ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬২

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬২
মিথুবুড়ি

‘অমোঘ সময় বহমান। দিন গেছে বেশ ক’টি৷ আট দিন ধরে জ্বরে পুড়েছে এলিজাবেথ। সেদিন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বেচারি। শরীরের অবস্থা হয়ে পড়ে উত্তপ্ত, বিক্ষিপ্ত, বেহাল। আজ দীর্ঘদিন পর সুস্থতার দেখা মিলে। সারা গায়ে অলসতা জমে রয়েছে এখনো। তবুও আজ শরীর কিছুটা হালকা লাগছে। ধীরে আড়মোড়া ভেঙে বিছানা থেকে উঠল এলিজাবেথ। দৃষ্টি গিয়ে থেমে গেল কাউচের দিকে। ঝলমলে চোখে আলো পড়ল যেনো। কাউচের উপর রাখা সফ্ট পিংক রঙের একটি রাজকীয় গাউন, প্রিন্সেস বার্বি কাটে। দেখতে খুবই স্নিগ্ধ আর অভিজাত। রিচার্ড নিজ হাতে বেছে এনেছিল সেটি এলিজাবেথের জন্য।

‘আজ রাতে মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এওয়ার্ড নাইট। রিচার্ডের কোম্পানি পাচ্ছে সম্মাননা। আর এলিজাবেথ তার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ তার সকল সম্পত্তির সহ-মালিক সে হিসেবে এলিজাবেথও নিমন্ত্রিত। হাইলি ইনভাইটেড। এলিজাবেথ অবশ্য এতে আপত্তি করেনি। জীবনের জঞ্জাল সরিয়ে এবার সে এবার এগোতে চায় উজ্জ্বল, সাহসী নতুন যাত্রায়। শাওয়ার নিয়ে স্নিগ্ধ হয়ে এলিজাবেথ ঢুকে পড়ে নিজের ভেনিটি স্পেসে। রিচার্ড নিজের হাতে গড়ে দিয়েছে এই বিশাল জায়গাটা। বিছানার পাশের রুমটিকে সম্পূর্ণভাবে রূপান্তর করেছে এক স্বপ্নপুরী।
‘রিচার্ড একদিন কথায়, কথার পৃষ্ঠে বলেছিল,”তুমি আসলে কি চাও?”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘মজার ছলে এলিজাবেথও অকপটে বলেছিল,”পঞ্চাশটা নতুন জামা আর পঞ্চাশ’টা নতুন জুতো চাই আমার।”
‘রিচার্ড সেদিন মুচকি হাসলেও পরিকল্পনা ছিল ভিন্ন। সে কথাটা খেলাচ্ছলে নেয়নি। সেই থেকেই একে একে সাজিয়ে দিয়েছে এলিজাবেথের রাজ্য। জুতো থেকে ব্যাগ, কসমেটিক থেকে গহনাগুলো পর্যন্ত আলাদা আলাদা অংশে রাখা। বামদিকে দণ্ডায়মান জামার র‍্যাকে রঙের ঢেউ। ডানদিকে শুধুই জুতো—পেন্সিল, সিল্ক, সুয়েড, স্টিলেটো সব কিছু। আর ঠিক পেছনে কাচঘেরা লাইটিং সেলফ। সেখানে একে একে সাজানো প্রসাধনী, বিদেশি ব্র্যান্ডের মেকআপ, পারফিউম, ব্রাশ আর কেশসজ্জার অসংখ্য উপকরণ। ভেনিটি স্পেস যেনো এক রাজপ্রাসাদ। যা রিচার্ড শুধুমাত্র তার ভালোবাসার শ্রদ্ধায় সাজিয়েছে।
‘হঠাৎ এলিজাবেথের মনে পড়ে সেদিনের কথা। রিচার্ড তাকে তার বাবার কবরের কাছে নিয়ে গিয়েছিল এবং বলেছিল,

“দেখ এলি জান দেখ। এটা আমার বাপের কবর। সেই নিকৃষ্ট মহিলার লাশ পায়নি আমি। ধরে নে পাশের জায়গাটা তার। আমি মরে গেলে মাঝখানের এই জায়গাটায় আমার কবর দিবি। আর, আর এই দেখ, এখানে বসে তুই কান্না করবি আমার জন্য। বুঝলি?”
‘গভীর নিঃশ্বাস ফেলে এলিজাবেথ সেই প্রিন্সেস গাউনটি গায়ে দিয়ে গিয়ে বসে বিশাল আয়নার সামনে। আলো পড়ে তার ঘাড়ের কাছে কাঁধের রেখায়। এলিজাবেথ নিজেকে দেখে। দেখে এক নারীর পুনর্জন্ম,নতুন এক অভিজ্ঞান। নিজের ঠোঁটে হালকা রোজ টিন্ট বুলিয়ে নেয় অতঃপর চোখে ছায়া আঁকে নিখুঁত হাতে। আজ এলিজাবেথ শুধু রিচার্ডের সঙ্গিনী নয়৷ আজ সে তার নিজেই নিজের অহংকার।
‘চারপাশে নৈঃশব্দ্য বিরাজমান। এলিজাবেথ আজ নিজেকে ফুটিয়ে তোলার মাঝে এতোই আবিষ্ট হয়ে ছিল যে রিচার্ড যে সেই কখন এসে দাঁড়িয়ে আছে তা টেরও পেলো না। লোকটা বরাবরই সুযোগ সন্ধানকারী। ওতপেতে থাকা শিকারীর মতো সেই কখন থেকে দরজায় কাঁধ হেলিয়ে, দু’হাত বুকে ভাঁজ করে আবেশিত দৃষ্টিতে অনড়ভাবে তাকিয়ে আছে তার নারীর দিকে। তার কালো ওয়েস্ট কোটে গুঁজে রাখা স্নিগ্ধ, সুবাশিষ একটা লাল গোলাপের কলি।

“ফুল পছন্দ কর?
‘পুরুষালী গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বরে টনক নড়লো রমণীর। শীর্ণ হাতে চেপে ধরা ব্লাশঅন শ্যাডো প্রেলেট রেখে ওঠে দাঁড়াল এলিজাবেথ। পিছন ফিরতেই পরিস্ফুটিত হলো দীর্ঘদেহি ও সুঠাম দেহের অধিকারী মানুষটাকে,তার সুদর্শন স্বামীকে। বরাবরের মতোই লোকটার শার্টের দু’টো বোতাম খোলা, ফলস্বরূপ সুবিস্তৃত,শক্তপোক্ত, সুঠোম, ঢেউ খেলানো বুক উন্মুক্ত। কণ্ঠগহ্বর দিয়ে নেমে গেলো শুকনো ঢোক। অধর কোণে এক চিলতে হাসির রেখা টেনে এলিজাবেথ নির্বিকার জবাব দেয়,
“খুব।”
‘রিচার্ড এগিয়ে আসতে থাকে,”দেখো না, ফুল আমার একদম পছন্দ না, কিন্তু খোদা জীবন্ত এক ফুল জুড়ে দিল জীবনের সাথে।”

‘এলিজাবেথের শরীর ছুঁই ছুঁই করে দাঁড়াল রিচার্ড। একহাতে পেঁচিয়ে ধরল ধনুকের ন্যায় বাঁকানো কোমড়। কুয়াশার ভারে সদ্য গজিয়ে ওঠা লাউয়ের ডগার মতো নুইয়ে পড়ল এলিজাবেথ। আড়ষ্ট নারীর লাজুকতায় নিচের ঠৌঁট কামড়ে হাসল রিচার্ড। কোটের পকেট থেকে কলি’টা নিয়ে অবিলম্বে গুঁজে দিল এলিজাবেথের কানের লতির ফাঁকে। এটা ছিল তার বহুদিনের অভিলাষ। রিচার্ডের বুড়ো আঙুলের উষ্ণ ছোঁয়ায় চমকে উঠলেও মাথা তুলে না এলিজাবেথ। অবিরাম নত দৃষ্টি নিবিষ্ট করে রাখে। আর রিচার্ড? সে-ও অনড়তায় একগুঁয়ে দৃষ্টিতে তাকিয়ে। হাঁসফাঁস করতে থাকে এলিজাবেথ। কাচুমাচু ভাব দূর করার জন্য খোলা বোতাম গুলো লাগিয়ে দিতে থাকে। রিচার্ডের অভ্যন্তরে পুরুষতান্ত্রিক শিহরণ জাগতে শুরু করে। সে শুষ্ক ঢোক গিলল গাঢ় খয়েরী রঙে রঞ্জিত ওষ্ঠের দিকে তাকিয়ে।
“একটা চুমু খাই?”
‘হাত থামল এলিজাবেথের। চোখেমুখে অবাক করা ভাব।
“রিচার্ড কায়নাত অনুমতি চাইছে?”

“অনুমতি না,পরবর্তীতে অসুস্থ হয়ে পড়লে সেটার দায়ভার কমাতে চাচ্ছি, নিশ্চয়ই সেদিনের কথা ভুলোনি। আমি আজও কন্ট্রোল হারিয়ে ফেলছি, আর ধরে রাখা আর সম্ভব হচ্ছে না৷ তুমি আজ যথেষ্ট সুস্থ, রেড।”
‘চিরায়ত গম্ভীর গলার এহেন লাগামহীন কথাবার্তায় লজ্জার পীড়নে মাটির নিচে চলে যেতে ইচ্ছে করছে তার। রিচার্ডের বুকে মৃদু ধাক্কা দিয়ে দূরে সরিয়ে দিল এলিজাবেথ। ঠৌঁট কামড়ে লাজুক হেসে বলল,
“সরুন।”
‘রিচার্ড তার শরীর হালকা করে রেখেছিল। পাখির ডানার মতো নরম হাতের ধাক্কায় এক কদম পিছিয়ে গিয়ে সুচারু দৃষ্টিতে তাকাল রক্তিম আভা দিয়ে ওঠা গালদুটোতে। কুটিল হেসে বলল,
“এতোটা সুন্দর হওয়া মোটেও ঠিক হয়নি, এখন মুড এসে গেছে, সয়ে নাও।”
“মা- মানে?
‘জবাব আসে না। রিচার্ড এগিয়ে গিয়ে ভেনিটি রুমের দরজাটা ভিতর থেকে লক করে দিল। কামড়ে ধরে এলিজাবেথের তনুমন। শরীরের রক্ত চলাচল তীব্র হয়ে উঠে।চকিতে সামনে তাকাল সে। কম্পিত কণ্ঠে বলে,
“আ-আপনি দরজা লাগাচ্ছেন কেনো?”

‘ঘোরগ্রস্ত শিহরণে ঝড়ের বেগে তেড়ে আসে রিচার্ড। আর অবকাশ দিল না পালানোর। ব্যস্ত ভঙ্গিতে দু’হাতে এলিজাবেথের কোমড় খামচে ধরে পা শূন্যে তুলে নিল। ভীতসন্ত্রস্ত হয় রমণীর হৃদস্পন্দন। খামচে ধরল পুরুষালী রুক্ষ কাঁধ। সেই ভয়ংকরী রাতের কথা মনে হলেই তোলপাড় শুরু হয় মস্তিষ্কে, কাঁপন ধরে সমস্ত শরীরে। শিহরণধ্বনিত প্রহরের ঘন্টা বাজতে থাকে আত্মার অন্তরালে। এলিজাবেথ ভর্য়াত চোখে তাকাল রিচার্ডের কুয়াশাভেজা নেশালো দৃষ্টিতে। মুহুর্তেই তনুমন পুলকিত হয়ে তলপেটে অজস্র প্রজাপতি উড়ে গেল। রিচার্ডের দৃষ্টি ক্রমান্বয়ে ভয়ংকর হতে থাকে। সে আলগোছে এলিজাবেথ’কে বসিয়ে দিল ভেনিটির উপর। অতঃপর নাকের ডগা আশ্লেষে রাঙিয়ে দিল এক সর্বনাশা চুমুতে। শরীর জুড়ে বৈদুত্যিক তরঙ্গ খেলে গেল এলিজাবেথের। রিচার্ড ঝুঁকল, ঠৌঁট ছুঁই ছুঁই হয়ে পুরুষালী হাস্কি টোনে ফিসফিসিয়ে বলল,
“চলো, তোমাকে একটা বাচ্চা দিই।”

‘নিচে রেডি হয়ে বিরক্তিমাখা মুখ করে বসে আসে ন্যাসো আর লুকাস। রিচার্ড সেই কখন উপরে গিয়েছে এলিজাবেথ’কে আনার জন্য, তিন ঘন্টা হতে চলল এখনও তাদের আসার নামগন্ধ নেই। ন্যাসোর ফর্সা গাত্রবর্ণ মলিন হয়ে আছে। আজকের পার্টিতে ইবরাত যাবে না। ইবরাতের শরীর কয়েকদিন ধরে ভালো যাচ্ছে না তেমন। মুখ ফুটে না বললেও ন্যাসো খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে সবিতা বেগমের হঠাৎ হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা ইবরাত মানতে পারছে না। সে কি করে বোঝাবে এই অবুঝ মেয়েকে। ন্যাসো ছিল একা, এতিম। ভবঘুরে অতীতের ছায়ায় গড়া এক এতিম অস্তিত্ব। রিচার্ড এসেছিল তার জীবনে অন্ধকারের অরুণোদয় হয়ে। যাকে সে জানত এক শাশ্বত ভরসার নাম হিসেবে। সেই সম্পর্ক বাহ্যিক চোখে অনুপস্থিত হলেও অন্তর্গতভাবে শিলালিপির মতো অমোচনীয় ছিল। একটা নীরব শপথের মতো যার শুরুটা হয়েছিল সেই দিন যেদিন থেকে ন্যাসো রিচার্ডের রয়্যাল গার্ড হয়ে উঠেছিল।

‘রিচার্ড তাকে আগলে রেখেছে নিঃশব্দে বহুবার। রক্তঝরা মিশনগুলোয় মৃত্যুর মিছিলে পা ফেলে যখন পিছু হটার উপায় ছিল না রিচার্ড নিজের জীবনকে বাজি রেখেছে ন্যাসোর জন্য, তাদের জন্য। এমনটা একবার না বহুবার হয়েছে। মালিক, মনিবের জন্য জীবন বিপদে ফেলেছে। আর সেই মানুষটাকেই যখন সবিতা বেগম নিশ্চিহ্ন করতে উদ্যত হন তখন ন্যাসোর চোখে তার আর কোনও মর্যাদা অবশিষ্ট ছিল না। সবিতা বেগম শুধু শ্বাশুড়ি নয় এক আত্মপ্রবঞ্চিত ষড়যন্ত্রী হিসেবে ধরা দিয়েছিলেন । ন্যাসো তাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছিল বারবার নীরবতায় বেদনাকে ভাষায় না বেঁধেও। কিন্তু যাদের বোধ অন্ধ, তাদের কাছে যুক্তি নিছক কোলাহল।

‘রিচার্ড ইবরাতের খাতিরে সহনশীল ছিল৷।। কিন্তু সবিতা বেগম? তিনি রয়ে গিয়েছিলেন কঠিন, অনড়। শিহাব আর ইকবাল সাহেবের মতো সবিতা বেগম’কে ধূলিসাৎ করে ফেলার ক্ষমতা রিচার্ডের থাকা সত্বেও, সে শুধু সুযোগ দিয়ে যাচ্ছিল সবিতা বেগম’কে। কিন্তু দিন শেষে শুধু প্রতারণা। তিনি হাত মেলালেন জেমসের সাথে। সেদিন যখন এলিজাবেথের হাতে থাকা ছুরিটা স্নিগ্ধ নিষ্ঠুরতায় খণ্ড খণ্ড করে দিচ্ছিল সবিতা বেগমের শরীর, ন্যাসো আড়াল থেকে দেখেছে সমস্তটা। আর একটিবারও বাঁধা দেয়নি। কারণ সেই মৃত্যু ছিল কুৎসিত মহিলার প্রাপ্য। ন্যায়সঙ্গত আর নির্মমভাবে পরিপূর্ণ।

‘আর মিনিট পাঁচেক পর উপর থেকে নামে রিচার্ড ও এলিজাবেথ। পায়ের শব্দে থমকে দাঁড়ায় ন্যাসো আর লুকাস। রিচার্ডের বাহুতে এলিজাবেথের নরম হাত। এক রাজকীয় মঞ্চের দুই নায়কের মতো নেমে আসছে তারা। এলিজাবেথের গায়ে এখন কালো গাউন বার্বি গাউনের পরিবর্তে। রিচার্ড সেই চিরপরিচিত সৌখিনতা-মগ্ন পুরুষ আজও নিজেকে সাজিয়েছে নিখুঁতভাবে৷ কালো কোটে মোড়া, চিবুকে তীক্ষ্ণতা আর ঘন কালো চুলে যেনো সমুদ্রের প্রান্তিক জ্যোৎস্না। জেল বসানো সেই চুল বালির মতো ঝিকিমিকি করে উঠছে আলোয়। হাতে তার রয়েলস-এর রক্তমাখা আভিজাত্য বহনকারী ঘড়ি।

‘হঠাৎ তাদের পোশাক পরিবর্তনের এই নাটকীয় রূপান্তরে ন্যাসো আর লুকাস চোখাচোখি করে চোখ টিপল। দুজনেই বুঝে ফেলল কিছু একটা ঘটেছে আর কি ঘটেছে,হিহিহি।এলিজাবেথ, রিচার্ড এসে দাঁড়াল তাদের সামনে। রিচার্ড এলিজাবেথকে সোফায় বসিয়ে নিজে হাঁটু গেড়ে বসে গেল সোনালী কেশরাশি রুশকন্যার পায়ের কাছে। এলিজাবেথ প্রথমে অবাক হলেও পরক্ষণেই চোখে ফুটে রূপোলি দীপ্তি রিচার্ডের হাতে ধরা সেই সিন্ডেলা শো’র ঝলকে। নিঃশব্দে, নিঃস্পৃহ ভঙ্গিতে রিচার্ড তা পরিয়ে দিল এলিজাবেথের পায়ে। অদ্ভুদ সুন্দর ভাবে মিশে গিয়েছে এলিজাবেথের পায়ের সাথে। রিচার্ড উঠে দাঁড়াল৷ পেছনে ফিরে একবার তাকাল ন্যাসো আর লুকাসের দিকে। অতঃপর ঠাণ্ডা ভঙ্গিতে কপালের কোণে বুড়ো আঙুল ঘষতে ঘষতে বলল,
“আম… একটা নতুন ভেনিটির অর্ডার দাও। এন্ড মাস্ট আগেরটার মতোই হওয়া চায়, সাদা রঙ।”
‘ছটফটে লুকাস সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা প্রশ্ন ছুড়ে দেয়,”কেন বস? এই তো সেদিনই তো ওটা এল। এখনই আবার কেন? কি হয়েছে?”

‘রিচার্ড একবার তাকাল চোখ নামিয়ে রাখা এলিজাবেথের দিকে। তারপর নিচু গলায় এমনভাবে যেন কথাটা ধোঁয়ার মতো উবে যায় বাতাসে, বলল,
“ভেঙে গেছে।”
‘তারা দু’জন একে-অপরের দিকে আড়চোখে দৃষ্টি মিলিয়ে বাঁকা হাসল। লুকাস একঝলক তাকাল রিচার্ডের বাহুর ফাঁক দিয়ে চোখ গিয়ে ঠেকল এলিজাবেথের ওপর। মুহূর্তেই সবার মতো সেও ভুলটা করে ফেলল। ফিসফিস করে ডাকল রুশকন্যা এলিজাবেথ’কে,
“পিংক।”
‘শব্দটা বাতাসে মিশে যাওয়ার আগেই রিচার্ড ঠাণ্ডা হাতে পকেট থেকে রিভলভার বের করল। লুকাস বুঝে গেল সে কী ভুল করেছে, আর কার সামনে। আর দাঁড়ায়নি। চর এক মুহূর্তও পায়ে রাখল না মাটিতে, দৌড় লাগিয়ে বেরিয়ে গেল হাওয়া কেটে। লুকাসের দৌড় দেখে ফিক করে হেসে উঠল এলিজাবেথ। পাশ থেকে ন্যাসোও হেসে ফেলল।

‘রাজধানীর সবচেয়ে বিলাসবহুল পাঁচতারকা হোটেল র‍্যাডিসন ব্লু। আজকের রাতটা শুধুই আভিজাত্যের, কেবল আমন্ত্রিতদের জন্য। দেশি-বিদেশি দিগন্ত ছোঁয়া ব্যবসায়ী, কূটনীতিক আর রয়েলসোসাইটির সদস্যরা একত্রিত হয়েছেন এই গৌরবময় সন্ধ্যায়। পুরো হোটেল নতুন রূপে সজ্জিত। ঝলমলে হলোও কেমন যেনো বিপজ্জনকভাবে শৃঙ্খলিত। চারপাশে কালো পোশাকে সজ্জিত নিরাপত্তার এক অদৃশ্য প্রাচীর। আপস্টেয়ারে হবে মূল পার্টি। নিচে প্রধান ফটকের সামনে এসে থামল এক ব্ল্যাক রোলস রয়েস তার পরপরই আটটি সুরক্ষা-জিপ। গাড়ি থামার সঙ্গে সঙ্গে নেমে এলো ন্যাসো আর লুকাস, তৎপর হাতে ডোর খুলে ধরল। ওদিকে গার্ডরা অস্ত্র হাতে সারিবদ্ধ পজিশনে দাঁড়িয়ে গেলো।চোখেমুখে নিঃশব্দ সতর্কতা।
‘রিচার্ড প্রথমে বেরিয়ে এলো। লোহমানবের চোখেমুখে সেই চিরচেনা অতল গম্ভীরতা। রিচার্ড এক সুনিপুণ ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে দিয়ে অভিন্ন স্বরে ডাকে,

“প্রিন্সেস এলিজাবেথ!”
‘এলিজাবেথ হাত রাখল রিচার্ডের করতলে। ভিতর থেকে এক অনবদ্য দৃশ্যের মতো আবির্ভূত হলো সে রিচার্ডের মেঘছোঁয়া জলচোখে চোখ রেখে। রিচার্ড শক্ত করে ধরল অগ্নিকেশী রূপবতীর হাত৷ তারপর রাজকীয় ভঙ্গিতে পা রাখল রেড কার্পেটে। অভ্যন্তরের দিকে শুরু হলো তাদের যাত্রা। আপস্টেয়ারের সিঁড়িতে পা রাখতেই এলিজাবেথ চোখে পড়ে এক অভিজাত বিশৃঙ্খলা। আলোকচ্ছটার নিচে দাঁড়িয়ে অর্ধনগ্ন নারীরা তৃষ্ণার্ত দৃষ্টিতে গিলে খাচ্ছে রিচার্ডকে। মুহূর্তেই এলিজাবেথের ভেতরে জ্বলে ওঠে ঈর্ষার দাবানল। সে রিচার্ডের বাহু শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। রিচার্ড একটু অবাক হয়ে ভ্রু কুঁচকে তাকায়।এলিজাবেথ দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
“স্টপ বিয়িং সো হ্যান্ডসাম, মি. কায়নাত।”
‘রিচার্ড কাত হয়ে কান দেয়, “হুহ?”

‘এলিজাবেথ চিবিয়ে চিবিয়ে ফিসফিস করে, “দেখুন না, মেয়েগুলো কেমন আপনাকে চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে।”
‘রিচার্ড তাকিয়ে দেখে তারপর ঠোঁট কামড়ে হালকা হাসে। গলায় বজ্রনিনাদের মত মাদকতা এনে বলল,
“উমহু, ওরা আমাকে দেখে না।ওরা তোমাকে দেখে হিংসে করছে। এত হ্যান্ডসাম স্বামী পেলে কে না জ্বলবে?”
‘এলিজাবেথের চোয়াল শক্ত হয়, “আর আপনি এতো কুল হয়ে এসে ওদের হিংসা করার সুযোগ দিচ্ছেন?”
‘রিচার্ড হাসে। ধীর স্বরে উত্তর দেয়,

“অফকোর্স না। প্রকৃত পুরুষ শত নারীর পেছনে ছোটে না, বরং নিরানব্বই জনকে জেলাস ফিল করায় একজনের জন্য। এবং এভিডেন্টলি, ইউ আর দ্য অবজেক্ট অব ইউনিভার্সাল এনভি, মিসেস কায়নাত।”
‘এই বলে রিচার্ড কোটের কলার সরিয়ে তার ঘাড় দেখায়। দৃশ্যমান হয় চামড়ে চিঁড়ে ধূসর রঙে খচিত হওয়া নতুন ট্যাটুসমূহ। গ্রীবায় ঈগলের দু’টি ডানা প্রসারিত হয়ে আছে তার নিচে ইটালিয়ান ভাষায় লেখা,”Te amo red”।ঠিক তার নিচেই এলিজাবেথের চোখের নিখুঁত প্রতিচ্ছবি।ধূসর রেখায় আঁকা এক জোড়া গভীর চোখ। চোখে জল আসে এলিজাবেথের। শরীর জুড়ে ভালোবাসার উষ্ণ ঢেউ বয়ে যায়।
‘রিচার্ড ঠোঁট কামড়ে হাসল। এলিজাবেথের চোখে ভাসমান ঈর্ষার দগ্ধ ছায়া দেখে এক অদ্ভুত সুখ পেল। হঠাৎই করেই মাথায় চেপে বসে দুষ্টুমি। এ অনুভূতির গভীরতা কতদূর দেখে নেওয়াই যাক। রিচার্ড হেলে পড়ল এলিজাবেথের কানের কাছে। ফিসফিসে স্বরে বলল,

“এতো যে জ্বলন হচ্ছে, যদি সত্যি সত্যি কারোর প্রতি মুগ্ধ হয়ে পরকীয়ায় লিপ্ত হই, তখন?”
‘এলিজাবেথের চোয়াল শক্ত হয়ে উঠল তৎক্ষনাৎ। চোখে জ্বলে উঠল দহন। আশপাশে কে আছে, কে দেখছে, কিছুই ভাবল না । পাশের টেবিল থেকে নিঃশব্দে তুলে নিল এক ধারালো ছুরি। ঠেসে ধরল রিচার্ডের কণ্ঠনালিতে। কণ্ঠে বিষ মিশিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,
“সোজা আল্লাহু আকবার করে দেবো।”
‘রিচার্ডের চোখে একটুও ভয় নেই। বরং হালকা হাসি খেলল ঠোঁটে। সেই হাসি যেন আগুনে ঘি ঢালে। এলিজাবেথ মুহূর্তেই একটানে বের করল রিচার্ডের রিভলবার। সরাসরি তাক করল কপালে। তবুও রিচার্ডের মধ্যে বিন্দুমাত্র ভাবান্তর নেই।

পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ন্যাসো ছুটে এসে ঢাল হয়ে দাঁড়াল রিচার্ডের সামনে। লুকাস তো হতভম্ব। কিন্তু এলিজাবেথ দক্ষ হাতে ন্যাসোর বাহুর ফাঁক গলে রিভলবারের মাথা বরাবর আবার রিচার্ডের কপালে স্থির রাখে। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে নিস্তব্ধতা ছিঁড়ে ন্যাসোর গলা দিয়ে বেরিয়ে আসে,
“হলি শিট।”
‘রিচার্ড ন্যাসোর কাঁধে হাত রেখে তাকে সরিয়ে দেয়। ঠান্ডা গলায় বলে,
“সাইড। শি ইজ এক্সপার্ট নাও। আই ট্রেইন্ড হার।”
‘ন্যাসো, লুকাস দু’জনেই সরে যায়। হ্যাঁ, রিচার্ড নিজ হাতে গড়ে তুলেছে এলিজাবেথ’কে। শিখিয়েছে অস্ত্র চালাতে,গাড়ি চালাতে, শিখিয়েছে বাঁচতে, লড়তে। রিচার্ড এগিয়ে আসে। এলিজাবেথের হাত থেকে ধীরে রিভলবারটি নিয়ে পকেটে রাখে। তারপর পিছন থেকে কাঁধে আলতো চাপ দেয়। দুজনেই চুপচাপ তাকিয়ে থাকে সামনের এক যুগলের দিকে।রিচার্ড নরম গলায় বলল,

“সুন্দর না?”
‘এলিজাবেথ সুপ্ত আঁখিতে দেখল একজোড়া সুখী দম্পতি। তাদের কোলে ছোট্ট একটা মেয়ে শিশু। শিশুটির নিষ্পাপ হাসিতে হাসি ফুটে উঠল এলিজাবেথের ঠৌঁটে। দৃষ্টি না ফিরিয়ে অস্পষ্টতায় আওড়ায় সে,
“হুম।”
“আজকে থেকে আর ওই ওষুধগুলো খাবে না, ওকে?”
‘বুঝতে পারল না এলিজাবেথ। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে রিচার্ডের দিকে তাকাতেই সে ইশারায় ভ্রু উঁচালো। সঙ্গে সঙ্গে তলপেটে মোচড় দিয়ে ধরল এলিজাবেথের। লাজুক হেসে মাথা নুইয়ে ফেলল সে।
“হেই, মি.কায়নাত।”
‘রিচার্ড এলিজাবেথকে আড়াল করে পিছন ফিরে দাঁড়াল। লাবাক্সো কোম্পানির সিইও-র সঙ্গে একরকম জোর করে সৌজন্য হাসি ছুঁড়ে দিয়ে হাত মিলিয়ে নিল। তবুও এলিজাবেথকে আড়াল করা গেল না৷ ভদ্রলোকের চোখ ঠিকই খুঁজে নিল তাকে। রুশকন্যার অপরূপ সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ হয়ে আপন মনে বিড়বিড় করে উঠল সে,
“রাশিয়ান।”

‘লোকটা এগিয়ে এলিজাবেথের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। এলিজাবেথ নিখুঁত কৌশলে সেই হাত এড়িয়ে গেল নরম সৌজন্য হাসি ছুঁড়ে দিয়ে। ভরা পার্টির মাঝে এমন প্রত্যাখ্যানে আঘাত লাগল লোকটার মেল ইগোতে। রিচার্ডের দিকে তাকিয়ে একরাশ বিদ্রূপ নিয়ে বলল,
“মি. কায়নাত, ইওর ওয়াইফ হ্যাজ সো মাচ অ্যাটিটিউড।”
‘রিচার্ডের চোখে অদ্ভুত এক গর্বের দীপ্তি। এলিজাবেথের কোমরটা আলতো করে নিজের কাছে টেনে নিয়ে স্টেজের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে শান্ত কণ্ঠে বলল,
“দ্যাটস হোয়াই শি ইজ মাই ওয়াইফ।”

‘চন্দনের হালকা গন্ধ মেশানো বাতাসে মোড়া এক অভিজাত সন্ধ্যা। হলঘর জুড়ে গোল করে সাজানো টেবিলগুলো প্রত্যেকের নিজস্ব আলোয় আলোকিত। টেবিলের উপর রাখা ক্রিস্টাল গ্লাসে ঢালা রয়েছে শ্যাম্পেন, বুরবন আর রেয়ার রেড ওয়াইন। প্রতিটি টেবিলে ফ্লোরাল সেন্টারপিস, সাদা গোলাপ আর কালো অর্কিডে গাঁথা। স্টেজের এক কোণে ধবধবে স্যুট পরা হোস্ট মাইক্রোফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকলেও সকলের নজর ঠিক সেদিকে নয়। রিচার্ড, শহরের ভয়ংকর গ্যাংস্টার বস সামনের সারির টেবিলে এলিজাবেথকে সঙ্গে নিয়ে বসেছে। চারপাশে আলতো গুঞ্জন। রিচার্ডের মনে হঠাৎ কেমন একটা অদ্ভুত খটকা লাগে। অ্যাওয়ার্ড ফাংশনের নামে এত গার্ড, এত তীক্ষ্ণ নজরদারি?চারপাশটা একবারে ঘুরিয়ে দেখল রিচার্ড। সমুদ্র নীল চোখে ধরা পড়ে সাজানো পরিপাটি মুখের আড়ালে চাপা উত্তেজনা। তার দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা বলে দেয় কিছু একটা ঘটতে চলেছে। এলিজাবেথ একটু দূরে বসেছিল৷ কিন্তু রিচার্ড সেই দূরত্বটুকুও সহ্য করল না। চেয়ারের নিচে হাত বাড়িয়ে টেনে নিল তাকে নিজের একেবারে সন্নিকটে। চারপাশের কিছু অতিথির মুখে তখন চাপা হাসি, শুরু হয় কানাঘুষা।

‘দূর থেকে হঠাৎ ন্যাসোর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল এলিজাবেথের। ন্যাসো হাত ইশারায় জানাল একটু সাইডে আসতে। ওদিকে মাইকে রিচার্ডের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। গলার কাছে একটা শুকনো ঢোক গিলল এলিজাবেথ। রিচার্ডের কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল,
“আই নিড টু গো টু দ্য ওয়াশরুম,ইট’স এ্যান ইমারজেন্সি।”
“ওকে, চল।”
“না, না।আপনার নামই তো বলল এখন। আই ক্যান ম্যানেজ।”
‘রিচার্ড আর কিছু বলল না। এলিজাবেথ উঠে যেতেই দূর থেকে লুকাসকে চোখে-চোখে ইশারা করল নজরে রাখতে। সকলের কানে ব্লুটুথ সংযুক্ত। ব্লুটুথেই লুকাস ‘ওকে’ জানাল। এলিজাবেথ একটানা হেঁটে নিচতলায় চলে গেল। ন্যাসো আগেই ওয়াশরুমের পাশে অপেক্ষায় ছিল।
“রিপোর্ট এসেছে?”
‘এলিজাবেথের প্রশ্নে ন্যাসোর মাথা নেমে এল। চোখেমুখে স্পষ্ট হতাশা। বলল,
“স্যরি ম্যাম,একটা ব্লান্ডার হয়ে গিয়েছে।”
“কি হয়েছে?”

“ল্যাব থেকে রিপোর্টটা চুরি হয়ে গেছে। এমনকি শিশিটাও—যেটা আপনি এনেছিলেন,সেটাও উধাও।”
‘আলো নিভে গেল এলিজাবেথের অন্তরে। এটাই তো সেই শিশি যেটা সে চাচার বাড়ি থেকে উদ্ধার করেছিল। কিছুক্ষণ নিঃশব্দ দাঁড়িয়ে থেকে কাতর চোখে ন্যাসোর দিকে তাকিয়ে বলল,
“আপনি কি আমাকে কোনো তথ্য দিয়ে সাহায্য করতে পারবেন?”
“স্যরি ম্যাম,বস আমাদের ইন্টারনাল কিছুই বলেন না। আমরা শুধু অর্ডার ফলো করি।”
‘ন্যাসো কিংবা লুকাস কেউই জানে না রিচার্ড কেন এতটা নির্মমভাবে হত্যা করেছিল ইকবাল সাহেবকে।তারা শুধু আদেশ পেয়েছিল।কারণ জানতে চায়নি, সাহসও করেনি।এতদিনেও ন্যাসো এলিজাবেথকে কিছু বলেনি তার চাচা ইকবাল সাহেব সম্পর্কে। এলিজাবেথও জিজ্ঞেস করেনি।অন্তত সরাসরি নয়। তবু নীরবতার ভেতর এক ধরনের চাপা অনুসন্ধান চলেছে তার। প্রশ্ন না করেও এলিজাবেথ কিছুটা বুঝে ফেলেছে৷ একেকটা আচরণ, একেকটা নীরবতা যেনো ধীরে ধীরে মিলে যাচ্ছে এক অদৃশ্য মানচিত্রে। এলিজাবেথ জানে না সবটা।তবে বুঝতে পারছে ঠিকই কী ঘটেছিল চাচার সঙ্গে। কিন্তু সেই বোঝাটা এখনো মুখে আনছে না। সত্যিটা জানার চেয়ে অজানাটাকে ঘিরেই তার ভিতরে গড়ে উঠছে এক নিঃশব্দ প্রতিশোধ।

‘মাইকে ঘোষণা ভেসে এল,
“দিস ইয়ার’স এক্সেলেন্সি অ্যাওয়ার্ড গোজ টু রিচার্ড কায়নাত!”
‘গমগমে হলরুমে মুহূর্তেই করতালির ঝড় বইলো। স্টেজে উঠে এওয়ার্ড হাতে দাঁড়াল রিচার্ড। হোস্ট উচ্ছ্বসিত স্বরে বলল,
“কনগ্র্যাচুলেশনস, মি. কায়নাত!”
‘রিচার্ডের কণ্ঠে গাম্ভীর্য। স্বল্প বাক্যে বলল,”থ্যাংক ইউ।”
“এই সম্মাননা আপনি কাকে উৎসর্গ করবেন?”
‘রিচার্ড চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। কারও উপস্থিতি খুঁজল কিন্তু না সেই মানুষটা নেই। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে এক চিলতে হাসি খেলাল অধরে। বলল,
“দিস অ্যাওয়ার্ড ইজ ফর মাই ওয়াইফ।”
‘হলরুমে একটা হালকা শিহরণ ছড়িয়ে পড়ল। কারও চোখে ঝিলিক, কারও চোখে বিস্ময়। হোস্ট হাসল প্রশংসায় ভরা মুখে,

“ওয়াহ! শি মাস্ট বি সো লাকি। উই ক্যান অল ক্লিয়ারলি সি মিস্টার কায়নাত’স ডিপ লাভ ফর হিজ ওয়াইফ। সো, মিস্টার কায়নাত, কুড ইউ শেয়ার সামথিং দ্যাট উড হেল্প আস আন্ডারস্ট্যান্ড দ্য ডেপথ অফ ইয়োর লাভ ইভেন মোর প্রফাউন্ডলি?”
‘রিচার্ড চোখ বন্ধ করল এক মুহূর্তের জন্য। সে এখন আর অনুভূতি প্রকাশ করতে ভয় পায় না, কোনো সংকোচ কাজ করে না তার ভেতর। নিঃশ্বাস টেনে নিয়ে চাপা স্বরে নির্দ্বিধায় বলে ফেলল,
“আই অ্যাম ডোনেটিং ওয়ান অফ মাই কিডনিজ টু হার।”

‘এক পলকে থেমে গেল চারপাশের শব্দ। যেনো বোমা ফাটল নীরবতার মাঝখানে। সবার চোখ রিচার্ডের দিকে বিস্ময়ে, শ্রদ্ধায়। কেঁপে উঠল এলিজাবেথের আড়ষ্ট কায়া। মাইকে উচ্চারিত প্রতিটি শব্দগুলো যে তার শরীরে বিদ্যুৎ বয়ে দিল। এলিজাবেথ ছুটল হলরুমের দিকে। পিছনে ছুটল ন্যাসো আর লুকাস। দু’জনের কারও ধারণা ছিল না এই সিদ্ধান্তের কথা। এলিজাবেথের ব্লাড গ্রুপ ছিল অত্যন্ত রেয়ার। রিচার্ড চেয়েছিল কেবল একজন নারী ডোনার। কিন্তু বহু খোঁজেও কাউকে পাওয়া যায়নি। সময় ফুরিয়ে আসছিল। শেষমেশ রিচার্ড সিদ্ধান্ত নেয় তারই একটি কিডনি যাবে এলিজাবেথের শরীরে। নিজের রক্ত Exchange Transfusion করে নিজের শরীরকে রেডি করেছিল রিচার্ড। কারণ ডাক্তার স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে কিডনি দিতে হলে রক্তের ম্যাচ ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় নেই।

‘ছুটতে ছুটতে মেয়েটা এসে দাঁড়াল সেই নরপিশাচের সামনে। লোকটা হৃদয়হীন, তবুও বারবার ভালোবাসার সংজ্ঞা পাল্টে দেওয়া এক মানুষ। বুকে হাত চেপে অস্বাভাবিক ভাবে হাঁপাচ্ছে এলিজাবেথ। লোকে বলে ভালোবাসলে বলতে হয়, প্রাণ খুলে উজাড় করে দিতে হয়। তাহলে রিচার্ড কেন সবসময় ব্যতিক্রম? সে তো সীমালঙ্ঘন না করেও বারবার বলে ভালোবাসি। মুখে নয়, চোখে এবং একশনে বোঝায় কতটা ভালোবাসে। কিন্তু কীভাবে? কী করে? এমন ভাঙা বুক নিয়ে এমন নির্বিকার মুখে! এমন অব্যক্ত চিৎকারে!
‘অগ্নকেশী কন্যার ওষ্ঠ কাঁপে। আঁখিদ্বয় টইটম্বুর সুখের ছোঁয়ায় ভেজা অশ্রুতে। রিচার্ড মাথা নাড়িয়ে হেসে ওঠে। চোখের ইশারায় জানান দেয় এই অশ্রু কষ্টের অংশও হতে দেবে না সে। ভালোবাসার ক্ষেত্রে খুবই হিংসুটে আর হিসাবি লোক ট্রিলিয়নায় গ্যাংস্টার বস। একফোঁটা অশ্রু বিসর্জন মানেও অনেক বড়সড় লস।
‘অযাচিত কিছুর ভারে গলা জড়িয়ে আসে রিচার্ডের। কঠিন ঢোক গিলে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নেয়। কাতর চোখ দু’টোতে তাকিয়ে থাকতে পারছে না আর। ঘাড় ঘুরিয়ে নেয়। কিন্তু বেশিক্ষণ নয়। হঠাৎ করেই চকিতে ফিরে তাকায় আর সকলের সামনে কণ্ঠ উথলে চিৎকার করে বলল,
“জানের থেকেও বেশি ভালোবাসি, এলি জান!”

‘এলিজাবেথ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারল না। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল সে৷ ছুটে গেল রিচার্ডকে জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু ঠিক তখনই রিচার্ডের পেছনের বিশাল স্ক্রিনে ঝলসে উঠল আলো। থমকে গেল এলিজাবেথের পা। স্ক্রিনে চোখ যেতেই রক্তশূন্য হয়ে উঠল মুখ। যেনো পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল। শরীর দুলে উঠল এদিক-সেদিক। সামলে নিতে চাইল নিজেকে কিন্তু পারল না। স্ক্রিনে বিকৃত করা এক ছবি৷ তারই মুখ। নিচে লেখা দাম—একশো মিলিয়ন ডলার। পাশে টাইমার আরেকটি কলামে ক্রমশ বাড়ছে সেই মূল্য। ভেসে উঠছে অজস্র কুৎসিত মন্তব্য, লালসায় ভরা, বিকৃত ভাষায় লেখা মন্তব্য।

‘নিজেকে ভূমিকম্পের ঠিক কেন্দ্রবিন্দুতে আটকে থাকা এক নিকৃষ্ট কীটের মতো মনে হলো এলিজাবেথের। চারপাশে গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ছে। চোখের পলকে বদলে যাচ্ছে পার্টির সবার মুখাবয়ব, অভিব্যক্তি। কেউ-ই যেনো এখন আর অতিথি নয় বরং হিংস্রতা-জর্জরিত শিকারি। রিচার্ড এলিজাবেথের দৃষ্টির উৎস অনুসরণ করে ঘুরে দাঁড়ায়। এক মুহূর্তেই তার রক্ত মাথায় উঠে যায়। সামনে রাখা ওয়াইনের গ্লাস ছুড়ে মারতে উদ্যত হয় স্ক্রিনে, কিন্তু তার আগেই সেই স্ক্রিন নিভে যায় রহস্যময় ভাবে। তবু যা হওয়ার তা হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। পাশে থাকা বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষেরা টাকার বান্ডিল ছুঁড়তে শুরু করে এলিজাবেথের শরীরের দিকে। এলিজাবেথ জমে আছে নিশ্চল, নিঃস্পন্দ। শরীরে অনুভূতি নেই। কেবল চোখ বেয়ে ঝরে পড়ছে অশ্রু টপ টপ করে।

‘রিচার্ড ছুটে আসে। নিজের কোট খুলে জড়িয়ে দেয় এলিজাবেথের গায়ে। ন্যাসো, লুকাস স্তব্ধ। ঠায় দাঁড়িয়ে।
সবার লালসায় পোড়া চোখ থেমে আছে এলিজাবেথের উপর। ঠোঁটের কোণে বিকৃত হাসি, আর কি বিকৃত ভাষা।রিচার্ডের সাইকো মস্তিষ্কে হিংস্রতা জেগে ওঠে। চোখদুটি পশুর মতো জ্বলজ্বল করে ওঠে। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
“আর একটা কথা, আর একটা শব্দ কারোর মুখ থেকে বের হলে রক্তের বন্যা বইয়ে দেবো আমি।”
‘একজন বিদেশি ব্যবসায়ী কটাক্ষ ছুড়ে দিলো,
“ছিঃ মি. কায়নাত, এমন এক বাজারি মেয়ের জন্য এত আবেগ? যা একেবারেই অপ্রাসঙ্গিক। এমন মেয়েকে ভালোবাসা দিয়ে কী হবে? টাকা ছুঁড়লেই ঘরে আনা যায়।”
‘রিচার্ড গর্জে উঠল,”সে বাজারি না,সে আমার স্ত্রী!”
‘বিদ্রূপ থামলো না। আরেকজন এগিয়ে এসে বলল,
“কিন্তু নাম তো উঠেছে পতি'”তা”দের সাইটে। শেষমেশ একটা বে”শ্যা’কে ঘরে তুললেন? শেম অন ইউ, মিস্টার কায়নাত!”
‘রিচার্ড দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

“পুরুষ মানুষের ভালোবাসা সত্যি হলে সে বেশ্যাকেও ঘরের রাণী বানিয়ে রাখে।”
‘পাশ থেকে আরেকজন হাসতে হাসতে বলে,”আপনাদের মতো লোকের মুখে এসব বুলি মানায় না, বস। বলুন, এখন কত দিলে ছাড়বেন?”
‘এলিজাবেথের সহ্যের সীমা ভেঙে গেল। ডুকরে উঠল। রিচার্ড শক্ত করে ওর মাথাটা নিজের বুকের সঙ্গে চেপে ধরে।কিন্তু ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে জঘন্যতম পর্ব। নিলাম।পদেশি-বিদেশি ব্যবসায়ী আর আন্ডারগ্রাউন্ড মাফিয়ারা একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ডলার এমনভাবে ছুঁড়ে দিচ্ছে যেনো কেউ একজনের আত্মাকে কিনে নিচ্ছে।
“দেড়শো মিলিয়ন!”
“দুইশো মিলিয়ন!”
“তিনশো মিলিয়ন!”
“পাঁচশো মিলিয়ন!”

‘কেউ ভাবছে না কেবল বলে যাচ্ছে। রিচার্ডের সমুদ্র নীল চোখে জমছে অগ্ন্যুৎপাতের জ্বালামুখ। মুষ্টিবদ্ধ হাতের শিরাগুলো গাঢ় রক্তে ফুলে উঠেছে। হুংকার দিয়ে উঠল রিচার্ড,
“ন্যাসো, এদের মরণের পাখনা গজিয়েছে। ব্যবস্থা করো। আর হ্যাঁ—ওদের ব্যাংক ব্যালেন্সের হিস্ট্রি আমার ম্যানেজারের কাছে পাঠিয়ে দাও। এই মুহূর্তে,আজ, এই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমি ওদের সমস্ত সম্পত্তি কিনে নিলাম।”
‘সকলেই শুকনো ঢোক গিলে এক পা পিছিয়ে যায়। তবে একজন নড়েনি। ঠান্ডা গলায় বলল,
“আমাদের অত সহজ ভাববেন না, মি. কায়নাত। আমরা প্রস্তুতি নিয়েই এসেছি। এই মেয়েটিকে এক রাতের জন্য হলেও আমার চাই-ই চাই।”
‘রিচার্ড দাঁত চেপে বলল,”এই জিভ দিয়ে আমার স্ত্রীর সম্পর্কে আর একটা কথা বেরুলে, সেই জিভ থাকবে তার পায়ের নিচে।”

‘লোকটা আবার মুখ খুলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই রিচার্ড হিংস্র বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে হাঁটুর ওপর এমনভাবে আঘাত করে যে লোকটা চিৎকার করে বসে পড়ে। তারপর কোনো বিলম্ব না করে রিচার্ড তার গলায় আঘাত করে কণ্ঠনালি চূর্ণ করে দেয়। হাড়ের ভিতর চিঁড়ে ওঠা শব্দে ঘরের বাতাস কেঁপে ওঠে। এক হাতে লোকটার জিভ চেপে ধরে, অপর হাতে পাশের টেবিল থেকে ভেঙে নেয়া গ্লাসের টুকরো দিয়ে জিভে সজোরে টান দেয় রিচার্ড। র’ক্তা’ক্ত জিভটা মাঝখান থেকে ছিঁড়ে বেরিয়ে আসে।হলরুম জুড়ে শীতল শিহরণ। লোকটা ছটফট করে ফ্লোরে পড়ে যায়। রিচার্ড সেই রক্তে ভেজা জিভটা ছুঁড়ে ফেলে এলিজাবেথের পায়ের কাছে। শিউরে উঠে পিছিয়ে যায় এলিজাবেথ। রিচার্ডের চোখে তখন আর কোনো হুঁশ নেই। সে ছুটে গিয়ে একহাতে ওর কোমর চেপে ধরে শূন্যে এলিজাবেথের হিলের সেই তীক্ষ্ণ আগ্নেয় হিল দিয়ে বিঁধে দেয় সেই ছিন্ন জিভটায়। এবার এলিজাবেথ চিৎকার করে ওঠে। খামচে ধরে রিচার্ডকে।

‘কেউ একজন চিৎকার করে গার্ড ডাকল। হুড়মুড়িয়ে ঢুকতে থাকে শতশত নিরাপত্তারক্ষী। রিচার্ড ততক্ষণে বুঝে গেছে এই ফাঁদ পূর্ব পরিকল্পিত। ন্যাসো, লুকাস এক ঝটকায় অস্ত্র বের করে রিচার্ড ও এলিজাবেথকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে যায়। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে আতঙ্ক। তবে গার্ডদের সংখ্যা প্রচুর। শুরু হয় মারামারি। বন্দুকের গর্জনে কেঁপে উঠছে চারদিক। এলিজাবেথের শরীর কাঁপছে।রিচার্ড লুকাসকে ডাক দেয়,
“লোকা?”
‘লুকাস গুলি চালাতে চালাতে সাড়া দেয়,”জি বস?”
‘চোখে চোখে সব বলে দেয় রিচার্ড। লুকাস ছুটে গিয়ে বিশাল দরজাটা উপড়ে ফেলে গার্ডদের রুখে দেয়। সরু এক ফাঁকা পথ খুলে দেয় পালানোর জন্য। রিচার্ড শক্ত করে এলিজাবেথের হাত চেপে ধরে। হলরুম ছাড়বার আগে সে একবার গ্রীবা বাঁকিয়ে চোখ রাখে সেই মুখগুলোর দিকে যারা কুৎসিত কথা বলেছিল এলিজাবেথ’কে নিয়ে।ওরা ছুটে পালায় ওয়াশরুমের দিকে। ভেঙে পড়া এলিজাবেথের ঠোঁট টেপাটেপ কাঁপছে। চোখে সমুদ্রভরা কান্না। থরথর করে কাঁপছে রক্তিম ওষ্ঠধর। রিচার্ড ঢোক গিলল। কিছু না বলে ওকে টেনে বাথরুমে নিয়ে যায়। হঠাৎই কামড়ে ধরে এলিজাবেথের ঠোঁট। হতভম্ব হয়ে পড়ে এলিজাবেথ। ধাক্কা মেরে সরিয়ে দেয় রিচার্ডকে। কান্নায় ভেজা কণ্ঠে ঝাঁঝ মেশানো তীব্রতা নিয়ে বলল,

“পেছনে শত্রুরা তেড়ে আসছে আর এই অবস্থায়ও আপনার রোমান্স করতে ইচ্ছে হচ্ছে?”
‘রিচার্ডের কানে যেন কিছুই যায় না। ঠোঁটের দিকে আবারও ঝুঁকে এসে ঠান্ডা গলায় বলে,
“রোমান্সের সাথে শত্রুর কি সম্পর্ক? এটা মুডের বিষয়।”
‘এক ঝটকায় ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ধরে আবারও।এবার এলিজাবেথের ভেতরটা ফেটে যেতে চায়৷ চোখ ঝাপসা হয়ে আসে কান্নায়। সে সজোরে কিল-ঘুষি মারতে থাকে রিচার্ডের বাহুতে। হঠাৎই রিচার্ডের চোখে ভেসে ওঠে হলরুমের সেই বিকৃত মুখগুলো। তাদের ঘিনঘিনে হাসি, লোলুপ চাহনি। কুৎসিত মন্তব্যগুলো মাথার ভেতর ছুরি হয়ে গেঁথে যায়। রিচার্ডের চেতন জাগে৷ নিঃশব্দে সরে আসে এলিজাবেথের কাছ থেকে। দৃঢ় হাতে দরজাটা বাইরে থেকে লক করে দেয়।একবারও ফিরে তাকায় না। পিছন থেকে এলিজাবেথ কাঁদতে কাঁদতে চিৎকার করে ডাকে। কিন্তু সেই ডাকে কোনো জবাব নেই। রিচার্ড ফিরে গেছে তার সেই চিরচেনা পৈশাচিক আত্মায়। হলরুমের দিকে পা বাড়ায়। মৃত্যুর মঞ্চে নেমে যাচ্ছে এক নরকের নায়ক।

‘এবার ফেরা যাক অতীতে,,,,,
‘সেদিন তাকবীর এলিজাবেথকে সবটা বলেনি। এমন নয় যে সে চায়নি বলতে বরং ভয় ছিল এই নরম হৃদয়ের মেয়েটা যদি জানতে পারে তারই বাবা নিজের জীবন বাঁচাতে তাকে একপ্রকার নিলামে তুলে দিয়েছে, তাহলে মেয়েটা ভিতর থেকে ভেঙে পড়বে। একটিমাত্র সত্য তার জগৎটাকে ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারে এটা জানত তাকবীর।
‘ইলহাম বেনজির যখন বর্তমান মেয়র আর বিপক্ষে দলকে প্রতারণার মাধ্যমে ফাঁসিয়ে নিজে ক্ষমতায় বসেন তখন সেই সব নেতাদের জেলে পুরে দেন। কিন্তু জেলে যাওয়া মানেই তো খেলা শেষ নয়। বাইরে থেকে রয়ে যায় তাদের অন্ধকার জগতের সঙ্গীরা। তখনকার বর্তমান মেয়র জেতার জন্য তার সমস্ত সম্পত্তি বিক্রি করে দিয়েছিলেন এক ভিয়েতনামী ক্যাসিনো লিডারের কাছে। তার কাছ থেকে নিয়েছিলেন পঞ্চাশ মিলিয়ন টাকা। কথা ছিল নির্বাচনে জেতার পর পরিশোধ করবে। কিন্তু মেয়র যখন ধরা পড়ে ও জেলে যায় তখন সেই লিডার ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। সে রওনা দেয় রাশিয়ার দিকে টাকা আদায়ের আশায়। এখানেই মিলিত হয় দুই আগুন। ক্যাসিনো লিভার আর বিপক্ষ দলের সহযোগী মাফিয়া বস। একদিকে প্রতিশোধপরায়ণ বিরোধী পক্ষের এক জন্তু, আরেকদিকে অর্থ ফেরত চাওয়া ক্যাসিনো লিডার। কিন্তু ইলহাম তখন ছিল সরকারি নিরাপত্তার চাদরে মোড়া।

তাকে সরাসরি আঘাত করা সহজ নয়। কিন্তু যারা ছায়ার আড়ালে থাকে তারা তো আঘাত করে নীরবে। একবারেই কড়া ঘা। তারা মিলে জাল বিছাতে থাকে ছলনার।গোপনে হাত মেলায় ইতালির কুখ্যাত মাফিয়া ফাদারের সাথে। যার নাম শুনলেই তখন ইউরোপ কেঁপে উঠত। তাদের চক্র তখন পাকে পরিণত হয় আর সেই পাকে জড়িয়ে পড়ে তাকবীর আর এলিজাবেথের নিঃশ্বাসও।

‘ফাদারের ইলহাম বেনজিরের প্রতি ক্ষোভটা ছিল বহুদিনের। তার এক রিপোর্টেই ফাদারের কয়েকটি অবৈধ বিজনেস মুখ থুবড়ে পড়েছিল। প্রতিশোধ ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। রাশিয়ার মেয়র হওয়ার পরও ইলহাম সাংবাদিকতা ছাড়েননি। সে রাতে যখন কোরিয়া থেকে একটি মেইল আসে ইলহামের ইনবক্সে তখনও তিনি বুঝতে পারেননি সেটা ফাদারের ছক ছিল । প্রফেশনালিজমের প্রতি এমন বিশ্বাস ছিল যে তিনি একা রওনা দেন কোরিয়ার পথে কোনো নিরাপত্তা ছাড়াই। এয়ারপোর্টে নামতেই তাকে আটক করা হয়। চোখে কাপড় বেঁধে নিয়ে যাওয়া হয় ফাদারের প্রাসাদোপম ম্যানশনে। দরজা খুলতেই সামনে এসে দাঁড়ায় ক্যাসিনো লিডার৷ ইলহামের দিকে তেড়ে আসে সে। টাকার লোভে পাগল হয়ে গিয়েছিল ক্যাসিনো লিডার। শুরু হয় নির্যাতন৷ কঠিন, নৃশংস, ধৈর্যের সীমা ছাড়ানো নির্যাতন। কিন্তু ইলহাম কী বলবে? কাকে বলবে? কীভাবে বলবে যে সে আবারও লোভে পড়ে ভেবেছিল একটা বিশাল প্রজেক্টে টাকা ঢাললেই রাতারাতি মিলিয়নার থেকে বিলিয়নিয়ার হয়ে যাবে। আর এখন? তার একাউন্ট খুলে দেখলেই বোঝা যায় সব ফাঁকা। শূন্যতার মতোই নিঃসঙ্গ।

‘ইলহাম বেনজির যখন বুঝলেন যে ক্যাসিনো লিডার আর সহ্য করছে না তখন তিনি নিজেকে বাঁচানোর জন্য এক নিঃশ্বাসে বলে উঠলেন,তিনি তার সমস্ত অর্থ স্ত্রী ও মেয়ের নামে লিখে দিয়েছেন। জোর করেই একটি ফাঁদ তৈরি করেছেন যাতে তার স্বাক্ষরেই সেই অর্থ ছোঁয়া যায় না। এলিজাবেথ ও মিস এলিসার সম্মতি ছাড়া এক পয়সাও তোলা যাবে না। আর এলিজাবেথের বয়স এখন মাত্র বারো, বিশ না হওয়া পর্যন্ত সে সেই সম্পত্তির বৈধ উত্তরাধিকারীও নয়। তিনি সময় চাইলেন ক্যাসিনো লিভারের কাছে৷ বললেন, ঠিক আট বছর পর যখন এলিজাবেথ বিশে পা দেবে তখন সমস্ত অর্থ ফেরত দেবেন। কিন্তু অতীতের ছলনায় কেউ আর তার কথায় আস্থা রাখতে পারল না। ক্যাসিনো লিডার বুঝে গেলেন এ লোকের কথা বিশ্বাস করা মানেই আত্মঘাতী হওয়া। তখনই খেলায় নামল এক ভয়ংকর চাল। মেয়েকে, মাত্র বারো বছরের এলিজাবেথকে তুলে দিলেন নিলামে। ইলহামের ফোনে এলিজাবেথের ছবি দেখেছিলেন ক্যাসিনো লিডার। সেই ছবি তাকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল। শিশু বয়স থেকেই যেনো তার চোখে ছিল অভিশপ্ত সৌন্দর্যের এক ভয়ানক চুম্বক।
‘ক্যাসিনো লিডারের মাথায় ঘুরে গেল এক নতুন বুদ্ধি।

যদি ইলহাম প্রতারণা করেও বাঁচতে চায়, তাহলে এই মেয়ে দিয়েই তাকে গুঁড়িয়ে দেওয়া যাবে। এমনকি পঞ্চাশ মিলিয়নের বদলে হাজার হাজার মিলিয়নও উঠে আসতে পারে শুধুমাত্র এলিজাবেথকে বিক্রি করে। সেই রাতেই গোপনে চালু হল এক নিষিদ্ধ ওয়েবসাইট। একটি একান্ত নির্দিষ্ট প”র্ন সাইটে যেখানে “মেয়েরা” বিক্রি হয় উচ্চমূল্যে সেখানে পোস্ট করা হল এলিজাবেথের ছবি “আগাম বুকিং” দিয়ে। সেটি ছিল এক জঘন্য লেনদেনের নীল খসড়া, যেখানে মেয়েরা বিকোয় মাংসের মতো, দাম ওঠে দেহের নিষ্পাপতায়। ওয়েবসাইটটি তৈরি হয় এমনভাবে যেনো নিজের ইচ্ছেমতো সচল হওয়ার ক্ষমতা রাখে। কোনো পাসওয়ার্ড নেই, কোনো মানুষ এটিকে হাতে ধরে চালাতে পারবে না। শুধু একটাই শর্ত আজ থেকে ঠিক আট বছর পর যদি এলিজাবেথের বাবা চুক্তির অর্থ দিতে অস্বীকার করেন, তাহলে যেদিন এলিজাবেথের বিশ পূর্ণ হবে সে রাতেই সাইটটি নিজে থেকে খুলে যাবে। এবং বিশ্বের যেকোনো প্রান্ত থেকে যেকোনো মানুষ তখন প্রবেশ করতে পারবে সেই ওয়েবসাইটে এবং সেই রাতে এলিজাবেথ হয়ে উঠবে এক ‘বিক্রির জন্য উপলব্ধ’ নামমাত্র পণ্য। এটি সচল হলেই নিষ্ক্রিয় করা যাবে, এছাড়া এই সাইটের বন্ধ করার কোনো উপায় নেই। সেই সাইট’টি ছিল এক জাহান্নামের দরজা,যা তৈরি করা হয়েছে শুধুমাত্র পবিত্র মেয়েদের পতনের জন্য।

‘ক্যাসিনো লিডার নিজের হারানো টাকা উদ্ধারের পথ খুঁজে পেলেও প্রতিশোধের আগুন জ্বলতে থাকে ফাদার আর সেই মাফিয়ার ভিতর। একদিন ক্যাসিনো লিডারের অনুপস্থিতিতে তারা নৃশংসভাবে হত্যা করে ইলহাম বেনজিরকে৷ তারপর সেই মৃতদেহ পাঠিয়ে দেয় রাশিয়ায় যেনো কোনো চিহ্ন না থাকে। এটা সত্য তাকবীর কখনোই এলিজাবেথের বাবাকে হত্যা করেনি। কিন্তু ফাঁসিয়ে দেওয়া হয় তাকবীরকে তখন, যখন এলিজাবেথের মা, মিস এলিসা, বাংলাদেশে এসে মেয়েকে রেখে যান এবং কোরিয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নেন ইলহাম বেনজিরের খুনির খোঁজে। এই খবর পৌঁছে যায় ফাদারের কানে। ফাদার তখন সেই মাফিয়ার মাধ্যমে যার সঙ্গে তাকবীরের ভালো সম্পর্ক ছিল, যোগাযোগ করে তাজুয়ার দেওয়ানের সঙ্গে। তারপর এয়ারপোর্ট থেকে অপহরণ করা হয় মিস এলিসাকে। তাকবীরের সেই পুরোনো ‘ঠিকানা’ ঘরের নিচে থাকা এক গোপন কক্ষে বন্দি করে রাখা হয় তাকে নিভৃতে, আড়ালে। একই বাড়িতে থেকেও টের পায়নি এলিজাবেথ।

‘এরপর ফাদার আর তাজুয়ার হাত মেলায়। একসাথে শুরু করে কিডনি পাচারের কালোবাজারি। সেই অপরাধজগতে তাকবীরও যুক্ত হয়ে পড়ে। আর সেই রাতেই তাজুয়ার দেওয়ান হাত মেলায় ইকবাল সাহেবের সঙ্গে। চুক্তি হয় এলিজাবেথ প্রাপ্তবয়স্ক হলে তাকে বেচে দেওয়া হবে। সবাই ছিল একসাথে কিন্তু প্রত্যেকের ভেতর লুকিয়ে ছিল আলাদা, আলাদা প্রতারণা। ছোট এলিজাবেথ জানতই না সে জড়িয়ে পড়েছে এক ভয়াবহ ও নোংরা ষড়যন্ত্রের জালে। তাজুয়ার দেওয়ান চেয়েছিল তাকে ব্যবহার করে কুৎসিত এক বাণিজ্য গড়ে তুলতে, অথচ ফাদার তাকে কড়া নিষেধ দিয়েছিল মিস এলিসা’কে মারতে এবং এলিজাবেথের ক্ষতি করতে কারণ ফাদার একসময় ক্যাসিনো লিডারের কাছে দেওয়া ওয়াদা ভাঙতে চায়নি। তাজুয়ার পরিকল্পনা ছিল এলিজাবেথের স্বাক্ষর নিয়ে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে তারপর তাকে মোটা অংকের দামে বিক্রি করে দেবে। সেই বিক্রির অংশীদার ছিল ইকবাল সাহেবও। তাই সেদিন যখন রিচার্ড এলিজাবেথকে তুলে নেয়, ইকবাল সাহেব যে ছটফট করছিলেন তা ভাগ্নির দুঃখে নয় বরং তার গড়া স্বপ্নভাঙার আতঙ্কে।

‘তবে এসবের কিছুই জানত না তাকবীর। জানত না কে এলিজাবেথ, জানত না মিস এলিসার সাথে তার সম্পর্ক কী। এলিজাবেথ এসেছিল তার জীবনে একেবারেই হঠাৎ করে নিঃশব্দে, অজান্তে। সবকিছু জানার সূত্রপাত হয় তখন, যখন তাকবীর নিজে লোক লাগায় এলিজাবেথের পেছনে। আর জানতে পারে তাঁর বাবাও আগেই লোক লাগিয়েছিল মেয়েটির গতিবিধির ওপর নজর রাখতে। সন্দেহ ঘনীভূত হলে তাকবীর চাপে ফেলে তাজুয়ার দেওয়ানকে আর সেখান থেকেই খুলে যায় সত্যের পর্দা। তাকবীর জানতে পারে কে মিস এলিসা, কেন তাকে বন্দি করে রাখা হয়েছে, কী সেই রহস্যময় ওয়েবসাইট যার ছায়ায় শ্বাসরুদ্ধ হয়ে আছে অজস্র জীবন। সেদিন যেনো আকাশটাই মাথায় ভেঙে পড়েছিল তাকবীরের। বাস্তবের নির্মমতা তার বুকের ভেতরটা ছিঁড়ে দিয়েছিল নিঃশব্দে।

‘ফাদার ছিলেন সূক্ষ্ম বিশ্লেষণী মনের এক রহস্যময় খেলোয়াড়। যার পাশে দাঁড়াতেন তার অতীত, বর্তমান, এমনকি ভবিষ্যতের ইশারাও খুঁটিয়ে জানতেন তিনি। ঠিক সেভাবেই তাকবীরের অতীতে হাত দিলেই বেরিয়ে আসে তাকবীর আর রিচার্ড আসলে দুই ভাই। তবে ফাদার কখনও তা প্রকাশ করেননি। বরং কৌশলে দু’জনকে দিয়ে করিয়ে নেন এক প্রতিজ্ঞা—কেউ কাউকে মারবে না। তিনি চেয়েছিলেন না এই দুই রক্ত একে অপরের রক্তে ভিজে যাক। কৌশলে তিনি নিজেকে সরিয়ে নেন কিডনি প্রাচারের ব্যবসা থেকে সেই মাটির নিচের ঘর থেকে রিচার্ড’কে মুক্তি দেওয়ার আগেই। আড়ালে যোগাযোগ থাকলেও রিচার্ড জানত না তাকবীরের সঙ্গে ফাদারের এত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বা ফাদার যে শুরু থেকেই সব জানেন। এমনকি ফাদারই যে এলিজাবেথের বাবাকে হত্যা করেছিলেন তাও রিচার্ড জানতে পারে অনেক পরে যখন রিচার্ড রেশমা মা ও এলিজাবেথের কথপোকথন শুনে রাশিয়ায় গিয়ে খুঁজছিল এলিজাবেথের বাবার খুনিকে, মিস এলিসা’কে। সত্য জানতে পারলেও সে তৎক্ষণাৎ কিছু বলেনি। কিন্তু সেই মুহূর্ত থেকে জমে উঠতে থাকে ফাদারের প্রতি তীব্র ঘৃণা।

‘তবে তখনও রিচার্ড জানত না সেই ভয়ংকর ওয়েবসাইটের কথা যেটা ঘিরে তৈরি হয়েছিল এক কালো জগত। জানে তখন, যখন সে টের পায় বহিরাগত কেউ নজর রেখে চলেছে এলিজাবেথের উপর। একদিন সেই নজরদারদের একজনকে ধরে ফেলে রিচার্ড আর সেখানেই খুলে যায় সত্যের দরজা। শুরু থেকেই সেই ক্যাসিনোর মালিক লোক লাগিয়ে রেখেছিল এলিজাবেথের পেছনে। এই খবর জানার পর রিচার্ডের ভিতর উপচে পড়ে এক ভয়। সে হয়তো হারাতে চলেছে এলিজাবেথকে। পাগলের মতো ছটফট করতে থাকে সেই নিষিদ্ধ শহরের ওয়েবসাইট’টি নিষ্ক্রিয় করার পথ খুঁজতে থাকে, তবে পথ যে নেই।

‘প্রতিশোধের আগুনে জ্বলে উঠে রিচার্ড। এলিজাবেথের বাবার খুনের ন্যায় বিচার আদায়ে সে লুকাসকে পাঠায় রাশিয়ায়। লুকাস খুন করে বর্তমান রাশিয়ান মেয়রকে যিনি আট বছর আগে সেই খুনের কেস ধামাচাপা দিয়ে দিয়েছিলেন। আর রিচার্ড নিজে যায় ভিয়েতনামে, খুন করে সেই মাফিয়াকে, খুন করে সেই ক্যাসিনো লিডারকে। আর এই মিশনের ভেতর দিয়েই ঝুঁকিতে পড়ে গিয়েছিল তার জীবন স্ত্রীর সম্মান রক্ষার্থে তবু, এতকিছুর পরেও রিচার্ড কখনও এলিজাবেথকে বলেনি সত্যটা। কারণ সত্য জানলে এলিজাবেথ তাকে ভুল বুঝত। কারণ, সত্য মানে ফাদার, যে তার বাবাকে খুন করেছে। সত্য মানে নিজের চাচা, যার হাতেই বিশ্বাসঘাতকতার ছুরি। কিন্তু সত্য তো চিরকাল চাপা থাকে না। একদিন এলিজাবেথ জানতে পারত সবটা। তখন সে ভেঙে পড়ত তার বাবার রক্তাক্ত ইতিহাস শুনে, চুরমার হয়ে যেত চাচার মুখোশ। প্রথম থেকেই এলিজাবেথ ছিল অসৎ লোকদের লক্ষ্যবস্তু। তাই তো রিচার্ড নিজের হাতেই গড়ে তুলেছিল এলিজাবেথ’কে যেনো তার অবর্তমানে কেউ আর কখনও তাকে ছুঁতে না পারে। যেনো সে না থেকেও এক অদৃশ্য ঢাল হয়ে থাকে মেয়েটার পাশে। খারাপ ব্যবহারের মাধ্যমে কঠোর করেছে মেয়েটাকে, যাতে করে যেদিন সত্য সামনে আসবে, ভেঙে যেনো না যায়।
‘দ্বিতীয় প্রশ্ন তাহলে মিস এলিসা এখন কোথায়?

তাকবীর ও এলিজাবেথের বিয়ের নাটক যখন মঞ্চস্থ হয় তখনও মিস এলিসা বন্দি ছিলেন দেওয়ান মঞ্জিলে। কিন্তু রিচার্ডের দৃশ্যপটে আবির্ভাবের পরই ফাদার বুঝে যান এই মানুষটি,রিচার্ড যে অতীতের প্রতিটি গোপন দুঃস্বপ্ন তুলে আনবে আলোর মুখে। তাই আগেভাগেই খেলাটি সাজিয়ে রাখেন তিনি। তাকবীরকে তিনি নির্দেশ দেন এলিজাবেথকে ক্যালিফোর্নিয়া নিয়ে যেতে যাতে করে রিচার্ডও তার পেছনে সরে যায়। সেই ফাঁকে ফাদার রেয়ানের মাধ্যমে মিস এলিসাকে সরিয়ে নিয়ে যান ইতালিতে। এজন্যই তাকবীর আর এলিজাবেথ ইতালিতে পৌঁছানোর আগেই রেয়ান সেখানে উপস্থিত ছিল। আর এজন্যই মৃত্যুর আগে নাসির মোড়ল অস্পষ্টভাবে বলে গিয়েছিল “ফা…”। ফাদার ছাড়া এখন আর কেউ জানে না কোথায় আছেন মিস এলিসা।

কিন্তু ফাদারের মৃত্যু সেই রহস্যকেও নিয়ে যায় এক চোরাবালির গহ্বরে। শুরু থেকেই সবকিছুর মাস্টারমাইন্ড ছিল ফাদার। বিছিয়েছিলেন এমন এক মায়াজাল, যেখানে তাকবীর ছিল এক নির্বোধ গুটি আর রিচার্ড সেই দাবার ছক ভেঙে দেওয়া এক বিদ্রোহী চাল।
‘এখানেও একটি প্রশ্ন উঁকি দেয় তাকবীর, যেহেতু নির্দোষ তাহলে সে এলিজাবেথকে কেন সবটা বলেনি? উত্তর—ভয়। মিস এলিসা বন্দি থাকাকালীন বহুবার তাকবীরকে দেখেছেন। এখন যদি তাকবীর নিজ হাতে এলিজাবেথের কাছে তার মাকে ফিরিয়ে দেয় তাহলে এলিজাবেথও ভাবত তাকবীরই সবকিছুর মূল, তার বাবার খুনি, তার মায়ের বন্দিদশার কারিগর। আর সেই ভুল বোঝার ভয়ই তাকবীরকে বেঁধে রাখে। নিষ্পাপ হয়েও অপরাধীর মতো।

‘দীর্ঘক্ষণ পর দরজাটা ধাক্কা মেরে খুলে ঢোকে রিচার্ড হলরুমে রক্তের বন্যা বইয়ে দিয়ে। শার্ট রক্তে ভেজা। স্বচ্ছ আকাশের নীলরঙা চোখে একরাশ জেদ। এলিজাবেথের হাত চেপে ধরে রিচার্ড ছুটে চলে পিছনের গেইটের দিকে। চারদিক থেকে ভাঙা কাঁচের মতো চিৎকার আসছে। বহিরাগতরা ভিতরে ঢুকে পড়েছে। স্যালুনের গাউন আর হিল সিন্ডেলা শো’র এলিজাবেথ ঠিকভাবে দৌড়াতে পারছে না। রিচার্ড হঠাৎ থেমে যায়। চারপাশে নজর বুলিয়ে নিঃশব্দে এক হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে ওর সামনে। এক ঝটকায় গাউনের নিচের অংশ ছিঁড়ে ফেলে, হিল ছুঁড়ে ফেলে দেয় দূরে। তারপর আবার ছুট। পেছনের গেইটে পৌঁছানোর আগেই তারা দেখে সেখানে আর মুক্তির কোনো পথ নেই। আগুনের রেখার মতো ছড়িয়ে পড়ছে শত্রুদের ছায়া। রিচার্ড থমকে তাকায় এলিজাবেথের চোখে, তারপর ঠেলে দেয় ওকে এক কোণে। পরপরই রিচার্ড জানালার কাচ ভাঙে ধাতব আওয়াজে। কাচের টুকরো দিয়ে বানিয়ে ফেলল রক্তপিপাসু এক অস্ত্র।

‘আক্রমণ আসে একের পর এক। ঘুষি, লাথি, ছু'”রির কোপ রিচার্ড সব নিতে নিতে এক অদ্ভুত নাচে নেমে পড়ে মৃত্যু আর জীবনের মাঝখানে। কপাল থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে চোখে, তবুও রিচার্ড একবারও এলিজাবেথের দিক থেকে চোখ সরায় না। ওদিকে এলিজাবেথ দাঁড়িয়ে ভয়ের চূড়ান্ত সীমায়। ওর চোখে এখন কেবল এক দৃশ্য রক্তাক্ত রিচার্ড, যে একাই দাঁড়িয়ে আছে শত শত্রুর বিরুদ্ধে, শুধুমাত্র তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য। কান্না আসে এলিজাবেথের। আজ আর নিজেকে একা মনে হলো না। সহসা এক বুক সাহস সঞ্চয় করে নিচ থেকে তুলে নিল একটা শট গান।

‘এলিজাবেথ ঠিক যখনই শুট করতে যাবে, হঠাৎই পেছন থেকে ভেসে আসে দৌড়ে আসার শব্দ। হাতভর্তি মস্ত এক ছুরি নিয়ে ছুটে আসছে এক আগন্তুক! পায়ের আওয়াজে চমকে পেছন ফিরে তাকাতেই এলিজাবেথের চোখ ছানাবড়া। মৃত্যুর স্পর্শ যেনো নাকে এসে ঠেকে। ভয়ঙ্কর সেই লোকটা এতটাই কাছে যে আতঙ্কে দু’হাতে মুখ চেপে ধরে এলিজাবেথ। শুট করার আগেই তার জীবনের সমাপ্তি লিখে দিতে চাইলো সেই ছুরি! ঠিক সেই মুহূর্তেই একটি ছুরি ঘূর্ণন বেগে উড়ে এসে কণ্ঠনালিত থেকে মাথা ছিন্ন করে যায় ওই লোকটার। র”ক্ত ছিটকে পড়ে চারদিকে। মাং’স ছিঁড়ছে এমন এক কর্কশ শব্দে কেঁপে ওঠে এলিজাবেথ। চোখ খুলে তাকিয়ে তাকবীর’কে দেখতেই চমকে ওঠে সে।

‘আজ আর সেই গারদের পোশাক নেই তার গায়ে। কালো টি-শার্ট, উপরে ডেনিম জ্যাকেট, জিন্সের প্যান্টে তাকবীর যেনো একেবারেই অন্য মানুষ। চোয়ালের দাড়িগুলো সাফ করে ফেলা। আজকেই শেভ করেছে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। কাঁধ ছুঁই ছুঁই চুলগুলো কানের লতির বরাবর চুড়ো করে বাঁধা। এলিজাবেথ থমকে দাঁড়িয়ে দেখে এই নতুন তাকবীর’কে। তাকবীর পালিয়েছে পাগলাগারদ থেকে রেয়ানের সহায়তায়। রিচার্ড এই বিষয়ে না জানলেও তাকবীর জানত ওই ওয়েবসাইটে এলিজাবেথের বাবা ইচ্ছা করে ভুল জন্মতারিখ দিয়েছিল। শুধু তাই নয় সে জানত আরও কিছু যা কেউ জানে না। তাই তো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সব কিছু পেছনে ফেলে ছুটে এসেছে।

‘তাকবীর মাত্র আসছে বিয়ানের কাছ থেকে। আজ সে বিয়ানের গলায় ছুরি বসাতে যায়নি, গিয়েছে পায়ে পড়ে সাহায্য চাইতে। সেই কারণেই ওয়েবসাইটটি তখন বন্ধ
হয়ে গিয়েছিল। আর আজকের এই আক্রমণ গুলো? এটি সাধারণ কোনো পার্টি ছিল না। এটি একটি সাজানো ফাঁদ। ক্যাসিনো লিডার জানত ইলহাম বেনজির আর নেই। তাই টাকা পাবারও আর সম্ভাবনা নেই। সেই সুযোগে সে আন্ডারগ্রাউন্ড মাফিয়াদের কাছে ওয়েবসাইটের কথা বলে ‘প্রি-অর্ডারে’ টাকা তুলে নিয়েছিল আর তাদের হাতে তুলে দিয়েছিল এলিজাবেথের লোকেশন। আজকের পার্টি ছিল শুধু একটা মুখোশ।
‘তাকবীর পাগলের মতো ছুটে গেল সেই মাথাবিহীন লাশটার দিকে। পাশ থেকে রক্তমাখা ছুরিটা তুলে নিয়ে বুকে বারবার আঘাত করতে লাগল উন্মাদ আর অসংলগ্নের ন্যায়! কাঁপা কাঁপা গলায় গোঙাতে গোঙাতে বলতে থাকে বারবার,

“কুত্তার বাচ্চা! সাহস কেমন করে হলো আমার এলোকেশীর দিকে হাত বাড়ানোর! তোকে আজ আমি শেষ করে ফেলব।আজকেই!”
‘ওদিকে রিচার্ডের চোয়াল মটমট করে ওঠে তাকবীরকে দেখেই। চোখে ভরা হিংস্রতা নিয়ে সে তেড়ে আসে এলিজাবেথের দিকে। তেড়ে আসা একজন আক্রমণকারীকে নিচে ফেলে দিয়ে তার বুকের উপর পা দিয়ে চেপে ধরে এলিজাবেথের চোয়াল দু’হাতে চেপে ধরে। কণ্ঠে বর্বর উন্মাদনা নিয়ে বলল,
“তুই শুধু আমার হয়ে থাক এলিজান। এভাবে পুরো পৃথিবীকে পায়ের নিচে পিষে, সকলের সামনে তোর ঠোঁটে ঠোঁট মেলাব আমি।”
‘সঙ্গে সঙ্গেই ঠোঁট চেপে বসে এলিজাবেথের ওপর। তাকবীর থেমে যায়। নিস্পৃহ চোখে দেখে এই দৃশ্য। অনুভর করল পাথর হয়ে গেছে তার ভেতরটা। দু’চোখ থেকে অচেতনভাবে গড়িয়ে পড়ে দু’ফোঁটা অশ্রু। ঠিক তখনই ভেসে আসে আরও পায়ের শব্দ। তাকবীর মুহূর্তেই সজাগ হয়ে ছুটে যায় গেটের দিকে। এক ঝলক চোখে দেখে এলিজাবেথ আর রিচার্ডকে। তারপর চিৎকার করে বলে,
“পালাও!”
‘রিচার্ড কোনোদিন এলিজাবেথকে নিয়ে রিস্ক নেবে না। সে ছুটে যায় এলিজাবেথকে নিয়ে। আর তাকবীর? সে একাই দাঁড়িয়ে যায় মৃত্যুর মুখোমুখি। পেছন ফিরে চেঁচিয়ে ওঠে রিচার্ডের উদ্দেশ্যে,
“যেভাবেই হোক তোকে এলোকেশীকে বাঁচাতেই হবে!”

‘রিচার্ডের গাড়ির ইঞ্জিন আচমকা বন্ধ হয়ে গেল একটা পুরনো ব্রিজের ওপর। গতি থামতেই পিছন থেকে আরও পাঁচটা গাড়ি এসে তাদের ঘিরে ফেলে চারদিক থেকে। একটু দূরে থামে আরেকটা গাড়ি। সেটা তাকবীরের গাড়ি। এতক্ষণ নীরবে রিচার্ডের গাড়িকে কভার করে এসেছে সে। রিচার্ড দ্রুত গাড়ি থেকে বেরিয়ে এলিজাবেথকে নিয়ে ছুটল ব্রিজের এক কোণে।ওকে একটা তুলনামূলক নিরাপদ জায়গায় রেখে শুরু করল যুদ্ধ। একের পর এক আঘাতে ঘায়েল করতে থাকে আক্রমণকারীদের। ওদিকে তাকবীরও গাড়ি থেকে বেরিয়ে তাদের দিকে ছুটে আসতে যাচ্ছিল ঠিক তখনই রেয়ান এসে পিছন থেকে তাকবীর’কে আঁকড়ে ধরে। তার হাতে পাসপোর্ট আর টিকিট। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলে,
“বস, এখনই চলুন। আপনার ফ্লাইট কিছুক্ষণের মধ্যে। আপনি পাগলাগারদ থেকে পালিয়েছেন, এটা এখনো প্রকাশ হয়নি। ওয়ারেন্ট বেরোনোর আগেই আপনাকে দেশ ছাড়তে হবে।”

‘তাকবীর জোর করে হাত ছাড়াতে চায়। গলা রুদ্ধস্বরে বলে,
“আমি কোথাও যাব না, রেয়ান।”
“বস, আপনি বুঝছেন না কেনো আপনি ফাঁসির আসামি।”
“যে আঘাত পেলে ব্যথা আমি অনুভব করি, তাকে এই বিপদে ফেলে কোথায় যাব, রেয়ান? তুমি পালাও।”
‘রেয়ান হতাশ। চোখ নামিয়ে নিয়ে গলা নামিয়ে বলে,
“আপনাকে একা ফেলে কীভাবে পালাই, বস? সেদিন বৃষ্টির রাতে যদি আপনি আমাদের তুলে না নিতেন, শকুনে ছিঁড়ে খেতো আমাদের। আমার ভাই ভীতু, ভুলে গিয়েছি হয়তো কিন্তু আপনার দেওয়া নুনে আজও বেঁচে আছি আমরা।”

‘তাকবীর চুপচাপ তার কাঁধে হাত রাখে। কিছু বলে না। শুধু একবার তাকায়। তারপর ছুটে যায় সেই যুদ্ধের দিকে।যেখানে একা দাঁড়িয়ে আছে রিচার্ড আর কোণে লুকিয়ে আছে এলোকেশী, তাকবীরের নিঃশব্দ হৃদয়।
‘রিচার্ড হিংস্র জন্তুর মতো একের পর এককে নিধন করছে। চারপাশে শুধু আতঙ্ক আর মৃত্যুর গন্ধ। এমন সময় পিছন থেকে একটি রট উঁচিয়ে একজন তেড়ে আসে রিচার্ডের দিকে। রিচার্ড ঘুরে তাকিয়েই সুট করতে যাবে ঠিক তখনই হঠাৎ একটি গুলির ঝাঁঝ তার কপাল ভেদ করে বেরিয়ে যায়। মৃতদেহটা রিচার্ডের পায়ের সামনে গড়িয়ে পড়ে। চমকে উঠে রিচার্ড সামনে তাকায়। দেখতে পেলো এলিজাবেথ। হাতে ধরা বন্দুক। চোখেমুখে কি তেজ আর ঠোঁটে ব্যঙ্গ মিশ্রিত এক চওড়া হাসি। দৃষ্টিতে অদ্ভুত এক বোঝাপড়া খেলে যায় তাদের মধ্যে। দুজনেই হালকা বাঁকা হেসে নেয়। এলিজাবেথ নির্ভার পায়ে এগিয়ে আসে। ঠোঁটের কোণে সেই হাসি৷ দৃঢ় কণ্ঠে চাপা সুর,

“I am his and he is mine
in the end him and I”
‘রিচার্ডের সামনে এসে এক হাতে তার গলা জড়িয়ে ধরে এলিজাবেথ অন্য হাতে বন্দুক। হঠাৎ করে রিচার্ডের
ঠোঁটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দেয় এলিজাবেথ এই রণক্ষেত্রের মাঝে। সেই সঙ্গে বন্দুকের ট্রিগারে চাপতে থাকে। গুলি ছুটে গিয়ে বিঁধতে থাকে মৃতদেহে। কিন্তু অবকাশ নেই।আরও এক ঝাঁক প্রহরী যেন দানব হয়ে ছুটে আসছে তাদের দিকে। রিচার্ড এক হাতে জড়িয়ে ধরে এলিজাবেথের কোমর। এবার শুরু হয় একসাথে মৃত্যুর নৃত্য। দুজন, দুদিক থেকে, নিখুঁত ঘূর্ণনে ছুড়তে থাকে গুলি। প্রতিটি গুলি একেকটি চুম্বন, একেকটি প্রতিশোধ। ভেতরে থেকে আগুন বের হয় আর বাইরে মৃত্যু হয়। মৃত্যু আর আগুনের মাঝখানে তারা দুজন।

‘পুরো ব্রিজটা এক মুহূর্তেই নরকে পরিণত হয়। চারদিকে বিস্ফোরণের শব্দে কেঁপে ওঠে আকাশ। গাড়িগুলোতে আগুন লেগে লাল ছায়া ফেলছে র’ক্তমাখা লাশগুলোর গায়ে। বাতাস ভারী বারুদের গন্ধে। আর তার ভেতর নিঃশব্দে ছুটে চলেছে মৃত্যু। গুলির শব্দ যেনো একেকটা তাণ্ডবের রিদম। রিচার্ড, এলিজাবেথ আর তাকবীর তিন দিক থেকে ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে আক্রমণকারীদের । তাকবীর ছায়ার মতো দ্রুত ছুটে গিয়ে এক জনের গলা কেটে দেয় ছু’রি দিয়ে৷ তাজা রক্তে সিক্ত হয় মৃত্তিকা। এলিজাবেথ এক হাতে দুইটা ম্যাগাজিন বদলায়। ওর নিখুঁত নিশামায় প্রতিটি গুলি একেকটা মাথার ভেতর ঢুকে যাচ্ছে।
রিচার্ড একটা উল্টে যাওয়া ট্রাকের উপর উঠে গিয়ে দুই হাতে দুই গান তুলে নেয়। ঝড়ের গতিতে ঘুরতে ঘুরতে গুলি ছুড়ছে একজনের বুকে, আরেকজনের কপালে।
‘হঠাৎ ব্রিজের নিচে থেকে ওঠে আরেক দল শত্রু।
তাদের দিকে তাকিয়ে শুধুই হাঁসে রিচার্ড৷ দাঁতে কামড়ানো সিগারেট থেকে ধোঁয়া বেরুচ্ছে। বাঁকা হেসে আওড়ায়,

“Time to end the party.”
‘তাকবীর একটা গ্রেনেড ছুঁড়ে দেয় সেদিকে। এক ঝলকেই হাড়-মাংস ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে, ছিটিয়ে পড়ে এদিকসেদিক। আগুনের ঢেউ পুরো এলাকা গ্রাস করে।
ব্রিজ এখন ধ্বংসস্তূপ। রিচার্ড এক লাফে নেমে পড়ে ট্রাক থেকে। পিলারের পাশে পরে থাকা আধমরা এক ব্যক্তির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চেপে ধরে। বন্য জন্তুর মতো পেটাতে থাকে। পাশেই এলিজাবেথ ধূলোমলিন ও ক্লান্ত, এক পাশে হেলে বসে পড়েছে। রিচার্ড এতটাই উন্মত্ত, এতটাই তাণ্ডবে মত্ত যে আশপাশের দুনিয়া অদৃশ্য তার কাছে।
‘এই সুযোগে তাকবীর নীরবে তুলে নেয় পড়ে থাকা বন্দুকটা। ধোঁয়ার ভিতর থেকে চোখ রিচার্ডের ওপর আটকে যায় তার। ট্রিগারে আঙুল রাখে৷ তবে চাপ দিতে পারে না। বুকের ভেতর কোথাও কিছু একটা তাকে থামিয়ে দেয়। এক অদ্ভুত দ্বন্দ্ব। নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে রাগে বন্দুকটা ছুঁড়ে ফেলে দেয় তাকবীর৷ ঠিক তখনই ধোঁয়ার অতল থেকে ছুটে আসে একটি গুলি। তীব্র এক ঝাঁকুনিতে রিচার্ডের বুক ফেটে যায়। ছিটকে গিয়ে পড়ে রিচার্ড পিলারের ওপাশে।
“নাহহহহহহহ!”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬১ (২)

‘এলিজাবেথের গলায় উঠে আসে ছিন্নবিচ্ছিন্ন এক চিৎকার। ছুটে যায় সে রিচার্ডের দিকে। হাত বাড়িয়ে ছুঁতে চায় রিচার্ড’কে। কিন্তু তার আগেই রিচার্ডের শরীর গড়িয়ে পড়ে পানিতে। থমকে যায় এলিজাবেথের পৃথিবী। পাগলের মতো ছুটে গিয়ে পানিতে ঝাঁপ দিতে চায়। ঠিক তখনই পিছন থেকে তাকবীর এসে জাপটে ধরল ওকে। হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে এলিজাবেথ। সে যেতে চায় রিচার্ডের কাছে, বারবার ছটফট করে। তবে পারে না যেতে। শুধু ঘোলাটে চোখ দেখে কীভাবে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছে রিচার্ডের শরীর। একসময় আর দেখা যায় না রিচার্ড’কে। শুধু রয়ে যায় রক্তিম হয়ে ওঠা জল। এলিজাবেথ লুটিয়ে পড়ল।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬২ (২)