বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৫০+৫১
রোজা রহমান
শিশির বেলকোনিতে গিয়ে নিজের রাগকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। অল্পতেই হঠাৎ হঠাৎই তার রাগ উঠে যায়৷ এটা তার ছোট থেকেই হয়।
আসলে শিশিরের রাগটাও স্বাভাবিক আর তার বুঝটাও অস্বাভাবিক। সে একবার জিজ্ঞেস বা শুনে নিতে পারত কুয়াশার থেকে৷ কিন্তু তার স্বভাবত কারণে সে আবার এক ভুল করে ফেলেছে। সারাদিন পর বাড়িতে এসেছে। বাহিরে নিজের প্রয়োজনে রোদে রোদে ঘুরেছে এরপর আবার কুয়াশার জন্য চিন্তাও হয়েছে৷ নিজের লাইফের সাথে এখন কুয়াশার লাইফ জরিয়ে গেছে।
এখন না চাইতেও তার কুয়াশার কথা ভাবতে হয় কারণ সে তার বউ। বউয়ের অসুস্থ শরীর রেখে বাহিরে ছিল সারাদিন খোঁজখবর নেবার সময় হয়নি। বাড়িতে এসে একটু চোখের সামনে বউটাকে সুস্থ হতে দেখবে কিন্তু সে এসে বউকে ঘরে পায়নি এটাই আরো রাগের কারণ হয়েছে। সে তো সারাদিনের কথা জানতো না! ভুল মানুষ মাত্রই হয়৷ কিন্তু তার অস্বাভাবিক আচরণটা হচ্ছে সে পরেও শান্ত হয়ে জিজ্ঞেস না করে কঠিন কথা শুনিয়ে ফেলেছে৷ আসলে রাগ মানুষকে প্রচুর হিংস্র করে তোলে৷ রাগের মাথায় অনেক মানুষ অনেক কথা বলে ফেলে, খারাপ কাজ করে ফেলে আর সেটা যখন রাগ পড়ে যায় তখন বুঝে উঠে আফসোসের শেষ থাকে না। নিজের উপরই নিজের রাগ ওঠে তখন৷
হিংস্র রাগটা অতিরিক্ত ভয়ঙ্কর যা সংসার বলো আর জীবন বলো শেষ করতে খুব বেশি সময় নেই না। এই জন্য রাগ উঠলে সেটাকে কন্ট্রোল করার অদম্য শক্তি থাকতে হবে৷ যেটা রাগত মানুষের বিশেষ গুণ বলে গণ্য করা যাবে। তাহলে সব কিছু থেকে সমাধান পাওয়া যাবে৷ রাগ নামলে নিজের ভুল স্বীকার করতে হবে, সমাধান করতে হবে৷ রাগ থাকা ভালো কিন্তু সেটা পুষে রাখা ভালো না৷
শিশির রাগ করে, হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তবে ওর একটা বিশেষ গুণ আছে সেটা হলো পরে নিজের ভুল বুঝতে পারে। রাগ কন্ট্রোল করতে পারে। থাকে না কিছু মানুষ এমন যারা রেগে গেলে বাঘ আর রাগ পড়লে বিড়াল? ঠিক তেমন।
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর ফেলছে সে। এরপর হঠাৎ মস্তিষ্কে কিছু একটা বাড়ি দিল। আর সেটা ধারণ করতেই বুকের ভেতর কাঁচ ভাঙার ন্যায় টুকরো টুকরো হয়ে গেল। বুকের মাঝে জ্বালা শুরু হলো৷ তিব্র ব্যথা অনুভব হলো। চিনচিন করছে। সে যে রাগের মাথা কী বলে ফেলেছে কুয়াশাকে এখন বুঝে আসল তার। মেয়েটাকে সে ভালোবাসে, খুব ভালোবাসে। তা না হলে কী আর এখন কষ্ট বুঝতে পারত? কই আগে তো হয়নি এমন! আগে তো কত মে-রেছে আর বাজে কথাও বলেছে, খোঁটা দিয়েছে। সেগুলো কুয়াশা কখনো গায়েও মাখেনি। আর আজ সে কতগুলো খারাপ কথা বলে ফেলেছে যেগুলো আগের বলার থেকে অনেক আলাদা৷ এখন এগুলো বলা মানে কথার ধারা আলাদা। সম্পর্ক বদলেছে তাদের। এখন বউ সে তার। সব থেকে বড় কথা তার ভালোবাসা সে। রাগের মাথায় বলে দিয়ে কতটা কষ্ট দিয়ে ফেলেছে বউটাকে এখন বুঝতে পারছে।
নিজের উপর খুব রাগ উঠল। দু’হাতে নিজের চুল খামচে ধরল। রেলিঙের উপর ডান হাত দিয়ে বার কয়েক বাড়ি দিল জোরে জোরে। বুক ভারী হয়ে এলো। বউটা যে তার খুব আহ্লাদী! সেটা ছোট থেকেই। এটা নতুন কিছু না। একমাত্র মেয়ে সকলের কাছে আহ্লাদী হবে এটাই স্বাভাবিক। আরো হবে আহ্লাদী তার বউ। সকলের আহ্লাদীই থাকবে। তারও আহ্লাদী বউ তার কাছে আহ্লাদ করবে যত খুশি করবে। সে সহ্য করবে। তার একমাত্র আহ্লাদী বউয়ের আহ্লাদ সহ্য করবে না তো কী করবে? ভাবতে ভাবতে বুকটার উপর হাত দিয়ে বার কয়েক ডলা দিল। বউয়ের কষ্টের কথা ভেবে তারও কষ্ট হচ্ছে এখন। আরো কীভাবে ঝটকা দিয়ে তুলল! এমনিতেই বউটা তার অসুস্থ। লেগেছে নিশ্চয়ই? ভেবেই আর এক পলও থামল না। জানে শরীরে ঝড় বইবে তবুও যেতেই হবে৷ ঐ আহ্লাদীকে ছাড়া তার এক পল একটুও চলবে না।
ভালোবাসা মানুষকে কতকিছু করায় চিন্তা করা যায়! কখনো ভেবেছিল এই ছেলেটা যে, তার ভাষায় ঐ কুয়াশা নামক মেয়েটার জন্য সে-ও তড়পাবে? তার কষ্টে সে-ও বুকে ব্যথা অনুভব করবে? ভালোবাসা কতটা গভীর হলে একে অপরের কষ্ট নিজের বুকে অনুভব করতে পারে!!
কুয়াশা এসে মায়ের ঘরে নক করে। কোনো কথা বলেনি। শুধু নক করেই চলে৷ আজমিরা এসে দরজা খুলে মেয়েকে অস্বাভাবিক অবস্থায় দেখে। আৎকে ওঠে। হাজার কথা জিজ্ঞেস করে। শরীর বেশি অসুস্থ লাগছে কিনা জিজ্ঞেস করে। কিছুই বলে না মেয়ে। শুধু টপটপ করে অশ্রু ফেলে। এরপর মা’কে বহু কষ্টে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে বলে,
” আম্মু তোমার কাছে ঘুমবো একটু!”
আজমিরা কী বলবেন ভেবে পায় না৷ কিছু কী হলো? কিন্তু তার চিন্তার মাঝে মেয়ে তার বাবা বলে ডেকে ওঠে। আজমিরা বুঝে মেয়েটার বাবার কথা মনে উঠেছে৷ আজমিরা অস্থির হয়৷ জড়িয়ে ধরে মেয়েকে৷ আগলে নেয় বুকে৷ দরজার কাছ থেকে নিয়ে বিছানায় আসে। নিজে বসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে৷ তার বুকেও তোলপাড় হয়৷ এক মেয়ের কষ্ট দেখে দুই স্বামীর কথা ভেবে৷ স্বামী হারা সে, তার সন্তান তাদের বাবা হারা৷ এই পথ কী খুব সহজ? উহু অতিশয় কঠিন তা৷ যারা এই পথ পাড় করেছে, করে তারা একমাত্র এর মর্ম জানে, বুঝে, বুঝবে।
আজমিরা মেয়েকে নানান কথা বলে৷ সারামুখে চুমু আঁকেন। তবুও মেয়ে বুক ফাটা কষ্ট নিয়ে ফুঁপিয়ে চলে৷ গুমরে, ডুকরে কাঁদে। বাবা বাবা বলে ডাকতে থাকে৷ তার বাবা আসুক তার কাছে৷ এসে মেয়ের ছায়া হোক৷ আদর দিক। দায়িত্ব নিক৷ সে এখন খুব করে চাচ্ছে বাবাকে৷ কারো ঘাড়ে গচিয়ে দেয়া পাত্রী সে হতে চায় না৷ কথাটা ভাবতেই বুক ছিঁড়ে আসে৷ শরীর ভেঙে আসে৷ ব্যথায় কাতরাতে থাকে। মায়ের কোলে শুয়ে পড়ে। পেটে মুখ গুঁজে ফুঁপিয়ে চলে। বলে,
” আম্মু বাবা কেন চলে গেল আমাদের একা ছেড়ে? বাবা থাকলে আমরাও সকলের মতো চলতে পারতাম তাই না? বাবা আমাদের দায়িত্ব নিত। আমাদের ইচ্ছে পূরণ করত। আমরাও এই বাড়িতে জোর দেখাতে পারতাম, অধিকার নিয়ে মতামত দিতে পারতাম। ও আম্মু আল্লাহ আমাদের বাবাকে কেন নিয়ে গেল গো? আমার না বাবার কথা খুব মনে পড়ছে আম্মু। ছোট বেলায় বাবার কোলের মাঝে শুয়ে ঘুমাতাম না? ওরকম ইচ্ছে করছে এখন। বাবা আমার মাথা হাত রেখে ঘুম পাড়িয়ে দিতেন। আমার খুব মনে পড়ছে আম্মু। একটা বার যদি বাবাকে পেতাম আর যেতে দিতাম না৷ বিশ্বাস করো আর যেতে দিতাম না। কিন্তু বাবা তো না ফেরার দেশে আসবে কী করে? সেখানের ঠিকানা তো নেই। আম্মু, ও আম্মু! বাবা কেমন আছে সেখানে? ”
আজমিরা মেয়ের ভাঙা ভাঙা কথা শুনে, কষ্ট, অভিমান, অভিযোগ বুঝে ঝরঝর করে চোখের পানি ছেড়ে দেন৷ দম আঁটকানো কান্না করেন আঁচল চেপে ধরে। তিনিও যে প্রায় রাত স্বামীর জন্য চোখের পানি ফেলেন৷ জীবনের যৌবন কালের মাঝেই স্বামী হারা হোন। একা একা রাত পাড় করেছেন৷ দুঃখের সঙ্গী হিসেবে মাথায় কারো হাত পাননি রাতে৷ কেউ বলেনি,
” আজমী কেঁদো না আমি আছি তো।”
ভাবতে ভাবতে চোখের পানি ফেলেন আর মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। মেয়ে উনার ফুঁপিয়ে চলে।
শিশির দ্রুত পায়ে ঘরে এসে দেখে বউ নেই৷ বুঝল অভিমান খুব হয়েছে। কষ্টও খুব পেয়েছে৷ যথার্থ সেই কষ্ট, অভিমান৷ সে ভেবে চলে গেল আবার দ্রুত পায়ে। আহ্লাদী বউয়ের মান ভাঙাতে অনেক কাঠখোড় পোড়াতে হবে। দশটা না পাঁচটা না একটা মাত্র বউ তার, সেটাও আবার আহ্লাদী। ভেবে আপনমনে হাসল।
কিন্তু তার ঘরে না পেয়ে দেখল শাশুড়ীর ঘরের দিকে আলো জ্বলছে বুঝল মা’য়ের কাছে গেছে।
দরজা খোলায় আছে। ঘরের সামনে গিয়ে দেখল মায়ের কোলে মুখ গুঁজে ফুঁপাচ্ছে। মা-মেয়ে দুটোই কান্না করছে। কুয়াশা বাবা বাবা করছে। যা বুঝার বুঝে গেল। বউ, শাশুড়ী তার দু’টোই পাগলী। কোনো কথা না বলে ঘরে ঢুকে বলল,
” ছোট আম্মু..! একটু গরম পানি আর এক কাপ কফি করে দাও না! ”
শিশিরের কন্ঠ পেয়ে আজমিরার সংবিৎ ফিরল। তিনি খেয়ালই করেননি। তড়িঘড়ি করে চোখের পানি মুছলেন। তাকালেন শিশিরের দিকে। বললেন,
” মেয়েটা এসেই বাবা, বাবা করে কান্না শুরু করেছে রে৷”
” তুমি গরম পানি আর কফি করে দাও আমি দেখছি।”
কুয়াশা সবই শুনল। কোনো প্রতিক্রিয়া করল না৷ মুখ গুঁজেই রাখল৷ শিশিরের কথা শুনে আজমিরাকে আরো জোর দিয়ে জড়িয়ে ধরল। আজমিরা বললেন,
” ছাড় মা, কফি করে আনি। ”
বলে জোর করে ছাড়িয়ে উঠে পড়লেন। শিশির সবটা দেখল। বলল,
” আমাদের ঘরে এনো। ”
আজমিরার শিশিরের আমাদের ঘর বলাটা ভালো লাগল। সম্মতি দিয়ে চলে গেলেন। কুয়াশা অন্য মুখো হয়ে বিছানায় মুখ গুঁজে পড়ে রইল। আজমিরা যেতেই শিশির এক পলও দেরি করল না। তৎক্ষনাৎ অতি সাবধানে কোলে তুলে নিল বউকে। কুয়াশা কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। ফুঁপিয়ে আবার কেঁদে দিল। শিশিরকে ধরলও না পর্যন্ত৷ শিশিরের বুকটা ভারী হয়ে এলো। কুয়াশাকে গুমরে কাঁদতে দেখে তারও মুখ, চোখ লাল হয়ে গেল। নিজের উপর রাগ হলো। কতটা কষ্ট পেয়েছে যে বাবা, বাবা বলে কাঁদছে? এতটায় আঘাত লেগেছে যে বাবার অপূর্ণতা টের পেয়েছে! ভেবেই বুকের সাথে চেপে ধরল বউকে৷ আগলে নিল তার আহ্লাদী বউকে। ঘর থেকে বেরিয়ে এলো।
কুয়াশা ফুঁপাতে ফুঁপাতে নিজের কষ্ট, যন্ত্রণা, শরীরের ব্যথা, ক্ষোভ, অভিমান, অভিযোগ এই সমষ্টি জিনিস শিশিরের কাঁধের উপর ঝারল। শিশিরের কাঁধের উপর দাঁত বসিয়ে দিল। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে কামড় দিয়ে ধরে রাখল। শিশির হাঁটতে হাঁটতে সেটা সাদরে গ্রহণ করল। কোনো প্রতিক্রিয়া করল না। সে জানে তার বউয়ের রাগ হোক আর অভিমান হোক কামড়ানোর স্বভাব আছে। কামড়ের মাধ্যমে তা নিরাময় করে। কামড় দিয়ে ধরেই রাখল সে। দাঁতে দাঁত চেপে সেই ব্যথা হজম করছে শিশির। কুয়াশা ছাড়ল না। শিশির হাঁটতে হাঁটতে কামড় দিয়ে ধরে রাখা কুয়াশার কপালে চুমু আঁকল গভীর একটা। কুয়াশা এবার দাঁত আলগা করে দিল। কামড় দেয়া বন্ধ করে সেখানে ওভাবেই মুখ রেখে ডুকরে উঠল। শিশির দ্রুত পায়ে এসে দরজা দিয়ে বউকে নিয়ে শুয়ে পড়ল। অতিরিক্ত লাইট বন্ধ করে দিয়ে ল্যাম্প দিল৷
কোলের মাঝে বুকের সাথে চেপে ধরল। কপালে চুমু দিল ঠোঁট দাবিয়ে। বলল,
” এ্যাই আহ্লাদী বউ..! স্যরি!”
কুয়াশার কোনো রেসপন্স নেই। সে নিরবে বুকে মুখ গুঁজে পড়ে রইল৷ সে আবার বলল,
” বলেছিলাম তো, আমিই মা-রব আমিই আদর করব! শাসনও আমিই করব। সব অধিকার আমার। ”
কুয়াশা কথা বলল না৷ ফুঁপিয়ে চলল৷ শাসন করা এক জিনিস আর মনে আঘাত দিয়ে কথা বলা এক জিনিস। তার কোনো কথা না পেয়ে শিশির আবার বলল,
” সোনা…! ওরকম বলতে চাইনি আমি। বিলিভ মি, রাগের মাথায় বলে ফেলেছি৷ ভুলে যা সোনা৷ আর কখনো বলব না৷ ”
কুয়াশা আবার ডুকরে উঠল। শিশির এবার কুয়াশার মুখ তুলে সারা মুখে ছোট ছোট চুমু দিয়ে ভরে ফেলতে লাগল। বলল,
” এ্যাই, আমার সোনা! আর কাঁদিস না লক্ষ্মীটি। আমার আহ্লাদী বউ-ই তুই থাকবি। আমার কাছেই আহ্লাদ করবি। আমি মাথা পেতে নেব, সহ্য করব সব। আমিই তোর সব। বাবার অপূর্ণতা কেন মনে করবি তুই? আমি আছি না?”
সারামুখে চুমু দিল কিন্তু কুয়াশা বরফের মতো পড়ে রইল৷ কোনো রেসপন্স দেখাল না৷ উপরে আদর দিয়ে কী হবে? লেগেছে তো তার ভেতরে! শিশির কুয়াশার পানি পড়তে থাকা বন্ধ চোখের পাতায় চুমু আঁকল। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
” সোনা স্যরি তো রে..! ”
কুয়াশা এবার চোখ খুলে তাকাল। লাল ফুলে ওঠা চোখ। নাকের ডগা ফুলে ফুলে উঠছে। লাল হয়ে আছে। ফুঁপানির জন্য ঠোঁট কাঁপছে। শিশির দেখল সব। চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ থেকে গল গলিয়ে পানি ফেলতে ফেলতে বলল,
” আমাকে তোমার ঘাড়ে গচিয়ে দিয়েছে সকলে?”
ভাঙা ভাঙা স্বরে দম আঁটকানো কন্ঠে বলল। শিশির তা শুনে কুয়াশার সারা মুখে, চোখে গাঢ়ভাবে অবলোকন করল একবার করে। করে তৎক্ষনাৎ কুয়াশার ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। ঠোঁট ডুবিয়ে অনেকটা সময় নিয়ে ধরে রেখে গভীর,গাঢ় একটা চুমু খেল। কুয়াশা কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। না নড়ল আর না কথা বলল। শিশির ঠোঁট ডুবিয়ে রেখে কুয়াশাকে দু’হাতের বন্ধনীতে বন্ধ করে বুকের সাথে চেপে ধরল। যেন আজ কুয়াশাকে বুকের ভেতর ঢুকিয়ে নেবে।
কিছুক্ষণ পর ছেড়ে দিয়ে কুয়াশার গাল বরাবর হাত রেখে তা স্লাইড করে কানের পাশে নিয়ে গেল। বলল,
” না, সোনা। আমি রাগের মাথায় বলে ফেলেছি। সারাদিন বাহিরে ছিলাম এতটা ব্যস্ত ছিলাম তোর খোঁজও নিতে পারিনি। ভেবেছি বাড়িতে গিয়ে দেখব৷ এসে তোকে ঘরে না দেখে রাগ উঠে গেছিল। আমি কত করে মানা করে গেলাম৷ তবুও তুই হাঁটাচলা করেছিস৷ এইজন্য রাগ উঠেছে। তোর ভালোর জন্যই তো বলেছি না? আর ঐ কথাগুলো একদম রাগের মাথায় বলেছি৷ তোকে যদি তেমনি ভাবতাম তবে কী আমি মেনে নিতাম তোকে? ভালোবাসতে পারতাম? সোনা রে ভুলে যা ওসব৷ তোকে খুব ভালোবাসি।”
কুয়াশা কেঁপে উঠল শেষ বাক্য শুনে। আজ প্রথম শিশিরের মুখে ভালোবাসি শব্দটা শুনল। এতদিন কাজে-কর্মে ব্যাবহারে বুঝিয়েছে কিন্তু কখনো মুখে বলেনি। ছলছল নয়নে চেয়ে রইল শিশিরের দিকে। শিশির কপালে চুমু আঁকল। কুয়াশা বলল,
” উপরে ব্যথা পাইনি আমি। ”
” কোথায় লেগেছে? আমাকে বল! গালে? কোমড়ে লেগেছে আবার? ”
শিশিরের অস্থিরতাময় বাক্যে কুয়াশা হাত দিয়ে দেখাল। সে হাত তুলে তার বাম পাশের বুকের দিকে দেখাল। বাচ্চাদের মতো স্বামীর কাছে অভিযোগ করল,
” এখানে খুব খুব ব্যথা পেয়েছি।”
শিশির কুয়াশার হাত রাখা বুকের দিকে দেখে মুখের দিকে তাকাল। সত্যি কথাগুলো অতি কষ্টদায়ক একটা মেয়ের কাছে। এতটা অবুঝ যে কী করে হয়ে গেল সে! নিজেকে একটু কন্ট্রোল করার প্রয়োজন ছিল। কুয়াশা ছলছল করে চেয়ে রইল। শিশির কুয়াশার মুখের দিকে চেয়ে থেকে কুয়াশা হাত রাখা বুকের উপর মুখ নামিয়ে নিল৷ আদর দিল সেখানে। চুমু আঁকল গাঢ় করে সময় নিয়ে গলার নিচের দিকে বুক বরাবর। কুয়াশা আবেশে চোখ বুজল।
শিশির আদর দিয়ে মুখ তুলল। আদুরে ভাবে বলল,
” ব্যথা সেরেছে?”
” অল্প। ”
তা শুনে আবার একই ভাবে আদর দিল সেখানে। মুখ তুলে আবার জিজ্ঞেস করল,
” এবার?”
” আরো একটু আছে। ”
শিশির এবার হেসে ফেলল শব্দহীন৷ এবার সে কুয়াশার সারা গলা, বুকে এলোপাতাড়ি চুমু দিল ছোট ছোট। কুয়াশা হাসল এবার। দীর্ঘ শ্বাস নিল। শিশির চুমু দিয়ে কুয়াশার মুখ অবলোকন করল। কুয়াশা লাজুক হাসল। সে বলল,
” সেরেছে ব্যথা? ”
কুয়াশা উপর নিচ মাথা ঝাঁকিয়ে উত্তর করল,
” হুঁ। ”
” আমার বউটার অভিমান গেছে?”
কুয়াশা উত্তর না করে শিশিরের গলা জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজল। শিশির তার আহ্লাদী বউকে আগলে ধরল। প্রশান্তিময় শ্বাস ফেলল আর নিল। বুকটাও হালকা হলো। এতক্ষণ সেখানে ভারী হয়ে ছিল। কুয়াশা মুখ গুঁজে রেখে বলল,
” আমি হাঁটাচলা করি নি। সারাদিন শুয়ে ছিলাম। ভাবিদের সাথে গল্প করেছি। ভাবিরা চলে গেলে ও ঘরে গেছি শুধু হেঁটে। সেখানে শুয়ে উপন্যাস পড়ছিলাম। অনেক রাত হয়ে গেছিল তবুও তুমি আসছিলে না দেখে তোমাকে কল করব বলে এই ঘরে আসছিলাম ফোন নিতে। ফোন এখানে ছিল। কিন্তু তুমি তো বরাবরই না জেনে, না শুনে রাগ দেখাও৷ ”
শিশির শুনল সবটা। ভুল নিজের সে আগেই বুঝেছে। এ নিয়ে আর কথা বলল না। কুয়াশার মাথার উপর চুমু আঁকল।
সেসময়ে আজমিরার ডাক কানে এলো। শিশির উঠে লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলল। আজমিরাকে ভেতরে আসতে বলল। আজমিরা ভেতরে ঢুকে কফি সহ গরম পানির পাত্রটা রাখলেন। জিজ্ঞেস করলেন শিশিরকে,
” ব্যথা কী আবার বেড়েছে? ”
” হু, গুঙাচ্ছিল ”
” কবে যে সারবে মেয়েটার অসুখ। ”
বলে পাশে বসলেন৷ হাত বুলিয়ে দিলেন মাথায়। কুয়াশা উপর হয়ে শুয়ে চোখ বন্ধ করে ছিল৷ মায়ের হাত পেয়ে তাকাল। আজমিরা বললেন,
” ঠিক হয়ে যাবে মা, কাঁদিস না। একটু ভুগতে হবেই। ”
কুয়াশা কিছু বলল না। শিশির কফি খেতে খেতে হট ওয়াটার ব্যাগে গরম পানি ঢালল৷ আজমিরা বললেন,
” আমি গেলাম। দরকার পড়লে আবার ডাকিস আব্বু। ”
” আচ্ছা। ”
শিশির সম্মতি দিতেই তিনি চলে গেলেন৷ শিশির আগের ন্যায় দরজা বন্ধ করে পাওয়ার লাইট বন্ধ করে দিল। কফিটা শেষ করে কুয়াশার পাশে বসে কোমড় থেকে জামা সরিয়ে সেঁক দিতে থাকল। কুয়াশা উপর হয়ে শুয়ে থেকেই চোখ বুঁজে রাখল৷ শিশির নিজের কাজ করতে করতে বলল,
” কুয়াশা! কিছু কথা বলছি মন দিয়ে শোন।”
কুয়াশা চোখ খুলে তাকাল৷ প্রত্যুত্তর করল না। শিশির বলা ধরল,
” কুশু, আমরা এখন স্বামী-স্ত্রী। আমাদের মাঝে সবই ঠিকঠাক হয়েছে। আমরা মেনে নিয়েছি একে অপরকে। ভালোবেসেছি একে অপরকে। এখন সংসার করব আমরা। সেই সংসার অনেক বিবাদ হবে, বিপদ-আপদ আসবে। সেসব দু’জনে মিলে ঠিক করার চেষ্টা করব। একান্তই না পারলে পরিবারকে জানাব। এক জায়গায় থাকতে গেলে হাজার ভালোবাসার সংসার হোক না কেন মান-অভিমান, বিবাদ সৃষ্টি হবেই, এটাই স্বাভাবিক। সেটা সব সংসারে হয়৷ আমাদের এই যে, যেমন আজ হলো! আমার দ্বারাই ভুল হলো! এমন ভবিষ্যতেও হবে কারো না কারো দ্বারা। তখন সে-সব আমরাই ঠিক করব। সে-সব কখনো পরিবারকে জানতে দিবি না বা পরিবারের কাউকে বলবি না। আমাদের সংসারের ঝামেলা আমাদের মধ্যই রাখবি।
পরিবার জানলে তারা কষ্ট পাবে৷ ভাববে হয়তো ভুল করেছেন তারা। স্বামী স্ত্রীর মাঝে পরিবার বা তৃতীয় ব্যক্তিকে ঢুকতে দিতে নেই। আমরা অতিতের হিংস্রতা, হিংসাত্মক নজর কাটিয়ে ভালোবাসতে শিখেছি। সংসার সাজাতে ব্যস্ত হয়েছি এসব এমনই চলবে। আর আমাদের স্বভাবগত ঝগড়া, চুলোচুলির কথা আলাদা। সেটা আগেও ছিল এখনো আছে। ভবিষ্যতেও হয়তো রয়ে যাবে। আজ যেমন ভুল আমি করলাম তোর দ্বারা হলেও একই ভাবে সমাধান করার চেষ্টা করবি। কিন্তু পরিবারকে জানাবি না। জানিস তো আমাদের পরিবারে বিবাদ জিনিসটা নেই! আব্বু, আম্মু খুব কষ্ট করেন এই পরিবারের মেলবন্ধন ঠিক রাখার জন্য। তুই এই বাড়িরই মেয়ে ছোট আম্মু তোর কষ্ট সহ্য করবে না। আর বাড়ির লোকও করবে না। তাই সবকিছু মেনে নিয়ে, মানিয়ে নেবার চেষ্টা করবি। আমি তোকে ভালোবাসার মতো বাসব, আমার কাছে আহ্লাদ করবি সব মানব কিন্তু ভুল পেলে আমি শাসনও করব। শাসন করার পর সব ভুলে আমার আদর নিবি তুই। এভাবেই সংসার করব, সংসার সাজাব আমরা।”
শিশির থামল। কুয়াশা তাকিয়ে রইল। জিজ্ঞেস করল সে,
” বুঝতে পেরেছিস আমি কী বোঝাতে চাইলাম? ”
কুয়াশা তাকিয়ে থেকে উঠে বসল। এগিয়ে এসে শিশিরের কোলের উপর বসে কোমড়ের দুই ফাঁকের মাঝে পা গলিয়ে দিয়ে শিশিরের মুখোমুখি বসল গলা জড়িয়ে ধরে। তা দেখে শিশির বলল,
” আরে সেঁক দেয়া হয়নি তো। ব্যথা করছে না আর?”
কুয়াশা সে কথার উত্তর করল না৷ দুই হাতে গলা জড়িয়ে শক্ত করে শিশিরকে জড়িয়ে ধরল। আহ্লাদী এখন আহ্লাদের ভোল ধরল। শিশির হাসল কার্বার দেখে৷ এক হাত সে-ও কুয়াশার পিঠ বরাবর রাখল৷ কুয়াশা শিশিরের শরীরের সাথে লেপ্টে থেকে আদুরে কন্ঠে বলল,
” আদর দাও। ”
” কতগুলো তো দিলাম!”
” হয়নি আমার। ”
শিশির হাসল। হট ব্যাগ রেখে সে-ও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল বউকে। কুয়াশা কিছুক্ষণ জড়িয়ে থেকে মুখ তুলে শিশিরের গালে চুমু খেল৷ শিশির হাসল৷ বলল,
” এটা কী সেই ঝগড়ুটে গোবর ঠাঁসা? যে আমার সাথে সারাদিন ঝগড়া করত? ”
কুয়াশা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল৷ বলল,
” এটা কী সেই খবিশ বুনো ওল যে সারাদিন আমার পিছে লাগার জন্য ছুতো খুঁজত? চুল ধরে চুলোচুলি করত? ”
” হ্যাঁ আমিই সে, চিনতে ভুল করেননি আপনি মিসেস শিশির কুয়াশা মালিথা। আপনি এখন সেই খবিশের ঝগড়ুটে বউ।”
কুয়াশা খিলখিল করে হেসে উঠল। বলল,
” তবে মিঃ শিশির মালিথা! আপনারও ভুলে যাবার কিছু নেই। আমিই সেই মেয়েটা যে এখন সেই গলা চুলকানোর গোডাউনের সারাজীবনের একমাত্র পার্মান্যান্ট রুগী। ”
শিশিরও হেসে ফেলল এবার শব্দ করে। কুয়াশা হাসছে শব্দহীন৷ দু’জন দু’জনের দিকে প্রগাঢ়ভাবে অবলোকন করছে হাসতে হাসতে। এক সময় দু’জনেই হাসি থামিয়ে একে অপরের ঠোঁট ঠোঁট ডুবিয়ে দিল। অধর চুম্বনে লিপ্ত হলো দু’জন। গভীর থেকে গভীরতর সেই চুম্বন।
এ মিলন মান অভিমান কাটিয়ে ওঠার সুখের মিলন৷ তারা মান অভিমান করেছিল সেটা নিজেরাই ঠিক করে নিয়েছে। পরিবারকে একচুল পরিমাণ বুঝতে দেয়নি। স্বামী স্ত্রীর মাঝে মান অভিমান থাকবে এটাই স্বাভাবিক। মান অভিমান না থাকলে কী সম্পর্কের গভীরতা বোঝা যায়? এই যে আজ যেমন শিশির তার গভীর ভালোবাসা বুঝতে পারল কুয়াশাকে কষ্ট দেবার পর তেমনি কুয়াশা শিশিরে ভালোবাসার গভীরতা টের পেল। এখন থেকে বুঝবে শিশির হাজার বকলেও ভালোবাসায় তার কমতি নেই। স্বামীরা কটু কথা বলবে এটা তাদের স্বামীগত অধিকার আর বউয়েরা সেই কটুবাক্য মেনে নিয়ে স্বামীর কাছে আহ্লাদী হবে এটা তাদের বউগত অধিকার। এভাবেই স্বামী স্ত্রী মান অভিমান করবে এবং তাদের মধ্যকার ভালোবাসা পরিমাপ করতে পারবে৷ একে অপরের থেকে দূরে যেতে পারবে না। এটাই স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার সম্পর্কের আসল রহস্য।
হ্যাঁ, এরাই তারা যারা সব সময় ঝগড়া, মা-রা মা-রি, চুলোচুলি করত। এখন তারা ঝগড়া, চুলোচুলির পর একে অপরকে আদর, ভালোবাসাও দেয়। তাদের সম্পর্কের মাঝে যে কতটা মিষ্টি, মধুর সম্পর্ক এসেছে! সেটা তারা নিজেরাও জানে না। ঝগড়া করুক, চুলোচুলি করুক আর মান অভিমান করুক দিন শেষে তারা একে অপরের পরিপূরক।
সময় এবং স্রোত বহমান। দেখতে দেখতে সেকেন্ড, মিনিট, ঘন্টা পেড়িয়ে একের পর এক দিন চলে যায়। মানবজীবনের দৈনন্দিন কাজের মধ্য দিয়ে চলতে থাকে একের পর এক একটি দিন। তেমনিভাবে মালিথা ভিলা প্রত্যেকটি সদস্যের জীবনে চলে গেছে কয়েকটা দিন। প্রতিনিয়ত চলতে থাকা নিয়মের মাধ্যমেই দিনগুলো পাড় হয়েছে তাদের। শিশির, কুয়াশার নিয়ম মাফিক ঝগড়া আর ভালোবাসা দিয়ে চলে গেছে কয়েকটাদিন। আগামীকাল থেকে শিশিরের পরীক্ষা। সে বউয়ের বর্তমান দায়িত্ব সহ ভবিষ্যতের দায়িত্ব নেবার তোড়জোড় করছে। এখন দায়িত্ব পালন করছে বউয়ের ভালো মন্দ খেয়াল রেখে, অসুস্থতার সেবা করে। আর ভবিষ্যত দায়িত্ব নেবার জন্য ক্যারিয়ারের পেছনে পড়েছে। দুই কাজ সে সুন্দরভাবে সামলাচ্ছে।
কুয়াশার এই কয়দিনে ব্যথাটা কমে গেছে। এখন আর ব্যথা আসে না। তবে খুব বেশি হাঁটা চলা করেনা। শিশিরের শাসনে সে তিড়িং বিড়িং করতে পারে না। নিচে এই কয়দিনে সে নামে নি। ঘরে থেকে থেকে তার মন মস্তিষ্ক খিটখিটে হয়ে গেছে। সেটার জন্য শিশিরকে আচ্ছা মতো ধুয়ে দেয়। তাতে শিশিরের কোনো পাত্তা পায়না। তার বকবক করার দরকার সে করে ওদিকে তার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। বাড়ির সদস্যরা এসব দেখে হেসে কুটিকুটি হয়। মাশাআল্লাহ বলতে দ্বিধাবোধ করে না। তাদের সেই ছোট থেকে একে অপরকে খামচা-খামচি করা দুই হাম সেপাইরা আজ নিজেরা একে অপরের প্রতি যত্নশীল। মিষ্টি সম্পর্ক তাদের। তারা কোনো ভুল করেননি।
আজমিরা এসব দেখেন আর আলহামদুলিল্লাহ পড়েন। তার মেয়ের রাজ কপাল। চোখের সামনে বড় হওয়া ছেলেকে নিজের মেয়ের জন্য পেয়েছেন৷ জাকির, জাহিদ মালিথার কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে ভুলেন না।
শিশির গোসল করে বের হলো। দুপুর বারটা বেজে গেছে। জুম্মার নামাজে যাবে সে। ঘরে বিছানায় কুয়াশা বসে আছে। চোখ ছোট ছোট করে নখ খুঁটছে আর চেয়ে আছে। একটু আগে তার প্যানপ্যানানি বন্ধ হয়েছিল। শিশির বেরোতেই আবার শুরু হলো। শিশির চুল মুচছে আর হাঁটছে। শরীরে শধু সাদা পাজামা৷ শিশিরের অসহ্য ধরে গেল। চোখ মুখ কুঁচকে দিল একটা রাম ধমক। বলল,
” এ্যাই! সমস্যা কিরে তোর? সুখে খেতে ভূতে কিলাই তোরে?”
কুয়াশা কিড়মিড় করতে করতে বলল,
” আমি আমার মুখে বকবক করছি তাতে তোর কী?”
শিশির তুই বলতে শুনে রেগে গেল। এগিয়ে গিয়ে কুয়াশার মাথার উপর চাটি বসাল চুল ধরে টেনে দিল। বলল,
” তোর সাহস বেড়ে যাচ্ছে। তুই তুকারি করলে এখানে মেরে আধমরা করে হসপিটালে পাঠাব বেয়াদব! ”
কুয়াশা মাথায় লাগাতে ‘আহ্’ শব্দ করে চেঁতে উঠল। বলল,
” হ্যাঁ নিজের মতো শুধু পারো তো মা-রতে আর সিদ্ধান্ত চাপাতে। আমি বাইরে যাব বলছি সেটা কানে যাচ্ছে নাহ্ তোমার? ”
” তোকে ধরে রেখেছি আমি? তোর ইচ্ছে তুই যা আমাকে জিজ্ঞেস করতে আসছিস কেন? ”
এইযে এই একটা উত্তরই তিনি তখন থেকে দিয়ে যাচ্ছেন। তার যে এই উত্তরটা ত্যাড়াব্যাকা মাম্মি সেটা কী আর কুয়াশা বুঝছে না? অবশ্যই বুঝছে৷ যেতে দেবে না বলেই এমনভাবে বলছে। কুয়াশা বলল,
” এ্যাই তোমার ত্যাড়াব্যাকা মাম্মির কথার ধরণ রাখো তোহ্! ভালোভাবে যাবার কথা বলো। আমি কতদিন নিচে যাই না। তোমার একটু মায়া হওয়া উচিত ”
” আচ্ছা তাই? ”
শিশির কুয়াশার দিকে ঝুঁকে বলল কথাটা। সে আবার বলল,
” সকলে তোর ভালো চাচ্ছে বলে তোর আহ্লাদ বেড়ে যাচ্ছে নাহ্?”
এই কথার প্রেক্ষিতে কুয়াশা এবার আহ্লাদীর ভোল ধরল। সে শিশিরের নগ্ন শরীরটার কোমড় জড়িয়ে ধরল দু’হাতে। শিশির ভ্রু কু্ঁচকে মাথা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে নিয়ে কুয়াশার দিকে তাকাল। কুয়াশা মাথা উঁচু করল। তাকাল শিশিরের দিকে। শিশির ভ্রু কুঁচকে রেখে কিছুটা বিরক্ত ভাব মুখে ফুটিয়ে তুলে বলল,
” আহ্লাদ করে কি হবে? ”
” নিচে যেতে পারব।”
শিশির এবার না হেসে পারল না। কুয়াশার কথাতে শব্দ করে হেসে ফেলল। কুয়াশা তার চিবুক শিশিরে পেটের উপর ঠেকিয়ে রেখেছে। সেও মিটমিট করে হাসছে। আজ কাল তার স্বার্থ সিদ্ধি করার জন্য আহ্লাদী ভোল বেশ ভালোই ধরে সে। শিশির হেসে নিয়ে বলল,
” কত বড় ফাজিল এটা ভাবা যায়!”
কুয়াশা মুখটা আম সত্ত্বর মতো করে ফেলল৷ মাথাটা তুলে শিশিরের হালকা ভেজা নগ্ন লোমশ বুকের উপর চুমু দিল একটা৷ শিশির তাকিয়ে রইল। মনে মনে সে হাসছে। কিন্তু মুখে কাঠিন্যতা৷ কুয়াশা তাকিয়ে দেখল স্বামী তার এখনো গলে নি। সে আবারও চুমু দিল একই জায়গায়, একই ভাবে। তবুও গলল না শিশির। শিশিরই কী কম ভোল জানে? সেও বউয়ের এই ছোট ছোট আহ্লাদীপনা আদর নেবার জন্য একই রকম রইল। কুয়াশা আবার আরো একটা চুমু দিল। পর পর তিনটা চুমু দিয়ে এবার আগের ন্যায় শিশিরের পেটের উপর চিবুক রাখল। বলল,
” দাও না অনুমতি! আজই যাব আর যাব না৷ শুক্রবারের দিন সকলের সাথে বসে খাব। প্লিজজ? ”
শিশির বউয়ের দিকে তাকাল। চোখের দিকে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। এবার সে তোয়ালে বিছনার উপর রেখে একহাত কুয়াশার কাঁধে রাখল আর একহাতে কুয়াশার কানের পিঠে চুল গুঁজতে গুঁজতে বলল,
” যাহ্ গোসল করে নে৷ নামাজ থেকে এসে নিচে একসাথে বসে খাব।”
কুয়াশা শুনে আনন্দে হেসে উঠল৷ এই ছোট ছোট বিষয়গুলো খুব আনন্দ দেয়। কী সুন্দর মূহুর্তটা তাই না? বউ তার স্বামীর কাছে আহ্লাদ করে আবদার করল আর স্বামী তার বউয়ের আহ্লাদটা মানল, পূরণ করে দিল। এমনই তো করা উচিত। স্বামী স্ত্রীর মাঝের এই জিনিস গুলো কত্তো মধুর মিষ্টি হয় ধারণা করা যায়!
কুয়াশা আনন্দে আটখানা হয়ে উঠে দুই হাঁটুটে ভর দিয়ে বিছানার উপর থেকেই শিশিরের গলা জড়িয়ে ধরে টুপ করে গালে আরেকটা চুমু দিল। শিশির শব্দহীন হাসল বলল,
” ব্যাপার কী বলত? আজকাল তুই কামড়ের বদলে চুমু দিস কেন? মতিগতি কি তোর? ”
কুয়াশা গলা ছেড়ে দিয়ে মেকি রেগে উঠে ঝাঁঝ নিয়ে শিশিরকে কিছুটা ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে বলল,
” এ্যাই, সরো তোহ্! আর আদরই দিব না তোমাকে। মানুষের ভালো করতে নেই। হাহ্, আদর দিচ্ছি বলে তেল হয়ে যাচ্ছে! ”
বলে সে নামতে লাগল।
” এ্যাই, এসব কী ভাষা তোর? আর আদর দিয়ে আমার কী ভালো করছিস তুই? ”
” হ্যাঁ ভালো করছি না তো। সেই জন্যই তো নিজেও বউয়ের আদর নেবার জন্য ভোল ধরে থাকো, যত্তসব কুচুটে মার্কা লোক।”
উচিত কথা পেয়ে শিশির ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। কথাটা মিথ্যা না। তবুও দমল না সে। বলল,
” এ্যাই ফাউল! তোর আদর নেবার জন্য আমি শিশির মরে যাচ্ছি? ”
” হ্যাঁ মরবা কেন তুমি শিশির? মরছ না তোহ্! সে তো নিজে বিয়ের আগেও বলেছিল, ‘এ্যাই গোবর ঠাঁসা! তোকে বিয়ে করার জন্য আমি শিশির ম-রে যাচ্ছি?’ অথচ এখন এই আমার নেক স্মেল না নিলে তার ঘুম হয় না। যত্তসব ঢং! ”
কুয়াশা ঝগড়া করছিল আর জামা বের করছিল। জামা বের করে নিয়ে ধেই ধেই করে বাথরুমে ঢুকে গেল। ধারাম দিয়ে দরজা বন্ধ করল। শিশিরের ঘরে গোসল করে এখন আগে করত না। ও ঘর থেকে সব জিনিস না আনলেও কিছু প্রয়োজনীয় জিনিস আর কয়েকটা ড্রেস এনে রেখেছে।
এদিকে শিশির আহাম্মকের মতো চেয়ে রইল। মনে মনে একটা কথায় ভাবল,
” তার বউটা এত ঝগড়ুটে কেন? ”
বেচারা। কী সুন্দর বউটার আদর পেল অথচ আবার ধুয়ে দিয়েও গেল! কী একটা জ্বালা তার! বউ তার এই রোমান্টিক মুডে থাকে আবার তৎক্ষনাৎ ঝগড়ুটে মুডে চলে যায়। তার হয়েছে যত দুনিয়ার জ্বালা। বিরক্ত নিয়ে পাঞ্জাবি পড়তে পড়তে চেঁচিয়ে কিছুটা বাথরুমের কাছে গিয়ে বলল,
” ধেই ধেই করে চলছিস ভালো কথা। সিঁড়ি দিয়ে এমন ধেই ধেই করে নাচতে নাচতে নামতে গিয়ে আবার যদি কিছু ঘটিয়েছিস তো তোর খবর আমি শিশির নিজে করব এবার। মনে রাখিস!”
ওপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। শিশির নিজের প্রয়োজনীয় কাজ সেরে নিচে নেমে গেল।
দুপুর দুটো। নামাজ শেষ করে সকলে মাত্র এলো। আজ জাহিদ মালিথা নেই। তিনি এই সপ্তাহে আসেননি। মসজিদের জিলাপি হাতে সকলের। নীহার কুয়াশাকে ডাকল,
” কুশু..! ”
কুয়াশা নিচে ডাইনিং রুমে সেটা তারা দেখেই ডাকছে। জাকির মালিথা ডাকলেন,
” কুহেলি মা!”
কুয়াশা ডাক শুনে। দ্রুত পায়ে এলো। এসে দেখল জিলাপি। আগের সেই স্বভাব তার এখনো রয়ে গেছে। যেই সপ্তাহে জিলাপি আনবে চাচুরা, ভাইরা সেই চিলের ন্যায় দৌড় দেবে৷ সেটা আজও করল। যেই না দৌড়ে আসতে গেল ওমনি খেল ধমক। সেটা অবশ্যই শিশির দিয়েছে। ধমকে বলল,
” এ্যাই ফাজিল! দৌড়াচ্ছিস কেন ওমন? কোমড় আবার ভাঙতে সাহায্য করব আমি?”
কুয়াশা ধমক খেয়ে দমল একটু। জাকির মালিথা বললেন,
” ওরকম দৌড়াচ্ছিস কেন মা? আবার সমস্যা হবে। মেনে চল। ”
কুয়াশা সম্মতি দিয়ে শ্বশুরের হাত থেকে জিলাপি নিয়ে নিল। একে একে তুহিন, তুষার, নীহারের হাত থেকে নিল। কিন্তু শিশির তাকে আজোও জিলাপি দেয় না। এই জিনিসটার কোনো পরিবর্তন আনেনি সে৷ হিমও দেয় না৷ শিশির আর হিম আয়েশ করে সোফায় বসে খেতে লাগল৷ শিশির এক কামড় দিয়ে কুয়াশার দিকে তাকাল। সে তীক্ষ্ণ চোখে শকুনের ন্যায় শিশিরের জিলাপি ও জিলাপি খাওয়ার দিকে চেয়ে আছে। যেন এখন চিলের ন্যায় ছো মারবে। আর করলও তাই। শিশির মাত্র একটা জিলাপিতে এক কামড় দিয়েছে। দিয়ে সেটা চিবিয়ে মাত্রই আরেক কামড় দেবার জন্য ঠোঁটে ঠেকিয়েছে ওমনি কুয়াশা ঝড়ের বেগে এসে তুফানের ন্যায় কেঁড়ে নিল শিশিরের হাত থেকে জিলাপি। সকলে দেখে মিটমিট করে হাসছে। শিশির আহাম্মকের মতো চেয়ে রইল। কুয়াশা মুখ ভেঙচিয়ে শিশিরের খাওয়া জিলাপিটায় কামড় দিতে দিতে চলে গেল ডাইনিং রুমের দিকে। সে এখন জা’য়েদের সাথে বসে খাবে। বৃষ্টি ইয়াসমিন ডাইনিংয়েই আছে।
কুয়াশা এমন করেই এখন থেকে জিলাপি কেঁড়ে নেয়। শিশির দেবে না তো কী হয়েছে? সে তার অধিকার বুঝে নিতে যানে এবং নেয়ও। আগের মতো হলে কী এটা করতে পারত? নাকি শিশিরই মানত? চুল ছিঁড়া ছিঁড়ি বেঁধে যেত নির্ঘাত! বিয়ের পর থেকে কুয়াশা শিশিরের থেকে কেঁড়ে চুড়েই খায়। শিশির এটা নিয়ে কিছু বলে না। সে হয়তো চায় তার বউ তার উপর অধিকার খাটাক। অধিকার দেখিয়ে তার অধিকার বুঝে নিক।
একদিন এমন করাতে কুয়াশা জিলাপি কেঁড়ে নিতে নিতে বলেছিল,
” আমি যেমন তোমার অধিকার তেমন-ই তুমি এবং তোমার জিনিস আমার অধিকার। আর এই জিলাপি আমার অধিকারের অধিকার। ”
কথাটা মনে করে শিশির অমায়িক হাসল। বউটা তার কথার উপর মাত ভালোই দিতে পারে। দিবেই তো বউটা যে ভবিষ্যত লয়ার!
একে একে সোফায় বসল পুরুষগুলো৷ নীহার গিয়ে শিশিরের গা ঘেঁষে বসল। মিটমিট করে হাসতে হাসতে ফিসফিস করে বলল,
” তোর চালাকি আমি ধরে ফেলেছি বুঝলি! তুইও চাস কুশু তোর থেকে কেঁড়ে নিয়েই খাক। এই জন্য ওকে আগে থেকে দিস না। যদি তোর দেবার ইচ্ছে না থাকতো তো এতক্ষণ চুলোচুলি করতি দু’টো। ”
শিশির নীহারের কথাগুলো ওর দিকে তাকিয়ে শুনছিল। এবার কথাগুলো শুনে মুচকি হেসে সোফায় গা এলিয়ে দিল। কোনো উত্তর করল না। নীহার তার ভাইয়ের ভাব ভঙ্গিতে বুঝে গেল ওর কথায় সত্য। হাসল মুচকি নীহারও। কতটা পরিবর্তন সম্পর্ক ভাবা যায়! বিয়ের বন্ধন বলে কথা!
খাবার টেবিলে। বাড়ির তিন গিন্নি বাদে সকলে খাচ্ছে। বৃষ্টি, ইয়াসমিন, কুয়াশা সকলের সাথে বসেছে। বৃষ্টি, ইয়াসমিন এখন সময় অসময়ে সকলের সাথে বসে খায়। কুয়াশা এখন আগের মতো মেয়ে হিসেবে বেশি চলে না। সে নিজে থেকেই চলে না। ভালোবাসা, আদর এক থাকলেও সে নিজেকে এই বাড়ির বউ মনে করে। তাই দুই জা’য়ের সঙ্গে বেশি তাল মিলায়। তার জ্ঞানবোধ সত্যি আলাদা৷ সে চায় আর দুটো জা যেন এসব নিয়ে মন খারাপ করতে না পারে। তার প্রতি ধারণা যেন না পাল্টায় যে, সে-ও তো এখন এই বাড়ির ছেলের বউ। তার কদর এত কেন এ বাড়িতে তাদের থেকে? এমন ধারণা পাল্টানোর জন্যই কুয়াশা নিজেকে বাড়ির বউয়ের মতোই রাখার চেষ্টা করে। তবে মেয়ের মতো সকলে এখনো দেখলে বৃষ্টি, ইয়াসমিন এ নিয়ে কখনো কিচ্ছু মনে করে না। তারা বুঝে কুয়াশা সর্ব প্রথম এই বাড়ির একমাত্র মেয়ে ছিল এখন বউ হয়েছে। কুয়াশার বিষয়টা একদম আলাদা৷ কুয়াশার জন্য তাদের ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। শ্বশুর,শাশুড়ীরা যথেষ্ট আদর করেন তাদের। আসলে বৃষ্টি, ইয়াসমিনের মতো জা, বউ, ছেলেবউ, ভাবি পাওয়াটাও ভাগ্যার বিষয়।
খাবার সময় আজ কাল কুয়াশা শিশির এক জায়গাতেই পাশাপাশি বসে। আজ শুক্রবার নিয়ম মাফিক ভালো ভালো সুস্বাদু খাবার রান্না হয়েছে। খাসির মাংস, মাছের মাথা তো আছেই সেই সাথে। যেগুলো শিশির কুয়াশার পছন্দের। এখনো এই বাড়িতে দুইটা করে মাথা রান্না হয়৷ কারণ এরা ভালোবাসার ভাগ দিতে রাজি সবতারই ভাগ দিতে রাজি কিন্তু মাছের মাথার ভাগ দিতে একদম নারাজ। মূলত প্রিয় খাবারের থেকে দু’জন দু’জনের ভালোবাসা দূরে রাখে। খাবারের কাছে কোনো আত্মীয়তা চলবে না। নিজেদের পছন্দের খাবারে এক চুল পরিমাণ ভাগ দিতে নারাজ তারা। এটা নিয়ে একদিন বেঁধেছিল। জাকিয়া কী মনে করে যেন একটা মাথা রেখেছিল। ওমনি শুরু হয়ে গেছিল। সেটা বেশি দিনের ঘটনা না অবশ্য। যায়হোক আজ আবার টেবিলে খাসির মাংস নিয়ে কাঁড়া-কাঁড়ি চলছে।
জাকির মালিথা সহ সকলে ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। এদের এই অভ্যাস কী জীবনেও যাবে না? আজমিরা ধমক দিলেন কুয়াশাকে। কুয়াশা ধমক খেয়ে বিরক্তিতে ভ্রু কু্ঁচকে খাবারে মন দিল। মনে মনে ভেবে রাখল ঘরে গিয়ে হবে এটার শেষটুকু অর্থাৎ যুদ্ধ।
কেটে গেছে আরো সপ্তাহ খানেক। শিশিরের নির্বাচনী পরীক্ষা চলছে৷ সে পড়াশুনো নিয়ে একটু ব্যস্ত। এদিকে কুয়াশারও পরের মাস থেকে সাময়িক পরীক্ষা।
আগামীকাল শিশিরের পরীক্ষা আছে। রাত এগারটা। কুয়াশা নিজের পড়া পড়ে এসে শুতে এলো। সে শুয়ে শুয়ে টুকটাক পড়াশুনো করছে বাড়িতেই৷ কলেজে যায় না। স্মৃতি, ঈশার থেকে নোট’স নিয়ে নেয়। স্মৃতিরা দুইদিন করে এসে কুয়াশাকে দেখে গেছে।
ঘরে এসে দেখল শিশির ঘাড় ম্যাসাজ করছে। হয়ত বসে থাকতে থাকতে ঘাড় ধরেছে। কুয়াশা এগিয়ে এসে তার নরম, কোমল হাতে আঙুল দিয়ে বিনা বাক্যে ঘাড় সহ পিঠ ম্যাসাজ করতে লাগল। একজোড়া কোমল, চিকন ছোট ছোট হাতের স্পর্শ নিজের ঘাড়ে পেয়ে শিশিরের হাত থেমে গেল। সে পিছন ঘুরে দেখল কুয়াশাকে। কুয়াশা অমায়িক হাসল৷ শিশির বলল,
” শুয়ে পর তুই। দাঁড়িয়ে থাকতে হবে না। ”
সে কথার উত্তর করল না৷ ম্যাসাজ করতে করতে বলল,
” কফি খাবে? ”
” তোকে অত পাকনামি করতে হবে না। এখনো সম্পূর্ণ দুই সপ্তাহ হয়নি। অত সিঁড়ি ভেঙে নামতে হবে না ঘুমো গিয়ে। ”
” এত বেশি কথা বলো কেন? বসো আমি আম্মুকে দিয়ে বানিয়ে আনছি ।”
বলে চলে যেতে নিলে শিশির আঁটকে দিল। বলল,
” লাগবে না।”
বলে হাত ধরে কোলের উপর বসাল৷ সে চেয়ারে বসে। কুয়াশা বলল,
” কফি খেলে ভালো লাগত। অনেক রাত জাগো।”
” মাঝে মাঝে অবাক হই ভিষণ রকম। যে এটাই কী সেই কুয়াশা নাকি আমি ভুল বাড়িতে ঢুকে পড়ি রোজ রোজ? ”
কুয়াশা খিলখিল করে হাসল৷ শিশিরের নাকে নাক ঘষে ছোট্ট একটা কামড় দিয়ে বলল,
” আমার নিজেরও তাই মনে হয়। যে এই বাড়িতে মনে হয় আমি ভুলে বসবাস করছি। ”
শিশির নিঃশব্দে হাসল। মানতে তারও দুই একসময় কষ্ট হয় যে এই মেয়েটার সাথে সে এখন সংসার করছে? যাকে চুল পরিমাণ সহ্য হতো না! ভেবে আপনমনে আবার হাসল৷ সময় কথা বলে কিনা!
সে কুয়াশার কপালে চুমু দিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” এ্যাই..! কবে সুস্থ হবি রে তুই? ”
কুয়াশা শিশিরের কথার মর্মার্থ বুঝে বুকে কপাল ঠেকিয়ে দিল৷ লজ্জা মাখা হাসি দিল লুকিয়ে৷ বলল,
” সুস্থ আমি। অথচ তোমার কাছে অসুস্থ। এত ভালোবাসলে কেন আমায়! ”
শিশির মুচকি হাসল। আগের ন্যায় স্বরে বলল,
” আরো সুস্থ হ। সে দিনের অপেক্ষা করছি। ”
কুয়াশা ভ্রু কুঁচকে তাকাল মাথা তুলে। শিশির হাসল। বলল,
” যাহ্ শুয়ে পর। ”
” তুমিও শুবে চলো। ”
” আসছি একটু পর। ”
কুয়াশা নেমে গিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় কাজ সেরে গিয়ে শুয়ে পড়ল। শিশির আরো কিছুক্ষণ পড়ে উঠে পড়ল৷ লাইট অফ করে কুয়াশকে কাছে টেনে নিয়ে শুয়ে পড়ল। কুয়াশা ঘুমই এসে গেছিল। শিশিরের স্পর্শ পেয়ে ঘুম হালকা করে শিশিরের হাতের উপর হাত রাখল। সে কুয়াশার গলার মাঝে মুখ গুঁজে রেখেছে। কুয়শার এটা কেন যেন শিশিরের সাথে সাথে নিজেরও অভ্যাস হয়ে গেছে। একদম বদ অভ্যাস যাকে বলে।
কেটে গেল আরো কয়েকটা সপ্তাহ। মাসের নামও পরিবর্তন হয়েছে। অক্টোবর মাসের অর্ধেক হয়ে এসেছে। কুয়াশার পরীক্ষা চলছে। তিনটা হয়ে গেছে।
সকালের খাবার খেয়ে শিশির, কুয়াশা চলে গেল পরীক্ষা দিতে। শিশিরের পরীক্ষা আজ হয়ে গেলে থাকবে আর একটা।
বিকেল সাড়ে চারটার দিকে শিশির আর রিজভী পরীক্ষার হল থেকে বের হলো। দু’জনে বেড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছে। কিছু ইম্পরট্যান্ট কথাও বিনিময় করছে৷ কথার মাঝে রিজভী পকেট থেকে ফোনটা বের করল। পরীক্ষার হলে ফোন সাইলেন্ট রাখে। এখন জেনারেল মোড করার জন্য ফোনটা বের করল। আর বের করে ফোনটা অন করতেই ফোনের স্কিনে তাকাতেই ভ্রু কুঁচকে গেল। শরীরও ঝাকানি দিল। ফটাফট ফোনের লক খুলতেই আকাশ ভেঙে পড়ল যেন তার মাথায়৷ শরীরে কিছু একটা চাপা পড়ল। বুকে কিছু একটা বাড়ি দিল।
শিশিরও রিজভীর ফোন বের করতে দেখে ওর ফোনও জেনারেল মোডে দেবার জন্য বের করতেই তার ভ্রু কুঁচকে গেল। লক খুলতেই সে-ও হতবাক হয়ে গেল। কুয়শা, নীহারের কল, মেসেজে ভর্তি! তড়াক বন্ধুর দিকে তাকাল। যা ভেবেছে তাই। ডেকে উঠল বন্ধুকে,
” রিজভী..! ”
রিজভী চোখ তুলে তাকাল। নির্জিব চোখ তার। ছলছল করছে যেন। ফ্যালফ্যাল করে তাকাল। শরীর ভেঙে আসছে তার। শিশির তড়াক করে রিজভীকে আগলে ধরল। রিজভী বিরস বদনে ডেকে উঠল,
” দোস্ত! ”
” কিছু হবে না। আমি আছি তো তোর সাথে! সব হ্যান্ডেল করব আমরা। চল আমার সাথে।”
বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৪৮+৪৯
রিজভী কিছুই বলতে পারল না। তার মাথায় শুধু একটা জিনিসই বাড়ি দিচ্ছে। শিশির তৎক্ষনাৎ নীহারকে ফোন করে বলে দিল কুয়াশাকে নিয়ে আসতে। আর বাইকে ওঠার আগে তুষারকে বলে সব বুঝিয়ে রাখল। প্রয়োজনে আইনের ব্যবস্থা নেবে তবুও বন্ধুকে কষ্টের ভাগিদার হতে দেবে না৷ তার একমাত্র কলিজার টুকরো বন্ধু। ছোট থেকে একসাথে। বন্ধুর থেকে ভাই বললেও কম হবে। সেই বন্ধুর জন্য সে সব করতে পারবে। তার বিপদে আপদে সব সময় এই বন্ধুকে পেয়েছে সে।
শিশির বলল,
” দোস্ত নিজেকে সামলা আর মন দিয়ে বাইক চালাবি, ওকে? ”
রিজভী সম্মতি দিয়ে বাইক স্টার্ট দিল। শিশিরও স্টার্ট দিল দু’জন বাইক নিয়ে তড়াক বেড়িয়ে গেল ক্যাম্পাস থেকে।
