ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৪
লেখিকা দিশা মনি
মিষ্টি দাঁড়িয়ে আছে ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেষে। তার কোণের কোনায় জমে আছে বিন্দু বিন্দু পানি। ভূমধ্যসাগরের বহমান জলরাশির দিকে তাকিয়ে মিষ্টি তার জীবনের হিসাব মিলাচ্ছিল। তার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে যেন ভূমধ্যসাগরের পানির সাথেই মিশে যাচ্ছিল৷ হঠাৎ কারো স্পর্শে মিষ্টি পিছনে ফিরে তাকায়। কাদো কাদো নয়ন দুটো তার দুঃখে ভারাক্রান্ত। আমিনা মিষ্টিকে এভাবে কাঁদতে দেখে বলে,
“তোমাকে এভাবে কাঁদতে দেখলে আমার একদম ভালো লাগে না আপু। তোমার জীবনটা এত কষ্টে ভরপুর কেন? তোমার জীবনে কি সত্যিই কোন সুখ আসবে না?”
মিষ্টি দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
“দীর্ঘ ৮ টা মাস তো সুখের সন্ধানই করে চলেছি। রাফসানকে হারিয়ে ফেলার পর থেকে যেন সুখ নামক বস্তুটিও আমার জীবন থেকে একদম হারিয়ে গেছে। যতদিন না রাফসান ফিরে আসছে, সুখও হয়তোবা আমার জীবনে আর ফিরবে না!”
আমিনা মিষ্টিকে বলে,
“বাদ দাও এখন এসব কথা। বাড়িতে চলো, আম্মুর রান্না হয়ে গেছে। কিছু খেয়ে নেবে চলো৷ নিজের কথা না ভাবো, নিজের ভেতরে বেড়ে ওঠা প্রাণটার কথা ভাবো। আর তো বেশি সময় বাকি নেই তার এই দুনিয়াতে আসার। ইতিমধ্যে তোমার গর্ভাবস্থার সাড়ে ৮ মাস চলছে। কিছুদিনের মধ্যেই মা হতে চলেছ তুমি। সেই খেয়াল আছে?”
মিষ্টি নিজের পেটে হাত বুলিয়ে বলে,
“আচ্ছা, আমিনা, আমার সন্তান কি তার বাবার সান্নিধ্য পাবে না? বাবাকে ছাড়াই কি তার জীবন কাটবে? বাবার ভালোবাসা, বাবার স্নেহ পাওয়ার সৌভাগ্য কি তার নেই?”
আমিনার ভীষণ কান্না পায় মিষ্টির এসব কথা শুনে। তবুও সে বলে,
“তুমি এত চিন্তা করো না তো৷ ডাক্তার তোমায় চিন্তা করতে বারণ করেছে। তুমি এখন চলো আমার সাথে।”
বলেই এক প্রকার মিষ্টিকে জোরপূর্বক ধরে নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে খেতে বসায়। ফাতিমা বিবি মিষ্টির থালায় ভাত দিতে দিতে বলেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
“পেট ভড়ে খেয়ে নাও মা, খাওয়া দাওয়া নিয়ে কোন অনিময় চলবে না। আর কিছুদিন বাদেই তোমার বাচ্চা প্রসব করতে হবে। এই সময় শরীরে অনেক শক্তির দরকার।”
মিষ্টি খাবারের থালার দিকে তাকিয়ে বলে,
“আমার মনে যে একটুও শক্তি বেচে নেই, আন্টি? তার কি হবে?”
ফাতিমা বিবি মিষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,
“এতোটা নিরাশ হয়ো না, মা। আল্লাহ আছেন। তিনি অনেক দয়ালু। দেখবে, তোমার সব বিপদ কেটে যাবে৷ তোমার জীবনে সুদিন ফিরবেই।”
মিষ্টি ফাতিমা বিবির মুখে এসব কথা শুনে কিছুটা হলেও শান্ত হয়ে খেতে শুরু করে। এদিকে ফাতিমা বিবি চোখ বন্ধ করে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন,
“এই মেয়েটার সমস্ত দুঃখ তুমি দূর করে দাও আল্লাহ। ওর স্বামীকে আবার ওর কাছে ফিরিয়ে দাও।”
শেষ সময়কার চেকআপের জন্য মিষ্টিকে নিয়ে মার্সেই শহরের একটি ক্লিনিকে এসেছে আমিনা। মিষ্টি উদাসীন হয়ে বাইরে বসে অপেক্ষা করছে। হঠাৎ করেই মিষ্টির ডাক আসতেই আমিনা তাকে নিয়ে যায় ডাক্তারের চেম্বারে। ডাক্তার মিষ্টির চেকআপ করে বলেন,
“আর এক সপ্তাহের মধ্যেই আপনার ডেলিভারি করতে হবে। পরিস্থিতি খুব একটা ভালো না। বাচ্চার পজিশন এখন বেশ আশংকাজনক।”
মিষ্টি কিছুটা ভয় পেয়ে বলে,
“আমার বাচ্চার কিছু হবে না তো ডাক্তার? আমি আমার স্বামীকে হারিয়ে ফেলেছি, এখন যদি নিজের সন্তানকেও হারিয়ে ফেলি তাহলে আমার কাছে যে আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।”
“আপনি দুশ্চিন্তা করবেন না। সব ঠিক হয়ে যাবে। আর মিস আমিনা, আপনি এখন ওনার আরো বেশি খেয়াল রাখবে। উনি যেন সবসময় বেডরেস্টে থাকে। আর এক সপ্তাহ পর ওনাকে হসপিটালে নিয়ে যাবেন।”
“ঠিক আছে।”
বলেই মিষ্টিকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বের হয় আমিনা৷ মিষ্টির চোখে মুখে ছিল দুশ্চিন্তার ছাপ। আমিনা সেটা খেয়াল করে বলে,
“এত চিন্তা করার দরকার নেই আপু। সব ঠিক হয়ে যাবে, দেখো।”
মিষ্টি ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে থাকে। আমিনা মিষ্টির এমন প্রতিক্রিয়া দেখে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে। অতঃপর মিষ্টিকে ধরে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে। হঠাৎ করেই রাস্তায় ভীড়ের মধ্যে প্রবেশ করলে কারো একটা স্পর্শে মিষ্টির কেমন জানি অদ্ভুত অনুভূতি হয়। মিষ্টি সাথে সাথেই পিছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে এক যুবক হেটে যাচ্ছে। মিষ্টি বলে ওঠে,
“এই যে শুনুন..”
যুবকটি থেমে যায়। মিষ্টি অনেক আশা নিয়ে যুবকটির দিকে ছুটে যায়। মিষ্টি যখন যাচ্ছিল তখন যুবকটি পিছনে ফিরে তাকায়৷ তার দিকে তাকাতেই যেন মিষ্টির সব আশা শেষ হয়ে যায়। সে ভেবেছিল, রাফসান হয়তো তার আশেপাশে আছে। কিন্তু এই যুবক তো রাফসান নয়। মিষ্টি তাই থেমে গিয়ে বলে,
“দুঃখিত! আপনি আসুন।”
আমিনা মিষ্টির সব গতিবিধি খেয়াল করে। মিষ্টির পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,
“কি হয়েছে আপু?”
“কিছু না। চলো যাই।”
বলেই মিষ্টি সামনের দিকে অগ্রসর হয়। আমিনাও তার সাথে যেতে থাকে।
মার্সেই শহরে নেমে এসেছে রাতের আধার। এই আধার রাত্রিতে হঠাৎ করেই একলা ঘুম বসে থাকা মিষ্টির মনটা ভীষণ ছটফট করতে থাকে। রাফসানের কথা যেন আরো বেশি করে মনে করতে থাকে। আর কিছুদিন পরই তার সন্তান পৃথিবীর আলো দেখবে অথচ তার স্বামী তার পাশে থাকবে না! মিষ্টির জন্য ব্যাপারটা অনেক কষ্টের। মিষ্টি বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় একদম বেলকনির পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে কিছু সময় আকাশের দিকে নিশ্চুপ তাকিয়ে থাকে। অতঃপর দৃষ্টি সরিয়ে মাটির দিকে তাকাতেই তার হুশ উড়ে যায়!
কোন এক ছায়ামূর্তি যেন দেখতে পায় মিষ্টি। বলে ওঠে,
“কে ওখানে?”
কিন্তু কোন সাড়া আসে না। মিষ্টির মনটা অস্থির হয়ে ওঠে। সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে নিচে কেউ একজন দাঁড়িয়ে তার দিকেই নজর রাখছে। লোক টাকে ধরার জন্য মিষ্টি নিজেদের রুম থেকে বের হয়ে দ্রুত সিড়ি বেয়ে নিচে নামতে থাকে যাতে করে লোকটা পালিয়ে যাবার সুযোগ না পায়। কিন্তু এর ফলে ঘটে যায় এক অনাকাঙ্ক্ষিত দূর্ঘটনা! জোরে নিচে নামতে গিয়ে মিষ্টির পা হঠাৎ করে মচকে যায় এবং সে সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে নিচে পড়ে যায়। সাথে সাথেই মিষ্টির রক্তে পুরো ফ্লোর ভেসে যায়। মিষ্টি চিৎকার করতে থাকে। মিষ্টির চিৎকার শুনে হঠাৎ করেই কোন এক পুরুষ অববয় ছুটে এসে মিষ্টিকে আগলে নেয়। মিষ্টির তখন ভীষণ যন্ত্রণা হচ্ছিল। সে চোখ খোলা রাখতে পারছিল না। যন্ত্রণায় তার পুরো শরীর যেন অসাড় হয়ে উঠেছিল। মিষ্টি অস্ফুটস্বরে বলে ওঠে,
“আমার…আমার সন্তান..ওর যেন কোন ক্ষতি না হয়।”
হঠাৎ করেই মিষ্টি একটি গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠ শুনতে পায়,
“তোমার বা তোমার সন্তানের কোন ক্ষতি হবে না।”
কন্ঠটা মিষ্টির অনেকটাই চেনা। সে ধীর গতিতে চোখ খোলার চেষ্টা করে কিন্তু তার আগেই অত্যাধিক রক্তপাত ও যন্ত্রণায় সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।
আমিনা ও ফাতিমা বিবি অটির সামনে পায়চারি করে চলেছেন। দুজনেই চোখেই ভয় এবং উদ্বিগ্নতা স্পষ্ট। ফাতিমা বিবি বলেন,
“এই মেয়ের জীবনে কি একটুও সুখ নেই? একের পর এক কিসব বিপদের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে মেয়েটিকে?”
আমিনা বলে,
“আমার খুব ভয় হচ্ছে আম্মু। মিষ্টি আপু আর তার বাচ্চা একদম ঠিক হয়ে যাবে তো? ওদের কোন ক্ষতি হবে না তো?”
এমন সময় একজন ডাক্তার ছুটে আসেন৷ তার চুখমুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে হয়তো তিনি কোন খারাপ খবর শোনাতে এসেছেন। তিনি আসতেই আমিনা বলে,
“কি হয়েছে ডাক্তার? মা ও বাচ্চা দুজনেই ঠিক আছে তো?”
ডাক্তার দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে,
ভূমধ্যসাগরের তীরে পর্ব ৩৩
“সবটাই এখন সৃষ্টিকর্তার হাতে। মাকে তো আমরা বাচিয়ে নিয়েছি কিন্তু বাচ্চাটার অবস্থা ভালো না। এখন দেখা যাক, অপারেশনে পর বাচ্চাটাকে বাচানো যায় কিনা।”
কথাটা শোনামাত্রই আমিনা ভেঙে পড়ে!