ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬২
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
শীতের রাত। বাইরে -৫০ ডিগ্রী তাপমাত্রার সাথে তুষার ঝড়ের বেগ বাড়ছে শুঁ শুঁ করে। প্রবল বাতাসের সঙ্গে আকাশের তীব্র গর্জনে কেঁপে কাঁচের দেওয়াল, চারপাশের প্রকৃতিও যেন কোন অশনি সংকেতের পূর্বাবাস দিচ্ছে।
তবে চার দেওয়ালের বাহিরের পৃথিবীটা উত্তাল হলেও ভিতরটা নৈসর্গিক সুখের আবহে ভেসে চলে। ভালোবাসার মৃদুমন্দ হাওয়ায় প্রেমের পর্দা উড়ে, যেখানে সুখী দুজন মানুষের নিশ্বাস-প্রশ্বাসের একত্র শব্দ—বেঁধিত অন্য কোনো সুর শোনা যায় না।
প্রণয় প্রিয়তাকে চেপে একদম বুকের গভীরে পুরে নিয়েছে, অস্তিত্বের সাথে মিশিয়ে দিয়েছে নিবিড়ভাবে। দুই হাতে প্রিয়তমার পিঠ জড়িয়ে, থুতনি ঠেকিয়েছে মাথায়। তার ঘুমন্ত ভারি ভারি নিঃশ্বাস এসে আছড়ে পড়ছে প্রিয়তার গলদেশে, প্রতিবার নিশ্বাসের সঙ্গে হুড়মুড়িয়ে হৃদপিণ্ডে প্রবেশ করছে অতুলনীয় সেই মাদকীয় সুঘ্রাণ, যা ঘুমের মধ্যেও ছেলেটাকে অপার্থিব মানসিক শান্তি দিচ্ছে। ব্যাস, এতটুকুই যেন তার জীবন।
প্রিয়তাও দুই হাতে প্রণয়ের শার্ট মুঠো করে ধরে গলায় মুখ গুঁজে দিয়েছে, যেন প্রিয় বুকে ঢুকে পড়ার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
প্রায় মিনিট দশেক হলো, জাভেদ প্রণয়ের রুমের বাইরে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। ভয় আতঙ্কে তার কলিজার পানি শুকিয়ে মরুভূমি। এই শীতের রাতেও কপাল বেয়ে ধর ধর করে ঘাম প্রবাহিত হচ্ছে, শরীরের কাপড়-চোপড় ভিজে জলে একাকার। জাভেদ পঞ্চম বারের মত রুমাল দিয়ে কপাল বেয়ে পড়া ঘামটুকু মুছলো। বসকে এখনই জাগানো জরুরি—কিন্তু কিভাবে জাগাবে সে? কিভাবে ডাকবে এখন? বিশাল কাচের তৈরি বাড়ির দরজা-জানলা সব কাঁচের তৈরি বিধায়, সে বিছানার দৃশ্যটা বাহিরে দাঁড়িয়েই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এমন সুখের মুহূর্তে তার মন চায় না স্যারকে ডাকতে, কারণ ডেকে দিলেই তো এই মুহূর্তটা হারিয়ে যাবে,আবার তার বস একা হয়ে যাবে। জাভেদের মাঝে মাঝে খুব খারাপ লাগে তার স্যারের জন্য, কারণ আর কেউ না দেখুক—সে এই মানুষটাকে খুব কাছ থেকে দেখে প্রতিদিন। দিনের শেষে, গভীর রাতে তার করা প্রত্যেকটা পাগলামির সাক্ষী হয় সে নিরবে; কখনো তাকে ঠেকাতে পারে, কখনো পারে না। তার সঠিক মনে পড়ে না, তার স্যার গত ৪ বছরে ঠিক কয়দিন ঘুমিয়েছিল। তাই এখন মানুষটার এই ক্ষণিকের শান্তিটুকু সে কেড়ে নিতে দ্বিধা বোধ করছে। কিন্তু এভাবে আর কতক্ষণ? এখানে বেশিক্ষণ থাকা মানে তো… তাই জাভেদ আর বেশি ভেবে সময় নষ্ট করলো না, দ্রুত দরজা থেকে একটু আড়ালে সরে দাঁড়াল। কিছুটা ভয় আর কিছুটা দ্বিধার সংমিশ্রণে কম্পিত হস্তে বসকে ফোনটা করেই ফেলল।
সেন্টার টেবিলের পাশে থাকা ফোনটা সাথে সাথেই রিংটোনের তুমুল শব্দে ভেসে উঠলো। নিস্তব্ধ ঘরে তার বিকট শব্দ শোনালো ভয়ংকর, কিন্তু এত জোরালো শব্দেও প্রণয় বা প্রিয়তার ওপর কোনো প্রভাব পড়তে দেখা গেল না। তারা দুজন এখনো গভীর ঘুমে, আর হবে নাই বা কেন—দুজনের ঘুম তৃষ্ণা কত বছরের!
জাভেদ ফোনটা কানে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো রিসিভের অপেক্ষায়, কিন্তু বিধিবাম—তার কলটা রিং হতে হতে বন্ধ হয়ে গেল একসময়। কিন্তু অপর প্রান্তের ব্যক্তির থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। এদিকে গার্ডদের কল-মেসেজে অতিষ্ঠ হয়ে যাচ্ছে জাভেদ।
সে কম্পিত হাতে পুনরায় স্যারের নাম্বারে কল লাগালো। আবারো ফোনটা বিকট শব্দে বেজে উঠলো কানের পাশে। এবার অনেকক্ষণ বাজার পর একটু নড়ে উঠলো প্রণয়। ঘুমটা তার হালকা হালকা ছেড়ে যাচ্ছে, কিন্তু এত আরাম আরাম অনুভূতি হচ্ছে যে চোখ মেলতেই মন চাচ্ছে না। কিন্তু অনবরত ফোনের শব্দে প্রণয় এভাবে শুয়েও থাকতে পারলো না। তার ঘুমের ঘোর কেটে গেল, তবে কাঁচা ঘুম ভাঙায় মাথাটা ঝিনঝিন করছে।
চোখ বন্ধ রেখেই মনে মনে প্রচণ্ড বিরক্ত হলো ফোনের ওপাশের ব্যক্তির উপর।
কিন্তু এই বেয়াদব যন্ত্রটার বন্ধ হওয়ার যেন কোনো নামই নেই। তাই অগত্যা বাধ্য হয়ে প্রণয়কে এই সুখ সজ্জা ছাড়তে হলো। সে ঘুম ঘুম চোখ মেলে উঠে বসতে গেলেই, ছোট্ট দুটো হাতের বাঁধনে বাধাপ্রাপ্ত হলো। বুকের দিকে তাকিয়ে দেখলো, তার পছন্দের শার্টের মালিকানা অন্য কারো হাতের অধীনে।
হালকা হাসলো প্রণয়, আবারো একটু ঝুঁকে গেল সেই নারীর দিকে। লম্বা এলোমেলো চুলের আড়ালে তার প্রিয় মুখখানা ঢেকে আছে।
প্রণয় আলতো ছুঁয়ে মুখের উপরে পড়া লম্বা চুলগুলো একটা একটা করে সরিয়ে দিলো। কমফটারটা গলা পর্যন্ত টেনে দিয়ে চকচকে কপালে, কালচে লাল ঠোঁটের দীর্ঘ পরশ একে দিল। নিজের হাতের বাঁধন আরও একটু শক্ত করে বুকের মধ্যে নিলো।
স্নেহের উষ্ণতায় একটু নড়ে উঠলো প্রিয়তা। আদুরে বিড়ালছানার ন্যায় আরেকটু গুটিয়ে গেল উষ্ণ বুকে, ঘুমের ঘোরে দুই হাতে ঝড়িয়ে ধরলো প্রণয়ের কোমর। তৃপ্তি নিয়ে সেই দৃশ্য অবলোকন করল প্রণয়।
হাত উঠিয়ে তেলচিকচিকে গালে আলতো করে বুড়ো আঙুল বুলিয়ে দিল। কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে আদর মাখা কণ্ঠে বললো—
“আমার ঘুমন্ত পরী।”
প্রণয় নিজের ধ্যানে মগ্ন হতে নিলেই, তৃতীয়বারের মতো ফোনের কর্কশ শব্দে ধ্যান ভেঙে গেল।
এবার আর চোখমুখে বিরক্তি ফুটিয়ে তুলল না প্রণয়। ভ্রু কুঁচকে ভাবল, “এত রাতে এতবার ফোন করছে যখন—নিশ্চয় কিছু হয়েছে।”
প্রণয় ভাবনা ছেড়ে হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো। মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রাখতেই জাভেদ নামটা দেখে কপালের চিকন রেখাগুলো আরও সুদীর্ঘ হলো। সে ফোন রিসিভ করে বললো—
“হ্যালো!”
অপর প্রান্ত থেকে জাভেদের ধৃত, সন্ত্রস্ত কণ্ঠ ভেসে এলো—
“স্…স্যার।”
জাভেদের ঘাবড়ে যাওয়া কণ্ঠধ্বনিতে নড়ে বসলো প্রণয়। কর্কশ গলায় প্রশ্ন ছুড়ে দিল—
“এক্সপ্রেশন না দিয়ে ঝটপট বলো, কী হয়েছে?”
জাভেদ ভয়ে দু’একটা ঢোঁক গিলে, কম্পিত কণ্ঠে বললো—
“স্যার, সর্বনাশ হয়ে গেছে। কানাডিয়ান সরকার আপনার লোকেশন ট্রেস করে ফেলেছে। তারা জেনে গেছে আপনি ফ্রস্ট হ্যাভেনে আছেন। এমনকি তারা এটা আরো দুই ঘন্টা আগে জেনেছে স্যার। তারা যখন তখন আপনাকে ধরতে চলে আসবে।তখন আপনি আর আপু ভীষণ বিপদে পড়ে যাবেন। বাহিরের অবস্থা ভালো নয়। চাইলে এখন আমরা সবাই একসাথে পালাতে পারবো না।”
জাভেদের কথায় প্রণয়ের কলিজা ধক করে উঠলো। সাথে সাথে দৃষ্টি চলে গেল নিজের বুকের মধ্যখানে, যেখানে ঘাপটি মেরে ঘুমিয়ে আছে তার প্রাণপাখি। এখন যদি এখানে পুলিশ-মিলিটারি হামলা চালায়, তখন প্রণয় কিভাবে সেফ করবে তার জানকে?
একটু পর তো এই শান্ত জায়গাটাই রণভূমিতে পরিণত হবে।
প্রণয়ের ভাবনার মধ্যেই অপর প্রান্ত হতে জাভেদের কণ্ঠ ভেসে এলো—
“স্যার, কী করবো দ্রুত বলুন, হাতে বেশি সময় নেই।”
প্রণয় একটা গাঢ় নিশ্বাস ফেলে ১ মিনিট ভেবে বললো—
“জাভেদ, জাস্ট ২ মিনিটের মধ্যে সিকোর্সকি ইউএইচ-৬০ ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টারটা বের করো, দ্রুত।”
জাভেদও আর উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে সময় নষ্ট করলো না, দৌড়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল। প্রণয় ফোন কেটে কোমল চোখে তাকালো প্রিয়তার নিষ্পাপ মুখের দিকে। কী নিষ্পাপ একটা চেহারা! প্রণয়ের মন মানছে না আবার তার জানটাকে দূরে সরিয়ে দিতে, কারণ এবার সে শতভাগ নিশ্চিত—এটাই তার জীবনের শেষ সুযোগ। এবারও যদি সে এই পাখিটাকে মুক্ত আকাশে উড়িয়ে দেয়, তবে ইহজনমের মতো তার প্রাণপাখিটা হারিয়ে যাবে অন্তরীক্ষে। আর কখনো ফিরবে না তার বুকের খাঁচায়, খড়কুটোর আশ্রয়ে নতুন ঘর বাঁধবে অন্য কারো বুকে।
এই যে তার পাখি হারাবে—এর পর শুষ্ক বক্ষে মরণের তৃষ্ণা জাগলেও আর কখনো তাকে বুকে জড়াতে পারবে না। প্রণয়ের শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আসছে। সে ঠোঁট চেপে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করল, প্রিয়তার দুই গালে হাত রেখে কাতর কণ্ঠে আবেদন করলো
“একটা কথা রাখবে, না বলোনা প্লিজ…
আমি মুখে তোমাকে যতই বলি আমায় ভুলে যাও, তুমি কিন্তু ভুলবে না জান… কখনো ভুলবে না, কেমন?”
কিন্তু প্রণয়ের সেই কাতর কণ্ঠ শুনতে পেল না প্রিয়তা, সে প্রণয়ের উষ্ণতায় আর মদের নেশায় বেঘোরে ঘুমোচ্ছে।
প্রণয় আরও কয়েক সেকেন্ড মনে ভরে দেখলো তাকে।
তবে বেশি সময় তাকালো না, টেনে হিছড়ে নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। কারণ, ওটা একটা মায়া, যার দিকে বেশি সময় তাকালেই হারিয়ে যাবে প্রণয়।
প্রণয় বড় বড় নিশ্বাস ফেলে নিজের বাড়ন্ত সকল আবেগ-অনুভূতি নিজের ভিতরেই চাপা দিলো, সন্তর্পণে একটা একটা করে প্রিয়তার শার্টের বোতাম লাগিয়ে দিলো।
ঘুমিয়ে থাকায় প্রিয়তার হাতের বাঁধন খুব একটা শক্ত নয়, তাই ধীরে প্রিয়তার কোমল হাত দুটো নিজের কোমরের ভাঁজ থেকে ছড়িয়ে উঠে বসলো।
ঘড়ির কাঁটা তখন রাত ৩টার কোঠায় ঠিক ঠিক করছে। প্রণয় হাত বাড়িয়ে বেডসাইড ড্রয়ার খুলে ভেতরের জিনিসপত্র ঘেঁটে ঘুঁটে একটা ইনজেকশন আর একটা সিরিঞ্জ বের করল।
মেডিসিনটা হাতে নিয়ে পুনরায় প্রিয়তাকে বুকে মেশালো। অদ্ভুতভাবে তার হাত কাঁপছে, ছোট্ট কাঁচের টেম্পুনেটটা ভাঙার জুরও যেন পাচ্ছে না ছেলেটা। মনের মিথ্যে ছলাকলায় প্রভাবিত হচ্ছে মস্তিষ্ক। মনে হচ্ছে, ভেতর থেকে কেউ আর্তনাদ করছে, করুন সুরে বলছে —
“একটু বুঝ, এটা দিস না। এটা দিলে ওর সকল তিক্ত কথাগুলো মনে পড়ে যাবে। ও সব ভুলে গেছে, ওকে নিয়ে অনেক দূরে হারিয়ে যা। এত দূরে হারিয়ে যা, যেখান থেকে তোদের আর কেউ খুঁজে পাবে না। চলে যা। আর দেখ, গত ৫ বছরের কোনো কথাই ওর নেই। ভুলে যা জীবনের অভিশপ্ত দিনগুলো।”
মনের কথায় প্রভাবিত হতে নিলে মস্তিষ্ক ও বিবেকবোধ বাঁগড়া দিলো। তাচ্ছিল্য করে বলল —
“কোথায় পালাবি? বল, কোথায় পালানোর জায়গা আছে তোর? আল্লাহর জমিনে এমন কোন জায়গা কি আছে, যেখানে তুই পালাতে পারবি, যেখানে তোকে কেউ খুঁজবে না? ভাব ভেবে দেখ, তুই দুনিয়া ছেড়ে পাতালে লুকালেও, সেখান থেকে তোকে খুঁড়ে বের করা হবে। আর তখন তুই একা মরবি না, তোর সঙ্গ দেওয়ার অপরাধে সবার আগে মরবে এই বাচ্চা মেয়েটা। হয়তো তোর সামনেই মারা হবে। তখন সহ্য করতে পারবি?”
মস্তিষ্কের দেখানো কঠিন-কঠিন সম্ভাব্য দৃশ্যে রুহু কেঁপে উঠল প্রণয়ের। নিজের চিন্তা-ভাবনার উপর প্রচণ্ড রাগ হল, সে কি ভাবছে এসব! প্রণয় আর হিজিবিজি ভেবে নিজের সময় নষ্ট করল না। টেম্পুনেটটা ভেঙে ইয়েলো মেডিসিনটা দ্রুত সিরিঞ্জে ভরে নিল। প্রিয়তার হাতের সাদা শার্টের হাতা ফোল্ড করে সিরিঞ্জটা ঢুকাতে নিতেই টিং টিং শব্দে প্রণয়ের ফোনে ম্যাসেজ এল। প্রণয় পাশে ফোন তুলে দেখল, জাভেদের ম্যাসেজে লেখা —
“Sir, যা করবেন, তারাতারি করুন। ওরা ১৫ মিনিটের মধ্যেই হয়তো চলে আসবে।”
প্রণয় ফোন রেখে মনের অনুভূতিকে পায়ে পিষে দিল। দ্রুত হাতে প্রিয়তার বাঁ হাতের শিরায় মেডিসিনটা পুশ করে দিল।
নিডেলের হালকা আঘাতে ঘুমের মধ্যে ও চোখ-মুখ কুঁচকে নড়ে উঠল প্রিয়তা। প্রণয় সিরিঞ্জটা ছুড়ে ফেলে এক টুকরো তুলো সুচ ফুটানোর জায়গায় চেপে ডলে দিল কিছুক্ষণ। অতঃপর প্রিয়তার পুরো শরীর কমফোর্ট দিয়ে মুড়িয়ে কোলে নিল। শেষবারের মতো কপালে ওষ্ঠ চেপে ধরে ব্যাকুল কণ্ঠে বলল —
“বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে, পাখি। নয়তো এই জীবনের মতো আলবিদা।”
প্রণয়ের গ্লাস হাউজ ‘ফ্রস্ট হ্যাভেন’-এর সামনে দাঁড়িয়ে আছে সিকরস্কি UH-60 ব্ল্যাক হক হেলিকপ্টার। তুষার ঝড়ের বেগ হয়তো একটু কমেছে। প্রণয় ধীরপায়ে বেরিয়ে এল বাড়ি থেকে। তার দুই পাশে প্রায় ১০০ মতো গার্ড, হাতে বন্দুক ধরে দুই পাশে দাঁড়িয়ে আছে। প্রণয় প্রিয়তার ঘুমন্ত শরীরটা নিয়ে আস্তে করে হেলিকপ্টারে উঠিয়ে দিল। জাভেদ পাশে দাঁড়িয়ে বলল —
“আপনি ও তারাতারি উঠে পড়ুন, স্যার। এখানে বেশিক্ষণ থাকা সেফ নয়।”
প্রণয় জাভেদের কথার জবাব না দিয়ে, জাভেদের হাতে একটা চিরকুট ধরিয়ে দিল।
কণ্ঠে কর্তৃত্ব ঢেলে তীব্র আদেশ সুলভ ভঙ্গিতে বলল —
“এই ঠিকানায় ওকে নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তোমার। রিমেম্বার, নিরাপদে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তোমার।”
প্রণয়ের কথার অর্থ বুঝল না জাভেদ, তাই পুনরায় বলল —
“আমি কীভাবে, স্যার? আমি তো এখানেই থাকব।”
প্রণয় পুনরায় আদেশ ছুড়লো —
“না, তুমি এখানে থাকবে না। তুমি এখুনি ওকে নিয়ে এই স্থান ত্যাগ করবে। যাও, উঠে পড়ো।”
প্রণয়ের কথায় যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত হলো জাভেদের মাথায়। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে বলল —
“কি বলছেন স্যার! আপনি এখানে থাকবেন, আর আমি চলে যাব? ইম্পসিবল স্যার, আমি আপনাকে ছেড়ে কোথাও যাব না।”
এতো খেজুরে আলাপ করার সময় প্রণয়ের হাতে নেই, তাই সে মুখে কিছু বলল না, সোজা জাভেদের মাথায় রিভলভার ঠেসে ধরল। শীতল কণ্ঠে হুমকি দিয়ে বলল —
“আমার হাতে মরবে নাকি এখান থেকে যাবে, চুজ ওয়ান!”
বন্দুক দেখে ভয়ে গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেল জাভেদের। ভয়ে হাঁটুর মালাই চাকি ঠক ঠক করে কেঁপে উঠল। তবু ও সে স্যারকে এই বিপদে ফেলে পালাতে নারাজ। তাই মনের সর্বোচ্চ সাহস জুগিয়ে বলল —
“ক্কককিন্তু স্যার, আমি আপনাকে ছেড়ে কিছুতেই—”
ঠাস করে গুলি ছুটার শব্দে আশপাশ কেঁপে উঠল।
“আহহহহহ!” — বলে দুনিয়া কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠল জাভেদ, পা চেপে ধরে মাটিতে বসে পড়ল।
হাঁটুর দুই ইঞ্চি নিচ থেকে গলগল করে বেয়ে পড়া রক্তে জমে যেতে লাগল বরফের চাকাগুলো।
প্রণয় শান্ত চোখে একটা গার্ডের দিকে তাকাতেই গার্ড ঝড়ের বেগে ছুটে এল। জাভেদকে দম ফেলার সুযোগ না দিয়ে চ্যাংদুলা করে তুলে হেলিকপ্টারে বসিয়ে দিল। কিন্তু তখনও জাভেদ চিৎকার দিয়ে বলছিল —
“স্যার, আপনি আমাকে মেরে ফেলুন, তবু-ও আমি যাব না আপনাকে ছেড়ে, স্যাররররর!”
কিন্তু সে-সব কথা প্রণয়ের কানে পৌঁছালো না। দেখতে দেখতেই চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেল হেলিকপ্টারটা, আর প্রণয়ের চেহারায়, চোখে-মুখে জেগে উঠলো পুরনো সেই হিংস্রতা। সে চোখ বন্ধ করে সাদমান শিকদারকে স্মরণ করলো।
প্রণয়ের জন্মের পর থেকে বাবা ছিলেন তার সব থেকে আপন। বাবাকে সে তার আইডল মনে করত। তাই ছোটো থেকে জ্ঞান-বুদ্ধি হওয়া পর্যন্ত সে কখনো বাবার কথার অবমাননা করেনি। বাবার জন্য জানটা ও কুরবান করতে রাজি ছিলো — ঠিক এতটাই ভালবাসতে প্রণয় তার বাবাকে। কিন্তু যেদিন বাবার আসল চেহারা দেখেছিল, যেদিন বাবার ঘৃণিত রূপটা দেখেছিল, সেদিনও কেন জানি রাগ করতে পারেনি প্রণয়, ঘৃণা ও করতে পারেনি। কেন যেন মনে হতো সাদমান শিকদার যা করছে তা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু জানে না কেন সে এই ঘৃণিত কাজগুলোকে সমর্থন করেছিল, কেন তার রাগ হয়নি। হয়তো রক্তই বলতো — এসব আমাদের পূর্বপুরুষের ধর্ম, স্বাভাবিক। কিন্তু প্রণয় সব জানলেও কখনো এই সকল কাজে নিজেকে লিপ্ত করেনি। সব কিছু জেনে যেমন প্রতিবাদ করেনি, তেমন ইন্ধনও যোগায়নি। যে যেমন চেয়েছে, তাকে তেমন থাকতে দিয়েছে। কারো বিষয়ে মাথা ঘামায়নি, কারণ তার পৃথিবী ছিল অন্যরকম।
কিন্তু সেই বাবাই একসময় প্রণয়কে মানসিকভাবে চাপ দিতে থাকে এসবে জড়িত হওয়ার জন্য। আর রাজি না হলে একসময় নিজের হাতেই ধ্বংস করে দেয় প্রণয়ের সাজানো পৃথিবী। তছনছ করে দেয় জীবন। তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে সকল সাজানো স্বপ্ন।
হিংস্র হতে হতে কখন ভেতরে জানোয়ার জেগে যায় বুঝতেই পারে না প্রণয়।
তবে বাবার কারণে নিঃস্ব হয়ে গিয়েও বাবাকে মন থেকে ঘৃণা করতে পারেনি প্রণয়। আর আজ এত বছর পরেও সে পারে না তার বাবাকে ঘৃণা করতে — যে বাবা নিজের ছেলেকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিল, ধ্বংসের শেষ প্রান্তে এনে দাঁড় করালো। এত কিছুর পরও সাদমান শিকদারকে ঘৃণা করে না প্রণয়, হয়তো রক্তের টান।
প্রণয় শূন্যে তাকিয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ত্যাগ করল। তাচ্ছিল্যের হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে বললো —
“নিজের ছেলেকে কাফনে মুড়ানোর জন্য রেডি থাকো, বাবা। কারণ তোমাকে শাস্তি আমি দেব না, দেবে মহান আল্লাহ তায়ালা। আমি যেমন আমার পাপের শাস্তি ভোগ করছি, তুমি ও ছাড় পাবে না, বাবা। আমি আপনজনদের বিশ্বাসঘাতকতায় সব হারিয়ে কেঁদেছি, তুমি আমাকে হারিয়ে কাঁদবে। এটাই হবে তোমার সর্বোচ্চ শাস্তি।”
প্রণয় বাড়ির দিকে আগাতেই পুনরায় থমকে দাঁড়ালো।
অধূর থেকে ভেসে আসছে হালকা বাতাসের ফিসফাস শব্দ। প্রণয় পেছনে না তাকিয়েই বাঁকা হাসল, গার্ডদের চোখের ইশারায় কিছু একটা বুঝিয়ে ভেতরে চলে গেল।
সেকেন্ড পাঁচেক গড়াতেই ঘন অন্ধকার আবৃত আকাশের বুক চিরে নেমে আসতে দেখা গেলো ব্ল্যাক সাউন্ড প্রুফ হেলিকপ্টার, যার ব্ল্যাড গুলো নিঃশব্দে ঘুরতে ঘুরতে এসে বরফ জমা ঢিপির উপর ল্যান্ড করলো—।
এমন করেই মাত্র দুই এক মিনিটের ব্যবধানে আরও ৫টা ক্যানোপি ফোর্স হেলিকপ্টার সাদা জমাট বাঁধা বরফের গায়ে ল্যান্ড করলো। সেই হেলিকপ্টারগুলোর কালো স্লাইডিং ডোর খুলে নিঃশব্দে পিঁপড়ের দলের মতো বেরিয়ে এলো ২০০-র বেশি ওয়েল ট্রেন্ড সোলজার বা কানাডিয়ান স্পেশাল ফোর্স, যার মধ্যমনি হিসেবে সামনে এসে দাঁড়ালেন ক্যাপ্টেন স্পেশাল ক্রাইম ব্রাঞ্চ অফিসার অবিনাশ শর্মা।
তীব্র তুষার বর্ষণ তখনো থামেনি। এই ঝড়ে সাধারণ মানুষের ঠিকা মুষকিল, তবু ও সৈন্যরা নির্বিকারে ঠিকে আছে।
অবিনাশ তাদের সামনে ইশারা করতেই তুষার আবরিত বরফের ঢিপির আড়াল থেকে সৈন্যরা হুঁশিয়ারি নজরে দৃষ্টি ফেললো সামনে।
তাদের থেকে প্রায় ৫০০ পা দূরত্বে অবস্থান করছে অবিশ্বাস্য একটা ঝাঁ চকচকে কাচের তৈরি ইমারত।
লোকালয় থেকে ১০০০ কিলোমিটার দূরে এমন বরফে ঢাকা পরিত্যক্ত স্থানে যে এমন কিছু থাকতে পারে, তা সাধারণ মানুষের কল্পনায় পৌঁছাবে না। তাহলে সরকার কোন ছাড়— এইজন্যই বোধহয় ক্রিমিনাল মাইন্ড আর নরমাল মাইন্ডের মধ্যে আকাশ-পাতাল ফারাক হয়।
কানাডিয়ান সৈন্যরা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে পুরো লোকেশনটা নিরীক্ষণ করলো, কোথায় কোন রাস্তা আছে তা দেখে নিয়ে সেই ঝড়ের মধ্যেই এগিয়ে চললো সামনে।
চোখে তাদের বুলেটপ্রুফ হেলমেটে ইনফ্রারেড ভিশন, গায়ে অ্যান্টি-স্নাইপার স্যুট, হাতে নীরব রাইফেল। মুখে কোনো কথা নেই, চোখে শুধু আদেশ পালন করার নিঃশব্দ প্রতিজ্ঞা।
মিনিট ১০-এর মধ্যেই তারা ঘুরে ঘুরে গ্লাস হাউসের চারপাশটা একদম মাকড়সার জালের মতো পেঁচিয়ে ফেললো, নিঃশব্দে পেতে ফেললো এক মরণ ফাঁদ।
মিনিট পাঁচেক যেতেই নিরব জায়গাটা কেমন হুট করেই বদলে গেলো— ২০০ জন সৈন্য কয়েকটা টিমে বিভক্ত হয়ে চুপিশারে পুরো বাড়িতে ছড়িয়ে পড়লো। তাদের কয়জন নিঃশব্দে ছাদে, কর্নারে, রেলিং-এ, ব্যালকনিতে বাড়ির বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে পড়ল— সর্বত্র তাদের নিঃশ্বাসের কম্পনে কাচের দেওয়ালে ভারী কুয়াশা সৃষ্টি করছে।
বাড়ির চারপাশে চলতে চলতে হঠাৎ সৈন্য দলের একজনের পা পড়ে কিছুতে, সাথে সাথে বোমা বিস্ফোরণে শব্দে সকলে পা থমকে গেলো। চোখের পলক ফেলার আগেই কয়েকজন সৈন্যের রক্ত-মাংসসহ ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন দেহ ছিটকে পড়লো ৩০ ফুট ধরে। বিপদ বুঝতে পেরে সাথে সাথেই সৈন্যরা লুকিয়ে পড়ে, যে যার পজিশন নিয়ে নিলো। মুহূর্তেই বুঝে গেলো এই বাড়ির সর্বত্র তাদের জন্য ট্র্যাপ পেতে রাখা হয়েছে।
তারা পুনরায় নিচু হয়ে প্রতিটা জানালার নিচে শুয়ে পড়ে, দু’জন করে সৈনিক তাদের পাশে লাগানো ছাদের পাইপ বেয়ে বেয়ে ছাদে ওঠে পড়ে ছয়জন স্নাইপার। গ্যারেজের পাশের গোপন টানেলও কেউ যেন না বোঝে, সেই ফ্লোরেই প্লাস্টিক বোমা বসানো হয়—
এ যেন এক নিঃশব্দ যুদ্ধ।
এতো কিছু হয়ে যাচ্ছে, তবু ও যেন ফ্রস্ট হ্যাভেনে কারো কোনো সাড়া নেই— পুরো বাড়িটা যেন মৃত্যুর গন্ধে চেয়ে গেছে চোরাচোখে অন্ধকারে।
আকাশে তখনো থেমে আছে দ্বিতীয় হেলিকপ্টার। তার ভেতর বসে আছে কর্নেল রায়ান আর্লেস্টন— স্নাইপার-ঠাণ্ডা চোখে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনের ম্যাপের দিকে।
“ইফ এএসআর ব্রিদস, আই ওয়ান্ট টু হিয়ার ইট।”
— এটাই ছিল তার আদেশ।
আসলে এই অপারেশনটা ছিল “ঘোস্ট কেজ প্রোটোকল”— বিশ্বজুড়ে চলমান একমাত্র সেই অপারেশন, যেটার উদ্দেশ্য “টার্গেট মাস্ট নট এস্কেপ, অর সারভাইভ।”
তবে কিছুক্ষণ পরেই অদ্ভুতভাবে সৈন্যদের সংখ্যা কমতে লাগলো। সেটা লক্ষ্য করে দাঁতে দাঁত চাপলো অবিনাশ, দলের থেকে কৌশলে আলাদা হয়ে সবার আড়ালে লুকিয়ে পড়লো।
একটা কাচের দেওয়ালের গা ঘেঁষে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ, অতঃপর সাবধানে দুটো নিঃশ্বাস ফেলে আবারো চার পাশে মাথা ঘুরালো। আশেপাশে কেউ নেই বুঝতে পেরে নিজের সাথে আনা বিশেষ জিনিসটা বের করলো। অন্ধকার রাতে ও ঝলসে উঠলো সেই বস্তু। অবিনাশ সেই কালো ছুড়ির মতো মেটালের সাহায্যে বুলেটপ্রুফ কাচের গায় ধীরে ধীরে আঁচড় কাটতে লাগলো এবং বেশ কয়েকবার প্রচেষ্টার পর কালো গ্লাসের গায় স্ক্র্যাচ ধরে গেলো। অবিনাশ বাঁকা হেসে ছুড়িটা পকেটে ঢুকিয়ে তার স্পেশাল টিম ডেকে কাচ ভেঙে নিঃশব্দে ঢুকে পড়লো বাড়ির ভেতরে।
মেঝেতে তুষারের দাগ, দেয়ালে অদ্ভুত নীরবতা। ঠিক তখনই—
“টিক… টিক…”
ধোঁয়ায় ঢাকা করিডরের ভেতর দিয়ে আবছা আলোয় সতর্ক পা ফেলছে অবিনাশ। বাড়ির ভেতরে অদ্ভুত ভৌতিক পরিবেশ— সিলিং-এর লাইটগুলো একটার পর একটা নিভে যাচ্ছে, যেন কেউ ইচ্ছে করেই অন্ধকার ছড়িয়ে দিচ্ছে চারপাশে। বাইরে থেকে তীব্র গুলাগুলির শব্দ কানে লাগছে। সেসবের পাত্তা দিচ্ছে না অবিনাশের বিশেষ টিম, কারণ ওদের মারার জন্যই এনেছে অবিনাশ।
ফার্স্ট করিডরের শেষ প্রান্তে গিয়েও থেমে যায় প্রথম ইউনিট— তাদের চোখে পাওয়ারফুল ইনফ্রারেড ভিশন, তবু ও বাড়ির ভেতরের সব কিছুই অস্পষ্ট কুয়াশা আর ধোঁয়ায় প্রায় সব কিছুই ঘুলা ঘুলা, কিছুই দেখা যাচ্ছে না।
“ক্লিয়ার রাইট… ক্লিয়ার লেফট—”
বাক্য শেষ হওয়ার আগেই, পাশের দেয়ালের প্যানেল সরে গিয়ে নিরিবে বেরিয়ে এলো দু’জন কালো পোশাকের গার্ড। যাদের দেখতে পেলো না সৈন্যরা, তারা চোখের ধোঁয়াশা ভাব হাত দিয়ে সরিয়ে এগিয়ে যেতেই শেষ জনের মুখ চেপে ধরে, এক গার্ড মুখ দিয়ে “উহু উহু” বের করার আগেই তৎক্ষণাৎ সুচালো সিরিঞ্জ ঢুকিয়ে দিলো সৈন্যের ঘাড়ের রগে।
অতঃপর টিম মেম্বারদের আরেকজনকে খপ করে ধরে গলা থেকে মাথাটা আলাদা করে দিলো নিঃশব্দে। কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই পাশের দরজা খুলে ধাক্কা মেরে তার দেহটা ফেলে দিলো অতল গহ্বরে। বাইরে থেকে একে দরজা মনে হলেও ভেতরের নকশাটা সম্পূর্ণ অন্যরকম— এভাবে একজন একজন করে কৌশলে টিম মেম্বারদেরকে হত্যা করতে থাকে ভেতরের গার্ডরা।
টিম মেম্বাররা সতর্ক পায়ে সামনের কর্নার ঘুরতেই হঠাৎ— সাইলেন্সড এসএমজি থেকে ছুটে আসা বুলেটে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে ছিটকে পড়লো কয়েকজন, রক্তে ভেসে গেলো কাচের ফ্লোর।
তার প্রতিক্রিয়ায় একজন সৈন্য গ্রেনেড ছুঁড়ে দিলো। তার তীব্র বিস্ফোরণে করিডরের শেষ প্রান্তের কংক্রিটের টুকরো আর লোহার ফ্রেম উড়ে এলো, কিন্তু ধোঁয়ার ভেতর থেকে কয়েকজন গার্ড এখনো দাঁড়িয়ে— দ্বিতীয় ইউনিট সিঁড়ি বেয়ে নামতেই নিচ থেকে স্বয়ংক্রিয় টারেট গর্জে উঠলো—
বুলেটপ্রুফ শিল্ড হাতে এগিয়ে এলো ক্যাপ্টেন অবিনাশ, হাতে তার এম৪১৬। নিঃশব্দ, নিখুঁত বার্স্ট— “পপ-পপ-পপ”— টারেট থেমে গেলো।
ঠিক তখনই সিঁড়ির ছায়া থেকে এক গার্ড এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো অচেতনভাবে। তবে সেখান থেকে কৌশলে সরে গেলো অবিনাশ, তার বদলে তীব্র জোরালো ধাক্কা লাগলো এক টিম মেম্বারের সঙ্গে। ধাক্কায় তীব্রতায় দু’জন গড়িয়ে পড়লো মেঝেতে, ছুরির ফলা গিয়ে ঠেকলো আর্মরের ফাঁকে।
অবিনাশ ডান হাতে এক ঝটকায় পিস্তল বের করে, “ঠাস! ঠাস!” করে মুহূর্তেই কয়েকটা লাশ ফেলে দিলো। গুলির আঘাতে ছিটকে পড়া রক্ত কাচের দেওয়াল বেয়ে চিকন ধারায় গড়িয়ে পড়ছে।
গ্লাস হাউসের কেন্দ্রীয় অ্যাট্রিয়ামে প্রবেশ করতেই একসাথে আগুন ঝরতে শুরু করলো। পনেরো-ষোলো গার্ড আর সৈন্য একে অপরের দিকে গুলি ছুঁড়ছে। বুলেটের ঝাঁক কাঁচের দেয়াল ভেদ করে বাইরে উড়ে যাচ্ছে, তুষার ভেতরে ঢুকে মেঝেতে সাদা গালিচা তৈরি করছে— যার উপর রক্তের ছোপ দাগ ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমাগত।
একজন গার্ড উপরে ফায়ার করতেই ঝুলন্ত বিশাল ঝাড়বাতি ভেঙে পড়লো দু’জন সৈন্যের মাথায়, পাশে থাকা সাদা মার্বেলের টেবিল চূর্ণ হয়ে গেলো। ব্যালকনির রেল থেকে উল্টো হয়ে ঝুলে আছে এক গার্ড, রোপে নেমে আসতে আসতে সাইলেন্সড এমপি৫ দিয়ে চারজন সৈন্যের হেলমেটে হেডশট দিলো এক নিঃশ্বাসে।
হঠাৎ রেডিওতে রায়ানের কণ্ঠ গর্জে উঠলো—
“হোল্ড ইয়োর গ্রাউন্ড! উই টেক দেম হিয়ার!”
কিন্তু পরের মুহূর্তেই তীব্র স্ট্যাটিক— যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলো। মনে হচ্ছিল গার্ডরা ঠিক এই মুহূর্তটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। তারা ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে মিলিটারি লাইনের মাঝখানে ঢুকে গেলো— হাতাহাতি শুরু হলো।
কাঁচ, রক্ত, ধোঁয়া, তুষার আর মৃত্যুমুখে পতিত সৈন্য ও গার্ডদের গুঞ্জনের শব্দে ভারী হয়ে উঠলো বাতাস—
তবে সবাইকে মরার জন্য ছেড়ে অবিনাশ দ্রুত উপরে উঠে গেলো, চোখে তার লক্ষ্য বেঁধের আগুন।
ঘরের বাতাসে গুমোট স্যাঁতসেতে ভাব। ঘরের খোলা জানালা দিয়ে শু শু করে ঢুকছে বাহিরের ঠান্ডা বাতাস। বাতাসের ধাক্কায় ভারি মোটা পর্দাগুলো উড়ছে ফর ফর শব্দে।
সম্পূর্ণ কালো রঙে আবৃত ঘরের বিছানার চাদর, ঘরের পর্দা থেকে শুরু করে পায়ের পাপশ পর্যন্ত নিখুঁত কালো রঙে মোড়ানো— তবে তার মধ্যে ও আজ অন্য ছোঁয়া।
কালো রঙের ঘরের মেঝেতে আজ মোটা সাদা রঙের মখমলে কার্পেট বিছানো। চারদিক সুরভিত সুগন্ধি মোমবাতির আলোয় স্নিগ্ধ হয়ে আছে। ঘরে জ্বালানো টিমটিমে নরম আলো দেখা যাচ্ছে। সেন্টার টেবিলের উপর রাখা এক গ্লাস রেড ওয়াইন, পাশে উষ্ণ আগুনের লেলিহান শিখা চিমনির ভেতর ধিকি ধিকি করে জ্বলছে। বাঘের চামড়া পাতা সোফার প্রান্তে বসে আছে এক মানব।
কাঁধজোড়া জেট ব্ল্যাক চামড়ার কোটে আবৃত, ভেতরে গাঢ় ব্ল্যাক সিল্ক শার্ট। হাতে কালো চামড়ার দস্তানা। তার শিকারি, হিংস্র চোখ দুটো অন্ধকারের মধ্যে ও কেমন চকচক করছে।
তার ঠোঁটে কোনো শব্দ নেই, তবে তাতে লেপ্টে আছে রক্ত জমিয়ে দেওয়া শীতল একটুকরো বাঁকা হাসি।
কিছু মুহূর্তের নিস্তব্ধতার পর টুপ করে ডোর হ্যান্ডেল চাপার শব্দ হলো। চোখের পলকেই সিকিউরিটি ব্যারিকেড টপকে অবিনাশ ঢুকে পড়ল সেই ঘরে। সাদা ট্রেঞ্চ কোটে ঢাকা শরীর, গলায় ঝুলছে ব্ল্যাক ব্যালিস্টিক ভেস্ট। পেছনে স্বয়ংক্রিয় এম৪১৬ ঝুলছে, কোমরে পিস্তল।
ঘরে ঢুকতেই থমকে যায় অবিনাশ।
সবার প্রথমেই তার চোখ আটকায় একজোড়া শীতল চোখে।
চোখে চোখ পড়তেই নির্ভীক অফিসার অবিনাশ শর্মার কলিজাটা কেঁপে উঠে নিঃশব্দে। সে নিজের চোখে এএসআর-কে দেখছে, যাকে গত নয় বছর হন্যে হয়ে খুঁজছে সকলে, কিন্তু— এ তো সেই মি. আবরার শিকদার প্রণয়! তার মানে প্রেসিডেন্টের সন্দেহটাই সঠিক ছিল!
অভিনাশের চোখে চোখ রেখে এএসআর ঠোঁট কামড়ে হাসে, ঠোঁটে এক টুকরো রহস্যময় হাসি ঝুলিয়ে বলে—
“একদম ঠিক গেস করেছিলেন অফিসার, আমি মি. আবরার শিকদার প্রণয়, ওনার অফ পিএস কোর্প?”
তবে এসব শুনে ভয় পাওয়ার মানুষ অবিনাশ নয়— সে এগিয়ে আসে এক ধাপ।
কঠিন কণ্ঠে বলে— “ভালোয় ভালোয় সারেন্ডার করুন, না হলে…”
হঠাৎ…
বিস্ফোরণের শব্দ!
ফ্রস্ট হ্যাভেনের এক প্রান্তে কিছু ধ্বংস হয়ে যাওয়ার শব্দ হয়। ঘরের দেওয়ালে লাগানো মনিটরে দেখা যায়, বাইরে স্নো-আলোর মাঝে মিলিটারি টিম ঢুকছে।
অভিনাশ পুনরায় সাহসিকতায় গর্জে ওঠে—
“ইউ আর সারাউন্ডেড, এএসআর! ডোন্ট ট্রাই এনিথিং!”
এএসআরের চোখে বিন্দুমাত্র চমক নেই। সে রিভলবারের নল দিয়ে কপাল চুলকায়। মাথা নাড়ে ধীরে, ওয়াইনের গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে বলে—
“ভুল করেছো, অফিসার…”
বলে অবিনাশকে কিছু বোঝার সুযোগ দেয় না—
উপরে না তাকিয়েই ঠাস! ঠাস! করে আচমকাই দুটো বুলেট ঢুকিয়ে দেয় অবিনাশের কপালে।
অভিনাশ অপ্রত্যাশিত আঘাত প্রতিরোধের সুযোগটা পর্যন্ত পায় না, বিধায় তার বোঝার আগেই সব ফুরিয়ে যায়— সে সহজেই লুটিয়ে পড়ে সাদা কার্পেট মোড়ানো মেঝেতে, মুহূর্তেই রক্তে রঞ্জিত হতে থাকে সাদা গালিচা।
তবে সে পড়ে যায় ঠিকই, কিন্তু দায়িত্ববোধ তাকে বাঁচিয়ে রাখে। মৃত্যুর এক সেকেন্ড পূর্বে সে গায়ের সর্বশক্তি দিয়ে বাঁ হাতে থাকা রিভলভার তুলে দুর্বল হাতে গুলি চালিয়ে দেয়— প্রণয় ও কিছু বোঝার আগেই গুলিটা ঝড়ের বেগে ছুটে এসে তার বুকের বা পাজরে গেঁথে যায়। ফিনকি দিয়ে বুকের গরম রক্ত ছিটকে পড়ে মেঝেতে। তবে চমকায় না প্রণয়— ঠোঁট কামড়ে চোখ বন্ধ করে নেয়।
নিঃশ্বাস ফুরিয়ে আসছে তার, সে হাঁটু ভেঙে পড়তে পড়তে বলে—
“মারার জন্য আর কোন জায়গা পেলি না…”
বলতে বলতেই অবিনাশের পাশে লুটিয়ে পড়ে প্রণয়—
পাশাপাশি দুটো দেহ— একজন দেশঘাতক, আরেকজন দেশপ্রেমিক। তবে এই গল্প কি এখানেই শেষ…
বন্ধ চোখের মনিতে বার বার তির্যক আলোর ছটা এসে ঠিকরে পড়ায় ঘুমের মধ্যেই বার বার চোখের পাতা কুঁচকে ফেলছে প্রিয়তা। মাঝে মাঝে কপাল জুড়ে দুই-একটা বিরক্তি চিহ্নেরও দেখা মিলছে।
প্রিয়তা অনেকক্ষণ এপাশ-ওপাশ করে আলোটাকে চোখে পড়া থেকে আটানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু লাভ হলো না। এখন আবার কেমন শরীর সেদ্ধ হয়ে যাওয়ার মতো গরম লাগছে। এই দুইয়ের ফলস্বরূপ কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রিয়তার ঘুম কেটে গেল। সে বিরক্ত মুখে চোখ খুলতেই থতমত খেয়ে গেল।
তার মাথার উপরের ছাদটা আজ কেমন অন্যরকম লাগছে— খুব চেনা কিন্তু প্রতিদিনের অভ্যাস নয়। কাঁচা ঘুম ভেঙেছে ভেবে মনের ভুল বলে উড়িয়ে দিলো প্রিয়তা। চোখ কচলে আড়ামোড়া ভেঙে শোয়া থেকে উঠে বসলো। ২ মিনিট ঝিমুনোর উদ্দেশ্যে মাথা ঝুঁকাতেই কারো পরিচিত কণ্ঠে একটা বাক্য ভেসে আসলো।
অতি পরিচিত অথচ প্রত্যাশিত নারী কণ্ঠটা কানে পৌঁছাতেই ধড়ফড়িয়ে উঠলো প্রিয়তা। তার সমস্ত ঘুম-আলস্য যেন এক ছুটে পালিয়ে গেল। সে তড়াক করে চোখ তুলে সামনে তাকিয়েই ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো। ঘরভর্তি মানুষের মধ্যে চেনা-পরিচিত মুখগুলো চোখে পড়তেই অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে রইল প্রিয়তা। তার মনে হচ্ছে সে হয়তো জেগে জেগে স্বপ্ন দেখছে।
প্রিয়তাকে আহাম্মকের মতো তাকিয়ে থাকতে দেখে অনন্যা বেগম মেয়ের মাথায় আস্তে করে হাত বুলিয়ে দিলেন। অশ্রুসিক্ত টলমলে চোখে তাকিয়ে ভেজা কণ্ঠে বললেন —
“৯ মাস কষ্ট করে পেটে ধরে ছিলাম তোকে। তোকে জন্ম দিতে গিয়ে প্রাণের ঝুঁকিতেও পড়েছিলাম। ডাক্তার বলেছিল আমার প্রেগনেন্সি কমপ্লিকেটেড, টুইন বেবি জন্ম না দিতে, কিন্তু আমি কারো কথা শুনিনি, সবার বিরুদ্ধেও তোকে জন্ম দিয়েছিলাম, এই দিন দেখবো বলে।”
বলে আঁচলে মুখ চেপে হুহু করে কেঁদে উঠলেন অনন্যা বেগম।
অনুস্রী বেগম বোনকে ধমকে বললো —
“আহ্ চুপ কর, মেয়েটার উপর দিয়ে কত ঝড়-ঝাপটা গেল, এখন কি এসব বলার সময়?”
প্রিয়তা যেন এসব দেখে আসমান থেকে টপকালো। উক্ত ঘটনার সবকিছুই তার মাথার ১০ হাত উপর দিয়ে যাচ্ছে। অনুস্রী বেগম মেয়ের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন —
“তুই এখন ঠিক আছিস তো মা? কোনো সমস্যা হচ্ছে না তো?”
প্রিয়তা কারো কথার কোনো জবাব দিতে পারলো না। সে আসলেই সত্য-মিথ্যের ঘোর থেকে বেরোতেই পারছে না। সে তো লেক কোয়ারেন্টাইনে ছিল, তাহলে এরা কোথা থেকে এলো?
প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই ইনায়া নিজের উঁচু পেটটা ধরে ধরে এসে প্রিয়তার সামনে বসলো। আচমকাই প্রিয় বান্ধবীর গলা জড়িয়ে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো, আবেগআপ্লুত কণ্ঠে বললো —
“তুই খুব খুব খারাপ প্রিয়, তুই কিভাবে এতটা স্বার্থপর হলি বল? কিভাবে আমার সাথে একটা কথা ও না বলে এই চার বছর থাকলি? তুই আমার থেকেও ভালো বন্ধু পেয়ে গেছিস তাই না? আমি বুঝে গেছি, খুব খুব স্বার্থপর তুই একদম তোর ভাইয়ার মতো।”
ইনায়াকে দেখে প্রিয়তার মুখ হা হয়ে গেলো। সে বড় বড় চোখে তাকিয়ে রইলো ইনায়ার দিকে। চার বছরে মেয়েটা কেমন পাল্টে গেছে, আগের থেকে ও বেশি মিষ্টি, ও গোলুমোলু, সারা শরীরে কেমন মাতৃত্বের চাপ। আবার পেট দেখে ও মনে হচ্ছে খুব তাড়াতাড়ি আরেকটা নতুন ছানা আসবে।
প্রিয়তা এবার সবাইকে ছেড়ে আসেপাশে চোখ ঘোরালো। চারপাশের পরিবেশ দেখে প্রিয়তার মাথা ঘুরে উঠলো। দক্ষিণ দিকের খোলা জানালার ওপারে দেখা যাচ্ছে শিকদার বাড়ির বারান্দা। প্রিয়তা সারা ঘরে চোখ ঘুরিয়ে দেখলো— এটা তারই চিরচেনা নিবাস, যার সাথে জড়িয়ে আছে প্রিয়তার জীবনের শ্রেষ্ঠ স্মৃতি। হ্যাঁ, এটা সেই ঘর যেখানে প্রিয়তা কাটিয়েছে নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ১৬ বছর।
প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই ঝড়ের বেগে ছুটে এসে কেউ তার বুকে আঁচড়ে পড়লো। ঘটনার আকস্মিকতায় তাল সামলাতে পারলো না প্রিয়তা, একটু হেলে পড়লো। তন্ময় শক্ত করে আপুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে অভিমানী কণ্ঠে বললো —
“তুমি কিছুতেই আমার প্রিয় আপু হতে পারো না। আমার প্রিয় আপু আমাকে বকলে ও কখনো আমায় কষ্ট দেয়নি। কিন্তু তুমি আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছো।”
তন্ময়ের উপর চোখ পড়তেই প্রিয়তার চেহারা কোমল হয়ে এলো, দৃষ্টির কৌতূহল নিভে গেলো। সে তন্ময়ের মাথায় হাত রেখে বললো —
“ভাই।”
প্রিয়তার এক শব্দে তন্ময়ের গলার জোর আরো বেড়ে গেলো। এবার তন্ময়ের দেখা দেখি থিরা আর থোরি— ওরা দু’পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে ভেঁ-ভেঁ করে কেঁদে দিলো। ইনায়া আর ঊষাও তাই করলো।
সবার এসব সেনটিমেন্টাল মেলোড্রামা দেখে মুখের সামনে তুরী বাজিয়ে হাই তুললো অরণ্য, অলস কণ্ঠে বললো —
“আরো জোরে দেখি কার গলায় কত জোর। যে ফার্স্ট হবে, তাকে দ্য গ্রেট অরণ্য শিকদারের তরফ থেকে ৫ টাকার ললিপপ উপহার দেওয়া হবে।”
তবে অরণ্যকে ওরা কেউ পাত্তা দিলো না। অনুস্রী বেগম এবার বিরক্ত হয়ে বললেন —
“এই তোরা ছাড় তো, ওকে। মেয়েটাকে একটু বিশ্রাম নিতে তো দে, না জানি কতো কষ্ট পেয়েছে মেয়েটা।”
অনুস্রী বেগম কথায় আশ্চর্য হলো প্রিয়তা— কষ্ট পেয়েছে মানে? সে আবার কবে কষ্ট পেলো? আর এখানেই বা আসলো কেমন করে?
এবার মুখ খুললো প্রিয়তা, কৌতূহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো —
“আচ্ছা আমি তো কানাডায় ছিলাম, এখানে আসলাম কিভাবে?”
প্রিয়তার প্রশ্নে সবাই এক মুহূর্তে চুপ হয়ে গেলো।
“তোকেই আমি নিয়ে আসছি।”
ভিড় ঠেলে এগিয়ে আসতে আসতে কথাটা বললো প্রথম। ৪ বছর পর ভাইয়াকে পুনরায় চোখের সামনে দেখে প্রিয়তার মনে পড়ে গেলো ৪ বছর আগের বিষাক্ত সে কথা। হ্যাঁ, এই প্রতিক শিকদার প্রীতমের একেকটা কথা প্রিয়তার কলিজা জ্বালিয়ে দিয়েছিল যার, যার ঘা পৌঁছেছিল প্রিয়তার রুহু আব্দি। তাই এত বছর পর এই মানুষটাকে পুনরায় দেখে বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নিলো প্রিয়তা।
বোনের চোখের ঘৃণা— আর এই নীরব প্রত্যাখ্যানে ভেতর ভেতর ভেঙে চুরে চুরমার হয়ে গেল প্রীতম। প্রিয়তা মাথা নিচু রেখেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো —
“আমি এখানে আসলাম কিভাবে, সেটা জানতে চাইছি।”
প্রীতম কষ্ট পেলেও বেশি আবেগ দেখালো না। প্রিয়তার হাতে এক গ্লাস পানি আর একটা ট্যাবলেট দিয়ে বললো —
“ওটা অনেক বড় কাহিনি, এটা খা, বলছি সব।”
প্রিয়তার ইচ্ছা না থাকলেও কোনো বাক্য ব্যয় ছাড়াই ওষুধটা খেয়ে নিলো। জানতে ও চাইলো না কিসের ওষুধ।
প্রিয়তা গ্লাসটা টেবিলের উপর রেখে শান্ত কণ্ঠে বললো —
“এখন বলো।”
তবে কিছুই বললো না প্রীতম। ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো —
“ধীরে সুস্থে সব জানতে পারবি, আগে খেয়ে-দেয়ে একটু ফিট হয়ে নে।” বলে চলে গেলো প্রীতম।
এতে বেশ খেপে গেলো প্রিয়তা, তবে নিজের বারন্ত রাগ চিবিয়ে হজম করে নিল, কারণ সে অবাধ্য হতে পারে কিন্তু বেয়াদব নয়। আর বিশ্বাসঘাতকতা এদের জন্মের অভ্যাস, তাই আশা রাখাটাই মূর্খতা।
তবে মস্তিষ্ককে বোঝিয়ে নিলেও মনকে শান্ত করতে পারলো না প্রিয়তা, হাজার প্রশ্নে তার মস্তিষ্ক জট পাকিয়ে যাচ্ছে।
অনুস্রী বেগম আদুরে কণ্ঠে বললেন —
“যা মা, ফ্রেশ হয়ে আয়, খাবার দিচ্ছি। আমার মেয়েটা কতদিন ঠিকমতো খায় না, হয়তো একদম চিকন কাঠি হয়ে গেছে। যা মা, ফ্রেশ হয়ে আয়।”
বলে বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লেন। অনুশ্রী বেগম থিরার উদ্দেশ্যে বললেন —
“থিরা, যাও মেজো বউকে সাবধানে ওর ঘরে দিয়ে আসো।”
থিরা ও বড়ো আম্মুর কথায় দুই পাশে মাথা কাত করলো।
তিনি এবার ঊষা ও পূর্ণতার উদ্দেশ্যে বললেন —
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬১ (২)
“সেজো বউ, ছোটো বউ, রান্নাঘরে আসো।”
শাশুড়ির কথায় ঊষা-পূর্ণতা কাটা হয়ে দাঁড়ালো “হ্যাঁ” সূচক মাথা নাড়িয়ে, লক্ষ্মী বউমার মতো শাশুড়ির আদেশ মেনে সুরসুর করে রান্নাঘরে চলে গেলো।