ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৩১

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৩১
মিথুবুড়ি

‘সকাল মানেই নতুনত্বরের সূচনা । কিন্তু নতুনত্ব মানেই সবসময় সুমিষ্ট হয় না। এলিজাবেথের জ্বর কিছুটা কমলেও একেবারে সেরে ওঠেনি। ক্লান্ত শরীর নিয়ে একটু দেরিতেই ঘুম ভাঙল। বিছানা ছেড়ে উঠে প্রথমেই তাকবীরকে খুঁজতে শুরু করল এলিজাবেথ। কাল রাতের ঘটনাগুলো এখনো মাথায় ঝড় তুলছে। মনে হাজারটা প্রশ্ন। যার উত্তর তাকবীর ছাড়া আর কেউ দিতে পারবে না। তাকবীরকে খুঁজতে খুঁজতে এলিজাবেথ প্রথমবারের মতো পা বাড়াল তাকবীরের রুমের দিকে,যেটা সমাজের চোখে তার স্বামীর ঘর। এলিজাবেথ দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে দেখল, ঘরটা পুরোপুরি ফাঁকা। কোথাও তাকবীরের কোনো চিহ্ন নেই।
‘তাকবীর সচারাচর এতো তাড়াতাড়ি কোথাও যায় না।

মনের অস্থিরতা মিলে একটা অদ্ভুত শূন্যতা তৈরি করল। এলিজাবেথের চোখ আটকালো তাকবীরের বিছানায়। খুবই এলোমেলো হয়ে রয়েছে। কাজের মানুষ যে কাজ ছাড়া থাকতে পারে না, এ এক অমোঘ সত্য। এলিজাবেথের জীবনেও তাই। দীর্ঘদিন ধরে নিজেকে গুটিয়ে রেখেছে তাকবীরের নিষেধাজ্ঞায়। এক কাপ চা বানানো তো দূরের কথা ঘরের ছোটখাটো কাজেও হাত বাড়ানো নিষেধ। বিছানা গোছাতে এগিয়ে গেল এলিজাবেথ। কিন্তু বিছানার চাদর ঝাড়তে গিয়ে হাতে উঠে এলো একটি ছবি। প্রথমে ঠাহর করতে পারেনি কিছুই। কিন্তু ছবিটা ভালো করে দেখার সঙ্গে সঙ্গে হাত থরথর করে কেঁপে উঠল এলিজাবেথের।
‘ছবিটি হাত থেকে খসে মাটিতে পড়ে। শ্বাস আটকে এলো এলিজাবেথের। চোখ দুটো ধীরে ধীরে আবার ছবির দিকে গেল। এক অপ্রতীকর নৃশংস দৃশ্যের সাক্ষী হলো এলিজাবেথের স্নায়ু। ছবিটা এতোই নৃশংস যে কোনো দূর্বল হৃদয়ের মানুষ এটাতে বেশিক্ষণ চেয়ে থাকতে পারবে না। (বন্ধ ঘর। মেঝে রক্তে ভেসে গেছে। সেখানে পড়ে আছে এক নারী—ধ্বংসস্তূপের মতো। তার দুই উরুর মাঝখানে সদ্য জন্মানো একটি শিশু, রক্তে মাখা, নীরব। দেখেই বুঝা যাচ্ছে দুজনেই মৃত।)

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘এলিজাবেথ ঝুঁকল। কাঁপা কাঁপা হাত বাড়ালো ছবিটা নেওয়ার জন্য। কিন্তু তার আগেই খপ করে কেউ হাতে তুলে নিল ছবিটা। এলিজাবেথ চমকে উঠল। সোজা হয়ে অবাক চোখে তাকাল তাকবীরের দিকে। তাকবীরের শ্যাম বর্ণ ঢাকা এক গভীর গম্ভীরতায়। তাকবীর ছবিটা আর হাতে রাখল না। সরাসরি পকেটে ঢুকিয়ে নিল। চোখে ফুটে উঠেছে অস্বস্থির ছাপ।
“ভালো মানুষ এটা কি ছিল?”
‘তাকবীর নিঃশব্দ। এলিজাবেথের কৌতূহল আরো বাড়ে। তাকবীরের চোখ ধীরে ধীরে লাল বর্ণ ধারণ করে। হাতের মৃদু কাঁপন কৌতূহলের ঝড় তুলল এলিজাবেথের ভিতর।
“ভালো মানুষ বলুন ওটা কে ছিল?”
“এটা একটা মুভির সিন।” ~খালি গলায় প্রত্যুত্তর করে তাকবীর। এলিজাবেথের ললাটের মাঝ বরাবর ভাঁজ সংকুচিত হলো। পাশাপাশি চোখে সন্দেহ সংকুচিত হয়।

“এইরকম নৃশংস মুভিও হয়? আর এটাই বা আপনার বালিশের নিচে কেন?”
‘তাকবীরের শ্যাম বর্ণ ঠাঁসা উদ্বিগ্নতায়। শুষ্ক ঢোক গিলে সরু গলায় বলল,,”বাস্তবে হতে পারলে মুভিতে হতে পারবে না কেন! মুভিটা আমার খুব প্রিয় ছিল তাই রেখে দিয়েছি। নাথিং এলস৷”
‘এলিজাবেথ কিছু বলতে যাবে, তখনই তাকবীরের মাথায় চাপানো সাদা টুপিতে চোখ পড়ল এলিজাবেথের। সংসদ সদস্য হওয়ার কারণে তাকবীর প্রায়শই পাঞ্জাবি পরলেও আজ টুপি পরা এলিজাবেথকে বিস্মিত করল। দ্বিধাহীন কণ্ঠে প্রশ্ন করল এলিজাবেথ,
“আপনার মাথায় টুপি কেন? কোথায় গিয়েছিলেন আপনি?”
‘তাকবীর আজ অপ্রত্যাশিতভাবে একবারও তাকাচ্ছে না এলিজাবেথের দিকে। নত দৃষ্টি নিবিষ্ট করে রেখেছে শুরু থেকে। নত দৃষ্টিতে স্থির থেকেই শান্ত গলায় বলল,

“জানাজায়।”
“কার? কে মারা গেছে?”
‘তাকবীরের কণ্ঠ কঠিন তবে স্তব্ধতার মতো ভারী।
“বিয়ান।”
‘আঁতকে উঠল এলিজাবেথ। বিয়ানের মৃত্যুর খবর ওর কোমল মনে গভীর প্রভাব ফেলল। কাঁপা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করল, “কীভাবে মারা গেলো?”
‘তাকবীর একই নিরাসক্ত স্বরে উত্তর দিল, “কার এক্সিডেন্ট।”
“ইন্না- লিল্লাহ! উনি তো খুব ভালো মানুষ ছিলেন। রেয়ান ভাইয়া কি খুব ভেঙে পড়েছে?”
‘তাকবীরের ঠোঁটের কোণে সামান্য তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল, তবে তা এলিজাবেথের দৃষ্টির আড়ালেই রইল। খাদযুক্ত স্বরে বলল, “কিছুটা।”
‘তাকবীর মাথার টুপি খুলে আলমারির দিকে এগিয়ে যেতে যেতে খালি গলায় বলল,
“আমি জানি তোমার অনেক প্রশ্ন আছে। সব উত্তর দেব। তবে একটু সময় চাচ্ছি। খুব ক্লান্ত আমি, একটু একা থাকতে চাই।”

‘এলিজাবেথ আর কথা বাড়াল না। নীরবে মাথা নেড়ে বের হয়ে যাচ্ছিল। তাকবীরের বিশ্বস্ত লোক রেয়ান আর বিয়ানের কথা চিন্তা করেই হয়তো মন এত ভারাক্রান্ত, এটা বোঝা কঠিন ছিল না এলিজাবেথের জন্য। দরজা পেরিয়ে যাচ্ছিল এলিজাবেথ, হঠাৎ পিছন থেকে ভেসে এলো তাকবীরের সেই দালিপকৃত দায়িত্বশীল কণ্ঠ,
“এলোকেশী! বার অনুযায়ী আজ মাথায় তেল দেওয়ার দিন।”
‘এলিজাবেথ ঠোঁট চেপে হাসল। হেসে মাথা নুইয়ে বেরিয়ে গেল নিঃশব্দে। ভেবে পায় না, এই মানুষটা কীভাবে এতোকিছু নজরে রাখে। ওর মতো অগোছালো একজনের জীবনে তাকবীর এক সাজানো শৃঙ্খলা এনে দিয়েছে। কখন নখ কাটার দরকার, মাথায় তেল দেওয়া প্রয়োজন, কিংবা নিজের মতো একা থাকার প্রয়োজন এলিজাবেথ জানার আগেই তাকবীর সব বুঝে যায় অদ্ভুত হলেও সত্যি।
‘এলিজাবেথ চলে যেতেই তাকবীর পিছন ফিরে সেই খালি দরজার দিকে তাকাল। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুগুলো নীরবে গড়িয়ে পড়ল।

‘তখন বিকেল। এলিজাবেথ নিচে যাওয়া জন্য সিঁড়ির দিকে এগোচ্ছিল। তখনই দেখা হয় তাকবীরের সাথে। তাকবীরও উপরেই আসছিল। দুজনের চোখাচোখি হতেই সৌজন্যমূলক হাসি উপহার দিল একজন আরেকজনকে। এলিজাবেথ আর এগিয়ে গেল না। তাকবীর এগিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়ায়। হাতে একগুচ্ছ সাদা গোলাপ। ফুলগুলো এলিজাবেথের দিকে এগিয়ে দিল তাকবীর। একগাল হেসে উচ্ছাসিত গলায় বলল,
“হ্যাপি ওয়ান মান্থ ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি লাভ অফ মাই লাইফ৷ দেখতে দেখতে একটা মাস হয়ে গেল।”
‘উজ্জ্বল মুখ স্নান হয়ে এলো এলিজাবেথের। টানাপোড়ানে জ্বলন হয় বুকের ভিতর। তবুও এলিজাবেথ স্মিত হেসে তাকবীরের হাত থেকে ফুলগুলো নিল। হাসল তাকবীর নিজেও। তবে অন্য সময়ের মতো এতো প্রাণখোলা ছিল না সেই হাসি।
“একটু আমার রুমে আসবে কিছু কথা ছিল।”

‘বুকের গভীরে মোচড় দিয়ে উঠল এলিজাবেথের। তাকবীর আজ প্রথমবারের মতো ওকে নিজের ব্যক্তিগত কক্ষে আসার ইঙ্গিত দিল। তবে কি আজ তাকবীর তার অধিকার দাবি করতে চলেছে? ফুল নিয়ে আসাটাও কি তাই? এলিজাবেথের মনের ভেতর হঠাৎই অজস্র অদ্ভুত চিন্তা মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। তাকবীর আবারও চোখের ইশারায় ডাকল এলিজাবেথকে৷ অতঃপর নিজে আগে এগিয়ে গেল কক্ষের দিকে। এলিজাবেথ দম বন্ধ করে ধীর পায়ে তাকবীরের পিছু পিছু গেল। এলিজাবেথ কক্ষের ভেতর পা রাখতেই তাকবীর দরজা ভেতর থেকে আঁটকে দেয়।
‘কিছু মুহূর্তের ব্যবধানে দরজা খুলে গেল। ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো এলিজাবেথ। তবে এবার সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে। যাওয়ার সময় চোখে-মুখে যে ভয় আর সংশয়ের ছায়া ছিল তা মুছে গেছে। বরংচ ঠোঁটের কোণে ফুটে আছে উজ্জ্বল, প্রশান্ত হাসি। কিন্তু সেই উজ্জ্বলতা মুহূর্তেই ম্লান হয়ে গেল। নিচ থেকে ভেসে আসা চিৎকার-চেঁচামেচিতে থমকে দাঁড়াল। সেই স্বর যে পরিচিত, খুবই পরিচিত। এলিজাবেথ সিঁড়ির কাছে ছুটে গিয়ে নিচে তাকাতেই দেখল বিধ্বস্ত রিচার্ড কে। রিচার্ডের মুখে রক্তের দাগ, পোশাক এলোমেলো।

“এলিজাবেথ।”
” এলিজাবেথ।”
“এলিজাবেথ।”
‘রিচার্ড এলিজাবেথের নাম ধরে চিৎকার করতে করতে ভিতরে আসছে। কিন্তু সেই কণ্ঠস্বর, যা একসময় গর্জনের মতো ভরাট ছিল, আজ তা ভাঙা ঢেউয়ের মতো কাঁপছে। সর্বদা পরিপাটি থাকা রিচার্ডের শরীর আজ বিধ্বস্ত। চুলগুলো উসকোখুসকো ঝড়ের তাণ্ডব সয়ে আসা। সেই শক্তিশালী দৃঢ়চেতা মানুষটা নিস্তেজ হয়ে ভিতরে ঢুকছে, ভারী পায়ে। রিচার্ডের সমুদ্র নীল চোখজোড়া নিবদ্ধ এলিজাবেথের দিকে তবে সেখানেও এক শূন্যতা। নির্বাক হয়ে গেল এলিজাবেথ এই এক অন্য রিচার্ড’কে দেখে। এলিজাবেথ রিচার্ডের চোখের গভীরে খুঁজল সেই তেজ, সেই আগুন যা গলিত লোহার মতো ভয়াবহ। কিন্তু সেখানে এখন কিছুই নেই, একদম শূন্য।

‘এলিজাবেথ রিচার্ডের শূন্য দৃষ্টির গভীরে চেয়ে থেকে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো এক অজানা টানে। রিচার্ড আরও কয়েক কদম এগোতেই পিছন থেকে দু’জন গার্ড এসে ওকে বাঁধা দেয়। একজন গার্ড রিচার্ডের কাঁধে হাত রাখতেই রিচার্ড ওদের আঘাত না করে উন্মাদের মতো পাশের কাচের গ্লাসে হাত দিয়ে আঘাত করতে শুরু করে। হাত থেকে ঝড়তে থাকা প্রতিটি রক্তফোঁটার সাথে বেরিয়ে যাচ্ছিল সমস্ত অব্যক্ত সব যন্ত্রণা। সাদা টাইলস তাজা লাল রক্তে সিক্ত হয়ে উঠল। রিচার্ডের এমন পাগলাটে কান্ড দেখে ভরকে গেল গার্ড দু’জন। তারা আর এগোনোর সাহস পেল না, থমকে দাঁড়িয়ে রইল সেখানেই।
‘এলিজাবেথ স্তব্ধ হয়ে দূর থেকে দেখছিল রিচার্ডের ছটফটানি। ওর চোখজোড়া বিস্মিত খুবই, একই সাথে বুকের ভিতর অস্থিরতা। শব্দে উপর থেকে তাকবীরও নেমে আসে। রিচার্ড’কে এমন অবস্থায় দেখে তাকবীর কিছু দূরে থেমে দাঁড়িয়ে গেল। তাকবীরের ফোলা চোখের লালচে আভা বলে দিচ্ছিল এই শক্তিশালী মানুষটা কতটা নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিয়ে এসেছে।

‘মনের ক্ষোভ অনুযায়ী রক্ত ঝড়িয়ে রিচার্ড শান্ত হলো। হেলেদুলে গিয়ে দাঁড়াল এলিজাবেথের সামনে। ক্রমাগত এলিজাবেথের বুকের ভিতরের চাপ বাড়তেই থাকে। রিচার্ড শূন্য অভিব্যক্তিতে কাতর দৃষ্টিতে চেয়ে আছে এলিজাবেথের দিকে ঠিক তেমনি ভাবে চেয়ে এলিজাবেথ রিচার্ডের দিকে। দু’জনের চোখে এক ধরনের অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ। এক অদৃশ্য সেতু যে সেতুর উপর দাঁড়িয়ে ছিল তারা দু’জন। কিন্তু কেউ কাউকে স্পর্শ করতে পারছিল না।
“আমায় একটু জড়িয়ে ধরবে, রেড?”

‘রিচার্ডের কণ্ঠে গভীর আর্তি। যেন ভেতরের সমস্ত শক্তি নিঃশেষ হয়ে আসছে। এই ভাঙা স্বর এলিজাবেথের বুকের গভীরে এক অজানা যন্ত্রণা ঢেউ তুলে। মোচড় দিয়ে উঠল অভ্যন্তরে। এমন দুর্বলতা এমন অসহায় আকুতি কি কখনো মানায় এই নিষ্ঠুর গ্যাংস্টার বসের কণ্ঠে? কিন্তু আজ,,, আজ কিছু আলাদা। রিচার্ড চেয়ে আছে এলিজাবেথের দিকে নিঃশব্দ। হিংস্রতার আগুন নেই, ক্ষুব্ধতা নেই, বরং কোথাও লুকানো এক তীব্র ব্যথা যা বহুদিন ধরে জমে ছিল সুরক্ষিত এক দুর্ভেদ্য দুর্গে। সেই দুর্গের দেয়ালগুলো আজ ভেঙে যাচ্ছে,খসে পড়ছে অজানা এক তীব্রতার কাছে।
‘রিচার্ডের চোখের গভীরতা এলিজাবেথকে আকর্ষণ করছে এমনভাবে যেন এক অদৃশ্য বাঁধনে ওকে টেনে নিচ্ছে। শরীরের শক্ত বাঁধ ভেঙে গিয়ে নরম হয়ে এলো এক অজানা আকর্ষণের বশে। পায়ের পদক্ষেপ নিজ থেকেই এগিয়ে গেল এক মহাকালীন ঘোরের মধ্যে দিয়ে এক অনিবার্য ভবিষ্যতের দিকে। তাদের মাঝখানের শূন্যতাটি মিলিয়ে গেল কোনো এক গোপন প্রভাতের আলোয়।

‘দুটো খাদযুক্ত দৃষ্টিতে মিশে গেল,স্বকীয়তা খোয়ালো। এলিজাবেথ ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে আলগোছে জড়িয়ে ধরল রিচার্ডকে। মিশে গেল দু’টি বৃক্ষপট।এলিজাবেথ ওর নরম তুলতুলে হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরল রিচার্ডের পিঠ। শরীরে ঢেউ খেলে গেলেও আজ এলিজাবেথ কাঁপল না। মিশে রইল রিচার্ডের বুকে, অনুভব করছিল রিচার্ডের বুকের ভিতরের গুপ্ত সেই অসহনীয় যন্ত্রণা। রিচার্ড ধরল না এলিজাবেথকে। পরিবর্তে শুধু নিজের পুরুষালি রুক্ষ থুতনি রাখল এলিজাবেথের কাঁধে। চোখ বুঁজে ফেলল। এইটুকু সংস্পর্শেই ছেড়ে দিল রিচার্ড তার শরীরের সমস্ত ভর এলিজাবেথের উপর।

‘নিঃশব্দে এলিজাবেথের চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ল অশ্রু, অযাচিত, অজানা কারণে। কেউ বুঝতে পারল না এলিজাবেথের কান্নার কারণ। এলিজাবেথ হাতের দৃঢ়তা আরও বাড়িয়ে রিচার্ডের বুকে ঠেকানো নাকটা ধীরে ঘষে নিল তার ত্বকের উপর। একটানে শুষে নিতে চাইল রিচার্ডের শরীরের সমস্ত ঘ্রাণ। ওর মন অনুভব করছিল রিচার্ডের ভেতরের অশান্ত ঝড়। এলিজাবেথের চোখে ছিল বেদনার গভীরতা, আর বুকে ছিল অনিশ্চিত তবু দৃঢ় গুপ্ত অনুভূতিগুচ্ছ।
‘মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেল তাকবীরের হাত এই দৃশ্য দেখে। রিচার্ড চোখ খুলল। সরাসরি তাকাল তাকবীরের উত্তপ্ত চোখে। মুহূর্তেই রিচার্ড এলিজাবেথের থেকে সরে আসলো। অতঃপর ধীর কদমে এগিয়ে গেল তাকবীরের দিকে। এলিজাবেথ অচেতন হয়ে তাকিয়ে ছিল রিচার্ডের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে। তখনই সদর দরজায় ছুটে এসে থামল ন্যাসে আর লুকাস। দুজনেই হাঁপাচ্ছিল! চোখে অশ্রু। এলিজাবেথ বিস্মিত চোখে লুকাসের দিকে তাকাতে লুকাস ভাঙা গলায় বলল,

“ফাদার আর নেই।”
‘থমকে গেল এলিজাবেথ মুহূর্তের জন্য। চকিতে ফিরে তাকাল রিচার্ডের দিকে। একটা মানুষটি কতোটা শক্ত আর কঠোর হলে এখনো নিজেকে এত দৃঢ়তায় আঁটকে রাখতে পারছে? অথচ তার সাথে থাকা দু’জনের কষ্টের সাক্ষী বহন করছে তাদের রক্তলাল চোখ। সেখানে রিচার্ডের চোখে-মুখে কোনো পরিবর্তন নেই। অভিব্যক্তি শূন্য, যদিও ভিতরে এক তোলপাড় করা ঝড় চলছে। তা এলিজাবেথ নিজে অনুভব করেছে আজ।
‘রিচার্ড এক পা এগিয়ে তাকবীরের সামনে দাঁড়াল। চোখে তীব্র ঘৃণা আর গলার স্বরে অঙ্গীকার। শব্দগুলো চিবিয়ে চিবিয়ে বের হতে লাগল,
“এবার আর কোনো সম্পর্কের টানে খেলা হবে না। এবার খেলা হবে প্রফেশনালি। তোর পতন আজ থেকে শুরু।”
‘তাকবীর দাঁতে দাঁত চেপে রইল। কোনো কথা না বলল। চোখে রাগের আগুন জ্বলছিল। দূর থেকে এলিজাবেথ ওরা কেউ কিছুই শুনতে পেল না রিচার্ডের কথা। রিচার্ড ঘুরে একবার তাকাল এলিজাবেথের দিকে। পরপর ক্রোধে মটমট করতে থাকা ধারালো চিবুকে এলিজাবেথের পাশ ঘেঁষে সামনে এগোতে থাকে। পিছন থেকে ডেকে উঠল এলিজাবেথ।

“আ-আপ,,,,,
‘অতর্কিত আক্রমণে হচকিয়ে গেল এলিজাবেথ। রিচার্ডের মস্তিষ্ক আবারও ফিরে গেলো তার ভয়ংকর পৈশাচিক স্বরূপে। হিংস্র প্রাণীর মতো গর্জে উঠে পিছন ঘুরে এলিজাবেথের কণ্ঠনালি চেপে ধরল। বজ্রপাতের মতো গম্ভীর কণ্ঠ,
“আমার কাছে নারী মানেই বিধ্বংসী। তুইও তার বাইরে না। বিধ্বংসী নারী।”
‘এলিজাবেথ’কে এক হাতে ছুঁড়ে ফেলে সঙ্গে সঙ্গে হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল রিচার্ড। পিছন পিছন গেল ন্যাসো আর লুকাস। এলিজাবেথ থমকে রিচার্ডের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইল। কার্নিশ কোণে বারিধারা। বার বার ভেঙে আসছে ঠৌঁট। তাকবীর তপ্ত শ্বাস ফেলে এলিজাবেথের সামনে এসে হাঁটু ভেঙে বসল। পকেট থেকে রুমাল বের করে বাড়িয়ে দিল এলিজাবেথের দিকে।

“এলোকেশী তুমি এখনও তাদের দেওয়া কষ্ট বহন করে চোখের পানি ফেলছ যারা তোমাকে মূল্য দেয় না। নিজেকে কষ্ট দিও না তোমার চোখের জল গুলো বাঁচিয়ে রাখো। তুমি আমার কাছে অমূল্য কারোর ব্যবহৃত পুতুল নও। শক্ত থাকো—আমার জন্য।”
‘এলিজাবেথের কানে আদৌতেও কোনো কথা পৌঁছায় না। বিষন্ন অনুভূতির মিলনে চুপসে যাওয়া অকুতোভয়ী হৃদিন্ড হৃদয় এখনো চেয়ে আছে শূন্য দরজার পানে।

‘কিছু কিছু মানুষ আমাদের জীবনে অদ্ভুতভাবে মূল্যবান হয়ে ওঠে। যাদের কষ্ট আমাদের ভিতরটা টুকরো টুকরো করে দেয়। আবার তাদের কর্মকাণ্ড বুকের ভিতর একরাশ অভিমান সৃষ্টি করে। যেমন এই দুনিয়ায় ফাদার ই ছিল একমাত্র ব্যক্তি যাকে গ্যাংস্টার রিচার্ড কায়নাত সম্মান করত, যাকে মানত। সেই ফাদার ই ছিল রিচার্ড কায়নাতের জন্য ভাগ্য পরিবর্তনকারী। যে ছোট এক রেদোয়ান থেকে ইতালির সবচেয়ে বড় গ্যাংস্টারে পরিণত করেছে রিচার্ডকে। সেই ফাদারের মৃত্যুর পরও রিচার্ড শেষ দেখা পর্যন্ত দেখতে গেল না। কারণ,ফাদারই ছিল একমাত্র কালপিট যে এলিজাবেথ’কে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এমনকি যে হামলা তাকবীরের ওপর ইতালির হসপিটালে করা হয়েছিল তা আর কেউ না ফাদার নিজেই করিয়েছিল। আর কিছুন আগে বাগানবাড়িতে এলিজাবেথ’কে মারার জন্য যারা এসেছিল তারাও ফাদারের ই লোক ছিল।

‘এসব কিছু শুরু থেকেই জানত রিচার্ড। আর সেই থেকেই ফাদার আর রিচার্ডের মধ্যে দূরত্ব বাড়তে থাকে। তবে ফাদার জানত না যে রিচার্ড সত্যিটা জানত। ফাদার এবং তাকবীরের মধ্যে পূর্ব পরিচয় ছিল। তবে তাদের সম্পর্কের প্রকৃতি বা তাদের মধ্যে কি সংযোগ ছিল সেটা রিচার্ড এখনও বুঝে উঠতে পারেনি। রহস্যটি ওর মনে এক অসমাপ্ত প্রশ্ন হয়ে রয়ে গিয়েছিল। যার উত্তর জানার জন্য রিচার্ড গভীরভাবে অনুসন্ধান করছিল। তবে তার আগেই ঘটে গেল এক অপ্রত্যাশিত, রহস্যময় ঘটনা। তবুও গ্যাংস্টার বস দমে যায় না। সে তার কাজ থেকে এক মুহূর্তের জন্যও পিছপা হয়নি, অভিমানের বাঁধও ভাঙতে দেয়নি। কারণ, মানুষটা এতোটাই কঠোর, এতোটাই অটল যে তার রাগ আর ক্ষোভের সামনে কারোর টিকে থাকা সম্ভব নয়। রিচার্ডের অন্তরের গহীনে যেই দুর্বোধ্য শক্তি রয়েছে তা ওকে কখনও পিছিয়ে যেতে দেয় না।

‘এক চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটল। বাংলাদেশের সোয়াট টিমে জয়েন করতে পাঁচ জন আমেরিকান এজেন্ট। তাদের বিশেষভাবে আনা হয়েছে একটি গোপন কেসের জন্য। কিন্তু সংবাদ মাধ্যমে এই তথ্য এখনও প্রকাশ করা হয়নি। তাদের রিসিভ করার জন্য প্রেম নিজেই এয়ারপোর্টে উপস্থিত হয়। উপর মহলের নির্দেশে প্রেমকেও সোয়াট টিমে ট্রান্সফার করা হয়। প্রেমের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিল তার সহকর্মী মাহাব।
‘শীতের মৌসুমের রোদ যেমন মজার, তেমনি তাপও বেশ তীব্র। রোদের নিচে দাঁড়িয়ে থেকে প্রেমের ফর্সা অবয়ব ইতিমধ্যে লালচে বর্ণ ধারণ করেছে। চোখে-মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট। প্রেম পাতলা হলেও লম্বায় বেশ। শরীরের মাংসে একটু কিপনতা থাকলেও তা গড়নকে একেবারে খাটো করে না। টি-শার্টের উপর পরা লেদারের জ্যাকেট’টা বাতাসে উড়ছে, সঙ্গে চুলগুলোও বাতাসে খেলে যাচ্ছে। সাধারণত পুলিশ অফিসারদের অন ডিউটি অবস্থায় রিপ্ট জিন্স বা স্কিনি প্যান্ট পরা নিষেধ। তবে অবাধ্য প্রেম স্বাচ্ছন্দ্যে সব নিয়ম ভেঙে যাচ্ছে। ফরমাল প্যান্টের বদলে জিন্স পরেছে, আর পায়ে ব্ল্যাক সো। সব মিলিয়ে দেখতে ভালোই লাগছে যদিও অভিব্যক্তিতে তিক্ততা ছাড়া কিছুই নেই।
‘হঠাৎ করেই প্রেমের কপালের সমস্ত বিরক্তির ছাপ মিলিয়ে গেল। চোয়াল ফাঁক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চোখে মুগ্ধতার ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠল। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে ফেলল প্রেম চোখের মুগ্ধতা আরও বাড়ানোর জন্য। নিস্প্রভ ও দ্বিধাহীন নজরে চেয়ে থাকল এয়ারপোর্টের ভিতর থেকে লাগেজ হাতে এগিয়ে আসা মেয়েটির দিকে। কাকতালীয়ভাবে মেয়েটির ড্রেসআপ সম্পূর্ণভাবে প্রেমের সঙ্গে মিলে গিয়েছে। শুধু মেয়েটির চুল কাঁধ পর্যন্ত আর ব্রাউন কালার করা। প্রেম ঠোঁট কামড়ে হেসে এগিয়ে গেল মেয়েটির দিকে।

“হেই লেডি।”
‘তিরিক্ষি মেজাজে পিছন ফিরল লাড়া। সানগ্লাসের ফাঁক দিয়ে এক নজরে প্রেমের পা থেমে মাথা পর্যন্ত দেখে নিল। পরপর গমগমে ব্যস্ত গলায় বলল,”হোয়াট?”
“নাথিং জাস্ট ইউ।”
‘প্রেম বাঁকা হাসি ঠৌঁটের কোণে ঝুলিয়ে লাড়ার সামনে এসে দাঁড়াল। শক্ত হলো লাড়ার চিবুক। প্রেমের চোখে চোখ রেখে বলল দাঁতে দাঁত চেপে বলে,”আর ইউ ইনসেন?”
‘প্রেমে অবাক হওয়ার ভঙ্গি ধরে দুপাশে মাথা নাড়লো ঘন।
“রাস্তা ছাড়ুন! যত্তসব।”
‘প্রেম তো সামনে থেকে সরে না উল্টে প্রশ্ন ছুড়ল,”আপনার নামটা যেন কি মিস?”
‘লাড়া অতিরিক্ত কথা বাড়াতে চাইলো না। প্যান্টের পকেট থেকে ফোন বের করে গাড়ির জন্য কাউকে কল দিতে দিতে ব্যস্ত গলায় বলল,”লাড়া! লাড়া স্ট্রোন।”

‘ভ্রু উঁচিয়ে ঠৌঁট কামড়ে হাসল প্রেম। এক গাল হেসে মনে মনে বিরবির করে আওড়াল, “উপসস! লাড়া জান্স।”
‘তবে লাড়া ছিল আরো বেশি তীক্ষ্ণ,চতুর। প্রেমের বাক্য কর্নপাত হয়ে গেল লাড়ার। ফোন পকেটে রেখে লাড়া সরাসরি দৃষ্টি নিক্ষেপ করল প্রেমের মুখাবয়বে। প্রশ্ন ছুড়ল, “ইউর নেইম?”
“প্রেম! প্রেম আহসান।”
“নামের মতোই চরিত্র।” ~চাপা স্বরে বলে লাড়া লাগেজ নিয়ে সামনে হাঁটা ধরল। প্রেম অবাক হয়ে পিছন থেকে গলা উঁচিয়ে ডেকে উঠল,”আরে ম্যাম আর কয়েকটা লাইন তো বলে যান। কোথায় যাচ্ছেন?”
‘লাড়া সামনে এগিয়ে যেতে যেতে গলা উঁচালো,”আপনার নামে থানায় কমপ্লেন করতে।”
‘প্রেমে মাথার পিছনে হাত দিয়ে ঠৌঁট কামড়ে হাসল। পরপর উচ্চশব্দে ফেলল। “ঠিক আছে! আমি থানায় পৌঁছে দিয়ে আসছি।”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৩০ (২)

‘প্রেম সঙ্গে সঙ্গে ওর পকেট থেকে জিপের চাবিটা মাহাবের দিকে ছুঁড়ে মারল। মাহাব অবাক হলো বটে, তবে মিস হলো না। চাবিটা হাতে নিয়ে প্রেমের দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালে প্রেমে চোখে টিপে লাড়ার পিছু দৌঁড় দিল। তাজ্জব বুনে সেখানেই ঠাঁই হয়ে দাঁড়িয়ে রইল মাহাব।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৩২