আজ তুমি আমার কাছে যা চাইবে তা-ই আমি তোমাকে দেব। বল তুমি কি চাও? ”
” আমি একটা সুখের সংসার চাই। যা আমার প্রথম থেকেই আছে। একটা দ্বায়িত্ববান স্বামী চাই। কিন্তু আমি তা পেয়েছি। আর কি চাই আমার! আমি আপনাকে পেয়ে পূর্ণ। আপনার সংসারে আমি সুখী। দুনিয়ার সকল সুখ আমাকে আপনি দিয়েছেন। আমার আর কিছু চাইনা। ”
তাহমিদ এবার কুহুর ঠোঁটে গভীর চুমু দেয়।
সানাউল রাশেদিন তার স্ত্রীর কোলে থাকা বাচ্চাটির দিকে পরম আবেগে তাকিয়ে আছেন। বাচ্চাতো নয় যেন একটা তুলতুলে ফুল।
” এই যে সিনিয়র ভদ্রলোক, আমার মেয়ের দিকে এভাবে বাজের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন কেন? দেখছেননা আমার মেয়েটা কেমন ভয় পাচ্ছে! বুড়ো হয়ে গেছেন তবুও আক্কেল হলোনা! নাকি আমার মেয়েকে দেখে আপনার হিং’সা হচ্ছে? “বুড়ো বয়সে আপনাকে কি ভীমরতিতে পেয়েছে! ”
” বাপ, আজকের দিনে তুই মানুষটার পেছনে এভাবে লাগিসনা তো। দেখছিস মানুষটা কত খুশি হয়েছে। তাকে এখন আর বিরক্ত করিসনা। ” আফরোজা নাজনীন হেসে তাহমিদকে বললেন।
” আগে সিনিয়র রাশেদিনকে জিজ্ঞেস কর আমার মেয়ের মুখ দেখে কি দিয়েছে? আমার মেয়েটা কি ফেলনা। যদি সে এমনি এমনি আমার মেয়ের মুখ দেখে তবে তার নিস্তার নেই। আমার বিয়েতে এই ভদ্রলোক ফাঁকি দিয়েছে। তাই বলে আমার মেয়েকেও ফাঁকি দেবে, এটা আমি মানবনা। ”
তাহমিদ কথা বলে শেষ করতে পারেনা, সানাউল রাশেদিন কার হাতের শপিং ব্যাগ থেকে একটা প্যাকেট বের করে আফরোজা নাজনীনের কাছে দেন।
” আফরোজা, এখানে ডায়মন্ডের সেট আছে, আমার নাতনির জন্য। এই উজবুককে দেখাও। ওর কলিজা ঠান্ডা কর। বেয়াদব ছেলে, আজও আমাকে সম্মান দিতে জানলনা! ” রেগে সানাউল রাশেদিন স্থান ত্যাগ করেন।
” দিলি তো মানুষটাকে রা’গি’য়ে। তুই আর শোধরালিনা। মেয়ের বাবা হয়েছিস, এবার একটু শোধরাবার চেষ্টা কর। ” আফরোজা নাজনীন হাসছেন।
কেবিনে সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে। নতুন অতিথিকে নিয়ে সবাই খুনসুটি করছে। নাজমা পারভিন, শাহনাজ সুলতানাও এসেছেন। তারাও ভিষণ খুশি।
কায়েস মেয়ের পাশে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।
সানাউল রাশেদিন নাতনিকে কোলে নিয়ে বসে আছেন।
” এই যে সিনিয়র রাশেদিন, বয়স তো শেষের দিকে চলে গেছে। এবার ছোট মেয়েটা একটা ব্যবস্থা করুন। তাছাড়া দেখবেন আনানের বাচ্চা কোলে নেয়ার ভাগ্য আপনার হবেনা। সিক্তার বিয়েটা তারাতারি দিয়ে দিন। অন্তত আপনার ভুঁড়ির জন্য হলেও ওদের বিয়ে দেয়াটা জরুরি।”
তাহমিদের কথা শুনে আনান বিষম খায়। আর সিক্তা লজ্জায় নিচে তাকিয়ে থাকে।
” ছোট ফুপু শ্বাশুড়ি, আপনার ছেলে আর ছোটটি নেই। তার বিয়ের বয়স হয়ে গেছে। ওর পড়া শেষ করার আশায় না থেকে, কুহুকে বাসায় নেয়ার পরই বিয়ের আয়োজন করুন। তাছাড়া দেখবেন ছেলের বিয়ের অনুষ্ঠান হলনা, কিন্তু নাতি/নাতনি নিয়ে ঠিকই ডাক্তারের কাছে দৌড়াচ্ছেন। ”
তাহমিদের কথা শুনে সবাই হাসছে।
আজ সিক্তার বিয়ে। কুহুকে বাসায় নিয়ে এসেছে সাতদিন হল৷
স্বল্প পরিসরে বিয়ের আয়োজন করা হয়েছে। তাহমিদের কথার মর্মার্থ বুঝেই সবাই বিয়েতে রাজি হয়েছে।
সিক্তাকে নীরা সাজাচ্ছে।
শিউলি আক্তার রুমের ভেতর ব’ন্দী জীবন কাটাচ্ছে। তার সেবাযত্নের জন্য দুইজন নার্সকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। তারা পালাক্রমে দিনরাত শিউলির দেখাশোনা করে।
সবুজের মামলার রায় হয়েছে। কয়েকটা মামলায় তার ত্রিশ বছরের জেল, জরিমানা হয়েছে ।সেই সাথে তার বাবা-মা’র ও জেল, জরিমানা হয়েছে।
সবুজের জেল থেকে বের হওয়ার সকল পথ রুদ্ধ করেছেন সানাউল রাশেদিন। বাকিটা জীবন ওকে জেলে কাটাতে হবে।
সিক্তাকে বিদায় দিয়ে আফরোজা নাজনীন কান্নায় ভেঙে পরেছেন। তার ছোট মেয়েটা বাড়ি মাতিয়ে রাখত। আজ সে-ই এ বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি মাতাতে রওনা দিয়েছে।
কুহু ঘুমন্ত মেয়ের পাশে শুয়ে আছে। তাহমিদ এসে মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে, কুহুর পাশে শুয়ে পরে। কুহুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। কুহুর কপালে, গালে, ঠোঁটে, কাঁধে চুমুতে ভরিয়ে দিচ্ছে।
” ভালোবাসি বউ, অনেক ভালোবাসি তোমাকে। সারাজীবন আমার বুকের মাঝে এভাবেই থেক। ” তাহমিদের গলায় নেশা।
” আমিও আপনাকে অনেক ভালোবাসি। সারাটাজীবন এভাবেই আপনার সাথে কাটাতে চাই। সিক্ত হতে চাই আপনার ভালোবাসায়। ভাসতে চাই আপনার প্রনয়ের সাগরে। প্রেমে মত্ত উড়তে চাই আপনার ভালোবাসার আকাশে। ”
” আমার ভালোবাসার আকাশ, সাগর সবই তোমার নামে। আমার ভালোবাসার অসীম গহব্বর তুমি ভরিয়েছ বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা দিয়ে। সেই অসীম গহব্বরের বৃত্ত তোমার ভালোবাসায় আজ পূর্ণ। ”
তাহমিদের বুকে চুপটি করে মিশে আছে কুহু।
” শেষ পর্যন্ত তোর বাপের ভুঁড়ি বাঁচল। তোর হিটলার ভাই অতটাও খারাপ নয়। আমার রুদ্ধ পথ কিভাবে ক্লিয়ার করে দিল। জয়, বউয়ের ভাইয়ের জয়। ”
বিন্দু থেকে বৃত্ত পর্ব ৫১
” তুমি কি ভালো হবেনা! আজ রাতেও তুমি আমার বাপ-ভাইকে নিয়ে পরে আছ! ”
আনান এক ঝটকায় সিক্তার দিকে তাকায়।
” আমি তো ভুলেই গেছিলাম আজ রাত আমার আর তোর। সরি বউ৷ তোর বাপ-ভাইকে নিয়ে না মাতামাতি করে বরং তোকে নিয়েই করি। আজ বিরিয়ানির মধ্যে আর কোন এলাচ, কাঁচামরিচ নেই। সলিড বিরিয়ানি আমার সামনে। তো এবার দূরে কেন! কাছে আয়। ”
আনান টান দিয়ে সিক্তাকে কাছে টেনে নেয়। শুরু হয় ওদের নতুন অধ্যায়।
অনেক অনেক সুন্দর একটা গল্প
পড়ে সত্যি অনেক ভালো লেগেছে
ধন্যবাদ আপনাকে এত সুন্দর একটা গল্প উপহার দেয়ার জন্য 🥰🥰