ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৩৮
মিথুবুড়ি
“এলি জান।”
“উমহু।”
“বাবু উঠো তো।”
‘এলিজাবেথ উল্টো ওপাশ হয়ে আরো বেশি করে বালিশের ভিতর মুখ গুঁজে দিল। খুবই আড়ম্বরে ঘুমাচ্ছে সে৷ রিচার্ড ওর কাঁধের আলগোছে হাত রেখে আলতো করে ঝাঁকি দিয়ে নরম গলায় আবারও ডাকল,
“এই এলি জান, হানি উঠো না৷”
‘এলিজাবেথ মোচড়ামুচড়ি করতে করতে ঘুম জড়ানো স্বরে বলল,”আর একটু।”
“ম্যাডাম আপনি কি আমাকে ব্লক দিয়েছেন?”
‘বলে রির্চাড এবার শক্ত করে চাপ দিল এলিজাবেথের কাঁধে। সহসাই স্তম্ভিত ফিরল এলিজাবেথ। পিটপিট করে চোখে মেলে বাচ্চাসুলভ মাথা নাড়িয়ে বলল,”নাহ তো।”
‘রিচার্ডের নিদারুণ কোমল স্বর,”একটু ভেবে বলুন না।”
“দিইনি তো। সত্যি।”
“ঠাসসসসস_______ ‘চাপার মধ্যে মস্ত বড় একটা থাবা পড়ল। কক্ষ কাঁপিয়ে হুংকার তুলল রিচার্ড,”উঠে দেখ।”
‘দরদরিয়ে ঘুম থেকে উঠে বসলো এলিজাবেথ। সারা শরীর তিরতির করে কাঁপছে। হৃদপিন্ড যেন আর একটু দেরিতে ঘুম ভাঙলেই ব্লাস্ট হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়তো। স্বপ্ন ছিল এটা। এলিজাবেথ হাঁপাতে হাঁপাতে বেডসাইড টেবিল থেকে পানির গ্লাস নিয়ে ঢকঢক করে পুরো গ্লাস খালি করে দিল।
‘তখন রিচার্ড’কে ব্লক দেওয়ার পর থেকেই এলিজাবেথের সাথে এমন অভূতপূর্ব আর অতীন্দ্রিয় ঘটনা ঘটছে। শ্বাস ফেলতে গেলেও মনে হচ্ছে রিচার্ড কণ্ঠনালীর ছিদ্রে চেয়ার পেতে বসে আছে। শ্বাস নিতেও দিচ্ছে না, বের হতেও দিচ্ছে না। এইতো ঘুমানোর আগেও বাথরুমে যাওয়ার সময় মনে হয়েছিল এই বুঝি রিচার্ড কমোডের ভিতর থেকে বেরিয়ে এলো হাতে ধারালো তীরের ফলা নিয়ে। ফলাটা একদম ডিরেক্ট গলায় বসিয়ে দিল এটা বলে,”শালি ভাতারি! তোর সাহস হলো কিভাবে রিচার্ড কায়নাত কে ব্লক দেওয়ার?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘তখন এক বুক সাহস সঞ্চয় করে বুকে এক প্যাকেট বরফ ঢেলে এলিজাবেথ প্রকৃতির ডাকে সারা দিয়ে আসতে পারলেও বের হয়ে পড়েছিল মহাবিপদে। জনাব আক্তার উদ্দিন এক্তিয়ার রিচার্ড কায়নাত তার খাটের উপর খুবই আয়েশী ভঙ্গিতে বসে ছিল। ঠৌঁট জুড়ে ছিল প্রসারিত শয়তানি হাসি। এলিজাবেথ হতবিহ্বল। শরীরে কাঁপন ধরানো তান্ডব বসে ছিল তার সামনে। শ্বাসরুদ্ধকর আতঙ্কে শরীরে রক্ত জমে আসে তার৷ রিচার্ডের চোখে ছিল ফুঁসে ওঠা অগ্নিগর্ভ। অগ্নিমুখর দৃষ্টিতে তাকাল এলিজাবেথের দিকে৷ আকস্মিক অধর এক কোণ এলিয়ে রিচার্ড পকেট থেকে ওর ছোট শট গান’টা বের করল। অতঃপর সরাসরি তাক করল এলিজাবেথের কপাল বরাবর। কাচলে ঠৌঁট নাড়িয়ে গর্জনমুখর চিৎকার করে উচ্চারণ করল,”আমার ব্লক দেওয়ার শাস্তি তোর মন্ডু পাবে শালি বান্দী।”
“ঠাসসসসসসসস,,,’এলিজাবেথ ধাতব মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল। কপালে গোল ছিদ্র। সরু ছিদ্র থেকে অতিবাহিত হচ্ছে তাজা লাল উষ্ণ তরল।
‘তেমনি রিচার্ডকে ব্লক দেওয়ার খানিকক্ষণ পরেই এলিজাবেথের সাথে ঘটল এক অসীম বিষ্ময়কর কান্ড। এলিজাবেথের শরীর এখন আগের থেকে সুস্থ। হাঁটাচলা করতে পারে স্বাভাবিক ভাবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে চুল আঁচড়াচ্ছিল এলিজাবেথ। অকস্মাৎ অশুভ উপস্থিতির মতো করে রিচার্ডের প্রচন্ড প্রতিশোধস্পৃহারক্তিম চোখ ফুটে উঠল আয়নায়। ভয়ে শিরদাঁড়া সোজা হয়ে গিয়েছিল এলিজাবেথের। হঠাৎ করে তির্যক বেগে আগুনে দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা একটা হাত আয়নার ভিতর থেকে বেরিয়ে গলা চেপে ধরল এলিজাবেথের। চোখের সামনের অদৃশ্য এক মরীচিকাময় দুঃস্বপ্ন থেকে তখন এলিজাবেথের বের হতে বেশখানিকটা সময় লেগেছিল।
‘এলিজাবেথ ঠৌঁট গোল করে ঘন ঘন নিশ্বাস ফেলে নিজেকে ধাতস্থ করল। আলো নিভিয়ে বুকে ফুঁ দিয়ে আবারও শুয়ে পড়ল। ঔষধের জন্য ইদানীং চোখে একটু বেশি ঘুম’ই। অল্প সময়ের মধ্যে ঘুমিয়েও পড়ল। তখন রাত্রির অন্তিম প্রহর চলমান। হঠাৎ এলিজাবেথের ফোন ভেজে উঠল। এলিজাবেথ ঘুমের মধ্যেই হাতড়ে বালিশের নিচ থেকে ফোন নিয়ে কানে ধরল। ওপাশ থেকে ভেসে এলো একজন প্রেমিক পুরুষের দরদী কণ্ঠস্বর। যেন সে আর প্রিয়তমার রাগ ভাঙানোর জন্য এতো রাতবিরেতে কল দিয়েছে।
“ম্যাডাম মেজাজ কি ঠান্ডা হয়েছে? প্রেম করা যাবে একটুখানি?”
‘এলিজাবেথ ঘুমের ঘোরে কাইকুঁই করে রিনরিনে আওয়াজে বলল,”মানে?”
“ঐ-যে দিনে রাগ করে ব্লক করে দিলে।”
‘ঘুমের মধ্যেই মস্তিষ্কে খুব চাপ অনুভূত করল এলিজাবেথ। শরীরের জমে থাকা স্নায়ু টান টান হয়ে গেল। এলিজাবেথ তড়িঘড়ি করে উঠে বসল। পরপর বার বার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে নিল নাম্বারটা। এটা তো রিচার্ডের নাম্বার না। তবে কি রিচার্ড অন্য কারোর নাম্বারে কল দিয়েছে, না সিম চেঞ্জ করেছে? তাও আবার এলিজাবেথের জন্য,,? যেই রিচার্ড কায়নাত নিজের মর্জি মাফিক পরিবেশ তৈরি করে, এবার সেই পরিবেশে অন্য কেউ দম আঁটকে মারা গেলে, যাক।
‘এলিজাবেথ এটা মুখে প্রকাশ করুক আর না করুন, সে এই পৃথিবীতে সবথেকে বেশি ভয় রিচার্ড’কে পায়। আর পাবে-ই না কেন! রিচার্ডের হিংস্রতা সম্পর্কে সে খুব ভালো করে অবগত। খুব কাছ থেকে দেখেছে নিজে; একে তো ব্লক দেওয়ার পর থেকে ভয়ে তটস্থ, তারউপর হয়ে যাচ্ছে যতো সব আজব কান্ড। তাই এই মুহুর্তে এলিজাবেথ আর ত্যাঁড়ামি করল না। উদ্বিগ্নতায় ঠাঁসা গলায় বলল,
“আপনি ঘুমাননি এখনো?”
‘ওপাশ থেকে তাৎক্ষণিক উত্তেজিত স্বর ভেসে এলো,”ঘুম! এখনই? না না না! রাত এখনও বাকি, প্রেম রাতের-ই পাখি।”
‘ভরকে গেল এলিজাবেথ এহেন স্বরে। কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওপাশ থেকে এবার এলো ভারি গভীর স্বর,
“বাইদ্যওয়ে, তোমার নামটা যেন কি?”
‘ঘাবড়ে যায় এলিজাবেথ। শুকনো ঢোক গিলে খাদযুক্ত কণ্ঠে বলল,”কে-কেন?”
‘ওপাশ থেকে সেই গভীর স্বর,”বিকজ আই ওয়ান্ট টু নো হু আই অ্যাম লুকিং অ্যাট নাও।”
‘কেঁপে উঠল এলিজাবেথের ভিতর। নিয়ন আলোতে মেঝেতে ফুটে উঠল লম্বা একটা মানব ছায়া। এলিজাবেথ ভীত-সন্ত্রস্ত হুদস্পন্দনে গ্রীবা পিছনে বাঁকাতেই শিউরে উঠল সর্বাঙ্গ। অন্ধকারে আবছায় একজন দাঁড়িয়ে আছে একদম খাট ঘেঁষে। এলিজাবেথ চিৎকার করতে যাবে তার আগেই ছায়া শিকারী ঝাপিয়ে পড়ল এলিজাবেথের উপর। অতর্কিত আক্রমণে হচকিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ল একদম। মানব ছায়ার শক্ত শরীরটাও উপুড় হয়ে পড়ল ওর উপর। হালকা আলোতে উদীয়মান হলো রিচার্ডের আকাশের নীল ছায়া মাখা চোখ। চোয়ালে আজ অন্যরকম ভাবসাব। এলিজাবেথ নড়েচড়ে উঠার আগেই রিচার্ড ওর হাত নিজের শক্ত হাতের আয়ত্তে নিয়ে মাথার উপর বিছানার সাথে চেপে ধরল। কোনোরকম হুশিয়ারী ছাড়াই মুখ ডুবিয়ে দিল ওর গ্রীবাদেশে।
‘জ্বলে যাচ্ছে ওষ্ঠ ছুঁয়ে যাওয়া জায়গা গুলোতে। এলিজাবেথের নিশ্বাস আঁটকে আসে। ভয়াল নিস্তব্ধতা নেমে আসে ঘন জঙ্গলের মাঝে নির্মিত ফার্মহাইজে। রিচার্ডের অন্তরঙ্গ অভ্যস্তরীণ ঘন শ্বাস গুলো আঁচড়ে পড়ছে এলিজাবেথের গ্রীবাদেশে। দু’টো বৃক্ষপট লেপ্টে আছে একসাথে অন্তরঙ্গ ভাবে। ওরা হৃদয়ের ভিতরের তীব্র সংযোগ শুনতে পাচ্ছে একে-অপরের। রিচার্ডের শীরা বয়ে আসা ভালোবাসার চিহ্ন একে একে একেঁ দিচ্ছে ঘাড়ের পাশ্ববর্তী জায়গাগুলেতে ছোট ছোট বিষাক্ত চুম্বনে। এলিজাবেথের গলার মধ্যে আঁটকে আসে ব্যাথাময় আতর্নাদ।
‘প্রতিটি স্পর্শে-ই শিরশির করে উঠছে পায়ের তলানিতে। তবুও পা নড়ানোর সাধ্যি অবধি নেই। রিচার্ড নিজের পা দিয়ে শক্ত করে পেঁচিয়ে রেখেছে ওর পা দু’টো। শরীরে জুড়ে তরঙ্গ খেলে যেতে থাকে বিষ মাখা ছোঁয়া গুলোতে। মনভর্তি প্রেমের ফুল নিবেদনের পরিবর্তে রিচার্ড যেন বিষ ঢেলে দিচ্ছে অযাচিত ক্ষুব্ধতায়। শরীর কেঁপে উঠা আর থমকে যাওয়ার রীতিনীতিতে এবার এলিজাবেথ না পেরে মাথা দিয়ে আঘাত করল রিচার্ডের কপালে। মুখ তুলল রিচার্ড। ওর চোখে ভয়ংকর দৃষ্টি, অস্থির মস্তিষ্ক। এলিজাবেথের চোখে নীরব আতঙ্ক। রিচার্ডের শরীরের ভারে ওর ছটফটে নিশ্বাস গুলো বাইরে বের হতে পারছিল না। অকস্মাৎ প্রাণভয়ে আটকে যাওয়া আতঙ্ক বেরিয়ে গেল রিচার্ডের ধরাশায়ী আক্রমণে, আর্তনাদ রূপে। রিচার্ড সজোরে কামড় বসাল এলিজাবেথের নাকের ডগায়। দন্ত বিঁধে দু’ফোঁটা রক্ত বেরিয়ে এলো নরম চামড়া ভেদ করে।
‘নীল চোখে তার মৃত্যুঞ্জয়ী সংকল্প। ক্রোধে মটমট করছে পুরুষালি রুক্ষ চোয়াল। এলিজাবেথের কার্নিশ কোণ ভেয়ে নেমে গেল শীতল আত্মব্যথা৷ অন্তর্হিত কান্না ভেজা চোখে চেয়ে আছে রিচার্ডের চোখে। রক্তহিম বিভীষিকাময় অন্তস্থলে নরকযন্ত্রণার আতর্নাদ৷ খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে রিচার্ড তাকে শুধুমাত্র কষ্ট দিতেই এসেছে। অভিমানী নিরবতা স্তব্ধ করে দিল ওর দূর্বোধ্য মনকে৷ রিচার্ডের পৈশাচিক আত্ম জুড়ে তরতর করে বেড়ে ওঠা ক্ষুব্ধতা আর হিংস্রতা তলিয়ে যায় বৃক্ষপটে লেগে থাকা বহমান মন্থর শিথিলতায়। হঠাৎই দৃষ্টিভঙ্গি বদলে গেল অক্ষিপটের। মোহমগ্ন দৃষ্টিতে এলিজাবেথের ভেঙে আসে ওষ্ঠের দিকে এগিয়ে যেতে নিলে মুখ ঘুরিয়ে নেয় এলিজাবেথ।
‘বিষন্ন আত্মনিঃসঙ্গতায় ফ্যাসফ্যাসে আওয়াজে আওড়ালো,”কি করতে চাইছেন আপনি?”
‘রিচার্ডের কণ্ঠে নেই রক্তাক্ত সংগ্রাম। ঠৌঁটের কোণে চিলতে হাসি। ছেড়ে দিল মুষ্টিবদ্ধ করে রাখা হাতজোড়া। অতঃপর ওর নরম-সরম হাত দু’টো নিয়ে আলগোছে পেঁচিয়ে দিল নিজের পিঠ। তবে তা সঙ্গে সঙ্গেই আলগা হয়ে গেল। তবুও নির্বিঘ্ন রিচার্ড। ওর শরীরের প্রতিটি অন্ডকোষের সাথে মিশে থাকা আড়ষ্ট মেয়েটার দিকে বিভোর দৃষ্টি চেয়ে বিমোহিত স্বরে বলল,
“ওটাই; যেটা করলে তুমি আমাতে বিলীন হবে।”
‘এলিজাবেথের কণ্ঠ শক্ত কাঠকাঠ হয়ে উঠল। জোরসে ধাক্কা দিয়ে সরাতে চাইলো রিচার্ডকে ওর বাহু থেকে। চেঁচিয়ে বলে উঠল,”আমি চাই না আপনার মাঝে বিলীন হতে। ঘৃণা করি আমি আপনাকে,শুধু ঘৃণা।”
‘রিচার্ডের একই স্বরের বিলম্বহীন জবাব,”সমস্ত ঘৃণা মুছে দিবো ভালোবাসায়।”
‘চকিতে রিচার্ডের দিকে ঘুরল এলিজাবেথ।স্ফটিক অগ্নির মতোন ক্রোধে হুট করে নেমে আসলো বর্ষণ। অস্পষ্ট স্বরে আওড়ালো,”ভালোবাসা?”
‘পুরোপুরি এড়িয়ে গেল রিচার্ড। এলিজাবেথের নাকের ডগায় নাক ঘষতে ঘষতে গাঢ় স্বরে হিসহিসিয়ে বলল,
“এখন আমি তোমার এতটাই কাছে আসব যে কাল সকাল অবধি তোমার ঠোঁট শুধু আমার নামই জানবে।”
“নাহহহহহহহ,,,,,,,, আবারও এলিজাবেথ দরদরিয়ে ঘুম থেকে উঠল। স্বপ্নটা এতটাই ভয়ংকর ছিল যে তার নিশ্বাস থমকে আছে। বুক চেপে ধরে জোরে জোরে শ্বাস নিতে চেষ্টা করল। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। পানি খেতে গিয়ে দেখে জগে এক ফোঁটা পানিও নেই। হতাশায় ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলল। এলিজাবেথ জগটা হাতে নিয়ে ধীরে ধীরে সিঁড়ির দিকে এগোল। ড্রিম লাইটের মৃদু আলোয় পা ফেলে সাবধানে নেমে এলো নিচে। কিচেনে গিয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে জগটা পূর্ণ করল। ঠিক পিছন ফিরে হাঁটা দিতেই আলোটা হঠাৎ নিভে গেল। অন্ধকার চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ঠান্ডা শিহরণ বয়ে গেল শরীরে। দূরের জঙ্গল থেকে ঝিঁঝি পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। ঘুটঘুটে অন্ধকারে জঙ্গলের ওপর এক ফোঁটা চাঁদের আলোও পড়েনি। এলিজাবেথ স্থির দাঁড়িয়ে রইল, গা ছমছমে অনুভূতিতে হারিয়ে যাচ্ছে।
‘আকষ্মিক তীর সূচক ধারালো কিছু এলিজাবেথের গলার পাশ ঘেঁষে গিয়ে বিঁধল দেয়ালে। হতবিহ্বল হয়ে যায় এলিজাবেথ। ভয়ে হাত-পা কাঁপতে থাকে। হঠাৎ অনুভূত হলো কেউ তার পাশ দিয়ে গোল করে হাঁটছে। সামনের কোনো কিছুই দেখতে পাচ্ছে না এলিজাবেথ। অন্তরের গভীরে আতঙ্ক ধ্বনিত হতে থাকে৷ এরিমধ্য আরেকটা সুচারু তীর এলিজাবেথ ঘাড়ের অপর পাশ ঘেঁষে গেল। তবে এবার রক্তপাত ঘটিয়ে গেল। ব্যাখায় ঘাড় চেপে ধরল এলিজাবেথ। এমন করে কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে তীরটা এলিজাবেথের খুব কাছ দিয়ে যাওয়া আসা করতে থাকে।।
‘এলিজাবেথ এক জায়গায় থমকে দাঁড়াল। সজাগ দৃষ্টি, নিখুঁত মনোযোগ। শরীর স্তব্ধ হলেও মস্তিষ্কে বিপদের ঘণ্টা বাজছে, প্রতিটি স্নায়ুতে সতর্কতার ঝড়। সেই অদৃশ্য পদচারণার শব্দ দূর থেকে ঘনীভূত হচ্ছে, আর সেই সুচারু সুইচটা বারবার ওর কাঁধের পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে যেন শিকারীর সামনে বেপরোয়া শিকারের দৌড়। মুহূর্তে সর্তক মন সমাধান খুঁজল।
বোধ কাজ করল। সময় আর ছন্দ মিলিয়ে নিখুঁত ফোকাসে এলিজাবেথ সুইচের পরবর্তী গতিপথ আন্দাজ করল। অতঃপর তীব্র গতিতে হাত ছুঁড়ে সুইচটাকে খপ করে আঁকড়ে ধরল এলিজাবেথ। ধাতব ঠান্ডা ছোঁয়া হাতের মুঠোয় জমাট বাঁধল। চারপাশে নেমে এলো নিস্তব্ধতার শ্বাসরুদ্ধকর পর্দা।
‘ভয়াল নিস্তব্ধতা ভেঙে করতালির ভারি শব্দ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ল। বিষাদমাখা কাঁপনে এলিজাবেথের শরীর শিউরে উঠে। ঠিক তখনই সাইরেনের হুংকারের মতো কেউ অন্ধকার চিরে ছুটে এসে ঝটকা মেরে দেয়ালের সাথে চেপে ধরল এলিজাবেথকে। শ্বাস আটকে এলো, হৃদপিণ্ড মুষ্টিবদ্ধ কণ্ঠের মতো ধুকপুক করতে লাগল। অদৃশ্য শিকারীর ছোবলে অসহায় ক্রন্দনের মতো কেঁদে উঠল এলিজাবেথ। হিমশীতল বাতাসে ভেসে এলো এক অদ্ভুত ঠান্ডা স্বর,
“গুড জব! এভাবেই নিজেকে গড়ো। হৃদয় নয়, মস্তিষ্ক দিয়ে কাজ করো সবসময়।”
‘অতঃপর হিমশীতল কিছু ছুঁলো এলিজাবেথের গ্রীবায়। ছোট্ট ক্ষতস্থানে শীতল স্পর্শে রক্তের ছাপ তীব্র লেহনে শুষে নিল কেউ। সঙ্গে সঙ্গে আঁধারে বিলীন হয়ে গেল সে। আলো হঠাৎ ঝলসে উঠল। চারপাশে শূন্যতা ছাড়া আর কিছু নেই। এলিজাবেথের চোখে আতঙ্কের ছাপ গভীর হয়ে ফুটে উঠে। শরীর থরথর করে কাঁপছে। চোখবুঁজে উপরের দিকে ছুটে গিয়ে সজোরে দরজা বন্ধ করে দিল। নিস্তব্ধতাকে টেনে নিয়ে নিজের সত্তার প্রতিধ্বনিতে আরও জোরে শ্বাস ফেলতে থাকে। তবুও কাঁপুনি থামে না শরীরের।
‘আলো আজ যেন ফার্মহাউজের প্রতিটি কোণে নিজের উপস্থিতি জাহির করছে। সাধারণত এমন তমসাচ্ছন্ন জায়গায় সূর্যের কিরণ ঢোকার সুযোগ পায় না তেমন । শেষ প্রহরে চোখের জলে ভিজে ঘুমিয়ে পড়েছিল এলিজাবেথ। এখন সূর্যের তীক্ষ্ণ আলো সরাসরি চোখে এসে পড়ায় মুখ কুঁচকে পিটপিট করে চোখ খুলল এলিজাবেথ। অস্পষ্ট দৃষ্টিতে ভেসে উঠল লম্বা গাছ আর সবুজে মোড়া বিস্তীর্ণ প্রান্তর। হঠাৎ হাতে কিছু একটা প্রচণ্ড কামড় বসাল। দু’টো তীক্ষ্ণ সুইচের মতো যন্ত্রণা ফুটে উঠল। ব্যথায় কুঁকড়ে উঠে বসল এলিজাবেথ। একটা বিশাল বিষ পিঁপড়া তখনও হাত কামড়ে ধরে আছে। দ্রুত সেটাকে মাটিতে ফেলে দিল এলিজাবেথ।
‘আকস্মিক কর্কশ গর্জনে বাতাসে প্রতিধ্বনি তুলল ভয়ংকর প্রাণীদের অশুভ আহ্বান। হচকিয়ে উঠে চারপাশ চোখ বুলালো এলিজাবেথ। চোখ বিস্ময় আর আতঙ্কে কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসার উপক্রম। গর্জনের উৎস বুঝতে চাইলেও সব যেন এক বিভ্রমের মতো ঘোলাটে থেকে গেল। এই মুহুর্তে এলিজাবেথ রয়েছে ঘন সবুজের মাঝখানে। একদম জঙ্গলের মাঝপ্রান্তে। চারপাশে শুধু অসংখ্য গাছের দেয়াল। সূর্যের আলো পাতার ছায়ায় ছিন্নভিন্ন হয়ে মাটিতে পড়ছে।
‘ঘন জঙ্গলের মাঝে একটা পালঙ্কের উপর একাকী বিভ্রান্ত হয়ে বসে আছে এলিজাবেথ। বিস্ফোরিত চোখে চারপাশের দৃশ্য দেখে গিলে নিচ্ছে শুষ্ক ঢোক। সে-ই এখানে কীভাবে? মনের কোণে ভয়ের কাঁপুনি ছড়িয়ে পড়ছে। ঠৌঁট ভেঙে এলিজাবেথের শ্বাস ভারী হয়ে এলো। বালিশের কাছে হাত যেতেই খচখচে শব্দে হলো। চকিতে তাকিয়ে দেখল একটা ভাঁজ করা চিরকুট। তাতে লেখা,
“তো এলি জান! জঙ্গলেই আজ মঙ্গল করা যাক? চলো বেডশিট টা রঙিন করি। আফটার অল লাল রং আমার খুবই প্রিয়৷”
‘বুকের ভেতর ধুকপুকানির তাণ্ডব শুরু হলো। আর কিছু বোঝার বাকি রইল না। চিন্তার আগেই শরীর প্রতিক্রিয়া দেখাল। খালি পায়ে প্রাণপণে ছুটতে লাগল এলিজাবেথ। গাছের ফাঁক গলে আলো-ছায়ার নাচনেও মুক্তি নেই। ধ্বংস থেকে পালানোর সেই যুদ্ধে নিঃশ্বাসের শব্দ ই একমাত্র সঙ্গী। মাঝ পথে বহুবার ক্লান্ত হয়ে পা ভেঙে আসলেও থামেনি এলিজাবেথ। পায়ের কিছু কিছু জায়গা থেকে রক্ত ঝড়ছে। ছুটতে ছুটতে রাস্তার দেখা পেল এলিজাবেথ। আশার আলো ছুঁয়ে গেল ওকে। দৌড়ে গেল রাস্তায়। নিঃশ্বাসের তোড় সামলাতে না পেরে মাঝ রাস্তায় হাত উঁচিয়ে গাড়ির জন্য সংকেত দিতে লাগল। ভাগ্যের পরিহাসে এক কালো গাড়ি থামল। দূর্বোধ্য অবস্থাতেও এলিজাবেথ দৌড়ে গাড়ির কাছে গিয়ে দরজা টানল। চালক ডোর আনলক করতেই ছুটে গিয়ে বসে পড়ল ভেতরে। হাঁপাতে হাঁপাতে অনুনয় করল,
“শহরের দিকে নিয়ে যান প্লিজ!”
‘কিন্তু কিছুতেই গাড়ি স্টার্ট হলো না। ইঞ্জিনে কোনো শব্দ নেই। গাড়ি স্থির, সময় আটকে গেছে সেখানে। সন্দেহ দানা বাঁধল এলিজাবেথের মনে। এলিজাবেথ সামনের দিকে তাকিয়ে চালককে পর্যবেক্ষণ করল। আকৃতি কেন যেন খুব পরিচিত ঠেকল ওর। গলা শুকিয়ে এলো আবারও। ধীরে বলল,
“এক্সকিউজ মি…”
‘চালক গ্রীবা বাঁকিয়ে পিছনে ফিরল। ঠোঁটের কোণে বিদঘুটে হাসি ঝুলে আছে। এলিজাবেথ বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে দেখল—রিচার্ড! ওর হৃদয় এক মুহূর্তে ভেঙে গেল। আতঙ্ক আর ধাক্কায় শরীর ভেঙে সিটে ঢলে পড়ল নিস্তেজ হয়ে।
‘মনিটরিং রুমে বসে আছে রিচার্ড। চারপাশের দেয়ালে বিশাল স্ক্রিনের সারি—যেন কোনো বিশাল টিভি শোরুম। কম্পিউটার আর ইলেকট্রনিক সরঞ্জামে ঘেরা সেই ঘরে তার সামনে চলছে হার্ফহাউজের প্রতিটি কোণার লাইভ সিসিটিভি ফুটেজ। বাথরুম থেকে শুরু করে শোবার ঘর,কোনো স্থানই রিচার্ডের নজর এড়ায় না। তবে এই মুহুর্তে রিচার্ডের চোখ আটকে আছে শুধুই এলিজাবেথের উপর। বিছানায় গুটিয়ে থাকা, বিষণ্ন এক মেয়ের করুণ প্রতিচ্ছবি। সকালের সেই ঘটনার পর থেকে ঘরের ছিটকানি খুলেনি এলিজাবেথ। একদম গুমরে গিয়েছে। একটু পরপর ঠুকরে উঠছে।
কান্নার ভারে শরীর ক্লান্ত,এই মাত্রই দীর্ঘশ্বাসের ভেলায় ভেসে ঘুমিয়েছে।
‘গ্যাংস্টার বস আরামে বসে দেখেছে সেই কান্না এলিজাবেথের কান্না তার জন্য ছিল এক নির্মম তৃপ্তি। তাকে ব্লক করার ‘অপরাধে’ এলিজাবেথকে দেওয়া ভয়ংকর শাস্তি সে উপভোগ করছে, প্রতিটি মুহূর্তে।
‘ হঠাৎ রিচার্ডের দৃষ্টি বদলে গেল। কঠিন চোখে নেমে এলো মলিনতা। বুকের গভীর থেকে অসহনীয় যন্ত্রণা হু হু করে উঠল। আলগোছে হাত রাখল স্ক্রিনের উপর, যেখানে এলিজাবেথ শুয়ে আছে। জমানো অভক্ত অনুভূতিগুলো শব্দ হয়ে বেরিয়ে এল সুরেলা কণ্ঠে,
“আমিও চাই, ছুটে যে যায়।
শুধু কাছে তোমার।
মন দরিয়া ভেসে যায়,
দু’জনে মিলে।
এক আকাশে উড়ে বেড়ায়
মেঘ ছোঁয়া নীলে।”
‘নিজ ডেস্কে বসে আছে তাকওয়া। সামনে অজস্র ফাইল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা। দৃষ্টি ল্যাপটপের স্ক্রিনে কাজের মধ্যে নিঃসন্দেহে মগ্ন। হঠাৎ আসমান এলো, সঙ্গে দু’জন —প্রেম এবং লাড়া। দু’জনের হাতেই হ্যান্ডকাফ। লাড়ার মুখে বিরক্তির ছাপ স্পষ্ট, তবে প্রেমের ঠোঁটে এক প্রসারিত হাসি, যা ওর ডিম্পলকে আরো উজ্জ্বল করে তুলছে। ওরা আজ মেইন রোডে বাইক রেসে নেমেছিল৷ অতিরিক্ত স্পিডে গাড়ি চালানোর জন্য এরিক তাদের আটক করেছে। পরবর্তীতে এরিক ওদের আসমানের হাতে তুলে দিয়ে বীর টেক্সটাইলে চলে গিয়েছে।
‘তাকওয়া গম্ভীর ও বুদ্ধিমতী মেয়ে। নির্দিষ্টভাবে জানে, কোনো ভিত্তিহীন কারণে এখানে ওদের আনা হবে না। চোখে এক পলকও সরলতা নেই, আবারও নিজের কাজে মনোযোগ দিল। আসমান লাড়া আর প্রেমকে আলাদা আলাদা লকআপে রাখে। লাড়াকে লকআপে ঢোকানোর সময় প্রেম শিস বাজিয়ে লাড়ার মনোযোগ আকর্ষণ করে গদগদ কণ্ঠে বলল,
“ডোয়ান্ট ওয়ারি জান্স। কাল সকাল হলেই বেরিয়ে যেতে পারবে। বারে পড়ে থাকার চেয়ে থানার থাকা ঢেড় ভালো।”
‘লাড়ার ঠোঁট টিপে বিশ্রী গালি দিল। প্রেম তার বিপরীতে ঠোঁট কামড়ে হাসল। আসমান গেলো তাকওয়ার পাশে বসতে। তাকওয়া ছিল গম্ভীর, সোজা প্রোফাইল। ও তাকবীরের পাস্ট হিস্ট্রি ঘাঁটছিল। ভেতর থেকে গরম নিশ্বাস বেরিয়ে এলো। আসমানকে লক্ষ্য করে বলল,
“এটা সত্যি ! কষ্ট ছাড়া নষ্ট হই না কেউ।”
‘আসমান কিছু বলার আগে তার ফোন বেজে উঠলে সে বেরিয়ে গেল। প্রেম লকআপের ভেতর থেকে গলা উঁচিয়ে বিটলামি স্বরে বলল,
“খুব মায়া হচ্ছে নাকি? কি ব্যাপার মিস তাকওয়া প্রেমে পড়ে-টড়ে যাচ্ছেন নাকি? আমি তো জানতাম আপনাদের কালচারের মানুষরা শ্যাম বর্ণ পছন্দ করে না।”
‘তাকওয়া একগুঁয়ে দৃষ্টিতে কম্পিউটারের স্ক্রিনে তাকবীরের ছবির দিকে তাকিয়ে আনমনে বলে উঠল,
“শ্যাম বর্ণ পুরুষের চাহনি যে একদম মন গহীনে গিয়ে লাগে।”
‘প্রেম অবাক হয়ে পরপরই নাক ছিটকালো। তারপর বলল,
“ছ্যাৎ! আপনিও প্রেমে ফেঁসে গেলেন। শুনেন মিস, প্রেমে পড়ার চেয়ে গাঞ্জা খাওয়া ঢেড় ভালো। কেন বলছি? শুনেন তবে, আপনার কাছে টাকা না থাকলেও ভিক্ষা করে হলেও আপনি গাঞ্জা কিনে খেতে পারবেন। তবে একবার ব্রাহ্মণ হয়ে চাঁদের প্রেমে পড়লে, শতবছর তৃষ্ণার্ত থাকলেও সেই তৃষ্ণা মিটাতে পারবেন না।”
‘তাকওয়া সশব্দে নিঃশ্বাস ফেলল। কিন্তু কোনো উত্তর দিল না।প্রেম তাকিয়ে ছিল লাড়ার সেলে। লাড়া ইতিমধ্যে শক্ত কাঠের চৌকিতে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আসার আগে গরম পানি খেয়েছে যথেষ্ট পরিমাণ। প্রেমের কণ্ঠস্বর এবার গম্ভীর হয়ে উঠল, বলল,
“এই! আপনাকে তো এখন এই মিশনে রাখা রিস্ক। বলা তো যায় না কখন আবার সব প্রমাণ প্রেমের সাগরে ভাসিয়ে দিলেন।”
‘তাকওয়া চোখ গরম করে প্রেমের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বলল,
“আমি সেই সব অবলা সবলা নারী নই, যে ভালোবেসে নিজের সততা খোয়াব।”
‘প্রেম তাচ্ছিল্যের স্বরে হাসল। কিন্তু হঠাৎ করেই ওর চেহারা মলিন হয়ে গেল। হতাশ স্বরে বলল,
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৩৭
“প্রেমের মরায় আর একটু মরুন। তখন আর এসব সততা-ততটা, পাপ-পূর্ণের বিচার করার ক্ষমতা থাকবে না।”
‘তাকওয়া এক অদ্ভুত অনুভূতিতে বুকের ভিতর চাপ অনুভব করল। নিজের মধ্যে একটা অস্থিরতা ঢুকে গেল। দ্রুত স্ক্রিন থেকে তাকবীরের ছবি সরিয়ে ফেলল। থাকল ই না আর, উঠে বেরিয়ে গেল। তাকে যে এই অনুভূতি থেকে মুক্তি পেতে হবে-ই। লোকটা যে এক অদৃশ্য বোঝা তার পিঠে চাপিয়ে দিচ্ছিল।