ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৯
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
সাদাফ বলল, “তাহলে এখন ফোন করে সবাইকে প্রণয়ের কন্ডিশন সম্পর্কে জানিয়ে দেই। সকলে দুশ্চিন্তা করছেন নিশ্চয়ই।”
পৃথম বলল, “আরও এক ঘণ্টা আগে বলে দিয়েছি, কিছুক্ষণের মধ্যেই সবাই এলো বলে।”
প্রেম একটু ইতস্তত করে বলল, “তাহলে এখন বোনকে ডেকে নিয়ে আসি, মেজদা? মানে, বড় আপু যদি দেখে সমস্যা করে বা আমাদের বোনকে আবার কষ্ট দিয়ে কিছু বলে…”
পৃথম দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে সম্মতি জানিয়ে বলল, “ঠিক আছে, যা। নক করে ঢুকবি।”
প্রেম সম্মতি জানিয়ে চলে যেতেই, পৃথমের বয়সী একটা ছেলে তাদের দিকে এগিয়ে এসে আন্তরিকভাবে হেসে বলল, “হাই, আম অনির্বাণ।”
পৃথম ছেলেটাকে ঠিক চিনতে পারল না।
ছেলেটা বোধহয় পৃথমের মনের ভাব বুঝতে পারল সে পুনরায় হেসে বলল, “আমিই প্রণয় ভাইয়াকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছিলাম, আর আমি আপনার ফোনটা পিক করেছিলাম।”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পৃথম এবার বুঝতে পারল। সে ও কিঞ্চিৎ হেসে হ্যান্ডশেক করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলল, “থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ, ভাই। আপনি আমাদের কত বড় উপকার করলেন, তা হয়তো আপনি নিজেই জানেন না।”
ছেলেটা আবার মৃদু হেসে আপত্তি জানিয়ে বলল, “এভাবে বলবেন না। প্রণয় ভাইয়া আমার ইউনিভার্সিটির সিনিয়র। বড় ভাই… সিনিয়র ভাইয়ের থেকেও বেশি, নিজের বড় ভাইয়ের মতো ছিলেন। আমাকে আমার খারাপ সময়ে যা হেল্প করেছেন, তার প্রতিদান হয়তো কোনোদিনই দেওয়া সম্ভব না।”
পৃথম আন্তরিকভাবে হাসলো।
তাদের কথার মাঝে সাদাফ কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, “কিন্তু প্রণয়ের অ্যাক্সিডেন্টটা হল কীভাবে?”
পৃথমও কৌতূহলী চোখে চাইল।
ছেলেটা একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে, গলা ভিজিয়ে নিয়ে বলতে শুরু করল, “আজ সকাল ৯টা। বারিধারায়, আমি রাস্তার পাশের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে, অফিসের বসের সঙ্গে কথা বলছিলাম, মূলত অফিসে একটা ইম্পোর্টেন্ট মিটিং আছে, অথচ আমি সময়ের মধ্যে যেতে পারছিলাম না, তাই বসের সঙ্গে কথা বলছিলাম। কথা বলার এক পর্যায়ে, একদম অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে, চোখের নিমিষেই একটা টয়োটা গাড়ি এসে আমার একদম পাশের গাছে সজোরে ধাক্কা মারলো। এত দ্রুত ঘটনাটা ঘটল যে, আমি কিছু বুঝে ওঠার সময়ই পেলাম না। কিছুক্ষণ থ মেরে নিশ্চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। অ্যাক্সিডেন্ট হওয়ার সাথেসাথেই জায়গাটা সরগরম হয়ে গেল, আশপাশের সব মানুষ জড়ো হয়ে হট্টগোল শুরু করে দিল।
আমি ভিড় ঠেলে ঢুকে দেখলাম, কিছু লোক গাড়ির দরজা খুলার চেষ্টা করছে, কিন্তু দরজা ভিতর থেকে বাজে ভাবে লক হয়ে গিয়েছে। পরে গাড়ির কাঁচ ভেঙে ভিতরের লক খুলে। সবাই যখন ধরা-ধরি করে গাড়ি থেকে নামাচ্ছিল, তার মুখ পুরো রক্তে লাল হয়ে গিয়েছিল, চেনাই যাচ্ছিল না। তবে খুব চেনা চেনা লাগছিল, কিছুক্ষণ দেখে বুঝতে পারলাম, এটা প্রণয় ভাই। আমি নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
সবাই ভাইকে দ্রুত হাসপাতালে পাঠানোর চেষ্টা করছিল। তখন আমি আমার গাড়ি দিয়ে হাসপাতালে নিয়ে আসি এবং অ্যাডমিট করে দেই।” ডাক্তার চেকআপ করে জানান, প্রণয় ভাই অতিরিক্ত ড্রিঙ্ক করে গাড়ি চালাচ্ছিলেন, তাই টাল সামলাতে না পেরে অ্যাক্সিডেন্ট করে ফেলেছেন। ভাগ্য ভালো, তেমন বড় কোনো ক্ষতি হয়নি, শুধু মাথায় কিছুটা আঘাত পেয়েছেন আর একটু কেটে ছিঁড়ে গেছে, তবে অনেক রক্তক্ষরণ হয়েছে, দু’দিন হাসপাতালে থেকে ৪ বেগ রক্ত দিতে হবে আর কিছু মেডিসিন।
ডাক্তার ভাইয়ার ফোনটা আমার কাছেই দিয়ে ছিলেন, কিন্তু আমি কাউকে ফোন দিয়ে জানাব তার উপায় ছিল না, আমি লক খুলতে পারছিলাম না। তখন ফাইনালি, ৬টার দিকে একটা ফোন এলো, দেখলাম, ফোনটা তড়িঘড়ি রিসিভ করে, হাসপাতালে নাম বলার মাত্রই ফোনটা অফ হয়ে গেল। অনির্বাণ ফোনটা প্রিথমের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এই যে ভাইয়ার ফোন।”
প্রিথম আর সাদাফ হাঁ করে শুনছিল, সকল ঘটনা আজ কত বড় বিপদ হতে পারত। প্রিথম আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বলল, “তোমাকে অনেক অনেক শুকরিয়া, মাবুদ! আজ তুমি অনেক বড় বিপদের হাত থেকে আমার ভাইকে বাঁচিয়েছো, আমার বোনকে বাঁচিয়েছো।” প্রেম মাথা নিচু করে গলা খাঁকারি দিয়ে ডাক দিলো, “আসবো দাদান।”
প্রিয়তা আর প্রণয় তখনও তাকিয়ে ছিল একে অপরের চোখের গভীরে। যেখানে দৃষ্টি কথা বলে, সেখানে বাক্য নিতান্তই নিরর্থক অপ্রয়োজনীয়। চোখ মানুষের মনের আয়না — মানুষ মিথ্যে বলতে পারে, কিন্তু চোখ কখনো মিথ্যা বলে না। সে হয়তো বাক্য গঠন করতে পারে না, কিন্তু তার মাঝেই নিহিত থাকে মনের সকল অনুভূতি। সে হয়তো অপরপাশের ব্যক্তিকে মুখে কিছু বলতে পারে না, কিন্তু ঠিকই অনুভব করাতে পারে তার অব্যক্ত সকল কথা।
প্রিয়তা ও ওই গাঢ় বাদামি দুটো চোখের ভাষা বুঝতে পারছে না, কিন্তু মনের ভিতরে কেমন যেন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছিল। বারবার মনে হচ্ছেল, ওই সুন্দর চোখ দুটো তাকে কিছু বলছে — যা সে খুব করে বুঝতে চায়, কিন্তু বারংবারই তাতে ব্যর্থ হচ্ছে। তবুও, কোনো শব্দের অপচয় ছাড়াই, একে অপরের মনের কথা গুলো শোনার চেষ্টা করছে, বোঝার চেষ্টা করছে, মেপে নিচ্ছে দৃষ্টির গভীরতা।
ওই দুটো চোখে চেয়ে তারা এক জীবন পার করে দিতে পারবে, প্রয়োজন হবে না কোনো বাক্যের, কোনো শব্দের। জীবন ফুরিয়ে গেলেও ওই দুই চোখের মায়া থেকে নিজেদের মুক্ত করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তারা জড়িয়ে আছে তীব্র মায়ার ঘেরা ইন্দ্রজালে।
“প্রেম”—খুক খুক শব্দ কানে আসতেই দুজনের ঘোর কেটে গেল। প্রিয়তা প্রনয়ের হাত ছেড়ে লাফিয়ে সরে গেল প্রণয়ের কাছ থেকে। গালে ছড়িয়ে পড়তে লাগল রক্তিম লালিমা। সে লজ্জা পেয়ে বলল,
— “ছি ছি, এতক্ষণ আমি এভাবে বসে ছিলাম প্রণয় ভাইয়ের সামনে!”
সে লজ্জায় মিইয়ে গেল।
সে প্রণয়ের দুই হাতের শিরা চেপে ধরে বসে ছিল হাত সরাতেই সেখান থেকে পুনরায় ফিনকি দিয়ে রক্ত বেরোতে শুরু করল।
প্রেমের আগমনে কিছুটা বিরক্ত হলো প্রণয়, কিন্তু বিরক্তিটুকু মুখে প্রকাশ না করে শান্ত কণ্ঠে বলল,
— “আয়।”
প্রেম ভিতরে ঢুকে বড় ভাইকে ভালোভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পর্যবেক্ষণ করল। বুকের ভিতর কেমন চিনচিনে ব্যথার অনুভব হলো। সে নম্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
— “এখন কেমন লাগছে, দাদান?”
হাসল প্রণয়। প্রিয়তার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে সন্তুষ্ট কণ্ঠে জবাব দিল,
— “অনেক ভালো।”
হাসল প্রেমও।
তাদের কথা বলার এক পর্যায়ে প্রিথম, সদাফ, অনির্বাণ আর একজন নার্স কেবিনে প্রবেশ করলেন। প্রিথম আর সদাফও খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল।
নার্স উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন,
— “ক্যানোলা গুলো খুলে ফেলেছেন কেন? কত রক্তক্ষরণ হচ্ছে আপনার! এমনিতেই আপনার অনেক রক্তক্ষরণ হয়ে গেছে, হিমোগ্লোবিন লেভেল একদম কমে গেছে। আর! আপনাকে আরও রক্ত দিতে হবে, আর আপনি আরও বের করে দিচ্ছেন?”
প্রণয় বিরক্ত হলো। তীব্র বিরক্তি নিয়ে বলল,
— “এগুলো ডিস্টার্ব করছিল, তাই খুলে ফেলেছি। এগুলো পরে আমি শুয়ে থাকতে পারবো না। আমার বাসায় যাওয়ার ব্যবস্থা করুন।”
প্রিথম আর প্রেম বিস্ফোরিত চোখে একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলো।
প্রিথমের বিস্ময় কাটার আগেই প্রণয় তাকে ধমকে দিয়ে বললো,
— “দেখছিস কী! ধর আমায়, বাড়ি যাবো।”
নার্স ছুটে গেলেন ডাক্তার ডাকতে।
প্রিয়তা উত্তেজিত কণ্ঠে প্রণয়ের কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, নিচু সরে বললো,
— “এমন করছেন কেন?
উনি তো বললেন, আপনাকে আরও ব্লাড দিতে হবে।”
প্রণয় শান্ত কণ্ঠে বললো,
— “লাগবে না, যথেষ্ট আছে।”
প্রিয়তা গিয়ে প্রণয়ের আরেকটু পাশে ঘেঁষে দাঁড়ালো। কণ্ঠ খাঁদে নামিয়ে বললো,
— “এমন করবেন না প্লিজ, প্রণয় ভাই। আপনি অনেক অসুস্থ। এভাবে বাড়ি যাবেন না। প্লিজ, একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আপনার হিমোগ্লোবিন লেভেল অনেক নিচে, আপনার হাঁটতে মাথা ঘুরাবে। প্লিজ, একটু বুঝুন।”
প্রণয় গভীর দৃষ্টিতে তাকালো প্রিয়তার করুণ মুখের দিকে।
ডাক্তার ছুটে এসে বললেন,
— “কি করছেন, মিস্টার শিকদার? আপনি এখনই বাড়ি কীভাবে যাবেন? কয়েক ঘণ্টা আগেই আপনার অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আপনি পুরো ছয় ঘণ্টা সেন্সলেস ছিলেন। আপনি গুরুতরভাবে অসুস্থ। এখন চলে গেলে আপনার অনেক প্রবলেম হবে। আপনাকে আরও ব্লাড নিতে হবে।”
প্রিথমের দিকে তাকিয়ে ডাক্তার বললেন,
— “আপনারা বুঝান উনাকে!”
প্রেম আর প্রিথম অসহায়ভাবে একে অপরের মুখের দিকে তাকালো।
বেচারা, ওরা আর কী বলবে! একটা ধমকেই তো তারা উড়ে যাবে।
তারা যত যাই হোক, বড় ভাইকে ভীষণ ভয় পায় ও সম্মান করে।
তাও প্রিথম ভয়-ভয় বললো,
— “প্লিজ দাদান, মাত্র দুইদিনই তো!”
প্রণয় তাকিয়ে আছে প্রিয়তার চোখের দিকে—যেখানে মেনে নেওয়ার জন্য অনুনয়, অনুরোধ স্পষ্ট।
প্রণয় ডাক্তারদের দিকে তাকিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
— “ঠিক আছে, কিন্তু দুই হাতে লাগাবেন না। এক হাত ফ্রি রাখবেন।”
ডাক্তার আপত্তি জানাতে নিলে, প্রিথম চোখের ইশারায় বারণ করলো।
ডাক্তার সম্মতি জানিয়ে শুধু রক্তের ক্যানোলা প্রণয়ের বাঁ হাতের শিরায় ঢুকিয়ে দিলেন।
প্রিয়তা এই দৃশ্য সহ্য করতে পারলো না।
চোখ খিঁচে, প্রণয়ের ডান বাহু শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো।
প্রণয় নরম চোখে তার জানের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললো,
— “এতো নরম মন ভালো নয় রক্তজবা। তোমাকে মন শক্ত করতে শিখতে হবে।”
ডাক্তার ক্যানোলা লাগিয়ে চলে যেতে যেতে বলে গেলেন,
— “এতোজন মিলে ভিড় করে থাকবেন না, পেশেন্টের সমস্যা হবে।”
ওরা ও সম্মতি জানালো।
অনির্বাণ হাঁ করে তাকিয়ে আছে।
সামনের ১৬-১৭ বছর বয়সী মেয়েটার দিকে কেবিনে পা রাখামাত্রই তার দৃষ্টি লক হয়ে গেছে একজোড়া নীলাভ চোখের পানে।
সে আর এক মুহূর্তের জন্যও চোখ ফিরিয়ে নিতে পারেনি।
এদিক-ওদিক কারো দিকেই তার খেয়াল নেই—সে তখন থেকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার দিকে।
সে মনে মনে বলল,
— “এতো সুন্দর মেয়ে হয়! এই ২৭ বছরের জীবনে অনেক সুন্দরী মেয়েই তো দেখলাম, কিন্তু এমন একজনকে ও এর আগে কখনো দেখিনি।
কি সুন্দর চোখ, চুল, চেহারা! এত মায়াও থাকে কারো চেহারায়?”
প্রণয় অনির্বাণের দিকে তাকালো। বিষয়টা তার নজরে আসতেই চোখের রঙ পাল্টে গেল।
সে গম্ভীর কণ্ঠে অনির্বাণকে বললো,
“তুমি এখানে কেন হঠাৎ?”
প্রণয়ের গম্ভীর কণ্ঠ কানে আসতেই হকচকিয়ে গেল অনির্বাণ।
তড়িতগতিতে নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিয়ে প্রত্যুত্তর করল,
“আমি আপনাকে এখানে নিয়ে এসেছি, ভাইয়া।”
প্রণয় কপাল কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে আছে।
অনির্বাণের দৃষ্টি বারবার ঘুরে ফিরে প্রিয়তার দিকেই যাচ্ছে।
তার জানের দিকে বারবার তাকাতে দেখে প্রণয়ের বিশাল মেজাজ খারাপ হলেও, সে নিজেকে শান্ত রেখে বললো,
“Thank you, অনির্বাণ, but I need to take a rest so…”
ওরা সবাই সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে গেল।
প্রিয়তা ও বেরিয়ে যেতে নিলে প্রণয় গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“তুই কোথায় যাচ্ছিস?”
থেমে গেল প্রিয়তা।
প্রণয়ের দিকে ফিরে বললো,
“বাইরে।”
প্রণয় ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন?”
প্রিয়তা স্বাভাবিক কণ্ঠেই জবাব দিলো,
“বা রে, আপনি না বললেন রেস্ট নেবেন?”
প্রণয় ওর কথা পাত্তা না দিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“এদিকে আয়।”
প্রিয়তা অবাক হলো, কিন্তু কিছু না বলে এগিয়ে গেল প্রণয়ের কাছে।
প্রণয় আদেশের সুরে বললো,
“বস।”
প্রিয়তা ও বাড়তি কথা না বলে লক্ষ্মী মেয়ের মতো পাশে বসে পড়লো।
প্রণয় আবার বললো,
“তোকে আমি একদিন বারণ করেছিলাম, বল তো—কি বারণ করেছিলাম?”
প্রিয়তা অবাক চোখে তাকিয়ে ভাবনায় পড়ে গেল।
নিচু স্বরে বলল,
“অনেক কিছুই তো বারণ করেছিলেন, এখন আলাদা করে কোনটা বলবো?”
প্রণয় কপাল কুঁচকে বলল,
“গাধা! কি তোকে সাধে বলি?”
প্রিয়তা গাল ফুলিয়ে তাকাল।
প্রণয় ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল।
প্রণয় আবারও বলল,
“যটপট চুলগুলো শক্ত করে বাঁধ। চুল খুলে ঘুরে বেড়াচ্ছিস কেন? তোকে না কতদিন বারণ করেছি চুল খুলে ঘুরতে?”
প্রিয়তার খেয়াল হলো, সে একহাঁটু চুল খুলে গত ৪ ঘণ্টা ধরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
সে তড়িঘড়ি লতানো চুলগুলো গলার কাছ থেকে সরিয়ে,
হাত পেছিয়ে খোঁপা করতে লাগলো।
উন্মুক্ত হলো তার ফর্সা গলা সেখানে চিকন চেনের প্যান্ডেন্ট নিজ দায়িত্বে তার শুভাবৃদ্ধি করছে , যা রূপের আগুনে ঘি ঢালে।
প্রণয় মুগ্ধ চোখে প্রিয়তাকে হাতে চুল পেঁচাতে দেখলো। চোখ ঝলসানো রূপের বাহার দেখে মন গেয়ে উঠলো—
“প্রনয় রাজ্যের রাজকুমারী, গলায় চন্দ্রহার, দিনে দিনে বাড়ছে তোমার চুলেরই বাহার!”
প্রিয়তা প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
“আর কিছু করবো?”
প্রণয় গভীর চোখে তাকালো।
ডান হাতে প্রিয়তার বেবি হেয়ারগুলো কানের পেছনে গুঁজে দিয়ে শান্ত গলায় শাসিয়ে বললো,
“ওই যে লোকটাকে দেখেছিস দ্বিতীয়বার, ওই ছেলেটার চোখের সামনে তোকে যেন পড়তে না দেখি। ওই লোক যতক্ষণ থাকবে, তুই আমার চোখের আড়াল হবি না— আর আমার এই কথার যদি একটু ও অমান্য হয়, তাহলে…”
প্রিয়তা গোল গোল চোখে তাকালো।
ঢোঁক গিলে বললো,
নাহলে,
প্রণয় হেসে প্রিয়তার চোখে চোখ রেখে, শান্ত অথচ ভয়ঙ্কর কণ্ঠে বলল,
“চোখ তুলে ফেলবো।”
প্রিয়তার চোখ জোড়া বিস্ময়ে বড়ো বড়ো হয়ে গেল।
আবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“আমার?”
প্রণয় শুধু হাসলো।
মনে মনে বলল – আমার ভালবাসার দিকেই সব শালাদের নজর।
ওদের কথা বলার মাঝেই কেউ ঝড়ের বেগে উড়ে এসে প্রণয়ের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল।
হঠাৎ এমন হওয়াতে একটু হকচকিয়ে গেল প্রণয়।
কয়েক সেকেন্ড সময় লাগল কী হচ্ছে বুঝতে।
ব্যাপারটা বুঝে আসতেই সে নিজের থেকে সেই অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যক্তিকে দূরে সরানোর চেষ্টা করতে লাগল।
প্রহেলিকা প্রণয়ের বুকে মাথা রেখে জোরে কেঁদে উঠল।
কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“তুমি ঠিক আছো প্রণয়? বেশি ব্যথা পাওনি তো?
এই কান্না দেখলে যে কারোরই মায়া হওয়ার কথা।
কিন্তু মায়া হল না প্রণয়ের।”
সে শান্ত কণ্ঠে বলল,
“কি হচ্ছে? কি? প্লিজ, ছাড়ো।”
কিন্তু প্রহেলিকা প্রণয়ের কথার তোয়াক্কা না করে আরও শক্ত করে প্রণয়ের পিঠ জড়িয়ে ধরল।
কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি অনেক ভয় পেয়ে গেছিলাম জানো, অনেক ভয়।
তুমি কেন এত অসাবধান, কেনো প্রণয়?
তোমার কিছু হয়ে গেলে কি হতো আমার?
আমি… আমি তো মরে যেতাম।
খুব ভালোবাসি তোমাকে প্রণয়, খুব।
প্লিজ, আমাকে একটু তোমার বুকে মাথা রাখতে দাও।
না হলে সত্যি বলছি, আমি এখানেই মরে যাব।”
বলতে বলতে আরও জোরে কেঁদে উঠল প্রহেলিকা।
প্রণয় এক হাতে প্রহেলিকাকে সরাতে পারল না।
সে করুণ চোখে পাশে চাইল।
প্রিয়তার মুখের সব হাসি, আনন্দ নিমিষেই মিলিয়ে গেছে।
তার দুই হাত মুষ্টিবদ্ধ, নীল চোখ পানিতে টলটল করছে, নাক ফুলছে—
সে আর এক সেকেন্ডও সেখানে বসে থাকতে পারল না।
হাতের উলটো পিঠ দিয়ে চোখ মুছে বাইরে দিকে দৌড় দিল।
প্রিয়তমার চোখের এই বেদনাশ্রু দেখে জ্বলসে গেলো প্রণয়ের বুক।
ভীষণ ব্যথা অনুভব হলো হৃদয়ে।
সে এবার রেগে গেল। কঠোর কণ্ঠে, কাট-কাট ভাবে বলল,
“দম বন্ধ লাগছে আমার, দূরে সরো।”
কিন্তু প্রহেলিকা সরতে চাইল না।
এবার প্রণয়ের ভীষণ রাগ হলো।
সে শক্ত করে প্রহেলিকার বাহু ধরে নিজেকে আলাদা করে দিল।
প্রহেলিকা করুণ চোখে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলল,
সব নিষ্ঠুরতা আমার বেলাতেই কেন, প্রণয়?
কেন তুমি আমার বেলাতেই এত নিষ্ঠুর?
কেন আমার কষ্ট তোমার চোখে পড়ে না?
আমার জায়গায় প্রিয়তা থাকলে পারতে তাকে দূরে সরিয়ে দিতে?
পারতে না বরং তাকে কিভাবে বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলা যায়, সেই চিন্তা করতে।
তবে কেন প্রণয়? ভালো না-ই বাসলে, একটু সহানুভূতি কি কাজ করে না?
খুব মন খারাপে তোমার বুকে দুদণ্ড মাথা রাখারও কি অধিকার নেই আমার?
আমার ভালোবাসা না হয় মানলে না,
কিন্তু আমার জন্য কি তোমার মনে এতটুকুও মায়া নেই?
একটু খারাপ লাগার অনুভূতিও কি কাজ করে না তোমার?
প্রণয় চোখ সরিয়ে পূর্বের ন্যায় বলল,
“শান্ত হও, ঠিক আছি আমি।”
প্রহেলিকার দৃষ্টিতে আজ কোনো হিংসা নেই।
যা আছে, তা কেবলই আক্ষেপ।
সব কিছু থাকা সত্ত্বেও তার কিছুই নেই।
যে দিন আনে, দিন খায়—সে ও তার চেয়ে ঢের সুখী।
জিতে গিয়েও সে আজ হেরে গেছে—নিজের কাছেই।
মানুষটাকে কেড়ে নিলেও মনের মালিক সে নয়।
রাত ১০টা।
সাদমান শিকদার আর অনুশ্রী বেগম এসেছেন ছেলেকে দেখতে।
অনুশ্রী বেগমের প্রেসার ফল করে যাওয়ায় তিনিও একটু অসুস্থ।
তিনি ছেলের পাশে গিয়ে বসলেন।
সাদমান শিকদারও সামনের টুলে বসলেন।
অনুশ্রী বেগমের কলিজাটা খাঁ খাঁ করছে ছেলের এই অবস্থা দেখে।
প্রণয় তাঁর প্রথম ছেলে—কত যত্নে তিনি এই ছেলেকে বড় করেছেন, সেটা কেবল তিনিই জানেন।
সেই ছেলেটাই আজ তাঁর চোখের সামনে একটু একটু করে ভেতর থেকে গুঁড়িয়ে যাচ্ছে, নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে দিনকে দিন।
মা হয়ে এটা কিভাবে সহ্য করবেন তিনি?
ছেলের মুখের দিকে তাকালে বড় কষ্ট হয় তাঁর।বড় অসহায় লাগে।
কিন্তু কিছুই যে করার নেই।
তাইতো সব জেনেও না জানার ভান করেন ছেলের সামনে।
তিনি তো মা—সব ছেলেমেয়েই তাঁর কাছে সমান।
কারো ভালোর জন্য তিনি কারো খারাপ চাইতে পারেন না।
আর বিষয়টা যত দূরে এগিয়ে গেছে, সেখান থেকে আর ফিরে আসার কোনো উপায় নেই।
কিন্তু মায়ের মন তো ছেলের কষ্ট সইতে পারে না।
অনুশ্রী বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— “এখন কেমন লাগছে, আব্বু?”
প্রণয় আম্মুর দিকে তাকালো।
অনুশ্রী বেগম আবারও আদুরে কণ্ঠে, শাসনের সুরে বললেন,
— “দেখে-শুনে চলতে হয় তো, আব্বু।
মাকে কেন সব সময় দুশ্চিন্তায় রাখো?
তুমি তো জানো, তোমার জন্য কত চিন্তা হয়!
তুমি তো এমন নও, আব্বু।
তুই তো তোমার ভাই-বোনদের মতো এতটা অবুঝ নও।”
প্রণয় কোনো উত্তর দিল না।
কেবল নিঃশব্দে অনুশ্রী বেগমের কোমর জড়িয়ে ধরে তাঁর বুকে মাথা রাখল।
অনুশ্রী বেগমের মাতৃমন ছেলের বেদনা অনুভব করতে পারলেন।
তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ছেলের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললেন,
— “ধৈর্য ধর, আব্বু।
একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে।
আল্লাহ ধৈর্য ধারণকারীকে পছন্দ করেন।
ধৈর্যের ফল কখনো টক হয় না।
সময় আমাদের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ।
সময় আমাদের সব থেকে বড় বন্ধু, আবার সবচেয়ে বড় শত্রুও।
সময় আমাদের জীবনে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে, কেড়ে নেয় অনেক কিছু, ব্যথা দেয় অনেক গভীরে।
আবার সেই সময়েই, তার স্রোতে সব ঠিক করে যায়—মনের ক্ষত ভরাট করে দেয়।
যেভাবে কেড়ে নিয়েছে, সেভাবেই নতুন অনেক কিছু ফিরিয়ে দেয়।
তার জন্য শুধু ধৈর্য ধরতে হয় আমাদের, আব্বু।”
প্রণয় এবারও কোনো উত্তর দিল না।
নিঃশব্দে সে মায়ের বুকে মাথা রেখে টুপটাপ অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছে।
অনুশ্রী বেগম বুঝলেন—ছেলের বোবা কান্না।
পুরুষ মানুষদের নাকি কাঁদতে হয় না, কিন্তু এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা।
পুরুষরাও কাঁদে—তবে সেটা সবার কাছে নয়, কিছু বিশেষ মানুষদের কাছে।
পুরুষরা ও নিজেদের আবেগ ধরে রাখতে পারে না যেমন প্রনয় তার আম্মুর কাছে নিজেকে ধরে রাখতে পারে না।
তাইতো সে তার আম্মুকে সবসময় এড়িয়ে চলে।
অনুশ্রী বেগম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে ছেলের মাথায় চুমু খেলেন।
এই ছেলেটা কখনো তাঁকে কিছু বলে না।
ভালো লাগলেও বলে না, কষ্ট পেলে তো নয়ই।
ভীষণ চাপা স্বভাবের।
তাঁর অন্য ছেলে-মেয়েরা তো এমন নয়।
সামান্য হাত কেটে গেলেও তারা বাড়ি মাথায় তোলে।
কিন্তু এই ছেলেটা যদি মরে যায়, তবুও মুখ দিয়ে শব্দ বের করে না।
প্রণয় আম্মুকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে উঠলো।
অনুশ্রী বেগম আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। ছেলেকে আঁকড়ে ধরে কেঁদে ফেললেন। প্রণয় অনুশ্রী বেগমের বুকে আরেকটু সেঁধিয়ে গেল। অনেকক্ষণ চুপ থেকে, ধরে আসা গলায় অভিযোগ করে বলল,
— “সবাই আমার সাথে এমন কেন করল, আম্মু? আমি তো কোনোদিন ও কারো সাথে কোনো অন্যায় করিনি — জেনে বুঝে তো কখনোই না।
**তবে তাদের কিসের শত্রুতা ছিল আমার সঙ্গে? কেন এমন করলো ওরা আমার সঙ্গে? কেন আমার সবকিছু কেড়ে নিলো? কেন আমার সুখ, শান্তি কেড়ে নিয়ে আমাকে যন্ত্রণার খাদে ফেলে দিলো? আমার সঙ্গে এমন কেন করলো, আম্মু? তারা তো আমার আপনজন ছিল। কীভাবে পারলো নিজের স্বার্থে আমার জীবন শেষ করে দিতে?
আমি তো জীবনে বেশি কিছু চাইনি, আম্মু। যেটা সবথেকে বেশি চেয়েছিলাম, যেটা ছাড়া বাঁচতে পারব না — সেটা কেন আমাকে হারাতে হলো, আম্মু? কেন আমাকে সেটা থেকে দূরে করে দেওয়া হল?
আমি ওর থেকে দূরে থাকতে পারি না, আম্মু। আমার খুব কষ্ট হয়, খুব। মাঝে মাঝে মরে যেতে মন চায়। আমার জীবনটা আবার আগের মতো করে দাও না, আম্মু… দাও না। আমি অনেক দূরে চলে যাবো, আর কখনো তোমাদের জীবনে ফিরে আসবো না — দাও না, আম্মু। শুধু একবার আমাকে আবার আমার সবকিছু ফিরিয়ে দাও…”
ছেলের এমন করুণ আর্তনাদ সহ্য করতে পারছেন না অনুশ্রী বেগম। তিনি ছেলেকে শান্তনা দিয়ে বললেন,
“শান্ত হও, আব্বু। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখো। তিনি নিশ্চয়ই তোমার মনে শান্তি দেবেন। যা হয়ে গেছে, তা আর কখনোই পরিবর্তন হবে না। আমরা চাইলেও আমাদের অতীত পাল্টাতে পারি না, বা যা ঘটে গেছে, তাও পরিবর্তন করতে পারি না — সেটা আমাদের হাতে নেই। আমরা শুধু চেষ্টা করতে পারি, বর্তমানে আর ভবিষ্যতটা যাতে সুন্দর হয়।
যাই হোক, যেভাবেই হোক, যাদের কারণে হোক — একবার আমাদের জীবনের মোড় একবার ঘুরে গেলে তা আর কখনোই আগের পর্যায়ে ফিরে আসে না।
মরে গেলে ও সেই গল্প বদলে যায় না, বাবা। সময় আমাদের জন্য পরিবর্তন হয় না, আমাদেরকেই সময়ের সঙ্গে পরিবর্তন হতে হয়।
প্রয়োজনে নিজেকে ভেঙে-চুরে হলেও সময়ের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হয়।
আমি জানি, এটা তোমার জন্য হয়তো অসম্ভব, হয়তো খুব কঠিন।
তবু বলবো, বাবা, তুমি চেষ্টা করো। সত্যি, এ ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই।
যে মনে আছে, সে বরং মনেই থাকুক। তবে যে ভাগ্যে আছে, তাকে মেনে নেওয়ার চেষ্টা করো।
তার সাথে জীবনটাকে নতুন করে ভাবার চেষ্টা করো।
ভালো থাকার চেষ্টা করো।”
“তুমি যেগুলো আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকতে চাচ্ছো, সেগুলো থেকে তুমি কষ্ট ছাড়া কিছুই পাবে না, বাবা। আমি মা হয়ে বলছি — ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো।”
ভুলে যাওয়ার কথা কানে আসতেই প্রণয়ের চোখ লাল হয়ে গেল।
মাথা তুলে, চোখ মুছে, নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করল প্রণয়।
কণ্ঠটা কেঁপে উঠল —
“সে খানিক শক্ত কণ্ঠে বলবো –
সে এই প্রণয় শিকদারের কেবল মনে নয় — মন, দেহ, মস্তিষ্ক, রক্তে, শিরায়, উপশিরায়, আত্মায়, নিঃশ্বাসে — সবকিছুতেই মিশে আছে।
সে এই প্রণয় শিকদারের জান-প্রাণ, সবকিছু।
তাকে আলাদা করার চেষ্টা করো না, আম্মু। তবে, যে সবথেকে বড় ক্ষতিটা তোমারই হবে।
তারা আমাকে যত বেশি মানসিক যন্ত্রণা দেয়, আমি ততই নিজের আত্মায় তাকে অনুভব করি।
সে-ই প্রণয় শিকদারের বেঁচে থাকার একমাত্র কারণ।”
অনুশ্রী বেগম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।
ছেলে যে এমন কিছুই বলবে, তা তিনি আগেই বুঝেছিলেন।
তিনি শান্ত কণ্ঠে বললেন, “তবে তার কি হবে? সেও তো তোমাকে অনেক ভালোবাসে। তার জীবনটা যে নষ্ট হয়ে যাবে।”
প্রণয় তাচ্ছিল্য করে বলল,
“আমি যা করছি, সব নিজের জন্য করছি। অন্যের জীবন নিয়ে আমার কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
অন্যের জীবনের দায় আমার নয়। আমি কারও জীবন নষ্ট করিনি, করতে চাইনি।
তার জীবন নষ্ট হলে, তার নিজের লোক দায়ি — আমি নই।”
প্রিয়তা বসে আছে প্রণয়ের কেবিনের বাইরে পাতানো চেয়ারে। খুব চেষ্টা করছে চোখের নদীতে বাঁধ দেওয়ার—পাবলিক প্লেসে না কাঁদার। কিন্তু বেয়াড়া চোখ কি কখনো তার কথা শুনেছে যে আজ শুনবে? ছোট্ট হৃদয়টা তীব্র ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছে। হাঁপানি রোগীর মতো নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। চোখ বন্ধ করলেই দৃশ্যপটে ভেসে উঠছে প্রহেলিকার জড়িয়ে ধরা মুহূর্তটা। সে দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছে—কিন্তু বহু প্রচেষ্টার পরেও সে ব্যর্থ।
ঠিকই, চোখ উপচে টপটপ করে নুনা জলের ধারা নামছে। দৃষ্টিতে ভেসে উঠছে একের পর এক অপ্রীতিকর, তিক্ত, বিষাক্ত দৃশ্য—যা সে বিগত দুই বছর ধরে সহ্য করে আসছে। এটা তার কাছে নতুন নয়। যতবারই প্রণয় আর প্রহেলিকাকে সে একসাথে দেখে, ততবারই নতুন-পুরোনো সব ক্ষতই আবার নতুন করে টাটকা তাজা হয়ে ওঠে। যন্ত্রণায় ছোট্ট হৃদয়টা ছিঁড়ে যেতে চায়।
এই যে সে চোখের জল ধরে রাখতে না পারলে ও শব্দ না করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে—তবুও থেমে থেমে ফুপিয়ে উঠছে। সে সব বিষাক্ত দৃশ্য খুব করে ভুলে যেতে চায়। এগুলো থেকে সে পালিয়ে বাঁচতে চায়। কিন্তু কোথায় পালাবে? সত্য থেকে কি কেউ পালাতে পারে? পারে না। প্রিয়তাও পারে নি। পুরনো ক্ষতে ঔষধি পড়ার আগেই নতুন ক্ষতের সৃষ্টি হয়, যা তাকে প্রতিনিয়ত একটু একটু করে শেষ করে দেয়। তবু সে ওই মানুষটাকে ঘৃণা করতে পারে না। ‘ঘৃণা’ শব্দটা আসেই না—ওটা যেন তার জন্য তৈরি হয় সে বোধহয় কেবলই ভালোবাসার জন্য।
প্রিয়তা বড় নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে। মনকে বোঝায়—এটা খুব স্বাভাবিক। বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর তারা
তাদের সম্পর্ক— আরও গভীর । নিজেকে এসব বোঝাতে গিয়েই সে উল্টো ফেঁসে গেল। এবার মনে কল্পনিক দৃশ্য ভেসে উঠছে—যা সে কখনো দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে চায় না। কল্পনায় প্রণয় আর প্রহেলিকাকে দেখে। হাত মুঠো করে নেয় প্রিয়তা। চোখ বন্ধ করতেই গড়িয়ে পড়ে উষ্ণ পানি। হাত, ঘাড় আর কপালের শিরা ধপধপ করছে। ফরসা চামড়া ভেদ করে সবুজ শিরাগুলো ফুলে উঠছে। মনের কষ্টের সঙ্গে সঙ্গে এবার রাগটাও মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে।
প্রিয়তা বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে। রাগ গিলে ফেলার চেষ্টা করল—কারণ কষ্টটা সত্যি, আর রাগটা নিতান্তই অহেতুক, অযৌক্তিক। সে তো ভালোবেসে বিয়ে করেছে সব তো করবেই সাজিয়ে রাখবে বলে করেনি—নিশ্চয়ই !
উফফ… এই যন্ত্রণা নিয়ে বাঁচার থেকে মৃত্যু ঢের ভালো?
সে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “দীর্ঘদিন মার খেলে, একটা সময়ের পর মারটা ও অভ্যাস হয়ে যায়।
কষ্ট পেতে পেতে মানুষের মন পাথর হয়ে যায়।
মানুষ নাকি অভ্যাসের দাস—একবার অভ্যাস হয়ে গেলে আর নাকি কিছু গায়ে লাগে না।
তাহলে আমার মনটা কেন পাথর হয়ে যায় না?
ব্যথা কি কম পেয়েছি?
না কি আরও পাওয়া বাকি আছে?
অনেক দিন তো হলো, তবুও কেন এই ব্যথাগুলো আমার সয়ে যায় না?
এতদিনে তো এসব অভ্যাস হয়ে যাওয়ার কথা।
প্রণয় ভাই, আপনি তো আমার নন, অন্য কারো—
এটা তো মেনে নেওয়ার কথা তাহলে মন কেন মানতে চায় না?
কেন এই যন্ত্রণাগুলো প্রত্যেকবার নতুন লাগে?
প্রত্যেকটা আঘাতই কেন নতুনের মতো মনে হয়?
কেন এতটা তরতাজা?”
ভাবতে ভাবতে ফুঁপিয়ে উঠলো মেয়েটা।
-পরিনীতা।
বড় দাদনের সাথে দেখা করে কেবিন থেকে বেরোতেই দেখল, প্রিয়তা মাথা নিচু করে বসে আছে। ভ্রু কুঁচকে গেল পরিনীতার। ভালোভাবে লক্ষ্য করে দেখল—কয়েক সেকেন্ড পরপর মেয়েটার শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে।
পরিনীতার সচল মস্তিষ্ক চট করে বুঝে নিল সব। চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল সে।
ধীরে পায়ে এগিয়ে এসে প্রিয়তার পাশে চেয়ারে বসে পড়ল। আশেপাশে তাকিয়ে বাড়ির কাউকে দেখতে পেল না।
“কোথায় গেল সবাই?”—সে ব্যথাতুর নয়নে তাকালো পাশের অল্পবয়সী মেয়েটার দিকে। এই মেয়েটাকে দেখলে বড় মায়া হয় পরিনীতার।
তার অনুভূতিগুলোকে একটুখানি অনুভব করতেও ভয় লাগে—তাহলে যে নিজেকে ঐ জায়গায় বসাতে হবে।
কিন্তু নিজেকে সেই জায়গায় দুঃস্বপ্নেও ভাবতে পারে না পরিনীতা । কল্পনাও করতে গেলেই গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।এত ভয়ঙ্কর কল্পনা সে ভুলেও করতে চায় না।
হঠাৎ প্রিয়তা কাঁধে কারো স্পর্শ অনুভব করতেই চমকে উঠলো। পাশে তাকালো—
পরিনীতার ছোট বোনের চোখ-মুখ দেখে চমকে গেল, পরিনীতার মনে আঘাত লাগলো।
সে বুঝলো—মেয়েটা হয়তো কোনো কারণে আবার কষ্ট পেয়েছে।
কিছু বলবে, তার আগেই প্রিয়তা তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে উঠলো।
ধরা গলায় বলল, “কোনো প্রশ্ন কোরো না, আপু।”
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো পরিনীতা। মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“বড় দাদন তোকে যেতে বলেছেন।”
প্রণয়ের কথা কানে আসতেই প্রিয়তার ভীষণ অভিমান হলো।
“কেন? কিসের জন্য? বুঝলাম না, কিন্তু অভিমান হয়েছে।”
পরিনীতা বলল, “যা, তোকে দাদন ডেকেছেন।”
প্রিয়তা নাক টেনে বলল, “তুমি যাও আপু।”
পরিনীতার ভ্রু কুঁচকে গেল। অবাক কণ্ঠে বলল, “তুই যাবি না?”
প্রিয়তা দুই পাশে মাথা নাড়ালো—যার অর্থ, সে যাবে না।
পরিনীতার ভ্রু কুঁচকে গেল। সে ও-দায় সারা ভাবে বলল,
“ঠিক আছে, আমি তাহলে দাদানকে বলি—তুই যাবি না বলেছিস।”
পরিনিতা দাঁড়িয়ে পড়ল। পরিনিতাকে দাঁড়াতে দেখে প্রিয়তার রক্ত চলকে উঠল।
সে তড়িত্ বেগে বলল, “যাচ্ছি।”
পরিণিতা দাঁড়িয়ে রইল। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
“যা তাহলে।”
প্রিয়তা ধীর পায়ে কেবিনে প্রবেশ করল। পরিণিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“যার জন্য কষ্ট, পাশ রাগ করিস, অভিমান করিস—তাকে দেখলে সেগুলো কেন ধরে রাখতে পারিস না?
তাহলে এমন রাগ করিস কেন, যা ধরে রাখতে পারিস না?”
তার ভাবনার মাঝেই ফোন বেজে উঠল। ফোনটা সামনে ধরে দেখল—মেঝো দাদান।
ফোন রিসিভ করতেই প্রীতম তাড়াহুড়ো করে বলল,
“তাড়াতাড়ি নিচের পার্কিং এরিয়াতে আয়।”
পরিণিতা অবাক কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“কেন, দাদান?”
প্রীতম ঝটপট উত্তর দিল,
“আমরা সবাই নিচে আছি। রাত ১১ টা বাজে, খাবি না নাকি? বড়ো আম্মু বকা-ঝকা করছেন, তাড়াতাড়ি আয়।”
পরিণিতা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“কিন্তু, মেঝো দাদান… প্রিয় খাবে না।”
প্রীতম থমকে গেল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“বলেছিলাম, রাজি হয়নি।”
বড়ো দাদান বললেন,
“ওর জন্য নিয়ে আসতে। তুই তাড়াতাড়ি আয়।”
বলে ফোনটা কেটে দিল।
পরিণিতা আর বেশি কিছু ভাবল না।
সে সামনে এক পা বাড়াতেই আবার ফোন বেজে উঠল।
ফোনের স্ক্রিনে চোখ রাখতেই তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
সে ঝটপট ফোন রিসিভ করে সালাম দিল।
আবিদ মৃদু হেসে সালামের উত্তর দিল।
পরিণিতা কথা বলতে বলতে নিচে চলে গেল।
প্রণয় চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে শুয়ে আছে, যার ফলে গলার অ্যাডামস অ্যাপলটা স্পষ্ট।
প্রিয়তা মাথা নিচু করে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে পাশে দাঁড়াল। কিন্তু ভুলেও ওর মুখের দিকে চাইল না।
তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে।
প্রণয় চোখ বন্ধ করেই ডাকল,
“রক্তজবা…”
কেঁপে উঠল প্রিয়তা।
কিছু একটা আছে এই সম্বোধনে—যা প্রতি বারই প্রিয়তার ভেতর ঝড় তুলে দেয়।
যা তাকে কখনোই শক্ত থাকতে দেয় না।
এই পুরুষ তাকে কোনোদিনও শক্ত থাকতে দেয়নি, দেবেও না।
প্রিয়তা কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“হুম।”
প্রণয় চোখ মেলে গভীর দৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়তার মুখের দিকে।
প্রিয়তা এখনো মাথা নিচু করে আছে।
প্রণয় একটু কঠিন কণ্ঠে বলল,
“তাকা আমার দিকে।”
প্রিয়তার কান্না পেয়ে গেল।
এই লোকটা এমন করে কেন?
কিছুতেই এই লোকের চোখে চাওয়া যাবে না—নাহলে সব বুঝে যাবে।
আর সে, এই লোককে কিছুই বুঝতে দিতে চায় না।
এখনো প্রিয়তা মাথা নিচু করে আছে দেখে একটু রেগে গেল প্রণয়।
ধমক দিয়ে বলল,
“লুক অ্যাট মি!
এমন ধমকানিতে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। বিদ্যুৎ বেগে তাকালো প্রণয়ের চোখে। দৃষ্টিতে দৃষ্টি, আটকাতেই মৃদু কম্পন ধরলো সর্বাঙ্গে। প্রণয় গভীর চোখে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার চোখে। নীল চোখ দুটো লাল—প্রিয়তমার ব্যথার গভীরতা অনুভব করে প্রণয়ের হৃদয়ও সেই একই ব্যথায় নীল হয়ে গেল। এটা যে কীরকম বিষাক্ত অনুভূতি—সেটা তো গত ২৪ ঘণ্টায় তার খুব ভালো মতোই জানা হয়ে গেছে।
শুধু মাত্র কল্পনা করেই তো সে আজ এখানে। তবে তার ছোট্টো পাখিটা না জানি কত কষ্ট পাচ্ছে—প্রিয়তার কষ্টগুলো প্রণয় অন্তর থেকে অনুভব করতে পারছে। এই যন্ত্রণা সহ্য করার মতো না। তবে তার জান কীভাবে সয়ে নিচ্ছে—প্রণয় কোনো প্রশ্ন করলো না, শুধু বলল, “এদিকে আয়।”
প্রিয়তা গেলো না, ভেবলার মতো তাকিয়ে রইলো। প্রণয় নরম সরে ডাকলো, “আয়।”
প্রিয়তার কী হলো, জানা নেই। সে মন্ত্রমুগ্ধদের মতো এগিয়ে গেলো। প্রণয় আদুরে গলায় বললো, “বসো।”
প্রিয়তা ও বাধ্য মেয়ের মতো বসে পড়লো। প্রণয় ডান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললো, “এখানে মাথা রাখো।”
প্রিয়তা ব্যথাতুর চোখে তাকালো প্রণয়ের চোখে। ওই চোখের ভাষা না বুঝলেও, নিজের জন্য এক আকাশ পরিমাণ মায়া দেখলো সে। আর কোনো বাক্য ব্যয় না করে প্রণয়ের ডান বাহুতে মাথা রাখলো।
পুরুষটা নিষিদ্ধ, অথচ আশক্তির সাগর। সে ডান হাতটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। বাহুতে মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে ফুপিয়ে উঠল, যথাসম্ভব শব্দ না করার চেষ্টা করল।
প্রিয় পুরুষের দেহের প্রিয় গন্ধটা আবার মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে বিচরণ করছে। না, অন্তরে আগুনে ঘি ঢালছে। অদ্ভুত না? যার জন্য কষ্ট পাই, মরে যেতে ইচ্ছে হয়—তার কাছেই সে কষ্টকে আহুতি দিতে হয়। তাকেই কষ্ট ভুলতে আঁকড়ে ধরতে হয়। সত্যি কি, তাকে আঁকড়ে ধরলেই কষ্ট ভুলা যায়?
নাকি তাকে কাছে পেলে, সে আমার নয়, সে অন্য কারো—তাকে আমি চিরতরে হারিয়ে ফেলেছি, এই ভাবনা, এই যন্ত্রণা শতগুণ হয়ে আরও তীব্রভাবে হৃদয় ক্ষত-বিক্ষত করে?
প্রিয়তার হৃদয়ের ব্যথায় চেয়ে যাচ্ছে প্রণয়ের মন।
ছোট দেহের কাঁপনটা সে খুব ভালো মতোই অনুভব করতে পারছে, যা তার সর্বাঙ্গ জ্বালিয়ে দিচ্ছে। মনে তৈরি হচ্ছে তীব্র অপরাধবোধ। সে প্রিয়তার চুলে গভীর ভালোবাসাময় স্পর্শ করে প্রথমবারের মতো অনুভব করলো—যা হচ্ছে, তা মোটেও ঠিক হচ্ছে না। আমাকে যত কষ্টই পেতে হোক না কেন, আমার ভালোবাসাকে এই মরণ যন্ত্রণা পেতে দেওয়া উচিত নয়।
আমার তো হাত-পা শক্ত করে বাঁধা, আমি তো চাইলেও এই বিষাক্ত বন্ধন থেকে কোনোদিন মুক্ত হতে পারবো না, আর না পারবো আমার ভালোবাসাকে কোনোদিন সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন দিতে।
প্রণয় চোখ বন্ধ করে নিয়ে মনে মনে কিছু কঠিন কথা আওড়ালো—
“আমাকে, আমার ভালোবাসাকে, এই অসুস্থ আশক্তি থেকে মুক্তি দিতেই হবে।”
এক ঘণ্টা আগে সে ভেবেছিল—যন্ত্রণায় দুকে দুকে মরলে, দুজনে একসাথেই মরবো।
কিন্তু এখন আর সেই ভাবনায় মন কিছুতেই সায় দিচ্ছে না। বরং আবার ও নিজের উপর ঘৃণা আসছে।
সে এতটা স্বার্থপর ও নিছ মানসিকতার ? নিজের একটু ভালো থাকার জন্য, যার গায়ে কখনো ফুলের টুকা পর্যন্ত লাগতে দেয়নি, তাকে এতটা কষ্ট দিল!
মনে মনে আফসোস করে বলল,
“সবকিছু তো আমার চোখের সামনেই ছিল। আমি দেখেও দেখতে চাইনি, বুঝেও বুঝতে চাইনি। অন্ধ হয়ে গিয়েছিলাম, তোমাকে নিজের করে পাওয়ার লোভে। একবারও ভাবিনি, যে সেটা আর কখনো সম্ভব নয়।”
সে প্রিয়তার হাত ধরে টেনে নিলো নিজের বুকে। মাথাটা বুকের সাথে চেপে ধরে কিছু কঠিন শপথ নিলো—
“এবার আর নিজের চিন্তা নয়।”
সে প্রিয়তার সুমিষ্ট মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবল, “আমাকে, আমার রক্তজবার ভবিষ্যতের কথা ভাবতে হবে। এভাবে আর ক’দিন চলবে?”
প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, “আমাকে ক্ষমা করে দাও রক্তজবা, আমি তোমাকে এমন জীবন দিতে চাইনি। আমি তোমাকে একটা সুস্থ, সুন্দর জীবন দিতে চেয়েছিলাম—যেখানে দুঃখ তোমার আশেপাশেও থাকবে না। ভালোবাসার বন্ধনে রাখতে চেয়েছিলাম তোমাকে।”
সেখানে আজ আমি নিজেই তোমাকে দুঃখের সাগরে ছুঁড়ে ফেলেছি। আমি তোমাকে ভালো রাখতে পারিনি আমি ব্যর্থ।
বড় আফসোস হলো তার…
নিজের বুকের সাথে লুটিয়ে থাকা ছোট্ট ফুলটাকে দ্বিতীয়বার ভালোবেসে প্রণয় বিড়বিড় করে বলতে লাগল,
“আমাকে ক্ষমা করে দে জান, তোর প্রণয় ভাই তোকে কথা দিচ্ছে, খুব তাড়াতাড়ি তোকে এই দুর্বিষহ জীবন থেকে মুক্তি দেবে।
আমি যে জালে জড়িয়ে গেছি, সেখান থেকে মৃত্যু ব্যতীত মুক্তি নেই আমার। কিন্তু তোর জীবন এমন হবে না—তোকে আর এই কষ্ট পেতে দেব না।”
নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করল প্রণয়।
প্রিয়তাকে আরেকটু বুকের সাথে মিশিয়ে নিয়ে অবাক চোখে চেয়ে বলল,
**“আমার জন্য এত পাগল তুই কবে হলি জান?
নিষিদ্ধ জেনেও দিনের পর দিন কীভাবে একতরফা ভালোবেসে গেলি?
কেন এতটা ভালোবাসলি আমায়?
জানতিস না, আমি যে জালে ফেঁসে গেছি, সেখান থেকে মৃত্যু ব্যথিত মুক্তি নেই আমার?
বিশ্বাস কর জান, আমি যদি একবার বুঝতে পারতাম, আমার জীবনটা এমনভাবে বদলে যাবে, তাহলে তোকে কোনোদিন এ জীবনে জড়াতাম না।
তোর অনুভূতিকে ও প্রশ্রয় দিতাম না।
এত কষ্ট পাস,
তবু… ওহ্… ঘৃণা কেন করিস না?
কেন বারবার ফিরে আসিস?
তোর জায়গায় আমি থাকলে এতদিনে আমার কবরে ঘাস উঠে যেত।
আজ আমার বড় আফসোস হচ্ছে—
জানিস, আমি কোনোদিন চাইনি তুই আমাকে ভুলে যা।
কিন্তু আজ অনুভব করছি—তোর আমায় ভুলে যাওয়া উচিত, একেবারে ভুলে যাওয়া উচিত।
তবেই তুই ভালো থাকবি।
জান, আমার মতো কাপুরুষকে ভালোবাসা একদম উচিত হয় নি তর।
যার জন্য তোর চোখের জল পড়ে, সে তোর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য নয়।
যে তোর চোখের জলের কারণ, তাকে ভালোবাসিস না।”**
প্রণয়ের কলিজাটা ছিঁড়ে যাচ্ছে এমন ভাবনায়। এসব কী ভাবছে সে? তার জান তাকে ভালোবাসে না? ভুলে যাবে? প্রত্যেকটা ভাবনাই যেন বিষের ছুরি, যা প্রণয়ের হৃদয়কে ক্ষত বিক্ষত করে দিচ্ছে। এসব ভাবতেই মনে হচ্ছে, কেউ যেন কলিজাটা ধরে ছিঁড়ে নিচ্ছে। ব্যথাটা ছড়িয়ে পড়ছে দেহ ও মনের আনাচে-কানাচে। তার জান যদি তাকে সত্যি ভুলে যায়, ওই মায়াভরা চোখে যদি আর না তাকায়—তাহলে বাঁচবে কীভাবে সে?
তার জান যদি একদিন সত্যিই তার থেকে দূরে চলে যায়, তবে সেই দিন আর বেশি দূরে নয়—যেদিন হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে প্রণয় শিকদারকে দুনিয়া ছাড়তে হবে। এই মেয়েটা শুধু মেয়ে নয়, সে প্রণয় শিকদারের প্রাণভোমরা। ভালোবাসায় গড়া ছোট্ট পুতুল।
কিছুক্ষণ পর প্রণয় অনুভব করল, তার গলায় বড় বড় ভারি নিঃশ্বাস আছড়ে পড়ছে। মৃদু হাসল প্রণয়। নিজের জানকে নিজের বুকের আরও একটু জায়গা করে দিয়ে পুনরায় মাথার ওপর এলিয়ে দিল।
বুক চিরে কয়েকটা লাইন বেরিয়ে এল—
পথ ভুলে গেছি চলে
দূরের কুয়াশায়।
তবু আমার, ফিরে আসার
সত্যিই নেই উপায়।
তুমি আমার জিতের বাজি,
তুমিই আমার হার।
কি করে বলবো তোমায়,
আসলে মন কি যে চায়,
নিজের বুকে শুইয়ে নিজের থেকে চিরতরে দূরে সরিয়ে দেওয়ার চিন্তা—সত্যিই কি সে পারবে তার রক্ত-জবাকে নিজের থেকে একেবারে দূরে সরিয়ে দিতে? যে একটুখানি চোখের আড়াল হলেই বাঁচা মুশকিল তাকে না দেখে?
শুদ্ধের মতোই সুখের সঙ্গে ও প্রণয়ের গভীর শত্রুতা—কোনো একসময় সখ্যতা থাকলেও বর্তমানে তারা দুজনই প্রণয়ের চিরশত্রু। একটু সুখের আশায়, হয়তো তার মৃত্যুই হবে।
রাত ৩টা ২০। হাসপাতালে গুটি কয়েক ডাক্তার, নার্স আর কিছু মানুষ জেগে আছে। প্রণয়ের কেবিনে খুব সতর্ক পায়ে কেউ ঢুকল। ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল বিছানার দিকে, যেখানে প্রিয়তা প্রণয়ের গলায় জড়িয়ে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে। প্রণয়ও তার ‘জান’-কে বুকে নিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে।
লোকটা পাশে বসে তাদের দুজনের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল কিছুক্ষণ। তার মুখে রাগ, ক্ষোভ কিছুই ছিল না। কারণ সে এই দৃশ্যে অভ্যস্ত। আর সে খুব ভালো করেই জানে—এই স্পর্শের চেয়ে পবিত্র কিছু নেই প্রিয়তার জন্য।
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ২৮
সে সেদিকে মনোযোগ দিচ্ছে না। তার সমস্ত মনোযোগ প্রণয়ের দিকে। সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে প্রনয় কে পর্যবেক্ষণ করল, কোথায় কোথায় কতটা আঘাত পেয়েছে সে।
মাথার ব্যান্ডেজে হাত ছোঁয়াতেই তার চোখে পানি চলে এল। হাতের লাগানো কেনুলায় ছোঁয়া দিতে কেঁপে উঠল হাত, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল দুই-এক ফোঁটা নোনা পানি।
সে আর সেখানে স্থির হয়ে দাঁড়াতে পারল না—দ্রুত পায়ে কেবিন ত্যাগ করল।
সে যেতেই চোখ মেলে চাইলো প্রণয়। ঠোঁটে তার অদ্ভুত এক হাসি।