ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৫

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৫
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

রাত ১২টা বেজে ১৫ মিনিট। রাজপ্রাসাদের মতো শিকদার বাড়ি মৃত্যুপুরীর মতো নিঝুম নিস্তব্ধতায় ঢাকা পড়ে আছে। বাড়ির ছোটো বড়ো প্রত্যেক সদস্যই গভীর তন্দ্রা মগ্ন। আজ আর কারো সেহরি পর্যন্ত জেগে থাকার বা আড্ডা দেওয়ার মতো এনার্জি হয়নি। বিধায় ফোনে রাত তিনটার অ্যালার্ম সেট করে তারাবির নামাজ পড়েই, যে যার মতো ঘুমিয়ে পড়েছে। আর কারো কারো কোনো সারা শব্দ মেলেনি। আজ যেন সবার ঘুম একটু বেশি গভীর—ক্লান্ত থাকলেও সচরাচর এমনটা হতে দেখা যায় না। হয়তো এর পেছনেও গভীর কোনো রহস্য আছে, কে জানে।
তবে এই মরণ ঘুমের ফাঁদ থেকে রক্ষা পায়নি প্রিয়তা ও। সে ও পাশ বালিশ বুকে জড়িয়ে গভীর নিদ্রায় তলিয়ে আছে, যেন চেতনাই নেই তার। তবু ঘুমের মধ্যেই কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে, অবচেতন মনে ও অনুভব হচ্ছে কেউ হয়তো তাকে অনেকক্ষণ থেকে ডাকছে বা জাগানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু সেই অসহ্য রকমের ঘুমের জন্য সে দৃষ্টি মেলে তাকাতে পারছে না। সারাটা শরীর যেন আলস্যের সাগরে ডুবে আছে। চোখের পাতা দুটো ভার—মেলতে গেলেই জ্বালা করে উঠছে। তাই সব কিছু অগ্রাহ্য করে ঘাপটি মেরে পড়ে আছে প্রিয়তা। কিন্তু সেই ব্যক্তি ও যেন আজ পণ করে নিয়েছে—প্রিয়তাকে সে জাগিয়েই ছাড়বে। উফ,!

প্রিয়তা এবার অনুভব করল, কেউ তার দুই গালে হাত রেখে আলতো চাপর দিয়ে দিয়ে ডাকছে। এত ডাকাডাকিতে এবার প্রচণ্ড বিরক্ত হলো প্রিয়তা। ঘুমের মধ্যেই নাক কুঁচকে ঠোঁট উল্টালো। নিজের বালিশ ছেড়ে ঝাঁপটে ধরল সেই ব্যক্তির কোমর। ঘুমের ঘোরে নরম শিমুল তুলোর বালিশটা ছুড়ে ফেলে সেই ব্যক্তির উরুতে মাথা রাখে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে পেটে মুখ গুঁজে দেয়। সাথে সাথেই হৃদপিণ্ড তার প্রিয় মাদকটা পেয়ে যায়। আর প্রিয়তা ও তলিয়ে যেতে নেয় সেই সুখের অতলে। নিদ্রা আরো ভারী হয়ে ওঠে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

কিন্তু প্রিয়তার এত সুখ যেন সহ্য হলো না সেই ব্যক্তির। তার বাঁকা পথ অবলম্বনে প্রিয়তার এবার দম বন্ধ করা অনুভূতি হতে লাগল। শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি বেড়ে গেল বহুগুণ। শিউরে শিউরে উঠতে লাগলো মখমলে দেহখানা। তার সারা মুখ জুড়ে উষ্ণ নরম ভেজা কিছুর অস্তিত্ব অনুভব হতে লাগল। এবার যেন আর মটকা মেরে পড়ে থাকতে পারল না প্রিয়তা। ঢুলু ঢুলু ঝাপসা চোখ মেলে তাকালো। অস্ফুটে ডাকলো—প্রণয় ভাই…
প্রণয় ওর মুখের উপর ঝুঁকে ওর দিকেই কেমন ঘোর লাগা তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তার বাদামি চোখের কালো মনিতে উপছে পড়ছিল নিখাদ ভালোবাসা। ঘুম পরীর ঘুম ভাঙাতে তার মন টানছিল না। মন বলছিল, হৃদয়ের অন্তঃপুরের ঘুমন্ত পরী, সে ঘুমাক না আর কিছুক্ষণ, আমি ততক্ষণ দু’নয়ন ভরে দেখি। কিন্তু ভাবনা আর বেশি দূর এগোনোর সময় পেল না প্রণয়। প্রিয়তা তার বুকে কাছের টি-শার্ট দুই হাতে টেনে ধরল। অন্যমনস্ক থাকায় প্রিয়তার একদম মুখের সামনে ঝুঁকে পড়ল প্রণয়। হয়তো আর সেন্টিমিটারের দূরত্ব—এটুকু ঘুচে গেলেই নিঃশ্বাসের মিলন ঘটবে। প্রিয়তা তার গালের কাছে মুখ নিয়ে আধো আধো ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বিড়বিড় করে বলল— “আরেকটু ঘুমাই না, প্রণয় ভাই… ভীষণ ঘুম পাচ্ছে তো… আপনি ও আমার পাশে ঘুমিয়ে পড়ুন।”

প্রিয়তার ঘুম জড়ানো আধো আধো কণ্ঠস্বরটা তীরের মতো ছুটে এসে প্রণয়ের হৃদপিণ্ডে লাগল। কিন্তু প্রিয়তার কথার জবাব দিল না প্রণয়। নিজেকে ধাতস্থ করে প্রিয়তাকে এক টানে শুয়া থেকে বসিয়ে দিল। ঘটনার আকস্মিকতায় হতবম্ভ হয়ে গেল প্রিয়তা। ঘুম জড়ানো চোখে পিটপিট করে তাকালো প্রণয়ের দিকে। প্রণয় কিছু বলবে, তার পূর্বেই প্রিয়তা আবার প্রণয়ের বুকে হেলে পড়ল। দুর্বল মুঠোয় টি-শার্টের একাংশ চেপে ধরে আগের মতোই ঘুমু ঘুমু কণ্ঠে অভিযোগ করল— “আপনি খুব পঁচা প্রণয় ভাই… আপনাকে আমার সাথে ঘুমাতে বললাম বলে… এভাবে তুলে দিলেন! আপনি খুব খুব পঁচা! আপনার সাথে কথা বলবো না,যান?”

প্রিয়তাকে শিশুসুলভ ভঙ্গিতে অভিযোগ জানাতে দেখে বুকটা তুলপাড় করে উঠল প্রণয়ের। বাচ্চাটাকে সেই আগের মতো বুকে নিয়ে একটু আদর করার জন্য মনটা ব্যাকুল হয়ে উঠল। কিন্তু মনের সেই অদম্য ইচ্ছাটাকে প্রশ্রয় দিল না প্রণয়। অনুভূতিটা গিলে নিয়ে প্রিয়তার মাথায় হাত রাখল। কণ্ঠে কোমলতা এঁটে স্নেহের সহিত মৃদু ধমকে বলল— “তোক তখন পায়েশটা খেতে বারণ করছিলাম না… তাহলে বাটি ভরে কেন খেলি?”
প্রণয়ের আদুরে ধমকে গাল ফুলিয়ে ফেলল প্রিয়তা। আবারও সেই ঘুম জড়ানো অলস কণ্ঠে প্রত্তুতর করলো— “শুধু শুধু বকবেন না, প্রণয় ভাই… তখন সবাই বলছিল এটা নাকি অনেক ভালো হয়েছে, আর বড় আম্মু ও অনেক জোর করছিলেন তাই…”

—”প্রণয় দীর্ঘশ্বাস ফেলে অসহায় কন্ঠে বলল, তাই, তুই বড়ো বাটি দিয়ে পুরো এক বাড়ি মেরে দিলি!” চুপসে গেল প্রিয়তা। প্রণয়ের বুকের ঘ্রাণ নিতে নিতে বলল— “একটুই তো খেয়েছি… প্লিজ বকবেন না… আসলে ওটা অনেক মিষ্টি ছিল, তাই লোভ সামলাতে পারি নি… প্লিজ…”
তাই মেডিসিন মেশানো পায়েসটা এত মিষ্টি ছিল।
সাথে সাথেই দুই পাশে তড়িৎ বেগে মাথা নাড়ালো প্রিয়তা, তীব্র বিরোধিতা জানিয়ে বলল মিষ্টি ছিল, কিন্তু ওটার থেকে বেশি নয়, ওটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মিষ্টি, ওটা আমি বারবার খেতে চাই।
প্রিয়তার কথায় কেমন সন্দেহ হলো প্রণয় এর ভ্রু বাকিয়ে প্রশ্ন করল, “কোনটা?”

প্রিয়তা এবার ওর বুকের সাথে আরেকটু মিশে গেলো লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে বলল, “আপনার ডার্ক রেড লিপ্স…যেরকম সুন্দর দেখতে ওরকম সুন্দর খেতে, অনেক ইয়াম্মি… ওটা আরেকটু খেতে দিবেন?”
প্রিয়তার এমন সোজা সাপ্টা জবাবে কেশে উঠলো প্রণয়। বিস্মিত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকালো, ভ্রু নাচিয়ে বলল, “তুই এমন নষ্ট চোখে দেখিস আমায়? আগে তো জানতাম না।”
প্রিয়তা পুনরায় ঘুমজড়ানো কণ্ঠে বিরোধিতা করে বলল,
“হ্যাঁ, আপনাকে নষ্ট চোখে দেখি তো কী হয়েছে? আপনাকেই তো দেখি… পাশের বাড়ির মোখলেসকে তো আর দেখতে যাই না!”

প্রণয় আর বিরোধিতা করার ভাষা খুঁজে পেল না এই কথার প্রেক্ষিতে আর কী বলবে সে?
সে যে বড্ড দুর্বল পুরুষ। তার উপর এই মেয়ে যদি এভাবে ভালোবাসার দাবি জাহির করে, তাহলে নিজেকে কিভাবে সামলে রাখবে প্রণয়?
তার জন্য যে সামনের পথটা আরও বেশি যন্ত্রণাময় হয়ে উঠবে—যেখানে সে পরিষ্কার জানে, তার ভালোবাসাটা একতরফা নয়।
প্রণয় কিভাবে তখন নিজের অনুভূতির উপর নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখবে?
এটা যে তার সাধ্যসীমার মধ্যে নেই।
আসলে, যারা একবার নিজের অনুভূতির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে—তারা আর কখনো সেই বাড়তে থাকা অনুভূতির উপর লাগাম টানতে পারে না।

কখনোই না।
প্রথমে সেই আবেগ হয়তো জন্মায় মনের কোনো এক কোণে, নিঃশব্দ শান্ত ছোট্ট এক সরোবরের ন্যায়—খুব নিরীহভাবে।
কিন্তু তাকে যদি সেখানেই থামিয়ে দেওয়া না হয়, বা তার পরিমাপ বেঁধে দেওয়া না হয়—তখন সেই নিরীহ অনুভূতিই রূপ নেয় বিশাল, অস্থির এক উত্তাল নোনা সাগরে…
যার স্রোত নিজের মতো করে দিক বদলায়, ঢেউ তোলে, ভাসিয়ে নিয়ে যায় সমস্ত কিছু।
আর তখন সেই ব্যক্তির, যাঁর ভিতরেই এই অনুভূতির সাগর জন্ম নেয়—তার কিছুই করার থাকে না।
সে কেবল অপার অসহায়তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে…
তার নিজেরই হৃদয় কিভাবে প্রতিনিয়ত একটু একটু করে গ্রাস করে ফেলছে।
তাই হয়তো গুণীজনেরা বলেন, বাড়াবাড়ি রকমের কোনো কিছুই ভালো নয়।
সবকিছুর উপরেই ব্যক্তির নিজের নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি—এটাই তার বেঁচে থাকার সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ।
কিন্তু এই জায়গাতেই বড্ড বাজেভাবে হেরে গেছে প্রণয়।

আর এর জন্য সে নিজেই সব থেকে বেশি দায়ী।
হয়তো সে নিজেকে কখনো আটকাতেই চায়নি।
হয়তো সে চেয়েছিল, সেই অনুভূতি একটু একটু করে বাড়ুক… আরও বাড়ুক… যতটা বাড়তে পারে, মনের সর্বত্র ছড়িয়ে যাক—
চাইলেই তো আর সব অনুভব থামানো যায় না।
আর থামানোর কারণও ছিল না…
সে দেখেছে, অনুভূতিরা সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে, তবুও সে তাদের স্বাধীন রেখেছে।
চুপ করে চোখ বুজে দাঁড়িয়ে থেকেছে, যেন নিজের ভিতরের কোনো নিষিদ্ধ বৃক্ষকে সে নিজেই পানি দিচ্ছে।
আর সেই গোপন বৃক্ষই সময়ের সাথে সাথে অনুভূতির ডালপালা মেলে ছড়িয়ে পড়েছে তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে।
সন্তর্পণে শিকড় গেড়েছে হৃদয়ের অতল গহীনে—

অতটা গভীরে, বোধ হয় প্রণয়ের কল্পনাশক্তি পৌঁছাতে পারে না।
তার সারা শরীর পাপে ঝলসে যাচ্ছে, অথচ ওই একটা টুকরো জায়গা যেন জান্নাতের বাগান।
কিন্তু যখন সবকিছু তার নিয়ন্ত্রণের অনেক বাইরে…
যখন সে একেবারে অচল, একেবারেই নিঃস্ব, অপারক, পরনির্ভরশীল—
তখনই একটা প্রচন্ড কালবৈশাখী ঝড় এসে তার গোটা জীবন তছনছ করে দিলো।
তার সকল চিন্তা আর সকল কল্পনা… তার সব উলটপালট করে দিল, একেবারে নিঃস্ব করে দিলো তাকে ভেতর থেকে।

তখন আর কিছুই ফেরানোর ছিল না।
প্রণয় তখন আর চাইলেও থামাতে পারত না সেই উথাল-পাথাল অনুভূতির জোয়ার।
আর আজও সেই অনুভূতি তার ভিতরে তীব্র সাগরের স্রোতের মতো প্রবাহিত হচ্ছে—
প্রতিদিন… অনিয়ন্ত্রিতভাবে বেড়েই চলেছে …
যার থামার কোনো নামগন্ধ নেই।
এই অনুভূতিরা বড় নির্মম, বড় বিশ্বাসঘাতক।
এরা জন্ম নেয় আমাদের হৃদয় থেকেই—
তবুও আমাদের কথা শোনে না, নিজেদের পথ নিজেরাই ঠিক করে নেয়।
যার বুকের গহীন কোণে তারা বাসা বাঁধে, তার চোখের দিকে তারা ফিরে ও তাকায় না।
বরং সেই বুকেই থেকেই অন্য কারো নামে দাসত্ব করে…
আর সেই ব্যক্তিকেও প্রতিনিয়ত বাধ্য করে—আগুন জেনে ও তাতে ঝাঁপ দিতে।
তারপর ফেলে রাখে—

তীব্র অনুশোচনার আগুনে দগ্ধ হয়ে…
ধীরে ধীরে ছাই হয়ে যেতে।
তাই প্রণয়ও জানে, সে ও একদিন ছাই হয়ে যাবে।
মাটির সাথে মিশে যাবে।
শতকোটি পাপের ভিড়ে—হয়তো এই ভালোবাসাটুকু ছাড়া আর ভালো কিছু মিলবে না তার ঝুলিতে।
তবে সত্যি বলতে, সেদিন এই ভালোবাসাটুকুও পাপ হিসেবে গণ্য করা হবে।
মানে, পুরো জীবনটাই পাপ—মাথা থেকে পা পর্যন্ত, পুরোটা পাপ।
জাহান্নামের সবচেয়ে নিচু স্তরের আগুন তার জন্য অপেক্ষা করছে—এ বিষয়ে সে নিশ্চিত।
কি সুখের জীবন তার—পৃথিবীতেও জাহান্নাম, মৃত্যুর পরেও জাহান্নাম।
আত্মার শান্তি যেন কোথাও নেই।

এত মন্দ ভাগ্যলিপি নিয়ে কারোরই জন্মানো উচিত নয়।
এসব ভাবতেই কলিজা ছিড়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস বেরিয়ে এলো প্রণয়ের।
সে কিছুক্ষণ চুপ থাকে।
প্রিয়তার চুলে মুখ গুঁজে দিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে নেয়।
আদুরে কণ্ঠে বলে—
“খুব ঘুম, তো? ঠিক আছে, ঘুমা। আমি এসেছিলাম তোকে একটা জায়গায় নিয়ে যেতে…
কিন্তু তুই যখন যাবি না, তখন আর কী! আমি একাই চলে যাবো…”
বলেই উঠতে নিলে, প্রিয়তা তার ডান বাহু আঁকড়ে ধরল।
কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে বিরবির করে বলল—
“আমাকে ফেলে যাবে না, প্লিজ… কোথায় যাবেন আমি ও যাবো… আমাকে ও নিয়ে চলুন…”
বলে আবারও চোখ বন্ধ করে ফেলল।
প্রিয়তার ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যাওয়ার চিন্তা-ভাবনা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলল প্রণয়।
হতাশ কণ্ঠে বলল—

“তুই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে যাবি?”
প্রিয়তা ও ছোট্ট পরিসরে জবাব দিল—
“উঁহু… আপনার কোলে চড়ে যাবো… নিন, কোলে নিন…”
বলে সামনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল প্রিয়তা।
প্রিয়তার মুখের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো প্রণয়।
প্রিয়তার কানের লতিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বললো,
“ঘুম পরী, তোর ঘুম… আমি এখুনি ছুটাচ্ছি… Just wait and see…”
বলেই পাজ কোলে তোলে নিল প্রিয়তাকে।
বিছানা থেকে নেমে ধীর কদমে হাঁটা দিলো ওয়াশরুমের দিকে।
প্রিয়তার এতে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা গেল না।
সে প্রণয়ের শরীরের মাতাল করা গন্ধে বুঁদ হয়ে আছে।
তার নার্ভ সিস্টেম এখনো ঠিকমত কাজ করছে না।

ঘুমের মেডিসিনের প্রভাব এখনো প্রখর ভাবে মস্তিষ্কে গেঁথে আছে।
কিন্তু শরীরের উপর তীব্র শীলত সুচ ফোটানোর মতো কিছু আঁচড়ে পড়তেই ধড়ফড়িয়ে জেগে উঠলো প্রিয়তা।
তার সকল ঘুম আর ঘ্রাণের মাতলামি এক ঝাপটা ঠান্ডা পানির ছিটায় পালিয়ে গেল।
ঢোক গিলে চোখ বড় বড় করে তাকালো ওপরে—
প্রণয় ওর দিকেই এক ভ্রু তুলে তাকিয়ে আছে।
প্রিয়তা চোখ মেলতে দেখেই কোল থেকে নামিয়ে দিল প্রণয়।
শাওয়ারের নিচ থেকে দুই কদম পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো,
বুকে হাত গুজে, ভ্রু নাচিয়ে বললো—
“এখনো তো ঠিকই উঠলি।
কিন্তু তখন কত আদর করে ডাকলাম, জান পাখি বলে ডাকলাম, তাও উঠলি না!
ঠিকই আছে…

যে রোগের, যে দাওয়াই…
তোর জন্যই এটাই পারফেক্ট।”
প্রণয়ের দূরে দাঁড়িয়ে নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলা বাক্যগুলোতে হতবম্ভ হয়ে গেলো প্রিয়তা।
বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের দিকে।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে ভিজে একেবারে চুপচুপে হয়ে গেল।
প্রণয়ের বলা সব কথাই তার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল।
ঘুম থেকে জেগেছে তো সে এখন—তাই একটু আগে কী বলেছে, কী করেছে, তার সব কথাই প্রিয়তার অবচেতন মস্তিষ্ক ভুলে গেল।
প্রণয় ভাই এই সময় এখানে কেন?
আর সেই বা এই মাঝরাতে শাওয়ারের নিচে কী করছে?
সেটাই ঠিক বুঝতে পারলো না প্রিয়তা।
সে কি স্বপ্ন দেখছে?

নাকি আসলেই এগুলো তার সাথে ঘটছে?
প্রিয়তার মনের ভাব বুঝতে পেরে হেসে ফেললো প্রণয়।
শাওয়ার অফ করে একটা সাদা তোয়ালে এনে প্রিয়তার চুলে জড়িয়ে দিলো।
প্রিয়তাকে বিস্ময়ের আকাশে ঝুলিয়ে রেখেই ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে গেলো প্রণয়।
প্রিয়তার ওয়ার্ডরোব খুলে একটা সুন্দর ফুল স্লিভ হোয়াইট লং টু-পিস বের করে এনে প্রিয়তার হাতে দিলো।
চোখে চোখ রেখে আদেশের সুরে বললো—
“Just 10 minutes এর মধ্যে চেঞ্জ করে বের হবি।
Without any excuse.”

প্রিয়তা বিস্মিত চোখ জোড়া একবার প্রণয়কে ছেড়ে জামার দিকে চাইলো,
অতঃপর আবার মাথা তুলে প্রণয়ের দৃষ্টিতে দৃষ্টি নিবদ্ধ করল।
কারণ এটা বাসায় পরার জামা নয়।
তাহলে এটা সে এই রাতের বেলা কেনই বা পড়বে?
প্রিয়তার ভেজা চোখের প্রশ্নটা ঝট করে পড়ে ফেলল প্রণয়।
তার ডার্ক রেড ঠোঁটে রহস্যময় বাঁকা হাসি ঝুলিয়ে প্রিয়তার দিকে দুই কদম এগিয়ে এলো—
প্রিয়তার ভেজা কানের লতিতে হালকা ঠোঁট ছুঁইয়ে মৃদু আওয়াজে বললো—
“Surprise.”
সামান্য কাঁপলো প্রিয়তা।
প্রণয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলো—এই রাতে আবার কী surprise?
প্রণয়ের শরীরও অনেকটাই ভিজে গেছে।
চেঞ্জ করা জরুরি।

তাই নিজের ভেজা চুলগুলো ব্যাকব্রাশ করে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো—
“Just 10 minutes. Okay, baby girl?”
বলেই চলে গেলো প্রণয়।
আর প্রিয়তা থমকে রইল তার বলা শেষ বাক্যটাতে।
কয়েক সেকেন্ড মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থেকে পুরো ব্যাপারটা হজম করে নিলো প্রিয়তা।
নিশ্চয়ই বিশাল কোনো ঘাপলা আছে আজ।
না জানি আবার কী দেখতে হবে!
তবে যা হবে, দেখা যাবে।
তাই সে ও আর নিজের ফাঁকা মাথায় ঢোল বাজালো না।
প্রণয়ের কথা মতো ড্রেসটা চেঞ্জ করে বেরিয়ে এলো।
সত্যি বলতে, সে ও ভিতরে ভিতরে ভীষণ খুশি।
সেটা এই জন্য নয় যে প্রণয় তাকে কোনো surprise দেবে,
বরং এই জন্য যে সে—এই মাঝরাতে সেজেগুজে প্রণয় ভাইয়ের সঙ্গে ঘুরতে যাবে!
আজ পাক্কা দুই বছর পর, আবারও তারা মাঝরাতে লুকিয়ে ঘুরতে বেরোবে।
প্রিয়তা মাথা থেকে ভেজা তোয়ালেটা খুলে আয়নার সামনে এসে দাঁড়ালো।
সিম্পল সাদা রঙা ড্রেসটা প্রিয়তার উজ্জ্বল গৌরবর্ণ দেহের সঙ্গে মিলেমিশে একদম একাকার
যেন একটুকরো সাদা মেঘ।

তার ভেজা চুলের পানিতে সাদা জামার পিঠটা হালকা হালকা ভিজে উঠছে,
তবে সে দিকটায় খেয়াল নেই প্রিয়তার।
সে ব্যস্ত ভঙ্গিতে সামনে আসা চুলগুলো আলগোছে কানের পিঠে গুঁজে নিলো,
বাঁ হাতে ড্রয়ারটা খুলে একটা বিশাল বড় সাদা বক্স বের করলো—
পুরো বক্স ভর্তি নানা ধরনের অক্সিডাইজ ঝুমকার কালেকশন।
প্রিয়তা সেখান থেকে এক জোড়া মাঝারি সাইজের ঝুমকা বের করে ফটাফট পরে নিলো।
এই ঝুমকাগুলো প্রণয় ভাই তাকে কয়েক মাস আগের মেলায় কিনে দিয়েছিলেন।
প্রিয়তা একটা কিটক্যাট খেতে খেতে দুনিয়ার একগাদা মেকআপ প্রোডাক্ট বের করল, কিন্তু একটা ও মুখে দিলো না।
সেগুলো একটা সিম্পল পলিথিন বেগে ভরে রেখে দিল, কারণ এগুলো সে ঝুলেখা আপা কে দিয়ে দেবে।
তার মেকাপ করতে কোন কালেই ভালো লাগেনা।
এগুলো সে কিনেছিলো পৃথার বিয়ের সময়, বিয়ে শেষ, এগুলোর কাজও শেষ।
কারণ তার মতে, তার স্কিনটোনের উপর একদম লাইট সেইডের ফাউন্ডেশন দিতে হয়,
আর যেটা একদমই দেখা যায় না।

তাহলে এগুলো দিয়ে কি লাভ? পুরাই এক গাদা আবর্জনা।
তাই প্রিয়তা এগুলো সাইডে রেখে ডানপাশে ড্রয়ার খুলে Apple Watch এর কালেকশন বের করলো।
সেখান থেকে বেছে বেছে একটা কালো বেল্টের Apple Watch হাতে পরে নিলো।
চোখে কাজলের বদলে হালকা করে eyeliner দিলো, ঠোঁটে হালকা strawberry flavor লিপগ্লস, ব্যাস, তার সাজ কম্পলিট।
তবে চুলের আর কোনো গতি করল না।
হাঁটু ছুঁয়ে নামা ভেজা চুলগুলো বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে টুপটাপ…
প্রিয়তা সাজ শেষ, সে বেখেয়ালি মনে আয়নায় চোখ রাখতেই, তার দৃষ্টি যেন এক মুহূর্তের জন্য স্থির হয়ে গেলো।
নিজের মিষ্টি চেহারার দিকে তাকিয়ে, নিজেই একটা ছোট খাটো ক্রাশ খেয়ে বসলো।
তার টমেটোর মতো লাল লাল গাল দুটোতে ব্লাসার ছাড়াই, লজ্জা মিশ্রিত স্নিগ্ধ গোলাপি আভা ছড়িয়ে পড়তে লাগলো।

দৃষ্টি নুইয়ে হালকা হাসলো প্রিয়তা।
অত:পর, আবার লজ্জা রাঙা মুখটা আয়নায় তুলে ধরতেই, তার বুকের ভেতর দুর্বল জমিটা ভূমিকম্পের ন্যায় কেঁপে উঠলো।
কম্পিত নিলাভ চোখের মণি দুটো স্থির হলো উল্টো দিকের দরজায়।
আবারও সেই চেনা মানুষের চোখের অচেনা দৃষ্টিতে কাঁটা দিয়ে উঠলো প্রিয়তার অঙ্গে।
সে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলো না ওই নেশালো দুই চোখে, মানুষটার ওই চোখ দুট যেন গভীর কোন নেশার সাগর, যার দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকলে ঘোর লেগে আশে মস্তিষ্কে,
বিধায় প্রিয়তার অক্ষিযোগল আপনা আপনি বন্ধ হয়ে এলো লজ্জায়।
প্রণয় সম্মোহিতের মতো এগিয়ে এলো প্রিয়তার দিকে।
প্রিয়তমার এই শুভ্র ভেজা রূপের সৌন্দর্যে সামলে উঠতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তার।
ওই নীলোভ চোখের অবুঝ চাহুনিতেই যেন তার মরণ লেখা আছে।
প্রিয়তা দৃষ্টি নত।

তার বুকটা কেমন অসস্বাভাবিক ভাবে ডিপ ডিপ শব্দ করছে,
তার নাজুক দেহ খানা বারংবার শিউরে ওঠছে অকারণেই।
কিন্তু ঘাড়ে কারো উষ্ণ নিঃশ্বাসের পরশ পেতেই রক্ত জমে যায় প্রিয়তার, নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠে মুহূর্তেই।
ভেজা চুল থেকে ছুটে আসা সেই পরিচিত শ্যাম্পুর ঘ্রানে উন্মাদ হয়ে যায় প্রণয়ের মন, অবশ হয়ে আসে হৃদপিণ্ড।
সে নিজের অবুঝ অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতির তাড়নায় না চাইতে ও মুখ গুঁজে দেয় প্রিয়তার সুগন্ধিত ভেজা চুলে।
প্রেম পিপাসু উন্মাদ প্রেমিকের মতো নিঃশ্বাসে আহরণ করে নিতে থাকে সেই সুগন্ধিত মাধক।
প্রণয়ের নিঃশব্দ স্পর্শে নিঃশ্বাস কেঁপে উঠে প্রিয়তার।
চোখ কুঁচকে নিজের পরনের জামাটা খামচে ধরে, বুকের ভিতর তোল পাড় চালাচ্ছে উষ্ণ এক প্রেমের সাগর।
প্রণয় গভীর শ্বাস টানে হৃদপিণ্ডে—প্রিয়তার ভেজা চুলের সুভাসে হারিয়ে ফেলে নিজেকে।
কম্পিত কন্ঠে বিড়বিড় করে বলে,

“কোন সার্জারির মাধ্যমে তোকে নিজের ভেতর লুকিয়ে ফেলা যায় না জান,
যে খানে তোকে শুধু আমি দেখবো, আমি অনুভব করবো,
তবে যদি তোকে পাওয়ার ইচ্ছেটা একটু হলেও কমতো…”
নিজের ভাবনাতেই আনমনে হেসে উঠলো প্রণয়।
ভালোবাসাকে আর একটু গভীরে স্পর্শ করার জন্য মনের গভীরে আগুন লেগে যায়,
তবু ও স্পর্শ করে না সে।
কারণ প্রিয়তমার কাঁপা নিঃশ্বাসে যে প্রেম জড়িয়ে আছে,
তা স্পর্শের চেয়েও জ্বলন্ত।
আর সেই আগুনেই একটু একটু করে ঝলসে যাচ্ছে সে।
প্রিয়তা পা দিয়ে মেঝে শক্ত করে চেপে ধরল।
প্রণয়ের অনবরত গরম নিঃশ্বাসের আলতো স্পর্শে প্রিয়তার রক্তে আগুন লেগে যাচ্ছে,
তার ঠোঁট স্পর্শ করছে না প্রিয়তাকে,

কেবল নিঃশ্বাসের উষ্ণতায় হাঁটুর জোড়ায় কাপন ধরছে।
পা দুটো অসাড় হয়ে আসছে।
এই পুরুষের স্পর্শ নয়, কেবল উষ্ণতাই প্রিয়তাকে ভেতর থেকে গলিয়ে ফেলার জন্য যথেষ্ট।
প্রিয়তা মাঝে মাঝে ভেবে পায় না—
সত্যি কি তার হার্ট দুর্বল?
নাকি এই পুরুষ একটু বেশি গরম?
প্রিয়তার ভাবনার মধ্যেই যেন চারপাশ শান্ত হয়ে গেল,
অনুভুতির ঝড়ো হাওয়া যেন মুহূর্তেই হারিয়ে গেলো,
হাঁটুতে ও বল ফিরে এলো।
শরীরে আর সেই তপ্ত নিঃশ্বাসের অস্তিত্ব অনুভব হচ্ছে না,
বুকের কাঁপন ও থেমে গেছে আচমকাই।
এতে প্রিয়তা স্বস্তি পেলো নাকি কষ্ট পেলো—
তা নিজেই বুঝতে পারলো না প্রিয়তা।

কেবল কম্পিত নয়নজোড়া ঘুরিয়ে আশে পাশে খুজলো সেই কাঙ্খিত পুরুষকে।
প্রণয় ওর থেকে দুই হাত সামনেই দাঁড়িয়ে আছে।
তার আকর্ষণীয় ডার্ক রেড কালার ঠোঁটে কেমন অদৃশ্য রহস্যময় হাসি লেপ্টে আছে,
যা খালি চোখে হয়তো দেখা যাবে না।
অন্য সময় হলে প্রিয়তা ও হয়তো দেখতে পেতো না,
কিন্তু এই মুহূর্তে প্রিয়তা সেটা স্পষ্টই দেখতে পেলো।
আর তাতে তার লজ্জার পরিমাণ এবার আকাশ ছুঁলো,
পুনরায় গাল দুটো লজ্জায় গরম হয়ে উঠলো।
প্রণয় তার লজ্জা রাঙা গাল দুটোর দিকে তাকিয়ে শুষ্ক ঢোক গিলল,
মনে মনে বির বির করে আওরালো—

“ধৈর্যের পরীক্ষা নিও না মেয়ে,
আমার ধৈর্যের বাঁধ মজবুত,
তবে তা ইস্ফাত দিয়ে বানাইনি,
তোমার ক্ষেত্রে তা অত্যন্ত দুর্বল ও নড়বড়ে।
যা তুমি একটা ঠোকা দিলেই ভেঙ্গে পড়বে,
আর তাতে সর্বনাশটা, ও…
কিন্তু তুমারই হবে।
তাই দুর্বল করো না,
আর মাত্র ২৯টা দিন,
একটু শক্ত থাকতে দাও।”
কিন্তু প্রিয়তা সেই সবের কিছুই শুনতে পেলো না।

প্রণয় টেনে হিঁচড়ে নিজের বেহায়া দৃষ্টি নামালো প্রিয়তার লজ্জা রাঙা রক্তিম চেহারা থেকে।
সে বড় বড় নিঃশ্বাস নিয়ে নিজের ভিতরের জলন্ত আগুনটা ছাই চাপা দিলো,
নিজেকে সর্বোচ্চ মাত্রায় স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে এগিয়ে গেলো প্রিয়তার কাছে।
পাশ থেকে টাওয়েলটা তুলে প্রিয়তার হাঁটু ছাড়িয়ে যাওয়া ভেজা চুলগুলো সযত্নে মুছে দিতে লাগলো।
এতে আরও লজ্জা পেয়ে গেলো প্রিয়তা।
লজ্জায় দুই হাতে মুখ ঢেকে বসে থাকতে মন চাইছে।
প্রণয় সুন্দর মতো প্রিয়তার চুলগুলো মুছে, আছড়ে একটা ফ্রেন্স বেনি করে দিলো।
অতঃপর, প্রিয়তার মাথা থেকে পা পর্যন্ত একবার চোখ বুলিয়ে, পাশ থেকে সাদা উড়নাটা তুলে সুন্দর মতো প্রিয়তমার গায় জড়িয়ে দিলো।

কিন্তু দৃষ্টিতে দৃষ্টি মিলালো না প্রিয়তা, সে মাথা নিচু করেই দাঁড়িয়ে রইলো।
প্রণয় এবার প্রিয়তার পছন্দের কিটেন হিল স্যান্ডেলটা এনে নিজ হাতে প্রিয়তার পায়ে পরিয়ে দিলো।
প্রিয়তা একটু বাধা দিতে চাইলে প্রণয় সোজা সাপটা ভাষায় বললো—
“কিছু বছর আগেও তোর দুই পায়ের তালুতে গুনে গুনে ২০-৪০টা চুমু না খেলে তুই ভাত খেতে রাজি হতিস না,
আর সেই তুই এখন আমায় আদব দেখাস?”
প্রণয় নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলা কথাগুলোতে প্রিয়তার চোখের পাতায় ভেসে উঠলো পুরনো দিনের কিছু ঝাপসা স্মৃতি,
যার সবটা প্রিয়তার মনে ও নেই।
তবে এসব কান্ড সে বিলক্ষণ ঘটিয়েছিল!
এসব মনে পড়তেই অনুসোচনায় প্রিয়তার মুখটা ছেট হয়ে গেলো।
প্রিয়তার মনে মনে নিজেকে ঝাঁটার বাড়ি মেরে বললো—

“ছিঃ প্রিয়তা, ছিঃ!
তুই প্রণয় ভাইকে দিয়ে এসব করিয়েছিস?
তুই তো পাপিষ্ট রে পাপিষ্ট!
তুই মরলে ডিরেক্ট নরকেই যাবি!
প্রণয় ভাই গুনে গুনে তোর থেকে এক দুই বছরের নয়, পাক্কা ১৩-১৪ বছরের বড়!”
প্রণয় ওর কানের নিচে নজরের টিপ পরাতে পরাতে বললো—
“নরকে যাবি না, চিন্তা নেই,
তোর মতো সুগন্ধি ফুলকে ওরকম জায়গায় মানায় না!”
প্রিয়তা নীলোভ চোখের ভারি পল্লব ঝাঁপটলো, প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে।
প্রণয় ওর কাজলের কৌটোটা রেখে, শক্ত করে নিজের আঙুলের ভাজে প্রিয়তার তুলতুলে নরম আঙুলগুলো পুরে নিলো।
প্রিয়তার ললাটে উষ্ণ পরশ এঁকে দিয়ে বললো—

“চল।”
প্রিয়তা পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কৌতুহলি কন্ঠে বললো—
“আমরা কোথায় যাচ্ছি প্রণয় ভাই?”
প্রণয় ছোট্ট করে জবাব দিল—
“কাজী অফিস।”
‘কাজী অফিস’ নামটা শুনে চরম আশ্চর্যজান্নিত হলো প্রিয়তা।
মুখ হা করে জিগ্যেস করলো—
“কেনো?”
প্রণয় পুনরায় ভাবলেশহীন কন্ঠে জবাব দিল—
“বিয়ে করতে।”
প্রণয়ের কথায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো প্রিয়তা,
তবে বিষয়টা মোটেও সিরিয়াসলি নিলো না,
কারণ প্রহেলিকার ভাষ্যমতে,

প্রণয় নাকি তার বউ এর নামে দুই ঢোক পানি বেশি খায়!
সেখানে তার মতো একটা অযোগ্য ছোট মেয়েকে বিয়ে করবে? অসম্ভব!
সদর দরজা খুলে ওরা দুজনে গ্যারাজের সামনে এসে দাঁড়ালো।
শিকদার বাড়ি কখনোই অন্ধকার হয় না,
ফলে বাড়ির চারপাশ দিনের আলোর মতো ঝলমলে।
প্রণয় প্রিয়তার দিকে দৃষ্টিপাত করে কোমল কণ্ঠে বললো—
“তুই জাস্ট ২ মিনিট দাঁড়া,
আমি এখুনি আসছি”,
বলে গ্যারাজের ভিতরে যেতে নিলে, প্রিয়তা ওর বাহু আঁকড়ে ধরলো।
কাঁপা কণ্ঠে বললো—

“আমি ও যাবো।”
প্রণয় ওর ভিতু হরিণীর দিকে তাকিয়ে বললো—
“আমি থাকতে কি ভূত তোকে খেতে নেবে!
চারপাশে অন্ধকার নেই, ভূত কোথা থেকে আসবে…”
তবু ও হাত ছাড়লো না।
প্রণয় ওর চোখের পাতায় হাত রেখে বললো—
“আমি না বলা পর্যন্ত চোখ খুলবি না!”
বলে গ্যারাজের ভিতরে চলে গেলো প্রণয়।
প্রিয়তার কেমন ভয় ভয় লাগছে, এত রাতে সে একা বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে আছে।
তবে কয়েক মুহূর্ত যেতেই চোখে তীব্র আলোর ছটা পড়াতে,
চোখ মুখ কুঁচকে, হাত দিয়ে চোখ আড়াল করে দাঁড়ালো প্রিয়তা।
ইয়ামাহা আর থ্রি বাইকটা শুউউউ করে এসে প্রিয়তার পায়ের কাছে দাঁড়াল।
তীব্র হেডলাইটের ঝলকানি একটু কমতেই, প্রিয়তা দৃষ্টি নরম হয়ে এলো।
সে ধীরে ধীরে চোখ মেলতেই, তার চোখ দুটো ইয়া বড় বড় হয়ে গেল।
নিজের অজান্তেই মুখটা হাঁ করে তাকিয়ে রইলো সামনে,

যেন চোখের পলক ফেলতেই ভুলে গেছে মেয়েটা।
তার পুরনো ক্রাশ যেন হুট করে ফিরে এলো হৃদয়ের দাবি নিয়ে।
স্কিন টাইট ব্ল্যাক টি-শার্টের ওপর ব্র্যান্ডেড ব্ল্যাক লেদার জ্যাকেট,
মাথায় চকচকে কালো হেলমেট—
ঠিক যেন সেই পুরোনো দিনের প্রণয় ভাই।
ভার্সিটি লাইফে এই বাইকের প্রতি প্রণয় ভাইয়ের অন্যরকম একটা নেশা ছিলো।
ভার্সিটিতে বিরোধীদলের সাথে বাইক রেস করতে গিয়ে,
প্রতি মাসে অন্তত একবার বাইক এক্সিডেন্ট হতোই হতো,
আর এসব নিয়ে শিকদার বাড়ি ঝামেলা চলতো হর হামেসাই।
কিন্তু সাত বছর আগে সেই এক দুর্ঘটনার পর,
তিনি আর কখনো বাইকের হ্যান্ডেলে হাত রাখেননি।
কিন্তু উনার সেই কিলার বাইক রাইডার লুকটা প্রিয়তা আজও ভীষণ মিস করে।
তাই এত বছর পর নিজের পুরনো ক্রাশকে পুনরায় চোখের সামনে দেখে, প্রতিক্রিয়া প্রদর্শন করতেই ভুলে গেল প্রিয়তা।

প্রণয় ওর মুগ্ধ দৃষ্টির দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে,
নিজের হাতে থাকা আরেকটা কালো হেলমেট প্রিয়তার মাথায় পরিয়ে দিল।
নিজের হেলমেটের শিল্ড নামিয়ে এনে, মৃদু কণ্ঠে বলল—
“বসো।”
প্রিয়তার যেন বিশ্বাসই হচ্ছিল না—
সে পুরো সাত বছর পর আবারো প্রণয় ভাইয়ের বাইকে উঠতে চলেছে!
প্রিয়তাকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে দেখে, প্রণয় একটু ঝুঁকে মুচকি হেসে বলল—

“আমাকে গিলে খাওয়া বন্ধ কর, নজর লেগে কালো হয়ে যাবো। এখন বস, তাড়াতাড়ি।”
প্রণয়ের খোঁচায় লজ্জা পেয়ে গেল প্রিয়তা।
কিছু না বলে ধীরে ধীরে বাইকের পেছনে উঠে বসল।
আহ্… কী সেই একটা ফিলিংস হলো প্রিয়তার মনে!
প্রণয় বাইক স্টার্ট দিতে দিতে বলল—
“ভালো মতো ধর, না হলে পড়ে যাবি।”
প্রিয়তাও তাই করল,
শক্ত করে দুই হাতে প্রণয়ের পেট জড়িয়ে ধরল।
চোখের পলকেই বাইকটা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেল।
নিঃঝুম রাত, দুই পাশে ঘন বিস্তৃত অরণ্য,
আর বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দের সাথে,
অরণ্যের বুক চিরে চলে গেছে তমসাচ্ছন্ন কালো পিচঢালা হাইওয়ে।
চারপাশে শুধু ঘন গাছপালা,
নিভে আসা চাঁদের ধূসর রূপোলি,
নরম আলোয় রাস্তাটা চকচক করছে,

RRRRRRRRRRRMMMMM!!!
বাইকটা হাওয়ার সাথে গর্জন কেটে এগিয়ে চলেছে ১৪৭ কিমি/ঘণ্টা স্পিডে।
প্রণয় সামনের হ্যান্ডেল শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে,
তার গাঢ় বাদামি চোখে রাত্রির প্রতিফলন,
তার দৃষ্টি ধ্রুবতারার মতো স্থির, এবং… আগুনের মতো তপ্ত।
পেছনে বসে থাকা প্রিয়তা এক হাতে প্রণয়ের কোমর জড়িয়ে,
অন্য হাতটা আস্তে করে প্রণয়ের বুক ছুঁয়ে রেখেছে,
মাথাটা নিঃশব্দে এলিয়ে দিয়েছে প্রণয়ের পিঠে।
প্রবল বাতাসের সাথে তাল মিলিয়ে, তার ঢেউ খেলানো চুলগুলো উড়ছে আপন গতিতে।
পিঠের উপর অত্যন্ত নরম কিছুর মৃদু চাপ অনুভব করছে প্রণয়,
ফলে কণ্ঠনালী অনবরত কাঁপছে তার,
তবুও দৃষ্টি সামনের পানে স্থির।
প্রিয়তা ধীরে একটা নিঃশ্বাস ছাড়ে—

উত্তপ্ত, থ্রিলিং, রোমাঞ্চে ভেজা নিঃশ্বাসটা গিয়ে প্রণয়ের কানের লতিতে আছড়ে পড়ে।
প্রণয় পেছনে না তাকিয়েই বা হাতটা প্রিয়তার উরুতে চেপে ধরে…
ঠান্ডা গলায় বলে—
“সাবধানে ধরে বস।”
প্রিয়তা ও তাই করে,
আরো শক্ত বাঁধনে প্রণয়ের পেট জড়িয়ে ধরে,
ফলে দুটি দেহের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায় অনেকখানি।
স্পিডোমিটারে তখন ১৫৮ কিমি/ঘণ্টা,
প্রিয়তার বুকে তখন হৃদস্পন্দনের চেয়ে বেশি রোমাঞ্চকর গরম রক্ত উতলে উঠছে।
সে চোখ বন্ধ করে বলে—

“I want this moment forever…”
প্রণয় কিছু বলে না, গতি বাড়ায়,
বাঁ হাত দিয়ে গিয়ার টেনে নেয়,
আর ডান পায়ে প্রেস করে স্পিড—
স্পিডোমিটার লাফিয়ে ওঠে ১৬৫… তারপর ১৭২ কিমি/ঘণ্টা…
ঘড়ির কাটায় তখন রাত দুটো ৩৫।
ব্যস্ত শহরের অলিগলি শুনশান নিস্তব্ধ।
বটতলার কাজি অফিসের ছোট্ট ভবনটা রাস্তার এক পাশে ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে, তার চারপাশে দু-একটা হ্যাজি স্ট্রিটল্যাম্প কাঁপা কাঁপা হোল্ডে আলো ছড়াচ্ছে।
বাতাসে ধুলো, গ্যাসোলিন আর রাতের জং ধরা নির্জনতার গন্ধ।
কখনো কখনো দূরে থেকে নিশুতি রাতের কুকুরগুলো ডেকে উঠছে।
কাজি অফিসের লোহার গেট বন্ধ, তালাবদ্ধ,

আর পাশে লাগানো সাইনবোর্ডটাও হালকা বাতাসে একটু দুলে উঠে,
“আল-ইখলাস কাজি অফিস – সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা” – লেখা ঝাপসা হয়ে আসে।
আশপাশে দোকানপাট বন্ধ, রাস্তায় কেবল মাঝে মাঝে দু-একটা বাইক কিংবা প্রাইভেট কারের দেখা মিলছে।
পাশের রং দোকানের ছাউনিতে দাঁড়িয়ে আছে আবিদ আর পরি।
আবিদের চোখ-মুখ স্বাভাবিক, তবে পরিনীতার চেহারার অবস্থা ভীতসন্ত্রস্ত চোখে মুখে চাপা ভয় ও উত্তেজনা।
মুখ দেখে মনে হচ্ছে, মেয়েটা ভিতরে ভিতরে প্রচণ্ড ঘাবড়ে আছে।
কি হতে চলেছে তার ভবিষ্যতে, তা আল্লাহই ভালো জানেন।
তার মন বলছে, সে হয়তো পালিয়ে এসে ঠিক কাজ করেনি, এর মাসুল হয়তো তাকে গুনতে হবে অনেক খারাপ ভাবে।

সে পালিয়েছে জানার পর নিশ্চয়ই সাদমান শিকদার হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না—
এসব ভেবেই ভয়ে পরিনীতার চেহারার রক্ত উড়ে গেল।
আবিদ কয়েক পলক নীরবে চেয়ে দেখল পরিনীতার ভয়ভীত উৎকণ্ঠা,
সে মৃদু হেসে পরিনীতার আঙুল ভাজে আঙুল রাখলো,
সাথে সাথেই সামান্য চমকে মাথা তুলে তাকালো পরিনীতা,
কম্পিত কণ্ঠে আওড়ালো, “আমরা কি কাজটা ঠিক করছি, মাস্টারমশাই?”
আবিদ পরিনীতার চোখের গভীরে তাকিয়ে বড় করে শ্বাস টানলো,
পরিনীতার চোয়ালে হাত রেখে দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
“তোমাকে আমি ভাবার সময় দিয়েছিলাম, পরি… তুমি ভেবেছো, কিন্তু এখন আর ভাবার সময় নেই।
আজ যদি তুমি ভয় পেয়ে পেছিয়ে যাও… তবে আর কোনওদিন… ওই জায়গায় এসে দাঁড়াতে পারবে না।
এটাই তোমার জীবনের প্রথম এবং শেষ সুযোগ।”

পরিনীতার জলজলে অক্ষিপল্লবে, অসহায়ত্বে ভর করলো।
সে আলগোছে আবিদের পেট জড়িয়ে ধরে মৃদু ফুপিয়ে উঠে বললো,
“আমার নিজের জন্য একটু ভয় করছে না… বিশ্বাস করুন।
আমার সব ভয় আব্বু আর বড়ো দাদনকে নিয়ে।
আপনি তো জানেন না, আমার বড়ো দাদন আসলে কি জিনিস!
আপনি আব্বুর হিংস্রতা দেখেছেন, কিন্তু বড়ো দাদনের হিংস্রতা দেখেননি।
যা আমি দেখেছি… আমার বাপ-ভাই এর মধ্যে বিশেষ কোন পার্থক্য নেই বললেই চলে,
তবে আমার ভাই তুলনায় অনেক বেশি হিংস্র।”
পরিনীতার কথায় কোনো রকম প্রতিক্রিয়া দেখানোর, সময়টুকু পর্যন্ত পেলো না আবিদ।
তার আগেই কারো পুরুষালি বলিষ্ঠ হাতের শক্ত আঘাত এসে আছড়ে পড়লো তার মুখে, এতে দুই কদম পিছিয়ে গেলো আবিদ,

আকস্মিক আক্রমণে ভয়ে লাফিয়ে উঠলো পরিনীতা।
পিছনে ফিরে তাকাতেই তার হৃদপিণ্ডটা কামড় দিয়ে উঠলো,
ভয়ে সারা শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে থর থর কাপন ধরলো।
প্রণয়ের সুন্দর মুখখানা মুহূর্তেই নরকীয় হিংস্রতায় ছেয়ে গেছে।
গাঢ় বাদামী বর্ণের শিকারি চোখদুটো যেন জ্বলন্ত অগ্নিশিখা।
মারাধর করার জন্য বলিষ্ঠ হাতের পেশিগুলোও ফুলে ফেঁপে উঠেছে।
প্রিয়তা গুটি শুটি মেরে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
সব কিছুই যেন তার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। কয়েক মুহূর্ত আগেও তো সবকিছুই কতো সুন্দর ছিলো, তাহলে হঠাৎ এমন চেহারার রং পাল্টে গেল কিভাবে? আর তাছাড়া আপু আর মাস্টারমশাই বা এখানে কি করছেন, তাও এত রাতে?

কিন্তু আবিদের উপর আরেকটা আঘাত পড়তেই ভয়ে লাফিয়ে উঠল তার সকল ভাবনাচিন্তা উড়ে গেল, কয়েক হাত দূরে ছিটকে পড়লো আবিদ।
এবার ভয়ে প্রিয়তার অবস্থাও পরিনীতার মতই হলো।
ভয়ের ছুটে দুজনের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমলো।
তারা দুজন কিছু বুঝবে, তার আগেই প্রণয় আবারো শার্টের হাতা গুটিয়ে এগিয়ে যায় আবিদের দিকে।
তার শরীরের পেশিগুলো টান টান হয়ে, কপালের শিরা ফুলে উঠছে।
দাদান এর দিকে তাকিয়ে ভয়ে কেঁপে উঠে পরিনিতার অন্তর।
সে পলক ঝাঁপটার আগেই,

আবিদের শরীরে তৃতীয় এবং চতুর্থবারের মতো সমর্থবান পেশিবহুল হাতের আঘাত এসে আছড়ে পড়ে,
রক্তের পিচকারি ছিটকে এসে লাগল পরিনীতার গায়ে।
চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠল পরিনীতা, ছুটে গিয়ে প্রণয়কে যে ধরে আটকাবে,
সেই সাহসটা পর্যন্ত জোগাতে পারছে না।
তবুও… আবিদের রক্ত… তার সহ্য হলো না।
ছুটে গিয়ে পা জড়িয়ে ধরলো প্রণয়ের,
কান্না করে দিয়ে মিনতি করে বললো,
“প্লিজ, উনাকে মারবেন না দাদন, উনার খুব কষ্ট হচ্ছে…
প্রয়োজনে আমাকেই মারুন… তবুও উনাকে মারবেন না।
পরিনীতার কণ্ঠে হাত থামলো প্রণয়।
সে দৃষ্টি নামিয়ে শীতল চোখে তাকালো পরিনীতার দিকে,
কিন্তু কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না।
পুনরায় আবিদের শার্টের কলার চেপে ধরলো,
হুংকার দিয়ে বললো,

“তোমার তো সাহস কম নয়, ছেলে!
তুমি আমার বোনকে নিয়ে পালিয়েছো?
আবার সেটা মেসেজ করে আমাকে জানিয়ে ও দিচ্ছো?!
খুব দম হয়েছে দেখছি বুকে,
যে প্রণয় শিকদারের পরিবারের দিকে মানুষ দিনের বেলাতে চোখ তুলে তাকানোর সাহস পায় না,
সেই তুমি রাতের অন্ধকারে আমার বোনকে নিয়ে পালাচ্ছো?
এত সাহস পাও কিভাবে আমার বোনকে বাড়ি থেকে তুলে আনার?”
প্রণয়ের এমন বজ্রকণ্ঠে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা ও পরিনীতা।
আবিদ ঠোঁটে লেগে থাকা রক্তটুকু মুছে, শান্ত কণ্ঠে হেসে বললো,
“সাহস আছে বলেই তো আপনার বোনকে ভালোবাসতে পেরেছি।
আর সেই সাহসের জোরেই তাকে নিজের করে নেবো।”

আবিদের স্পর্ধা দেখে বুকে কেঁপে উঠলো পরিনীতা ও প্রিয়তা।
আবিদের বাক্যে বাঁকা হাসলো প্রণয়, কাঁধে হাত রেখে বিদ্রুপ করে বললো,
“Really? আমার বোনকে এতই ভালোবাসো?
এত কিছু জানো, তখন এটা ও নিশ্চয়ই জানো…
আমার বোনকে যে ভালোবাসে, তাকে মরতে হয়।
And unfortunately, তোকেও মরতে হবে।
‘Now get ready… death is coming for you.’”
বলেই রিভলভার আবিদের কপাল বরাবর ঠেকায়।
পরিনীতা এতক্ষণ ঠিক এই ভয়টাই পাচ্ছিল…
সে বুঝলো, এবার হয়তো সময় এসে গেছে এই পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার…
তাই এবার আর ভয় করলো না।
পরিনীতা নির্ভয়ে গিয়ে দাঁড়ালো প্রণয়ের রিভলভারের সামনে,
দৃঢ় কণ্ঠে বললো,

“ভালোবাসা যদি অপরাধ হয়, তবে সেই অপরাধ আমি ও করেছি, দাদান।
তাই শাস্তি ভুগলে, মাস্টারমশাই একা ভুগবে না।
আমরা দুজনেই সমান অপরাধী।
তাই মারতে হলে আমাকেও মারুন।”
বলে মাথা নিচু করে নিলো পরিনীতা।
আবিদ আর প্রণয় একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
এমন সিরিয়াস মোমেন্টে দুজনকে হাসতে দেখে হকচকিয়ে গেল প্রিয়তা ও পরিণীতা।
তাদের ভয় এখনও কাটেনি, তাই দুজনের এমন অদ্ভুত ব্যবহারে অবাক হলো, কম ভয় পেল, বেশি।
রিভলভারটা আবার পকেটে ঢুকিয়ে, আবিদের কাঁধে হাত রাখলো প্রণয়।
সন্তুষ্ট হেসে বললো,

“আমি মানুষ চিনতে ভুল করি না।”
আবিদও তৃপ্ত হেসে পরিণীতার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভাইয়া, আপনার ঋণ শোধ করার সামর্থ্য এই জীবনে আমার হবে না,
কিন্তু আজীবন আমি আপনার কাছে কৃতজ্ঞ থাকবো।
আপনি আমাকে আমার পরি দিয়েছেন।”
আবিদের দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো প্রণয়।
আবিদের কাঁধ চাপড়ে বললো,
“আমি তোমার জন্য কিছু করি নাই।
আমি যা করেছি, আমার বোনের জন্য করেছি।
আমি সব সময় চেয়েছি, আমার বোনের জীবনে একজন সঠিক মানুষ আসুক,
যে আমার বোনের মর্ম বুঝবে।

যে দিনশেষে টাকা নয়, আমার বোনকে খুঁজবে।
আর সেই ছেলেটাই তুমি। তাই তোমাকে আমার বোনের জীবনে এনেছি।
এখানে তোমার স্বার্থ নয়, আমি নিজের স্বার্থটাই দেখেছি।”
আবিদ ও প্রণয়ের কথোপকথনে তাজ্জব বনে গেল প্রিয়তা ও পরিণীতা।
বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দুজনের দিকে।
প্রিয়তা কৌতূহল চেপতে না পেরে, হতবিহবল কণ্ঠে প্রশ্ন করেই ফেললো,
“আপনিই তো এ.আর. স্যারকে আপুর টিউটর হিসেবে নিয়ে এসেছিলেন? তার মানে—”
কথা সম্পূর্ণ করার আগেই প্রিয়তার আঁখিকুটোর ছেঁড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো।
পরিণীতাও হতবাক।

তবে তাদের বিস্ময়কে বেশি দূর এগোতে না দিয়ে, পরিণীতার দিকে এগিয়ে এলো প্রণয়।
শীতল চোখে বোনের দিকে তাকিয়ে, গম্ভীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো,
“তুই যদি একবার আমায় বলতি যে তুই আবিদকে ভালোবাসিস, আমি কি তোকে খেয়ে ফেলতাম?
দাদান খুব খারাপ, তাই না বোন?
খুব হিংস্র, নিকৃষ্ট?”
প্রণয়ের কঠোর কণ্ঠে বলা বাক্যগুলোতে পরিণীতার কলিজা মুচড় দিয়ে উঠলো।
অশ্রুশিক্ত নয়নজোড়া নামিয়ে নিলো।
প্রণয় ওর মাথায় হাত রেখে বললো,
“অনেক বড় হয়ে গেছিস, নিজের সিদ্ধান্ত নিজেই নিতে শিখে গেছিস।
কাউকে না জানিয়েই বাড়ি থেকে পালাচ্ছিস?
দুনিয়াটাকে তুই যতটা সহজ ভাবছিস, দুনিয়াটা কিন্তু অতটা ও সহজ নয়।”
পরিণীতা আর শুনতে পারলো না।
দাদানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো, ফুপিয়ে উঠে বললো,

“Sorry, দাদান… আমাকে মাফ করে দাও… আমি… আমি আসলে বুঝতে পারি নি।”
প্রণয় আর কিছু বললো না।
পকেট থেকে ফোন বের করে কাউকে ফোন করে বললো,
“সব রেডি আছে? ওকে, আসছি,”
বলে ফোন কেটে দিলো।
প্রণয় সবার দিকে তাকিয়ে বললো,
“চলো।”
প্রিয়তা আবার গোল গোল চোখে তাকিয়ে বললো,
“আবার কোথায়?”
প্রণয় ওর দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে বাঁকা হেসে বললো,
“বিয়ে করতে।”
রাত ২টা

“Boss, I’ve brought him. Should I bring him in here?” (“বস, উনাকে নিয়ে এসেছি, উনাকে কি এখানে নিয়ে আসবো?”)
আফ্রিকান গার্ডটা ফর্মাল ভঙ্গিতে প্রণয়ের উদ্দেশ্যে বললো।
কালো পোশাক পরিহিত, বেশ মোটা-সোটা, কালো বর্ণের লম্বা মত লোকটাকে দেখে প্রিয়তার মুখ একদম ‘হা’ হয়ে গেল।
লোকটা একেবারে কুচকুচে কালো।
প্রিয়তার মনে হলো, লোকটা হয়তো আফ্রিকান, অথবা নাইজেরিয়ান।
অন্ধকার রাতে হাই-পাওয়ার টর্চ লাইট ছাড়া যে এই মহাশয়কে খুঁজে পাওয়া যাবে না, এই বিষয়ে প্রিয়তা শতভাগ নিশ্চিত।
প্রণয় ইশারা দিতেই দুজন গার্ড কম্বল পেঁচানো কিছু একটা চেংদুলা করে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।
জিনিসটা বোধহয় নড়ছে ও।
প্রিয়তা সেদিকে ওর গোল গোল চোখে তাকিয়ে মনে মনে বললো,

“আজ বোধহয় প্রণয় ভাই আমাকে সারপ্রাইজ দিতে দিতে হার্ট অ্যাটাক করিয়ে ফেলবে।”
প্রিয়তার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই গার্ডটা সেই কম্বল-পেঁচানো জিনিসটা প্রণয়দের সামনে কাউচে রাখলো।
সাথে সাথেই চাদরের ভিতর থেকে ধড়ফড়িয়ে বেরিয়ে এলেন এক ৬৫ ঊর্ধ্ব, এক লম্বা দাড়িওয়াল ভদ্রলোক।
প্রিয়তা লোকটাকে ভালোভাবে দেখার আগেই, প্রণয় তার চোখে হাত চেপে ধরলো।
গার্ডটার দিকে তাকিয়ে রেগে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“তুলে আনতে বলেছিলাম, কাপড় খুলে আনতে বলিনি।”
প্রণয়ের চাপা রাগ দেখে সাথে সাথেই গার্ড দুটো মাথা নিচু করে নিলো।
নিম্ন কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করলো,

“Sorry boss, উনাকে আমাদের সাথে আসার জন্য অনেকভাবে বুঝিয়েছিলাম, অনেক রিকোয়েস্ট করেছিলাম, অনেক টাকা ও অফার করেছিলাম।
কিন্তু উনার একটাই কথা—এতো রাতে উনি উনার বউ ছেড়ে আসবেন না।
তাই বাধ্য হয়ে উনাকে এভাবে তুলে আনতে হয়েছে।
আর বেশি ধস্তাধস্তি করাতে, উনার লুঙ্গি বিপদ সীমা অতিক্রম করার পর্যায়ে চলে গেছে।”
কাজীর লুঙ্গির এমন বেহাল দশা দেখে জাভেদের মনে ও ভীষণ মায়া হলো।
মনে মনে বললো,
“আহারে বেচারা, এই মাঝরাতে বউকে ছেড়ে আসতে কতই না কষ্ট হয়েছে!
ঠিকই তো… আসবে কেন? এখন তো বউয়ের সাথে কুস্তির সময়…
তা না, বুনো হাতিদের সাথে কুস্তি করতে হচ্ছে।”
প্রিয়তা চোখের উপর থেকে প্রণয়ের হাত সরানোর চেষ্টা করতে করতে বললো,
“ইসস! কী করছেন প্রণয় ভাই, ছাড়ুন! আমি তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না!”
প্রণয় ওর কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে মৃদু ধমকে বললো,

“অন্যের বউয়ের সম্পদ তুই কেন দেখবি?”
আশ্চর্য হলো, প্রিয়তা চোখের উপর থেকে হাত সরানোর সাথে সাথে অন্যের বউয়ের সম্পদ দেখার কী সম্পর্ক?
জাভেদ এগিয়ে গিয়ে কাজীর লুঙ্গি ঠিক করে দিলো।
কাজী সাহেব যেন মহা বিরক্ত। তিনি এবার প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে তেজি কণ্ঠে বললেন,
“এই পুলা, তাহলে তুমার কথায় এই কালা আর ধলা পাঁঠা গুলা আমাকে এই রাতে তুলে আনছে?
তা, বিয়ে থা করো নি নাকি? বোঝো না, মাঝরাতে বউ ছেড়ে আসা যায় না?
সারাদিন এই ঢংয়ের বিয়ে পড়ানোর চক্করে বউয়ের আঁচলের সাথে বেঁধে থাকতে পারি না।
যাও, তবু রাতে একটু সময় পাই… এই সময়ও যদি এই পাঁঠাগুলো গিয়ে এভাবে জ্বালাতন করে, তাহলে আমার ঘরে আলোটা জ্বালাবো কী ভাবে?”
কাজীকে এমন ছুড়ির মত জবান চালাতে দেখে ভয় তটস্থ হলো আবিদ ও জাভেদ,
যদিও প্রণয় একেবারেই নির্লিপ্ত।
তাঁর দৃষ্টি শীতল।

কাজীর বলা কথাগুলোর প্রথম কয়েক লাইন বুঝলেও, শেষের লাইনটা বুঝতে প্রিয়তার অসুবিধা হলো,
তাই কৌতূহলে প্রশ্ন করতে নিলে—
সাথে সাথেই প্রণয় চাপা কণ্ঠে ধমকে বললো,
“একদম চুপ!”
ধমক খেয়ে চুপ মেরে গেল প্রিয়তা।
তবে প্রিয়তা চুপ করতে পারলে ও।
জাভেদ পারলো না, সে ‘ফট’ করে প্রিয়তার মনের প্রশ্নটা করেই বসলো,
তীব্র কৌতূহল নিয়ে বললো,
“আজ্ঞে চাচা, বউয়ের আঁচল ধরে ঘোরার সাথে ঘরে আলো জ্বালানোর কী সম্পর্ক?”
কাজী লোকটা মনের বিরক্তিটুকু নাকের ডগায় ছড়িয়ে তাকালো জাভেদের দিকে।
জাভেদ কেবলা মার্কা হাসি দিয়ে তাকিয়ে আছে।
কাজী লোকটা জাভেদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন,
“বউ আছে?”
কাজীর প্রশ্ন শুনে মুখ চুন হয়ে গেল জাভেদের।
করুণ চোখে মাথা দুই পাশে দুলালো, যার অর্থ ‘নেই’।
জাভেদকে মাথা থেকে পা পর্যন্ত দেখে, বিরাট হতাশার শ্বাস ছাড়লেন কাজী।
হতাশ কণ্ঠে বললেন,
“কি হে ছোকরা, দেখে তো মনে হচ্ছে বুড়া ধামড়া!
তাহলে বিয়ে থা করছো না কেন?
ঘরে আলো জ্বালানোর দরকার নেই নাকি?
জানো, আমি কত বয়সে বিয়ে করেছিলাম?”
কাজীর কথা শুনে ভীষণ হাসি পেলো প্রিয়তা ও পরিণীতার।
তবে প্রণয়ের ভয়ে হাসতে পারলো না ঠিকই,
কিন্তু কৌতূহলী চোখে কাজীর দিকে তাকিয়ে রইলো।
জাভেদ আগ্রহভরা কণ্ঠে বললো,

“জি, কতো?”
কাজী লোকটা একটু ভাব নিয়ে বললেন,
“১৫ বছর বয়সে বিয়ে সেরে ফেলেছিলাম,
তাই আজ অবধি পুরো ১৮ খানা উজ্জ্বল বাতি ঘরে জ্বলিয়েছি।
এখন ১৯ নম্বরটা জ্বালাবো ইনশাল্লাহ।
তা, তোমার বয়স কতো হে ছোকরা?
কি করো?
আমার কাছে ভালো পাত্রী আছে, বিয়ে করবা?”
জাভেদ শুকনো ঢোক গিলে আতঙ্কিত চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে।
প্রণয় এখনও শান্ত।
জাভেদ ভয়ে ভয়ে বললো,

“জি… ২৫।”
২৫ শুনে হায় হায় করে উঠলেন কাজী সাহেব।
আফসোস করে বললেন,
“আহারে, পোলাটার যৌবনের পুরো ১০টা বছর নষ্ট করে ফেললো!
পোলা, তোমার যৌবন তো পিঁপড়ায় চেটে খাচ্ছে।
শোনো পোলা, এখনো সময় আছে।
তোমার তো উচিত, আজই বিয়ে করে ফেলা!”
কাজীর সহানুভূতিতে, অদৃশ্য হাতে চোখের জল মুছলো জাভেদ।
আজ এগুলোর ১ শতাংশও যদি তার বস বুঝতো, তাহলে আজ তার ঘরেও বাতি জ্বলতো।
দুঃখ।

কাজী আবার কিছু বলতে নিলে, তাঁর পাশের ফ্লাওয়ারভাসে ‘শুট’ করে দিলো প্রণয়।
শীতল কণ্ঠে হুমকি দিয়ে বললো,
“মুখ দিয়ে যদি আর একটা ও অপ্রয়োজনীয় কথা বের করেন,
তো আপনার ১৯ নম্বর বাতি জ্বালানোর স্বপ্ন আজীবন স্বপ্নই থেকে যাবে!”
গার্ড ব্যথিত ‘গুলির শব্দে’ লাফিয়ে উঠলো,
সবাই ভয়ে ব্যাঙের মতো লাফ দিতে গিয়ে পুনরায় কাজীর লুঙ্গি খোলার উপক্রম হলো।
সে ভীত চক্ষে তাকালো প্রণয়ের দিকে।
এই ছেলেকে উনার সুবিধার মনে হচ্ছে না।
তাই যত তারাতারি সম্ভব, এখান থেকে কেটে পড়তে হবে।
তাই তিনি কাঁপা কণ্ঠে বললেন,

“কা… কা… কার বিয়ে দিতে হবে বলুন?”
কাজীর ‘কা… কা’ শুনে, প্রিয়তা ‘ফট’ করে বলে উঠলো,
“আহা কাজী সাহেব! কাকের বিয়ে দিতে হবে না তো, আমার আপুর বিয়ে দেবেন!”
কাজী এবার প্রিয়তার দিকে তাকালেন,
“আহ্, এই মেয়েটা বেশ মিষ্টি।
তবে… বেশি ‘গদগদ’ হওয়া যাবে না, নাহলে পরে দেখা যাবে…
উনার আর শেষবারের মতো উনার ১৮ সন্তানের জননী, প্রাণের প্রিয়া গুলবাহার বানুকে আর দেখা হবে না, তাই সেই ভয়ে চুপ মেরে গেলেন।”
জাভেদ পরি আর আবিদকে দেখিয়ে বললো,

“ওনাদের বিয়ে,”
কাজী পরি আর আবিদের দিকে তাকিয়ে প্রশংসা করে বললেন,
“মাশা আল্লাহ্‌! খুব সুন্দর মানাইছে।
তা বাবা, তোমাদের নাম পরিচয়টা একটু বলো…
আর মা, তোমার অভিভাবক কে? একটু ডাকো।”
কাজীর প্রশ্নে, প্রণয় পুনরায় ঠান্ডা কণ্ঠে বললো,
“ওর অভিভাবক আমি।
ওর বড় ভাই।”
প্রণয়ের কথায় আবার কেঁপে উঠলেন কাজী সাহেব।
মনে মনে বললেন,
“আহ্, কি মিষ্টি মেয়ে! তার এমন গম্ভীর ভাই!”
তবে প্রণয়ের কথায়,

পরি আর প্রণয়ের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলেন—
সত্যি, মেয়েটার চেহারায় এই ছেলেটার মুখের আধলের হালকা হালকা ছাপ পাওয়া যায়।
তিনি এবার আবিদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“তোমার নাম পরিচয় বলো, আর কতো টাকা মোহরানা বাঁধবো, বলো।”
আবিদ একবার পরির দিকে তাকিয়ে বললো,
“আমার নাম আবিদ রাফাত।
আমার আব্বার নাম মুহাম্মদ রহমান।
আর দেনমোহর… ১০১ টাকা।”
পাশ থেকে বলে উঠলো পরিণীতা,
“দেনমোহরে টাকার অংক শুনে একটু অবাক হলেন কাজী সাহেব।
খানিক ধীর কণ্ঠে বললেন,
“তুমি নিশ্চিত? ১০১ টাকাই লিখবো?”
পরিণীতা দৃঢ় কণ্ঠে বললো,
“জি, ১০১ টাকাই লিখুন।”
আবিদও পরিণীতার কথায় আপত্তি জানালো না।
কারণ—

সাদমান শিকদারের মেয়েকে সে যদি নিজের গায়ের শেষ রক্তবিন্দুটাও বিক্রি করে দেয়,
তবুও সেই টাকা পরির কাছে ‘হাতের ময়লার’ সমান।
কাজীও আর দ্বিমত করলেন না।
বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন—
“আলহামদুলিল্লাহ্, ওয়াস্-সালাতু ওয়াস্-সালামু ‘আলা রাসূলিল্লাহ।”
“সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ্‌র জন্য, যিনি মানুষকে যুগল সৃষ্টি করেছেন এবং দাম্পত্য জীবনে শান্তি ও করুণা রেখেছেন।
আজ আমি এই পবিত্র আসনে বসে, আপনাদের সবাইকে সাক্ষী রেখে, দুইটি পরিবারকে এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করতে যাচ্ছি।”
“এই বিয়েতে কন্যাদান করিতেছেন কন্যার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা, জনাব আবরার শিকদার প্রণয়।
আমি এখন তাঁর সম্মতি চাই।”
কাজী সাহেব:

“জনাব আবরার শিকদার প্রণয়, আপনি কি কন্যার পক্ষ হতে এই বিয়েতে সম্মতি দিচ্ছেন?”
প্রণয় ভরাট কণ্ঠে বললো:
“জি, আমি এই বিয়েতে সম্মতি দিচ্ছি।”
এরপর কাজী সাহেব বলেন:
“প্রথমেই, আমি কনের সম্মতি গ্রহণ করবো।
জনাব সাদমান শিকদার সাহেবের কনিষ্ঠ কন্যা, অনুজা শিকদার (পরিণীতা)-কে,
আমি একশো এক টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া, মোহাম্মদ রহমান সাহেবের পুত্র
জনাব আবিদ রাফাত-এর সাথে ইসলামী শরিয়তের বিধান মোতাবেক বিবাহের জন্য প্রস্তাব রাখিতেছি।”
কাজী সাহেব এবার পরিণীতার দিকে তাকিয়ে মৃদু আওয়াজে বললেন:
“পরিণীতা, আপনি কি একশো এক টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া,
আবিদ রাফাত-এর সাথে ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক বিবাহে সম্মত আছেন?”
পরিণীতা চোখ তুলে তাকালো আবিদের দিকে।
আবিদ সন্তর্পণে ওর হাতের মুঠো নিজের হাতে নিলো।
চোখের ইশারায় ভরসা দিলো।

পরিণীতার ভীষণ কষ্ট লাগলো, আব্বুর কথা ভেবে।
বড় ভাইয়ের দিকে জ্বলজ্বলে নয়নে তাকালো।
প্রণয় বোনের মনের ভাব বুঝতে পেরে পরিণীতার মাথায় হাত রাখলো,
আদুরে কণ্ঠে বললো,
“তুই অনেক বুঝদার বোন… তুই সব বুঝিস।
তাই এটাও খুব ভালো মতো জানিস,
আমরা সব সময় চাইলে ও সব কিছু পাই না।
আমরা যাদের আমাদের আপন ভাবি, তারাই দিন শেষে আমাদের সব থেকে বড় ক্ষতিটা করে।
তাই আমার সাথে যা হয়েছে, আমি কখনোই চাইবো না তা আমার বোনের সাথে হোক।
তুই নিজেকে সামলে নিস।
চাইলেই তুই সবার মন পাবি না।”

পরিণীতা ও নিরবে দুই ফোঁটা অশ্রু ফেললো।
নত কণ্ঠে বললো,
“জি, আমি কবুল করছি।”
কাজী সাহেব (দ্বিতীয়বার):
“আপনি কি কবুল করছেন?”
“জি, আমি কবুল করছি।”
তৃতীয়বার:
“আপনি কি কবুল করছেন?”
“জি, আমি কবুল করছি।”
এরপর কাজী সাহেব পাত্রের সম্মতির জন্য বলেন:
“আমি, মোহাম্মদ রহমান সাহেবের সুযোগ্য পুত্র, জনাব আবিদ রাফাত-এর,
সন্তুষ্টি ও সম্মতির ভিত্তিতে,

জনাব সাদমান শিকদার সাহেবের কনিষ্ঠ কন্যা, অনুজা শিকদার (পরিণীতা)-কে,
মাহর ধার্য করিতেছি একশো এক টাকা,
ইসলামী শরিয়তের বিধান অনুসারে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ করিতেছি।
আমি এখন পাত্রের সম্মতি চাই—”
কাজী সাহেব (আবিদ-এর দিকে তাকিয়ে):
“জনাব আবিদ রাফাত, আপনি কি একশো এক টাকা দেনমোহর ধার্য করিয়া,
অনুজা শিকদার (পরিণীতা)-কে ইসলামী শরিয়ত মোতাবেক বিয়ে করতে কবুল করছেন?”
আবিদ স্থির ও সম্মানপূর্ণ স্বরে:
“জি, আমি কবুল করছি।”
দ্বিতীয়বার:

“আপনি কি কবুল করছেন?”
“জি, আমি কবুল করছি।”
তৃতীয়বার:
“আপনি কি কবুল করছেন?”
“জি, আমি কবুল করছি।”
কাজী সাহেব:
“আলহামদুলিল্লাহ্‌! বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে।
আমি ঘোষণা করছি—
আজ হতে, আবিদ রাফাত ও অনুজা শিকদার (পরিণীতা) ইসলামী শরিয়তের বিধান মোতাবেক স্বামী-স্ত্রী।
আল্লাহ্‌ তাদের জীবনে বারাকাহ দান করুন, রহমত বর্ষণ করুন, ভালোবাসা ও প্রশান্তি দিয়ে ঘর ভরে উঠুক।
সবাই বলুন—আমিন।”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৪

একসাথে সবাই বলে উঠলেন:
“আমিন!”
আবিদ ও পরির চোখে পানি,
তবে তা দুঃখের নয়।
হাজার প্রতিকূল পরিস্থিতির পর সুখের সোনালী প্রাপ্তির আজ।
ফাইনালি, পরি পেয়ে গেলো তার ‘মাস্টার মশাই’কে,
আর আবিদ পেয়ে গেলো তার ‘এঞ্জেল’কে।
তাই এই সুখে আপনারাও বলুন—
“আমিন!”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৬