ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৯
প্রিয়স্মিতা তেহজীব রাই
শুদ্ধো ফোনে কাউকে চিৎকার করে বলছে, “তুমি আমাকে একদম ফোন দেবে না! কতবার বারণ করেছি তোমাকে! গায়ে পড়া মেয়ে-ছেলে! ছিঃ!”—বলে ফোন কেটে দিল।
সে আজ সারাদিন অনেক ব্যস্ত ছিল। প্রীথাকে বিদায় দেওয়ার পর পরি হাসপাতালে ছুটেতে হয়েছে। আজ পরপর তিনটি হার্টের অপারেশন করেছে সে, তাই ভীষণ ক্লান্ত। শরীরটা ও ম্যাজম্যাজ করছে, কোনো কাজ করতে ইচ্ছেই করছে না।
তার ওপর আবার এই মেয়েটার জালাতন সে জাস্ট নিতে পারছে না এই মেয়েটা তাকে অতিরিক্ত বিরক্ত করে! নিজের মনেই ফোঁসফোঁস করতে করতে সে হাসপাতালের পোশাক পাল্টে নিল। ওয়ার্ডরোব থেকে ট্রাউজার ও টি-শার্ট নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকবে, তখনই তার কিছু একটা মনে পড়ল।
সে ড্রয়ার খুলে একটা ফটো ফ্রেম বের করে ছবিটার দিকে অপলক তাকিয়ে রইল। ছবিটায় স্পর্শ করে চোখ বন্ধ করে নিল। চোখের পাতায় ভেসে উঠল একটি নরম, কোমল, সুগন্ধি, পবিত্র ফুল। শুদ্ধোর এক আকাশ পরিমাণ ইচ্ছে—ওই ফুলটাকে একটুখানি ছুঁয়ে দেখার, নিজের বুকে জড়িয়ে নেওয়ার! সে সেই তৃষ্ণায় কতকাল ধরে তৃষ্ণার্ত! পিপাসার্ত!
সে আবার চোখ মেলে ছবিটার দিকে চাইল। ছবিটিতে নীল চোখের, লম্বা চুলওয়ালা একটি হাস্যোজ্জ্বল মুখের প্রতিচ্ছবি। যার চেহারার প্রতিটি পরতে পরতে লেপ্টে আছে অপার্থিব ও অনিন্দ্য সৌন্দর্য। আজীবন ধরে দেখলেও চোখ ফেরানোর ইচ্ছে হবে না!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
শুদ্ধো ছবিটায় গভির চুমু খেয়ে বলল, “সুইটহার্ট, খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে আমার করে নেব! ট্রাস্ট মি! খুব তাড়াতাড়ি! অনেক ভালোবাসব তোমাকে! সারাদিন ভালোবাসব, সারারাত ভালোবাসব, সারাজীবন ভালোবাসব! এত ভালোবাসা দেব যে তোমার কখনো প্রণয়ের কথা মনেই আসবে না। আমার ভালোবাসায় আগলে রাখব তোমাকে আমার বুকে—তুমি শুধু একটি বার আমার হয়ে দেখো! পৃথিবীর সকল সুখ তোমার পায়ে লুটিয়ে দেব।”
এইসব বলে আবারো চুমু খেতে নিলে…
ফোনটা দ্বিতীয়বারের মতো তারস্বরে বেজে উঠলো।
এইবার চরম বিরক্তিতে কপালের শিরা ফুলে উঠলো শুদ্ধর। ফোনের স্ক্রিনে নামটা দেখে রাগ আর বিরক্তি দুটোই সমানতালে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। সে ফোন রিসিভ করেই চেঁচিয়ে বলল, “কি সমস্যা তোর? তোকে না বারণ করেছি আমাকে ফোন দিতে? তোকে আর কিভাবে বারণ করলে তুই আমারে ফোন দেওয়া বন্ধ করবি?”
ওপাশের মেয়েটি বলল, “আমার সঙ্গে এভাবে কেন কথা বলছ তুমি?”
চটে থাকা শুদ্ধর মেজাজ এবার আকাশে উঠলো। সে দাঁত কিড়মিড় করে বলল, “তোর মতো গায়ে পড়া মেয়ের সাথে এর থেকে ভালো ব্যবহার আমার জানা নেই!”
মেয়েটির চোখ ছলছল করে উঠলো। সে ভাঙা গলায় বলল, “শুদ্ধ ভাইয়া, আমি রায়পুরে এসে গেছি।”
শুদ্ধ কয়েক সেকেন্ডের জন্য অবাক হয়ে গেল। কি বলল সেটা ব্রেনে প্রসেস হতে একটু সময় নিলো। যখনই বুঝতে পারল কী বলেছে, তৎক্ষণাৎ ফোন কেটে সোজা ব্লক করে দিল। রাগে গজরাতে গজরাতে বলল,
“এই একটা মেয়ে আমার জীবনটা জাহান্নাম বানিয়ে ছেড়ে দিয়েছে! একে সে কবেই নিজের রাস্তা থেকে সরিয়ে দিত, কিন্তু নিজের একমাত্র ফুপির মুখের দিকে তাকিয়ে পারে না। আবার এই মেয়েটাকে সহ্যও হয় না! সারাদিন জোঁকের মতো চিপকে থাকার পাঁয়তারা খোঁজে! আর যখন-তখন কল, মেসেজ দিয়ে ডিস্টার্ব করে!”
এসব ভাবতে ভাবতে তার মুখটা তেতো হয়ে গেল।
সে প্রিয়তার ছবিটার দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বলল, “তুই সবার থেকে আলাদা জানিস? এগুলো একটা ও তোর নখের যোগ্য না।”
সে আরও কিছুক্ষণ ছবিটা দেখার পর তার মনে পড়লো, তাকে গোসল করতে হবে। সে মনে মনে একটু হাসলো—প্রিয়তাকে দেখতে গেলে তার সময় জ্ঞান সব উলট-পালট হয়ে যায়!
সে ছবিটা যথাস্থানে রেখে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।
প্রীথম নিজের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে আছে। সে তার রসগোল্লাকে মিস করছে। বিড়বিড় করে বলছে, “ইচ্ছে তো হচ্ছে গাল দুটো টেনে চুমু খাই!” চুমু খাওয়ার ইচ্ছে সে কিছুতেই দমাতে পারল না, তাই ভাবতে লাগল কী করা যায়। হুট করেই তার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে গেল।
সে ফোন বের করে ইনায়াকে টেক্সট লিখল—
“রসগোল্লা, আমার প্রচুর ব্লিডিং হচ্ছে! তুমি তাড়াতাড়ি আসো!”
ইনায়া তখন হাতে নেইলপলিশ লাগাচ্ছিল।
ফোনে টুং শব্দ হতেই সে ফোনটা হাতে নিল। আশেপাশে পূর্ণতা নেই।
মেসেজ ওপেন করতেই তার সর্বাঙ্গ ঝটকা দিয়ে উঠল। তড়িৎ গতিতে বিছানা থেকে নেমে দৌড় লাগাল চারতলায়। অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে শিরায়-উপশিরায়।
তাড়াহুড়ো করে সে প্রীথমের ঘরের দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করল।
সারা ঘরময় অন্ধকার ও নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে আছে। তার এমনিতেই অন্ধকারে ভয় লাগে! সে দেখল, বারান্দায় ক্ষীণ আলো জ্বলছে। পা টিপে টিপে, দুরদুর বুকে, সে সেদিকে পা বাড়াল।
প্রীথম রেলিংয়ে হাত দিয়ে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে। আজকের চাঁদটা অর্ধেকের বেশি গোল—চারদিকে মনোরম ধূতি ছড়াচ্ছে।
ইনায়া দৌড়ে এসে প্রীথমের পিঠে ঝাঁপিয়ে পড়ল!
প্রীথম তাল সামলাতে না পেরে সামান্য সামনের দিকে ঝুঁকে গেল। ইনায়া তাড়াহুড়ো করে তাকে সামনের দিকে ঘুরালো, সারা শরীরের এদিক-ওদিক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল, সে কোথায় ব্যথা পেয়েছে।
প্রীথম মনে মনে হাসল। ইনায়া পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভালো করে দেখছে। উত্তেজনায় সে ভুলেই বসেছে যে, সে একজন পরিপূর্ণ পুরুষের দেহে—যেখানে-সেখানে হাত দিয়ে এভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা যায় না! স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে সে লজ্জায় প্রীথমের দিকে চোখ তুলে ভালো করে দেখতেও চায় না।
অভিমানী কন্যার কাজলকালো টানা চোখে পানি টলমল করছে। সে বুঝে গেছে, প্রীথম তাকে মিথ্যে কথা বলেছে! অভিমানে তার বুক ভারী হলো। এই নিষ্ঠুর লোকটা কখনোই বুঝবে না, সে আঘাত পেলে ইনায়ার কতটা কষ্ট হয়!
সে কিছু না বলে পিছিয়ে গিয়ে এক পা বারান্দার দিকে বাড়াতেই প্রীথম তার কোমর জড়িয়ে ধরল।
অভিমানে ইনায়া প্রীথমকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে করতে বললো, “ছাড়ুন আমাকে!”— সে অভিরাম ঠেলা-ধাক্কা দিতে লাগলো।
আপনাদের মনে হয়, সাতাশ বছরের এক বলিষ্ঠ পুরুষকে ওর মতো দু’ধের শিশু ঠেলে সরাতে পারবে? উহুঁ! কখনোই না!
প্রীথম আরও একটু চেপে ধরলো! গোলুমোলু মেয়েটা একটু রাগ করলেই তার আদর আদর পায়, ফুলে থাকা গালের ওপর চুমুর ঝড় বইয়ে দিতে মন চায়! তাই তো সে সর্বক্ষণ তার রসগোল্লাকে রাগানোর মতলবে থাকে!
সে বুঝলো, এই মেয়েটাকে “থিরিং-বিরিং” এভাবে শান্ত করা যাবে না! তাই কৌশল খাটালো।
চুলের ক্লিপটা খুলে দিলো!
সাথে সাথেই পিঠের ওপর ছড়িয়ে পড়লো একরাশ রেশমের মতো শিল্কি কালো চুল!
চুল থেকে ছুটে এলো প্রিয় নারীর দেহের ঘ্রাণ!
প্রীথম ভেবেছিল এভাবে তার রসগোল্লাকে কাবু করে ফেলবে, কিন্তু এখন সে নিজেই কাবু হয়ে যাচ্ছে! তার কেমন মাতাল মাতাল লাগছে।
সে ইনায়াকে আরেকটু কাছে টেনে নিলো। আলতো হাতে মুখটা উঁচু করে ধরে ইনায়ার কালো চোখে নিজের নিলাভ নীল সাগরের মতো চোখ জোড়া স্থির করলো। ইনায়া চোখ সরিয়ে নিলো— ওই চোখে সে বেশিক্ষণ তালিয়ে থাকতে পারে না!
প্রীথম গলায় স্লাইড করতে করতে হাস্কি টোনে বললো, “রসগোল্লা, একটু আদর করি?”— বলেই জবাবের প্রতিজ্ঞা করো না। ইনায়ার গলায় নিজের গাল ঘষতে লাগলো।
ইনায়ার সর্বাঙ্গ শিরশির অনুভূতিতে চেয়ে গেল! এমন কথায় ও স্পর্শে কিশোর-কন্যার শরীরও মনে কিরকম অদ্ভুত এক নেশা ধরানো অনুভূতি হচ্ছে— যেমন অনুভূতি সে এই মানুষটির কাছে না আসলে আর কোথাও পায় না! প্রীথমের খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো ওর গালে-গলায় স্পর্শ করছে, তার মনে হচ্ছে এখুনি সে দম আটকে মারা পড়বে!
প্রীথম ঘাড় থেকে চুল সরিয়ে ইনায়ার গলা আর গালে ছোট ছোট চুমু দিতে লাগলো!
মনে হচ্ছে, কেউ তাকে হাজার ভোল্টেজের ইলেকট্রিক শক দিচ্ছে!
এমনটা নয় যে প্রিতম থাকে আজ প্রথমবার স্পর্শ করছে কিন্তু প্রতিবারই তার কাছে নতুন মনে হয় এই পুরুষের স্পর্শ সে নিতে পারে না।
সে আর সহ্য করতে পারলো না। সামনে ফিরে উঁচু হয়ে প্রীথমের টি-শার্ট খামছে ধরে গলা জড়িয়ে ধরলো!
প্রীথমের পুরোপুরি নেশা চড়ে গেছে!
তার ওই নীলাভ চোখে অন্যরকম ভাষা— যা ইনায়ার অন্তরঅবধি নাড়া দিচ্ছে!
বিড়ালছানার ন্যায় সে প্রীথমের বুকে লেপ্টে আছে। প্রীথমের শরীরের মেনলি ঘ্রাণটা ইনায়ার মস্তিষ্কের সব কিছু উলটপালট করে দিচ্ছে!
প্রীথম মাথা নিচু করে ইনায়ার কপালে চুমু খেলো। তারপর গালে, আর কানের লতিতে চুমু খেলো! হাস্কি টোনে বললো, “I love you, রসগোল্লা! I love you so much, and I wanat you!”
ইনায়ার বুকের ভেতর কেমন তোলপাড় করা অনুভূতি হচ্ছে!
প্রীথম ধীরে ধীরে ইনায়ার ঠোঁটে স্লাইড করছে… নরম লাল স্ট্রবেরির মতো ঠোঁট দুটি যেন তাকে বলছে— Eat me!
প্রীথম একহাত কোমরে, আরেক হাত চুলের মাঝে রেখে ইনায়ার অধরে নিজের অধর ডুবিয়ে দিলো!
ইনায়া চটফটিয়ে উঠলো! খামচি দিতে লাগলো এখান-ওখান!
পাঁচ মিনিট পর, প্রীথম ইনায়াকে ছেড়ে দিল!
এবার তার চোখ গেল অন্য জায়গায়। সে নিজেকে আর কন্ট্রোল করতে পারছে না!
এক ঝটকায় দূরে সরে গেল।
ইনায়া অবাক হলো!
প্রীথম আবার তার আদুরিনীর দিকে তাকালো—
“তার চোখেও সে নিজের মতো নিষিদ্ধ কামনা-বাসনা দেখতে পাচ্ছে! কিন্তু এই মুহূর্তে সে কোনো রকম ভুল করতে চায় না!”
তাই সে আবার কাছে চলে এলো।
কোমর চেপে ধরে গলায় গভীরভাবে চুমু খেলো, তারপর সেখানে জুরে সুরে একটা কামড় বসালো!
ইনায়া চেঁচিয়ে উঠলো—
“মা গো!”
রেগে বলল, “কামড় দিলেন কেন?”
প্রীথম বাঁকা হেসে বলল—
“এটাকে কামড় বলে না, বেবি! পাপ হবে! ইট’স কলড লাভ বাইট!”
চোখ টিপ দিয়ে বলল, “তুমি চাইলে তুমিও দিতে পারো!”
বলে নিজের গলা এগিয়ে দিয়ে বলল, “বোনাস হিসেবে আমাকে পুরোটা খেয়েই ফেলতে পারো! ট্রাস্ট মি, মাইন্ড করবো না!”
ইনায়া রেগে গিয়ে সত্যি সত্যি প্রীথমের বুকে কামড় বসিয়ে দৌড় দিল!
প্রীথম বাঁকা হাসলো!
এই আদুরে মেয়েটা কাছাকাছি থাকলে সে কোনো মতেই নিজের উপর কন্ট্রোল রাখতে পারে না। সে খুব ভালো করেই জানে— কন্ট্রোল রাখতে না পারার কারণ একটাই! সে এই আদুরে মেয়েটার প্রতি সে বড্ড আসক্ত… বড্ড বেশি ভালোবাসে এই মেয়েটাকে!
নিশুতি রাত।
প্রহেলিকা প্রণয়ের বুকে মাথা দিয়ে ঘুমিয়ে আছে, কিন্তু ঘুম নেই প্রণয়ের চোখে!
শিকদার বাড়ি এখন ঘুমন্তপুরী— প্রত্যেকে প্রায় মরার মতো ঘুমাচ্ছে। কিন্তু ঘুম নেই তার চোখে!
সে নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস নিল। মনে হচ্ছে, বুকের উপর কেউ পাথর চাপিয়ে দিয়েছে, সে জাস্ট নিতে পারছে না!
প্রহেলিকার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
প্রহেলিকাও ঘুমায়নি।
সে-ও পিছু নিলো।
প্রণয় প্রিয়তার ঘরে গেল। সেখানে দুটি মেয়ে ঘুমিয়ে আছে।
প্রণয় সেদিকে তাকালো না। সে প্রিয়তার ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। সেখানে ময়লা কাপড়ের ঝুড়ি থেকে জমিয়ে রাখা একটা কালো রঙের ওড়না নিল, যেটা প্রিয়তা কাচার জন্য রেখেছিল।
প্রণয় সেটি নিয়ে তিনতলার মাঝারি আকারের ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়ালো।
হাতের ওড়নাটা নাকের কাছে নিয়ে গভীর নিঃশ্বাস নিলো!
নিঃশ্বাসের সাথে শু-শু করে অতি প্রিয় মেয়েলি ঘ্রাণটা ফুসফুসে গিয়ে ঠেকলো।
ওড়নাটা বুকে জড়িয়ে নিলো!
আবার বের করে প্রাণ ভরে ঘ্রাণ নিলো!
দূর থেকে দেখলে মনে হবে, কোনো ড্রাগ-এডিক্টেড লোক তার প্রিয় ড্রাগ গ্রহণ করছে।
সে আবারও ওড়নাটা বুকে জড়িয়ে নিলো!
ওড়নাটাতে চুমু খেয়ে বললো, “ওই শার্টটা কেচে দিয়েছে! ওইটাতে তুই নেই, জান! ওটাতে আমি তোর গন্ধ পাই না, ওটাতে আমি তোকে অনুভব করতে পারি না! তাইতো এটা নিয়ে এলাম! তুই তো জানিস, তুই দুনিয়ায় আসার পর থেকে একটা মুহূর্তও আমার তোকে ছাড়া চলে না! তোকে আমার সব সময় কাছে চাই! যে সবকিছুতে তুই নেই, সেইসব বড়ই বিষাদময়, রে জান!”
সে পাগলের মতো এসব প্রলাপ বলতে লাগলো …
দূর থেকে এসব দেখে প্রহেলিকার বুকটা ফেটে যাচ্ছে!
সে বললো, “কেন আমাকে ভালোবাসলে না, প্রণয়? কেন ভালোবাসলে না? আমি কি তোমাকে কম ভালোবাসি? বলো! আজ পর্যন্ত ন্যায়-অন্যায় যাই করেছি, সবই তো তোমার জন্য করেছি! আমাকে কি একটুও ভালোবাসা যায় না? ওকে যতটা ভালোবাসো, আমার অতটা ভালোবাসা চাই না! সামান্য ভালোবাসলেই হবে! প্লিজ, প্রণয়! প্লিজ, একটু ভালোবাসো আমাকে! দেখবে, আমি আজীবন তোমার পায়ের কাছে পড়ে থাকবো!”
এসব বলতে বলতেই তার বুক ফেটে কান্না আসছে!
সে মুখে ওড়না গুঁজে নিজের ঘরের দিকে দৌড় দিলো!
এইসব দৃশ্য প্রেম দূর থেকে দেখলো।
সে-ও দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আল্লাহকে বললো—
“হে মহান রব, তোমার দরবারে কোনো কিছুই অভাব নেই! তুমি তো সব জানো! এদের সবার জীবনে একটু শান্তি দাও! সবার মনে শান্তি দাও! আর কারো জীবন নষ্ট হতে দিও না! ভালোবাসা হারানোর যন্ত্রণা যে বড় ভয়ানক!”
সকাল ৯টা-১০টার দিকে সবাই প্রীতার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে!
অর্থি বেগম চেঁচাচ্ছেন ছেলেদের সাথে, কিন্তু তারা কেউ তাদের মা-ছোটোমার কথা কানেই তুললো না!
মটকা মেরে পড়ে রইলো!
অর্থি বেগম অনুশ্রী বেগমকে বললেন, “বড় ভাবি, আমি পারিনি! আপনি দেখুন!”
তিনি প্রথমে তার বড় ছেলের ঘরে নক করলেন।
প্রহেলিকা দরজা খুলে সালাম দিলো।
অনুশ্রী বেগম বললেন, “প্রণয় কই, আম্মু?”
প্রহেলিকা বললো, “গোসল করছে!”
অনুশ্রী বেগম বললেন, “তারাতারি দু’জনে নিচে নামো!”
প্রহেলিকা মাথা দুলালো।
এরপর তিনি মেঝো ছেলে প্রীতমের ঘরের দরজায় কয়েকবার নক করলেন!
কিন্তু প্রীতমের ঘুম এতটাও হালকা নয় যে, এমন ছোটোখাটো ধাক্কায় উঠে পড়বে!
এসব মিষ্টি শোরগোল তার কানেই গেলো না!
অনুশ্রী বেগম এবার চেঁচিয়ে বললেন, “মেঝো আব্বু, তারাতারি উঠো! না হলে এখন তোমাদের দাদাভাইকে ডাকবো!”
এতক্ষণ সে বড় আম্মুর কথা আমলে না নিয়ে মটকা মেরে পড়ে থাকলেও, প্রণয়ের কথা কানে আসতেই লাফিয়ে উঠলো!
ঘুম-ঘুম চোখে দরজা খুলে বড় আম্মুর মমতা মাখা মুখ দেখে প্রাণ জুড়ানো হাসি দিলো!
ঘুম-ঘুম চোখে অনুশ্রী বেগমকে জড়িয়ে ধরে প্রীতম বলল, “ওহ, বড় আম্মু! আরেকটু ঘুমাই না?”
অনুশ্রী বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “না, আব্বু! ৯টা বেজে গেছে! বোনের বাড়িতে যেতে হবে তো!”
প্রীতম নড়ে-চড়ে উঠল!
এরপর অনুশ্রী বেগম তাকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে রাজের রুমের দিকে গেলেন।
রাজ উদোম গায়ে উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে!
অনুশ্রী বেগম দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকে দেখলেন, ছেলে এভাবে শুয়ে আছে। তিনি বিরক্ত হলেন!
এই ছেলেকে তিনি কতবার বলেছেন, “খালি গায়ে না ঘুমাতে! জিন-পরির নজর লেগে যাবে!” ওনার ছেলেগুলো মাশাআল্লাহ রাজপুত্রদের মতো, নজর লাগাও অস্বাভাবিক কিছু নয়।
কিন্তু এই ছেলে তার কোনো কথাই কানে তোলে না!
অনুশ্রী বেগম ডাকাডাকি শুরু করলেন।
রাজ একটু নড়ে-চড়ে আবার ঘুমিয়ে গেল!
এবার তিনি রেগে গিয়ে কানের ধরে বসিয়ে দিলেন!
সে ঘুম-ঘুম চোখে হতবম্ব হলো!
কিছুক্ষণ পর মায়ের রণচণ্ডী রূপ দেখে সে বুঝতে পারল কী হচ্ছে!
তিনি ধমক দিয়ে বললেন, “তোকে কতবার বারণ করেছি, খালি গায়ে না শুতে!”
রাজ আম্মুর কোমর জড়িয়ে পেটে মাথা রেখে বলল, “সরি আম্মু!”
তিনি একটু নরম হলেন, মাথায় হাত বুলিয়ে ছেলেকে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে সমুদ্র ও অরণ্যের ঘরে গেলেন।
দুই ভাই বিদঘুটে ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে! দুজনের ঘুমানোর স্টাইল এতই খারাপ যে, তা বলার বাইরে!
অরণ্যের পা দুটো বেডের ওপরে ঠেকানো, আর সে সমুদ্রের পা জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে!
সমুদ্র ঝুলে আছে— একটু এদিক-ওদিক হলেই ধপাস করে নিচে পড়বে!
অনুশ্রী বেগম মনে মনে বললেন, “এই ছেলেগুলো কবে বড় হবে?”
তিনি দুই ছেলেকে ডেকে তুলে প্রেমের ঘরে গেলেন।
প্রেম পাশবালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে!
অনুশ্রী বেগম প্রেমের মাথায় হাত বুলিয়ে আদুরে সুরে ডাকলেন।
প্রেম আধো-আধো চোখ মেলে তাকিয়ে সামনের সবকিছু ঝাপসা দেখল। অনুশ্রী বেগম তার বেডসাইড টেবিল থেকে চশমাটা তুলে ছেলের চোখে পরিয়ে দিলেন।
প্রেম মাকে দেখে হাসল। মায়ের হাত জড়িয়ে নিয়ে বলল, “আম্মু, মাথায় হাত বুলিয়ে দাও!”
অনুশ্রী বেগম মমতার সাথে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
ছেলেকে ফ্রেশ হতে পাঠিয়ে তন্ময় আর থরির রুমে গেলেন।
দুই পুচকু ঘুমাচ্ছে!
তিনি দু’বার ডাক দিতেই থরি উঠে গেল, কিন্তু তন্ময় উঠল না!
তন্ময় যেন রাজের কার্বন কপি! কানের কাছে ড্রাম বাজালেও সে ঘুম থেকে উঠবে না। তার কাছে ঘুম খুব প্রিয় একটা সাবজেক্ট!
তিনি অনেক কষ্টে তাকে তুলে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে নিচে চলে গেলেন।
চার গিন্নি মিলে নাস্তার টেবিল রেডি করছেন।
প্রেরণা, প্রহেলিকা, কুহু, চিত্রা, পূর্ণতা, ইনায়া,তোরি, তিরা— সবাই রেডি হয়ে নিচে নামলো।
সবাইকে অনেক মিষ্টি দেখাচ্ছে!
কিছু সময়ের মধ্যেই তরুণ শিকদাররাও হ্যান্ডসাম লুকে হাজির!
সবাই মিলে ডাইনিং টেবিল আলো করে বসে পড়লো।
চার কর্তা সকাল সাতটার সাথে সাথেই নাস্তা সেরে নেন। এটা তাদের নিয়ম, তাই এখন গিন্নিদের দামড়া বাচ্চারা খাবে!
সবাই সিরিয়াল ওয়াইজ বসে পড়লো।
পুরো ডাইনিং টেবিলে জমজমাট পরিবেশ।
গিন্নিরা সবার প্লেটে খাবার তুলে দিচ্ছেন!
এমন সময় একটা স্টাইলিশ, সুন্দরী মেয়ে এসে সোজা শুদ্ধ’র পাশের চেয়ারটায় বসে পড়লো!
শুদ্ধ কেবল স্যান্ডউইচে কামড় বসিয়েছিল। কেউ পাশে এসে বসেছে অনুভব হতেই পাশে তাকালো!
পাশের মানুষটাকে দেখে চোখ-মুখ কুঁচকালো!
তুহিনা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুদ্ধ’র দিকে!
পুরো টেবিল হাঁ করে তাকিয়ে আছে শুদ্ধ’র দিকে!
এটা দেখে সবাই মিটিমিটি করে হাসছে!
কারণ তারা সবাই জানে, তুহিনা শুদ্ধকে কতটা ভালোবাসে!
প্রেরণা বললো, “আপি, তুমি কখন এলে?”
তুহিনা লাজুক হেসে বললো, “কালকেই!”
সবার এত আদিখ্যেতা দেখে শুদ্ধ বিরক্ত হলো!
সবাই বেশ উত্তেজিত, শুধু তিনজন ছাড়া— প্রহেলিকা, প্রণয় আর শুদ্ধ!
শুদ্ধ’র ভীষণ রাগ হচ্ছে এই মেয়েটার ওপর!
এই মেয়ে ওর জিনা হারাম করে দিয়েছে!
সবার খাওয়া শেষ হলে একে একে গাড়িতে গিয়ে বসল!
এক গাড়িতে চার কর্তা।
এক গাড়িতে চার গিন্নি।
এক গাড়িতে প্রণয়, প্রীতম, প্রেম, রাজ, সমুদ্র।
অন্য এক গাড়িতে প্রেরণা, প্রহেলিকা, পূর্ণতা,ইনায়া, চিত্রা, কুহু।
আরেক গাড়িতে তিরা, তোরি, তন্ময়, সাদাফ,শুদ্ধ।
শুদ্ধ ড্রাইভিং সিটে বসতেই তুহিনা এসে ওর পাশে বসল!
শুদ্ধ রেগে গেল, কিন্তু কিছু বললো না!
পরপর গাড়িগুলো শিকদার বাড়ির গেট অতিক্রম করে চলে গেলো!
তালুকদার বাড়ি আজ রাজকীয় স্টাইলে সাজানো হয়েছে, কারণ বড় ছেলের বিয়েতে তালুকদার সাহেব কোনো কমতি রাখতে চান না!
প্রীথাকে সুন্দর করে সাজাচ্ছে তার একমাত্র ননদ সুহা, প্রিয়তা আর পরিণীতা! লাল রঙের লেহেঙ্গায় রানীর মতো লাগছে!
প্রিয়তা আর পরিণীতা তাদের জন্য বরাদ্দ করা কক্ষে বসে ভাবছে— কে কোনটা পরবে!
প্রিয়তা আর পরিণীতার বডি মেজারমেন্ট, হাইট, ওয়েট— সব এক!
প্রিয়তা সিম্পলের মধ্যে এক্সক্লুসিভ কালো রঙের একটা গাউন সিলেক্ট করল।
পরিণীতা পার্পেল রঙের একটি ডিজাইনার শাড়ি সিলেক্ট করল।
দুই বোন মিলে হাসাহাসি আর গল্পের পাশাপাশি সাজগোজ শুরু করলো!
পরিণীতা গলায় আর কানে এক্সক্লুসিভ ডায়মন্ডের সেট পরে নিলো।
হাতে ডায়মন্ডের চিকন চারটি চুড়ি।
কপালে ছোট হোয়াইট স্টোনের টিপ।
রিবন্ডিং করা চুলগুলো কার্ল করে ছেড়ে দিলো।
ফর্সা শরীরে শাড়িটা আর ম্যাচিং গয়নাগুলো চকচক করছে, যেন সত্যি কোনো হুরপরী!
প্রিয়তা হাঁ করে তাকিয়ে ছিল।
পরি বললো, “কি দেখছিস?”
প্রিয়তা বললো, “তোকে ভীষণ সুন্দর লাগছে, আপু!”
পরিণীতা প্রিয়তার গালে হাত দিয়ে বললো, “তোর থেকে বেশি না!”
বলে দুই বোন হেসে দিলো!
এবার প্রিয়তা রেডি হয়ে নিলো।
কালো রঙের গাউনে তাকে একেবারে “ব্ল্যাক কুইন” লাগছে!
অতি ফর্সা শরীরে কালো রঙটা দারুণ মানিয়েছে।
হাঁটু অব্দি লতানো চুলগুলো কার্ল করে পিঠের ওপর ছেড়ে দিলো।
হাতে কালো রঙের চুড়ি, কানে সিম্পল ডায়মন্ড বসানো ইয়াররিং পড়ে নিল।
কপালে ছোট্ট কালো টিপ।
নীল চোখে হালকা কাজল আর ঠোঁটে ডার্ক লিপস্টিক!
একদম পুতুলের মতো লাগছে মেয়েটাকে। সত্যি, কোনো নারী যে এতটা মায়াময়ী হয়, সেটা প্রিয়তাকে দেখার আগে কেউ মানতেই চাইবে না।
যে কোনো ছেলের “হার্ট অ্যাটাক” করানোর জন্য যথেষ্ট!
দুই বোনকে সত্যিকারের রাজকন্যার মতো লাগছে!
আসলে শিকদার বংশের সবাই অতি সুদর্শন আর সুদর্শনা!
দুপুর ১২টার দিকে শিকদার বাড়ির সবাই তালুকদার বাড়িতে এসে পৌঁছালো।
প্রীথাকে স্টেজে বসিয়ে রাখা হয়েছে।
সাদিক আর তার বাবা-চাচারা অতিথিদের আপ্যায়নে কোনো কমতি রাখছে না!
শিকদার বাড়ির লোক বলে কথা!
বাড়ির সব মেয়েরা বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে তরুণ শিকদারদের দিকে!
বিশেষ করে প্রণয় আর শুদ্ধকে—চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে! ছেলেদুটোকে বড্ড আকর্ষণীয় দেখাচ্ছে, একদম “চকলেট বয়”!
এমনকি চার কর্তারাও এখনো যথেষ্ট সুদর্শন!
কিন্তু তাদের এসব বিষয়ে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই! কারণ, তাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো প্রিয়তমা রয়েছে।
সবাই মিলে প্রীতার কাছে গেল!
প্রীতার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল প্রিয়তা আর পরিণীতা!
বিয়ে বাড়িতে বুড়ো থেকে ছোড়া—সবাই হাঁ করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে!
বিয়ে বাড়ির বিশেষ প্রজাতির আন্টিদের চোখ-মুখ চকচক করছে! হয়তো তারা মনে মনে বলছে—”এরকম একটা মেয়ে যদি আমার বেটার বউ হতো!” কিন্তু আফসোস! চাইলেই কি আর সব পাওয়া যায়? শিকদার বাড়ির মেয়েদের নিয়ে এমন কল্পনা করাও তাদের জন্য বিলাসিতা!
সবাই প্রীতার সাথে দেখা করতে এলেন!
প্রীথা বাবা-মা, ভাই-বোনদের দেখে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো!
দৌড়ে গিয়ে সাদমান শিকদারকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল!
তিনি ও ভাতিজির মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন!
এক এক করে সবার সাথে কথা বলছে প্রীথা!
কিন্তু দু’জন পুরুষের চোখ স্থির হয়ে গেছে একটি নারীর ওপর!
প্রণয় আশেপাশে তাকিয়ে দেখল… সব বয়সের ছেলেরাই প্রায় প্রিয়তাকে দেখছে!
বিশাল রাগ হলো তার!
এই মেয়েটাকে সে ছোট থেকেই প্রয়োজন ব্যতীত বাইরের মানুষের সাথে মিশতে দিত না।
তার কিনা আজ এসব অসহায় হয়ে দেখা ছাড়া কোনো উপায় নেই!
কিছু বলার বা অধিকার দেখিয়ে কিছু বলার অধিকারটা ওর নেই!
সে জানে, সে যদি প্রিয়তাকে কিছু বললে বলতে দেরি কিন্তু করতে দেরি হবে না।
কিন্তু সে এমন করবে না! কারণ, তার রক্তজবা প্রথম থেকেই তার প্রতি ভীষণ দুর্বল!
এখন তার এমন অধিকারবোধ প্রকাশে সে আরো দুর্বল হয়ে পড়বে।
হঠাৎ করেই প্রিয়তার নজর পড়ল প্রণয়ের উপর। হোয়াইট ফরমাল শার্টের সাথে ব্ল্যাক প্যান্টে ওকে ভীষণ সুদর্শন লাগছে । শরীরের জিম করার সুগঠিত মাসেলস গুলো শার্টের উপর দিয়ে স্পষ্ট ভেসে উঠছে রীতিমতো সব মেয়েরা হা করে তাকিয়ে আছে। প্রিয়তার ভীষণ খারাপ লাগল, আবার রাগও হলো। আবার মনে মনে বলল—
“সে তো অন্য কারোর! অন্য কাউকে ভালোবাসে, প্রতিনিয়ত জড়িয়ে থাকে অন্য কারোর সাথে মায়ায় সেখানে কয়েকটা মেয়ে কি তাকাল কি না তাকাল, তাতে কী বা যায় আসে!”
প্রিয়তা আবার মনে মনে বলল যে পুরুষ অন্য কারো সে পুরুষের প্রতি আমার এত ভালোবাসা
যে শুনবে সেই পাপি বা পাপিষ্ঠা বলে আখ্যায়িত করবে আমার নিশ্চিত জাহান্নামে ও ঠাই হবে না
আমি জানি আমি তোমাকে এ জনমে কক্ষনো পাবো না কিন্তু বিশ্বাস কর তোমাকে ভালোবাসাটা ছাড়তে পারবো না।।
এসব ভেবে তার অন্তর চিরে নিঃশ্বাস বেরিয়ে এল।
সেলফি কুইন পরিণীতা বিভিন্ন পোজে ছবি তুলছে, কিন্তু সে মহা বিরক্ত। কারণ, একটা ছবিও ওর মনের মতো হচ্ছে না! ও আপুর বিয়ের সকল অনুষ্ঠান মিলিয়ে মোট ৪০,০০০+ ছবি তুলেছে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, ওর অনেক ফটোগ্রাফার রয়েছে—প্রেরণা, প্রিয়তা, থিরা, থোরি, ইনায়া, কুহু, চিত্রা—সবাই। কিন্তু এখন সে কাউকেই খুঁজে পাচ্ছে না।
এর উপর উত্তপ্ত সূর্যের রশ্মিতে দাঁড়িয়ে থাকায় চেহারা লাল হয়ে গেছে! পরিণীতা গরমের মাঝে ভারী শাড়ি পরে রেগে গজগজ করতে করতে বলল—
“উফ! এত করে ডাকলাম, একটা ছবি তুলে দেওয়ার জন্য কেউ এল না! সব স্বার্থপর, বেঈমানের দল! এখানে আমার মাস্টারমশাই থাকলে ওদের কাউকেই লাগত না!”
আবিদের কথা মনে পড়তেই ওর গাল লাল হয়ে উঠল। এমনিতেই ফরসা মেয়ে, তার উপর গরমে টুকটুকে লাল হয়ে গেছে। লজ্জার লালিমায় গাল দুটি যেন চেরি ফলের মতো দেখাচ্ছে। এমন সৌন্দর্যের বাহার দেখে সাদাফ কয়েকটা হার্টবিট মিস করল! শাড়ি পরিহিতা এই অতি সুন্দর রমণী তার বক্ষপিঞ্জরে ঝড় বসিয়ে দিচ্ছে।
সে কাছে এসে নমনীয় স্বরে বলল—
“ফুলপরী!”
পরিণীতা পিছনে ফিরে চাইল। সাদাফকে দেখে মন মাতানো হাসি হেসে বলল—
“সরি ভাইয়া, ওই দিনের জন্য!”
সাদাফ মনে মনে বলল—
“এভাবে হেসো না, ফুলপরী! তাহলে যে নিজেকে কন্ট্রোল করা অনেকটাই কষ্ট হয়ে যাবে!”
সাদাফ বলল, “ও, আমি কিছু মনে করিনি। কী করছ তুমি, ফুলপরী?”
পরিণীতা ঠোঁট উল্টে বলল, “আমাকে ছবি তুলে দেওয়ার মতো মানুষ পাচ্ছি না! আপু-বনুরা কেউ আসছে না!”
সাদাফ ওর গাল টেনে দিয়ে বলল, “এই ব্যাপারে আমি আছি তো!”
পরিণীতার চোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠল। সাদাফ প্রশস্ত হাসল। এই মেয়েটার সামান্য আনন্দও যে তাকে কতটা প্রশান্তি দেয়, সেটা কি এই সপ্তদশী জানে?
সাদাফ ও পরিণীতা বাড়ির পাশের বাগানে গেল। সাদাফ ওকে বিভিন্ন পোজে ছবি তুলে দিচ্ছে, আর পরিণীতা একের পর এক পোজ দিচ্ছে। প্রায় ১০০-র মতো ছবি তোলার পর পরিণীতা ছুটে এসে উচ্ছ্বাসিত কণ্ঠে বলল—
“কই? দেখি ছবিগুলো!”
সাদাফ নিজের ফোনে ছবি তুলেছিল, তাই ফোনটা ওর হাতে দিল।
পরিণীতা মন দিয়ে একের পর এক ছবি দেখছে। সবগুলোই প্রায় অসাধারণ!
এমন সময় দূর থেকে অরণ্য ডাক দিল—
“ভাইয়া, শুনছেন?”
সাদাফ ফিরে তাকাল।
অরণ্য আবার বলল, “আপনাকে বড়দাদান ডাকছে!”
সাদাফ পরিণীতার দিকে তাকিয়ে বলল, “ফুলপরী, তুমি দেখো, আমি একটু আসছি!”
পরিণীতা মাথা নাড়ল।
সাদাফ অরণ্যের সঙ্গে ভেতরের দিকে যাচ্ছিল, এমন সময় অনন্যা বলল, “ভাইয়া, আপনি এত জেন্টল হয়ে ওই চুন্নিকে কেমন করে পছন্দ করলেন?”
সাদাফ বুঝতে পারল না। কপালে ভাঁজ ফেলে বলল, “কে চুন্নি?”
অরণ্য দুষ্টু হেসে বলল, “বুঝি, বুঝি! সবই বুঝি!”
সাদাফের কপালের ভাঁজ মিলিয়ে গেল। সে ক্ষীণ হাসল।
অরণ্য বলল, “ভালো মানিয়েছে! চালিয়ে যান!”
সাদাফ প্রণয়ের সাথে কথা বলে ফিরছিল। এমন সময় ফোন বেজে উঠল। পকেট থেকে বের করে দেখল, এটা পরিণীতার ফোন। তখন পরিণীতা নিজের ফোনটা সাদাফের হাতে দিয়েছিল। সে দেখল, স্ক্রিনে একটা নাম ভাসছে—মাস্টারমশাই।
সাদাফ ভাবল, হয়তো ওর কোনো স্যার হবে। ধরবে কি ধরবে না, একটু ইতস্তত করছিল, কিন্তু বারবার ফোন আসতে দেখে আগের জায়গায় ছুটে গেল। কিন্তু আশেপাশে কোথাও পরিণীতা নেই। বাধ্য হয়েই ফোনটা রিসিভ করল।
ওপাশ থেকে পুরুষালী কণ্ঠ ঝাঁঝিয়ে উঠল—
“এই মেয়ে! তোমার সমস্যা কী? কখন থেকে ফোন দিয়ে যাচ্ছি!”
সাদাফ অবাক হলো। স্যার এমনভাবে কথা বলছে কেন?
আবিদ আবার বলল, “অ্যাঞ্জেল, কথা বলছো না কেন?”
সাদাফ আরও অবাক হলো! সে বলল, “আমি পরিণীতা নই।”
আবিদ হতবাক হয়ে কণ্ঠ নামিয়ে বলল, “তাহলে আপনি কে?”
সাদাফ বলল, “আমি পরিণীতার আপনজনদের মধ্যেই পড়ি। কোনো গুরুত্বপূর্ণ কথা থাকলে আমাকে বলতে পারেন। আমি ওকে বলে দেবো। ওকে আশেপাশে খুঁজে পাচ্ছি না।”
আবিদ বলল, “ওহ! তেমন কিছু না!” বলে ফোন কেটে দিল।
সাদাফ ভাবল, আজব! কী হলো? কিছুই বুঝলাম না!
ফোন কেটে ফোনটা শক্ত করে চেপে ধরল। সে ভাবছিল, লোকটা কী বলল? ‘আপনজন’? আর অ্যাঞ্জেলের ফোন তার কাছে কেন?
আবিদ নিজেকে শান্ত করল। সে জানে, পরিণীতা তাকে কতটা ভালোবাসে। তাই এসব উল্টোপাল্টা ভাবনা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিল।
এমন সময় মনোয়ারা বেগম ভাতের থালা হাতে ঘরে ঢুকলেন। ছেলের সামনে বসে ভাত মাখতে মাখতে বললেন—
“বাবাজান, তোর বাপের শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। তুই কোনো চাকরি-বাকরি পেলি?”
আবিদ মায়ের মায়াময় মুখের দিকে চেয়ে বলল, “হুম।”
মনোয়ারা বেগমের চোখ খুশিতে চিকচিক করে উঠল। তিনি ছেলের মুখে ভাতের লোকমা তুলে দিয়ে বললেন—
“কিসের চাকরি, বাজান?”
“কলেজের চাকরি, আম্মা।”
মনোয়ারা বেগম মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, “বাপ, তুই মাস্টার হয়ে গেছিস!” তাঁর চোখের কোণে আনন্দের অশ্রু চিকচিক করছে।
কথায় আছে না, আল্লাহ সবাইকে সবকিছু দেন না। কাউকে টাকা-পয়সা দেন, আবার কাউকে সুখ-শান্তি দেন। ঠিক তেমনি, আবিদের হয়তো অত টাকা নেই, কিন্তু সুখ-শান্তি আর ভালোবাসার কোনো কমতি নেই। আল্লাহর কাছে তার এখন একটাই চাওয়া—
তার ভালোবাসার পরীটাকে যেন আল্লাহ তার নামে লিখে দেন। সে জানে সে কোন দিক থেকে পরিনীতার তার যোগ্য নয় কোথায় রাজকন্যা আর কোথায় সে অতি সাধারন একটা ছেলে তবুও সে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রতিটি মোনাজাতে তার ভালোবাসার আকুতি জানায়।।
আবিদ ভাবল, আজকে তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে, অ্যাঞ্জেল!
শুদ্ধকে প্রায় অর্ধপাগল বানিয়ে ছেড়েছে তুহিনা! শুদ্ধ যেখানে যাচ্ছে, সেও সেখানে সেখানে যাচ্ছে!
শুদ্ধর অপমান মিশ্রিত কটু বাক্য তার চামড়ার বেধ করে ভেতরে ঢুকতেই পারছে না।
সে যেন প্রতিজ্ঞা করে নিয়েছে—”শুদ্ধর মাথাটা চিবিয়ে খেয়ে তবে শান্ত হব!”
তুহিনা চৌধুরী, শুদ্ধর ফুপি তৃণা চৌধুরীর একমাত্র মেয়ে। পেশায় ডাক্তার।
সে ডাক্তার হতে চায়নি, কিন্তু শুদ্ধর কাছাকাছি থাকার জন্য নিজের পছন্দের বিষয় ছেড়ে মেডিক্যালে ভর্তি হয়েছিল।
অনেক্ক্ষণ পর শুদ্ধ তেতে উঠে বলল, “কী সমস্যা তোর? মারবো টেনে এক চড়! বেয়াদব মেয়ে! আমার পিছে পিছে কি? হ্যাঁ? আরেকবার আমার পিছনে আসলে, I swear, এখানেই তোকে পুতে দিয়ে যাব! মাইন্ড ইট!”
ভরা বিয়েবাড়িতে এমন অপমানে তুহিনার মুখ থমথমে হয়ে গেল। চোখে জল টলমল করে উঠল।
শ্বেতা ছুটে এসে উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, “আপু, তুমি ঠিক আছো?”
ভালোবাসার সীমানা পেরিয়ে পর্ব ৮
শ্বেতা আবার বলল, “তুমি তো জানো, আপু, ভাইয়া তোমাকে পছন্দ করে না। তাও সব সময় কেন ওর পিছে পড়ে থাকো?”
তুহিনা চোখভরা জল নিয়ে শুদ্ধর যাওয়ার পানে তাকিয়ে বলল, “ভীষণ ভালোবাসি যে!”