ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২০

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২০
মিথুবুড়ি

‘লাভার্স পয়েন্ট বিচ (Lovers Point Beach) ক্যালিফোর্নিয়ার মন্টেরে উপদ্বীপে অবস্থিত একটি অপূর্ব সুন্দর সৈকত, যা প্রকৃতির নিখুঁত সৌন্দর্য এবং শান্ত পরিবেশের জন্য বিখ্যাত। নামের মতোই, এই স্থানটিতে যুগলপ্রেমের আবেগময় মুহূর্তগুলো সবচেয়ে বেশি প্রতিফলিত হয়। সমুদ্রের ধারে উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় ঝকঝকে বালি। লাইন ধরে সারি সারি ডাব গাছ। সমুদ্রের মাঝখানে মাঝারি আকৃতির এই দ্বীপ প্রতিটি যুগল আশিকদের ভ্যাকেশনের জন্য বেস্ট। এলিজাবেথ মন খুলে চির চিত্তে সমুদ্রের স্বচ্ছ নীল পানিতে পা ভেজাচ্ছে। মুক্ত বাতাস, সমুদ্রের ঠান্ডা পানি, এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এলিজাবেথের মধ্যে স্বাধীনতার নতুন অনুভূতি জাগ্রত করে আবারো। ওর কাছে এটি এক ধরনের পুনর্জন্মের অনুভূতি, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে মানুষ অনুভব করে যে তার জীবন আবার শুরু হয়েছে, সমস্ত সীমাবদ্ধতা ও কষ্ট ভুলে গিয়ে।

” জামা ভিজে যাবে এলোকেশী। এতো গভীরে যেও না।
‘ মোটেও এলিজাবেথ গভীরে যায়নি। পাড়ে দাঁড়িয়েই সমুদ্রের পানিতে স্নান করাচ্ছিল পা’কে। অষ্টাদশীর মতো আবেগে আপ্লুত হয়ে যাচ্ছে ক্রমাগত। ওষ্ঠপুট জুড়ে চঞ্চল প্রাণখোলা হাসি। ওষ্ঠ ছড়ানোর হাসির আজ নিস্তার নেই। পরণের স্কাই ব্লু কালারের লং ফ্লোরার পিন্টের গাউন টাকনু থেকে আর একটু উপরে তুলে নিল। গ্রীবা ঘুরিয়ে তাকাল তাকবীরের দিকে। ভেংচি কেটে বললো, “কেন এটা ভিজে গেলে আর একটা কি কিনে দিতে পারবেন না? ”
‘ অধর প্রসারিত করে হাসল তাকবীব। সে এলিজাবেথের পিছনেই ওর জুতোজোড়া হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। গভীর চোখ দুটো আশ্লেষে জরিয়ে রেখেছে এলিজাবেথের পা থেকে মাথা পর্যন্ত। প্রতিবারের মতো তাকবীর আজও ম্যাচিং করে জামা পরেছে এলিজাবেথের সাথে । এই সব কিছুই তাকবীর অতি আবেগ আর যত্নের সহিত কিনে। এক অষ্টাদশীর সান্নিধ্যে আসলে ভুলে যায় নিজের বয়স, প্রফেশন। মনে হয়ে উঠে চাঙ্গা, আচরণ করতে থাকে তরুণ বয়সের যুবকদের মতো। ফর্মাল পেন্টের সাথে মিলিয়ে এলিজাবেথের গাউনের সেইম পিন্টের হাফ হাতার বিচ শার্ট পরেছে তাকবীর। চোখে সানগ্লাস, শার্টের বুকের বোতাম দুটি অনাড়ম্বরভাবে খোলা। কোঁকড়া চুল গুলো উড়ছে এলোমেলো ভাবে উত্তরের হাওয়াতে। চোখে একরাশ মুগ্ধতা, অধরে উজ্জ্বলিত শিখা।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘কারা বলে শ্যাম বর্ণের পুরুষরা সুন্দর হয় না? বোকা তারা, যথেষ্ট বোকা। _শ্যাম বর্ণের চেহারা যেন চাঁদের আলোয় ফুটে ওঠা একটি নিখুঁত রূপ, যার মাঝে এক অমলিন কোমলতা আর জটিলতা মিশে থাকে। তাকবীরের চোখ দুটি গভীর, সাগরের মত বিশাল ও উদার, যেন কল্পনার জগতে প্রবাহিত এক নদী। হালকা হাসিতেই পৃথিবীর সব রঙের মেলবন্ধন ঘটে, আর তার উপস্থিতি চারপাশে এক ধরনের মিষ্টি ছোঁয়া রেখে যায়।
‘এলিজাবেথের কথায় ঠৌঁট কামড়ে হাসল তাকবীর। আপন মনে বিরবির করল, “তোমার এই অপরূপ সৌন্দর্য শুধুমাত্র আমি দেখব বলে যদি পুরো বিচ টা কিনে নিতে পারি, তবে কি সামান্য জানা কাপড় কিনতে কি আমার খুব বেশি কষ্ট হয়ে যাবে বোকা রাণী? ”
‘ কথাগুলো বরাবরের মতোই দেখা মিলল না দন্তপাটে। বাকি সবকিছুর মতো এগুলোও ভিতরেই চেপে রাখল।
” কিছু বলার নেই মেডাম। ”
‘ অকারণেই খিলখিল করে হাসছে এলিজাবেথ। উচ্ছাসিত স্বরে চেঁচাল, ” ধন্যবাদ এতো সুন্দর একটা জায়গায় নিয়ে আসার জন্য। খুব সুন্দর জায়গাটা আমার অনেক পছন্দ হয়েছে। ”
” তখন তো আসতে চাইছিলে না।
” ভাগ্যিস আপনি জোর করে ছিলেন। ~ হাসির মাত্রা বাড়ে এলিজাবেথের। তাকবীর শুধু মনোমুগ্ধকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কথা আসতে চায় না তার ভিতর থেকে। অভ্যন্তর থেকে বলছে চেয়ে থাক এভাবেই একগুঁয়ে দৃষ্টিতে। প্রশান্তির স্রোতে বইয়ে নে আমাকে। কাল রাতে হোটেলে ফেরার পরপরই এলিজাবেথের রুমের দরজা লক করে দেয় ভিতর থেকে। তাকবীর শতবার ডাকলেও দরজা খুলে না এলিজাবেথ। পরে সকালে উপায়ন্তর না পেয়ে তাকবীর হোটেল স্টাফের কাছ থেকে ডুবলিকেট চাবি এনে দরজা খুলে। এলিজাবেথ কে ওর কাছে খুবই অস্বাভাবিক লাগছিল। তারপরই জোর করে নিয়ে আসে এখানে তাকবীর।

” আপনার রুচি খুব ভালো।
‘ এলিজাবেথের কথায় সন্ধি ফিরে পায় তাকবীর। ভ্রু জোড়া কিঞ্চিৎ কুঁচকিয়ে ভাবহেলিস ভাবে জবাব দেয়,
” অবশ্যই ভালো। না হলে তোমাকে পছন্দ করতাম? ”
‘ মুখ বাঁকায় এলিজাবেথ। পিছন থেকে না দেখেও বুঝতে পারে এলিজাবেথের এক্সপ্রেশন। ফিক করে হেসে দেয় তাকবীর। ” হাসছেন যে? ” ফিরে উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো এলিজাবেথ। হাসি আটকে রাখে তাকবীর।
” কই না তো।”
“ঢং।
” খুব পাকনা পাকনা কথা শিখেছ তো মেয়ে। ”
” আমি পেট থেকেই পাকনা হয়ে বের হয়েছি। ” ~ বলে সাগরের পাড়ে পড়ে থাকা ঝিনুক কুড়াতে থাকে এলিজাবেথ। নাক কুঁচকায় তাকবীর। ” এসব নিচ্ছ কেন?
‘ প্রত্যুত্তর করে না এলিজাবেথ। পাড় ধরে ধরে ঝিনুক কুড়িয়ে কুড়িয়ে সামনে এগোতে থাকে। তাকবীরও জুতোজোড়া হাতে নিয়ে পিছু যেতে থাকে এলিজাবেথের।
“এলোকেশী ছেলেমানুষী করে না। এগুলো ধারালো, হাত কেটে যেতে পারে। ”
‘ এতোক্ষণে গিয়ে দাঁড়ায় এলিজাবেথ। গাল ফুলিয়ে পিছন ফিরে। দু’হাতে কোমর বেঁধে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকবীরের কৃষ্ণগহ্বরে। গমগমে গলায় বললো,

“ছেলেমানুষী মানে? আপনি জায়গায় দাঁড়িয়ে আমার লিঙ্গ পরিবর্তন করে দিচ্ছেন। খুব অসভ্য তো আপনি। ”
‘ তৎক্ষনাৎ আবার ঘুরে ফিরে এলিজাবেথ। তাকবীর পেট চেপে ধরে হাসতে লাগল। পরপর নিজের ভুল চটজলদি সংশোধন করে নিল, ” আচ্ছা, আচ্ছা সরি মেডাম। মেয়েমানুষী করবেন না। এগুলো রাখো হাত কেটে যাবে। ”
‘ ভদ্র মেয়ের মতো কথা শুনলো এলিজাবেথ। ফেলে দিল হাত থেকে। তাকবীরের অভ্যন্তর শিউরে উঠল এই একটুখানি বাধ্যকতায়। তবে এবার করে বসল আরেক কান্ড। চুল ছেড়ে দিয়ে দু-হাত ছড়িয়ে পাখির মতো ডানা মেলে দৌঁড়াতে থাকে। তপ্ত শ্বাস ফেলে তাকবীরও দৌঁড় দিল পিছন পিছন। সমুদ্রের নরম বালুকাবেলায় দু’জন প্রেমিকযুগল। দূরে ঢেউয়ের কলকল শব্দ, আকাশে পড়ন্ত সূর্যের সোনালি আভা। মেয়েটি হাত ছড়িয়ে উচ্ছল হাসিতে দৌঁড়ে চলেছে, যেন ঢেউয়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। তার খোলা লাল চুল বাতাসে উড়ছে, আর পায়ের কাছের বালুগুলো ছিটিয়ে দিচ্ছে। ছেলেটি তার ঠিক পিছনেই, হালকা হাসি মুখে তাড়া করছে, যেন মেয়েটির হাসির উৎস ধরতে চাইছে। তাদের পদচারণায় বালুর উপর দাগ রেখে যায়, আর সেই দাগগুলোও যেন তাদের ভালোবাসার গল্প বলে। সমুদ্রের ঢেউ এসে আবার সেই পদচিহ্ন মুছে দেয়, ঠিক যেমন প্রকৃতি মানুষের মধুর মুহূর্তগুলোকে গোপন করে রাখে। ক্লান্ত হয়ে থামল এলিজাবেথ, থামল তাকবীর। দু’জনেই হাঁটুতে ভর দিয়ে হাঁপাচ্ছে।

” বড় হবে কবে হুম? এখনো এতো বাচ্চামো করে কেউ ? ”
‘ এলিজাবেথ শুকনো ঢোক গিলে রুষ্ট গলায় বলে,
“আমি যথেষ্ট বড় হয়েছি। ঠিক বয়সে বিয়ে হলে এতোদিনে আমার মেয়ের সাথে আপনার ছেলের নিয়ে দিতে পারতাম। ”
“এটা মানাতো না। বাচ্চারা চাইনি স্বামী স্ত্রী হতে। ওরা ভাই-বোন হচ্ছে ইচ্ছুক তাই তো আমাদের কারোরই ঠিক সময়ে বিয়ে হয়নি। ” ~ তাকবীর ঠৌঁটে দাঁত চেপে হাসি থামানো চেষ্টা করল যথাসম্ভব। স্তব্ধ হয় এলিজাবেথ, পরিবর্তন হলো চেহারার রং,স্বর।
“আপনি জানেন আপনি আমার বিশ্বাসের ঠিক কতো বড় জায়গা দখল করে নিয়েছেন ভালো মানুষ ? ”
‘ আবেশিত দৃষ্টিতে তাকায় তাকবীব। দৃষ্টি স্থির, কণ্ঠে নমনীয়তা, ” এভাবেই, ঠিক এভাবেই একদিন পুরো তুমি টাকে নিজের দখলে নিয়ে যাব। ”
“যদি না পারেন?”
‘ ফোঁস নিশ্বাস ফেলে তাকবীর। ঘুরে তাকাল উতালপাতাল ঢেউের সমুদ্রে। অভিব্যক্তি শূন্য, কণ্ঠে নেই প্রাণ। নিস্তব্ধ ভাবে আওড়াল, “ভাসিয়ে দিব নিজেকে, বিলীন হয়ে যাব বিচ্ছেদের দহনে। ”

‘ গাঁ কেঁপে ওঠে এলিজাবেথের। খৈই হারিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল, “কি বলছেন এসব? ”
‘ ঢোক গিলার মতো হজম করে নিল তাকবীর নিজের অব্যক্ত বেদনার বাণী। ” চল গিয়ে বসি। ”
‘ বিচের মধ্যে সুন্দর করে ডেকোরেট করা এক অতি রোমাঞ্চকর পরিবেশ। সাদা সফেদ চাদর বিছানো সাদা চিকচিকে বালিতে। তার উপর নানা রকমের স্ন্যাকস জুস, কেক, আর একটা গিটার সব মিলিয়ে সুন্দর করে সাজানো। সাথে যুক্ত হয়েছে গোছা গোছা সাদা গোলাপ। এবার আর লাল গোলাপ আনেনি তাকবীর। এলিজাবেথ এতোক্ষণ এগুলো তেমন খেয়াল করে দেখেনি। এখন দেখতে পেয়েই চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। ঠৌঁট গোল করে তাকায় তাকবীরের দিকে।
” কখন করলেন এগুলো?”
‘ তাকবীর নিশ্চুপ। এলিজাবেথ আবারো বলল,
” আপনার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহুর্তই মনে হয় আগে থেকেই কত শখ করে সাজানো সবকিছু । ”
‘ নিঃশব্দে হাসে তাকবীর। হঠাৎ আনমনে বিরবির করতে থাকে, ” আমি গোপনে ভালোবেসেছি, বাড়ি ফেরা পিছিয়েছি তোমায় নিয়ে যাব বলে। ” কর্ণপাত এড়ায় না এলিজাবেথের। চকিতে তাকবীরের দিকে ফিরে তাকাল। বাচ্চাসুলভ গলায় আবদার করল,

” একটা গান শুনান না। ”
‘ বেশি জোর করতে হয়নি তাকবীর কে। অমায়িক হেসে গিটার হাতে তুলে নিল তাকবীর। তাল তুলে গিটারে, সাথে সুর দেয়_
আজও হায় রিক্ত শাখায়
উত্তরী বায়, ঝুরছে নিশিদিন
আসেনি দখনে হাওয়া,
গজল গাওয়া, মৌমাছি বিভোল ”
আসেনি দখনে হাওয়া,
গজল গাওয়া, মৌমাছি বিভোল
বাগিচায় বুলবুলি তুই
ফুলশাখাতে, দিসনে আজই দোল। ”
‘মুগ্ধতায় ধাঁধিয়ে যায় এলিজাবেথের অন্তঃকরণ। দু’হাতে তালি দিতে থাকে। “অসম্ভব সুন্দর আপনার গানের গলা।” ~পেরিয়ে গেল আরো কিছু মুহুর্ত অপ্রাসঙ্গিক বাক্য আদান-প্রদানে। হঠাৎ ভেসে এলো তাকবীরের গদগদে কণ্ঠ।
“এই, এই এখুনি চুল বাঁধো।”
‘এলিজাবেথ জুস খাচ্ছিল৷ ওর সামনের চুলগুলো পিন্ট্রেস্টি ক্ল ক্লিপার দিয়ে আটকানো ছিল। তাও বাতাসের তোড়ে এলোমেলো ভাবে উড়ছিল অবাধ্যকতার পরিচয় দিয়ে। এলিজাবেথ ঠৌঁট ভেঙে তাকবীরের দিকে তাকাল, চুপসানো গলায় বলল,

“কেন?”
‘তাকবীরের তৎক্ষনাৎ জবাব, “এই এলোমেলো চুলগুলো ঝড় তুলে দিচ্ছে ভিতরে।”
‘খানিকটা লজ্জা পেল এলিজাবেথ। মাথা নিচু করে ফেলল।পার হলো কিছু মুহুর্ত নিরবে। তাকবীর শুধু তাকিয়েই থাকে।
“আপনি যে এভাবে সারাক্ষণ তাকিয়ে থাকেন, ক্লান্ত হন না?”
‘হাঁটুতে কনুই ঠেকিয়ে গালের নিচে হাত রাখা অবস্থায় বসা ছিল তাকবীর। সেই ভাবেই উত্তর দিল,
“চোখে মাঝেসাঝে ক্লান্তির ছাপ আসলেও, মন আসে না।”
‘ একটা গভীর সান্ত্বনার মুহূর্ত, যেখানে সমস্ত দুঃখ, উদ্বেগ ও যন্ত্রণা সময়ের সাথে প্রশমিত হয়ে যায়। সেই মুহূর্তে মনে হয়, অনেক কঠিন সময়ের পর অবশেষে একটু শান্তি ও স্বস্তি মিলেছে, যা তাকে আবার নতুন করে জীবনের উদ্দেশ্য ও শক্তি দেয়। অনুভূতিটি হতে পারে অব্যক্ত, কিন্তু তার মধ্যে এক ধরনের তৃপ্তি এবং মানসিক শুদ্ধতার অনুভূতি থাকে। এলিজাবেথের নিজেরও মাঝে মাঝে খারাপ লাগা কাজ করে প্রতি ক্ষনে ক্ষনে এভাবেই তাকবীরের অনুভূতিকে এড়িয়ে যেতে। জীবনটা এমন কেন? আমাদের চাওয়া অনুযায়ী খুবই জিনিসই পেয়ে থাকি আমরা। _কেন?
“আমাকে রাশিয়া নিয়ে চলুন না?”

‘সোজা হয়ে বসল তাকবীর। গম্ভীর স্বরে জানতে চাইলো, ” কেন?”
‘এলিজাবেথের কণ্ঠে আকুলতায় ঠাসা। সবেগে আওড়াল,
“আমি মম’কে খুঁজে বের করতে চাই। আমার বিশ্বাস মম এখনো বেঁচে আছে।”
‘তাকবীর কিছু বলতে যাবে তখনই ভেসে আসে কর্কশ শব্দ। যেন যুদ্ধে হুশিয়ার। তাকবীর উঠে দাঁড়ায়। দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সমুদ্রে। ওর পিছন পিছন এলিজাবেথও উঠে দাঁড়ায়। তাকবীরের কপালে ভাঁজ সংকুচিত হলো। ভিভ দিয়ে ঠৌঁট ভেজাল। চিন্তিত ভাব। চারটি বড় বড় ফ্রিগেট বোর্ড এদিকেই আসছে। তাকবীর এলিজাবেথ কে নিজের আড়াল নিয়ে যায়। এলিজাবেথ কে পিঠ দিয়ে আড়াল করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সামনে। তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে খারাপ কিছু হতে চলেছে। তাকবীর আজ পুরো বিচ টা কিনে নিয়েছে একান্ত মুহুর্ত কাটানোর জন্য। সুতরাং কোনো পর্যটকের আসার সম্ভাবনা একেবারেই নগ্ন।
‘ভাবনার ভিতরই ফ্রিগেট বোর্ডটি এসে পাড়ে থামে। মুহুর্তের মধ্যেই এক ঝাঁক পাখির মতো কালো পোশাকধারী লাফিয়ে নেমে ওদের দিকেই তেড়ে আসতে থাকে। তাদের চোখে হিংস্রতা, হাতে অস্ত্র। অভ্যন্তর শিউরে উঠে এলিজাবেথের৷ খামচে ধরে তাকবীরের শার্ট। অকস্মাৎ তাকবীর এলিজাবেথকে অবাক করে দিয়ে ঝড়ের বেগে দৌঁড়ে গেল সামনে। যেন যান্ত্রিক মেশিন। সুইচ অন করার সাথে সাথে চলতে শুরু হয়েছে। চোখের পলকে দু’জনকে বালির উপর শুইয়ে দিল তাকবীর। এলিজাবেথের দিকে তেড়ে আসা সকলে একে একে করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ছে। তাকবীর নিপুনভাবে প্রতিহত করছে সকল ঘাতকদের। ঢেউয়ের মতো একের পর এক আক্রমণ আসছে আর তাকবীর প্রতিবার তার দৃঢ়তাকে ঢালের মতো ব্যবহার করছে । র/ক্তে সিক্ত হচ্ছে সাদা বালি। সাদা ঝকঝকে বাকির রং পরিবর্তিত হয়ে রেড ক্লে তে পরিনত হচ্ছে। তবুও পিছু হটে না তাকবীর। কেঁপে উঠল এলিজাবেথ তাকবীরের হুংকারে,
“তোরা ভুল জায়গায় এসেছিস।”
‘এলিজাবেথ স্তব্ধতায় ছেয়ে যায়। চিনতে পারছে না এই তাকবীরকে। এই এক অন্য তাকবীর, সমুদ্রের হিংস্র এবং চোখে সাহসের আগুন। এতো উগ্র আচরণ, এতো ভয়ংকর মুখভঙ্গি। কমতে থাকে সৈন্য সংখ্যা।

‘ইমিগ্রেশনে দাঁড়িয়ে ছিল রিচার্ড আর লুকাস। আজ ইতালি ব্যাক করছে তারা। হঠাৎ করে রিচার্ডের হাতের ঘড়িতে রেড এলার্ড দিতে থাকে। চোখেমুখে হিংস্রতার ছাপ ভেসে উঠে গ্যাংস্টার বসের। ল্যাগেজ ফেলে উন্মাদের মতো এগজিটের দিকে যেতে থাকে। তাজ্জব বুনে যায় লুকাস। পিছন থেকে চেঁচাল,
” বস কোথায় যাচ্ছেন?”
” বিপদ ।”
‘ বিপদ ‘ এই একটা শব্দ শুধু উচ্চারণ করল রিচার্ড। শোনা মাত্র লুকাস নিজেও সচল হয়ে গেল। নিজের কাজে বেরিয়ে পড়ল তৎক্ষনাৎ।

‘হঠাৎ পিছন থেকে ভেসে আসল এলিজাবেথের চিৎকার। চকিতে পিছন ফিরে তাকবীর। যেন কি হারিয়ে গেল। একজন তাকবীরের মারা/মারির সুযোগ বুঝে গিয়ে আক্রমণ আনে এলিজাবেথের উপর। চেপে ধরে এলিজাবেথের চুলের মুঠি। ব্যাথা কুকড়িয়ে নাকমুখ কুঁচকে রেখেছে এলিজাবেথ। ইতিমধ্যে অর্ধেক সৈন্য সংখ্যা কাবু হয়ে গিয়েছে । তাকবীর একাই অধিকের সাথে লড়াই করেছে। তাকবীর তাকাল এলিজাবেথের ব্যাথাতুর মুখে। পরপর তাকাল তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মুষ্টিবদ্ধ হাতের দিকে। গভীর, নিকোষ কালো চোখে ফুটে উঠল ক্রোধের আগুন। নিচে পড়ে থাকা একটা কাচের বোতল তুলে নিল তাকবীর অতঃপর হাঁটুতে এক বারির মাধ্যমে ঠিক মাঝ বরাবর ভেঙে ফেলল। ভাঙা বোতলের অংশ তীক্ষ্ণ অস্ত্র বানিয়ে দ্রুত ঘূর্ণিতে ছুঁড়ে মারল মুষ্টিবদ্ধ হাতে। চামড়া ভেদ করে কাচের সরু অংশ মাংসে বিঁধে যায়। রক্তা/ক্ত হাত চেপে ঘাতকটি বসে পড়ল । তাকবীর ছুটে গেল এলিজাবেথের কাছে। জবুথবু করে কাঁপতে থাকে এলিজাবেথ। ভিতরে ঘূর্ণিঝড় অনুভূত হচ্ছে তার এই শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতে। কই মাছের প্রাণ এতো সহজে মরে না। আহত ঘাতক’রা আবারও তেড়ে আসে। পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠে আবারও। পাঁচ-ছয়জন ঘিরে ধরল ওদের। তাকবীর কৌশলে এলিজাবেথকে আড়াল করে সকলের মোকাবিলা করতে থাকে। সমুদ্রের ঢেউয়ের গর্জনের সঙ্গে শুরু হয় এক ভয়ংকর লড়াই।
‘ হঠাৎ পিছন থেকে একজন তেড়ে আসে এলিজাবেথের দিকে ছু/ড়ি নিয়ে। এলিজাবেথ দু’হাতে মুখ চেপে ধরে চিৎকার করে উঠল।
” আহহ।”

‘ কোনোরকম যন্ত্রণা অনুভব না হওয়ায় কাঁপা কাঁপা হাতগুলো মুখ থেকে সরাই এলিজাবেথ। চোখ মেলে তাকাতেই সামনের দৃশ্য অবলোকন হলে গা শিউরে ওঠে এলিজাবেথের। মুখে হাত চেপে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। তাকবীর এলিজাবেথের পেটের দিকে অগ্রসর হওয়া ধারালো ছুড়িটি নিজের হাতে চেপে ধরে রেখেছে। গলগলিয়ে রক্ত পড়ছে হাত থেকে। সেদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই তার, দাঁতে দাঁত চেপে তাকিয়ে আছে সামনের ঘাতকের দিকে। পরপর পেট বরাবর এক লাথিতে ফেলে দিল তাকবীর ঘাতক কে। আবারও তেড়ে আসে এক ধরাশায়ী আক্রমণ। প্রত্যেকটা আঘাতই আসছে শুধু এলিজাবেথের উপর। পিছন থেকে আরেকজন ছুড়ি নিয়ে দৌঁড়ে আসছে এলিজাবেথের দিকে। তাকবীর একটানে এলিজাবেথ কে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ঘুরিয়ে ফেলে। ছুড়ি গিয়ে বিঁধে তাকবীরের বাহুতে। রক্তে ভিজে যায় সমস্ত শার্ট। তবুও দূর্বল হয় না তাকবীর। লড়তে থাকে। এতো চেষ্টা করেও এলিজাবেথকে রক্ষা করতে পারেনি তাকবীর। মারামারির এক পর্যায়ে লাঠির আঘাত এসে লাগে এলিজাবেথের মাথায়। গ্রীবা বেয়ে বেয়ে লাল তরল ঝড়তে থাকে।
‘ থমকে যায় তাকবীরের দুনিয়া এলিজাবেথের মাথায় চেপে রাখা হাত সামনে আনতেই। এতোক্ষণে নিজেকে খুবই দূর্বল অনুভূত হচ্ছে। চোখে যন্ত্রণা আর আর সাহসের এক অদ্ভুত মিশ্রণে এলোমেলো হয়ে টলে যেতে থাকে তাকবীর। চুলের ফাঁক গলিয়ে গলিতে রক্ত ঝরতে থাকে এলিজাবেথের। নিজের রক্ত তোয়াক্কা না করে এলিজাবেথের রক্ত দেখে বিচলিত হয়ে বুকের মধ্যে জরিয়ে ধরে তাকবীর ওকে শক্ত করে। চোখের সামনে একটা বড় দুঃস্বপ্ন ফিরে আসছে যেন। শরীর ছেড়ে দেয় এলিজাবেথ তাকবীরের বৃক্ষপটে, নিজের শরীরেরও এস্ত হারাতে থাকে তাকবীর। অসাড় হয়ে আসে সর্বাঙ্গ। লুটিয়ে পড়ে দুজনেই। ঘাতকরা তখনও একের পর এক আঘাত করতেই থাকে তাদের উপর। তাকবীর শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত এলিজাবেথ কে রক্ষা করে যায়। একটা আঘাতও আসতে দেয়নি এলিজাবেথের উপর। বিরতিহীন ভাবে পিঠের উপর লাঠি দিয়ে আঘাত করছে ঘাতকরা। চোখের সামনে সবকিছু আঁধার হতে থাকে তাকবীরের৷ নিভে আসে চোখের পাপড়ি জোড়া। পেছনে সূর্য ডুবতে থাকে, আর ঢেউ গর্জন করতে করতে যেন ঘোষণা দিচ্ছে যে __” অপূর্ণ প্রেমের অপূর্নতা। ” সহসাই মিলে যায় চোখের পাপড়ি জোড়া।

‘ঠিক তখনই প্রদীপ শিখার ন্যায় আশার আলো জ্বলে উঠল। সমুদ্রের পাড়ে বাতাসের তীব্র গর্জন, ঢেউয়ের তালে এক দুর্দান্ত দৃশ্য ফুটে ওঠে। আকাশে সূর্য স্বর্ণালি আভা ছড়িয়ে নিচ্ছে, আর সমুদ্রের জল যেন তার প্রতিফলন হয়ে ঝলমল করছে। ঠিক সেই মুহূর্তে, আকাশে ভেসে আসে একটি হেলিকপ্টার, তার বিশাল পাখা বায়ু কেটে এদিকেই আসছে । পাইলট তার দক্ষ হাতে মসৃণভাবে হেলিকপ্টারটি নামায় সমুদ্রের তীরবর্তী বালির ওপর। উদীয়মান হলো এক সুঠাম দেহের অধিকারী মানবের। হেলিকপ্টারের ল্যান্ডিং স্কিডে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেন অধিক তাড়া কখন নামবে। বিশাল আকৃতির পাখার ঘূর্ণিতে সেট করা চুলগুলো গতিহীন।
‘ সমুদ্র পাড়ে উপস্থিত হয় এক অজানা শক্তি, দৃঢ় সংকল্পে প্রতীক। সমুদ্রের তীরে পা রেখেই একঝলকেই প্রতীয়মান করে রিচার্ড তার প্রশিক্ষণ এবং সাহসিকতা। এন্ট্রি হয় হিরো রূপী ভিলেনের। রিচার্ড কোটের ভিতরের দুই পাশের পকেট হতে দু’টি গান বের করে পাখির মতো দু’পাশে হাত ছড়িয়ে একনাগাড়ে সুট করতে থাকে ৷ চেহারা শক্ত, সুরক্ষিত, আর চোখে এক অদ্ভুত আত্মবিশ্বাসের আভা। একে একে করে ঘায়েল করতে থাকে সকল ঘাতকদের। পাল্টা আক্রমণের সময় অব্দি পায়নি কেউ। তাকবীরের পাশ বিছিয়ে যায় লাশে। তাকবীর এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিচার্ডের দিকে। রিচার্ড সুট করতে করতে সামনে এগিয়ে আসে। নিজের কাজে অটল থাকা অবস্থায় একপলক পাশ ফিরে তাকাল তাকবীরের দিকে, নিস্তেজ এলিজাবেথর দিকে। অতঃপর দক্ষ হাতে অনড়ভাবে সুট করতে করতে বজ্রপাতের মতো গম্ভীর কণ্ঠ চেঁচিয়ে বললো,

“স্টপ স্টেয়ারিং অ্যাট মি ইডিয়ট। গেট হার ইন দ্য হেলিকপ্টার।”
‘চকিতে হতচেতন হয়ে ফিরে তাকবীর। তাৎক্ষণিক ভাবে অচেতন এলিজাবেথকে কোলে তুলে নিল। এগোতে থাকে হেলিকপ্টারের দিকে। রিচার্ডের গা/নের গুলি শেষ হয়ে যায়। তখনও একজন বেঁচে ছিল। খালি হাতে হিংস্র প্রাণীর মতো হামলে পরল রিচার্ড। বুকের উপর হাঁটু দিয়ে চেপে ধরে শক্ত মুষ্টিবদ্ধ হাতে আঘাত করতে থাকে মুখে ৷ শরীরের সকল তেজ হাতে ঢেলে দিয়েছে এযেন আরেক ভয়ংকর দৃশ্য। তাকবীর হেলিকপ্টারের সিটে এলিজাবেথ কে শুইয়ে দেয়। বিস্মিত চোখে তাকায় রিচার্ডের দিকে, ওর উন্মাদনার দিকে। পাইলট রিচার্ডের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। তবে সে যে বিধ্বংসী ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠেছে। এতো সহজেই কি তা শেষ হবে। উপায়ন্তর না পেয়ে পাইলট আহত তাকবীর আর এলিজাবেথ কে নিয়ে ফ্লাই করে। দৃষ্টিশূন্য না হওয়া পর্যন্ত তাকবীর চেয়ে দেখতে থাকে রিচার্ডের মধ্যের সেই নরখাদকটাকে। যেটা ধ্বংসযজ্ঞের ফূর্তিতে মেতে আছে।
‘দ্বীপের কাছের একটা হসপিটালের ব্যক্তিগত হেলিপ্যাডে হেলিকপ্টারটি ল্যান্ড করানো হয়। রিচার্ডের কথা অনুযায়ী লুকাস আগে থেকেই সব বন্দবস্ত করে রেখেছিল। নার্স’রা স্ট্রেচার নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। চটজলদি ওরা হেলিকপ্টার থেকে এলিজাবেথকে নামিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। তাকবীর নিজেও যথেষ্ট আহত, এখনো রক্ত ঝড়ছে। তবুও পিছু পিছু ছুটে গেল। পাইলট পিছন ফিরে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকবীরের দিকে তাকায়। বিদেশি সংস্কৃতির কাছে পুরুষ মানুষের কান্না খুবই ক্রিঞ্জ। পুরোটা সময় তাকবীর এলিজাবেথের মাথার কাটা অংশ হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছিল রক্তপাত ঠেকাতে। আর পুরুষ বৈশিষ্ট্য থেকে বেরিয়ে নিগূঢ় অনুভূতির জোয়ারে ভেসে কেঁদেছে।

‘হাসপাতালের শীতল করিডোরে বাতাস থমকে আছে। জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের ভার যেন সেখানে জমে আছে। ভেতরে চলছে বাঁচার একমাত্রের উৎসের চিকিৎসা। বাইরে বসে আছে এক পাগল প্রেমিক—নিঃস্ব, অসহায়। তাকবীরের চুল এলোমেলো হয়ে আছে, চোখ ফুলে লাল হয়ে একাকার। অশ্রু শুকিয়ে লবণের দাগ ফেলা হয়েছে গন্ডে। চাতক পাখির মতো ছটফট করছে তাকবীর। হাতের আঙুলগুলো ক্রমাগত মুঠো করে আবার খুলছে।
‘বারবার উঠে দাঁড়ায় তাকবীর, ভিতরে এলিজাবেথের কাছে যেতে থাকে। কিন্তু প্রতিবারই সাদা পোশাকের নার্স থামিয়ে দেয়। কাতর চোখে কাচের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকে, যেখানে তার প্রাণপাখির চিকিৎসা চলছে। তাকবীরকে জোর করে একজন নার্স এসে মাথায় আর হাতে ব্যান্ডেজ করিয়ে দিয়ে যায়। শরীরের প্রতিটি জায়গায় ব্যাথায় টনটন করছে। তবুও জ্বলছে শুধুমাত্র মনের দহনেই। করিডরের এক কোণায় নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে মেঝেতে স্থান দখল করে নেয়। শূন্য দৃষ্টিতে নেই প্রাণ। হঠাৎ একটা লম্বা ছায়া এসে পড়ল তার সামনে। মাথা তুলে তাকবীর, ডক্টরকে দেখতে পেয়ে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়।
” ডক্টর আমার ওয়াইফ?”
“দুঃখিত, আপনার ওয়াইফ কোমায় চলে গিয়েছে। ”
‘ তাকবীর হঠাৎ করেই নিজের চুল মুঠো করে ধরে, দেয়ালে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে অস্পষ্ট স্বরে আওড়ায়,
“প্রাণ আছে?”
‘ ডক্টর চোখ কিঞ্চিৎ ছোট করে ফেলল তাকবীরের এহেন কথায়। পরপর প্রফেশনালি হ্যান্ডেল করতে চাইল,
“হ্যাঁ। দেখুন সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রে করুন। যেকোনো সময় মিরাকেল হতে পারে। ”
‘ লম্বা শ্বাস ছাড়ে তাকবীর, বলল “এতেই হবে। অন্তত বেঁচে থাকার উৎস’টা তো কাছে থাকবে । ”

‘দৃশ্যপট লাস ভেগাসের একটি ক্যাসিনোর বেজমেন্টে। অন্ধকার ক্যাসিনোর বেজমেন্টে ঘন অন্ধকার আর ভেজা বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে আতঙ্কের গন্ধ। ধুলোর স্তূপ আর ভাঙা টেবিলের নিচে মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় কেবলই দুর্বল মানুষগুলোর মুখকে আরো ফ্যাকাশে করে তুলছে। তাদের হাত-পা শক্ত রশিতে বাঁধা, আর ঠোঁটের কোণে জমে থাকা রক্ত আর অশ্রু তাদের অসহায়তার সাক্ষী। মেঝেতে ধপধপ শব্দ তুলে এগিয়ে আসছে এক বিভীষিকাময় মানব। বাম হাতে ঝুলছে মৃত্যুর বাহন বন্দু/ক —ভারী, ধারালো, এবং নৃশংসতার প্রতীক। তার চোখে লালচে দীপ্তি, এ যেন রক্তের নেশায় অন্ধ হয়ে গিয়েছে ।
‘প্রতিটি পদক্ষেপে বন্দিদের শ্বাস ভারী হয়ে নির্গত হচ্ছে। একটি শীতল বাতাস তাদের চামড়া ছিদ্র করে প্রবেশ করে যাচ্ছে । কেউ ফিসফিস করে প্রার্থনা করছে, কেউ চিৎকার করে উঠে বলছে, “আমাদের ছেড়ে দাও!” কিন্তু সেই নরখাদক মুখে এক ভয়াবহ বিকৃত হাসি রেখে ক্রমশ তাদের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। লুকাস এসে রিচার্ডের পাশে দাঁড়াল, নত দৃষ্টি নিবিষ্ট করে নিচু স্বরে বলল,

” বস অ্যালেক্স’কে, কে জানি ওর ম্যানশনেই মেরে ফেলে রেখে গেছে।”
‘গ্রীবা বাঁকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করল লুকাসের উপর। রিচার্ডের শশব্যস্ত বিদুৎ বেগী চাহনি দেখে দু’কদম পিছিয়ে গেল লুকাস। রিচার্ডের নীল চোখ থেকে আগুন অগ্নুৎপাত হচ্ছে। পিঠমোড়া ভান দিয়ে মেঝেতে ফেলে রাখা কীট সমতূল্য বস্তুদের দিকে তাকাল। এক মুহূর্তের জন্য সব স্থির। বন্দু/ক’টা ওপরে উঠল। আলো মোমবাতির ওপর পড়ে, এবং প্রতিফলিত হয় সেই ধাতব বন্দু/কের ধারালো কিনারায়। তারপর…
এক মুহূর্তের নিস্তব্ধতা, এবং সারা ঘরে ছিটকে পড়ে এক ভীতিকর চিৎকারের প্রতিধ্বনি।

‘হাসপাতালের শীতল আলোয় সাদা চাদরে মোড়া একটি বেড। যেখানে শুয়ে আছে এলিজাবেথ, নিঃশেষিত, যেন এক মৃতপ্রায় পাখি। চারদিকে মনিটরের অস্পষ্ট বিপ্‌ বিপ্‌ শব্দ, অক্সিজেন মাস্কের নিচে তার মুখটা ক্রমশ ফ্যাকাশে। ঘরের বাতাস ভারী। শোক আর উৎকণ্ঠায় জমাট বেঁধেছে। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে আছে তাকবীর অতি ক্ষীণ অবস্থায়। মাথার সাদা ব্যান্ডেজের উপর লাল ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। মুখে বিভ্রান্তি, বুকের ভেতর অগ্নি। হঠাৎ করেই অস্বাভাবিক আচরণ করতে থাকে তাকবীর, চিৎকার করে বার বার বলতে থাকে, “আমাকে ওর কাছে যেতে দাও! প্লিজ!” কিন্তু ডাক্তার আর নার্সরা শক্ত হাতে ওকে আটকে রেখেছে। তাকবীরের পাগলামি বাড়তে থাকে। দশ জনের শক্তি ভর করছে শরীরে। সকলকে হাত দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে সামনে এগোনোর চেষ্টা করে, কিন্তু ডাক্তার’রা টেনে ধরছে । কাঁদছে তাকবীর, চোখ থেকে অঝোরে জল গড়িয়ে পড়ছে। গলার স্বর ভেঙে গিয়েছে ততোক্ষণে, অঝোরে চেঁচাতে থাকে , “আমি আমার এলোকেশীকে একবার দেখতে চাই! শুধু একবার!”
‘ডাক্তাররা শান্ত করার চেষ্টা করেও ব্যর্থ। তাকবীর মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে, মাথা নিচু করে কাঁদতে থাকে। “আমি তোমাকে ছেড়ে যেতে দেবো না এলোকেশী, দেবো না যেতে। ”

‘এটা কিছু মুহুর্ত আগের ঘটনা এটা। এলিজাবেথের বেডের পাশে দাঁড়িয়ে আছে তাকবীর। অপেক্ষা করছে ওর জ্ঞান ফেরার৷ ক্ষত তেমন গাঢ় না। তিনটে সেলাই লেগেছে শুধু। তখন ডাক্তারের সাথে মিস আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছিল। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেছিল তাকবীর। তখন ওর মুখের অবস্থা দেখার মতো ছিল। বিশ মিনিট ধরে একটানা দাঁড়িয়ে আছে তাকবীর। শরীরে আর বিন্দু পরিমাণ শক্তিও পাচ্ছে না। তবুও অটল। ছটফট করছে মন তার শখের নারীর মুখ থেকে কথা শোনার জন্য। ডক্টর যতই বলুক সব ঠিক আছে , চিন্তা মুক্ত হতে পারছে না তাকবীর।
‘কিছু মুহূর্ত পর পিটপিট করে চোখে মেলে এলিজাবেথ। চোখের সামনে এখনও সব অস্পষ্ট। ঝাপসা চোখে প্রথমেই অবলোকন হলো তাকবীরের করুণ চাহনি। কাতরায় ঠাঁসা মানুষটার কৃষ্ণগহ্বর। এখনই বুঝি পড়ে যাবে লোকটা। চোখে চোখ পড়তেই মস্তিষ্ক সজাগ হতে থাকে এলিজাবেথের। “ভালো ম,,,,,,
‘এলিজাবেথের দূর্বল ভাঙা কণ্ঠেও সহসাই এক উজ্জ্বলিত শিখা প্রজ্জ্বলিত হলো ভিতরে। আর ধরে রাখতে পারল না নিজেকে। ছেড়ে দিল শরীর। হাঁটু ভেঙে বসে এলিজাবেথের বেডের পাশে। দুহাতের আজলায় চেপে ধরে এলিজাবেথের স্যালাইন যুক্ত হাত। ঠেকাল লালটে। আবারও বাঁধ ভাঙে কান্নার। ভিজে যায় এলিজাবেথের হাত। প্রকম্পিত হচ্ছে তাকবীরের কম্পনে। যত্ন দেখেছে, ভালোবাসা দেখেছে, তবে এটা,,? একদমই নতুন এটা। এই প্রথম বারের মতো তাকবীরের শরীরে স্পর্শ করল এলিজাবেথ আগ বাড়িয়ে। হাত রাখল তাকবীরের ললাটে। আঙুল চালালো চুলের ভাঁজে। “আপনি কাঁদছেন কেন? আমি ঠিক আছি তো ভালো মানুষ।”

‘নিশ্চুপ তাকবীর। শুধু হয় বর্ষণ। অস্থির হলো এলিজাবেথ।
“আমি ঠিক আছি তো ভালো মানুষ। ”
‘এবারেও নিঃশব্দ।
“ছেলেরাও এভাবে কাঁধে?”
‘এবার গিয়ে মাথা তুলে তাকবীর। তখনও কাঁপছে পাপড়িজোড়া। ভেজা গলায় আওড়াল,
“বিশ্বাস হয় না পুরুষও কাঁদে?
কখনো দেখেছ কোনো পুরুষকে ভরা হসপিটালে হাউমাউ করে কাঁদতে? হ্যাঁ আমি কেঁদেছি—শুধু তোমার জন্য। আর সেই ভাগ্যবতী নারী, যার জন্য আমি বেদনায় ভেসেছি। সেই নারী তুমি আর কেউ নও, তুমি আমার এলোকেশী। আমার প্রেমে নিজেকে সঁপে দাও, আমার নিবেদন গ্রহণ কর। ~ ‘শেষে লাইনটি ভিতরেই চেপে রেখে দিল তাকবীর। এলিজাবেথ বাক্য হারায়। শরীর জুড়ে বৈদুত্যিক তরঙ্গ খেলে গেল। কে যেন চাপ দিয়ে ধরে রেখেছে কণ্ঠনালিতে। তাকবীর উঠে বসল ওর পাশে। ছাড়েনি হাত। ভেজা গলায় কোমলতা,বলল,
“এই নশ্বর পৃথিবীতে অবিনশ্বর হওয়ার কোনো তৃষ্ণা নেই আমার। আমি শুধু চেয়েছি যতটুকু সময় পায় সে সময়টুকু তোমার সঙ্গেই কাটাতে। হোক তা একদিন, হোক দুইদিন, তোমার সাথে প্রতিটি মুহূর্তে হারিয়ে যেতে চাই, যেখানে শুধুই আমরা। প্রতিটা মুহূর্তের পূর্ণতা খুঁজে পেতে চাই। সব ভুলে তোমার মধ্যে মজেছি আমি। তুমি হারালে নিঃস্ব আমি।”
“আপনার কথায় আমি ভাষা হারিয়ে ফেলি প্রতিবার।”
‘স্নান হাসল তাকবীর এলিজাবেথের বোলাভালা চেহারা দেখে। হঠাৎ করে দৃষ্টি শক্ত হয় এলিজাবেথের। গম্ভীর কণ্ঠে বলল,” আমি এতো মারামারি জানেন কিভাবে? ”
“তোমার জন্য আমার যেখানে সেখানে হুটহাট যুদ্ধের ঘোষণা।”

“আমি বুঝলাম না বস। ঐদিন আপনার উপর হামলা কে করল? আর আজকে অ্যালেক্স কে-ই মারল কে! আর ওর লোকেরাই বা জানল কি ভাবে এলিজাবেথের কথা। সব কিছু খুবই রহস্যময় লাগছে।
‘গাড়ি চালাতে চালাতে বলল লুকাস। রিচার্ড কোনো প্রত্যুত্তর করে না। সিটে গাঁ এলিয়ে চোখ বুজে রেখেছে। লাস ভেগাস পাপের নগরী নামে অতি পরিচিত। বলা হয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাপ আড্ডা হয় আমেরিকার বড় শহর লাস ভেগাসে। অ্যালেক্স লাগ ভেগাসের একজন কুখ্যাত মাফিয়া। রিচার্ডের সাথে রেশা রেশি শুরু হয় আজ থেকে আরও চার বছর আগে। ইস্যু ড্রাগস৷ অ্যালেক্সের ড্রাগসের বিশাল বড় একটা চালান যেত ইতালি। তবে রিচার্ডের জন্য একসময় তা বন্ধ হয়ে যায়। সম্মুখীন হতে হয় লসের। পুরো ইতালিতে শুধু রিচার্ডের বিজনেসই চলত। সেই থেকেই ক্ষোভ। তবে এখানে এখনও অনেক কিছুই অস্পষ্ট। কে কলকাঠি নাড়াচ্ছে আড়াল থেকে? অ্যালেক্সের পক্ষে কখনোই সম্ভব নয় জানা রিচার্ড যে এখন সানফ্রান্সিসকো তে আছে। আর এলিজাবেথের উপরই আক্রমন কেন হলো,,,,,? হাজারটা_ প্রশ্ন, রহস্য, ষড়যন্ত্র।
“ঐদিকের কি অবস্থা ?”
‘সোজা হয়ে বসল রিচার্ড। লুকাস কথার মানে বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞাসা করল, “জ্বি বস?”
‘কেন যেনো মুখে কথা আটকে আসছে রিচার্ডের। বলতে চেয়েও বলতে পারছে না। সেই ক্রোধ ঝাড়ল লুকাসের উপর। ধমক দিয়ে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“হসপিটালের ইডিয়ট।”

‘হাসি পেল লুকাসের। তবে এখন হাসাও পাপ।
“ঠিক আছে এখন। মেয়ে মানুষ তো অল্প আঘাতেই একদম টলে গিয়েছে। ” ~ বলে কিছু মুহুর্ত আগের ফুটেছ তুলে ধরল লুকাস রিচার্ডের সামনে। রিচার্ড ভ্রু কুঁচকিয়ে তাকায় ট্যাবের দিকে। এটা সেই সময়কার ফুটেজ। যখন তাকবীর পাগলামি করছিল, কান্না করছিল এলিজাবেথের জন্য । কপালে বিরক্তিকর ছাপ ফুটে উঠল রিচার্ডের। বলল,
“এভাবে কান্না করার কি আছে স্ট্রেঞ্জ!”
‘লুকাস স্মিত হাসে। এক হাসিতে ভুলে যায় পাশের মানুষটা কে। ড্রাইভ করতে করতে বলল,
“এটাই ভালোবাসা বস। আপনি বুঝবেন না। মানুষ যখন কাউকে মনপ্রাণ উজাড় করে ভালোবাসে। তখন তাকে হারানো ভয়ে এভাবেই কাঁদে। আমিও তো কতো আমার সুইটির জ,,,
“ঠাসসসসসসস,,,

‘রেড ওয়াইন নামক নাইট ক্লাব। একটা অন্ধকার ঘুটঘুটে ফাঁকা রুম। ভিতরে রয়েছে গ্যাংস্টার রিচার্ড কায়নাত, যার মনে এক অবিশ্বাস্য দুঃখ এবং ক্রোধ, অজানা এক দহনে পোড়া হৃদয় নিয়ে ক্রস পাঞ্চে অনবরত ঘুষি ছুড়ে যাচ্ছে। প্রতিটি আঘাত যেন রিচার্ডের বেদনা আরও গভীর হয়। তবে এই যন্ত্রণার সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছে রিচার্ড অনড়ভাবে ,তবুও নিজের তুচ্ছ অনুভূতির কাছে আত্মসমর্পণ করতে রাজি নয়। এক কঠিন দ্বন্দ্বের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে—এমন এক লড়াই, যেখানে জিততে পারলেও শান্তি মিলবে না। হিংসা নামক এক দাবানলে জ্বলসে সে। জ্বলেপুড়ে যাচ্ছে অন্তকোষ।
‘পাশেই চুপসানো মুখ নিয়ে বসে আছে লুকাস। পায়ে ব্যান্ডেজ করা। এবারের পর থেকে সে ঠিকঠাক ভাবে মুখে লাগাম টানবে। হঠাৎ রাশভারি আওয়াজে চেঁচাল রিচার্ড,
“নেক্সট ফ্লাইট কখন?”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ১৯

‘দুই প্রান্তে দুই মানব। তাদের পথ এক, কিন্তু চলার ধরন ভিন্ন। এক জনে পা ধরে থাকে শান্তির পথে, যেখানে নরম শব্দে গন্তব্যে পৌঁছানোর আশা, অন্যজনের পথ বেয়ে অন্ধকার ও উত্তেজনা, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপে সংগ্রাম। তাদের বৈশিষ্ট্য আলাদা—একজনের হৃদয়ে প্রেম, অন্যজনের মনে ক্রোধ। এই দুই মানব যেন দুটি ভিন্ন দুনিয়া, যেখানে একে অপরের বিরুদ্ধে সংঘর্ষ করে, কিন্তু একত্রে তারা পৃথিবীকে বুঝতে শেখে। তাদের লক্ষ এক।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২১