ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬০

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬০
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

ASR নীরব পদধ্বনিতে এগিয়ে যায় সেই পাহাড়ের দিকে। দুই পায়ে এগিয়ে সতর্ক দৃষ্টি আশেপাশে ঘুরিয়ে নেয়, অতঃপর পুনরায় এগিয়ে চলে সেই বরফ আবৃত্ত গুহার দিকে… তার ধীরকদমের নিঃশব্দ প্রতিধ্বনি আর শিকারি দুটো চোখ যেন লক্ষ্যভেদের অঙ্গীকারে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
সে মৃত হ্রদ পার করে পৌঁছে যায় সেই বরফ ঢাকা শতবার্ষিকী প্রাচীন গুহার সামনে।
শেওলা পড়া, স্যাঁতস্যতে, পিচ্ছিল গুহাটা দেখে প্রথম দর্শনে কারো মনেই কোন সন্দেহ বাধবে না। তবে যে চেনার, সে ঠিকই চিনে নেবে। ASR গুহার সামনে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ চোখে খুঁটে খুঁটে দেখল পুরোটা—গুহার সামনের দিক ভাঙাচোরা, বুনো লতাগুল্ম ঝুলে ঝালে আবৃত চারপাশ।

ASR জানে এই সবই চোখের ভ্রম। এখানে এক পা ভুল মানে সাংঘাতিক মৃত্যু। তাই সে সবদানে এক পা এগিয়ে আসে গুহামুখ আবৃত্ত সাদা পাথরের দিকে।
সে ডান হাত উঠিয়ে ধীরে স্পর্শ করে পাথরটা। সাথে সাথেই একটা শিরশিরে ঠাণ্ডা কম্পন ছড়িয়ে যায় তার শরীরে।
সে চোখ বন্ধ করে লম্বা শ্বাস টানে। অতঃপর চোখ সরু করে তাকায় পাথরটার একেবারে নিচের দিকে।
সেখানে কিছুটা বরফ লাগানো।
ASR সেটাতে তর্জনী আঙ্গুল ছুঁইয়ে দেখতে পায়, সেটা আসল নয়, বরং আপাতদৃষ্টিতে ভ্রম সৃষ্টিকারী লিকুইড নাইট্রোজেন সৃষ্ট কৃত্রিম বরফ।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

নকল বরফ চিনে ফেলতেই তার দুরন্ধর মস্তিষ্ক রাস্তা পেয়ে যায়। সে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে পাথরটার সামনে।
পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা স্পেশাল গার্ড চারটে বলে—
“ভেতরে প্রবেশের কোন রাস্তা পেয়েছেন, বস?” প্রশ্ন করলে ও তারা উত্তরের আশা করে না।
আর তাই হয় গার্ডদের প্রশ্নের প্রত্যুত্তর করে না ASR। হাত বাড়ায় গার্ডের দিকে। সাথে সাথেই একটা কার্ড টুলবক্স থেকে হ্যান্ড গ্লাভস বের করে দেয়। ASR সেটা হাতে পরে নেয়। চারপাশ দেখে মনে হয় রহস্যের অন্তর্জাল আরো গণিভূত হচ্ছে।

ASR এবার কৃত্রিম বরফের দানাগুলো এক হাতে একটু সরিয়ে দেয়।
নকল বরফগুলো সরাতেই এবার তার চোখ পড়ে হিমের অন্তরালে লুকিয়ে থাকা ধূসর বৃত্তাকার রেড বাটনের উপর—
বাটনটা দৃষ্টিগোচর হতেই একটা অদৃশ্য রহস্যময় হাসি খেলে যায় ASR-এর ডার্ক রেড ঠোঁটে।
সে মুখটা একটু ঝুঁকিয়ে নেয় পাথরটার নিকট। খুব নিচু গলায় হালকা আওয়াজে বলে ওঠে—
“Abyss knows me.”

তার ঠোঁট থেকে উচ্চারিত তিনটে শব্দ বাতাসে মিশতেই সেই বৃত্তাকার পাথরের টেক্সচার বদলে যেতে থাকে…
হঠাৎ করেই বৃত্তটা মাঝখান থেকে একটু একটু করে গলতে থাকে, যেন সেটা বরফ নয়, স্মার্টলিকুইড মেটাল…
বৃত্ত সরে গিয়ে ভেতর থেকে উঠে আসে এক অস্পষ্ট নীলচে আলোর রেখা—মাটির ভিতর থেকে উঠে আসা ধোঁয়া-ধোঁয়া ঠাণ্ডা ভ্যাপসা একটা শ্বাস টেনে নেয় আশপাশের বাতাস।
সেই নীল আলো ফ্ল্যাশ করে এক সেকেন্ডে ASR-এর পুরো মুখটা স্ক্যান করে ফেলে—চোখের রেটিনা, গলার কম্পন, এমনকি ত্বকের পোরস ও ধুলোর নিচের জৈবঘটিত তাপমাত্রা সবকিছু এক সেকেন্ডে বিশ্লেষণ করে। ফিঙ্গারপ্রিন্ট স্ক্যান করে ASR-এর ডান হাতের তর্জনির নিচের রেখার উপর দিয়ে এক মাইক্রোপ্লাজমা আলো দ্রুত বেগে ছুটে যায়।

এক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে ১৪৩টি দেশের ডিজিটাল ক্রাইম ডেটাবেস এবং এনক্রিপ্টেড ব্ল্যাক স্যাটেলাইট রেকর্ড থেকে জিনগত ও চেহারার ম্যাচিং প্রমাণিত হয়।
এবার একটা যান্ত্রিক নারীকণ্ঠে ভেসে আসে কৃত্রিম ইন্টেলিজেন্সের কণ্ঠস্বর, যেটা simultaneously হিউম্যান এবং অমানবিক শোনায়। সে বলে—
“Genetic match: 99.9% — Subject Code: ASR. Welcome back, Alpha.”
তারপর সেই পাথরের টুকরোগুলো একে একে ভেতরের দিকে সরে যায়, যেন সে নিজে ওয়েলকাম জানাচ্ছে নতুন অতিথিকে।
অন্ধকারের মধ্যে সেই ফাঁকটা ধীরে ধীরে প্রশস্ত হয়… আর ধীরে ধীরে গুহার ভিতরকার আবরণ উঠে যায়, চোখের সামনে উন্মুক্ত হয় আসল চিত্র।

সামনে ধোঁয়া-ধোঁয়া আলোয় দেখা যায় মেটাল আর কাঁচের এক সুড়ঙ্গ। বাহির থেকে যেটাকে দেখে একটা সামান্য গুহা মনে হচ্ছিল, ভেতর থেকে সেটা এক অন্য দুনিয়া—বিজ্ঞানের এক অনবদ্য জগত। বসা থেকে উঠে দাঁড়ায় ASR। সেই গুহামুখে প্রবেশ করে ঘাড় বাঁকিয়ে তাকায় লেফট সাইডের দেওয়ালে।
গার্ড জ্যাকশন তার দিকে এগিয়ে দেয় একটা রিভলভার।
ASR সেটা হাতে নেয়। বাঁকা হেসে তাকায় FLIR Triton PT-Series CCTV ক্যামেরাটার দিকে।
এক সেকেন্ডের ব্যবধানে ক্যামেরাটার দিকে রিভলবার তাক করে ট্রিগার চেপে দেয়। সাথে সাথেই চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে পড়ে থাকে হাইটেক ক্যামেরাটা।
তারা এবার ধীর পায়ে এগিয়ে চলে ভেতরের দিকে। তার যত ভেতরে প্রবেশ করতে থাকে, ততই নিঃশ্বাসে ভারি হয়ে উঠেছে চারপাশ।

বাহির থেকে একটা সাধারণ গুহা মনে হলেও ভেতর থেকে এটা কিন্তু গুহা নয়।
এটার ভেতরের স্পেস সাধারণ গুহার মত নয়, বরং তার ১৫ থেকে ২০ গুণ বেশি হিউজ। এই হিউজ আকৃতির রিসার্চ সেন্টার দেখে মনে হচ্ছে সুপরিকল্পিতভাবে এটাকে নির্মাণ করা হয়েছে।
ভিতরে প্রবেশ করে সামনে কিছুদূর এগোতেই প্রথমেই চোখে পড়ে কানাডিয়ান মিলিটারি রিসার্চ ল্যাবরেটরি, যারা সেন্টারের ভেতর থেকে রিসার্চারদেরকে হাই প্রটেকশন দিচ্ছে। ASR সতর্কভাবে আরো কিছুদূর এগিয়ে যায়। দেখতে পায় এক জায়গা থেকে চতুর্দিকে বেকে গেছে বিল্ট-ইন মেটাল করিডোর। প্রত্যেকটা করিডোরে ১০ থেকে ১৫টা করে সাউন্ডপ্রুফ গ্লাস চেম্বার আর একের পর এক সাইবার ডোর।

চারপাশে নরম সাদা আলো জেনারেটেড ম্যাগনেটিক ফ্লো পুরো এলাকাটাকে অসহ্যভাবে ভারী করে তুলেছে।
ASR থেমে যায়। তার নৈশব্দ শিকারি চোখ দুটো কারো উপস্থিতি আঁচ করতে পারে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কয়েক মিলিসেকেন্ডে বুঝে নেয় সামনের দেয়ালের পেছনে তাদের থেকে ঠিক ৩৭ মিটার দূরত্বে হেঁটে আসছে ৫ জন মিলিটারি কম্যান্ডো। তাদের হাতে সব সময়ের মতো AK-47।
তারপর কয়েক সেকেন্ড আশপাশ একদম নীরব হয়ে যায়।
হঠাৎ—”দ্রুত বেগে ছুটে আসা একটা বুলেট নিঃশব্দে ঢুকে যায় এক সোলজারের মগজের ভেতর। কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যেই এই অতর্কিত ঘটনাটা ঘটে যায়। কেউ কিছু বুঝতে পারে না।
যার জন্য চোখের সামনে লুটিয়ে পড়ে তাদের সহযোদ্ধার নিথর দেহ।

রিসার্চ সেন্টারে অপরিচিত কেউ ঢুকে পড়েছে বুঝতে পেরে তৎক্ষণাৎ সতর্ক হয়ে যায় চারজন।
“Intruder spotted! Someone’s inside the research center!”
(অনুপ্রবেশকারী দেখা গেছে! কেউ রিসার্চ সেন্টারের ভেতরে ঢুকে পড়েছে!)— বলে চিৎকার করে একজন সোলজার।
“Take cover! Everyone, hide now!”
(কভার নাও! সবাই, তাড়াতাড়ি লুকিয়ে পড়ো!) বলে পিলারের আড়ালে ঝট করে লুকিয়ে পড়ে চারজন।
কিন্তু তাদের বুঝতে অনেক দেরি হয়ে যায়। দৌড়ে লুকাতে গেলে ASR পিছন থেকে সাইলেন্সার লাগানো হেভি কমব্যাট গানটার ট্রিগার চাপ দিতেই পিছন দিক থেকে ছুটে আসা গুলিতে চোখের পলকেই ঝাঁঝরা হয়ে যায় দুটো সোলজারের দেহ।

বাকি দুজন লাফিয়ে উঠে কভার নেয় স্টিল সিলিন্ডারের পেছনে।
“How the hell did he get in? Lock every gate, now!”
(সে ভেতরে ঢুকলো কীভাবে? সব গেট লক করো, এখনই!)!”
কিন্তু এত কিছু ভাবার সময় থাকে না। আড়াল থেকে গোলাগুলি শুরু হয়।
ধাতব করিডোর কেঁপে উঠে সোলজারদের গুলির শব্দে। রিসার্চ সেন্টারে কেউ প্রবেশ করেছে বুঝতে পেরে ইমারজেন্সি সাইরেন বেজে ওঠে। চারপাশ লাল আলোয় ভরে যায়। চেম্বারগুলো auto-lock হয়ে যায়। দৌড়ে আসে অন্য সোলজাররা।

ASR সহ তার চার গার্ড পেছন ঘুরে দেয়ালের পাশে লাফিয়ে পড়ে।
ASR নিঃশব্দে গিয়ে দাঁড়ায় একটা সোলজারের পিছে। হাত মুঠো হয়ে আসে। তার চিকচিকে ব্লেড বেরিয়ে আসে বুট থেকে—সেটা তুলে এক টানে গলার রগ কেটে দেয় সোলজারের। রক্ত ছিটকে পড়ে ইনফ্রারেড লাইটে, দৃশ্যটা হয়ে ওঠে বিভীষিকাময়।
আরেক সেকেন্ডে সে তার সাইলেন্সার গান উঁচু করে আরেক সেনার কপালে ঠক ঠক করে দেয়—!… মাথা উড়ে যায় নিঃশব্দে।
সেকেন্ডের মধ্যে ১০-১২টা লাশ পড়ে যায় থরে থরে। ASR-এর একজন গার্ড গুরুতরভাবে আহত হয়।
রিসার্চ সেন্টারের সিকিউরিটিতে যত সেনা ছিল, সকলেই খুন হয়ে যায় নিঃশব্দে।
মৃত লাশগুলোর দিকে তাকিয়ে ASR-এর ঠোঁটের কোণে ভয়ংকর বিকৃত হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
এই মানুষ খুন করার ব্যাপারটা বড্ড ইনজয় করে সে। যত বেশি ভয়ংকর মৃত্যু, তত বেশি সেলফ সেটিসফেকশন।
প্রিয়তার পর যদি কোন কিছু থাকে তীব্রভাবে আকর্ষিত করে, আসক্ত করে, সেটা হচ্ছে হিউম্যান হান্টিং (মানুষ শিকার)।

সে ডান হাতটা ঘাড়ের পেছনে রেখে ধীরে চাপ দিতে থাকে। পর মুহূর্তেই—
“মট মট!”
ঘাড়ের হাড়ে ভয়ানক শব্দ তুলতে তুলতে মাথাটা প্রায় ওয়ান এইটি ফাইভ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে ঘুরায়। লম্বা করে শ্বাস টানে। বাতাসে ভেসে বেড়ানো তাজা মানুষের রক্তের গন্ধ নাক দিয়ে ঢুকে ফুসফুসে ঠেকতেই নিঃশ্বাস ভারী হয়ে ওঠে তার। বাদামি চোখের পুতলি তীব্র হিংস্রতার আগুনে ঝলসে ওঠে—শিকারি নেকড়ের মত।
একসাথে এতগুলো তাজা লাশের গন্ধ নিতে পেরে মাথার ভেতর পৈশাচিক তৃপ্তির ঢেউ খেলে যায়।
আরো আরো রক্ত দেখার জন্য মন ব্যাকুল হয়ে ওঠে। প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠে পুরুষালী রক্তের শিরায় শিরায়।
বুকের ভেতর উতলে উঠে ফুটন্ত লাভা নদী—ক্ষুধা, রাগ আর হিংস্রতার এক তীব্র বিকৃত মিশ্রণ।
সে ধীরে মাথা ঘুরিয়ে তাকায় গার্ডদের দিকে। ঠোঁট নাড়ে না—শুধু হিংস্র চোখের ইশারায় কিছু বোঝায়।
বসের চোখ দেখে থরথর করে কেঁপে উঠে গার্ড তিনটে। দ্রুত চোখ নামিয়ে মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানায়।
বাঁকা হাসে ASR। অতঃপর সন্তর্পণে এগিয়ে যায় ল্যাবরেটরি রুমের দিকে।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৫৯

তার মনে বাজছে পৈশাচিক কোন সুর। মস্তিষ্কের রক্ত গরম হয়ে উঠছে শিকারের লোভে। সে যেতে যেতে হিংস্র ঠোঁটে বক্র হাসি ঝুলিয়ে বলে—
“আহ, নতুন শিকার। আমি এসে গেছি তোদের মৃত্যু দূত এসে গেছে। তোদের শিকার করে যে তৃপ্তি পাব, সেই রকম তৃপ্তি মনে হয় না আর জীবনে কোন শিকারে পাবো।” বলতে বলতেই তার ঠোঁটের হাসি মিলিয়ে যায়।
চরম রাগ, ক্ষোভ আর হিংস্রতার মিশেলে জ্বলে ওঠে তার চোখের মনি। ধপ করে ফুলে ওঠে কপালের শিরা।
সুদর্শন চেহারা তার কোন দিক থেকেই সুদর্শন লাগে না। এই চেহারা বর্তমানে যে দেখবে, সেই নিঃসন্দেহে হার্ট অ্যাটাক করবে।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬১