ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৫
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
প্রহেলিকা ছুটে শুদ্ধর ঘরে ঢুকল। আশপাশে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল। মেঝের দিকে তাকিয়ে দেখল, সেখানে দু-একটা শোপিসের টুকরো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সে ভ্রু কুঁচকে সামনে তাকাতেই দেখল, শুদ্ধ একটা বড় ফার্স্ট এইড বক্স নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তুলোয় স্যাভলন লাগাচ্ছে।
প্রহেলিকা এগিয়ে যেতে যেতে লক্ষ্য করল, শুদ্ধের ঠোঁটের পাশে ও গায়ের কিছু জায়গায় ভালোই জখম হয়েছে। সে ধীরে ধীরে সেসব স্থানে স্যাভলন লাগাচ্ছে, তবে তার চেহারায় বিন্দুমাত্র ব্যথা বা বেদনার কোনো ছাপ নেই।
শুদ্ধ সামনের দিকে তাকিয়েই প্রহেলিকার উদ্দেশ্যে খোঁচা মেরে বলল, “আরে বড় ভাবি! আপনি এত সকালে? আসেন, আসেন!”
প্রহেলিকা ভ্রু কুঁচকে শুদ্ধর পাশে এসে দাঁড়াল। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মাথা থেকে পা পর্যন্ত কয়েক সেকেন্ড পর্যবেক্ষণ করল।
শুদ্ধ ভ্রু নাচিয়ে রসিকতার সুরে বলল, “নাউজুবিল্লাহ! বড় ভাবি, আপনি এভাবে আমার হবু বউয়ের স্বামীকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে পারেন না! এতে কিন্তু আমার বউয়ের হক নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা আছে!”
প্রহেলিকা বিরক্ত হলো। কপালে ভাঁজ ফেলে বিদ্রুপের কণ্ঠে বলল, “দ্য গ্রেট ডাক্তার আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধের গায়ে এমন সুন্দর ডিজাইন কে এঁকে দিল, শুনি?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শুদ্ধ শুধু হাসল, কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখাল না। সে নিজের মতোই হাত চালাতে লাগলো।
প্রহেলিকা আবার ও ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে কটাক্ষ করে বলল, “এই না বলো! শুদ্ধ চৌধুরী… এই শুদ্ধ চৌধুরী সেই, সে না চাইলেও তাকে মারার ক্ষমতা পৃথিবীর কেউ রাখে না? তাহলে এখন তোমার চেহারার নকশার এমন হাল কেন?”
শুদ্ধ এবার পুরোপুরি প্রহেলিকার দিকে ঘুরে তাকাল। ঠোঁটে বাঁকা হাসি ধরে রেখেই বলল, “শুদ্ধ চৌধুরী না চাইলে তাকে মারার ক্ষমতা কেউ রাখে না… আর সেটা তোর চেয়ে ভালো কে জানে? চেয়েছি বলেই মারতে পেরেছে। শুদ্ধ চৌধুরীকে তার কাছের মানুষ বা আপনজনরা আঘাত করতে চাইলে সে বাধা দেয় না।”
প্রহেলিকা তাচ্ছিল্যের হেসে। পুনরায় ব্যঙ্গ করে বলল, “বাহ বাহ! সামনাসামনি তো সাপ-বেজির মতো আচরণ কর, কিন্তু তলে তলে দরদ দেখছি কম না!”
শুদ্ধ রক্তমাখা তুলোটা ডাস্টবিনে ফেলতে ফেলতে অপমানের সুরে বলল, “আফসোস তোকে এভাবে ভালোবাসার মতো একজন ও নেই! আমাকে নিয়ে গবেষণা করে যত সময় নষ্ট করছিস, তার এক পার্সেন্টও যদি নিজের স্বামীর পেছনে দিতি, তাহলে আজ তোর এই দশা হতো না।
এখনো সময় আছে! আমার বিষয়ে মাথা ঘামিয়ে কিছুই করতে পারবি না। এর চেয়ে ভালো, নিজের চরকায় তেল দে। আমার পেছনে গোয়েন্দাগিরি করে সময় নষ্ট কোরিস না।”
প্রহেলিকা মনে মনে তীব্র ক্রোধে জ্বলে উঠল। কিন্তু রাগটা চিবিয়ে গিলে নিয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “যা ভালো বোঝো!”
সকাল ৯টা।
শিকদার বাড়ির নাশতার টেবিলে উপচে পড়া জনগণের ভিড়। সবার কথাবার্তা আর হৈ-হুল্লোড়ে শব্দের পুরো ডাইনিং রুম গমগম করছে। তিন কর্তার খাওয়া অনেক আগেই শেষ। সাজিদ শিকদার বাসায় নেই, তিনি সিলেট গিয়েছেন। বছরের প্রায় অর্ধেক সময়ই তিনি সিলেটে থেকে ওখানকার ব্যবসা দেখাশোনা করেন।
শিকদার বাড়ির তরুণ জমিদাররা একে একে চোখ ডলতে ডলতে এসে নিজেদের পছন্দমতো বসে পড়েছেন। তাঁদের জমিদারি সব আদব-কায়দা, মা-চাচিদের হাতের ঝাটার বাড়ি না খেলে তাঁদের আবার ঘুম ছাড়তেই চায় না।
তনুস্রী বেগম সব ছেলে-মেয়েদের তুলে নাশতার টেবিলে পাঠিয়ে দিয়েছেন। অনুস্রী বেগম, অনন্যা বেগম ও অর্থি বেগম মিলে সব খাবার বাচ্চাদের পরিবেশন করে দিচ্ছেন।
পৃথম নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে একদম স্বাভাবিকভাবেই স্যান্ডউইচে কামড় বসাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, তার থেকে সুবোধ ছেলে হয়তো এই শিকদার বংশে আগে কখনো জন্মায়নি। তার ঠিক সামনের চেয়ারে বসে লজ্জায় লতিয়ে যাচ্ছে ইনায়া। সে ক্ষণে ক্ষণেই কেঁপে কেঁপে উঠছে, সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে তার গালের রক্তিম লালিমা।
প্রিয়তা হাত দিয়ে লম্বা চুলগুলো পেঁচাতে পেঁচাতে এসে ইনায়ার পাশে ধপ করে বসে পড়লো।
চোখ-মুখে ঘুম ঘুম ভাব স্পষ্ট। অরণ্য ওর ঠিক সামনাসামনি বসেছে। তন্ময় এখনো আসেনি বিধায় সে তার পিছে লাগতে পারছে না। কিন্তু সে আবার বেশি সময় কারো পিছে না লেগে থাকতে পারে না, তাই তখন থেকে উসখুস করে যাচ্ছে।
কিন্তু প্রিয়তাকে এসে বসতে দেখে তার মাথায় শয়তানি বুদ্ধিগুলো কিলবিল করে উঠলো। সে বাঁকা হেসে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে গভীর চিন্তার অভিনয় করে বললো, “গতকাল রাতে মনে হয় রায়পুরে ডাকাতি হয়েছিল, ছোড়দা!”
সমুদ্র শুধু পানির গ্লাসটা মুখে দিয়েছিল, কিন্তু ভাইয়ের মুখে ‘ডাকাতির’ কথা শুনেই বিষম খেলো।
সঙ্গে সঙ্গেই রাজ চোখ-মুখ কুঁচকে বিরক্ত কণ্ঠে বললো, “আমাদের মন অনেক বড়, ফকির-মিসকিনদের খাওয়ানো আমাদের খানদানের অনেক দিনের অভ্যাস। তাই সব খেয়ে নিলেও তোকে না করবো না। তাও ধীরে খা, খেতে গিয়ে যদি পটল তুলিস, তখন আবার আমাদের মান-সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়বে। লোকে ভাববে তোকে হয়তো খেতে দেই না!”
সমুদ্র করুণ মুখে চাইল রাজের দিকে, কিন্তু রাজ পাত্তা দিল না। বিশ্বজয়ের হাসি দিয়ে মুরগির রানে কামড় বসালো।
সমুদ্র এবার রেগে তাকালো ভাইয়ের দিকে, রেগে বলল, “আমাকে খেতে দেখলেই তোর সব আজাইরা কথা মনে পড়ে!”
অরণ্য দুষ্টু ভঙ্গিতে ভাইকে কিছু একটা ইশারা করতেই সমুদ্রের ফেস এক্সপ্রেশন চেঞ্জ হয়ে গেল। সে ও বাঁকা হেসে তাল মিলিয়ে বললো, “হে আল্লাহ! কোথায় কোথায় কী কী ডাকাতি হয়েছে? ভাই, বড় আব্বুকে খবর দিবো নাকি? তুই জাস্ট একবার ডাকাতের নামটা বল, বড় আব্বুকে বলে নেড়া করিয়ে রায়পুরের চৌরাস্তায় দাঁড় করিয়ে রাখবো!”
অরণ্য ভুল শুধরে দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ওটা ‘ডাকাত’ হবে না, ‘ডাকাতি’ হবে।”
টেবিলের সকল উৎসুক জনতা চোখ বড় বড় করে উৎসাহ নিয়ে ওদের দুই ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
শুধু পৃথম, প্রেম আর প্রিয়তা এসব নিয়ে কোনো ইন্টারেস্ট নেই, কারণ তারা বেশ ভালোই জানে—এগুলো কী লেভেলের বাঁদর, আর তাদের বাঁদরামির লেভেল সম্পর্কেও তাদের বেশ ভালোই ধারণা আছে!
পূর্ণতা বিস্মিত হয়ে বললো, “কিন্তু ভাইয়া, এমন কিছু তো শুনলাম না?”
অরণ্য সাথে সাথেই জবাব দিল, “আরে সেজভাবি, এটা ডাকাতনির সিক্রেট মিশন ছিল, তাই কেউ জানে না।”
অরণ্যের সম্বোধন শুনে সবাই আরও বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকালো, থতমত খেয়ে গেল। অরণ্য, পূর্ণতার ও ভ্রু কুঁচকে গেল।
অরণ্য ভয়ার্ত চোখে রাজের দিকে তাকালো, কিন্তু রাজ এসবে পাত্তা দিলো না সে না শোনার ভান করে একের পর এক খাবার মুখে ঢোকাচ্ছে। ভাবখানা এমন, কে কী বললো, কে কী করলো—তাতে তার কিছু যায় আসে না।
চিত্রা সন্দেহের সুরে বলল, “সব না হয় বোঝলাম, কিন্তু ভাইয়া, পূর্ণ আপনার ভাবি হয় কিভাবে?”
অরণ্য কেবলা মার্কা হাসি দিলো কথাটা কাটানোর চেষ্টা করে বলল, “আসলে আমার সেজো ভাবির অনেক শখ! কিন্তু দুঃখের বিষয়, আমার সেজদাকে আব্বু-আম্মু কিছুতেই বিয়ে দিতে রাজি হচ্ছেন না। তাই আমারও আর ভাবি হচ্ছে না! তাই ভাবির বয়সী কাউকে দেখলেই আজকাল সেজদার বউ মনে হয় তার মুখের দিকে তাকালেই ভাবি ভাবি ফিল পাই । তাই না চাইতেও ‘ভাবি’ মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, হিহি!”
চিত্রা এমন বেহুদা লজিক শুনে বেক্কেল বনে গেল।
অরণ্য ঘাড় ফিরাতেই দেখল, রাজ ওর দিকে কঠিন চোখে তাকিয়ে আছে। সে ভয়ে একটা ফাঁকা ঢোক গিলে আল্লাহর উদ্দেশে বলল, “হে আল্লাহ! লাথি মারার জন্য সব সময় আমার এই পেকাটি মার্কা পেটটাই আপনার পছন্দ হয়!”
কত চেষ্টা করি সত্যি কথাগুলো হজম করে নেওয়ার , কিন্তু সেই বদহজম হয়েই জিভ দিয়ে পিচলে যায়!”
প্রেরণা বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “কি সব ভংচং বলে যাচ্ছিস? মূল টপিকটাই তো চাপা পড়ে গেল!”
থিরা ও সায় জানিয়ে বলল, “হ্যাঁ ছুড়দা, তুমি কোন সিক্রেট ডাকাতনির কথা বলছিলে?”
ডাকাতের কথা মনে পড়তেই অরণ্যের ঠোঁটে আবারও শয়তানি হাসি খেলে গেল। সে মুহূর্তেই চিন্তিত হয়ে বলল, “হ্যাঁ, ডাকাত তো আমাদের মধ্যেই আছে, আর সেটা নিয়েই দুশ্চিন্তায় আছি!”
সবাই বিস্ফোরিত নয়নে তাকালো। এবার প্রিথম, প্রেম আর প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তাকালো।
প্রিথম ঠান্ডা কণ্ঠে বলল, “আরেকটা বদরামি মার্কা কথা বললে তোর কপালে দুঃখ আছে!”
অরণ্য মেজদাদানের কথায় গুরুত্ব না দিয়ে ভাষণ দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল, “হে জনগণ! কাল সারারাত যে ডাকাতি করেছে, সে বর্তমানে আমাদের মধ্যেই আছে!”
“এখন তোমরা জিজ্ঞেস করতে পারো, আমি কিভাবে বুঝলাম? দেখো, সবাই পুরো রাত ঘুমিয়েছে, কিন্তু ডাকাত তো আর ঘুমায়নি!”
সবাই উত্তেজিত নয়নে তাকিয়ে সম্মতি জানালো।
অরণ্য পুনরায় বলল, “সে যেহেতু ঘুমায়নি, তাই এখন নিশ্চয়ই ঘুমে ঢুলছে। তো, আপনারাই বুঝে নিন!”
“বুঝলে বুঝপাতা, না বুঝলে তেঁতুলপাতা! আমি আবার বেশি সত্যি কথা বলে কারো শত্রু হতে চাই না!”
সবাই হাঁ করে চেয়ে রইল অরণ্যের দিকে।
প্রেম বিরক্ত কণ্ঠে বলল, “সকাল সকাল আমার ভাই-বোনদের পিছে না লাগলে হয় না? তোর হয় না, লেজকাটা হনুমান!”
সবাই একসাথে হেসে উঠল। তারা আগেই বুঝেছিল, এসব ফাজলামি। অনুশ্রী বেগম ধমকে ছেলেমেয়েদের বললেন,
“আহ্! খাওয়ার সময় এত কথা কিসের? সবাই চুপচাপ খাও!”
সঙ্গে সঙ্গে সবাই একদম ভালো বাচ্চার মতো চুপ হয়ে গেল। ইনায়া এখনো থেকে থেকে কেঁপে কেঁপে উঠছে। প্রিথম শুরু থেকেই তার দুই পা নিজের পুরুষালি পা দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে, কিন্তু তার মুখে কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
ইনায়াকে এভাবে চিংড়ি মাছের মতো লাফাতে দেখে প্রিয়তা বিরক্ত কণ্ঠে বলে উঠল,
“কি সমস্যা তোর? এমন কাঁপাকাঁপি করছিস কেন?”
ইনায়া অসহায় চোখে প্রিয়তার দিকে তাকাল। প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে তার দিকেই তাকিয়ে আছে, কিন্তু ইনায়া আর কিছু বলতে পারল না। তার যে প্রচণ্ড লজ্জা লাগছে! সে যে এই মানুষটার স্পর্শ নিতে পারে না, তার কেমন কেমন লাগে, এটা কাকে বুঝাবে? আবার এই লোককে ছাড়া ও বাঁচা যাবে না!
শুদ্ধ নাশতা না করেই অনুস্রি বেগমের চোখ ফাঁকি দিয়ে চুপচাপ কেটে পড়ার তাল করছিল। কিন্তু অনুস্রি বেগম ঠিকই তাকে দেখে ফেললেন। সে সদর দরজার কাছে পৌঁছতেই অনুস্রি বেগম পেছন থেকে ডাক দিলেন,
“আব্বু, আব্বু, না খেয়ে কোথায় যাচ্ছ ? এসো, খেয়ে যাও!”
শুদ্ধ দাঁড়িয়ে পড়ল, কিন্তু পেছনে ফিরল না। অনুস্রি বেগম আবারও ডাকতে ডাকতে তার কাছে চলে এলেন। আদুরে কণ্ঠে বললেন,
“এসো, আব্বু।”
শুদ্ধ অসহায় চোখে অনুস্রি বেগমের দিকে ফিরে তাকাল। তিনি শুদ্ধকে দেখে ভ্রু কুঁচকে বললেন,
“বাড়ির ভেতর মাস্ক পরে ঘুরছ কেন?”
শুদ্ধ নমনীয় কণ্ঠে উত্তর দিল,
“বড়মামী, আমার খুব জরুরি একটা পেশেন্ট এসে গেছে। এখনই যেতে হবে। আমি বাইরে খেয়ে নেব।”
কিন্তু অনুস্রি বেগম অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললেন,
“বাইরের খাবার শরীরের জন্য ভালো নয়, অস্বাস্থ্যকর! তুমি নিজেই ডাক্তার হয়ে এমন কথা কীভাবে বলতে পারো? চলো, খাবে!”
শুদ্ধ আরও কিছু বলতে চাইল, কিন্তু অনুস্রি বেগম কোনো কথা না শুনেই আদেশের সুরে বললেন,
“চুপচাপ এসো!”
শুদ্ধ বেচারা আর কি করবে তাই সে ও অসহায় মুখে পিছু নিল। এতক্ষণে প্রায় সকলেই খাওয়া শেষ, কেবল প্রিয়তা আর তুহিনা বসে আছে। প্রিয়তা ওর ফেভারিট খিচুড়ি এক লোকমা মুখে দিচ্ছে, আর একটা করে কাঁচা মরিচে কামড় বসাচ্ছে। ঝালে মেয়েটার চোখ-মুখ লাল হয়ে গেছে, কিন্তু কিছুতেই খাওয়া থামানো যাবে না! প্রিয়তার ভাষ্যমতে, এটাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ খাবার, যদিও প্রণয় ওকে কখনোই ঝাল খেতে দিতো না।
কিন্তু ঝাল তো প্রিয়তার খুবই ফেভারিট! আর সাথে বড় এক প্লেট বিফ খিচুড়ি থাকলে তো আর কথাই নেই! তাই তো সে অনেকক্ষণ ধরে মনের সুখে খেয়েই চলেছে!
ডাইনিং রুমে পা রাখতেই থমকে গেল শুদ্ধ। তার দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল কালো থ্রি-পিস পরা রমনীর পানে। তার হৃদপিণ্ড সহসাই ধুকপুক করতে করতে বলে উঠল,
“তুই একদিন এই মেয়ের হাতেই মরবি!”
বেশিক্ষণ ঘুমানোর ফলে প্রিয়তার চোখ-মুখে ঘুমু ঘুমু আভাটা এখনো লেপ্টে আছে। অতিরিক্ত ঝালের কারণে ফরসা গাল আর নাকের ডগা রক্তিম হয়ে উঠেছে, চুলে বাঁধা ঢিলা খোঁপাটা প্রায় খুলে যাবে যাবে ভাব! কিন্তু এসব নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই, সে নিজের খাওয়ায় মগ্ন।
শুদ্ধ হেসে মনে মনে বলল, “কি জ্বলন্ত রূপ তোমার, অগ্নিকন্যা! ওই আগুনে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ঝলসে যেতে হয়!”
প্রিয়তার ঝালের ঠেলায় এবার নাক দিয়ে চোখে দিয়ে পানি এসে গেছে। সে তড়িঘড়ি করে পানির গ্লাস হাতে নিল, কিন্তু বিধি বাম—পুরো গ্লাসে এক ফুটা ও পানি নেই !
প্রিয়তা নাক টেনে বলল,
“উফ!”
সে পাশের জগ তুলে দেখলো সেটাও খালি! আসলে মূলত এগুলো সে নিজেই খালি করেছে।
— অতিরিক্ত ঝালে প্রিয়তা লাল হতে হতে ঘামতে শুরু করেছে।
রক্তলাল ঠোঁটজোড়া মরিচের মতো ঝলছে! সে উঠে রান্নাঘরের দিকে দৌড় দিতে নিলেই পেছন থেকে শুদ্ধ ওর হাত টেনে ধরল!
প্রিয়তা ঝটপট পিছন ফিরে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, “ডাক্তার সাহেব, পানি!”
শুদ্ধ হেসে জলভর্তি গ্লাস ওর মুখের সামনে ধরতেই প্রিয়তা ঢকঢক করে পুরো গ্লাস খালি করে দিল।
শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে চেয়ে আছে। প্রিয়তা পানিটা শেষ করে মনে হলো দেহে পুনরায় প্রাণ ফিরে পেয়েছে! সে বড় একটা শ্বাস নিয়ে শুদ্ধর দিকে তাকালো।
শুদ্ধ বাঁকা হেসে বলল, “এই সামান্য ঝালটা সহ্য করতে পারলে না, রেড চেরি?”
প্রিয়তা হাঁ করে শ্বাস ফেলে বলল, “ওটা কে সামান্য বলে অপমান করবেন না! ওটা অনেক ঝাল!”
শুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে হেসে কিছুটা প্রিয়তার কাছে এগিয়ে গেলো। নিজের পকেট থেকে রুমাল বের করে প্রিয়তার কপালের ঘাম মুছতে মুছতে রহস্যময় কণ্ঠে বলল—
“খুব ঝাল লেগেছে, তাই না, মাই চেরি? মিষ্টি খাবে? না থাক, এখনই মিষ্টি খেয়ে ঝাল কমানোর দরকার নেই। বরং আরও বেশি বেশি ঝাল সয়ে নেওয়ার অভ্যাস করো। কারণ এরপর তোমাকে আরও ভয়ানক ঝাল সহ্য করতে হবে! আর সেই ঝাল মিষ্টি দিয়েও যাবে না! তখন তুমি না বললেও আমি কিন্তু শুনবো না!”
বলেই বাঁকা হেসে চেয়ার টেনে বসে পড়ল।
প্রিয়তা আহাম্মক বনে গেলো! সে গোলগোল চোখে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো, এই মানুষটা কী বলে গেল! কিন্তু আফসোস, এমন জট পাকানো জিলাপির প্যাঁচমার্কা কথার প্যাঁচ ছাড়াতে প্রিয়তার ছোট্ট মস্তিষ্ক ব্যর্থ হলো! সে শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বলল—
“উনার নিশ্চিত পাগলের ডাক্তার হওয়া উচিত ছিল! কিন্তু উনাকে হার্টের ডাক্তার বানালো! কোন গাধায়?”
তার ভাবনার মধ্যেই তীব্র ঝালে তার ঠোঁট জ্বলে উঠলো! সে তো ভুলেই গিয়েছিলো! ছুটে গেল সে রান্নাঘরের দিকে!
তুহিনা এতক্ষণ ধরে পুরো কাহিনি হাঁ করে গিলছিল! বিস্ময়ে তার চোখ-মুখ হা হয়ে আছে!
শুদ্ধ প্রিয়তার চেয়ারে বসে সামনে তাকালো—প্রিয়তার ফেলে যাওয়া মরিচ মেশানো আধা প্লেট খিচুড়ি! খেতে পারুক আর না পারুক, দুই-তিনজনের খাবার সে একাই নিয়ে বসে !
শুদ্ধ হাসলো পাশের র্যাক থেকে একটা spoon তুলে নিলো। প্লেটের পাশে এখনও আট-নয়টা কাঁচা মরিচ পড়ে আছে! শুদ্ধ মুখ থেকে মাস্ক খুলে এক চামচ খিচুড়ি মুখে দিতেই ঝালে তার ব্রহ্মতালু অবধি জ্বলে উঠলো!
শুদ্ধ আবার প্রিয়তার মতো এত বড় ঝাল লাভার নয়! তার ঝাল সহ্য হয় না!
শুদ্ধ আরেক চামচ মুখে দিয়ে মনে মনে বলল—
“উফ! সব তেজ শুধু আমার বেলাতেই, সুইটহার্ট! কিন্তু ব্যাপার না, এই শুদ্ধ চৌধুরীর প্রেমের সাগরে তোমার সকল তেজকেই আহুতি দিতে হবে!”
সে সব খিচুড়ির সাথে অতিরিক্ত ঝাল অংশটা মিশিয়ে একের পর এক বাইট নিতে লাগলো। এবার ঝাল কম লাগছে! তার ঠোঁটের পাশে একটু কাটা ছিল, তাই খানিকটা জ্বলছে। তবুও সে পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুরো প্লেট শেষ করে টিস্যু পেপারে মুখ মুছতে মুছতে উঠে চলে গেলো!
তুহিনা নামের যে কেউ একজন তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে—তাতে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালো না শুদ্ধ! এমন ভাব করলো যেন সে তুহিনাকে দেখতেই পায়নি!
তুহিনার আঁখিজুগল কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম! সে গোল গোল চোখে শুদ্ধের কার্যকলাপ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব দেখল! তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে, তার মাথায় যেন দিনে-দুপুরে বজ্রপাত হলো!
শুদ্ধের মতো স্ট্রং পার্সোনালিটির কেউ কিনা এত তৃপ্তি করে কারও এত এঁটো খাবার খেল?
এটা তুহিনার চোখ কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইলো না। তুহিনা মনে মনে আওড়ালো—পশ্চিম দিকে যেমন সূর্য উঠতে পারে না, তেমন শুদ্ধ চৌধুরীও কারও এঁটো খেতে পারে না! It’s totally impossible! তাহলে আমি যেটা দেখলাম…?
গলা কাঁপছে তুহিনার।
ডাক্তার শুদ্ধ চৌধুরী প্রোপার হাইজিন মেইনটেইন করে চলেন। তাঁর আলাদা ডায়েট চার্টও রয়েছে। তিনি যখন যেমন ইচ্ছা, তখন তেমন খাবার খান না। আর এসব অতিরিক্ত তেল মসলাযুক্ত খিচুড়ি-টিচুড়ি তো কখনো খাওয়ার প্রশ্নই আসে না! তাছাড়া, খাবার টেবিলে কারও একটা এঁটো প্লেট পড়ে থাকলে শুদ্ধ সেই টেবিলে বসেন না পর্যন্ত!
এই পর্যন্ত ভাবতেই তুহিনার মনে হলো, সে হয়তো স্বপ্নের জগতে আছে! সবকিছু বিশ্বাস করতে তার পাক্কা দশ মিনিট লাগলো!
চিত্তে কিছু একটা আসতেই তুহিনার নিঃশ্বাস আটকে গেল! সে যা ভাবছে, তা কখনোই সত্য হতে পারে না!
সে বিদ্যুৎগতিতে উঠে দাঁড়াল, কাঁপা পায়ে ছুটল প্রহেলিকার ঘরের দিকে।
ব্রেকফাস্ট শেষ, তাই এখনই শিকদার বাড়ির ছেলে-মেয়েরা স্কুল, কলেজ, অফিস, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য বেরিয়ে যাবে। অরণ্য, সমুদ্র আর প্রেরণা দশ মিনিট আগেই ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেছে। প্রণয় নিজের গাড়ি নিয়ে চলে গেছে। প্রেম, রাজ, প্রীতমও বেরিয়ে যাচ্ছিল।
ঠিক তখনই পেছন থেকে অনুস্রী বেগম ডেকে উঠলেন।
মায়ের ডাক শুনে তিন ভাই দাঁড়িয়ে পড়ল। অনুস্রী বেগম কাছে এসে বললেন, “তোরা তো চলে যাচ্ছিস, ওদেরকে একটু ওদের বাড়ি পৌঁছে দে!”
প্রেম একটু তাড়াহুড়ো করে বলল, “বাড়িতে তো আরও এক্সট্রা দুটো গাড়ি আছে, আম্মু! ড্রাইভার আঙ্কেলকে পৌঁছে দিতে বলো। আজ অনেক ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে!”
অনুস্রী বেগম ছোট ছেলেকে ধমক দিয়ে বললেন, “মেহমানের আগে কিছু নয়! আর বাড়ির এক্সট্রা গাড়ি দুটো সার্ভিসিংয়ে দেওয়া হয়েছে।”
রাজ খানিকটা বিরক্ত হলো।
প্রীতম দেখল, ভাইরা কেউ যাবে না। তাই সে বলল, “আমি ওদের পৌঁছে দেব, বড় আম্মু।”
অনুস্রী বেগম হাসলেন। ওরা সবাই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল।
প্রহেলিকা নিজের ঘরে বসে গভীর চিন্তায় ডুবে আছে। সে প্রণয়কে ফোন করতে করতে পাগল হয়ে যাচ্ছে, কিন্তু চিরাচরিতভাবে প্রণয় ফোন ধরছে না! আজ তার খুব টেনশন হচ্ছে। প্রচণ্ড রেগে আছে প্রনয়—এখন যদি ওর নিজের কোনো ক্ষতি করে ফেলে? প্রণয়ের বিপদের আশঙ্কায় প্রহেলিকার রুহু কেঁপে উঠল। প্রণয়ের কিছু হলে সে কীভাবে বাঁচবে? প্রণয়ের প্রাণ যেমন প্রিয়তা, তেমন প্রহেলিকার প্রান প্রণয়!
প্রহেলিকা ফুঁসতে ফুঁসতে বলল, “আমার প্রণয়ের যদি কিছু হয়, তবে আমি তোদের দু’জনকেই মেরে ফেলব!”
তার ভাবনার মাঝেই তুহিনা হুড়মুড় করে রুমে ঢুকে সোজা প্রহেলিকার পায়ের কাছে বসে পড়ল। গভীর চিন্তায় নিমগ্ন প্রহেলিকা হঠাৎ কাণ্ডে চমকে উঠল, চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেল।
তুহিনা কান্নায় ভেঙে পড়ে জড়ানো গলায় বলল, “আপু, প্লিজ, আমাকে সত্যি বলো!”
প্রহেলিকা চট করে উঠে দাঁড়াল, অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, “তোমার এমন অবস্থা কেন? কী হয়েছে?”
তুহিনা কান্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলল, “শুদ্ধ ভাই তোমার ছোটবেলার বন্ধু, তাই না আপু?”
প্রহেলিকা অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। শুদ্ধর নাম শুনতেই তার মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে বলল, বন্ধু? সে আমার চিরশত্রু! কিন্তু মুখে বলল, “হুম, মোটামুটি ভালো সম্পর্ক। কিন্তু কেন?”
তুহিনা চোখ মুছে বলল, “শুদ্ধ ভাই কি কাউকে ভালোবাসে, আপু? সত্যি বলবে?”
প্রহেলিকা ভ্রু কুঁচকাল, তুহিনাকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত স্ক্যান করল। যা বোঝার বুঝে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।
তার অবস্থা ও তো ঠিক এমনই!
প্রহেলিকার মনে দয়া হলো, কিন্তু মুখ স্বাভাবিক রেখে বলল, “তুমি জানো না?”
তুহিনার হৃদয় ধক করে উঠল। তার মন যা সন্দেহ করেছিল, তবে কি সেটাই সত্যি?
— “কী জানব, আপু?”
প্রহেলিকা কয়েক সেকেন্ড তুহিনার দিকে তাকিয়ে থাকল, তারপর ঠোঁটে রহস্যময় হাসি ফুটিয়ে পরিষ্কার কণ্ঠে বলল, “শোনো তুহিনা, শুদ্ধ তোমাকে পাঁচ পয়সারও ভালোবাসে না, আর না কখনো বাসবে!”
তুহিনা অবাক চোখে চেয়ে রইল।
প্রহেলিকা বাঁকা হেসে বলল, “কেন ভালোবাসে না, জানো?”
তুহিনা চমকে তাকাল।
— “কেন?”
প্রহেলিকা বলল, “তার কাছে কারো মূল্য তার জীবনের থেকেও বেশি! সেখানে তোমার দাম দুই পয়সাও না !”
তুহিনা অধৈর্য হয়ে বলল, “প্লিজ, আপু, বলো! কে সে? কে আমার শুদ্ধ ভাইকে আমার থেকে আলাদা করতে চাইছে?”
প্রহেলিকা বাঁকা হেসে বলল, “জানলে কী করবে?”
তুহিনার করুণ চোখ মুহূর্তেই প্রতিহিংসায় জ্বলে উঠল। মুখাবয়ব ভয়ংকর হয়ে গেল। সে গর্জে উঠে বলল, “এই দুনিয়া থেকেই সরিয়ে দেব!”
প্রহেলিকা বাঁকা হাসল। মনে মনে বলল—
এটাই তো চাই! এবার আমার হয়ে আমার করতে না পারা কাজগুলো তুমি করবে!
প্রহেলিকা তুহিনার কাঁধে হাত রেখে বলল, “উহু, এই কাজ এত সহজ নয়!”
তুহিনা আগের মতোই বলল, “প্লিজ, আপু, তুমি শুধু নামটা বলো! বাকিটা আমি দেখে নেব!”
প্রহেলিকা তুহিনাকে সোফায় বসিয়ে হাতে পানির গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে বলল।
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৪
— “আগে এটা খাও, শান্ত হও।”
তুহিনা ঢকঢক করে পুরো গ্লাসের পানি শেষ করল।
— “এবার তো বলো, আপু!”
প্রহেলিকা হাসল…