ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৬

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৬
মিথুবুড়ি

‘এই প্রথম নতুন ম্যানশনে প্রবেশ করল ন্যাসো ও লুকাস। তীব্র উত্তেজনায় হন্তদন্ত হয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে গেল । দুজনেরই মুখ গম্ভীর। ভ্রুতে গভীর ভাঁজ, চোখে আতঙ্কের শীতল ছায়া। মাস্টার সাইজ বেডরুমের পাশে ছোট একটি রুম। দরজায় অনবরত আঘাত করতে থাকে ওরা। অথচ ভিতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ নেই। চারপাশ নিস্তব্ধ! যেন এক শূন্য মরুভূমির নিঃসঙ্গতা ঘিরে আছে গোটা ঘরটাকে।

‘কাল এলিজাবেথকে দেখে স্বপ্ন সুপারশপে গিয়েছিল রিচার্ড। সেখান থেকে ফিরে এসে গভীর রাতে পরম যত্নে এই ছোট রুমটি সাজিয়েছিল সে, প্রতিটি কোণায় আনন্দের আভা ছড়িয়ে। বহুদিন পর এমন উচ্ছ্বাসে মত্ত হয়ে গলা পর্যন্ত মদ ঢেলে নিয়েছিল রিচার্ড। রাতের চতুর্থ প্রহরে মদের বোতলের ভিড়ে মেঝেতেই ঢলে পড়েছিল সে। দরজায় অবিরাম ধাক্কার শব্দ ধীরে ধীরে ফাটল ধরালো সেই নিস্তব্ধতায়। ভারী মাথাটা ঝিমিয়ে উঠল, চারপাশ ঘোলাটে, চোখের সামনে ঝিরিঝিরি কুয়াশার ছায়া। অস্পষ্ট দৃষ্টিতে হাতড়ে ফোন তুলে নিতেই মুহূর্তে সব তন্দ্রা উধাও। স্ক্রিনে এলিজাবেথের নাম্বার থেকে অসংখ্য মিসড কল। হৃদস্পন্দন মুহূর্তে তীব্র হয়ে উঠল রিচার্ডের। ধড়ফড়িয়ে উঠে দরজা খুলতেই দেখতে পেল ন্যাসো আর লুকাসের আতঙ্কিত চোখ। তাদের দৃষ্টি সংকেত দিচ্ছে,তারা কোনো দুর্যোগের বার্তা নিয়ে এসেছে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘রিচার্ড অস্থিরতা চেপে ধরে কঠিন স্বরে জিজ্ঞেস করল,”কি হয়েছে?”
‘ন্যাসো আর লুকাস আতঙ্কিত চোখে একে অন্যের দিকে চাওয়াচাওয়ি করল। রিচার্ডের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে দেখে ন্যাসো মাথা নিচু করে করে বলল,
“বস, ম্যামের ওপর কাদেরের লোকেরা আক্রমণ করেছে।”
‘বুকের ভেতরটা দপ করে উঠল। এক মুহূর্তের জন্য যেন সময় থমকাল টাইম লাইনের চক্রে। রিচার্ড ছটফটিয়ে উঠল, শ্বাস কষে জানতে চাই,” আমার রেড ঠিক আছ……
‘কথার মাঝেই থমকে গেল রিচার্ড। তার মন তীক্ষ্ণ, হিসাবি। মগজের প্রতিটি কোষে শীতল ঝড় বয়ে গেল। শক্ত করে ঢোক গিলল রিচার্ড। গতি-হীন হৃদস্পন্দন চেপে রেখে কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “আ-আমার বাচ্চা?”
‘কেউ জবাব দিল না। দুজনেই যেন পালাতে চাইছে,অথচ পা টলল না। নৈঃশব্দ্যে স্থির দাঁড়িয়ে রইল নত দৃষ্টি নিবিষ্ট করে।

‘করিডরের সামনে বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছে তাকবীর। চারপাশে নির্বাক নীরবতা অথচ তার ভেতরে চিৎকারের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এলিজাবেথ ভিতরে, অতিরিক্ত রক্তপাতের জন্য কন্ডিশন ভালো না। ভোরের প্রথম আলো ফোটার পর আশপাশের লোকেরা রক্তাক্ত, অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে হসপিটালে নিয়ে আসে এলিজাবেথকে। ইকবাল সাহেবও একই শয্যায়৷ চিকিৎসা চলছে তবে অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাকবীর সবটা শুনেই উন্মাদের মতো ছুটে এসেছিল। বুকের ভেতরটা দাউ দাউ করে জ্বলছে। রেল গাড়ির ইঞ্জিনের মতো কর্কশ অস্থিরতা ছুটে চলেছে শিরা-ধমনী জুড়ে। অথচ বাইরে থেকে নিঃশব্দ, হতবাক।।
‘করিডরের নিস্তব্ধতা ভেঙে কারোর ভারি পায়ের শব্দ প্রতিধ্বনিত হয়। তাকবীর ফাঁকা চোখে সামনে তাকাল। রিচার্ড উন্মাদের মতো দৌড়ে আসছে তার পেছনে লুকাস আর ন্যাসো। কেবিন থেকে কিছুদূর থাকতেই দরজার ওপরে জ্বলতে থাকা লাল আলো নিভে গেল। মুহূর্তের জন্য সবকিছু স্থির হয়ে যায়। ভিতর থেকে বেরিয়ে এল সাদা পোশাকের একজন ডাক্তার। রিচার্ড মাঝপথেই থেমে গেল। মুখভঙ্গি একেবারে অচেনা, শীতল। বরাবরের মতোই ভেতরে কি চলছে তা বোঝার উপায় নেই। তাকবীর হুরমুড়িয়ে উঠে ছুটে গেল ডক্টরের কাছে। গলার স্বর ব্যাকুল হয়ে উঠল,

“ডক্টর হাউ ইজ শি অ্যান্ড হার বেবি?”
‘ডাক্তার মুখ থেকে মাস্ক খুলল। গভীর এক শ্বাস নিল তারপর নিচু গলায় বলল, “সরি, হসপিটালে নিয়ে আসার পূর্বেই মিসক্যারেজ হয়ে গেছে।”
‘কিসের যেন এক প্রবল ধাক্কা খেল তাকবীর। দু’কদম পিছিয়ে গেল৷ ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে বাস্তবতার ধাক্কায়। রিচার্ড স্থির। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ডাক্তারের দিকে। ন্যাসো আর লুকাসের মুখে বিষাদের ছায়া তবে রিচার্ড পাথরের মতো স্থির। শুধু নীল চোখজোড়া রক্তিম হয়ে উঠেছে। যন্ত্রণার আগুন সেখানে জ্বলছে, অথচ মুখে একটিও শব্দ নেই। ডাক্তার তাকবীরের দিকে ফিরে প্রশ্ন করল,”ওনার হাসবেন্ড কোথায়?”
‘তাকবীর ধীর চোখে তাকাল রিচার্ডের দিকে। রিচার্ড তখনও নিশ্চুপ। কোনো অনুভূতিই ছুঁতে পারছে না তাকে। পাশ থেকে ন্যাসো নিরবতা ভেঙে বলে উঠল,”হিয়ার ইজ হি।”
‘ডাক্তার এবার রিচার্ডের দিকে ভালো করে তাকাল। গভীর দৃষ্টি বুলিয়ে গেল রিচার্ডের চেহারা আর শারীরিক গঠনজুড়ে। ফাঁকা ঢোক গিলল ডাক্তার,কিছুটা সঙ্কোচে পড়েছে। শান্ত স্বরে বললেন,”ম্যান্টালি প্রিপেয়ার থাকুক। জ্ঞান ফেরার পর আপনার ওয়াইফ অনেক অস্থির হয়ে পড়তে পারে। অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের কারণে শরীর খুবই উইক। জ্ঞান ফিরতে সময় লাগবে। শক্ত থাকুন।”
‘রিচার্ড কোনো প্রতিক্রিয়া দিল না। সেই মুহূর্তে তার ফোনে এক অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ এলো। স্ক্রিনে লেখা,

“সন্তান হারানোর শোক একসাথে পালন করি কেমন?”
‘রিচার্ড মেসেজটি দেখে এক মুহূর্তের জন্য স্থির রইল। অতঃপর নিঃশব্দে ফোনটি পকেটে রেখে দিল। একবার শুধু কেবিনের দিকে তাকাল—সেখানে এলিজাবেথ শায়িত আছে নিঃসাড়, সংজ্ঞাহীন অবস্থায়। একপল চেয়ে জমে থাকা পা চালিয়ে পেছন ফিরে হাঁটতে শুরু করল রিচার্ড। ডাক্তার পিছন থেকে ডেকে উঠল, “একটা ব্যাপার আপনাদের জানানো দরকার।”
‘রিচার্ড থামল কিন্তু ঘুরল না।
‘ডাক্তার গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “আপনাদের দ্রুত একজন কিডনি ডোনার খুঁজতে হবে। আপনার ওয়াইফের এক কিডনিতে টিউমার ধরা পড়েছে। যথাসময়ে অপারেশন না করলে ভবিষ্যতে সমস্যা হতে পারে। যদিও এই অবস্থায় এখনই অপারেশন সম্ভব নয়, কিন্তু খোঁজ শুরু করে দিন। ওনার ব্লাড গ্রুপ খুবই রেয়ার। যখন শরীরিকভাবে সুস্থ হবে, ট্রমা কাটিয়ে উঠবে, তখন অপারেশন করাতে হবে।”
‘রিচার্ড একটুও সাড়া দিল না। এসব কথাও কোনো প্রতিক্রিয়া জাগাতে পারছে না ওর ভিতরে। নিঃশব্দে হাঁটতে শুরু করল আবার। লুকাস আর ন্যাসো বিস্মিত চোখে চেয়ে আছে রিচার্ডের যাওয়ার পানে।

‘সন্ধ্যার নিবিড় আঁধারে জ্ঞান ফিরল এলিজাবেথের। তাকবীর পাশেই ছিল। নিঃশব্দ প্রতীক্ষায়, দুঃস্বপ্নের মত আটকে থাকা কিছু সত্য মেনে নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল সে। ডাক্তারের প্রতিটি বাক্য ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছিল তার বোধ, হৃদয়, আত্মা। ভয়, অপরাধবোধ আর বেদনাবৃত লজ্জায় শ্বাস ভারী হয়ে আসছিল বারংবার। সে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল ভালো রাখার, আজ কী মুখে দাঁড়াবে তার এলোকেশীর সামনে?
‘পিটপিট করে চোখ খুলল এলিজাবেথ। কোমরের নিচে নিঃসীম শূন্যতা। কেমন যেন অনুভূতিহীন, অস্তিত্বহীন। ব্যথার ধাক্কায় শরীর অবশ হয়ে আছে। সিলিংয়ের শীতল সাদার দিকে স্থির চেয়ে থেকে স্যালাইনের নীলাভ তরলে ভিজে থাকা হাতটা কাঁপতে কাঁপতে নামাল পেটের ওপর।আলতোভাবে রাখল তলপেটে। একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস! তারপর ফিসফিস করে ফেটে বেরোল শব্দ,
“ও নেই… তাই না?”
‘তাকবীর নির্বাক। ঠোঁট কাঁপল, অথচ কোনো শব্দ বেরোল না। শুধু শক্ত করে চোখ বুজল। এলিজাবেথও চোখ বন্ধ করল ধীরে। নৈঃশব্দ্যের আড়ালে কার্নিশ বেয়ে গড়িয়ে পড়ল শত্রুর রক্ত। তবু চিবুকের রেখায় একফোঁটা দ্বিধাও নেই।
“ওরা কারা ছিল?”
‘তাকবীরের নিশ্বাস ভারী হয়ে এল।ফোঁস শব্দে ছিঁড়ে গেল নীরবতা,”রিচার্ডের শত্রু। সাউথ ইস্ট কোম্পানির মালিক কাদেরের ছেলেকে খুন করেছিল রিচার্ড।”

“সে এসেছিল ?”
‘তাকবীর সংক্ষিপ্ত জবাব দিল,”এসেছিল, চলে গেছে।”
‘এলিজাবেথের বুকের ভেতর দাউ দাউ করে উঠল আগুন।
“ওনাকে আসতে বলুন! এক্ষুনি বলুন! ওনাকে জবাব দিতে হবে!”
‘তাকবীর স্থির চোখে চেয়ে রইল,”কিসের জবাব?”
‘এলিজাবেথের সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল। হঠাৎ করেই চিৎকার করে উঠল, “ওই লোকটাকে জবাব দিতে হবে! কেন তার পাপের শাস্তি পেল আমার সন্তান?”
“এলোকেশী, শান্ত হও।”
‘কিন্তু শান্তি কোথায়? বুকের ভেতর যে রক্তাক্ত কান্না, সে কি এত সহজে বশ মানে? এলিজাবেথ পাগলের মতো ছটফট করতে লাগল। হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। এক বুক শূন্যতার মধ্যে নিজেকে উন্মূল করে দিতে চলল। হাতের ক্যানুলা ছিঁড়ে ছুঁড়ে ফেলে মেঝেতে। চুইয়ে চুইয়ে নয়, গলগলিয়ে রক্ত গড়িয়ে নামল ওর হাত বেয়ে, বুকে, বিছানায়।
“সে বাধ্য! তাকে জবাব দিতেই হবে! তার পাপের বলি কেন হলো আমার সন্তান!”

‘তাকবীর ছুটে গেল এলিজাবেথের দিকে! রক্তাক্ত হাতটা আঁকড়ে ধরতে চাইল। কিন্তু পারেনি! এলিজাবেথের বেপরোয়া ছটফটানিতে বারবার পিছলে যাচ্ছে সে। এলিজাবেথের কান্না দমকে আসছে। ক্লান্ত পথিক দীর্ঘ পথের শেষে হাঁপিয়ে উঠেছে, তবু থামতে পারছে না। প্রতিটি চিৎকারে তীব্র হয়ে উঠছে ওর অভ্যন্তরীণ যন্ত্রণা! পেটের গভীরে যেন ছুরির আঘাত তবু ও গলা ছেড়ে কাঁদছে।
‘তার সন্তান! কোথায় হারিয়ে গেল সে? যে ছিল তার আলো, তার শেষ অবলম্বন, তার অস্তিত্বের একমাত্র উপাখ্যান—সেই ছোট্ট বুকটা কেড়ে নিল কে? কোন নরপিশাচের লোভ এত অন্ধ হয়ে উঠল? সে ঠোঁট কাঁপতে কাঁপতে আহাজারি করে উঠল,
“আমার ফুলটার প্রতি সবার এত লোভ কেন ছিল? কেন?”
‘তাকবীর আবারও ছুটে গিয়ে এলিজাবেথের রক্তাক্ত হাত আঁকড়ে ধরতে চাইল তবে এবারও পারে না। এলিজাবেথের অস্থির, বিধ্বস্ত ছটফটানি বারবার বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছিল। এলিজাবেথের সকল কান্না হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে আসছে। প্রতিটি চিৎকার শরীর কাঁপিয়ে দিচ্ছে, পেটের গভীরে ব্যথার ঝড় তুলছে তবু এলিজাবেথ থামল না,থামতে পারে না।
“আমি কী নিয়ে বাঁচব?”

‘তাকবীরও কষ্ট পাচ্ছিল, শুধু এলিজাবেথ নয়। বুকের ভেতর অগ্নিকুণ্ড জ্বলছিল তারও। সেই শিশুটির জন্য! ডাক্তারের শেষ কথাগুলো এখনো কানে বাজছিল, প্রতিধ্বনির মতো ধাক্কা দিচ্ছে আত্মায়। কথা আটকে গেলেও তাকবীর বলল,
“এলোকেশী, পাখি আমার প্লিজ শান্ত হও। তোমার শরীর ভালো নেই।”
‘সন্তানহারা মাতার যন্ত্রণার কাছে এই শব্দগুলো ঠুনকো, তুচ্ছ। এলিজাবেথ হিংস্র গর্জনে কাঁপিয়ে তুলল দেয়াল,
“সন্তান হারিয়েছি আমি! এই দুনিয়ার কেউ বুঝবে না আমার কষ্ট! কারো সামর্থ্য নেই বোঝার! সন্তানহারা মায়ের বুকের যন্ত্রণা ভাষায় বাঁধা যায় না!”
“আপনারা শুধু শান্তনা দিতে পারবেন। তবে মায়ের মন থেকে সন্তানের শূন্যতা কখনোই দূর করতে পারবেন না। কাউকে লাগবে না আমার। দূরে থাকুন সবাই আমার থেকে।”
‘এলিজাবেথ পাগলের মতো চুল টেনে ধরে হাঁপাতে লাগল। বুকের ভেতর আগুন আরও প্রজ্বলিত হলো। হঠাৎ করে আবারও চিৎকার করে উঠল,

“ওই লোকটা কেন আসেনি? কেন আসেনি সে? সে-ই খুনি! আমার সন্তানের খুনি! নিজের সন্তানের খুনি!”
‘ওর গগনবিদারী চিৎকারে করিডোরে ভিড় জমে। কাঁদছিল সবাই। তাকবীরের চোখও টলমল করছিল, সে পারছিল না এই ভগ্ন হৃদয়কে শান্ত করতে। সত্যিই তো, যার সব হারিয়ে গেছে, তাকে কীভাবে সান্ত্বনা দেওয়া যায়? এলিজাবেথের বিক্ষুব্ধ চিৎকার প্রতিধ্বনি হয়ে ছড়িয়ে পড়ল হাসপাতালের প্রতিটি কোণায়। বারবার হাত বুলিয়ে যাচ্ছিল সে নিজের পেটে। একদিন আগেও সেখানে প্রাণ ছিল, আলো ছিল, উষ্ণতা ছিল। আজ কেন নিঃস্ব? এলিজাবেথ তাকবীরের হাত আঁকড়ে ধরল। নিষ্পেষিত কণ্ঠে অঝোরে কাঁদতে কাঁদতে বলতে থাকে,
“ও ভালো মানুষ গো, আমি আপনাকেও মাফ করে দেব। আপনার সারেন্ডার করতে হবে না, কিচ্ছু করতে হবে না। শুধু আমার সন্তানকে ফিরিয়ে দিন, আমি সব ভুলে যাবো। অনেক দূরে চলে যাবো ওকে নিয়ে। ওকে ফিরিয়ে দিন না,,..আমি কীভাবে বাঁচব ওকে ছাড়া?”

‘তাকবীরের গলা কাঁপল,”ও আর আসবে না এলোকেশী। আমাদের ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেছে…”
‘ও আর আসবে না।’ এই শব্দগুলো যেন বজ্রাঘাত হয়ে এলো। এলিজাবেথ ছিটকে দূরে সরে গেল! চোখের সামনে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে আসে। ঠৌঁট কাঁপার সাথে পুরো শরীর শিউরে উঠল।
“ও না থাকলে আমি থাকব কী করে?”বিরবির করে
বলেই স্ট্রেচারের পাশের ছোট টেবিল থেকে সিজার তুলে নিল এলিজাবেথ। তাকবীর বিদ্যুৎগতিতে ছোঁ মেরে ওর হাত থেকে সিজার কেড়ে নিল। শক্ত করে বুকে চেপে ধরল এলিজাবেথকে। ভাঙা পৃথিবীর শেষ আশ্রয় পেয়ে এলিজাবেথ থমকে গেল। আঁকড়ে ধরল তাকবীরের পাঞ্জাবি! মুঠোর জোরে তার সকল অস্থিরতা প্রকাশ পেল। ভাঙা কণ্ঠে চিৎকার করতে থাকে,

“আমি পারিনি আমার সন্তানকে রক্ষা করতে… ব্যর্থ মা আমি! ব্যর্থ! ব্যর্থ!”
‘তাকবীর ওর মাথাটা শক্ত করে চেপে ধরল বুকে। তার নিজের চোখেও অশ্রু থেমে থাকল না। দরজার দিকে তাকাতেই সবাই দ্রুত সরে গেল৷ নীরবে রেখে গেল এলিজাবেথকে তার অসীম শূন্যতার মাঝে।
“নিজেকে শক্ত কর, এলোকেশী। তোমাকে ঠিক থাকতে হবে।”
‘এলিজাবেথ আবারও ভেঙে পড়ল। ওর বুকফাটা আর্তনাদে হাসপাতালের দেওয়াল কেঁপে উঠছে,
“ওহ খোদা! তুমি কেন দিলে না আমার ডাকে সাড়া? কেন নিয়ে গেলে আমার বুকের ধন? কিসের অভাব ছিল তোমার, যার ঘাটতি পূরণ করলে আমার সন্তানকে কেড়ে নিয়ে?”
‘তাকবীর ইশারা করতেই নার্স ইনজেকশন নিয়ে এলো। এলিজাবেথ খেয়ালই করল না সে-সব কিছু। সে কান্নার স্রোতে ভাসছিল! অভিমানের বন্যায় নিজেকে ভাসিয়ে দিচ্ছিল। তার প্রতিটি বাক্য হাসপাতালের শীতল দেয়ালে প্রতিধ্বনি হয়ে ধাক্কা খাচ্ছিল বারবার।

“ও খোদা, ও খোদা! এত কঠোর তুমি কী করে হলে? আমার বুকফাটা কান্না কি পৌঁছায়নি তোমার আরশে? কিসের অভাব ছিল আমার ভক্তিতে…? ইয়া রব! ফিরিয়ে দাও ওকে! আমি ওকে একটু ছুঁতে চাই… একটু অনুভব করতে চাই…”
‘নার্স নিঃশব্দে এগিয়ে এসে পিছন থেকে সুচটা গেঁথে দিল এলিজাবেথের কাঁধে। মুহূর্তেই ঝাঁকি খেল শরীরটা, ধকধক করতে লাগল শিরাগুলো। তাকবীর রক্তগরম চোখে তাকাতেই নার্স দ্রুত পিছু হটে বেরিয়ে গেল কেবিন থেকে। এলিজাবেথের আঙুলের বাঁধন ঢিলে হয়ে এলো! চোখে নেমে এলো গভীর ঘুমের ছায়া। তাকবীর নিঃশব্দে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর আস্তে করে ওকে বালিশে শুইয়ে দিল। তবু এলিজাবেথের ঠোঁট নড়ে যাচ্ছিল। অস্পষ্ট অথচ শীতল এক প্রতিজ্ঞায়,
“কেউ বাঁচবে না… কাউকে ছাড়ব না আমি…”

‘ম্যানশনের খাড়া, দুর্গের মতো প্রাচীরের ফাঁক দিয়ে ধোঁয়া ধীরে ধীরে আকাশে মিশছে। নিচে জড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গার্ডদের চোখে ভয়! কারোর সাহস নেই ওপরে যাওয়ার। ধ্বংসের শব্দ উঠে আসছে মাস্টার বেডরুমের পাশের ছোট ঘরটি থেকে। সেখানে গ্যাংস্টার বস রিচার্ড কায়নাত বেপরোয়া তাণ্ডবে মেতেছে।
‘যে পুরুষ মুখে কোনো অনুভূতি প্রকাশ করতে জানে না, সে-ই নিঃশব্দ ভালোবাসায় নিজের হাতে সাজিয়েছিল সন্তানের ঘর। ছোট ছোট খেলনা, নরম তুলতুলে কুশন, রঙিন পর্দায় ঘেরা এক স্বপ্নময় আশ্রয়, যেখানে তার শিশুটি হাঁটবে, হাসবে, তার প্রথম কথাগুলো উচ্চারণ করবে। অথচ আজ সেই ভালোবাসার ঘরই রিচার্ডের ক্রোধের আগুনে ছাই হয়ে যাচ্ছে। ঠিক যেমন করে স্বপ্ন পুড়ে যায় কঠিন বাস্তবতার দহনজ্বালায়।
‘রাত এগারোটার পর সাধারণত সব সুপারশপ বন্ধ হয়ে যায়। স্বপ্ন সুপারশপও তার ব্যতিক্রম ছিল না। রিচার্ড যখন সেখানে পৌঁছেছিল শাটার তখন নামানো। কিন্তু সময়ের সীমারেখা কে ঠিক করে? রিচার্ডের নিয়ম আলাদা। পরবর্তীতে রিচার্ডের গার্ডরা গিয়ে ম্যানেজারকে তুলে নিয়ে আসে। পোস স্বভাবের মানুষটা ছিল সেরা জিনিস বেছে নেওয়ার পক্ষে। নিজের সন্তানের জন্যও সে সবচেয়ে রুচিশীল জিনিসগুলোই কিনেছিল। মুখে শুধু “ছেলে, ছেলে” করলেও, কেনাকাটা করেছিলেন উভয়ের জন্যই, ছেলে এবং মেয়ে। সন্তানের প্রতি তার ভালোবাসায় কোনো বিভাজন ছিল না, শুধু ছিল কালো অতীত।

‘সবশেষে ম্যানশনে ফিরে নিজের হাতে সাজিয়ে তুলছিল সেই ছোট্ট ঘর৷ যা ছিল তার সন্তানদের জন্য। প্রতিটি কোণে ছিল যত্নের ছোঁয়া, প্রতিটি সাজসজ্জায় ভালোবাসার ছাপ।বাগান বাড়ির মতো নতুন ম্যানশনেও উপরে শুধুমাত্র রিচার্ডের জন্য মাস্টার বেডরুম তৈরি করা হয়েছিল। পরবর্তীতে আবার রিচার্ড বেডরুমের পাশেই ছোট একটা রুম বানায়। তখনও সে জানতো না তার সন্তান আসতে চলেছে দুনিয়ায়।
‘জানার পর সেখানে তৈরি করেছিল এক টুকরো ডিজনিল্যান্ড—একটা ছোট্ট, রঙিন স্বপ্ন। সেখানে কী ছিল না? পুতুল, খেলনা, নরম কম্বল, ঝলমলে জুতো… কাঠের তৈরি ছোট্ট একটা ঘর, গেমিং স্পট, আরও কত কি,,কিন্তু যা সবচেয়ে বেশি ছিল তা হলো ভালোবাসা। এখন সেই স্বপ্ন দাউদাউ করে জ্বলছে। আগুনের লেলিহান শিখায় পুড়ছে ছোট ছোট খেলনা, নরম মোজা, সযত্নে রাখা সব কিছু। রিচার্ড দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে, শূন্য চোখে দেখছে নিজের সাজানো ভালোবাসাকে ছাই হয়ে যেতে। বাইরে যে আগুনটা জ্বলছে তার চেয়েও দ্বিগুণ আগুন জ্বলছে তার ভেতরে ধ্বংস, প্রতিশোধ আর এক শূন্যতার আগুন।

‘ন্যাসো আর লুকাস ছুটে আসে ম্যানশনের দিকে। হসপিটাল থেকে রিচার্ড ওদের রেখেই চলে গিয়েছিল। পরে ওরা আর অনুসরণ করেনি। বরং গিয়েছিল আসলামকে ধরতে। আসলাম বর্ডার ক্রস করে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। গার্ডদের কল পেয়েই দ্রুত ফিরে আসে তারা। ম্যানশনের ভেতরে পা রেখে উপরের দিকে তাকিয়ে আঁতকে ওঠে। আগুন ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ছে! ধোঁয়ায় চারিপাশ কালো হয়ে যাচ্ছে। যে কোনো মুহূর্তে পুরো জায়গাটা গ্রাস করবে লেলিহান শিখা। রিচার্ড দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে অটল, অচঞ্চল,অবিচল প্রাচীরের মতো। পিছন থেকে ওকে দেখে মনে হচ্ছে রক্তমাংসের মানুষ নয়, এক নিস্তেজ রোবট যার ভেতরটা আগুনে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। ন্যাসো আর লুকাস ছুটে গিয়ে স্টোররুম থেকে গ্যাস নিয়ে উপরে গিয়ে আগুন নেভাতে শুরু করল। ওদেরও বুক ভিজে যাচ্ছিল সুন্দর স্মৃতিগুলোকে পুড়তে দেখে।
‘রিচার্ড ক্রান্ত পায়ে গেল বেডরুমে। দেয়ালে ঝুলে থাকা এলিজাবেথের ছবিটাতে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকল। অতঃপর নিজের পাসপোর্ট নিয়ে কেবিনেট থেকে একটা ব্যাগ কাঁধে চাপিয়ে বেরিয়ে গেল পৈশাচিক প্রতিশোধের স্পৃহায়। নিচে নামতেই গার্ডরা তাড়াতাড়ি সরে গেল। লুকাস আর ন্যাসো আগুন নেভাতে সফল হলেও রিচার্ডের কাঁধে থাকা ব্যাগ দেখে ওরা শিউরে উঠল। দ্রুত রিচার্ডের পিছু নেয়।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৫

“বস, আমরা আসছি।”
‘রিচার্ডের কাঠকাঠ জবাব, “নো।”
‘ন্যাসো ব্যগ্র কণ্ঠে বলল, “বস এই মিশনে আমরাও থাকতে চাই। আপনার প্রয়োজন আমাদের সাহায্যের।”
‘রিচার্ড থামল তবে পিছন ঘুরে তাকাল। ওর সমুদ্র নীল চোখ দু’টোতে আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাত হচ্ছে। ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেল ওরা রিচার্ডের বিদ্যুৎ বেগে চাহনি দেখে। হিংস্রতার প্রভাবে রিচার্ডের পৈশাচিক, সাইকো মস্তিষ্ক বুনো ষাঁড়ের মতো গর্জে উঠল প্রলয়ের আগামী বার্তা দিয়ে,
“এক নিকৃষ্ট পাপিষ্ঠা নারীর জন্য যদি আমি জানোয়ারে পরিণত হতে পারি, তবে নিজ সন্তানের জন্য গোটা পৃথিবীকে রক্তে ভিজিয়ে তার প্রতিটি শ্বাস চূর্ণ করে ফেলতে পারে এই রিচার্ড কায়নাত।”
‘অতঃপর আর এক মূহুর্তও সেখানে স্থির রইল না সে। ন্যাসো লুকাসের কানের পাশ ছিল যেন ধ্বংসের হীম শীতল হাওয়া বইয়ে গেল। কানে বাজছে থাকে সাইরেনের হাহাকার আর ছিন্নভিন্ন ধ্বনি।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৪৭