ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ১২

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ১২
মিথুবুড়ি

“বস দেওয়ার মঞ্জিল থেকে এইমাত্র একটা GTR35 বের হল। পিছু করব?”
“যেতে দাও।”
“এয়ারপোর্টের দিকে যাচ্ছে বস।”
‘অপর পাশ থেকে রিচার্ডের নিরুদ্বেগহীন স্বরে একই জবাব,”যেতে দাও।”
‘ব্রাউন চুলের আড়ালে লুকিয়ে থাকা ললাটে ক্ষীণ এক ভাঁজ ফুটে উঠল ন্যাসোর। কাল থেকে রিচার্ডের আচরণ একটুও বুঝে উঠতে পারছে না। কায়নাত নামের এই মানুষটা শুরু থেকেই তার কাছে এক রহস্যময় গোলকধাঁধা৷ যার কেন্দ্রে পৌঁছানো আজও সম্ভব হয়নি। সাধারণ এক বাংলাদেশি ছেলে কীভাবে ইতালির পাপময় সাম্রাজ্যের রাজা হয়ে উঠল, সেই গল্প আজও অস্পষ্ট, অধরা তাদের কাছে।

“I’m nodded off.”—বলেই কল কেটে দেয় রিচার্ড। ন্যাসো আর মাথা ঘামায় না। ফোনটা পকেটে রেখে গাড়ি স্টার্ট দেয়৷ গন্তব্য—বাগানবাড়ি। তবে মস্তিষ্ক থেকে কৌতূহল মুছে ফেলা এত সহজ নয়। রিচার্ডের চোখে এলিজাবেথের জন্য কখনো কোনো বিনয় বা মুগ্ধতা দেখেনি তারা। তবুও এলিজাবেথেরচলে যাওয়া কেন রিচার্ডকে এতটা আগ্রাসী করে তুলেছিল? আবার হঠাৎ এতটা শান্ত হয়ে যাওয়ারই বা মানে কী? কারণ! কারণ!হাজারো প্রশ্ন মাথার ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে ন্যাসোর, যেগুলোর উত্তর পাওয়ার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। রিচার্ড অনুভূতি প্রকাশে ব্যর্থ এক মানুষ। পাপাচারে নিবিষ্ট জীবন তার কোমল মনকে মরিচীকার মতো বিলীন করে দিয়েছে বহু আগেই। কোমলতা হারিয়ে বুকে জন্ম নিয়েছে হিংস্র নরখাদক পশুর হৃদয়। রক্তক্ষরণের বদলে রক্ত ঝরাতেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে তার যান্ত্রিক হৃৎপিণ্ড। তবে হঠাৎ এতটা শান্ত হয়ে যাওয়ার মানে কী? যার জন্য এত দূর থেকে এসেছে, এক কলে…!
‘এলিজাবেথ, রিচার্ডের জিদ ছাড়া কিছুই না। রিচার্ড যা চায় সেটা যেকোনো মূল্যে হাসিল করে। তাহলে কি এলিজাবেথও ছিল কেবল এক মুহূর্তের জিদ? কিন্তু রিচার্ডের ক্ষেত্রে “জিদ” মানেই এক অপ্রতিরোধ্য সংকল্প যা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত সবকিছু ধ্বংস করে ফেলতেও পিছপা হয় না রিচার্ড। ঈগলের মতো হাজার ক্রোশ দূর থেকেও শিকারের ওপর ছোঁ মেরে পড়তে পারে। তাহলে হঠাৎ এই নিক্ষিপ্ততা কেন? নানান চিন্তায় ডুবে গিয়ে ন্যাসো গাড়ি চালিয়ে যেতে থাকে। উত্তরহীন প্রশ্নগুলো মনের ভেতর ঘূর্ণির মতো পাক খেতে থাকে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘ঘুমাবে বলে কল কাটলেও ঘুমায় না রিচার্ড। অবশিষ্ট মদের বোতলটা হাতে তুলে নিল। কালচে ঠোঁটের ফাঁকে বোতল গুঁজে, দুই দাঁতের ফাঁকে কর্ক চেপে ধরে এক মুচড়ে খুলে ফেলল। অতঃপর এক ঢোকে পুরো বোতল শেষ করে। শেষ হতেই ফাঁকা বোতলটা ছুড়ে মারে দেয়ালে। প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে চুরমার হয়ে ছড়িয়ে পড়ে কাচের টুকরো। গোছানো ঘর ইতিমধ্যে ময়লার স্তুপে পরিণত হয়েছে। মেঝেজুড়ে ভাঙা কাঁচ, ড্রাগসের প্যাকেট আরও ছড়িয়ে,ছিটিয়ে আছে ইনজেকশন। পুরো কক্ষ যেন এক বিধ্বস্ত রাজ্য। সারারাত এসবের মাঝেই ডুবে ছিল রিচার্ড। অথচ এত মদ গিলেও নেশা ধরছে না! ক্রোধ সামলাতে না পেরে বারবার বোতল ভেঙে ফেলছে। সিগারেট আর ড্রাগের তীব্র গন্ধে চারপাশ ভারী হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত ইনজেকশন পোশের কারণে হাতে ছোপ ছোপ রক্ত জমাট বেঁধে শুকিয়ে গেছে। তবু রিচার্ডের মধ্যে কোনো ব্যথার অনুভূতি নেই।
‘তীব্র ক্রোধে মটমট করছে রিচার্ডের ধারালো চিবুক। দাঁতে দাঁত পিষে উঠে দাঁড়ায়, ব্যগ্র পায়ে এগিয়ে যায় ক্যাবিনেটের দিকে। আর কোনো মদের বোতল নেই! মুহূর্তেই ঝড়ের মতো ঘরের অবশিষ্ট সবকিছু ভাঙচুর করতে থাকে রিচার্ড। নয় ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটের দীর্ঘ জার্নি করেও ক্লান্তির লেশমাত্র নেই শরীরে। বরং এক দানবীয় ক্রোধ চেপে বসেছে অস্তিত্বে। তবুও ঠোঁটের কোণে জড়িয়ে আছে এক রহস্যময়, অভেদ্য অভিব্যক্তি। ভাঙা কাঁচের ওপর দিয়েই উন্মাদের মতো হেঁটে গিয়ে দাঁড়ায় ট্যারেসের কিনারে। দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ঘন জঙ্গলের সীমান্তে৷ প্রতীকের মতো সোজা দাঁড়িয়ে থাকা উঁচু গাছগুলোর দিকে। চিবিয়ে চিবিয়ে উচ্চারণ করল,
“You have to pay for it red.” ‘স্বরে জেদ, চোখে নির্ভয়ের দীপ্তি। নিস্তেজ অথচ তীব্র প্রতিশোধের ম্রিয়মাণ আগুন।

‘প্লেনটি এভিয়েশন মুডে, ভুবনের সঙ্গে সব যোগাযোগ ছিন্ন করে বায়ুমণ্ডল চিরে মহাকাশের শূন্যতার দিকে ছুটছে। সাদা মেঘ গলিয়ে, দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। উদ্দেশ্য ইউএসএ। ছোট্ট কাঁচের গ্লাসের ওপার থেকে দেখা যায় মেঘেরা যেন পুরো আকাশ দখল করে ছড়িয়ে পড়েছে। একেকটি দল গঠন করে গোপন বৈঠকে মগ্ন। নীল আকাশের বুকে সাদা মেঘের রাজত্ব। নিচে ব্যস্ত শহরকে দেখে মনে হয়, যেন গুটি গুটি পিঁপড়ার সারি—যারা অবিরাম দৌড়াচ্ছে খাদ্যের সন্ধানে, জীবনের প্রয়োজনে।
‘উইন্ডো সাইডে স্থির বসে আছে এলিজাবেথ। প্লেন জার্নি ওর জন্য নতুন নয় তাই অভিব্যক্তি একদম স্বাভাবিক। তবুও সেই কখন থেকে সূদূর আকাশের দিকে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। যেন নিথর, জমাট বাঁধা কোনো জড় বস্তু। চোখে প্রাণ আছে, কিন্তু মনোযোগ নেই। সে এখনো আটকে আছে গত রাতের ঘটনায়। এই মানুষটার সান্নিধ্যে এসেছে দুই দিনও হয়নি অথচ কীভাবে ঢাল হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে গেছে সে! মাথার ওপর ছায়া দিচ্ছে বিশাল বটবৃক্ষের মতো যা এলিজাবেথ কখনোই পায়নি, কোনোদিনও না। অন্ধকার জগৎ থেকে টেনে তুলে তাকে আলোর দিকে নিয়ে যেতে চায়। সামনে এগোনোর জন্য বাড়িয়ে দিয়েছে হাত। অথচ অন্যের কলঙ্ক মুছতে গিয়ে নিজের জীবনেই কাদা মাখিয়ে নিচ্ছে সে। তবু বিস্ময়ের ব্যাপার কৃষ্ণগহ্বরের মতো গভীর বাস্তবতার মাঝেও একটুও বিষাদের ছাপ নেই তার মুখে।

~ফ্লাসব্যাক ~
‘হঠাৎ অসুস্থতার কারণে কাজী আসতে পারেনি। মাঝপথ থেকেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করা হয়। পরবর্তী সময়ে উকিল আনা হয়, সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় আপাতত রেজিস্ট্রিই হবে। দেশে ফিরে হবে ঘটা করে বিয়ের আয়োজন। তাকবীর দেওয়ান—যার নামে কিছুক্ষণ পর দলীয়করণ হবে এলিজাবেথের। মাত্র এক সাইনের মাধ্যমে তার অগোছালো জীবন জড়িয়ে যাবে এক অতি সুদর্শন ও মহৎ হৃদয়ের পুরুষের সঙ্গে। যে মানুষটা কথা দিয়েছে আগলে রাখবে সযত্নে।যেমন মাটিতে পড়ে থাকা ফুলগুলোর মতো শখ করে তুলে নেয়া হয়েছে তাকে,তেমনি বৃক্ষপটের পাশে শুভ্র পাঞ্জাবির বাম পকেটে রেখে দেওয়া হবে অতি যত্নে।
এক মুহূর্তের জন্যও নিঃসঙ্গতায় পুড়তে দেবে না সে। পথে, মাঠে, মিছিলে,সর্বত্র থাকবে বুকের বাঁ পাশে, বাম পাঁজরের হাড়ের মতোই অবিচ্ছেদ্য হয়ে। পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে এক কলঙ্কিত নারী রূপান্তরিত হবে নিষ্ঠাবান, আদর্শ নীতিমালায় গড়া এক পুরুষের স্ত্রীতে। মিনিস্টার তাকবীর দেওয়ানের স্ত্রীতে। যাকে সে চিনত… অনেক আগে থেকে, অনেক ভালো করে।

‘বিয়ের কথা একটা কাকপক্ষী কেও জানানো হয়নি। তাকবীর এলিজাবেথের নিরাপত্তার কথা ভেবে সিদ্ধান্ত নেয় আর কিছুদিন পর সবাইকে জানাবে বিয়ের কথা যখন অনুষ্ঠান করা হবে। মিনিস্টারের বিয়ে রাতারাতি ছড়িয়ে যাবে সকলের মাঝে। এভাবেই পরে তা কর্ণপাত হবে সেই নিকৃষ্ট মানবের। তাই কোনো রিস্ক নিতে চায়নি তাকবীর। বাবা তাজুয়ার আর নিজের দুই বিশস্ত বডিগার্ড রেয়ান, বিয়ান কে নিয়ে বিয়ে সম্পূর্ণ করার চিন্তাভাবনা করে স্বল্প আয়োজনের মাধ্যমে। বিয়েতে এলিজাবেথের কোনো প্রকার অভিব্যক্তি বা ভুমিকা দেখার মতো ছিল না। না কোনো আগ্রহ, না কোনো উৎফুল্লতা। এমনকি কাঁদেনি একবারের জন্যও। হঠাৎ করেই নিজেকে শক্ত খোলসে আবদ্ধ করে ফেলেছে। তাকবীর নিজে পছন্দ করে এলিজাবেথের জন্য একটা লাল টুকটুকে বেনারসি কিনে আনে। কিন্তু এলিজাবেথ পরতে চায়নি, তা নিয়ে তাকবীরও তেমন জোর করেনি এলিজাবেথকে। সম্পূর্ণ এখতিয়ার থাকা সত্বেও চাপ দেয়নি ওকে। মনের ইচ্ছে মনের মধ্যেই পোষণ করে রাখল কোনো এক বৃষ্টিবাদল দিনের জন্য।

‘পরনে সাধারণ থ্রি-পিস নিয়েই বিয়েতে বসে এলিজাবেথ। তাকবীর রক্তমাখা পাঞ্জাবি পরিবর্তন করে গায়ে নতুন পাঞ্জাবি চাপায় সাদা শুভ্র রঙের। এলিজাবেথ এক মুহূর্তের জন্যও তাকিয়ে দেখেনি তার পাশে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা বাগদত্তার দিকে। তাকবীর শূন্য অভিব্যক্তিতে তাকিয়ে ছিল এলিজাবেথের নিস্তেজ হয়ে থাকা মুখশ্রীতে। তার আকুল মন খুব করে চাইছিল তার এলোকেশী একটু হাসুক, তার মতো ভিতরে ভিতরে হলেও ছটফট করুক একটু একে-অপরের হওয়ার খুশিতে। ব্যস এইটুকুই চাওয়া শুধু তার। তবে এবারও জোর করল না তাকবীর এলিজাবেথের মনের অবস্থা ভেবে। সময় দিল আড়ষ্ট মেয়েটাকে একটু মানিয়ে নেওয়ার জন্য। সে অপেক্ষা করতে রাজি, করবে অপেক্ষা।

‘উকিল সাহেব সকল কাগজপত্র রেডি করে রাখে। রেয়ান, বিয়ান দুজনেই তাকবীরের পাশে বুক বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। দু’জনের মুখেই আন্তরিক হাসি। যথারীতি সবকিছু সুন্দর ভাবে এগোতে থাকে। তবে বাঁধ সাধে তাজুয়ার দেওয়ানের ক্ষেত্রে। বিয়ের আগ মুহুর্তে বিকট শব্দ করে দরজার ছিটকিনি খুলে বেরিয়ে আসে গমগম পায়ে। বয়সের তোড়ে চামড়া ঝুলে পরা চোয়াল ক্রোধে মটমট করছে। গুমোট পরিবেশ কেঁপে উঠে তার হুংকারে। তাকবীরের দিকে এগিয়ে দেওয়া রেজিস্ট্রার পেপার উকিলের হাত থেকে পড়ে যায়। ঢোক গিলে তাকাল প্রাক্তন সংসদ সদস্য তাজুয়ার দেওয়ানের দিকে। এলিজাবেথ কেঁপে চোখমুখ কুঁচকে রাখে।
“বীর আমি আবারো বলছি এই মেয়েকে তুমি বিয়ে করবে না।”
‘বাবার কথায় চিবুক শক্ত হয়ে আসে তাকবীরের। ওঠে দু’কদম এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বাবার সামনে। কণ্ঠ যথাসম্ভব খাদে নামানোর চেষ্টা করে বলে, “আব্বা আপনি ভিতরে যান।”
‘ছেলের নরম কন্ঠে যেন দু’কদম এগিয়ে গেল তাজুয়ার দেওয়ান। জিদ্দি গলায় বলল, “যাব। তুমিও আমার সাথে চল। কোনো বিয়ে হবে না এখানে।”

“আব্বা আমি আপনাকে যেতে বলছি।”
“আমার কথার বাইরে যাবে না বীর।”
“আব্বা আপনার ঔষধের সময় হয়ে গিয়েছে। খেয়ে ঘুমান গিয়ে।”
“আমার কথা ইচ্ছাকৃত ভাবে এরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করবে না। ভুলে যাবে না আমার সন্তান তুমি, তোমার ঘর থেকে হয়নি আমি। ”
‘তাকবীর চোখ বুজে ঠৌঁট গোল করে তপ্ত শ্বাস ফেলে রাগ নিয়ন্ত্রণে রাখার প্রচেষ্টা চালিয়ে গেল। সবিনয়ে বলল, “তাই বলছি আব্বা ঘরে যান। আমি কোনোরকম ঝামেলায় জড়াতে চাচ্ছি না। এই মুহুর্তটা খুবই স্পেশাল আমার জন্য।”
‘তাজুয়ার দেওয়ানের সেই জিদ্দি গলা, বলল, “এই বিয়ে কোনোদিনই হবে না। অন্তত আমি বেঁচে থাকতে তো না।”
সংযম হারাতে থাকে তাকবীর। বাবার চোখে চোখ রেখে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “বিয়ে তো হবেই আব্বা। তাও আজই, সেটা আপনি না মানলেও।”
‘এবার চেঁচাতে শুরু করলেন তাজুয়ার দেওয়ান,
“সাধারণ একটা দু’টাকার মেয়ের জন্য বাবার সাথে উঁচু গলায় কথা বলছ? এই মেয়ে রূপ দেখিয়ে আমার ছেলের মাথা খেয়েছিস নষ্টা মেয়েছেলে কোথা,,,,,

“ও দু’টাকার মেয়ে নই। আমার ভালোবাসা, ভালোবেসে নিয়ে এসেছি আমি বুকে নিয়ে রাখার জন্য। যদি এই গলা দিয়ে আমার স্ত্রীর ব্যাপারে আর একটা নোংরা কথা বের হয়,খোদার কসম তবে সেই গলায় পাঁচ আঙুলের দাগ বসিয়ে দিতে একটু দ্বিধাবোধ করব না আমি আব্বা।”
‘প্রচন্ড জোরে চেঁচাল তাকবীর ভদ্রতার খোলস থেকে বেড়িয়ে। নিয়ন্ত্রণে বাইরে গিয়ে উগ্রতা ভেঙে হিংস্র প্রাণীর মতো গর্জে উঠল। গ্রীবা অংশের নীলচে রগ গুলো ফুলে ফেপে উঠেছে ক্রোধে । এতোক্ষণ দম আঁটকে সকল অপমান সহ্য করে নিলেও এবার চোখ মেলে তাকায় এলিজাবেথ। ভিজে গেল তার চোখের পাপড়ি। জলে টইটম্বুর আখিঁদ্বয় মেলে জোড়ালো আলো নিয়ে তাকাল তাকবীরের দিকে। পুলকিত হয়ে গেল নারী তনুমন৷ এক বুক ভালোলাগা ছেয়ে গেল মনে। আঁধারে তলিয়ে যাওয়া মন আকাশে ঝিলিক দিয়ে উঠল এক নির্মল বিশুদ্ধ দুত্যি। সব ভুলে উৎফুল্ল চোখে দেখে গেল রাগে ফুঁসতে থাকা কৃষ্ণগহ্বর। তাজুয়ার দেওয়ান স্তব্ধ হয়ে যায় ছেলের এহেন উগ্রতা দেখে। তাকবীর তাজুয়ার দেওয়ানকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ক্রন্দ পায়ে আবার গিয়ে বসে আগের জায়গায়। তাকবীর রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে কোনোদিকে না তাকিয়ে হাতরে নিচে পড়ে কাজগুলো তুলে পাত্রের জায়গায় সই করে এগিয়ে দেয় এলিজাবেথের দিকে । এলিজাবেথ রাগে গিজগিজ করতে থাকা চওড়া চিবুকে তাকিয়ে ঘোরের মধ্যেই সই করে দেয়।

‘এলিজাবেথ ভাবনায় এতোই মজে রয়েছে যে, কেউ যে তাকে দু’চোখে গিলে খাচ্ছে তার সেদিকে খেয়াল নেই। গালের নিচে হাতের তালু ঠেকিয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে আছে তাকবীর একগুঁয়ে দৃষ্টিতে। গভীর চোখ দুটো আশ্লেষে জরিয়ে রেখেছে তার এলোকেশীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত। ষোল’র এক লাস্যময়ী নারীর শীর্নকায় স্তম্ভিত হয়েছিল সে। চার বছরে গঠনে অনেক পরিবর্তন আসলেও চেহারা থেকে সেই বিষাক্ত মায়া একফোঁটাও এদিকসেদিক হয়নি। এই মায়াময় চেহারায় যে এক পলক তালাকেই নিজের ধ্বংস দেখতে পায় প্রেমিক পুরুষ। উলোটপালোট হয়ে যায় ভিতরে সবকিছু। সময় কত দ্রুত চলে যায়।

‘কেলেন্ডারের পাতায় পিছিয়ে গেল আরো চার বছর পূর্বে। চৈত্র মাসের ভ্যাপসা গরমে খ্যাঁ খ্যাঁ করছিল চারিপাশ। খাল বিলের পানি শুকিয়ে মাটি খরখরে হয়ে যায় সেসময়। ঠিক তেমনি ভাবে ভিতরে খরার মতো শুকিয়ে ছিল এক শীর্ণ মানবের ভগ্নহৃদয়। সেদিনটা ছিল ইলেকশনের দিন। বিপুল ভোটে জয়লাভ করেও মনেও মধ্যে কোথাও বিজয়ের আনন্দের ছিটেফোঁটাও ছিল না। অযাচিত কারণে বিষাদে ছেয়ে ছিল অম্তঃকরণ। বারোটায় ফলাফল প্রকাশিত হয়।ফলাফল শোনার পরপরই তাকবীর গাড়ি নিয়ে বেড়িয়ে পড়ে একা-একা কোনো বডিগার্ড ছাড়ায়। এই ব্যস্ত শহরে মন একটু একা থাকতে চাইছে, যেখানে থাকবে না কোনো কোলাহল। যেই ভাবা সেই কাজ। আবাসিক এলাকা থেকে গ্রাম্য রাস্তার দিকে যেতে থাকে তাকবীর।

‘সূবিস্তৃর মাঠের মতো খোলা জায়গা পেয়ে গাড়ি থামায় তাকবীর, একটা বটগাছের নিচে। গাড়ির ডোর খুলে বের হতেই এক পশলা শীতল হাওয়া ছুঁইয়ে দিল তার গা। চোখ বুজে শুষে নিল তাকবীর সেই স্নিগ্ধময় প্রকৃতির সতেজ হাওয়া। বাতাসের তোড়ে পাঞ্জাবীর নিচের অংশ এ-পথ,ও-পথ ধরে দুলতে থাকে। দমকা হাওয়ায় কুঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো ভাবে উড়ে কপালে বিছিয়ে যায় কিছুসংখ্যক। প্রশান্তিময় বাতাস গুলো শরীরে মাখিয়ে নিয়ে চোখ মেলে তাকায় তাকবীর। ঘাড় ঘুরিয়ে এদিকসেদিক তাকাতে গিয়ে হঠাৎ চোখ যায় বট গাছের উপরে।

‘এক মুহূর্তের জন্য শক্ত গঠনের পুরুষালি দেহখান কেঁপে ওঠে দু’কদম পিছিয়ে যায়। শুকনো ঢোক গিলতে থাকে সে অনবরত। প্রচলিত এমন অনেক কথা শুনেছে সে, ভর দুপুরে নাকি বের হতে নেই। শাঁকচুন্নি ঘুরে বেড়ায়, বিশেষ করে বট গাছে। তবে একজন গণমান্য , সুনামধন্য মিনিস্টারের চরিত্রের সাথে এসব উদ্ভট কথাবার্তায় বিশ্বাস করা কখনোই সোভা পায় না। সাহস সঞ্চয় করে সামনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিল তাকবীর। বটগাছের সরু চিকন ঢালের মধ্য দিয়ে মোটা মোটা পাতার ফাঁক দিয়ে ঝুলে আছে এক মুঠো লাল লম্বা লম্বা চুল। এক পা বাড়ালো তাকবীর, তখনই ভেসে আসল মেয়েলি সুমধুর কণ্ঠস্বর। এক মুহুর্তের জন্য থমকে যায় তাকবীর।
“ভয় পাবেন না। এই পাড়ায় ভূত নেই, আমি মানুষ।”
“মসকরা হচ্ছে ?এই দিন দুপুরে কোনো মানুষ গাছের ডগায় উঠে বসে থাকে?”
“আমি তো মেয়ে মানুষ।”

‘গাছের উপর থেকে আগত মধু মিশ্রিত কন্ঠে এমন বাবলা কথা শুনে কপাল কুঁচকাল ফেলে তাকবীর। গমগমে গলায় বলল, “মানে?”
“কুকুর দেখে ভয় পেয়ে গাছে উঠেছি।”
‘তাকবীর ভ্রু গুছিয়ে ঠৌঁট কামড়ে আশেপাশে তাকাল। সত্যিই তার গাড়ির পিছনেই কতগুলো কুকুর দল বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। তারাও যেন অপেক্ষা করছে কখন গাছ থেকে পরিটা নামবে আর হাউ-মাউ খাও বলে হাপিশ গাপিস করে খেয়ে ফেলবে। এবার সবকিছু পানির মতো পরিষ্কার হল তাকবীরের কাছে। পুরো কথার ছক আবারো মাথায় ঘুরিয়ে ঠৌঁট কামড়ে হাসল। হেসে নিচ থেকে একটা বড় ইটের ভাঙা অংশ নিয়ে কুকুরগুলোর দিকে ছুঁড়ে মারতেই দৌঁড়ে পালিয়ে যায় সবগুলো।
“এই মেয়ে নামতে পারো এবার। কুকুরগুলো চলে গিয়েছে।”
“সত্যি তো?”
“তিন সত্যি।”

‘বাক্য কর্নপাত হবার সাথে সাথে এক লাফে নিচে পড়ল তরুণীটি। সেখানেই ফ্রিজড হয়ে যায় তাকবীর। চোখের পলক ফেলতে যেন ভুলে গেল সে। এবার মনে হচ্ছে সত্যি সত্যিই সে দিনদুপুরে ভূত দেখছে। দু’চোখ ধাঁধিয়ে গেল মুগ্ধতায়। কিছু পলকের জন্য চোখের পাতা যেন কোনো এক টাইম ট্র্যাভেলের চক্রে আঁটকে যায়। সবকিছু ভুলে শুধু চোখ জোড়ালো আলো দিয়ে দেখতে থাকে তার সান্নিধ্যে কাচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক লাস্যময়ী নারীকে। মনের কোণায় জাগা ক্ষুদ্র অনুভূতি গুলো একমনে গেয়ে উঠল, “এলোকেশী।”

‘এলিজাবেথ তাকবীরের অদ্ভুত চাহুনি দেখে কিছুটা ভরকে যায়। সবসময় ঘর বন্দী আর একা থাকার কারণে মন এখনো সেই বারো বছরের এলিজাবেথেই আঁটকে আছে। ম্যাচুরিটি তখনও আসেনি সেইভাবে। শুধু এটা জানত এই সমাজ ভালো না, তার জন্য নিরাপদ নয়। চাচা বলেছে। এলিজাবেথ তড়িঘড়ি করে কোমর সমান এলোমেলো চুলগুলো চুড়ো করে বেঁধে দেয়। অতঃপর চাদর দিয়ে চুল, মুখ আপাদমস্তক ঢেকে ফেলে। এলিজাবেথের এহেন আচরণে ছোট ছোট চোখ করে তাকায় তাকবীর। দৃষ্টি ভঙ্গ করে পা থেকে মাথা পর্যন্ত পরখ করে নিল। গায়ে সুতি গোল জামা যা প্রায় পায়ের গোড়ালি ছুঁই ছুঁই, ফুল হাতার হওয়ায় একদম বোরকার মতো লাগছে। পুরনো, ছেড়া জামাও যেন গায়ের সৌন্দর্য, মাধুর্যতা এক ফোটাও কমাতে পারেনি এই মেয়ের। গলা খাসকি দিয়ে পরিষ্কার করে নিল তাকবীর।

“এই সময় বের হয়েছ কেন? জানো না সুন্দরী মেয়েদের ভূতে আছর করে বেশি।”
‘কথার বিপরীতে এলিজাবেথের সরল জবাব, “কিন্তু আমাকে তো কুকুরে আছর করতে চেয়েছে।”
‘ঘাড় কাত করে ঠৌঁট কামড়ে হাসল তাকবীব। কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই বুঝে গিয়েছে মেয়েটা অত্যন্ত সরল সোজা। হঠাৎ করেই কেন জানি মেয়েটিকে খুব ঘাঁটতে ইচ্ছে হলো তাকবীরের। জিভ দিয়ে ঠৌঁট ভিজিয়ে বলল, “আরে বাচ্চা কুকুর আছর করে না কামড়ায়।”
চোখ বড় বড় হয়ে যায় এলিজাবেথের,”সত্যি?”
‘উপর-নীচ মাথা ঝুঁকায় তাকবীর, “হুম ! এইযে তোমার লাল চুলগুলো দেখছ এগুলো কামড়ে ছিঁড়ে ফেলবে।”
‘কর্ণপাত হতে দেরি হয়, এলিজাবেথের হাত মাথায় যেতে দেরি হয় না। চাদর দিয়ে দ্রুত ভালো করে পেঁচিয়ে দিল মাথা। কপালের দিক দিয়ে টানতে টানতে একদম চোখই ঢেকে ফেলে। এবার আর হাসি নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারল না তাকবীর। ফিক করে হেসে দিল। প্রাণখোলা, আড়ম্বর হাসি।
“কোথায় যাচ্ছিলে?”

‘কিছুটা লজ্জা পায় এলিজাবেথ নিজের বোকামির জন্য। নিভু স্বরে প্রত্যুত্তর করল, বাসায় কেউ নেই। চাচির জ্বর, তাই আমাকে বলল বোনকে স্কুলে দিয়ে আসতে।”
“আর তোমার স্কুল! তুমি স্কুলে যাওনি?”
“না।”
‘তেরছা চোখে তাকাল তাকবীর । কন্ঠস্বর খানিকটা নিচে নামিয়ে বলল,”কেন? পড়াশোনা কর না তুমি?”
‘এলিজাবেথ জটিলতা ছাড়া উত্তর দিল স্পষ্টভাষায়,
“চাঁচি বলেছে আমাকে পড়ানোর টাকা নেই।”
‘থেমে, বিষন্নতায় চুপসে যাওয়া মন হঠাৎ উৎফুল্লতায় গেয়ে উঠল, বলল, “মম আসলে আমি আবার স্কুলে যাবো।”
“মম? প্যারেন্টস নেই তোমার?”
“ড্যাড নেই।”

‘তাকবীর কিছু প্রশ্ন করতে গিয়েও করল না। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকল এলিজাবেথের চুপসে যাওয়া অবয়বে। শান্ত মুখশ্রীর অন্তরালে যে অকুতোভয়ী হৃদিন্ড হৃদয়ে কষ্টের বাঁধ ভাঙতে শুরু হয়ে গিয়েছে তা বুঝতে পারে সে। কথা পাল্টে পকেট থেকে গাড়ির চাবি বের করে চাবিতে প্রেস করে লক খুলে নিল। পরপর এলিজাবেথের দিকে তাকিয়ে ফ্রন্ট ডোর খুলে দিয়ে বলল, “গেট ইন দ্য কার বাচ্চা।”
‘বাচ্চা শব্দ শুনে নাক কুঁচকে মাথা তুলল এলিজাবেথ। ঠৌঁটে ঠৌঁট চেপে হাসল তাকবীর। সবিনয়ে বলল,
“ওঠ পৌঁছে দিচ্ছি এলোকেশী।”
‘আঙুলের ভাঁজে আঙুল দিয়ে কচলাতে থাকে এলিজাবেথ। এই নতুন নামের মানে সে বুঝতে পারেনি। মাথা নাড়িয়ে বলল, “না।”
“কেন।”
‘আমতাআমতা করতে থাকে এলিজাবেথ,”চাচা বলেছে অচেনা কারোর থেকে সাহায্য না নেওয়ার জন্য। আমার জন্য নাকি কেউ নিরাপদ না। ”

‘তাকবীর বুঝতে পারল এলিজাবেথের চাচার এই কথা বলার কারণ। কণ্ঠে নমনীয়তা আনল তাকবীর, নিদারুন কোমল স্বরে বলল, “আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। আমি নিরাপদ তোমার জন্য। কোনো ক্ষতি করব না।”
‘ উৎসুক হয়ে তাকিয়ে থাকল এলিজাবেথ। ফর্সা মুখ উদ্বিগ্নতায় ঠাসা। এমনিতেই কুকুরের জন্য অনেকটা দেরি হয়ে গিয়েছে। এখন হেঁটে গেলে আরো দেরি হবে। যত দেরি হবে চাচির কটুবাক্য তত বেশি হবে, খেতে দিবে না আজ নিশ্চয়ই । উপায়ন্তর না পেয়ে রাজি হলো এলিজাবেথ। তাকবীর এক চিলতে হেসে নিজেও গিয়ে ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিল। টুকটাক কথা বলে এলিজাবেথ কে নিয়ে বাসায় গেল। ঐ মাঠ থেকে বাসার দূরত্ব পনেরো মিনিটের। খুব আস্তে গাড়ি চালিয়ে আসলে তাকবীরের সময় লাগে মাত্র পাঁচ মিনিট। ভিতরে ভিতরে খুবই ক্ষুব্ধ তাকবীর। সময় আজ এতো তাড়াতাড়ি যেতে হলো? একটু থেমে থাকলে হতো না? শান্তি নিকেতনের সামনে গাড়ি থামায় তাকবীর। ভরদুপুর হওয়ায় আশেপাশে তেমন কেউই ছিল না। এলিজাবেথ গাড়ি থেকে নেমে এক গাল হাসি দিল। সত্যিই তো তার কোনো ক্ষতি করেনি। চাচা তাকে যেভাবে বুঝিয়েছিল তেমন কিছুই হয়নি।

“আপনি খুব ভালো মানুষ।”
‘ উইন্ডো মিরর নামাল তাকবীর। কথার বিপরীতে এক ফালি হাসি দিয়ে বলল, ” আমাদের আবারো দেখা হবে এলোকেশী। ”
‘ এলিজাবেথ তেমন মাথায় নিল না কথাটা। চলে গেল। তাকবীরও গাড়ি ঘুরিয়ে চলে আসে। সেদিন সেই জায়গা থেকে চলে আসলেও ঘোর থেকে বের হতে পারেনি। এক অজানা, অচেনা মেয়ে রাজত্ব কায়েম করে নিয়ে ছিল তার অন্দরমহলে। লোক লাগিয়ে এলিজাবেথের চাচাতো ভাই শিহাব কে ক্লাবে আনায় তাকবীর। শিহাব তখন মাদকে পুরোপুরি ভাবে আসক্ত। তাকবীর শিহাবের কাছে থেকে জানতে পারে এলিজাবেথ এতিম। পরবর্তীতে এলিজাবেথের পরিবার নিয়ে আর মাথা ঘামাইনি তাকবীর। শিহাব কে শাসিয়ে এলিজাবেথ কে স্কুলে ভর্তি করার কথা বললেও পরবর্তীতে বিদ্বেষমূলক কিছু কথা ভেবে তা আর হতে দেয় না। এই মেয়ে আগুন সুন্দরী, যেখানেই যাবে সকলে ভস্ম হবে এর রূপে। সকল প্রকার সাইড ইফেক্ট ভেবে এলিজাবেথ কে স্কুলে পড়ানোর চিন্তাভাবনা বাদ দিল তাকবীর। শিহাব কে টাকা দিয়ে দিয়ে এলিজাবেথের ব্যাপারে খোঁজ খবর নিত সবসময়।

‘অতিরিক্ত টাকা বাড়িয়ে দিত এলিজাবেথের জন্য, মাঝেমধ্যে নিজের শখ করে অনেক কিছু কিনেও দিত এলিজাবেথের জন্য। তবে তার কিছুই পেত না এলিজাবেথ। শিহাব সবকিছু নিজের নাম করে ইবরাত কে দিত। তাকবীরের ভয়ে এলিজাবেথ শিহাবের কুদৃষ্টি থেকে একটু ছাড় পেলেও একেবারে মুক্তি পায়নি। কথায় আছে কয়লা ধুইলে ময়লা যায় না। সুযোগ পেলেই এলিজাবেথের স্পর্শকাতর জায়গায় হাত ছোঁয়াত শিহাব। যেসব কিছুই ছিল তাকবীরের অজানা। এক নাজুক মেয়ের এক দর্শনের স্তম্ভিত সে।
‘ছটফটে মনকে কোনো ভাবেই মানাতে পারত না তাকবীর। অবুঝ বাচ্চার মতো সে মানতে নারাজ মেয়েটা এখনো বাচ্চা। শিহাবকে টাকা খাইয়ে এলিজাবেথের বিয়ে আঁটকে রাখতে পারলেও নিজের ছটফটে মনকে বেঁধে রাখতে পারত না তাকবীর । বার-বার ছুটে যেত একপল এলিজাবেথকে দেখার জন্য। শিহাবকে বলে প্রায়শয়ই এলিজাবেথকে বাসা থেকে বাইরে বের করত তাকবীর। যেসকল কিছুই সবিতা বেগমের অজানা ছিল। ইবরাতকে স্কুল থেকে আনার বাহানা দিয়ে এলিজাবেথকে বাসা থেকে বের করত শিহাব। যেদিনই এলিজাবেথ বাইরে বের হতো সেদিন অযাচিত ভাবে তাকবীরের সাথে দেখা হতে যেত পথে। বোকা এলিজাবেথের কাছে তা অযাচিত থাকলেও প্রেমিক পুরুষ তাকবীরের কাছে ছিল তা প্রি প্ল্যান।

‘তাকবীর একটা সঠিক সময়ের আশায় চেয়ে ছিল যেদিন একেবারে নিজের কাছে নিয়ে আসতে পারবে তার এলোকেশী কে। তাজুয়ার দেওয়ানের নজর থেকে এলিজাবেথ কে আড়াল করে রাখার জন্য বারবার দেখা তৃষ্ণা পেলেও নিজের মন কে শুকিয়ে রাখত শুধুমাত্র এলিজাবেথের সেফটির কথা ভেবে। এতো কাছে আর একই শহরে থেকেও তাদের দেখা হতো তাদের বছরে এক কিংবা দু’বার। এভাবেই পেরিয়ে যায় চারটি বছর। প্রিয়দর্শনীর আশায় চেয়ে থেকে থেকে । আজ মিটিয়ে নিচ্ছে সকল তৃষ্ণা তাকবীর সুযোগ সন্ধানী শিকারীর মতো এলিজাবেথের নিক্ষিপ্ততার সুযোগ নিয়ে।

‘ কপালের প্রান্ত পথে বেবি হেয়ার গুলো বড় হয়ে কপালের দুইপাশে টেম্পোরাল রেখার ঊর্ধ্বভাগে বিছিয়ে রয়েছে এলিজাবেথের। তাকবীর পলকহীন ভাবে চেয়ে হাত তুলল চুল গুলো সরিয়ে দেওয়ার জন্য। পরবর্তীতে নিজের করা প্রতিজ্ঞার কথা ভেবে নিজেকে সংবরণ করে নিল। পদ্ম ফুলের ডগার অংশের স্নিগ্ধ রঙে রাঙান ঠৌঁট গোল করে ফুঁ দিল। এক পশলা উষ্ণ হাওয়ায় উড়ে গেল চুলগুলো। সন্ধি ফিরে পেল এলিজাবেথ, ঘাড় বাকিয়ে তাকাল তাকবীরের দিকে। তাৎক্ষণিক তাকবীর ব্যস্ত গলায় বলতে শুরু করলো,
” ছুঁইনি আমি। কথা দিয়েছি তোমার অনুমতি ছাড়া স্পর্শ করব না তোমায়। ”
‘ এক চিলতে হাসি দিল এলিজাবেথ। ধাতস্থ গলায় শুধায়, ” আমি জানি। ”

‘ ন্যাসো হাই তুলে ডলতে ডলতে লিভিং স্পেস আসে। এই দু’দিন রিচার্ড নিজের সাথে সকলের ঘুমও হারাম করে রেখেছিল। হঠাৎ রির্চাডের নিস্তব্ধতা দেখে এই সুযোগে একটু ঘুমিয়ে ছিল ন্যাসো। পর্যাপ্ত ঘুম পরিপূর্ণ হবার আগেই এক গার্ড গিয়ে ডেকে দিল। কাউচে বসা লুকাস কে দেখতে পেয়ে সকল ঘুম উবে গেল ন্যাসোর । কিছু বলতে উদ্যত হবে তখন কারোর পায়ের শব্দ ভেসে আসে। ঘাড় বাঁকিয়ে দু’জনেই এক সাথে উৎসুকভাবে পিছন ফিরে তাকাল। রিচার্ড কে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেলে ন্যাসো। চোখে সন্দেহ সংকুচিত হলো। হঠাৎ রিচার্ডের ড্রেস আপের এতো পরিবর্তন ঘটার কারণ বুঝে উঠতে পারল না। গিরগিটির থেকেও দ্রুত রঙ পাল্টিয়ে ফেলেছে রিচার্ড নামের এই রহস্যময় মানব। কিছুক্ষণ আগেও ন্যাসো দেখে গিয়েছে রিচার্ড কিভাবে গতকালের পোশাক শরীরে চাপিয়ে উন্মাদনায় মেতে ওঠে ড্রাগস টানছিল। অথচ এখন কি ড্যাসিং লুকে এক হাত পকেটে ঢুকিয়ে অ্যাটিটিউড নিয়ে আসছে।

‘বরাবরের মতোই সম্পূর্ণ কালোতে আবৃত রিচার্ড। তবে আজ ভিন্নতা এসেছে শুধু হেয়ার স্টাইলে। রিচার্ড কখনো চুলে ওয়েট জ্যাল ইউজ করে না। কালো Ripped jeans এর সাথে ইং করা কালো শার্টে জ্যাল দিয়ে খাঁড়া খাঁড়া করে রাখে চুলে খুবই অ্যাট্রাক্টিভ লাগছে গ্যাংস্টার বস’কে। শার্টের হাতা কনুই পযন্ত ফোল্ড করে রাখা পরিপাটি করা। বা হাতের কনুই এর নিচে জয়েন্ট হাড়ের গৌড় বর্ণের শিরার উপর আচ্ছাদিত পি.সিক্সের ব্যানক্রফ্ট সিলভার ব্রেসলেট। বুকের সামনে দু’টি বোতাম খোলা ফলস্বরূপ সুবিস্তৃত,শক্তপোক্ত সুঠোম বুক ভাসমান। অধমাঙ্গে পরিহিত কালো স্নিকার্সের চপচপ শব্দের দফারফা করে সরাসরি ন্যাসোর সামনে দাঁড়ায় রিচার্ড। গাঁ থেকে ভেসে আসা ডার্ক পারফিউমের কড়া ফ্যাগরেন্স মত্ত করে দিচ্ছে চতুষ্পার্শ। রিচার্ডের ঠৌঁটের কোণায়ও জুলে আছে প্রত্যাশিত আন্তরিক হাসি। ন্যাসো লুকাসের দিকে পূর্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বললো,
“গেট রেডি বয়েস। উই আর গোয়িং অন আ ট্রিপ।”
‘ লুকাস, ন্যাসো একে-অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে তপ্ত শ্বাস ফেলে দুজনেই চলে গেল তৈরি হওয়ার জন্য। লুকাস কিছুক্ষণ আগে মাত্রই আসল রিচার্ডের কলে। এবার একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানে এই জরুরি কল আর ট্রিপের পিছনে কি রহস্য লুকিয়ে রেখেছে এই রহস্যময় মানব।

‘ ন্যাসো কিছুপল বেজমেন্টের স্যাটারের সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে মনস্থির করে ব্যগ্র পেয়ে হেঁটে ভিতরে ঢুকলো। ন্যাসোর কথায় পুরো আঠারো ঘন্টা পর আজ ইবরাত আর সবিতা বেগম কে পানি দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে কিছু খাবারও। খাবার হিসেবে মওজুদ ছিল শুকনো খরখরে রুটি আর গুড়। পাঁচদিন পর সবিতা বেগম কে খাঁচা থেকে বের করা হয়। দীর্ঘদিন অনাহারে থাকার কারণে খাবার দেখে ঝাপিয়ে পরে তারউপর। ক্ষিধা পেটে শুকনো দু’টো রুটি। চোখের পলকে খেয়ে শেষ করে ফেলে। কিন্তু পরে আর তা পেটে রাখতে পারল কই। খালি পেটে অতি তৃষ্ণায় বেশি পানি খেয়ে ফেলায় পর সহসাই পেটের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠল তৎক্ষণাৎ। এক নাড়াতেই পাকস্থলী উগড়ে বেরিয়ে এলো সকল খাদ্যকণা। বমি করতে করতে রক্ত বমি শুরু হয়। মায়ের এই অবস্থা দেখে নিস্তেজ শরীর নিয়েও ইবরাত ছুটে যেতে চাই মায়ের কাছে। শিকল দিয়ে হাত পা বেঁধে রাখার কারণে যেতে পারে না। দূর থেকে মায়ের করুন পরিণতি দেখে হাউমাউ করে শুধু কাঁদে ইবরাত কিছুই করতে পারে না।

‘ন্যাসোর কর্নপাত হলে ন্যাসোর আদেশে সবিতা বেগম কে অন্য কক্ষে নিয়ে রাখা হয়। তারপর থেকে আর মুখে পানিও তুলছে না ইবরাত। শরীর একদম স্যাঁতস্যাঁতে মেঝের সাথে মিশে গিয়েছে। গোসলের অভাবে শরীর থেকে ঘামের বিদঘুটে বিশ্রি গন্ধ নির্গত হয়। ন্যাসো সরাসরি এসে দাঁড়ায় দুর্বোধ্য ইবরাতের সামনে। কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে মাথা তুলে ইবরাত। টানানো চোখগুলো গর্তের ভিতর চলে গিয়েছে অনাহারে। ন্যাসোকে দেখার সাথে সাথে ঝুলে যাওয়া চোয়ালে খুশির ঝিলিক ফুটে উঠে ইবরাতের । যা ন্যাসোর ক্রোধ আরও বাড়িয়ে দিল। রুষ্ট গলায় বলল,
” মরতে চাও? ”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ১১

‘ গলা দিয়ে শব্দ বের হয় না ইবরাতের। দুর্বল চিত্তে অস্পষ্ট ভাবে আওড়ায়, ” হ্যাঁ চাই তো। ঐ-যে আপনার প্রেমে। ”
‘ অর্হনিশে কর্ণপাত হতেই চোয়াল শক্ত হয়ে যায় ন্যাসোর। চেঁচিয়ে বলল, “হ্যাভ ইউ গন ম্যাড? ”
” আই জাস্ট ফল ইন লাভ। ”
” নেশা কেটে গেলে খেয়ে নিও। ” বলে হনহনিয়ে চলে যায় ন্যাসো। সহসাই নিষ্পলক তাকিয়ে থাকল ইবরাত ন্যাসোর যাওয়া পানে। হঠাৎ এক ফিচলে হাসির দেখা মিলল ঠৌঁটে। লাজুক হাসিতে শ্যাম বর্ণের মুখশ্রী লাল হয়ে যায়।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ১৩