ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩৭
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
প্রণয় টিস্যুতে রক্ত মাখা হাত মুছতে মুছতে গার্ডদের উদ্দেশে একদম স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
— “এই আবর্জনাটা কেটে ছোট ছোট পিস করে আমার রিও-কে (ব্ল্যাক প্যান্থার) খাইয়ে দিও। আর ওর মাথাটা পার্সেল করে DCP-র বাসায় পাঠিয়ে দিও। এন্ড রিমেম্বার, ওর এই মরনের জার্নিটা যেন কাল সকালের খবরের কাগজের ফ্রন্ট পেজে চাপা হয়। এই হট নিউজটাই হবে কালকের হেডলাইন, উইথ ভিডিও ক্লিপ।”
গার্ডদের হেড মাথা নেড়ে সম্মতি জানিয়ে বলল,
— “ইয়েস বস! বস, দুবাইয়ের অর্ডার পাঠিয়ে দিয়েছি। তারা পেমেন্টও করে দিয়েছে। সিঙ্গাপুর আর মালয়েশিয়ার অর্ডার কালকে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু একটা প্রবলেম হয়ে গেছে, বস।”
প্রণয় ভ্রু কুঁচকালো,
— “কি প্রবলেম?”
এবার ম্যানেজার ভয়ভয় কণ্ঠে বলল,
— “কালকে মাল ডেলিভারির কথাটা লিক হয়ে গেছে বস। আর এই বিশ্বাসঘাতকতাটা আমাদের মধ্যেই কেউ এই করেছে।”
এই কথা কানে আসতেই সবাই ভয়ে তটস্থ হয়ে গেল।
প্রণয় বাঁকা হেসে বলল,
— “বুকের পাটা আছে মানতেই হবে বুকের পাটা দেখে তাকে পুরস্কৃত করতে মন চাচ্ছে।”
সবাই আতঙ্কিত চোখে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে আছে।
প্রণয় একবার জাভেদের দিকে বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
— “এটাকে উঠাও।”
জাভেদ ওই সিনটা সহ্য করতে না পেরে এখনো অজ্ঞান হয়ে মাটিতে উল্টে পড়ে আছে।
একজন গার্ড এসে তার চোখে-মুখে এক বালতি পানি ছুড়ে মারল।
সাথে সাথেই ধরফরিয়ে উঠল জাভেদ।
বংশের বাত্তি চেপে ধরে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগল,
— “আমি এখনো বিয়ে করিনি স্যার, আমাকে মারবেন না!”
সবাই তার দিকে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে।
তার প্রলাপ বকার মধ্যেই জলদ গম্ভীর কণ্ঠস্বর কানে এলো,
— “এখনো সময় আছে, নিজের হার্ট শক্ত কর, না হলে তোমার বংশের বাত্তিও বেশিদিন আলো ছড়াতে পারবে না।”
বলে বেরিয়ে গেলো।
জাবেদ আল্লাহকে স্মরণ করে মনে মনে বলল,
— “রিজিক না থাকলে উঠায়ে নিতেন, তবুও এমন বস দিতেন না!”
রাত ১০টা ৩৫।
শিকদার বাড়ির ডাইনিং টেবিলে বড়-ছোট সবাই বসে আছে, শুধু প্রণয় আর প্রিয়তা বাদে।
চার গিন্নি খাবার পরিবেশন করছেন। পরিবেশ বেশ শান্ত ও গম্ভীর। যেহেতু তিন কর্তা এখানেই আছেন, তাই ছুটরাও কেউ কোন কথা বলছে না, সবাই ভদ্রভাবে খাচ্ছে।
কিন্তু সেই সব ভদ্রতা উপর উপর।
সবারই কথা বলার জন্য মুখ চুলকাচ্ছে।
অরণ্য সমুদ্রকে পা দিয়ে ঠেলা দিল।
সমুদ্র হাতির মত বিশাল হা করে খাবার গিলছে।
তার এসব ঠেলাঠেলি গায়েই লাগছে না।
অরণ্য একবার বিরক্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আশেপাশে নজর ঘুরালো— আর কাকে জ্বালানো যায়?
সমুদ্রের পাশেই বসেছে তন্ময়, কিন্তু তন্ময় ওর থেকে অনেকটা দূরে।
এখন তন্ময়ের পেছনে লাগলে সবাই ওকেই সাবান ছাড়া ধুয়ে দেবে— সবই তার কপাল।
সকলেই মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছেন।
তার মধ্যেই খালিদ শিকদারের একটা কথা কানে আসতেই সবাই চোখ বড় বড় করে ফেলল, খাবার গেলা বন্ধ করে তাঁর দিকে তাকাল।
— “বিয়ের বয়স তো তোমার হয়ে গেছে, প্রিথম। পড়াশোনা ও তো অনেক আগেই শেষ করেছো, ব্যবসাও সামলাচ্ছো। বাড়ির দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে এখন তোমার পালা। আর তোমার বড় দাদানেরও তো বিয়ে হয়ে গেছে।”
সবাই একযোগে চোখ বড় বড় করে তাকালো প্রিথমের দিকে।
প্রিথম নির্বিকারভাবে ভাতের লুকমা মুখে তুলছে।
সে খাবারের প্লেট শেষ করে স্বাভাবিকভাবে তাকালো খালিদ শিকদারের দিকে।
সাদমান শিকদার ও সোহেব শিকদার প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকিয়ে আছেন প্রিথমের দিকে।
প্রিথম তিন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বুঝল, এটা তিন ভাইয়ের বড় কোন বিজনেস প্রজেক্ট।
সে টিস্যুতে হাত মুছতে মুছতে শান্ত কণ্ঠে বলল,
— “বিয়ের বয়স যেহেতু হয়েছে, বিয়ে নিশ্চয়ই করবো। তবে এখন নয়। যখন আমার মনে হবে আমার বিয়ে করার প্রয়োজন, তখনই বিয়ে করব। এখন বিয়ে করার প্রয়োজন বোধ করছি না।”
খালিদ শিকদার বুঝলেন, এই ছেলে সজন নয়। কিন্তু এই ছেলে যদি এখন বেকে বসে তবে বিরাট লস হবে।
তিনি একটু নরম কণ্ঠে বললেন,
— “তোমার যখন ইচ্ছে তখন বিয়ে করলেই তো হবে না বাবা। তুমি তো আর এই বংশের শেষ সন্তান নও, তোমার পরে তোমার আরো ভাইয়েরা বাকি আছে। রাজের বিয়ের বয়স হয়েছে, প্রেমেরও পড়াশোনা শেষ— সবাই বিয়ের উপযুক্ত।”
প্রিথম আগের মতোই বলল,
— “বেশ, তাহলে ওদেরকেই দিন।”
এই কথা কানে আসতেই প্রেমের কাশি উঠে গেল।
খালিদ শিকদারের এবার ধৈর্যের বাঁধ ভাঙছে।
তিনি কিছুটা কড়াভাবে বললেন,
— “সেটা হয় না। তুমি সবার বড়, এই বংশের দ্বিতীয় সন্তান হিসেবে আগে তোমার বিয়ে হবে। তোমার জন্য একটা ভালো মেয়ে আমরা দেখে রেখেছি। মেয়েটা রিসেন্টলি ইউকে থেকে পড়াশোনা শেষ করেছে। তোমার সাথে একদম পারফেক্ট মানাবে। আর মেয়েটা তোমাকে পছন্দ ও করে।”
প্রিথম সংক্ষেপে জবাব দিল,
— “তো কি হয়েছে? আমি তো আর করি না।”
এবার সোহেব শিকদার বললেন,
— “শুনো বাবা, মেয়েটার বাবার সাথে আমরা কথা বলে রেখেছি। বলতে পারো একপ্রকার কথা দিয়ে রেখেছি। আর মেয়েটার বাবার সাথে আমাদের অনেক দিনের বিজনেস রিলেশন। এখন তোমার সাথে যদি তার মেয়ের বিয়ে হয়, আমাদের সম্পর্কটা আরও খানিকটা মজবুত হবে।”
সবাই বিস্মিত চোখে তাকিয়ে তাদের কথাগুলো গিলছে।
প্রিথম এবার আর স্বাভাবিক থাকতে পারল না। কিছুটা ক্ষিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
— “আমার জীবনটা আপনাদের বিজনেস ডিল বা পার্সোনাল প্রপার্টি নয়, যে আপনারা যাকে বলবেন আমি তাকেই বিয়ে করব।
আমি একটা কথা এখন এখানেই সবাইকে ক্লিয়ার করে বলতে চাই—
আমি আপনাদের কারো পছন্দ করা মেয়েকেই বিয়ে করব না।
আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি, আর তাকেই বিয়ে করব।”
প্রিথমের এমন দুর্সাহসিকতা আর সরল স্বীকারোক্তিতে ডাইনিং টেবিলে যেন বোমা পড়ল।
সবাই বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে আছে প্রিথমের দিকে।
প্রেরণা, পরিনীতা, থিরা, তোরি— সবার বুকই ভয়ে ধড়ফড় করছে।
অরণ্য মনে মনে নেচে উঠল,
— “জিও মেজদা!”
সাদমান শিকদার এতক্ষণ সব কিছু শান্ত চোখে দেখছিলেন।
তিনি এবার কিছুটা অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললেন,
— “বড়দের মুখে মুখে এভাবে তর্ক করা শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে বেয়াদব ছেলে? আদব-কায়দা সব ভুলে গেছো?”
প্রিথম এবার আরও রেগে গেল।
ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,
— “সরি, আমি আপনাদের পছন্দমতো মেয়ে বিয়ে করে আদব কায়দার প্রমাণ দিতে পারব না!”
বলে ধপাধপ পা ফেলে ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
সাদমান শিকদার ও খালিদ শিকদার একে অপরের চোখের দিকে তাকালেন— যার অর্থ বোঝা কারো সাধ্য নয়।
তারা তিন ভাইও হাত ধুয়ে চলে গেলেন।
প্রিথমের বাবা বাসায় নেই, তাই তিনি এসবের কিছুই জানলেন না।
অনুস্রী বেগম এবার অসন্তুষ্ট কণ্ঠে অনন্যা বেগমের উদ্দেশে বললেন,
— “সেজো, তোর ছেলেটা একেবারেই বেয়াদব হয়ে গেছে। বড় চাচাদের মুখের উপর কেউ এভাবে কথা বলে! ছি! ছি! কি আদব-কায়দা?”
অনন্যা বেগম চুপ করে রইলেন। তিনি কিছুই বললেন না।
উনার কাছে উনার ছেলে-মেয়ের খুশিই সবার আগে।
প্রিথম যাকে পছন্দ করে বিয়ে করবে, তিনিই তাকেই সাদরে বউমা হিসেবে গ্রহণ করে নেবেন।
ইনায়া বিছানায় শুয়ে শুয়ে এপাশ-ওপাশ করছে। তার পেয়ারেলালের কথা ভীষণ মনে পড়ছে। ভীষণ মিস করছে তার পেয়ারের পেয়ারেলালকে। তাই আর মনকে বেশি কষ্ট দিলো না—দ্রুত শোয়া থেকে উঠে বসে প্রিথমের নম্বরে ফোন লাগালো।
কিছুক্ষণ রিং হওয়ার পর ফোন রিসিভ হলো।
ইনায়া মিষ্টি কণ্ঠে সালাম দিলো।
প্রিথম দুষ্টু হেসে সালামের উত্তর দিয়ে বললো,
— “কি ব্যাপার? রসগোল্লা খাওয়াতে ফোন দিয়েছো বুঝি?”
ইনায়া লজ্জায় পেয়ে গেলো। সে বুঝে পায় না, এই লোকটা এত লুচ্চা কীভাবে হলো!
সে মিষ্টি কণ্ঠে জবাব দিলো,
— “আপনাকে মিস করছি।”
— “সত্যি?”
— “হুম।”
— “তাহলে অপেক্ষা করো, আসছি!”
— “এই, এই শোনেন…”
আর কিছু বলার আগেই ফোন কুট কুট শব্দে ফোন কেটে গেলো।
ইনায়া এবার মাইনকা চিপায় ফেঁসে গেলো। এই লোক যদি এতো রাতে এখানে এসে বাওয়াল করে, আর এসব যদি কেউ দেখে ফেলে, তবে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে!
সে নিজের কপাল চাপড়ে বললো,
— “নিশ্চয়ই আমাকে শয়তানে লাড়া দিয়েছিলো! না হলে এই বেটাকে এসব বলি? হায় আল্লাহ, আমার মানুষটাকে একটু ধৈর্য সহ্য দাও, একটু শান্ত থাকার তৌফিক দাও। এত উত্তেজিত লোক আমি সামলাতে পারবো না!”
রাত ১১টা।
আবিদ বসে বসে কলেজের আনসার শিট চেক করছে।
চাকরিটা পাওয়ার পর থেকে আজকাল আর নিজেকে একটু সময় দেওয়ার সুযোগ হয় না তার।
বাড়ির একমাত্র ছেলে সে—কত দায়িত্ব তার, বিশ্রাম নেওয়ার সময় কই!
আবিদের আম্মু, আমিনা বেগম, এক ঘণ্টা যাবত রান্নাঘর থেকে হাঁক দিচ্ছেন—
— “আব্বু, ভাত খায়ে যাও, তারপর কাজ করো।”
কিন্তু সেসব কথা আবিদের কানে পৌঁছাবে তার পর তো!
সে চশমার কোণা ঠেলে মনোযোগ দিয়ে খাতায় মার্ক বসাচ্ছে।
আমিনা বেগম এবার বিরক্ত হয়ে খাবার নিয়ে ঘরে চলে এলেন।
ছেলের দিকে মায়া ভরা নজরে তাকালেন।
উনার ছেলেটা যে কতো পরিশ্রম করে, তা তিনি ভালোই বুঝতে পারেন। মা হিসেবে কষ্টও পান, কিন্তু কী আর করবেন, বাধা দেওয়ার সামর্থ্যও যে নেই—একটা মাত্র ছেলে উনার, সে না করলে আর কে করবে এসব?
তিনি খাবারের থালা নিয়ে ছেলের সামনে গিয়ে বসলেন।
আবিদ খাতা দেখতে দেখতে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
— “খাবারটা রেখে যাও, আম্মু। পরে খেয়ে নেবো।”
আমিনা বেগম মমতাময়ী চোখে ছেলেকে পরখ করলেন।
তিনি জানেন, খাবার রেখে চলে গেলে কখন খাবে তার ঠিক নেই—হয়তো খাবে, হয়তো খাবে না।
তাই তিনি নিজের হাতে ভাত মেখে এক লুকমা খাবার ছেলের মুখের সামনে ধরলেন।
আবিদ একবার মাথা তুলে আম্মুর দিকে তাকালো, অতঃপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে খাবার মুখে নিয়ে আবারো খাতা দেখতে মনোযোগ দিলো।
আমিনা বেগম ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে মমতাময়ী কণ্ঠে বললেন,
— “এখন আর টিউশন করানো ছেড়ে দাও বাবা। আর এত পরিশ্রম করতে হবে না। এখন তো চাকরি হয়ে গেছে।”
আবিদ খাবারটা গিলে নিয়ে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
— “শুধু একটা চাকরির ওই সামান্য কটা টাকায় এই দুর্মূল্যের বাজারে সংসার চলবে না, আম্মু।
ওষুধপত্র থেকে শুরু করে যাবতীয় সবকিছুতে অনেক খরচ—টিউশন করিয়ে যা পাই, তার সব মিলিয়ে ভালোমতো চলতে পারি।
একটা চাকরির ওপর ভরসা করে একটা পরিবার চলে না, আম্মু।”
আমিনা বেগম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন।
— “তুমি খেয়েছো, আম্মু?”
আমিনা বেগম ছেলের মুখে ভাত তুলে দিয়ে ছোট্ট করে বললেন,
— “হুম।”
— “আব্বুকে ডাক্তার দেখিয়েছিলে? কী বলেছেন ডক্টর?”
আমিনা বেগমের চোখে পানি চলে এলো।
তিনি এই কথাটা ছেলেকে কীভাবে বলবেন?
ডাক্তার অপারেশনের কথা বলেছে, তাই না আম্মু?
কত টাকা লাগবে?
থমকে গেলেন আমিনা বেগম।
আবিদ বললো,
— “সংকোচ করো না, আম্মু। আমি তোমাদের ছেলে। আমাকে অনেক কষ্টে মানুষ করেছো তোমরা।
আমার গায়ের চামড়া দিয়ে জুতা বানিয়ে পড়ালেও তোমাদের ঋণ শোধ হবে না, আর সেখানে তুমি আমাকে কিছুই বলতে চাও না?”
আমিনা বেগম আঁচল দিয়ে মুখ চেপে কেঁদে উঠলেন।
— “আমি জানি আম্মু, আব্বুর লিভার ট্রান্সপ্লান্ট করাতে হবে।
এদেশে তার অনেক খরচ, তাই ইন্ডিয়াতে নিয়ে গিয়ে করাতে হবে, তাই না?
সর্বমোট কত টাকা লাগবে?”
আমিনা বেগমের গলা কাঁপছে।
তিনি ধরা গলায় বললেন,
— “সর্বনিম্ন ২০–২৫ লক্ষ টাকা!”
টাকার অঙ্ক কানে আসতেই হাত থেমে গেলো আবিদের।
কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার খাতা দেখতে মনোযোগ দিলো।
তারপর সময় নিয়ে বললো,
— “কবে অপারেশন করাতে হবে, কিছু বলেছে?”
— “দুই মাস পর।”
— “ঠিক আছে। আর যা যা টেস্ট লাগে, কাল গিয়ে করিয়ে নিও।”
আমিনা বেগম মাথা নেড়ে চলে যেতে নিলেন।
আবিদ পেছন থেকে আম্মুর হাত ধরে ফেললো।
তিনি আবারও পেছন ফিরে তাকালেন।
আবিদ আম্মুর মুখের পানে তাকিয়ে আশ্বস্ত কণ্ঠে বললো,
— “টাকা নিয়ে চিন্তা কোরো না।
যখন যা লাগবে, বিনা সংকোচে বলবে।
মনে রাখবে, তোমাদের ছেলে এখনো বেঁচে আছে।
আমি থাকতে তোমাদের কোনো অভাব হতে দেবো না।
আর সেখানে বিনা চিকিৎসায় থাকতে দেওয়ার তো প্রশ্নই আসে না।”
চোখের পানি ছেড়ে দিলেন আমিনা বেগম।
ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
— “তুই আমার গর্ব, বাবা।”
আবিদ সচ্ছ হাসলো।
সে তো জীবনে এতটুকুই চায়—তার বাবা-মাকে সর্বোচ্চ ভালো রাখতে চায়।
আমিনা বেগম ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
আবিদ আবারও খাতা দেখতে মনোযোগ দিলো।
কিছুক্ষণ পর টুং শব্দে ফোনে একটা মেসেজ এলো।
হাসলো আবিদ। ফোন হাতে নিয়ে মেসেজটা ওপেন করতেই তার হাসি মিলিয়ে গেলো।
বুক কেঁপে উঠলো।
এক-দুই লাইনের মেসেজটা এমন ছিলো—
“এখনও সময় আছে।
যদি নিজের ভাইয়ের মতো মরতে না চাও, তবে ‘পরী’কে ভুলে যাও।”
এইটুকু মেসেজ পড়তেই হৃদপিণ্ড থেমে গেলো আবিদের।
এতগুলো বছর পর ভাইয়ের নামটা দেখতেই আবারো সেই অভিশপ্ত দিনটার কথা মনে পড়ে গেলো।
চোখের সামনে ১৭ বছর আগের কিছু ঝাপসা স্মৃতি ভেসে উঠলো—
“ভাইয়া, কোথায় যাচ্ছো?”
আদিল হেসে ছোট ভাইকে সাইকেলে তুলে নিয়ে বললো,
— “চল ঘুরতে যাচ্ছি, তুইও যাবি?”
আমিনা বেগম পেছন থেকে বারণ করে বললেন,
— “কোথাও যাবে না দু’জন।”
কিন্তু তারা দু’ ভাই আম্মুর কথা শোনার অপেক্ষা করলো না।
সাইকেল টেনে চলে গেলো।
গ্রামের আঁকা-বাঁকা মেঠোপথ, দুই ভাই খিলখিল করে হাসছে।
অনেকটা জায়গা পেরিয়ে সাইকেলটা একটা বড় মাঠের সামনে যেতেই আচমকা একটা বড় গাড়ি এসে তাদের সাইকেলটাকে ধাক্কা দেয়।
দু’ ভাই উল্টে পড়ে যায় পাশের মাঠে।
তৎক্ষণাৎ গাড়ি থেকে নামে ১০ জন কালো মাস্ক পরা বিশালদেহী লোক এবং এক সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত ভদ্রলোক।
কালো পোশাক পরা লোকগুলো আবিদের চোখের সামনেই তার বড় ভাইকে টেনে নিয়ে যায়।
৯ বছরের আবিদ বাধা দিতে চাইলে একজন তাকে শক্ত করে আটকে ফেলে।
তার চোখের সামনে তার ভাইকে নির্মমভাবে মারতে থাকে।
সেদিন সে লোকগুলোর কাছে অনেক কেঁদে কাকুতি-মিনতি করেছিল, কিন্তু সেই লোকগুলো তার একটা কথাও শোনেনি।
তার ভাই চিত্কার করছিল—আজও কানে বাজে সেই করুণ আর্তনাদ।
অনেক মারার পর সেই ভদ্রলোক এগিয়ে যায় তার ভাইয়ের কাছে।
জীবিত অবস্থায় তার ভাইয়ের বুক কেটে কলিজা টেনে ছিঁড়ে নেয়।
এতটুকু মনে করতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো আবিদ।
১৭ বছর আগের সেই দিনটা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে।
মাঝে মাঝে দুঃস্বপ্ন হয়ে, ঘুমাতে দেয় না।
চোখ মুছে আবার মেসেজটা দেখলো আবিদ।
অতঃপর তাচ্ছিল্যের হেসে নাম্বারটা ব্লক করে দিলো।
গ্যালারিতে ঢুকে একটা ছবি ওপেন করে চোখের সামনে ধরলো—
বাদামি চোখের, পার্পল শাড়ি পরিহিতা এক অতিসুন্দরী রমণী।
সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আনমনে বললো—
“ওরা সব জেনে গেছে, ‘পরী’।
তবে তুমি চিন্তা কোরো না,
তোমার মাস্টারমশাই না মরা পর্যন্ত তোমার হাত ছাড়বে না।
এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, আমার অবস্থা আমার ভাইয়ের থেকেও খারাপ হবে।
তবে তোমায় হারিয়ে এ জীবন বাঁচার চেয়ে
তোমায় ভালোবেসে মৃত্যুকে আপন করে নেওয়া আমার জন্য পরম সুখের।
আমি তো প্রথম দিন থেকেই জানতাম,
আমাকে মরতে হবে।
মৃত্যু আসবে জেনেই তো তোমায় ভালোবেসেছি।
তুমি আমার সুখের অসুখ পাখি…
এই নিঃস্ব পৃথিবীতে তুমি আমার সব…
আজ বুঝি সেদিন ভাইয়াকে মরতে দেখেছি কিন্তু আফসোস করতে দেখি নি,, না জেনে করা অপরাধের মূল্য তাকে জীবন দিয়ে চুকাতে হয়েছে-
কিন্তু আমিতো সেই একই অপরাধ জেনে শুনে করেছি।
তোমাকে ভালোবাসার অপরাধে তোমার মাস্টারমশাইয়ের মৃত্যুদণ্ড হবে—ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক নয়।
তবে যাই হয়ে যাক ‘পরী’, তুমি শুধু আমার হাত ধরে থেকো।”
পৃথম আসবে বলে লাপাত্তা হয়ে গেছে।
ইনায়া অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে করতে নিজের অজান্তেই ঘুমিয়ে পড়েছে। কিন্তু বেশ অনেকক্ষণ থেকেই তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে, কেউ তার দিকে অপলকে চেয়ে আছে। ইনায়া ঘুমের মধ্যে ডিস্টার্ব ফিল করলো। পাশ ফিরে নিজের পাশ বালিশটা জড়িয়ে ধরতে গেলে অনুভব করলো—বালিশটা কেমন বড় আর শক্ত শক্ত লাগছে। সে তার উপর পা তুলে দিল, বালিশটা দুই হাতে বুকের সাথে চেপে ধরতে চাচ্ছে, কিন্তু কিছুতেই কমফোর্টেবল ফিল করতে পারছে না। বালিশটা ওর নিজের ডাবল মনে হচ্ছে। সে একটু বিরক্ত হলো।
তার এসব চটকাচটকির মধ্যেই একটা ভারী পুরুষালি কণ্ঠস্বর কানে এলো—
“এভাবে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে সিডিউস করার চেষ্টা করোনা, রসগোল্লা! কন্ট্রোল হারিয়ে রসগোল্লা পুরোটা খেয়ে নিলে সমাজে মুখ দেখাতে পারবো না! তখন আমায় কে বিয়ে করবে, শুনি?”
এমন ভয়ঙ্কর কথা কানে আসতেই তড়াক করে চোখ মেলে তাকালো ইনায়া। অন্ধকার ঘরে পাশে কারো বিশাল কায়া অবয়ব দেখে ভয়ে চিৎকার দিতে নিলে, সঙ্গে সঙ্গেই তার মুখ চেপে ধরলো পৃথম। ধমকে বললো—
“একদম চুপ নিজের হবু বাচ্চার বাপকে পাবলিকের হাতে গণপিটুনি খাওয়াতে চাও, নাকি?”
পৃথমের কণ্ঠ চিনতে পেরে শান্ত হলো ইনায়া। কিন্তু মুখ থেকে হাত সরিয়ে নিলো না। এবার পৃথম ইনায়ার দিকে আরেকটু চেপে বসে ফিসফিস করে বললো—
“আসছি, এখন দাও।”
ইনায়া ভ্রু কুঁচকে গেলো। মুখের উপর থেকে হাত সরিয়ে দিয়ে বিস্মিত কণ্ঠে বললো—
“কি দেবো?”
ইনায়ার কথায় পৃথমের চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলে গেলো। সে ঝটপট বিছানা থেকে উঠে পড়লো। ইনায়া কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে কোলে তুলে নিলো।
ইনায়া চমকে উঠে বললো—
“এই, কী করছেন! আব্বু দেখে ফেলবে, ছাড়ুন!”
পৃথম “ডোন্ট কেয়ার” ভাব নিয়ে বললো—
“হু কেয়ার্স? তোমার বাপরে কে ভয় পায়?”
বলে ইনায়াকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেলো। গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে নিজে গাড়িতে বসতে বসতে বললো—
“ডেকে যখন এনেছো, তখন এমনি এমনি তো আর চলে যেতে পারি না, মাই ডিয়ার রসগোল্লা!”
ইনায়া আহাম্মক হয়ে গেলো—
“আমি কখন ডাকলাম আপনাকে?”
“মনে মনে ডেকেছো, শুনেছি।”
ইনায়া পৃথমের নীল চোখের দিকে তাকিয়ে আশ্চর্যান্বিত কণ্ঠে বললো—
“আপনি মনও বোঝেন?”
পৃথম তার নরম গলায় স্লাইড করতে করতে বললো—
“হার্ট টু হার্ট চুম্বকীয় কানেকশন, বেবি! এখন স্পেশাল রসগোল্লা টেস্ট করাও!”
ইনায়া ভ্রু বাকিয়ে সন্দেহভরা কণ্ঠে বললো—
“এই যে সারাদিন রসগোল্লা রসগোল্লা বলে মুখে ফেনা তোলেন, পরে খেয়ে ছেড়ে দেবেন না তো?”
পৃথম ইনায়ার ঘাড়ে নখ ঘষেতে ঘষতে হাস্কি টোনে বললো—
“তোমার কি মনে হয়, তুমাকে একবার খেলেই আমার মন ভরে যাবে? ইউ আর রং, মাই ডিয়ার রসগোল্লা। যদি তাই হতো, তবে এই প্রতিক শিকদার পৃথম তোমাকে কবেই খেয়ে ছেড়ে দিতো। কিন্তু তুমি তো আমার কালো জাদু করেছো রসগোল্লার প্রতি আসক্ত বানিয়ে ফেলেছো। এখন তো এই রসগোল্লা আমার রোজ চাই! এই রসগোল্লা সারা জীবন ধরে খেলেও আমার মন ভরবে না জান। তাই প্রতিদিন রেখে রেখে একটু একটু করে খাব, ডায়াবেটিক হয়ে উপরে না যাওয়া পর্যন্ত খাব!
তুমি আমার একদিনের নয়, প্রতিদিনের প্রয়োজন—চিরকালের রসগোল্লা!”
লজ্জায় ইনায়ার গাল লাল হয়ে গেলো। সে চোখ নামিয়ে আরষ্ট কণ্ঠে বললো—
“ছিঃ! আপনি এত লুচ্চা কেন?”
পৃথম বাঁকা হাসলো, ইনায়ার মুখটা তুলে ধরে তার গোলাপের পাপড়ির ন্যায় নরম ঠোঁটের দিকে লুভাতুর নয়নে তাকালো। ঠোঁটে স্লাইড করতে করতে নেশাগ্রস্ত কণ্ঠে গাইল—
“তোর ঠোঁটে ফুল ফোটে, পারি না সামলাতে,
বুকে ঢেউ আসছে, কেউ ঠিকানা বদলাতে!”
লজ্জায় চোখ বন্ধ করে নিলো ইনায়া। ইনায়াকে লজ্জায় লাল হয়ে যেতে দেখে পৃথম আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলো না—
অধরে অধর মিলিয়ে দিল।
রাত ১২টা। প্রহেলিকা ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজছে।
স্লিভলেস ব্লাউজের সঙ্গে পাতলা ফিনফিনে শাড়িতে বেশ আকর্ষণীয় ও আবেদনময়ী লাগছে। শরীরের প্রত্যেকটা ভাঁজ শাড়ির উপর দিয়ে ফুটে উঠেছে এবং তা যেকোনো পুরুষকে আকর্ষিত করতে সক্ষম। সে চুলে স্ট্রেইটনার চালাতে চালাতে মনে মনে বললো—
“আজ দেখবো, ওই মেয়েটার প্রতি ভালোবাসা কতক্ষণ টিকে থাকে!”
সে চুলগুলো স্ট্রেইট করে ছেড়ে রাখলো। গায়ে পারফিউম দিতে দিতে বললো—
“আজ তুমি হবে শুধু আমার।”
তার ভাবনার মাঝেই দরজায় কড়াঘাত পড়লো। প্রহেলিকা কানে দুল পরতে পরতে হাঁক দিয়ে বললো—
“আসো!”
দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন শিকদার বাড়ির অনেক পুরনো হেল্পিং হ্যান্ড—জুলেখা বানু। হাতে তার কেশর দুধের গ্লাস। তিনি প্রহেলিকার কাছে এসে নরম স্বরে বললেন—
“বড় আপা, আপনার কেশর দুধ আনছি।”
প্রহেলিকা বসা থেকে উঠল। হাতে থেকে গ্লাসটা নিতে নিতে বললো—
“আজ এত দেরি করলেন কেন, আপা? জানেন তো, এটা ছাড়া আমার রাতে ঘুম আসে না!”
জুলেখা খালা ফোকলা দাঁতে হেসে বললেন—
“বড় আম্মারে পান সাজিয়ে দিচ্ছিলাম, আপা।”
প্রহেলিকা ঢকঢক করে গ্লাসটা খালি করে ফেললো। ছোটবেলা থেকে রোজ রাতে এক গ্লাস কেশর দুধ খাওয়ার অভ্যাস প্রহেলিকার। এটা না খেলে তার ঘুমই আসে না। জুলেখা বানু আবার বললেন—
“আজ আপনাকে অনেক সুন্দর লাগছে, আপা। বড় ভাইজান তো দেখলেই বেহুশ হয়ে যাবেন!”
জুলেখা খালার কথায় লজ্জা পেলো প্রহেলিকা। দুধের গ্লাসটা উনার হাতে দিয়ে বললো—
“কি যে বলেন, না আপা!”
জুলেখা বানু হেসে চলে গেলেন। প্রহেলিকা মনে মনে বলল—
আজকে তাই হবে!
প্রহেলিকা ঘরের সব লাইট অফ করে বসে রইল। আরও প্রায় ১০ মিনিট পর বাসায় ফিরল প্রণয়—ক্লান্ত, সে ভীষণ ক্লান্ত। ঘরে ঢুকেই চারপাশে অন্ধকার দেখে মেজাজ খারাপ হলো।
তার সচল মস্তিষ্ক আরও অনেক কিছুর আভাস পেল। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে হাতের ঘড়িটা খোলার সাথে সাথেই ঘরের ডিম লাইট জ্বলে উঠল। যার নরম আলোয় আশপাশটা বেশ মোহনীয় লাগছে। ভ্রু কুঁচকালো প্রণয়। সঙ্গে সঙ্গেই অনুভব করল—
তাকে পেছন থেকে কেউ জড়িয়ে ধরেছে।
প্রণয় বাঁকা হেসে তার হাত ধরে সামনে আনল, প্রহেলিকাকে আজ বেশ হট লাগছে। কিন্তু প্রণয় এক সেকেন্ডের জন্যও তার শরীরের দিকে তাকাল না, সোজা দৃষ্টিপাত করল তার চোখের দিকে। তার দৃষ্টি স্থির।
প্রহেলিকা প্রণয়ের গলায় স্লাইড করতে করতে বলল—
আমাকে কেমন লাগছে, বেবি?
প্রণয় বাঁকা হাসল।
প্রহেলিকা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়াল। মুখের কাছে ঝুঁকে গিয়ে বলল—
I want to be very close to you—will you accept me as a part of your life?
প্রণয় তাকে কোলে তুলতে তুলতে বলল—
Yah! Sure. Why not!
প্রহেলিকা বাঁকা হেসে প্রণয়ের গলা জড়িয়ে ধরল। মনে মনে বলল—
রাতের অন্ধকারে সব ভালোবাসা পালিয়ে যায়।
প্রণয় তাকে কোলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল। প্রণয়ের গায়ের মেনলি পারফিউমের গন্ধটা প্রহেলিকাকে ভীষণভাবে উত্তেজিত করে তুলছে। সে দ্রুত হাতে প্রণয়ের শার্টের বোতাম খুলতে উদ্যত হল। শুরুর দিক থেকে চারটা বোতাম খুলতেই প্রণয়ের শার্ট থেকে হাত ছুটে বিছানায় পড়ে গেল।
প্রহেলিকাকে নিস্তেজ হয়ে পড়তে দেখে আবারও বাঁকা হাসল প্রণয়। সে দ্রুত বিছানা থেকে উঠে পড়ল। পাশের ড্রয়ার থেকে গ্লাভস বের করে হাতে পরে নিল।
আবার প্রহেলিকার পাশে বসে তার ঠোঁটের লিপস্টিক ঢলে দিল, চোখের কাজল লেপ্টে দিল, চুল এলোমেলো করে দিল। নিজের পরনের সাদা শার্টটা গা থেকে খুলে ফেলে প্রহেলিকার ঠোঁটে ঘষে দিল। অতঃপর শার্টটা প্রহেলিকার পাশেই ছুঁড়ে ফেলল।
ড্রেসিং টেবিল থেকে নিজের রেগুলার ইউজড পারফিউম এনে প্রহেলিকার পুরো গায়ে স্প্রে করে দিল। বিছানা কিছুটা এলোমেলো করে দিল। অতঃপর প্রহেলিকার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল—
অতি চালাকের গলায় দড়ি, ডার্লিং!
বলে উঠে পড়ল সে। ওয়ারড্রোব থেকে কফি কালার টি-শার্ট বের করে পরে নিল। ওয়ারড্রোবের পাশের ড্রয়ার খুলে সেখান থেকে বড় একটা উঁচু খাম বের করল। একই রকম দেখতে আরও দুটো খাম নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
জুলেখা বানু ভয় ভয় তিন তলার মাঝারি ছাদে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রণয় তার দিকে তিনটা খাম এগিয়ে দিয়ে বলল—
Good job। এভাবেই মন দিয়ে কাজ করুন, আরও পাবেন।
খাম তিনটা হাতে পেতেই জুলেখা বানুর চোখ দুটো চকচক করে উঠল। তিনি উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললেন—
অনেক অনেক ধন্যবাদ, বড় ভাইজান।
প্রণয় তার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলল—
ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই, এটা তোমার পারিশ্রমিক। তুমি আমার হয়ে কাজ করে যাও, এমন আরও পাবে। তবে, যদি কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করার চেষ্টা করো…
জুলেখা বানু আতকে উঠলেন। সঙ্গে সঙ্গে বিরোধিতা জানিয়ে বললেন—
ছি ছি! এ আপনি কী বললেন, বড় ভাইজান! আমি আপনার নুন খেয়েছি। আর এই জুলেখা কারও নুন খেয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করে না।
প্রণয় পুনরায় বাঁকা হেসে তার দিকে একটা মেডিসিনের বক্স এগিয়ে দিয়ে বলল—
শেষ হওয়ার ১০ দিন আগে জানাবেন।
জুলেখা বানু বক্সটা নিয়ে বললেন—
আচ্ছা ভাইজান।
প্রণয় তাকে আরও ৫০০ টাকা এক্সট্রা টিপস দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেল। জুলেখা বানুর জন্য আজ ঈদের দিন। প্রতি মাসের এক তারিখে তিনি পুরো লাল হয়ে যান—এক মাসের অতিরিক্ত রোজগার তার পুরো বছরের বেতনের চেয়ে বেশি।
প্রণয় নিজের ল্যাপটপ নিয়ে কাউচের ওপর বসল। বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে ল্যাপটপ ওপেন করল। তার বুকে অস্বাভাবিক কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে। সে কানাডার স্বনামধন্য BCIT College-এর ওয়েবসাইট ওপেন করল, যেখানে পরিষ্কারভাবে লেখা আছে—
“Administration form fill-up”-এর মাত্র দুই দিন বাকি।
প্রণয়ের হার্ট অনেক স্পিডে বিট করছে। হাত কাঁপছে তার। সে কাঁপা হাতে ফর্ম ফিলাপ করতে লাগল। সাবজেক্ট, স্ট্রিম সব সিলেক্ট করে মার্কশিটের একটা কপি সাবমিট করে দিল। সঙ্গে অ্যাডমিশন ফিও ক্লিয়ার করে দিল। সব কনফার্ম করে ‘Done’-এ ক্লিক করতে প্রণয়ের নিঃশ্বাস আটকে আসছে। বুকের ভেতর থাকা প্রাণটা ছটফট করতে শুরু করেছে।
মন করুন সুরে মিনতি করে বলল—
এটা কিন্তু তোর নিজের মৃত্যুর প্রথম পদক্ষেপ। এখনো সময় আছে, এমন করিস না!
তাকে না দেখে তুই একটা দিনও থাকতে পারবি না। বাঁচতে পারবি না, মরে যাবি। শেষ হয়ে যাবি।
মস্তিষ্ক মনের বিরোধিতা করে বলল—
যা করছিস তাই কর। ওর কথা শুনবি না। ও তোকে স্বার্থপর বানিয়ে দিচ্ছে। ও চায় না তোর রক্তজবা ভালো থাকুক। ও তাকে কাঁদতে দেখলে খুশি হয়।
এটাই ঠিক ডিসিশন।
প্রণয়ের বুকের বাম পাশটা তীব্র ব্যথায় অবশ হয়ে আসছে। হল হল করে মরণ যন্ত্রণার বিষ ছড়িয়ে পড়ছে হৃদপিণ্ডে। সে মনের কথা শুনল না। কাঁপা হাতে ফর্মটা সাবমিট করে দিল।
আর সে একদম ১০০% নিশ্চিত—
ফর্মটা একসেপ্ট হবেই হবে।
প্রণয় ল্যাপটপ অফ করে কাউচে মাথা এলিয়ে দিল। বন্ধ চোখের কার্নিশ বেয়ে গড়াতে লাগল তরল স্রোত। কলিজা পুড়ছে। সে এখনই সহ্য করতে পারছে না। তবে সেদিন তো সে মরেই যাবে।
কিন্তু এখন এসব ভাবলে চলবে না—
সে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এই সিদ্ধান্ত থেকে সে আর পিছু হটবে না।
নেক্সট ১০ দিনের মধ্যেই কলেজের First Merit List পাবলিশ হবে। আর প্রণয় নিশ্চিত—
সেখানে তার রক্তজবার নাম থাকবেই থাকবে।
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৩৬
সে ফোন বের করে প্রিয়তার একটা ছবি ওপেন করল। চেহারার প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে অপরিসীম মায়া।
প্রণয় ঝাপসা চোখে কিছুক্ষণ ছবিটার দিকে চেয়ে রইল।
হঠাৎ তার নজর পড়ল আজকের তারিখের দিকে।
সাথে সাথেই প্রণয় হকচকিয়ে গেল।
বসে থাকা থেকে একপ্রকার লাফিয়ে উঠল। ঘড়ির কাটায় এখন প্রায় রাত ১টা।
সে দ্রুত দরজা খুলে ছুটল প্রিয়তার ঘরের দিকে…