ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৮ (২)
মিথুবুড়ি
‘রিচার্ড বের হয়ে যাওয়ার পরপরই রেশমা গুটি গুটি পায়ে উপরে যায়। চোখেমুখে উদ্বিগ্নতা আর অস্থিরতায় ঠাঁসা। মানসিক ভাবে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয় এলিজাবেথের বিভৎস অবস্থায় দেখার জন্য। ফোঁস নিশ্বাস ফেলে ভিতরে পা রাখল রেশমা । যা ভেবেছিল তার থেকেও বিধ্বস্ত ভাবে আবিষ্কার করল এলিজাবেথ কে। তপ্ত শ্বাস ফেলল রেশমা, পরপর আহত এলিজাবেথ’কে নিয়ে ফ্রেস করিয়ে আনে। হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় গোসল করাতে জবুথবু হয়ে কাঁপতে থাকে গড়ন।
‘রেশমা আরেকটা কম্ফর্টার বের করে এলিজাবেথের গায়ে মুড়িয়ে দিল। একদম হিমালয় পর্বতের বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে আছে এলিজাবেথ। চোখেমুখে নেই কোনো অভিব্যক্তি। রেশমা নিষ্পকল তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ এলিজাবেথের রক্তশূন্য মুখে। গাঢ় গোলাপি ঠৌঁট জোড়া ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে। এই ক’দিনে চোখের নিচে কালো দাগ একদম আড়াআড়ি ভাবে জায়গা দখল করে নিয়েছে। কেন জানি এলিজাবেথের এই নিষ্পলকতা বুকে লাগছে রেশমার। হঠাৎ করেই এলিজাবেথ’কে টেনে তুলে বসালো। এলিজাবেথ কোনোরকম বাঁধা দেয়নি। শুধু বাচ্চাদের মতো অবুঝ মুখ করে চেয়েছিল রেশমার দিকে। রেশমার গলায় জড়তা-সংকোচ, তবুও সাহস নিয়ে বলল,
“আপনি এই নরক থেকে পালিয়ে যান ম্যাডাম।”
‘প্রত্যুত্তরে এক চিলতে হাসি দিল এলিজাবেথ, বলল,
“পথ আছে?”
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
‘রেশমা তৎক্ষনাৎ এলিজাবেথের পাশ থেকে ওঠে ছুটে যায় ট্যারেসের কাছে। কাচ গলিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল দৃষ্টিসীমানার শেষাংশ পর্যন্ত ঘন জঙ্গলের আবছায়া। নিচে কালো পোশাকে বেশদারি গার্ড’রা অস্ত্র হাতে ঘুরাঘুরি করছে। সম্পূর্ণ এলাকা রিচার্ডের নিয়ন্ত্রণে সেটা রেশমা জানে। জেনেও মন ছটফট করছে, পারছে না একটা মেয়ের এতো কষ্ট দেখতে। আবারও গিয়ে এলিজাবেথের পাশে বসল রেশমা । দুহাতের আজলায় চেপে ধরে এলিজাবেথের দু’টি গাল। ভেজা স্বরে বলল,
“এখানে থাকলে তো মারা যাবেন আপনি।”
‘এই কঠিন টানাপোড়নের জীবনে একটুখানি সহানুভূতি, একটুখানি নরম ছোঁয়া—যেখানে ছিল না কোনো স্বার্থপরতা, নৃশংসতা বা হিংস্রতার ছায়া। ছিল শুধু মায়া, মমতা আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। সেই ভালোবাসার আশ্রয়ে আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলো না এলিজাবেথ। সমস্ত সংযম ভেঙে বুকের ভেতর আটকে রাখা দুঃখের নদী ভেঙে পড়লো রেশমার বুকের ওপর।
‘রেশমা প্রথমে কিছুটা হতভম্ব হয়ে গেলেও দ্রুত নিজেকে সামলে নেয়। কোমল ভালোবাসায় মোড়া হাতে এলিজাবেথের মাথায় বুলিয়ে দিতে থাকে। কিন্তু এলিজাবেথ শান্ত হতে পারে না। বুক ফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে, হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। সে কান্না কেবল চোখের জল নয়, বরং তার জমে থাকা সমস্ত দুঃখ, সমস্ত ব্যথা, সমস্ত ক্ষত বন্যার মতো উপচে বেরিয়ে আসে।
‘রেশমার বুকে এলিজাবেথ যেন খুঁজে পায় হারানো এক আশ্রয়। এক স্বর্গ যেখানে সমস্ত দুঃখ গলে গড়িয়ে যায়, আর শুধু রয়ে যায় মায়া ও মমতার এক নির্ভেজাল সুর।
“হয়েছে কান্না?”
‘কি নিদারুণ কোমল স্বর। শিরশিরে অনুভূতিতে নিভু চোখে বুক থেকে মাথা তুলে রেশমার মুখের দিকে চাইলো এলিজাবেথ। রেশমার মুখে লেপ্টে আছে অমায়িক হাসি। কান্নায় বুজে এলো গলা। ক্ষীণ আওয়াজে বলল এলিজাবেথ,
“জানো এই একটু আদর মাখা ছোঁয়ার জন্য কত বছর ধরে বুক শুকিয়ে ছিল আমার । কতো বছর পর মাতৃ বুকের উষ্ণ ছোঁয়া পেলাম।”
‘এলিজাবেথের কান্নায় জরিয়ে আসা কণ্ঠ যা সোজে গিয়ে বিঁধতে থাকে রেশমার বৃক্ষপটে। পেলব দু’হাতে ওর রক্তাভ মুখশ্রীতে লেপ্টে থাকা জল মুছে দিয়ে বলল,
“তোমার মা নেই?”
“জানি না।”
‘ভ্রু কুঁচকে ফেলল রেশমা, “মানে?”
‘বিষন্ন অনুভূতিতে চুপসে গেল এলিজাবেথের মন। শূন্য অভিব্যক্তি, চেহারা থেকে বাচ্চাসুলভ সেই ছাপ চলে যায়, যা মাত্রই উঁকি দিয়েছিল। কান্নার তোড় কমে আসে এলিজাবেথের। মাথা ঘুরিয়ে অন্য দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। রেশমা তড়িঘড়ি করে কথার প্রশঙ্গ পাল্টে ফেলে এলিজাবেথের চোখমুখে আঁধার দেখে। কাইকুঁই করে রিনরিনে আওয়াজে বললেন,
“ব্যাথা হচ্ছে?”
‘চোখে পানি সমেত হাসল এলিজাবেথ। ভণিতাহীন বলল,”আমার শরীর তুলোর মতো নরম হলেও ভিতর থেকে খুবই শক্ত ধাঁচের। ব্যাথা সহে-রয়ে যায়। একটু জ্বরও আসবে না আমার দেখে নিয়েন।”
‘কিছুটা অবাক হল বটে রেশমা। সে ভেবেই রেখেছিল এতো কাটাছেঁড়া, শরীরের উপর পাশবিক নির্যাতনের পর জ্বর নিশ্চয়ই আসবে। কিন্তু সত্যিই এলিজাবেথের গায়ের তাপমাত্রা একদমই স্বাভাবিক। রেশমা কে ভাবনার জগতে ডুবে যেতে দেখে ফিক করে হেসে দিল এলিজাবেথ। রেশমার চোখ ধাঁধিয়ে গেল সেই হাসিতে। আজ প্রথম এলিজাবেথ’কে হাসতে দেখল। এতো সুন্দর হাসিও বুঝি হয় কারোর? মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়ে দেখতে থাকে রেশমা এলিজাবেথের হাসি। অকারণেই রেশমার ঠৌঁটের কোণেও হাসির দেখা মিলে।
“কিছু কিছু মানুষ উপর থেকে দেখতে যেমন, ভিতর থেকে ঠিক তার উল্টো পিঠ হয়। মানবচরিত্র অদ্ভুত এক রহস্যময় ধাঁধা।”
‘সেদিকে ধ্যান নেই রেশমার। চোখে শুধু ভাসছে এলিজাবেথের সুন্দর, স্নিন্ধ হাসি। যা সে আর কখনো দেখেনি। এখন কিছুটা হলেও আন্দাজ করতে পারছে রেশমা রিচার্ড কেন এলিজাবেথ’কে তুলে নিয়ে এসেছে। আর সকলকে চোখের সামনে আসতে নিষেধ করতেও এলিজাবেথ’কে কেন নিজের সাথে জোর করে আটকে রেখেছে। এই দুইদিনে যা বুঝতে পেরেছে রিচার্ড মানুষ হিসেবে খুবই নৃশংস হলেও নারী নেশা নেই। হিংস্র, পৈশাচিক, সাইকো মস্তিষ্ক হয়তো এক লাস্যময়ী শীর্নকায় নারীর সংস্পর্শে স্তম্ভিত। রেশমা খৈ হারিয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,
“আপনি অসম্ভব সুন্দর ম্যাডাম। আচ্ছা স্যার আর আপনার মধ্যে সম্পর্কটা ঠিক কেমন?
“সম্পর্ক? ‘ বলে এক অদ্ভুত হাসি দিল এলিজাবেথ। তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে ভঙ্গিমা স্থির করে থমথমে গলায় প্রত্যুত্তর করে, “রক্ষিতা ! পঁচিশ লক্ষ টাকা দিয়ে কিনে নিয়ে এসেছে আমাকে আপনাদের স্যার ।”
“আপনার সৌন্দর্যের কাছে পঁচিশ লাখ খুবই নস্যি। আমার মনে হ,,,
“রেশমা মা।”
‘থমকে যায় রেশমা। অবাক চোখে তাকায় ক্রদনরত দুর্বোধ্য মেয়েটার দিকে। এলিজাবেথ আকুলতা ভরা চোখে তাকিয়ে আছে রেশমার পানে । জলে টইটম্বুর চোখ হতে কয়েক ফোঁটা জল গাল বেয়ে পড়ল। এই ভেজা চোখগুলো যেন কতো কি বলতে চাচ্ছে। গলায় দলা পাকিয়ে আসার কারণে তা প্রকাশ করতে পারছে না এলিজাবেথ। বহু কসরতে ভাঙা গলায় শুধায়,
“আমি তোমাকে রেশমা মা বলে ডাকি?”
‘চোখ ভিজে এলো রেশমারও, চোখের পাতা কাঁপছে অনবরত । মুখে বলতে পারে না কিছুই। শুধু বুকের সাথে চেপে ধরে এলিজাবেথ’কে। এলিজাবেথ রেশমার বক্ষপটে জায়গা পেয়ে আবারও কাঁদতে থাকে। আজ বহু বছর পর সে উষ্ণ ছোঁয়া পেয়েছে। সেই উষ্ণ ছোঁয়ায় পাহাড় সমপরিমাণ জমে থাকা কষ্ট, আক্ষেপগুলো গলিয়ে নিচ্ছে উষ্ণতায় । এভাবে কিছু মুহুর্তে পার হয় সদ্য মা মেয়ের সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া দুই আড়ষ্ঠ নারীর।
‘রেশমা এলিজাবেথের অগোছালো লাল চুলগুলো দু’হাতের আজলায় নিয়ে আঁচড়িয়ে চুড়ো করে বেঁধে দিল। অতঃপর তেলের বাটি নিয়ে আসতেই নাকমুখ কুঁচকে ফেলল এলিজাবেথ। শীর্ণ আওয়াজে বলল,
“এটা কি ! এ্যা কেন?”
‘রেশমা তেলের বাটি নিয়ে এলিজাবেথের পিছনে বসল। বিলি করে করে প্রতিটা ভাঁজে ভাঁজে ভালো করে ম্যাসাস করে দিতে দিতে বলল, “স্যার বলেছে চুলগুলোর যত্ন নেয়ার জন্য।”
‘কথার পারদে চোয়াল শক্ত হলো এলিজাবেথের। স্যার নামক সেই নরখাদকের কথা অর্হনিশে যেতেই চোখের সামনে ভেসে উঠল এক হিংস্র, দানবীয়, শক্তপোক্ত চিবুক। ঘৃণায় মন বিষিয়ে ওঠে এলিজাবেথের।
‘আকাশ তলিয়ে গিয়েছে আঁধারে। আঁধার রাজ্যের রাজারা এখন রাজত্ব করে নিয়েছে আকাশে। সাথে ভুবন তলিয়ে গিয়েছে ঘুটঘুটে অন্ধকারের আড়ালে। আজ আকাশে চাঁদের পাশে সেনাবাহিনীর মতো জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকা শতশত উজ্জল নক্ষত্রগুলো নেই। সম্ভবত বৃষ্টি আসবে, একটু পরপর দিন ডাকছে। ট্যারেসে কাচ দিয়ে তৈরি দরজা লক থাকার কারণে বাইরে থেকে আলো,বাতাসের শব্দ খুব কমই আসে ভিতরে। যেই ভাবা সেই কাজ, হঠাৎ আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে। বজ্রপাতের শব্দে কেঁপে উঠছে এলিজাবেথের গড়ন একটু পরপর।
‘রেশমা এলিজাবেথ’কে রাতের খাবার আর ঔষধ খাইয়ে দিয়ে চলে গিয়েছে সেই কখন। কিন্তু এখনও ঘুম ধরা দেয়নি এলিজাবেথের চোখে। জীবন নামক অস্তিত্বের সাথে মিশে যাওয়া কঠিন সূত্রের হিসেব মিলাতে খুবই ব্যস্ত আড়ষ্ট মেয়েটা। তবে শত ভেবেও সেই সকল সূত্রের সমাধান মেলাতে পারে না এলিজাবেথ । বীজগণিতের অংকের মতো চার পৃষ্ঠে ভুল সূত্র মিলিয়ে শেষে গিয়ে ফলাফল শূন্য, ভূল।
‘জীবনের কঠিন সত্যগুলো সঠিক সূত্রের মতো এসে খাতার কোণা বরাবর দুই টানে কেটে দেয়। চোখে আঙুল দিয়ে আর্হনিশে স্কুল ছুটির ঘন্টার মতো হাতুড়ি দিয়ে আঘাত করে জোরে জোরে শব্দ করে জানিয়ে দেয় তুমি ভুল, সঠিক সূত্র মেলাতে ব্যর্থ তুমি। চোখের পানি শুকিয়েও আবার ভিজে আসে। দেয়ালের সাথে সেট করে রাখা ড্রাগনের পেইন্টিং থেকে আসা তির্যক রশ্মিতে কিছুটা আলোকিত আলিশান কামরা।
‘হঠাৎ হস্ততন্ত পায়ে কাক ভেজা অবস্থায় কামরায় প্রবেশ করল রিচার্ড। শরীর বেয়ে বেয়ে বৃষ্টির পানির পবিত্র ফোঁটা, ফোঁটা গুলো চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে এক অপবিত্র, পাপিষ্ঠ কায়া থেকে। এলিজাবেথ তখনও কঠিন হিসেবের ফাঁকফোকরে তলিয়ে ছিল। আলো জ্বলতেই হতচেতন হয়ে ফিরে। রিচার্ড’কে দেখে কেঁপে উঠে সমস্ত শরীর। কম্ফোর্টার দিয়ে নিজেকে ভালোভাবে পেঁচিয়ে নেয় দ্রুত। রিচার্ড শক্ত চিবুকে একবার দুর্বোধ্য এলিজাবেথের দিকে তাকিয়ে সরাসরি যায় কেবিনেটের কাছে।
‘কেবিনেটের তৃতীয় সারির ডোর খুলতেই উন্মুক্ত হয় দামি দামি মদের সমাহার। সারি সারি মদের বোতল, ড্রাগস, ইনজেকশন দিয়ে সজ্জিত এই তাকের পুরো অংশ। নামি-দামি সকল ব্যান্ডের মদ রয়েছে এখানে। চোখ বড় বড় হয়ে যায় এলিজাবেথের। এই ক’দিনে সে একবারের জন্য কিছুতে ছুঁয়ে দেখেনি। রেশমা যখন যেটা পরিয়ে দিতো সেটায় চুপচাপ গায়ে জরিয়ে নিতো। এতো মদের বোতল দেখে মনে হচ্ছে এটা কারোর ব্যক্তিগত কামরা না নিজস্ব বার।
‘রিচার্ডের চোখেমুখে লেপ্টে রয়েছে অযাচিত ক্ষুব্ধতা। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে ওয়াইনের বোতল নিয়ে দুই দাঁতের ফাঁকে চাপ দিয়ে ধরে এক মোচড়ে কর্ক খুলে ফেলল খুবই দক্ষতার সহিত। বাম হাত দিয়ে গলগল করে রক্তক্ষরণ হওয়া জায়গাটায় ওয়াইনের বোতল উল্টো করে ঢালতে থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে রিচার্ড নিজেকে শক্ত করে রাখল। চোখ বড় বড় হয়ে যায় এলিজাবেথের। আঁতকে ওঠে মৃদু শব্দ করে দু’হাতে মুখ চেপে ধরল। এলিজাবেথের শব্দে রিচার্ড শক্ত চোয়াল ফাঁক করে ঘুরে তাকাল সেদিকে। ললাটে বিরক্তির ভাঁজ। এলিজাবেথের ভয়কাতুরে চোখ দেখে বাঁকা হাসল। ঠৌঁটের কোণায় জড় হয়েছে রহস্যময় সন্ধি।
‘বোতলে থাকা বাকিটুকু মদ দুই ঠৌঁটের ফাঁকে চেপে উপরে তুলে এক নিশ্বাসে শেষ করল। ঢোক গিলার কারণে বারবার উদীয়মান হচ্ছে পুরুষালি রুক্ষ এডামস আপেল। বৃষ্টির পানিতে ভিজে শার্ট শরীরের সাথে অষ্টেপৃষ্ঠে জরিয়ে আছে। অতি ফর্সা ত্বক বৃষ্টির স্নিগ্ধ ছোয়ায় উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পেয়েছে আরো দ্বিগুণ। বাচ্চাদের সকালে মচরে পড়া নরম রোদ গা মাখিয়ে গোসল করানোর পর শরীরে জনসন লোচন মাখিয়ে দেওয়ার পর যেভাবে শরীরের ত্বক চকচক করে ঠিক সেভাবেই রিচার্ডের গাঁ জ্বলজ্বল করছে। পৈশাচিক আত্মার হিংস্র মানবকেও এখন লাগছে খুবই আকর্ষনীয়, ঘোর লাগার মতো। অথচ এই হ্যান্ডসাম সুর্দশন পুরুষের ভিতরে নেই কোনো হৃদয়। হিংস্রতা আর নৃশংসতার দাবানলে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে গিয়েছে সেই কবেই।
‘রিচার্ড ঠৌঁটের কোণে বাঁকা হাসি ঝুকিয়ে এক পা এক পা করে এগিয়ে যায় এলিজাবেথের দিকে। গুটিয়ে যেতে থাকে এলিজাবেথ ভয়ে, সংকীর্ণে। রিচার্ড ভেজা শরীরেই বেডে বসল। বেড কেন্দ্রীয় তিন তাকের ড্রয়ার থেকে ফাস্টএইড বক্স বের করল। অতঃপর বক্স খুলে ব্যান্ডেজ বের করতে করতে ডাকল।
“রেড।”
‘রিচার্ডের গুরুগম্ভীর, হিংস্র, কর্কশ গলার পরিবর্তে নিরেট ঠান্ডা স্বরে ঝড় উঠে গেল এলিজাবেথের ভিতর। তিরতির করে কাঁপতে থাকে সমস্ত শরীর। দ্বিতীয় বারের মতো অবাক করে ডাকল রিচার্ড ঠান্ডা গলায়,
“কাম ক্লোজার রেড।”
‘এলিজাবেথ দু-টানায় ফেঁসে যায় কি করবে। এই শান্ত রিচার্ডের আড়ালে ক্ষুব্ধ পৈশাচিক আত্মার রিচার্ড কে সে চিনে। কথার বাইরে যাওয়া মানেই সেই হিংস্র আত্মা জেগে ওঠা । এলিজাবেথ ঢোক গিলে তটস্থ হয়ে রিচার্ডের নিটক যায়। রিচার্ড ততক্ষণে আঙুল থেকে ম্যানস ব্যাং রিং খুলে বেডসাইডে রেখেছে। এলিজাবেথ কে এগিয়ে আসতে দেখে অধর এলিয়ে হাসল। হাসিটা বরাবরের মতোই দেখা দিল না দন্তপাটে।
‘এলিজাবেথের দিকে ফাস্টএইড বক্স এগিয়ে দিল রিচার্ড। এলিজাবেথের চোখের পাতা কাঁপছে, উৎসুক হয়ে তাকায় রিচার্ডের দিকে। রিচার্ড ভ্রু উঁচিয়ে ইশারা দিল ড্রেসিং করে দেওয়া জন্য। এলিজাবেথ এবার কাছ থেকে তাকাল রিচার্ড হাতের দিকে। হাতের উপরের পিঠ আঙুলের ভিতর হতে তেরছাভাবে কেটে গিয়েছে। কোনো ধারালো ছুরি দিয়ে হবে হয়তো। নিশ্চয়ই কারোর শেষ দিন ছিল আজ। ফিনকি দিয়ে অঝোরে রক্ত ঝড়ছে এখনো। গাঁ শিউরে ওঠে, হাত কাঁপতে থাকে এলিজাবেথের। যা নেকামো ছাড়া কিছুই মনে হলো না রিচার্ডের কাছে। শক্ত করে এলিজাবেথের হাত চেপে ধরে রক্তাক্ত জায়গায়। ছিটকে দূরে সরে যায় এলিজাবেথ।
‘রিচার্ডের শশব্যস্ত বিদুৎ বেগী চাহনি দেখে বুক শুকিয়ে এলো। ঠৌঁট গোল করে পরপর ঘন কয়েকবার নিশ্বাস ছেড়ে সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে আসে। সহসাই কুটিল হাতে তুলো নিয়ে রক্ত মুছতে থাকে রিচার্ডের। ক্ষত খুবই গভীর, তবুও অভিব্যক্তি একদমই শূন্য রিচার্ডের। নির্নিমেষ তাকিয়ে থাকল এলিজাবেথের দিকে,চেয়ে থাকল কাঁপতে থাকা হাতের দিকে।
“একজন গ্যাংস্টারের সাথে থাকতে হলে রক্তকে সাদরে গ্রহণ করতে হবে চলতি পথের সঙ্গী মনে করে।”
‘কান্নায় কন্ঠ বুঁজে এলো গলা। তবুও সাহস করে গলার জড়তা দূর করে বলল,”থাকতে চাই না আমি।”
‘হিংস্রতার প্রভাবে বিড়বিড়িয়ে ওঠে পৈশাচিক, সাইকো
মস্তিষ্ক, তবুও কন্ঠস্বর নিরেট ঠান্ডা, “থাকতে তো তোমাকে হবেই রেড, তাও আমার সাথে।”
‘রিচার্ডের বিলম্বহীন জবাবে বুক ফেটে কান্না আসে এলিজাবেথের। ঠৌঁট কামড়ে যথাসম্ভব কান্না আটকানো বৃথা চেষ্টা করল। হঠাৎ রিচার্ডের চোখ গেল ছোট কেবিনেটের উপর রাখা একটা ছোট ঘাসফুল। অযাচিত কারণে চোয়াল শক্ত হয়ে গেল রিচার্ডের। রক্তগরম চোখে তাকায় এলিজাবেথের দিকে। কিরমিরিয়ে বলল,
“ফুল কোথা থেকে আসলো ?”
“রেশমা মা বাইরে থেকে এনেছিল।”
‘রেশমা, মেডের নাম এটা রিচার্ড জানে। তবুও ক্ষিপ্ততা কমলো না। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“কোন সাহসে আমার রুমে বাইরের জিনিস আসলো
উইথআউট মাই পারমিশন ?”
“উপর থেকে দেখে আমার ভাল,,,,
‘বলার মধ্যেই হঠাৎ অতর্কিত আক্রমণে এলিজাবেথ চমকে গিয়ে খামচে ধরল রিচার্ডের শার্টের কলার। হেঁচকা টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে রিচার্ড এলিজাবেথ’কে। এক হাত দিয়ে পেঁচিয়ে ধরেছে নিজের সাথে এলিজাবেথের পেট,পিঠ। তিরতির করে কাঁপতে থাকে এলিজাবেথ। রিচার্ডের গাঁ থেকে আসা পারফিউমের ডার্ক স্মেইল নাকের ডগায় ভারি খাচ্ছে।
অকুতোভয়ী হৃদিন্ড এলিজাবেথ চোখমুখ খিঁচে নেয় রিচার্ডের গরম নিশ্বাসের উত্তাপে। রিচার্ড অকস্মাৎ এলিজাবেথের গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়। শুষে নিতে থাকে শরীরের সকল ঘ্রাণ। রিচার্ডের ভেজা শরীরের সংস্পর্শে শরীরের প্রতিটা লোমকূপের শিহরণ জেগে ওঠতে থাকে।
‘হঠাৎই কিছু একটা ভেবে এলিজাবেথ কিছুটা ঘনিষ্ঠ হয় রিচার্ডের। আর একটু কাছ ঘেঁষল। রির্চাডের ঠৌঁটের আগায় জড়ো হয় বাঁকা হাসি এলিজাবেথের এহেন অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপে। তবে ভ্রুক্ষেপ করল না, ছোট ছোট চুমুতে ভরিয়ে দিছে এলিজাবেথের কোমল গ্রীবায়। এলিজাবেথ সহসাই মুখ বুঝে সব সহ্য করে নিতে থাকে রিচার্ডের এলোমেলো ছোঁয়া গুলো। কৌশলে রিচার্ডের কোমরে গুঁজে রাখা গানে হাত দিতে যাবে তার আগেই ব্যাথায় কুকড়িয়ে উঠল সে। ছিটকে গিয়ে দূরে সরে পড়ল এলিজাবেথ। ঠৌঁট থেকে ফোঁটা ফোঁটা তাজা উষ্ণ রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। রিচার্ডের সমুদ্র নীল চোখ দু’টোতে আগুনের লেলিহান। তবুও অভিব্যক্তি শান্ত নদীর ন্যায়, ঠৌঁটের কোণে বক্র হাসি। হাতের পিঠ দিয়ে ঠৌঁট মুছে আবারও ঝুঁকল পড়ে থাকা এলিজাবেথের উপর। রক্তাক্ত ঠৌঁটে হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে এলিজাবেথ। রিচার্ড ওর চিবুক শক্ত করে চেপে ধরে হিংস্র প্রাণীর মতো গর্জে উঠল,
“চালাকি করো ভালো কথা, তবে করার আগে ভেবে দেখো বিপরীত পাশের মানুষটা কে মাই ফা*কিং ডার্ক রেড।”
‘বরাবরের মতোই এলিজাবেথ’কে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হনহনিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেল রিচার্ড। এলিজাবেথ করুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে শূন্য বুকে দু’চোখ বুঁজে ফেলল। হেরে যাওয়া পথিকের মতো আবারও মাঝ রাস্তায় মুখ থুবড়ে পড়ল। তলপেটের চিনচিনে ব্যাথায় ঠৌঁট কামড়ে বিছানার সাথে মিশে যেতে থাকল পেটে দু’হাত চেপে ধরে।
‘লম্বা কোল্ড শাওয়ার নিয়ে তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলো রিচার্ড। এলিজাবেথ গায়ে কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে একদৃষ্টিতে বেডসাইডে রাখা রিচার্ডের হাতের রিং এর দিকে তাকিয়ে ছিল। রিচার্ডের উপস্থিত টের পেয়ে মুখ ঢুকিয়ে ফেলে কম্ফোর্টারের ভিতর চটজলদি। ঠৌঁট বাঁকিয়ে হাসল রিচার্ড। কাউচের উপর তোয়ালে রেখে কেবিনেট থেকে ওয়াইনের বোতল বের করতে করতে হাস্কি ভয়েসে আওড়াল,
“ডু ইউ লাইক দ্যাট রেড?”
‘কোনোরূপ প্রত্যুত্তর আসে না কথার পারদে। রিচার্ড ও আশা করে থাকে না উত্তরের জন্য। ওয়াইনের বোতল নিয়ে সরাসরি গেল ওপেন ট্যারেসে ভেজা চুল থেকে তখনও টপটপ করে পানি ঝড়ছে। পরণে কালো নাইট স্যুট। খোলা আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে একদৃষ্টিতে ঘন জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে পুরো বোতল খালাস করল। অতঃপর সঙ্গে সঙ্গে গমগম পায়ে হেঁটে রুমে যায়। বেডে শুইয়েই কম্ফোর্টারের নিচে লেপ্টে থাকা এলিজাবেথ’কে একটানে নিজের কাছে নিয়ে আসে। শিউরে উঠল এলিজাবেথের অভ্যন্তর। রিচার্ডের কাছ থেকে ছোটার জন্য ছটফট করতে থাকল সে। ভয়ে গতি হারায় হৃদস্পন্দন, চোখ দিয়ে ছাপিয়ে জল ঝড়তে থাকে অনবরত। রিচার্ড শক্ত চোখে তাকালে ছটফটানি কমে এলিজাবেথের। ভেজা গলায় অস্পষ্ট স্বরে আওড়ালো,
“না প্লিজ! আমার পিরিয়,,,, কথা শেষ করতে দিল না রিচার্ড। নিরুদ্বেগহীন ভাবে দু’হাতে তালি বাজাতেই লাইট বন্ধ হয়ে গেল রুমের। অতঃপর আবারও এলিজাবেথ’কে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসলো। ওর ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিয়ে ঘুমিয়ে যায় কোনোরূপ বাক্য ছাড়ায়। বিস্ময়ে হতভম্ব হয়ে যায় এলিজাবেথ, নিশ্বাস নিতেও ভুলে গেল। রিচার্ডের ভারি শরীরের পুরো ভর ওর উপর দিয়ে রেখেছে। দম বন্ধ হয়ে আসছে এলিজাবেথের তাও সরাতে পারছে না। সারাদিন ভয়ংকর মিশনের পর শরীর অতিরিক্ত ক্লান্ত পাশাপাশি ড্র্যাঙ্ক হওয়ায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ল রিচার্ড। শত চেষ্টা করেও রিচার্ড কে এক চুলও সরাতে পারল না এলিজাবেথ। না পেরে নিজের শরীর ছেড়ে দেয় বিছানায়।শূন্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সিলিংয়ে।অমীমাংসিত হিসাবের হিসেব আবারও মেলাতে চাইল। তার জীবনের প্রথম পুরুষ রিচার্ড, যে তাকে এতো কাছ থেকে ছুলো, লুটে নিল তার সর্বস্ব। তাও আবার এতো নৃশংস এক নরখাদক। যার ভিতরে হৃদয় বলতে কিছুই নেই। এর শেষ পরিণতি কি,,,,,এমন নানান কথা চিন্তা করতে করতে একসময় এলিজাবেথও ঘুমের রাজ্যে তলিয়ে গেল।
‘কড়া ডোজের অ্যান্টিবায়োটিকের প্রভাবে এলিজাবেথের ঘুম ভাঙল অনেক দেরিতে। চোখ মেলে দেখল রিচার্ড নেই পাশে। একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল । নিজেকে খানিক গুছিয়ে অলসতা ঝেড়ে উঠে বসার চেষ্টা করল। ওয়াশরুমে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বিছানা থেকে পা নামাতেই শরীরজুড়ে তীব্র যন্ত্রণা ছড়িয়ে পড়ল। ব্যথায় শিউরে উঠল । ফর্সা মুখ ক্রমশ নীলচে হয়ে গেল, ঠোঁট গোল করে লম্বা লম্বা শ্বাস নিতে শুরু করল। যন্ত্রণায় চোখ ভিজে উঠল জলকণায়। একটু শান্ত হতে এদিকসেদিক তাকাতেই নজর গেল ট্যারেসের দিকে। পরক্ষণেই চোখ বিস্ময়ে ছানাবড়া হয়ে গেল। অবিশ্বাসে কয়েকবার হাত দিয়ে চোখ কচলালো। কিন্তু না, এটি কোনো কল্পনা নয়।
এ-তো সত্যি। দীর্ঘ পাঁচ দিন কালো মেঘের রাজত্বে বন্দী থাকা আকাশে প্রথমবারের মতো সোনালি আলো ফুটে উঠেছে। সূর্যের উজ্জ্বল রশ্মি ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। এক মুহূর্তের জন্য সব যন্ত্রণা ভুলে গিয়ে এলিজাবেথ তাকিয়ে রইল সেই উদিত আলোয়।
‘মনের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে প্রশান্তির এক ঝলক ফুটে উঠল এলিজাবেথের। শিরশিরে অনুভূতি নিয়ে নিভু চোখে তাকিয়ে রইল ট্যারেসের দিকে। যে জায়গাটা এতদিন খাঁ খাঁ রোদে শুকিয়ে গোমট হয়ে ছিল, সেটা এখন এক স্নিগ্ধ ফুলের স্বর্গ। বিস্তৃত ট্যারেসজুড়ে নানান বাহারের ফুলে ভরপুর। কোথাও এক চুল পরিমাণ ফাঁক নেই। যেন কেউ নিজের সমস্ত যত্ন আর ভালোবাসা ঢেলে সাজিয়েছে এই বাগান। প্রতিটি ফুল যেন বলছে—কিপ্টেমি নেই, অপার উদারতায় সাজানো হয়েছে এ সৌন্দর্য। এলিজাবেথের চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল।
ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৮
‘তবে বিস্ময়ের শেষ এখানেই নয়। চোখ ঘুরিয়ে মেঝের দিকে তাকাতেই হার্টবিট বেড়ে গেল। চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। পুরো মেঝে ভর্তি লাল গোলাপ। ডার্ক থ্রিমের টাইলস ঢাকা পড়ে গিয়েছে রক্তিম লালের মোহনায়। এলিজাবেথ এখনো নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না। এমন সূর্যের আলোয় ভেজা সকালে এত বড় ধাক্কা, এক বিশাল ধাক্কা। স্নিগ্ধ সৌন্দর্যের মাঝে বিস্ময়ে ভাসতে থাকল সে।