ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৬

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৬
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

পৃথম তার বউ নিয়ে ঝটপট রুমে এসে দরজা লক করে দিলো।
ইনয়া এখনও ভয়ে কাঁপছে। সে জানতো, এই বাড়িতে তাকে এত সহজে হয়তো কেউ মেনে নেবে না।
ইনয়ার মন ভীষণ খারাপ হলো। অশ্রু চোখে পৃথমের দিকে তাকালো।
পৃথম ভ্রু কুঁচকে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।
ইনয়া পৃথমের গালে হাত রেখে বললো,
— “আপনার খুব লেগেছে তাই না?”
বলতে বলতে চোখ বেয়ে টুপ করে একফোঁটা নোনা অশ্রু গড়িয়ে পড়লো ইনয়ার।
মায়াভরা মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলো পৃথম।
সে তো নিজের সব রাগ, ক্ষোভ দরজার বাইরে রেখেই এসেছে।
তাই ইনয়ার কোমর চেপে ধরে, ব্যথাথুর কন্ঠে বললো,

— “উফফফ… খুব লেগেছে বউ, এই বুড়ো বয়সে বউয়ের জন্য বাড়িতে উদম কেলানি খেলাম।”
লাগবে না মুখটা ইনোসেন্ট করে বললো পৃথম।
ইনয়ার মনটা আরও খারাপ হয়ে গেলো, মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেলো।
পৃথম আরও একটু অভিনয় করে বললো,
— “তবে তুমি চাইলে এখনই ফটাফট কয়টা চুমু খেয়ে ব্যথা সারিয়ে দিতে পারো।”
ইনয়ার আবারও ভীষণ মায়া হলো।
পৃথম যে অভিনয় করছে তা বুঝতে না পেরে, সত্যি সত্যি পৃথমের দুই গালে ফটাফট অনেকগুলো চুমু খেলো।
মনে মনে হাসলো পৃথম।
ইনয়াকে আরেকটু কাছে টেনে চুমু দিতেই যাচ্ছিল, এমন সময় ধারাম-ধারাম করে দরজায় করাঘাত পড়লো।
একবার, দু’বার… কয়েকবার।
দরজা পেটানোর শব্দে বিরক্ত হলো পৃথম।
তেতো কণ্ঠে বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

— “আবার এসেছে বাদরগুলো… বড় ভাইয়ের রোমান্স দেখতে পারে না।”
অরন্য বাইরে থেকে চিৎকার দিয়ে বললো,
— “দরজা খুলো মেজো দাদান! না হলে ড্রিল মেশিন নিয়ে আসবো।”
পৃথম মনে মনে চরম বিরক্ত হলো।
লজ্জা পেলো ইনয়া।
পৃথম রাগে ফুঁসফুঁস করতে করতে দরজা খুলে সামনে তাকালো।
সামনে রাজ, প্রেম, অরন্য, সমুদ্র, প্রিয়তা, প্রেরণা, থিরা, থোরি, তন্ময়—সবাই দাঁত কেলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
পৃথম এতে আরও চটে গেলো।
দাঁত দাত চেপে বললো,

— “এতো রাতে কী চাস তোরা?”
রাজ আর অরন্য পৃথমকে জড়িয়ে ধরে সামনে থেকে সরিয়ে দিলো।
এই ফাঁকে বাকিরা সবাই সুউউ করে ঘরে ঢুকে পড়লো।
অরন্য দুষ্টু হেসে পৃথমের কানে কানে বললো,
— “কন্ট্রোল মেজদা, কন্ট্রোল…”
অরন্যর কথায় ফিক করে হেসে দিলো রাজ।
অন্যরা সবাই নিজ নিজ জায়গায় বসে পড়লো।
সমুদ্র বললো,
— “চল দাদা, মেজদাকে নিয়ে বাইরে যাই।”
প্রেম পৃথমকে চেপে ধরে ফেললো।
পৃথম অসম্মতি জানিয়ে রেগে বললো,
— “আমার ঘর, আমি কেন যাবো? তোরা সবাই বের হ, আমার ঘর থেকে।”
রাজ দুষ্টু হেসে বললো,
— “আমরা তো আজ যাবই না।”
অরন্য তাল মিলিয়ে বলল,

— “একদম।”
প্রেম পৃথমের কানে কানে বললো,
— “আরে, বড় দাদান তোমাকে ডেকেছেন, তাই যেতে বলছি।”
পৃথম ভ্রু কুঁচকে তাকালো প্রেমের দিকে।
সন্দেহভরা কণ্ঠে বললো,
— “মিথ্যে বলছিস না তো?”
অরন্য হায় হায় করে উঠে, দুখি দুখি মুখ করে বললো,
— “আমাদের ভাই, আমাদের অবিশ্বাস করে! এই মুখ আমরা কাকে দেখাবো?”
পৃথম ওরন্যর মাথায় চাটি মেরে বললো,
— “ড্রামাবাজ!”
বলে চলে গেলো ঘর থেকে।
পৃথম ঘর থেকে বের হতেই ওরা ধারাম করে দরজা লাগিয়ে দিলো।
অরন্য প্রিয়তাকে বললো,

— “এই নাচুনি বুড়ি, তুই মেজো ভাবীকে নিয়ে যা।
আর সঙ্গে ওই শপিং ব্যাগটাও নিয়ে যা।
আর মেজদা যেন কোনো ভাবেই ভাবীকে না পায়।”
ইনয়া লজ্জায় মাথা নিচু করে দিলো।
প্রিয়তা দুষ্টু হেসে বললো,
— “একদম নো টেনশন।”
প্রিয়তা, থিরা, থোরি, তন্ময় আর প্রেরণা ইনয়াকে নিয়ে প্রিয়তার ঘরে চলে গেলো।
ওরা যেতেই অরণ্য পৃথমের বিছানায় লাফিয়ে পড়ে বললো,
— “চলো ভাইয়ো, এই ঘরকে যুদ্ধক্ষেত্র বানানো যাক!”
প্রেম ওর পাশে শুয়ে পরে বললো,

— “মাথা নষ্ট হয়ে গেছে তোর?
এটা কী!
আমরা বাসর ঘর সাজাবো, যুদ্ধক্ষেত্র কেন বানাতে যাব খামোখা?”
অরণ্য মুখ বিকৃত করে ছোড়দার দিকে তাকালো।
হতাশ কণ্ঠে বললো,
— “সেসব তোমাদের মতো বিবাহিত কুমাররা বুঝবে না!
যাও, তুমি গিয়ে হরলিক্স খাও।
এটা বড়দের জায়গা!”
প্রেম ভ্রু কুঁচকালো।
কান টেনে ধরে বললো,
— “তুই সব থেকে বেশি পাকনা!
বিয়ে তো সবার আগে তোর হওয়া উচিত ছিল!”
অরণ্য মুখ দুখী দুখী করে বললো,
— “হওয়া তো উচিত ছিল!
কিন্তু ৪-৬ তো আগে তোমরাই মেরে দিলে!
আমি আর কী করবো!”
এবার রাজ আর সমুদ্র,

— “ওহ দারাম ধড়াম!” করে বিছানায় বসতে বসতে বললো,
— “আজকের জন্য কোনো একটা প্ল্যান করা যায় না?”
অরণ্য হেসে বললো,
— “প্ল্যান তো আমি আগেই করে রেখেছি।”
রাজ কপাল কুঁচকে বললো,
— “কি প্ল্যান?”
অরণ্য বাঁকা হেসে বললো,
— “আজ ১২টার পর পুকুর পারে আমরা দারু পার্টি করবো!”
প্রেম কপাল কুঁচকে বললো,
— “আগের বারে বড় দাদানের হাতে ঠ্যাঙ্গানি খাওয়ার কথা ভুলে গেছিস?
বড় দাদন বাড়িতেই আছে, একবার জানতে পারলে চাল ছড়িয়ে নুন মাখাবে!”
অরণ্য হাঁ করে বললো,

— “জীবনে ভয় পেলে তো হেরে গেলি!
উত্তেজনামুখো কিছু করতে গেলে মাঝে মাঝে রিস্ক নিতে হয়!
আর প্রয়োজনে ঠ্যাঙ্গানি… ও খেতে হয়!”
রাজ উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,
— “কয় বোতল এনেছিস?”
সমুদ্র বাঁকা হেসে বললো,
— “পাক্কা ১০টা!
এক সিপ গলায় পড়লেই আউট হয়ে যাবে!”
সকলেরই চোখ মুখ উজ্জ্বল হলো,
যদিও একটু রিস্ক আছে,
ধরা না পড়লে ভরপুর মজা হবে।
প্রিয়তা পরিণিতাকে জোর করে ধরে নিয়ে এলো।
পরিণিতার চোখ-মুখ ঠিক লাগছে না, ভারী চোখের পাপড়িগুলো ভিজে।
প্রিয়তা অনেকবার জিজ্ঞেস করাতে ও পরিণিতা কিছুই বলে না, তাই প্রিয়তা ও আর জিজ্ঞেস করে নি — হবে হয়তো বিশেষ কিছু।
পরিণিতা অরণ্যের দেওয়া শপিং ব্যাগ খুলে একটা টকটকে লাল সিঁদুররাঙা বেনারসি বের করলো।
শাড়িটা এত সুন্দর যে সবার চোখ-মুখ জুড়ে গেল।
প্রেরণা বললো, “জাস্ট অস্থির!”

পরিণিতা শাড়িটা ইনায়ার গায়ে ধরে বললো, “বাহ! তোকে তো ভীষণ সুন্দর মানিয়েছে!”
তন্ময় ছুটে এসে ইনায়ার হাত ধরে টানলো, “নিচে চাইলো ইনায়া!”
তন্ময় দুই হাত বাড়িয়ে আব্দারের সুরে বললো, “কোলে নাও মেজো ভাবী!”
ইনায়া হেসে কোলে নিলো।
তন্ময় গুলগুল চোখে ইনায়াকে কিছুক্ষণ দেখে কান্নাভেজা কণ্ঠে বললো, “এই বউটাও আমার অনেক পছন্দ হয়েছিল! এটা আমি বিয়ে করবো বলে পছন্দ করে রেখেছিলাম! মেজো দাদন বিয়ে করে নিয়েছে!”
এএএএ্যাাাাাা —
বলতে বলতে ঘর ফাটিয়ে কেঁদে উঠলো।
ওর আচমকা কান্নাতে ইনায়া সহ সব বোনেরা আহাম্মক বনে গেলো।
প্রিয়তা কপাল চাপড়ে বললো, “ভাই, তোর বিয়ে করার জন্য খালি বড় মেয়ে পছন্দ হয়? কাদিস না ভাই, তুই বড় হো! তোর জন্য মেজো ভাবী, ছোটো ভাবীর থেকেও সুন্দর বউ এনে দেবো!”
কিন্তু থামলো না তন্ময়।
পরিণিতা বিরক্ত কণ্ঠে বললো, “দৌড়ে গিয়ে বড়ো আপু, না হয় বড়ো দাদনকে নিয়ে আয়!”
তাই করলো।

থিরা ৫ মিনিটের মধ্যে প্রণয়কে নিয়ে এলো।
প্রণয় এসে তন্ময়কে কোলে নিলো।
প্রণয় দেখতেই তন্ময়ের কান্না ও ফট করে থেমে গেলো।
প্রণয় ভ্রু নাচিয়ে বললো, “কি ব্যাপার ছোটো কর্তা! কাঁদছিস কেন?”
তন্ময় অসন্মতি জানিয়ে বললো, “কই দাদন! কাঁদছি না তো!”
তন্ময়ের এক সেকেন্ডে পাল্টি মারা দেখে সবাই ঠোঁট টিপে হাসলো।
প্রণয় তাকে কুঁলে নিয়ে ঘর থেকে চলে গেলো।
পরি বললো, “এখন বল! আমরা জানি না, অথচ তোর বিয়ে কিভাবে ঠিক হলো?”
প্রিয়তা ঊষা ও থিরে কৌতূহলী চোখে তাকালো।
ইনায়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব বললো।

সব শুনে প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “শেষমেশ তুই আমার ভাইয়ের ঘাড়েই চাপলি!”
ইনায়া ও কম কিসে!
সে ও দুষ্টু হেসে বললো, “হুহ! তোর ভাইয়ের ঘাড়ে চেপেছি! শুধু তোকে জলাবো বলে! এখন তোর ভাইয়ের ঘাড়ে বসে তোর আর তোর ভাইয়ের রক্ত চুষে খাবো!”
প্রিয়তা গলায় হার পরাতে পরাতে বাঁকা হেসে বললো, “মনু! কাল সকাল অবধি ওই অবস্থায় থাকলে আমার আর আমার ভাইয়ের রক্ত চুষে খেও!”
প্রিয়তার কথায় না চাইলেও ও হেসে ফেললো পরিণিতা !
ঊষা কিছু না বুঝলেও, ও ইনায়ার কথার মর্ম ঠিকই বুঝল।
প্রিয়তা আবার বললো, “কাল সকালে আমি ঝান্ডু বাম নিয়ে আসবো! তখন রক্ত খাস!”
কিছু জিনিস কল্পনা করে ইনায়া ভয়ে ফাঁকা ঢোঁক গিললো।
রাত ১টা
কালকের শিন্নির সব প্রস্তুতি শেষ।

ঘিন্নি সহ সকলে তন্দ্রাজনিত, গুটি কয়েকজন মানুষ ছাড়া।
ইনায়া দুরুদুরু বুকে কিছুটা ভয় আর কিছুটা আশঙ্কা নিয়ে বসে আছে পৃথমের ঘরে।
কিছুক্ষণ অতিবাহিত হওয়ার পর…
ঘরের দরজায় খট করে শব্দ হতেই ইনায়ার রক্তপ্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়, পুরো শরীর এক লহমায় জমে যায়।
হাই পাওয়ার এসির ঠান্ডা বাতাসও তাকে আজ ছুঁতে ব্যর্থ — কারণ তার বুকের ভেতর জমে থাকা ভয়ে সে দরদর করে ঘামছে।
মুহূর্তেই সারা শরীর ঘামে ভিজে ওঠছে, হৃৎপিণ্ডের লাফডুপ শব্দ এক অদ্ভুত ছন্দ তুলে বেড়ে চলেছে।

এই পুষ্পসজ্জিত স্বপ্নরাজ্য যেন আজ ইনায়ার কাছে প্রেমময় বাসরঘর নয়, বরং তার নিকট পুষ্পসজ্জিত ফাঁসির মঞ্চ — আর সে একজন নিষ্পাপ অপরাধী, যাকে আজ এই পুষ্পসজ্জিত বিছানায় নিজের আত্মার আহুতি দিতে হবে।
তার কোন বারণ শোনা হবে না — মৃত্যু হবে তার, সুখের মৃত্যু, ভালোবাসার মৃত্যু।
সে জানে তার প্রিয় পুরুষ আজ তার কাছে তাকে দাবি করবে,
আর তাকে ও এই প্রতীক্ষার সীমানা পেরিয়ে, এই দম বন্ধ করা সুখের মরণে শরিক হতে হবে।
তবু কেন যেন আজ সবকিছু এত ভয় কাজ করছে?
আজ সামনের মানুষটার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহসটুকু হচ্ছে না।
বুকের ভেতর দ্রিম দ্রিম শব্দ বেড়েই চলেছে।

ছোট্ট হৃদয়ে একরাশ ভয়, লজ্জা, কুণ্ঠা, আশঙ্কা, ভালোলাগা হানা দিয়েছে।
সারা শরীর ও মন জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে অজানা এক শিহরণ — যাকে সে চিনে না, জানে না, অনুভব করেনি কখনো।
তাই এখন তাকে অনুভব করতে দম বন্ধ হয়ে আসছে।
অজানা শিহরণে শরীর বারংবার ঝংকার তুলে কেঁপে উঠছে —
দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়ছে অদ্ভুত উত্তেজনা, নিশ্বাস-প্রশ্বাসের গতি দ্রুত হচ্ছে।
এ কি প্রেম? না কি আসন্ন এক অনিবার্য পরিবর্তনের পূর্বসন্ধ্যা?
প্রীতম দরজা ঠেলে কক্ষে প্রবেশ করতেই ঝড়ের বেগে তার নাকে এসে লাগে জুঁই, বেলি, গোলাপ, চাঁপা, রজনীগন্ধা আর নানাবিধ অসংখ্য ফুলের সংমিশ্রিত ঘ্রাণ।

সেই সঙ্গে নানা রকম আতর ও পারফিউমের মিশ্র গন্ধ যেন নাক দিয়ে ঢুকে মস্তিষ্কে ঘোর লাগিয়ে দেয়।
সে তখনো সামনের দৃশ্য দেখেনি, কেবল সুগন্ধে বিমোহিত।
সে ভেতরে দুই পা এগিয়ে সামনে দৃষ্টিপাত করতেই তার হৃদপিণ্ড কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়।
নিলাভ চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে যায় সামনে।
মুগ্ধতার স্রোত তাকে গিলে খায়।
ঠোঁট ফুঁড়ে বেরিয়ে আসে — “মাশাআল্লাহ” — অজান্তেই, অবলীলায়।
আজ পৃথমের কক্ষ অন্যদিনের মতো সাদামাটা ধূসর রঙা নয়।
পূর্বের সেই সাদামাটা কক্ষ আজ স্বর্গরাজ্যের কোন অনিন্দ্য সুন্দর ফুল সজ্জিত কক্ষ লাগছে।
ঘরের বাতাসেও প্রেম প্রেম আবহ।

লাল-সাদা মিশ্রণে সাজানো এই কক্ষ আজ স্বপ্ননীর প্রেমভূমি।
ঘরের পরিবেশ এতটাই মোহনীয় যে, পৃথমের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
পুরো ঘর জুড়ে কেবল সাদা রঙের বড়-ছোট ক্যান্ডেলের আলোয় ঘর ভরে আছে,
কোথাও কোনো বৈদ্যুতিক আলো নেই।
পুরো মেঝে জুড়ে লাল গোলাপের অজস্র পাপড়ি ছড়ানো, আর তাতে ছোট বড় ক্যান্ডেল স্তরে স্তরে সাজানো।
ঘরের দক্ষিণ দিকের জানালাটা খোলা,
সেখান দিয়ে পূর্ণ চাঁদের রুপালি আলো ঘরে প্রবেশ করছে।
বাতাসে উড়ছে ফিনফিনে সাদা পর্দা, যা ঘরটাকে আরো স্বর্গীয় করে তুলছে।
প্রীতমের বিছানাটা ঠিক দক্ষিণের জানালার পাশে — বিশাল বড় রাজকীয় বিছানা।
এই মুহূর্তে বিছানাটা যেন স্বর্গের টুকরো।

সাদা মখমলের চাদর পাতা, তাতে ছড়ানো অগণিত লাল গোলাপের পাপড়ি।
ঠিক মাঝখানে সাদা গোলাপ দিয়ে আঁকা লাভ-সেপ আকৃতি।
এক পাশে রাখা মখমলে সাদা দুটি বালিশ, বালিশের ওপরেও অসংখ্য গোলাপের পাপড়ি।
বিছানার চারপাশ হালকা পাতলা সাদা পর্দায় ঢাকা।
পর্দার ফাঁক দিয়ে মোমবাতির আলো এসে পড়ছে বিছানায়,
সর্ব কক্ষকে এক স্বপ্নিল কুয়াশার মধ্যে ভাসিয়ে দিচ্ছে।
বাতাসে রজনীগন্ধার মৃদু গন্ধ, যা নিঃশ্বাসে শরীর নয় — আত্মাকে কাঁপিয়ে দেয়।

চাদরের মাঝখানে হৃদয় আকৃতির পাপড়ির ওপরে বসে আছে ঘোমটা টানা এক নববধূ —
সিঁদুররাঙা বেনারসিতে মোড়ানো, টুকটুকে লাল রঙের মেয়েটি যেন এই মুহূর্তে ঘরের সৌন্দর্যকে পূর্ণতা দিয়েছে।
চাঁদের আলো আর মোমবাতির নরম আভায় তার লাজে রাঙা মুখশ্রী যেন এক অপার্থিব দৃশ্য।
তার অস্থির চোখজোড়া বলছে অনেক কথা, আর সেই চোখে পৃথম নিজেরই সর্বনাশ দেখতে পাচ্ছে — নিজেকে দেখছে এক ভালোবাসায় হেরে যাওয়া পুরুষ হিসেবে।

আজ এটা শুধু একটা বিছানা না, আজ এটা দুটো হৃদয়ের মিশে যাওয়ার নিঃশব্দ কাব্য…
ভালোবাসার সেই গভীর মুহূর্তের মঞ্চ, যেখানে কোনো শব্দের প্রয়োজন হয় না — শুধু চোখে চোখ রাখাই যথেষ্ট।
ইনায়ার লজ্জা রাঙা মুখশ্রী দেখে পৃথমের শিরা উপশিরায় অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছিটকে পড়ল। কপালে সূক্ষ্ম ভ্রুকুটি দেখা গেল, সে যেন নিজের মধ্যেই নেই। সে মন্ত্রমুগ্ধদের মতো ধীর পায়ে এগিয়ে গেলো বিছানার দিকে।
কারো পায়ের শব্দ কক্ষে পেতেই ইনয়া ভিতর ভিতর চমকিত হল। শব্দটা যতই নিকট থেকে আসছে, ততই ইনয়ার বুকের ধরফরানি বাড়ছে। ইনয়া চোখ বন্ধ করে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করলো। তার শরীরটা তীর তীর করে কাঁপছে।

সে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো, কাঁপা কদমে এগিয়ে এসে পৃথমের পা ছুঁয়ে সালাম করলো। তার গলা শুকাতে শুকাতে এখন মনে হচ্ছে, সে হার্ট অ্যাটাক করবে। শরীরের কাঁপনও বাড়ছে। আজ পৃথমকে চোখ তুলে দেখার সাহসটুকু হচ্ছে না, মেয়েটার সকল সাহস যেন কেউ শুষে নিয়েছে সন্তর্পণে।
পৃথম ঘোর লাগানো, নেশাগ্রস্ত চোখে দেখলো ইনয়ার দেহের মৃদু কম্পন, যা দেখে তার ঠোঁটের কোণায় খেলে গেল মাতাল করা বাঁকা হাসি। সে ধীরে ধীরে ইনয়ার কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
“Calm down, রসগোল্লা… শান্ত হও। আমি কি তোমায় এখনই খেয়ে ফেলছি? তবে নিশ্চিত থাকো, একটু পর অবশ্যই খাব।

উপ্সসস… শুধু খাব না, একদম টুক করে গিলে ফেলবো।”
ইনায়া চোখ বড় বড় করে তাকালো পৃথমের দিকে। সাথে সাথেই পৃথম এক চোখ টিপ দিয়ে বলল,
“এতগুলা বছরের ধৈর্যের ফল আজ আমি পাবো। আজ তুমি হবে শুধুই আমার। আজ রাতটা হবে শুধুই আমার—এই পৃথম সিকদারের।
আজ তোমার দেহের প্রতিটি লোমে লোমে এই পৃথম সিকদার রাজ চলবে।”
আবারও ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“তুমি সহ্য করতে পারবে তো, রসগোল্লা?”
পৃথমের বলার ধরনে ইনয়ার হাত-পা মেঝেতে সেঁটে গেলো, হৃদপিণ্ডের রক্ত প্রবাহ থমকে গেল। কম্পন বাড়লো তনু মনে। হাসলো পৃথম।

আচমকাই শাড়ির ফাঁক দিয়ে হাত গলিয়ে ইনয়ার উন্মুক্ত উঁধোর চেপে ধরলো। এক ঝটকায় দেহের সেন্টিমিটার সম দূরত্বটাও গুছিয়ে দিয়ে ঘনিষ্ঠতা বাড়ালো পৃথম। পুরুষালী ঠান্ডা হাতের স্পর্শে ইনয়ার সর্বাঙ্গে দ্রুত বেগে বিদ্যুৎ খেলে গেলো। পৃথমের ভারী ভারী ঘনঘন নিঃশ্বাস ইনয়ার কাঁধে, ঘাড়ে আঁচড়ে পড়ছে।
পৃথম নিজের পুরুষালি ওষ্ট দাঁড়া ইনয়ার নরম গলায় স্লাইড করতে করতে হাস্কে কণ্ঠে বললো,
“আজ কিন্তু আমি কিচ্ছু শুনবো না রসগোল্লা। তুমি চাও বা না চাও, আজ আমার তোমাকে চাই চাই।”
ইনয়া শক্ত করে চেপে ধরলো পৃথমের সাদা শার্ট।
ভীতু কণ্ঠে তুতলিয়ে বলল,
“আ-আমি ছোট…”

পৃথম ঠোঁট এলিয়ে হাসলো। ইনয়াকে নেশাগ্রস্ত চোখে মাথা থেকে পা পর্যন্ত খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরখ করল। গলা থেকে বেশ খানিকটা নিচে দাঁত বসিয়ে দিলো সহশাই। পুনরায় ব্যথা প্রাপ্ত স্থানে ঠোঁট বুলিয়ে দুষ্টু কণ্ঠে বললো,
“তো আমি তো বড়… তোমার থেকে গুনে গুনে ১১ বছরের বড়। পারবে তো আমার সকল সুখ মিশ্রিত যাতনা সহ্য করে নিতে?”
ইনায়া ঢোক গিলল, তার কণ্ঠনালী কাপছে।
প্রীতম আবারো মদ্যপানের মতো অধৈর্য কণ্ঠে বলল,

“উফফ, এত কিছু পরে আমার ইয়াম্মি ইয়াম্মি রসগোল্লা লুকানোর কী দরকার ছিল? এই রসগোল্লা খাওয়ার জন্য, ট্রাস্ট মি বেবি, আমি অনেক অনেক অপেক্ষা করেছি। তাই এখন কি আর এত কিছু ছাড়ানোর ধৈর্য আমার আছে?”
পৃথমের কথায় ইনয়ার চোখ রসগোল্লা করে ফেলল। সে চোখ বড় বড় করে তাকালো পৃথমের দিকে। পৃথম ইনয়ার দৃষ্টি দৃষ্টিতে রেখে তার নরম ঠোঁটে আলতো চুমু খেয়ে বললো,
“হুম্… ইয়াম্মি ইয়াম্মি কেষ্ট পেতে গেলে একটু কষ্ট তো করতেই হয়। চলো রসগোল্লা, মিষ্টির বক্স থেকে আগে রসগোল্লা বের করি, তার পর আরাম করে বসে খাবো।”
পৃথমের বলার ধরনে ইনয়ার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। পৃথম তাকে কোলে নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের দিকে যেতে যেতে দুষ্টু কণ্ঠে বললো,

“তুমি বলেছিলে, আমার স্পর্শ ছাড়া তুমি অন্য কারো স্পর্শ নিতে পারবে না। আজ দেখবো, আমার স্পর্শ তুমি কতক্ষণ নিতে পারো।”
ইনয়ার ভয়ে ভিতর কাঁপছে। এই লোক কি তাকে ভয় দেখাচ্ছে?
পৃথম তাকে ড্রেসিং টেবিলের সামনে চেয়ারে বসিয়ে আলতো হাতে ধীরে ধীরে হাতের চুড়ি, গলার হার, কানের ঝুমকো—ভারী ভারী সব গয়না খুলতে শুরু করলো। কিছুক্ষণ পর কী হবে, এই ভেবে ইনয়ার ভয়ে জ্বর আসার উপক্রম হলো।
পৃথম চুলের ক্লিপ খুলতে খুলতে আচমকাই উন্মুক্ত পিঠে ঠোঁট চেপে ধরলো। অদ্ভুত নেশালো গলায় ধীরে ধীরে বললো,

“এভাবে কাঁপছো কেন রসগোল্লা? তুমি জানো, তোমার এই কাঁপাকাঁপি আমাকে কীভাবে s****e করে? তুমি কি জানো? তুমি না বললেও, তোমার দেহ আমাকে কী বলে?”
পৃথমের এমন ভয়াবহ নেশাগ্রস্ত কণ্ঠে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে এলো ইনয়ার।
পৃথম আবারো একই ভাবে বলল,
“বলোনা… শুনবে কি বলে?”
ইনায়া কাপা কাপা কণ্ঠে প্রশ্ন করল,
“ক-কী?”
পৃথম ইনয়ার ঘাড়ে নাক ঘষতে ঘষতে বলল,
“You didn’t speak—but your body screamed, ‘Eat me, Pritom… slowly…. Eat me, Pritam… hardly .’”

ইনয়া বসা থেকে উঠে শক্ত করে ঝাঁপটে ধরলো পৃথমকে।
কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“আমার ভয় করছে।”
পৃথম হাসলো। ব্লাউজের ফিতা এক টানে খুলে ফেলে বললো,
“কিসের ভয়?”
ইনয়া তুতলিয়ে বললো,
“আমার তোমাকে ভয় করছে। কেন জানি মনে হচ্ছে তুমি আমার সাথে অন্য কিছু করবে।”
ইনায়া কথা শেষ করার আগেই পৃথম তাকে ঘুরিয়ে পাশে দেয়ালে চেপে ধরলো।
তার দুই পাশে হাত রেখে বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করলো।
চোখে চোখ রেখে উত্তপ্ত কণ্ঠে বললো,

“একদম ঠিক ভেবেছো। আজ তোমার সাথে অন্য কিছু করবো—একদম নতুন কিছু।
এমন কিছু, যা তুমি কোনো দিন ভুলতে পারবে না, ভুলতে পারবে না।
আজকের রাতের এক একটা সেকেন্ড—আজ থেকে তোমার নিগূঢ় রাতের শুরু, রসগোল্লা।
আজ থেকে তোমার রাত হবে শুধুই পৃথমময়।”
আজ থেকে প্রতি রাতে তোমাতে আমার বিচরণ হবে।
ইনয়া পৃথমের কথার গভীরতায় লজ্জায় নুয়ে গেলো।
পৃথম ইনয়াকে লজ্জা পেতে দেখে কপালে কপাল ঠেকিয়ে ব্যাকুল কন্ঠে বললো,
“তোমাকে কতদিন বলেছি, রসগোল্লা, তোমাকে লজ্জা পেতে দেখে আমার নিজের উপর কন্ট্রোল থাকে না।
এমনি তেই তো মরবে, তাহলে এত তাড়া কিসের? ধীরে-সুস্থে মরো।”

ইনয়ার হাতে-পায়ে কাঁপন ধরেছে।
সে অক্সিজেনের অভাব বোধ করলো।
পৃথমের হাত থেকে বাঁচতে কাঁপা কণ্ঠে বললো,
“আপনি এত লুচু কেন?”
ইনয়ার কথায় পৃথম ভ্রু বাঁকালো।
শাড়ির ফাঁক গলিয়ে উন্মুক্ত উঁধোরে স্লাইড করতে করতে বললো,
“ছিঃ! বউ বাসর রাতে নিজের ভার্জিন স্বামীর নামে এমন অপবাদ, উপরওয়ালা সইবে না!
ধরলাম না, ছুইলাম না, খেলাম না—এর মধ্যেই লুচু ট্যাগ পেয়ে গেলাম?
পৃথম লাগামছাড়া কথায়!”
ইনয়ার গলা শুকালো,
জিভ দিয়ে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে কাঁপাকাঁপা কণ্ঠে বললো,

“আপনি… আপনি…”
পৃথম পেট চেরে ইনয়ার কম্পনরত ঠোঁটে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে স্লাইড করতে করতে বললো,
“হুম্, বলো, আমি কী?”
ইনয়া ঢোক গিলে বললো,
“আপনি অনেক কিছু। বাসর রাতে স্বামীরা তাঁদের নতুন বউদের কত কিছু গিফট দেয়, আর আপনি একটা বাসি ফুল পর্যন্ত দেননি, ছেহ!”
ইনয়ার কথায় পৃথমের ঠোঁটের বক্র হাসি আরও প্রসারিত হলো।
সে আরও একটু ঘনিষ্ঠ হয়ে দুষ্টু হেসে বললো,
“তোমার কি এই পৃথম সিকদারকে ছোটলোক মনে হয়, রসগোল্লা?”
ইনয়া অবাক হলো—সে কী বললো, আর এই লোক কী বলছে?
পৃথম ইনয়াকে তুলতুলে ফুলফুল গালে হালকা কামড় বসিয়ে বলল,
“বাসর রাতে বউকে সোনা, দানা, ফুল, পাতা—এসব…ছোটলোকরা দেয় এইসব ছোট লুকি গিফট, আমি আমার বউকে দেব না।

পৃথম শিখদার ইজ ডিফরেন্ট, আর গিফট ও ডিফারেন্ট দেবে।”
ইনায়া কৌতূহল হল।
পৃথম আবার বলল,
“আমার বউকে আমি এমন গিফট দেবো, যার অন্যরা সৎ সাহস নিয়ে বলতে ও পারবে না।”
পৃথমের কথায় ইনায়ার ভ্রু এর মাঝে ভাজ পড়লো।
আগ্রহ নিয়ে তাকালো প্রীতমের দিকে।
পৃথম দুষ্টু কণ্ঠে বলল,
“বাসর রাতে তোমার সবচেয়ে বড় গিফট হিসেবে, তোমাকে তোমার বর একদম পিওর ভার্জিন, আনর‍্যাপ পৃথম শিখদার গিফট করলাম।”
পৃথমের কথায় ইনায়া চোখ গুল গুল করে তাকালো।
পৃথম ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছে না, বউ? আচ্ছা, তাহলে এখুনি একবার টেস্ট করে দেখো।”
পৃথমের কথায় ইনায়া তাজ্জব বনে গেল।

পৃথম বাঁকা হেসে ইনায়ার কাঁপা হাতটা নিজের শার্টের বোতামে রেখে বলল,
“নাও বউ, তোমার ব্র্যান্ড নিউ গিফট আনবক্স করো।”
ইনায়া তাড়াহুড়ো করে হাত সরিয়ে নিতে নিতে বিরবির করে বলল,
“আস্তাগফিরুল্লাহ্! নির্লজ্জ পুরুষ মানুষ!”
ইনায়ার বিরবির করে বলা বাক্য পৃথম শুনে নিল।
ইনায়াকে ঘুরিয়ে তার উন্মুক্ত চুলে মুখ ডুবাতে ডুবাতে বলল,
“বউয়ের কাছে যারা লজ্জা পায়, তারা বংশের বাতি জ্বালাতে পারে না।
আর তুমি তো জানোই বউ, পৃথম শিখদার ইজ ডিফরেন্ট।”
পৃথমের ঘন ঘন গরম শ্বাস-প্রশ্বাস এসে আঁচড়ে পড়ছে ইনায়ার গায়ে-কাঁধে-গলায়।
সে কেঁপে উঠে হার মেনে নিল।

ফর্সা পিঠে ঠোঁট বুলাতে বুলাতে অস্থির তৎপর হয়ে উঠেছে প্রিথম।
ইনায়া বুঝলো, আজ তার জন্য সহজ হবে না।
পৃথম তাকে আবার ঘুরিয়ে দেয়ালের সাথে চেপে ধরলো।
নিজের রক্তিম ঠোঁট জুড়ে ইনায়ার গোলাপি ঠোঁটের কাছে নিতে নিতে বলল,
“ইয়াম্মি ইয়াম্মি…”
বলেই তুল তুলে ওষ্টে ওষ্ট মিলিয়ে দিল।
কেঁপে উঠে পৃথমের পেটের কাছের শার্ট খামচে ধরলো ইনায়া।
পৃথম উষ্ণ দীর্ঘ চুম্বন সেরে ধীরে ধীরে গলা বেয়ে নিচে নামতে লাগলো।
পৃথমের ঠোঁটের এক-একটা গভীর চুম্বন ইনায়ার শরীরের শিরশিরানি হাজার গুণ বাড়াচ্ছে।
মনে হচ্ছে উত্তপ্ত অগ্নিতে কেউ ক্রমাগত কাঠ কয়লা ফেলছে।
পৃথম মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে ইনায়ার পেটের কাছের শাড়ি সরিয়ে দিল,
শিহরণে শরীর ছেয়ে গেল ইনায়ার।

পা দিয়ে ফ্লোর চেপে ধরে বিদ্যুৎ বেগে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিলো।
পৃথম মুখ তুলে নেশাগ্রস্ত চোখে ইনায়ার এক্সপ্রেশন দেখলো।
ইনায়ার দেহের মৃদু কম্পন তার শরীরের শিরা-উপশিরায় ভালোবাসাকে চিরতরে আপন করে নেওয়ার বাসনাকে তীব্র থেকে তীব্রতর করছে।
আজ আর পৃথম নিজের অনুভূতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে না।
আজ তার মনের কথা শুনবে, ছুঁয়ে দেবে তার প্রিয় রসগোল্লাকে, যতটা গভীরে ছোঁয়ে দেওয়া যায়…
তার চোখ-মুখে তীব্র উন্মাদনা, তীব্র আসক্তি।
সেই তীব্র আসক্তির তাড়নায় ঝড়ের বেগে ইনায়ার ফর্সা, মেদহীন পেটে মুখ ডুবিয়ে দিলো পৃথম।
দুই হাতে ঠেসে চেপে ধরলো ইনায়ার কোমর।
ইনায়ার সারা শরীর অবশ হয়ে আসছে।

অদ্ভুত, অচেনা সব অনুভূতিরা শরীর জুড়ে বিচরণ করছে।
এই পুরুষের স্পর্শ সহ্য করা যাচ্ছে না, আবার এই মুহূর্তে এই পুরুষের স্পর্শ ছাড়া ও বাঁচা যাবে না—এ কেমন বিষ!
পান করলেও মরণ, না করলেও মরণ!
ইনায়া অনুভূতির তাড়নায় কাবু হয়ে গেল।
শক্ত করে খামচে ধরলো পৃথমের চুল।
মুখ দিয়ে অস্ফুট সরে গুঙিয়ে উঠলো।
পৃথম—চোখ-মুখ চেনা যাচ্ছে না—কি তীব্র নেশা চড়েছে তার!
সে বসা থেকে উঠে ইনায়াকে কোলে নিতে নিতেই বলল,
“প্রিথমের ভালোবাসা সবটুকু নেওয়ার আগে প্রমিস করো রসগোল্লা, কাঁদবে না প্লিজ।
লক্ষ্মী সোনা, কেঁদো না কেমন? তখন কাঁদলে ও তোমার কথা শুনতে পারবো না, তাই আগেই থেকে খুব করে সরি জান…”

বলে কপালে দীর্ঘ চুম্বন আঁকলো পৃথম।
ইনায়াকে কোলে নিয়ে ফুলে সজ্জিত শুভ্র বিছানায় আস্তে করে শুইয়ে দিলো পৃথম।
তার ভেতর এক ধরনের চরম উন্মত্ততা কাজ করছে।
সে আবেগের তোড়ে মুখ ডুবিয়ে দিলো ইনায়ার সুবাসময় নরম গলায়, ধীরে ধীরে ভালোবাসা খুঁজতে লাগলো ইনায়ার কোমল সত্তায়।
জীবনে প্রথমবার কোনো পুরুষের দ্বারা এমন ঘনিষ্ঠ স্পর্শে মুহূর্তেই ইনায়ার সমগ্র শরীর ভূমিকম্পের ন্যায় থর থর করে কেঁপে উঠলো,

অঙ্গপ্রত্যঙ্গে তীব্র কম্পনের সৃষ্টি হলো, কিন্তু প্রিথম উন্মত্ত, মরিয়া।
সে সেই সব কাঁপুনি আমলে নিল না, বরং ছটফটানি বাড়াতে ইনায়ার দুই হাত বেডের সাথে শক্ত করে চেপে ধরল, নিবিষ্ট হলো ভালোবাসাতে।
এক পর্যায়ে ব্যস্ত হাতে এক টানে ইনায়ার শরীর থেকে আঁচল সরিয়ে দিলো।
চারপাশে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো এসে লুটোপুটি খাচ্ছে বিছানার ওপর,
আর সেই আলোয় যেন প্রিথম আরও বেশি উন্মাদ, আরও বেশি আগ্রেসিভ হয়ে উঠছে।
উত্তেজিত হস্তে নিজের সফেদ রঙা শার্টটা এক প্রকার টেনেটুনে খুলে বিছানার এক কোণে ছুঁড়ে ফেললো।
শার্টটা সেথায় পড়ে রইল অবহেলায়।
আজ আর সে কোনো বাধা মানতে চায় না।
মিশে যেতে চায় ইনায়ার অস্তিত্বে—তাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে অনুভব করতে চায়, প্রতিটি নিঃশ্বাসে তার অধীনতা।
প্রিথমের শক্তপক্ত, সুগঠিত নগ্ন পুরুষালি শরীরের দিকে চোখ পড়তেই ইনায়ার নিঃশ্বাসটুকু আটকে আসলো কণ্ঠনালীতে,

গলার কাছে জমে উঠলো অপ্রকাশিত লজ্জা।
সে লজ্জায়, কুণ্ঠায় চোখ নামিয়ে নিলো।
ইনায়াকে লজ্জায় কুণ্ঠিত হতে দেখে প্রিথম তার কানের কাছে ঠোঁট এনে মৃদু হেসে বলে উঠলো,
“আজ তুমি শেষ রসগোল্লা…
I desperately need your rasgulla।”
ইনায়ার নাজুক, কোমল শরীরখানা শিউরে উঠলো।
সে বিছানার চাদর শক্ত করে মুঠোয় চেপে ধরলো।

তার সেই শিমুল তুলোর মত দেহখানা প্রিথমের চুম্বনে ও ছোঁয়ায় ধীরে ধীরে জেগে উঠছে।
চাঁদের আলোয় চোখাচোখি হলো দুজনের, আর তাতেই প্রিথম নিজের উপর থেকে সমস্ত নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললো।
রসগোল্লার মতো প্রিয় এই নারীর সঙ্গে সে আজ আর কোনো দূরত্ব রাখলো না—
শারীরিক, মানসিক, আত্মিক—সব বাঁধা ছিন্ন করে সে বিচরণ করতে লাগলো ইনায়ার দেহের প্রতিটি লোমে লোমে, আবেগের ঘূর্ণিতে।

ইনায়ার শরীর বারবার কেঁপে উঠছে প্রিথমের স্পর্শে—
কখনো আবেগে, কখনো ব্যথায়, কখনো সুখে, কখনো ভালোবাসায়।
আজ কোনো নিয়ম নেই, কোনো সামাজিক বালাই নেই, নেই কোনো দূরত্ব—
আজ শুধুই ভালোবাসার চরমতম উপলব্ধি।
দুটি মন, দুটি প্রাণ, দুটি আত্মা আজ এক বিন্দুতে মিলিত হলো।

তারা একে অন্যের অস্তিত্বে পূর্ণতা খুঁজে পেলো—ভালোবাসায়, আবেগে, তীব্রতম আকাঙ্ক্ষায়।
সেই কক্ষের চারপাশের দেয়ালে বাড়ি খেতে লাগলো ভালোবাসাময় মৃদু আর্তনাদ।
কাপোত-কাপোতীর গভীরতম মিলনের ধ্বনি যেন বাতাসে মিশে গেলো।
প্রিথমের সেই গভীর উন্মত্ততা ইনায়া বেশিক্ষণ সহ্য করতে পারলো না।
হঠাৎ করেই, গভীর আবেগে, সে প্রিথমের চুল দুহাতে মুঠো করে ধরে, কান্নামিশ্রিত কাঁপা কণ্ঠে আর্তনাদ করে ডেকে উঠলো—

“না প্লিজ প্রিথম… ব্যথা লাগছে।”
কিন্তু প্রিথম যেন সেই ব্যাকুল কণ্ঠ শুনলোই না।
সে ইনায়ার কপালে গভীর চুম্বন এঁকে, অধৈর্য, অসহায়, ব্যাকুল কণ্ঠে অজস্র ভালোবাসা মিশিয়ে আদর করে বললো

“আমার জান… আমার রসগোল্লা… আমার সোনা পাখি… একটু সহ্য করো নাও প্লিজ, না হলে আমি মরে যাবো।”
ইনায়া চুপ হয়ে গেলো আর, কোনো প্রতিরোধ করলো না।
সে চায় না প্রিথম ব্যথা পাক—কখনোই না।
সে ঠোঁট কামড়ে ধৈর্য ধরে নিদারুণ ব্যথা সহ্য করতে করতে, চোখের কোনায় জমে ওঠা নোনা অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে,
যেন নিঃশব্দে এক ভালোবাসার নদী বয়ে যাচ্ছে।
প্রিথমের উন্মাদনা আরও তীব্র হতে থাকে।
প্রিথম তার শুষ্ক ঠোঁটে একটুকরো আলতো চুমু খেয়ে অস্ফুট কণ্ঠে বলে,

“আমার রসগোল্লা… দুই-এক দিন গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
আর ব্যথা করবে না।
আই লাভ ইউ।”
ইনায়া কিছু না বলে শুধু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে প্রিথমকে,
যেন প্রিথমের হাতে তার সর্বস্ব সঁপে দেওয়ার বিশ্বাস।
তার ভালোবাসার রজনী যতই গভীর হতে থাকে, ততই ভালোবাসার গভীরতা ও বৃদ্ধি পেতে থাকে।
আর তাদের শরীরের নিচে অবহেলায় পৃষ্ঠ হতে থাকে ভালোবাসার প্রতীক চিহ্ন লাল গোলাপের পাপড়িগুলো নিরবে সাক্ষী হয় দুজনের ভালোবাসার।
গভীর রজনী, শুনশান নীরবতা চারিধারে বিরাজমান।
কেবল দুই-একটা নিশাচর প্রাণীর বিচরণ।
ব্যস্ত জীবকুলের প্রায় সকলেই বর্তমানে নিদ্রামগ্ন।
তবে ‘নিদ্রা’ শব্দটা যতই ছোট হোক না কেন, তার মর্মার্থ বিশাল।
এই ছোট্ট একটা শব্দে নিহিত থাকে অপার্থিব সুখ, শান্তি—
তাই এই সুখের জিনিসটা সকলে কি আর ছুঁতে পারে?
মনমস্তিষ্ক চঞ্চল, চিত্ত চৈতন্য, শান্ত না হলে নিদ্রা আসে না।
আর যাদের ভিতরে তুষের আগুন প্রতিনিয়ত ধিকিধিকি জ্বলে, তাদের জন্য বোধহয় এই জিনিসটা নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে চিরতরে।

তারা শত চেষ্টা ও এই নিষিদ্ধ সুখকে অর্জন করতে পারে না।
নিদ্রার দেশে পাড়ি দিতে তাদের জন্য উচ্চ মাত্রার ঘুমের ওষুধই ভরসা।
কিন্তু প্রতিদিন কি আর ওভাবে ঘুমাতে ভালো লাগে?
তাই কিছু মানুষ এই গভীর রজনীতেও জেগে থাকে।
কেউ দুঃখ বিলাস করে, কেউ জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির খাতা খুলে বসে।
এই রাত কারও কারও জন্য প্রেমের সুখের অতিমধুর,
আবার কারও জন্য তিক্ত, বিষাক্ত, যন্ত্রণাময় বিষাদময়।
তাদের কাছে নির্মল দক্ষিণা বাতাসও বিষাক্ত পবন মনে হয়।
তেমনি বেশ কিছু মানুষের বসবাস ‘এই শিকদার বাড়ি’তে।

অভিজাত ঐশ্বর্য আর চাকচিক্যে ভরা এই বাড়ির সুখ-পাখিটা কবে যে মরে গেছে, তার খোঁজ কেউ রাখে না।
এই বাড়ির সকলেই মুখোশধারী, প্রতিদিন চলতে থাকে তাদের ভালো থাকার অভিনয়।
আকাশের পূর্ণচন্দ্র তার চন্দ্রগোলায় দু’হাত ছড়িয়ে ধরনীর বুকে নেমে এসেছে।
আশেপাশে গভীর রাতের জোনাকি পোকারা রঙিন ডানা মেলে উড়ে বেড়াচ্ছে।
এই রাতের সৌন্দর্যে ও থাকে এক অন্যরকম শান্তি, যা নিদ্রামগ্ন বাসিন্দারা কখনো দেখতেই পায় না।
প্রণয় শিকদার বাড়ির বিশাল ছাদের উত্তর দিকে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
মাথার উপর ২০০ বছরের পুরনো বিশাল জাম গাছটা ভূতুড়ে লাগছে।
আঙুলের ফাঁকে তার জ্বলন্ত সিগারেট, যেটাতে সে কয়েক সেকেন্ড পরপরই সুখটান দিচ্ছে।
হয়তো প্রাণপণ চেষ্টারত ভিতরের জ্বলন্ত দহন-কান্ডের কিছুটা ধামাচাপা দিতে।
সিগারেটের তিক্ন আগুনটা সবাই দেখতে পায়,

কিন্তু ব্যক্তির হৃদয় জ্বলতে থাকা বিধ্বংসী সেই দহনলীলা কেউ দেখতে পায় না।
মানুষ শুধু মানুষকে ক্ষতবিক্ষত হতে দেখে,
যন্ত্রণা ছটফট করতে করতে মরতে দেখে,
কিন্তু কেউ দেখেনা নিরবে নিভৃতে একটা সুন্দর মনকে যন্ত্রণা ক্ষতবিক্ষত হয়ে নিস্তেজ হয়ে যেতে।
কেউ শোনে না তার করুন আর্তনাদ,
কেউ দেখেনা হৃদয়ের নিরব রক্তক্ষরণ।
মানুষ হত্যা করলে খুনের মামলা হয়, হৃদয়ের হত্যা করলে কি হয় না।
খুব কি ক্ষতি হতো,
যদি প্রনয়কে তার সুখপাখিটা দিয়ে দেওয়া হতো ?
খুব কি ক্ষতি হয়ে যেতো,
যদি তার বিরুদ্ধে এই নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্রটা না করা হতো?
খুব কি ক্ষতি হয়ে যেতো,
তাকে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দিলে?
খুব কি ক্ষতি হয়ে যেতো,

তাকে মানুষ থেকে জানোয়ারে পরিণত না করলে?
সে তো কখনো কারো ক্ষতি করেনি,
কখনো কারো সাথে পাছে থাকে নি, কিচ্ছু চায় নি,
শুধু মন থেকে, প্রাণ থেকে, আত্মার অন্তঃস্থল থেকে মাত্র এক জনকে চেয়েছিলো।
কিন্তু বিনা অপরাধে তার থেকে সে অতি আকাঙ্ক্ষিত জিনিসটাও কেড়ে নেওয়া হলো!
ছুড়ে মারা হলো তাকে অতুল যন্ত্রণার নীল সাগরে।
কেন তার থেকে তার বাঁচার কারণ লুপ্ত করা হলো—এ প্রশ্নের কোন উত্তর নেই।
কি অপরাধের শাস্তি সে পেল—সে এ প্রশ্নেরও কোন উত্তর নেই।
শুধু জানে সে নিঃস্ব হয়ে গেছে।
কার কাছে করবে সে এই অভিযোগগুলো?
কে দেবে এর উত্তর? কেউ নেই।

সত্যি বলতে, তাকে নিঃস্বার্থে এই পৃথিবীতে কেউ ভালোবাসেনি কখনো—কেউ না।
চিন্তা করতে করতে সিগারেটটা শেষ হয়ে হাতটা পুড়ে গেল নিমেষেই।
তবুও উফ পর্যন্ত করলো না প্রণয় , কারণ এগুলো তার কাছে ব্যথার কাতারেই পড়ে না।
সে রেলিং-এর ওপর রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে,
পুরুষালী কালছে লাল ঠোঁটে চেপে ধরলো।
চোখ বন্ধ করতেই হৃদয়ে বন্দী মুখটা চোখের পাতায় ভেসে উঠলো।
সঙ্গে সঙ্গে দৃশ্যপটে ভেসে উঠলো অতীতের কিছু সুখকর স্মৃতি সহ ভবিষ্যতের সম্ভাব্য কিছু দৃশ্য।
সাথে সাথেই চমকে চোখ খুলে ফেললো প্রণয়।
নিঃশ্বাসটা আটকে আসলো গলায়।

চোখের পলক ফেলবার আগেই চোখের কর্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়লো উষ্ণ কয়েক ফোঁটা তরল।
বেশি চিন্তা ভাবনা করতে গিয়ে সে জ্বলন্ত বুকের আগুনে ঘি ঢেলে দিয়েছে।
এখন তার নিশ্বাস নিতেও মনে হচ্ছে প্রাণ বেরিয়ে যাবে।
তবু ও সে ঠোঁটে ঠেসে হাসলো।
বুকে হাত দিয়ে অস্ফুটে বললো—
“কল্পনা করেই এভাবে কাঁদছিস, তাহলে নিজের চোখে দেখবি কিভাবে?
তোকে তো সচক্ষে দেখার সামর্থ্য রাখতে হবে।
সব না দেখে তুই মরতে পারবি না।
এই আবরার শিকদার প্রণয় তোকে মরতে দেবে না!
কি ভাবছিস এত নিষ্ঠুর কিভাবে হলাম?
কারণ আমি আর নিজেকে মানুষ হিসেবে মনে করি না।
তাই তোর মায়া আমি অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছি।
তুই যাকে বুকে শক্ত করে ধরে রেখেছিস,

যাকে ছাড়া দম ফেলতে পারিস না, সে কোনদিনও তোর হবে না।
বরং যা হবে, তা তুই সহ্য করতে পারবি না।
তাই যতক্ষণ যন্ত্রণা সহ্য করতে পারবি, ততক্ষণই বেঁচে থাকবি।
তোর আপনজনেরা তোর পিঠে ছুরি মেরেছে, এর থেকে বেশি আর তুই কী আশা করিস?”
হাতে থাকা দ্বিতীয় সিগারেটটা ও পুড়ে গেল।
প্রণয় আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে ঠোঁটে চেপে ধরতেই,
কেউ এক ঝটকায় সেটা বের করে নিলো।
চোখ বন্ধ রেখেই মৃদু হেসে ফেললো প্রণয়।
আগন্তুককে এক হাতে টেনে ধরে আচমকাই বুকে সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে শক্তপোক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরল।
স্তব্ধ হয়ে গেলো প্রিয়তা।

কিছু বলতে নিলে, প্রণয় ব্যথাথুর কণ্ঠে ধীরে বলল—
“শ্‌… চুপ, কোন কথা নয়… একটু থাক না জান… এভাবে।”
প্রিয়তার ও কী হলো কে জানে,
সে ও দুই হাতে শক্ত করে প্রণয়ের পিঠ জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করলো।
মিশে গেল প্রণয়ের বলিষ্ঠ পুরুষালি বক্ষে।
প্রাণভরে বড় বড় নিঃশ্বাসে হৃৎপিণ্ডে টেনে নিতে লাগলো।
পুরুষালি দেহের পরিচিত গন্ধটা।
প্রণয়ের বুক কাপছে অনবরত,
কানে বেজে যাচ্ছে শুদ্ধের বলা কথাগুলো।
প্রণয়ের ভীষণ কষ্ট হচ্ছে,

এই মুহূর্তে সত্যি তার খুব প্রয়োজন ছিল তার প্রাণপাখিকে অশান্ত বক্ষের সাথে চেপে ধরা।
ছোট্ট পাখিটাকে বুকে নিয়ে—নিজের জ্বলন্ত অশান্ত বুকটাকে একটুখানি সস্তি দেওয়া।
কারো প্রতি হয়ত এতটা নির্দয় হওয়া উচিত নয়।
প্রণয় আরো আষ্টেপৃষ্ঠে শক্ত করে তুলতুলে দেহটা নিজের পুরুষালী শক্ত সামর্থ্য বলিষ্ঠ দেহের সাথে মিশিয়ে নিলো।
মনে মনে আওড়াল—
“এই ব্যথাটা কবে জানি আমার জান নিয়ে নেয়…”
প্রিয়তার মাথাটা বুকে চেপে ধরে মনকে বললো—
“এবার একটু শান্ত হ,
এই যন্ত্রনাগুলো ভবিষ্যতের জন্য জমিয়ে রাখ…
আপাতত আমাকে আর জ্বালাস না, একটু খানি শান্তি দে।”
সত্যি, সত্যি…

প্রিয়তার স্পর্শে প্রণয়ের জ্বলন্ত হৃদয়টা শীতল হতে শুরু করলো।
২০ মিনিট পর, প্রণয় একটু শান্ত হলো। নিজের বুকে চেপে রেখে মৃদু ধমকে বললো,
“এত রাতে এখানে কী করিস তুই? ভয় করে না?”
প্রিয়তা উত্তর দিলো না, আরও গুটিসুটি মেরে প্রশস্ত বুকে মিশে গেল।
অনুভব করতে লাগলো প্রিয় পুরুষের হৃদস্পন্দন।
প্রণয় মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,
“রাত কয়টা বাজে জানিস? তোর ভয় করলো না এখানে আসতে? মাথার উপর দেখছিস ভূতুড়ে জামগাছ? এত রাতে ভূত-প্রেতের সঙ্গে গল্প করতে আসছিস?”
প্রিয়তা এবার মুখ খুললো, নিচু গলায় মিনমিন করে বললো,

“ভূত-প্রেতের সঙ্গে কেন গল্প করতে আসবো?
“তাহলে…’
“তাহলে আপনাকে ছাদে আসতে দেখেছি তাই…”
প্রণয় বুক ভরে প্রিয়তার চুলের সুমিষ্ট ঘ্রাণটা হৃদপিণ্ডে টেনে নিয়ে বললো,
“সে তো দেখেছি! আমার পেছন পেছন চোরের মতো আসছিলি!
এসেছিলি ভালো কথা, লুকিয়ে ছিলি কেন?”
প্রণয়ের কথায় চমকে উঠলো প্রিয়তা। ধরা পড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বললো,
“না মানে… যদি বকেন তাই…”

“তাহলে এখন সাহস জুটালি কীভাবে?”
প্রিয়তা প্রণয়ের বুকে মুখ গুঁজে দিতে দিতে বললো,
“আপনি একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছিলেন, তাই…”
হেসে উঠলো প্রণয়,
“তো আমি সিগারেট খেলেই তোর কী?”
প্রিয়তা একটু বাচ্চা সুলভ ভঙ্গিতে বললো,
“আপনি তো কত বড়! তার পরও এটা জানেন না—ধূমপান ক্যান্সারের কারণ।”
ঠোঁটের হাসি প্রশস্ত হলো প্রণয়ের।
কপালে অধর চেপে ধরে মনে মনে বলল,
বোকা মেয়ে, এইসব তুচ্ছ জিনিস প্রণয় শিখদার কিচ্ছু করতে পারবে না।
আমার হৃদপিণ্ডের ক্যান্সার তো তুই,

যা বাড়তে বাড়তে আমাকে মরণের পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
প্রণয়কে চুপ করে থাকতে দেখে আলতো চিমটি কাটলো প্রিয়তা,
“কি হলো? চুপ করে আছেন কেন?”
প্রণয় প্রিয়তাকে নিজের থেকে একটু আলাদা করে দাঁড় করালো।
ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“ওসব পরে বলবো, তুই আগে বল—
এমন রাত বিরেতে সবসময় ছাদে আশিস?”
প্রিয়তা ভয়ার্ত চোখে দুই পাশে মাথা নাড়ালো।
প্রণয় আসক্ত চোখে তাকিয়ে রইলো ষোড়শী রমণীর পানে।
মধ্যরজনীর পূর্ণ চাঁদের আলো এসে পড়ছে রমণীর দুধে, আলতো অঙ্গে।
এই রমণীর ভুবনমোহিনী রূপের কাছে চাঁদও যেন লজ্জা পাবে?
প্রণয় দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো,

“তাহলে আমাকে দেখে এসেছিস?”
উপর-নিচ মাথা ঝাঁকালো প্রিয়তা।
প্রণয় ভ্রু কুঁচকে দু’কদম এগিয়ে এলো।
চোখে চোখ রেখে বললো,
“কেন? ভয় করিস না আমাকে?”
প্রিয়তা মাথা তুলে অবুঝ চোখে তাকালো।
প্রণয় গালে আলতো হাত ছুঁইয়ে বললো,
“আমি একটা প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ।
আমার থেকে তোর যে কোনো মুহূর্তে, যে কোনো রকম বিপদ হতে পারে।
ভয় হয় না আমাকে?

যদি আমার ধারা তোর সর্বনাশ হয়ে যায়?
কয়েকবার তো অসংযত হয়ে তোর সাথে কত কিছু করেও ফেলেছি।”
প্রিয়তা ভয় পাওয়া তো দূর, প্রণয়ের কথায় লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।
নিজ উদ্যোগে প্রণয়কে জড়িয়ে ধরলো।
শুধু এক বাক্যে বললো,
“আপনি আমার সব।”
থমকালো প্রণয়।
আবার নিজের থেকে কিছুটা দূরে সরিয়ে দিলো।
কিছুটা কঠোর কণ্ঠে বললো,

“আজ থেকে তুই আর আমার আশেপাশে আসবি না।
তুই এখন আর ছোট নেই, বড় হচ্ছিস।
যত পারবি দূরে দূরে থাকবি।
আর ছোঁয়ার চেষ্টা তো একদমই করবি না।
এবার ঘরে যা।”
প্রণয়ের কঠোর কণ্ঠে বলা নিষ্ঠুর বাক্যে জল টলমল করে উঠলো প্রিয়তার চোখে।
অভিমানে মনের দু’কূল চাপিয়ে, চোখের পলক ফেলার আগেই ঝুম বৃষ্টি নামলো।
প্রিয়তার নিঃশব্দ অশ্রুতে ধক করে উঠলো প্রণয়ের হৃদপিণ্ড।
আবারও হৃদয় অনলে জ্বলতে শুরু করলো মন।
প্রিয়তা অশ্রু চোখে তীব্র অভিমানে চলে যেতে নিলে, তার আবার হাত টেনে ধরলো প্রণয়।
প্রিয়তা হাত মোচরাতে মোচরাতে অভিমানী কণ্ঠে বললো,
“ছাড়ুন আমাকে।

আর আসবো না আপনার সামনে, কথা ও বলবো না, আর দেখবেন না আমায়।”
প্রিয়তার বলা বাক্যগুলো প্রণয়ের বুকে গভীর পীড়া লাগলো।
এক টানে তাকে আবার বুকে জাপটে ধরলো।
জড়ানো কণ্ঠে বললো,
“তোকে না দেখে বাঁচবো কিভাবে?”
প্রিয়তার অভিমান কমলো না।
গাল ফুলিয়ে রইলো।
প্রণয় তাকে নিজ থেকে আলাদা করলো।
পেটের দুই পাশ চেপে ধরে উঁচু করে রেলিংয়ের উপর বসালো।
প্রিয়তার দুই পাশে হাত রেখে সেফটি দিলো।
কপালে উষ্ণ চুমু দিয়ে কোমল কণ্ঠে বললো,
“আমার কথায় অভিমান হচ্ছে জানি।
অভিমান করিস না।

তুই তো বুঝদার, বল—
যথেষ্ট বড় হয়েছিস, সব বুঝিস।
আর এটা বুঝিস না?
এখন আগের মতো আমার সাথে থাকা তোর মানায় না।
এত ঘনিষ্ঠতা থাকলে এখন আমাদের মধ্যে কার সম্পর্ক স্বাভাবিক থাকবে না।
কখন কি থেকে কি হয়ে যায়।”
প্রিয়তা অশ্রু চোখে তাকালো।
প্রণয়ের পেট জড়িয়ে ধরে বললো,
“অতো কিছু বুঝিনা, আমি শুধু আপনাকে বুঝি।”
দীর্ঘনিশ্বাস ফেললো প্রণয়।
আর কিছু না বলে চুপ করে চেয়ে রইলো।
এই পাখি যদি অন্যের হয়,

প্রণয় নিজেকে ধরে রাখতে পারবে না।
সে নিজেকে শেষ করে দিতে পারবে না ঠিকই,
কিন্তু হৃদপিণ্ডের ব্যথা সইতে না পেরে
নিশ্চিত কোনো না কোনো ভয়ংকর হৃদরোগে সে আক্রান্ত হবেই হবে।
দেহ সয়ে নিলেও মন কখনো সইতে পারবে না।
বুকের ভিতরের নরম মাংসপিণ্ডের এখনো বোধহয় অত ক্ষমতা হয়নি।
প্রিয়তা গোলচাঁদের দিকে তাকালো।
আকাশে থালার মতো বিরাট চাঁদ।
তারা নেই বললেই চলে।
প্রিয়তা চাঁদের দিকে তাকিয়ে হাসোজ্জ্বল কণ্ঠে বললো,
“আজকের চাঁদটা খুব সুন্দর, তাই না প্রণয় ভাই?”
প্রণয় প্রিয়তার হাসোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিউত্তর করলো,
“খুব সুন্দর।”

প্রিয়তা খুশি হলো।
কিন্তু কথার মধ্যেই যেন হাত পড়লো কিছু একটার উপর।
মনোযোগ নষ্ট হলো।
সেটা হাতে নিয়ে দেখলো সিগারেটের প্যাকেট।
প্রিয়তা সেটা নাকের কাছে ধরে বললো,
“ছিঃ, কি বিচ্ছিরি গন্ধ! এটা আপনি খান প্রণয় ভাই?”
প্রণয় ছোট করে বললো,
“হুম।”
প্রিয়তা অসন্তুষ্ট হলো।
মুখ বিকৃত করে পুনরায় বললো,

“ছিঃ, আগে তো এসব ছাই পাস কখনো খেতে দেখিনি। এখন খান কেন?”
প্রণয় বেদনাতুর হেসে বললো,
“আগে খাওয়ার কারণ ছিল।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকালো,
“তাহলে এখন কারণ আছে?”
“হুম।”
“কি কারণ?”
“মরে যেতে চাই না।”
প্রিয়তা আশ্চর্য হলো।
চোখ বড় বড় করে বললো,
“কি? এটা না খেলে কেউ মরে যায়? বরং এটা খেলে মানুষ মরে!”
প্রণয় ধীর কণ্ঠে বললো,
“কিন্তু আমি না খেলে মরে যাবো।”
প্রিয়তা কপাল কুঁচকে বললো,

“কি সব উল্টাপাল্টা লজিক! আজ থেকে আর এটা আপনি খাবেন না।”
বলে ফেলে দিতে নিলে হাত চেপে ধরলো প্রণয়।
প্রিয়তার হাত থেকে প্যাকেটটা নিতে নিতে বললো,
“এমন করিস না জান। আগে আমার কাছে এটার বিকল্প ছিল। এখন আর সেই বিকল্প নেই। পৃথিবীতে সবাই ছেড়ে গেলে এটা আমাকে কোনোদিনও ছাড়বে না।”
প্রিয়তা যেন বিস্ময়ের শেষ নেই।
এই লোকের কি মাথা খারাপ?
কি সব বলে!
প্রিয়তা নাছরবান্ধা।

প্রণয়ের হাত থেকে প্যাকেটটা নিয়ে অন্ধকারে ছুঁড়ে মারলো।
দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
“কি সব উল্টাপাল্টা কথা! এত কিছু জানি না, খাবেন না, মানে খাবেন না!”
প্রণয় বুকটা আবারো জ্বলে উঠলো,
মনে মনে বললো,
“এটা না খেলে কিভাবে বাঁচবো আমি?
যখন তুই থাকবি না, তখন বুকের ব্যথা কী দিয়ে চেপে রাখবো?
সইতে পারবো না আমি।”
প্রিয়তা মৃদু কণ্ঠে ডাকলো,
“কি ভাবছেন?”
প্রণয় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললো,
“কিছু না।”
প্রিয়তা আবদার করে বললো,
“প্রমিস করেন, আপনি আর খাবেন না।”
কিন্তু কিছু বললো না প্রণয়,

শুধু আকাশ পানে চেয়ে থেকে বললো,
“আকড়ে ধরার জন্য মানুষের কিছু না কিছু প্রয়োজন হয়।
যখন আমার প্রাণ পাখি আমার ছিল, তখন আমার পৃথিবী অন্যরকম ছিল, এসবের প্রয়োজন ছিল না।
এখন আর আমার প্রাণ পাখি আমার নেই, তাই আমি এটাকে আঁকড়ে ধরেছি।
যখন সে অন্যের হবে, তখন হয়তো এর সাথে আরও কিছু যোগ হবে।
পুরুষ মানুষ আকড়ে ধরার জন্য দু’টোর মধ্যে একটার প্রয়োজন হয় জান।
দুটোর মধ্যে যে কোনো একটা নেশায় তাকে ডুবে থাকতে হয়।”
প্রণয়ের অদ্ভুত কথার আগা-মাথা প্রিয়তা কিছুই বুঝলো না।
তবুও ও অবুঝের মতো প্রশ্ন করলো,

“কোন দু’টা?”
প্রণয় প্রিয়তার পানে চেয়ে হাসলো।
তার রক্ত লাল ঠোঁটে পানে চেয়ে বললো,
“কিছু না।
এখন চল, অনেক রাত হয়েছে।”
প্রিয়তা রাজি হলো না।
রেলিং থেকে নেমে গিয়ে ছাদে লাগানো বড় দোলনায় বসলো।
প্রণয় ও গিয়ে তার পাশে বসলো।
প্রিয়তা তার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে বললো,
“ঐ পাশে বসুন।”

প্রণয় বাক্য ব্যয় না করে দোলনার এক প্রান্তে বসলো।
প্রিয়তা সুন্দর মতো তার উরুতে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো।
কমর জড়িয়ে ধরে পেটে মুখগুজে বললো,
“গুড নাইট।”
হাসলো।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৫

প্রণয় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চুলের ক্লিপটা খুলে পাশে রাখলো।
সাথে সাথেই দুই হাত সমান লম্বা চুলগুলো তর তর করে ছাদের মেজেতে লুটিয়ে পড়লো।
প্রণয় ধীরে ধীরে সবগুলো নিজের বা হাতে পেঁচিয়ে নিলো।
ডান হাতে চুলে বিলি কাটতে কাটতে বললো,
“গুড নাইট প্রিন্সেস।”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৪৭