ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৯
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
ফুল তুলে ঝুড়ি ভর্তি করে নিলো থিরা। অতপর শ্বেতাকে ঢেকে বললো,
“আপু, আমার লাল গোলাপ তোলা হয়ে গেছে।”
শ্বেতা বেলিফুলের ঝুড়িটা নামিয়ে রেখে থিরার নিকট এগিয়ে এলো। ফুলের ঝুড়িতে উঁকি মেরে বলল,
“ভালোই ভরেছে! কিন্তু এক ঝুড়িতে কি হবে? ব্রাইড তো দুটো, জানিস না? যা, ঘর থেকে আরও দুটো ঝুড়ি নিয়ে আয়।”
থিরা মাথা নাড়ালো।
“ঠিক আছে আপু,” — বলে যেতে ধরলো থিরা,আবার পেছন থেকে ডেকে উঠলো শ্বেতা,
“এই দাঁড়া!”
“জি আপু?”
“যেটা ভরে গেছে, ওটা নিয়ে যা। সাথে আমারটাও নিয়ে যা। দাদিকে দিয়ে বলবি বাকি গুলো পাঠাচ্ছি।”
“ঠিক আছে আপু।”
“হুম।”
চলে গেলো থিরা।
শ্বেতা ও থিরা বাড়ির পিছনের বাগান থেকে গোলাপ, রজনীগন্ধা সহ বিভিন্ন সুগন্ধি ফুল তুলছে। গুলবাহার বানুর নির্দেশ — বিয়ের পূর্বে নাকি এই বাড়ির মেয়েদের দুধ, ফুল, মধু আর না জানি কী কী দিয়ে গুসল করানো হয়।
থিরা চলে যাওয়ার পর শ্বেতা একা একা ফুল কুড়াচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ দূরের বাগানে চোখ পড়তেই কাজ থামিয়ে দিলো। লাল টকটকে ঝুলন্ত পাকা আমটা দেখে লোভে তার চোখ মুখ চকচক করে উঠলো। শ্বেতা ঝুড়ি নিচে রেখে দৌড় দিলো আমের কাছে।
শিকদার বাড়ির পদ্ম পুকুর লাগোয়া আমবাগান বিশাল বড়। এই বাগান শিকদারদের নিজস্ব। শ্বেতা লাফিয়ে এসে এক টানে আমটা ডাঁটা থেকে ছিঁড়ে নিলো। অন্যান্য গাছগুলো বিশাল বড় বড় হলেও এই গাছটা বেশ নিচু আর ঝুলেও ছিল একদম হাতের কাছে।
শ্বেতা আমটা হাতে নিয়ে বিশ্বজয়ের হাসি দিলো। তার লোভাতুর মন ফুলের কথা ভুলেই গেলো।
শ্বেতা আমটা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে খেতে খেতে বাগানের ভেতর প্রবেশ করলো আরও বেশি আম কুড়ানোর আশায়। আম তার জান-প্রাণের থেকেও বেশি প্রিয়।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
কানাডায় থাকা কালে গন্ধহীন বিদেশি আলফোনসো খেতে খেতে মুখে ছ্যাঁতলা পড়ে গেছে শ্বেতার।
নিজের দেশের আমের যে স্বাদ আর যে গন্ধ — তা কি আর অন্য কোথাও পাওয়া যায় নাকি!
শ্বেতা গাছের উপরে তাকিয়ে দেখলো — হলুদ-সবুজ অজস্র কাঁচা পাকা আম ঝুলছে। কিন্তু এগুলো শ্বেতা একা কোনোদিনই পাড়তে পারবে না। তাই গাছের নিচে দেখতে লাগলো।
এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ বাচ্চাদের হাসির শব্দে দাঁড়িয়ে পড়লো শ্বেতা। কান খাড়া করে শুনলো — আরও ভেতর থেকে আসছে। সাথেসাথেই একটা বিরাট শয়তানি বুদ্ধি লাফিয়ে পেট থেকে মাথায় উঠে গেলো তার।
বাঁকা হাসলো সে। পা টিপে টিপে এগিয়ে গেলো সেদিকে।
বাগানের মাঝ বরাবর ৭-১০ বছর বয়সী বেশ কিছু বাচ্চা চুপি চুপি আম চুরি করছে। গাছের নিচে কয়েকজন, গাছের উপরে কয়েকজন।
তাদের দেখে মিষ্টি হাসলো শ্বেতা। তবে হাসি চেপে গিয়ে চেহারায় গম্ভীর্য ফুটিয়ে তুলে বললো,
“কি হচ্ছে এখানে?”
শব্দ শুনে লাফিয়ে উঠলো বাচ্চাগুলো। আতঙ্কিত দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো শ্বেতার পানে।
শ্বেতা কোমরে হাত দিয়ে এগিয়ে গেলো তাদের নিকট। ভ্রু নাচিয়ে বললো,
“চুপি চুপি আম চুরি করা হচ্ছে হুম? আচ্ছা, আমি গিয়ে বড় মামাকে বলে দিচ্ছি!”
ভয়ে মুখ শুকিয়ে এইটুকু হয়ে গেলো বাচ্চাগুলোর। তাদের মধ্যে থাকা একটা মেয়ে করুণ কণ্ঠে বললো,
“নানা আপু, বড়সাহেবকে কিছু বলবেন না। আপনি সব আম নিয়ে যান, তবুও আমাদের কথা বলবেন না।”
তাদের ভয় পেতে দেখে ফিক করে হেসে দিলো শ্বেতা। কাছে গিয়ে বললো,
“তোমাদের আম আমি কেন নেবো? তোমাদেরগুলো তোমরাই নাও। তবে মামুকে বলবো না — এক শর্তে।”
“কি শর্ত, আপু?”
শ্বেতা এবার নিজের মনোবাঞ্ছা পেশ করল,
“বলবো না — যদি আমাকে ও তোমাদের সাথে নাও। মানে, আমাকেও ও গাছে ওঠা শেখাও।”
বাচ্চাগুলো চোখ বড় বড় করে তাকালো শ্বেতার দিকে।
“আমি ও তোমাদের সাথে আম পাড়তে চাই!”
“আপু, আপনি তো অনেক বড়। আপনি কিভাবে গাছে উঠবেন?”
“কেন? পারবো না? দেখিয়ে দিলেই পারবো!”
বাচ্চাগুলো নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করলো। তাদের হাতে আর কোনো উপায় নেই। তাই তাদের মধ্যে একজন বললো,
“ঠিক আছে।”
বিজয়ী হাসলো শ্বেতা।
“তাহলে কোন গাছে উঠবো?”
“ওই যে, ওই গাছটা। ওই গাছে প্রায় সব আম পাকা।”
“ঠিক আছে, চলো।”
অতঃপর শ্বেতা আর বাচ্চাগুলো এগিয়ে গেলো গাছের নিকট। শ্বেতা উপরে তাকিয়ে দেখলো — সত্যি তাই। কিন্তু গাছটা বিশাল।
“ওরে বাবা, এত অনেক বড়!”
“হ্যাঁ আপু। আগে আমি উঠে দেখাচ্ছি, তারপর আপনি উঠবেন।”
“ঠিক আছে।”
অতঃপর দেখতেই দেখতেই বাচ্চা ছেলেটা টিকটিকির মতো বেয়ে বেয়ে উঠে পড়লো গাছের উপর। মগডালে বসে বললো,
“এবার আপনি উঠুন, আপু!”
শ্বেতা পড়লো আচ্ছা ফেঁসাদে। বাচ্চা ছেলেটা খালি গায়ে ছিল, কিন্তু শ্বেতা পরে আছে একটা গর্জিয়াস পিঙ্ক পেস্টাল থ্রিপিস, সাথে ভারী ওড়না।
তবুও চেষ্টা করলো শ্বেতা। গাছের খসখসে অংশ ধরে গাছের অর্ধেকটা উঠতেই আচমকা ঠাস করে পড়ে গেলো নিচে!
আতকে উঠলো বাচ্চাগুলো।
গাছের উপর থেকে পড়ে
“আহ্!” — বলে আর্তনাদ করে উঠলো শ্বেতা। বাঁ পাটা উল্টো দিকে মুচড়ে গেলো বোধহয়।
বাচ্চাগুলো গাছ থেকে নেমে ভয়ে দৌড় দিলো সেখান থেকে।
বাগানের মাঝখানে একলা পড়ে রইলো শ্বেতা। টনটন করতে আরম্ভ করেছে পা। যেন এবার কেঁদেই দেবে শ্বেতা।
সে ওঠার চেষ্টা করলো, কিন্তু এতে আরও তীব্র ব্যথা অনুভব করলো পায়ে।
ওখানে বসে বসেই থিরার উদ্দেশ্যে হাঁক ছাড়লো শ্বেতা।
কিন্তু অনেকটা ভেতরে থাকার দরুন হয়তো শুনতে পেলো না থিরা।
অনেকক্ষণ এভাবে পড়ে থাকার পর হাড়ের ব্যথায় কান্না করে দিলো শ্বেতা। পা বোধহয় এবার একটু একটু করে ফুলতে শুরু করেছে…
বিয়ে বাড়ির লোকসমাগমে অতিষ্ঠ হয়ে গেলো আবির্ভাব। আজ চূড়ান্ত দিন — বিদায়। মানুষ একটু বেশি, যারা আগের দিনগুলোতে আসতে পারেনি, তারাও এসেছে। শান্তিমতো কোথাও দাঁড়িয়ে দুদণ্ড কথা বলার জো নেই, বিরক্তিকর। আর এদিকে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে পূজারিনী রায় চৌধুরী সকাল থেকে প্রায় ২৫৬টা কল দিয়েছেন, এখনো দিচ্ছেন।
এতে করে আবির্ভাবের বিরক্তির মাত্রা চড়চড় করে বাড়ছে। মা যেহেতু কিছু করারও নেই, ইচ্ছা না থাকলেও কথা বলতে হবে — তাই বাধ্য হয়ে বাড়ির পেছন দিকে চলে এলো আবির্ভাব। এই দিকটা মোটামুটি ফাঁকা। সে অতিষ্ঠ মেজাজে ফোন বের করে পূজারিনী রায় চৌধুরীর নাম্বারে ডায়াল করতে নিলেই আবারো ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো।
পূজারিনী রায় চৌধুরীর ফোন এবার ফাইনালি রিসিভ করতে পারলো আবির্ভাব। ফোন কানে নিয়ে সে কিছু বলবে, তার পূর্বেই তারস্বরে ধমকে উঠলেন পূজারিনী রায় চৌধুরী।
“কুলাঙ্গার ছেলে! তোমাকে আমরা এই শিক্ষা দিয়েছি? তুমি কিনা সারারাত অন্যত্র কাটিয়ে এসে বউ-এর গায়ে হাত তুলছো? তোমাকে এতো সাহস কে দিলো একটা মেয়ের গায়ে হাত তোলার?”
এমনিতেই মেজাজ ঠিক নেই আবির্ভাবের। তার উপর এমন পিত্তি-জ্বালানো কথা শুনে তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলো সে। তবে ভদ্রতার সীমা বজায় রেখে বললো,
“আমি যথেষ্ট ভদ্র, মিসেস রায় চৌধুরী। আর ভদ্র বলেই আপনি ফোন করতে পেরেছেন। আর হ্যাঁ, আমি ইচ্ছে করে ওর গায়ে হাত তুলিনি।”
“বাহ! বাহ! তুমি যে কতো কতো ভদ্র ছেলে! তা তো প্রমাণ করেই দিয়েছো — এক একটা কান্ড ঘটিয়ে শ্বশুর বাড়িতে প্রতিনিয়ত বাপ-মায়ের মুখ উজ্জ্বল করছো। তুমি জানো সকালে দেবীর মা ফোন করে কী কী শুনিয়েছেন আমায়?”
“That’s completely your responsibility, Mrs. Chaudhari. That is none of my business.”
“Shut up, Abirvab! বউ মানো না, আবার তার গায়ে হাত তোলো, ঝগড়া করো!”
“মানিনা বলে কি মুক্তি পেয়েছি, মিসেস রায়চৌধুরী? আপনারা আমায় মুক্তি পেতে দিয়েছেন? যাই হোক, আপনার সাথে এসব নিয়ে আমার তর্ক করার কোনো ইন্টারেস্ট নেই। আমি আপনাকে আজ আবার ক্লিয়ার জানিয়ে দিচ্ছি — আপনি আমায় ফোন করবেন না, কখনোই করবেন না, কোন অবস্থাতেই করবেন না। আমি মরে গেলে ও না। আর হ্যাঁ, বেশি সমস্যা হলে ওকে আপনার কাছে নিয়ে যেতে পারেন। রাখলাম।”
বলে ফোন কাটতে নিলো আবির্ভাব।
“দাঁড়াও!”
“তাড়াতাড়ি বলুন।”
কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে পদ্মপুকুর পেরিয়ে আম বাগানের অনেকটা গভীরে চলে এলো আবির্ভাব।
“সত্যি বলো, আবির্ভাব — তোমার কি ওই মেয়েটার সাথে এখনো সম্পর্ক আছে?”
“আপনার কোনো সন্দেহ আছে?”
চমকে উঠলেন পূজারিনী রায় চৌধুরী, আমতা আমতা করে বললেন,
“মা-মানে?”
“এই সামান্য কথার মানে ও জানো না? আচ্ছা আমি বলে দিচ্ছি — কান খুলে শুনে রাখুন, ওর সাথে আমার জীবন-মরণের সম্পর্ক ছিল, আছে, থাকবে। প্রতিটা নিশ্বাসে নিশ্বাসে ভালোবাসি আমি ওকে। যতবার আমার হৃৎপিণ্ড স্পন্দিত হয়, ততবার ভালোবাসি ওকে। আমি বেঁচেই আছি ওকে ভালোবেসে। তাহলে বলুন, সম্পর্ক থাকলো না কিভাবে? যার সাথে আত্মার সম্পর্ক সংযুক্ত রয়েছে, তার সাথে সম্পর্ক অস্বীকার করার দৃষ্টতা আমার নেই।”
“চুপ করো, বেয়াদব ছেলে! তুমি কাকে কী বলছো, একটু বুঝে বলো — আমি তোমার মা!”
“আচ্ছা আপনি আমার মা? তো মায়ের মতো কোন কাজটা করেছেন আপনি? আবার গৌরব করে বলছেন আপনি আমার মা?”
“শুনুন, মিসেস রায় চৌধুরী, আপনার নাটক দেখার বা শোনার কোনটার জন্যই আমার হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই। যা বলার তা সাফ সাফ বলুন।”
“ঠিক আছে, পরিষ্কার করেই বলছি — তোমার এসব নিয়ে আমার কোন মাথা ব্যথা নেই। তুমি কাকে ভালোবাসো না বাসো, হোয়াটএভার, এটা তোমার ব্যাপার। কিন্তু তুমি ভুলে যেও না তুমি আমাকে কি কথা দিয়েছো। শুধু এটা মনে রেখো — তুমি এখন বিবাহিত, তোমার একটা বউ আছে।”
“আর যদি তুমি কোনভাবে তোমার কথার খেলাপ করো, তাহলে পরবর্তী বার ফিরে আর বাবা-মাকে দেখতে পাবেনা!”
ব্যাঙ্গাত্মক হাসলো আবির্ভাব।
“হ্যাঁ হ্যাঁ, অবশ্যই মনে আছে — যে ফাঁসির দড়ি আপনি আমার গলায় পরিয়েছেন, তার কি আর ভোলা যায়? চিতায় না ওঠা পর্যন্তই এই দড়ি আমার গলা থেকে খুলবে না — এ আমি বেশ জানি।”
কথা বলতে বলতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়লো আবির্ভাব। মনে হলো আশেপাশে হয়তো কেউ কাঁদছে। কান থেকে ফোন নামিয়ে সে আশপাশ তাকালো। আরো কিছু দূরে এগিয়ে যেতেই একটা হালকা কান্নার শব্দ সে স্পষ্ট শুনতে পেল। তবে কণ্ঠটা বেশ চেনা লাগলো আবির্ভাবের কাছে।
কয়েক মিলিসেকেন্ড যেতেই তার হৃৎপিণ্ড ধক করে উঠলো। সে দ্রুত ফোন পকেটে ভরে আশপাশ খুঁজতে লাগলো।
“মাই লাভ!”
অনাকাঙ্ক্ষিত কিন্তু চেনা কণ্ঠ শুনে আরো জোরে কেঁদে উঠলো শ্বেতা। শব্দের উৎস খুঁজে চলে এলো আবির্ভাব। শ্বেতার উপর নজর পড়তেই স্থির হয়ে গেলো তার চোখের মনি।
গাছের ঝড়ে সবুজ ঘাসের উপর পা ভাঁজ করে বসে ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে শ্বেতা। কান্নার তালে তালে তার তনু শরীরে মৃদু কম্পনের সৃষ্টি হচ্ছে।
আবির্ভাব দৌড়ে গেলো শ্বেতার নিকট, অস্থির কণ্ঠে ডাকলো,
“মাই লাভ!”
জল টলটলে অশ্রু-শিক্ত নজরে দৃষ্টি তুললো শ্বেতা। মায়াবি ধূসরবর্ণ চোখ জোড়া দেখে বুকটা মুচড়ে উঠলো আবির্ভাবের। মন বলল, কী হয়েছে মেয়েটার?
শ্বেতা ঠোঁট উল্টে দুই হাত বাড়িয়ে দিলো আবির্ভাবের দিকে। আবির্ভাব চমকালো, তবে বেশি না ভেবে শ্বেতার হাত ধরে পাশে বসে পড়লো। মেয়েটার মুখটায় যেন সৃষ্টির সকল মায়া উপচে পড়ছে।
আবির্ভাব বৃদ্ধাঙ্গুল দ্বারা তুলতুলে গাল মুছিয়ে দিয়ে কোমল কণ্ঠে শুধালো,
“এই ভর দুপুরে এখানে বসে বসে কাঁদছো কেন, পাখি?”
আবির্ভাবের অক্ষি-পানে চেয়ে শব্দ করে কান্না করে দিলো শ্বেতা। ভেবাচেকা খেয়ে গেলো আবির্ভাব। এই মেয়ে বাচ্চাদের মতো করছে কেন? সে তো এমন করার মেয়ে নয়।
অতিরিক্ত কান্নার ফলে নাকের ডগাটা টকটকে লাল আপেলের মতো লাগছে আবির্ভাবের নিকট। সে সন্ধিহান চোখে শ্বেতার মাথা থেকে পা পর্যন্ত সূক্ষ্ম নজরে পর্যবেক্ষণ করলো। মেয়েটাকে কাঁদতে দেখে তার বুকের ভেতর কেমন অদ্ভুত কষ্ট কষ্ট অনুভুতি হচ্ছে।
চোখের পানি দেখে সে উতলা কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
“বলো আমায়, কী হয়েছে তোমার?”
কিছু বললো না শ্বেতা। হুট করে আবির্ভাবের বাহু জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে উঠলো।
এবার অস্থির হয়ে উঠলো আবির্ভাব। শ্বেতার হাত-পা দেখতে লাগলো পাগলের মতো। তবে পায়ে হাত দিতেই আচমকা আর্তনাদ করে উঠলো শ্বেতা। ঘাবড়ে গেলো আবির্ভাব, বুঝলো ঘাপলা এখানেই আছে।
দুই গাল ধরে অস্থির হয়ে শুধালো,
“পায়ের কোথায় ব্যথা পেয়েছো জান? দেখি, পা-টা দেখাও।”
কিন্তু এক চুলও নড়লো না শ্বেতা। আবির্ভাবের হাত চেপে ধরে ঠায় বসে থাকলো, চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে অনর্গল বারিধারা।
আবির্ভাব কিছুক্ষণ ওর মুখ পানে চেয়ে পায়ে হাত দিলো। আবারো ব্যথায় চিৎকার দিয়ে উঠলো শ্বেতা।
এবার ধমকে উঠলো আবির্ভাব,
“দেখি, এদিকে পা দাও।”
ভয়ে কেঁপে উঠলো শ্বেতা। ভিতু চোখে তাকিয়ে দুই পাশে মাথা নাড়ালো।
কিন্তু আবির্ভাব বুঝি এসব শোনার পাত্র? সে শ্বেতার বাঁ-পা-টা টেনে সামনে নিয়ে এলো। তীব্র ব্যথায় চিৎকার দিয়ে আবির্ভাবের বুকে মুখ গুঁজে দিলো শ্বেতা।
পায়ের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলো আবির্ভাব। পায়ের পাতার উপরের অংশ অনেকটাই ফুলে উঠেছে।
ফোলা অংশে আলতো স্পর্শ করতেই বুকে মুখ গুঁজে বাচ্চাদের মত কেঁদে উঠলো শ্বেতা। আবির্ভাবের মনে হচ্ছে শুধু এতটুকুই নয়। তাই নিশ্চিত হতে পাজামাটা খানিকটা উপরে টেনে তুললো সে — যা ভেবেছিল, তাই। পায়ের জোড়া থেকে চারপাশের অনেকটা জায়গা একসাথে ফুলেছে।
শ্বেতার অনবরত কান্নাতে বুক পাঁজরে চিনচিনে ব্যথা অনুভব করলো আবির্ভাব। সে জানে এখন তাকে কী করতে হবে।
দীর্ঘশ্বাস ফেললো আবির্ভাব। শ্বেতার মাথায় হাত বুলিয়ে নরম গলায় শুধালো,
“বেশি ব্যথা করছে, মাই লাভ?”
“হুম।” — আবির্ভাবের বক্ষ থেকেই জবাব দিল শ্বেতা।
“কোন মহৎ কর্ম সম্পাদন করতে গিয়ে এতো ব্যথা পেলে শুনি?”
“পড়ে গিয়ে।”
জবাব শুনে ভ্রু কুঁচকালো আবির্ভাব। সন্ধিহান কণ্ঠে শুধালো,
“কোথা থেকে?”
“গাছ থেকে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেললো আবির্ভাব। যা বোঝার সে বুঝে গেছে, মেয়েটা বদলায়নি একটুও।
“আচ্ছা, গাছে উঠেছিলে তাহলে… আম পেয়েছো?”
“উঁহু।”
“হাড়টা ঘুরিয়ে দিয়েছে তো ঠিকই। এখানে কতক্ষণ ধরে পড়ে আছো?”
“অনেকক্ষণ।”
“তাইতো বলি এত ফুলল কিভাবে।”
এভাবে কথার জালে ভুলাতে শুরু করলো আবির্ভাব।
উম পেয়ে ধীরে ধীরে শান্ত হলো শ্বেতা। তবে কিছু বুঝে ওঠার আগেই মট করে একটা শব্দ হলো। সঙ্গে সঙ্গেই জমিন কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো শ্বেতা। ব্যথা সইতে না পেরে সজোরে কামড়ে ধরলো আবির্ভাবের বুকের মাংস।
চোখ বন্ধ করে হাসলো আবির্ভাব। দাঁতে দাঁত পিষে উক্ত ব্যথা হজম করে নিলো নীরবে।
ধীরে ধীরে আবারো শান্ত হলো শ্বেতা। ব্যথা কমে যেতেই হুঁশ হলো তার। ঝড়ের বেগে সরে গেল আবির্ভাবের বুক থেকে। দৃষ্টি নত করে ধীরে বলল,
“সরি।”
ব্যথাতুর চোখে তাকিয়ে মলিন হাসলো আবির্ভাব। জবাব না দিয়ে পুনরায় পায়ে হাত দিলো। চমকে উঠলো শ্বেতা। পা সরিয়ে নিতে চাইলেও ছাড়লো না আবির্ভাব, বরং আস্তে আস্তে ফোলা অংশে মাসাজ করতে লাগলো। সঙ্গে এটাও লক্ষ্য করলো — তার দেওয়া প্রথম প্রেমর চিহ্ন শ্বেতা আজও শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছে। ফর্সা পায়ে এখনও জলজল করছে রুপোলি পাতলা চিকন পায়েলটা।
শ্বেতার এবার অন্য কারণে কান্না পাচ্ছে। নিজেকে সামলানো যেন দুঃসহ। সে পা ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বলল,
“প্লিজ, আমাকে ছাড়ুন আবির্ভাব। আপনার পায়ে হাত দেওয়াটা দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছে, আপনি আমার গুরুজন।”
একটু আগেও শ্বেতার আচরণে মনে হচ্ছিল না আবির্ভাব তার পর। কিন্তু সত্যি এটাই — কাছে থাকলেও তাদের মধ্যে কয়েক লক্ষ আলোকবর্ষের দূরত্ব, আর যা কখনো মিটবার নয়।
আবির্ভাব ম্লান কণ্ঠে বলল,
“সর্বপ্রথম আমি একজন ডাক্তার। আর এটা আমার ডিউটি। মাসাজ না করে দিলে তুমি দাঁড়াতে পারবে না।”
“ধন্যবাদ, আপনার উপকার মনে থাকবে,” বলে পা ছাড়িয়ে নিলো শ্বেতা। উঠে দাঁড়িয়ে পায়ের পাতায় ভর দিতেই ব্যথায় কুঁকড়ে গেল সে। ভারসাম্য হারিয়ে আঁচড়ে পড়ল আবির্ভাবের বুকে।
সযত্নে আগলে নিলো আবির্ভাব। শ্বেতাকে ধরে পুনরায় পাশে বসিয়ে দিলো। শীতল কণ্ঠে বলল,
“বড়দের কথা না শুনলে এই হয়। দেখি, পা টা দাও।”
শ্বেতা দিল না। রাগে, দুঃখে, অভিমানে তার মরে যেতে মন চাচ্ছে। যে মানুষটার থেকে সে পালিয়ে বাঁচতে চায়, সেই মানুষটাই কেন বারবার সামনে এসে দাঁড়ায়? চোখ ভিজে উঠল শ্বেতার।
“আমি যদি তোমাকে এখানে ফেলে চলে যাই, তাহলে সন্ধ্যার পর ভূত-শাঁকচুন্নিদের সাথে কিটি পার্টি করতে হবে তোমায়। ইউ নো, শাকচুন্নি, পেত্নী, ডাইনি, পিশাচিনী এক্সট্রা!”
“সমস্যা নেই, চলে যান আপনি,” কান্না দমিয়ে বলল শ্বেতা।
“তাতো অবশ্যই যাব। আমার বা কি অধিকার আছে থাকার? কিন্তু মানবিক কর্তব্যটুকু করতে না পারলে বিবেক দহনে জ্বলতে হবে আমায়।”
শ্বেতার কেন যেন হাসি পেল কথাটা শুনে। তাচ্ছিল্যের সাথে বলল,
“আপনার বিবেক আছে তাহলে?”
কিছু বলল না আবির্ভাব। শ্বেতার পা-টা নিয়ে নিজের উরুতে রাখল। জেন্টলি মাসাজ করতে করতে মনে মনে বলল,
“আমাকে আঘাত করতে তোমার এত কষ্ট কেন হয়, মাই লাভ? আমি তো তোমায় কম কষ্ট দিইনি। তোমার তো উচিত — আঘাতে আঘাতে আমার কলিজাটা ছিঁড়ে ফেলা। কিন্তু তুমি কিছুই বলছ না।”
সামনের মানুষটাকে দেখে শ্বেতার ভেতরটা অসহনীয় ব্যথায় নীল হয়ে যাচ্ছে। এই মানুষটাই তাকে ভেতর থেকে গুঁড়িয়ে দিয়েছে, সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে নিঃস্ব করে ছেড়েছে। তবু ও এই মানুষটার প্রতি ভালোবাসা-ব্যথিত, অন্য কোনো অনুভূতি আসে না শ্বেতার।
আবির্ভাব হঠাৎ বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। হাত বাড়িয়ে দিল শ্বেতার পানে, শান্ত কণ্ঠে বলল,
“হাত ধরে ওঠো।”
শ্বেতার কষ্ট হচ্ছে, তবু সে নিরুপায়। কম্পনরত হাতটা বাড়িয়ে দিল আবির্ভাবের পানে। আবির্ভাব তাকে তুলে দাঁড় করাল, দুই বাহুতে সাপোর্ট দিয়ে বলল,
“দেখ তো, হাঁটতে পারো কিনা।”
শ্বেতা অনেক কষ্টে দুই পা এগিয়ে আবার হোঁচট খেল। সাথে সাথেই ভয়ে চোখ-মুখ খিচে বন্ধ করে নিল। মুখ থুবড়ে পড়তে নিলেই নিজেকে হাওয়ায় অনুভব হলো।
সঙ্গে সঙ্গেই চমকে চোখ খুলে ফেলল শ্বেতা। মুখের সামনে ভেসে উঠল এক কঠোর পুরুষালী অবয়ব। শ্বেতার আর কান্না চেপে রাখা গেল না—ঝরঝর করে কেঁদে দিল।
আবির্ভাব তাকে পেছনের দরজা দিয়ে উপরে নিয়ে এলো। এখন সম্ভবত সবাই দুপুরের খাবার খেতে ব্যস্ত, বিধায় খুব একটা কেউ দেখতে পেল না তাদের।
আবির্ভাব শ্বেতাকে ওর বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বলল,
“চিন্তা করোনা, আমি কাউকে বলছি — তোমাকে গরম এনে তেল মালিশ করে দিতে। ২-৩ ঘণ্টার মধ্যেই অনেকটা আরাম পাবে।”
শ্বেতা কিছু বলতেই পারল না, কেবল মাথা নিচু করে রইল।
আবির্ভাব কিছুক্ষণ দেখে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গেল সেখান থেকে।
শ্বেতার অশ্রুশিক্ত টলমলে চোখে চেয়ে রইলো আবির্ভাবের যাওয়ার পানে। জীবনের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যে এত সংগ্রামের হয়ে পড়বে, তা কখনো দুঃস্বপ্নে ও কল্পনা করতে পারেনি শ্বেতা। ভালোবাসার সময় বুঝেনি এই ভালোবাসার ফুলে সুবাসিত নয়, কাটার আঘাতে রক্তাক্ত হতে হবে তাকে—দুঃস্বপ্নেও কখনো ভাবেনি জীবনে করা ছোট্ট একটা ভুল তার ভবিষ্যৎ জীবনটাকে এভাবে অন্ধকারে ডুবিয়ে দেবে, আবেগের বয়সে করা ভুলের জন্য এভাবে ধুঁকে ধুঁকে মরতে হবে প্রতিনিয়ত।
এমনটা নয় যে আবির্ভাব তাকে জোর করে ভালোবাসতে বাধ্য করেছিল। এমনটা একদমই নয়, বরং সে নিজেই পাগল ছিল আবির্ভাবের জন্য। নিজের থেকে ১২ বছরের বড় ভাইয়ের বন্ধুকে দেখে দেওয়ানা হয়ে গিয়েছিলো রীতিমতো। যদিও প্রথমে জানত না, সেই মানুষটা অন্য ধর্মের। ভাইয়ের সাথে সবসময় চলাফেরা করতো দেখে কখনো মনেই হতোনা। আর যখন সে সত্যিটা জেনেছিলো, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।
বিদেশের মাটিতে থাকার দরুন পাশ্চাত্য সভ্যতায় ভুলে গিয়েছিল দেশিয় সংস্কৃতি, গায়ে মাখেনি সমাজ, বাড়তে দিয়েছে ভালোবাসা।
বিশ্বের বড় বড় সকল নদীতেও বাঁধ দেওয়া যায়। কিন্তু কেউ কি কখনো শুনেছে, সমুদ্রে বাঁধ দিতে?
শ্বেতার ভালোবাসাটা ওই পর্যায়ে চলে গিয়েছিল ততদিনে। এমনকি ভালোবাসার জন্য শ্বেতা সবার বিরুদ্ধে যেতে রাজি ছিলো—কেবল যেকোনো মূল্যেই তার ওই মানুষটাকে চাই, ওই মানুষটার ভালোবাসা চাই।
এক সময় তাই হলো ও সে খুব করে পেয়ে গিয়েছিল সেই মানুষটাকে। ভালোবাসার রঙিন ডানা পেয়েছিল জীবন। কৈশোরের সেই সময় ছিল বাস্তবতা থেকে বহু দূরে, যেখানে শ্বেতা কেবল ওই নিষিদ্ধ মানুষটাকে চাইত। ওই মানুষটাও তাকে খুব আস্কারা দিত, আহ্লাদ করতো, মাথায় তুলে রাখত।
কিন্তু হঠাৎ করে একদিন কোন এক অজানা কারণে মানুষটা বদলে গেল। ভুলে গেল তার করা সকল প্রতিশ্রুতি। মাঝপথে হাত ছেড়ে হারিয়ে গেল বহুদূরে। নির্দয়ের মতো ছুড়ে মারল এক সমুদ্রের যন্ত্রণায়।
তবুও শ্বেতা কখনোই তাকে অভিশাপ দেয় না। আসলে যে মানুষটাকে ভালোবাসা যায়, কখনোই সেই মানুষটার মন্দ কামনা করা যায় না। তা সে যতই অন্যায় করুক, প্রতারণা করুক, বিশ্বাসঘাতকতা করুক — দিন শেষে সেই আপনার ভালোবাসার মানুষ আর এটাই সত্য হয়ে থেকে যায়—মধ্যরাতে তাহাজ্জুদের নামাজে না চাইতেও সেই মানুষটার জন্য দোয়া কামনা হয়ে যায়। সব এমনি এমনিই হয়ে যায়।
“কেমন বোধ করছ শ্বেতা?”
গভীর মনোযোগে থাকা শ্বেতা, কারো অপ্রত্যাশিত আওয়াজে চমকে উঠলো। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখলো, দেবী দাঁড়িয়ে আছে। বেশ অবাক হলো শ্বেতা। এই সময় দেবীর উপস্থিতি সে মোটেই আশা করেনি।
“আপনিই?”
“হ্যাঁ, আমি ভাবলাম তোমার সাথে আলাপ করে আসি,” বলে শ্বেতার বিছানায় এসে বসলো দেবী।
শ্বেতা বিব্রত বোধ করল, ছোট করে জবাব দিলো,
“আচ্ছা।”
“এই বাড়ির সকলের সাথে আমার ভালোই আলাপ হয়েছে, কথা ও হয় টুকটাক। কিন্তু তুমি একমাত্র ব্যক্তি যার সাথে কোনোদিন কথা হয়নি। এক বাড়িতে থাকি, অথচ পরিচিত নই — বিষয়টা ওয়েয়ার্ড না?”
শ্বেতা অস্বস্তিতে জড়িয়ে হাসার চেষ্টা করলো।
“বাই দ্য ওয়ে, তুমি জানোতো আমি কে? কী আমার পরিচয়?”
শ্বেতা জবাব দিলো না। অস্থিরভাবে এদিক-ওদিক দৃষ্টি ফেলতে লাগলো।
বিষয়টা নোটিশ করলো দেবী। বক্র হেসে বললো,
“ঠিক আছে, আমি বলে দিচ্ছি। আমি মিসেস রায় চৌধুরী। ওয়াইফ অফ আবির্ভাব রায় চৌধুরী।”
শ্বেতা স্থির দৃষ্টিতে তাকালো।
“এবার বলো, তোমার পরিচয় কী?”
“আপনি তো জানেন আমার পরিচয়।” শান্ত কন্ঠে প্রত্তুত্তর করলো শ্বেতা।
“অবশ্যই জানি। কিন্তু আমার জানার বাইরে ও তোমার একটা পরিচয় আছে, আমি সেটা জানতে চাই,” কথাটা বলার সময় কণ্ঠটা কেমন কঠিন শুনালো দেবীর।
শ্বেতা আশ্চর্য হয়ে বললো,
“ঠিক বুঝলাম না। আলাদা পরিচয় কেন থাকবে?”
গভীর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো দেবী। তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
“নেই বুঝি?”
শ্বেতা একটু অবাক হয়ে মনে মনে ভাবলো, “কি বলছে এই মহিলা? পাগলের সাথে থাকতে থাকতে পাগল টাগল হয়ে গেল নাকি?”
দেবী পুনরায় বললো,
“আচ্ছা দেখো তো, তুমি কি আমার থেকেও বেশি সুন্দরী?”
হঠাৎ এমন উদ্ভট কথা শুনে শ্বেতা চোখ বড় বড় করে ফেললো। ওর এক্সপ্রেশন লক্ষ্য করে বিদ্রুপ করে হাসলো দেবী। তাচ্ছিল্য করে বলল,
“আবাক হওয়ার কি আছে? বয়সে তুমি আমার ২–৩ বছরের ছোটই হবে। কিন্তু সৌন্দর্যে আমার থেকে বড় কিনা, তা তো যাচাই করে দেখতে হবে আমায়।”
“আপনি কী বলছেন, আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।”
দেবী মাথা দুলিয়ে বললো,
“বুঝবে, বুঝবে… বুঝাতেই তো এসেছি।”
“কি বুঝতে এসেছেন?” — কৌতূহলী কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়লো শ্বেতা।
দেবী জবাব না দিয়ে ফের বললো,
“তোমার আর আমার স্কিন টোন তো প্রায় একই রকম—এক্সট্রিম ব্রাইট। হাইট, ওয়েট, ফিগার — সবই তো প্রায় কাছাকাছি। তাহলে তোমার মধ্যে আলাদা করে আছেটা কি?”
এবার বিরক্ত হলো শ্বেতা, কন্ঠে কাঠিন্য টেনে বললো,
“শুধু শুধু করছেন কেন? একটা মেয়ে আরেকটা মেয়ের কাছে এসে এমনি এমনি তো আর নিজের খুঁত খুঁজে বেরাবে না। নিশ্চয়ই কোনো কারণ আছে! কী কারণ?”
“আমি শুনেছিলাম, মেয়েরাই নাকি মেয়েদের আসল শত্রু। ছোট থেকেই শুনতাম প্রবাদটা কিন্তু কেন জানি বিশ্বাস হতো না, হাসি পেতো।” কথা থামিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়লো দেবী। পুনরায় বলা ধরলো —
“ভাবতাম, এগুলো আজগুবি প্রবাদ। কিন্তু এই একই কথা যখন নিজের জীবনে সত্যি হয়ে গেলো, তখন বুঝলাম কিছু কিছু প্রবাদ বোধ হয় বাস্তব জীবন থেকে নেওয়া।”
শ্বেতা এবারও কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝলো না।
দেবী এবার হেঁয়ালি ছেড়ে স্পষ্ট করে বললো,
“তুমি আমার ছোট বোনের মতো। তাই তোমার কাছে অনুরোধ করছি—আমার সংসারটা ভাঙো না। এই সংসারটা আমি অনেক স্বপ্ন নিয়ে তিলে তিলে সাজিয়েছি। একটা সম্পূর্ণ অগোছালো মানুষকে গুছিয়েছি অনেক যত্ন নিয়ে। ভালোবাসা দিও প্লিজ, আমার সংসারটা ভেঙ্গো না। তোমার বিয়ে হয়নি, তুমি ভীষণ সুন্দরী, না চাইলেও অনেক ভালো ছেলে পেয়ে যাবে। কিন্তু আমি ইতিমধ্যে বিবাহিত। আমার আর কোনো অপশন নেই।”
দেবীর কথাগুলোতে শ্বেতার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলো দেবীর পানে। অতঃপর কিছুক্ষণ নীরব থেকে এক বাক্যে বললো,
“আপনার স্বামীর সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই।”
দেবীর কেন যেন প্রচণ্ড মেজাজ খারাপ লাগলো এই কথা শুনে। মৃদু চেঁচিয়ে বললো,
“আমাকে মিথ্যে বলার কোনো প্রয়োজন নেই মেয়ে। আমি জানি, তোমাদের মধ্যেকার সম্পর্ক কতটা গভীর আর তোমাদের মধ্যে ঠিক কি কি হয়েছে।”
চোখ বড় বড় করে ফেলল শ্বেতা।
“অবাক হচ্ছ নাকি যে আমি কিভাবে জানলাম? অবাক হওয়ার কিছুই নেই। আমি সব জানি—আমার স্বামীর সাথে তোমার ঠিক কি কি টাইপের সম্পর্ক ছিল, আমি সব জানি। তোমাদের মধ্যে কি কি হয়েছে, আমি তাও জানি। কিন্তু সবকিছু পরেও আমি চাই আমার সংসারটা টিকে থাকুক।”
শ্বেতা বিস্ময় কাটিয়ে উঠে বলল,
“আপনি ভুল ভাবছেন। আবির্ভাবের সাথে আমার কোন ফিজিক্যাল রিলেশন ছিল না।”
“তাই তুমি অস্বীকার করতে পারো তোমার আর আবির্ভাবের মধ্যে সম্পর্ক আছে?”
“হ্যাঁ, পারি। কারণ আবির্ভাবের সাথে এখন আর আমার কোন সম্পর্ক নেই।”
“মিথ্যেবাদী মানুষ আমার পছন্দ নয় মেয়ে। সম্পর্ক নেই বলেই বুঝি, পাপা থাকতে ও আমার স্বামীর কোলে চেপে জঙ্গল থেকে ঘরে এলে?”
“আপনি ফলো করছিলেন?”
“সেসবের উত্তর আমি তোমায় দিতে বাধ্য নই। তুমি শুধু আমার স্বামীর সাথে কোনো সম্পর্ক রাখবে না, ভালোবাসবে না। তাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা তো মোটেই করবে না।”
শ্বেতার ভেতরটা কেমন মুচড়ে উঠলো। চোখের কোনে পানি চলে এলো অজান্তেই। দম আটকে বললো,
“আপনি বিশ্বাস না করলে সেটা আপনার ব্যাপার। কিন্তু সত্যি এটাই—আবির্ভাবের সাথে আমার আর কোনো সম্পর্ক নেই। তবে এটা সত্যি, আমি আবির্ভাবকে ভালোবেসেছিলাম, এখনো ভালোবাসি, আর ভবিষ্যতেও ভালোবাসবো। এটা অপরিবর্তনীয় সত্যি, যেটা আমি অস্বীকার করতে চাই না।”
শ্বেতার স্বীকারোক্তিতে গরম কড়াইয়ে পানির ঝাপটা লাগার মত অনুভূতি হল। দেবির তীব্র ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল,
“নির্লজ্জ মেয়ে, তোমার লজ্জা করছে না কথাটা বলতে? আবার গৌরব করে বলছো, তুমি অন্যের স্বামীকে ভালোবাসো?”
“হ্যাঁ, বলছি। কারণ আমি সত্যি ভালোবাসি। আর ‘অন্যের স্বামী’কে ভালোবাসিনি। আমি কোনো বিবাহিত পুরুষকে ভালোবাসিনি। আমি একজন অবিবাহিত ব্যাচেলর পুরুষকে ভালোবেসেছিলাম। ভাগ্যের ফেরে সে আমার হয়নি। কিন্তু তাই বলে তো আর আমার ভালোবাসা পরিবর্তন হয়ে যাবে না!”
“বিবাহিত পুরুষদের প্রতি যে মেয়েরা আকর্ষণ অনুভব করে, তাদের কি বলা হয় জানো তো?”
হাত মুঠি বদ্ধ করে ফেললো শ্বেতা।
“ভদ্রভাবে কথা বলুন দেবি।”
“ভদ্রভাবেই তো বলছিলাম। কিন্তু ভদ্রতার মূল্য আর পেলাম কোথায়?”
“এটা আপনার সমস্যা। আপনি নিজের স্বামীকে বিশ্বাস করতে পারেন না, তাই আপনাকে আমার কাছে আসতে হচ্ছে।”
“বাহিরে অবৈধ সম্পর্কে জড়ানো পুরুষের কি আর ঘরের বউ ভালোলাগে?”
“চুপ করুন! আবির্ভাবকে নিয়ে একটা নোংরা শব্দ ও আমি কারো মুখ থেকে শুনতে চাই না। সে এমন মানুষ নয়!”
“বাহ, আমার স্বামীকে দেখছি আমার থেকে ভালো তুমি চিনো!”
“হ্যাঁ চিনি। আর আপনার এত রাগ কেন? আমি সেটাই বুঝতে পারছি না। আপনি তার বউ—আপনার কিসের এত ইনসিকিউরিটি?”
“হ্যাঁ, এটা সত্যি, আমি তার বউ। অগ্নিসাক্ষী করে সম্পূর্ণ বৈধ উপায়ে বিয়ে করেছে আমায়। কিন্তু তুমি তো…”
মুচকি হাসলো শ্বেতা। আড়ষ্ট কণ্ঠে বলল,
“আবির্ভাব আমাকে ‘বউ’ ডেকেছিলো ঠিকই, কিন্তু বউ বানায়নি।”
“আচ্ছা ছাড়ো, কাজের কথায় আসি।”
শ্বেতা প্রশ্নসূচক দৃষ্টি নিক্ষেপ করলো।
ঠোঁটে বক্র হাসির দেখা মিলল দেবির মুখে। সে নিজের মোক্ষম চালটা ফেলে বলল,
“তুমি যদি আমার স্বামীর থেকে দূরে না যাও, তাহলে এই ছবিগুলো তোমার বাবা, মা, ভাই, মামা সবার হাতে পৌঁছে যাবে। আমি নিজ দায়িত্বে সবার হাতে হাতে পৌঁছে দেবো।”
হাতের ছবিগুলোর দিকে ইশারা করে বললো দেবি।
ছবিগুলো দেখে চোখ ভিজে উঠলো শ্বেতার। বুকটা খাঁ খাঁ করে উঠলো চৈত্রের দুপুরের ন্যায়। সে আবেগাপ্লুত হয়ে ছবিগুলো নেওয়ার জন্য হাত বাড়িয়ে দিতেই, দেবী হাত সরিয়ে ফেললো। বাঁকা হেসে বললো,
“উহু, ওদিকে হাত দেওয়া বারণ। এখন তুমি ভেবে বলো, তুমি কী করবে?”
শ্বেতা অশ্রু চোখে অনুনয় করে বলল,
“প্লিজ, ছবিগুলো আমাকে দিয়ে দিন। এগুলো আপনি কোথায় পেলেন?”
“পেয়েছি, যেখানে পাই।”
“ওগুলো আমাকে দিয়ে দিন।”
“তোমার কি আমাকে গাধা মনে হয়, যে এগুলো আমি তোমায় দিয়ে দেবো? এগুলো আমার কাছেই থাকবে। তুমি আমাকে বলো, তুমি কি আমার কথামতো চলবে, নাকি এগুলো আমি তোমার গার্ডিয়ানের হাতে পৌঁছে দেবো?”
ভয়ে বুকের রক্ত জমে হিম হয়ে যায় শ্বেতার। আতঙ্কিত কণ্ঠে মিনতি করে বলল,
“প্লিজ, অনুরোধ, ওগুলো কাউকে দেখাবেন না। ভুলেও না। ওরা সবাই মিলে আবির্ভাবকে মেরে ফেলবে।”
“কেন, তোমাদের বংশ খুনি নাকি?”
শুষ্ক ঢোঁক গিললো শ্বেতা। হাঁসফাঁস করে উঠলো। কাঁপা কণ্ঠে বলল,
“আপনি যা বলবেন, আমি তাই শুনবো। যা করতে বলবেন, আমি তাই করবো। শুধু এই ছবিগুলো কাউকে দেখাবেন না, কাউকে না মানে কাউকে না। নাহলে সব হারাবেন আপনি আর সব হারাবো আমি।”
“সে যাই হোক, আমার কথা শুনে চললেই হলো।”
“বলুন আমায় কী করতে হবে?”
“বেশি কিছু না, শুধু সেজেগুজে বিয়ে করতে হবে।”
দেবির শর্তে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো শ্বেতার। চেচিয়ে উঠে বলল,
“What!”
“হ্যাঁ, বিয়ে করতে হবে। একমাত্র তুমি বিয়ে করে নিলেই আমি নিশ্চিন্ত হতে পারবো।”
“এ অসম্ভব! আমি কিছুতেই বিয়ে করতে পারবো না!”
“তাহলে?”
রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না শ্বেতা। চিৎকার দিয়ে বললো,
“আপনি প্রচণ্ড খারাপ মহিলা জানেন! যে নিজের বরকে বিশ্বাস করে না।”
“সে তুমি আমাকে যা ইচ্ছা তাই বলতে পারো, I don’t care. কিন্তু বিয়ে তো তোমায় করতেই হবে। তোমার বিয়ে আমার সংসারের জন্য সঞ্জীবনী। তুমি অন্যের হয়ে গেলে, আবির্ভাব ও আমার হয়ে যাবে।”
“আমি বুঝলাম না, ২.৫ বছর পর আপনি কেন আমার পিছনে পড়লেন? অভির্বাবের সাথে সম্পর্ক তো আপনার বিয়ের আগেই শেষ হয়ে গেছে। এসব থেকে মুক্তি দিন আমায়।”
“কিছু শেষ হয়নি।”
“মানে?”
“তোমার জানা লাগবে না। যা বললাম তাই করো।”
“পারবো না।”
“তাহলে বলেই দিই সবাইকে।”
“আপনি আমার ঘর থেকে এখনই বেরিয়ে যাও।”
“যাচ্ছি। কিন্তু ভেবে দেখো। ২৪ ঘণ্টা সময় দিলাম তোমায়। এর পর আমি শুনতে আসবো তোমার জবাব।”
“যদি হ্যাঁ হয় তো ভালো, আর না হলে…”
বকা হেসে চলে গেলো দেবী।
শ্বেতার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। সে এখন অন্য কাউকে বিয়ে করবে—এ অসম্ভব! মরে যাবে শ্বেতা। প্রয়োজনে গলায় দড়ি দেবে, তবু ও অন্য কাউকে কবুল বলতে পারবে না।
যেখানে মনের সবটা জুড়ে কেবল আবির্ভাব, সেখানে অন্য কাউকে গ্রহণ করা শ্বেতার নিকট বিষ পান করার চেয়ে ও যন্ত্রণাদায়ক।
আর ওই ছবিগুলো যদি মা বা মামুদেত হাতে পড়ে যায়…
ভয়ে সিঁওরে উঠলো শ্বেতা।
“অভির্বাব, তোমাকে ভালোবাসার পরিণাম এতো খারাপ কেন হলো? বলতে পারো কী করবো আমি?”
“তোমাকে না পাওয়ার বিষ তো আমি পান করেছিলাম, সে বিষের জ্বালাই সহ্য করতে পারছি না — সেখানে তোমার আপদ আমাকে খুন করতে চায়!”
বিকেল ঘড়িয়ে সন্ধ্যা প্রায় লাল মরিচ বাতির আলোয় ঝিলমিল করছে পরিবেশ।
পুরো বাড়ি সেজে উঠছে লাল রঙে। নানাবিধ ও গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের আগমন ঘটছে বিশেষ মুহূর্তে। দেশ-বিদেশের অনেক প্রেস মিডিয়া কর্মীও আছেন। অতিথি আপ্যায়নে নিজেদেরকে উজাড় করে দিচ্ছে শিকদাররা।
বাড়ির বাইরের ব্যস্ততার পাশাপাশি ভেতরেও চলছে হরদম ব্যস্ততা। রান্নাঘরে চলছে বিশেষ অতিথি আপ্যায়ের আয়োজন।
তৃধা কালো মিষ্টিগুলো মাঝ বরাবর কেটে তার মধ্যে ভরে ভরে লংকার গুঁড়ো ঢুকাচ্ছে।
শ্বেতা শরবতে নুন মিশাচ্ছে, আর দীপ্তি মরিচের পুর দেওয়া সিঙাড়া ভাজছে।
রাইমা এই সব কাণ্ড দেখে বললো,
“এসব কী করছো তোমরা? খাবার নষ্ট করছো কেন?”
দীপ্তি ভাব নিয়ে বললো,
“আরে ধুর বোকা! এগুলোকে নষ্ট বলা যায়? এগুলো হচ্ছে স্পেশাল অতিথিদের জন্য স্পেশাল আপ্যায়ের ব্যবস্থা!”
“স্পেশাল অতিথি?”
“হ্যাঁ, আমাদের সুইট সুইট বেয়াই সাহেব দের জন্য ঝাল ঝাল সিঙাড়া!”
“হুম, তাহলে অন্য মেডিসিন কেন মিশাচ্ছো না?”
“কী মেডিসিন?”
“দাঁড়াও, নিয়ে আসছি!” — বলে দৌড় দিয়ে উপরে চলে গেলো রাইমা। দুই মিনিটের মধ্যেই একটা ছোট কাচের শিশি নিয়ে এসে বললো,
“এই যে, একবার খেলে আর হাতের পানি শুকাবে না!”
“ওয়াও! গ্রেট সিস্টার!”
প্রিয়তা ও প্রেরণাকে আলাদা আলাদা ঘরে তৈরি করছে মেয়েরা।
শুদ্ধ ও সাদাফকে আলাদা আলাদা কক্ষে তৈরি করছে ছেলেরা।
খাটের উপর সর্বত্র ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন ডিজাইনের ভারি ভারি শাড়ি, জুয়েলারি, মেকআপ প্রোডাক্ট ইত্যাদি।
সবার মধ্যমণি হয়ে বসে আছে টুকটুকে মেরুন বেনারসি পরিহিত নববধূ।
তার সর্বাঙ্গে যেন রাজকীয় রূপের জৌলুস ছড়িয়ে পড়ছে।
তাকে নিজের হাতে যত্ন করে সাজিয়ে দিচ্ছে শ্বেতা, ইনায়া, উষা ও আরো অনেকে।
মেকআপ আর্টিস্ট আনার কথা হয়েছিলো, কিন্তু শুদ্ধ সাফ বারণ করে দিয়েছে।
তার ভাষ্যমতে —
“তার পরীর মত বউকে রঙচঙ মাখিয়ে সঙ সাজানোর কোন প্রয়োজন নেই।”
ইনায়া, প্রিয়তার হাতে মোটা মোটা স্বর্ণের বালা পরাতে পরাতে বললো,
“বান্ধবী, তোকে আজ কি যে কড়া লাগছে মাইরি! বলে বুঝতে পারবো না, মনে হচ্ছে তোর জামাইকে সরিয়ে আমি নিজেই বিয়ে করে নি !”
শুভ্রতা টিটকারি মেরে বললো,
“ধুর ভাবি! সুন্দর করে বল — পড়ে না চোখের পলক, কি তোমার রূপের ঝলক! দুহাই লাগে, মুখটা তোমার একটু আঁচলে ঢাকো, আমি জ্ঞান হারাবো, মরে যাবো, বাঁচাতে পারবে নাকো!”
“তোর সব সময় ঢং!” — মাথায় গাট্টা মেরে বললো থিরা।
শ্বেতা, প্রিয়তার নীলাভ চোখে কাজল আঁকতে আঁকতে বললো,
“সত্যি ভাবি, আজ তোমাকে সত্যি সত্যি আমার ভাবি লাগছে। আমার দাদার কত বছরের অপেক্ষার অবসান ঘটতে চলেছে ফাইনালি।”
ওদের কথার মধ্যেই ঘরে প্রবেশ করলেন গুলবাহার বানু।
কুঁজো হয়ে এগিয়ে এসে বললেন,
“সর তো নডিরা, আমায় দেখতে দে — কেমন দেকাচ্ছে আমার নাতনীকে?”
ওরা সকলে সরে গেলো।
গুলবাহার বানু প্রিয়তার রূপ দেখে মুখ হা করে ফেললেন।
মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বলে উঠলেন,
“ঠিক এমনি একটা লাল টুকটুকে বধূ আমি দেখেছিলাম প্রায় ৬৮ বছর আগে। ঠিক অবিকল এমনি দেখতে ছিলো — সেই নাক, সেই চোখ, সেই মুখ, সেই ঠোঁট, সেই চেহারা… হুবহু আমার সই আনজুম নাহার!”
“আনজুম নাহার? কে?”
“আমাদের দাদী — পাশ থেকে ফুরন কেটে বললো থিরা।
পৃথা বললো,
“হ্যাঁ, প্রিয় তো একদম আমাদের দাদীর মতো দেখতে। আব্বু-চাচ্চুরা তো সব সময় বলেন, প্রিয়তা নাকি উনাদের মায়ের মতো হুবহু।
শুধু দাদীর গায়ের রঙ হালকা চাপা ছিলো, আর চোখটা কালো ছিলো, শুনেছি।”
গুলবাহার বানু ও সায় জানালেন।
পৃথা পুনরায় বললো,
“হ্যাঁ, প্রিয় — আর মেজদার চোখ তো সেজো আম্মুর মতো নীল, দাদীর চোখ শুনেছি ছিলো কালো।”
গুলবাহার বানু প্রিয়তার ললাটে চুম্বন আঁকলেন।
মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
“আমি বুড়ো হয়ে গেছি সই… কিন্তু তুই এখনো ঠিকই জুয়ান আছিস। হ্যাঙ্গগা ও করতে চলেছিস!”
প্রিয়তা কিছু বললো না, কেবল চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে রইলো সবার দিকে।
“এই! তুমাদের হলো?” — বলে দরজায় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো পৃথম।
ব্যস্ত কণ্ঠে তাড়া দিয়ে বললো,
“কাজী সাহেব এসে গেছেন।”
কথা বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গেলো পৃথম।
তার দৃষ্টি পড়লো বোনের পানে।
না চাইতেই চোখ ভিজে উঠলো তার — তার সেই ছোট্ট বোনটা কত বড় হয়ে গেছে। আজ পর হয়ে যাবে।
পৃথম ধীর কদমে এগিয়ে এলো প্রিয়তার নিকট।
প্রিয়তা মাথা নিচু করে বসে আছে।
পৃথম সামনে বসে আলতো করে হাত রাখলো বোনের মাথায়।
ফট করে দৃষ্টি তুললো প্রিয়তা।
পৃথম চোখের পানি ধরে রাখতে পারলো না।
বোনকে বাহুতে ঝাপটে ধরে হুহু করে কেঁদে উঠলো।
নিচু মস্তকে বললো,
“তোর এই নিকৃষ্ট ভাইটাকে মাফ করে দিস সোনা।
তোর ভাইয়া তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছে, দিচ্ছে।
জেনে না জেনে অনেক কটু কথা বলেছে।
তুই সেসব মনে রাখিস না।
বোন, বিশ্বাস কর — আমার হাতে আর দ্বিতীয় কোন রাস্তা ছিলো না।
দেখিস, তুই একদিন অনেক সুখী হবি।”
প্রিয়তা কিছু বললো না।
কেবল নির্বিকার হয়ে তাকিয়ে রইলো পৃথম এর পানে।
“সর তো ভাই, আমগোরে বইতে দে!” — বলে পাশে বসে পড়লেন গুলবাহার বানু।
ইনায়ার উদ্দেশে বললেন,
“এই মেজো বউ, ওর মাথায় ঘোমটা টেনে দে।
আর পুয়াতি মানুষ — বেশি ছুটা-ছুটি করবি না।”
ইনায়া মাথা নাড়ালো।
সুন্দর মতো লাল টুকটুকে বিয়ের উর্ণাটা নাক অবধি টেনে দিলো।
“আমার বড়ো নাতনী কি তৈরি হইচে?”
“জি নানী।”
“নাতি, যা — জামাইরে নিয়ে যা। আমরা আইতাছি।”
পৃথম উঠে চলে গেলো।
বিবাহ আসরের বাইরে বিরাট ক্যাচাল লেগে গেছে।
টাকা নিয়ে কনে পক্ষের দাবি মানতে নারাজ বর পক্ষ।
মেয়েদের পক্ষে, মেয়েরা —
ছেলেদের পক্ষে, ছেলেরা।
“যা বল্লাম, তাই হবে! ৫০,০০০ টাকার নিচে এক পয়সাতেও আপোষ করা হবে না!” — হাত ভাজ করে বললো তৃধা।
“গুনে গুনে ৫০,০০০ — ঐ চাই!”
“আহ বেয়ান সাহেব, আমরা ভদ্রলোক। আর ভদ্রলোকের এক কথা। আপনাদের টাকা দেওয়া হবে, তবে এক শর্তে।”
বাকা হেসে বলল অরণ্য।
শ্বেতা ভ্রু নাচিয়ে শুধালো,
“কি শর্ত?”
“শর্ত এটাই — ভদ্র লোকের এক কথা! তাই আমরা ঠিক ৫০,০০০ টাকাই দেবো। কিন্তু ভেতরে না ঢোকা পর্যন্ত খাম খুলে দেখা যাবে না!” — তাল মিলিয়ে বলল ইরফান।
“আপনাদের কি মনে হয়, বেয়াই সাহেব — আমরা দুই বেলা ঘাস খাই?”
“নিশ্চিত বলতে পারছি না বেয়ান সাহেব, কিন্তু হতে তো পারে!”
“এত চালাকি করার দরকার নেই আপনাদের। আপনারা চুপ থাকুন। দুলাভাই, ৫০,০০০ টাকা দিন। আপনার বউ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে!”
শুদ্ধ কিছু বলতে গেলেই ছেলেরা তাকে চেপে ধরলো।
“একদম চুপ! বর, বরের মতো মুখে রুমাল চেপে চুপ করে থাকো!”
“তো বেয়ান সাহেব, বেশি দর কষাকষি করলে আমরা ছেলে দেবো না!”
“আমরাও মেয়ে দেবো না!”
“ভাবুন, বেয়ান সাহেব!”
শ্বেতা কিছুক্ষণ ভেবে বলল,
“ওকে, টাকাটা দিন!”
ছেলেরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
ইরফান একটা টাকা ভর্তি খাম এগিয়ে দিলো।
শ্বেতা সেটা ধরতে নিলে ইরফান হাত সরিয়ে নিলো।
চতুর কণ্ঠে বললো,
“চালাকি চলবে না, বেয়ান সাহেব! কাঁচি দেন, টাকা নেন!”
“হেহে, থাক! একটু পরেই নেই। অনেকক্ষণ হাকা-হাকি করে বেয়াই সাহেবদের গলা নিশ্চই শুকিয়ে গেছে!”
“নেন বেয়াই, মিষ্টি মুখ করুন!” — বলে একটা শরবতের গ্লাস ইরফানের হাতে তুলে দিলো শ্বেতা।
ইরফান ভ্রুকুটি করে গ্লাসটার দিকে তাকালো।
তন্ময় বললো,
“একদম ওটা খাবে না ইরফান ভাইয়া! ওটার মধ্যে নিশ্চিত ভেজাল আছে। রান্না ঘরে আমি নিজের চোখে দেখেছি ওদের কারসাজি করতে!”
“তাই নাকি?”
শ্বেতা চোখ রাঙালো তন্ময়কে।
ইরফানের সন্দেহভরা নজর দেখে চেহারায় একটা মায়াময় ভাব ফুটিয়ে তুললো শ্বেতা।
শ্বেতা ইরফানের হাত থেকে গ্লাস কেড়ে নিয়ে বলল,
“হায়, এতো অবিশ্বাস? থাক, আপনাদের খেতে হবে না। আমার দাদা খান!”
“দাদা, তুমি খাও!” — বলে গ্লাসটা শুদ্ধর হাতে ধরিয়ে দিলো।
শুদ্ধর তার বোনের প্রতি অগাধ বিশ্বাস।
তাই সে এক নিঃশ্বাসে ঢক ঢক করে পুরো গ্লাস খালি করে দিলো।
ছেলেরা হা করে দেখছিলো তার প্রতিক্রিয়া।
“ভাইয়া, এটা তুমি খেয়ে নিলে? না জানি কি না কি মিশিয়েছে!” — অবাক কণ্ঠে বললো রাদিফ।
শুদ্ধ রুমাল দিয়ে মুখ মুছে বললো,
“কই, কিছুই তো না। নরমাল অরেঞ্জ জুস!”
“আসলেই?” — ভ্রু কুঁচকে বললো ইরফান।
শুদ্ধ মাথা নারলো।
মেয়েরা একে অপরের দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসলো।
শ্বেতা এবার আরেকটা গ্লাস ইরফানের হাতে তুলে দিয়ে বললো,
“এবার নিশ্চই বেয়াই সাহেবের খেতে কোনো আপত্তি নেই? চলুন, আমি মিষ্টি মুখ করিয়ে দিচ্ছি!”
— বলে একটুকরো মিষ্টি ইরফানকে খাইয়ে দিলো শ্বেতা।
সাথে সাথে মুখ চেপে ধরে গ্লাসের শরবতটুকুও খাইয়ে দিলো।
ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটলো যে ছেলেরা কিছু বুঝতেই পারলো না।
কিন্তু অদ্ভুতভাবে ইরফান কোনো রিঅ্যাক্ট করলো না।
খেয়ে বললো,
“বাহ! এত ভালো মিষ্টি! লাইফে প্রথমবার খেলাম — টেস্টবারই চেঞ্জ হয়ে গেলো!”
মেয়েরা একটু অবাক হলো।
পরপর দু’জনকে খেয়ে ঠিক থাকতে দেখে সাহস পেলো ছেলেটাও।
দীপ্ত বললো,
“তাহলে আমরাই বা কী দোষ করলাম? আমরাও মিষ্টি মুখ করতে চাই!”
“নিশ্চই করবেন, বেয়াই সাহেব! তার আগে টাকাটা দিন।” — খামটা ত্রিধার হাতে তুলে দিলো অরণ্য।
তারপর মিষ্টি আর শরবতের উপর একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়লো ছেলেরা।
কিন্তু এক বাইট গালে পড়তেই…
নাচ শুরু হয়ে গেলো তাদের!
“ঝাল!” — বলে চিৎকার করে উঠলো অরণ্য, সাদিফ সহ আরও অনেকে।
“ওয়াক ওয়াক!” করতে করতে দৌড় দিলো ওয়াশরুমের দিকে।
ওদের এই হাল দেখে মেয়েরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো।
সেই সুযোগে ফিতা কেটে ভেতরে ঢুকে গেলো ইরফান।
অতঃপর মেয়েরা একত্র হয়ে টাকার খামটা ছিঁড়ে ফেললো।
কিন্তু ভেতর থেকে যা বেরিয়ে এলো —
তা দেখে যেন সকলের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো!
খামের ভেতর ছিলো খালি কাগজের বান্ডিল।
তার উপর হাতে লেখা —
❝ ৫০০ টাকা ফর বেয়ান সাহেব ❞
দুই পক্ষই একে অপরকে বাঁশ দিল আচ্ছামত।
বর বেশে শুদ্ধ ও সাদাফকে নিয়ে আসা হলো পুষ্পসজ্জিত আলো ঝলমলে বিবাহ আসরে। যার মাঝ বরাবর বেলি ফুলের প্রশস্ত পর্দা টানানো। মাথার উপর ঝুলছে বিশাল এক ক্রিস্টাল ঝাড়বাতি, যার মাধুর্যে ভরে উঠেছে পরিবেশ। পর্দার আড়ালে নারীদের এবং পর্দার সম্মুখে পুরুষদের বসার সুব্যবস্থা করা হয়েছে।
কাজী সাহেব এসে গেছেন। শুদ্ধকে এনে বসানো হয়েছে পুষ্প পর্দার সম্মুখে। পর্দার অপর প্রান্তে গোলাকৃতির বিশাল এক কাঁসার পাত্র, যার মধ্যেকার টলটলে পানি দুলে উঠছে ক্ষণে ক্ষণ।
সকল মুরুব্বিদের উপস্থিতিতে কাজী সাহেব ডাকলেন,
“কই, মেয়েকে নিয়ে আসুন।”
সঙ্গে সঙ্গে ঘোমটা পরিহিত দুজন নববধূকে এনে পর্দার অপর প্রান্তে বসানো হলো।
কাজী সাহেব রাশভারি কন্ঠে বললেন,
“সকলে কি উপস্থিত জনাব?”
পাশে দাঁড়ানো ব্যক্তি নমনীয় কন্ঠে জবাব দিলেন,
“জ্বী না হুজুর, কন্যার পিতা এখনো অনুপস্থিত।”
“তাহলে উনাকে নিয়ে আসুন।”
“জি, আজ্ঞে হুজুর।”
একজন চলে গেলেন সাজিদ শিকদারকে আনতে।
কাজী সাহেব এবার নবযুগলদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
“হবু স্বামী-স্ত্রীরা কি বিবাহের পূর্বে একে অপরকে কিছু জানাতে ইচ্ছুক? যদি বলার থাকে, বলতে পারেন।”
কাজী সাহেবের নির্দেশের সাথে সাথে বেলি ফুলের পর্দাটা মাঝখান থেকে সরিয়ে নেওয়া হলো। তার আড়াল হইতে দৃশ্যমান হলো ফিনফিনে পাতলা আরেকটি পর্দা।
শ্বেতা শুদ্ধের কানে কানে বললো,
“ভাবির দিকে ভুলেও মুখ তুলে তাকাবে না দাদা।”
“তাহলে আমার রমণীকে দেখো কিভাবে?”
“ওই যে ওখানে দেখো।” — বলে কাঁসার পাত্রটির দিকে ইশারা করলো শ্বেতা।
শুদ্ধের ভেতরটা কেমন ধরাস ধরাস করছে উত্তেজনায়। সে তার নববধূকে দেখার তৃষ্ণায় আকুল দৃষ্টি নিক্ষেপ করল স্বচ্ছ জলের পাত্রে। সাথে সাথেই চোখ আটকে গেল, শুদ্ধের হৃৎপিণ্ডটা কেমন অষাঢ় হয়ে এলো অনুভূতিতে। দেখা মিললো এক অভূতপূর্ব জৌলুসময় নারী প্রতিবিম্বের।
রূপের মোহে বিভোর, সে হারিয়ে গেল অন্য দুনিয়ায়। ঘোরের মাঝেই কানে লাগলো সুরেলা কন্ঠ—
“আসসালামুয়ালাইকুম ডাক্তার সাহেব।”
কণ্ঠটা যেন কান দিয়ে ঢুকে হৃৎপিণ্ডে দাগ কাটলো শুদ্ধের। সে আসক্ত কণ্ঠে উত্তর করলো,
“ওয়ালাইকুমাসসালাম বেগম।”
“সাদি মুবারক ডাক্তার সাহেব।”
“ইশক মুবারক বিবিজান।”
উপস্থিত সকলে প্রসন্ন হলেন।
কাজী সাহেবের নির্দেশে বিবাহ আসরে এসে উপস্থিত হলেন সাজিদ শিকদার। তার কয়েক মুহূর্ত পর উপস্থিত হলো প্রণয়। তার চোখ মুখে ক্লান্তির ছাপ। তবে তার উপস্থিতি বোধ হয় কারোরই কাম্য ছিল না। অপ্রস্তুত বোধ করলেন সকলে। প্রণয়ের মুখটা দেখে যেন তাদের সবটুকু আনন্দ মিলিয়ে গেলো।
সাজিদ শিকদার পর্দার অন্য প্রান্তে মেয়ের পাশে গিয়ে বসলেন। বাড়ির সকলে বার বার আড় চোখে তাকাচ্ছে প্রণয়ের দিকে। সকলেই যেন আশা করছিল তার উন্মাদনা দেখার। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে সে সম্পূর্ণ শান্ত। পরিবারের মানুষ থেকে দূরে, আলাদা এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে। তার শূন্যদৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে পর্দার অপরপ্রান্তে।
এখানে দাঁড়িয়েও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে মেরুন বেনারসি পরিহিত নববধূর স্নিগ্ধ মুখ। তবে তার চোখ-মুখ দেখে ভেতরের পরিস্থিতি বোঝার উপায় নেই। এক ফাঁকে চুপি চুপি তার পাশে এসে দাঁড়ালো প্রহেলিকা।
কাজী সাহেবের নির্দেশে পুনরায় ফুলের পর্দা মাঝখানে টানিয়ে দেওয়া হলো। সাথে সাথেই আড়াল হয়ে গেল সেই মায়া ভরা মুখ। বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন কাজী সাহেব।
“প্রথমে কোন দম্পতিকে বিবাহ পড়ানো হবে?” — সাদমান সিকদারের উদ্দেশ্যে জিজ্ঞাসা করলেন কাজী সাহেব।
“প্রথমে আমি।”
কেউ কিছু বলার পূর্বে বলে উঠলো শুদ্ধ। সকলে ও সায় জানালেন।
কাজী সাহেব বললেন,
“আজ্ঞে, দেনমোহর কত বাঁধবো?”
“বাঁধুন, আপনার যত ইচ্ছা।”
“এভাবে হয় না বাবা, এটা একটা নিয়ম। কন্যার সব দিক বিবেচনা করে দেনমোহর বাধা হয়।”
“আপনি লিখুন ১০ লক্ষ ১ টাকা।” — পর্দার ওপর প্রান্ত থেকে বললেন সাজিদ শিকদার।
“জি, আজ্ঞে।”
> (খুতবাতুন নিকাহ পড়া শুরু হয়)
সকল প্রশংসা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের…
…আমরা আজ একটি বরকতময়, হালাল এবং সুন্নাহ সম্মত বিবাহ সম্পন্ন করতে যাচ্ছি।
সকলেই একত্রে বলে উঠলেন,
“আমিন।”
> সূরা ফাতিহা এবং খুতবাহ পাঠ শেষে…
“আমি, পাত্রীর ওয়ালি (বাবা) সাজিদ শিকদার-এর পক্ষ থেকে, উনার কন্যা তনয়া শিকদার প্রিয়তা-কে, মোহরানা ১০,০০,০০১ টাকা ফাতেমি মোহর ধার্য করিয়া, ফারহান চৌধুরীর একমাত্র পুত্র আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ-এর সহিত ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী নিকাহের প্রস্তাব দিচ্ছি।”
“আপনি কি আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ-কে ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী স্বামী রূপে কবুল করছেন? যদি করে থাকেন, তাহলে তিনবার বলুন ‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল’?”
পর্দার অপর প্রান্ত থেকে কিছুক্ষণ কোন শব্দ এলো না।
কাজী সাহেব বললেন,
“বলুন মা, কবুল।”
পর্দার অপর প্রান্ত থেকে আচমকা ফুঁপানোর শব্দ শোনা গেল। সাজিদ শিকদার মেয়ের মাথায় হাত রাখলেন। আদুরে কণ্ঠে বললেন,
“বল মা, কোনো মেয়েই সারা জীবন বাবার কাছে থাকতে পারে না, কারো বাবাই চিরকাল বেঁচে থাকে না। স্বামী হয় তার সর্বোচ্চ আপন।”
প্রিয়তা অশ্রু চোখে তাকালো বাবার দিকে।
অতঃপর কাঁপা কণ্ঠে সম্মতি জানালো,
“জী, আমি কবুল করছি।”
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
“সুবহান আল্লাহ। আবার বলো মা, কবুল।”
“জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
“মাশাল্লাহ, আবার বলো মা, কবুল।”
“জ্বী, আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
সকলেই একত্রে বলে উঠলেন,
“আলহামদুলিল্লাহ।”
নিঃশ্বাস ফুরিয়ে এলো এক পুরুষের। শ্বাসকষ্ট শুরু হলো বোধহয়। মস্তিষ্কে উন্মাদনা ছেয়ে গেল।
এবার কাজী সাহেব শুদ্ধের উদ্দেশ্যে বললেন,
“আমি ফারহান চৌধুরীর পুত্র আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ-কে, সাজিদ শিকদারের একমাত্র কন্যা তনয়া শিকদার প্রিয়তা-কে ১০,০০,০০১ টাকা দেনমোহর নির্ধারণ করিয়া, ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী স্ত্রী রূপে স্বীকার করিতে সম্মত আছেন? যদি থাকেন, তাহলে তিনবার আলহামদুলিল্লাহ কবুল বলুন।”
শুদ্ধ ভেবেচিন্তে মোটেও সময় নষ্ট করলো না, এক নিঃশ্বাসে বলে দিল,
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
আবারও সকলে একত্রে বলে উঠলেন,
“আলহামদুলিল্লাহ।”
দারদ মোবারক, মিস্টার আবরার সিকদার প্রণয়।
প্রণয়ের কানের কাছে হঠাৎ ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো প্রহেলিকা, তার ওষ্ঠকোণে চিকন বিজয়ী হাসি।
প্রহেলিকা বাঁকা হেসে বলল,
“তোমার এই পরিণতি দেখে আমার বড্ড মায়া লাগছে প্রণয়। দেখো দেখো, চোখ মেলে দেখো, তোমার এত বছরের এত এত ভালোবাসার, এত এত আত্মত্যাগের শেষ পরিণতি।
আমাকে ভালবাসলে আজ তোমায় এই দিনটা দেখতে হতো না।”
শ্বাসরুদ্ধকর বুকের ব্যথায় প্রণয়ের বোধ হচ্ছে বুকের ভেতর হৃদপিণ্ডটা কেউ টুকরো টুকরো করে কাটছে।
সে নিরীহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলো প্রহেলিকার উল্লাস।
মাত্র কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে সে আজ সত্যি সত্যি নিঃস্ব হয়ে গেল, চিরতরে হারিয়ে ফেলল নিজের সুখ।
পুষ্পাবৃত পর্দাটা সরিয়ে ধবধবে ফর্সা ললাটে প্রথম হালাল চুম্বন এঁকে দিল শুদ্ধ।
প্রণয় শ্বাস আটকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল সেদিকে।
অতঃপর মানুষের ভিড় ঠেলে বেরিয়ে গেল দুর্বল পায়ে। মাথা ঘুরছে তার অনবরত।
নিস্তেজ শরীরটা টেনে নিয়ে কিছু দূর এগোতেই হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল।
মুখ দিয়ে গলগলিয়ে উঠে আসলো তাজা রক্ত।
তীব্র যন্ত্রণায় বুক চেপে ধরে লুঠিয়ে পড়লো মাটিতে।
চোখের সামনের রঙিন পৃথিবীটা অন্ধকারে তলিয়ে গেল মুহূর্তেই।
নিভু-নিভ ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখলো গোল ফ্রক পরিহিত একটা ছোট্ট বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে, খিলখিল করে হেসে উঠছে তাকে দেখে।
দূরে দাঁড়িয়ে আধো আধো কণ্ঠে ডাকছে,
“প্রণয় ভাই…!”
প্রণয় ও হেসে ফেললো, হাত বাড়িয়ে মেয়েটাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করে বলল,
“তুমি কিভাবে ভাবতে পারো জান, আমি তুমি ব্যতীত বেঁচে থাকব?”
বলে বলতে নিস্তেজ হয়ে যায় প্রণয়।
চোখের পাতা বন্ধ হয়ে যায়।
তার পিছু নিয়ে ছুটে আসে প্রেম, প্রীতম, আবির্ভাব।
এই অবস্থা দেখে আর্তনাদ করে উঠে তারা।
আবির্ভাব ছুটে এসে ধরলো বন্ধুকে।
প্রীতম চিৎকার দিয়ে বললো,
“দ্রুত গাড়ি বের কর প্রেম!”
দৌড় দিলো প্রেম।
আবির্ভাব প্রণয়কে ঝাঁকিয়ে উন্মাদের মতো ডেকে বলল,
“প্রণয়! এই ভাই! এই ভাই! চোখ খুল! দেখ! বাল মেজাজ এমনি অনেক খারাপ, তুই আর খারাপ করবি না!”
কিন্তু একচুলও নড়লো না প্রণয়।
প্রেম গাড়ি নিয়ে আসতেই, আবির্ভাব ও প্রীতম ধরাধরি করে তুলল।
ক্রমাগত উঠে আসা টাটকা রক্তের স্রোতে মুহূর্তেই ধবধবে পাঞ্জাবীটা রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো প্রণয়ের।
তারা দুজন অনেক কষ্টে প্রণয়কে নিয়ে গাড়িতে বসালো।
নিজেরাও বসলো তার দুই দিকে।
প্রীতম চেঁচিয়ে বললো,
“১০ মিনিটের মধ্যে কাছের কোন হাসপাতালে নিয়ে চল প্রেম, যেভাবে পারিস!”
প্রেমও তাই করলো।
গাড়িতে সর্বোচ্চ গতি টেনে প্রাণপণ ড্রাইভ করতে লাগলো যেন তাদের নিজেদের জানের কোন মায়া নেই।
মাত্র ৩০ মিনিটের ব্যবধানে গাড়ি এসে পৌঁছালো ডিসি হাসপাতালের বাইরে।
প্রণয়ের অবস্থা বেগতিক দেখে তাকে দ্রুত আইসিইউতে দিলেন ডাক্তাররা।
ভাগ্য ভালো থাকায় শহরের সবচেয়ে বড় কার্ডিও স্পেশালিস্ট ডঃ অনিশ শর্মা এই হাসপাতালেই ছিলেন।
খবর পেয়ে দ্রুত ছুটে এলেন তিনি।
প্রণয়ের অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক।
আইসিইউর ভেতরে অনেক আধুনিক যন্ত্রপাতি সেট করে মুখে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে রাখা হয়েছে।
পাশের কার্ডিও মনিটরে হার্ট রেট দেখাচ্ছে ৪৫%।
প্রীতম ও প্রেম হাউমাউ করে কাঁদছে বাইরে বসে।
তাদের কাছে এক একটা মুহূর্ত এক একটি যুগসম দীর্ঘ মনে হচ্ছে।
আবির্ভাব ও ডক্টর শর্মার সাথে আইসিইউর ভেতর।
ঘণ্টা দুই-এক পর আইসিইউ থেকে বেরিয়ে আসেন ডক্টর শর্মা ও আবির্ভাব।
প্রীতম ছুটে যায় তাদের কাছে।
আবির্ভাবের চোখ মুখের অবস্থা ভালো নয়।
প্রেম আবির্ভাবের হাত চেপে ধরে কাঁদতে কাঁদতে জিজ্ঞেস করলো,
“বলুন না ভাইয়া, আমাদের দাদানের কি হয়েছে? ওভাবে মুখ দিয়ে রক্ত উঠছিলো কেনো?”
মূর্তির ন্যায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো আবির্ভাব।
তার নিজেরই মাথা ঘুরছে।
ডক্টর শর্মা প্রফেশনাল ভঙ্গিতে বললেন,
“দেখুন, আমরা উনাকে ব্লাড দিচ্ছি, সাথে প্রাথমিক চিকিৎসা ও দিয়েছি। সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি ওনার চাপ কমানোর।
কিন্তু আমার মনে হয়, আপনাদের উনাকে নিয়ে বিদেশে যাওয়া উচিত।
নাহলে আল্লাহ না করুক, যখন-তখন ভালো-মন্দ একটা কিছু হতে যেতে পারে।
অবস্থা খুবই খারাপ।”
ডক্টরের কথায় পা টলে গেলো প্রীতম ও প্রেমের।
আবির্ভাব প্রীতমের কাঁধে হাত রেখে বললো,
“অতিরিক্ত চাপ আর মানসিক যন্ত্রণা সইতে না পেরে ওর টাইপ ৩ কার্ডিও অ্যাটাক এসেছে, যাকে আমরা সাধারণ ভাষায় বলি মেজর হার্ট অ্যাটাক।
কিন্তু রিমেম্বার, এটা কোন সাধারণ হার্ট অ্যাটাক নয়। কারণ হার্ট অ্যাটাকে কখনোই মুখ দিয়ে রক্ত উঠে না।
কিন্তু ওর উঠেছে, কারণ দীর্ঘদিন ধরে স্মোকিং, ড্রিঙ্কিং এবং আল্ট্রা মেন্টাল প্রেশারের কারণে একটু একটু করে ধীরে ধীরে ভেতর থেকে দুর্বল হয়েছে ওর হার্ট,
আর প্রতিদিন প্রতিনিয়ত সেই মেন্টাল প্রেসারের মাত্রা বাড়েছে, আর আজ ফাইনালি সব সীমা অতিক্রম করাতে অ্যাটাক এসেছে।
এখন ইমার্জেন্সি সার্জারির জন্য ইউএসএ নিয়ে যেতে হবে।”
ডঃ শর্মা বললেন,
“বেস্ট কার্ডিও সার্জন ডঃ আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধ তো দেশেই আছেন।
উনার আন্ডারে চিকিৎসা নিতে পারতেন, কিন্তু আনফরচুনেটলি আজ উনার বিয়ে আর উনি ছুটিতে আছেন বেশ কিছুদিনের জন্য!”
“ইটস ওকে, ডক্টর। আমরা ইউএসএ নেওয়ার ব্যবস্থা করছি।”
“হ্যাঁ, তাই ভালো। যত দ্রুত সম্ভব তাই করুন।”
আবির্ভাব কথা শেষ করতে না করতেই তার ফোন বেজে উঠলো।
এই সময় কে ফোন করেছে ভেবে চরম বিরক্ত হলো আবির্ভাব।
পকেট থেকে ফোন করে দেখলো – শুদ্ধ ইজ কলিং।
আবির্ভাব কালবিলম্ব না করে ফোন রিসিভ করলো।
সাথে সাথেই অপর প্রান্ত থেকে বেসামাল কণ্ঠে শুদ্ধ বললো,
“প্রণয় কোথায়? আর তুই, তুই কোথায়?”
উত্তেজিত হলো না আবির্ভাব, ঠান্ডা মাথায় প্রত্তুত্তর করলো,
“কেনো? আমাদের দিয়ে কি কাজ?”
হঠাৎ কেন জানি রেগে গেল শুদ্ধ।
“দেখ, হেয়ালি করিস না। আমি ৩ ঘণ্টা যাবৎ প্রণয়কে খুঁজছি কিন্তু দেখতে পাচ্ছি না। কোথায় তোরা?”
আবির্ভাব কথা না বাড়িয়ে সোজা বললো,
“আমি একটু বাইরে আছি। আর প্রণয় দেশে নেই, ডেনমার্ক ব্যাক করেছে ৩ ঘণ্টা আগেই।”
“Whatttt!” — মৃদু কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো শুদ্ধ।
“হ্যাঁ, যাওয়ার সময় আমায় বলল তুই জিজ্ঞেস করলে তোকে বলে দিত।”
“আমাকে না জানিয়ে চলে যাবে? এটা হতেই পারে না! আমি বিশ্বাস করি না!”
“কেনো? সব সময় তোকে সবকিছু জানিয়ে করতে হবে কেনো? তোর তো আর ওর কাছ থেকে আদায় করার কিছু নেই। তোর যা চাই, তুই তো তা পেয়েই গেছিস। নিজের প্রাণটা তো তোকে উৎসর্গ করে দিয়ে যাচ্ছে। এখন কীভাবে বাসর করবি, সেটা দেখাতে চাস?
তোকে একটা অ্যাডভাইস দেই — ভালো হবে এখন প্রণয়কে খুঁজাখুঁজি না করে মন দিয়ে বাসর কর। নিজে ভালো থাক, ওকেও ভালো থাকতে দে। অযথা ওকে ফোন করে বিরক্ত করিস না, পাবি না। রাখলাম, বাসায় এসে কথা বলবো।”
বলে কট করে ফোন কেটে দিলো আবির্ভাব। শুদ্ধকে কিছু বলার সুযোগই দিল না।
“তুমি মিথ্যে কেনো বললে ভাইয়া?”
“তো সত্যি কি বলতাম? আমরা প্রণয়কে নিয়ে ইউএসএ যাচ্ছি — এটা বললে ও এক্ষুনি ছুটে আসতো। ওর আজকের স্বপ্নটা নষ্ট হয়ে যেত। যা হওয়ার, তা তো হয়েই গেছে। কোনো কিছুর মূল্যেই তা আর বদলানো যাবে না। তাহলে শুধু শুধু ওকে এগুলো শুনিয়ে পেরেশান করার কী দরকার? এগুলো শুনলে নিজেকে দোষ দেবে, হীনমন্যতায় ভুগবে, নতুন জীবনের স্বপ্নটা তার ফিকে হয়ে যাবে।”
প্রীতম অবাক চোখে দেখলো।
আবির্ভাব পুনরায় বলল,
“প্রণয় এত কিছু কেনো সহ্য করেছিল? এই পরিণয়ের পর যেন ওরা ভালো থাকে, ওরা সুখে থাকে, ওদের জীবনে যেন কোনো জটিলতা না আসে। তাহলে আজ সব শেষ হয়ে যাওয়ার পর ওকে এগুলো শুনিয়ে কোনো লাভ আছে? হুদাই পাগলামি করবে। এর থেকে বরং ওরা ভালো থাকুক, ওদের মতো।”
প্রীতম হুট করে জড়িয়ে ধরলো আবির্ভাবকে। কাঁদতে কাঁদতে বললো,
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৬৮
“আমার দাদান এই কয়দিন একদম ভালো ছিল না ভাইয়া। হাসিমুখে সব কাজ করেছে, তাও আমি বুঝতে পারতাম সে ভালো নেই। আমি নিজে দেখেছি কিন্তু কিচ্ছু করতে পারিনি। আমাদের বড় ভাইকে সুস্থ করে দাও ভাইয়া, আমাদের মাথার উপর তার হাতটা খুব প্রয়োজন।”
আবির্ভাব প্রীতমের কাঁধ চাপড়ে বললো,
“শান্ত হও। ঈশ্বর চাইলে সব ঠিক হয়ে যাবে।”