ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৪

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৪
মিথুবুড়ি

‘সবকিছু পেরিয়ে, দীর্ঘ ভোগান্তির অবসানে এখন এলিজাবেথ ও রিচার্ডের জীবনে সুখের স্বর্ণসময়। নতুন সংসার গড়ে তোলার আজ ঠিক পনেরো দিন। এই পনেরো দিনে তারা একে অপরকে নতুন করে চিনেছে, অনুভব করেছে ভিন্ন রকম এক ভালোবাসা। আর প্রতিদিন নিজেদের আবিষ্কার করেছে নতুন আলোয়। এরই মাঝে ঘটেছে কিছু চমকপ্রদ ঘটনা। ইবরাত এখন দুই মাসের অন্তঃসত্ত্বা। এই খবরে সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়েছে উচ্ছ্বাস। অন্যদিকে, লুকাস ও সুইটির বিয়েও হয়ে গেছে এক ঘনিষ্ঠ, আবেগভরা পরিসরে। তবে রিচার্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজনেস পার্টির কারণে তারা এখনও হানিমুনে যেতে পারেনি। বিয়ের সমস্ত আনুষ্ঠানিকতা সেরে তারা সোজা ফিরেছে বাংলাদেশে।
সুইটির বাবা অসুস্থ থাকায় সে লুকাসের সঙ্গে ফিরেনি।

‘রাজধানীর এক বিলাসবহুল পাঁচতারকা হোটেলে জমকালো পার্টির আয়োজন করা হয়েছে। রিচার্ড ও তার দল হোটেলে প্রবেশ করলেও, লুকাস ফোনে কথা বলতে বলতে একসময় হোটেলের পেছন দিকে চলে যায়। হঠাৎ প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে সে নির্জন জায়গায় গিয়ে মাটিকে জৈব রাসায়নিক সার ডোনেট করে নিজেকে কিছুটা হালকা করে। জিপার তুলে ঘুরতেই মুহূর্তেই চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে ওঠে। সামনেই দাঁড়িয়ে একদল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। কী রঙিন, কী ঝলমলে তাদের সাজসজ্জা! কপালে বৃত্তাকার বিশাল টিপ, চোখে মোটা করে টানা কাজল, ঠোঁটে লালচে বেগুনি চকচকে লিপস্টিক। হাতে কাঁচের চুড়ি চুমকির কাজে আলোর রঙ ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। দৃষ্টিভঙ্গি ভয়ংকর। লুকাস সচকিত হলো।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

‘হিজরাদের মধ্যে মোটাতাজা একজন এগিয়ে এসে বিশ্রি ভঙ্গিতে দু-হাত বুকের ওপর তুলে কাঁধ ঝাকিয়ে তালি দিতে দিতে বলল,”এই, টাকা দে, টাকা দে।”
‘লুকাসের ভ্রুতে ভাঁজ পড়ল। সে বরাবরই হিসেবি মানুষ। লুকাস তৎক্ষনাৎ ধূর্ধতার সাথে পকেট চেক করল রিভলভার সাথে আছে কিনা সেটা পরখ করতে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত নেই। গাড়িতে ফেলে এসেছে বোধহয়। বুক ভরে দম টানল লুকাস। সচকিত ভাব কাটিয়ে রুষ্ট গলায় বলল,
“আমার কাছে টাকা নেই।”
‘সঙ্গে সঙ্গে ক্ষেপা ষাঁড়ের মতো খেঁকিয়ে উঠল হিজরা’টা। এগিয়ে এসে তালি বাজাতে, বাজাতে বলল,”টাকা নেই কি রে? এখুনি পঞ্চাশ হাজার দে।”
‘পঞ্চাশ হাজার? লুকাসের চোখ কপালে ওঠে যায়। সে তীব্র আপত্তিতে নিস্তরঙ্গ মেজাজে বলল,”ইসসস! পঞ্চাশ হাজার!আমার কাছে বিষ খাবার টাকাও নেই।”
‘পিছন থেকে হিজরা দলের সরদার এগিয়ে এসে পুরুষালী গম্ভীর কণ্ঠে বলল,”তুই বিষ খাবি? এই নে টাকা! তোকে আমি টাকা দিচ্ছি, তুই বিষ খা।”

‘থতমত খেয়ে গেল লুকাস। এই মুহূর্তে সে তার বস’কে মনেপ্রাণে খুবই স্মরণ করছে। রিচার্ড থাকলে রাশভারি এক ধমকে সবগুলোকে পুরো এলাকা থেকে বিতারিত করত। লুকাস’কে মিইয়ে যেতে দেখে, এগিয়ে আসা হিজরা টা আবারও বুক উঁচিয়ে,কাঁধ ঝাঁকিয়ে তালি দিতে দিতে বলল,
“এখুনি পঞ্চাশ হাজার টাকা দে, কাইল্লা। গোলামের পুত, দামি, দামি জাইঙ্গা পরতে পারিস, আর আমাদের টাকা দিতে গেলেই তোদের গো-য়া শুকিয়ে যায়। সব মাদারবোর্ড গুলারে চিনি। এই বড়লোকেরা হইছে আস্ত হইয়িন্নি। এখুনি পঞ্চাশ হাজার দে। নইলে তোর জাইঙ্গা খুইল্লা নিয়া বাংলা বাজারে বেচমু।”

‘লুকাস ভেতরে, ভেতরে জ্বলে উঠলেও অস্ত্রহীন তা প্রকাশ্যে আনা বোকামি। তবে তাদের হুমকিতে ভয়ের লেশমাত্রও দেখা গেলো না তার মুখাবয়বে। উলটে ভেংচি কেটে বলল,”আমাকে বাংলা বাজারে বেচলেও পঞ্চাশ হাজার টাকা পাওয়া যাবে না। দামি বলতে, ব্যক্তিগত একটা জিনিস আছে, সেটাও আরেকজনের। সুতরাং, আপনারা আমাকে নিয়ে বেচে দিলে লাভবান হতে পারবেন না। উলটে আমার মতো মোটাতাজা, স্বাস্থ্যবান একজনকে নেওয়ার জন্য টাকা দিয়ে ট্রাক ভাড়া করতে হবে।”
‘লুকাসের কথায় হলুদ কারচুপির কামিজ পরিহিত একজন এগিয়ে এসে জিভ ঘুরিয়ে বলল,”ওলে,লে লে লে লে। তোর কি আমগোরে এতোই বেক্কল মনে হয়, যে তোর মতো গুদামের বস্তার লাইগা ট্রাক ভাড়া করুম? ভালই, ভালই কইতাছি, টাকা দে। নইলে কিন্তু, এক্ষুনি খুইলা দিমু।”
‘শেষের কথাটা তালি বাজিয়ে, বাজিয়ে বলল। লুকাসও তাদের মতো একই ভঙ্গিতে কাঁধ নাচিয়ে তালি দিতে দিতে বলল,”খুল, খুল,আমিও দেখি।”

‘রিচার্ড পুলের এককোণে দাঁড়িয়ে ডক্টরের সাথে ফোনে কথা বলছিল। কালপরশুর মধ্যে এলিজাবেথের অপারেটর করা হবে বলে রিচার্ডের চিন্তাভাবনা। এতোদিন শুধু এলিজাবেথের শারিরীক সুস্থতার জন্য অধীর অপেক্ষায় ছিল সে। কল কেটে পিছন ঘুরতেই মসৃণ কপোলে ভাঁজ পড়ল চিন্তার বলিরেখার। একজন দীর্ঘদেহি লোক দাঁড়িয়ে। পরনে কালো লেদারের জ্যাকেট। ভেতরে কালো ট্রি-শার্ট। মুখে মাস্ক আর মাথায় কালো ক্যাপ। দৃশ্যমান শুধু নিকষ কালো চোখদু’টো। মাস্কের অন্তরালে আচ্ছাদিত মুখটি চিনতে সময় লাগল না রিচার্ডের। সে সুচারু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তাকবীরের দিকে।

“আমার নামে হওয়া সকল কেসের প্রমাণ পুড়িয়ে দিয়ে তুই কি প্রমাণ করতে চাইছিস? তুই মহৎ? পুলিশকে টাকা খাইয়ে আমারে ধরতে নিষেধ করে প্রমাণ করতে চাইছিস তুই আমার ভাই? যদি তাই প্রমাণ করতে চাস, তবে শুনে রাখ তুই আমার কেউ না, কেউ না তুই।”
‘রিচার্ড নিরেট ঠান্ডা গলায় বলল,”কিছুই প্রমাণ করতে চাচ্ছি না। প্রমাণ দেওয়ার মতো এতোটাও মূল্যবান তুই না। তোর শরীরে কায়নাত বংশের রক্ত। কায়নতা বংশের রক্তের এই পরিণতি মানা যাচ্ছিল না। বলতে পারিস, শুধুমাত্র এই রক্তের জন্যই তুই এখনও বেঁচে আছিস।”
‘তাকবীরের চোখেমুখে বিদুৎচমকানোর মতো হিংস্রতা। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল,”এটাকে বেঁচে থাকা বলে? মানুষের মধ্যে থেকেও, মানুষকে মুখ দেখাতে না পারাকে কি বেঁচে থাকা বলে? একসময় যারা আমাকে সম্মান করত, পায়ে ধরে সালাম করত, আজ তাদের চোখে আমার জন্য ঘৃণা। মানুষ ভয় পায় আমাকে দেখলে। এটাকে তুই বেঁচে থাকা বলছিস?”

‘তাকবীরের চোখে গনগনে অগ্নিশিখা। বুকভরা আর্তনাদ। চোখদু’টো অসম্ভব লাল হয়ে আছে। রিচার্ড শান্ত চোখে তাকবীর’কে নিরীক্ষণ করছে। লোকটার গায়েগতরের গঠনই বলে দিচ্ছে, জীবনের ধাক্কার ভারে তার জীবন ভরে উঠেছে গভীর নৈরাশ্যে।
“রেহান কে কেন মেরেছিস? ও তো তোর কোনো ক্ষতি করেনি।”
‘তাকবীরের কঠিন বাক্যে স্তম্ভিত ফিরে পায় রিচার্ড। তার বাকশক্তি রহিত। সেদিন শুধুমাত্র ভুলবোঝাবুঝির কারণে রেহানের প্রাণ যায়। লুকাস’কে রেহান না, জেমস বিষ দিয়েছিল। রিচার্ড সেটা পরবর্তীতে জানতে পারে। তবে ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছিল। একটা সময় ভুলবোঝাবুঝি মিটে গেলেও, মৃত মানুষেরা আর কখনো ফিরে আসে না। রিচার্ড ফোঁস নিশ্বাস ফেলল।
“তোদের কি খুব বেশি ক্ষতি করে ফেলেছিলাম আমি? আমাকে এভাবে যে নিঃস্ব করে দিলি। আমার ক্ষমতা, সুনাম, সম্মান, ভালোবাসা, ভাইয়ের মতো একজন ছিল, তাকেও কেঁড়ে নিলি। শত্রুকেও তো কেউ এভাবে তিলে, তিলে ধ্বংস করে না।”

‘পূর্বের কথা মনে হতেই রিচার্ডের থমকে যাওয়া মস্তিষ্ক ফিরে যায় তার পৈশাচিক আত্মায়। তাকবীরের কলার খামচে ধরে অগ্নি চোখে দাঁতে দাঁত পিষে বলল,
“শত্রু? হ্যাঁ, তুই আমার শত্রুই। জানিস না কি কি ক্ষতি করেছি আমার? আমার ভালোবাসা কে ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিস, বার,বার আমাকে খুন করার চেষ্টা করেছিস,আমার পিতামহী ফাদার’কে মেরে ফেলেছি, আম-আ আমার স,,,,

‘কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল রিচার্ড। উত্তেজনায় তার বাঁ হাত কাঁপছে। ভেতরে থেকে হট্টগোলের শব্দ আসছে। রিচার্ড ক্ষিপ্ত চোখে একবার সামনের দিকে তাকিয়ে, ফের তাকবীরের দিকে তাকাল। অতঃপর, স্বর পরিবর্তন করে রহস্য করে বলল,” বলেছিলাম না, তোর সবটা কেড়ে নিবো আমি। দেখলি তো? আজ তোর কিছুই নেই। এলিজাবেথ আমার। আর ক্ষমতা? সেটা থাকা স্বত্তেও কাজে লাগাতে পারছিস না। কারণ তোর ডানা দু’টো আমি আগেই কেটে দিয়েছি। আর মৃত্যু? তুই সেটা চাইলেও পাবি না এতো সহজে। কারণ তুই বেঁচে থেকেও মরা। বেঁচে থাকাটাও তোর জন্য শাস্তি। বেঁচে থেকে তুই অনুভব কর, হারানোর কষ্ট কাকে বলে।”
“ওই লোকটার একটা ছবি হবে?”
‘রিচার্ড থমকাল হঠাৎ তাকবীরের এহেন প্রশ্নে। তাকবীরের আচরণ হঠাৎ করেই তার কাছে অচেনা লাগছে। রিচার্ড জলদগম্ভীর গলায় বলল,

“কার?”
‘তাকবীর শুকনো ঢোক গিলল। কথাটা বলতে গিয়ে তার ভেতরটা ছিঁড়ে আসছে। তবুও বহু করসতে আওড়ালো,
“আমার আসল বাবার।”
‘থেমে, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে আবারও বলল,
“তাকে আমি দেখেছি। তার আবছা চেহারা মনে করতে না পারলেও তাকে আমি দেখেছি। আমি জানি, আমার মৃত্যু ঘনিয়ে আসছে। মৃত্যুর আগে আমি আমার আসল বাবার চেহারা’টা দেখতে চাই। আমার আসল পরিবার।”
‘রিচার্ড একবাক্যে জানিয়ে দিল,”কখনোই না।”
‘তাকবীর তৃষাতুর চোখে তাকাই রিচার্ডের দিকে। তার চোখদু’টো ছলছলে। ভেতরে অসহনীয় ব্যাথার ঢেউ উঠেছে। কণ্ঠে জমেছে তরল ব্যাথা। অনুনয়ের সুরে বলল,

“প্লিজ?”
“যেদিন তুই তোর নিজের রক্তের মানুষের রক্ত ঝরিয়েছিস, সেদিনই সে-ই সুযোগ হারিয়ে ফেলেছিস। তোর কোনো যোগ্যতাই নেই, ফেরেস্তার মতো লোকটার ছবি দেখার।”
‘এই বলে রিচার্ড হনহনিয়ে চলে গেল। তাকবীর পিছন ফিরে ভেজা চোখে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। বড্ড আফসোসের সাথে তার ঠৌঁটের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে আসে কথাটা,
“তুই যে ভাগ্য নিয়ে জন্মেছিস, সেই ভাগ্য পাওয়া আমার আমৃত্যু ইচ্ছা ছিল।”

‘গর্ভাবস্থার সমস্ত উপসর্গই গভীরভাবে ছায়া ফেলেছে ইবরাতের ওপর। ঘন ঘন বমি, মাথা ঘোরা—এই অসুস্থতার জন্যই ইবরাত আজকের পার্টিতে আসতে পারেনি। রিচার্ড এলিজাবেথকে এক কোণে দাঁড় করিয়ে রেখে জরুরি ফোনে কথা বলতে বাইরে গিয়েছে। এলিজাবেথ তখন জুস খাচ্ছিল। হঠাৎ পিছন ফিরে দাঁড়াতেই তার হাতে থাকা গ্লাসের জুস অসাবধানতাবশত এক ভদ্রলোকের গায়ে ছিটকে পড়ে। মুহূর্তেই চমকে ওঠে দু’জনই। এলিজাবেথ অপরাধবোধে ভরা কণ্ঠে তড়িঘড়ি বলল,
“আই’ম সো স্যরি! স্যরি, প্লিজ!”
‘সামনের কোট সেট পরা লোকটা প্রথমে বিরক্ত মুখে গা মুছতে থাকে। অশোভন কিছু বলার জন্য ঠোঁট কাঁপলেও, এলিজাবেথের মুখের দিকে তাকাতেই থেমে যায়। তার চোখ আটকে যায় মেয়েটির মোহময় গোলাপি আদলে। বিস্ময়ে ভরে ওঠে তার দৃষ্টি। ঠোঁটের কোণে ফুটে ওঠে এক রহস্যময় হাসি। সহকারীকে একপাশে টেনে নিয়ে ফিসফিসিয়ে জানতে চায়,

“হু ইজ দ্যাট বিউটিফুল ক্রিয়েচার?”
‘লোকটা রর্বাটের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,”বস, গ্যাংস্টার ওয়াইফ।”
‘মুহূর্তেই রর্বাটের দৃষ্টি ভঙ্গিতে পরিবর্তন আসে। রিচার্ডের প্রতি তার পূর্ব থেকেই চাপা ক্ষোভ। বিজনেস নিয়ে চলতে থাকা রেষারেষিটা বহুদিনের। সে গ্রীবা উঁচিয়ে আশপাশ পর্যবেক্ষণ করল। রিচার্ড নেই দেখে সে এই সুযোগ কাজে লাগালো পূঙ্খানুপুঙ্খর ভাবে। তীব্র রেস নিয়ে বলল,
“আর ইউ ব্লাইন্ড?”
‘এলিজাবেথের মুখ অপমানে থেঁতো হয়ে গেল। সে পূণরায় নিচু স্বরে বলল,”স্যরি এগেইন।”
‘রর্বাট কুৎসিত ভঙ্গিতে হাসল,”স্যরি? আই ডোন্ট নিড ইওর ফাকিং স্যরি। ডু ইউ ইভেন নো হাউ মাচ দিস কোট অফ মাইন কস্টস? ইউ’ল হ্যাভ টু বেগ ফর ফর্গিভনেস অ্যাট মাই ফিট!”
‘এলিজাবেথ হতচকিত হয়ে রর্বাটের দিকে তাকাল। সামান্য একটা ভুলে জন্য পায়ে পড়তে হবে? এলিজাবেথ চিবুক শক্ত করে বলল,”অসম্ভব।”

‘রর্বাট মুহূর্তেই বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ভরা মজলিসে সে চিৎকার করে বলতে থাকে,
“হে, হোয়্যার’স ইয়োর ফ্যামিলি? আরেন্ট ইউ গোইং টু অ্যাপলোজাইজ টু মি? হু ডিড ইউ কাম হিয়ার উইথ? আরেন্ট ইউ আ গ্যাংস্টার’স ওয়াইফ? হোয়্যার ইজ হি? হি ম্যারিড আ গার্ল উইথ নো ম্যানার্স অ্যাট অল। নো বেসিক সেন্স অফ হাউ টু বিহেভ অ্যাট আ পার্টি।”
‘তার চিৎকার-চেঁচামেচিতে কয়েকজন এগিয়ে এসে আড়চোখে এলিজাবেথের দিকে তাকিয়ে রর্বাটের কানে কানে কিছু বলতেই সে আরো তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। এদিকে অস্বস্তিতে গা ঘিনঘিন করছে এলিজাবেথের। তার ছটফট ছোট দু’টো আকুল হয়ে খুঁজছে রিচার্ড’কে। জীবনের এমন একটা পর্যায়ে এসে পড়েছে মেয়েটা, যেখানে প্রতিটি মুহুর্তে তার প্রয়োজন রিচার্ডকে। এই লোকটা এমন ভাবেই জড়িয়ে গিয়েছে তার শরীরের প্রতিটি শিরা-উপশিরার সাথে, যে তাকে ছাড়া এক দন্ড থাকাও দায়।

‘রর্বাট এগিয়ে এল। লালসিত দৃষ্টিতে তাকায় এলিজাবেথের দিকে। দৃষ্টিভঙ্গির মতোই কুৎসিত তার মুখের ভাষা। অশিষ্ট মন্তব্য করতে শুরু করল রর্বাট,
“ওয়াহ! তুমিই তাহলে সেই বাজারি, যার নাম পতি-তা-দের ওয়েবসাইটে ওঠেছিল। এজন্যই তো বলি এতো দাম্ভিকতা কিসের। নষ্ট মেয়ের আবার এতো ভাব? ইউ ফাকিং বিচ, ইউ’ল হ্যাভ টু বেগ ফর ফর্গিভনেস অ্যাট মাই ফিট!”

‘অপমান, তাচ্ছিল্যে, অতীতের গুমরে ওঠা যন্ত্রণার ভারে এলিজাবেথের চোখের কোণ বাষ্পাকুল হয়৷ অজ্ঞাতকের রুক্ষ ভাষায় কাঁপতে থাকে আড়ষ্ট রমণীর দেহবল্লরী। এলিজাবেথ ঠৌঁট কামড়ে ধরে নিজেকে সংযত করে। নিমিষেই তৈরি হওয়া দূর্ভেদ্য ভিড়ে শুধু কানাঘুষা, কু-কথা আর কটু ভাষা। অশ্লীল বাক্যগুলো কুয়াশার মতো চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে তাকে। রর্বাট আবারও চিৎকার করে উঠল,
“সে ফর গিভ মি মাই লর্ড।”

‘এলিজাবেথের ঠৌঁট থরথর করে কাঁপছে, কাঁপছে হাত দু’টো। হঠাৎ চোখেমুখে ঝলক দিয়ে ওঠে অব্যাখ্যাত শক্তি।
“মাই লর্ড? ইউ বাস্টার্ড ” বিদুৎ চমকানোর মতো প্রচন্ড জোরে চিৎকার করে এলিজাবেথ তার হাতে থাকা পার্স দিয়ে আঘাত করল রর্বাটের মুখে। উপস্থিত সকলে হতচকিত। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে থাকে এলিজাবেথের দিকে। রর্বাটের ঠৌঁট ফেটে রক্তপাত হয়। এলিজাবেথের শরীর তখনও ক্রোধে থরথর করে কাঁপছে।
রর্বাট মুহুর্তেই গর্জে উঠল,
“ইউ বিচ, তোর কত্তবড় সাহস তুই আমার গায়ে হাত তুলিস। সামান্য একটা রক্ষিতার এতো দম্ভ। জন্মপরিচয়হীন একটা মেয়ে! তুই কি ভেবেছিস, রিচার্ড কায়নাতের মতো এতো বড় গ্যাংস্টার তোর মতো পতি-তার প্রেমে পড়বে? নো, নেভার।

হি’জ ওনলি ইউজিং ইউ টু স্যাটিসফাই হিজ ফিজিকাল ডিজায়ার্স। হোয়েন হিজ নিডস আর ফুলফিল্ড, ইউর ফেইট উইল বি জাস্ট লাইক দি আদার গার্লস। হি’ল সেল ইউ টু।”
‘হিংস্রতা প্রভাবে চিৎকার করে ওঠা রর্বাট যখন হাত তুলে এলিজাবেথ’কে আঘাত করতে যাবে,ঠিক তখনই ভেসে আসে রিচার্ডের কণ্ঠস্বর, বরফের মতো ঠান্ডা,
“মাই লাভ!”
‘সঙ্গে, সঙ্গে উপস্থিতি সকলের চোখ ফুটে ওঠে স্পষ্ট আতঙ্কের ছাপ। সকলের মাঝে শিহরণ জাগানো নৈঃশব্দ নেমে আসে৷ জনমনে নামে ত্রাসের ছায়া। প্রত্যেকে নিজের জীবন বাঁচাতে নিজ দায়িত্বে সরে গেল। রর্বাট পাশে তাকিয়ে দেখল তার এসিস্ট্যান্টও নেই। দূর থেকে এগিয়ে আসছে রিচার্ড। রিচার্ডের চোখেমুখে আজ কোনো রাগ নেই, নেই হিংস্রতার ছায়া। নিরেট চিবুকে দৃঢ়তা নিয়ে সে এগিয়ে আসে। হঠাৎ কোটের ভেতর থেকে একটি ডলারের বান্ডিল বের করে এলিজাবেথের সামনে এসে দাঁড়ায়। স্তব্ধ চোখে, ঘাড় তুলে এলিজাবেথ তাকিয়ে থাকে রিচার্ডের দিকে। রিচার্ড এক মৃদু হাসি ছুঁড়ে দেয় এলিজাবেথের চোখে চোখ রেখে। সেই হাসিই যেন সংক্রামক। হালকা হেসে ওঠে এলিজাবেথও।

‘পরমুহূর্তেই রিচার্ড বান্ডিলের উপরিভাগ খুলে ডলারগুলো এলিজাবেথের মাথার চারপাশে ঘুরিয়ে দেয়। ঠিক যেভাবে রাজরানির অভিষেক করা হয়। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল তার অন্দরমহলের রাজরানীর পায়ের কাছে। বান্ডিলটি পায়ের নিচে রেখে উঠে দাঁড়ায় রিচার্ড। হঠাৎ কোমর পেঁচিয়ে এলিজাবেথকে টেনে আনে বুকের কাছে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“ডু ইউ ওয়ান্ট মি টু কিল দ্যাম প্রিন্সেস?”
‘এলিজাবেথের ঠোঁটে খেলে যায় এক রহস্যময় হাসি। সেও কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিসিয়ে জবাব দেয়,
“ইউ নো, হোয়াট ইউ হ্যাভ টু ডু।”
‘রিচার্ড নিঃশব্দে কোমর ছেড়ে দেয়। এলিজাবেথ দু’পা এগিয়ে যেতেই রিচার্ড ঝড়ের মতো পাশের টেবিল থেকে একটি ওয়াইনের বোতল নিয়ে সজোরে আঘাত করে রবার্টের মাথায়। ছিটকে পড়া রক্ত এসে লাগে এলিজাবেথের জামায়। সে অসন্তোষে পেছন ফিরে তাকায়। রিচার্ড ছটফট করতে থাকা জেমসকে পায়ের নিচে চেপে ধরে হেসে বলল,
“স্যরি প্রিন্সেস।”
“আমি ক্লিন করে আসছি,” বলে ঠাণ্ডা ভঙ্গিতে চলে যায় এলিজাবেথ।

‘এলিজাবেথ ওয়াশরুমের পথে যেতেই আচমকা থমকে দাঁড়াল। এতদিন পর তাকবীরকে দেখে শরীর কেঁপে উঠল। চেনা সেই মুখটা আজ সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাকবীর এখন মাস্কহীন, রুগ্ন। এক সময়ের সুগঠিত শরীরটা হাড়ে গড়িয়ে এসেছে। চিবুকে গর্ত, চোখের নিচে গভীর কালো ছায়া। এই করুণ পরিণতির সামনে দাঁড়িয়ে এলিজাবেথের ভিতরকার সমস্ত রাগ গলে গিয়ে এক অদ্ভুত মায়ায় রূপ নিল। সে নিজেই এগিয়ে গেল। স্তব্ধ তাকিয়ে থাকা তাকবীরের সামনে দাঁড়িয়ে নরম গলায় বলল,
“আপনি মিস তাকওয়ার সাথে পালিয়ে গেলেন না কেন?”
‘তাকবীর শুধু চেয়ে রইল এলিজাবেথের চোখে। মুখে কিছু বলল না। শুধু পকেট থেকে ফোনটা বের করে এলিজাবেথের সামনে ধরল। স্ক্রিনে ভেসে উঠল একটি নিউজ হেডলাইন:

[Fugitive secret agent Takwa Markey, accused of betraying her own profession and attempting to destroy key evidence, was killed in a crossfire during a high-risk NYPD operation.—নিজ পেশার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ নষ্টের চেষ্টার অভিযোগে অভিযুক্ত পলাতক সিক্রেট এজেন্ট তাকওয়া মার্কি, এক ঝুঁকিপূর্ণ এনওয়াইপিডি অভিযানে ক্রসফায়ারে নিহত হন।]
‘এলিজাবেথ প্রলম্বিত শ্বাস ফেলে বলল,”আপনি দূরে কোথায় পালিয়ে যান।”
‘তাকবীর থেকেও না থাকার মতো দাঁড়িয়ে রইল। ফিনফিনে শরীরখানা যেন এবার মাঝ থেকে ভেঙে পড়বে। নেই কোনো অভিব্যক্তি, নেই কণ্ঠে প্রাণ। ফাঁপা দৃষ্টিতে চেয়ে বিরসমুখে বলল,
“তোমাকে না পেলে সবাইকে আলবিদা জানিয়ে হারিয়ে যাবো। আর কখনো ফিরে আসবো না। কেউ খুঁজে পাবে না আমায়।”

“আপনি তো আপনার হইনি।”
‘তাকবীর যেন ধাক্কা খেল। অজানা উদ্বেগ চেপে বসল ভিতরে। অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে ততধিক বিস্ময় নিয়ে বলল,
“আমার হওনি তুমি?”
“নাহ।”
‘তাকবীরের চোখ ছলছল হয়ে এল। বিষন্ন অনুভূতির মিলনে চুপসে গেল মন। হঠাৎ করেই যেন গুমোট পরিবেশ শোকে গেয়ে উঠল। শরীরের শিরা-উপশিরা বাজতে শুরু করে। হৃদয় রাজ্যে হানা দেয় দুঃখ রাজ্যের সৈন্যরা। মুহুর্তেই চিনচিনে ব্যাথা ছড়িয়ে পড়ে সারা শরীরে। তাকবীর তৃষিত চোখে এলিজাবেথের আলদে তাকিয়ে জড়িয়ে আসা কণ্ঠে বলল,
“আমি কেন এখনও বিশ্বাস করতে পারিনা, তুমি আর আমার না, তুমি আমার হবে না। আমার আশা এখনো কেন ভাঙে না, বলতে পারো এলোকেশী?”
‘এলিজাবেথ চুপ। তাকবীর আবারও বলল,
“তুমি আমার না হয়েও কেনো মনে রয়ে গেলে? আমি তোমার হয়েও কেনো তোমার মনে স্থান পেলাম নাহ? এই প্রশ্নরা যে আমাকে রাতে ঘুমাতে দেয়না। মানুষ কেন বুঝে না, বিষ মানুষকে মারে না। মানুষকে মারে, মানুষের শূন্যতা। আর তোমার বিরহে আমি চাষ করি সেই মরণব্যাধি শূন্যতা।আদেও কি আমি বেঁচে আছি, প্রশ্ন করে বসে নিজেরই কাছে।”

‘এলিজাবেথ এবারও চুপ থাকার সিন্ধান্তে স্থির রইল। তাকবীরের চোখের কোল ছাপিয়ে প্লাবন হলো। সে মেঘলা চোখে তাকিয়ে থাকে এলিজাবেথের আঁখির মায়াভরা মৃগনয়নী চোখদু’টোয়। বিরহবিধুর মন যে শুধু টানে তার সর্বনাশের দিকে। শূন্য চোখে শখের নারীর আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করে দন্ত বিকশিত হাসি দিয়ে বলল,
“সব হারিয়ে পাগল আমি ভেবেই বসেছিলাম তুমিই আমার শেষ আশ্রয়। কিন্তু তুমি আমায় রাখলে কই? না তোমার বুকে, না পায়ের নিচে। আমার ভালোবাসা এতোটাও তুচ্ছ ছিল না এলোকেশী।”
‘এলিজাবেথ বিহ্বল হয়ে তাকবীরের দিকে তাকাল। তাকবীরের সুগভীর, নিকষ কালো চোখ দু’টোতে চিকচিক করছে অশ্রুরা। আষাঢ় আঁধারে তলিয়ে গিয়েছে শ্যামর্বণ। সেই নির্মল, মায়াভরা চেহারা আজ বিধ্বস্ত, ক্ষতবিক্ষত। ধ্বংসের শেষ প্রান্তে দাঁড়য়ে। তার-ও কার্নিশদ্বয় সিক্ত হয় অযাচিত নোনাজলে। এলিজাবেথ শান্ত গলায় বলল,

“আমি খুব করে চাই আমার সন্দেহ ভুল প্রমাণিত হোক। এই মুহুর্তে এসে,আমি চাচ্ছি আমার সন্দেহ সত্য হলেও তা যেন মিথ্যে হয়। আপনি যেন সারাজীবন আমার ভালো মানুষ হয়ে থাকুন। আপনি বিশ্বাসঘাতক হলেও আপনিই একমাত্র মানুষ যাকে আমি চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করছি একটা সময়। আমি সবসময়ই আপনার মঙ্গল কামনা করে এসেছি। নিজের আগে সৃষ্টিকর্তার কাছে আপনার জন্য প্রার্থনা করেছি। খুব করে চেয়েছি, আপনার জীবনেও যেন এমন কেউ আসে, যে আপনাকে আগলে রাখবে, আপনার মতোই আপনাকে ভালোবাসবে। কিন্তু, যখন দেখলাম, আমার বিশ্বাসের পাহাড় ধীরে ধীরে ধসে পড়ছে, তখন যতটা না কষ্ট হয়েছে; তারচে বেশি কষ্ট হয়েছে যখন অনুভব করলাম মানুষটার ছিল হৃদয়ের খুব কাছের কেউ। ভালো থাকুক বেইমানে’রা।”
‘এলিজাবেথ চলে যেতে উদ্যত হলে তাকবীর পিছন থেকে এলিজাবেথের পা জাপটে ধরল। উন্মাদ লোকটা অসহনীয় ব্যাথায় শব্দ করে কাঁদতে থাকে। তার আহাজারিতে নিস্তব্ধ চারিপাশ।

“এলোকেশী, এলোকেশী, আমার এলোকেশী। তুমি তো আমার না। অন্যের পাঁজরের হাড়ে তোমার সৃষ্টি, অন্যের ভালোবাসা তুমি। অন্যের স্ত্রী তুমি। আমার ভাই, আমার রক্ত, আমার আপন ভাইয়ের স্ত্রী তুমি—সবটা জানার পরও আমি কেন ভুলতে পারছি না তোমায়?আমি এখনও কেন মানতে পারছি না, তুমি আমার হবে না। তোমাকে পাওয়ার আর কোনো সম্ভবনা যে রইল না। আমি কেন এতো অবুঝ?আমার মন কেন মানে না, এলোকেশী আমার না। সে কখনোই আমার হবে না। আমি বাঁচতে পারছি না, বিশ্বাস কর আমি মরতে চাই। আমাকে মরতে দাও তোমরা। সে ক্ষমতা দিয়ে আমার জেল ফাঁসি আটকিয়ে রেখেছে, তোমার স্মৃতি আমাকে আত্মহত্যা করতে দিচ্ছে না। আমি কি করব বলতে পারো? তোমরা একটু মায়া কর আমার ওপর। আমাকে মরতে দাও। শখের মানুষটাকে আমি অন্য কারোর সাথে সহ্য করতে পারছি না। তুমি যে আমার খুব শখের ছিলে। আমাকে মুক্তি দাও তোমরা এই দহন থেকে। আমার সকল পাপের জন্য ক্ষমা চাচ্ছি আমি। তোমরা মাফ কর আমায়। আমি তো কবেই ধ্বংস হয়ে গিয়েছি, আর কেন পড়ে আছো আমার পিছনে? আমি মরতে চাই, ওপারে যেতে চাই। খোদার সামনে দাঁড়িয়ে শুধু একটা প্রশ্ন করতে চাই—কি কমতি ছিল আমার ভালোবাসায়? আমি কেন পেলাম না আমার এলোকেশী’কে? আমার চার বছরের চাওয়া, আকাঙ্ক্ষার মূল্য কোথায় রইল? খোদার আরশে কি পৌঁছায়নি আমার আর্তনাদ? খোদা তো সবটা শুনেছে, দেখেছে কিভাবে আমি ছটফট করেছি তোমাকে ছাড়া। কত পাপ করেছি তোমাকে পাওয়ার জন্য৷ তোমার পাওয়ার জন্য কিভাবে সব পাপ থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম, আমার খোদা তো সাক্ষী ছিল। তাও কেন আমি পেলাম না তোমায়?”

‘এলিজাবেথ লোকটাকে সোজা করে তার মুখোমুখি বসল। নরম স্বরে ডাকল,
“ভালো মানুষ।
‘তাকবীর ছলছলে নয়নে এলিজাবেথের দিকে তাকাই, ঠিক যেভাবে শেষ ট্রেনের যাত্রী পিছন ফিরে তাকায়। সে ভেতরে সমস্ত আবেগ, প্রেম চাপা কষ্ট ঢেলে দিয়ে প্রত্যুত্তর করল,
“এলোকেশী!”

“ভাগ্য লাগে ভালো মানুষ, শখের মানুষকে পাওয়ার জন্য। ভাগ্যের লিখনেই যদি না থাকে, তবে চাইলেও কিছু পাওয়া যায় না। আপনি আমার জীবনে এসেছিলেন আমার স্বামীরও আগে, ভালোবেসেছিলেন আমায় নিঃস্বার্থভাবে। কিন্তু তবু আমি পারিনি আপনাকে ভালোবাসতে। কারণ, আমার ভালোবাসা বিধাতা রাখেন অন্য কারও জন্য৷ যার হাত ধরে আজ আমি চলেছি। বিশ্বাস করুন, যদি আপনাকে ভালোবাসার সামর্থ্য আমার হৃদয়ে থাকত, তবে অনেক আগেই আমি আপনার প্রেমে হেরে যেতাম। তবে সেই অধিকারটা আমার ছিল না, হয়তো কখনো ছিলই না।”
‘শান্ত স্বরে কথাগুলো বলে চলে গেল এলিজাবেথ। কিন্তু লোকটার অশান্ত মন আর শান্ত হলো না। সে ফ্লোরে বসে হাউমাউ করে কাঁদতেই থাকল। থামল না কান্না।
বেচারা বোঝে না—তার এই সস্তা, অবুঝ কান্নাগুলোই মেয়েদের চোখে পুরুষের ভালোবাসাকে ঠুনকো আর অমূল্য করে তোলে।

‘কিছুদূর যেতেই এলিজাবেথের ফোনে অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে কল আসে। ফোন কানে তোলার সঙ্গে সঙ্গেই ওপাশে ভেসে আসে বিকৃত এক কণ্ঠস্বর। হিমশীতল সেই কণ্ঠে শরীরের লোম খাড়া হয়ে যায় এলিজাবেথের।
“মম’কে চাই?”
‘এলিজাবেথের কণ্ঠস্বর কেঁপে ওঠে।গলাটাও যেন শুকিয়ে যায়, তবুও সে বলে,
“শুভাকাঙ্ক্ষী৷ শুভাকাঙ্ক্ষী না হলে কি কেউ এমন খবর দেয়?”
‘সে তীব্র নিঃশ্বাসে বুক ভরতে থাকে। চারপাশে তাকিয়ে রিচার্ডকে খোঁজে। চোখে-মুখে আতঙ্ক নিয়ে বলল,
“কী প্রমাণ আছে যে আমার মা আপনার কাছেই?”

‘লোকটার বিদঘুটে হাসিতে গা শিউরে ওঠে এলিজাবেথের।”প্রমাণ দিচ্ছি,” বলে ফোন কেটে দেয়। এক সেকেন্ডও না যেতেই হোয়াটসঅ্যাপে ভেসে আসে একটি ভিডিও। ভিডিওটা দেখামাত্র এলিজাবেথের হাত থেকে ফোনটা পড়ে যায়। হৃদয়টা জমে বরফ হয়ে আসে। এলিজাবেথ ছুটে যায় রিচার্ডের দিকে৷ রিচার্ড নিজেও তখন গাড়ির দিকে দৌড়াচ্ছিল। এলিজাবেথ দৌড়ে গিয়ে রিচার্ডের বাহু আঁকড়ে ধরে চিৎকার করে উঠল,
“আমার ম…
‘রিচার্ড আগেভাগেই নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়। গাড়ির দিকে ছুটে যেতে যেতে বলল,
“হোটেল থেকে এক পা-ও নড়বে না। ন্যাসো ইন ডেঞ্জার। আমি যাচ্ছি।”এলিজাবেথ নিস্তব্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে রিচার্ডের চলে যাওয়া পথের দিকে। ঝড়ের বেগে রিচার্ড মিলিয়ে যায় দৃষ্টির বাইরে।

‘শহর থেকে অনেক দূরে, জনমানবশূন্য এক এলাকায় এসে থামল রিচার্ডের গাড়ি। সামনে দাঁড়িয়ে আছে ধ্বংসপ্রায়, পরিত্যক্ত একটি বিল্ডিং। রিচার্ডের মুখে স্পষ্ট উত্তেজনা, চোখেমুখে হিংস্র এক রূপ। সে দরজা ঠেলে বেরিয়েই ছুটে চলল বিল্ডিংয়ের দিকে। ঠিক তখনই ফোন বেজে উঠল। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো ন্যাসোর কণ্ঠস্বর,
“বস, প্লিজ আর আসবেন না! ওরা সংখ্যায় অনেক। সাধারণ একজন বডিগার্ডের জন্য নিজের জীবন রিস্কে ফেলবেন না। এভাবে একা, অস্ত্রহীন ছুটে আসারা ঠিক হয়নি।”
‘রিচার্ড চারপাশে চোখ বোলাল। উপরের দিকে তাকাতেই চোখ আটকে গেল বিল্ডিংয়ের ছাদে। সেখানে রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ন্যাসো, সুস্থ, অক্ষত। তবে মাথায় বন্দুক ঠেকানো। দৃশ্যটা দেখেই রিচার্ডের চোখেমুখের সব আতঙ্ক মিলিয়ে গেল। ঠোঁটের কোণে হাসি টেনে বলল,
“সাধারণ একটা বডিগার্ডের জন্য এসেছি, কে বলল? আমি তো আমার ভাইকে সুস্থ অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে এসেছি।”
‘ন্যাসোর চোখে রহস্যময় আতঙ্ক আর অস্থিরতা। কণ্ঠ কাঁপছে তার। সে চিৎকার করে বলে,

“বস, প্লিজ! আমার জন্য নিজেকে বিপদে ফেলবেন না।”
‘রিচার্ড দাঁতে দাঁত চেপে, আগুনভরা চোখে চেয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল,
“যতক্ষণ তোমরা আমার সাথে আছো, কোনো বিপদ আমাকে ছুঁতেও পারবে না।”
‘রিচার্ড কথা শেষ না করেই ফোন কেটে পকেট থেকে বের করে আনে নিজের ব্যক্তিগত রিভলভার। সামনে এগোতে যাবে ঠিক তখনই পিছন থেকে এক কণ্ঠস্বর ভেসে আসে।
“আমার আপনার সাথে কথা আছে!”

‘রিচার্ড থেমে যায়। চকিতে পেছনে ঘোরে। এলিজাবেথ দাঁড়িয়ে আছে রাস্তার অপরপ্রান্তে। এলিজাবেথ তখন রিচার্ডের গাড়ি অনুসরণ করতে করতে এই জনমানবহীন স্থানে পৌঁছেছে। রিচার্ডের চোখে চোখ পড়তেই সে রাস্তার অপর প্রান্ত থেকে ছুটে আসার জন্য পা বাড়ায়। ঠিক সেই মুহূর্তেই একটি গুলির ঝাঁঝ এসে রিচার্ডের বুক ঝাঁঝরা করে দেয়। মুখ থেকে ছিটকে বেরুয় র-ক্ত। অবিশ্বাস্য চোখে রিচার্ড ঘুরে দাঁড়ায়। নিস্পৃহ, রক্তশূণ্য চোখে যা দেখল, তা হলো—ন্যাসোর হাতে ধরা রিভলভার। ন্যাসোর চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। চোয়াল কাঁপছে। রিচার্ড স্তব্ধ চোখে ন্যাসোর দিকে তাকাতেই দ্বিতীয় গুলি ছুড়ল ন্যাসো।
“নাআআআআহহহহহ!!”

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৩ (৪)

‘এলিজাবেথের হাহাকার চারপাশ কাঁপিয়ে তোলে। রিচার্ড এবার চোখ সরিয়ে সামনে তাকায়। সদ্য বুকে জায়গা নেওয়া ছোট দু’টো গর্ত থেকে ঝরনাপ্রবাহের মতো র-ক্ত ঝড়ছে। হঠাৎ একটা কালো এসইউভি এসে দাঁড়িয়েছে এলিজাবেথের সামনে। দরজা খুলে কয়েকজন লোক ঝাঁপিয়ে পড়ে। এলিজাবেথকে তারা জোর করে গাড়িতে তুলতে থাকে। রক্তাক্ত, গুলিবিদ্ধ শরীর নিয়ে রিচার্ড ছুটে যেতে চেষ্টা করে সেদিকে। কিন্তু তখনই প্রচণ্ড শব্দে এক মালবাহী ট্রাক ধাক্কা মারে তার শরীরে। রিচার্ডের দেহ শূন্যে ভাসে। মুখ থেকে ছিটকে বেরুয় আরেক দলা র-ক্ত৷ ভাসতে ভাসতে সে অসহায় চোখে দেখে গাড়িটা এলিজাবেথকে নিয়ে চলে যাচ্ছে। শব্দ করে, ধুলো উড়িয়ে রিচার্ডের শরীর আছড়ে পড়ে মাটিতে। মুখটা থুবড়ে পড়ে একটা ইটের ওপর। শেষবারের মতো রিচার্ডের চোখে পড়ে এলিজাবেথের মুখ। তারপর…চোখ বন্ধ হয়ে যায়। সব কিছু নিঃশব্দ।

ভিলেন ক্যান বি লাভার পর্ব ৬৫