ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২১
মিথুবুড়ি
‘এলিজাবেথের মাথার ক্ষতটি গভীর না হলেও, তাকবীরের ক্ষতগুলো ছিল যথেষ্ট গুরুতর। বাহুতে চারটি সেলাই, আর হাতে ছয়টি সেলাই পরেছিল। এজন্য তাদের তিনদিন হাসপাতালে থাকতে হয়েছে । অসুস্থ অবস্থাতেও তাকবীর এলিজাবেথের প্রতি তার যত্নের দায়িত্বটা পরিপূর্ণভাবে পালন করেছে। কিন্তু শুধু তাকবীর নয় এলিজাবেথও চেষ্টা করেছে তাকবীরের পাশে থাকতে, তাকে দেখভাল করতে। তারা একে অপরের পরিপূরক হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল যেন দুজনের সম্পর্কের মাঝে কোন দুরত্ব বা বাধা না থাকে।
‘যদিও তাদের মধ্যে স্বামী-স্ত্রী সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি, তবুও তাদের মধ্যে যে সম্পর্কটি তৈরি হয়েছিল। তা ছিল এক অমূল্য, গভীর বন্ধুত্ব—যে বন্ধুত্বে ছিল অটুট বিশ্বাস, মমতা, এবং একে অপরের প্রতি নিঃস্বার্থ যত্ন। আজ ওদের ডিসচার্জ দিয়ে দেওয়া হয়েছে। গাড়ি চলছে এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্য। এলিজাবেথ এখনোও জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে। মনে হাজারো কৌতুহল। তবে তাকবীরকে দেখে মনে হচ্ছে কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে আগ্রহী নই এই মুহুর্তে। তবে ছটফটে মন এলিজাবেথের। দমিয়ে রাখতে পারল না আর।
“শুনুন না।”
“বলুন ম্যাডাম।”
“আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
‘তাকবীর অনবরত ফোনে টাইপিং করে যাচ্ছে। এলিজাবেথের কথায় ফোন থেকে মাথা তুলে ওর দিকে তাকাল। পরপর বিষাদময় কণ্ঠে বলল,” ইতালি। ‘
‘কর্ণফলক হবার সাথে সাথে এলিজাবেথের সমস্ত শরীরে তরঙ্গ খেলে গেল গেল। আঁধারে তলিয়ে যায় দীপ্তিময় অবয়ব। প্রকম্পিত স্বরে আওড়ালো,”কি বলছেন আপনি এসব?”
‘তাকবীর ফোন রেখে এলিজাবেথের দিকে ঘুরে বসল। দু’চোখে আশ্বাস দিয়ে ধাতস্থ গলায় বলতে থাকল,
“আমার কথা শুনো এলোকেশী। এই মুহুর্তে ইতালি আমাদের জন্য সবথেকে সেভ প্লেইজ। তাছাড়া আর কোনো অপশন নেই আমাদের কাছে।”
“আপনি বুঝতে পারছেন না। ঐ সাইকো টা ওখানেই থাকে। জেনে-বুঝে কেন বাঘের খাঁচায় নিয়ে যাচ্ছেন আমাকে। সে আমাকে সুখে থাকতে দিবে না। মেরে ফেলবে আমাকে।”
“আমি আছি তো পাশে। ~ তাকবীর নানান ভাবে বুঝাতে থাকে এলিজাবেথকে। তবে মানতে নারাজ সংকীর্ণ মন।
“এতোদিন সাইকো’টা এখানে ছিল না। আমরা শান্তিতে ছিলাম। আপনি আবার এমনটা কেন করতে চাচ্ছেন ভালো মানুষ। কেন বুঝতে পারছেন না?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘গম্ভীর হয় তাকবীরের স্বর। শক্ত হয় দৃষ্টিভঙ্গি,বলল,
“লিসেন পাখি ৷ আমাকে বিশ্বাস কর,,? করো তো?”
‘নিঃশব্দে মাথা নাড়ালো এলিজাবেথ। তবুও ভিতর থেকে ভয় দূর হয় না। চলতে থাকে গাড়ি পথ ধরে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কয়েক মিনিটের ব্যবধানে গাড়ি গিয়ে থামে এয়ারপোর্টের সামনে। তাকবীর একাই দুটো লাগেজ নিয়ে এগোতে থাকে। এলিজাবেথ এগিয়ে গেল নিজেরটা নেওয়ার জন্য।
“আমাকে দেন। আপনার কষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
“আই ক্যান ম্যানেজ।”
“এটা কেমন? সবকিছু শুধু আপনিই করবেন? আমিও ফাস্ট হতে চাই৷”
‘বাচ্চাদের মতো গাল দুটো ফুলিয়ে বলল এলিজাবেথ। তাকবীর হাসে এলিজাবেকে দেখল। পরপর সামনে এগোতে এগোতে ঠৌঁট কামড়ে হেসে বলল,
“আই অ্যাম অ্যাট ইয়োর সার্ভিস উইফলি৷”
”স্টপ! ডন্ট কল মি দ্যাট।” ভেংচি কাটে এলিজাবেথ।
“ওহ ! অ্যাজ ইউ উইশ, মাই প্রিন্সেস।”
‘এলিজাবেথ নিশ্চুপ। কোনো এক কারণে চুপসে আছে মুখ। তাকবীর খুব সহজেই ধরে ফেলতে পারে লুকায়িত বিষয়টি। উচ্ছাসিত হয়ে হাসতে থাকে তাকবীর অকারণেই। ভেংচি কেটে বলল,
“প্রতিটা বেস্টফেন্ডেরই দায়িত্ব তার বেস্টু কে বেস্ট প্রিন্সেস টিট্রমেন্ট দেওয়া। আমি ভাই কথার নিচে পড়ে থাকতে চাই না।”
‘হেসে ফেলল এলিজাবেথ। এই হাসিতে মন ভরে যায় পাশের পুরুষটিরও। দীর্ঘ নয় ঘন্টা আকাশ পথে জার্নির পর তারা ইতালি গিয়ে পৌঁছে। দু’টো লাগেজ হাতে নিয়ে এক্সিটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাকবীর, পাশেই রয়েছে এক লাবন্যময়ী নারী। তবে এতো ঘন্টার জার্নিতে শরীরে আর অবশিষ্ট শক্তি নেই। নেতিয়ে পড়েছে একদম। তাকবীর বার বার কাকে যেন কল করছে। অভিব্যক্তিতে চাপা রাগ। মিনিট পাঁচেক পর একটা মার্সিডিজ- বেঞ্জ এসে থামে তাদের সামনে। ভিতর থেকে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে আসে রেয়ান। গাড়ি থেকে নেমেই মাথা নত করে দাঁড়ায় তাকবীরের সামনে। ভয়ে চুপসে আছে মুখখানা।
“সরি বস কিছু কারণে একটু দেরি হয়ে গেল।”
‘কারণ ‘ শুনতে পেয়ে তাকবীর ভিতরের চাপা ক্ষোভ ভিতরেই চেপে দেয়। কাঠকাঠ গলায় বলল,”লাগেজ গুলো ডিঁকিতে তুলো।”
‘রেয়ান মাথা নাড়িয়ে তৎক্ষণাৎ লাগেজ ডিঁকিতে তুলে দেয়। এলিজাবেথ ক্লান্তিতে কোনো কিছুই আমলে নেয়নি। হাই তুলতে তুলতে প্যাসেঞ্জার সিটে বসতে যায়। তাকবীর তার আগেই ফ্রন্ট ডোর খুলে দিল। উৎসুকভাবে তাকাল এলিজাবেথ। তাকবীর মাথা নাড়িয়ে উঠতে বলল। এলিজাবেথ নিঃশব্দে উঠে স্থান দখল করে নিয়ে সিটে শরীরের ভর ছেড়ে দেয়। পরপর তাকবীরও গিয়ে বসল ড্রাইভিং সিটে। রেয়ান সব মালপত্র ডিঁকিতে রেখে, লাগিয়ে, দু-হাত ঝেড়ে সোজা হয় সবেমাত্র। ঠিক তখন তখনই তাকবীর ঝড়ের বেগে ধুলো উড়িয়ে স্থান ত্যাগ করে নিমিষেই। চোয়াল ফাঁক হয়ে যায় রেয়ানের।
“আরে আরে ওনাকে রেখে আসলেন তো।”
‘তাকবীর স্মুথলি ড্রাইভ করতে করতে নিরুদ্বেগ ভাব নিয়ে বলল, “ডোন্ট ওয়ারি। ও সব চিনে।”
‘হঠাৎ করেই এলিজাবেথের কপালে ভাঁজ পড়ল। তাকবীরের দিকে তেরছা নজরে তাকিয়ে বলল,”ওনি এখানে কি করছিল?”
“রেয়ান আমার বডিগার্ড। আমি ওকে আগেই বলে রেখেছিলাম এখানে এসে সব রেডি করে রাখতে।”
“এভাবে তো আপনার রাজনীতি,ব্যবসা গোল্লায় যাবে।”
“সমস্যা নেই। ও দিকটা বিয়ান সামলে নিবে।”
‘আঁখিদ্বয় কিঞ্চিৎ ছোট করে তাকায় তাকবীরের পানে এলিজাবেথ। পরপর আড়ষ্ট গলায় বলল,”বিয়ান, রেয়ান নাম দু’টো,,
“ওরা জমজ।”
“কিন্তু ওদের তো চেহারার মিল নেই।”
‘তাকবীর মুচকি হাসল, হেসে বলল,”ওদের চেহারার মতো বৈশিষ্ট্যেরও কোনো মিল নেই। একজনের বুক ভরা সাহসে, আরেকজন খুবই ভীতু।”
‘ফিঁক করে হেসে দেয় এলিজাবেথ,”এতো ভীতু একজন দিয়ে আপনার কাজ কি?”
‘আকষ্মিক খুবই গম্ভীর হয় তাকবীরের কণ্ঠস্বর। প্রেমিক পুরুষের আবরণ থেকে বেরিয়ে রুপান্তরিত হল একজন নেতা বৈশিষ্ট্যে। গুরুগম্ভীর হয়ে বলল,
”প্রতিটি মানুষের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে একেকটি অনন্য প্রতিভা, যা অনেক সময় সমাজের চোখে ধরা পড়ে না। যেমন অন্ধকার নর্দমার গভীরে জাতীয় ফুল শাপলা তার সৌন্দর্য মেলে ধরে, তেমনি কঠিন দারিদ্র্যের মাঝে থেকেও উজ্জ্বল প্রতিভা ঠিকই জন্ম নেয়। পাথরের খাঁজে যেমন মনের অজান্তেই ফুল ফোটে, তেমনি সাধারণ মানুষের মাঝেও থাকে অসাধারণ কিছু করার ক্ষমতা, যা সঠিক সুযোগের অভাবে অনেক সময় অজানাই থেকে যায়। প্রতিভা ঠিক ঝড়ের মতো যেখানে সুযোগ পায়, সেখানে সাড়া দেয়।
“ও আচ্ছা তাই বুঝি? তো বিয়ানের প্রতিভা কি শুনি?”
“ও হ্যাকিংয়ে খুবই ভালো।” ~ বলে হেসে দেয় তাকবীর। দু’চোখে সন্দেহ সংকুচিত হলো এলিজাবেথের। গম্ভীর গলায় বলল,”ব্যাপার কি মশাই? হ্যাকিং দিয়ে আপনার কাজ কি?রাজনীতি রেখে এখন ব্যাংক ডাকাতি করার ইচ্ছে হয়েছে নাকি?”
“দেখেন যা ভালো মনে করেন।”
‘একসাথে দু’জনেই হেসে উঠল।
‘ইতালির সবচেয়ে বড় শহর হলো রোম । এটি ইতালির রাজধানী এবং দেশটির জনসংখ্যার দিক থেকেও সবচেয়ে বড় শহর। রোম শহরটি তার ঐতিহাসিক স্থাপত্য, প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন এবং পর্যটনকেন্দ্রগুলোর জন্য বিশ্বব্যাপী বিখ্যাত। এই রোম শহরেই গড়ে তুলেছে রিচার্ড তার সাম্রাজ্য। করেছে রাজত্ব কায়েম।
_ Bloodhound ( রক্তপিসাসু শিকারী) _
‘ম্যানশনের নেইম-প্লেটে বড় বড় অক্ষরে খোদাই করে লেখা এই ভয়ংকর নামটি। আর নামের মতো ভয়ংকর এখানকার মানুষজন। গ্যাংস্টার এন্ড দ্য ক্রাইম লর্ড রিচার্ড কায়নাতের ম্যানশন। চরিত্রের মতোই জাঁকজমকপূর্ণ এবং রহস্যে ঘেরা ম্যানশনটি। বিশাল লোহার গেট পেরিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ে ছায়ায় ঢাকা দীর্ঘ ড্রাইভওয়ে, যার দুপাশে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু উঁচু সাইপ্রাস গাছ। ম্যানশনের গঠনটি এক আধুনিক দুর্গের মতো। অন্ধকার ছায়ায় মোড়ানো বিশাল পাথরের দেয়াল, বড় বড় জানালা, এবং ছাদের কোণায় বিশাল আকৃতির ড্রাগনের মূর্তি। অন্দরমহলে দেখা যায় চকচকে মার্বেলের মেঝে, সোনার কারুকাজ করা সিঁড়ি, আর দেয়ালে ঝুলে থাকা বিখ্যাত, বিখ্যাত অদ্ভুত যতসব চিত্রকর্ম।
‘লিভিং রুমের কোণায় রাখা দামি সিগারেটের কেস এবং পাশে রাখা পুরনো অস্ত্র, যা এই ম্যানশনের নৃশংসতার এক নীরব সাক্ষী বহন করে আসছে। ম্যানশনের প্রতিটি কোণে ছড়িয়ে আছে নিয়ন্ত্রিত শৃঙ্খলা, যেখানে বিলাসিতা আর ভয় যেন একসাথে হাত ধরে চলেছে। বাইরে থেকে কেউ সহজে বুঝতে পারবে না—এই চমৎকার প্রাসাদের ভিতরে বাস করে এমন একজন ব্যক্তি, যার হাসির আড়ালে লুকিয়ে আছে ভয়ংকর শক্তি। শত-শত গার্ড অনড়ভাবে শিকারী পাখির মতো মোতায়ন থাকলেও একটা গাঁ ছমছমে ভাব রয়েছে। ম্যানশনের কয়েক মাইলের ভিতর নেই কোনো বসতি।
‘বস – ক্যাপোমান্ডামেন্টো, ক্যাপোক্রাইমাইন, র্যাপ্রেসেন্টেন্ট, ডন বা গডফাদার নামে পরিচিত। একটি অপরাধ পরিবারের সর্বোচ্চ স্তর হলো “ফাদার “। এককালীন ইতালি কাঁপানো গ্যাংস্টার ভিনসেনজো কাসানো ( Vincenzo cassano) দ্য ফাদার অফ গ্যাংস্টার রিচার্ড কায়নাত। বয়সের ছাপ পড়লেও মানসিক শক্তি এবং প্রতিপত্তি একেবারে অটুট এখনো। মুখাবয়বের চামড়া ঝুলে গেলেও, চোখে সেই পুরানো আগুন এখনও জ্বলছে। চোখ দুটি যেন একটি অন্ধকার গহ্বর, যেখানে অসংখ্য গল্প ও রহস্য লুকিয়ে আছে। সাদা চুল, কিন্তু মুখের ত্রাণ ও অভিজ্ঞতায় পূর্ণ ছাপ তার প্রতিটি ত্বকচাপ, কুঁচকে যাওয়া চোখের কোণায় জীবনযুদ্ধে কাটানো বছরগুলোর সাক্ষী। ফাদার শান্ত ভাবে বসে আছে, হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। গভীর চোখ দুটোতে যেন পুরো শহরের গল্প লুকিয়ে । ফাদার খুবই কথা কম বলে, কিন্তু যখন বলে, সবাই চুপ হতে বাধ্য। ফাদারের শক্তি শুধু বাহ্যিক নয়, মনস্তাত্ত্বিকভাবে সে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করতে জানে। এই গ্যাংস্টার বস শুধু অপরাধ জগতের নেতা নয়, শহরের অপ্রকাশিত শাসক।
‘ফাদারের পাশের সোফায় বসে আছে রিচার্ড। মুষ্টিবদ্ধ দু’হাত। ধারালো চিবুকে নেই কোনো প্রকার ক্রোধ,রয়েছে বিরক্ততা। ফাদারের সিগারেটের বিষাক্ত ধোঁয়া গুলো এসে পড়ছে রিচার্ডের উপর। তবুও অভিব্যক্তি অত্যন্ত স্বাভাবিক রিচার্ডের। থমথমে পরিবেশ। সুবিস্তীর্ণ এই ম্যানশনের ভিতর রয়েছে বিশের অধিক মেড। তবুও গুমোট পরিবেশ, নেই বিন্দু পরিমাণ শব্দ। শোকে গেয়ে উঠেছে এমন। অতিবাহিত হলো কিছু মূহুর্ত নৈঃশব্দে। এ যেন নিরবতা আর ধৈর্যের প্রতিযোগিতা। তবে শেষ পর্যন্ত হার মানলো ফাদার রিচার্ডের দৃঢ়তায়।
“রিদ।”
‘রিচার্ড একই ভাবে হাঁটুর উপর কনুই ঠেকিয়ে ঝুঁকে থাকা অবস্থায় প্রত্যুত্তর করল, “আমাকে এই নামে ডাকবেন না,আই টোল্ড ইউ ফাদার।”
‘শব্দ করে হাসল ফাদার। প্রসারিত হয় চামড়া ঝুলে যাওয়া চোয়াল। গদগদে গলায় বলল, “এই নামের পিছনের রহস্য জানার মতোই ডাকার অধিকারও রয়েছে শুধু আমার ই। আমার ভালো লাগে তোমাকে এই নামে ডাকতে।”
‘রিচার্ডের অনড় দৃষ্টি মেঝেতে। স্বরে গম্ভীরতা টেনে বলল,” রিচার্ড কিন্তু আপনার পছন্দ করে দেওয়া নাম।”
“এইসব কিছুর থেকেও আমার কাছে বেশি পছন্দের তুমি মাই সান।”
স্মিত হাসল রিচার্ড। হাসিটা যথারীতি রহস্যময় রইল, ওষ্ঠপুটে ঝিলিক দেওয়ার সুযোগ পেল না।
“ফাদার কিছু বলার না থাকলে উঠছি আমি। কাজ আছে আমার।”
“আমি কিছু বলার জন্যই এখানে ডেকেছি তোমায় রিদ।”
‘আবারও বসল রিচার্ড,”কি কথা?”
‘ফাদারের সোজাসাপ্টা কথা, “মেয়ে লাগবে তোমার?”
‘কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজ সংকুচিত হয় রিচার্ডের । মাথা তুলে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ফাদারের দিকে। চাপা ক্রোধ মিশ্রিত কণ্ঠে আওড়ালো, “মানে?”
“কয়টা মেয়ে লাগবে তোমার, বল? পৃথিবীর সবথেকে সুন্দরী সুন্দরী মেয়েদের লাইন বসিয়ে দিব তোমার পিছনে। তবুও ঐ মেয়ের থেকে দূরে থাকো।”
‘কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই লুকাস এসে দাঁড়ায় রিচার্ডের পিছন। ফাদার’কে নিদ্রালুতায় মাথা ঝাঁকিয়ে রিচার্ডের কানে কানে কিছু বলল লুকাস। বাঁকা হাসি ফুটে উঠল রিচার্ডের ওষ্ঠপুটে। হিংস্রতার তীব্র প্রভাবে ফুঁসে ওঠে পৈশাচিক সাইকো মন। মনে মনে আওড়াল,
“পাখি তবে নিজে থেকে খাঁচায় ধরা দিল।”
‘তৎক্ষনাৎ উঠে দাঁড়াল রিচার্ড। ঠোঁটের আগায় জড়ো হয়েছে রহস্যের ঘনঘটা। বাঁকা হাসল। হাস্কি স্বরে আওড়ায়,
“আই’ম অ্যাফ্রেড দ্যাটস আ প্রাইভেট ম্যাটার। সো ব্যাক অফ। ( দুঃখিত, এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাই দূরে থাকুন।)”
‘সঙ্গে সঙ্গে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল রিচার্ড। ফাদার নিঃশব্দে চশমার ফাঁক দিয়ে দেখতে থাকে রিচার্ডের চলে যাওয়া। সে নিজেও এক ধ্বংসযজ্ঞ, পাপাচারে নিবিষ্ট এক অন্তহীন মরিচীকা। জানে এবং বুঝে কোন খেলার গুটি কিভাবে,কখন চালতে হয় ।
“খেয়ে নাও।”
‘মুখ ফিরিয়ে নেয় ইবরাত। ন্যাসো কোমরে হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে ছিল ইবরাতের সামনে। তপ্ত শ্বাস ফেলে বসল এবার এক হাঁটু ভেঙে ইবরাতের সামনে। খাবারের থালাটা আর একটু এগিয়ে দিল। কোনো নড়চড় নেই ইবরাতের। শুধু নীরবে চোখের পানি ফেলছে। ন্যাসো বুঝতে পারে না এই অহেতুক কান্নার মানে। সেদিনের পর আর কোনো মেল গার্ড ভিতরে আসেনি। ন্যাসোর কড়া নিষেধ ছিল। ফিমেল মেড এসে তিন বেলা খাবার দিয়ে যেতো। তবে প্রতিবারই ইবরাতের খাবার যেমন কি তেমনই ফেরত যেতো। কেন জানি ইবরাতের চোখের পানি ন্যাসের ভিতর শীতল করে দিচ্ছে। অদ্ভুত, অদৃশ্য এক কষ্ট।
“কি সমস্যা কান্না করছ কেন?”
“একজন শ্যাম বর্নের নারী সবসময় একজন সুদর্শন পুরুষের প্রেমে পড়ে। যাকে পাওয়া চাঁদ সমতূল্য।”
‘বিরক্তে চ’ উচ্চারণ করে ন্যাসো, “এই মেয়ে আবার শুরু করেছ তুমি? আর কতবার বোঝাবো?”
‘হঠাৎ করেই কান্না মিশ্রিত ভাঙা কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল ইবরাত। সহসা বের করে দিল ভিতরে সকল ক্ষোভ, কষ্ট, জ্বালাপোড়া।
“মেরে ফেলুন আমাকে, অন্তত মৃত্যু তো শান্তি দেবে। এই কষ্ট, এই দহন, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। আপনার প্রেমের আগুনে পুড়ে পুড়ে আমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছি। একে একে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি আমি। প্রতিটি শ্বাস যেন আগুনের মত গরম, প্রতিটি মুহূর্ত মৃত্যুর থেকেও যন্ত্রণাদায়ক। দয়া করে আমাকে এই জ্বালা থেকে মুক্তি দিন, আমাকে রক্ষা করুন।”
‘সংযম হারায় ন্যাসো। খোপ করে চেপে ধরে ইবরাতের কণ্ঠনালি। গলা টেনে কাছে নিয়ে আসে। রাগী স্বরে বলল,”একদম আমার সাথে উঁচু গলায় কথা বলবে না।”
‘গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। তবুও দৃষ্টি ভঙ্গ করে না ইবরাত। নিস্প্রভ দ্বিধাহীন নজরে চেয়ে থেকে বলল,
“একটু ভালোবাসেন নাহ আমাকে।”
‘ধীরে ধীরে স্বর পরিবর্তন হতে থাকে ন্যাসো। চোখেমুখে ফুটে ওঠে অস্থিরতা। চেঁচিয়ে বলল,”আমি একটা খুনি। একজন খুনির সাথে নিজের জীবন জড়াতে চাচ্ছো?”
‘ইবরাতের একই স্বরে জবাব, “খুন করা পাপ।ভালোবাসা না।”
“আই অ্যাম ইন ডেঞ্জার, ইন মাই মাইন্ড, দের আর ডিফারেন্ট ওয়ার্ল্ডস ক্রিপিং ইন। দ্য হেভেনস অ্যান্ড দ্য আর্থ কলাইড। আই ডু নট নো হোয়্যার আই অ্যাম। আমি জানি না আমার ডেসটিনিতে কি আছে। যেকোনো সময় শত্রুদের বন্দুকের গুলি আমি বুক চিঁড়ে বেরিয়ে যেতে পারে। কোনো ভবিষ্যৎ নেই এই সম্পর্কের।”
“আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
“স্টপ অ্যাকটিং সো ইম্যাচিওর। ইউ ডোন্ট ওয়ান্ট আ লাইফ উইথ মি, অ্যান্ড অনেস্টলি, নো ওয়ান ডাজ। তোমার পুরো জীবন পড়ে আছে। আমাকে এভাবে আর যন্ত্রণা দিও না প্লিজ।”
“সবকিছু ভুলে আমি আপনার সাথে থাকতে চাই। আপনার পাশে থাকতে চাই। আমি কোনো কিছু শুনতে বা দেখতে চাই না আমি। ডু ইউ লাভ মি?”
“আই লাভ ইউ।”
‘কেঁপে উঠল পুরো বেজমেন্ট। তিনটি শব্দ। শুধুমাত্র তিনটি শব্দ নিস্তব্ধ করে দেয় ইবরাতকে। নিশ্বাস আঁটকে চেয়ে রইল ন্যাসোর বাদামি চোখজোড়ায়। গতি হারালো হৃদয়স্পন্দন,বেরিয়ে এল শক্ত মস্তিষ্ক থেকে। চেঁচিয়ে বলতে থাকল ন্যাসো,
“ভালোবাসি আমি তোমাকে। সেই শুরু থেকে। গলিয়ে জল করে দিয়েছ আমার শক্ত হৃদয়কে। ইচ্ছেকৃত ভাবে জরিয়েছ আমার এই জীবনে। পরবর্তীতে আফসোস করলে চলবে না।”
‘ইবরাত এখনো নিজের চোখ এবং কান’কে বিশ্বাস করতে পারছে না। মনে হচ্ছে সবই স্বপ্ন। এক ঘোরের মধ্যে থেকে বলে দিল, “করব না আফসোস।”
‘অকস্মাৎ শরীর জুড়ে বৈদুত্যিক তরঙ্গ খেলে গেল ইবরাতের। নিজেকে আবিষ্কার করল ন্যাসোর শক্ত বৃক্ষপটে। ওর ওষ্ঠের ভাঁজে বিরাজ করছে ন্যাসোর ওষ্ঠ। কাঁপতে থাকে ইবরাত। এতোক্ষণে বিশ্বাস হয় এ সকল কিছুই সত্যি, কোনো কল্পনা জল্পনা নয়। প্রেম নিবেদনে সাই দিল ইবরাত, খামচে ধরল ন্যাসোর জ্যাকেট। প্রখর অনুভূতি তীব্রভাবে কামড়ে ধরল তনুমনকে। কালো বর্তমান যেন সমস্ত পথ রুদ্ধ করে দেয়, আর স্তব্ধ আকাশে একটি নির্মল, বিশুদ্ধ দীপ্তি ঝিলিক দিয়ে উঠল। হৃদয়ের কপাটে আনাচে-কানাচে দোল খেল সজীব বসন্তের মৃদু দোলনা, যেন জীবনের নতুন শুরুর এক মিষ্টি অনুরণন।
“পূর্ণতার লোভ দেখিয়ে অপূর্ণতায় ঠেলে দিবেন না তো?”
“আমি ইতালি যাব কাল ই, বসের সাথে কথা বলব আমাদের ব্যাপারে।”
“আবার আমাকে রেখে চলে যাবেন?”~ ন্যাসোর বৃক্ষপটে লেপ্টে ছিল ইবরাত। স্মিত হাসল ন্যাসো। ইবরাতের ললাটে পরশের ছোঁয়া দিয়ে বলল,
“একেবারে কাছে আনার জন্য একটু দূরে যেতেই হবে।”
‘এক গাল হেসে আবারও ন্যাসোর বুকে মাথা রাখে ইবরাত। অতি খুশিতে বাচ্চাসুলভ আচরণ করতে থাকে,
“আম্মুকে আমার সাথে রেখে যান প্লিজ। আমার একা একা খুব ভয় লাগে।”
“আচ্ছা।”
‘ন্যাসোর বুকে অকারণেই আঙুল ঘুরাতে থাকে ইবরাত। হাই হা-হুতাশ করে হতাশাগ্রস্ত স্বরে বলল,
“অথচ বয়সটা ছিল শুক্রবারে স্বামী নামাজ শেষে এসে বলবে,”ওগো তোমার জন্য জিলাপি এনেছি”।কিন্তু পোড়া কপাল এখানে বন্দী হয়ে আছি।”
“আমি খ্রিস্টান ইবরাত।”
‘চকিতে সরে আসে ইবরাত। নিমিষেই রক্তশূণ্য হয়ে যায় অবয়ব। ঘূর্ণিঝড় ঘূর্নিভূত হয় হৃদয়কপাটে। চোখের কোণে জ্বলে ওঠা সুপ্ত আলোর ন্যায় ধাঁধিয়ে যাওয়া স্বচ্ছ ভালোবাসা উবে গিয়ে অক্ষিপট ছেড়ে গিয়ে দাঁড়ালো শূন্যের কোটায়। দৃষ্টি ফিরিয়ে নিল ন্যাসোর কাতর দৃষ্টি থেকে।
“চলে যায় আপনি।”
‘বুক খালি হয়ে আসে ন্যাসো। রক্তাভ মুখশ্রীত উৎকণ্ঠায় ঠাসা। বলল,”কেন?”
কাঁদছে ইবরাত, থরথর করে কাঁপছে শরীর। ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে আওড়ায়,
“ধর্মের দেয়াল আমাদের কখনো এক হতে দিবে না।
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ২০
কারণ, আমি আপনার থেকেও বেশি আমার রব’কে ভালোবাসি। চলে যান আপনি।”
‘ফিচলে হেসে উঠে দাঁড়াল ন্যাসো। তাকাল ক্রদনরত মেয়েটার দিকে। অতঃপর জড়তা-সংকোচ বিহীন বলল,
“ভালোবাসা খুবই শক্তিশালী ইবরাত জান।”
‘সাথে সাথে চলে যায় ন্যাসো। লুটিয়ে পড়ল ইবরাত। ওর কান্নার তোড়ে প্রকম্পিত হতে থাকে মেঝে।