ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭৪

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭৪
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই

অগুনের হলকার মতো ছড়িয়েছে শিকদার বাড়ির অন্ধরের কেচ্ছা।
পুরো রায় পুরো ঢি ঢি পড়ে গেছে, বড়কর্তার ভাগ্নি পালিয়েছে। তাও একটা হিন্দু ছেলের সাথে। ফলের সাদমান সিকদারের আত্মগৌরব এসে ঠেকেছে তলানিতে।
সপ্তাহ খনিক বাংলাদেশের চতুরদিকে আনাচে-কানাচে তন্নতন্ন করে খুঁজে, ওহ সেই কাংক্ষিত যুগলের দেখা মিলে নি। তবে ফল পাওয়া যায়নি বলে হাল ছেরে বসে নেই সিকদাররা। তারা শত ভাগ নিশ্চিত, ওরা বাংলাদেশেরই কোনো না কোনো প্রান্তে নিশ্চয় আছে। “আজ নাহয় কাল খুঁজতো তো ঠিকই পাওয়া যাবে। সাদমান সিকদার যাকে শিকার করবে বলে ভাবে, তাকে শিকার করেই ছাড়ে। এর অন্যতা হয় না। ধরা তো তারা ঠিকই পড়বে, পড়তেই হবে। তবে এই সম্মান হানির মূল্য তাদের ঠিক কিভাবে চোকাতে হবে, তা তো কেবল আল্লাহই জানেন।”
এসব কেচ্ছা কেলেঙ্কারি গোপন থাকার নয়, থাকে ও নি। ছি ছি পড়ে গেছে। রায়পুরের চতুরদিকে হাটে বাজারে, গলির মুড়ে চায়ের আড্ডায় সকল বয়সী মানুষের মুখে একটাই আলোচনা। “একই বিষয়কে রশিয়ে রশিয়ে তারা ১০০ ভাবে আলোচনা করছে।”

দুই ঘন্টার দীর্ঘ আলোচনা শেষে আবার বলছে, “ছাড়ো, আমাদের কি বড় লোকদের বড় বড় ব্যাপার স্যাপার?”
আবার কেউ কেউ খুচা দিয়ে বলছে, “শুধু কি তাই?”
সিকদার সাহেবের বড় ছেলেটা তো আরো বড় খেলোয়ার। “মিথ্যা বিয়ের নাটক করে দিন রাত কি কিয়া কলাপ চালালো নিজের চাচাতো বোনের সাথে।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আবার কেউ কেউ তাল মিলিয়ে বলছে, “আরে মিয়া, শুধু কি তাই? সেজো কর্তার আরেকটা সুন্দরী মেয়ে আছে না কি যেন নাম তাকে সব সময় পাশে পাশে রাখতো। তাহলে ওখানে ও ভালই দাও মেরেছে।”
“ঠিকই বলেছ ভায়া, তবে কিনা ওই মেয়েটা তো অনেক ছোট ওই পোলার চেয়ে।”
“হাহ, কি যে বলোনা ভায়া, মেয়ে মানুষকে ছোঁয়ার কোন বয়স হয় না। নারী পুরুষের সম্পর্ক আগুন আর ঘিয়ের মতো। কাছাকাছি থাকলে আগুন জ্বলবেই। তাছাড়া ওই মাইয়াটার বড় ভাই কি করলো, দেখলা না?”
“হেইয়া, অবশ্য ঠিক কইচো ভায়া। সেজো কর্তার পোলাডা কতো খারাপ, আমাগো করিম মাস্টারের মাইয়ারে তুলে নিয়ে গিয়ে বিয়া করছে।”
“আরে ভায়া, আস্তে কন। কখন কে কুঁঁদিক থেকে শুনে ফেলবে? পরে আমরা গরিব মানুষ, আমাদেরই গর্দান যাবে।”

বলে টং দোকানের লোকগুলো নিজেদের মধ্যেই হেসে উঠলো।
তাদের উক্ত কথোপকথনগুলো শুনে যুবক ফোন স্ক্রিন থেকে মুখ তুলে তাকালো তাদের দিকে। লোকগুলো বেশ রশিয়ে রশিয়ে সিকদার বাড়ির ছেলে-মেয়েদের চরিত্র বিশ্লেষণ করছে। তাদের এসব পিত্তি জ্বালানো কথা শুনে রাগে কপালের শিরা দপ দপ করে উঠলো যুবকের। সে অনেকক্ষণ নিজেকে সমলানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালালে ও লোকগুলো থামার নাম নিচ্ছে না। একের পর এক কোটু বাক্য বলেই চলেছে।
এবার ধৈর্য ধারণ করতে পারলো না সে। যুবক তেড়ে গিয়ে সজোরে লাথি বসিয়ে দিলো এক জনের মুখ বরাবর।
পেছনদিকে হুরমুর করে উলটে পড়লো লুকটা। চমকে উঠলো তার আশেপাশের লোকজন। ভয়র্থ চোখে তাকালো যুবকের দিকে। অরন্যের ফর্সা মুখখানা তীব্র ক্রুদ্ধে রক্তিম হয়ে উঠেছে। সে অকথ্য বাসায় গালিগালাজ করতে শুরু করলো।

“ফকিন্নির বাচ্চা! তুমি আমার ভাই বোনদের চরিত্রের দিকে আঙুল তুলিস? তোকে আজ জেন্তো মাঠি চাপা দিয়ে যাব!”
লোকটা কে এমন বেধড়ক মার খেতে দেখে আতঙ্কে ছিটকে গেলো। চার পাশের লোকজন মুহূর্তে একটা জটলা পাকিয়ে গেলো। দূর থেকে এত মানুষের হট্টগোল দেখে দৌড়ে এলো প্রেম ওহ সমুদ্র।
লোকজনের ভিড় ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করতেই চোখ বড় বড় হয়ে এলো তাদের।
প্রেম ওহ সমুদ্র একে ওপরের মুখ চাওয়া চাওয়া করে বললো, “ছোট ভাইকে পেছন থেকে টানতে টানতে, কি করছিস এভাবে? মারছিস কেন? অসহায় লোকটা মরে যাবে তো!”

অরন্য ঝাড়া মেরে সরিয়ে দিল। দিলো তাদের রক্তিম চোখে তাকিয়ে ফোস ফোস করতে করতে বললো, “তুমি জানো না ওই বান্দির ছেলে বলে কিনা আমাদের বড় দাদানের চরিত্রে সমস্যা আছে?”
ওর কথা শুনে সমুদ্র আর প্রেমেরও মাথা গরম হয়ে গেলো। তবু ওরা নিজেদের সমলে ভাইকে টেনে সরিয়ে নিল। ধীর কণ্ঠে বললো, “ছাড়, ওটাকে পাবলিক প্লেসে বড় আব্বুর নাম খারাপ করিস না।”
লোকগুলোর ভেতরে থেকে একজন বলে উঠলো, “চোরের মায়ের বড় গলা, ঠিকই তো বলেছে। সত্যি বলার জন্য এভাবে মারবে? গরিব বলে কি আমাদের কোনো নিরাপত্তা নেই? সিকদার সাহেবরা নিজেদের বাড়িতে গুন্ডা পেলে রেখেছে।”

অরন্য আরো রেগে গেল। এসব শুনে মারতে উদ্যত হতেই তাকে টানতে টানতে নিয়ে গেল প্রেম ওহ সমুদ্র।
রায়পুর বড় বাজারের মানুষগুলো এতক্ষণ ফ্রিতে মুখরোচক চিত্রনাট্য দেখে নিল।
যে মানুষরা আগে সিকদারের নাম নিতে ভয় পেতো, সেই মানুষরা আজ ভরা বাজারে সিকদারের মেয়েদের চরিত্র নিলামে তুলছে। সবটাই কি সময়ের বিবর্ধন, নাকি অন্য কিছু? তবে কি নিজের পুরনো শাসন ফিরে পেতে আবারো নতুন কোনো দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চলেছেন সাদমান সিকদার?

প্রিয়স্মিতাকে কোলের উপর বসিয়ে পেছন থেকে জড়িয়ে রেখেছে শুদ্ধ। খুঁচা খুঁচা গাল যুক্ত তুথনি কাঁধে চেপে আদুরে আলাপ করছে বউয়ের সাথে।
এই কদিনের ঝামেলায় তার সোনার টুকরো বউটাকে একটু আদরও করা হয়নি।
“বেগম।”
“জি।”
“স্বামীর ওপর রাগ করে আছেন?”
“জি না।”
“তাহলে ওদিকে ফিরে কথা বলছেন কেন? এদিকে ফিরে দেখুন এই অধম যে এই পত্নীবিয়োগের বেদনা আর সইতে পারছে না?”
প্রিয়স্মিতা অন্যদিকে ঘুরে মুখ বাঁকিয়ে বললো, “উহহহ বুড়ো বয়সে ঢঙ দেখে বাঁচিনা।”
বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল শুদ্ধ। গাল হাঁ করে বলল, “এই এই এই মাতারি কি বলো? আমি বুড়ো হয়ে গেছি?”
প্রিয়স্মিতা তৎক্ষণাৎ সম্মতি সূচক উপর নিচ মাথা ঝাকালো। কপাল চাপড়ানোর অভিনয় করে বলল, “আবার জিগায় সব দোষ আমার বাপের! সে কিভাবে আমায় একটা বুড়ো লোকের গলায় ঝুলিয়ে দিল আহহা
আমি জোয়ান একটা মাইয়া, বুড়ো জামাইর কাছে আমার বাবায় দিছে বিয়া! ও সে যৌবন জ্বালা মিঠায় না রে মরে কুকাইয়া!”

গান শুনে অকস্মাৎ বিষম লেগে গেল শুদ্ধর। প্রিয়স্মিতা গান ছেড়ে চটজলদি পিছন ফিরে তাকালো, গলা জড়িয়ে ধরে পিঠ মালিশ করতে করতে অসহায় মুখ করে বলল, “হে মাবুদ সত্যি শুনে বুড়োর কাশি উঠে গেছে! হে মাবুদ! আমার স্বামীকে সত্যি হজম তৌফিক দান করো! আমার স্বামীকে হেদায়েত দান করো হে মাবুদ…!”
প্রিয়স্মিতা আর কিছু বলতে পারল না। তার পূর্বেই হেঁচকা টানে ফেলে দিয়ে বিছানার সাথে চেপে ধরল শুদ্ধ। প্রিয়স্মিতার দুই পাশে হাত ভ্রু নাচিয়ে বলল, “ভন্ডামি করো আমার সাথে!”
প্রিয়স্মিতা তৎক্ষণাৎ দুই পাশে না বোধক মাথা নাড়ালো। চেহারায় শিশুসুলভ ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, “নাউজুবিল্লাহ! সারা দুনিয়ার সাথে ভন্ডামি করলেও শ্বশুরীর ছেলের সাথে কখনো করবো না।”
শুদ্ধ ভ্রু কুঁচকে তাকালো। গালের নিচে হাত রেখে ভর দিয়ে বলল, “তোমার মত মিচকে শয়তান্নি নিয়ে দুনিয়াতে খুব কমই আছে বেগম,
আই এম অনলি ওয়ান ডক্টর সাহেব।”

শুদ্ধ ঠোট বাকিয়ে হাসলো। “কোনো ব্যাপার না, সব শয়তানের দাওয়াই আছে। এই ডক্টর আবদ্ধ চৌধুরী শুদ্ধর কাছে কাল রাতে ‘ভ্যাঁ ভ্যাঁ’ করে কাঁদছিলে বলে মায়া দেখিয়েছিলাম। কিন্তু এখন সুন্দরী, তোমার নিস্তার নেই। এখন কেঁদে কেঁদে সাগর বানিয়ে দিলেও…” বলে থামল শুদ্ধ। বাঁকা হেসে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল, “You know what I mean…”
ভয়ার্থ চোখে তাকিয়ে ঢোক গিলল প্রিয়স্মিতা। মজা নিতে গিয়ে এমনে ফেঁসে যাবে তা বেচারি দুঃস্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেননি।
শুদ্ধর অসংলগ্ন স্পর্শে প্রিয়স্মিতার শরীর কাঁপছে অনবরত। বিয়ে হয়েছে প্রায় দুই মাস — এক হতে চললো — কিন্তু এখনও এই মানুষটার স্পর্শের সাথে শরীরকে মানিয়ে নিতে পারেনি প্রিয়স্মিতা। এই মানুষটা স্পর্শ করলেই কেমন ভূমিকম্প শুরু হয়ে যায় দেহ মনে।
শুদ্ধ থরথর করে কাঁপতে থাকা লাল টুকটুকে ওষ্ঠে বৃদ্ধাঙ্গুলি ছুঁইয়ে হালকা স্লাইড করল। ঢোক গিলে বলল, “I want to eat your red lips।” বলতে বলতে প্রিয়স্মিতার তুলতুলে ওষ্ঠের মাঝে নিজের পুরুষালি ওষ্ঠ ডুবিয়ে দিল শুদ্ধ।

চোখ খিঁচে, পিঠ খামচে ধরল প্রিয়স্মিতা। কয়েক সেকেন্ড পার হতে না হতেই অস্বাভাবিকভাবে ছটফটিয়ে উঠল।
অস্থির ভঙ্গিতে শুদ্ধর ভারী শরীরটা ঠেলে সরিয়ে দিল নিজের উপর থেকে।
অনুভূতির তোড়ে বেসামাল শুদ্ধ আবার কাছে টানার চেষ্টা করতেই প্রিয়স্মিতা লাফিয়ে উঠে পড়ল বিছানা থেকে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুই হাতে মুখ চেপে দৌড় দিল ওয়াশরুমে।
শুদ্ধর নেশা কেটে গেল। সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রইলো ওয়াশরুমের দিকে।
ওয়াশরুমের দরজা খোলা, এখান থেকেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে, প্রিয়স্মিতা বেসিন ধরে গড়গড় করে বমি করছে।
শুদ্ধর কপালের ভাঁজ দৃঢ় হলো। প্রিয়স্মিতার ওড়নার কোনায় চোখ-মুখ মুছতে মুছতে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলো। শুদ্ধের সন্দিহান মুখের দিকে তাকিয়ে ভ্যাটকি দিয়ে বলল, “হ্যাই… স্ট্রবেরি ডক্টর?”
শুদ্ধ দুই পা এগিয়ে এলো প্রিয়স্মিতার নিকট। কোমর চেপে ধরে কাছে টেনে নিল। হাতের নাড়ি চেপে ধরে চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কি প্রেগন্যান্ট?”

উক্ত প্রশ্নে চোখ বড় বড় করে ফেলল প্রিয়স্মিতা। মুখ হাঁ করে তাকিয়ে রইল।
শুদ্ধ অস্থির গলায় শুধালো, “বলো বেগম, আমি যা ভাবছি, তাই কি সত্যি?”
ফর্সা গালে লালচে আভার দেখা মিলল প্রিয়স্মিতার। সে চোখ নামিয়ে উপর নিচ হ্যাঁ সূচক মাথা ঝাকালো।
অনুভূশূন্য চোখে তাকিয়ে রইল শুদ্ধ। কাঁপা কণ্ঠে বলল, “স্‌স্‌স্‌সত্যি বলছিস বউ? আমি বাবা হতে চলেছি?”
প্রিয়স্মিতা ধীর মাথা নিচু করে আবার উপরে তুলল।
আনন্দের বদলে শুদ্ধর মুখটা কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। সে হাটু গেড়ে প্রিয়স্মিতার মেধহিন পেটে মাথা রাখলো, ঠোঁট উল্টে বলল, “কিছু করার আগেই বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো তুই কোথা থেকে উদয় হলে, বাপ এক বলেই উইকেট পড়ে যাবে। এটা তো আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।”

প্রিয়স্মিতা চুল টেনে ধরে বলল, “এগুলো কি বলছেন আমার বাচ্চাকে?”
শুদ্ধ বসা থেকে উঠে হঠাৎ আনন্দে চিৎকার দিয়ে উঠল। প্রিয়স্মিতাকে উপরে তুলে ঘুরাতে ঘুরাতে বলল, “পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার আজ তুই আমাকে দিলি বউ! তোকে কোথায় রাখব আমি!”
প্রিয়স্মিতা মিষ্টি হেসে শুদ্ধর গালে চুমু খেল।
তাদের হাসির শব্দ শুনে থেমে গেল প্রণয়। না চাইতে ও চোখ আটকালো সামনে, অর্ধউন্মুক্ত দরজার ফাঁক দিয়ে ভেতরের সব দৃশ্যই পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে।
কলিজাটা ছিদ্র হয়ে গেল প্রণয়ের। বেশিক্ষণ সেদিকে চেয়ে থাকতে পারল না। ব্যথাতুর হেসে স্থান ত্যাগ করল।

সময় প্রবাহমান, কয়েক দিন ধরে কর্মব্যস্ততায় ডুবে থাকা প্রণয় তার বড় লক্ষ্য সামনে রেখে এগোচ্ছে। নিজের হাতে গড়া আকাশসম বিস্তৃত পাপের সাম্রাজ্যে সে আবার নিজেকে ডুবিয়ে নিয়েছে। চারদিকে শুধু হাহাকার, এটাকেই নিজের জগৎ বানিয়েছে প্রণয়। এটাকেই মানসিক শান্তি প্রাপ্তির অন্তিম পন্থা হিসেবে গ্রহণ করেছে।
এই বহুরূপী ভালো মানুষদের বাজারে সে আর নিজেকে ভালো মানুষ হিসেবে প্রেজেন্ট করতে চায় না। এবার সবাই দেখবে সে আসলে কী। আর তার কোনো ভয় নেই, পরোয়া নেই, পিছুটান নেই। এখন যা হবে, সামনাসামনিই হবে।
এসব ভেবে ভেবেই কুটিল, পৈশাচিক হাসি খেলে যাচ্ছিল প্রণয়ের রক্তিম ওষ্ঠের কোণে। সে ঘাড় কাত করে হাতে থাকা পেপার হোল্ডার ঘুরাতে ঘুরাতে বলল —

“এই জগতে ভালো হওয়ার চেয়ে মন্দ হওয়াতে বেশি সুখ, আর সেই সুখের সাগরে ভেসে যাবে প্রণয় সিকদার।”
রাজনৈতিক চামচারা অনেক বেড়ে গেছে। এবার সময় এসেছে সবগুলো ডানা ছেটে দেওয়ার। শের কখনও তার শিকারকে পিঠ দেখায় না। আবরার শিকদার প্রণয়ও আর দেখাবে না। এবার থেকে যা হবে, সব সামনাসামনিই হবে। তার কোনো দুর্বলতা নেই, আর কিছু হারানোর ভয়ও নেই। সে সকল বন্ধন থেকে স্বাধীন, অবাধ।
এসব বলতে বলতে চোখ বুঝে চেয়ারে মাথা এলিয়ে দিল প্রণয়। বুক পুড়ছে, চোখ জ্বলছে। শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ চিৎকার দিয়ে জানাচ্ছে তাদের অসহায়ত্ব, তাদের যন্ত্রণা।
কিন্তু চাইলেই কি সব পাওয়া যায়? প্রণয় বুকে হাত রেখে কল্পনায় এঁকে নিল সেই প্রিয় মুখ। আজকাল তাকে কল্পনা করলেই কলিজা জ্বালানোর মতো সব দৃশ্য ভেসে ওঠে।
প্রণয় চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস টানল, বক্ষ পাজরে হাত রেখে মলিন সুরে গেয়ে উঠল —

“তুমি তো আমায় ছেড়ে চলে গেছ অনেক দূরে, সুখে আছ শুনলাম আমি,
ভাসাইয়া আমায় তরে কতটা যন্ত্রণাময় প্রতি রাত জেগে থাকি,
তোমার স্মৃতি অন্তরে বাজে বাজে সাজিয়ে রাখি।”
গান গাইতে গাইতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল প্রণয়। হাসতে হাসতে চোখের কোনায় পানি জমে উঠল।
চোখ খুলে আহত গলায় বলল —
“জান জ্বালিয়ে আগুন আমার বুকে, তবু ও চিরকাল তুই যেন থাকিস সুখে।”
প্রণয় পাগলের মতো করতে লাগল। তার প্রিয়তাকে ছোঁয়ার সাংঘাতিক ক্রেভিং হচ্ছে। চেয়ার খামচে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে পড়ে রইল।
একই সময় কাচের দরজায় নক হলো। জাভেদ বলল —
“আই উইল কাম, বস।”
প্রণয় মাত্র এক শব্দে অনুমতি দিল —
“কাম।”
দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল জাভেদ সহ কয়েকজন ফরেনার স্টাফ। তাদের হেড বলল —
“বস, হ্যাজ সাকসেসফুলি শিপড ২০০ কনটেইনারস টু কানাডা।”
প্রণয় শুধু হুম করল।

“নো বস, নট অনলি কানাডা — ইউকে, কানাডা, মালয়েশিয়া, প্যারিস, দুবাই, চায়না, জাপান অ্যান্ড মোর দ্যান ২০ কান্ট্রিজ। আওয়ার কনটেইনারস হেভ সাকসেসফুলি রিচড। উই হ্যাভ নট ফেসড এনি লিগ্যাল ট্রাবল আফটার গিভিং ইয়োর গ্যারান্টি।”
প্রণয় চোখ বন্ধ রেখেই হেসে উঠল।
“অ্যান্ড বস, কান্ট্রিজ হ্যাভ পেইড ৫০,০০০ বিলিয়ন ইউএস ডলারস ফর অল দ্য কনটেইনারস।”
প্রণয় চোখ খুলে তাকালো। দূরদর্শী বাদামি চোখে কিছু খেলছে।
লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে সন্তুষ্ট কণ্ঠে বলল —
“দ্যাটস গুড ওয়ার্ক, মাই বয়েজ। কিপ ইট আপ। অ্যান্ড ডিভাইড টোয়েন্টি পারসেন্ট অফ দ্য প্রফিট অ্যামং ইয়োরসেলভস।”
জাভেদ ভয়ে বলল —

“এটা একটু বেশি হয়ে যাবে।”
প্রণয় শীতল দৃষ্টিতে তাকালো। জাভেদ আরও পিছিয়ে গেল —
“আরও বেশি দিলে আরও ভালো হতো, হেহে…”
প্রণয় চোখ ঘুরিয়ে স্টাফদের দিকে তাকাল। ঠান্ডা গলায় আদেশ করল —
“নাও, গো।”
নির্দেশ পাওয়া মাত্রই শুঁর-শুঁর করে বেরিয়ে গেল লোকগুলো।
প্রণয়ের মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, সে কতটা তৃপ্তি পেয়েছে। এবার দেশগুলোর পেছনে আরও ভালো মতো আগুন লাগবে।

২০২৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী গোটা পৃথিবীর জিডিপি ২০০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। সেখান থেকে ৪ ভাগের ১ ভাগ অর্থাৎ ফিফটি থাউজেন্ড বিলিয়ন ইউএস ডলার এখন প্রণয়ের হাতে। এবার বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি নিশ্চিতরূপে মুখ থুবড়ে পড়বে, পড়তে বাধ্য।
এসবই ৯-৬ ভাবছিল প্রণয়। ঠিক তখনই “টুং টুং” করে মেসেজ আসার শব্দে ভাবনার সুতো ছিঁড়ে গেল। মেজাজ বিগড়ে গেল প্রণয়ের। ফোনের পানে তাকিয়ে দেখল স্ক্রিন জ্বলছে।
বিরক্তি নিয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিল প্রণয়। একটা আননোন নাম্বার থেকে কয়েকটা ভয়েস নোট আর কয়েকটা ছবি সেন্ড করা হয়েছে।

জাভেদ ভীত চোখে তাকিয়ে দেখল — স্যারের মসৃণ টানটান কপালে সুক্ষ সুক্ষ কয়েকটা ভাঁজ পড়েছে।
জাভেদ আহাম্মকের মতো হা করে তাকিয়ে রইল — এমন হ্যান্ডসাম বস পেয়ে সে ধন্য। প্রতিটা এক্সপ্রেশন কী চমৎকার আর নিখুঁত! মাইরি, মেয়ে হলে সে কবেই প্রেমে পাগল হয়ে যেত।
ছবিটা ওপেন করতেই ঠাস করে হাত থেকে ফোনটা ছিটকে পড়ল মার্বেল বসানো মেঝেতে।
বিকট শব্দে কেঁপে উঠল জাভেদ। প্রণয় গলা কাটা মুরগির ন্যায় ছটফটিয়ে উঠল। প্রণয়ের নাক দিয়ে রক্ত ওঠতে শুরু হলো।
বসের অবস্থা দেখে গা শিউরে উঠল জাভেদ। লাফিয়ে এসে প্রণয়কে চেপে ধরল। আতঙ্কিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল

“কি হয়েছে স্যার? আপনি প্যানিক করছেন কেন? শান্ত হন!”
প্রণয় শার্টের হাতায় নাক মুছে কাঁপা হাতে ফোনটা তুলে ভয়েস নোটগুলো প্লে করল।
ঘর কাঁপানো হাসির শব্দ এসে কানে লাগল প্রণয়ের।
“ছবিগুলো দেখে নিশ্চয়ই অন্তরাত্মা কেঁপে উঠছে, মাই বয়! চলে এসো, চলে এসো, নিজের মেহবুবাকে বাঁচাতে চাইলে দ্রুত আমার কাছে চলে এসো, নাহলে এই মেয়েটাকে…” — বলে আবার হেসে উঠল লোকটি।
সঙ্গেই ভয়েস নোট শেষ হয়ে গেল।
ভয়ে জমে গেল জাভেদ। আতঙ্কিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল নিজের বসের দিকে।
প্রণয় কোনো রিঅ্যাকশন দিল না। সব কিছু ছুঁড়ে পাগলের মতো ছুটে বেরিয়ে গেল অফিস থেকে।
আবারও আতঙ্কে কাটা হয়ে গেল জাভেদ।

অপারেশন থিয়েটারে পাঁচ ঘণ্টা নিরলস প্রচেষ্টার পরে তৃতীয় সার্জারিও সফলভাবে শেষ করল শুদ্ধ।
তবে, একইভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ছেলেটার ঘাড়, পিঠ সবকিছু ব্যথায় টনটন করছে। সার্জিক্যাল ড্রেস ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে নিল। দুপুর গড়িয়ে বিকেল, এখনো কিছু খাওয়া হয়নি। সে লাঞ্চ অর্ডার দিয়ে এসে নিজের কেবিনে বসলো। নিশ্চিন্ত মনে চেয়ারে গা এলিয়ে দিল।
দুই সেকেন্ড থেমে নিঃশ্বাস নিয়ে ফোন হাতে নিতেই দেখল, বেশ কিছু ছবি এসেছে এবং একটা ভয়েস নোটও। তা-ও অজানা নাম্বার থেকে। একটু অবাক হল শুদ্ধ।
অলস ভঙ্গিতে ছবিগুলোতে ক্লিক করতেই হৃদপিণ্ড লাফিয়ে উঠল শুদ্ধর। ছবিগুলোতে দেখা যাচ্ছে প্রিয়স্মিতা কে চোখ-মুখ বেঁধে একটা কাঠের চেয়ারের সঙ্গে বাঁধা রয়েছে।
শুদ্ধ ছবিগুলো দেখে এক মুহূর্তে পাগল হয়ে গেল। ভয়েস নোট শোনা মাত্রই শরীরের শিরায় শিরায় হল হল করে রাগ ছড়িয়ে পড়ল। বসা থেকে উঠে হন হনিয়ে বেরিয়ে গেল কেবিন ছেড়ে।

বিস্তৃত এক বিশাল কক্ষের মধ্যভাগে প্রিয়স্মিতার হাত-পা চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে রাখা হয়েছে। ডিকে বস নিজে পায়ের ওপর পা তুলে বসে, সামনে পড়ে থাকা মেয়েটার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
প্রিয়স্মিতা মুখ দিয়ে “উহু উহু” শব্দ করতে করতে মুচড়ামুচড়ি করছে। ডিকে বস বাঁকা হেসে ইশারা করলো। গার্ডটি চোখের পলকেই প্রিয়স্মিতার মুখের কালো টেপ খুলে দিল। সাথে সাথেই মুখ হাঁ করে নিঃশ্বাস ফেললো প্রিয়স্মিতা। অতিরিক্ত অস্বস্তিতে গা গুলিয়ে বমি এলো তার।
তবে তার ভেতরের শক্তি কমে যায়নি। বাঁধন মুক্ত হতেই চেঁচিয়ে উঠলো, চোখ-মুখ শক্ত করে হুংকার ছেড়ে বললো,

“তুমি আমার শাওয়ার মাফিয়া বস, শালা চামচিকি, ছোটলোকের বাচ্চা! আমাকে ধরেছিস! সাহস থাকলে হাত-পা খুলে তোর মার হ্যাঙা এখুনি আরও চারটা করিয়ে দেবো।”
গালি শুনে উপস্থিত বাঙালি গার্ডগুলো চোখ বড় করে তাকাল আতঙ্কে।
ডিকে বসও কিছু বুঝতে পারলো না। ভ্রু কুঁচকে সামনের গার্ডকে জিজ্ঞেস করলো,
“What did the girl say?”
গার্ডটা ভয়ে সিঁটিয়ে গেল। প্রিয়স্মিতা আবার বললো,
“ওই শালা আবুলের নাতি, আমার হাত-পা খুলে দে, এর অর্থ আমি তোকে বুঝাচ্ছি।”
গার্ডটি ভয়ভয়ভাবে বললো,
“Boss, the girl says it means to untie her hands and feet.”
ডিকে বস ভ্রু তুলে হেসে বললো,
“Oh really? Okay, free her.”
ওদের কথোপকথনের মাঝেই আরেকজন সাদা চামড়ার গার্ড হাজির হলো। ডিকে বস ভ্রু কুঁচকে তাকাল। গার্ডটি চোখ নামিয়ে মাথা নত করে বললো,

“Boss, ASR is coming.”
প্রিয়স্মিতা চমকে উঠলো। সে অনেকবার ASR নাম শুনেছে, কিন্তু এত বিখ্যাত আসামী এখানে কেন আসবে? এটার মানে কি চিচকে মাস্তানগুলোর সঙ্গে ASR-এর কোনো লিংক আছে?
প্রিয়স্মিতার চিন্তা শেষ হওয়ার আগেই কর্ণে এল চমকপ্রদ এক কণ্ঠস্বর। প্রণয়ের মুখাবয়বে ভয়াবহ নিষ্ঠুরতা। সে পেছন থেকে তেড়ে এসে চেপে ধরলো ডিকে বসের কলার। বজ্র কণ্ঠে হুংকার দিয়ে বললো,
“Where is my love?”
ডিকে বস নিশ্চুপ থেকে ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। প্রণয় ফের চেঁচিয়ে বললো,
“Say, bastard! Where is my love? By Allah, if you don’t return my love, I will finish you here!”

এবারও কিছু না বলে নিশ্চুপ থাকলেন ডিকে বস। প্রণয়ের ছটফটানি দেখে মনের ভেতর কেমন পৈশাচিক সুখের জোয়ার নামছে। প্রণয়ের উধ্রান্ত চিত্ত আরও বেশি শান্তি দিচ্ছে মনে। প্রণয় ফের ঘর কাঁপিয়ে চিৎকার দিয়ে উঠলো। এক লাথিতে উল্টে ফেললো ডিকে বসের চেয়ার। পেছন দিকে উল্টে পড়ে সজোরে মেঝের সাথে বাড়ি খেলেন ডিকে বস। গার্ড ছুটে আসতে নিলে হাত উঁচু করে আটকে দিলেন ডিকে বস।
অতিরিক্ত ক্রোধ কখনোই কন্ট্রোল করতে পারে না প্রণয়। রেগে গেলে মানুষ থেকে জানোয়ার হয়ে যায়। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে তীব্র বেগে লাথি বসালো বসের পেটে। তেড়ে গিয়ে থাবা মেরে চেপে ধরলো বসের কলার। কপালে বন্দুকের নল চেপে ধরে চোখ লাল করে বললো, “আমার জান-এর গায়ে একটুকুও আঁচ আসলে সবকিছু জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শ্মশান বানিয়ে দেবে এই প্রণয় শিকদার, তুইও বাঁচবি না।”
পায়ের রক্ত চরচর করে মাথায় চড়ছে প্রণয়ের। ঘাড়ের রগ ফুলে কলা গাছ। প্রিয়স্মিতার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে গেলো প্রণয় শিকদার নামটা শুনে। সে যেন নিজের কানকেই বিশ্বাস করতে পারছে না। এটা কি শুনলো সে? আর কিছু ভাবতে পারলো না।

তার পূর্বেই মাঝখান থেকে সাদা পর্দাটা টেনে সরিয়ে দিলো কেউ। সাথে সাথেই চোখের নিমিষে চিত্র পরিবর্তন হয়ে গেলো এত তাড়াতাড়ি ঘটনাটা ঘটে গেলো যে কিছু বুঝে উঠতে পারলো না প্রণয়।
পর্দা সরাতেই হৃদপিণ্ড থেমে গেছিলো প্রণয়ের। অশ্রুতে ঝাপসা চোখ দুটো ব্যর্থতা নিয়ে চেয়ে ছিলো প্রিয়স্মিতার শুকনো মুখের পানে। প্রণয়ের ক্ষণিকের দুর্বলতা কে সুযোগ রূপে ব্যবহার করলেন ডিকে বস। লাথি মেরে ফেলে দিলেন প্রণয়কে। নিজের অবস্থানে রেখে গান চেপে ধরলেন প্রণয়ের বুকে। আশ্চর্য হলো না প্রণয়। এই লোকটার ধূর্ততা সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবগত সে।

ডিকে বস প্রণয়ের বুকের উপর পা চেপে ধরলো। এতক্ষণের শান্ত চেহারা পৈশাচিক হিংস্রতার আড়ালে ঢাকা পড়েছে। সে জুতা দ্বারা প্রণয়ের বুকে বল প্রয়োগ করে বললো, “আমার বিড়াল আমাকেই মেও বলছে! তোকে আমি অন্ধকার দুনিয়ার অলি গলি চেনালাম। এই অন্ধকার দুনিয়ার সম্রাট বানালাম, আর তুই আমার সাথে থেকে, আমার খেয়ে পরে আমার পা’ত ফুটো করি! তুই তো জানতিস, তোকে এএসআর বানানোর আমার একটাই লক্ষ্য, আমার সন্তানের খুনিকে খুঁজে বের করা। আর তুই পাওয়ার নিয়ে সেই খুনিকেই প্রোটেক্ট করলি! এবার তুই বল, এই মেয়েটার কি করবো?”

হিংস্রতা নিভে গিয়ে ভয়ে কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এলো প্রণয়ের। ডিকে বসের সাথে পাঙ্গা নিয়ে আন্ডারওয়ার্ল্ডে কেউ জিততে পারেনি, পারবেও না। এর হাত থেকে নিজের প্রাণ কে সুরক্ষা দিতে নিজেকে অন্ধকারের আশেপাশে জড়িয়েছে প্রণয়।
ডিকে বস ফের বললো, “এই মেয়েটা আমার থেকে আমার সন্তান কেড়ে নিয়েছে, আমার পোষা বাঘ কেড়ে নিয়েছে। ওকে কি করবো তুই বল! তুই হলে ছেড়ে দিতি? তোর সন্তানকে যদি কেউ খুন করতো, তুই ছেড়ে দিতি?”

ডিকে বসের চোখের ইশারায় দুটো গার্ড এসে প্রিয়স্মিতার মাথায় রিভলভার তাক করে দাঁড়িয়ে রইলো। ভয়ে আঁতকে উঠলো প্রণয়। অউদ্ধত ঝেড়ে ফেলে মিনতি করে বললো, “প্লিজ! ওর কোনো ক্ষতি করবেন না। আমি সব সময় আপনার সব কথা শুনেছি, এবারও শুনবো।”
ডিকে বস ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলেন। পুনরায় গার্ডদের ইশারা করতেই আরও দুটো বিশাল আকৃতির গার্ড এসে প্রণয়ের দুই বাহু চেপে আঁটকে দিলো।
প্রিয়স্মিতা কেবল চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে প্রণয়ের দিকে। কিছুই বলছে না, আর না কিছু ভাবতে পারছে। শিকদার বাড়ির বড় ছেলে এত বড় ক্রিমিনাল! এটা তো সে কোনোদিন দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি। এই ছেলেটার সাথে যদি তার বোকাসুকা বোনটা কোনো ভাবে জড়িয়ে যায়, তখন কি হবে! প্রিয়স্মিতা আর কিছু ভাবতে পারলো না।
প্রণয় আর্তনাদ করে বললো, “প্লিজ বস! আপনি যা জেনেছেন, তার সব সঠিক নয়।”
“সঠিক বেঠিক অতকিছু আমার জানার দরকার নেই। আমি শুধু জানি, এই মেয়েটাই সেই মেয়েটা যাকে আমি ৯ বছর হন্যে হয়ে খুঁজছি।”

প্রণয় চোখে চারপাশ অন্ধকার দেখছে। এই পরিস্থিতিতে সে কোনোদিনও পড়তে চায়নি।
ডিকে বস ঘাড় ঘুরিয়ে চাইলো প্রিয়স্মিতার পানে। কালো বন্দুকের নলটা প্রিয়স্মিতার গলায় চেপে ধরে বললো, “এটাই তোমার উইক পয়েন্ট তাই না, মাই সান? এটাকে আমার চোখের সামনে থাকা সত্ত্বেও আড়াল করেছো। তুমি তো পানিশমেন্ট ডিজার্ভ করো।”
প্রণয় ধস্তাধস্তি করতে করতে গর্জন দিয়ে উঠলো, “দূরে সরুন ওর থেকে। ওকে আপনি কিছু করতে পারবে না।”
“উহু, তা বললে তো হবে না, মাই সান। তোমাকে তো পানিশমেন্ট পেতেই হবে। আর তোমার পানিশমেন্ট হবে তোমার দুই চোখের সামনে একে আমি ফিনিশ করে দেবো, আর তুমি কিছু করতে পারবে না।”
“But এটা তো আপনি wrong number dial করলেন, Mr. DK. আপনার কাছ থেকে আসলে এমন মূর্খামি আশা করা যায় না।”

পেছন থেকে ভেসে আসা ভারি গমগমে আওয়াজে ডিকে বসের কণ্ঠ থেমে গেলো। তিনি ভ্রু কুঁচকে চাইলেন। শুদ্ধ পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
ডিকে বস চোখ ছোট ছোট করে বললেন, “মানে?”
শুদ্ধ বাঁকা হাসলো। হেলে দুলে এসে প্রণয়ের পাশে দাঁড়ালো। রহস্যময়ী কণ্ঠে বললো, “মানে এটাই, আপনি রং নাম্বার ডায়াল করেছেন। ওটা ছেড়ে দিন। ওটা আমার বউ, আপনার শিকার না।”
“বোকা বানানোর চেষ্টা ভালো, কিন্তু এসব বলে লাভ নেই, মাই বয়। তোমার ব্যাপারেও সব জানি, যদি ও তোমার গাদ্দারির লেভেলটা কম…”

শুদ্ধ ঠোঁট কামড়ে হাসলো। প্রিয়স্মিতা বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে শুদ্ধর দিকে। এ কেমন মায়ার ইন্দ্রজালে ফেঁসে গেছে সে!
শুদ্ধ ঠোঁটে বক্র হাসি ফুটিয়ে তুলে বললো, “ওটা আমার বউ, মেহরিমা শিকদার প্রিয়স্মিতা, নট আ তনায়া শিকদার প্রিয়তা।”
শুদ্ধর কণ্ঠ নিঃসৃত শব্দে চক্ষু চড়কগাছ হয়ে গেলো প্রিয়স্মিতার। শরীরের পশম দাঁড়িয়ে গেলো। প্রণয় কপাল কুঁচকে তাকালো শুদ্ধর দিকে।
শুদ্ধ প্রণয়ের পিঠ চাপড়ে বললো, “তুই কিভাবে ভাবলি, তোর ভাগেরটা আমি খেয়ে নেবো? আমি আমার ভাগেরটাই খাইছি।”

ডিকে বস প্রিয়স্মিতার কপালে আরও জোরে বন্দুক চেপে ধরে বললো, “নো চালাকি!”
শুদ্ধ হাই তুলে বললো, “এই গোবর ভরা ব্রেইন নিয়ে এই হালা কিভাবে বস হলো বলতো ভাই!” বলে জবাবের আশায় প্রণয়ের মুখের দিকে তাকালো।
শুদ্ধ পকেট থেকে রিভলভার বের করে শুট করে দিলো ডিকে বসের হাতে। পর পর প্রণয়কে ধরে রাখা গার্ড দুটোরও কপাল বরাবর ঠাস ঠাস করে গুলি চালিয়ে দিলো। আচমকা এমন কাণ্ডে হতভম্ব হয়ে গেলো সকলে।
গার্ড গুলো আক্রমণ করতে নিলেই চোখের নিমিষে সবগুলোকে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিলো প্রণয়। কয়েক মুহূর্তেই একা হয়ে গেলো ডিকে বস। সে বোকা নয়। সে জানে এখন পরিস্থিতি তার হাতে নেই। এখান থেকে বের হতে হবে। তার পর জাস্ট কয়েক মুহূর্ত লাগবে আসল শিকারকে খুঁজে বের করতে।

ডিকে বস সুযোগ বুঝে প্রিয়স্মিতাকে বেঁধে রাখা চেয়ারটা উল্টে দিলো। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলো প্রিয়স্মিতা। হাতের হাড়ে ভয়ানক ব্যথা পেল।
চমকে উঠলো প্রণয় ও শুদ্ধ উধ্রান্তের ন্যায় ছুটে গেলো প্রিয়স্মিতার নিকট। সুযোগ বুঝে স্থান ত্যাগ করলো ডিকে।
শুদ্ধ প্রিয়স্মিতাকে টেনে তুলে বুকে মেশালো। গালে মুখে হাত বোলাতে বোলাতে আতঙ্কিত কণ্ঠে বললো, “বিবি জান, তুমি ব্যথা পাওনি তো?”
প্রিয়স্মিতা দুই পাশে মাথা নাড়ালো। শুদ্ধ ঝটপট খুলে দিলো প্রিয়স্মিতার হাতের বাঁধন।
প্রণয় অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছে তাদের দু’জনের দিকে। শুদ্ধ ওর কৌতূহলী চাহুনি দেখে হালকা হাসলো। কাঁধে হাত রেখে বললো, “যা শুনেছিস, তাই সত্যি। ও তোর প্রিয়তা নয়।”

প্রণয়ের পায়ের নিচের জমিন সরে গেলো। বিস্মিত চোখে তাকালো প্রিয়স্মিতার দিকে। হাত পা নাক মুখ চোখ চুল কণ্ঠ, কোথাও এক পার্সেন্টও পার্থক্য নেই। সব একদম হুবহু।
প্রণয় শান্ত চোখে তাকালো প্রিয়স্মিতার চোখের গভীরে। বিয়ের পর আর একবারও চেয়ে দেখা হয়নি ওই মায়া মেশানো চোখ দুটো। কিন্তু এবার খানিক আশ্চর্য হলো প্রণয়। চোখ দুটো নীল ঠিকই, কিন্তু সেই চিরাচরিত মায়া নেই। এই চোখের ভাষা কেমন অস্পষ্ট, বুঝতে পারছে না প্রণয়।
“এখানে দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করিস না একটুও। প্রিয়তা মধুুপুর গ্রামে আছে। তাড়াতাড়ি যা। ডিকে-র ওখানে পৌঁছাতে বেশি সময় লাগবে না।”

প্রণয় অস্থির হল আর কারও দিকে তাকালো না। দুই পা পিছু হেঁটে পাগলের মতো বেরিয়ে গেলো।
শুদ্ধ প্রিয়স্মিতাকে বুকে জড়িয়ে বললো, “আমার বউটা কি ব্যথা পেয়েছে?”
প্রিয়স্মিতা হালকা হেসে বুকে মুখ গুঁজে দিলো।

গ্রামের কালো পিচঢালা রাস্তায় ২১০ কিমি. প্রতি ঘন্টার গতিতে ঝড়ের বেগে ছুটে চলছে ব্ল্যাক টয়োটা। উৎকণ্ঠায় দিশেহারা হয়ে পড়ছে প্রণয় তীব্র অস্থিরতায় চোখে ঝাপসা দেখছে, গাড়ির ভেতরের গোমোট আবহাওয়া কমাতে এসির পাওয়ার আরো বাড়িয়ে দিলো প্রণয়। টেনেটুনে শার্টের বোতাম লুজ করে হাঁ করে নিঃশ্বাস ফেলল তবু ও স্বস্তি মিললো না। ১ ঘন্টার রাস্তা মাত্র ২৫ মিনিটে কিভাবে পাড়ি দিয়েছে বলতে পারবে না সে। গুগল ম্যাপে নির্ধারিত গন্তব্য চিহ্নিত হতেই সজোরে ব্রেক কষল প্রণয়।

উত্তেজনায় হাত কাঁপছে তার, হৃদপিন্ডের লাভডুপ সামলাতে পারছে না। যা শুনেছে তা সত্যি হবে—আর ভাবতে পারল না প্রণয়। গাড়ির দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এলো।
চাঁদনি রাত, আকাশের সহস্রাধিক তারার ভিড়ে শুভ্র রঙা চাঁদটা সর্বপ্রথম চোখে লাগে, রাস্তার দুই পাশে বিস্তৃত সবুজ ধানজমি। প্রণয় ব্যাকুল চোখে তাকালো সামনে—ধানক্ষেতের মাঝ বরাবর ছোট্ট একটা কুঁড়ে ঘর, আলো জ্বলছে টিমটিম করে।
আশেপাশে এমন আরও অনেক কুঁড়ে ঘরের অস্তিত্ব দেখতে পেলো।
প্রেয়সীর তেষ্টায় কন্ঠনালী শুকিয়ে শুষ্ক মরুভূমিতে রূপান্তরিত হল ছেলেটার। প্রণয় লম্বা লম্বা শ্বাস টানলো জিভ দ্বারা শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে কর্দমাক্ত মাটির আইলে পা রাখল; উত্তেজনায় বুঝি হৃদপিণ্ডটা এখুনি লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে।

হারিকেনের হলুদ আলোয় বিজনেস স্ট্যাটিস্টিকস এর মোটা বইয়ের পাতায় চোখ ভুলাচ্ছে প্রিয়তা একটু পরপর আগ্রহ হারিয়ে বড় বড় হাই তুলছে, এই পড়ায় মনোযোগ লাগছে না কিছুতেই। তবু ও প্রাণপণ চেষ্টা করছে আগ্রহ ধরে রাখার, সামনে সেমিস্টার টেস্ট ফেল করলেন এক্সাম ফ্রী স্বরূপ প্রণয় ভাইয়ের ১০ লাখ টাকার ইয়াক্কা বুল বুল হয়ে যাবে।

খোলা জানালার পর্দা গলিয়ে ফুরফুর করে শীতল হাওয়া ঘরে প্রবেশ করছে। চোখ বন্ধ করে সেই মৌসুমী বাতাস গায়ে মেখে নিলো প্রিয়তা, চিত্তের চঞ্চলতা কেমন শিথিল হয়ে আসছে। হঠাৎ ‘ঠাস’ করে কাঠের দরজা খোলার মৃদু শব্দ মনোযোগ ছুটে যায় প্রিয়তার।
সে এই মুহূর্তে এই ঘরে সম্পূর্ণ একা। দৃষ্টি, সৃষ্টী, রুহি, স্নেহা, জারা, নুহা—ওরা কেউ নেই। সকলে বাইরে গেছে কোনো কাজে; বলেছিল ফিরতে খানিক দেরি হবে।
এ সময় কে আসতে পারে—ভেবে খানিক গুটিয়ে গেল প্রিয়তা। সঙ্গে সঙ্গে পিছন থেকে কাতর কণ্ঠে সেই বহুল কাঙ্খিত সম্বোধনটি ভেসে এলো—

“জান…”
ডাকটা বোধহয় কলিজায় ছুড়ি চালিয়ে দিল প্রিয়তার। অজানা অনুভূতির ঢেউ খেলে গেল শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে, পর পর আবারও সেই একই সম্বোধনে নিঃশ্বাস আটকে এলো প্রিয়তার। ভারী চোখের পলক ঝাপটে পিছন ঘুরতেই বুকের ভেতরটা ছ্যাত করে উঠল।
তীরের ফলার ন্যায় বুকে বিধলো প্রিয় পুরুষের নেশা জড়ানো আসক্ত চোখ দুটি।
তার থেকে দুই হাত দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছে প্রণয়, চুলগুলো উসকো, খুস্ক চোখ দুটো লাল।
প্রিয়তা অবাক হওয়ার সময় পেল না, তার পূর্বেই সমস্ত দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে নিজ সত্তায় মিশিয়ে নিল, আশ্রয় দিল প্রিয়তাকে তার প্রিয় নীড়ে।

শরীরের সবটুকু শক্তি দিয়ে আঁকড়ে ধরল প্রণয়। রুক্ষ শরীরের ভাজে অনুভব করলে তুলতুলে এক অস্তিত্ব। এই সেই শান্তি, এই সেই সন্তুষ্টি, এই সেই কোমলতা, এই সেই ভালোবাসা, যাকে পেতে শরীরের সকল রক্ত ঝড়িয়ে দিতে রাজি প্রণয়।
প্রিয়তা কিছুই বুঝলো না কিংবা, বুঝতে ও চাইল না। আদুরে বিড়াল ছানার ন্যায় ঘাপটি মেরে পড়ে রইল বুকের মাঝে।
বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁপা কন্ঠে ধমকে উঠলো প্রণয় প্রিয়তার দেহে মৃদু চাপ প্রয়োগ করে বলল—
“তোতা পাখি তুই কিভাবে আমাকে মরার জন্য একলা ফেলে চলে এলি? খুব বাড় বেড়েছে তোর তাই না তুই জানিস না তোকে ছাড়া তোর প্রণয় ভাই একটুও থাকতে পারে না… জানিস না তুই তোর দূরত্বে মৃত্যু হয় তোর প্রণয় ভাইয়ের?”
প্রিয়তা এসব হৃদয় নিংড়ানো কথা শুনে একটুও গলে গেল না। বরং দুই হাত বুকের ওপর রেখে অল্প জুড়ে ধাক্কা দিয়ে বলল—

“খারাপ লোক ছাড়ুন আমাকে। আপনি তো এর থেকে ও বেশি কষ্ট ডিজার্ভ করেন কোন ইঁদুরের ছাও আপনাকে আমার ঠিকানা দিছে এক্ষুনি চলে যান আপনি।”
“হাঁসের বাচ্চা একদম প্যাক প্যাক করিস না অনেক জ্বালিয়েছিস বাঁচাতে চাইলে এখন একটু শান্তি দে। তোকে বুকে নিলে এতো আরাম লাগে কেন জান? পৃথিবীতে আরো একটা দুটো তুই থাকলে কি এমন ক্ষতি হতো।”
প্রিয়তা মুখ বাঁকিয়ে ভাব নিয়ে বলল—
“কারণ তনয়া শিকদার প্রিয়তার কোন রিপ্লেসমেন্ট নেই। ভিক্ষুক আপনি, শান্তি ভিক্ষা করতে চাইলে আপনাকে আমার দুয়ারে আসতেই হবে।”
ঠোঁট কামড়ে হেসে ফেলল প্রণয়। প্রিয়তার গলায় মুখ ডুবিয়ে গভীর হাস্কে টোনে বলল—

“তাহলে দুর্বলতা ধরে ফেলেছিস তুই এত চালাক কবে হলি জান, তুই তো আমার বোকাশুকা একটা মুরগির বাচ্চা ছিলি।
“আপনি বানিয়েছেন…”
” উহম, প্রণয় শিকদারের দুর্বলতা আইডেন্টিফাই করতে পেরেছিস বলেই দুর্বল জায়গায় আঘাত করে চলে এসেছিলি, একবারও এই ভিক্ষুকের জন্য মায়া হলোনা।”
প্রিয়তা এবার আরো চটে গেলো। প্রণয়ের বুকে কিল ঘুষি মারতে মারতে বলল—
“এই ছাড়ুন আমায়। একদম ছুবেন না, আপনি বহুত খারাপ মানুষ। ওখানে থাকলে আপনি আমায় এভাবে ছেড়ে দিতেন, আপনার বন্ধুর সঙ্গে বিয়ে দিয়ে হালি হালি বাচ্চা পয়দা করিয়ে তবে ক্ষ্যান্ত হতেন। এখন এসছে পিরিত দেখাতে!”

প্রণয় ছাড়ল না, বুকের আরও গভীরে টেনে নিল প্রিয়তাকে। মাথার চুলে ঠোঁট চেপে ধরে বলল—
“এসব কেন করি, আমার জ্বালাটা যদি তুই বুঝতে পারতিস…”
প্রিয়তার মুখ তেতো হলো, নাক মুখ কুঁচকে বলল—
“থাক থাক, হয়েছে হয়েছে। যথেষ্ট বুঝেছি, ক্ষেমা চাই আর বুঝতে চাই না।”
প্রণয় আর কিছু বলল না। কিছুক্ষণ এভাবে থেকে প্রিয়তার আঙুলের ফাঁকে আঙুল গুঁজে দিয়ে বলল—
“আচ্ছা, আমার অভিমানী রাজকন্যা, তোর অভিমান পরে ভাঙাব। এখন চলো, আমার সঙ্গে।”
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকালো। এক চুল ও না নড়ে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থেকে প্রশ্ন করল—
“কোথায়?”
প্রণয় থ্রস্থ কণ্ঠে জবাব দিল—

“জানি না, কিন্তু এখানে আর এক মুহূর্তও নয়।”
প্রিয়তার চোখ সরু শুধালো—
“কি খিচুড়ি পাকাচ্ছেন বলুন তো?”
“গোয়েন্দাগিরি পরে করবি, এখন চল এখান থেকে।”
প্রিয়তা হাই তুলল—
“আপনার ইচ্ছা, আপনি যান। আমি কোথাও যাচ্ছি না।”
মেয়েটার দিনদিন জেদি হয়ে যাচ্ছে।
প্রণয় চাপা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল। প্রিয়তার দুই হাত মুঠোয় পুরে চুমু খেল। নরম গলায় বলল—
“জেদ করিস না, ময়না পাখি। এখানে আর কিছুক্ষণ থাকলে তোমার অনেক বড় বিপদ।”
প্রিয়তার কপালে ভাঁজ পড়ল। সন্দিহান কণ্ঠে বলল—

“কি বিপদ?”
প্রণয় বিব্রত বোধ করল। প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলল—
“এটা এখন তোকে বলতে পারব না, শুধু এতটুকু জান আমার প্রাণ পাখি, ওপর অনেক বড় বিপদ আসতে চলেছে।”
প্রিয়তার কপালের ছোট ছোট ভাঁজগুলো আরো দৃঢ় হলো, চোখ ছোট ছোট করে গভীর পর্যবেক্ষণি দৃষ্টিতে দেখল প্রণয়ের অস্থিরতা।
তার মন বলছে—বড় কিছু হচ্ছে বা হবে।
প্রিয়তার ভাবতে ভাবতে ব্রেনের বাত্তি জ্বলে উঠল।
সামনের পুরুষটার অস্থিরতা দেখে মনে মনে শয়তানি হেসে বলল—
“বার বার ঘু ঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, এবার ঘু ঘু তোমার বধিবো পরান।”
“কি হলো চল সোনা?”

প্রিয়তা ঠোঁট বাঁকিয়ে হেসে বলল, “যাবো, কিন্তু আই হ্যাভ এ ওয়ান কন্ডিশন।”
প্রণয় তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে বলল, “ওকে, আমি সব শুনব — কিন্তু এখানে নয়, এখান থেকে—”
“উহু, এখুনি শুনবেন।” প্রিয়তা নাছোড় বান্ধা জেদ ধরে বলল।
প্রণয় হার মেনে নিয়ে তাড়া দিয়ে বলল, “আচ্ছা ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি বল।”
অনুমতি পেয়ে মনের সুপ্ত বাসনা পেশ করল প্রিয়তা। লাজুক হেসে বলল, “বিয়ে করুন আমায়, আজ, এখানেই, এখুনি।”
শর্ত শুনে বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল প্রণয়।

প্রিয়তা প্রণয়ের বাহু জড়িয়ে ধরে, মায়াভরা চোখে তাকালো প্রণয়ের দিকে, আদুরে গলায় বায়না ধরে বলল, “আমার শুধু আপনাকে চাই প্রণয় ভাই, আপনার ভালোবাসা চাই, আপনার বউ হতে চাই, বিয়ে করুন আমায়।”
প্রণয় ঠোঁট কামড়ে নিজের অনুভূতি সংযত করল। প্রিয়তার কোমল গালে হাত রেখে বলল, “এই যে আমায় ছুঁয়ে আছিস, আমি কি জানিস?”
“কি?”
“ধ্বংস।”

“আমাকে স্পর্শ করা প্রত্যেকটা জিনিস ধ্বংস হয়ে যায় — বলা বাহুল্য, আমি ধ্বংস করে দিই। কিন্তু তুই তো আমার আদরের ছোট্ট পুতুল, যাকে আমি নিজের হাতে তৈরি করেছি — যাকে এত ভালবেসে বুকে আগলে রেখেছি তাকে ধ্বংস করার সামর্থ্য আমার নেই আর না তার ধ্বংস দেখার সামর্থ আছে।”
“আমাকে আপন করলে তোর জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে প্রাণ।”
প্রিয়তার চোখ অশ্রুতে টলমল করে ওঠে, তবু ও হাতের বাধন শক্ত করে দৃঢ় কন্ঠে বলল,
“কবুল।”
“আমার নামের সাথে নাম জড়ালে সারা জীবন হাহাকার ব্যথিত কিছুই মিলবে না।”
“কবুল।”
“আমার গভীর স্পর্শে ঝলসে যাবে তোর ফুলের অঙ্গ।”
“কবুল।”
“আমাদের পারস্পরিক মিলনে মৃত্যু ব্যতীত সুখ আসবে না।”
“কবুল।”

এবার রেগে গেল প্রণয়। প্রিয়তা দুই বাহু ঝাঁকিয়ে চিত্‍কার দিয়ে বলল, “কি দেখেছিস তুই আমার মাঝে? তুই জানিস না আমি কে! তুই জানিস কি আমার পরিচয় জানলে ঘৃণায় থুথু ফেলতে চাইবি না! তখন তোর কাছে মনে হবে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ নিকৃষ্ট মানুষটা তোর সামনে দাঁড়িয়ে আছে।”
“জানতে চাই না।”
প্রণয় দাতে দাঁত চেপে নিজেকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করল। হাতের কব্জি চেপে ধরে কঠোর কন্ঠে বলল, “পাগলামি করিস না, চল আমার সঙ্গে।”
“যাব না।” — প্রিয়তা জেদ ধরে বসে রইল।
“উফ, বুঝবার চেষ্টা কর — এখানে থাকা তোর জন্য সেফ না।”
“তাহলে বলুন, বিয়ে করবেন?”
“না।”
প্রিয়তা বিরক্ত হয়ে নাক কুচকালো, ‘হাই’ তুলে বলল, “তাহলে যান তো মিয়া যান, শুধু শুধু আজাইরা প্যাঁচাল পারবেন না। ঘুম পাচ্ছে, অবশ্যই যাওয়ার আগে ওই রুম থেকে একটা খেতা-বালিশ এনে নিয়ে বিদেয় হোন।”
“জান…”

প্রিয়তা প্রত্যুত্তরে আবার কিছু বলতে গিয়েই থেমে গেল। খুলা জানালার দিকে চোখ পড়তেই দেখল, অন্ধকারে কেউ জমির হাঁইল দিয়ে হেঁটে এদিকেই আসছে।
এবার আরেকটা সাংঘাতিক কুবুদ্ধি মাথায় চারা দিয়ে প্রিয়তার। শয়তানি হেসে তাকালো প্রণয়ের দিকে।
ওর হাসি দেখে ভুরু কুঁচকাল প্রণয়।
প্রিয়তা আচমকাই তার গলা জড়িয়ে ধরে টপাটপ চুমু দিতে লাগলো, শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে মাধকীয় কন্ঠে গাইলো, “আশিক বানায়া আশিক বানায়া আশিক বানায়া আপনে।”
ওর অবস্থা দেখে সন্দিহান কন্ঠে শুধালো, “কি চাই?”
“আপনার দেহ”- প্রিয়তার কণ্ঠস্বরে ঘোর মাধকতার আভাস পেলো প্রণয়।
প্রিয়তা উল্টাপাল্টা জায়গায় স্পর্শ করছে দেখে তার দুই হাত একত্রে চেপে ধরল প্রণয়। কঠোর সংযমী কণ্ঠে বললো, “তুই আমাকে ব্যাড টাচ করছিস।”

প্রিয়তা উন্মুক্ত বুকে নাক মুখ ঘষেতে ঘষেতে বলল, “উমহ করছি তো আপনি আসলেই আস্ত এক প্যাকেট ডার্ক চকোলেট, প্রণয় ভাই। আপনাকে দেখলেই শুধু কামড়ে কামড়ে খেয়ে ফেলতে মন চায়! ডোন্ট মাইন্ড আপনাকে একটু টেস্ট করি,” বলেই বুকে হালকা বাইট করলো প্রিয়তা।
এমন অদ্ভুত ব্যবহারে হতবাক হয়ে গেল প্রণয়। প্রিয়তা নিজের গলার ওড়না খুলে ছুঁড়ে মারল জানালা দিয়ে।
প্রণয় ঢোক গিলে বলল, “কি করছিস এগুলো?”
প্রিয়তা জবাব দিল না, বাঁকা হেসে প্রণয়কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল বিছানায়। খোঁপার ক্লিপটা খুলে ছুড়ে মারলো, উন্মুক্ত চুলগুলো এলোমেলো করে ঝাঁপিয়ে পড়ল প্রণয়ের ওপর।
প্রণয় হতবাক গলায় শুধালো, “কি করছিস এসব?”
প্রিয়তা এবার ও কোনো জবাব দিল না, বরং হালকা উঁচু গলায় বলল, “আহ্ আহ্ প্রণয় ভাই, আস্তে করুন লাগছে।”

প্রণয় বিস্ময়ে চোখ বড় বড় করে ফেলল।
প্রিয়তা ফের বলল, “আহ্ আস্তে কামড় দিন, ব্যথা পাই তো।” বলতে বলতে নিজেই প্রণয়ের গলায় জোরে কামড়ে দিল।
প্রণয় ওর মাথায় বাড়ি মেরে বলল, “এই, তোকে কোথায় কামড় দিলাম?”
প্রিয়তা দুজনের উপর হালকা চাদরটা টেনে দিয়ে বলল, “আহ্‌ ফা*ক প্রণয় ভাই!”
এবার কাশি উঠে গেল প্রণয়ের।
সঙ্গে সঙ্গে দরজার সামনে থেকে চিত্‍কার দিয়ে উঠল কেউ — “ওরে নুরুল চাচা, হারান চাচা, মুখলেস চাচা ফারজানা চাচী! দেখে যান, আমাদের গ্রামে কি নষ্টামি চলছে!”

লোকটার চিত্‍কার শুনে ধড়ফড়িয়ে শুয়া থেকে উঠে বসল প্রণয়, ভয়ার্থ চোখে তাকালো লোকটার দিকে।
ফিনফিনে, হেংলা গড়নের, সাদা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরা একটা লোক, তার চিৎকারে মুহূর্তের মধ্যেই হুড়মুড় করে আশপাশের ঘরগুলো থেকে ২০–২৫ জন মানুষ দৌড়ে এলো সেই কুঁড়ে ঘরের সামনে।
প্রিয়তা চোখ মুখে অসহায়ত্ব ফুটিয়ে তুলে শরীর ঢাকার অভিনয় করছে।
মানুষ জড়ো হয়ে যাচ্ছে দেখে চিন্তিত হলো প্রণয়। লোকগুলো ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে আছে তাদের দুজনের দিকে।

“ছ্যা ছ্যা ছ্যা ছ্যা! এভাবে রাতবিরেতে আমাদের গ্রামে ফুর্তি করছে! আর এই মেয়েটা — তোকে তো ভালো মনে করেছিলাম, তুই শেষমেষ এমন নষ্টা বেরলি?” বলে ছি ছি করে উঠলেন একজন মহিলা।
এতক্ষণ নীরব থাকা প্রণয় এবার খেপে গেল।
রক্তিম চোখে তাকিয়ে হিশহিশিয়ে বলল, “মুখ সামলে কথা বলুন, নাহলে—”
প্রণয়ের হুমকিতে আরও খেপে গেল লোকগুলো।
তর তর করে ভেতরে ঢুকে এসে বলল, “চোরের মায়ের বড় গলা! এই ধর ধর বাঁধ দুটোকে, এরা রাতবিরেতে নষ্টামি করে আবার আমাদের হুমকি দেয়!”
পরিস্থিতি অনুকূলে নেই বুঝতে পেরে রাগ চিবিয়ে গিলে নিল প্রণয়—
“এদের ঘাটালে এখন নিজেরাই বিপদে পড়ব।”
প্রণয় বোঝানোর উদ্দেশ্যে কিছু বলতে যাবে তার আগেই নাকে মুখে হাত চেপে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে উঠল প্রিয়তা, কন্ঠে অপরাধবোধ মিশিয়ে বলল,
“এ আমি কি ভুল করে ফেললাম! এখন কি হবে আমার! আমার কে বিয়ে করবে আমাকে? আমার সতীত্ব যে নষ্ট হয়ে গেল!”

প্রণয় শক্ত চোখে তাকালো প্রিয়তার দিকে।
উচ্চ স্বরে ধমকে উঠে বলল, “কি সব নাটক করছিস! আমি কি তোর সাথে কিছু করেছি?”
প্রিয়তা কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি তুলে বলল, “দয়া করে এমন অস্বীকার করবেন না প্রণয় ভাই, আমি মরে যাবো। আপনি তো বলেছিলেন আমায় বিয়ে করবেন, তাই তো আপনার সাথে…”
এই বাঁধ বাঁধ পোলা তাকে বেঁধে কয়েক ঘা লাগা, খাঙ্কির পোলা মাইয়াটারে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নষ্ট করল।
বলে সত্যি সত্যি লোকগুলো মারতে তেড়ে এলো, এবার সত্যি সত্যি ভয় আতকে উঠলো প্রিয়তা। কাহিনি অন্যদিকে ঘুরে যাচ্ছে দেখে সবার সামনে আবার প্রণয়কে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“দয়া করে মারধর করবেন না, উনাকে যতই হোক ভালোবাসি তো। মারার কী দরকার, আপনারা বরং আমাদের বিয়ে দিয়ে দিন, যাতে আর ছেড়ে দিতে না যেতে পারে।”

প্রিয়তার কথা শুনে থেমে গেল লোকগুলো, প্রণয় রাগী দৃষ্টিতে তাকাল প্রিয়তার দিকে।
কিন্তু ওসবে পাত্তা দিল না প্রিয়তা, অবলা মুখে লোকগুলোর দিকে চেয়ে রইল ন্যায়বিচারের আশায়।
লোকগুলো নিজেদের মধ্যে ফিসফাস করে কি যেন বলল, “ঠিক আছে, ছেলেটাকে মারব না, তবে এই মেয়েটাকে বিয়ে করতে হবে ওর।”
প্রণয় বিরক্ত কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল, “অসম্ভব, আমি বিয়ে করতে পারব না, আর এসব আমাদের দু’জনের ব্যাপার, আমাদের মধ্যে আপনারা আসবেন না।”
“বিয়ে না করলে তো তোদের যেতে দেব না, নষ্টামী করে পার পেয়ে যাবে তোদের দুটোকেই জ্যান্ত জ্বালিয়ে মারব।”

এদের কথা শুনে ভয় কেঁপে উঠলো প্রিয়তা। প্রণয় এবার দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল; এদের থেকে সহজে ছাড়া পাওয়া যাবে না। লোকগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখল ২৫ জন থেকে বাড়তে বাড়তে এখন পঞ্চাশ জনের অধিক। এতজনের সঙ্গে একা সে একা কখনো পারবে না।
মহিলাদের একজন বলল, “ছিঃ, ওই নষ্টা মেয়েকে এভাবে ছাড়া উচিত না। ওর চুল নেড়া করে মাথায় গুল ঢেলে চার গ্রাম ঘোরানো তবেই এর আসল বিচার হবে।”
এতে উপস্থিত লোকগুলো সন্তুষ্ট হয়ে সম্মতি জানালো।
এদের কথা শুনে ভয়ে আতঙ্কে জমে গেলো প্রিয়তা, আরও শক্ত করে প্রণয়ের সঙ্গে জড়িয়ে ধরল।
প্রণয় দেখল লোকগুলোর ভাব ভালো না, এরা বিয়ে না দিয়ে ছাড়বে না।
মহিলাগুলো এগিয়ে এসে প্রিয়তার চুলের মুঠি চেপে ধরতেই ডুকরে কেঁদে উঠল প্রিয়তা, আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরল প্রণয়ের বাহু।

প্রণয় নরম হাতে প্রিয়তার চুলের মুঠি ছাড়িয়ে নিয়ে কর্তৃত্বপূর্ণ কণ্ঠে হুংকার দিয়ে বলল,
“দূরে সরুন, মনের ভুলে ওর শরীরে কেউ ছোঁয়ার দুঃসাহস দেখাবেন না।”
প্রিয়তা নিজেকে লুকিয়ে ফেলল প্রণয়ের পেছনে।
লোকগুলো আবার কিছু কটু বাক্য ছুঁড়ে মারতে চাইলে হাত দিয়ে থামিয়ে দিল প্রণয়।
কাঠ-কাঠ কণ্ঠে বলল, “বেশি কথা না বলে কাজী ডাকুন, আমি বিয়ে করতে রাজি আছি।”
লোক গুলো চুপ হয়ে গেল, প্রিয়তা চোখ বড়ো বড়ো করে তাকাল প্রণয়ের মুখের দিকে।
দশ মিনিটের মধ্যেই গ্রামের কাজীকে ডেকে আনল লোকজন।
বিস্ময়ে হতবাক প্রিয়তা, তার বিশ্বাসই হচ্ছিল না—এতোদিনের পুষে রাখা স্বপ্নটা তার এভাবে পূরণ হতে চলেছে।
কাজী সাহেব তাদের সম্মুখে বসে বললেন,
“তোমাদের নাম আর তোমাদের বাবার নাম বলো।”
প্রণয় গম্ভীর গলায় বলল। সব শুনে কাজী সাহেব দ্রুত বিয়ের পড়ানো শুরু করলেন—

> “বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম — পরম করুণাময়, অসীম দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি।”
“আলহামদুলিল্লাহ, আজকের এই পবিত্র ক্ষণে
রায়পুর নিবাসী জনাব সাদমান শিকদারের জ্যেষ্ঠ পুত্র আবরার শিকদার প্রণয়
ও একই রায়পুর নিবাসী জনাব সাজিদ শিকদারের কনিষ্ঠ কন্যা তনয়া শিকদার প্রিয়তা
তাদের মধ্যে ইসলামী শরীয়াহ মোতাবেক নিকাহ সম্পন্ন করা হচ্ছে।”
“হে তনয়া শিকদার প্রিয়তা, আপনি কি স্বেচ্ছায় ও খুশি মনে জনাব সাদমান শিকদারের জ্যেষ্ঠ পুত্র আবরার শিকদার প্রণয় সাহেবকে এক লক্ষ এক টাকা দেনমোহর ধার্য করে বিবাহ করতে সম্মত আছেন? যদি থাকেন তাহলে তিনবার ‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল’ বলুন।”
প্রিয়তা ভয় ভীতি ভুলে খুশিতে বাকবাকুম হয়ে গেল, কোনো ধরনের থামাথামি ছাড়াই এক নিঃশ্বাসে বলে দিল—
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল, আলহামদুলিল্লাহ কবুল, আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
কাজী সাহেব প্রণয়ের দিকে ফিরে বলেন—

“হে আবরার শিকদার প্রণয়, আপনি কি স্বেচ্ছায় ও খুশি মনে সাজিদ শিকদারের কনিষ্ঠ কন্যা তনয়া শিকদার প্রিয়তাকে এক লক্ষ এক টাকা দেনমোহর ধার্য করে বিবাহ করতে সম্মত আছেন? যদি থাকেন তাহলে তিনবার ‘আলহামদুলিল্লাহ কবুল’ বলুন।”
প্রণয়ও এক নিঃশ্বাসে বলে ফেলল—
“আলহামদুলিল্লাহ কবুল, আলহামদুলিল্লাহ কবুল, আলহামদুলিল্লাহ কবুল।”
অতঃপর কাজী সাহেব বললেন—
“সাক্ষীদের উপস্থিতিতে আমি ঘোষণা করছি, আল্লাহর নামে এই নিকাহ সম্পন্ন হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা এই নবদম্পতিকে ভালোবাসা, রহমত ও বরকতে পরিপূর্ণ জীবন দান করুন।”

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭৩

“বারাকাল্লাহু লাকা, ওয়া বারাকা ‘লাইকা, ওয়া জামা‘আ বাইনাকুমা ফি খাইর।”
(আল্লাহ তোমাদের উপর বরকত দান করুন এবং কল্যাণে একত্র রাখুন।)
বিয়ের সম্পন্ন হতে প্রণয় কঠিন চোখে তাকালো প্রিয়তার দিকে, যার অর্থ একবার ছাড়া পাই তোর খবর আছে।
প্রিয়তা চোখ দেখে ভীষম খেয়ে গেল।

ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৭৫

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here