ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬১
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
কানাডার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে, নুনাভুট টেরিটরির এক অচিহ্নিত অঞ্চল—”ফ্রস্টহ্যাভেন”। মানচিত্রে এর উল্লেখ থাকলেও অবস্থান সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায় না। তাই সরকার এই জায়গাটাকে বাতিলের খাতায় ফেলেছে বহু আগে। কারণ, স্যাটেলাইট ইমেজ থেকেও এর কোনো সঠিক পিকচার পাওয়া যায় না। শুধু চারপাশ দুর্গম পাহাড়ে ঘেরা আর তুষারের ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা ভাব। সভ্যতা থেকে অন্তত এক হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই স্বর্গলোক, যেখানে পৌঁছাতে হলে পাড়ি দিতে হয় হাড়কাঁপানো বরফঝড় আর মৃত্যুর নীরবতায় মোড়া তুষারভূমি, যেখান থেকে এক পা ফসকালেই নিশ্চিত মৃত্যু।
তিন দিক ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ ছুঁয়ে থাকা খাড়া বরফ-আবৃত পর্বতশৃঙ্গ, যেন প্রকৃতিই নিজেই এই জায়গাটাকে দুর্গম ও নিষিদ্ধ করে তুলেছে। চতুর্থ দিকে বিস্তৃত এক হিমায়িত সমুদ্র—ফ্রোজেন নর্থ সি অব ওসেন, যার বুক ফুঁড়ে ওঠা নীল বরফে প্রতিফলিত হয় কেবল চাঁদের শীতল আলো। চারদিকের বাতাস এতটাই জমাট যে শ্বাস নিতে গেলেই ফুসফুস কেটে যাওয়ার মতো অনুভূতি হয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এই হিম রাজ্যের মধ্যপ্রান্তে জমাট বাঁধানো সমুদ্রের তীরে সগৌরবে দাঁড়িয়ে আছে এক স্বপ্নময় স্থাপত্য—সম্পূর্ণ কালো কাঁচে গড়া এক বিশাল ডুপ্লেক্স গ্লাস হাউস, যার পুরোটাই ব্ল্যাক মেটাল। সূর্যের আলোয় তা ঝলসে ওঠে বরফে গড়া আয়নার মতো, আর রাত নামলে নিজের নীলাভ আলোয় যেন শূন্য আকাশের অংশ হয়ে ওঠে। তুষারের প্রতিটি ফ্লেক কাঁচে লেগে হিমশীতল রত্নের মতো ঝলমল করে প্রতিনিয়ত।
পাশে জমাট বাঁধানো সমুদ্র তীরে নোঙর করা আছে এক আধুনিকতম ইস্পাত-গ্লাসের জাহাজ—”সেলেস্টিয়াল স্পাইন”, যার নকশা এতটাই নিখুঁত যে দেখলে শুধু দেখতেই মন চাইবে।
জায়গাটা এত সুন্দর, নিরিবিলি, শুনশান, মনোরম যে যে কারোরই ভালো লাগবে। কিন্তু জায়গাটা মোটেও বসবাসের যোগ্য নয়। অত্যন্ত দুর্গম—বরফের গহ্বর, পর্বতের ছায়া, জমাট হাওয়ার হাহাকার। এখানে কোনো মানুষের উপস্থিতি কল্পনাতেও আসবে না—অসম্ভব। একমাত্র ফ্রস্টহ্যাভেন প্রকৃতির এত অত্যাচার সহ্য করে এখনো সগৌরবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে টিকে আছে।
সাদা মখমলে বিছানায় প্রিয়তার তুলতুলে শরীরটা লেপ্টে আছে আদরে। ফ্যাকাশে মুখখানাতে যেন পুনরায় অঢেল রূপ লাবণ্য জেগে উঠেছে। ফর্সা টুকটুকে গোলাপি আভাযুক্ত গাল দুটো চিকচিক করছে, মায়াবী চোখের কালো কুচকুচে ভারী পল্লব দুটো একত্রে শোভা বর্ধন করছে। এত সুন্দর ন্যাচারাল আইল্যাশ হয়তো কেউ সারাদিন মাসকারা ঘষলেও পাবে না। পানপাতা মুখের গঠনে খাড়া নাক, প্রস্ফুটিত রক্ত লাল ঠোঁট, গোলাপি আভাযুক্ত মুখ—সর্বাঙ্গে যেন পূর্ণ যৌবনের ছোঁয়া।
কি যে দৃষ্টিনন্দন দৃশ্য, যে দেখবে সে শুধু দেখতেই থাকবে! এ যেন নারী নয়, প্রেমের দেবী। এমন নারীটিতে একবার যে পুরুষ আসক্ত হয়, এই নারীকে না পেলে সেই পুরুষের মৃত্যু ব্যতীত আর কোনো নিস্তার থাকে না! আর সেটা যদি হয় নিষিদ্ধ আসক্তি, তাহলে তো আর কথাই নেই। মানুষের আবার নিষিদ্ধ জিনিসের বড় টান।
এখন যেমন গত ১০ ঘণ্টা যাবৎ একটানা এক দৃষ্টিতে চরম তৃষ্ণায় তাকে অবলোকন করে চলেছে এক পুরুষ। তবু ও যেন তার এ দেখার কোনো শেষ নেই। সেই পুরুষের অতৃপ্ত মনের তৃষ্ণার কোনো অন্তই নেই।
যতো দেখবে, তৃষ্ণা ততোই বাড়বে।
যেন ৪ বছর নয়, ৪ জন্ম পর আবার দেখছে এই নারীকে। একটিবারও চোখের পলক এদিল-ওদিক ফেলছে না, পাছে যদি হারিয়ে যায়! আর যদি দেখতে পায়, তবে সইবে কীভাবে এই বেদনা?
প্রণয় নিষ্পলক চোখে দেখতে দেখতে প্রিয়তার নরম হাতটা তুলে নিজের বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরলো। সেই নারীর উষ্ণ হাতের স্পর্শে বুকের ভেতরটা যেন পরম সুখের জোয়ারে ভেসে গেল। আবেশিত নয়নজোড়া মুদে আসলো নিজে থেকেই। এই তো সেই সুখানুভূতি, সেই তৃপ্তি, সেই মায়া,সেই টান, সেই ভালোবাসা—যার তৃষ্ণায় সে ছটফটিয়ে মরেছে গত চার বছর। প্রণয় ধীরে চোখ মেলে তাকালো। নিজের বুকে লেগে থাকা হাতটা নিয়ে নিজের নাকের কাছে ধরল, বুকভরে নিঃশ্বাস টেনে নিল।
সাথে সাথেই হুড়মুড় করে পুরনো সেই মাদকীয় সুঘ্রান নাক দিয়ে ঢুকে হৃদপিণ্ডে গিয়ে ধাক্কা লাগলো। সেই সুগন্ধে যেন মন-মস্তিষ্ক জুড়িয়ে গেল প্রণয়ের। মনে অনুভব করলো এক অনিয়ন্ত্রিত অনুভূতির তরঙ্গ।
আবেশে ঠোঁট চেপে ধরলো প্রিয়তার কোমল হাতের উল্টো পৃষ্ঠে। এভাবে এপিঠ-ওপিঠ করে দুই পিঠে অগণিত চুমু দিল।
অন্তরেত অন্তরস্থল থেকে অনুভব করতে চাইল প্রিয় সেই স্পর্শ, কিন্তু মাদকীয় সেই স্পর্শে যে অবুঝ মনের পাগলামি আরো বাড়ছে।
তবে দৃষ্টিতে তার কামনা, বাসনা, উন্মাদনা কিছু নেই। যা আছে, তা কেবলি নিষ্পাপ মনের আকুলতা।
প্রণয় নিজের এত বছরের চাপা অনুভূতি কন্ট্রোল করতে পারল না। পুড়ে যাওয়া হৃদয়কে একটু খানি স্বস্তি দিতে হন্যে হলো মন।
নিজের অজান্তেই এগিয়ে গেল প্রিয়তার কাছে, খুব কাছে। প্রিয়তার লেফট সাইডে হাত রেখে প্রিয়তার মুখের ওপর সামান্য ঝুঁকে পড়লো। হাত রাখল তার দুই গালে। সাথে সাথেই বাদামি দুই চোখ পানি দিয়ে টলমল করে উঠলো। মন গহীনের শিকড় গেড়ে বসা যন্ত্রণার পাহাড় যেন দ্বিগুণ হলো। তবুও নিজেকে সামলে নিল প্রণয়। আলতো হাতে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে বুলিয়ে দিল প্রিয়তার নরম গাল। তীব্র আসক্তির নেশা দৌড়াচ্ছে শরীরের শিরায় শিরায়।
প্রণয় নিজের সবটুকু ভালোবাসায় গভীরভাবে ঠোঁট ডুবিয়ে দিল প্রিয়তার নরম গালে। সাথে সাথেই থেমে গেল প্রণয়ের পৃথিবী। এক সেকেন্ডেই মস্তিষ্ক থেকে নিঃসৃত হলো প্রচুর পরিমাণে ডোপামিন, সেরোটোনিন, অক্সিটোসিন নামক হ্যাপি হরমোন।
এতো সুখ কেন? এই মেয়েটার মাঝে এত শান্তি কেন? এত ভালোবাসাই বা কেন? কেন এই মেয়েটার স্পর্শ তাকে উন্মাদ বানিয়ে দেয়? আর কেনই বা এই মেয়েটার দূরত্ব তাকে মনুষ্যত্ব ভুলিয়ে দেয়? এই কেনোর উত্তর কখনো খুঁজে পায় না প্রণয়। এটাকে কি ভালোবাসা বলে, নাকি পাগলামি—তাও জানে না প্রণয়।
প্রণয় একই ভাবে অন্য গালেও ঠোঁট চেপে ধরল। আলতো করে ঠোঁট চাপতেই নরম গালটা এক ইঞ্চির মতো ভিতরে ঢেবে গেল। পর পর পাগলের মতো দুই গালে অসংখ্যবার ঠোঁট ছুঁয়ালো প্রণয়।
শুভ্র মুখের ওপর পড়া দুই-একটা চুল কানের পিঠে গুজে দিয়ে কাতর কণ্ঠে বললো—
— আমি তোকে অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি, তাই না, প্রাণপাখি? আমার ওপর অনেক রাগ হয়, আমাকে অনেক ঘৃণা করতে চাস, তাই না?
কিন্তু কী করব বল? আমি যে কাপুরুষ। সাধ থাকলেও আমার আর সামর্থ্য নেই তোকে নিজের করার। আমি বড়জোর সবকিছু ধ্বংস করে দিতে পারি, নিজেকেও ধ্বংস করে দিতে পারি। কিন্তু তোকে ছেড়ে যেতে পারি না আমি। আমি একদম পচে গেছি, জান। বিশ্বাস কর, একদম পচে গেছি। তাই সত্যি, এখন আমি মন থেকে চাই প্রয়োজনে…
— তোর বিরহে আমার মৃত্যু হোক! তবুও তোর আর আমার মিলন না হোক।
আমি আর কোনো মতেই তোর সুন্দর জীবনটাতে আমার কালো হাতের থাবা বসাতে পারবো না। যাকে নিজের হাতে একটু একটু করে আদর জমিয়ে জমিয়ে গড়েছি, তাকে ধ্বংস করে দিতে পারব না।
তাই ভুলে যা আমাকে। ভাগ্যে যা আছে তা-ই শিকার করে নে। মেনে নে। এক জীবনে সবাই সব পায় না। সবার সব চাওয়াও পূরণ হয় না। তেমন এই জীবনে না হয় আমাদের অপূর্ণতাই থাকলো।
তুই আমায় চাস, আমি তোকে চাই। কিন্তু ভাগ্য আমাদের একসাথে দেখতে চায় না, জান।
ছোট করে দম ফেলল প্রণয়। বন্ধ চোখের পাপড়িতে পুনরায় চুমু দিয়ে বলল—
— এতো কেন ভালবাসলি আমায় তুই? যাতে আমায় ভুলতে পারিস, সে জন্য তোকে নিজের থেকে এত দূরে রাখলাম। নিজেকে পুড়ালাম, তোকে পুড়ালাম। কিন্তু এতো কিছু করে কি লাভ হলো? তুই তোর চার বছরের জমানো অভিমানটাকেই রাগে পরিণত করতে পারলি না, তুই ফেল…
আমি জানি, তোর এসব ঘৃণা সত্যি নয়। আমার প্রাণ কখনোই আমাকে ঘৃণা করতে পারে না, বড়জোর খুব অভিমানে গাল ফুলিয়ে রাখতে পারে। তবুও আমি মন থেকে চাই, তোর এই অভিনয় আমার মৃত্যু পর্যন্ত স্থায়ী হোক। আমি যেন তোকে কখনো দুর্বল না দেখি।
তোকে হয়তো এই জীবনে কখনো বলা হবে না, তোকে কতটা ভালোবেসেছি, কতটা চেয়েছি, তোকে বুকের ঠিক কোথায় রেখেছি। সেসব না হয় না বলাই থাক। আমি তোকে ছায়া দেবো যতক্ষণ জীবিত আছি।
বিনিময়ে শুধু এটুকুই চাইবো—তুই অনেক ভালো থাকিস। আর মাঝে মাঝে শুধু অভিমানী চোখে একবার আমায় দেখিস। তাতেই হবে।
বলতে বলতে ঠোঁট কেঁপে উঠলো প্রণয়ের। প্রিয়তার চকচকে গালে গড়িয়ে পড়লো দুই-এক ফোঁটা তরল অশ্রু।
প্রণয়ের মন বলছে—কোনোভাবে যদি এই মেয়েটাকে বুকে একেবারে গভীরে কোনো এক গোপন কুঠুরিতে চিরতরে লুকিয়ে ফেলা যেত! যেখান থেকে এই মেয়েটাকে আর দেখবে না কেউ, চাইবে না কেউ, খুঁজবে না কেউ। ভালোবাসার অধিকার ছিনিয়ে নেবে না। এমনি কোনো উপায় যদি সত্যি থাকতো!
নিজের ভাবনায় নিজেই হেসে ফেলল প্রণয়। পুনরায় প্রিয়তার দিকে গভীর দৃষ্টিপাত করে বলল—
— জানিস পাখি, এই ৪ বছরে আমি তোর অভাবে কতো পুড়েছি। দূরে থেকে কতোটা পুড়িয়েছিস আমায়। তোর অভাব মেটাতে কী কী করেছি! কিন্তু পারিনি ভাই। তুই বল, তোর মাঝে এমন কী পদার্থ আছে, যা এই সাত আসমানের কোথাও নেই?
প্রণয় বলতে বলতে চুপ হয়ে গেল। মাথার চুলে ঠোঁট ছুঁইয়ে আকুল কণ্ঠে বললো—
— সব দোষ তোর জানিস। আমি তো ভালোই ছিলাম। তুই কেন এলি আমার জীবনে? আর এলি, যখন তখন আমার জান কেন আমার হয়ে ও আমার হলি না? এভাবে মরলে কি আমি মরে ও শান্তি পাবো? কেন আমায় ধ্বংস করার জন্য তোকে বাড়ানো হলো? অন্য কোনো উপায় কি ছিল না? আমি কি তোকে ছাড়া কী চেয়েছিলাম জীবনে? বল না জান, কী চেয়েছিলাম?
বলতে বলতে জমে ওঠা কান্নাতে গলা জড়িয়ে আসলো প্রণয়ের।
কিন্তু প্রিয়তার তরফ থেকে কোনো উত্তর ভেসে এলো না। সে নিস্তব্ধ।
ক্ষীণ হাসলো প্রণয়। আর কিছু না বলে নীরবে মাথা রাখলো প্রিয়তার বুকে। শুয়ে শুয়ে তৃপ্ত কণ্ঠে বললো—
— বলতো, এই পাপের জীবনের বোঝা আমি কেন বয়ে বেড়াচ্ছি?
কিন্তু অপরপক্ষ নীরব।
তবু প্রণয় চুপ থাকলো না। নিজেই কণ্ঠে আগ্রহ ঢেলে বললো—
— এই পাপের জীবন বয়ে বেড়াচ্ছি কেবল তোকে দেখার লোভে। কারণ, মরে গেলে তো চিরতরে হারিয়ে যাবো। আর কখনো আমার প্রাণটাকে প্রাণভরে দেখতে পাবো না। একটু ছুঁয়ে আদর করে দিতে পারবো না।
আর আমি এতটাই পাপী যে, আমি তোকে হাসর কিয়ামতের ও পাওয়ার আশা রাখি না। কারণ, আমার জন্য জাহান্নামের আগুন বরাদ্দ করা হয়েছে অনেক পূর্বেই। তাই যতদিন বেঁচে থাকবো, ততোদিনই তো আমার প্রাণটাকে প্রাণভরে দেখতে পারবো।
“আসবো স্যার।”
বাহির থেকে ভেসে আসা ভারী আওয়াজে ঠিক হয়ে বসলো প্রণয়। প্রিয়তার শরীর ভারী কমফোর্টারটা দিয়ে ঢেকে দিলো।
“আসো,” ভরাট কণ্ঠে বললো প্রণয়।
ঘরের ভেতর জাভেদসহ একজন ৬০ ঊর্ধ্ব ভদ্রলোক প্রবেশ করলেন। জাভেদ এগিয়ে এসে নিচু কণ্ঠে বললো,
“বস, উনি ডাক্তার মার্কো। অনেক কষ্টে উনাকে তুলে এনেছি।”
ডাক্তার মার্কো চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছেন প্রণয়ের দিকে। সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত—মানে বিখ্যাত কুখ্যাত ASR-কে চোখের সামনে দেখে ভয়ে ছুটে উনার কাপড় ভিজিয়ে ফেলার উপক্রম। তিনি এখানে আসতে চাননি কিছুতেই।
প্রণয় ডাক্তার-এর দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিল। অতঃপর ঠাণ্ডা কণ্ঠে বাক্য ছুড়লো,
“জাভেদের কাছ থেকে সব কিছু শুনেছেন নিশ্চয়ই।”
প্রণয়ের পুরুষালি ভারী কণ্ঠে লাফিয়ে উঠলেন ডাক্তার মার্কো। মাথা নিচু করে ভয় ভয় করে বললেন,
“জি স্যার, সব শুনেছি। ক্-কিন্তু যদি একবার চেকআপ করতে পারতাম, তাহলে…”
ডাক্তার কথা শেষ করার পূর্বেই হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো প্রণয়। হিমশীতল কণ্ঠে বললো,
“ঠিক আছে, দেখুন। কিন্তু খবরদার, একদম হাত লাগাবেন না।”
ডাক্তার বেচারা আচ্ছা ফেঁসাদে পড়লো। হাত না লাগিয়ে চেকআপ করবে কীভাবে! কিন্তু ASR-এর সঙ্গে তর্ক করার মতো বুকের পাটা শুধু তার কেন, ১৪ কুলে কারো নেই।
তাই ডাক্তার ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে এগিয়ে গেলেন। বুকে একটু সাহস যোগিয়ে কম্পিত কণ্ঠে বললেন,
“জি স্যার, আপনি যদি ম্যাডামের চোখ দুটো খুলে দেখাতেন, তাহলে বুঝতে…”
এবারও ডাক্তারকে কথা শেষ করতে দিলো না প্রণয়। প্রিয়তার চোখের পাতা হালকা মেলে ধরলো। ডাক্তার মার্কো ভালো মতো পরীক্ষা করলেন। এবার স্টেথোস্কোপ-এর মাথাটা প্রণয়ের দিকে এগিয়ে দিয়ে ঢোক গিলে বললেন,
“স্যার, এটা বুকে চেপে ধরুন। হার্টবিট মাপতে হবে।”
প্রণয় স্টেথোস্কোপটা হাতে নিলো। কিন্তু বুকে স্পর্শ করতে হবে ভাবতেই তার গলা শুকাচ্ছে, শরীর কেমন কেমন করছে। কিন্তু এখন এসব উল্টোপাল্টা ফিলিংসকে সে পাত্তা দিল না। ডাক্তারের কথা মতো কাজ করলো। কমফোর্টারের নিচে হাত ঢুকিয়ে আলতো করে স্টেথোস্কোপটা প্রিয়তার বুকে, ডান পাশে ধরলো। ডাক্তার ইয়ার টিউব কানে পরে হার্টবিট বোঝার চেষ্টা করলেন। কিন্তু ভালো মতো বোঝাই যাচ্ছে না।
তাই প্রফেশনাল ভঙ্গিতে বললেন,
“আরেকটু জোরে চাপুন।”
ডাক্তারের কথায় মেজাজটা গরম হয়ে গেল প্রণয়ের। এমনি উল্টোপাল্টা জায়গায় হাত লাগছে বলে বুকের ভেতরে ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে গেছে। হাত কাঁপছে, পা কাঁপছে, বুক ধরফর করছে। এর মধ্যে এই ব্যাটা আরো জোরে চাপতে! কিন্তু নিজের এই অসস্থি প্রকাশ করলো না প্রণয়। কম্পিত হাতে ডাক্তারের কথামতো স্টেথোস্কোপের মাথা জোরে চেপে ধরলো।
এই হাড় হিম করা শীতেও কপাল ঘামছে প্রণয়ের। জাভেদ স্যারের ফিলিংস আন্দাজ করতে পেরে মুচকি মুচকি হাসলো।
ডাক্তার প্রেসার মেপে আরো কিছু টেস্ট করে প্রফেশনাল ভঙ্গিতে বললেন,
“স্যার, আপনারা যেরকমটা ভাবছেন ওরকম নয়। উনাকে নিউরো মেডিসিন ACO-টা পুশ করা হয়নি। কারণ ওই মেডিসিনটা সাবজেক্ট-এর বডিতে পুশ করার আগে কমপক্ষে ৪৮ ঘণ্টা বডিটা প্রিজারভেশনে রাখতে হয়। সেখানে ম্যাডামকে মাত্র ২৪ ঘণ্টা রাখা হয়েছে। তাই বিশেষ কোনো চিন্তা নেই। তবে…”
প্রণয় গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“তবে কী?”
ডাক্তার কয়েক সেকেন্ডের বিরতির পর বললেন,
“খুব সামান্য মাত্রায় উনার বডিতে ওই মেডিসিনটা পাওয়া গেছে। কারণ ফাইনাল টেস্টের আগে ওরা প্রি-টেস্ট করে দেখতে চেয়েছিল ওই মেডিসিনের এফেক্টে ম্যাডামের বডি কিরকম বিক্রিয়া করে বা ম্যাডাম আদৌ ওই মেডিসিনটা নেওয়ার উপযুক্ত কিনা।”
ডাক্তারের কথায় প্রণয়ের চেহারার রং পাল্টাতে শুরু করলো। যা দেখে ভড়কে গেলো জাভেদ। তাড়াহুড়ো করে ডাক্তারকে বললো,
“কি বলছেন ডাক্তার? এর কোনো সাইড এফেক্ট আছে?”
জাভেদের কথায় ডাক্তার মার্কো উপর-নিচ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
“স্যার, এটা অনেক পাওয়ারফুল একটা মেডিসিন। যাকে-ই দেওয়া হয় সে আজীবনের জন্য পাগল হয়ে যায়। তবে যেহেতু উনার শরীরে খুব সামান্য মাত্রা আছে, তাই কিছুই হবে না। তবে অবশ্যই এর অ্যান্টিডট দিতে হবে।”
জাভেদ দ্রুত সম্মতি জানিয়ে বললো,
“এর অ্যান্টিডট আমরা এনেছি ওই ল্যাব থেকে। এখনই নিয়ে আসছি।”
বলে চলে যেতে নিলো। ডাক্তার তৎক্ষণাৎ পিছন থেকে বলে উঠলেন,
“কমপক্ষে ১০-১২ ঘণ্টার আগে উনাকে অ্যান্টিডট দেওয়া যাবে না।”
প্রণয় এবার শীতল চোখে তাকিয়ে কঠিন কণ্ঠে বললো,
“তাহলে কি ১২ ঘণ্টা আমার জান এভাবে পড়ে থাকবে?”
ডাক্তার দ্রুত দুই পাশে মাথা নেড়ে অসম্মতি জানিয়ে বললেন,
“না স্যার, ম্যাডামের সেন্স কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরবে। তবে…”
এই “তবে তবে” শুনে রাগ ধরে যাচ্ছে প্রণয়ের।
ডাক্তার আর হেলাফেলা করে নিজের বিপদ বাড়ালেন না। সরাসরি বললেন,
“যতক্ষণ না পর্যন্ত ম্যাডামের বডিতে অ্যান্টিডট পুশ করা হচ্ছে, ততক্ষণ উনি বর্তমানে থাকবেন না।”
প্রণয় কপাল কুঁচকে বললো,
“মানে?”
ডাক্তার শান্ত স্বরে বললেন,
“মানে হয়তো উনি উনার জীবনকাল থেকে কিছু বছর পিছে গিয়েছেন। এখন সেটা কত বছর সেটা তো উনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে ১০–১২ ঘণ্টা পর যদি অ্যান্টিডট পুশ করা হয়, তবে উনি একেবারে আগের মতো হয়ে যাবেন।”
জাভেদ বিস্ময় নিয়ে চোখ গোল গোল করে বললো,
“তার মানে আপুর বর্তমানের কথা মনে থাকবে না?”
ডাক্তার দুই পাশে মাথা নাড়লেন।
প্রণয় যা জানার তা জানা হয়ে গেছে। পাশের টেবিল থেকে রিভলভারটা হাতে নিলো। হাতের তালুতে ঘুরাতে ঘুরাতে বললো,
“আমি কাউকে বিশ্বাস করি না। এই রঙের দুনিয়ায় নিঃশ্বাসও বিশ্বাসঘাতকতা করে। সেখানে…?”
কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই ডাক্তার মার্কো এসে হুরমুরিয়ে প্রণয়ের পায়ের কাছে ঝুঁকে পড়লো। কাকুতি-মিনতি করে বললো,
“প্লিজ স্যার, আমায় মারবেন না। আমি কাউকে কিছু বলবো না।”
প্রণয় বাঁকা হেসে বললো,
“কিছু জানলে তবে তো বলবেন। গার্ড।”
সাথে সাথে দু’জন কালো পোশাক পরিহিত গার্ড এসে ডাক্তারকে তুলে নিয়ে যায়।
জাভেদ প্রণয়ের দিকে তাকিয়ে ভয় ভয় করে বললো,
“উনাকে কি মেরে ফেলবেন স্যার?”
প্রণয় বাঁকা হাসলো। রিভলভারটা যথাস্থানে রেখে দিয়ে বললো,
“না। কেবল গত ১ সপ্তাহ ভুলিয়ে দেবো।”
জাভেদ-এর দ্বিতীয় প্রশ্ন করার সাহস পেলো না। সে পেছন ফিরে বেরিয়ে যেতে নিলো। পেছন থেকে পুনরায় ভরাট কণ্ঠ ভেসে এলো,
“৫ মিনিটের মধ্যে বাড়িটা খালি করো। আগামী ১২ ঘণ্টা আমি এই বাড়ির ভেতর কাউকে দেখতে চাই না। সব গার্ডদের বাইরে আউট হাউসে শিফট করে দাও। কোনো দরকার পড়লে আমি নিজেই ডেকে নেবো।”
জাভেদ ঢোঁক গিলে সম্মতি জানিয়ে বললো,
“জি স্যার।”
“হুম।”
হুম শুনে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালো না জাভেদ। এক ছুটে পালিয়ে গেলো। যাওয়ার আগে অবশ্যই মনে মনে ভ্যাংচি কেটে বললো,
“যাচ্ছি যাচ্ছি। আমারও কোনো শখ নেই এখানে থাকার। নিজ ইচ্ছেয় কোন শালা চায় সিংহের গুহায় থাকতে!”
জাভেদ চলে যেতেই প্রণয় ঘুরে তাকালো প্রিয়তার দিকে। হালকা হেসে নাকে নাক ঘষে দিয়ে বললো,
“তাহলে আমি আবার আমার বাচ্চাটা কে ফেরত পেতে চলেছি।”
সাথে সাথেই প্রিয়তার বন্ধ চোখের পাপড়ি কেঁপে উঠলো। প্রণয় বাঁকা হেসে সোজা হয়ে বসলো। প্রিয়তা ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকালো সিলিং-এর দিকে। বিরাট একটা হাই তুলে উঠে বসলো চোখ কচলে গলা ফাটিয়ে ডাকলো,
“আম্মু, ওহ আম্মু! কোথায় তুমি? স্কুলে যাবো তো, খবার দাও আমি গোসল করে আসছি।”
বলতে বলতে আড়মুড়ো ভেঙে আবারো মুরগির বাচ্চার মতো ঝিম মেরে বসে রইলো প্রিয়তা।
ঘুম থেকে ওঠার পর কিছুক্ষণ না ঝিমালে মাথার ভেতরটা ফাঁকা ঢোল মনে হয়। প্রিয়তা কিছুক্ষণ ঝিম মেরে সতেজ হওয়ার চেষ্টা করল। আলসেমি ছেড়ে নিজের দিকে তাকাতেই লাফিয়ে উঠলো। সচকিত হয়ে নিজের গায়ের দিকে ভালো মতো তাকাতেই বিস্ময়ে তার চোখ দুটো রসগোল্লার মত বৃহৎ আকৃতি ধারণ করল।
সে চোখ দুটো আরো বড়ো করে নিজের হাতটা চোখের সামনে তুলে ধরলো।
ওর গায়ে একটা বিশাল আকৃতির ঢিলঢুলে ফরমাল শার্ট, যেটার মধ্যে ওর মতো ৩টা প্রিয়তা হয়তো অনায়াসে ফিট খেয়ে যাবে। শার্টটা হাতাগুলো এত বড়ো আর লম্বা লম্বা যে প্রিয়তার হাতের তালু পর্যন্ত ঢেকে গেছে। প্রিয়তা নিজের বিস্ময় কাটাতে পারলো না। চোখ-মুখ হাঁ করে বিরবির করলো,
“আমাকে কি ভূতে ধরলো? কাল রাতে প্লাজো টি-শার্ট পরে ঘুমালাম, আর সকালে এটা আলখাল্লা হয়ে গেলো?”
নিজের বিস্ময় নিয়ে বেশি দূর এগোতে পারলো না প্রিয়তা। তার আগেই সাদা রঙা ফরমাল শার্টটা থেকে একটা খুব সুন্দর পরিচিত পুরুষালি গন্ধ ভেসে আসছে। গন্ধটা নাকে লাগতেই অটোমেটিক্যালি বুলি বন্ধ হয়ে গেলো প্রিয়তার। এবার যেন আর মেয়েটার বিস্ময়ের অন্ত রইলো না।
সে মাথা চুলকে গায়ের উপর থেকে কমফোর্টার সরালো। তার নিচের দৃশ্য দেখে
“আয়ায়ায়ায়ায়ায়ায়া!” বলে ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো প্রিয়তা।
সাথে সাথেই পাশ থেকে সজরে রাম ধমক ভেসে এলো।
“চুপ করবি!”
ধমক খেয়ে কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। কাঁদো কাঁদো মুখে চোখ পিটপিট করে পাশ ফিরিয়ে তাকালো। প্রণয় ওর দিকেই বিরক্তি মাখা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
প্রণয়ের দিকে চোখ পড়তেই চুয়াল আলগা হয়ে ঝুলে গেলো প্রিয়তার। মুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইলো প্রণয়ের দিকে। তার শব্দ ভান্ডার যেন এক নিমিষেই তালা লেগে গেল।
প্রিয়তার হতবাক দৃষ্টি দেখে বেশ মজা পেলো প্রণয়। প্রিয়তার মুখের কাছে মুখ নিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“চোখ নামা। তোর দৃষ্টি দেখে আমার ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে পানি ছাড়াই গিলে খাবি আমাকে।”
প্রণয়ের এমন লাগামছাড়া কথায় থতমত খেয়ে গেলো প্রিয়তা। ঝট করে চোখ নামিয়ে নিলো। তবে সেকেন্ড গড়ানোর আগেই আবার ফট করে মাথা তুলে তাকালো। প্রণয় কিছু বুঝে ওঠার আগে এক লাফে প্রণয়ের কাছে চলে গেলো।
তবে অবাক হলো না প্রণয়। প্রিয়তা প্রণয়ের একদম কাছে বসে আবার বড়ো চোখে দেখতে লাগলো। আসলে মেয়েটা বোঝার চেষ্টা করছে।
প্রণয় ওর দৃষ্টি কে পাত্তা না দিয়ে উঠে যেতে নিলে প্রণয়ের শার্ট টেনে ধরলো প্রিয়তা।
বাধা প্রাপ্ত হয়ে ফুঁশ করে নিঃশ্বাস ছাড়লো প্রণয়। পেছন ফরে তাকিয়ে ভ্রু বাকিয়ে বললো,
“কি চাই?”
প্রিয়তা বিস্মিত, চমকিত, চরম আশ্চর্যমিত সব কিছু একত্রে মিশিয়ে বললো,
“আপনি সত্যি বলুন, আপনি আমার প্রণয় ভাই তো?”
প্রিয়তার কথায় প্রণয়ের ঠোঁটের কোনে অদৃশ্য হাসির রেখা খেলে গেলো, তবে তা চেহারায় প্রকাশিত হলো না। প্রণয় চেহারার গাম্ভীর্য এঠেঁ বলল,
“কেন বলতো?”
প্রিয়তা আবার গাল হাঁ করে বললো,
“এক রাতে আপনি এত সুন্দর হয়ে গেলেন কিভাবে প্রণয় ভাই? কাল রাতেও তো অন্যরকম ছিলেন, তাহলে এক রাতে এত সুন্দর কিভাবে হলেন?”
প্রণয় মনে মনে কপাল চাপড়ে বললো, ঢেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভাঙে!
কিন্তু মুখে বললো,
“তাই এক রাতে পরিবর্তন হয়ে গেছি! তা কী কী পরিবর্তন হয়েছে ম্যাডাম?”
প্রিয়তার উৎসাহ বাড়লো। সে প্রণয়ের শার্ট ধরে টেনে তাকে পুনরায় নিজের পাশে বসালো।
চোখ ছোট ছোট করে তাকালো প্রণয়ের দিকে। হাত দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো সব পরিবর্তন। প্রথমেই ঠোঁটে বৃদ্ধাঙ্গুলি ছুঁইয়ে বললো,
“আপনার ঠোঁট দুটো আগের থেকেও ৫ গুণ বেশি শাইন করছে। আরো ডার্ক মনে হচ্ছে।”
প্রিয়তার অপ্রত্যাশিত স্পর্শে প্রণয়ের হার্টবিট হুট করেই বেড়ে গেলো। নেশাগ্রস্ত চোখে তাকালো সে প্রিয়তার নীলাভ চোখে। মোহনীয় কণ্ঠে বললো,
“আর?”
প্রিয়তা এবার গালে হাত রাখলো। অন্যমনস্কভাবে বললো,
“আপনার গালের দাড়ি গুলো কেমন অতিরিক্ত সুন্দর হয়ে গেছে। মানে, আমি বলতে চাইছি আপনার পুরো ফেসটাই আরো সুন্দর হয়ে গেছে। কেমন পরিণত পরিণত একটা ভাব।”
“আর?”
প্রিয়তা এবার প্রণয়ের পেশীবহুল হাতের পেটানো মাসেলস গুলো ছুঁয়ে দিল। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে দেখতে বললো,
“আপনার হাতের বাইসেপসগুলো আরো বেশি দৃঢ় ও শক্ত হয়েছে।”
“আর?”
প্রিয়তা এবার প্রণয়ের গলার অ্যাডামস অ্যাপল-এ আলতো হাত ছুঁইয়ে অবুঝ কণ্ঠে বললো,
“এটা আরো অনেক বেশি স্পষ্ট। একদম রিয়েল অ্যাপল!”
“আর?”
প্রিয়তা এবার প্রণয়ের বুকে হাত রাখলো। পুরুষালি বুকের ছাতি পর্যবেক্ষণ করে বললো,
“এটা আরো বেশি প্রশস্ত।”
“আর?”
প্রিয়তা এবার কোমর জড়িয়ে ধরলো। আরো বিস্ময় নিয়ে বললো,
“বাপরে! আপনি তো হাতেই আসছেন না।”
“আর?”
প্রিয়তা এবার পায়ের নখ থেকে মাথার চুল পর্যন্ত দেখে নিজের থুতনিতে হাত রেখে বললো,
“হুঁউউ! বিষয়টা খুবই রহস্যজনক। এক রাতে আপনার পুরো বডি চেঞ্জ হয়ে গেছে কিভাবে? কি খেয়েছেন কাল রাতে?”
প্রিয়তার এমন উল্টোপাল্টা স্পর্শে প্রণয় কিছু বলতে পারলো না। তার বুকের ভেতর নিঃশব্দে পাহাড় গলতে লাগলো। শুকনো ঢোঁক গিলার সাথে নড়ে উঠলো গলার অ্যাডামস অ্যাপল।
প্রণয়ের জবাব না পেয়ে প্রিয়তা ড্যাব ড্যাব চোখে তাকিয়ে মনে মনে বললো, বাবা বাহ, কী মারকাটারি সেক্সি ফিগার মাইরি!
প্রিয়তার চোখের ভাষা পড়ে হেসে ফেললো প্রণয়। প্রিয়তার নাক টেনে বললো,
“নষ্ট চোখে আমায় দেখা বন্ধ কর। উঠে গিয়ে ফ্রেশ হও।”
প্রিয়তা কথার সাপেক্ষে কিছু বলতে গেলেই তার দৃষ্টি পড়লো পাশের দেওয়ালে। সাথে সাথেই ভ্রু কুঁচকে এলো প্রিয়তার। প্রণয় ভাইয়ের হটনেসে সে এতটাই ফিদা হয়ে গিয়েছিলো যে পারিপার্শ্বিক সবকিছু মাথা থেকে উড়ে গিয়েছিলো। প্রিয়তা প্রণয়ের ভাবনা ঝেড়ে সরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। ধীরপায়ে পুরো ঘরে চোখ বুলাল।
এটা ঘর। প্রিয়তার পূর্ব দিকের দেওয়ালে তাকিয়ে দেখলো, কাচের দেওয়াল ভেদ করে অদূরে বরফে ঢাকা পর্বত শৃঙ্গ দেখা যাচ্ছে। এটা দেখে প্রিয়তার মুখ আবার হাঁ হয়ে গেলো। সে দক্ষিণ দিকের দেওয়ালে তাকাতেই তার দৃষ্টিতে মুগ্ধতার ছেঁয়ে গেলো। আকাশ থেকে তুলোর মতো তুষার ঝরে ঝরে পড়ছে। সেই দৃশ্য নিন্দনীয় দৃশ্যের সবটাই কাচের দেওয়ালের এপাশ থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
প্রণয় বিছানায় গা এলিয়ে প্রাণ ভরে দেখলো প্রিয়তার মুগ্ধ চোখের দৃষ্টি।
দেখতে দেখতেই প্রিয়তার হাসি মাখা মুখটা হুট করে নিভে গেলো। ঝড়ের বেগে মাথায় একটা প্রশ্ন জাগলো। সে পাশ ফিরেই ভ্রু কুঁচকে তাকালো প্রণয়ের দিকে। পুনরায় প্রণয়ের কাছে গিয়ে হতবিহ্বল কণ্ঠে বললো,
“আমি এখানে কী করে আসলাম প্রণয় ভাই? আমি তো কাল রাতে আমার ঘরেই ঘুমিয়েছিলাম। তাহলে পাহাড় কোথা থেকে এলো আর স্নোফলই বা কোথা থেকে আসলো?”
প্রণয় শান্ত চোখে দেখলো প্রিয়তার মনের কৌতূহল। সে প্রিয়তার কথায় পাত্তা না দিয়ে ব্যঙ্গ করে বললো,
“হুঁ, মনে থাকবে কিভাবে? যে তেলাপোকার কামড় খেয়ে ১০ ঘণ্টা ফিট হয়ে পড়ে থাকে সে কি আর এত কিছু মনে রাখতে পারে?”
প্রণয়ের কথায় জমে গেলো প্রিয়তা। ভীত চোখে আশপাশ তাকিয়ে প্রণয়ের গা ঘেঁষে বসে পড়ল। ভয়ার্থ কণ্ঠে বললো,
“ক্কি ক্কি বলছেন? এই ঘরে তে- তেলাপোকা আছে, নাকি?”
প্রণয় বাঁকা হাসলো। তবে চেহারা সিরিয়াস করে বললো,
“তুই কি বলতে চাস আমি মিথ্যা কথা বলি?”
প্রিয়তা এবার আরো গা ঘেঁষে বসলো প্রণয়ের। হুট করেই বলিষ্ঠ বাহু আঁকড়ে ধরলো। অভিমানী কণ্ঠে বললো,
“মা-মা! মানে সত্যি! ওই তেলাপোকাটা আমাকে অজ্ঞান করে দিলো! আর আপনি চুপ করে দাঁড়িয়ে দেখলেন? জুতার বাড়ি মেরে মেরে ফেলতে পারলেন না?”
প্রণয় আরো খানিকটা সিরিয়াস হলো। গম্ভীর কণ্ঠে বললো,
“হুম, সত্যি। এই বাড়ি ভরতি ভূত আর তেলাপোকা। কারণ বাইরে -৫০ ডিগ্রি তাপমাত্রা। এই হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় বেচারারা কোথায় যাবে? তাই আমায় বললো তাদের একটু আশ্রয় দিতে। আমার ও দয়ার শরীর, তাই থাকতে দিলাম। আর ভয় দেখিয়েছে তোকে। মারবি তুই? আমি কেন জীব হত্যা করতে যাবো?”
ভূতের কথা শুনে এবার হাত ছেড়ে পেট ঝড়িয়ে ধরলো প্রিয়তা। ধীরে ধীরে বুকের গভীরে মুখ ডুবালো। কম্পিত কণ্ঠে বললো,
“শুধু শুধু ভয় দেখাবেন না প্রণয় ভাই।”
এবার আর কোনো প্রত্যুত্তর করলো না প্রণয়। একদম শান্ত হয়ে গেলো।
প্রিয়তার প্রত্যেকটা উষ্ণ নিঃশ্বাস গিয়ে জমা হচ্ছে প্রণয়ের বুকের গভীরে। এই শান্তিনীড়ে প্রিয়তা আজ বহুকাল পর পুনরায় আশ্রয় পেলো। প্রিয়তা বুক থেকে মাথা তুলতে চাইলেও অদৃশ্য বাধা প্রাপ্ত হলো। কেন জানি তার মন বলছে সে প্রচণ্ড তৃষ্ণার্ত। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে কালকেই তো এই বুকে মাথা রেখেছিলো। তাহলে?
প্রিয়তার মনে এই মুহূর্তে হাজার প্রশ্ন। কিন্তু বলতে ইচ্ছে করছে না। তাই চোখ বন্ধ করে পড়ে রইলো উষ্ণ নীড়ে। চোখ বন্ধ করে শুনতে লাগলো হৃদপিণ্ডের ধুকপুক আওয়াজ। উফফ, এত শান্তি কেন এই বুকে?
প্রিয়তার মনে হলো পৃথিবী ভেসে যাক। এই বুকটা শুধু তার হয়ে থাক।
কিন্তু হঠাৎই মনে পড়লো এই বুকে মাথা রাখতে পারলেও এই বুকের মালিক সে নয়।
প্রিয়তা অন্যকে নিয়ে ভাবতে চায় না। মানুষ কি বলে না বলে, তা-ও শুনতে চায় না। সে শুধু এই মানুষটাকে চায়। তার বুকে আশ্রয় পেতে চায়।
প্রণয় আলতো হাতে জড়িয়ে ধরলো প্রিয়তার পিঠ। কপালে দীর্ঘ চুম্বন এঁকে আদুরে কণ্ঠে বললো,
“দেখি, ছাড়। আমি গিয়ে রান্না করি। কিছু খাবি তো নাকি?”
প্রিয়তা অনিচ্ছা সত্ত্বেও বুক থেকে মাথা তুললো, তার অভিমান হচ্ছে খুব কোনো কারণ ছাড়াই।
প্রণয় ফোলা ফোলা গাল দু’টোর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো। সে জানে মহারানীর অভিমান হয়েছে, কিন্তু মহারানি তো আর জানে না, ১২ ঘণ্টা পর মহারানী ঠিকই সব ভুলে যাবে। কিন্তু মহারানীর শরীরের এই গন্ধ, এই ছোট ছোট অভিমান, অবুঝ চোখের আবদার—এগুলো প্রণয়ের বিশ্বাস চেপে ধরবে, কলিজায় যতটুকু দম বাঁচিয়ে রেখেছিলো, তাও ছিঁড়ে নিয়ে যাবে।
হঠাৎ প্রিয়তার চিৎকারে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল প্রণয়ের। সে বিরক্ত চোখে তাকালো প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তা এখনো কানফাটা চিৎকার দিয়ে যাচ্ছে।
প্রণয় পুনরায় রাম ধমক লাগিয়ে দিলো,
“চুপ কর!”
সাথে সাথেই চুপ মেরে গেলো প্রিয়তা।
প্রণয়ের বাম হাতে ওর চুয়াল চেপে ধরলো। নীলাভ চোখে দৃষ্টি স্থির করে ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“কী সমস্যা? একটু পর পর ছাগলের বাচ্চার মতো চিৎকার করিস কেন?”
প্রিয়তা গালে ব্যথা পাচ্ছে, তাই হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু ছাড়লো না প্রণয়।
প্রিয়তা ও সাথে সাথেই প্ল্যান বি অ্যাপ্লাই করলো, মনে মনে বললো, দাড়াও ব্যাটা, দেখাচ্ছি মজা।
বলেই প্রণয়ের পেটের মাংসে জুড়ে একটা চিমটি কাটলো।
প্রণয় চোখ মুখ কুঁচকে,
“আউচ!” বলে মৃদু আর্তনাদ করে ছেড়ে দিলো।
প্রিয়তা একটা শয়তানি হাসি দিয়ে বললো,
“উফফ, খুব লেগেছে প্রণয় ভাই? আসুন আমি ঢলে দেই।”
প্রণয় পেট ঢলতে ঢলতে মৃদু আওয়াজে বললো,
“বেয়াদব, তোকে আমি—”
প্রিয়তা লজ্জা পাওয়ার ভান ধরে বললো,
“কী করবেন? আদর করবেন?”
প্রণয় পেট ছেড়ে সরু চোখে তাকালো। আচমকাই প্রিয়তার দু’পাশে হাত রাখলো। ধীরে ধীরে কাছে আসতে আসতে বললো,
“তোর আদর চাই।”
প্রিয়তা যেন হালকা মজা নিতে গিয়ে ফেঁসে গেল। চোখ পিটপিট করে হেলে পড়তে পড়তে বালিশের সাথে লেগে গেল। শুষ্ক ঢুক গিলে তুতলিয়ে বললো,
“ন… ন… না…”
প্রিয়তাকে নিজের পুরুষালি শরীরের তলে পিষ্ট করে ফেললো প্রণয়। প্রিয়তার গালে ঠোঁটের আলতো পরশ এঁকে হাস্কে কণ্ঠে বললো,
“কী বললে জান? আরেকবার বলো। তুমি না আদর চাও? বলো, তোমায় কীভাবে আদর করবো? কোথায় কোথায় আদর করবো?”
প্রণয়ের এমন বিহেভিয়ার প্রিয়তা পুরো জমে গেল। দুজনের নিঃশ্বাসের মিলন ঘটছে অনবরত। সে বেশ বুঝতে পারছে, এখন আদর দেওয়ার বদলে চড়িয়ে গান লাল করে ফেলবে। চিমটি কাটায় রেগে গেছেন মহাশয়, কারণ প্রণয়ের চিমটি জিনিসটা মোটেই পছন্দ নয়।
প্রিয়তা প্রণয়ের বুকে হাত রেখে বললো,
“না না, আদর চাই না, প্লিজ মাফ চাই।”
প্রণয় দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
“এভাবে চাই না বললে তো হবে না, বেবি ডল। আদর তো তোমায় নিতেই হবে। বলো, কোথা থেকে শুরু করব?”
প্রিয়তা হার মেনে চোখ মুখ খিঁচে আল্লাহ আল্লাহ করতে লাগলো। কিন্তু সেকেন্ড গড়িয়ে মিনিট পার হয়ে গেলো, কিছুই ফিল করতে পারলো না। তাই ফট করে চোখ খুলে দেখলো—
“একি!”
প্রণয় কোথায়? আদরের লোভ দেখিয়ে আদর না করেই হাওয়া হয়ে গেলো। সে মুখে যতই না করুক, মনে মনে তো চেয়েছিলো।
ধ্যাত!
সে উঠে দেখলো, লেফট সাইডের ওয়ার্ডরোব খুলে কিছু একটা বের করছে প্রণয়।
প্রিয়তা বেশ বুঝতে পারছে প্রণয় অনেক রেগে আছে, কিন্তু তারও যে পেট গুড়গুড় করছে প্রণয় ভাইয়ের সাথে ঝামেলা করার জন্য। তাই প্রিয়তা বিছানা থেকে উঠে পড়লো, গুটি গুটি পায়ে প্রণয়ের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো।
প্রণয় ওয়ার্ডরোব খুলে একটা হোয়াইট টি-শার্ট আর ব্ল্যাক ট্রাউজার বের করল। কাপড় নিয়ে পেছন ফিরতেই ছোট্টখাট্টো একটা ননীর পুতুলের সাথে ধাক্কা লেগে গেলো। তবে তাকে পাত্তা দিলো না প্রণয়, পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে শার্ট টেনে ধরলো প্রিয়তা।
বিস্মিত হওয়ার ভান ধরে বললো,
“আমার কাপড় কে পাল্টেছে?”
প্রণয় নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিলো,
“আমি।”
“আমি?” শুনে গা শির শির করে উঠলো প্রিয়তার। লজ্জায় গাল রক্তিম হয়ে উঠলো। সে ভেবেছে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর প্রণয় ভাই হয়তো অন্য কাউকে দিয়ে করিয়েছেন।
প্রিয়তা নিজের লজ্জা লুকিয়ে কপাল চাপড়াতে চাপড়াতে বললো,
“হায় হায়! এ আমার কি সর্বনাশ হলো? আপনি আমার সবকিছু লুটে নিলেন! এ্যাঁ, এখন আর আমার বিয়ে হবে না!”
প্রণয় এবার ফিরে তাকালো প্রিয়তার দিকে। কয়েক সেকেন্ড প্রিয়তার ড্রামা দেখে নাক সিঁটকে সোজা সাপটা কণ্ঠে বললো,
“তোর শরীরে কি এমন আছে, যেটা আমার অদেখা? তোর সবকিছু তোর আগে আমি দেখেছি। তাই বেশি নাটক করার প্রয়োজন নেই। বাংলা ছায়াছবি কয়েক হাজার বার দেখলে যেমন ফিল আসে, ওরকম ফিল পেয়েছি। এক জিনিস বারবার দেখলে কি আর ইন্টারেস্ট থাকে?”
বলে আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না প্রণয়। জামা নিয়ে সটান ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
কিন্তু প্রিয়তাকে ফেলে গেল বিস্ময়ের সাগরে। প্রিয়তার মুখ থেকে,
“আস্তাগফিরুল্লাহ!” আপনাআপনি বেরিয়ে গেল। আনমনে খাটে গিয়ে বসলো। গালে হাত দিয়ে গভীর ভাবনায় তলিয়ে গেলো—
সত্যি তো! আমাকে প্রণয় ভাই ছোটো থেকে ফিডার খাইয়ে খাইয়ে বড়ো করেছেন। তার মানে উনি অনেক আগেই—
প্রিয়তা ঢুক গিলে নিজের দিকে তাকালো। সাথে সাথে লজ্জায় দু’হাতে মুখ ঢেকে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মনে মনে বললো,
“হায় আল্লাহ! আমি এই মুখ এখন উনাকে কীভাবে দেখাবো? ছি ছি! এই মানুষটা একদিনে এত লাগামহীন হলো কিভাবে?”
প্রিয়তা লজ্জায় লাল নীল বেগুনি হচ্ছে। এর মধ্যেই লোমশ কিছুটা লাফিয়ে এসে তার গায়ে পড়লো। আচমকা অপ্রত্যাশিত কান্ডে চেঁচিয়ে উঠলো প্রিয়তা,
“আরশোলা! আরশোলা! আরশোলা!”
বলে মুখ চেপে ধরলো।
তার গলা ফাটা চিৎকারে কাঁচের দেওয়ালগুলো যেন ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। গায়ে অর্ধেক সাবান মেখে শ্যাম্পু লাগানো অবস্থায় ছুটে বের হলো প্রণয়।
প্রিয়তার চিৎকার শুনে কলিজা তার ধক ধক করছে। সে রুমে এসে যা দেখলো, তাতে কী রিঅ্যাকশন দেবে বুঝতে পারলো না।
মনে মনে একে গাধা বললে গাধাকে অপমান করা হবে। প্রণয় কপট রাগ দেখিয়ে এগিয়ে গেল প্রিয়তার কাছে। প্রিয়তা এখনো চোখ মুখ কুঁচকে পড়ে আছে।
প্রিয়তা হঠাৎ কানে ব্যথা পেয়ে আহহ করে উঠলো। মিটি মিটি চোখ মেলে দেখলো প্রণয় ভাই ঝাল মরিচের মতো লাল হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। কোমরে শুধু একটা তোয়ালে পেঁচানো। সাবানের ফেনা মাখানো সারা শরীর, মাখনের মতো চিকচিক করছে। প্রিয়তা চোখ নামালো না, বরং আরশোলার কথা ভুলোই গেল।
প্রণয় কপট রাগ দেখিয়ে বললো,
“তুই কি কোনোদিনও শুধরাবি না!”
প্রণয়ের কথা প্রিয়তার কানে ঢুকলো না। তার লজ্জা লাগছে।
প্রিয়তার ফর্সা গালের রক্তিম আভা ছড়াতে দেখে প্রণয়ের রাগ করার মুডটাই চলে গেল। আচমকাই ও হাতে প্রিয়তার নরম গাল চেপে ধরে পদ্মলাল ঠোঁট দুটো একত্র করলো। ঠোঁটের দিকে ইশারা করে শাসিয়ে বলল,
“এই ঠোঁট দিয়ে যদি আর একবার চিৎকার বের হয়, তাহলে—”
প্রিয়তা আতঙ্কিত দৃষ্টি মেলে তাকালো প্রণয়ের দিকে। ঠোঁট চেপে ধরায় ভালোভাবে বলতে পারলো না, তবুও অস্পষ্ট বললো—
“তাহলে?”
প্রণয় বাঁকা হাসলো ওর দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ প্রিয়তার কল্পনার বাইরে এক কান্ড করে বসলো।
আচমকাই প্রিয়তার রক্তিম ঠোঁটে নিজের দাঁত বসিয়ে দিলো।
“আউচ!” করে উঠলো প্রিয়তা।
প্রণয় সেসব পাত্তা না দিয়ে ঠান্ডা কণ্ঠে বললো,
“এই ঠোঁট দিয়ে যদি আর একটা বেক্কেল মার্কা কথা বের হয়, তাহলে জাস্ট ওয়ান বাইট অ্যান্ড ফিনিশ ইয়োর লিপস।”
বলে প্রিয়তাকে ছেড়ে আবার ওয়াশরুমে ঢুকে পড়লো।
কিন্তু কোনো এক ঘোরের মধ্যে হারিয়ে গেল প্রিয়তা। নিজেই নিজের ঠোঁটে স্পর্শ করে চমকে উঠলো। কাঁপা কণ্ঠে আওড়ালো,
“১ দিনে এত পরিবর্তন?”
প্রিয়তা বিস্ময় চেপে পারলো না। দৃষ্টি ঘোরাতেই তার চোখ জুড়ো কুটোর ছড়ানোর উপক্রম হলো। প্রণয়ের সতর্কবাণী ভুলে পুনরায় খুশিতে চিৎকার দিয়ে উঠলো।
হাত বাড়িয়ে খপ করে ধরে ফেললো পাশে থাকা সাদা লোমশ বিড়ালটা। সে বুঝলো, আরশোলা টারশোলা কিছু না, কিছুক্ষণ আগে এই ব্যাটাই তার গায়ে উড়ে এসে পড়েছিলো।
প্রিয়তা বিড়ালটা কোলে বসিয়ে খান ১০ এক চুমু ঠুকে দিলো বিড়ালটার গালে। বিড়ালটা কিছু বলছে না, শুধু ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে আছে প্রিয়তার মুখের দিকে।
প্রিয়তা বিড়ালটার গলা চুলকে দিয়ে আদুরে কণ্ঠে বললো,
“তোর নাম কী বাবু? তোর বাবা মা কই?”
বিড়ালটা কী বুঝলো কে জানে, শুধু “মিঁউ” বলে প্রিয়তার হাতে মাথা ঘষে দিলো। হয়তো বুঝালো, তুমি আমার মা।
কিন্তু প্রিয়তা সেই ভাষা বুঝলো না ঠিকই, তবু আনন্দে আটখানা হয়ে গেল।
পেরিয়েছে আরো কয়েক ঘন্টা।
প্রিয়তা বিড়ালটা কোলে নিয়ে ফ্রস্ট হ্যাভেনের এদিক-ওদিক গোল গোল ঘুরছে আর বাড়িটা খুঁটেখুঁটে দেখছে। যত দেখছে, ততোই আশ্চর্য হচ্ছে, চোখে মুখে তার ঠিকরে পড়ছে বিস্ময়।
এমন বাড়ি সে আগে বাপের জন্মে ও দেখেছে বলে মনে পড়ে না। তবে হলিউড মুভিতে অনেক দেখেছে পুরো কাচের তৈরি বাড়ি, সব ফার্নিচারও কাচের তৈরি।
বাড়ির ভেতর যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে বাহিরের সবটা দেখা যায়, কিন্তু বাহির থেকে ভেতর দেখা যায় না।
প্রিয়তা ঘুরছে একা একা। তার গায়ে কেবল একটা হোয়াইট ফরমাল শার্ট আর কিছু নেই। সাদা ঢুলঢুলে শার্টটা প্রিয়তার গায়ে পাঞ্জাবির মতো লাগছে। ফর্সা পা দুটো হাঁটুর একটু ওপর পর্যন্ত দৃশ্যমান। গলার কাছের প্রথম দুটো বোতাম খোলা।
এক হাঁটু, খোলা চুলের সাথে এই শার্টটা পরে প্রিয়তাকে মারাত্মক হট সেক্সি লাগছে। তবে এতে আনকামফর্টেবল ফিল করছে না প্রিয়তা। কারণ এই বাড়িতে সে আর প্রণয় ছাড়া কেউ নেই, আর প্রণয় ভাই তো…
প্রিয়তা ঘুরতে ঘুরতে বিড়ালটাকে নিয়ে কিচেনে পৌঁছে গেল। প্রণয় গায়ে কিচেন অ্যাপ্রোন জড়িয়ে কিছু একটা রান্না করছে। প্রিয়তা বিড়ালটা নিয়ে প্রণয়ের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। বিড়ালের মতো চোখ ছোট ছোট করে উঁকি দিয়ে বলল,
“কী রান্না করছেন?”
প্রণয় ওর দিকে না ফিরেই জবাব দিলো,
“এই বাড়িতে তেমন কিছুই নেই, একটু চাল আর একটু ডাল পেয়েছি, তাই দিয়েই খিচুড়ি।”
খিচুড়ি শুনে মনে মনে লাফিয়ে উঠলো প্রিয়তা। আল্লাদি কণ্ঠে বললো,
“আমি হেল্প করবো প্রণয় ভাই।”
প্রণয় ক্যাপসিকাম কুচি কুচি করতে করতে সোজা সাপ্টা মুখের ওপর বলে দিলো,
“থাক, আমার এত উপকার করতে হবে না, ম্যাডাম। দূরে গিয়ে দাঁড়ান, নাহলে তেল-টেল ছিটকে পড়তে পারে।”
প্রিয়তা সরলো না, বরং নিজের বুকে থাকা বিড়ালটা দেখিয়ে বললো,
“এই বাবুটা কার প্রণয় ভাই, এই ফাঁকা বাড়িতে কি ও একাই থাকে?”
প্রিয়তার কথা শুনে এবার থামলো প্রণয়। পেছন ফিরেই তাকালো প্রিয়তার দিকে।
বিড়ালটা ঘাপটি মেরে পড়ে আছে প্রিয়তার বুকে।
এই দৃশ্যে প্রণয়ের বুকের ভেতর বড্ড সুখ সুখ অনুভূতি হলো। সে পুনরায় রান্নায় মন দিয়ে বললো,
“না, ও আমার মেয়ে।”
প্রণয়ের কথায় ভ্রু কুঁচকে গেল প্রিয়তার। বিস্ময় নিয়ে বললো,
“কি?”
“হুম।”
“কিন্তু ও আপনাদের মেয়ে হয় কীভাবে? আপনাকে তো কখনো দেখলাম না বিড়াল আনতে, আর ওকে তো আগে কখনো দেখিনি।”
প্রণয় ডালের পানিতে হলুদ দিতে দিতে বললো,
“তুই দেখিসনি, মানে ছিল না, এমন তো নয়। ও আমার মেয়ে।”
প্রিয়তা বুকা বনে গেল। মনে মনে ভাবলো, এসব আবার কবে হলো?
বিড়ালটাকে দেখতে দেখতে আনমনে বললো,
“কী নাম ওর?”
প্রণয় নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল,
“কোকো।”
“আচ্ছা, ও কবে থেকে আপনার সাথে আছে?”
“৪ বছর।”
এবার যেন প্রিয়তার বিস্ময়ের অন্ত রইলো না।
বিড়ালটাকে আদর দিতে দিতে অভিমান করে বললো,
“ওকে আপনার কাছে লুকিয়ে রেখেছিলেন? আমায় একবারও বললেন না?”
“না বললাম না। তোকে বললে তো তুই এক দিনেই চটকে পটকে খেয়ে ফেলতি।”
প্রিয়তা মনে আরো অভিমান জমলো। অভিমানে নাকের পাটা ফুলে উঠলো।
ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো প্রণয়।
তবে কিছু বললো না প্রিয়তা। প্রণয়ের থেকে দূরে গিয়ে বসল। তবে বিড়ালটাকে হাত ছাড়া করল না। কি নাদুস নুদুস মটকু একটা বিড়াল! কোলটা কেমন ঝুড়ে আছে!
প্রণয় আড় চোখে তাকিয়ে হাসলো।
প্রিয়তা মিনিট পাঁচেই মুখ গোমড়া করে রাখার পর আর বসে থাকতে পারলো না। তার মাথায় অন্য প্রশ্ন উঁকি দিলো।
সে গাল ফুলিয়ে আবার প্রণয়ের পাশে এসে দাঁড়ালো। অন্য দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুড়লো,
“আগের জন্মে হিটলার ছিলেন নাকি চেঙ্গিস খা?”
প্রণয় ভাবকেশহীনভাবে জবাব দিলো,
“কেন বলতো?”
প্রিয়তা পুনরায় অভিমান করে বললো,
“না, আমায় কষ্ট দিতে তো আপনার জুড়ি নেই, তাই বলছি।”
প্রণয় বাটি থেকে ছোটো চামচে করে কিছু একটা আচমকা প্রিয়তার মুখে পুড়ে দিয়ে বললো,
“আহ! এত দুঃখ কোথায় রাখিস? আচ্ছা তোকে একটা গামলা এনে দিবো। ওতে জমা করে রখিস। আর গামলা ভরে গেলে আবার আমাকে রিটার্ন দিস।”
প্রিয়তা খাবারটার টেস্টে চোখ বড়ো বড়ো হয়ে গেল।
ওয়াও এক্সপ্রেশন দিয়ে বললো,
“এটা কী প্রণয় ভাই?”
প্রণয় আরেক চামচ মুখে দিয়ে বললো,
“নিউ রেসিপি।”
“কিন্তু কী?”
“রোজ কিস ডিলাইট।”
খাবারের নাম শুনে ভিরমি খাওয়ার উপক্রম হলো প্রিয়তার।
মুখ ছোট করে বললো,
“এটা কোনো নাম হলো? চুমু কেউ বাটিতে নিয়ে খায়?”
“যাই হোক, এটা কী দিয়ে বানিয়েছেন? অনেক টেস্টি।”
“স্ট্রবেরি, কনডেন্সড মিল্ক, ব্রাউন সুগার, ইত্যাদি।”
প্রিয়তা প্রণয়ের হাত থেকে পুরো বাটিটাই নিয়ে নিলো। ক্যাবিনেটের ওপর উঠে বসতে চাইল, কিন্তু উঁচু অনেকটাই। তাই প্রণয়ের টি-শার্টের হাতা ধরে টান দিলো।
প্রণয় শান্ত চোখে তাকালো ওর দিকে।
প্রিয়তা ইনোসেন্ট ফেস করে বললো,
“একটু উঠিয়ে দিন না।”
দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললো প্রণয়। দুই হাতে কোমর ধরে বসিয়ে দিলো। সাথে সাথেই ফর্সা উরু দৃশ্যমান হয়ে গেল।
ঢুক গিললো প্রণয়। কোকোকে তুলে প্রিয়তার কোলে দিলো। এবার আর উরু দেখা যাচ্ছে না।
প্রিয়তা খেতে খেতে বললো,
“আচ্ছা প্রণয় ভাই, আমরা যে এখানে চলে এলাম, বাড়ির সবাই চিন্তা করবে না?”
“I don’t care.”
প্রিয়তা পুনরায় বললো,
“আচ্ছা প্রণয় ভাই, আমি যে চলে এলাম, তাহলেই আর ১০ দিন পর থেকে যে আমার এসএসসি এক্সাম, ওটা কীভাবে দিবো?”
প্রণয় ওর দিকে না তাকিয়েই বললো,
“কী করবি এত পড়ে? সেই তো কোনো টাকলা বুড়িওয়ালার গলায় ঝুলবি।”
প্রণয়ের কথায় মুখ বাঁকালো প্রিয়তা। মনে মনে বললো, বেটা হাড় বজ্জাত! কিন্তু ১ দিনে এমন পরিবর্তন হলো কীভাবে? যে বেটা না পড়লে হাড় খুলে নিতে চাইতো, সেই বেটাই বলছে এসএসসি দিতে হবে না। স্ট্রেঞ্জ!
তবে ভয়ে বেশি কিছু বললো না প্রিয়তা। পাছে যদি আবার বাড়ি দিয়ে আসে, তাহলে আর এই মানুষটাকে এত কাছ থেকে দেখতে পারবে না।
প্রিয়তা মুগ্ধ চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে। প্রণয়ের অতিমাত্রার সুদর্শন চেহারার আর অতি আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব দেখে কল্পনার জগতে হারিয়ে গিয়ে ভাবলো—
প্রণয় ভাই তার হাতে হাত রেখে চোখে চোখ রেখে কাপল ড্যান্স করছেন, ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে কোমরে হাত দিচ্ছেন, আরো কত কী…
প্রণয় ওকে নিজের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকতে দেখে মুখের সামনে তুরী বাজাল। ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“এতো সখ?”
প্রিয়তা ভেবাচেকা খেয়ে গেল।
প্রণয় ওকে আবার নামিয়ে দিলো। নিজের গা থেকে কিচেন অ্যাপ্রন খুলে পাশে রাখলো। প্রিয়তা হাঁ করে তাকিয়ে আছে প্রণয়ের দিকে।
প্রণয় প্রিয়তার চোখে চোখ রেখে দুই পা এগিয়ে এলো প্রিয়তার দিকে। প্রিয়তার কোমর ধরে এক টানে নিজের একদম কাছে নিয়ে আসলো। হাত ধরে ঘুরিয়ে প্রিয়তার পিঠ নিজের বুকে ঠেসে ধরলো। আলতো হাতে চুল সরিয়ে নিঃশ্বাস ফেললো ঘাড়ের কাছে।
কারেন্ট লাগার মতো শক খেয়ে গেল প্রিয়তা। প্রণয় হাতে হাত রেখে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ধীরে ধীরে কাপল ড্যান্স করতে লাগলো। আবার কোমর ধরে ঘুরিয়ে নিলো নিজের দিকে।
প্রিয়তা আবেশে হারিয়ে গেল গভীর একজোড়া বাদামী বর্ণের চোখে। মনে মনে ভাবলো, কেন এই লোকটাকে কিছু বলে বুঝাতে হয় না?
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬০
এই প্রশ্নের উত্তর প্রণয়ই দিলো। গালে হাত রেখে আবেশিত কণ্ঠে বললো,
“কারণ তুই আত্মার অবিচ্ছেদ্য অংশ। শরীর তোর হলেও মনটা আমার, আত্মাটা তো আমার।”
থমকালো না প্রিয়তা। এটা সে জানে, তাই উপভোগ করতে লাগলো প্রিয়তা মানুষের সঙ্গ।
কেটে গেছে আরো অনেকটা সময়। প্রণয় প্রিয়তাকে খাইয়ে দাইয়ে অন্য রুমে পাঠিয়ে দিয়েছে।