ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫২ (২)
মিথুবুড়ি
“রিচার্ড সোজা লনে গিয়েই এলিজাবেথকে কাঁধ থেকে নামাল। তার চোখে তখনো রাতের উন্মত্ততা, শরীরে আগ্রাসনের ছাপ। রিচার্ডকে হিংস্র প্রাণীর মতো এগিয়ে আসতে দেখামাত্র গার্ডরা উল্টো দিক ঘুরিয়ে টানটান হয়ে দাঁড়ায়, যেন কিছুই দেখছে না। এলিজাবেথ সামনের দিকে তাকালে মুহূর্তেই শিউরে উঠে। কয়েক জনকে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে রাখা হয়েছে পিঠমোড়া ভান দিয়ে। সকলের শরীর ক্ষত-বিক্ষত। ছিন্ন মাংসের ফাঁক দিয়ে গাঢ় লাল রক্ত ধীরে ধীরে গড়িয়ে পড়ছে মাটিতে। মুখের ভেতর পর্যন্ত থেঁতলে গেছে। বোঝাই যায় পাশবিক নির্যাতনের মাত্রা কতটা ভয়াবহ ছিল।
‘এলিজাবেথের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল। তাহলে কি রিচার্ডই এই ধ্বংসযজ্ঞের কারণ? কাল রাতে এই শরীরগুলোই কি তার উন্মত্ততার শিকার হয়েছিল? ওর শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে এলো। ভয়কাতুরে চোখ ডান পাশে যেতেই দ্বিতীয় দফায় তার গায়ের রক্ত জল হয়ে গেল। পিছু হটতে গিয়েও থমকে দাঁড়াল—তার সামনে চেয়ারে বাঁধা আছে এক নরখাদকের মুখাবয়ব! রক্তমাখা, বিকৃত এক হাসি যেনো এখনও তার ঠোঁটের কোণে জমাট বেঁধে আছে
‘আসলাম!
তার সন্তানের হত্যাকারী!
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
এক মুহূর্তের জন্য এলিজাবেথের সমস্ত অনুভূতি স্তব্ধ হয়ে গেল। সমস্ত শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে গেল তপ্ত লেলিহান শিখা। চোখের সামনে স্পষ্ট ভেসে উঠল সেই নিষ্ঠুর মুহূর্ত কতটা বীভৎস কষ্ট দিয়ে তার অনাগত শিশুকে হত্যা করা হয়েছিল! রাগ নয়, ঘৃণা নয়—সন্তান হারানো মায়ের ভেতর তখন ফুঁসে উঠেছে এক বিধ্বংসী প্রতিশোধের আগুন!
‘রিচার্ড একটা রিভলবার তুলেই ধরল এলিজাবেথের চোখের সামনে। তবে এলিজাবেথের দৃষ্টি একটুও সরল না। তার ঘৃণার আগুন শুধু আসলামের দিকেই বিধ্বংসী শিখার মতো জ্বলছিল। আসলামের পা একটা অ্যাসিডের পাত্রে ডুবিয়ে রাখা হয়েছে। হাঁটুর নিচ থেকে মাংস সব গলে পড়ে গেছে ইতিমধ্যে। শুধু হাড়গুলো এসিডের ওপরে ভাসছে। আসলামের শরীরের কোথাও আস্ত চামড়া নেই—নাক, চোখ, মুখ, সব ছিন্নভিন্ন। শুধু নিঃশ্বাস নিচ্ছে আর মৃত্যুর আগের দীর্ঘতম শাস্তি ভোগ করছে। এমন বর্বর দৃশ্য দেখেও এলিজাবেথের মনে আজ কোনো ভয় নেই, নেই একটুও করুণা। হঠাৎ রিচার্ডের কণ্ঠে তীক্ষ্ণ নির্দেশ ঝরে পড়ল,
“নিজের সন্তানের প্রতিশোধ নাও, রেড।”
‘এলিজাবেথ নির্বাক দাঁড়িয়ে । তার চোখে শুধু দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলছে। ন্যাসো আর লুকাস এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে নিঃশব্দে। দুজনের চোখ লালচে, ঘুম জড়ানো। কাল রাতভর রিচার্ডের বর্বরতার সাক্ষী থেকেছে তারাও।
এলিজাবেথের নির্লিপ্ততা রিচার্ডের সহ্য হলো না। তার রাগ মুহূর্তে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ল।
“আই সেইড কিল দ্যাম, ইউ ফাকিং রেড!”
‘রিচার্ডের হুংকারে আশপাশের গাছ থেকে সব পাখি একসাথে ডানা ঝাপটা মেরে উড়ে গেল। বাতাস তীব্র হয়ে উঠল। ঘাসের ওপর রোদের ঝলকানি ছড়িয়ে থাকা ধাতব অস্ত্রগুলো চকচক করছে—ছু’রি, চা’পা’তি, ব্যা’টল নাইফ, ক্যা’সে’ক,ব’ল্ল’ম, ফল’কা’টা আরো কিছু মরণকাঠি। হঠাৎ দমকা হাওয়া বইল। বাতাসে এলিজাবেথের লাল রেশমি চুল এলোমেলো হয়ে উড়ছে তবুও সে নড়ছে না। একচুলও না। রিচার্ড আরও এক ধাপ এগিয়ে এসে গর্জে উঠল,
“আজ যদি প্রতিশোধ নিতে না পারিস, কখনোই মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবি না! ওপারে আমার সন্তানের কাছে মুখ দেখাতে পারবি?”
‘এলিজাবেথের নিস্তব্ধতায় রিচার্ডের হিংস্রতা আজ শিখর ছুঁয়েছে। সেই অভিশপ্ত সুর বাজিয়েই সে হাতে থাকা গান দিয়েই একে একে হত্যা করতে থাকে বাঁধা গার্ডদের। যারা সেদিন আসলামের সহকর্মী ছিল। ন্যাসো লুকাস ওদের সেদিনই ধরে ফেলেছিল কিন্তু রিচার্ড এতদিন কাউকে মারেনি। প্রতিশোধের জন্য অপেক্ষা করছিল, চেয়েছিল এলিজাবেথের হাত দিয়েই ওদের মৃত্যুর স্বাদ দিতে। কিন্তু আজ আর ধৈর্য নেই। একটি একটি করে নিথর দেহ লুটিয়ে পড়ছে সবুজ ঘাসে। তাজা রক্তে সিক্ত হচ্ছে সবুজকলি। কেউ আর্তনাদ করার সুযোগও পায় না। শুধু গুলির ধারালো শব্দ বাতাস কাঁপিয়ে তোলে। রিচার্ডের মুখে অসংযত গালিগালাজ আর গলায় উন্মত্ততার ঝাঁজ। একে একে সে সবাইকে পায়ের নিচে পিষে ধরে গুলি করছে বুক, কপাল, গলা—যেখানে ইচ্ছা সেখানেই।
‘গোলাগুলির শব্দে ইবরাত ছুটে আসে ট্যারেসে। নিচের ভয়ংকর দৃশ্য দেখে সে আতঙ্কে চিৎকার করে ওঠে। মেয়েলি চিৎকার শুনে সেদিকে তাকিয়ে কাঁপতে থাকা ইবরাতকে দেখে ন্যাসো দ্রুত ছুটে যায় ভিতরের দিকে। এদিকে আসলামের এতক্ষণে অজ্ঞান অবস্থা থেকে ফিরেছে। চাক্ষুষ এই দৃশ্য দেখে আতঙ্কে তার শরীর কাঁপছে, প্যান্ট ভিজে গেছে, তবু শব্দ করতে পারছে না। কারণ রিচার্ড আগেই তার জিহ্বা কেটে নিয়েছে,তার সমস্ত আর্তনাদ চিরতরে রুদ্ধ করে দিয়েছে। ভয়ংকর নৃশংসতা আর রক্তঝরা ক্রোধের মাঝে ছটফট করতে হয়েছে তাকে বিগত পনেরো দিন যাবত।
‘এলিজাবেথের শূন্যচোখে নীরিক্ষণ। নিষ্ঠুর তান্ডব চালিয়ে রিচার্ড আবারও তেড়ে গেল এলিজাবেথের কাছে। ওর কাঁধ ঝাঁকিয়ে ক্ষুব্ধ স্বরে বলল,
“মায়েদের হাতে সবসময় শুধু কোমলতা মানায় না, সেই কোমল হাত কখনো কখনো সন্তানের জন্য অস্ত্রও তুলতে হয়।যখন ভালোবাসার চেয়ে প্রতিশোধের ওজন ভারী হয়ে ওঠে।”
‘অকস্মাৎ কি যেন হল এলিজাবেথের। সে অমোঘ বিধ্বংসী খেলায় মত্ত হতে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল রিচার্ডকে। ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের গতিতে ছুটে গিয়ে নিচ থেকে তুলে নিল একটা ফলকাটা। অতঃপর নির্ভুল নিশানায়, নির্ভীকে চালিয়ে দিল ফলকাটা আসলামের গলা বরাবর। ঘাড় থেকে মন্ডু ছিটকে গিয়ে পড়ল সবুজ ঘাসে। এতেই থেমে থাকল না। জল্লাদীয় আক্রমণ হতে থাকে একের পর এক। রক্তের তপ্ত তরঙ্গ এসে ছিটকে পরে ওর মুখাবয়বে। এলিজাবেথ কোপ বসালো আসলামের হাতের কবজা বরাবর। নিথর, প্রাণহীন, হিমশীতল শরীরটা লুটিয়ে পড়ল মাটিতে তৎক্ষনাৎ। বজ্রমুষ্টি করে রাখা ফলকাটা স্থিতিশীল গতিতে চলতে আছে। ফিনকি দিয়ে ছিটে আসা রক্তে রঞ্জিত হল লাল শাড়ি দ্বিতীয় দফায়। মাংস ছিঁড়ে যাওয়ার করুন শব্দ আর হাড় ভাঙার শব্দের মাঝে এলিজাবেথ শুনতে পায়, সেদিনের আর্তনাদ৷ কিভাবে সে চেয়েছিল তার সন্তানের জীবন ভিক্ষা। পশুগুলো সেদিন ছাড় দেয়নি তাকে, আজকে সেও ছাড় দেয়নি। হাতে তুলে নিয়েছে অস্ত্র, ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে অস্তিত্ব।
‘রিচার্ডের চিবুক নিরেট ঠান্ডা। চোখে নিঃশব্দ শীতলতা অথচ বিপরীত পাশে দাঁড়িয়ে লুকাসের দৃষ্টিতে বিস্ময়ের ঝড়। তাদের সামনে এলিজাবেথ—বন্য জন্তুর মতো ক্ষত-বিক্ষত দেহে কোপ বসাচ্ছে সাথে এক অদ্ভুত গর্জনে কাঁপিয়ে দিচ্ছে বাতাস। সম্পূণ শরীর রক্তে ভেজা। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মাংসের টুকরো, হাড়গোড়—সবুজ ঘাসের ওপর যেন এক ভয়াবহ চিত্রকল্প। ফলকাটা চালাতে চালাতে একসময় শরীর দমে এলো ওর। এলিজাবেথের চোখে ঝাপসা অন্ধকার নেমে আসার আগেই রিচার্ড এগিয়ে গিয়ে তাকে ধরে ফেলল।পাজাকোলে তুলে নিল। তারপর নিঃশব্দে নিজের গাল ওর রক্তাক্ত মুখের সাথে চেপে ধরল। এভাবেই রক্তের উষ্ণতা শুষে নিল। লুকাস ধীর পায়ে এগিয়ে এল। তার চোখে হতাশা।
“বস আর কত? এক সন্তানের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শত শত শিশুকে এতিম করে দিচ্ছেন আপনি। আর কত?”
‘রিচার্ড চুপচাপ এলিজাবেথের রক্তাক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইল যেন ওর ক্ষতগুলোর গভীরে কোনো প্রতিজ্ঞা লুকিয়ে আছে। তারপর গম্ভীর, ভারী কণ্ঠে বলল,
“ওর শরীর থেকে যত ফোঁটা রক্ত বেরিয়েছে ঠিক ততজনকে।”
‘গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে থাকা জঙ্গলের সামনে এসে থামল তাকবীরের গাড়ি। ইঞ্জিন বন্ধ হতেই চারপাশ আরও নিস্তব্ধ হয়ে গেল। দরজা খুলে নেমে এল তাকবীর, নিঃশব্দে পা ফেলল গভীর জঙ্গলের দিকে। পেছনে রেয়ান ছায়ার মতো অনুসরণ করল তাকে। অন্ধকারে পথ করে একটু এগিয়ে যেতেই রেয়ান থামল। দ্রুত ঝোপঝাড় সরাতেই বেরিয়ে এল ধাতব এক ঢাকনা। ঢাকনা সরানো মাত্রই নিচ থেকে উঠে এল থমকে থাকা বাতাস। মাটির নিচে লুকিয়ে থাকা এক রহস্যময় পথের নিশ্বাস যেন। তাকবীর আর রেয়ান ধীর পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নামল সেই গুপ্ত পথের গভীরে। দেয়ালের স্যাঁতসেঁতে গন্ধ আর দূর্বল আলোয় ছায়াগুলো কাঁপছিল। যেন এই পথের সাথেই জেগে আছে কিছু অজানা আতঙ্ক। দীর্ঘ পথ পেরিয়ে তারা এসে পৌঁছাল বিটিআর ক্যাসিনোর বেজমেন্টে।
‘রেয়ান থমকে দাঁড়াল, নজর বোলাল চারপাশে। সে ভিতরে গেল না, বাইরেই দাঁড়িয়ে থাকল। উপরতলায় কঠোর নিরাপত্তার বিপরীতে এখানে নিস্তব্ধতা। তাকবীর এক মুহূর্তও দেরি করল না লোহার দরজাটা ঠেলে ঢুকে গেল ভিতরে। তার বুকের ব্যান্ডেজে এখনও রক্তের ছোপ লেগে আছে। দরজা খোলার শব্দ হতেই ভেতর থেকে এক করুণ আর্তনাদ ভেসে এলো। তাকবীর স্বতঃস্ফূর্ত কদমে ভিতরে ঢুকল। বিশাল, নির্জন কক্ষের এক কোণে একটি মেয়ে দেয়ালের সঙ্গে মিশে আছে কাচুমাচু হয়ে। শরীর ঢাকার ব্যর্থ চেষ্টা তার দু’হাতে, ফোলা পেটের ওপরে আঁকড়ে ধরা ভয়ার্ত আঙুল। চোখেমুখে নিখাদ আতঙ্ক। শরীর থেকে ভেসে আসছে দূষিত গন্ধ। তাকবীর নাক সিটকিয়ে চারপাশে দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। ঘরটায় আসবাব বলতে একটিমাত্র পুরোনো চেয়ার, মলিন কম্বল, একটা নোংরা বালিশ, এক কোণে কমোড আর মরচে ধরা ঝরনা। পায়ের কাছে পড়ে আছে পচা খাবারের টুকরো। মেয়েটা অনবরত থরথর করে কাঁপছে।
‘চেয়ারে বসে তাকবীর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “তিন মাস আসিনি এতেই এই অবস্থা?”
‘মেয়েটি থরথরিয়ে উঠল।আরও গা ঘেঁষে নিল দেয়ালটাকে। কাঁপা কণ্ঠে অনুনয়ের সুরে বলল, “একদম কাছে আসবেন না!”
‘তাকবীর বাঁকা হাসল।তার চেহারায় আজ কোনো স্নিগ্ধতা নেই বরং এক নির্মম, শীতল অন্ধকার।
“কুল। আসব না।”
‘মেয়েটা যেন দেহে প্রাণ ফিরে পেল। হাঁপাতে হাঁপাতে নয় মাসের ভারী পেটের ওপর হাত রাখল। তার দৃষ্টিতে ঘৃণার আগুন। কণ্ঠে বিরাজ তীব্র তাচ্ছিল্য,”আপনি মরেননি?”
‘তাকবীর ভ্রু তুলল, ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা।
“দোয়া করেছিলে নাকি?”
‘মেয়েটির নাম নাতাশা। নাতাশা বিষাক্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে, “সেই দোয়া কবুল হলে আট মাস আগেই আপনার অস্তিত্ব নিঃশেষ হয়ে যেত!”
‘একটু থেমে, গভীর বিষাদ মিশিয়ে আবারও বলল, “হাশরের ময়দানে আল্লাহর কাছে তোদের জন্য আমি জাহান্নাম চাইব। আমার জীবনটাকে তুই নরক বানিয়ে দিয়েছিস।”
‘তাকবীর নির্লিপ্তভাবে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “মেয়ে মানুষের মুখে এত বড় বড় কথা একদম মানায় না।”
“জানোয়ার! শুয়োরের বাচ্চা! ছেড়ে দে আমাকে!”
‘তাকবীর পায়ের কাছে পড়ে থাকা পচা খাবারের দিকে তাকিয়ে বলল, “খাওয়া-দাওয়া ঠিকমতো করছ না কেন? বাচ্চাটাকে কিন্তু আমার লাগবেই।”
‘নাতাশা আঁতকে উঠল। বুকের ভেতর ধক করে উঠল তার।, সে তড়িঘড়ি করে পেট দু’হাতে আঁকড়ে ধরল। কাঁপা কণ্ঠে অনুনয় করতে থাকে, “না… না, আমি আমার বাচ্চাকে দেব না! এই সন্তানের উপর আপনার কোনো অধিকার নেই! ও শুধু আমার!”
“এই বাচ্চা আমার, তবে একে আমার কোনো প্রয়োজন।তবে নিজের জন্য না, আমার খেলার গুটি হিসেবে লাগবে এই বাচ্চাটা। আমার এলোকেশীর জন্য এই বাচ্চাটা লাগবেই লাগবে।”
“মানে?”
‘তাকবীর ঝুঁকে ওর গাল ছুঁয়ে দিল তর্জনী দিয়ে, ফিসফিস করে বলল, “মানে এই বাচ্চা আমার আর আমার এলোকেশীর হবে।”
‘ঘৃণায় শিউরে উঠল নাতাশার গা। ছিটকে সরিয়ে দিল তাকবীরের হাত। রুষ্ট কণ্ঠে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, “যাকে এত ভালোবাসেন তাকে ঠকাতে বুঝি কষ্ট হয় না?”
‘তাকবীর স্মিত হেসে সোজা হয়ে বসল, “উমহু, কষ্ট হয় অন্য কারও সঙ্গে তাকে কল্পনা করতে।”
‘নাতাশার চোখে তখন ঘৃণার দাবানল। কাঁপা ঠোঁটে বিষ মাখিয়ে বলল,”জানেন, মাঝেমধ্যে সেই মেয়েটাকে খুব ভাগ্যবতী মনে হতো। খুব শখ ছিল মরার আগে একবারের জন্য হলেও তাকে দেখতে। যখন আপনার মুখ থেকে তার নাম ঝরা বৃষ্টির মতো ঝরত,ভাবতাম জানোয়ার’রা বুঝি এতো ভালোবাসতে পারে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, সেই মেয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় হতভাগী, যে আপনাকে বিশ্বাস করেছে।”
‘তাকবীর বিস্ফোরিত হলো মুহূর্তে। বিদ্যুৎবেগে উঠে দাঁড়িয়ে লাথি মেরে চূর্ণ করে দিল চেয়ারটা। ছুটে গিয়ে নাতাশার চুল মুঠোয় ধরল। প্রচণ্ড আক্রোশে চিৎকার করে উঠল,
“চুপ! একদম চুপ! তোর মতো মেয়ের মুখে আমার এলোকেশীর নাম মানায় না! সে পবিত্র, সে নিষ্পাপ ফুল, আমার ফুল! ধরিত্রীর সবচেয়ে সুন্দরী রমণী, আমার এলোকেশী, আমার বেঁচে থাকার উৎস!”
‘নাতাশা তবুও দমে না। তাকবীরের ক্ষিপ্ত কৃষ্ণগহ্বরে এক দলা থুতু ছুড়ে দিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে বলল,
“তোর পাপ তোকে গিলে খাবে। সত্য কখনো দামাচাপা দেওয়া যায় না! উপরে একজন আছে, যে সব দেখছে। তুই আর তোর বাপ মিলে আমার সঙ্গে যা করেছিস, সেই পাপ খোদা কখনোই মাফ করবে না! পাপ যেমন তোর বাপকে গিলে খেয়েছে, ঠিক সেইভাবেই তোকে খাবে। পাপ বাপকেও ছাড়ে না! সব থেকে ভয়ংকর মৃত্যু হবে তোর, তোরা কেউ বাঁচবি না!”
‘তাকবীরের চোখ মুহূর্তেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ছড়াল। সে হিতাহিতজ্ঞান হারিয়ে নাতাশার গালে থাবা বসাতে লাগল। একের পর এক আঘাত নেমে এলো অনবরত। এই তাকবীরই যে তার এলোকেশীর গায়ে কখনো শক্ত হাতে ছোঁয়নি, যদি ব্যাথা লাগে মেয়েটার, সেই তাকবীরের আজ এক ভয়ংকর রূপ। ক্রোধে উন্মত্ত হয়ে সে দেয়ালে ঠুকতে লাগল নাতাশার মাথা। মেয়েলি কণ্ঠের ব্যথা মিশ্রিত হৃদয়বিদারক চিৎকারে কেঁপে উঠল স্যাঁতসেঁতে বেজমেন্টের দেয়াল। তবু তাকবীরের আক্রোশ থামল না। নিঃশ্বাসের তীব্র ধ্বনি ছড়িয়ে তাকবীর এক পা পিছিয়ে এল, তারপর দাঁড়িয়ে সজোরে লাথি বসাল নাতাশার ফোলা পেটে। বিকট এক চিৎকার! বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা রেয়ানের শিরদাঁড়া বেয়ে নামল শীতল স্রোত। সেও চমকে উঠল সেই করুণ আর্তনাদে।
‘তাকবীরকে ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে বেরিয়ে আসতে দেখে রেয়ানও পিছু নিল। ওর গর্জনমিশ্রিত কণ্ঠ আকাশে বিদ্যুতের মতো ঝলসে উঠল,
“ডেলিভারি ডেট আর কতদূর?”
“এই মাসেই সম্ভবত।”
‘তাকবীরের ঠোঁটে এক অদ্ভুত হাসি ফুটে উঠল। চোখদুটো নিষ্ঠুর এক প্রতিজ্ঞায় ঝলসে উঠল। সে এগিয়ে যেতে যেতে বলল,
“খুব শীঘ্রই আমার এলোকেশী আবারও আমার কাছে ফিরে আসবে।”
‘রেয়ান বিরক্ত স্বরে বলল, “বস, ঐ মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে।”
‘তাকবীর থমকাল। চোখ সরু করে নিরুদ্বেগ স্বরে বলল,
“তো?”
‘রেয়ান গভীর শ্বাস নিয়ে শান্ত গলায় বলল, “বুঝার চেষ্টা করুন বস, সে এবার নিজের ইচ্ছেতে বিয়ে করেছে। একটা বাচ্চার জন্য সে কখনোই আপনার কাছে ফিরে আসবে না ভালোবাসা, সংসার ফেলে। বাস্তবতায় বিরাজ করুন, প্লিজ।”
‘তাকবীরের বুকের ভেতর ধপ করে উঠল। সে জানে এই নির্মম সত্য কিন্তু মন কিছুতেই মেনে নিতে রাজি নয়। সেদিন এয়ারপোর্টে যখন রিচার্ড এলিজাবেথকে নিয়ে যাচ্ছিল, সে গার্ডদের ছাড়িয়ে পিছু ধাওয়া করতে গেলে বুলেট বিদ্ধ হয়েছিল তার বুকে। দু’দিন পর চেতনা ফিরতেই জানতে পারে— সব শেষ। এলিজাবেথ চলে গেছে। সেই মুহূর্তেও তাকবীর ছুটে গিয়েছিল বাগানবাড়িতে। কিন্তু সেখানে কেউ ছিল না। এখনো রিচার্ডের নতুন ম্যানশনের খবর তার কাছে পৌঁছায়নি, তবে সে লোক লাগিয়েছে। খুব শিগগিরই তার এলোকেশী ফিরে আসবে। তাকবীর ফাঁপা দৃষ্টিতে চাইল রেয়ানের দিকে। কণ্ঠে অবিশ্বাস্যের জাল, ফিসফিস করে বলল,
“বিয়ে হয়ে গিয়েছে আমার এলোকেশীর?”
‘রেয়ান জানে তাকবীর মেজর ডিপ্রেসিভ ডিসঅর্ডার নামক ব্যাধির জন্য এমন অদ্ভুত আচরণ করছে। সে অনুনয়ের সুরে বলে, “বস প্লিজ, নিজের জন্য বাঁচুন। এখনও সময় আছে, পালিয়ে যান। এখানে থাকলে আপনার ধ্বংস সুনিশ্চিত। এক পা এক পা করে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন আপনি।”
‘তাকবীর মাটির নিচের গুপ্ত পথের দিকে এগোতে এগোতে শান্ত স্বরে বলল,”স্বার্থপরের মতো কেমন করে চলে যাই বল? ওর কষ্টের সময় যে আমাকে পাশে খুব প্রয়োজন হয়।”
‘রেয়ান এবার ধৈর্য হারিয়ে গর্জে উঠল, “বস উনি শুধুমাত্র সাধারণ একটা মেয়ে! মেয়ে মানুষের জন্য আজ পর্যন্ত কেউ মরেনি। আপনিও মরবেন না। বাদ দেন এসব!”
“আমি মরে যাবো।”
‘”বস আপ…”
‘রেয়ানকে হাত তুলে থামিয়ে দিল তাকবীর। সুরঙ্গ পথে হাঁটতে হাঁটতে বিদ্রূপভরা সুরে গেয়ে উঠল,
“পাগল আব্দুল করিম গায়~
ভুলিতে পারি না, আমার মনে যারে চায়…
কুলনাশা পিরিতের নেশায় কুলমান গেছে,
হায় গো, কুলনাশা পিরিতের নেশার কুলমান গেছে…
দেওয়ানা বানাইছে~
কি যাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে…
কি যাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে…
বন্ধে মায়া লাগাইছে, পিরিতি শিখাইছে~
দেওয়ানা বানাইছে…
কি যাদু করিয়া বন্ধে মায়া লাগাইছে…”
‘জঙ্গলের পথ পেরিয়ে রাস্তায় উঠতেই থেমে গেল তাকবীরের পা। চোখের সামনে দৃশ্যটা ধাক্কা দিল বুকের মাঝে। রিচার্ড ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ির গায়ে। ওষ্ঠের কোণে সেই চিরচেনা বাঁকা হাসি। ধোঁয়ার কুণ্ডলী ছাড়তে ছাড়তে তাকবীরের সামনে গিয়ে এক পকেটে হাত রেখে টানটান হয়ে দাঁড়াল রিচার্ড। রেয়ান বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল একবার রিচার্ডের দিকে, তারপর তাকবীরের দিকে। আর তাকবীর? তার গভীর, নিকষ কালো চোখে যেন অগ্নিশিখা জ্বলছে।
“তাহলে আবারও মুখোমুখি হয়েই গেলাম।”
‘তাকবীর রিচার্ডের চোখে চোখ রেখে দাঁত পিষল,
“এক জঙ্গলে দুই বাঘ থাকলে তো দেখা হওয়ারই কথা।”
‘ঠোঁট কামড়ে হাসল রিচার্ড, “উমহু, ভুল বলেছিস। এক জঙ্গলে কখনো দুই বাঘ থাকতে পারে না। বনের রাজা একজনই হয়, বাকিরা হয় শিকার।”
‘এক মুহূর্ত থেমে, শব্দের ভার বাড়িয়ে রিচার্ড ঝুঁকল তাকবীরের উপর,
“তোকে কামড়ে ধরার সময় হয়ে গেছে। সাবধান! বলেছিলাম না, জানে মারব না… তবে তোর আত্মা মরে যাবে।”
‘তাকবীর পকেট থেকে গান বের করতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই রেয়ানের ফোন বেজে উঠল। ফোনের স্ক্রিনে নাম ভেসে উঠতেই শব্দ করে হেসে উঠল রিচার্ড।
“তোর পতন শুরু।”
‘রেয়ান ফোন রিসিভ করতেই তার মুখের রং ফ্যাকাশে হয়ে যায় মুহূর্তেই। সেটা দেখে রিচার্ডের হাসির শব্দ আরও বেড়ে গেল। চোখে অদ্ভুত এক বিদ্রুপ নিয়ে হিসহিসিয়ে বলল,
“অন্যের সন্তানের জন্য এত দরদ দেখিয়েছিস… কিন্তু কখনো ভেবে দেখেছিস? যাকে নিজের সন্তান ভাবছিস, তার শরীরে আদৌও কি তোর রক্ত বইছে কিনা?”
‘তাকবীর চমকে উঠল! ক্ষিপ্ত হয়ে এক ঝটকায় রিচার্ডের কলার চেপে ধরল। কিন্তু এর আগেই রেয়ান আতঙ্কিত স্বরে বলে উঠল,
“বস! সোয়াট টিম বিটিআর ক্যাসিনোর বেজমেন্টের সন্ধান পেয়ে গেছে!”
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৫২
‘মুহূর্তেই তাকবীরের হাত আলগা হয়ে গেল। চোখে ফুটে উঠল নিঃশব্দ এক ভয়। রিচার্ডের দিকে তাকাতেই দেখল সে বাঁকা হেসে ভ্রু নাচাচ্ছে। চারপাশে যেন একটা থমথমে নিস্তব্ধতা নেমে এল। পরক্ষণেই দুজনেই পাগলের মতো ছুটে গেল জঙ্গলের পথ ধরে। পেছনে দাঁড়িয়ে রিচার্ড অট্টহাসিতে মেতে উঠল। হাসির ঝংকারে পুরো শরীর থরথর করে কাঁপছে। পকেট থেকে একটা ছোট রিমোট বের করল রিচার্ড। ঠোঁটের কোণে এক চিলতে শয়তানি হাসি রেখে প্রেস করল বোতামটা। বিকট শব্দে কেঁপে উঠল পুরো জঙ্গল!