বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৬৩+৬৪
রোজা রহমান
মালিথা ভিলায় আনন্দের বর্ষণ বইছে। বইবে না কেন? তারা যে আনন্দের আস্ত একটা বর্ষণ-ই পেয়েছে! বর্ষণকে নিয়ে আজ মালিথা ভিলায় পা রেখেছে তুষার বৃষ্টি। বর্ষণ’র আগমনে খুশিরও বর্ষণ হচ্ছে সকলের চোখে মুখে। এই মালিথা ভিলার ছোট্ট নতুন অতিথির নাম যেন স্বার্থকতা লাভ করছে। যেমন নামে বর্ষণ তেমনই কামেও বর্ষণ। সব জায়গায় শুধু বর্ষণ আর বর্ষণ৷
আজ পাঁচদিন পর বৃষ্টি ও বর্ষণকে নিয়ে তুষার সহ শিশির, নীহার, কুয়াশা এলো। তুষার সেদিনই বিকেলে মিষ্টি বিলিয়েছে ছেলে হবার খুশিতে। এছাড়া ছেলের দোয়া চেয়ে অনেক টাকা ফকির, এতিমখানায় ও মসজিদে দিয়েছে। ছেলে তারা হারাতে হারাতে ফিরে পেয়েছে। আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় সহ ভবিষ্যত দোয়া নিয়েছে।
বাড়িতে খুশি আনাচে কানাচে ছড়িয়েছিটিয়ে পড়েছে। তিন দাদি সহ দুই দাদা আনন্দ আহ্লাদে আটখানা৷ তাদের নাতিদের সাথে খেলার বয়স হয়ে গেল! ভাবা যায়!
আরও গল্প পড়তে আমাদের গ্রুপে জয়েন করুন
জাকির মালিথা ও জাহিদ মালিথা আজ প্রথম দেখছেন বর্ষণকে৷ আজমিরা, হিম, ইয়াসমিন এরা হসপিটাল থেকেই দেখে এসেছিল৷ বৃষ্টির বাবা, মা সেদিন এসে আবার চলে গেছেন। বৃষ্টির প্রতি তারা কোনোই দায়িত্ব পালন করেন না ধরতে গেলে। চোখের দেখাটুুকু দেখে শুধু। বিয়ে দিয়েই খালাশ৷ যদিও বাবা মাঝে মাঝে খোঁজ খবর নেন তবে সৎ মায়ের জন্য সেটাও আর করতে পারে না বেশি। গ্রামের মেয়ে তার সৎ মা তার বাবার বাড়িও অবশ্য গ্রামেই। মেয়েটা এটার জন্য খুব কষ্টে পায়। কিন্তু তুষার অনেক সান্ত্বনা দেয়। মন খারাপ করতে মানা করে। সব পরিবার বা সব মানুষের মন মানসিকতা তো আর এক হয় না! সে তার পরিবার দেখিয়ে বলে,
” আমার পরিবার আঁকড়ে ধরে রাখো বৃষ্টি। দেখবা এখানে সব পাবে তুমি। কিচ্ছুর কমতি থাকবে না তোমার”
বৃষ্টি সেটাই করার চেষ্টা করে। মেয়েটার বিয়ের আগেও এমন কষ্টে ভুগত। এখন এমন শ্বশুরবাড়ি, স্বামী পেয়ে রাজকপাল মনে করে৷ আল্লাহ সব কিছু একেবারে কেঁড়ে নেন না৷ কোনো না কোনো দিকে বান্দাকে অবশ্যই খুশি করেন৷ আর এই মালিথার ভিলায় যে বা যারা বউ হয়ে আসবে তাদেরই রাজকপাল মনে হবে। কারণ এই মালিথা ভিলা পুরোটাই আস্ত একটা রাজপ্রাসাদ আর এই রাজপ্রাসাদের ছেলেগুলো এক একটা রাজপুত্র। সুখী না হয়ে পারবে কেউ? কপাল করে না জন্মালে এমন সব স্বামী সংসার পাওয়া যায় না৷ ভাগ্য থাকা লাগে৷ আর সেই ভাগ্য লেখনেওয়ালাও স্বয়ং আল্লাহ। তিনি চাইলে সব সম্ভব। রাজপ্রাসাদও সম্ভব রাজপুত্রও সম্ভব।
হসপিটালে বৃষ্টির কাছে আজমিরা, আম্বিয়া, ইয়াসমিন এরাই রাতে থেকেছে রাতে আর সাথে তুষার তো ছিলই! সে ডিউটি করেই রাতে হসপিটালে যেত সেখানেই রাত কাটাত৷ জাকিয়াকে একটা রাতও থাকতে দেয়নি কেউ৷ কারণ সকলে রাতে জাকির মালিথাকে দেখার কথা বলেছিল।
জাকির মালিথাকে নিচে আনা হয়েছে। তিনি সোফায় বসে আছেন। বৃষ্টিকে সোফায় বসানো হয়েছে। বর্ষণ বাড়িতে এসেছে কুয়াশার কোলে চড়ে। ঢুকেছেও কুয়াশার কোলে চড়ে। ফুপুকে যেন খুব পছন্দ হয়েছে তার৷ একমাত্র ফুপুর কোলে থাকতে সে আনন্দবোধ করে৷ সকলে তা নিয়ে কত হাসাহাসি৷ শিশির যদি কোলে নেই, যেই না নিয়ে গালে গাল লাগাবে অমনি চেঁচাতে লেগে যায় সে। তখন কুয়াশা দেখেই শুরু করে ঝগড়া। গত দিনগুলোর মাঝে বেশ কয়েকবার এমনটা হয়েছে। বর্ষণ চাচুর দাঁড়িতে খুবই বিরক্তবোধ করে।
কুয়াশার কোল থেকে দুই দাদা দেখে বলে উঠলেন,
” মাশাআল্লাহ, মাশাআল্লাহ”
সকলে মুচকি হাসল। জাকিয়া এবার কুয়াশার থেকে নিলেন। নিয়ে জাকির মালিথার কাছে এগিয়ে গেলেন৷ বললেন,
” কোলে নাও তোমার প্রথম ছেলের ঘরের প্রথম প্রদ্বীপ”
জাকির মালিথা অমায়িক হাসলেন। বললেন,
” দাও ”
জাকির মালিথা বসে আছেন জাকিয়া উনার যে হাতটা ভালো সেই হাতের পাশ করে নাতিছেলেকে দিলেন। আহ্ কী সুন্দর! জাকির মালিথা আনন্দে অমায়িক হাসলেন। বলে উঠলেন,
” আমার দাদু..! ”
প্রশান্তিময় হাসল সকলে। বর্ষণ দাদুর কোলে চড়তে পেরে বোধহয় অতি আনন্দিত। ফোকলা দাঁতে হাসির রেখা টানল গুলুমুলু গালে। গাল জোড়া টেনে দিতে মন চাইবে দেখলে। চোখ জোড়া হয়েছে মার্বেলের ন্যায় ডাগর ডাগর। সেই চোখে চেয়ে দাদুকে দেখছে৷ জাকির মালিথা আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। বর্ষণকে বললেন,
” আমার দাদু..! দাদুর কোলে উঠেছ? ”
তা শুনে বর্ষণ ঠোঁট প্রসারিত করল। হাসির রেখা দেখা দিল। বৃষ্টি, তুষার অবাক চোখে সেই দৃশ্য দেখছে৷ এই আনন্দটা যদি উপভোগ করার সুযোগ না পেতেন তিনি! ভাবলেই বুক কাঁপে৷ সকলে মুগ্ধ হয়ে দেখছে দাদু আর নাতিকে। জাহিদ মালিথা পাশে থেকে হাত বাড়িয়ে কোলে তুলে নিলেন। প্রথমে চুমু আঁকলেন। এই দাদুকেও বোধহয় তার প্রচুর পছন্দ হলো। কোলে উঠেই হাত পা নাড়াতে লাগল। এই পাঁচদিনেই মনে হচ্ছে বড় হয়ে গেছে অনেকটা।
সকলে দীর্ঘ শ্বাস ফেলল৷ আনন্দ অটুট থাকুক৷ একে একে সকলে বর্ষণকে নিয়ে মাতল। জাকির মালিথা তুষারকে বললেন,
“কাল তো সপ্তমদিন হবে আকিকাহ’র ব্যবস্থা কোরো”
তুষার সম্মতি দিল। জাহিদ মালিথা বললেন,
” কিছু টাকা আমি দিব বাবা। একা এত পারবে না ”
তুহিনও বলল,
” আমিও দিব ভাই। সমস্যা হবে না। এমনিতেও প্রথম ভাতিজাকে কিছু দিতেই হতো ”
তুষার কিছু বলতে চাইলে জাহিদ মালিথা বললেন,
” সবাই তোমারই। একা বাবার দায়িত্ব পালন করতে হবে না। আমাদেরও নাতি হিসেবে দায়িত্ব আছে। প্রথম নাতির মুখ দেখলাম। এটুকু সকলে মিলেই করো। ”
সকলে অমায়িক হাসির রেখা টানল ঠোঁটে। তুষার আর কি বলবে? খুঁজে পেল না৷ তারা খুশি হয়ে নিজ দায়িত্ব থেকে দিতে চাইছে এখানে কি বা বলার আছে? এই পরিবারের সবাই সবার আপন। জাকির মালিথা ও জাকিয়াও সম্মতি দিলেন৷
আত্মীয়দের দাওয়াত করার কথা হলো। নীহার আজ সকালে শশীকে জানিয়েছে বর্ষণকে আনা হবে৷ সেটা শুনে সে আসার জন্য পাড়াপাড়ি বাঁধিয়েছে। জিনিয়াদের বলা হয়েছে। জানিয়েছেন আগামীকালই আসবেন। বোনের প্রথম নাতিছেলেকে তিনিও দেখবেন কিন্তু খালি হাতে তো আর দেখা যায় না নতুন অতিথিকে? আসলে সেই ভাবেই আসতে হবে। এই জন্য কাল আসবেন৷ শশীর যেন তড় সইছে না। নিজের ভাইয়ের এখনো বাচ্চা হয়নি। তার ভাই ভালোবেসে বিয়ে করে এনেছিল নিজে নিজেই। বিয়েরও তিন-চার বছর হয়ে গেছে সৌরজের কিন্তু বাচ্চা নেয়নি এখনো।
বর্ষণ মালিথা ভিলার সকলের কাছেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। ছোট হিমও বর্ষণকে নিয়ে বসে বসে থাকছে। তার যেন নেবার মানুষের অভাব নেই। তাকে ঠিকমতো ঘুম অবধি কেউ আসতে দিচ্ছে না৷ এ ছেড়ে ও নিচ্ছে ও ছেড়ে এ। মানে পুচ্চুটার শান্তি নেই। বেজায় বিরক্ত হচ্ছে মাঝে মাঝে সে। হয়তো মনে মনে সে ভাবছে,
“এত আদিক্ষেতারই বা কি আছে ভাই? দুনিয়ায় কি আর পুচ্চু পাচ্চি আসে না নাকি! আমাকে তোমরা একটু ঘুমাতে তো দেবে নাকি!”
বিকেল হয়ে গেছে। বর্ষণকে নিয়ে সব বৃষ্টির ঘরে গল্প গুজব করছিল গতকালের কথাও হচ্ছিল। পুরুষরা অবশ্য কেউ নেই। তুষার ডিউটি সহ আকিকাহ’র ব্যবস্থায় ব্যস্ত। শিশিররাও সকলে বাহিরে। জাকির মালিথাকে নিয়ে জাহিদ মালিথা বাহিরে গেছেন হাঁটতে।
কিছুক্ষণ পর শিশির এলো বাড়িতে। কুয়াশাকে না পেয়ে বিরক্ত হলো। ওটাকে কখনোই এসে পায় না সে। এখন তো আরোই পাওয়া যাবে না। বাহিরে গিয়ে ডেকে এলো। ডেকে বাথরুম ঢুকেছে গোসলের জন্য।
কুয়াশা বর্ষণকে কোলে করেই এসেছে ঘরে। মূলত তার কোলে ছিল বর্ষণ তাই ওভাবেই নিয়ে চলে এসেছে। সকলে এ নিয়ে কিছু বলেও নি৷ যানে কুয়াশাই বেশিটা সময় রাখছে ও’কে৷
এসে দেখল শিশির বাথরুমে। তাই বর্ষণকে নিয়ে বসল বিছানায়। টুকটাক কথা আর খেলা চালিয়ে গেল। জেগে আছে সে ফুপুর কোলে। ঘুম থেকে একটু আগেই উঠেছে৷ আর তখনই কুয়াশা নিয়েছে।
শিশির গোসল করে এসে দেখল বউ তার ভাতিজা নিয়ে খেলছে। কিছু বলল না আর৷ চুল মুছতে মুছতে মিররের সামনে গেল৷ নিজের কাজ সারল। কুয়াশা শিশিরকে সহ বর্ষণকে দেখতে থাকল। কুয়াশা জিজ্ঞেস করল,
” ডাকলে কেন? ”
শিশির ঘুরে ভ্রু কুঁচকাল। আবার পূর্বের ন্যায় ঘুরে চুলে চিরুনি করল। বলল,
” বউ আমার ঘরে নেই ডাকব না? ”
কুয়াশা তাকিয়ে রইল শুধু উত্তর করল না। তবে বর্ষণকে বলল,
” এ্যাই পুচ্চু শোন! চাচুর মতো খবরদার বউ পাগল হবি না ওকে? ”
বর্ষণ কী বুঝল কে জানে! হাসি হাসি মুখ করল কুয়াশার কথা পেয়ে। এদিকে শিশির ভ্রু কুঁচকে তাকাল কুয়াশার দিকে। মানে তাকে বউ পাগল বলল এই ফাজিলটা? কথাটা ভাবতে ভাবতে এগিয়ে গেল কুয়াশার কাছে৷ গিয়ে কুয়াশার মতো করেই পা তুলে হাঁটু মুড়িয়ে দুই পা ভাজ করে বসল বিছানায় কুয়াশার সামনাসামনি। বলল,
” এ্যাই বেয়াদব, তুই আমাকে বউ পাগল বললি? ”
” বুঝতে এত সময় নিলে কেন? ”
কতটা ফাজিল ভাবো! কিড়মিড় করে বলল,
” একশ বার হব। আমার বউ আমি পাগল হব তোর দেখার আছে?”
একই সুরে কুয়াশা বলল,
” ফর ইউর কাইন্ড ইনফরমেশন, তুমি যে বউকে নিয়ে পাগল হবে সেই বউ-ই আমি, বুঝেছ? ”
শিশির মনে মনে হাসল। কিন্তু মুখে প্রকাশ না করে ঝগড়া চালিয়ে যেতে কুয়াশার মাথায় চাটি মারল। ব্যথা পেল সে। এই ফাজিল বুনো ওলটা মারে কি করে এভাবে? যে মাথায় মারলেই ব্যথা লাগে! কুয়াশা রাগে ফুঁসে উঠল। কিছু বলতে যাবে তার আগেই শিশির বর্ষণের দিকে কিছুটা ঝুকে আস্তে করে বলল,
” বর্ষণ আব্বু শুনো, চাচুর মতোই বউ পাগল হবে, ওকে? বড় হয়ে চাচুর কার্বন কপি হবে। চাচুর মতো হতে আমি নিজে হেল্প করব তোমায়, নো টেনশন।”
শিশিরের কথা পেয়েও বর্ষণ ঠোঁট প্রসারিত করল। শিশির মুচকি হাসল। কুয়াশার দিকে তাকিয়ে বলল,
” দেখ, আমার ছেলে আমার মতোই হবে একদম৷ সে রাজি এবং বেজায় খুশি, দেখলি বদমাইশ!”
বলে আবার মাথায় মারল। কুয়াশা আবার ফুঁসে উঠল। এবার সে এক হাত দিয়ে বসে থাকা শিশিরের চুল টেনে দিল আচ্ছা মতো। চুল সহ মাথা ঘুরিয়ে দিয়ে রাগে কিড়মিড় করতে করতে বলল,
” ফালতু লোক! ছেলেকে বউ মারাও শিখাচ্ছ নাকি? ”
শিশিরও মেকি রাগ তুলে বলল,
” হ্যাঁ, কীভাবে ঘাড়ত্যাড়া বউকে মেরে সোজা করতে হয় সেটাই শিক্ষা দিচ্ছি। ”
বলে নিয়ে বর্ষণের দিকে তাকিয়ে বলল,
” আব্বু, দেখে শিখে রাখো হুঁ? এভাবেই কিন্তু বউ পি-টাতে হয় বুঝলে! ”
বলে মনে মনে দম ফাটা হাসি হাসল সে মুখে প্রকাশ না করে। কুয়াশা শিশিরের বাহুতে চাপ্পড় সহ কিল, ঘুষি দিল। বর্ষণকে বলল,
” এ্যাই পুচ্চু শোন, একদম এই ফালতু মার্কা গলা চুলকানোর গোডাউন চাচুর মতো হবি না! না হলে তোর প্রমোশন দেব না! ”
শিশির হাসতে হাসতে শেষ হচ্ছে ভেতরে ভেতরে। কিন্তু কুয়াশার শেষ কথাটা শুনে ভ্রু কুঁচকে বলল,
” কি প্রমোশন দিবি তুই ও’কে? ”
কুয়াশা তা শুনে পাত্তা দিল না৷ মুখ ঝামটা দিয়ে বলল,
” হুহ্ তোমায় কব ক্যা?”
শিশির কুয়াশার মাথায় আরেকটা বসাতে গিয়েও থেমে গেল। মারার জন্য হাত উঠিয়ে সেটা ওভাবে উপর করে কুয়াশার মাথা কাছে রেখে বর্ষণের দিকে তাকিয়ে বলল,
” এ্যাই চাচু, একটু চোখটা বন্ধ করো তো। তোমার এই ফুপু নামক চাচিটাকে আগে কয়েকটা বসিয়ে নিই। নয়তো সোজা হবে না। ”
কুয়াশা তা শুনে আবার ফুঁসে উঠল। কুলিম সা-পের মতো করে ফোঁসফোঁস করতে লাগল। শিশির মারার আগেই সে মেরে দিল।
বেচারা বর্ষণ পড়ল এক জ্বলায় দুনিয়ায় এসেও বিপদে পড়ে গেছে। এসে পর্যন্ত এদের ঝগড়া মারা মারি, চুলোচুলি দেখতে দেখতে সে পাঁচটা দিন কাটিয়ে দিল। এখন সারাজীবন তারও এটাই দেখেই কাটানো লাগবে। জীবন তারও ত্যাজপাতা। কোনো মাফ নেই৷ তার এই চাচি নামক ফুপু থুক্কু, ফুপু নামক চাচি নাকি কী! আচ্ছা যায়হোক, তার আর এই সামনে থাকা চাচুর ঝগড়া চুলোচুলি দেখতে দেখতে বড় হতে হবে। মনে মনে হয়তো সে-ও ভাবছে এরা পারে কি করে এতো? মুখ, হাত, পা লাগে না এদের? দুনিয়ায় এসে পর্যন্ত দেখছে এসব। এসব করার বয়স তো তার আসছে সামনে। হয়তো আরো একটা কথা সে-ও বলছে, চাচু, চাচি, ফুফু, মামা যায় হও না তোমরাও একটা পুচ্চু আনো দুনিয়ায় আমিও করি তোমাদের মতো চুলোচুলি। নিজেরা ছেড়ে আমাদের সুযোগ দাও এবার।
কিন্তু আফসোস বর্ষণের কথাটা ওরা না বুঝল আর না শুনল। ওরা ওদের কাজে ব্যস্ত৷ সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখছে ফুপু, চাচুর চুলোচুলি করা৷
শিশির এবার বর্ষণকে কোলের উপর নিল৷ কুয়াশা একটু এগিয়ে এলো শিশিরের দিকে। একটু আগে যে দু’টো ঝগড়া, হাতাহাতি করল সেটার কোনো লেশমাত্রই নেই৷ সব হাওয়ায় ভাসিয়ে দিল৷ এরা পারেও বটে। মারা মারি করতেও দেরি লাগে না আবার পিরিত দেখাতেও দেরি লাগে না৷
দু’জন সামনাসামনি বসে বর্ষণকে নিয়ে খেলতে লাগল আর বর্ষণের সাথে কথা বলতে লাগল৷ বর্ষণ কথা পেয়ে ঠোঁট প্রশারিত করে হাসির ভাব বোঝাচ্ছে। তা দেখে কুয়াশা বলল,
” এ্যাই, এটা দেখো সেই লেভেলের পটানো ওয়ালা হবে। দেখো কীরকম হেসে মানুষ ভুলাচ্ছে! ”
” হ্যাঁ তোর মতো, কেউ পাত্তা না দিলে হেসে আর আহ্লাদ করে মানুষ ভুলাবে।”
কুয়াশা বিরক্ত চোখে চাইল৷ শিশিরও ঠোঁট কামড়ে দুষ্টু হাসি ঠোঁটে রেখে কুয়াশার দিকে তাকাল৷ কুয়াশা মুখ ঝামটাল। শিশির দুষ্টু হেসে দুষ্টুমি করে বলল,
” লাগবে তোর এমন একটা?”
কুয়াশা তাকাল আবার শিশিরের চোখের দিকে৷ কথার মর্মার্থ বুঝতে সময় নিল না। কুয়াশা লজ্জা তো পেল কিন্তু এক চুল পরিমাণ সেটা বাহিরে প্রকাশ করল না৷ বর্ষণের হাতের মাঝে আঙুল দিল৷ বর্ষণ তা আকড়ে ধরল। তা দেখে সে হাসল৷ বর্ষণের দিকে তাকিয়েই স্বামীর কথার উত্তর করল,
” লাগবে তো অবশ্যই। কিন্তু কী জানো তো! আমার স্বামী বলেছে দুই তিন বছর অপেক্ষা করতে। তার নাকি আগে ক্যারিয়ার গড়তে হবে। তো আমিও সেই অপেক্ষাতেই আছি৷ দেখি কবে তার সময় হয়৷ সেদিনের জন্য না হয় একটু অপেক্ষা করেই নিলাম? আমার মনে হয় না খুব বেশি তাতে ক্ষতি হবে! ”
শিশির হেসে ফেলল মুখ খুলে ফিসফিস শব্দ করে। তা দেখে কুয়াশাও হাসল শব্দহীন৷ বলল,
” দেখো ছেলে এখনই আবদার করছে হাত পেড়ে ধরে বোন অথবা ভাই এনে দেবার জন্য। ”
কুয়াশার কথায় শিশির নিচে নজর দিল। দেখল বর্ষণ কুয়াশার তর্জণী আঙুলটা নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়েছে৷ হাসল তা দেখে নিঃশব্দে সে। বলল,
” এনে দেব বাবা৷ কিন্তু কয়েকবছর অপেক্ষা করতে হবে তোমায়। জানো তো, অপেক্ষার ফল মিষ্টি হয়! ”
বর্ষণের গালে হাত দিয়ে হালকা টিপে দিয়ে বলল কথাটা। এরপর কুয়াশার দিকে তাকাল। সে লজ্জা মাখা মুখ নিয়ে মিটিমিটি হেসে যাচ্ছে। শিশিরও কুয়াশার দিকে দুষ্টু চোখে মিটমিটিয়ে হাসতে হাসতে আবার বলল,
” আর কী জানো তো আব্বু! তোমার এই ফুপু নামক চাচিটা নিজেই এখনো বাচ্চা। তিড়িং বিড়িং করে দৌড়ে বেড়ানোর তার স্বভাব। তাই এটাকে আগে বড় করে নিই। বড় না করে তোমার বোন বা ভাই আনলে তাকে নিয়েই তিড়িং বিড়িং করে বেড়াবে। তোমার চাচুর হয়েছে যত দুনিয়ার জ্বালা বুঝলে তোহ্! ”
কুয়াশা তা শুনে শিশিরের দিকে চোখ পাকিয়ে তাকাল। শিশির আগের ন্যায় তাকিয়ে ঠোঁটে হাসি ঝুলিয়ে রেখেছে। কুয়াশা আবারও মুখ ঝামটাল৷ মুখ ঝামটিয়ে আবার স্বামীরই বুকের উপর এসে পড়ে আশ্রয় নিল। আগের ন্যায় বসে থেকেই শিশিরের বুকের উপর মাথা রেখে পেট সহ কোমড় জড়িয়ে ধরল। ঝগড়া করে এখন আবার আহ্লাদ দেখাতে লাগল৷ শিশির নিঃশব্দে হাসল৷ কুয়াশা বাম সাইট থেকে জড়িয়ে ধরেছে আর বর্ষণ শিশিরের ডান সাইটের হাতের উপর৷ সে ফ্যালফ্যাল করে একবার চাচুর দিকে দেখছে তো একবার ফুপু নামক চাচির দিকে দেখছে৷ সে সাক্ষী হলো চাচু ও ফুপু নামক চাচির ঝগড়ার, মারা মারির, চুলোচুলির এবং আদর ও ভালোবাসার৷ সে-ও দেখল এই দু’টো কী পরিমাণে ঝগড়া, চুলোচুলি করে আবার তখনই আদর ভালোবাসা দেখায়।
শিশির তার বুকের উপর মাথা দিয়ে থাকা কুয়াশার দিকে তাকাল৷ কুয়াশাও মুখ তুলে শিশিরের দিকে তাকাল৷ দুই জনেরই ঠোঁটে তৃপ্তিময় ও সুখের হাসি৷ তারা অনেক সুখী। এই সুখে যেন কখনো কুনজর না লাগে৷ আল্লাহ্’র কাছে শুধু এই টুকুই চাওয়া। ভেবে কুয়াশা স্বামীকে আরেকটু শক্ত করে ধরল। বুকের মাঝে বিড়াল ছানার মতো করে ঢুকে যেতে চাইল৷ শিশির মুচকি হেসে কুয়াশার কপালে ঠোঁট জোড়া দাবিয়ে চুমু আঁকল। কুয়াশা চোখ বন্ধ করে পড়ে রইল স্বামীর বুকে৷ কী সুন্দর একটা দৃশ্য নাহ্? এমন একটা সুখময় সংসার তাদেরও হোক মনে মনে সেই বাসনা দু’জনই পোষণ করল৷
কেটে গেল আরো দুইটা সপ্তাহর বেশি। শিশিরের চলে যাবার সময় ঘনিয়ে আসছে ক্রমেই। ফেব্রুয়ারী মাস শেষ হয়েছে। মার্চেরও অর্ধেক হয়ে এলো। এই মাসের শেষের দিকে চলে যাবে। ঢাকায় গিয়ে সব ঠিকঠাক করবে। রেজাল্ট পেলেই ভর্তি। সে-সবরই গোছগাছ করছে সে আর রিজভী। দু’জনে একই সাথে যাবে এবং থাকবে৷
শুক্রবার আজ। সকলে বাড়িতেই আছে৷ সকালের দিকে সকলে খাওয়া দাওয়া করে টুকটাক গল্প গুজব করছে। বর্ষণের সাথে মূলত খেলা করছে সকলে। ওকে নিয়ে ঘাটাঘাটি হচ্ছে। বৃষ্টি এখন সুস্থ। সে টুকটাক কাজও করে। তবে শাশুড়ীরা করতে দেয় না বললেই চলে৷ কাটা ছেঁড়া নিয়ে তাকে রেস্টে থাকতে বলেন৷ জাকিয়াই নাতির কাঁথা, কাপড় ধুয়ে দিত কিছুদিন। তবে আজমিরাই বেশি করে এসব। তিনি জাকিয়াকেও বেশি চাপ দিতে চান না। স্বামীর জন্য এমনিতেই ক্লান্ত থাকেন। এছাড়া আজমিরার থেকে বয়সটাও বেশি হওয়াতে তিনি একটু মুটিয়ে যাচ্ছেন। চিরকাল তো আর মানুষ এক থাকে না! আম্বিয়া স্কুলের জন্য সকাল থেকেই বাড়িতে থাকতে পারেন না। তবে বিকেলে এসে নাতিকে নিয়ে বসে থাকেন। এছাড়া ইয়াসমিনও বৃষ্টিকে অনেক সাহায্য করে। কুয়াশা তো বর্ষণকেই নিয়ে বেশি থাকে৷ সকালে নাস্তার পর বর্ষণ জাকির মালিথার কোলের মাঝে শুয়ে খেলা করে দাদুর সাথে। ঐ সময়টা তার বরাদ্দ দাদুর জন্য। নাস্তা করেই আগে বর্ষণকে আনার জন্য জাকিয়াকে তাগাদ দেবেন৷
হসপিটাল থেকে এসে পরেরদিনই বর্ষণের আকিকাহ’র আয়োজন করা হয়েছিল। শশীরা সহ অনেক আত্মীয়রা এসেছিল। রিজভী, স্মৃতিরা সহ ঈশারাও এসেছিল। জাকিয়ার ভাই, ভাবিরাও এসেছিলেন। সাব্বির, সাবিব আকিকাহ্তে আসতে পারেনি। তবে অন্যরা এসেছিল। সকলে আবার এক হয়েছিল ছোট্ট প্রাণটার জন্য।
রাতের খাবার খেয়ে কুয়াশা শুয়ে পড়েছে৷ শিশির একটু বাহিরে গেছিল। একটু আগেই এসেছে। রাতের খাবার খেয়ে ঘরে এলো৷ শীত চলে গেছে প্রায়। এখন বেশ গরমই পড়ে। ঘরে এসে শিশির ঘড়ি দেখল৷ দশটা পার হয়ে গেছে। এত জলদি কুয়াশা শুয়ে পড়েছে আজ! কথা না বলে নিজের কাজ সেরে অতিরিক্ত লাইট অফ করে দিল৷ ল্যাম্প জ্বালিয়ে রাখল৷ কুয়াশা ঘুমচ্ছে বোধহয় নয়তো জেগে যেত৷ ভেবে বিছানায় আধ শোয়া হয়ে বসল লেপটপ নিয়ে৷ কিছু কাজ করার আছে সেগুলোই করবে৷
ঘন্টা খানেক পর লেপটপ রেখে কুয়াশার দিকে তাকাল। এক পাশ হয়ে জোড়োকোড়ো হয়ে শুয়ে আছে৷ শিশির মুচকি হেসে এগিয়ে গেল। পাতলা কাঁথা টেনে গায়ের উপর দিল। শিশির বালিশে মাথা না রেখে অন্যপাশ ঘুরে শুয়ে থাকা কুয়াশার মুখ দেখার চেষ্টা করল। একদম এগিয়ে গিয়ে কুয়াশার শরীরের সাথে শরীর ঠেকিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে কুয়াশার জামাবিহীন পেটে বিচরণ করতে করতে আদুরে স্বরে বলল,
” এ্যাই আহ্লাদী বউ! ঘুমিয়ে গেছিস সোনা? ”
কুয়াশা পেট স্পর্শ ও কথা পেয়ে জেগে উঠল। ঘুমটা বেশি গাঢ় না তার। অল্পতেই জেগে যায়। শরীরটা ভালো না তাই জলদি ঘুমিয়ে গেছিল। শিশিরের মুখের দিকে তাকাল। বলল,
” হ্যাঁ, কখন এলে তুমি? ”
ঘুম জড়ানো ভারী কন্ঠ তার। শিশির সব সময়ই বউয়ের উপর মাতাল হয় আজকাল। ভালোবাসা বাসির পর থেকেই কেন যেন কুয়াশার প্রতিটা জিনিসই তার মাদকতায় রূপ নিয়েছে। এই যে ঘুম জড়ানো বাণীগুলো অতিরিক্ত আহ্লাদী মনে হলো। কিছুদিন পর থেকে তার এই বউয়ের এই সুন্দর সুন্দর জিনসগুলো কাছে পাবে না, শুনতে পাবে না, দেখতে পাবে না। বউটার নেক স্মেল, সকালের তৈলাক্ত ফোলা ফোলা মুখ, ঘুম জড়ানো সালাম কিচ্ছুটি পাবে না। কতদিনের দূরত্ব হবে কে জানে! ভাবলেই বুকটা চিনচিন করে। থাকবে কীকরে সে? শিশির কুয়াশার দিকে তাকিয়ে ভাবল কথাগুলো। কথার উত্তর না দিয়ে কুয়াশার উন্মুক্ত কাঁধ সহ গলায় নাক ঘষতে লাগল৷ এরপর ছোট ছোট চুমু দিল। অন্তরের অশান্তিতে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল আরো। কুয়াশা স্বামীর ইরাদা বুঝে কিছু বলতে যাবে শিশির অধরে অধর ছুঁতে গেল তখনই কুয়াশা আটকে দিল৷ বলল,
” ঘুমে ছিলাম আমি!”
শিশির কুয়াশার দিকে নেশাতুর দৃষ্টি দিল। ঘারে চুমু খেয়ে বলল,
” যা উঠে ফ্রেশ হয়ে আয়।”
কুয়াশা একটু ইতস্তত হয়ে আমতাআমতা করতে লাগল৷ বলল,
” শুনো! ”
শিশির উত্তর করল না। নাক ঘষতে ব্যস্ত সে। কুয়াশা বলল,
” অসুস্থ আমি।”
শিশির শুনে মুখ তুলে তাকাল। কুয়াশার মুখটা কাচুমাচু করা। হাসল তা দেখে৷ বউ তার পাক্কা বুদ্ধিমতি হয়েছে। নামেই শুধু গোবর ঠাসা। কখনো স্বামীকে ফেরায় না অসুস্থ না থাকলে। শিশির এই কয় মাসে এটা বুঝে গেছে। সে কুয়াশার গ্রীবাদেশে আরো একটা চুমু আঁকল। বলল,
” তো এটা এভাবে বলার কি আছে? গোবর ঠাসা!”
বলে লাইট অফ করতে গেলে কুয়াশা বলল,
” রাখো, ফ্রেশ হয়ে আসছি। ঘুম ছুঁটে গেছে আমার।”
শিশির তা শুনে শুয়ে পড়ল। দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ফেলল। নিজেকে সংবরণ করল। কুয়াশা উঠে বসে সবই দেখল। সে-ও দীর্ঘ শ্বাস ফেলে উঠে গেল। কিছুক্ষণের মাঝে এসে শুয়ে শিশিরকে লাইট বন্ধ করে দিতে বলল। শিশির শুনে বন্ধ করল৷ কুয়াশা শুয়ে এগিয়ে গেল স্বামীর দিকে। চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা স্বামীর বুকে মাথা রাখল। পেটের উপর হাত রাখল৷ শিশির কুয়াশার পিঠের উপর হাত দিয়ে আগলে ধরল। বলল,
” নিজের পরিস্থিতি ওভাবে কেন বলিস আমাকে? আমি কখনো তোকে জোর করি? ”
কুয়াশা তড়িঘড়ি করে বলল,
” আরেহ্ নাহ্। তেমন কিছু না। আসলে..!”
” কি আসলে? ”
বলে কুয়াশার দিকে কাত হয়ে শুয়ে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল। বলল,
” কোনো প্রকার খারপ লাগলেই আমাকে বলবি। আমি বললেই যে আসতে হবে তার কোনো মানে নেই। নিজেকে আমার কাছে কখনো তুচ্ছ করে দিবি না৷ আমার চাহিদার থেকে তোর সুস্থতা এবং মানসিকতা আগে প্রায়োরিটি পাবে। মন না চাইলে আমাকে জানাবি নির্দ্বিধায়। সব সময় সবার মন মানসিকতা এক থাকে না৷ আমি তেমন স্বামীদের মতো হতে চাই না যারা পশুর ন্যায় আচরণ করে। আর এটাও চাই না তুই আমাকে সেই সুযোগ দে। আমার বউ তুই। তোর সম্পূর্ণ প্রায়োরিটি আমার কাছে আছে এবং থাকবে৷ সেটাই সব সময় ধরে রাখার চেষ্টা করব। কুয়াশা একটা সংসারে শারীরিক চাহিদা অনুযায়ী চলে না। ভালোবাসা দিয়ে চলাতে হয়৷ তুই ভালোমতো জানিস আমাদের মাঝে তেমন সম্পর্ক বা সংসার গড়ার হলে আমরা বিয়ের রাত থেকেই পারতাম।
কিংবা আমি চাইলেই পারতাম। বল পারতান নাহ্? কিন্তু আমি কখনো সেটা চাই নি। আমি চেয়েছি ভালোবাসা দিয়ে সংসার বাঁধতে। সেই জন্য সময় নিয়েছিলাম। আর সেটা দিয়েই বেঁধেছি৷ শারীরিক চাহিদা একটা সংসারের মূল্যবান মাধ্যম সেটা আমি বা তুই বা অন্য কেউই অস্বীকার করতে পারব না৷ সেটা আদিম চাহিদা। কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে সংসার কয়জনে বাঁধে বল? কত এ্যারেঞ্জ ম্যারেজ আছে তারা বিয়ের পর থেকেই সব চালিয়ে যায়। আমার কাছে সেটা অযাচিত লাগে আর মানুষের কাছে কী লাগে জানি না আমি শুধু আমার কথা বললাম৷ যায়হোক সেসব কথায় না যাই। এখন বল আমি কি বলতে চাইলাম এবং বোঝাতে চাইলাম বুঝেছিস কিনা! ”
কুয়াশা এতক্ষণ মুগ্ধ হয়ে স্বামীর কথা শুনছিল। সে কপাল করে স্বামী পেয়েছে। কে জানত এই জোর করে বিয়ে দেয়াটাই একদিন তাদের কাছে কোহিনূর হাতে পাওয়ার মতো আনন্দ দেবে! তার স্বামী এতক্ষণ যা বলল সব সঠিক। সত্যি তো সে চাইলে বিয়ের রাত থেকেই অধিকার খাটিয়ে নিজের অধিকার বুঝে নিতে পারত৷ কিন্তু সে তেমনটা চায়নি। সে আগে তার মনের দখল নিয়েছে। ভেবেই স্বামীর বুকের মুখ ঘষল, নাক ঘষল এরপর চুমু আঁকল। বলল,
” বুঝেছি, আর মনে থাকবে৷ ”
শিশির নিঃশব্দে হাসল। বলল,
” ব্যথা আসে নি আজ? ”
” সন্ধ্যায় এসেছিল। চা, আদা, সেঁক নিয়ে কমিয়েছি। তারপর ঘুমিয়ে গেছিলাম। ”
শিশির কুয়াশাকে বুক থেকে তুলে গলায় মুখ গুঁজল৷ শক্ত করে জড়িয়ে ধরে মুখ গুঁজে রেখেই বলল,
” ঘুমা। ”
এখন ঘুম আসবে না আর৷ তুমি ঘুমোও আমি বিলি কেটে দিচ্ছি মাথায়। শিশির কিছু বলল না৷ সে জানে বউ তার এই কাজে খুব পটু। এক একটা বদ অভ্যাস তৈরি করে দিয়েছে এই মেয়েটা৷ কী করে যে থাকবে দূরে গেলে! ভেবেই দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো।
প্রকৃতিতে বাংলা চৈত্র মাস পড়েছে বেশে দু’য়েক সপ্তাহ আগে। এসেছে বসন্ত ঋতু। ইংরেজি মার্চ মাসের শেষের দিকে। আগামীকাল শিশির চলে যাবে ঢাকায়। এই শব্দটাই মালিথা ভিলাতে শোকের ছায়া নিয়ে আসছে বার বার। এই বাড়ির কোনো ছেলে, মেয়ে আজ অবধি বাহিরে গিয়ে বছরের পর বছর থাকেনি। তুষারের থেকে শুরু করে সকলেই লেখাপড়া কুষ্টিয়াতেই কমপ্লিট করেছে। তুষার, তুহিন, নীহার, হিম, কুয়াশা এরা সকলেই এখানের স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিতে পড়াশুনো করে এসেছে৷ কয়েক মাস বা এক বছরের জন্য অবশ্য তুষার বাহিরে গেছে কিন্তু শিশিরের মতো এত বছর বাড়ি ছেড়ে দূরে কেউই থাকেনি এখনো৷ প্রয়োজনও পড়েনি। আর শিশির! এই বাড়ি ছেড়ে কোথাও যায়নি এক ঘুরাফেরা ছাড়া। তাহলে তো খারাপ লাগারই কথা নাহ্?
মানুষ হলো অভ্যাসের দাস। যে যেমন ভাবে চলে, থেকে অভ্যস্থ। শিশির যেমন মালিথা ভিলা ছেড়ে কখনো থাকেনি তেমনি এই বাড়ির কেউই শিশিরকে ছাড়া থাকেনি। কাছে কোলে করেই এতগুলো বছর বড় করেছে মা, বাবা, ভাইরা। তাই সে অনির্দিষ্ট দিনের জন্য বাহিরে চলে যাবে এটা তারা মানতে পারছে না। তারা দিনগুলো পাড় করবে কি করে? মা, বাবার মন, তারা যে সন্তানের জন্য কতটা পুড়ে তা বলার ভাষা রাখে না। একমাত্র মা, বাবারাই এই কষ্ট বোঝে। ছেলে, মেয়েরা যখন কিছু ঘন্টার জন্যও রাস্তা ঘাটে বের হয় তখন হাজারটা চিন্তা কুঁড়ে কুঁড়ে ধরে৷ বাড়িতে না আসা পর্যন্ত একটা মা’য়ের চিন্তা কমে না৷ তারা এমনই হয়৷ নাড়ি ছেড়া ধনের জন্য সব সময়ই তড়পায় সে হাজার বড় হোক না কেন! আর সব থেকে বড় কথা ছেলে, মেয়েরা কখনো মা-বাবার কাছে বড় হয়না৷
শিশিরের কাল চলে যাওয়া নিয়ে জাকিয়া, কুয়াশা সহ সকলেরই মন খারাপ। জাকিয়া তো সকালে কেঁদেছেনও ছেলের জন্য। ছেলেকে মানুষ করেছেন এখনো অবধি কাছ ছাড়া করেননি। তবে এখন থাকবেন কি করে? আর তিনি শিশিরকে একটু বেশি আদরে, আহ্লাদে বড় করেছেন এবং ভালোবাসেন৷ ছেলেটা ছোট থেকেই মা পাগল। সেই ছেলের প্রতি দরদ হবে নাহ্!
শিশির বহু কষ্টে মা’কে বুঝিয়েছে সময় পেলেই আসবে। এসে এসে ঘুরে যাবে৷ কিন্তু সেটা তো শুধু সান্ত্বনাবাণী! আসলে তার তো আসার কোনো ইচ্ছে নাই৷ ঠিক এই কারণেই আসবে না সে৷ আসলে আর যেতে ইচ্ছে হবেনা৷ বাড়ি ছেড়ে, মা-বাবা, বউ, ভাইদের ছেড়ে। দূরে গেলে যে কতটা খারাপ লাগে আপন মানুষ ছেড়ে থাকতে এটা যারা থাকে তারাই একমাত্র জানে৷
কুয়াশার মনে সকাল থেকে মেঘ জমে আছে। না খাওয়া দাওয়া করছে, না হেসে খেলে বেড়াচ্ছে আর না কারো সাথে কথা বলছে। বর্ষণ ফুপুকে খুব মিস করছে সকাল থেকে কিন্তু ফুপুর দেখা সে কালেভদ্রে পাচ্ছে। যদিও কালেভদ্রে পাচ্ছে কিন্তু তাকে না কোলে নিচ্ছে আর না কথা বলছে৷ মাস পেড়িয়ে গেছে বয়স তার। এখন সকলের কোল চেনা ধরেছে, মুখ চেনা ধরেছে। ফুপু বেশি রাখে বলে ফুপুকে মিস করছে৷ কান্না করলে কুয়াশাকে দেখা মাত্র থেমে যায় আর সেই বর্ষণ সারাদিন ফুপুর কোল পায়নি৷
ঘরে শুয়ে সে চোখের পানি ফেলছে৷ বাড়ির সকলেরই মন খারাপ তার মাঝে কুয়াশার অবস্থাও সকলে বুঝছে। তারা জানে এই দুইটা ছোট থেকেই আলাদা হয়নি৷ এখন তো তারা স্বামী স্ত্রী! ভালোবাসার মানুষ, তো থাকবে কি করে? কুয়াশার ব্যবহারটা সম্পূর্ণ লজিক্যাল। স্বামী ছাড়া কোনো বউই থাকতে পারবে না৷ আর সেখানে শিশিরের মতো বউ ভালোবাসে এমন স্বামীর বউ হলে তো আরো কথায়ই নেই!
সকালে ঘুম থেকে উঠে তার চোখের পানি দেখেছে শিশির৷ তার হৃদয়ও যে পুড়ছে! সপ্তাহখানেক আগেই জানিয়েছিল আগামীকাল যাবার কথা৷ সেদিন থেকেই মন বেজার করে থাকে তার বউটা। সকালে আদরে, আহ্লাদে বউকে থামিয়েছে সে। একটু থেমে আবার শুরু করেছে এখন৷ শিশির যে রাত পোহালে তার থেকে দূরে চলে যাবে এটাই সে মানতে পারছে না৷ দহনে পুড়ছে সে। হৃদয় খা-খা করছে। জ্বলে যাচ্ছে বুক। যে মানুষটাকে কখনো দূরে যেতে দেখেনি, সব সময় কাছে পেয়েছে, বিয়ের পর থেকে একটা রাতও একা কাটায় নি, আদর, সোহাগে, ভালোবাসায় মুড়িয়ে রেখেছে সেই মানুষটাকে ছাড়া থাকা চারটেখানি কথা না! যে কোনো মানুষের হৃদয় পুড়বে৷ এক একটা দিন বহু বছরের মতো মনে হবে৷ দিন, রাত তার শূন্যতায় কাটবে৷ ঘরে এলে, বাহিরে গেলে তার স্বামীর সঙ্গ মনে পড়বে। মানুষটাকে কাছে পাবার বাসনা জাগবে কিন্তু পাবে না চাইলেও৷ চাইলেও যখন তখন আদর, সোহাগ পাবে না৷ আহ্লাদী বউকে আহ্লাদ করে মান অভিমান ভাঙানো, কথা বলা, আদর করা কিছুই হবে না। এসবই মানতে পারছে না শিশির, কুয়াশা। দুই জনেরই এক অবস্থা হচ্ছে। এক দহনে পুড়ছে৷
ভালোবাসা বড়ই অদ্ভুত জিনিস৷ সেটার সুখ, দহন দুটোয় হয় তুখোড়। ভালোবাসার মানুষটা কাছে থাকলে হাজারো রঙবেরঙের সুখের প্রজাপতি মন কুঠুড়িতে উড়ে বেড়ায় আর দূরে গেলে দা-বানল, লা’ভা’র ন্যায় তুখোড় দহন বাড়ায়। কী একটা অদ্ভুত জিনিস নাহ্! ভালোবাসার মানুষটা একটু ক্ষণের জন্যও দূরে গেলে হৃদয়ে তোলপাড় হয়, মস্তিষ্কে লাফিয়ে বেড়ায় মনে হয় সারাটাক্ষন যদি মানুষটাকে কাছে পাওয়া যায়!!
সেই ভালোবাসা নামক জিনিসটা ছেড়ে তারা কি থাকতে পারবে? পারবে কি থাকতে এরা? যারা সব সময় মারা মারি, চুলোচুলি, ঝগড়া করে এসেছে! দিন রাত যাদের এসব করে কেটেছে এতগুলো বছর! কতটা মিস করবে ভাবা যায়! ভাবা যায় কি তাদের মনের অবস্থা? নাকি অনুধাবন করাই যায়?
সকাল গড়িয়ে বিকেল, বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা, সন্ধ্যা গড়িয়ে ধরিত্রীপুরে রাত নেমেছে। চারিদিকে যেমন অন্ধকার, নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যাচ্ছে? ঠিক তেমনই অন্ধকার, নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যাচ্ছে কুয়াশার মন। তার হৃদয়ে যেন আমাবস্যা লেগেছে। লেগেছে অনামিশার গ্রহণ। বসন্ত ঋতু তো সকলের হৃদয় রঙিন করে কিন্তু তার হৃদয় আজ বেরঙ৷ তার যে হৃদয় রঙিন করার মানুষটায় তারথেকে দূরে চলে যাচ্ছে! রঙের মানুষটায় যদি না থাকে তবে হৃদয় রঙিন হবে কি করে?
রাত নয়টার দিকে কুয়াশা রাতের খাবারও খায়নি এখোনো৷ তার কিচ্ছু ভালো লাগছে না। শুধু কান্না পাচ্ছে। কান্নাকেই তার এখন আপন আপন মনে হচ্ছে। আজমিরা, জাকিয়া, ইয়াসমিন কত করে ডেকেছেন সে যায়নি৷ শিশির নেই বাড়িতে। সে সন্ধ্যায় বেড়িয়েছে কিছু দরকারে। রিজভীও তার সাথে।
দুই বন্ধুর হয়েছে এক জ্বালা৷ অল্প বয়সে বিয়ে করে এখন বউ বিনা দূরে থাকতে হবে এটা কি সহ্য করা যায়? না মানা যায়? দু’জনই এক বিরহে দিন কাটাচ্ছে। এদিকে বান্ধবীরা তার স্বামী শোকে দিন কাটাচ্ছে। কী একটা জ্বালা! ব্যাচেলর লাইফটায় এখন প্যারাময় করে বউ জুটেছে। সেই বউয়ের বিরহে এখন দুইজনেরই মনির খানের গান শোনার মতো অবস্থা।
সময় রাত দশটার দিকে শিশির বাড়িতে এলো। ওদিকে সব ঠিকঠাক করে এসেছে। মূলত গাড়ি ঠিক করা সহ কিছু দরকার ছিল। রিজভী এবং সে দুইজনই কারে যাবে৷ কারে একবারে ঢাকায় গিয়ে পৌঁছাবে। সকাল আটটায় তারা রওনা দেবে৷
শিশির ঘরে এলো তখন কুয়াশা বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে ফুঁপাচ্ছে। শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। দরজার সামনে থেকে তা দেখল সে। দীর্ঘ একটা শ্বাস ফেলল। নিজের ভেতরকার তোলপাড় দমিয়ে এগিয়ে গেল তার আহ্লাদী বউকে অভয় দিতে। সকাল থেকে সে এটাই করে আসছে। নিজেকে শক্ত রেখে বউকে সামলাচ্ছে। নিজের অবস্থা যদি বউয়ের কাছে প্রকাশ করে আহ্লাদী বউ তার আরো ভেঙে পড়বে। তাই সে নিজের দহন ভেতরেই দমিয়ে রাখছে। বলল,
” সারাদিন তো শুধু কেঁদেই গেলি! এবার তো একটু থাম! আর কত কাঁদবি?”
বলে শার্ট খুলতে লাগল সে। কুয়াশা প্রত্যুত্তর করল না। আগের ন্যায় পড়ে রইল। শিশিরের আবারো দীর্ঘ শ্বাস বেড়িয়ে এলো। সে বাথরুম ঢুকে গেল৷ আগে নিজেকে ফ্রেশ করা যাক। খিদেও লেগেছে খেয়ে দেয়ে বউকে দেখবে। ভেবে নিজে ফ্রেশ হয়ে বের হলো। প্রয়োজনীয় কাজ করল। কুয়াশা আগের মতোই পড়ে আছে। না শিশিরকে তাকিয়ে দেখেছে আর না উঠেছে। আজ সারাটাদিন যখনই বাড়িতে এসেছে, যেটুকু সময় বাড়িতে ছিল তখনই কুয়াশার সারামুখে অনামিশা সহ চোখে সমুদ্র দেখেছে। কারো ভালো লাগে এসব?
বেড়িয়ে গেল সে। রাতের খাবার সকলে নয়টাতেই সারে মালিথা ভিলায়। এরপর যারা বাহিরে থাকে তারা পরে এসে খায়। নিয়মমাফিক শিশিরও ভাবল কুয়াশা খেয়েছে এই জন্য কিছু জিজ্ঞেস না করেই চলে গেল। কিন্তু নিচে গিয়ে শাশুড়ীর কাছে খাবার চাইলে আজমিরা জানালেন কুয়াশাও খায়নি। জাকিয়াও সে-সময়ে নিচে এসে জানালেন অনেক ডেকেও আনা যায়নি আহ্লাদীকে। শিশিরের একটু রাগ উঠল। এতটাও সহ্য হলো না। তবে নিজেকে দমিয়ে নিল। হয়তো কুয়াশার জায়গায় সে নেই তাই তার মনে অবস্থাটাও সে বুঝছে না। কষ্ট তো তারও হচ্ছে! বউটার হয়তো একটু বেশিই হচ্ছে! এই ভেবে নিজেকে সংবরণ করে উপরে উঠে গেল আবার।
ঘরে এসে কুয়াশাকে তুলল দুইহাতে। কুয়াশা এবার ফোলা চোখ মুখ নিয়ে তাকাল শিশিরের দিকে। আৎকে উঠল শিশির। এ কী অবস্থা! সাথে সাথে বুকে ব্যথা অনুভব করল সে। বউকে জড়িয়ে ধরল বুকের সাথে। মিশিয়ে নিতে চাইল৷ জড়িয়ে ধরে বসে পড়ল বিছানায়। আর কুয়াশা হাউমাউ করে কেঁদে উঠল আবার। গলা জড়িয়ে ধরে।
কি করবে সে একে নিয়ে? তারও আর সহ্য হচ্ছে না। যাবার প্রতি মন চলে যাচ্ছে একেক সময়। কিন্তু যেতে যে তার হবেই! জোর গেলে সে একটা কাজ করতে পারবে সেটা হচ্ছে, সময় পেলে বাড়িতে আসা। এই ভেবে কুয়াশাকে তুলল। ব্যথাতুর নয়নে বউয়ের দিকে তাকাল সে। কুয়াশা ফুঁপাতে ফুঁপাতে তাকাল টলমল চোখে। চোখের পানি মুছিয়ে দিল দুই হাতে। আদুরে বাণী ছুড়ল,
” এ্যাই সোনা! তুই যদি এতটা ভেঙে পড়িস তো কিকরে হবে বলতো? আমি তো যেতেই পারব না? দেখ তোর এসব দেখে আমার যাবার মন উঠে যাচ্ছে। কিন্তু এমন সিদ্ধান্ত নিলে তো ভবিষ্যত আমাদের রসাতলে যাবে! একটু কষ্ট কমিয়ে বাস্তবে ফেরেক। এতটা আবেগী কবে থেকে হলি তুই? বুঝদার বউ আমার কোথায় গেল? ”
কুয়াশা ফুঁপাতে লাগল৷ কোনো উত্তর করল না। তার কিচ্ছু ভালো লাগছে না৷ আসলে সে সহ্য করতে পারছে না৷ এই মুখ কাল থেকে দেখতে পাবে না, ছুঁতে পারবে না! এইসব ভেবে বুক ভেঙে আসছে৷ শিশির আবার বলল,
” আমার যেতেই হবে। জোর গেলে আমি সময় পেলে শুধু আসতে পারব। তবে আমি আসব সময় পেলে। এবার হ্যাপি? ”
কুয়াশা তাও কথা বলল না। সে আবার বলল,
” এখনো খাসনি কেন? আর ঠিকমতো সকাল থেকেই নাকি খাসনি? ”
এবার সে উত্তর করল কান্না স্বরে,
” খেতে ইচ্ছে হয়নি। আর খেতেও ইচ্ছে করছে না।”
” থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দেব ফাজিল! খাবার যদি অনিয়ম করেছিস তো! এ্যাই তোর বয়ফ্রেন্ড লাগি আমি? যে ছেড়ে দিয়ে চলে যাচ্ছি সেই শোকে তুই নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে ঘরবন্দী হয়ে পড়ে আছিস? এতটাও কিন্তু মানব না আমি! অতিরিক্ত আবেগে ভাসলে খবর করব তোর। নিয়মিত যদি না খেয়েছিস তবে তোর অবস্থা কী করি দেখিস! ”
কুয়াশা আবার কেঁদে দিল। আঁকড়ে ধরল শিশরকে। শিশির আগলে ধরল। কুয়াশা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
” বিশ্বাস করো আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। থাকব কি করে আমি? একটা রাত, দিনও পাড় করতে পারব না আমি তোমায় ছাড়া। থেকেছি কি এমন কখনো? না তুমি থাকতে দিয়েছ? তুমিই তো এমন অভ্যাস তৈরি করে দিয়েছ ”
শিশির কি বলবে বুঝল না। এই আহ্লাদীকে সে একটা দিন না দেখে থাকতে পারে না। সে-ও থাকতে দেয়নি৷ কষ্ট তো হবেই! আবার নিজের কষ্টটা, ইমোশনটা নিজের মাঝে দমিয়ে নিল৷ নিজেকে যতটা পারল শক্ত ও কঠিন করল। বলল,
” কিছু হবে না। দুইদিন থাকলে সয়ে যাবে। এছাড়া আমি তোর হারানো জিনিস না যে হারিয়ে যাচ্ছি বা ছেড়ে চলে যাচ্ছি আর তুই বিরহে পাগল হয়ে যাচ্ছিস। ক্ষনিকের জন্য, নিজেদের ভালোর জন্য দূরে যাচ্ছি। মন চাইলে আসতে পারব, কথা বলতে পারব। তবে এতটা কেন ভেঙে পড়ছিস? হ্যাঁ এটা সত্যি যে আমরা ছোট থেকে এক সাথে আছি চোখের সামনে, কখনো দূরে যাইনি বা যাওয়ার প্রয়োজনও পড়েনি যেটা এখন পড়ছে।
এই জন্য এমন কষ্ট হচ্ছে। তবে নিজেদের একটু সামলাতে হবে। দুইদিন গেলে সয়ে যাবে। কুয়াশা আমরা স্বামী স্ত্রী কোনো গার্লফ্রেন্ড বয়ফ্রেন্ড না যে বিচ্ছেদের বিরহে ভুগতে হবে। এটা বাস্তব ফ্যান্টাসি থেকে বের হ আর আবেগ কমা৷ ভবিষ্যতের সুখের চিন্তা কর৷ আমাদের ভবিষ্যত আসবে তখনের চিন্তা কর৷ আমি যদি তোর আবেগে গা ভাসিয়ে দিই, বউয়ের পাগলামিতে সায় দিয়ে না যাবার সিদ্ধান্ত নিই তবে কি করে চলবে? ভবিষ্যতে আমার বউ, বাচ্চাকে খেতে, পড়তে দিতে হবে নাহ্? আর কতকাল বাবার পয়সায় বউ পালব? আর তুই যে ভান ধরেছিস, এতে বাড়ির লোক কি ভাবছে বলত? কষ্ট পাচ্ছিস, মন খারাপ করছিস ঘরে কর, নিজের মাঝে রাখেক পরিবারকে দেখাচ্ছিস কেন? নির্লজ্জ মনে করবে তোকে সকলে৷ বলবে কুয়াশা স্বামী শোকে কাতর হয়ে নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। ছিঃহ্ কী বাজে লাগবে শুনতে কথাটা! আচ্ছা সত্যি কী আমি তোকে এতটা পাগল করে দিয়েছে আদর সোহাগে? ”
শেষ কথাগুলো বলতে বলতে মিটমিট করে হাসল। মূলত কুয়াশাকে নরমাল করার চেষ্টা করল আর আগের বাঘা তেঁতুল রূপী বউকে দেখার ইচ্ছে জাগল তার৷ এই জন্য কথাগুলো বলা৷ কুয়াশা কাঁধে মাথা রেখে বুকের সাথে লেপ্টে এতক্ষণ কথাগুলো মন দিয়ে শুনছিল। কিন্তু শেষ কথাগুলো শুনে ভ্রু জোড়া আপনাআপনিই কুঁচকে এলো। শিশিরকে ছেড়ে দিয়ে মুখের দিকে তাকাল। দেখল মিটমিট করে হাসসে৷ রাগ উঠল কিঞ্চিৎ তার। সে এই বুনো ওলের শোকে কাতর হচ্ছে, ‘স্বামী তার বিদেশ’ ফিলিংস হচ্ছে আর সে আছে লোকে কি বলবে তা নিয়ে? ভেবেই দিল একটা কি-ল বসিয়ে শিশিরের বাহুতে। শিশির হাসল৷ বউ তার বাঘা তেঁতুল রূপে ফিরে এসেছে৷ এই তো এই রূপেই বউকে ভালো লাগে তার৷ কুয়াশা বলল,
” অসভ্য ফাউল আমি আছি আমার জ্বালায় আর তুমি আছো লোকের কথার ঠেলায়? আমার লোকের সাথে অত সাথ নেই। আমার স্বামী আমার থেকে দূরে যাচ্ছে এটাই আমার কষ্টের একমাত্র কারণ। আর হ্যাঁ তার আদর সোহাগও আমি রোজ মিস করব। ”
কুয়াশা শেষ কথাটা আবার কান্না মিশ্রিত স্বরে বলল৷ শিশিরেরও বুকটা ভারী হয়ে এলো৷ বুকে জ্বালা অনুভব হলো৷ কুয়াশাকে টেনে আবার বুকে নিল৷ লেপ্টে গেল সে স্বামীর বুকে। কাঁধের উপর মাথা রেখে গলায় মুখ গুঁজে দিল স্বামীর। গলা জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠল সে৷ শিশির বুকের মাঝে চেপে ধরল৷ মিশিয়ে নিতে চাইল বউকে। তার বউ আহ্লাদে গলে রইল। শিশির বলল,
” চল, খাবি! আমার খিদে পেয়েছে৷ খায়নি এখনো। ”
কুয়াশা তা শুনে ছেড়ে দিল। উঠে তাকিয়ে বলল,
” চলো, খাবে।”
বলে উঠে পড়ল৷ শিশির দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। শক্ত সে-ও হোক বউটা নিজেও হোক৷ কষ্ট পিষ্টে দিনগুলো চলে গেলেই হলো। ভাবতে ভাবতে শিশির উঠে দাঁড়াল। কুয়াশার হাত ধরল। এরপর একসাথে বেড়িয়ে গেল। তিন জা বসে ছিল বসার ঘরে৷ সকলের খাওয়া হয়ে গেছে এরা দু’জনেই শুধু বাদ আছে৷ নেমে শিশির মা’য়ের উদ্দেশ্যে বলল,
” খেতে দাও আম্মু। ”
জাকিয়ারা দু’জনকে দেখলেন৷ মুচকি হাসলেন৷ ছেলের কথায় সায় দিয়ে উঠতে গেলে কুয়াশা থামিয়ে দিয়ে বলল,
” লাগবে না আম্মু, তোমরা শুয়ে পড়ো গিয়ে। আমি করে নেব সব। ”
শিশির মুচকি হাসল। হাসল মা’য়েরাও। জাকিয়া তবুও বললেন,
” এগিয়ে দিই চল। ”
” বললাম তো লাগবে না। যাও শুয়ে পড়ো গিয়ে। আর জাগতে হবে না।”
অতিরিক্ত অধিকারমূলক কথাগুলো ছিল। যেটা দ্বারা যে কেউ বুঝবে সে এখন স্বামীকে নিজে হাতে পরিবেশন করে খাওয়াবে একা। আজমিরা সহ জাকিয়া, আম্বিয়া অবাক চোখে চেয়ে রইলেন তাদের সেই ছোট্ট কু্য়াশার দিকে। কত বড় হয়ে গেছে? স্বামী, সংসারের দায়িত্ব নিতে শিখে গেছে তাও আবার অধিকারের সাথে। জাকির মালিথা ও জাহিদ মালিথার সেই কথাগুলো তিন জনেরই মনে পড়ে গেল। তিনজনই আর কথা বললেন না। সম্মতি দিয়ে চলে গেল। শিশিরও চুপ করে শুধু দেখে গেল। কুয়াশা বলল,
” চলো! ”
বলে হাঁটা ধরল। পেছন পেছন শিশির গেল। কুয়াশা দু’জনের জন্য খাবার বেরে নিল। শিশির দেখল বউ তার গিন্নীর মতো সব পরিবেশন করল৷ কুয়াশা পাশে বসতে গেলে শিশির একটু টিভি সিরিয়ালের মতো ভোল ধরল। বউকে কোলের উপর বসিয়ে নিল। কুয়াশা বলল,
” আরেহ্ কি করছ? কেউ এসে যাবে। ”
” না আসে।”
” এবার তুমি একটু বেশি করছ না? এতক্ষণ না জ্ঞানের বন্যা বইয়ে দিয়ে এলে আমার মগজে? তো এখন তোমার এসব কি? ড্রামা, সিরিয়ালের ভোল ধরলে কেন? যে বেডরুম ছেড়ে ডাইনিংরুম, কিচেনরুমে রোমান্স করা? থার্ড ক্লাস একটা বিষয় এসব৷ ছাড়ো! যত রোমান্স ঘরে কোরো। লোকের সামনে পড়ে লোক হাসানোর প্রয়োজন নেই। ”
শিশির বউয়ের জ্ঞানের কথাগুলো শুনে হেসে ফেলল শব্দ করে। থেমে বলল,
” বাবাহ্! বউ দেখি আমার থেকে দ্বিগুণ জ্ঞানী? আচ্ছা এসব জ্ঞানের কথা ছাড়। আপাতত কেউ আর আসবে না এদিকে। আজ না হয় একটু ড্রামা, সিরিয়ালের মতো রোমান্স করলামই? ক্ষতি কি তাতে?”
কুয়াশা কথা না বলে ভ্রু ম্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। শিশির ভাত মাখাল। মাছের মাথা রান্না আজ। সাথে মাংস টাংসও আছে। মাখিয়ে নিজের ভাগের মাছের মাথা থেকে মাছ ছাড়িয়ে নিয়ে কুয়াশার মুখে ধরল। কুয়াশা অবাক হয়ে তাকাল৷ আজ অবধি শিশির কুয়াশাকে খাইয়ে দেয়নি। এই প্রথম। কুয়াশা আবার ইমোশনাল হয়ে উঠল৷ শিশিরের দিকে তাকাল৷ শিশির আবার খাবার নেবার জন্য ইশারা করল। কুয়াশা টলমল চোখে খাবার তুলে নিল৷ পরের বার মাখিয়ে সে মুখে নিল৷ কুয়াশা শিশিরের গলা জড়িয়ে ধরল। আনন্দে তার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। বললও সেটা খাবার চিবাতে চিবাতে,
” আমার আবার কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ”
শিশির খাবার চিবাতে চিবাতে বলল,
” এই বউ জাতি বড়ই রহস্যময়।”
কুয়াশা চোখ ছোট ছোট করে তাকাল। বলল,
” এ্যাই, আমার আনন্দে কাঁদতে ইচ্ছে হচ্ছে এতে রহস্যের কি দেখলে?”
” হ্যাঁ তো কাঁদ ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে, ট্রিপিক্যাল বউদের মতো!”
কুয়াশা শিশিরের বাহুতে একটা কিল বসিয়ে দিয়ে বলল,
” এ্যাই শুনো, কথায় কথায় এমন ট্রিপিক্যাল বউ বউ করবা তোহ্! অসহ্য লাগে! আমি মোটেও ঐগুলোর মতো করি নাহ্। হুহ্! ”
বলে আবার খাবার মুখে নিল শিশির ওর মুখের সামনে খাবার ধরে রেখে কথা শুনছিল। শিশির বলল,
” আচ্ছা?”
” হুঁ ”
” তা অনুভূতি বল! স্বামীর কোলে বসে তারই প্লেটে তারই হাতে খাচ্ছিস! ”
কুয়াশা তা শুনে বলল,
” শুধু তাই-ই নয় তারই পাতের তারই স্বাধের প্রিয় মাছের মাথাও খাচ্ছি। যেটার ভাগ সে আমাকে কেন? কাউকেই দিতে একচুল পরিমাণ রাজি হত না। ভাবা যায়!! ”
শিশির খাবার মুখে নিয়েই হেসে ফেলল কুয়াশার কথায়। কত ঝগড়াই না করত এগুলো নিয়ে? এখন আজ সেটার ভাগও দিয়ে দিল এই বউকে! শিশির বলল,
” কী আর করার? আমাদের সম্পর্কই যে হয়েছে ভাগাভাগি করার সম্পর্ক! তাই তোকে আমার মনের দখলের সাথে মাছের মাথার দখলও দিতে হচ্ছে। ”
বলে কুয়াশার মুখের সামনে খাবার ধরল৷ কুয়াশা খিলখিল করে হাসল শুধু৷ সুখ সুখ লাগে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার আগামীকালের কথা মাথায় চলে এলো৷ খাবার চিবাতে চিবাতে শিশিরের বুকে মাথা এলিয়ে দিল। শিশির যত্ন করে মাছের মাথার কাঁটা বেছে বউকে খাওয়ানো সহ নিজেও খেতে লাগল৷
খেয়ে দেয়ে শিশির ঘরে এসেছে। কুয়াশা ওদিকে নিজের কাজ সেরে ঘরে এলো। শিশিরের সব জামা কাপড় দিনেই গোছানো হয়ে গেছে৷ এখন সকালে আরো কিছু দরকারি ব্যবহার করাগুলো গোছালেই হয়ে যায়৷ সবই কুয়াশা করে দিয়েছে সকাল থেকে আর চোখের পানি ফেলেছে থেকে থেকে। শিশির দরজা আঁটকে এলো। কুয়াশা চুল বাঁধছিল মিররের সামনে দাঁড়িয়ে। সে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরল। পেট দুই হাতের মাঝে নিয়ে মিশিয়ে নিল বুকের সাথে৷ কুয়াশার উন্মুক্ত কাঁধে নাক ঘষা সহ ঠোঁট ছোঁয়াল৷ কুয়াশা স্বামীর ছোঁয়ায় কেঁপে উঠেছে। আজো শিশির ছুঁলে তার শিহরণ হয়৷ চোখ বন্ধ ছিল শুনতে পেল স্বামীর অতি নিপুনতায়, অতি নেশাক্ত কন্ঠে, অতি আহ্লাদময় আবদার,
” এ্যাই শাড়ি পরবি আজ একটু?”
কুয়াশা চোখ খুলল। দেখতে পেল শিশির মিররে তাকেই দেখছে৷ নজরে নজর আটকাল দু’জনের। আবদার একচুল পরিমাণ প্রত্যাক্ষাণ করল না সে মূহুর্তের মাঝে বলে উঠল,
” পরে আসি ছাড়ো। ”
শিশির শুনে আবার কাঁধের উপর অধর ছোঁয়াল। ছেড়ে দিল বউকে। কুয়াশা চলে গেল শাড়ি নিয়ে বাথরুমে। শিশির দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। নিজের মাঝের কষ্টটা সে যত পারছে দমানোর চেষ্টায় আছে। বার কয়েক শ্বাস নিল আর ফেলল। গিয়ে আধ শোয়া হয়ে বসল বিছানায়। ফোন নিয়ে ঘাটাঘাটি করা শুরু করল। কিছুক্ষণের মাঝে কুয়াশা শাড়ি পরে বেড়িয়ে এলো৷ আজ সেই শাড়িটা পরেছে যেটা সে বিয়ের দিন রাতে পরেছিল। সেই কালো পেড়ে লাল জমিনের সিল্ক-জামদানী শাড়িটা। মিররের সামনে গিয়ে একটু সাজল। কাজল সহ কিছু সিম্পল কসমেটিক্স পরল। চুল ছেড়ে দিল। আঁচল ছেড়ে বাম হাতে রাখা। ব্যস এতেই হয়ে গেল৷ শিশির ফোনে কাজ সেরে কুয়াশার দিকে তাকাল৷ কুয়াশা মিররের সামনে থেকে এগিয়ে গেল। শিশির মুগ্ধ হলো। সেই বিয়ের রাতের কথা মনে উঠে গেল। সেদিনের সেই শাড়িটা পরেছে বউ তার! নাকে তার দেয়া হীরার নাকফুল, হাতে বালা, গলায় চেইন, চোখে কাজল ছেড়ে দেয়া চুলে পুরোই অপূর্ব। ভেবে বলল,
” আমার অপ্সরা বউ। ”
কুয়াশা এই উপমাতে বার বার লজ্জায় নূয়ে পড়ে যতবার শোনে। ডাকল,
” এদিকে আয়!”
কুয়াশা এগিয়ে গেল। যেতেই কুয়াশাকে সামনে বসিয়ে বলল,
” বিয়ের দিন এই শাড়িতে দেখে সর্বপ্রথম বারের মতো তোর উপর ঘায়েল হয়েছিলাম। যেটা আগে কখনো হয়েছিলাম না। কেন বলতো? বিয়ের তিন কবুলের জন্যই কি?”
” হয়তো।”
শুনে কুয়াশার কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল সে। বলল,
” সত্যি বিয়ের তিন কবুলের জোর ভয়ংকর। যাহ্ যেকোনো বাঁধা পেরতে পারে। তা না হলে কি আর আমরা এভাবে এক হতে পারতাম? ”
কুয়াশা উত্তর করল না। শিশিরও আর এ নিয়ে কথা বলল না। তাকিয়ে থাকল। এরপর অতিরিক্ত লাইট অফ করে জিরো লাইট জ্বালাল। ঘরে হলুদাভ রঙে রঙ্গিন হলো। শিশির দুষ্টুমি করে বলল,
” এখন স্বামী তোর বিদেশ যাচ্ছে সেই ভোল ছাড়। আদর দে অনেক। যেন সেই আদর আগামী দুই বছরেও না মেটে। চল শুরু কর। ”
” কী ঠোঁট কাটা গো তুমি? ”
শিশির তা শুনে আধ শোয়া হয়ে শুয়ে থাকা বুকের উপর টেনে নিল কুয়াশাকে। বলল,
” যা ইচ্ছে বল। কিন্তু আজ আদর চাই আমার অনেক। কাল থেকে আর কাছে পাব না তোকে। সেই দহনে পুড়ছি আমি।”
এতক্ষণ পর স্বামীর ভেতরের দাবানল টের পেয়ে আবার কেঁদে উঠল সে। শিশিরের বুকে কপাল ঠেকিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে দিল। শিশির কিছু বলল না। কাঁদতে দিল এবার। সে-ও আর সহ্য করতে পারছে না। কিছুক্ষণ পর বলল,
” শুধু কি কাঁদবিই নাকি আদর টাদরও একটু দিবি? ”
বলতে বলতে উঠে বসল কুয়াশাকে নিয়েই। কুয়াশা তা শুনতে পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে শিশিরের শরীরের টিশার্ট খুলে নিল টান দিয়ে নিজেই। শিশির নির্বিকার। পরনে এখন টাউজার তার। কুয়াশা শিশিরের নগ্ন বুকে দুই হাত দিয়ে ধাক্কা দিল। শুয়ে পড়ল শিশির। কুয়াশা সেই বুকে নিজের অর্ধেক শরীর ছেড়ে দিল। শিশির মিটমিট করে হাসতে লাগল এবার৷ বউ তার নাকের পানি চোখের পানি এক করে ফেলল। বলতে নিল,
” এ্যাই… ”
আর বলতে পারল না। সব দুঃখ, কষ্ট ক্ষোভ, অভিমান শিশিরের বুকে ঝাড়তে লাগল। পুরো বুকে দাঁত দিয়ে ক্ষত বিক্ষত করতে লাগল। অনেক জোরে জোরেই বসাচ্ছে সেই দাঁত। কামড় দেবার প্রসেস টা এমন যে জ্বালিয়ে দিচ্ছে বুক। কিন্তু শিশির নির্বিকার হয়ে পড়ে রইল৷ দাঁত চেপে সহ্য করল। বলেছে দুই বছরেও মিটবে না এমন আদর দিতে কিন্তু এটা তাকে কামড়ে রক্তাক্ত করছে যেটা দুই বছর কেন আগামী দুই যুগেও মিটবে না।
মেয়েরা হয় ভালোবাসার পাগল, যত্নের পাগল। স্বামীর ভালোবাসা তারা সবসময় চাই। স্বপ্ন বুনে তা বিয়ের আগে। আর সেই স্বপ্ন যদি সত্যি পূরণ হয় তারা আনন্দে আহ্লাদী হয়৷ কুয়াশারও হয়েছে ঠিক তেমন অবস্থা। সে স্বামীর ভালোবাসা, যত্নের সাগরে ডুবে থাকে এবং আছে। আহ্লাদী হয়েছে স্বামীর কাছে। এখন সেই ভালোবাসা, যত্ন যদি কাছ ছাড়া করতে হয় সে তো দাপাবেই! শিশিরের থেকে সে না চাইতেই আদর, সোহাগ, ভালোবাসা বেশি বেশি পায় যেটা তার কাছে স্বপ্ন ছিল। এখন শিশিরের ভালোবাসা, আদর, সোহাগ থেকে দূরে থাকতে হবে এটাই তার দহন বাড়িয়ে তুলছে। জ্বলছে, পুড়ছে, ম’রছে।
শিশিরকেও সে দহনে পুড়িয়ে দিচ্ছে। দুটি হৃদয়ের এক অবস্থা। ভালোবাসা বাসির থেকে মরণ যন্ত্রণা হচ্ছে এই রাতে, এই ক্ষণে। তড়পাচ্ছে দুটি ভালোবাসার হৃদয়। দূরে যাবার কষ্ট একে অপরের শরীরের উপর প্রভাব বিস্তার করছে।
কুয়াশা শিশিরের বুকে কামড়াতে কামড়াতে একসময় আবারও ডুকরে কেঁদে ওঠে। মন চাচ্ছে হৃদয়টা বের করে দিয়ে দিতে তবেই যদি শান্তি পেত৷ শিশির অভাবে শুয়ে ছিল চোখ মুখ এঁটে ধরে৷ কুয়াশাকে ডুকরে কাঁদতে দেখে তাকাল। উঠে বসল আবার কুয়াশাকে সমেত নিয়ে৷ মাথা নিচু করে বুকের অবস্থা দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু হালকা আলোয় তা ভালোভাবে নজরে এলো না৷ এরপর তাকাল কান্নারত বউয়ের দিকে৷ বলল,
” জায়গা আর নেই? পাচ্ছিস না? খুঁজে দেব? ”
তা শুনে কুয়াশা শিশিরের বুকে ঝাপিয়ে পড়ল। আরো জোরে কেঁদে উঠল। দম আঁটকে কান্না আসছে। বুকে কী রকম কষ্ট হচ্ছে তা বোঝাতে কান্নারত অবস্থায় আঁটকে আঁটকে শিশিরকে বলে উঠল,
” আমি সহ্য করতে পারছি না৷ দেখো এখানে এই বুকে খুব কষ্ট হচ্ছে। এই রাত পর আগামী রাত আমার একা থাকতে হবে, একা রাত পাড় করতে হবে। আর তোমার নিঃশ্বাসের শব্দ আমি পাব না, তোমার গন্ধ আমি পাব না, তোমার বুক আমি পাব না, জড়িয়ে রাখার জন্য তোমার হাত পাব না। তোমার বুক আমার শান্তির জায়গা সেটা পাব না। রোজ সকালে কপালে চুমু আমি পাব না। তুমি আমার নেক স্মেল নিয়ে উঠবে আমার সকালের সেই শিহরণ আর পাওয়া হবে না৷ তোমার শরীরের মাদকের গন্ধ আমার শরীরের আর লেগে থাকবে না। কতদিন থাকব বলো তো একা? সে প্রহর কি যাবে? কাটবে কি আমার এক একটা দিন? তোমার সাথে খুঁনসুটি, ঝগড়া, মারা মারি কিছুই করতে পারব না। কতদিন থাকবে সেই নিঃসঙ্গতা? আমি একা থাকতে পারব না৷ যেয়ো না তুমি, প্লিজ যেয়ো না৷ নয়তো আমাকে, আমাকে তুমি নিয়ে যাও তোমার সাথে৷ দূরত্ব ভাবলে আমার বুক ভেঙে আসছে। ভালোবাসি, ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি তোমায়।”
আটকানো কন্ঠে প্রতিটা কথা বলল৷ কী নিদারুণ যন্ত্রণার কথাগুলো! একটা মেয়ে কতটা ভালোবাসলে এমন পাগলামো করতে পারে? এটা হচ্ছে পবিত্র ভালোবাসা। বিয়ের আগের প্রেমিক প্রেমিকারা দূরে বা ছেড়ে দিলে যে পাগলানি করে! সেটা হচ্ছে হারাম পাগলামি আর এটা সম্পূর্ণ হালাল পাগলামি। কতটা শক্তিশালী সে স্বামীর ভালোবাসা যে স্বামী বউয়ের থেকে দূরে যাচ্ছে বলে এমন পাগলামি করছে তার বউ? এই জন্যই বলা হয়, হালাল জিনিসের মূল্যই আলাদা হয়৷ তিন কবুলের জোরে সব কিছুই সম্ভব হয়।
কে বলে বিয়ের পর ভালোবাসা বাসি, আদর, যত্ন হয় না? যারা বলে তারা নির্বোধ। আলবাত হয়! চাইলেই হয়।সেটারও মন থাকা চায়৷ দুটি মনের মিল থাকা চায়৷ সেটা হয় সম্পূর্ণ হালাল সম্পর্ক যেটা আল্লাহ প্রদত্ত এবং ধর্মের বিধান৷ বিয়ে নামক পবিত্র শব্দ সাথে তিন কবুল নামক জোর। বিয়ের আগে হারাম, নিষিদ্ধ, সম্পর্কের জন্য হাজার কেঁদে, পাগলামি করে কি লাভ? সেই বুক ভাসানোটা যদি স্বামীর জন্য হয় তো ক্ষতি কি? সেটা কি ন্যাকামির কাতারে পরে? মনে হয় কি ন্যাকামি? এটা কোনো ন্যাকামি না স্বামী একটা শ্রদ্ধার জিনিস, সম্মানের জিনিস, সম্মান দিয়ে ভালোবাসার জিনিস৷ আর সেই সম্মানিয় ভালোবাসার স্বামী যদি দূরে যায় কষ্ট হবে না? এটা কি ন্যাকামোর পরিচয় হবে? উহু এটা পবিত্র সম্পর্কের জোর হবে৷
সকলে বলে সংসারের গেঁড়াকলে ভালোবাসা জানালা দিয়ে পালায়। আসলে এটা কিঞ্চিৎ হলেও ভুল কথা৷ ভালোবাসা কখনো হারায় না। সেটা চাপা পড়ে যায়। তাই সেটা চাপা পড়তে না দিয়ে দেখাতে হয়, প্রকাশ করতে হয়৷ সংসার ঝামেলা সব সংসারেই থাকে তাই বলে ভালোবাসাও কি বিলুপ্ত করতে হবে? উহু একদম না! ভালোবাসাকে লালল, পালন করে সারাজীবন চোখের সামনে ফুটিয়ে, তুলে ধরে রাখতে হবে। একজন স্বামী যেন দেখে আর ভাবে, তার স্ত্রী তাকে এখনো ভালোবাসে সেটাও আগেরই মতো আবার একজন বউ-ও যেন দেখে তার স্বামী তাকে সেই আগের মতোই ভালোবাসে। এভাবে দুইয়ের মাঝে চললে কখনো তৃতীয় ব্যক্তি বা পরকীয়ার মতো জঘন্য, নিকৃষ্ট, হারাম কিছুর সৃষ্টি হবে না আর না ডিভোর্স নামের শব্দটা কোনো স্বামী স্ত্রীর মাঝে শোভা পাবে৷ এইজন্য সংসার ভালোবাসা দিয়ে বাঁধতে হয়, ভালোবাসা দিয়ে সাজাতে হয়।
শিশির কুয়াশার গভীর কষ্টটা উপলব্ধি করতে পারল৷ যন্ত্রণাটা বুঝতে পারল৷ জ্বলে উঠল ভেতরে সব তারও৷ বউকে বুকের সাথে মিশিয়ে নেবার পণ করল৷ ভাবটা এমন যেন সে এই বুকে করেই তার বউকে সাথে করে নিয়ে যাবে ঢাকায়৷ কুয়াশা হিচকি তুলে কাঁদতে লাগল। মুখ তার স্বভাব সূলভ শিশিরের গলার মাঝে গুঁজে রাখা৷ সে কাঁদতে গেলেই এভাবে কাঁদে। কী পায় গলার মাঝে মুখ গুঁজে কাঁদতে কে জানে! শিশির নিজেকে সামলাল। একটুও প্রকাশ করল না নিজেকে কুয়াশার কাছে। শক্ত হয়ে রইল। শুধু বউকে অভয় দিতে আগলে রাখল বুকের সাথে। মাথা ঝুকিয়ে ঠোঁট ছুঁয়ে ধরে রাখল কুয়াশার উন্মুক্ত কাঁধে।
কিছুক্ষণ ওভাবেই থেকে শিশির বলল,
” হয়েছে কান্না? হলে শুরু কর আবার আদর দেয়া।”
ফুঁপানির মাঝে এমন কথা শুনে কুয়াশার প্রচণ্ড রাগ উঠল। একটুও মূল্য দিল না তার কষ্টকে? এই ভেবে সে শিশিরকে ছেড়ে দিল। মুখ তুলে ভেজা চোখে তাকাল শিশিরের পানে। শিশির নির্বিকার। সে কিছু বলতে নিবে কিন্তু বলতে পারল না৷ আবার এই কষ্টের মূল্য না দেয়া রাগটা শিশিরের অধরে ঝাড়তে লাগল। জম্মের আদর দিতে লাগল৷
কুয়াশা এক হাতে শিশিরের মাথার পেছনে দিয়ে ছোট ছোট চুল গুলো খামচে ধরে আছে আর এক হাতে শিশিরের গালে দিয়ে ঠোঁটে সমানে কামড় বসাতে লাগল। শিশির প্রথমে গুঙিয়ে উঠলেও পরক্ষণেই শান্ত হয়ে গেল৷ আজকের এই অত্যাচার গুলো সে মুখবুজে, মাথা পেতে মেনে নিল৷ কুয়াশার আক্রমণে পাল্টা আক্রমণ সে করল না। তবে নিজের ঠোঁটের বেহাল দশা সে বুঝতে পারল। রাগের মাত্রা কুয়াশা বুঝিয়ে দিল। সে ব্যথাটা হজম করতে কুয়াশার শাড়ির থেকে উন্মুক্ত কোমড়েরের বাঁকা খাঁজের মাঝে নিজের হাত দিয়ে খামচে ধরল। কুয়াশা সেদিকে নজর দিল না৷ সে রাগ, ক্ষোভ, অভিমান ঝারতে ব্যস্ত। শিশিরের আদর নেবার ঝাল মেটাতে ব্যস্ত।
কুয়াশার ঠোঁটে চুমু দেবার ধরণটা এমন যেন চুইংগাম চিবচ্ছে সে। শিশিরের ঠোঁটজোড়া তার কাছে এইমাত্র তেমনটায় মনে হচ্ছে। চিবিয়ে চিবিয়ে খেয়ে ফেলবে ভাব৷ কিছুক্ষণ তেমনটা চলতে থাকলে একসময় নোনতা স্বাদ পেল সে। রক্ত বের করে ফেলেছে৷ তখন হুশ এলো তার। থেমে গেল। অধর ছেড়ে দিল। তাকাল মুখ তুলে চোখ খুলে৷ শিশিরও চোখ খুলে তাকাল কুয়াশা ছেড়ে দিয়েছে বুঝে। এরপর ঠোঁট উল্টিয়ে নিজের ঠোঁট দেখার চেষ্টা করল। দেখল অবস্থা কাহিল। কুয়াশার শাড়ির আঁচল দিয়ে রক্ত মুছল। বলল,
” জোর শেষ? ”
বলে আবার বলল,
” আরেকটু সময় কামড়াতে পারতি! কম হয়ে গেছে। ”
কুয়াশা প্রত্যুত্তর করল না। শুধু বড় বড় নিঃশ্বাস নিল আর ফেলল। সে আবার বলল,
” বললাম আদর দিতে যেন দুই বছর না প্রয়োজন পড়ে। আর তুই এমন আদরই দিলি এ তো ইহজীবনেও আর না লাগে!”
বলে অসহায় লুকে তাকাল সে। কুয়াশা আগের ন্যায় বসে রইল। শিশির কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল বউয়ের ভেজা চোখের দিকে। এরপর বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলল। কুয়াশা কোমড়ের দুই পাশে হাত দিয়ে টেনে নিল অনেকটা কাছে। বলল,
” নিজেকে স্বাভাবিক কর। স্বামী তোর একা বাহিরে যাচ্ছে না। আরো লোকের যায়। প্রথম তাই খারাপ লাগছে। সব ঠিক হয়ে যাবে। ভিডিও কলে দেখা দেখি হবে। ওসব ছাড়। আজকের রাতটা আমার আদরে কাটা।”
বেশ শক্ত কন্ঠে কথাগুলো কাটকাট ভাবে বলল। কুয়াশা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল শুধু। একে একটুও নাড়াতে পারল না তার কষ্টটা? শিশির নিজেকে যতটা পারল শক্ত প্রকাশ করল। কথাগুলো বলে কুয়াশার বুক থেকে শাড়ির আঁচল টান দিয়ে সরিয়ে ফেলল। উন্মুক্ত হয়ে উঠল বুক, পেট। কুয়াশা তবুও নির্বিকার। কোনো প্রকার রেসপন্স দেখাল না। বলল,
” কৃত্রিম জিনিসে কি আর বাস্তবের স্বাদ পাওয়া যায়? ”
আবার সেই ইমোশনাল কথা! শিশির কি করবে এটাকে নিয়ে? কিভাবে শক্ত, স্বাভাবিক করবে? হাফ স্লিভের ব্লাউজ কুয়াশার শরীরে। গলা বড় হওয়াতে বক্ষবিভাজন ভেসে উঠেছে। শিশির সেদিকে তাকিয়ে ছিল। কুয়াশার কথায় মুখের দিকে তাকাল। হাত রাখল আদুরে বউয়ের গালে। বাণীও ছুড়ল আদুরে,
” একটু স্বাভাবিক হ সোনা! ”
কুয়াশা তা শুনে চোখ বন্ধ করল। বার কয়েক শ্বাস নিল আর ফেলল। চোখ খুলে তাকাল শিশিরের পানে। নেশাতুর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। চোখের ভাষা বলে দিচ্ছে,
” তোর সঙ্গ চাই আমার! ”
কুয়াশা তা বুঝল বুদ্ধিমতীর সাথে। মাথা ঝাঁকিয়ে উপর নিচ করে উত্তর করল। শিশির মুচকি হাসল। কুয়াশা শাড়ি খসিয়ে ফেলল। তা দেখে শিশির বলল,
” এ্যাই আমার সোনা আহ্লাদী বউ! এই পাঁজরে শুধু তুই আছিস। ”
শোনা মাত্র এক মূহুর্ত বসে থাকল না কুয়াশা। স্বামীর বুকে আশ্রয় নিল৷ শিশিরও আর কথা বলার সুযোগ দিল না৷ বউকে মিশিয়ে নিয়ে নিজের বুকের নিচে ফেলল৷ আদরে, সোহাগে ভরিয়ে তুলল বউকে৷ রাতটা বড্ড স্পেশাল করার চেষ্টা করল দুইজনে। দূরত্বের দহনটা আজ রাতে মিটিয়ে নিতে চাইল। আদরে, আদরে ভালোবাসায়, ভালোবাসার চাদরে। অন্তরের দাবনলের আগুন আদরে নিভাতে ব্যস্ত হলো। চার দেয়ালে, আলোআঁধারির ঘরে, নিস্তব্ধতার মাঝে, পূর্ণিমার রাতে আজকের সুখের মাত্রা বুঝিয়ে দিল দু’জন দু’জনকে। তারা স্বামী স্ত্রী দূরে গেলেও ভালোবাসা কমবে না।
চারিদিকে আজান দিচ্ছে। শিশির, কুয়াশা গল্পই করছিল। আজ রাতটা দু’জনে জেগেই কাটাল। কারো চোখে ঘুম ধরা দিল না৷ রাতে দুইজনের একান্ত ভালোবাসা বাসি, আদরের সময় কাটিয়ে গল্পে মত্ত হয়েছিল৷ স্বামীর নগ্ন বুকের সাথে লেপ্টে শুয়ে আছে কুয়াশা৷ শিশির বউকে আদরে আগলে রেখেছে দুই হাতের মাঝে৷ আজান কানে আসতেই কুয়াশা বলল,
” এ্যাই, আজান দিচ্ছে। ওঠো এবার! ”
শিশির নিজের কথা থামিয়ে তাকাল বউয়ের দিকে। কুয়াশাও তাকাল। চোখ টলমল করে উঠল কুয়াশার। আর মাত্র কিছু ঘন্টা এই মানুষটা চোখের সামনে থাকবে। শিশির কুয়াশার মনের কথা ধরতে পেরে আরেকটু শক্ত করে ধরল৷ কুয়াশাও ধরল। নিঃশব্দে কাঁদল কিছুক্ষণ বুকে মুখ গুঁজে। এরপর শিশিরের লোমশ বুকের সাথে নাক ঘষতে লাগল। মুখ ঘষল যেন বিড়াল ছানা শিশিরের বুকে লুকিয়ে পড়বে এবং লুকিয়েই শিশিরের সাথে যাবে। শিশির বউয়ের কপালে গাঢ় একটা চুমু আঁকল। কুয়াশা শিশিরের বুকে ঠোঁট ছোঁয়াল গভীর, গাঢ় করে। এরপর ছোট কয়েকটা চুমু দিল। মাথা তুলে তাকাল। শিশির নিচু হয়ে তাকাল। কুয়াশা ডান হাতটা তুলে শিশিরের ঠোঁটের উপর রাখল। আঙুল দিয়ে বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
” ব্যথা হয়েছে? ”
অতিশয় আদুরে কথা৷ শিশির মুচকি হেসে বলল,
” হুম অনেক, আদর দে! ”
কুয়াশা সত্যি সত্যি ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়াল। গাঢ় একটা চুমু দিল। ঠোঁট উঠিয়ে নিবে কিন্তু শিশির আঁকড়ে ধরল। অধর চুম্বন করল কিছুক্ষণ। নাকের উপর চুমু আঁকল। বলল,
” সব ঠিক হয়ে যাবে। নিজেকে পরিবারের সামনে নির্লজ্জ প্রকাশ করিস না৷ বাহিরে বাবা, মা’য়েরা থাকবে। স্বাভাবিক থাকবি ওকে? ”
কুয়াশা কিছু বলল না। উঠতে চাইল। শিশির কুয়াশাকে বুকের উপর তুলে নিল। টেনে নিজের মুখ সোজাসুজি করে। দুই গালে চুমু দিল, চিবুকে দিল, ঘাড়ের উপরে গলার নিচ বরাবর দিল৷ কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি আমার আহ্লাদী বউকে। আমরণ ভালোবেসে যাব আমার বউটাকে। ”
বলে কুয়াশার কালের লতিতে ছোট্ট কামড় দিল৷ কুয়াশাও পাল্টা অনুভূতি প্রকাশ করল। শিশিরের দুই গালে সহ নাকে, কাপালে, চিবুকে অধর ছুঁইয়ে দিয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
” আমিও ভালোবাসি আমার সুদর্শন স্বামীকে। আমরণ ভালোবেসে যাব আমার স্বামীকে। থেকে যাব তার একমাত্র একান্ত ব্যক্তিগত রুগী হয়ে। ”
বলে সে-ও কামর দিল কানের লতিতে। শিশির মুচকি হাসল। বলল,
” চল নামাজের দেরি হবে। ”
কুয়াশা আর কথা বাড়াল না৷ উঠে পড়ল। শরীরে শাড়ি জড়িয়ে নিল। এতক্ষণ ব্লাউজ আর পেটিকোট ছিল। সে কখনো স্বামীর সাথে বিশেষ সময়ের পর নগ্ন হয়ে থাকে না। নিজেকে যথাযথ ঢেকেই শোয়। এটা শিশিরই তাকে বলেছিল প্রথম দিন৷ জানিয়েছিল নগ্ন হয়ে যেন না ঘুমোয় কিংবা না থাকে। ওমনটা থাকা অনুচিত।
দু’জনই উঠে বাথরুমে ঢুকে গেল। একসাথে পাক-পবিত্র হয়ে ফরজ নামাজ আদায় করে নিল৷ কুয়াশা হিজাব খুলে মিররের সামনে দাঁড়িয়ে হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকাতে লাগল৷ তা দেখে শিশির এগিয়ে এলো। কুয়াশার থেকে নিয়ে নিল হেয়ার ড্রায়ারটা৷ বসল কুয়াশাকে নিয়ে বিছানায়। কোলের উপর বসিয়ে নিয়ে যত্ন করে শুকিয়ে দিল কুয়াশার চুল৷ কুয়াশা নির্বিকার। লেপ্টে রইল শুধু স্বামীর বুকে।
চুল শুকিয়ে এলে হেয়ার ড্রায়ার টা রেখে কুয়াশাকে দুই হাতে জড়িয়ে ধরল। বলল,
” সোনা! ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করবি, পড়াশুনো করবি। রোজকার মতো হেসে খেলে বেড়াবি৷ খারাপ লাগলেও বাহিরে প্রকাশ করবি না। আমি আছি ফোন দিবি তৎক্ষনাৎ। যখন ইচ্ছে হবে হুয়াট্স আপে ভিডিও কল দিবি৷ আমি ফ্রি থাকলেই তোকে সময় দেব৷ দুই একদিন থেকে অভ্যাস হয়ে যাবে৷ এই ঘরে একা থাকতে না পারলে তোর ঘরে গিয়ে থাকিস নয়তো ছোট আম্মুর কাছে থাকিস৷ বাড়িতে সকলে থাকবে সকলের সাথে আড্ডা দিবি মন ভালো থাকবে। আমি চেষ্টা করব আসার। আর মন খারাপ করে থাকবি না ওকে? আমাকে হাসি মুখে বিদায় দিবি শান্তি লাগবে আমার। ”
কুয়াশা বুকে মাথা রেখে প্রতিটা কথা শিশিরের দিকে তাকিয়ে শুনল৷ শিশিরও কুয়াশার দিকে তাকিয়েই বলল৷ টলমল চোখে চেয়ে রইল শিশিরের দিকে। শিশির কপালে অধর ছোঁয়াল। টপটপ করে পানি পরল চোখ থেকে৷ মুছিয়ে দিল শিশির যত্ন করে৷ বুকের সাথে আগলে নিল বউকে। তার বুকটা ভারী হয়ে আসল৷ আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা!!
সকাল ছয়টার দিকে শিশির, কুয়াশা বাহিরে নিচে নেমে গেল। দু’জন মিলে বাকি জিনিস গুছিয়ে নিয়েছে। বসার ঘরে জাকির মালিথা ছাড়া প্রতিটা সদস্য আছে এমনকি পুচ্চু বর্ষণও আছে। সে উঠে গেছে। মা’য়ের কোলে শুয়ে আছে। শিশির গিয়ে আগে বর্ষণকে নিল বৃষ্টির কোল থেকে। চুমু খেল। দিন দিন কিউটের ডিব্বা হচ্ছে ছেলেটা৷ ছেলেকে নিয়ে বসল সোফায়। সকলে মুচকি হাসি উপহার দিল শিশিরকে। নীহার, হিম গিয়ে দুই পাশে বসল। নীহার কাঁধে হাত রাখল। সেদিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল শিশির৷ তার এই ভাইটাকে সব ভাইদের থেকে বেশি মিস করবে সে। নীহারের বুকটা ভারী হয়ে এলো। জড়িয়ে নিল একহাতে। বলল,
” দেখে শুনে থাকবি৷ আর আসার চেষ্টা করিস। আমি জানি তুই বলেছিস আসবি কিন্তু না আসার প্ল্যানে আছিস। এটা করিস না। সকলের সাথে দেখা সাক্ষাৎ করে যাস৷ আমারও এপ্রিলের পর ঢাকায় যেতে হবে পরীক্ষার জন্য এরপর টিকলে ট্রেনিং। এর মাঝে সময় করে করে দেখা করে আসব।”
শিশির ভাইয়ের কাঁধে মাথা রাখল৷ যেটা সে আগেও করত৷ পাশে থেকে হিম বলল,
” ভাই! মিস করব তোমাকে খুব৷ ”
শিশির একহাতে বর্ষণকে ধরে অন্যহাতে হিমকে জড়িয়ে নিল৷ ভাইয়ের মাথায় চুমু দিয়ে বলল,
” আমিও তোদের খুব মিস করব৷ ”
বৃষ্টি বলল,
” দেখে শুনে থাবকে দেবরজী। সময় পেলে আসবে। মিস করব আমরা সকলে তোমায়৷ ”
ইয়াসমিন বলল,
” মাঝে মাঝে ভিডিও কল দিবি সময় নিয়ে কথা বলবি সকলের সাথে। চাপ কম নিবি টেনশন করবি না। ”
আহ্ এমন ভাবি কইজনে পায়? শিশির অমায়িক হাসল দুই ভাবির কথা শুনে। ভাবিদের অভয় দিল। তুষার বলল,
” কখনো থাকিস নি একা একটু সমস্যা হবে তবে মানিয়ে নিয়ে চলবি৷ বাহিরে ভালো মন্দ দেখে, বেছে চলবি ”
বড় ভাই বলে কথা! তেমন ভাবেই ট্রিট করবে এটাই স্বাভাবিক৷ সে কি এতটাই ছোট? নাকি এই পরিবারের কাছে এখনো সেই ছোট্ট শিশিরই রয়ে গেছে!! শিশির হাসল ঠোঁট প্রসারিত করে। বলল,
” আচ্ছা ভাই। ”
তুহিন বলল,
” বাসায় উঠবি নাকি ? ”
” বাসায় ওঠার চিন্তা করেছি তবে ঠিক করিনি এখনো ওখানে গিয়ে করব আপাতত হোটেলে উঠব। কয়েকটা রাত কাটানো লাগবে এরপর বাসা নিব। রিজভী আছে দুইজনে মিলে ম্যানেজ করে নেব”
উত্তরে তুহিন বলল,
” খাবার তো কিনে খেতে হবে তাহলে?”
” হ্যাঁ, কিনেই খাব৷ এরপর যদি সমস্যা হয় তো ভর্তির পর ম্যাস নেব ভার্সিটি কাছাকাছি অনুযায়ী।”
“যেটা ভালো হয় করিস। তবে দেখেশুনে থাকিস। ”
তুহিনের কথাতেও বলল,
” আচ্ছা ভাই ”
সকলে এভাবেই টুকটাক গল্পগুজব করল৷ কুয়াশা রান্না ঘরে চলে গেছে তখনি৷ মা’য়েরা শিশিরের জন্য রান্না করতে অনেক আগেই উঠে গেছে৷
সকাল সাতটার দিকে। কুয়াশার বুক আরো ভারী হয়ে গেছে। আর মাত্র এক ঘন্টা! সে বার বার ঘড়ি দেখছে। খাবার টেবিলে সকল ভাইরা এক সাথে বসেছে। জাকির মালিথাকে শিশিররা গিয়ে নিয়ে এসেছে আজ। শিশির বাবার পাশে বসে ভাইদের সাথে খাচ্ছে। বৃষ্টিরা কেউ বসেনি৷ বৃষ্টি ঘরে গেছে বর্ষণ কান্না করছিল খাওয়াতে গেছে। কুয়াশা, ইয়াসমিন সহ মা’য়েরা পরিবেশন করছে। আজমিরা মেয়ে-জামাইকে যত্ন আত্তি ভালোই করে। আজো করছে। জাকিয়া টলমল চোখে ছেলেকে দেখছে। শিশির কারো দিকে তাকাতে পারছে না। সকলের মন খারাপ তার চলে যাওয়া নিয়ে৷ আজ হারে হারে বুঝছে এই বাড়ির প্রতিটা সদস্য তাকে কতটা চোখে হারায় আর ভালোবাসে৷ যেটা তার এতদিনের অভিযোগ ছিল যে কুয়াশার জন্য তার আদর কমিয়ে দিয়েছে।
খাওয়া দাওয়া করে সব গোছগাছ এবং রেডি হয়ে গেল শিশির। ঘরেই সে। কুয়াশা একের পর এক পানি ফেলছে শিশির রেডি হচ্ছে। শব্দহীন কেঁদেই চলল৷ শিশির কিছু বলল না। সে তার কাজ করল। এসবে এখন মন দিলে তার যাওয়াই হবে না৷
রেডি হয়ে কুয়াশার সামনে গিয়ে হাঁটু মুড়িয়ে বসল। দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
” আমার যেতেই হবে। এভাবেই কেঁদে বিদায় দিবি আমাকে? কাল থেকে তোর হাসি মুখটা দেখি নি। একটু হাসবি না? ”
” আসছে না হাসি। আমি কি করব? কান্না পাচ্ছে আমার শুধু। ”
কাঁদতে কাঁদতে উত্তর করল সে। শিশির মুচকি হাসল। হাতের পিঠে ঠোঁট ছুঁয়ে বলল,
” হাসতে না পারলেও কান্না বন্ধ কর।”
কুয়াশা তা শুনে ফুঁপানি বন্ধ করল বাধ্য মেয়ের মতো। শিশির চোখ মুছে দিল। উঠে দাঁড়িয়ে বউকেও দাঁড় করাল৷ কুয়াশা শিশিরের পিঠ আঁকড়ে ধরে জড়িয়ে ধরল। বুকে মাথা রাখল। বলল,
” এই শান্তির স্থান আমার জন্য বরাদ্দ। কখনো কেউ জায়গা করে নেবে না তো? ”
শিশির চমকে উঠল। কেঁপে উঠল কেন যেন। এ কি বলল তার বউ? এত বড় কথা!! শিশির বুক থেকে কুয়াশাকে তুলল৷ হতবাক চোখে চায়ল। বলল,
” কুয়াশা..! ”
কন্ঠটা রূঢ় ছিল অনেক৷ কুয়াশা কেঁদে বলল,
” আমাকে মাফ করো। আমি ভুল কথা বলেছি জানি৷ আমার উপর অভিযোগ রেখো না। কিন্তু আমার খুব ভয় হয়৷ আল্লাহ না চাইতে এত ভালোবাসা দিয়েছে আমাকে। এত এত ভালোবাসা সারাজীবন সইবে কিনা সেটা ভাবি সবসময়। তাই বলে ফেললাম৷ ক্ষমা করো।”
শিশির বুঝল কুয়াশা মনের কথাগুলো। সব মেয়েই এমন ভয় পায়। এটা স্বাভাবিক। স্বামী কাছ ছাড়া হলে সবার আগে ঠিক এই ভয়টাই মনে এসে হানা দেয়৷ শিশির বলল,
” তিন কবুল বলা বউ রেখে অন্য মেয়ের দিকে তাকানোর প্রয়োজন পড়বে না আমার। এই বুক শুধু আর শুধু মাত্র আমার আহ্লাদী বউয়ের। তার নামে দলিল করে দিয়েছি। আমরণ তারই রবে৷ আমি আমার বউয়ের ভালোবাসায় ডুবে আছি। কে তুলবে সেখান থেকে? কারো সাধ্যি আছে কি আমাকে তোলার? ”
কুয়াশার বুকটা আনন্দে নেচে উঠল৷ শিশিরের বুকে চুমু দিল৷ পা উঁচু করে গলা জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিল। ঠোঁটে গভীর একটা চুমু দিয়ে মুখ তুলে শিশিরকে অমায়িক একটা হাসি উপহার দিল৷ নিজেকে সংবরণ করল। আর তার স্বামীকে দেখাবে না তার কষ্টটা৷ শিশির মুচকি হেসে বউয়ে কপালে চুমু দিয়ে বলল,
” সাবধানে থাকবি।”
” সাবধানে যাবে এবং সাবধানে থাকবে।”
শিশির হেসে কুয়াশাকে ছেড়ে ব্যাগ গুলো সব একে একে বের করে রেখে আসল বাহিরে৷ শেষ ব্যাগ নিয়ে দরজার সামনে যেতেই বুক কেঁপে উঠল। ঘুরে কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আবার শক্ত করে জড়িয়ে ধরল কুয়াশাকে। কুয়াশা প্রতিক্রিয়া দেখাল না৷ কিন্তু হাসল। শিশির ছেড়ে বেড়িয়ে গেল৷
‘
গাড়ি চলে এসেছে। সে আগে উঠবে এরপর রিজভীকে নিয়ে রওনা হবে৷ বাবার ঘরে গিয়ে বাবার মাথার কাছে বসে আদর নিল। জাকির মালিথা বললেন,
” স্বপ্ন পূরণ করে ফিরবে ইনশাআল্লাহ।”
মুচকি হাসল সে৷ এরপর উঠে আরো ভালোমন্দ কথা বলে মা’কে অনেকটা সময় নিয়ে জড়িয়ে ধরে রাখল। জাকিয়া শক্ত থেকে হাসি মুখে ছেলেকে বিদায় দিচ্ছেন৷ বললেন,
” আমার সোনা, আমার ছোট মানিক সাবধানে থাকবি। আল্লাহর কৃপায় সব ভালো হবে ইনশাআল্লাহ। ”
সম্মতি দিয়ে মাকে নিয়ে বসার ঘরে এলো। একে একে সব ভাইদের জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল৷ জাহিদ মালিথাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় নিল। তিনি বললেন,
” ইনশাআল্লাহ যাত্রা সহ তোমার দিন এবং উদ্দেশ্য শুভ হোক এবং সফল হোক তা। ”
আজমিরা, আম্বিয়ার থেকে বিদায় নিল। উনারাও হাসি মুখে বিদায় দিচ্ছেন। আদর করলেন। বৃষ্টি, ইয়াসমিনের থেকে নিল সব শেষে বর্ষণকে চুমু খেয়ে বিদায় নিল। কুয়াশা চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। তাকাল সেদিকে৷ ইয়াসমিন পাশে থেকে আশ্বাস দিল৷ শিশির বেড়িয়ে গেল একে একে সকলে গেল৷ নীহার শিশিরের কাঁধ ধরে গাড়ির সামনে আসল৷ পেছনে বাড়ির সকলে এলো কিন্তু দুইটা মানুষ নেই। ব্যাগ তুলে দিয়ে শিশির সকলের দিকে তাকাল৷ কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মানুষটাকে পেল না৷ বুকটা ভারী হয়ে গেল। বুকে ব্যথা অনুভব হলো। জাকির মালিথা তো আসতে পারবেন না তাই আসে নি। কিন্তু কুয়াশা!! সে আসেনি স্বামীকে গাড়িতে তুলতে।
শিশির ডাকল মা’কে,
” আম্মু, কুশু কই? ”
আশেপাশে দেখল সে নেই। পাগলিটা আসে নি! ইয়াসমিন বলল,
” আনতে গেলাম এলো না৷ দৌড়ে উপরে চলে গেছে। ”
শিশিরের এবার সবকিছু এলোমেলো হয়ে উঠল। আর সহ্য হলো না৷ নিজেকে সহ্য করার যথা সাধ্যি চেষ্টা করেও ধরে রাখতে পারল না৷ কাল থেকে কষ্ট, আবেগ সব দমিয়ে রেখেছে৷ ভালোবাসার কাছে শক্ত থেকেছে। কিন্তু এখন শেষ যাত্রায় কুয়াশার মুখটা না দেখে তার গাড়িতে ওঠা অসম্ভব মনে হলো৷ চোখ মুখ লাল হয়ে গেল৷ মায়ের দিকে তাকাল৷ জাকিয়া বললেন,
” পাগলীটা বোধহয় কান্না করছে ঘরে। ”
শিশির অসহায় হয়ে বলল,
” আম্মু…! ”
” যাহ্ থামিয়ে নিয়ে আয়।”
শিশির আর একটা সেকেন্ডও দেরি করল না। বউকে ছাড়া সে গাড়িতে উঠবে না। টান পায়ে চলে গেল ভেতরে৷ তড়িৎ এলো নিজের ঘরের দিকে। গুঙিয়ে কান্নার আওয়াজ বাহিরে থেকেই পেল। দরজা ভিড়ানো। বউটাকে বলা হয়েছে পরিবারের সামনে নির্লজ্জ না হতে এটা ভেবে সে আর গাড়ির কাছেই যায়নি। শিশিরকে গাড়িতে উঠতে দেখলেই সে কেঁদে দেবে।
শিশির দরজা খুলে হতভম্ব, হতবাক হয়ে গেল৷ পাঁজরে তীব্র ব্যথা হতে লাগল বউয়ের এই করুণ দশা দেখে। এ কী অবস্থা!! ছুটে এসে কুয়াশাকে ধরল৷ বলে উঠল,
” আমার সোনা! এ কী করছিস তুই বলতো? ”
শিশিরের হাত পেয়ে আর কথা পেয়ে সে আরো জোরে কেঁদে উঠল। শিশিরকে ছাড়াতে ছাড়াতে তিব্র ক্রোধের সাথে বলল,
” ছাড়! ছাড় আমাকে। তুই যেখানে যাচ্ছিস সেখানে যা৷ আমাকে দেখতে হবে না তোর। চলে যা তুই৷ আমাকে একা রেখে যাচ্ছিস যাহ্। কি দেখতে এলি আবার? দেখ তোকে ছাড়া ভালো থাকতে পারব না আমি। দেখেছিস? এবার যাহ্!”
বলতে বলতে শিশিরের পিঠে খামচি সহ কিল, চাপ্পড় দিতে লাগল আর ধাক্কাতে লাগল। কিন্তু শিশির ছাড়ল না আর না সরল। সে একের পর এক বলেই গেল ছাড়ার কথা আর সরার কথা৷ শিশির খামচি সহ সবটা সহ্য করে নিল। ধরে রাখল অস্থির বউকে শান্ত করার জন্য।
শিশির যখনি মেইন দরজা দিয়ে বের হয়ে গেছিল তখনই সে ঘরে চলে আসে৷ তার আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি হয়নি। পরিবারের সামনে নিজেকে প্রকাশ না করে ঘরে চলে আসে। আজ অবধি যাকে এমন রাখঢাক করে বিদায় দিতে হয়নি আজ সেটা সে পারল না। ঘরে এসে নিজের শরীর থেকে টান দিয়ে ওড়না খসিয়ে ছুড়ে মা-রে অন্যদিকে। তার অসহ্য লাগছে সব। বুক ছিড়ে যাচ্ছে। একটা দিনও কাটানোর শক্তি পাচ্ছে না সেখানে একের পর এক দিন কাটানো অসম্ভব! ওড়না ছুঁড়ে দিয়ে নিজের চুল খামচে ধরে সেখানেই ক্ষান্ত হয় না। গলার সামনে বুকের উপর আঁচড় কাটে। বুকের উপরের জামার অংশ ধরে ছিঁড়ে ফেলার পণ করে। সেটাতে আরো আঁচড় লেগে রক্ত বেড়িয়ে আসে। নরম চামড়া এরজন্য রক্ত আসে৷ বুকের জামা টানার ফলে ছিঁড়ে তো নি কিন্তু পেছনের চেইনে টান লেগে অনেকটা খুলে যায় ফলে কাঁধ আলগা হয়ে যায়৷ শরীরে থাকা অন্তর্বাস দৃশ্যমান হয় কাঁধের উপর৷ সব শেষে সে বিছানার পাশে ফ্লোরে বসে বিছানায় কপাল ঠেকিয়ে গুঙিয়ে কাঁদতে থাকে।
ওর এমন অবস্থা দেখে শিশির কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেছে৷ একে রেখে যাবে কি করে? এমন পাগলামি কবে থেকে শিখল? এই মেয়ে এতটা ভালোবেসে ফেলেছে তাকে? ভাবতে ভাবতে শিশির বুকের সাথে ধরে রাখা কুয়াশাকে তুলে সারা মুখে, গলায়, বুকে এলোপাতাড়ি চুমু দিল৷ কুয়াশা আদর পেয়ে শিশিরকে আঁকড়ে ধরে গলায় মুখ গুঁজে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। এর এত ভালোবাসা কই রাখবে সে? আবার চেপে ধরল বুকে৷ কুয়াশা কেঁদেই গেল৷ শিশির বুকে রেখেই কুয়াশার কাঁধ থেকে জামার স্লিভ তুলে অন্তর্বাস অদৃশ্য করল। পেছনের চেইন টেনে দিল৷ কাঁধে চুমু দিল৷ তুলল বুক থেকে৷ তাকাল বউয়ের গলা, বুকের দিকে৷ আঁচড়ে রক্ত উঠছে। হাত বুলিয়ে দিল৷ আদর দিল অজস্র সেখানে৷ কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় বসল। ফাস্ট এইড বক্স বের করল। সেভলন দিতে দিতে বলল,
” যাহ্ গেলাম নাহ্। সব বাদ দিয়ে দিলাম৷ ঘরে বসে শুধু বউয়ের কাছে থাকব৷ বউয়ের আদর নেব আর দেব। ঘরকুনো পুরুষ হবো৷ বউ আর বাচ্চাকে বাপের ঘাড়েই রাখব। এটাই সঠিক উপায় হবে৷ বউ তো চাচ্ছে না এসব৷ সে কাছে চাচ্ছে তাই থাকব৷ আমার বোধহয় আরো ভালো হবে। মানুষের তো আর স্বামী নেই। স্বামী ছাড়া থাকে না তারা। সবাই বউয়ের আঁচলের নিচে থাকে। আমিও থাকব৷ এতে যদি কেউ খুশি হয় তো সেটাই হোক ”
শিশির এক একটা কথা রূঢ় ছিল কিন্তু সাথে অভিমানও ছিল৷ এত করে বুঝিয়ে কাজ হচ্ছে না। মেজাজটা তো উঠছেই সাথে খারাপও লাগছে। কুয়াশা হিচকি তুলতে তুলতে বলল,
” আমি তো কাউকে দেখাতে চাই নি এসব! হাসি মুখেই তো বিদায় দিলাম। এখন আমি আমার কষ্ট বদ্ধঘরে একাই প্রকাশ করছি দেখতে এলো কেন কেউ? সে তো বেড়িয়ে গেল তো ফিরে এলো কেন? আমি তো যেতে মানা করছি না! ”
শিশির শুনল৷ একটু রেগে বলল,
” এমন ভাব ধরেছিস যেন স্বামী দুনিয়ায় আর কারো নেই৷ পাবলিক দেখলে তোকে ন্যাকামি করা মেয়ে উপাধি দেবে। ”
” আমার স্বামীর মতো নেই কারো। ”
শিশির পাল্টা উত্তর পেয়ে তাকাল৷ সে কুয়াশার বুকের উপর সেভলন দিচ্ছিল৷ বলল,
” নেই তোহ্ এভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করবি? কি করেছিস এসব? ”
” ঠিক করেছি৷ আমার শরীর আমি করেছি। কাউকে দেখতে বলি নি। ”
কী পাগলামো উত্তর আর জেদ!! শিশির বলল,
” তুই পুরোটাই আমার। ”
কুয়াশা কিছু বলল না৷ শিশির সেভলন দিয়ে রাখল সেগুলো। কুয়াশা বলল,
” যাও আমি ঠিক আছি। ”
” গাড়িতে তুলে দিয়ে আয় ।”
” পারব না। ”
চোখ গরম করে তাকাল শিশির৷ নামিয়ে দিল কোল থেকে। ওড়না তুলে এনে পড়িয়ে দিল৷ বলল,
” চল।”
কুয়াশা কোনো কথা বলল না। শুধু পা মিলাল।
গাড়ির কাছে যেতেই সকলে তাকাল৷ হাসল কিঞ্চিৎ। বিয়ে করতে না চাওয়া দুইজনেরই কী অবস্থা দেখল সকলে। শিশির কুয়াশার দিকে তাকিয়ে আদুরে ভাবে বলল,
” আসছি, নিজের যত্ন নিস। ”
” তুমিও। ”
বুনো ওল বাঘা তেঁতুল পর্ব ৬১+৬২
শিশির অমায়িক হেসে সকলের থেকে আবার বিদায় নিল৷ এরপর গাড়িতে উঠে পড়ল। কিছুক্ষণের মাঝে গাড়ি চলেও গেল৷ কুয়াশার মুখে আমাবস্যাতে ছেয়ে গেল। শিশির গাড়ি গেইট পার হওয়ার আগে হাত নাড়িয়ে বিদায় নিয়ে কুয়াশা সহ সকলের দিকে তাকিয়ে রইল যতক্ষণ দেখা গেল৷ অদৃশ্য হতেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলল। এই দূরত্ব জলদি শেষ হোক৷
