ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৪

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৪
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

আবির্ভাব মুচকি হেসে শ্বেতাকে বুকে মিশিয়ে নিলো, মাথায় হাত রেখে দুঃখ প্রকাশ করে বলল,
“এখন কি বরকে কান্না দেখানোর সময়, বলো মাই লাভ? কোথায় বর সারাদিন খেটে খুটে বাড়ি ফিরলো, তোমাকে এতো আদর করলো, কই এখন থাকে সুন্দর মতো পাত পেড়ে খেতে দেবে, হাওয়া বাতাস করবে, তা করে ফেঁচ ফেঁচ করে কাঁদছো! আহ্, আমার কপালটাই মন্দ।”
আবির্ভাবের এসব রঙ্গ কানে তুলল না শ্বেতা, আরো শক্ত করে চেপে ধরলো আবির্ভাবের শার্ট। কান্নাভেজা কণ্ঠে মিনতি করল—

“সারাজীবন আমার হয়ে থাকবেন তো আবির্ভাব? কখনো আমাকে ভুলে যাবেন না তো? আপনাকে ছাড়া এই আমি ভীষণ দুর্বল আবির্ভাব। বড়ো ভালোবেসে ফেলেছি আপনাকে।”
আবির্ভাব তৃপ্ত হলো। বুক থেকে শ্বেতাকে তুলে দুই গালে হাত রাখলো, বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে আলতো করে চোখের পানি মুছে দিলো, মনের সকল অনুভূতি উজাড় করে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়াল, গভীর প্রেমময় স্পর্শ এঁকে দিল।
ভেজা দুই চোখের পাতায় চুমু দিয়ে বললো—

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“তোমাকে ভুলে বাঁচবো কীভাবে, মাই লাভ! তুমি আমার জান। তুমি আমার নিঃশ্বাসের শেষ সাত সেকেন্ড।”
আবির্ভাবের কথার ধরনে শ্বেতার কলিজা ঠান্ডা হয়ে গেল, বেশ লজ্জা ও পেলো মেয়েটা।
লাজে রাঙা মুখ দেখে আবির্ভাব দুষ্টু হাসলো, লজ্জার মাত্রা বাড়িয়ে দিতে বললো—
“নতুন বৌয়ের মুখের এই লাজটুকুই মিসিং ছিলো, মাই লাভ। এখন তোমাকে একদম নতুন বৌ লাগছে।”
শ্বেতা লজ্জায় এবার হাসফাস করে উঠলো। আবির্ভাব দুষ্টু হেসে বলল—
“বধূ না হয় বুঝলাম, কিন্তু বালিকা তুমি কার বধূ?”
শ্বেতা আবির্ভাবকে ধাক্কা দিয়ে বেরিয়ে যেতে নিলো। কোমর টেনে ধরলো আবির্ভাব, হেঁচকা টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। শ্বেতার পিঠ ঠেকলো আবির্ভাবের বুকে।
আবির্ভাব আলতো স্পর্শে গলার কাছ থেকে চুল সরিয়ে সেখানে তপ্ত নিশ্বাস ফেললো। সুগন্ধিত ঘাড়ে নাক ঘষে দিয়ে স্লো ভয়সে বললো—

“উত্তর না নিয়ে তো ছাড়বো না, মাই লাভ। বলো, তুমি কার বধূ?”
নাজুক শরীরে উষ্ণ নিশ্বাসের ছোঁয়া লাগতেই জমে গেলো শ্বেতা, পেটের ভেতর গুড়গুড় করে উঠলো।
জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলো।
আবির্ভাব ততক্ষণে দীঘল কেশে মুখ ডুবিয়ে দিয়েছে। উন্মাদের মতো চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে হাস্কে কণ্ঠে বলল—
“চুলে কোন ব্র্যান্ডের ওয়াইন ইউজ করো, মাই লাভ?
স্মেলস লাইক কোকেন।
আই লাভ ইট।”
শ্বেতার নিশ্বাস জড়িয়ে আসছে, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কাঁপছে থরথর করে। সে কাঁপা কণ্ঠে ডাকলো—
“আবির্ভাব…”
“হুম…”
“খাবেন না?”
“হুম…”
“চলুন।”
“হুম…”
শ্বেতা সম্মতি পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো। যাওয়ার উদ্দেশ্যে এক পা সামনে বাড়াতেই পুনরায় সমর্থবান বলিষ্ঠ হাতের বাঁধনে বাধাপ্রাপ্ত হলো।
কাঁপা কণ্ঠে বললো—

“ছাড়ুন।”
“উহু…”
আবির্ভাবের কণ্ঠস্বরে অন্যরকম মাদকতা।
আবির্ভাব নেশা-জড়ানো মাদকীয় কণ্ঠে বললো—
“বলো না মাই লাভ, তুমি কার বধূ?”
উত্তরটা জানা, কিন্তু অতি লজ্জায় সেটা মুখ দিয়ে আসছে না শ্বেতার।
কিন্তু এই লোকের এই মারাত্মক স্পর্শ গুলো সহ্য করার মতো নয়, তাই বাঁচতে চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বললো
“আপনার।”
আবির্ভাব ঠোঁট কামড়ে হেসে বলল,
“সত্যি?”
“হুম…”
“তাহলে আরেকবার বলো, তুমি কার বধূ?”
“আপনার।”
আবির্ভাব পুনরায় শ্বেতার ললাটে চুম্বন করে, আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে দিয়ে কন্ঠের তীব্র অধিকার বোধ মিশিয়ে বলল,
“মনে থাকে, যেনো তুমি শুধু আমার বধূ। শুধুই এই আবির্ভাবের।”

বলে শ্বেতাকে নিয়ে ডাইনিং টেবিলে চলে গেলো।
বিশাল ডাইনিং টেবিলের একটা চেয়ার টেনে “ধপ” করে বসে পড়লো আবির্ভাব। ক্ষুধায় তার পেট জ্বলছে, মাথা ভনভন করছে। সে অধীর কণ্ঠে হাঁক ছেড়ে বললো—
“কোথায় মাই লাভ, খাবার কি আজ পাবো না?”
“উফফ আল্লাহ! আসছি,”— বলে রান্নাঘর থেকে জবাব দিলো শ্বেতা।
আবির্ভাব দাঁত খিঁচিয়ে বললো—
“এই হচ্ছে মেয়েমানুষের এক সমস্যা, নড়ে চড়তে আঠারো মাস।”
শ্বেতা একটা বড়ো কাশার থালায় প্লেটভর্তি ভাতের সাথে সব পদের তরকারির বাটিগুলো সাজিয়ে এনে আবির্ভাবের সামনে দিলো।
এতো খাবার দেখে আবির্ভাব চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল।
সে একবার খাবারের দিকে তো আরেকবার শ্বেতার দিকে তাকিয়ে সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল—
“এতো রান্না তুমি করেছো?”
শ্বেতা সুমিষ্ট কণ্ঠে জবাব দিলো—

“জ্বী।”
আবির্ভাব পুনরায় গোয়েন্দাদের মত থুতনিতে হাত রেখে সন্দিহান কণ্ঠে বললো—
“পুরো অ্যাপার্টমেন্টে ভিক্ষা করলেও এত তাড়াতাড়ি এতো খাবার পাওয়া যাবে না।”
শ্বেতা কোমরে হাত দিয়ে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো আবির্ভাবের দিকে।
বউ রেগে যেতে পারে ভেবে আর বেশি ঘাটালো না আবির্ভাব। তবে এটা সত্যি, সে বাইরের খাবার খেতে পছন্দ করে না, আর ঘরে এত পদের খাবার সাজিয়ে গুছিয়ে শেষবার খাইয়েছিলেন পুজারিণী রায় চৌধুরী—তাও বহু মাস আগে।
শ্বেতা একটা প্লেটে সাদা ভাত বেড়ে দিয়ে সব পদের তরকারি একটু একটু করে তালার পাশে সাজিয়ে দিলো।
আবির্ভাব মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো। জীবনে এতটুকু সুখই তো সে চায়।
শ্বেতা গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ে বললো—
“খাচ্ছেন না কেন? রাত ২টা তো বাজতে চললো, কখন খাবেন আর কখন ঘুমাবেন? কাল সকাল সকাল তো আবার হাসপাতালে যেতে হবে।”

আহহহ! আবির্ভাব এতগুলো বছর তো ঠিক এই দিনের জন্যই অপেক্ষা করছিলো, এই শাসন-বরনগুলোর জন্যই তো সে ছটফট করছিলো।
বিবাহিত জীবনে এত সুখ! এখন তো…
আর ভাবার আগেই সুমিষ্ট কণ্ঠে ঝাড়ি ভেসে এলো—
“এতক্ষণ খাবারের জন্য চিৎকার দিয়ে বাড়ি মাথায় তুলছিলেন, তাহলে এখন খাবার রেখে আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছেন কেনো?”
আবির্ভাব ঠোঁট চেপে হাসলো। শ্বেতাকে টেনে নিজের পাশের চেয়ার বসালো, খাবারের প্লেটটা শ্বেতার দিকে এগিয়ে দিয়ে ঠোঁট উল্টে বললো—
“তোমার বরের ক্লান্ত শরীরে একটুও এনার্জি নেই, মাই লাভ। প্লিজ।”
শ্বেতা বেশ বুঝলো, এই লোক কিসের বায়না করছে। চাপা দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করলো শ্বেতা। হাত দু’য়ে ভাতের প্লেট হাতে নিলো, সুন্দর মতো তরকারি দিয়ে মেখে এক লোকমা ভাত আবির্ভাবের মুখের সামনে ধরলো।
আবির্ভাবের নিজেকে বড়ো সুখী সুখী লাগছে। সে পরম তৃপ্তিতে লোকমাটা মুখে নিলো।
শ্বেতা এভাবে একের পর এক ভাতের লোকমা গালে তুলে দিতে লাগলো। আবির্ভাব ও বাচ্চাদের মতো গপগপ করে খেতে লাগলো।

এভাবে এক প্লেট, এক প্লেট করে— বড়ো বড়ো দুই প্লেট ভাত খাইয়ে দিলো শ্বেতা। কিন্তু আবির্ভাব বুঝতেই পারলো না।
সে এটুকুই বুঝলো না যে সাধারণ ভাত-ডাল-মাছের ঝুলেও এত শান্তি থাকে।
শ্বেতা খাবারের প্লেট-সহ থালা-বাটি নিয়ে কিচেনে চলে গেলো। আবির্ভাব খাওয়ার সময় না বুঝলেও এখন নড়তে পারছে না। মনে হচ্ছে, একটু নড়াচড়া করলেই ভাত তরকারি সব নাক-মুখ দিয়ে উঠে আসবে।
শ্বেতা থালা-বাটি ধুয়ে এসে বললো—
“কি ব্যাপার, এখন বসে আছেন কেন? গিয়ে শুয়ে পড়ুন।”
“হুম, চলো।”
আবির্ভাবের কথায় আতকে উঠলো শ্বেতা, শুকনো ঢোঁক গিলে বললো—
“কো-কো কোথায় যাবো?”
আবির্ভাব ভাবলেশহীনভাবে জবাব দিলো—
“ঘুমাতে।”

শ্বেতার উপর আবার পুরনো কাঁপা কাঁপির রুগ ভর করলো।
সে তোতলিয়ে বললো—
“দ-দ…দেখুন।”
“এখনই দেখবো।”
বলে বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো আবির্ভাব। শ্বেতাকে কিছু বলতে না দিয়ে দুই হাতে চেপে কোলে তুলে নিলো।
শ্বেতা আবির্ভাবের বুকে কিল-ঘুঁষি মারতে মারতে বললো—
“আবির্ভাব!”
“শশশ, মাই লাভ। ইটস টাইম টু স্লিপ।”
“আবির্ভাব, প্লিজ!”
আবির্ভাব এসব না নিষেধ কিচ্ছু শুনলো না। শ্বেতাকে নিয়ে গিয়ে নিজের বেডে আলতো করে শুইয়ে দিলো।
হাত বাড়িয়ে ঘরের সব লাইট অফ করে দিলো।
ভয়ে-লজ্জায় শ্বেতার হৃদপিণ্ড ধরাস ধরাস করছে। আবির্ভাব দুটো বালিশ এক করে শ্বেতার মাথার নিচে দিলো।
নিজের হাতে ঘড়ি খুলে টেবিল ল্যাম্পের পাশে রাখলো।

হোয়াইট শার্টের হাতের কব্জিতে থাকা দুটো বোতাম খুলে ঢিলে করলো।
অতঃপর বুকে কাছের দুটো বোতাম খুলে শার্ট ঢিলে করলো। এবার কমফর্টেবল লাগছে।
শ্বেতা মুখ ফুটে কিছু বলতে নিলো, নিজের কোমল শরীরে ভীষণ চাপ অনুভব করলো।
আবির্ভাব দুই হাতে শ্বেতার কোমর জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে দিলো।
স্তব্ধ হয়ে গেলো শ্বেতা। অতিরিক্ত ওজনটা আস্তে আস্তে শ্বেতার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়লো। বিধায় এখন আর খুব একটা চাপ অনুভব হচ্ছে না। শরীরের ভেতর কেমন কেমন অনুভূতিরা উথালপাথাল করছে, অন্যরকম প্রশান্তিতে ভরে উঠছে হৃদয়।
আবির্ভাব শ্বেতার হাতটা ধরে নিজের চুলের ভাঁজে রাখলো। ক্লান্ত ঘুম-জড়ানো কণ্ঠে বললো—
“চুলগুলো টেনে দাও মাই লাভ, ঘুম পাচ্ছে।”
শ্বেতা ও তাই করলো। দুই হাত আবির্ভাবের চুলের গভীরে ঢুকিয়ে আস্তে আস্তে মুঠো মুঠো করে টেনে দিতে লাগলো।
কিছুক্ষণের মধ্যেই আবির্ভাব গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেলো। তার ভারী ভারী গরম নিশ্বাস এসে জমা হতে লাগলো শ্বেতার বুকে।

দরজায় কড়া ঘাটার শব্দে কেঁপে উঠলো শ্বেতা, ঘোর কেটে গেল।
বাইরে থেকে অনবরত দরজা ধাক্কানোর শব্দ ভেসে আসছে, কেউ ডাকছে বোধয়। শ্বেতা দুই হাতে চোখ মুছলো, নিজেকে যথাসাধ্য স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে উঠে দাঁড়ালো। হাতের শাখা-পলাগুলো পুনরায় পুটলিতে বেঁধে যথাস্থানে রেখে দিলো। দ্রুত ওয়াশরুমে ঢুকে চোখে-মুখে পানি দিয়ে নিজের বিধ্বস্ত অবস্থা ঢাকলো। টাওয়াল দিয়ে চোখ-মুখ মুছতে মুছতে দরজা খুলে দেখলো, থিরা দাঁড়িয়ে আছে।
শ্বেতা প্রশ্নবোধক দৃষ্টি নিক্ষেপ করল থিরার পানে।
থিরা ব্যস্ত কন্ঠে বললো,
“শ্বেতাপু, নিচে চলো। বড়ো আম্মু তোমাকে খেতে ডাকছেন।”

“তুই যা, আমি আসছি।” বলে রুমে ঢুকে পড়লো শ্বেতা। তার মনের গোপন সিন্ধুকে তুলে রাখা ব্যথাগুলো সে আর কাউকে দেখাতে চায় না। যা হওয়ার হয়ে গেছে, ওই মানুষটা সুখে আছে এটাই বা কম কী! তার এই কান্নাকাটি আহাজারিতে যদি বদ-দোয়া লেগে যায়, এই ভেবে আশঙ্কিত হয় শ্বেতা। তাই সে ঠিক করে আর কাঁদবে না, যথা সম্ভব নিজেকে সামলে রাখবে। কারণ মানুষের অভিশাপ দেওয়ার জন্য মুখে বলার প্রয়োজন পড়ে না, রুহের অভিশাপ তার থেকেও ভারী।
প্রিয়তার শোয়ার ঘরের মেঝেতে বড়ো করে মাদুর পাতা হয়েছে, যার মধ্যমণি হয়ে বসে আছে প্রিয়তা।
মাথার সব চুল একত্র করে উঁচুতে তুলে শক্ত একটা খোঁপা করে রেখেছে। বেশ সুনিপুণতার সহিত মেহেদির ডিজাইন আঁকছে অবনীর ছোট্ট ছোট্ট হাতে।

তাকে চারপাশ থেকে ঘিরে বসেছে থিরা, থোরি, অভিরাজ, শুভ্রতা, ওদের কাজিনসহ আরো বেশ কিছু মেয়ে। সবার মুখে ফেসপ্যাক, হাতে মেহেদি। সকলের অনেক চাপাচাপিতে প্রিয়তা রাজি হয়েছে মেহেদি পরাতে এবং টানা তিন ঘণ্টা যাবৎ একভাবে বসে থেকে নিরলস ভঙ্গিতে সবার হাতে মেহেদি পরাচ্ছে।
প্রিয়তা অবনীর হাতে মেহেদি দিচ্ছে, আর অবনী চুপটি করে বসে প্রিয়তার সাথে টুকরো টুকরো গল্প করছে।
প্রিয়তা অবনীর হাতে মেহেদি দেওয়ার শেষ করে বড়ো একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়তেই তার চোখে ভেসে উঠলো ডজন খানেক হাত।

এতো বড়ো বড়ো হাত দেখে প্রিয়তা কপাল কুঁচকে সামনে তাকালো।
ওর মুখের সামনে সাদমান সিকদার, খালিদ সিকদার, সাজিদ সিকদার, সোহেব সিকদার, প্রেম, রাজ, অরণ্য, সমুদ্র, তন্ময় দুই হাত তুলে বসে পড়েছেন।
সবাইকে এই মুহূর্তে এখানে আশা করেনি প্রিয়তা।
প্রিয়তা সবার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো, নির্লিপ্ত কন্ঠে বলল,
“এ কী! আপনারা এখানে কেনো?”
প্রিয়তার এমন নিগূঢ় নির্লিপ্ততায় কষ্ট পেলেন সাদমান সিকদার। অভিমানী কণ্ঠে বললেন,
“প্রত্যেকবার তো আমার মা আমাকে সারাবাড়ি ছুটিয়ে ধরে মেহেদি পরায়। তাই এবার আমি নিজেই মেহেদি পরতে এসেছি।”

বলে রাজার দিকে তাকিয়ে চোখ রাঙালেন সাদমান সিকদার।
রাজ বেচারার অবস্থা বলির পাঁঠার মতো। সে একটা কেবলামার্কা হাসি দিয়ে বললো,
“হ্যাঁ হ্যাঁ, শুন তুই! প্রত্যেকবার আমাদের অনেক লম্ফঝম্প করে ধরিস নে, এবার আমরাই এসেছি। তাড়াতাড়ি ধরে মেয়ে সাজিয়ে দে দেখি।”
সোহেব সিকদার চোখ রাঙিয়ে তাকালেন। চুপসে গেলো রাজ।
অরণ্য হাই তুলে বললো,
“আরে আবুলের নাতনি, যা করবি ঝটপট কর। এভাবে বেশি ক্ষণ থাকলে আমার মান্জা ব্যথা হয়ে যাবে। নাকি তুই চাচ্ছিস আবারো দৌড়ঝাপ করে ধরতে?”
প্রিয়তা এবারো কোনো জবাব দিলো না।
সাজিদ সিকদার অসহায় চোখে তাকিয়ে বললেন,
“আমরা কী করেছি বলো আম্মা? আমাদের দোষ কোথায়? আমাদের কেনো শাস্তি দিচ্ছো?”
সমুদ্রও তাল মিলিয়ে বলল,
“হ্যাঁ, আমরা কী করেছি বল!”
তন্ময় বললো,

“প্রিয় আপু, ভালো মতো বর সাজিয়ে দাও তো।”
সবার কথা শুনে প্রিয়তার হাত নিশফিশ করছে, মন উশখুশ করছে।
তন্ময় ভয় ভয় অরণ্যের কানে কানে বললো,
“পার্টনার, এই আবুলের নাতনি যদি এখন ভুল করে ও রাজি হয়ে যায় তাহলে তো আমাদের ইন্নালিল্লাহ।”
পাশ থেকে বলে উঠলো সমুদ্র,
“ঠিক বলছিস!”
অরণ্যও ভয় ভয় তন্ময়ের কানে কানে বললো,
“আমি বলির বকড়া হতে চাই না। এই কুদ্দুসের মা একবার ধরলে আর ছাড়বে না। ছাল ছাড়িয়ে নুন মাখে রোদে শুকোতে দেবে।”
আবারো পাশ থেকে বলে উঠলো সমুদ্র,
“একদম ঠিক!”
অরণ্য আবার বললো,
“আল্লাহ আল্লাহ কর যাতে রাজি না হয়।”
বলে দুই ভাই হে হে করে হাসার চেষ্টা করলো।
প্রিয়তা অনেক ভাবনা চিন্তা করে দেখলো, আসলেই এদের দোষ নেই। তাই প্রিয়তা বসা থেকে উঠে পড়লো, বাবা-চাচা-বড়ো ভাইদের লাইন ধরিয়ে মাদুরের ওপর বসালো।
তন্ময় ঢুক গিলে বললো,

“কাম সারছে পার্টনার। কাল তোর আর আমার ব্রেকআপ কেউ ঠেকাতে পারবে না।”
দুই ভাই অসহায় হয়ে চোখ পিটপিট করলো।
প্রিয়তা বসা থেকে উঠে গিয়ে নখানা পুতুল বসানো উলের হেয়ারব্যান্ড নিয়ে এলো। একে একে সবার মাথায় হেয়ারব্যান্ড পরিয়ে দিলো।
ওদের একে অপরকে দেখে পেট ফেটে হাসি আসছে।
অরণ্য হাসি চাপতে না পেরে ফিক করে হেসে দিলো। সাথে সাথেই বেশ কয়েক জোড়া অগ্নি দৃষ্টি তার দিকে নিক্ষিপ্ত হলো। ভয়ে চুপ মেরে গেলো অরণ্য। তন্ময়ের কানে কানে বললো,
“এখন যদি একটা ছবি তুলে ফেসবুকে আপ দেওয়া যায় তাহলে আইডির রিচে ফেসবুক কেঁপে যাবে। এক ঘণ্টায় দ্য গ্রেট এস.কে গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রির এমডি-সিইওরা ভাইরাল হয়ে যাবে। সাথে আমরাও।”
সকলে ফিসফাস করলে ও প্রিয়তা গম্ভীর মুখে উঠে গিয়ে ফেসপ্যাকের বাটি নিয়ে এলো। একে সুন্দর মতো সবার মুখে অ্যাপ্লাই করে দিলো।
রাজ গন্ধ শুকে ওয়াক তুলে বললো,

“মুখে এটা কী লেপে দিলি হারানের বউ? কি বিচ্চিরি গন্ধ!”
পাশ থেকে বলে উঠলো সমুদ্র,
“ফ্রেশ কাউ ডাঙ্ক।”
এটা শুনে ওয়াক ওয়াক করতে লাগলো তন্ময়।
প্রিয়তা ওদের বাড়াবাড়ি পাত্তা না দিয়ে সবার মুখে লাগিয়ে দিলো। এবার হাঁটু মুড়ে বসে সবার হাতে মেহেদি পরাতে শুরু করলো। এতক্ষণ মন খারাপ থাকলেও, ও এখন মনে মনে খুশিতে ফেটে পড়ছে প্রিয়তা।
আজ থেকে চার বছর আগে, ও প্রতি বছর ঈদের আগের দিন সবাইকে ধরে বেঁধে স্কিন কেয়ার করাতো প্রিয়তা! ইঁদুরের গর্তে লুকিয়ে ও কারো জান বাঁচতো না। আর আজ তো পাখি নিজে থেকেই জালে ধরা দিতে এসেছে, তাহলে শিকারি ছাড়বে কেনো!

অন্ধকারে ডুবানো নিঝুম রাতের গা চমচমে সৌন্দর্য অদ্ভুত রকমের ভয়াবহ, যা খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে উপভোগ করার সাহস সবাই রাখে না।
শিকদার বাড়ির দক্ষিণ দিকের ছাদ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা শতবর্ষীয় প্রাচীন জামগাছের নিচে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে দুই পুরুষ, আঙুলের ফাঁকে তাদের জ্বলন্ত সিগারেট।
প্রতিবার সুখটানের সঙ্গে ঝলসে উঠছে সিগারেটের আগুন, নাক-মুখ থেকে নির্গত বিষাক্ত ধোঁয়া অন্ধকারাচ্ছন্ন বাতাসে কুণ্ডলি পাকিয়ে উড়ে যাচ্ছে।
তাদের মুখে কোনো শব্দ নেই, চোখে কেবল পাথর চাপা অনুভূতির জুয়ার।
“কি ভাই, রাত ১২টার সময় এমন কুখ্যাত জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভূতের সাথে কি শলা-পরামর্শ চলছে?”
দূর থেকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো সাদাফ, ট্রাউজারের পকেটে হাত ঢুকিয়ে ধীর পায়ে এসে দাঁড়ালো দুজনের পাশে।
ছাদে আলো ঝলছে, কিন্তু অন্যদিকে এই দিকটা সম্পূর্ণ অন্ধকারে নিমজ্জিত। আর তাছাড়া ভূতের ভয়ে কেউ এদিকে আসে না।

পুরো রায়পুরের রটনা, শিকদার বাড়ির দক্ষিণ দিকে জামগাছ নাকি ভুতুড়ে। অনেকে নাকি ভূত দেখেছে স্বচক্ষে।
সাদাফের উক্ত প্রশ্নে কোনো ভাবান্তর হলো না দুজনের।
সাদ লাফিয়ে উঠে বসলো গাছঘেষা রেলিঙে, খসখসে জামগাছের ছালে হেলান দিয়ে বললো,
“আহ তোদের দেখে আমার বড় মায়া হয়। বেচারা, মেরুদণ্ডটা যদি আরেকটু সোজা থাকতো, তাহলে আজ তোদের দিনও অন্যরকম হতো।”
“কি বলতে চাস?”
অন্ধকারে ভারী পুরুষালী কণ্ঠ শোনা গেলো।
সাদাফ বাঁকা হেসে বললো,
“আমি কি বলতে চাইছি সেটা তুই খুব ভালো মতোই বুঝতে পারছিস।”
প্রণয় সিগারেটটা দূরে ছুড়ে ফেলল, তিক্ত কণ্ঠে বললো,
“মজা নিচ্ছিস?”
সাদাফ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো, রসিয়ে রসিয়ে বললো,

“ঠিক বলেছিস, মজা দেখতেই এসেছি। Revenge of nature বলে একটা বহু প্রচলিত প্রবাদ আছে জানিস তো? তুই অন্যের সাথে যেমনটা করবি, ঠিক তেমনটাই একদিন তোর সাথেও হবে, তার প্রমাণ তুই নিজেই দেখ।
আজ থেকে চার বছর আগে… চার বছর আগে আমি তোর দুই পা জড়িয়ে কেঁদেছিলাম, কাকুতি-মিনতি করেছিলাম। কিন্তু তুই আমার যন্ত্রণা দেখতে চাসনি, এক রাতে নিঃস্ব করে দিয়েছিলি আমায়। সব জেনে-শুনেও আমার ফুলপরীকে অন্যের হাতে তুলে দিয়েছিলি।
আজ দেখ, সেই চার বছর আগের জায়গায় তুই দাঁড়িয়ে আছিস।
সেদিন আমি অসহায় ছিলাম, দুর্বল ছিলাম, কিচ্ছু করার ছিল না আমার। কিন্তু তুই তো না! তুই তো দুর্বল নয়, তবে আমার থেকেও বেশি অসহায়।

তোর কাছে কি নেই? টাকা আছে, পাওয়ার আছে, জস আছে, পুরো পৃথিবী তোর পায়ের নিচে। তবুও তুই একজন পথচারী ভিক্ষুকের থেকেও অতিকায় নিম্ন দরিদ্র।”
প্রণয় চুপচাপ সব শুনলো, তবে বিশেষ কোনো প্রতিক্রিয়া দেখালো না। ক্ষণকাল চুপ থেকে নীরলিপ্ত কণ্ঠে বললো,
“আমার বোন তোকে চায়নি, কখনোই ভালোবাসেনি। তাই বড় ভাই হিসেবে আমার বোন যাকে চেয়েছে আমি তার হাতেই তাকে দিয়েছি।”
সাদাফের চোখে-মুখে তাচ্ছিল্য খেলে যায়। ব্যঙ্গ করে বলে,

“নে, মেনে নিলাম, পরী আমার ছিল না, আমায় ভালোবাসেনি। কিন্তু প্রিয়তা তো তোর ছিল, তোকে অনেক ভালোবেসেছে। তাহলে তুই কেন এত কষ্ট পাচ্ছিস? তুই চাইলেই তো প্রিয়তাকে বিয়ে করে নিতে পারিস। বাচ্চা-কাচ্চা পয়দা করে সুখে দিন কাটাতে পারিস। জানি বেশি দিন বাঁচবি না, তবু ও যতদিন হয় আর কি। কেন শুধু এভাবে ধুকে ধুকে মরছিস?”
পাশ থেকে সিগারেট ফুঁকতে-ফুঁকতে নীরলিপ্ত কণ্ঠে আবির্ভাব বললো,
“কোন প্রশ্নের উত্তর ছাড়াই যদি এই কেনোর উত্তরটা তুই বুঝে যেতিস, তাহলে আজ এই প্রশ্ন করতিস না।”
সাদাফ এবার প্রণয়ের দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আবির্ভাবের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো। কিছু একটা চিন্তা করে পুনরায় ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটিয়ে তুললো।
রহস্যময় কণ্ঠে বললো,

“তোর মুখেও বড় বড় কথা মানায় না। তোর ব্যাপারেও সব জানা আছে আমার।
আসলে কি বলতো… এটা-ওটা বলে তোরা নিজেদের অক্ষমতা ঢাকতে চাস। আসলে তোরা দুটোই মেরুদণ্ডহীন।
আমার ভালোবাসা না হয় আমায় ভালোবাসেনি, তাই দেখিয়ে দিতে পারিনি ভালোবাসা কিভাবে ধরে রাখতে হয়। কিন্তু তোদের তো এমন না। তোদের ভালোবাসার মানুষ তো তোদের ভালোবেসেছিল, পাগলের মতো ভালোবেসেছিল। তাহলে তোরা কেন হেরে গেলে? কেন তোদের জন্য ওই নিষ্পাপ মেয়েদুটো এত কষ্ট পাচ্ছে?”
সাদাফের কড়া প্রশ্নবাণে দমে যায় আবির্ভাব, গলা শুকিয়ে আসে তার, কোনো প্রতিউত্তর করতে পারে না।
প্রণয় লম্বা শ্বাস টেনে মলিন কণ্ঠে বলল,

“ওর জন্য শুধু ভালোবাসা নেই বলেই, দূরে সরিয়ে রেখেছি।
যদি শুধু ভালোবাসতাম তাহলে নিশ্চয়ই তুই যেগুলো বলেছিস ওগুলো করতাম। বিয়ে হতো, বাচ্চা হতো, সংসার হতো, সব হতো। আমি ও হয়তো অন্যান্য সো-কলড হিরো বা ভিলেনদের মতো বলতে পারতাম যে, সে মরুক বা বাঁচুক তা আমার দেখার বিষয় না। ও মরলেও আমার সাথে মরুক, বাঁচলে ও আমার সাথে বাঁচুক। তবুও ও আমার হয়েই থাকুক।
কিন্তু আফসোস, এসব ফিল্মি ডায়লগ আমি দিতে পারবো না।”
প্রণয়ের হেয়ালিপূর্ণ কথায় ভুরু কুঁচকে ফেললো সাদাফ, চোখ ছোটো ছোটো করে প্রশ্ন করলো,
“মানে?”

প্রণয় বুক ভরে শ্বাস নেবার চেষ্টা করলো, কিন্তু আশ্চর্য, তার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। আজকাল বাতাসে বোধহয় অক্সিজেনের তুলনায় পয়জনের পরিমাণ বেড়েছে।
প্রণয় পুনরায় আরেকটা সিগারেট জ্বালিয়ে নিজের কালচে লাল ঠোঁটে চেপে ধরলো।
নিঃশ্বাসের সাথে ফুসফুসে বিষাক্ত ধোঁয়া টেনে নিয়ে বললো,
“মানে আমি শুধুমাত্র ওর প্রেমিক বা স্বামী নই। স্বামী তো নই, আর প্রেমিকও নই। ওর আর আমার সম্পর্কের নাম আমি ওর অভিভাবক। ও আমার শুধুমাত্র ভালোবাসা নয়, ও আমার সন্তান।
বাবা-মা যেমন নিজের আগে, সবার আগে, দুনিয়ার আগে সন্তানের সুরক্ষা নিশ্চিত করেন, ভালো থাকা নিশ্চিত করেন, একটা সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে দেন।
আমি ও তাই। আমার সন্তানকে সবার আগে একটা সুন্দর জীবন দিতে চাই, একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ দিতে চাই। আমি চাই না আমার সন্তানও আমার মত হোক। আমার বাচ্চাকে টেনে হিচড়ে আমি সেই নর্দমায় নামাতে চাই না, যেখানে আমি গলা অবধি ডুবে আছি।

যে পুরুষ ভালোবাসাকে বিছানা অব্দি নিতে না পারলে প্রেমের ব্যর্থতা মনে করে, বা প্রেমিকার শরীর ভোগের মাধ্যমে পূর্ণতা খোঁজে—সে কখনোই পুরুষ হতে পারে না। সে স্রেফ দেহলোভী রাক্ষস। তার কাছে প্রেমের সংজ্ঞা একটা উষ্ণ শরীর। আর আমার কাছে প্রেমের সংজ্ঞা একটা উষ্ণ হৃদয়।
আর আমার ধর্ম তুই দেখিস না? আমি যদি দেখি আমার ভালোবাসার মানুষ ভালো আছে, আমার বাচ্চাটা ভালো আছে, তাহলে আমিও ভালো থাকবো। তোর মতো জ্বলে মরবো না।”
প্রণয়ের কথার গভীরতায় স্তব্ধ হয়ে গেলো সাদাফ ও আবির্ভাব।
যদিও আবির্ভাব এসব অনেক আগেই জানে, তাই বেশি অবাক হলো না।
প্রণয়ের কথা শুনে সাদাফ ঘোরের মধ্যে হারিয়ে গিয়েছিলো। সত্যি তো—ভালোবাসার মানুষকে সুখী দেখার মধ্যে ও আলাদা একটা সুখ আছে। কিন্তু সেটা সে কখনোই অনুভব করতে পারেনা। পরীকে দেখলেই বুকের ভেতর আগুন লেগে যায়।

“আমাকে ছাড়াই দেখছি আসর জমে উঠেছে।”
অন্ধকারে কারো পুরুষালি গম্ভীর কণ্ঠস্বরে সাদাফের ভাবনা ছুটে গেল।
শুদ্ধ কফি মগে চুমুক দিতে দিতে ওদের পাশে এসে দাঁড়ালো।
সতস্ফূর্ত মেজাজে বললো, “তোরা এখানে আমায় একবারও বললি না কেনো?”
শুদ্ধ ও প্রণয়কে পাশে পাশি দেখে সাদাফের দুই সতীন মনে হলো। বিড়বিড় করে বলল, “কারো পৌষ মাস আর কারো সর্বনাশ।”
“হোয়াট?”
সাদাফ কথাটা একটু জোরেই বলেছিল বিধায় সবাই শুনেছে।
কিন্তু শুদ্ধ কথার অর্থ বুঝতে না পেরে ভ্রু বাঁকিয়ে বললো, “কিছু বললি?”
সাদাফ বোকা বোকা হেসে বললো, “না, আবির্ভাবের ব্যর্থতার কাহিনি শুনছিলাম।” — বলে আবির্ভাবের দিকে ইশারা করলো সাদাফ।

সাদাফের কথায় শুদ্ধ তীক্ষ্ণ চোখে তাকালো আবির্ভাবের দিকে।
অন্ধকার রাতে ও আবির্ভাবের চোখ দুটো ভয়াবহ লাল আর তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
শুদ্ধ সন্দিহান কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো, “কি হয়েছে? ছ্যাকা খেয়েছিস?”
সাদাফ পুনরায় বিড়বিড় করে বললো, “কি হয়েছে জানলে সবার আগে তুই কেলিয়ে বৃন্দাবন পাঠিয়ে দিতিস।”
আবারও ওর কথা উপস্থিত সবাই শুনতে পেলো।
আবির্ভাব কটমট চোখে তাকালো সাদাফের দিকে।
শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে বললো, “কিছু বললি?”
“না রে ভাই, কিছু বলি নি। আমি আর প্রণয় আবির্ভাবকে ওর আগের পক্ষের সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করছিলাম।”
“আগের পক্ষ?”

“আরে আগের পক্ষ মানে, ও একটা মেয়েকে অনেক ভালোবাসতো। কিন্তু এত ভালোবাসার পরও আসল স্টাম্প মেরেছে অন্য মেয়ের মাথায়।”
“যদিও ও এখন এসব বলা ঠিক না, কারণ আবির্ভাব তো নিজের জীবনে অনেক দূরে গিয়ে গেছে।”
সাদাফের কথায় শুদ্ধর খেয়াল হলো।
সে অবাক চোখে তাকালো আবির্ভাবের দিকে।
কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে বললো, “হ্যা, তুই তো মুসলিম কোনো একটা মেয়েকে ভালোবাসতিস। তাহলে হঠাৎ কোথা থেকে কি হয়ে গেল?”

আতে আঘাত করা এসব প্রশ্ন একদম সহ্য হচ্ছে না আবির্ভাবের।
এরা ক্ষতস্থানকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে পুনরায় রক্তাক্ত করছে।
আবির্ভাব মনে মনে ঠিক করলো, সে কাল সকালেই এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে।
নইলে বেশিক্ষণ নিজেকে আটকে রাখতে পারবে না সে।
শুদ্ধ হালকা ধাক্কা দিয়ে বললো, “কি রে বল, কিভাবে কি হয়েছিলো?”
প্রণয় এসব শুনতে ইন্টারেস্টেড নয়। তাই সে অন্যদিকে চলে গেলো।
আবির্ভাব শুকনো ঢোঁক গিলে গলা ভিজালো।
হাঁসফাঁস করে উঠে বললো, “এসব কী প্রশ্ন করছিস তোরা প্লিজ! I can’t control myself.”
আবির্ভাবকে এতো অস্থির হতে দেখে শুদ্ধ আর সাদাফ দুজনেই মাত্রাতিরিক্ত আশ্চর্য হলো।
সাদাফ তো বলেই বসলো, “এতো হাইপার হচ্ছিস কেনো? She is just your past, that’s it।”
“নাকি?”

ঝট করে আবির্ভাবের অক্ষি কোনে অশ্রু এসে গেলো।
সে শুদ্ধ সাদাফ সবাইকে ইগনোর করে ধপাধপ পা ফেলে ছাদের অন্যদিকে চলে গেলো।
সাদাফ বাঁকা হেসে বললো, “কিছু বুঝলি?”
শুদ্ধ কফির মগে লম্বা চুমুক দিয়ে বললো,
“বুঝা-বুঝির কি আছে? সব তো নিজের চোখেই দেখলাম।
তো তোর মনে প্রশ্ন জাগে না, এত ভালোবাসতো, এখনো কতো ভালোবাসে তা তো দেখলি। এরপরও অন্য একটা মেয়েকে এত সহজে বিয়ে করে নিল—কেনো?”
শুদ্ধ উদাস কণ্ঠে প্রত্যুত্তর করলো,
“কিছু জিনিস চোখে দেখা যায় না, অনুভব করে নিতে হয়। কিছু শব্দ, কিছু কথা, কিছু ঘটনা লুকিয়ে থাকে অন্তরালে, যার গোপনীয়তায় জ্বালিয়ে দেয় সবকিছু। সব কেনোর উত্তর হয়তো দেওয়া যায় না। সব চাওয়া হয়তো পাওয়া যায় না। কিছু ব্যর্থতার ভার বয়ে বেড়াতে হয় আজীবন। ভাগ্য যার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাদের জন্য মৃত্যুর পরে জাহান্নাম নয়—দুনিয়াতেই জাহান্নামের আজাব শুরু হয়ে যায়।”

বলে ছাদ থেকে নেমে গেলো শুদ্ধ।
সাদাফ একা বসে রইলো।
নিকষ কালো আধারে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে বললো,
“প্রত্যেকের জীবনেই এমন একজন মায়ার মানুষ কেনো আসে বলতে পারিস, যে আমার হবে না? তার প্রতি এতো মায়া দিয়ে কি করবো আমরা?”
ছাদের পূর্ব প্রান্তে শতোবর্ষীয় প্রাচীন ফারিশ গাছ, যার বিশাল ছায়ায় ছাদের পূর্ব দিকে চাঁদের আলো পড়তে পারে না। তবে এই জায়গাটা ঘুটঘুটে অন্ধকারাচ্ছন্ন নয়, দূরে কোথাও থেকে হলুদ একটা ঝাপসা আলো ছুটে আসছে।
গাছের নিচে সাদা মার্বেল পাথর বসানো চেয়ার-টেবিল। এদিক-ওদিক সবদিকে শুনশান নির্জনতা।
আবির্ভাব গুটি গুটি পায়ে হেঁটে এসে একটা চেয়ারে ধপ করে বসে পড়লো।
চোখ দুটো তার টকটকে লাল, তাতে টলমল করছে গরম অশ্রু।

পুরুষদের শৈশবকাল থেকেই শক্ত হতে শেখানো হয়। মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয় কান্নাকাটি মেয়েদের কাজ। পুরুষদের হতে হয় ইস্পাতের মতো দৃঢ় শক্ত, যাদের কোনো দুর্বলতা হয় না।
আবির্ভাবও তাই মানে, সকলের সামনে নিজের দৃঢ় আবরণ ধরে রাখে।
কিন্তু দিনের আলো ফুরিয়ে যখন রাতের আঁধারে নামে তখন পুরুষরাও নিজেদের কৃত্রিম আবরণ ঝেড়ে ফেলে।
তাদেরও বুক কাঁপে, হাত-পা কাঁপে, শরীর কাঁপে। ঠোঁট ভেঙে কান্না আসে।
হ্যা, পুরুষরাও কাঁদে—কিন্তু নিরবে, নিভৃতে।
যেই কান্না রাতের বোবা জিন ছাড়া কেউ দেখে না।
আবির্ভাব পাথরের টেবিলের উপর দুই হাত রেখে তার ভাজে মুখ গুঁজলো। চোখ বন্ধ করে নিঃশব্দে ফুপিয়ে উঠলো।
নিঃশব্দ কান্নার তালে দুলে উঠলো পুরুষালি শরীর।
রুদ্ধ কণ্ঠে বললো, “তুমি আমায় কখনো ক্ষমা করো না মাই লাভ, কখনো না।”
আবির্ভাব থেকে থেকে অন্ধকারে আর্তনাদ করে উঠলো,

“হ্যাঁ ঈশ্বর, আমায় মুক্তি দাও, শান্তি দাও, পোড়া হৃদয়ে একটু বৃষ্টি দাও।”
“মুক্তি, শান্তি, বৃষ্টি — এগুলো তোর জন্য নয়।” — বলে টেবিলের উপর দুটো কাঁচের বোতল রাখলো প্রণয়।
আবির্ভাবের পাশে চেয়ারে বসে বললো, “নে, গলা ভেজা, হালকা লাগবে।”
আবির্ভাব মাথা উঠিয়ে রক্তিম চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে।
প্রণয় নির্লিপ্ত, যেন এসব তার জন্য পান্তা ভাত।
আবির্ভাব কোনো দ্বিমত প্রকাশ করলো না।
দুটো বোতল থেকে একটা তুলে টোকা মেরে চিপি উড়িয়ে দিলো।
কাঁচের বোতলে ঠোঁট লাগিয়ে ভেতরের পাতলা লাল তরল ঢকঢক করে গলায় ঢালতে লাগলো।
“ধীরে ধীরে খা, নইলে মাথায় উঠে যাবে।” — বলে পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট বের করলো প্রণয়।
একটা সিগারেট ঠোঁটে চেপে ধরে লাইটার জ্বালালো।
টান দিতে দিতে বললো, “Feeling better?”
আবির্ভাব ঢকঢক এক নিঃশ্বাসে অর্ধেকটা শেষ করে থামলো।
তরলটা যেদিক-যেদিক দিয়ে নামছে জ্বলে যাচ্ছে তার সর্বত্র।
আবির্ভাব ব্যাথাতুর কণ্ঠে জানালো,

“আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে ভাই। I want her, I want to touch, I want to hug her.
আমার আর সহ্য হচ্ছে না ভাই কোনোভাবে যদি আর একবার আমার পাখিটাকে বুকে নিতে পারতাম, আর একটা বার যদি তাকে আমার মাঝে অনুভব করতে পারতাম—তাহলে হয়তো এই পোড়া বুকটা একটু শান্ত হতো। আমার জানটাকে ছুঁতে না পেরে আমি মরে যাচ্ছি।
এই অনুভূতিটা এতো জঘন্য কেনো?” — বলে চিৎকার দিয়ে সজোরে ঘুষি মারলো শক্ত পাথরে টেবিলে। সাথে সাথেই হাতের ফর্সা চামড়া থেতলে রক্ত বেরিয়ে এলো।
আবির্ভাবের ছটফটানি দেখে নীরবে হাসলো প্রণয়।
নির্লিপ্ত ভাবে বলল, “এটা তোর পাপের শাস্তি। পাপ বাপকে ও ছাড়েনা, আমাকেও ছাড়েনি, তোকেও ছাড়বে না।”
আবির্ভাব হতবাক কন্ঠে প্রশ্ন ছুড়ল, “পাপ?”
“হ্যা, পাপ। এটাই তোর পাপের শাস্তি। প্রথমেই অহংকারী পিতা-মাতার অহংকারের শাস্তি। দ্বিতীয় সীমাহীন ভালোবাসার শাস্তি। তৃতীয় কাউকে কথা দিয়ে মাঝপথে তার হাত ছেড়ে দেওয়ার শাস্তি।
এই সবগুলোর শাস্তি একত্রে তুই পাচ্ছিস, ঠিক আমার মতো।”
আবির্ভাবের কণ্ঠ কাঁপে।

“বিশ্বাস কর ভাই, আমি ওর হাত ছাড়তে চাইনি। কিন্তু…”
“কিন্তু?”
আবির্ভাব থেমে যায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। মনে পড়ে যায় জীবনে করা সর্বশ্রেষ্ঠ ভুলের কথা। মনে পড়ে যায় সেই দিনের কথা।
অতিথ
সাল ২০২৭
আশ্বিন মাস, বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব দুর্গা পূজোর মহা দশমীর তিথি, বিসর্জনের দিন।
ঢাকের শব্দে মুখরিত হচ্ছে কলকাতা। বিসর্জনের আগ মুহূর্তে সিঁদুর খেলায় মেতে উঠেছে রায়চৌধুরী পরিবার।
হুগলি জেলার শ্রীরামপুরের রায়চৌধুরী পরিবার অনেক নামজাদা, স্বনামধন্য একটি পরিবার।
রায়চৌধুরী বাড়ির পারিবারিক দুর্গাপূজা প্রায় পূর্ব ৪০০ বছরের পুরাতন ও বংশীয় রীতি, যা চলে আসছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।

এই পরিবারের বর্তমান কর্তা শ্রদ্ধেয় নারায়ণ রায়চৌধুরী, যিনি বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত ম্যাজিস্ট্রেট।
উনার ৭ ভাই, তাদের ছেলে-বউমা, নাতি-নাতনি মিলে বিশাল ৫১ ভর্তি সদস্য সংখ্যা নিয়ে রায়চৌধুরী পরিবার।
আবির্ভাবের বাবা শ্রদ্ধেয় অনিমেষ রায়চৌধুরী, নারায়ণ রায়চৌধুরীর জ্যেষ্ঠ পুত্র।
উনার স্ত্রী শ্রীমতী পুজারিনী রায়চৌধুরী ও দুই ছেলে অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরী ও আবির্ভাব রায়চৌধুরী।
আবির্ভাব দ্বিতীয়।
এছাড়া এই বাড়ির বেশির ভাগ সদস্যই বছরের অন্য সময় কর্মসূত্রে দেশের বাইরে থাকেন।
কেবল পারিবারিক সম্মেলন হয় পূজোর ৪টা দিন। এই দিনের অপেক্ষায় থাকেন বাড়ির কর্তা নারায়ণ রায়চৌধুরী ও উনার স্ত্রী লক্ষ্মী রায়চৌধুরী।
বিশেষ করে নাতি-নাতনিরা তাদের খুবই প্রিয়।

বিজয়া দশমীর বিকেল, বাড়ির এবং পাড়ার সব এয়ো (বিবাহিতা) নারীরা মিলে দেবী বরণ করছেন, সিঁদুর খেলছেন।
আবির্ভাব দুতলার একটা ঘরে বসে নিজেই নিজের মাথার চুল টেনে ধরেছে, দুশ্চিন্তায় তার মাথা টনটন করছে। হাসপাতাল থেকে নেওয়া ছুটি অনুযায়ী কালই তাকে বাংলাদেশে ব্যাক করতে হবে। তাই আজকেই সে তার ভালোবাসার ব্যাপারটা বাবা-মাকে জানাতে চায়। এমন নয় যে সে ভয় পাচ্ছে, কিন্তু তার মাত্রাতিরিক্ত টেনশন হচ্ছে বাবা-মা কীভাবে রিয়্যাক্ট করবে তা ভেবে।
কিন্তু আবির্ভাব নিজেকে বুঝিয়ে নিয়েছে—কেউ না মানলে না মানবে।
বেশি হলে কী বলবে?
“বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাও”, বা “তোমার মুখ দেখতে চাই না”, “ত্যাজ্যপুত্র করলাম”—এসবই তো।
এসব কিছু শোনার জন্যও এবং মেনে নেওয়ার জন্যও মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করল আবির্ভাব।
প্রয়োজনে সে শ্বেতাকে নিয়ে পালিয়ে যাবে অনেক দূরে।
কিন্তু যাওয়ার আগে বাবা-মাকে একবার জানানো তার কর্তব্য।
“আসবো বাবা।”

দরজায় কড়া ঘাতের শব্দে ভাবনায় বিঘ্ন ঘটল আবির্ভাবের। সে সোজা হয়ে বসে বলল—”আসো বাবা।”
ছেলের সম্মতি পেয়ে ঘরের ভেতর প্রবেশ করলেন অনিমেষ রায়চৌধুরী ও পুজারিনী রায়চৌধুরী।
আবির্ভাব তাদের দেখে ভেতর ভেতর নার্ভাস ফিল করছে।
অনিমেষ রায়চৌধুরী এসে আবির্ভাবের সামনের বিছানায় বসলেন।
নরম গলায় বললেন—”বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী, এত কাজ, একটু পর বিসর্জন, এখন ডাকাডাকি করছিস কেনো বাবা?”
পুজারিনী রায়চৌধুরী স্বামী থামিয়ে বললেন—”চুপ করুন তো আপনি। বল বাবা, কী বলবি?”
আবির্ভাব ঢোক গিলে বাবা-মায়ের দিকে তাকালো।
ছোট্ট একটা দম ফেলে কোনো ইতস্তত ছাড়াই সোজাসাপ্টা বলল—”আমি একটা মেয়েকে ভালোবাসি বাবা। আমি তাকে বিয়ে করতে চাই।”

ছেলের কথায় অনিমেষ ও পুজারিনীর মুখের ক্লান্তির চাপ উড়ে গেল।
উনারা স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন, অতঃপর একে অপরের মুখের দিকে তাকালেন।
আবির্ভাবের হৃদপিণ্ড কেমন ধড়াস ধড়াস করছে।
অনিমেষ রায়চৌধুরী গম্ভীর কণ্ঠে বললেন—”ভালোবাসো?”
আবির্ভাব নিঃশব্দে ওপর-নিচ মাথা দোলালো।
“বিয়ে করতে চাও?”
আবির্ভাব আবারও ওপর-নিচ মাথা দোলালো।
এবার অনিমেষ রায়চৌধুরী ও পুজারিনী রায়চৌধুরী একে অপরের মুখের দিকে তাকিয়ে একত্রে হেসে উঠলেন।
আনন্দিত কণ্ঠে বললেন—”এতো বিরাট সুখবর! তাহলে এতো দিনে আমাদের ছেলের সমতির উদয় হয়েছে! বলো পুজারিনী?”
পুজারিনী রায়চৌধুরী মুচকি হেসে ছেলের মাথায় হাত রাখলেন।

নম্র কণ্ঠে বললেন—”আমরা তো কবে থেকে বলছি বাবা, বিয়ে কর, বিয়ে কর। এই কথাটা বলতে এত সময় লাগালি? এবার ঝটপট মেয়েটার নাম-ঠিকানা বল, মেয়েটাকে আমার ঘরের লক্ষ্মী করে নিয়ে আসি।”
আবির্ভাবের এবার গলা কাঁপছে।
অনিমেষ রায়চৌধুরী ওকে চেপে ধরে বললেন—”হ্যাঁ বাবা, তাড়াতাড়ি বল। মেয়েটার বাবা-মায়ের সাথে কথা বলি।”
আবির্ভাব এবার বড় করে দম নিলো। চোখ বন্ধ করে এক নিঃশ্বাসে বলল—”বাবা, মেয়েটা আমাদের ধর্মের নয়। মেয়েটা ইসলাম ধর্মাবলম্বী। কিন্তু আমি ওকে প্রচণ্ড ভালোবাসি বাবা-মা।”
আবির্ভাব কথা বলতে দেরি কিন্তু গালে সজোরে চপেটাঘাত পড়তে দেরি হলো না।
শান্তশিষ্ট ঠান্ডা মেজাজের পুজারিনী রায়চৌধুরী হুঙ্কার দিয়ে বললেন—”কি বললি তুই! আজ যা বলেছিস, বলেছিস। কিন্তু এমন শব্দকে তোর মুখে যেন আর দ্বিতীয়বার না শুনি আবির্ভাব!”

আবির্ভাব আহত চোখে তাকালো অনিমেষ রায়চৌধুরীর দিকে।
গম্ভীর কণ্ঠে অনিমেষ রায়চৌধুরী বললেন—”দেখো, যা বলেছো বলেছো। এই কথা আর দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করো না। বাড়ি ভর্তি আত্মীয়-স্বজন মানুষজন, কখন কে কোন দিকে শুনে নেবে, আর আমাদের নাক-কান কাটা যাবে।”
তবে এসব কথায় আবির্ভাব দমে গেল না।
চট করে বসা থেকে উঠে পড়ল।
কাটকাট কণ্ঠে বলল—”আমি ওকে খুব ভালোবাসি বাবা। এটা আমার জন্য লজ্জার নয়, তাই এ কথা শুধু তোমাদের সামনে নয়, পুরো পৃথিবীর সবার সামনেও চিৎকার করে বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই—আমি ওকে ভালোবাসি, ভালোবাসি, ভালোবাসি, খুব ভালোবাসি! আর বিয়ে করলে ওকেই করব!”
আবারও আবির্ভাবের দুই গালে ঠাস ঠাস করে ৪-৫টা চড় বসিয়ে দিলেন পুজারিনী রায়চৌধুরী।
ক্রোধে তাঁর চোখের মণি লাল হয়ে উঠেছে।
অনিমেষ রায়চৌধুরী চাপা কণ্ঠে বললেন—”আহ, পুজারিনী, এতো বড় ছেলের গায়ে হাত তুলছো কেন?”
পুজারিনী রায়চৌধুরী অগ্নি চোখে তাকালেন স্বামীর দিকে।
আবার ক্রধান্বিত কন্ঠে ছেলেকে শাসিয়ে বললেন—”একদম চুপ। তুই আমার ছেলে। তোকে আমি যেখানে বিয়ে দেব, সেখানেই তোর বিয়ে হবে।”
আবির্ভাব পুজারিনীর কথায় পাত্তা দিল না।
দাঁড়িয়ে কাঠকাঠ কণ্ঠে বিরোধিতা জানিয়ে বলল—”সরি মা, আমি তোমাদের সব কথা শুনলেও এই কথা শুনতে পারব না। বিয়ে তো আমি শ্বেতাকেই করব। আর তোমাদের আটকানোর কোনো অধিকার নেই। তোমাদের সো-ক্যালড সোশ্যাল স্ট্যাটাসের জন্য আমি আমার ভালোবাসাকে বলি দিতে পারব না, অসম্ভব! আর এতো কথা বলছি কেন? আমি, শ্বে…”

আবির্ভাব কথা সম্পূর্ণ করার পূর্বেই দরজার কাছে কিছু পড়ার শব্দ হলো।
স্টিলের ভারী কিছু পড়ার তীব্র শব্দে অনিমেষ, আবির্ভাব আর পুজারিনী একত্রে তাকালেন দরজার দিকে।
দরজার কাছে নারায়ণ রায়চৌধুরী বুক চেপে ধরে পড়ে ছটফট করছেন।
বাবাকে কাতরাতে দেখে আতকে উঠলেন অনিমেষ রায়চৌধুরী।
“বাবা!” বলে ছুটে গেলেন বাবার কাছে। আবির্ভাবও ছুটে গিয়ে দ্রুত ধরল উনাকে।
মাত্র ৫ মিনিটের মধ্যে পুরো বাড়ির মানুষ জড়ো হয়ে গেল।
উৎসবমুখর পরিবেশ পাল্টে গেল।
বাড়িতে কান্নার মিছিল পড়ে গেল এক মুহূর্তে।
আবির্ভাব অনিরুদ্ধসহ আরো কয়েকজন তড়িঘড়ি করে নারায়ণ রায়চৌধুরীকে হাসপাতালে ভর্তি করলেন।
সুদীর্ঘ ৪৮ ঘণ্টা পর উনার জ্ঞান ফিরল।
ডাক্তার জানালেন—

“হয়তো কোনো বিরাট আঘাত পেয়ে নিজেকে সামলাতে পারেননি। হার্ট অ্যাটাক করে বসেছিলেন।”
আরো জানালেন—
“উনার অনেক বয়স হয়েছে, উনাকে টেনশন-ফ্রি রাখতে হবে। বেশি চাপ দেওয়া যাবে না। উনার সকল কথা বেদবাক্যের মতো শুনতে হবে। না হলে আবার যদি সেকেন্ড টাইম অ্যাটাক আসে তাহলে সেখানেই স্পট ডেথ হয়ে যাবে।”
ডাক্তারের এই কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল পুরো রায়চৌধুরী পরিবার।
কেউ বুঝতে পারছিল না কী হয়েছে।

কিন্তু অনিমেষ রায়চৌধুরী আর পুজারিনী রায়চৌধুরী ঠিকই বুঝেছিলেন সব।
নারায়ণ রায়চৌধুরীর জ্ঞান ফেরার পর তিনি সবার আগে আবির্ভাবের খোঁজ করলেন।
আবির্ভাব গেলে তিনি আবির্ভাবের দুই হাত ধরে মিনতি করে বললেন—
“দাদাভাই, আমার এতো এতো বছরের মান-সম্মান তুই নষ্ট করিস না। এতে যে আমি আর আমার পরিবার মরে ও মুখ লুকানোর জায়গা পাব না। সমাজ আমাদের একঘরে করে দেবে। দয়া কর ভাই।”
আবির্ভাব স্তব্ধ হয়ে যায়।
সে কিছুই মানতে চায় না।
নারায়ণ রায়চৌধুরীর পা জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠে বলে—
“দাদু, এতো বড় শাস্তি আমায় দেবেন না? আমি তো বেঁচে থেকেও মরে যাব দাদু, জীবন্ত লাশ হয়ে যাব। আমি পারব না ওকে ছাড়তে। আপনি তো বোঝেন ভালোবাসা কী। আমার উপর দয়া করুন দাদু, এমন বলবেন না।”
আবির্ভাবের কথায় নারায়ণ রায়চৌধুরীর শ্বাস টান উঠল।
আবার ডাক্তার ডাকা হলো।

রোগীকে উত্তেজিত করার জন্য ডাক্তার অনেক বকা-ঝকা করলেন।
পুজারিনী রায়চৌধুরী আর সহ্য করতে না পেরে ছেলেকে টেনে নিয়ে অনন্যত্র গেলেন।
ছেলের হাত নিজের মাথায় রেখে বললেন—
“আজ যদি আমাদের কথার অমান্য করিস বা আমার শ্বশুরের কিছু হয়, তাহলে তোকে তোর মায়ের দিব্বি, তুই তোর মা-বাবার মরা খুব দেখবি!”
পুজারিনীর কথায় আবির্ভাবের দুনিয়া থেমে যায়।
পুজারিনী রায়চৌধুরী পুনরায় বললেন—
“আমি যাকে পছন্দ করে দেব, তুই তাকেই বিয়ে করবি। তোকে জন্ম দিয়েছি, দুনিয়া দেখিয়েছি, খাইয়েছি, পরিয়েছি, লালন-পালন করেছি—এর তো একটা প্রতিদান আছে। দে, সব কিছুর হিসেব চুকিয়ে দে।”
“মা…”
“চুপ! একদম মা ডাকবি না আমায়। তোর হাতে দুটি রাস্তা—হয় ওই মেয়েকে ভুলে আমার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে কর, নাহয় আমার আর আমার স্বামীর মুখে আগুন দিয়ে ওই মেয়ের কাছে চলে যা চিরতরে। নয়তো এই কলঙ্ক আমাদের বেঁচে থাকতে হজম হবে না। সমাজের মানুষ আমাদের মুখ পোড়াবে উঠতে বসতে।
১ থেকে ৫ গুনবো, এর মধ্যে তুই তোর সিদ্ধান্ত জানাবি।

১”
“মা…”
“২”
“মা, আমার কথা একটু বোঝো…”
“৩”
“মা, তুমি আমাকে মেরে ফেলো, তবু ওসব বলো না…”
“৪”
“মা গো…”
“৫”
বলে আর এক মিনিটও দাঁড়ালেন না পুজারিনী রায়চৌধুরী।
ঘটঘট করে চলে গেলেন আবির্ভাবের সামনা হইতে।
এতে প্রচণ্ড ঘাবড়ে হয়ে গেল আবির্ভাব।
পুজারিনী রায়চৌধুরী সবার সামনে থেকে উনার স্বামীকে টানতে টানতে নিয়ে চলে যাচ্ছেন।
“কোথায় যাব পূজারিণী?”
“মরতে।”

পুরো হাসপাতালের করিডোরভর্তি মানুষ অবাক চোখে চেয়ে দেখছে তাদের।
আবির্ভাব সবার সামনে ছুটে এসে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে পুজারিনী রায়চৌধুরীর সামনে।
৩১ বছরের এক যুবক ছেলে সবার সামনে কেঁদে উঠে পা জড়িয়ে ধরে পুজারিনী রায়চৌধুরীর হিতাহিত জ্ঞান হারায়।
ছেলেটা কাঁদতে কাঁদতে মায়ের পা শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে—
“তুমি যা বলবে আমি তাই শুনব মা। তবু তোমরা আমাকে ছেড়ে যেয়ো না, প্লিজ মা…”
ছেলের কথায় থেমে যান পুজারিনী রায়চৌধুরী।
প্রণয় নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে সব শুনলো। আবির্ভাব দুটো বোতল খালি করে চেয়ারের পেছন দিকে মাথা হেলিয়ে দিয়েছে।

“উফফফ ইশ্বর, বুকের ভেতর এত জ্বলে কেন, এমন জ্বালন থেকে মরণ ভালো।”
“তাহলে এখন কি করবি?”
আবির্ভাব সোজা হয়ে বসার চেষ্টা করলো, প্রণয়ের দিকে টলমলে চোখে তাকিয়ে হঠাৎ করেই হেসে উঠলো।
হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়তে নিলেই শার্টের কলার টেনে ধরলো প্রণয়।
আবির্ভাব আবার সোজা হয়ে বসে মাতলামো করে বললো—
“কি আর করবো ভাই, আমার মতো নরদমার কীটের বেঁচে থাকাই তো কথাই নয়। শালা তুই ভালোবাসার জন্য জীবনে কি না করেছিস আর আমি!
আমি বাল মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ, আমিই আমার ভালোবাসাকেই সব থেকে বেশি যন্ত্রণা দিয়েছি।
বিশ্বাস কর, আজ যখন ও আমার দিকে টলটলে অভিমানী চোখে চেয়ে ছিল, ওর সেই চোখের দৃষ্টি বিষ মাখানো তীরের ন্যায় আঘাত এনেছে আমার বুকে,কলিজা ছিড়ে যাচ্ছিল ভাই।
ওই চোখে আমি তৃষ্ণার সাগর দেখেছি, অভিযোগ অভিমানের পাহাড় দেখেছি। আমার প্রাণটা মরছিল ওকে বুকে নেবার জন্য, কিন্তু পারিনি আমি বিষ পান করেছি।
প্রণয় আবির্ভাবের মাঝে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো। তবে বন্ধুর ব্যথায় ব্যথিত হলো না, কারণ তার নিজের ব্যথাই রাখার জায়গা নেই।

“ঘরে যাবি?”
আবির্ভাব সটান দুই পাশে মাথা নাড়ে।
প্রণয়ও আর কিছু বলে না। ফাঁকা ওয়াইনের বোতল দুটো তুলে ছাদের ডাস্টবিনে ফেলে দেয়।
একবার আবির্ভাবের দিকে তাকিয়ে বেরিয়ে যায় ছাদ থেকে।
আবির্ভাব চাঁদের দিকে তাকায়, ঠোঁট কাপে, বুকের বাঁ পাশে হাত চেপে ব্যাকুল কণ্ঠে বলে—
“মাই লাভ, সত্যি কি আর কোনো দিন তুমি এই বুকে আসবে না? এই জনমের মতো বুঝি চির বিচ্ছেদ হলো। আমাকে ক্ষমা করো না পাখি, কোনো দিনও করো না। তোমার জীবনের সব থেকে বড় অপরাধী আমি আছি আর আমার মৃত্যু অবধি আমিই যেন থাকি। তুমি আমার জন্য থেমে থেকো না মাই লাভ, আমার শেষ করে হলেও তুমি তোমার জীবনে এগিয়ে যাও।”

আবির্ভাব ঠোঁট কামড়ে নিজেকে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করে।
দূর আকাশের পানে তাকিয়ে ব্যথাতুর কণ্ঠে গুনগুন করে গানটা যেন পুরোই তাদের জীবন থেকে নেওয়া—
যদি এক সমাজে হইতাম দুই জন
সুন্দর এই ভূবন
তবে থাকতো না যে কোন বাঁধা
হয় যেন মরন
বিধী তুমি আমায় বলে দাও
ও কেন তারে ভালোবাসিলাম
নিঃস্ব হয়ে গেলো এখন
দুজনার জীবন
যদি এক সমাজে হইতাম দুই জন
সুন্দর এই ভূবন
তবে থাকতো না যে কোন বাধা
হয় যেন মরন
পৃথিবীতে বেঁচে থেকে হল না মিলন
তোমার আমার একি সাথে
হয় যেন মরন
ভালোবাসা পুড়ে যাবে চিতারো আগুনে
পর পারে দেখা হবে
তোমার আমার সনে
বিধী তুমি আমায় বলে দাও
ও কেন তারে ভালোবাসিলাম
দুই ভূবনে থাকবো দুই জন
এ কেমন নিয়ম
যদি এক সমাজে হইতাম দুই জন
সুন্দর এই ভূবনে
তবে থাকতো না যে কোন বাধা
হয় যদি মরন
প্রেম তো মানে কোন জাতি কোল মান
রেখে গেলাম আমরা দুজন
তারই প্রমাণ
ভালোবাসা মেনে নিতে
কেনো এত ভয়
কখনো হবেনা এই প্রেমের পরাজয়
কেন হল এমন অবিচার
ও দুটি মনের একটাই অন্তর
তবু প্রেমে খাঁটি হল
দু জনার জীবন
যদি জন্ম হতো বারে বারে
ঐ সুন্দর ভূবনে
তবে ভালোবেসে যেতাম আমি
তোমারি সনে
যদি জন্ম হতো বারে বারে
ঐ সুন্দর ভূবনে
তবে ভালোবেসে যেতাম আমি
তোমারি সনে
জনম জনম ভালোবাসিতাম
ও সারা জীবন তোমারি ছিলাম
তবু প্রেম খাঁটি হল
দু জনার জীবন
যদি জন্ম হতো বারে বারে
ঐ সুন্দর ভূবনে
তবে ভালোবেসে যেতাম আমি
তোমারি সনে

রাত আনুমানিক অনেক, তবে শিকদার বাড়ির হৈচৈ মুখর পরিবেশে ভাটা পড়েনি বিন্দুমাত্র, বরং রাত বাড়ার সাথে সাথে হৈ-হুল্লোড়ের মাত্রা বাড়ছে দ্বিগুণ হারে। বাচ্চা বুড়ো নারী পুরুষ কারো চোখেই ঘুম নেই।
বোম ফাটানোর শব্দে কেঁপে উঠছে শিকদার বাড়ির গার্ডেন এরিয়া। বাচ্চাদের হাসি আর আনন্দের কোলাহলে মুখরিত হচ্ছে নিস্তব্ধ রজনী।
একটার পর একটা বাজি ফাটছে আর এসবের লিডার হচ্ছে শিকদার বাড়ির অস্কার প্রাপ্ত দুই বাঁদরা—দ্য গ্রেট অরণ্য শিকদার ও নান অফ দ্য ডেন তন্ময় শিকদার।
তাদের সাথে মিশে দল ভারী করেছে প্রায় এক ঝাক কচি কাঁচা। তাদের মধ্যে অভিরাজ, অবনী, প্রীত, প্রীতি, থিরা, থোরি ও তাদের মামাতো-খালাতো ভাইবোনেদের আরো গোটা দশেক বাচ্চাকাচ্চা।
এতো বাজির শব্দে বিরক্ত হয়ে একটু আগে বকেও গেছেন সাদমান শিকদার। ছেলের প্রতি অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেছেন—

“অরণ্য, ওরা না হয় ছোট মেনে নিলাম, কিন্তু তুমি কি ছোট বাবা? এই বুড়ো বয়সে কেন শিং ভেঙে বাছুরের দলে নাম লিখিয়েছে? সঠিক সময়ে বিয়ে দিলে তোমারও এদের মতো গোটা চারেক বাচ্চা থাকতো।”
সাদমান শিকদারের ঠেস মারা কথার জবাবে অরণ্য অলস মার্কা একটা হাই তুলে বলেছিলো—
“মনের কোনো বয়স হয় না বড় আব্বু। মন থেকে আমি অলওয়েজ কচি। তা ছাড়া সঠিক সময়ে বিয়ে দাও নাই, এটা তোমাদের ব্যর্থতা। আজ বিয়ে দাও, কাল ভদ্র হয়ে যাবো—সোজা হিসেব।”
সাদমান শিকদার আর কথা বাড়াননি এই ছেলের সাথে। হালকা কেশে স্থান ত্যাগ করেছিলেন।
শিকদার বাড়ির অন্দরমহলে বিশাল রাজকীয় হেঁসলে ঝুড়ি ঝুড়ি পিঠে বানানোর তোড়জোড় চলছে। তা হইতে বাদ যাচ্ছে না কোনো পদের পিঠা। বাংলাদেশের চৌষট্টি জেলার সব বিখ্যাত বিখ্যাত পিঠা বানানো হচ্ছে। এমনকি এই কাজে হাত লাগিয়েছে দেবীও।

বিয়ের পর সে সম্পূর্ণ একা হয়ে গিয়েছিলো। সারাদিন তাকে একা একাই থাকতে হয়। কথা বলতে চাইলে ও একটা কথা বলার মানুষ পাওয়া যায় না। আবির্ভাব ভীষণ ব্যস্ত মানুষ, থাকে কি আর সারাদিন পাওয়া যায়? আবির্ভাব সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত হাসপাতালে থাকে, তার পর আসে। কোনো মতে দুটো খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে, পরদিন সকালে আবার চলে যায়।
জীবনটা পুরো একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিলো দেবীর। কিন্তু এই বাড়িতে আসার পর এতো এতো মানুষদের পেয়ে দেবীরও অনেক ভালো লাগছে।
পরিণীতা, প্রেরণা, উষা, পূর্ণতা, অনুশ্রী বেগম, তনুশ্রী বেগম, অনন্যা বেগম, অর্থি বেগম আরো বেশ কিছু মহিলা মিলে এখানেও হাসি আড্ডা আর গল্পের আসর জমে উঠেছে।

ড্রইং রুমের সোফায় সাদমান শিকদার, খালিদ শিকদার, সাজিদ শিকদার, সোহেব শিকদার সহ প্রেম, রাজ, তন্ময়, অরণ্য, সমুদ্র মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে চোখে শসা সেঁটে চুপচাপ ভদ্রভাবে বসে আছেন।
সকলের হাতের কনুই অবধি অর্গানিক মেহেদি দিয়ে ডিজাইন করা। তারা মুখে কিছু বলতে পারছে না, আবার সইতেও পারছে না। যে জায়গায় অন্যান্য বছর তাদেরকে ধরে বেঁধে এই অত্যাচার করা হতো, সেই জায়গায় আজ তারা সেঁধে সেঁধে বধ হতে গিয়েছিলো। কি আর করা যাবে, সবই নসিবের লিখন।
ওনাদের এই করুণ অবস্থা দেখে বাড়ির মহিলারা খিটখিট করে হাসছেন আর মজা নিচ্ছেন।
সমুদ্র বিরক্তিতে দাঁত কটমট করে সাদমান শিকদারের উদ্দেশ্যে বললো—
“সব দোষ আপনার বড় আব্বুর। কি দরকার ছিল তেল দিতে যাওয়ার? অমন পেঁচার মতো মুখ করে ঘুরে বেড়াতো, দেখলেন তো এবারে কিভাবে ফাঁসলেন? আপনাদের চক্করে আমরাও ফাঁসলাম।”
প্রেম ও তাল মিলিয়ে বললো—

“ঠিক বলছিস ভাই, চোখে কিছু দেখতে পারছি না। ছাতা! এভাবে আর কতক্ষণ সং সেজে বসে থাকবো?”
অরণ্য আরো নাক সিটকে ওয়াক তুলে বললো—
“ওয়াক্ক্ক্ক্ক থুউউউউ! মুখে মনে হচ্ছে গোবর লেপে দিয়েছে। এত বধ হবার ইচ্ছে থাকলে আপনারা গিয়ে গলায় পেতে দিতেন। আমাদেরকে দলে টানার কি দরকার ছিল? আমি এভাবে আর বসতে পারছি না।”
রাজ কাঁদো কাঁদো মুখে বললো—
“শুধু কি তাই রে ভাই! দেখ হাতের কনুই অবধি মেয়েদের মতো ব্রাইডাল মেহেদি দিয়ে দিয়েছে। এই মুখ আমরা মানুষকে কেমনে দেখাবো? আমার বউ তো খোঁটা দিয়েই আমার প্রাণ অষ্টাগত করে দেবে।”
ছেলেদের এতো এতো অভিযোগ শুনে বিরাট হতাশা মিশ্রিত দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করলেন সাদমান শিকদার। কণ্ঠে অপরাধ বোধ মিশিয়ে বললেন—

“মাফ কর বাপ। কি করবো বল? বাড়ির সবাই কত আনন্দ করছে আর আমার মা মুখ গুমড়া করে ঘুরে বেড়াচ্ছিলো। মায়ের মন খারাপ থাকলে ছেলেদের কি ভালো লাগে?”
সাজিদ শিকদার বললেন—
“হ্যাঁ বাপ, একটু হজম করে নে। তোদেরই তো ছোট বোন।”
তন্ময় ফেঁচ ফেঁচ করে কাঁদার অভিনয় করে বললো—
“কেউ একটা ছাঁকনি এনে দে। আমার মান সম্মান ধুলোয় মিশে গেছে। একটা ছাঁকনি দিয়ে চেলে তুলি। আমি তন্ময় শিকদার, কিনা মুখে ডাল বাটা মেখে বসে আছি! তিশা শুনলে কালকেই আমার সাথে ব্রেকআপ করে ফেলবে।”
অরণ্য তাল মিলিয়ে বললো—
“সহমত ভাই। আমার গার্লফ্রেন্ডগুলোও যদি এসব দেখে, আমার মুখে বদনা ছুড়ে মেরে ব্রেকআপ করে চলে যাবে।”
তন্ময় কানে কানে বললো—

“পার্টনার, সবাই চোখে ঠুলি পড়ে আছে। চলো, এই সুযোগে আমরা চুপি চুপি কেটে পড়ি। কেউ দেখতে পাবে না।”
অরণ্য ও তন্ময়ের দিকে চেপে বসল। ফিসফিসিয়ে বললো—
“হালকা করে একটু চেয়ে দেখতো আশেপাশে কে কে আছে।”
তন্ময় এক চোখ থেকে শসা সরিয়ে চারপাশে সতর্ক দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে বললো—
“ময়দান পুরোটাই ফাঁকা। চলোওওওওওওওওওও।”
বলে দুই ভাই এই সেকেন্ডেই ভ্যানিশ হয়ে গেলো।
রাজ নিজের অবস্থা কল্পনা করে নাক সিটকে বললো—
“ছিঃ ছিঃ ছিঃ রে রাজ, ছিঃ ছিঃ ছিঃ রে রাজ, ছিঃ রে ছিঃ রে ছিঃ! আমি ভাই এসব নির্যাতনের হাত থেকে বেঁচে গেছি। এইজন্যই বলি, বেশি মধু ঢালতে গেলে পিঁপড়ে ধরে যায়।”
পৃথমের কণ্ঠ পেয়ে রাজ, প্রেম আর সমুদ্র মুখ লোকানোর চেষ্টা করলো।
পৃথম পুনরায় টোন কেঁটে বললো—

“কি লাভ ব্রাদার, আমার থেকে লুকিয়ে? পুরো বাড়ির মালী থেকে কালী, সবাই তোদের দেখে দাঁত কেলিয়ে হাসছে। যা ভাগ, হাঁত, মুখ ধুয়ে মানুষ হয়ে আয়।”
মেজো ভাইয়ের বলতে দেরি, ওদের লাফিয়ে বসা থেকে উঠতে দেরি হলো না। চোখ থেকে শসা ফেলে উঠে দৌড় দিলো যে যেদিকে পারে।
পৃথমের কণ্ঠ শুনে গম্ভীর হয়ে গেলেন সাদমান শিকদার। রাশভারী কণ্ঠে বললেন—
“কি সমস্যা তোমার? ওদেরকে ভাগিয়ে দিলে কেন? আমার মেয়েটা এত কষ্ট করে ওদের এসব মাখিয়েছে।”
পৃথম দায় সারা ভাবে জবাব দিলো—
“আপনার মেয়ে মাখিয়েছে, আপনি সেজে বসে থাকুন। আমার ভাইরা কেন সং সেজে বসে থাকবে?”
ছেলের কথায় ধমকে উঠলেন সাজিদ শিকদার—
“এসব কেমন আচরণ পৃথম? বড় চাচ্চুর সাথে কেউ এভাবে কথা বলে?”
পৃথম কোনো জবাব দিলো না। “ডোন্ট কেয়ার” ভাব নিয়ে বসে রইলো।
সাদমান শিকদার পুনরায় বললেন—

“শোনো পৃথম, যা হওয়ার হয়ে গেছে। আর কোনো বিষয় নিয়ে আমার মাকে জোরজবরদস্তি করবে না।”
সাদমান শিকদারের কথায় ক্রোধে পৃথমের চোখমুখ লাল হয়ে গেলো। ঘৃণিত কণ্ঠে বললো—
“কাশ, এই দরদটা যদি আপনি আরো ৯ বছর আগে দেখাতেন, তাহলেই আজকের দিনটা অন্যরকম হতে পারতো। তাই আমার বোনের কি হবে, না হবে, তা নিয়ে আপনাদের থেকে কোনো মতামত আমি শুনবো না।”
বলে গটগট করে উঠে চলে গেলো।
পৃথমের কণ্ঠ হতে নির্গত সূচালো বাক্যবাণে মনে ভীষণ আঘাত পেলেন সাদমান শিকদার। উনার বুকের ভার বেড়ে গেলো কয়েকগুণ। অপরাধ বোধের বোঝায় যেন তিনি নুয়ে পড়েছেন একেবারে।
মাঝে মাঝে ছেলের ভবিষ্যৎ কল্পনা করে শিউরে ওঠেন সাদমান শিকদার। তাঁর ছেলে জেনেশুনে মরণের পথ বেছে নিয়েছে, আর সেই পথে ছেলেকে নামতে বাধ্য করেছেন তিনি নিজে।
এটা স্বীকার করতে তাঁর কোনো দ্বিধা নেই যে প্রণয় তাঁর সব থেকে প্রিয় পুত্র। তিনি কখনোই চাননি প্রণয় এতো বড় জালে জড়িয়ে পড়ুক। তিনি শুধু চেয়েছিলেন উনার বংশ পরম্পরা রক্ষা পাক, কিন্তু এই চাওয়াই যেন উনার কাল হলো।

তবে ছেলে কে উনার থেকে ভালো আর কে চেনে? উনার ছেলে তো কেবল বেঁচেই আছে ওই মেয়েটার জন্য। ছেলের সেই আকাশসম ভালোবাসাকে দুর্বলতা বানিয়ে ফায়দা লুটেছেন এতো গুলো বছর, কিন্তু এখন আর এসব করতে মন চায় না।
এখন ভীষণ ভাবে মন চায় ছেলেকে হাসিখুশি দেখতে, স্বাভাবিক দেখতে, ছেলের একটা সুন্দর সুখের সংসার দেখতে। কিন্তু তা কি আর কোনোদিন সম্ভব?
আর মাত্র কয়েকটা দিন এর পর যদি সত্যি সত্যি শুদ্ধর সাথে মেয়েটার বিয়ে হয়ে যায়, তাহলে উনার ছেলে হয়তো তখনই স্ট্রোক করেই মরে যাবে।
এসব ভেবে সাদমান শিকদারের শ্বাসকষ্ট বেড়ে যায়। তিনি ও উঠে ধীরে ধীরে নিজের ঘরের দিকে চলে যান।
খালিদ শিকদারও বিরক্ত মুখে উঠে চলে গেলেন।

তবে উক্ত ঘটনার সারমর্ম কিছুই বুঝতে পারলেন না সাজিদ শিকদার ও সোহেব শিকদার। সবাই চলে গেছে, উনারা আর বসে থেকে কি করবেন, তাই উনারাও চলে গেলেন।
পুরো বাড়ির এত চিৎকার চেঁচামিচিতে মাথা ভোঁ ভোঁ করছে প্রিয়তার। অনেকক্ষণ যাবৎ একই ভাবে বসে থেকে সবাইকে মেহেদি পরিয়ে দিতে দিতে ঘাড় কোমর টন টন করছে। সে একটু শান্ত নিরব পরিবেশ চায়, যেখানে একটু মন খুলে বসা যাবে, নিজের সাথে একাকিত্বে কিছুটা সময় কাটানো যাবে।
প্রিয়তার আজকাল মোটেও এত কথা-বার্তা, চিৎকার-চেঁচামিচি হৈ-হট্টগোল ভালো লাগে না। ৪ বছর একা থাকতে থাকতে শুচিবাই হয়ে গেছে।
প্রিয়তা রিবন্ডিং করা লম্বা চুলগুলো হাতে পেঁচিয়ে খোঁপা করতে করতে অমনোযোগী ভাবে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে উঠছে।
চুলে পিঙ্ক ক্লাচারটা গুঁজে কনুই দিয়ে ছাদের বড় দরজা ঠেলে রাফ প্লাস্টার করা মেঝেতে পা রাখতেই ধারাম করে কারো বলিষ্ঠ বুকের সাথে ধাক্কা খেলো বসলো।
নিশিতো রাতের মধ্য গগনে এক ফালি জ্যোৎস্না মাখা চাঁদ। আকাশ ভর্তি সহস্র তারার মিশেলে সেই এক ফালি চাঁদকে অঢেল রূপের অধিকারী মনে হচ্ছে।

থেকে থেকে বয়ে চলেছে মৃদুমন্দ হাওয়া। ছাদে লাগানো মিশ্র ফুলের একত্র সুগন্ধ এসে নাকে লাগছে।
কারো শক্ত সামর্থ বুকের ধাক্কায় এক পা পিছিয়ে গেছে প্রিয়তা। এতে অবশ্য সে ব্যথা পায়নি, কিন্তু যাকে ঠুকেছে সে নিশ্চয় ভীষণ ব্যথা পেয়েছে।
নিজের কৃতকর্মের জন্য প্রিয়তার অনুশোচনা হলো। সে “সরি” বলার উদ্দেশ্যে মাথা উপরে উঠাতেই চাঁদের ঝাপসা আলোয় এক জোড়া গভীর নীল চোখের সাথে এক জোড়া গভীর বাদামী চোখের অকস্মাৎ মিলন ঘটল।
থমকালো প্রিয়তা। চোখে চোখ পড়তেই তীব্র অভিমানের পদতলে পিষ্ট হলো প্রেম। চোখের দৃষ্টি নত করলো প্রিয়তা। দুই হাত শক্ত মুঠো করে নিজেকে সামলে নিলো। এই মানুষটার সাথে সে একটা ও কথা বলতে চায় না।
প্রিয়তা অযথা বাক্য ব্যয় না করে মুখ ঘুরিয়ে অন্যত্র চলে যেতে নিতেই পাশে থেকে এ চিরপরিচিত কণ্ঠ ভেসে এলো।
প্রণয় বেশ অপমানের সুরেই বললো—
“এখনও আমায় দেখলে ধাক্কা খেতে মন চায়?”
এখনও কাছাকাছি আসতে চাস আমার?
অভিমানের প্রিয়তার গোলাপি নাকের ডগা ফুলে ফুলে উঠছে। সে মোটে ও চায়নি এই দাম্ভিক অহংকারী পুরুষের সাথে বাক্য বিনিময় করতে। কিন্তু এই তির্যক বাক্যটা প্রিয়তার ভীষণ মানে লাগলো। এর জবাব না দিয়ে তো সে কিছুতেই যাবে।

তাই থামলো প্রিয়তা, পুনরায় হেঁটে এসে দাঁড়ালো প্রণয়ের মুখের সামনে। মাথা উঁচু করে প্রণয়ের চোখে চোখ রাখল, হালকা একটা হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে কটাক্ষ করে বললো,
“আপনি নিজেকে কি মনে করেন মিস্টার আবরার সিকদার প্রণয়? বিশ্ব সুন্দরী, যে আপনাকে দেখলেই মেয়েদের ধাক্কা খেতে মন চাইবে?”
প্রণয় তির্যক হেসে বললো,
“সুন্দর নই বুঝি?”
প্রণয়ের মোলায়েম কণ্ঠস্বরেই প্রিয়তার বুকে ভেতর ঝড় উঠলো। কিন্তু চোখ মুখে অস্বাভাবিক রকমের শীতলতা।
“আপনার রূপের খুব অহংকার, তাই না?”

“হ্যাঁ, অবশ্যই রূপ আছে বলেই তো তুই আমার পিছু পিছু ঘুরিস। তা কি আর এমনি এমনি?”
প্রিয়তা আবার ও অপমানিত বোধ করলো। মনের যত রাগ ক্ষোভ সব উগড়ে আসতে চাইল এই মানুষটার ওপর।
মুখের হাসি আর ধরে রাখতে পারলো না প্রিয়তা। এবার রাগে তেতে উঠলো, দাঁতে দাঁত পিষে বললো—
“বাহ! নিজের ওপর দেখছি আপনার খূব কনফিডেন্স। কিন্তু আমার গণনা কিন্চিৎ অশুদ্ধ। আপনি কি ভেবেছেন আপনাকে না পেলে আমি কেঁদে কেটে মরে যাবো? এটা আপনার ভুল ধারণা, মিস্টার আবরার সিকদার প্রণয়। আপনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।

আমি আপনাকে একসময় ভালোবেসেছিলাম, এটা আপনার সৌভাগ্য। কিন্তু এখন আর ভালোবাসি না, কারণ আমি বুঝে গেছি হীরের মূল্য কেবল কেন রাজারাই বোঝে। আপনার মতো পথচারী ভিক্ষুক কিভাবে বুঝবে সেটার মর্ম?”
প্রণয় কিছুই বলল না, কেবল চুপ করে চেয়ে রইল প্রিয়তার মুখের পানে।
প্রিয়তা রাগের বসে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে এবার চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে শুরু করলো—
“আপনি কি এক্সপেক্ট করেছিলেন, আমার মতো সুন্দরী রূপবতী একটা মেয়ে আপনার জন্য কেঁদে কেটে মরে যাবে? বড্ড বোকা আপনি।
বলি, আমার মতো এমন সুন্দরী মেয়ে আর একটা ও দেখেছেন?”
প্রণয় দেখলো রাগের চূড়ান্তে প্রিয়তার নাক মুখ সব মরিচের মতো লাল টকটকে হয়ে গেছে। কে জানি বলেছিল সুন্দরীরা রেগে গেলে তাদের আরো সুন্দর দেখায়—ব্যাপারটা আসলেই সত্য। সে যাই হোক, প্রণয় বিষয়টা বেশ ইনজয় করছে। তাই প্রিয়তাকে আরো রাগিয়ে দিতে বললো—
“পর নারী’র সৌন্দর্য দেখে আমি কি করবো? আমার বউ কি কম সুন্দরী? আমার কাছে আমার বউই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুন্দরী।”

প্রণয় উচ্চারিত এক একটা বাক্যে প্রিয়তার মনে হলো, কেউ তার কানে গরম শিষা ঢেলে দিয়েছে। নিজের অজান্তেই চোখে পানি চলে এলো। তবুও থেমে রইলো না প্রিয়তা।
প্রণয় আবার বললো,
“সামান্য রূপের এত অহংকার! তোর এই চেহারা আজ আছে, কাল নেই। কিন্তু আমার বউ ঢাকা ইউনিভার্সিটির ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের নামকরা প্রফেসর। তুই কি? কি যোগ্যতা আছে তোর?”
প্রিয়তা রাগ চড়চড় করে বাড়তে থাকলো। মুখের ওপর সপাটে জবাব দিয়ে বললো,
“আপনার বউ বয়সে বুড়ি! ৩১ বছরের বয়সে মাত্র কিনা ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর? ছিঃ! আমি ৩১ বছরের বয়সে এর থেকে হাজার গুণ বেশি সফল হবো।”

“সে তুই যা ইচ্ছে তাই হ। এখন সামনে থেকে সরে দাঁড়া। আমার বউ আমার জন্য অপেক্ষা করছে”—বলে তাড়াহুড়ো করে যেতে ধরলো প্রণয়।
রাগে প্রিয়তার কান্না পেয়ে যায়। সে খামছে ধরে প্রণয়ের হাত।
থমকে দাঁড়ায় প্রণয়। মলিন হেসে তাকায় প্রিয়তার দিকে।
প্রিয়তার চোখে স্পষ্ট পানি চিকচিক করছে। এমনকি তা একসময় গাল বেয়ে গড়িয়ে ও পড়লো।
প্রিয়তা ভেতর ভেতর যন্ত্রণায় ছটফটিয়ে উঠলো কান্না মিশ্রিত কন্ঠে বলল,
“আমায় কষ্ট দিয়ে খূব মজা পাচ্ছেন, তাই না? দেখবেন, একদিন এমন আসবে, যেদিন কেবল আপনি একা কষ্ট পাবেন, আপনি একা কাঁদবেন। আমাকে যতটা যন্ত্রণা দিচ্ছেন, তার হাজার গুণ করে আপনি ফেরত পাবেন।
আপনি ও আমার মতো যন্ত্রণা কাত্রাবেন, মৃত্যু ভিক্ষা চাইবেন। কিন্তু মৃত্যু হবে না আপনার। বেঁচে থাকবেন, নয়ন জুড়িয়ে সব দেখবেন। আত্মার গভীরে অনুভব করবেন আমাকে ঠিক কতটা পুড়িয়েছেন।

আর সেদিন হবে আমার আসল জয়। আপনার যন্ত্রণাই হবে আমার পরম তৃপ্তি। আপনাকে কষ্ট পেতে দেখাই হবে আমার সুখ। সেদিন আপনাকে ছটফট করতে দেখে উল্লাস করবো আমি। সেদিন সুখী হবো আমি, সর্বোচ্চ সুখী।”
প্রিয়তা বুঝতেও পারলো না, সে রাগের মাথায় প্রণয়কে কোথায় আঘাত করে বসলো।
প্রণয় তৃপ্ত হাসি দিয়ে এগিয়ে এসে প্রিয়তার মাথায় হাত রাখলো, সচ্ছ অন্তরে বলল—
“তাই হোক। তোর মুখের এক একটা বাণী আল্লাহ’র দরবারে কবুল হোক। যা, তোকে অভিশাপ দিলাম—সুখী হো তুই। কঠিন সুখের অসুখ হোক তোর।

যা অভিশাপ দিলাম তোকে, যার তুই সংসার হবি, যে হবে তোর ঘর, তার যেন তোকে ভালোবাসার কঠিন একটা অসুখ হয়। তার যেন তুই হতে না হয় কোনোদিন ও আমার মতো পর।”
বলে মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলো প্রণয়। পাথরের মূর্তির মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো প্রিয়তা। সে রাগের মাথায় প্রণয় ভাইকে এগুলো কি বলে বসলো!
কিন্তু এগুলো নিয়ে বেশি মাথা ঘামালো না প্রিয়তা। রাগে এখনও তার মাথা ধপধপ কতছে। এই সিকদার বাড়ির বড় ছেলের অহংকার চূর্ণ না করা পর্যন্ত থামবে না সে।
প্রিয়তা দুই সেকেন্ড ভেবে গটগট পায়ে নিচে নেমে গেলো।
“পাপ্পা আমি বাংলাদেশ আসছি।”
“কেনো মাম্মা? তোমার গ্র্যাজুয়েশন শেষ হতে এখনো ২.৫–৩ বছর বাকি, তাহলে এত তাড়াতাড়ি কেনো আসতে চাও?”

প্রিয়স্মিতা উত্তেজিত হয়ে পড়লো। কোনো এক্সপ্লেনেশন ছাড়াই বললো—”আমার এখানের কাজ ফুরিয়েছে পাপ্পা, তাই আমি next ১ week এর মধ্যেই BD তে আসছি।”
সাজিদ শিকদার চাইলে ও মেয়ের উপর রাগ দেখাতে পারেন না। তাই বুঝিয়ে বললেন—”দেখো মা, অস্ট্রেলিয়াতে তুমি অনেক ভালো একটা ইউনিভার্সিটিতে আছো, অনেক কতো ভালো র‍্যাঙ্ক তোমার। তুমি BD তে এসে কি করবে? এখানে ভালো কোনো এডুকেশন সিস্টেম নেই, সব জায়গায় শুধু পলিটিক্স।”
প্রিয়স্মিতা কিছু বলছিলো কিন্তু সেটা না শুনেই ঝট করে ফোন কেটে দিলেন সাজিদ শিকদার।
খুব কাছ থেকে কারো পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তিনি সতর্ক চোখে দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করলেন।
উনার সন্দেহ সত্যি হলো। প্রিয়তা রাগে জেদে লাল টকটকে হয়ে সাজিদ শিকদারের রুমে প্রবেশ করলো।
মেয়েকে রাগে গজগজ করতে দেখে ভ্রু কুঁচকালেন সাজিদ শিকদার। উনার রাগ করতে না জানা মেয়ে আজকাল অল্পতেই রাগান্বিত হয়ে পড়ে।

তিনি প্রিয়তার নিকট এগিয়ে গেলেন, মাথায় হাত রেখে শুধালেন—”কি হয়েছে আমার মায়ের? আমার মা এত রেগে আছে কেনো?”
প্রিয়তা রাগে ফসফস করতে করতে বললো—”আব্বু, বিয়ে করবো, আমাকে বিয়ে দাও।”
মেয়ের এমন আচানক কথায় ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন সাজিদ শিকদার। মেয়ে কি বলছে বুঝতে পেরে কেশে উঠলেন।
বিস্ময়ে ভদ্রলোকের মুখ হাঁ। প্রিয়তা বিরক্ত চোখে তাকালো আব্বুর দিকে।
রাগে তার ফর্সা নাকের গোলাপি ডগা জ্বলছে।
প্রিয়তা খেপে গিয়ে বললো—”আব্বু, রিঅ্যাকশন দেখতে চাই না, বলো আমাকে বিয়ে দেবে কিনা। তুমি যদি আমাকে বিয়ে না দাও তাহলে আমি যাকে পাবো তাকেই বিয়ে করে নেবো। মানে বিয়ে আমাকে করতেই হবে।”
সাজিদ শিকদার চুপ থাকেন। জবাব না দিয়ে মেয়েকে ধরে নিয়ে গিয়ে সোফায় বসালেন। জগ থেকে এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি ঢেলে মেয়ের সামনে ধরে বললেন—”নে মা, আগে তুই পানি খা।”

বিরক্ত প্রিয়তা চরম বিরক্তি নিয়ে তাকালো আব্বুর দিকে।
ঝাঁঝ দেখিয়ে বললো—”আমি পানি খেতে আসিনি আব্বু, বিয়ে করতে এসেছি। এখন তুমি আমাকে পরিষ্কার বলো তুমি আমাকে বিয়ে দিতে পারবে নাকি আমার জন্য বর আমি খুঁজবো।”
সাজিদ শিকদার ঢোক গিললেন। তিনি এক মেয়ের মাঝে আরেক মেয়ের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছেন।
তিনি ঝটকা সামলে বললেন—”অবশ্যই বিয়ে দেবো আম্মা। কিন্তু আব্বা চাই, এটা আপনার কখন মনে হলো?”
প্রিয়তা সোজা তাকিয়ে সোজা সাপ্টা জবাব দিল—”এখনই।”
“আচ্ছা, আপনি যা চাইবেন তাই হবে। আমি আব্বার ব্যবস্থা করে দেবো।”
প্রিয়তা ফের আব্বুর দিকে তাকিয়ে বললো—”করবো না, এখনই করে দাও।”
সাজিদ শিকদার বুঝতে পারছেন না উনার মেয়েটার কি হলো হঠাৎ করে।
তিনি বোঝানোর ভঙ্গিতে প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন—”আম্মা, এভাবে আপনার জন্য আমি কিভাবে বর খুঁজবো? এক-দুই দিন সময় দিন।”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৩ (২)

প্রিয়তা ওসব শুনলো না। রাগে লাল হয়ে বলল—”জাস্ট দুই দিনের মধ্যে আমার জন্য বর খুঁজে আনবে, না হলে…”
“না না আম্মা, আমি খুঁজে দেবো। এখন বলুন, কেমন আব্বা আপনি চান?”
প্রিয়তা এ বিষয়ে কোনো আগ্রহ দেখালো না। দায়সারা ভাবে বললো—”শুধু ছেলে হলেই হবে।”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৪ (২)