ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭১

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭১
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

শিকদার বাড়ির বিয়ে মিটেছে সপ্তাহ খানিক। অতিথি-আত্মীয়স্বজনের আর কেউই তেমন নেই—সকলেই যে যার নীড়ে প্রস্থান করেছেন,শিকদার বাড়ি ফিরে পেয়েছে তার পুরনো ছন্দ।
সকালের কর্মব্যস্ততায় ডুবে আছে বাড়ির তরুণ প্রজন্মের রমণীরা; সময় হতে চললো স্কুল, কলেজ, অফিসের।
কোমরের টাওয়াল পেঁচিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে শুদ্ধ।
দর্পণে তাকিয়ে সুচারু ভঙ্গিতে হেয়ার ড্রায়ার চালাচ্ছে ভেজা চুলে।
তার প্রশস্ত কাঁধ পিঠ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু স্বচ্ছ জলের দানা।
শুদ্ধ ভেজা শরীরে ফর্মাল শার্ট জড়াতে জড়াতে বাঁকা হেসে চেয়ে আছে বউয়ের পানে।
তার বউটা তার থেকেও বড় নির্লজ্জ।
শুদ্ধ ভেজা চুলে ব্যাক ব্রাশ করতে করতে দুষ্টু হেসে বললো –

“এভাবে চোখ দিয়ে ধর্ষণ করার কারণ কী জানতে পারি, বেগম?
আমি মাথা থেকে পা পর্যন্ত পুরোটাই আপনার—আপনি চাইলে প্র্যাকটিক্যালি ধর্ষণ করতে পারেন, আমি মোটেও মাইন্ড করবো না।”
প্রিয়াস্মিতা বিছানায় পায়ের উপর পা তুলে বসে চকলেট খেতে খেতে লোভাতুর চোখে গিলে খাচ্ছিল স্বামীর নগ্ন শরীর।
তবে শুদ্ধর এই শীতল আহ্বানে প্রিয়াস্মিতার সংযমের বাঁধ ভেঙে চূর্ণ হয়ে গেল।
সে রক্তিম ওষ্ঠে বক্র হাসি ঝুলিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল স্বামীর নিকট।
শুদ্ধ হেঁচকা টানে কোমর জড়িয়ে ধরল, নাকে নাক ঘষে দিয়ে বলল –

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

“আদর খাবে?”
প্রিয়াস্মিতা আদুরে বিড়ালছানার ন্যায় লেপ্টে রইলো শুদ্ধর সাথে, আহ্লাদী কণ্ঠে বলল –
“অনেক।”
শুদ্ধ হেসে বলল –
“ওলে বাবারে! আমার বাচ্চাটা আসো, আদর করে দেই।”
বলেই সারা মুখে টুকরো টুকরো চুমু এঁকে দিল শুদ্ধ।
প্রিয়াস্মিতা বৃদ্ধাঙ্গুলে ভর দিয়ে শুদ্ধর গলায় ঝুঁলে পড়লো, কানের লতিতে উষ্ণ ঠোঁটের স্পর্শ এঁকে বললো –
“আমাকে কি আপনার ভিখারি মনে হয় ডক্টর চৌধুরী? এতো কম আদরে আমার পোষাবে না।
আমার স্বামী ওয়ার্ল্ডের বেস্ট ডক্টরদের একজন—তাহলে আমার আদরের ভাগটাও হবে ওরকম লেভেলের।”
শুদ্ধ ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো, টুকরো টুকরো আদর ভরিয়ে দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো –
“উফ্‌, এখন ফিলিংসে নাড়া দিও না বেগম, এখন খাওয়া শুরু করলে তোমাকে ভালো মতো ইনজয় করতে পারব না।

৩০ মিনিট পর এমার্জেন্সি সার্জারি আছে দু’টা, এই অধমের উপর একটু মায়া করো।
আমার মিষ্টিটা তুলে রাখো, বাসায় এসে পুরোটা খাবো।”
প্রিয়াস্মিতার মন খারাপ হয়ে গেল।
সে মুখ কালো করে বললো –
“সত্যি চলে যাচ্ছেন?”
শুদ্ধ তার রক্তিম ওষ্ঠে আলতো চুমু দিয়ে বাচ্চা বোঝানোর মতো করে বললো –
“রাগ করো না বাবু, আমি এসে তোমাকে অনেক আদর করবো—প্রমিস।”
প্রিয়াস্মিতা আর জেদ করলো না।
খুশি হয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো শুদ্ধর কোমর।
শুদ্ধ তুলতুলে গালে হাত বুলাতে বুলাতে বলল –

“আসার পথে আমার বউয়ের জন্য কী নিয়ে আসবো বেগম? আমার বউ কী খাবে?”
এই প্রশ্নে প্রিয়াস্মিতার চোখ মুখ খুশিতে চিকচিক করে উঠলো।
সে শুদ্ধর হাতের কব্জিতে ঘড়ি পরাতে পরাতে উৎসুক কণ্ঠে বললো –
“আচ্ছা, আমার জন্য অনেক অনেক মিষ্টি নিয়ে আসবেন।”
শুদ্ধ হেসে বললো –
“আচ্ছা, আমার মিষ্টি বউ মিষ্টি খাবে তো? কী কী মিষ্টি খাবে বেগম?”
প্রিয়াস্মিতা একটু ভেবে চোখ বড় বড় করে বললো –
“উহ্‌… ছানার জিলিপি, রসগোল্লা, রসমালাই আর জলভরা সন্দেশ!
আর আপনি যদি খুশি হয়ে আরো কিছু আনেন তো আমার কোন সমস্যা নেই!”
শুদ্ধ হাসলো।

সে ভালোই জানে, প্রিয়তার মিষ্টি পছন্দ নয়—
তার খেলেই নাকি গা গুলায়।
কিন্তু তার বউয়ের আবার মিষ্টি খুব পছন্দ।
শুদ্ধ ওয়ালেট পকেটে ঢুকিয়ে প্রিয়াস্মিতার গালে ও কপালে চুমু খেলো।
ঘর থেকে বের হতে হতে বললো –
“ঠিক আছে, আমি সব নিয়ে আসবো বেগম, এখন আসি।”
প্রিয়াস্মিতা লাফিয়ে উঠলো –
“আসি আবার কী? আপনি নাস্তা খাবেন না?”
“চুপচাপ ডাইনিং-এ গিয়ে বসুন, আমি আসছি।”
শুদ্ধ তৃপ্ত হেসে চলে গেল।

“ধুর ধুর, সময়টা এত খারাপ যাচ্ছে যে কী বলবো!”
প্রহেলিকা ল্যাপটপে দ্রুত কিছু টাইপ করতে করতে নিরোৎসাহি কণ্ঠে জানতে চাইলো –
“কী নিয়ে এত ডিস্টার্ব, বাবা?”
খালিদ শিকদার রাগে গজগজ করতে করতে মেয়ের পাশে বসে পড়লেন।
রাগে চিরবিরিয়ে উঠে বললেন –
“আমার ব্যবসা লাটে উঠেছে! সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে!”
প্রহেলিকা ল্যাপটপের স্ক্রিনে চোখ রেখে দায়সারা ভঙ্গিতে প্রশ্ন করল –
“কেনো?”
খালিদ শিকদার ছ্যাঁত করে উঠলেন মেয়ের এমন গা ছাড়া ভাব দেখে।
তিনি চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন –
“তুই জানিস না, তোর সাথে প্রণয়কে বিয়ে দিতে চেয়েছিলাম।
ছেলেটা জিনিয়াস, ক্রিমিনাল মাইন্ডে ও পাক্কা খিলাড়ি!
ও আমার হাতে থাকলে আমি, দ্য গ্রেট খালিদ শিকদার, বাংলাদেশের টপ বিজনেসম্যানদের মধ্যে নাম্বার ওয়ান হতে পারতাম।

এমন মেয়ে জন্ম দিয়েছি ভাই—সব আমার কপালের দোষ!
একটা দুধের বাচ্চা এত বড় দামরা ছেলের মাথায় চিবিয়ে খেতে পারলো, অথচ আমার দামরা মেয়ে সেই কর্ম সম্পাদন করতে পারল না!”
বাপের এসব আহাজারি দেখে বিরক্তিতে মুখ তেতো হলো প্রহেলিকার।
খালিদ শিকদার পুনরায় আফসোসের সুরে বললেন –
“সেযাই হোক, কত কাঠ খড় পুড়িয়ে ছেলেটাকে অন্তত হাতে তো রাখতে পেরেছিলাম।
কিন্তু এখন দেখ—রামও গেল, থালাও গেল।”
প্রহেলিকা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।
ল্যাপটপ অফ করে শান্ত চোখে তাকালো বাবার দিকে।
খালিদ শিকদার আবার বললেন –

“প্রণয় লাস্ট চার বছর ধরে আমাদের ব্যবসায় একটা টাকাও ইনভেস্ট করে না।
ব্যবসা প্রায় ডুবতে বসেছে।
ওই মেয়েটাকে নিয়ে যে ব্ল্যাকমেল করবো, সেই উপায়টাও নেই ছ্যাহ!”
“কেন? তুমি চাওলে এখনো ব্ল্যাকমেল করতে পারো।”
– প্রহেলিকার ঠান্ডা জবাব।
খালিদ খেঁকিয়ে উঠলেন –
“তোর এই গোবরভরা ব্রেইনের জন্যই আজ তুই ডুবছিস, সাথে আমরাও!
ওই মেয়েটার সাথে এখন আর প্রণয়ের কী সম্পর্ক আছে?
মেয়েটা এখন অন্য কারো বউ!
আর কার বউ জানিস তো?
ওই ছেলেটা বড় সাংঘাতিক—যতটা আলা ভোলা দেখায়, ও কিন্তু মোটেও তেমন না!
এর সাথে আমি পাঙ্গা নিতে চাই না।
ওই ছেলে প্রণয়েরও এক কাঁটি ওপরে!”
প্রহেলিকা থুতনি চুলকে বললো –
“ভয় পেলে আর কী করবো বলো!

তবে তোমার আমাকে মাথামোটা মনে হতে পারে, কিন্তু বাস্তব একটা কথা তোমায় স্পষ্ট বুঝতে হবে—
ধরো, তোমার দুর্বলতা যেমন টাকা, তেমন ওদের দুজনের একটা মাত্র দুর্বলতা একটাই—সেটা প্রিয়তা।”
সে রহস্যময় কণ্ঠে বললো –
“প্রিয়তার গলা টিপে ধরলে ওরা দুজনেই সিধে হয়ে যাবে।
প্রণয়ও তোমার সব কথা শুনবে—তোমার কথায় উঠবে বসবে।
শুদ্ধর জিনিয়াস ব্রেনটাও তুমি তোমার মত কাজে লাগাতে পারবে।
ওরা দুজন বাঁচেই ওই মেয়েটাকে দেখে।
ওদের দুজনের হৃদস্পন্দনই চলে ওই মেয়েটার নামে।”
খালিদ শিকদার ভ্রু কুঁচকালেন –
“কি বলতে চাস?”

প্রহেলিকা বাঁকা হাসলো, রহস্যময় কণ্ঠে বললো –
“প্রণয় আজো প্রিয়তার প্রতি ঠিক ততোটাই দুর্বল, যতটা আগে ছিল।
আজও ঠিক ততটাই ভালোবাসে যতটা আগে বসতো—না না, ভুল বললাম, আগের থেকে কয়েকশো গুণ বেশি ভালোবাসে!
প্রিয়তা সামান্য আঘাত পেলে ও প্রণয়ের বুকে অঝরে রক্তক্ষরণ হয়।
হোক না সে অন্যের স্ত্রী তাতে কী?
আর জানোই তো—ভালোবাসা অন্ধ।
সে প্রিয়তাকে বিয়ে দিয়েছে কেবল নিজেকে থেকে দূরে রাখতে, দুনিয়ার হাত থেকে বাঁচাতে।
আমার একটা সলিড প্ল্যান আছে, শুনবে?”
সাজিদ শিকদার চোখ সরু করে তাকালেন।
প্রহেলিকা বাঁকা হেসে বললো –
“শোনো, তাহলে।”

দরজায় হেলান দিয়ে এতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল প্রিয়াস্মিতা।
বাপ-মেয়ের সব পরিকল্পনা শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত শুনলো।
ক্রোধে তার সমগ্র শরীরের রক্ত ফুটছে টগবগ করে ফুটছে।
সে দাঁতের দাঁত চেপে নিজের রাগ সংবরণ করল।
অতঃপর কিছু একটা ভেবে ডেভিল স্মাইল দিয়ে চলে গেল।
একটু দূর গিয়ে ফোন আনমিউট করল প্রিয়াস্মিতা।
কণ্ঠের স্বাভাবিক মাত্রা টেনে বলল –
“হুম, বল।”
ওপাশ থেকে প্রিয়তা অধৈর্য কণ্ঠে বললো –
“এতক্ষণ কোথায় ছিলি আপু? কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি!”
প্রিয়াস্মিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো –
“এই বাড়িতে সাইজে খুব ছোট ছোট দুটো নেংটি ইঁদুর থাকে জানিস—বড্ড লাফাচ্ছে।
তার কি ব্যবস্থা করব সেটাই ভাবছি।”
“এ্যাঁ? কী বলো?”

“হ্যাঁ, একদম ছোট ছোট—ছোট গর্তে থেকে নিজেকে গভীর জলের ফিশ মনে করে!”
প্রিয়াস্মিতার সব কথা প্রিয়তার মাথার দুই হাত উপর দিয়ে উড়ে গেল।
তবু এসব নিয়ে অযথা প্রশ্ন করলো না, বরং ব্যাকুল কণ্ঠে জানতে চাইল –
“আমার প্রণয় ভাই কোথায় আপু? উনি কেমন আছেন?”
প্রিয়াস্মিতা দীর্ঘশ্বাস ফেলল হতাশা নিয়ে বললো –
“তোর প্রণয় ভাইকে আমি চিনি না, বোন।
এমনকি এই সাত দিনে একবারও দেখি নাই উনাকে—উনি বাসায় নেই।”
প্রিয়াস্মিতার জবাবে নিরাশ হলো প্রিয়তা।
তার মনের সকল আশা নিবে গেল।
সে থমথমে কণ্ঠে জানতে চাইল –

“তুমি সত্যি দেখোনি?”
“না।
আচ্ছা, মন খারাপ করিস না।
তোর প্রণয় ভাই ফিরলে সাথে সাথেই আমি তোকে জানাবো, লক্ষ্মী বোন আমার।
মন খারাপ করিস না।”
প্রিয়তা হাসার চেষ্টা করলো।
প্রিয়াস্মিতা ব্যস্ত কণ্ঠে বললো –

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭০

“আচ্ছা রাখি, তোর দুলাভাই হসপিটাল যাবে, নাস্তা দেব।”
প্রণয়ের ব্যাপারে মন খারাপ থাকলেও হাসল প্রিয়তা।
তার যাই হোক, তার বোনটা যে ভালো আছে—এটাই স্বস্তির।
“ঠিক আছে আপু, টাটা।”
“টাটা, সুইটহার্ট।”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭১ (২)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here