ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৩

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৩
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

তৃপ্তি বেগম রাগে গজগজ করতে করতে রান্না করছেন। উনার স্বামীর এক বায়না, তো মেয়ের একশো বায়না—উনি পুরো ফেঁসে গেছেন। তিনি তরকারিতে লবণ দিতে দিতে বললেন—
— এই বাপ-বেটি মিলে আমার গোটা জীবনটাই মসলা পি‌ষার মতন পিষে দিল! বাপ যেমন-তেমন, মেয়েটা তো কোন কথাই শুনতে চায় না। আর মেয়ের নামে কিছু বললে উনার স্বামী কিছু কানে তুলেন না, ছেহ!
উনার ভাবনার মাঝেই ফ্ল্যাটের কলিং বেল বেজে উঠলো। তিনি গ্যাস বন্ধ করে থুয়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলেন।
দরজার বাইরে প্রিয়স্মিতা সারা শরীরে কাদামাটি মেখে দাঁড়িয়ে আছে। সে মাকে দেখেও না দেখার ভান করে চুপচাপ গিয়ে ড্রয়িং রুমে সোফায় সটান হয়ে শুয়ে পড়লো।
মেয়েকে এমন অবস্থায় দেখে তৃপ্তি বেগম চিৎকার চিৎকার দিয়ে উঠলেন—

— এই প্রিয়! উঠ ওখান থেকে! সারা শরীরের কি অবস্থা! একটু আগেই সোফাটা ঝেরে ঝুরে পরিষ্কার করে রেখেছি, আর তুই এই নোংরা শরীরে শুয়ে নষ্ট করে দিলি! এগুলো পরিষ্কার করতে কি আমার কষ্ট হয় না? উঠ বলছি! তোর বাপ তো আমায় বিনা পয়সায় চাকরানি এনেছে!
প্রিয়স্মিতা বিরক্ত চোখে তাকালো আম্মুর দিকে। বাসায় আসতে না আসতেই ঘ্যানঘ্যান শুরু হয়ে গেছে।
তৃপ্তি বেগম মেয়েকে বকতে বকতে ঠান্ডা পানির গ্লাস নিয়ে এগিয়ে এলেন মেয়ের কাছে। সামনে যেতেই মেয়ের হাত গড়িয়ে রক্ত পড়তে দেখে হায় হায় করে উঠলেন—
পানির গ্লাস রেখে ছুটে গিয়ে ফার্স্ট-এইড বক্স নিয়ে আসলেন। তুলোতে সেভলন লাগিয়ে মেয়ের হাত পরিষ্কার করতে করতে আরো উচ্চ শব্দে বকাঝকা শুরু করলেন—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— এত বড় দাড়ি মেয়ে ,না জানি কোথায় না কোথায় মারপিট করে আসে! মেয়ে মানুষ হবে নরম-শরম, সে আবার ব্যাটা ছেলেদের মত মারপিট করবে কেন? আমার হয়েছে যত জ্বালা! বাপ তার মেয়েকে আদর দিয়ে দিয়ে মাথায় তুলে ফেলেছে! এই গেছো মেয়েকে কে বিয়ে করে আমি ও দেখবো!
প্রিয়স্মিতা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে কান চেপে ধরলো। ঝড়ের গতিতে বসা থেকে উঠে নিজের ঘরের দিকে দৌড় দিল।
তৃপ্তি বেগম চিৎকার করে বললেন—
— হ্যাঁ, আমার কথা তো তোমাদের বাবা-মেয়ে ভালো লাগে না। যেদিন মরে যাবো, সেদিন বুঝবে!
স্ত্রীর কান ফাটানো চিৎকার আর ঘরে বসে থাকতে পারলেন না সাজিদ শিকদার। ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সোফায় বসলেন। নিজের রাগান্বিত স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে নরম কণ্ঠে বললেন—

— আমার সুন্দরী বউটা এত রেগে আছে কেন? আমার লক্ষী মেয়েটা আবার কি করলো?
তৃপ্তি বেগম অগ্নি চোখে তাকালেন স্বামীর অসহায় মুখের দিকে। খেঁক করে উঠে বললেন—
— আপনার আস্কারা পেয়ে আপনার মেয়েটা উশৃঙ্খল হচ্ছে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও মারপিট করে হাত-মুখ ফাটিয়ে আসে!
সাজিদ শিকদার মৃদু হাসলেন। স্ত্রীর কোমর জড়িয়ে ধরে বললেন—
— শান্ত হও, ও আমার মেয়ে। অনেক স্ট্রং, ওর কিছু হবে না।
তৃপ্তি বেগম ঝাড়া মেরে বললেন—
— ছাড়ুন বলছি, আমার কথা তো আপনাদের পছন্দ হয় না।
সাজিদ শিকদার উঠে দাঁড়ালেন। স্ত্রীকে কোলে নিয়ে আরো নরম কণ্ঠে বললেন—

— আমার বউটা বোধহয় একটু বেশি রাগ করেছে। ঘরে চলো বউ, ফু দিয়ে তোমার সব রাগ উড়িয়ে দিচ্ছি।
চুপ হয়ে গেলেন তৃপ্তি বেগম। মুহূর্তেই তাঁর রাগ গলে পানি পানি হয়ে গেলো।
বউ বসে চলে এসেছে দেখে সাজিদ শিকদার আবার বললেন—
— এই আমার বউটা লজ্জা পেলে তাকে কত সুন্দর লাগে, সে কি জানে?
তৃপ্তি বেগম লজ্জা মিশ্রিত হেসে স্বামীর বুকে ধাক্কা দিয়ে বললেন—
— বুড়ো বয়সে ভীমরতি!
সাজিদ শিকদার বউকে কোলে দিয়ে ঘরের দিকে হাঁটতে হাঁটতে বললেন—
— তুমি আমাকে বুড়ো বললে? তৃপ্তি, চলো তাহলে আজ তোমাকে প্রমাণটা দিয়েই দেই—এই সাজিদ শিকদার বুড়ো না, যুবক।
তৃপ্তি বেগম স্বামীর বুকে কিল মারতে মারতে বললেন—

— ছাড়ুন! মেয়ে বাসায় আছে, দেখে ফেলবে।
সাজিদ শিকদার দরজা বন্ধ করতে করতে বললেন—
— কিছুই দেখবে না।
প্রিয়স্মিতা ঘরের দরজা বন্ধ করে ব্যাগ-ট্যাগ ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে গিয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়লো।
তার ঠোঁট থেকে আজ মুচকি হাসি সরছেই না। অকারণেই লজ্জা লাগছে,
ভিতরের অস্থিরতা চক্রবৃদ্ধি হারে সেকেন্ড সেকেন্ডে বেড়ে চলেছে।
বুকটা হাফরের মতো ওঠানামা করছে।
প্রিয়স্মিতা লজ্জায় বালিশে মুখ গুঁজে দিলো।
আসলে প্রিয়স্মিতার চরিত্রের সাথে লজ্জা জিনিসটা খুবই বেমানান।

কিন্তু আজ, তার এত বছরের জীবনকালে প্রথমবার ভীষণ রকম লজ্জা লাগছে।
সে সেই ধূসর চোখের পুরুষের কথা মন-মস্তিষ্ক থেকে সরছেই না, চেহারাটা যেন জ্বলন্ত ভাসছে চোখের সামনে।
ওই পুরুষের মাঝে কী এমন ছিল, যা এক দেখাতেই প্রিয়স্মিতার মন-প্রাণ নিয়ে নিলো?
এখন প্রিয়স্মিতার অদ্ভুত অদ্ভুত সব ফিলিংস হচ্ছে।
প্রিয়স্মিতা উঠে গুল হয়ে বসলো। ঠোঁটে এখনো লেপ্টে আছে সেই মুচকি হাসি।
সেই অজানা পুরুষের কথা ভাবতে ভাবতেই হারিয়ে গেলো সে। মন গহীন থেকে সুরেলা কণ্ঠে কেউ গেয়ে উঠলো দেবের সেই বিখ্যাত গানের কয়েকটি লাইন—

“প্রেম কি বুঝিনি আগে তো
খুঁজি নি আজ কি হলো রে আমার
তুই তো ছিলি বেশ, লুকিয়ে বিদেশ
কাজ ছিল না পালাবার
তুই ছাড়া না এমন বাঁচে
তুই ছাড়া বল কে আর আছে
আয় চলে আয়, আমার কাছে আয়…”
প্রিয়স্মিতার মন সেই পুরুষকে আরেকটিবার দেখার জন্য ছটফট করে উঠলো, উতলা হলো চিত্ত।
চটপট বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লো প্রিয়স্মিতা। সে ঘরে বসে ছটফট করার মেয়ে নয়। দেখতে মন চাইছে এখনই, মানে এখনই দেখতে হবে।
প্রিয়স্মিতা বিছানা থেকে নেমে পায়চারি করতে করতে চোখ বন্ধ করে মনে করতে লাগলো সেই সময়ের সব কথা।
বাঁকা হেসে বললো—

“হে মিস্টার, তুমি কি ভাবছো, তোমাকে আমি খুঁজে পাবো না? তুমি এই মেহেরিমা শিকদার প্রিয়স্মিতার নজরে পড়েছ! তুমি কে? তোমার পরিচয় কী? এসব!”
এসব জানা মেহেরিমা শিকদার প্রিয়স্মিতার জন্য পান্তা ভাত।
“এবার তুমি শেষ। এবার তোমার জীবনের সব সুখ-শান্তি টা টা বাই বাই বলে চলে যাবে!
তার রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে আমি এন্ট্রি নেব—এই মেহেরিমা শিকদার প্রিয়স্মিতা !”
প্রিয়স্মিতা হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো। তখন লোকটার অ্যাপ্রোনের ওপর কিছু একটা নাম দেখেছিল—
কী যেন ছিল নামটা?
প্রিয়স্মিতা চোখ বন্ধ করে ব্রেইনে একটু চাপ দিতেই মনে পড়ে গেলো।
সঙ্গে সঙ্গে তার ঠোঁটে খেলে গেলো বাঁকা হাসি।
সে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে গুগল ওপেন করতে করতে মনে মনে বললো—
“ডাক্তার, যেহেতু… সেহেতু, তোমার সকল ইনফরমেশন ইজি‌লি গুগল আঙ্কেল থেকে পেয়ে যাবো!”
প্রিয়স্মিতা গুগল ওপেন করে সার্চ বারে লিখলো—

“Hello Google, Who is Doctor Aboddho Chowdhury Shuddho?”
Google:
Search Results:
Name: Dr. Aboddho Chowdhury Shuddho
Date of Birth: March 19, 1996
Nationality: Bangladeshi (by birth), Canadian Citizen
Current Location: Dhaka, Bangladesh
Profession: Cardiothoracic Surgeon (Heart Specialist)
Reputation: Ranked among the Top 10 Most Popular & Handsome Heart Surgeons in Canada
Medical Degree: M.B.B.S. from University of Toronto, Faculty of Medicine
Graduation Year: 2018
Postgraduate Training: Royal Victoria Hospital, Montreal
Awards: Canadian Medical Excellence Award (2021), Young Global Surgeon Recognition (2022)
Relationship Status: Unmarried
Social Media Presence: Over 1.5M followers on Instagram
Public Image:
Height: 6 feet 1 inch
Complexion: Extremely fair
Eyes: Smoky grey (ধূসর)
Facial Hair: Light stubble (হালকা দাড়ি)
Face: Sharp jawline, deep-set eyes
Appearance: Widely regarded as exceptionally handsome; his presence often compared to that of a movie star
Signature Look: Crisp white coat, minimal smile, intense gaze

(সার্চ ফলাফল:
নাম: ড. আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ
জন্মতারিখ: ১৯ মার্চ, ১৯৯৬
জাতীয়তা: জন্মসূত্রে বাংলাদেশি, কানাডিয়ান নাগরিক
বর্তমান অবস্থান: ঢাকা, বাংলাদেশ
পেশা: কার্ডিওথোরাসিক সার্জন (হৃদরোগের বিশেষজ্ঞ)
খ্যাতি: কানাডার সেরা ১০ জন জনপ্রিয় ও সুদর্শন হৃদরোগ বিশেষজ্ঞের মধ্যে অন্যতম
চিকিৎসা ডিগ্রি: এম.বি.বি.এস – ইউনিভার্সিটি অফ টরোন্টো, ফ্যাকাল্টি অফ মেডিসিন
স্নাতক সম্পন্ন: ২০১৮ সালে
পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ট্রেনিং: রয়্যাল ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল, মন্ট্রিয়াল
পুরস্কার: কানাডিয়ান মেডিকেল এক্সেলেন্স অ্যাওয়ার্ড (২০২১), ইয়াং গ্লোবাল সার্জন রিকগনিশন (২০২২)
সম্পর্ক অবস্থা: অবিবাহিত
সামাজিক উপস্থিতি: ইনস্টাগ্রামে ১৫ লাখের বেশি অনুসারী, চিকিৎসা সচেতনতা ও সমাজসেবায় জনপ্রিয়)
ব্যক্তিত্ব ও বাহ্যিক চেহারা:
উচ্চতা: ৬ ফুট ১ ইঞ্চি
গায়ের রং: একেবারে ফর্সা
চোখ: ধূসর (স্মোকি গ্রে)
দাড়ি: হালকা চাপ দাড়ি
মুখাবয়ব: তীক্ষ্ণ চোয়াল, গভীর চোখ
চেহারা: অতিমাত্রায় সুদর্শন; অনেকেই বলেন, তার উপস্থিতি যেন সিনেমার নায়কদের মতো
স্বাক্ষর লুক: ধবধবে সাদা কোট, অল্প হাসি, কিন্তু চোখে ভয়ঙ্কর দৃঢ়তা
গুগলে যা এলো, তা দেখে প্রিয়স্মিতার মাথা ঘুরে গেলো।
মুখ হা হয়ে গেল, মুখ থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে এলো—

“ওরে শালা!”
প্রিয়স্মিতা বিছানায় ধপ করে বসে পড়লো।
ভুরু কুঁচকে বললো—
“এই জন্যই বেটার এতো তেজ!”
“ওকে, Never mind! তুমি যতই তেজি হও, সেই তো বিয়ের পর আমার কথায় উঠতে বসতে হবে!”
প্রিয়স্মিতা আর কিছু না ভেবে ঝটপট কল লাগালো জারার নম্বরে।
একবার রিং হতেই রিসিভ হয়ে গেলো।
জারা ওপাশ থেকে ঝাড়ি দিয়ে বললো—
“এই, তুই কিছু না বলে চলে গেলি কেন?”
কিন্তু প্রিয়স্মিতা জারার প্রশ্ন সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে ব্যস্ত কণ্ঠে বললো—
“আমাদের কলেজে এক দল ডাক্তার এসেছে, রাইট?”
ডাক্তারের কথা শুনে ভুরু কুঁচকালো জারা।
ছোট করে বললো—

“হুঁ।”
প্রিয়স্মিতার ঠোঁটে হাসি প্রশস্ত হলো। এবার সে কোনও ভনিতা ছাড়াই বললো—
“ওই যে ডাক্তারটা, যার সাথে ধাক্কা খেয়েছিলাম… মানে তোদের দুলাভাই—সেও কি ওখানে আছে?”
প্রিয়স্মিতার কথায় বেক্কেল বনে গেলো জারা।
কিছু বুঝতে না পেরে বললো—
“এ্যাহ—!”
প্রিয়স্মিতা বিরক্ত হলো। তেতো কণ্ঠে বললো—
“শালী, তোর নাটক পরে করবি! তোর নাটক দেখার সময় নেই, আমার হার্ট লাফাচ্ছে!
তুই কোথায় আছিস, বল! আমি এক্ষুনি আসছি!”
জারা ঢোক গিলে বললো—
“বাসায়!”
প্রিয়স্মিতা ব্যস্ত কণ্ঠে বললো—

“Just ১০ মিনিটের মধ্যে কলেজ পার্কের সামনে সব শালীদের দেখতে চাই!”
বলে কট করে ফোন কেটে দিলো।
ফোন কাটতেই প্রিয়স্মিতার ঠোঁটে ফুটে উঠল এক অদ্ভুত হাসি।
এটা রহস্যময় হাসি? বাঁকা হাসি? নাকি লাজুক হাসি?—ভীষণ কনফিউজিং!
প্রিয়স্মিতার এক একটা কথা বোধহয় জরার কানে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটালো।
সে কান থেকে ফোন নামিয়ে নিজের কানে কয়েকটা বাড়ি দিলো।
নিজের উপর সন্দেহ করে বললো—
“আমি ঠিক শুনলাম তো?”
মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো জরার।
কিছুক্ষণ সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।
পুরো ঘটনা বুঝতে মুখ থেকে আপনা-আপনি বেরিয়ে আসলো—
“ইন্নালিল্লাহ…”

উষা, অনুশ্রী বেগম, তনুশ্রী বেগম ও অনন্যা বেগম বসে সবাই মিলে মশকাবারি লিস্ট বানাচ্ছেন।
কারণ, দুদিন পরই পহেলা রমজান।
রমজানের আগেই প্রতিবছরের মতো এবারও শিকদার বাড়ির গিন্নিরা রুটি-শিন্নির আয়োজন করবেন।
যদিও আরও আগে হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু নানা কারণে হয়ে ওঠেনি।
আর কাল যদি না দেওয়া যায়, তাহলে এ বছর আর হবে না।
তাই শিন্নির জন্য যা যা লাগবে, লিস্ট তৈরি করছেন।
অনুশ্রী বেগম উষার উদ্দেশে বললেন—
“আম্মু, তোমার বিয়ের পর এটা প্রথম রমজান। তাই প্রথম রোজায় তোমার মামা-শ্বশুররা তাঁদের স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ভাগ্নে-বউ দেখতে আসবেন।
আর জানো তো, এই বাড়ির সবার মামাবাড়ি একটাই!”
ঊষা একটু অবাক হয়ে বললো,
“এই বাড়ির ভাইয়া-আপু তো অনেক, সবার মামাবাড়ি এক হয় কীভাবে, আম্মু? আপনারা চার জন তো আলাদা আলাদা।”
তনুশ্রী বেগম হেসে বললেন,

“বোকা মেয়ে, আমরা চার জন আপন মায়ের পেটের চার বোন।”
ঊষা অবাক হল।
অনন্যা বেগম বললেন,
“এই যে তোমার শাশুড়ি, উনি আমাদের বড় আপা। তাই আমরা তোমার চাচি-শাশুড়ির পাশাপাশি খালা-শাশুড়িও।”
চোখ বড় বড় করে ফেললো ঊষা।
অর্থি বেগম বললেন,
“তাই সবার মামাবাড়ি একটাই, আর প্রথম রোজায় সবাই মিলে তোমাকে দেখতে আসবে।”
ঊষার সব সম্পর্ক তালগোল পাকিয়ে গেল। সে না বুঝেই মাথা নেড়ে বললো,
“আচ্ছা, সেজ আম্মু।”
অনুশ্রী বেগম হেসে উঠলেন। মেয়েটাকে তিনি অনেক পছন্দ করছেন—

কিছু বুঝুক আর না বুঝুক, কখনো কথার অবাধ্য হয় না,
এমনকি মেয়েটা আজকালকার ইচড়ে পাকামি করা মেয়েদের মতো নয়।
সবকিছুতেই প্রশ্ন করে না, শান্ত, শিষ্ট, নম্র, ভদ্র—একদম নরম কাদামাটি, যাকে নিজের ইচ্ছেমতো গড়ে নেওয়া যায়।
তিনি আল্লাহর কাছে সব সময় দোয়া করেন, যেন তাঁর বাকি ছেলেদের বউগুলোরও এমন হয়।
সবার আগমনে যেন এই সংসারটা সুখে-শান্তিতে ভরে ওঠে, কারো আগমনে যেন ভাঙন না ধরে।
উনার ভাবনার মাঝেই থিরা ছুটে এল।
ঊষার হাত ধরে বললো,
“ভাভি, তাড়াতাড়ি চলো, ছোড়দা তোমায় ডাকছেন।”
স্বামীর কাণ্ডে ঊষা শাশুড়িদের সামনে লজ্জা পেল।
থিরা আবার তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বললো, “তাড়াতাড়ি চলো ভাভি, ছোড়দা বলেছেন, অনেক গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে।”
ঊষা একটু লাজুক ভঙ্গিতে শাশুড়িদের দিকে তাকালো।
উনারা মিটিমিটিয়ে হাসছেন।
অনুশ্রী বেগম বললেন, “যাও আম্মু, গিয়ে দেখো আমার ছেলেটা কী বলে।”
ঊষা বুকা হেসে থিরার পেছনে নিলো।
প্রেম ড্রয়িংরুমে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে ডাকছে, “পরী! প্রিয়! কোথায় দুজন?…”
আরো কয়েকটা ডাক দিতেই পরী ছুটে এলো।
প্রিয়তা ও এলো।
পরিনিতা বললো,
“ডাকছো কেন ছোড়দা?”
প্রিয়তা কৌতূহলী চোখে তাকালো প্রেমের দিকে।
প্রেম বোনেদের দিকে তাকিয়ে বললো,

“তোমাদের ভাবিকে নিয়ে একটু শপিংয়ে যাও। ওর যা যা লাগে, নিয়ে আসো। আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ পড়ে গেছে, না হলে আমি যেতাম।”
পরিনিতা মিটিমিটিয়ে হাসলো। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে বলল,
“উহু, এমনি এমনি তো যাব না।”
প্রেম ভুরু কুঁচকে বললো,
“কত টাকা লাগবে?”
প্রিয়তা কষ্ট পাওয়ার অভিনয় করে বললো,
“ছি ছোড়দা! আমাদের কি তোমার এমন মনে হয়? তোমার টাকা দিয়ে কি করব আমরা! যদি ভাবির সাথে যাই, তাহলে বেশি কিছু না, ভাবির পাশাপাশি আমরাও শপিংটা সেরে আসবো।”
থিরাও যোগ দিয়ে বললো,
“আপু, তোমরা শপিংয়ে যাবে? তাহলে আমি-ও যাব।”
ঊষা হাঁ করে ভাই-বোনদের দিকে তাকিয়ে আছে।

প্রেম বোনদের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো। ওয়ালেট থেকে কার্ড বের করে ঊষার হাতে দিয়ে বললো,
“এটা থেকে যা যা লাগবে, সব কিনে নিও। আর এই বাঁদরগুলো যা কিনতে চায়, তাও কিনে দিও।”
প্রিয়তা ও পরিনিতা দুষ্টু হেসে একে অপরের দিকে চাইলো।
পরিনিতা প্রিয়তাকে এক চোখ টিপ দিয়ে বললো, “বাহ বাহ! বিয়ে হতে পারলো না, ভাই আমার পর হয়ে গেল! তার কাছে বউ, আপন বোন পর! এইজন্যই ননদরা ভাবিদের দেখতে পারে না!”
ঊষা চোখ বড় বড় করে চাইলো পরিনিতার দিকে।
প্রেম ভুরু কুঁচকে বোনের কান টেনে ধরে বললো, “খুব পেকে গেছিস!”
পরিনিতা চিৎকার দিয়ে বললো,

“আহ্ ছোড়দা! লাগছে! আমি তো মজা করছিলাম। তোমার বউয়ের মতো বউ আরও চারটা হোক!”
পরিনিতাকে লাফাতে দেখে প্রিয়তা আর থিরা ফিক করে হেসে দিলো।
ঊষা প্রেমের হাত ধরে বললো,
“আপুর লাগছে তো, ছেড়ে দিন।”
প্রেম ঊষার দিকে তাকিয়ে ছেড়ে দিলো।
পরিনিতা কান ডলতে ডলতে পা টিপে টিপে প্রিয়তার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
ফিসফিস করে বললো,
“তোর কী মনে হয়, আমার ভাই কি প্রেমে পড়েছে?”
প্রিয়তা কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো,
“আমি কী জানি! আমি তো প্রেম বিশেষজ্ঞ নই।”
থিরা তাদের কথার মাঝে হাত ঢুকিয়ে বললো, “প্রেমে পড়েনি আপু, তবে প্রেমে পড়বে, পড়বে ভাব।”
পরিনিতাও সম্মতি জানিয়ে বললো,

“ঠিক বলেছিস।”
সাথে সাথেই প্রিয়তা ওর কান চেপে ধরে বললো, “তুইও খুব পেকে গেছিস!”
থিরা লাফিয়ে বললো,
“আহ্ আপু! আমি তো বড় হচ্ছি!”
প্রেম তাড়া দিয়ে বললো,
“বাদরামো না করে তাড়াতাড়ি যা। বিকেলের আগেই ফিরে আসবি।”
বলে উপরে চলে গেল।
পরিনিতা ঊষাকে পিন্চ মেরে বললো,
“আহা ভাবি! জামাই তো আঁচলে বেঁধে ফেলেছেন, মাত্র দুই দিনেই কাবু করে ফেললেন!”
ঊষা লজ্জায় মাথা নিচু করে নিলো।
প্রিয়তা বললো,

“চলো, রেডি হয়ে আসি।”
পরিনিতাও সম্মতি জানিয়ে বললো, “ভাবি, তুমি ও চলো।”
ওরা চলে গেলো রেডি হতে।
পাঁচ মিনিটের মধ্যে সবাই রেডি হয়ে নিচে চলে এলো।
অনুশ্রী বেগম এগিয়ে এসে বললেন—
“কোথায় যাচ্ছো সবাই এত সেজে গুজে?”
প্রিয়তা নম্র কণ্ঠে উত্তর দিল—
“ছোটো ভাবিকে নিয়ে শপিংয়ে যাচ্ছি, বড়ো আম্মু। এই বাড়িতে আসার পর ছোটো ভাবির জন্য কেনাকাটা করা হয়নি।”
প্রিয়তার কথায় অনুশ্রীর খেয়াল হলো—আজ সকালে ঊষা তাঁর কাছ থেকে শাড়ি নিয়ে পরেছে।
তিনি ঊষার দিকে তাকিয়ে বললেন—
“তোমার বাসায় পরার জামাকাপড় নেই, আমায় আগে বলোনি কেন, আম্মু?”
ঊষা নিচু গলায় বলল—
তিনি আবার বললেন—

“এত জন মিলে যাচ্ছো, বাড়ির কাউকে সাথে নিয়ে যাও।”
পরিনিতা হাই তুলে বলল—
“যেতে তো চাই, কিন্তু তোমার ছেলেরা কি রাজি হবে?”
তাদের কথার মাঝেই তন্ময় সেজে-গুজে চলে এলো।
প্রিয়তা ভ্রু নাচিয়ে বলল—
“তুই কোথায় যাবি, মোটু?”
তন্ময় আপুকে দুই পয়সারও পাত্তা দিল না, সোজা গিয়ে ঊষার শাড়ির আঁচল টেনে ধরে বলল—
“কোলে নাও, ভাবি।”
ঊষা হেসে তাকে কোলে নিলো।
তন্ময় সঙ্গে সঙ্গেই ছোটো ভাবির গালে হামি খেলো।
কিউট ফেস করে স্যুইট কণ্ঠে বলল—
“আমি ও তোমাদের সাথে যাই, ভাবি প্লিজ। আমার আপুদের বললে ওরা রাজি হবে, তাই তুমি নিয়ে চলো, প্লিজ ভাবি, প্লিজ।”
ঊষার কাছে তন্ময় ভীষণ কিউট লাগে!

সে তন্ময়ের সামনে পড়া চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বলল—
“কেন যাবে না ভাইয়া, নিশ্চয়ই যাবে।”
সঙ্গে সঙ্গেই থিরা বাধা দিয়ে বলল—
“একদম না ভাবি! ও যা মিছকে, আমাদের সাথে গেলে শান্তিতে শপিং করতে দেবে না। ওকে কোলে নিয়ে বসে থাকতে হবে।”
ঊষা তাকালো তন্ময়ের দিকে।
তন্ময় ইনোসেন্ট মুখ করে তাকিয়ে আছে।
অনুশ্রী বেগম থিরাকে ধমকে বললেন—
“কি হয়, ছোটো ভাইকে সাথে নিলেই! দিন দিন মেয়েগুলো হিংসুটে হয়ে যাচ্ছে। ছোটো ভাইকে সাথে নিয়ে যাও।”
মুখ ছোটো করে ফেলল থিরা।
পরিনিতা বলল—
“তাহলে যাই, আম্মু।”

অনুশ্রী বেগম মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন—
“এতগুলো যুবতী মেয়ে, শুধু ড্রাইভারের ভরসায় তো আমি ছাড়তে পারি না।”
উনার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রণয় ফর্মাল শার্ট-প্যান্ট পরে, একদম ফর্মাল লুকে নিচে নামলো।
দেখে মনে হচ্ছে, অফিসে যাবে।
অনুশ্রী বেগম ছেলেকে ডাকলেন—
“বড়ো আব্বু!”
প্রণয় জাভেদের সাথে ইম্পর্ট্যান্ট কিছু নিয়ে কথা বলছিলো।
আম্মুর ডাক শুনে কানে থেকে ফোনটা নামালো।
অনুশ্রী বেগম আবারও ডাকলেন—
“এদিকে আসো, আব্বু।”
প্রণয় ফোন কেটে পকেটে ঢুকিয়ে আম্মুর দিকে এগিয়ে গেলো।
অনুশ্রী বেগম ছেলেকে দেখে প্রশস্ত হাসলেন।
মাথায় হাত বুলিয়ে নরম কণ্ঠে বললেন—
“শহরের দিকে যাচ্ছো, আব্বু?”
প্রণয় ছোট করে জবাব দিল—

“হুঁ।”
অনুশ্রী বেগম মেয়েদের দেখিয়ে বললেন—
“শহরের দিকে যেহেতু যাচ্ছো, তাহলে তোমার ভাই-বোনদের নিয়ে যাও। এতগুলো মেয়েকে একা এত দূর কীভাবে পাঠাবো?”
প্রণয় একবার তাকালো সবার দিকে, কিছুক্ষণ ভেবে গম্ভীর কণ্ঠে বলল—
“গাড়িতে গিয়ে বস, আসছি।”
বলে ফোন নিয়ে বেরিয়ে গেলো। প্রণয় যতক্ষণ ছিলো, প্রিয়তা ততক্ষণ হা করে তাকিয়ে ছিলো, না প্রণয়ের দিকে তাকায় নি, তাকিয়ে ছিল প্রণয়ের গলার চমৎকার অ্যাডাম’স অ্যাপলটার দিকে।
হোয়াইট ফর্মাল শার্ট-প্যান্টে তো অলওয়েজ কিলার লাগে, তাই ওটা বাদ! এগুলোর সবকিছু ঊর্ধ্বে সবথেকে বেশি অ্যাট্রাকটিভ লাগে কথা বলার সময় নড়তে থাকা সেই প্রাণঘাতী জিনিসটা—ওটাকে নড়তে দেখলেই প্রিয়তার নিশ্বাস আটকে যায়।
ওরা সবাই চলে গেলো। শুধু হা করে দাঁড়িয়ে রইলো প্রিয়তা।
ঊষা প্রিয়তাকে হা করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মৃদু ধাক্কা দিয়ে ডাকলো,

— “প্রিয় আপু।”
ঊষার ডাকে হকচকিয়ে গেলো প্রিয়তা। চোখ মেলে তাকালো ঊষার দিকে।
প্রিয়তাকে চমকে দেখল সবাই চলে গেছে। ঊষা অবাক কণ্ঠে বলল,
— “কি ভাবছিলে আপু? চলো, সবাই চলে গেছে।”
প্রিয়তা হেসে কথা কাটিয়ে বলল,
— “ওহ, চলো।”
বাইরে এসে সবাই আগে আগেই গিয়ে ব্যাকসিটে বসে পড়লো।
প্রণয় আসলো প্রায় ১০ মিনিট পর। সে ড্রাইভিং সিটে বসে সবাইকে ব্যাকসিটে দেখে কিছুটা রুষ্ট হল, কিছুটা ধমকে বলল,

— “আমাকে কি তোদের ড্রাইভার মনে হয় যে সবাই মিলে পেছনে গিয়ে বসলি?”
বড়ো দাদার ধমক খেয়ে একযোগে কেঁপে উঠলো সবাই।
সাধারণত বড়ো দাদা এত কথা বলেন না, ধমকানও না। তাই তারা বড়ো দাদাকে জমের মতো ভয় করে।
পরিনীতা প্রিয়তাকে চিমটি দিয়ে বলল,
— “দেখচিস, কি তারাতারি সামনে যা!”
প্রিয়তা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
— “আমি কেন?”
থিরা ওর কানে কানে বলল,

— “আরে আপু, বুঝো না! আমরা যদি গিয়ে বড়ো দাদার পাশে বসি, তো এখন শপিং মলে নয়, হসপিটালে যেতে হবে! কারণ বড়ো দাদার সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতেই আমাদের হাঁটু কাঁপে, আর পাশে বসে এতটা রাস্তা যেতে গেলে নিশ্চিত হার্ট অ্যাটাক করবো।”
প্রিয়তা সবার ভয়ভীত মুখের দিকে একবার তাকালো।
এই প্রথমবার প্রিয়তার নিজেকে অনেক সাহসী মনে হচ্ছে। কারণ তারা যাকে জমের মতো ভয় পায়, সে তো শুধু তার পাশে বসে নি—আরও অনেক কিছু করে ফেলেছে! সেগুলো যদি এরা জানে তবে কি হার্ট অ্যাটাক করবে?
প্রিয়তা গাড়ি থেকে নেমে প্রণয়ের পাশে গিয়ে বসল। হাফ ছেড়ে বাঁচলো সবাই।
প্রণয় গাড়ি স্টার্ট দিলো। প্রিয়তা আড়চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে।
প্রণয়ের পাশে বসতে পেরে তারও অনেক ভালো লাগছে। কিন্তু প্রণয় কোনো দিকে তাকালো না, সোজা ড্রাইভ করতে লাগলো।

প্রিয়তা কিছুক্ষণ আড়চোখে তাকিয়ে এবার সোজা সরাসরি দেখতে লাগলো প্রণয়কে।
প্রণয়ের এক হাতে গাড়ি ড্রাইভ করার স্কিলটা—উফফ, এটাও কি মারাত্মক!
প্রিয়তা মনে মনে বলল,
— “এই পোলার রূপের আগুনে জলে পুড়ে পাগল হয়ে না জানি কবে আমায় পাবনায় যেতে হয়।”
প্রিয়তাকে একটানা নিজের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে চোখে হাসলো প্রণয়।
যা কেউ দেখলো না।
পার্কের সবুজ ঘাসের উপর শুয়ে হাঁফাচ্ছে দৃষ্টি, সৃষ্টি, জারা, নুহা, রুহি, স্নেহা। তাদের জিব বেরিয়ে গেছে ১০ হাত।
স্নেহা হাপাতে হাঁপাতে বললো,

“কোন না কোন শালার জন্য আমাদের জান যায় যায় অবস্থা।”
স্নেহার কথা শুনে রুহি ঝারি দিয়ে বললো,
“চুপ শালী! আমার ক্রাশের নামে একটা ও ওলটাপালটা কথা বলবি না?”
স্নেহা মুখ বাকিয়ে বললো,
“যা বলছিস গিলে নে। ঐ মালটা তোর আমার কারোরই হবে না। ওটার উপর প্রিয়স্মিতার নজর পড়েছে।”
জারা ওদের কথা শুনে আবার পড়লো, “ইন্নালিল্লাহ!”
দৃষ্টি শুয়ে শুয়ে জারাকে পা দিয়ে লাথি দিয়ে বললো,
“ওই শালী, তোর আবার কোন জামাই মরলো, ‘ইন্নালিল্লাহ’ পড়ছিস?”
জারা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো,
“তোরা ফাজলামি করছিস, তোদের কি হার্ট বলতে কিছু নেই? তোদের কি? ঐ ডাক্তারের জন্য একটু ও মায়া হচ্ছে না? বেচারা!”

সৃষ্টি ও কণ্ঠে দুঃখ মিশিয়ে বললো,
“আহ! বেচারার জন্য মায়া লাগে। কী মাসুম চেহারা!”
স্নেহা বললো, “
ভাই, আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না প্রিয় কারো প্রেমে উষ্টা খেয়েছে! হাউ ইজ ইট পসিবল?”
জারা গালে হাত দিয়ে বললো,
“আমি প্রথমবার শুনে ভেবেছিলাম আমার মাথা, হয়তোবা কান খারাপ হয়ে গেছে।”
নুহা বললো,
“ভাই রে ভাই, কলেজ থেকে ঐ বেটার হোটেলের ইনফরমেশন বের করতে গিয়ে আমার জুতা ছিড়ে গেছে।”
রুহি ‘হাই’ তুলে বললো,

“তোরা যাই বলিস আর তাই বলিস, আমি এখন পিওর নিশ্চিন্ত!”
স্নেহা কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“কেন কেন?”
রুহি আরেকটা হাই তুলে বললো,
“এই যে, ফাইনালি একটা বেটা পেয়েছি, যার মাথায় আমার কাটাল ভাঙবো।”
জারা ভ্রু কুঁচকে বললো
“মানে?
মানে, আমাদের বুঝা ঐ বেটার মাথাত চাপাবো, এই আর কি?”
চিতমাইরা শুইয়া কার গুষ্টির পিন্ডি চটকানো হচ্ছে।
প্রিয়স্মিতার কণ্ঠে, ওরা সবাই ধড়ফড়িয়ে শুয়া থেকে উঠে বসলো।

প্রিয়স্মিতা বুকে হাত গুঁজে, ভ্রু কুঁচকে ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। স্কিন টাইট লেডিস জিন্সের সাথে ক্রপ টপ, তার উপর চেক শার্ট হাঁটুর নিচ পর্যন্ত, চুলগুলো পনিটেল করে উঁচুতে তুলে খোপা করা, হাতে কালো পুতির ব্রেসলেট, মুখে কালো মাস্ক—পুরাই টমবয়!
ওরা সবাই ধড়ফড়িয়ে উঠে পড়লো।
রুহি রেগে বললো,
“ওই শালী! আমাদের জান কয়লা কয়লা করে, তুই গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিস?”
নুহা বললো,
“বইন, তোর স্ট্রবেরি ডাক্তারের ইনফরমেশন বের করতে গিয়ে আমার ২০০০ টাকার জুতা ছিড়ে গেছে।”
প্রিয়স্মিতা সবার দিকে তাকিয়ে বিরক্ত কণ্ঠে বললো,

“পেক পেকানি শেষ হলে, আমার স্ট্রবেরি ডাক্তারের অ্যাড্রেস বল।”
জারা বললো,
“বেশি কিছু জানতে পারি নাই, শুধু জেনেছি ‘সানশাইন হোটেল’।”
হোটেলের নাম শুনে প্রিয়স্মিতার চোখে খেলে গেলো ধূর্ত হাসি। সে পার্ক থেকে যেতে যেতে বললো,
“বাই বাই শালিরা।”
রুহি চিৎকার দিয়ে বললো,
“কাজের বেলা কাজী, আর কাজ ফুরালে পাজি! দাড়া শালী! আমরা ও যাবো।”
বলে ওরা ওর পিছু নিলো।
সানশাইন হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে ওরা।
নুহা বললো,

“রুম নাম্বার জানি না।”
প্রিয়স্মিতা বাঁকা হেসে বললো,
“এখনই জেনে নিচ্ছি।”
বলে হোটেলের ভিতরে চলে গেলো।
জারা ভয় ভয় করে বললো,
“না জানি ভিতরে আবার কুন গন্ডগোল, পাকিয়ে আসে।”
প্রিয়স্মিতা রিসেপশনে এসে রিসেপশনিস্টের উদ্দেশ্যে বললো,
“এক্সকিউজ মি, ডক্টর আবদ্ধ চৌধুরী সুদ্ধ হাউ ম্যানি নাম্বারস আর ইন দ্য রুম?”
রিসেপশনি‌স্ট প্রিয়স্মিতার দিকে তাকিয়ে বললেন, “হু আর ইউ টু হিম?”
প্রিয়স্মিতা একটু লজ্জা পাওয়ার অভিনয় করে বললো,
“আই অ্যাম হিজ গার্লফ্রেন্ড।”

রিসেপশনি‌স্ট হেসে বললেন,
“ওহ! হি ইজ ইন দ্য রুম নাম্বার ১০৩।”
প্রিয়স্মিতা হেসে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলো।
প্রিয়স্মিতাকে আসতে দেখে জারা দৌড়ে গিয়ে বললো,
“ভাই, তুই কোনো ঝামেলা করে আসিসনি তো? এখানে ঝামেলা করলে পুলিশ কেস হয়ে যাবে।”
প্রিয়স্মিতা বিরক্ত চোখে তাকালো জারার দিকে, ঝাড়ি দিয়ে বললো,
“চুপ শালী! তোর এত ডর আসে কোথা থেকে?”
জারা অসহায় চোখে তাকালো প্রিয়স্মিতার দিকে।
রুহি বললো,
“ওই শালী, কী শুনে এলি?”

প্রিয়স্মিতা বাঁকা হেসে হোটেলের পেছন দিকে যেতে যেতে বললো,
“তোরা দাড়া, আমি চুমু খেয়ে আসি।”
বলে চলে গেলো।
নুহা বললো,
“ওরে শালা! পানি চুমু পর্যন্ত চলে গেছে!”
সৃষ্টি বললো,
“ও হট ডাক্টরের চুমু খাবে আর আমরা কী এখানে দাঁড়িয়ে মশার চুমু খাবো? চল, সামনের ক্যাফেতে গিয়ে বসি।”
ওরা সকলে সম্মতি জানিয়ে ক্যাফেতে চলে গেলো।
প্রিয়স্মিতা হোটেলের নিচে দাঁড়িয়ে উপরের দিকে তাকালো, ভালোভাবে দেখে আইডিয়া করলো দুই তলার কর্নারের রুমটাই ২০৩।

সে মনে মনে বললো,
“আই অ্যাম কামিং টু ইওর হার্ট, মাই স্ট্রবেরি ডাক্টর!”
বলে আশপাশে তাকিয়ে ছেলেদের মতো পাইপ ধরে ঝুলে পড়ল, জুতা নিচে ফেলে সাবধানে পাইপ বেয়ে উপরে উঠতে শুরু করলো।
ও চার মিনিটের মধ্যে উঠে গেলো। পাইপ ধরে ঝুলে পা রাখলো রুমের বেলকনিতে।
এত লাফঝাঁপ করায় বুকে হাত ধরে গেছে।
সে কয়েক সেকেন্ড বড় নিঃশ্বাস নিয়ে স্বাভাবিক হলো, সতর্ক দৃষ্টিতে তাকালো রুমের দিকে।
বেলকনির দরজা খোলা।
দরজা খোলা দেখে মনে মনে হাসলো প্রিয়স্মিতা।
বাঁকা হেসে বললো,
“আমি চলে এসেছি, আমার জিনিস বুঝে নিতে।”
আর না ভেবে রুমের দিকে পা বাড়ালো।
বেলকনির পর্দা সরিয়ে রুমে পা রাখতেই প্রিয়স্মিতার সারা শরীর ঝংকার দিয়ে কেঁপে উঠলো।
বুকের ভিতর ঢাকঢোলক বাজতে শুরু করলো।
সাথে সাথেই চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো, পিছন ফিরে ঢোক গিলে বললো,

“বেহায়া লোক!”
সে কিছুক্ষণ বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে নিজেকে
বুঝালো,
“আমার জিনিসই তো! তাহলে এত লজ্জা ব্যয় করে কী লাভ?”
“এরকম আরো কত কিছু…”
নিজেকে বুঝিয়ে আবার সামনে তাকালো।
শুদ্ধ খালি গায়, কেবল ট্রাউজার পরে, উপুড় হয়ে ঘুমিয়ে আছে।
তার অতিআকর্ষণীয় ফরসা পুরুষি পৃষ্ঠ উন্মুক্ত — যা যে কোনো নারীকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে সক্ষম।
যার থেকে বাদ গেলো না প্রিয়স্মিতাও।

সে নিজেকে যতই বুঝাক, তবু ওর বুক অনবরত কেঁপে চলেছে।
প্রিয়স্মিতা নিজেকে ঝাঁটা মেরে বললো,
“কত ছেলেকে খালি গায় পিটিয়েছি, আর এই বেটার পিঠ দেখে শরীর কাঁপছে ছ্যাহ?”
প্রিয়স্মিতা ধীরে পায়ে গিয়ে দাঁড়ালো শুদ্ধর মাথার কাছে।
শুদ্ধর চেহারাটা চোখের সামনে দৃশ্যমান হতেই আবারো প্রিয়স্মিতার সব চিন্তা এলোমেলো হতে লাগলো।
সে নিজেকে সামলে নিলো। কারণ এই বেটা যদি জেগে যায়, কেলো হয়ে যাবে।
তাই সে বেশি রিস্ক না নিয়ে পকেট থেকে ক্লোরোফর্ম বের করে শুদ্ধর নাকের কাছে দুইবার স্প্রে করে দিলো।
এবার নিশ্চিত।
সে এবার নিশ্চিন্তে শুদ্ধর পাশে বসে পড়লো।

মুগ্ধ চোখে চেয়ে রইলো শুদ্ধর দিকে — একটা বার দেখার জন্য মনটা কিরকম উতাল পাতাল করছিল তখন।
প্রিয়স্মিতা শুদ্ধর কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো সযত্নে সরিয়ে দিল, কী নিষ্পাপ চেহারায়… এই চেহারা দেখে কে বলবে, জেগে থাকলে এই বেটার রাগ নাকের ডগায় থাকে।
প্রিয়স্মিতা কাঁপা হাতে শুদ্ধর গালের হালকা হালকা দাড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,
“এক দেখাতে আমার মন প্রাণ কেড়ে নিয়ে, কাজটা ভালো করো নি, তাই শাস্তি তো তোমাকে পেতেই হবে!”
“আর তোমার শাস্তি — এখন থেকে তুমি শুধু আমার, শুধুই এই মেহেরিমা শিকদার প্রিয়স্মিতার।”
প্রিয়স্মিতা দেখলো পাশে শুদ্ধর ফোন পড়ে আছে।
প্রিয়স্মিতা সেটা হাতে নিয়ে দেখলো, লক।

ফোনের ওয়ালপেপার একটা তিন-চার বছর বয়সী বাচ্চা মেয়ের ছবি, যদিও ছবিটা প্রিয়স্মিতার খুব চেনা লাগলো তবু ও বেশি মাথা ঘামালো না।
সে ফোনটা আবার পাশে রেখে, নিজের ফোন দিয়ে শুদ্ধর ঘুমন্ত অবস্থার ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নিলো।
আবার শুদ্ধর দিকে তাকিয়ে বললো,
“বাই বাই স্ট্রবেরি বাবু, কাল আবার দেখা হবে।”
বলে বাঁকা হেসে যেভাবে এসেছিলো, সেভাবেই চলে গেলো।
দৃষ্টি, সৃষ্টি, স্নেহা, জারা, রুহি, নুহা — সবাই মিলে ক্যাফেতে বসে আছে।
রুহি বললো,

“দূর বাল, কখন চুমু খেতে গেছে, এখনো আসার নাম নেই! চুমু খাওয়ার নাম করে কি পুরোটা খেয়ে নিচ্ছে!”
নুহা নাক সিঁটকে বললো,
“ছি, কী অশ্লীল, নষ্ট নষ্ট!”
রুহি মুখ বাকিয়ে তাকালো নুহার দিকে,
“ও হে শালী, সাধু সাজো! তুই কোনো ওলি-আওলিয়া? কাল যে রাফসান ভাইয়াকে চুমু খেয়েছিস, আরও কত কিছু করেছিস — বলবো সবাইকে!”
রুহির কথায় সবাই বিস্ফোরিত চোখে তাকালো নুহার দিকে।
নুহা কটমট চোখে তাকালো রুহির দিকে, মনে মনে বললো,
“শালী, সব বলে দিয়েও আবার জিজ্ঞেস করে!”
ওদের কথার মধ্যেই জমদূতের মতো হাজির হলো নির্ভান। ওদের পাশে চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো,
“বানর সেনারা এখানে কেন? আর তোমাদের লিডার কোথায়?”
ওরা আচমকা পেঁচে পড়ে গেলো। এবার এই বান্ধা যদি কিছু বুঝে যায়, তাহলে নিশ্চিত ওদের গর্দান যাবে!
জারা কণ্ঠে মধু ঢেলে বললো,
“মানে ভাইয়া, ও একটু বাইরে গেছে, এখুনি চলে আসবে।”
নির্ভান ভ্রু কুঁচকে বললো,
“আমি তো বাহির থেকে আসলাম, বাহিরে কোথায়?”

রুহি বললো,
“এই যাঁ শালী! তুই আজ শেষ!”
নির্ভান আবার কিছু বলতে নিলে আচমকাই ওদের পাশে চেয়ার টেনে বসলো প্রিয়স্মিতা। ভদ্র কণ্ঠে বললো,
“এই কী নির্ভান ভাই, আপনি এখানে?”
নির্ভান তৃষ্ণার্ত চোখে তাকালো প্রিয়স্মিতার দিকে, চশমা ঠেলে বললো,
“কোথায় গেছিলে চড়ুই?”
প্রিয়স্মিতা হাসার চেষ্টা করে বললো,
“এই তো, আইসক্রিম খেতে।”
নির্ভান ভ্রু কুঁচকে বললো, ওদের ফেলে
প্রিয়স্মিতার সাথেই সটান বললো,
“ওই শালীদের খাইয়ে আমার কি লাভ!”
ওরা সবাই কটমট চোখে তাকালো প্রিয়স্মিতার দিকে।

নির্ভান প্রিয়স্মিতার কথা শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো, ওয়েটারকে ডেকে খাবার অর্ডার দিতে দিতে বললো,
“দুপুরে কিছু খাওনি, নিশ্চয়ই। খেয়ে নাও।”
প্রিয়স্মিতা মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে শুরু করলো — কোন কক্ষণে এই ছেলের সামনে পড়েছে! এখন এই ছেলেই ওর পিণ্ডি চটকে দেবে।
জীবনে এত এত মানুষকে টাইট দিয়ে ছেড়ে দিতে পারলে, ও — এই ছেলেকে তার সামলে চলতে হয় কী বিরক্তিকর!

ঘণ্টা তিনেক ড্রাইভ করে গাড়ি এসে থামলো যমুনা ফিউচার পার্কের সামনে।
ওরা গাড়ি থেকে নেমে শপিংমলের ভিতর প্রবেশ করলো।
প্রণয় আগেই পাঁচজন গার্ডকে শপিংমলের সামনে আসতে বলেছিল। সেই গার্ডরা ও প্রিয়তা-দের পিছু নিলো—যাদের একটাই কাজ, প্রতিটা মিনিট, সেকেন্ডের আপডেট তাদের বসকে দেওয়া।
প্রিয়তা, পরিণীতা, ঊষা, থিরা, তন্ময়—ওরা সবাই মিলে প্রতিটা দোকান ঘুরে ঘুরে শপিং শুরু করে দিলো।
প্রিয়তা-পরিণীতাদের বড়লোকি চালচলন আর পানির মতো টাকা খরচ করা দেখে ঊষার চোখ কপালে উঠে গেল।
প্রিয়তা আর পরিণীতা পুরো শপিংমল ঘুরে ঘুরে বেস্ট বেস্ট ব্র্যান্ডেড সব শাড়ি, সালোয়ার, থ্রিপিস কিনতে শুরু করলো—যার স্টার্টিং প্রাইসই ২০,০০০-এর উপরে!
শপিং করতে করতে প্রিয়তার নজর পড়লো একটা হালকা রঙের প্রিন্টেড থ্রিপিসের উপর। সে সেটা তুলে এনে ঊষার উপর ধরলো।

ঊষার গোল গাল, ফর্সা চেহারার সাথে সাদা রঙের থ্রিপিসটা অসম্ভব সুন্দর মানিয়ে গেলো।
ঊষা সেটার প্রাইস ট্যাগ তুলে দেখলো—৩৫,০০০ টাকা!
প্রিয়তা দাম না দেখেই সেটা নিয়ে নিলো।
সাথে সাথেই ঊষা বাধা দিয়ে বললো,
“কি করছো, আপু? এর তো অনেক দাম! এটা থাক, অন্যটা নাও।”
পরিণীতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“নিয়ে নাও, ভাবি। তোমার জামাইয়ের টাকা-পয়সা কিছু কম নেই! এর থেকে দশ গুণ দামি ড্রেস তোমাকে পরানোর সামর্থ্য তার আছে। এটা তো কিছুই না।”
বলে আবার ড্রেস দেখতে শুরু করলো।

ঊষার এভাবে টাকা ওড়ানো দেখে মন খুঁতখুঁত করছে। সে জানে, এই পরিবারের জন্য এইসব পোষাক-আশাক খুবই সামান্য! তারা আরও দামি দামি কাপড় পরে। তাও টাকা আছে বলেই যে সেটা নষ্ট করতে হবে, তার কোন মানে নেই।
পরিণীতা শাড়ি-থ্রিপিস কিনতে কিনতে প্লাজো, টি-শার্ট কিনতে শুরু করলো।
ঊষা চোখ বড় বড় করে বললো,
“এসব নিচ্ছো কেন, আপু? এসব কে পরবে?”
পরিণীতা ঊষার দিকে তাকিয়ে দুষ্টু হাসলো। হাতের ঢিলেঢালা টি-শার্টটা ঊষার গায়ে ধরে বললো,
“পারফেক্ট!”
ঊষা আবার বললো,
“এগুলো কে পরবে, আপু?”
পরিণীতা দুষ্টু হেসে বললো,
“কেন, তুমি পরবে!”
ঊষা সাথেসাথেই আপত্তি জানিয়ে বললো,

“এসব পরবো না, আপু!”
পরিণীতা আবার দুষ্টু হাসলো, প্রিয়তাকে চোখ টিপ দিয়ে বললো,
“আরে ভাবি, এটা পরে রাতে ঘুমাবে! এটা পরে ঘুমালে রাতে সুবিধা হবে!”
পরিণীতার বলার ধরণ দেখে প্রিয়তা ফিক করে হেসে দিলো।
ঊষা বুকার মত তাকিয়ে অবুঝ কণ্ঠে প্রশ্ন করলো, “কেমন সুবিধা?”
প্রিয়তা টি-শার্টটা রাখতে রাখতে বললো,
“আপু, তুমি দিন দিন ডার্টি হয়ে যাচ্ছো!”
পরিণীতা আবার টি-শার্টটা তুলে নিতে নিতে বললো,
“এটা রাখছিস কেন? তুই অবিবাহিত—তুই এইটার বেনিফিট কিভাবে বুঝবি?”
ঊষা ওদের কথা কিছুই বুঝলো না।

পরিণীতা প্লাজো আর টি-শার্ট দেখিয়ে বললো, “ঘুমানোর সময় এসব হিজিবিজি কিছু পরবা না—এগুলো পরে ঘুমাবে, অনেক কমফর্টেবল আর লাভজনক।”
ঊষা কিছু না বুঝলেও আর বারন করলো না।
আরও অনেকক্ষণ ঘুরে ঘুরে ঊষার জন্য আর নিজেদের জন্য মিলিয়ে প্রায় ৭ লাখ টাকার বিল উঠালো ওরা।
এখনো তাদের শপিং শেষ করে নি।
প্রিয়তা ঘুরতে ঘুরতে জুয়েলারি শপে চলে এসেছে। তবে তার নজর সোনা দানার উপর নয়।
সে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে ডায়মন্ডের সব এক্সক্লুসিভ কালেকশন দেখছে। কারণ, ডায়মন্ড তার অনেক পছন্দ।
রিং দেখতে দেখতে হঠাৎ তার নজর আটকালো শপের শেষ প্রান্তে—যেখানে ভীষণ প্রিমিয়াম ভাবে একটা কাচের বক্স রাখা।

প্রিয়তা কৌতূহলবশত এগিয়ে গেলো সেদিকে। ধীরে পায়ে বক্সটার সামনে যেতেই তার চোখ বড় বড় হয়ে গেলো, মুখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো।
বক্সটার ভিতরে ভীষণ প্রিমিয়ামভাবে সাজিয়ে রাখা বিশ্বের রেয়ার পিঙ্ক ডায়মন্ডের রিং!
এত বড় বক্সের মধ্যে একটা সিঙ্গেল পিস রিং, তাও আবার ভীষণ সিম্পল ও ছোট!
প্রিয়তা মন প্রাণ গেঁথে ফেললো সেই রিংটার উপর।
সে সেলারকে ডেকে বললো…
প্রিয়তা: “এক্সকিউজ মি, ইজ দিস পিংক ডায়মন্ড রিং অ্যাভেইলেবল ফর সেল?”

সেলার প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে অত্যন্ত ফরমাল ভেবে বললেন, “ইয়েস, ম্যাম। দিস পিস ইজ অ্যাভেইলেবল, বাট ইট’স দ্য অনলি ওয়ান ইন দ্য এন্টায়ার শপিং মল। ইন ফ্যাক্ট, ইট’স অ্যা লিমিটেড-এডিশন ডিজাইন, ক্র্যাফটেড উইথ প্রিমিয়াম-গ্রেড ন্যাচারাল পিংক ডায়মন্ড—এক্সট্রিমলি রেয়ার অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনালি সার্টিফায়েড।”
সেলার কথা শুনে প্রিয়তা খুশি হলো, আবার বললো, “ইট লুকস সো এলিগেন্ট… আই’ভ নেভার সিন অ্যা রিং দিস ইউনিক। ক্যান ইউ টেল মি মোর অ্যাবাউট ইট?”
সেলার আবারো প্রফেশনাল ভঙ্গিতে বললেন, “সার্টেনলি। দ্য সেন্টারপিস ইজ অ্যা ন্যাচারাল পিংক ডায়মন্ড, গ্রেডেড VVS1 ক্ল্যারিটি, হুইচ মিনস ইট হ্যাজ ভেরি, ভেরি স্লাইট ইনক্লুশনস—বেয়ারলি ভিজিবল আন্ডার 10x ম্যাগনিফিকেশন। ইট’স সারাউন্ডেড বাই অ্যা হ্যালো অফ হোয়াইট ডায়মন্ডস, সেট ইন ১৮কে রোজ গোল্ড। দ্য ক্র্যাফটসম্যানশিপ ইজ এনটায়ারলি হ্যান্ডক্র্যাফটেড বাই টপ-টিয়ার আর্টিজান্স।”
প্রিয়তা জিজ্ঞেস করলো,

“দ্যাট সাউন্ডস এক্সকুইজিট। হোয়াট মেইকস দিস ডায়মন্ড পিংক? ইজ ইট ন্যাচারাল?”
সেলার: “অ্যাবসোলিউটলি। ন্যাচারাল পিংক ডায়মন্ডস আর অ্যামং দ্য রেয়ারেস্ট ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। দ্য কালার অক্কার্স ডিউ টু অ্যা ইউনিক ডিস্টরশন ইন দ্য ক্রিস্টাল ল্যাটিস ডিউরিং ফরমেশন। দিস ইজন’ট ল্যাব-ক্রিয়েটেড অর ট্রিটেড—ইট’স ১০০% অথেনটিক অ্যান্ড এথিক্যালি সোর্সড। দ্যাট’স পার্ট অফ হোয়াই ইট’স সো ভ্যালুয়েবল।”
প্রিয়তা: “ওয়াও। সো হোয়াট’স দ্য প্রাইস?”
সেলার: “দ্য প্রাইস ৩.৯ মিলিয়ন (৩৯ লক্ষ টাকা) । গিভেন ইটস র্যারিটি, ক্ল্যারিটি, অ্যান্ড হ্যান্ডক্র্যাফটেড নেচার, ইট’স কনসিডার্ড অ্যা কালেক্টর’স আইটেম।”
প্রিয়তা: “আই আন্ডারস্ট্যান্ড। ইট’স এক্সপেনসিভ, বাট ইট ফিলস লাইক সামথিং ওয়ান্স ইন অ্যা লাইফটাইম। আই থিঙ্ক… আই’ড লাইক টু পারচেইজ ইট।”
সেলার: “অ্যা ব্রিলিয়্যান্ট ডিসিশন, ম্যাম। দিস রিং ইজ নট জাস্ট জুয়েলারি—ইট’স অ্যা লিগেসি। শ্যাল আই প্রিপেয়ার দ্য বিলিং ফর ইউ?”

প্রিয়তা প্রেমের কার্ডটা এগিয়ে দিতে দিতে বললো, “ইয়েস, প্লিজ। অ্যান্ড আই’ল পে বাই কার্ড।”
সাথে সাথেই পরিণীতা কার্ডটা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো, প্রিয়তার মাথায় গাঁট্টা মেরে বললো,
“তোর কি মাথা খারাপ, প্রিয়? তুই ছোড়দার কার্ড দিয়ে এত এক্সপেন্সিভ ডায়মন্ডের জুয়েলারি কিনছিস? তুই এটা কিনলে পুরো কার্ডই তো ফাঁকা হয়ে যাবে। তুই জানিস না ভাইয়ারা, আব্বু, চাচ্চুরা টাকা নেয় না, আর ছোড়দা তো আরও সাংঘাতিক—কোম্পানি থেকে সেলারি টাও নেয় না। নিজের পেইন্টিং বিক্রি করে যা পায়, তাই।”
পরিণীতার কথায় প্রিয়তার মন খারাপ হয়ে গেল। সে মায়াভরা চোখে চাইলো রিংটার দিকে।
পরিণীতা বোনের মনের ভাব বুঝে, নরম কণ্ঠে বললো,
“এখন বাসায় চল, বোন। বাসায় গিয়ে আব্বুকে বল। আব্বু রাতেই তোকে এটা এনে দেবে।”
প্রিয়তা মনে আফসোস করে বললো,

“ততোক্ষণে কি আর এটা থাকবে?”
তাও ও মনকে বুঝিয়ে ওরা বিল পে করতে চলে গেল।
বিল পে করে এক গাদা শপিং ব্যাগ নিয়ে প্রণয়ের গাড়িতে এসে উঠে বসলো।
প্রণয় দেখলো, প্রিয়তার মুখ ভার। প্রিয়তাকে মুখ অন্ধকার করে বসে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকালো প্রণয়।
তবু, ও কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দিল।
গাড়ি চলতে লাগলো তার আপন গতিতে।
প্রায় চার ঘণ্টা পর তারা এসে পৌঁছালো শিকদার বাড়ি।
পরিণীতা, ঊষা, থিরা, তন্ময়—সবাই শপিং ব্যাগগুলো নিয়ে চলে গেল।
প্রিয়তা ও মুখ গুমড়া করে নামতে নিল, তার হাত টেনে ধরলো প্রণয়।
থমকালো প্রিয়তা।

পেছন ফিরে তাকালো প্রণয়ের মুখের দিকে।
প্রণয়ের চেহারা অনুভূতিশূন্য।
প্রিয়তা তার দিকে প্রশ্নবোধক চোখে তাকালো।
প্রণয়, তার চোখের প্রশ্নকে পাত্তা না দিয়ে, একটা টানে তাকে একদম কাছে টেনে নিল।
হতবম্ব হয়ে গেল প্রিয়তা।
প্রণয় কয়েক সেকেন্ড তার নীলোভ চোখে তাকিয়ে, তার পকেট থেকে একটা পিংক কালারের রিং-এর বক্স বের করলো।

প্রিয়তা অবাক চোখে তাকিয়ে আছে প্রণয়ের দিকে।
প্রণয় বক্সটা ওপেন করতেই, প্রিয়তার চোখ রসগোল্লার মতো বড় বড় হয়ে গেল।
সে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো সেই পিংক ডায়মন্ড রিংটার দিকে।
প্রণয়, রিংটা বের করে, প্রিয়তার বা হাতের অনামিকায় পরাতে পরাতে শান্ত কণ্ঠে ধমক দিয়ে বললো,
“আমার মন কি চাচ্ছে, বলতো?”
প্রিয়তা, অবাক চোখে প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে থেকেও, অনমনে বললো,
“কি?”

প্রণয়, কণ্ঠে আরও একটু তেজ মিশিয়ে, খানিক ঝাড়ি দিয়ে বললো,
“মন চাচ্ছে থাপড়ে তোর নরম গালের চামড়া তুলে ফেলি। জিজ্ঞেস কর, কেন?”
প্রিয়তা ভয় ঢোক গিললো। আংটি পরাতে পরাতে যে কারো থাপ্পড় দেওয়ার ইচ্ছে হতে পারে, এটা সে স্বপ্নের কল্পনাও করতে পারেনি।
তবু, সে ভয়ভয় বললো,
“কেন?”

প্রণয়, প্রিয়তার দুই হাত নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে, প্রিয়তার চোখে চোখ রাখলো। খানিক রাগান্বিত কণ্ঠে বললো,
“তোকে বলিনি কখনো, কিছু পছন্দ হলে সাথে সাথে আমাকে জানাবি? সেটা ফেলে আসবি না!”
প্রিয়তার মনের ভয় আকাশের মেঘের মতো হারিয়ে গেল।
সে চেয়ে রইলো প্রণয়ের বাদামী চোখের গভীরে।
প্রণয় আবার বললো,
“তুই চাইলে, তোর জন্য পৃথিবীর সব থেকে রেয়ার আর এক্সপেন্সিভ ডায়মন্ডটা ও তুলে এনে দিবো। আর তুই, সামান্য একটা সস্তার জিনিসের জন্য মন খারাপ করছিলি!”
প্রিয়তা, কিছু না বলে, নিজের হাতের দিকে তাকালো। রিংটা খুব খুব সুন্দর লাগছে। একদম ছোট্ট একটা রিং, কিন্তু পুরো হাতের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেছে কয়েক গুণ।

প্রণয় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। আসলেই এই মেয়েটাকে থাপড়াতে মন চাচ্ছে, শুধু মাত্র একে মারলে নিজেরই ব্যথা লাগবে বলে সামলে নিলো—না হলে সত্যি সত্যি কয়েক ঘা লাগিয়ে দিতো।
প্রিয়তা, নিজের হাতের আংটিটার দিকে তাকিয়ে খুশি হয়ে গেল। মনের যত কালো মেঘ, সব মুহূর্তেই কেটে গিয়ে রোদ উঠলো।

এত খুশি হলো—যা বলার বাইরে, কারণ সত্যি, আংটিটা ওর খুব খুব পছন্দ হয়েছিল।
সে উজ্জ্বল চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে।
প্রিয়তার চোখের উচ্ছ্বাস দেখে, প্রণয়ের থাপ্পড় দেওয়ার মনোভাব মুহূর্তেই মরে গেল।
প্রিয়তা, নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে, খুশিতে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলো না—ঝড়ের বেগে প্রণয়ের উপর ঝাঁপি পড়ল, শার্টের কলার টেনে ধরে বাঁ গালে কষে কষে দুটো চুমু খেলো।
প্রিয়তা আসছে না দেখে, পরিণীতা থিরাকে দেখতে পাঠিয়েছিল।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪২

কিন্তু, গাড়ির কাছে এসে, এই মহা আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখে, থিরার চোখ কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম! তার মনে হচ্ছে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড তার মাথার উপর ঘুরছে।
এটা কি দেখলো সে? যে বড় দাদানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে, তাদের হাঁটু কাঁপে—আর ছোট আপু কিনা, সেই বড় দাদানকে চুমু খাচ্ছে!

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৪