মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১১

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১১
মুসতারিন মুসাররাত

সময়টা রোদঝলমলে দুপুরবেলা। বেশ কয়েকজন আত্মীয় স্বজনকে দাওয়াত করা হয়েছে। মেহমানদের প্রাণবন্ত আলাপ আর বাচ্চাদের কোলাহলে ড্রয়িংরুমের দিকটা সরগরম। প্রত্যাশা গোসল সেরে পরিপাটি হয়ে ড্রয়িংরুমের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে দূর থেকেই চোখে পড়ল; টেবিলে শরবতের গ্লাস, বেশ কয়েকটা অচেনা মুখ। নীলা হাসিমুখে কুশলাদি বিনিময় করছে। প্রত্যাশা খানিক দূরে দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছিল। আচমকাই শর্মিলা ডাক দিলেন,
-” প্রত্যাশা! ওখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? এসো, পরিচয় করিয়ে দিই।”
প্রত্যাশা হালকা হাসি ঠোঁটে এনে এগিয়ে যাচ্ছিল। এমন সময় সামনে এসে দাঁড়ালেন নীহারিকা। চোখে একরাশ কঠিন দৃঢ়তা। দারাজ স্বরে বললেন,

-” দাঁড়াও।”
প্রত্যাশা থেমে, কিছুটা বিভ্রান্ত হয়ে নীহারিকার দিকে তাকাল। বুঝে ওঠার আগেই নীহারিকা ওর কব্জি চেপে ধরলেন। গলায় আদেশমাখা কর্কশতা নিয়ে বললেন,
-” আমার সঙ্গে চলো।”
প্রত্যাশা হঠাৎ নীহারিকার এরুপ আচরণ ঠাহর করতে পারল না। নীহারিকা শক্ত হাতে টেনে নিয়ে গেলেন নিজের রুমে। পরিস্থিতিটা এতটাই অপ্রত্যাশিত ছিল যে প্রত্যাশা চুপচাপ হেঁটে গেল। শর্মিলা কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবলেন–আপার আবার কী হলো? হুটহাট আপার যে কী হয় না। বুঝতে পারি না। মেয়েটা কোনো ভুলটুল করেনি তো। এসব ভেবে বেশ চিন্তায় পড়ে যান শর্মিলা। নীলা একটু মনেমনে খুশিই হলো– প্রত্যাশা বোধহয় কিছু একটা আকাম করেছে। তাইই মা এখন ওকে ব’কবে।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

প্রত্যাশার আপাদমস্তক পরখ করলেন নীহারিকা। পরনে হাঁটু অবধি টপস, লেডিস জিন্স। কিছু চুল পেঁচিয়ে প্রজাপতি ব্যান্ড দিয়ে একপাশে আটকানো। একদম বাচ্চা-বাচ্চা লাগছে।
-” এইটা কী পরেছো তুমি? এত বড় মেয়ে হয়ে কীসব বাচ্চাদের ফ্রক পড়েছো! তারউপর বাড়িতে মেহমান এসেছে।”
-” বড় আন্টি এইটা তো টপস, ফ্রক নয়।”
নীহারিকা আলমারি খুলে খুঁজে খুঁজে শাড়ি, প্রয়োজনীয় জিনিস আর গহনা বক্স বের করে বিছানায় নামালেন।
-” বাড়িতে অনেক লোকজন আছে। উনারা এ বাড়ির ছোট বউকে দেখতে চাইছেন, তাই বউয়ের মতো হয়ে যাও। এখন জলদি এই শাড়ি আর গহনাগুলো পড়ে তৈরি হয়ে নাও।”
নীহারিকা এই বলে চলে যেতে নিচ্ছিল। প্রত্যাশা মুখটা কাঁচুমাচু করে বলে উঠল,
-” আমি তো শাড়ি ঠিকঠাক পড়তে পারি না।”
কয়েক মূহুর্ত নিরুত্তর থেকে ইশারায় দেখিয়ে বললেন,
-” ওগুলো পড়ে আসো। আমি পড়িয়ে দিচ্ছি।”
প্রত্যাশা হাসিমুখে প্রয়োজনীয় জিনিস হাতে নেয়। নীহারিকা ফের বললেন,
-” লম্বায় তো আমার সমানই। পেটিকোটের সাইজ ঠিকই হবে আশাকরি। আর.. ব্লাউজটা তোমার গায়ে একটু ঢিলা হতে পারে। যদিও এটা অনেক আগের ব্লাউজ ছিলো, গায়ে লাগেনি বিধায় পড়া হয়নি। তবুও রেখে দিয়েছিলাম।”

নীহারিকা সিল্কের লাল রঙের শাড়িটা হাতে তুলে নিলেন। প্রত্যাশা চঞ্চল কণ্ঠে বলল,
-” শাড়িটাও বুঝি আগে পড়েননি। নতুন ভাঁজ খুলছেন দেখছি।”
নীহারিকা প্রত্যুত্তর না দিয়ে ভাঁজ খুলে কোমরের চারপাশে জড়াতে শুরু করলেন। এক কোণা যখন কোমরে গুঁজতে নিলেন, প্রত্যাশা হঠাৎ নড়াচড়া করে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। নীহারিকা কপালে ভাঁজ ফেলে প্রত্যাশার দিকে চাইল। চোখের ভাষায় বোঝালেন–কী সমস্যা? প্রত্যাশা নড়াচড়া করতে করতে বলল,
-” উফ্! বড় আন্টি সুড়সুড়ি লাগছে তো!”
নীহারিকা তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। একে নিয়ে চলা মুশকিল। বা’নরের মতো নড়তে থাকল প্রত্যাশা। নীহারিকা বিরক্তি নিয়েই কোনো রকমে গুঁজে দিলেন। পরপর কুঁচি দিতে দিতে গম্ভীর স্বরে বললেন,
-” তোমার মা কিছুই শেখায়নি বুঝি? শাড়ি পড়া, তারপর কাকে কী সম্বোধন করতে হয়? এসব শেখায়নি?”
প্রত্যাশা দাঁত কেলিয়ে বলল,

-” শিখিয়েছে তো। তবে আম্মু বলেছে, ‘সব আগেভাগে শিখে ফেললে শাশুড়ি শিখাবে কী? তখন তো তারা ভাববে, বউ আবার আমাদের চেয়ে বেশি জানে।’ তাই কিছুটা খালি রেখেছে, আপনার স্পেশাল ক্লাসের জন্য!”
আঁচলটা গুছিয়ে কাঁধে পিনআপ করতে করতে নীহারিকা বললেন,
-” শোনো, এই ‘বড় আন্টি’ বলে ডাকা বন্ধ করো। নীলাশা যেভাবে সম্বোধন করে এরপর থেকে তুমিও সেভাবে..”
-” ঠিক আছে বড় আ…”
এতটুকু বলেই জিভে কা’মুড় দেয় প্রত্যাশা। শুধরে নিয়ে বলল,
-” অপসসস স্যরি মা!”
নীহারিকা নিজ হাতে গহনা আর বালা জোড়া পরিয়ে দিলেন প্রত্যাশার হাতে। প্রত্যাশা কিছুটা সংকোচে বলল,
-” এত কিছুর দরকার ছিল না। না মানে গহনা তো হয় খুব শখের। এগুলো নিশ্চয় আপনার খুব শখের। যদি না বুঝে কোনোটা হারিয়ে ফেলি। তাই…”
-” এগুলো আজ থেকে তোমার। অনেক আগেই গড়ে রেখেছিলাম–আমার নীরবের বউয়ের জন্য। নীলাশার টা ওর বিয়ের দিনই দিয়েছিলাম। তোমাদের বিয়ে তো হঠাৎ করে হয়ে গেল। তাই দেওয়া হয়ে ওঠেনি।”
এটুকু থেমে,
-” হারিয়ে ফেলা এটা ভালো কথা নয় মা। সবকিছু যত্ন সহকারে আগলে রাখতে হয়। আগলে রাখাটাই ক্রেডিট। হারিয়ে ফেলা নয়। ঠিক গহনার মতো বর, সংসারকেও আগলে রাখতে হয়।”

ড্রয়িংরুমে অপরিচিত মানুষের ভিড়ে প্রত্যাশার ভালো লাগছিলো না। লাঞ্চ করে অল্প সময় কাটিয়েই রুমে চলে আসে। লাঞ্চ করতে বসে তো একজন জিজ্ঞেস করে বসলেন–নীরব কখন আসবে? প্রত্যাশা সরল মনে জানি না বলে। এটা নিয়ে অন্যজন তো আবার ঠেস দিতে বাদ দিলেন না–ওমা, সে কি কথা। বর কখন আসবে জানো না। আবার বর ছাড়াই আগেভাগে লাঞ্চ করতে বসেছো। মহিলার ভাগ্য ভালো প্রত্যাশা মুখ খোলার আগেই নীহারিকা বেগম বলেন–আমিই ওকে বসতে বলেছি। নীরব ডিউটাতে ব্যস্ত থাকে…তাই অযথা বারবার ফোন দেওয়া ওর পছন্দ নয়।

নীরব ব্রেকফাস্ট করে অফিসে যাওয়ার পর প্রত্যাশা সারা ঘরে চিরুনি তল্লাশি চালিয়েছে। কিন্তু কোনো আলামত পাওয়া যায়নি। প্রত্যাশা ভেবে নেয়–ওমন রসকষহীন পুলিশের প্রেমিকা আছে এটা ভাবা বিলাসিতা বৈ কিছু নয়। ব্যাটার কপালে তো বউই টিকতো না। আমি ছাড়া অন্যকেউ হলে, এই এক সপ্তাহও হতো না, হুঁ।
ভাবনার মাঝে পরী দরজার দাড়গোড়ায় দাঁড়িয়ে লন্ড্রি থেকে দেওয়া নীরবের শার্ট-প্যান্ট প্রত্যাশার হাতে দিয়ে বলে– খালাম্মা সব তুইলা রাখতে কয়ছে। প্রত্যাশা কাবার্ড খুলে তুলে রাখল। হঠাৎ সাদা শার্টের দিকে তাকাতেই মাথায় দুষ্টুমি চাপল। সাদা শার্টটা গায়ে জড়াল। শার্টের বোতামগুলো খোলা, ওর শরীরের সঙ্গে আলগা হয়ে উড়ছে ফ্যানের হাওয়ায়। এদিক-ওদিক বাঁকা হয়ে নিজেকে আয়নায় দেখে নেয় প্রত্যাশা। দুষ্টু হেসে লাল রক্ত জবার ন্যায় রঙিন করা ঠোঁটজোড়ার ছাপ ফেলে শার্টের কলারে। সেদিন এই সাদা শার্টটা পড়েই বুঝি শ্বশুরবাড়ি গিয়েছিল জনাব। প্রত্যাশা ভাবে–লোকটা গম্ভীর, রষকষহীন হলেও, দেখতে হেব্বি আছে। হ্যান্ডসামের বউ হতে পারা চারটিখানি কথা নয়। ফ্রেন্ডদের সামনে বেশ ভাব নিয়ে বরকে প্রেজেন্ট করা যাবে। এসব ভেবে ওর ভালোই লাগল।
ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর থেকে নীরবের সানগ্লাস হাতে নেয় প্রত্যাশা। আয়নার দিকে চেয়ে চোখ টিপে চশমাটা চোখে দিয়ে সুর করে গাইল,

-” হ্যায় ও হ্যান্ডসাম সোনা সাবসে, মেরে দিল কো গ্যায়া লে কার…
গাইতে গাইতে প্রতিটি পায়ে যেন ছন্দ জড়িয়ে যায়। ধীরে সুস্থে ঘূর্ণি দেয় মাথায়, পরপর দুইহাত এক করে গালের এপাশে আবার ওপাশে ধরে গায়,
-” মেরি নিন্দ চুরা নে উসনে, ওর খ্বাব গ্যায়া দে কার…”
চোখে-মুখে ছেলেমানুষি দুষ্টুমি নিয়ে,
-” আব ইয়ে নয়না বোলে ইয়ার, বলো ইয়ে হি লাগাতার…”
শরীর বাঁকিয়ে একপাশে হেলে পড়ে,
-” কউই চাহে কিতনা রোকে কারুঁংগি প্যায়ারআরআর…”
কোমড় দুলিয়ে দু’পাশে হাত নাড়িয়ে,
-” মেরে সাঁইয়া সুপারস্টার, মেরে সাইয়া সুপারস্টার ম্যায় ফ্যান হুয়ি উনকি ও মেরে সাঁইয়া সুপারস্টার। ম্যায় ফ্যান হুয়ি উনকি মে’রেএএ…”

একহাত কোমড়ে অন্যহাত গালে রেখে ঘুরতে গিয়ে, গলার স্বর আঁটকে যায়, চোখ দু’টো বড়বড় হয়ে যায়। দরজার ফাঁকে নীরব দাঁড়িয়ে। প্রত্যাশার মুখে ঝট করে লজ্জার ছায়া ছড়িয়ে পড়ে। চশমাটা খুলে হাতের মুঠোয় চেপে ধরে। শার্টটা বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে দুপা পেছনে সরে যায়। ত্রস্ত চোখ নামিয়ে নেয়। ফোনে কিছু একটা করে নীরব নির্লিপ্ত ভঙিতে ভেতরে এগিয়ে আসে। প্রত্যাশা মূক বনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। বিছানায় বসে, পায়ের উপর অপর পা তুলে নীরব মোজা খুলতে খুলতে প্রত্যাশার দিকে তাকাল। বলল,
-” ডান্স স্টেপস সুন্দর হচ্ছিল। থামলে কেনো? সুপারস্টার এর সাথে কো-স্টার হিসেবে তোমাকে মানাবে কী না! এইজন্য হলেও পুরোটা দেখা দরকার ছিলো।”
প্রত্যাশা তড়িৎ মাথা তুলে চাইল। বলল,
-” শুনুন, এটা জাস্ট গান। আপনি আবার ভেবে বসবেন না, আপনাকে ভেবে গেয়েছি। আর না তো গানের লাইনগুলো আপনাকে উদ্দেশ্য করে বলা।”
নীরব হালকা হাসে, চোখে একটু কৌতুকের ঝিলিক। বলল,

-” আরে না না, আমি তো এমন কিছু ভাবিনি। তবে গানের লাইনগুলো তুমি এত মন দিয়ে গাচ্ছিলে যে, মনে হচ্ছিল কাউকে ভেবেই। এখন তুমি যদি এক্সট্রা সিরিয়াস হয়ে আমাকে ডিসক্লেইমার দাও, তাহলে তো আমার সন্দেহ জাগে; সত্যিই কি আমি ছিলাম না তোমার সাঁইয়া সুপারস্টার এ?”
নীরবের থেকে খানিকটা দূরত্বে বিছানায় বসল প্রত্যাশা। দুইহাত বিছানায় ঠেস দিয়ে মাথা দুদিকে নাড়িয়ে বলল,
-” উঁহু! ছিলেন না। ওইযে বললাম জাস্ট গান।”
লাল শাড়ির উপর সাদা শার্ট। নীরব চেয়ে চেয়ে দেখছে। প্রত্যাশার দিকে তাকিয়েই বিজ্ঞের মতন মুখাবয়ব করে বলল,

-” ওহ্।”
-” হুম।”
প্রত্যাশা হেসে বলল। নীরব নিটোল চাহনিতে প্রত্যাশার হাসিটা দেখল। পরপর ফ্রেশ হতে যাবে বলে উঠে দাঁড়াল। কিছু ভেবে পিছুনে তাকাল। প্রত্যাশা শার্ট খুলতে ব্যস্ত। নীরবের ঠান্ডা স্বরে প্রত্যাশার হাত থেমে গেল,
-” প্রত্যাশা?”
প্রত্যাশা চোখ তুলে চাইল। এই প্রথম নীরবের মুখ থেকে নিজের নামটা শুনল। আগে শুনেছে বলে মনে করতে পারল না। ডাকটা শান্ত, অথচ কেমন গাঢ় স্বরে ছিলো। প্রত্যাশা অপ্রস্তুত কণ্ঠে বলল,
-” হুঁ।”
ঠোঁটের পাশে স্মিত হাসি ছড়িয়ে নীরব বলল,
-” হাসলে তোমাকে সুন্দর লাগে!”

বাদ্যযন্ত্রের সুরের মতোই বাক্যটি রিনিঝিনি করে বাজতে থাকল প্রত্যাশার কানে। নীরব দ্বিতীয় কথা না বলে ফ্রেশ হতে যায়। ‘হাসলে ওকে সুন্দর লাগে’ এটা আব্বু-আম্মু ছাড়া কেউ বলেছে বলে মনেহয় না। যদিও তাঁদের বলা কথাগুলো বরাবরই সান্ত্বনার মতো লাগত। কারণ বেশিরভাগ মানুষই বলে–হাসলে ডান পাশের গজ দাঁতটা স্পষ্ট দেখা যায়। আর এই গজ দাঁত নাকি সৌন্দর্যের অপূর্ণতা।
এইতো, কিছুক্ষণ আগেই এক অতিথি হইচই করে বলে উঠেছিলেন–‘আরে, নতুন বউয়ের তো দেখি গজ দাঁত!’
বলবার ভঙ্গিটা এমন ছিল যেন এটা কোনো বড় দোষ!
অবচেতনেই মনটা ভার হয়ে এসেছিল প্রত্যাশার।
তবে এই মুহূর্তটা আলাদা। চিরচেনা সেই অনাকাঙ্ক্ষিত অপূর্ণতার জায়গায় এবার এক অপ্রত্যাশিত প্রশংসা যেন নিঃশব্দে এসে বসে গেল। নীরবের ছোট্ট মন্তব্যে, প্রত্যাশার মনটা ভরে উঠল অদ্ভুত এক ভালোলাগার আবেশে।

রাত্রি এগারোটা বাজতে চলেছে। প্রত্যাশা বিছানায় আধশোয়া, হালকা পেটব্যথায় চোখে ঘুম নেই। নীরব আর নিভান কিছুক্ষণ আগেই এয়ারপোর্ট থেকে বাবাকে পৌঁছে দিয়ে ফিরেছে। চোখবুঁজে ছিলো প্রত্যাশা হঠাৎ শব্দ পেয়ে চোখ মেলে নীরবকে দেখে উঠে বসল। কয়েকটা প্যাকেট বিছানার ধারে নামিয়ে রাখল নীরব। বলল,
-” মেয়েদের পছন্দ সম্পর্কে আমার কোনো স্পষ্ট ধারণা নেই। জানি না, এগুলো তোমার পছন্দ হবে কিনা। তবুও আজকের মতো নিজের রুচিটাই তোমার উপর আরোপ করলাম। পরে না হয় পছন্দ মতো করে নিও।”
প্রত্যাশা অবাক হলো। প্রত্যাশাকে আরেক দফা অবাক করে নীরব ছোট্ট হলুদ খামটা পকেট থেকে বের করে বলল,
-” এটা রাখো। তোমার পছন্দ মতো শপিং করে নিও।
প্রত্যাশা ভ্রু গুটিয়ে প্রশ্ন করল,

-” এটা বুঝি বউয়ের ভরণ-পোষনের দায়িত্ব থেকে দিচ্ছেন।”
নীরব একটু হাসল। পরপর আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে বলল,
-” বর হিসেবে তোমার সবটুকু চাওয়া পূরণ করাটাই তো আমার ন্যূনতম দায়িত্ব। উমম! এটাকে ভরণ-পোষণ বললে আমার তেমন আপত্তি নেই। তবে আমি বলবো, একধরনের অভ্যাস করতে চাইছি। এখন থেকেই অভ্যস্ত হতে চাইছি। তোমার দেখভাল করার অভ্যাসে নিজেকে অভ্যস্ত করতে চাইছি। আশাকরি তুমি সুযোগটা দিবে।”
প্রত্যাশা ভাবল–এএসপি সাহেব খুব ধূরন্দর। ঠিক এমনভাবে বলল, যাতে আমি না করতে না পারি।

নীরব ফ্রেশ হয়ে সোফায় বসে কফি খাচ্ছে আর ফোন স্ক্রল করছে। এমন সময় প্রত্যাশার ফোনটা বেজে উঠল। জেনারেল মোডে ছিলো। ঘরের নিরাবতা চিঁড়ে রিংটোনে সেট করা–Main to sheher di thandi Shabnam haan. Gulshan ka itar churau… গানটা বাজতে লাগল। রিংটোনে এমন গান শুনে নীরবের গলায় কফি আঁটকে আসার জোগার। কোনো রকমে খুকখুক কেশে গলাটা ঠিক করল নীরব‌। প্রত্যাশা ফোন হাতে নিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে শুয়ে রিসিভ করল। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে হ্যাপি প্রশ্ন করল,
-” এই প্রত্যাশা কই তুই? কলেজ আসলি না। বিকেলে প্রাইভেটেও তো আসলি না। গ্রুপেও দেখছি না। হঠাৎ কোথায় গায়েব হয়ে গেলি রে?”

-” শ্বশুর বাড়িতে।”
হ্যাপি বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠল,
-” শ্বশুড় বাড়ি? হোয়াট?”
-” আপুর শ্বশুরবাড়ি।”
-” ওহ, তাই বল। এমনভাবে বললি..আমি তো ভেবেছিলাম। আচ্ছা যাক গে…শোন কেমিস্ট্রি স্যার তো খাতা দিয়েছে। সেদিন পরীক্ষা নিলো না..কী হয়েছে জানিস? স্যার তো আমাদের উপর খুব চটেছে। সে কী হম্বিতম্বি করলেন। বলেছেন, তোদের পাঁচ জনের খাতায় সেইম সেইম উত্তর।”
প্রত্যাশা এক হাতে পেট চেপে তেতে উঠল,
-” সেইম উত্তর হবে না তো আলাদা উত্তর হবে। আরে বলতে পারলি না, স্যার আপনি কী আমাদের পাঁচজনের আলাদা আলাদা প্রশ্ন দিয়েছেন? যে উত্তর আলাদা হবে আশা করছেন।”
-” আরে ধূর। বুঝলি না তুই। স্যার বলেছেন–তোরা পাঁচজন একেবারে কপি পেস্ট করে খাতায় তুলেছিস। ভুল গুলোও সেইম। তোরা পাঁচজন একেঅপরকে টুকলি করে লিখেছিস। তাই তোদের এবার নম্বর দেইনি। ফেইল তোরা। খাতা তোদের বাবা-মার কাছে যাবে।”

-” ওওও..”
অপ্রস্তুত গলায় বলে প্রত্যাশা। হ্যাপি ভুলগুলো বলছিলো। এক সময় হাসতে হাসতে বলল,
-” শোন দোস্ত, স্যার তো পুরা আ’গুন! বললেন–তোরা মৌল চিনতে পারিস না। ভুলভাল মৌল মিশিয়ে এমন বিক্রিয়া লিখছিস। খাতায় দেখে মনে হচ্ছে পরীক্ষাগারে করলে তো তখুনি ব্লাস্ট হতো।”
আরো কিছু কথা শেষ করে প্রত্যাশা ফোনটা বিছানায় নামিয়ে রাখে। পেটের ব্যথাটা ক্রমশ অসহনীয় রূপ নিচ্ছে। বিছানায় বসে দুইহাতে কোমর চেপে ধরে। মাথাটা নিচু করে একরাশ যন্ত্রণায় মৃদুস্বরে বলে ওঠে প্রত্যাশা,
-” উফ্ফো।”
নীরব কফির মগ রেখে এদিকেই আসছিল। প্রত্যাশার কষ্টময় মুখ দেখে ওর কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। কাছে এসে উদ্বিগ্ন গলায় জিজ্ঞেস করে,

-” প্রত্যাশা, কোনো সমস্যা?”
প্রত্যাশা কিছু বলতে পারে না, শুধু মাথা নেড়ে না বোঝায়। নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেও ব্যথায় কপাল কুঁচকে যাচ্ছে ওর। নীরব পাশে বসে ওর দুই বাহু আলতো করে ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে নেয়। কপালে ঘাম জমে উঠেছে প্রত্যাশার, মুখমণ্ডলে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। নীরবের মন দুশ্চিন্তায় ভরে উঠল।
-” কী হয়েছে বলো? ডক্ট..”
বাক্যটা শেষ করার আগেই প্রত্যাশা অস্পষ্ট স্বরে বলে,
-” তেমন কিছু নয়।”
তবে দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কিছু একটা হয়েছে। কিন্তু প্রত্যাশা কিছুতেই খুলে বলছে না। নীরব একটু ভেবে নিয়ে নিচু স্বরে সাবধানে জিজ্ঞেস করে,
-” মেয়েলি সমস্যা?”
প্রত্যাশার মুখ লজ্জায় রঙ হারায়। কিছু বলতে পারে না। চোখ বন্ধ করে মাথা নিচু করে হালকা করে সম্মতি জানায়। মাত্র কয়েকদিন হলো বিয়ে হয়েছে, সম্পর্কটাও এখনো সাবলীল হয়ে ওঠেনি। এমন ব্যক্তিগত বিষয়ে লজ্জা পাওয়াটাই স্বাভাবিক। নীরব আর কোনো প্রশ্ন করে না। এক মুহূর্ত দেরি না করে ফোনটা হাতে নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।

ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে প্রত্যাশা চোখেমুখে পানি দিয়ে একটু স্বস্তি পাওয়ার চেষ্টা করে। তন্মধ্যে নীরব হন্তদন্ত পায়ে রুমে ঢোকে। হাতে একটা ফার্মেসির প্যাকেট। নিঃশব্দে সেটা প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে দেয়। তারপর আরও একটা ছোট প্যাকেট হাতে দিয়ে নরম গলায় বলে,
-” এখানে পেইন কিলার আছে। এক্ষুনি খেয়ে নাও। ডোন্ট ওরি, দ্য পেইন উইল ইজ সুন।”
প্রত্যাশা কিছু বলতে পারে না। লজ্জা, কৃতজ্ঞতা আর অস্বস্তির এক অদ্ভুত মিশেলে ও শুধু প্যাকেটটা হাতে নিয়ে মাথা ঝুঁকিয়ে রাখল। নীরব ওর অবস্থাটা বুঝে, যেন কিছুই না ঘটেছে এমন ভঙ্গিতে ব্যালকনিতে চলে যায়। যেন ওর লজ্জাটা আর না বাড়ে। নীরবের পিঠের দিকে প্রত্যাশা তাকিয়ে রইল। প্রত্যাশার বুকটা একটু হালকা লাগল। এতটা কেয়ার, এতটা বুঝে চলা দেখে প্রত্যাশার মনের ভিতর একফোঁটা কৃতজ্ঞতা জমে উঠল। সাথে ভালোও লাগল বটে।
প্রত্যাশা বিছানায় শুয়ে চোখ বুজে। ঘুমের অভিনয় করে আছে। নীরব নিঃশব্দে এসে বিছানার পাশে দাঁড়াল। ফ্যানের বাতাসে কয়েকটা চুল প্রত্যাশার মুখের উপর উড়াউড়ি করছে। নীরব ঝুঁকে একহাত দিয়ে চুলগুলো সরাতে নেয়। এমন সময় প্রত্যাশা ঝট করে চোখ মেলে তাকায়। নীরব অপ্রস্তুত ভঙিতে হাত থামিয়ে নেয়। তারমানে ঘুমায়নি ও। নীরব মুখাবয়ব স্বাভাবিক করে সাফাই দিতে জড়তা নিয়ে বলল,

-” ভ-ভাবলাম চুলগুলো তোমায় ডিস্টার্ব করছে..তাই সরিয়ে দিতে।”
প্রত্যাশা মনেমনে হাসল। হঠাৎ প্রশ্ন করল কৌতুহল নিয়ে,
-” আচ্ছা আব্বু তো সকাল হলেই আমাকে নিয়ে যাবে। চলে যাওয়ার পর.. এএসপি সাহেব কী বউকে মিসটিস করবে?”
নীরব উত্তর না দিয়ে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে নেয়। শুধালো,
-” হাউ আর ইউ ফিলিং নাউ?”
-” বেটার। থ্যাংকস।

পরেরদিন…বিকেল বেলা। প্রীতিদের ড্রয়িংরুমে নীরব বসে। হাঁটুতে কনুই রেখে দুইহাত মুখের কাছে ধরে গভীর ভাবনায় মশগুল– তার ভাইয়ের এত পরিবর্তন কী এমনি এমনি হয়েছে? নাকি সে যেটা ধারণা করে সেটাই সঠিক? প্রশ্নের উত্তর অজানা। আজও সবটা ধোঁয়াশা।
পরিবারের কেউই নীবিড়ের বিয়ের পর যোগাযোগ রাখেনি ওর সাথে। জমজ ছিলো ওরা দুইভাই। একসাথে সবসময় থাকা, একই স্কুলসহ একই ভার্সিটিতে পড়েছে। তবে সাবজেক্ট ভিন্ন ছিলো। হলে একসাথে থেকেছে। প্রীতি ওদের ব্যাচমেট। নীবিড় প্রেমে জড়াল, গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করার আগেই বিয়ে নিয়ে এক মহা ঝামেলা হলো। তারপর আরো ঝামেলা মিলে পরিবারের সবার সাথে নীবিড়ের যোগাযোগ না হলেও, নীরবের সাথে মাঝেমাঝে হতো। কিন্তু দেড় বছর ট্রেনিংয়ের ব্যস্ততার জন্য দুইভাইয়ের আর যোগাযোগ হয়নি। ট্রেনিং শেষে চাকরিতে জয়েন করতে এসে খবর এলো–নীবিড় গভীরভাবে ড্রা’গে আ’সক্ত হয়ে পড়েছে। আচরণ পুরো বদলে গেছে—রাগী, রাগ হলে ভাঙচুর করা স্বভাবে পরিণত হয়েছে। মেয়ে ইচ্ছে ছিলো নীবিড়ের প্রাণ। প্রীতি বিদেশি প্রজেক্টে চাকরি করত। মেয়েকে সময় দিতোই না বলা চলে। ছোট থেকেই নীবিড়ই ইচ্ছেকে বেশি দেখভাল করত, খেলা করত, আদর করত, খুব বেশিই মিশতো। ইচ্ছেও বাবার নেওটা ছিলো। ড্রাগের প্রতিক্রিয়ায় খুব তাড়াতাড়িই নীবিড় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলতে বসে। নীরব ট্রেনিং শেষে এসে এসব শুনে হতভম্ব। কিছু সন্দেহ তীব্র হয়। তারপর নিজে নীবিড়ের জন্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করে।

এদিকে বাবার অনুপস্থিতিতে ছোট্ট ইচ্ছের মানসিক বিকাশে বিঘ্ন ঘটে। কারো সাথে কথা বলতো না, হাসতো না। ছোট্ট চঞ্চল ইচ্ছের চঞ্চলতা হারিয়ে যায়। নীরব যখন ইচ্ছেকে দেখতে আসলো। ইচ্ছে তখন নীরবকেই বাবা ভেবেছিলো। নীরব ভুল ভাঙিয়ে দেয়। তবুও অবুঝ ইচ্ছে পাপাই ভাবতো। এদিকে মেয়ের মানসিক বিকাশে বিঘ্ন ঘটায় প্রীতি সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নেয়। সাথে নীরবও ছিলো। ডক্টর বলেন,
-” ইচ্ছে বাবার অনুপস্থিতিতে RAD রোগে ভুগছে। এরকম চলতে থাকলে ওর সমস্যা বাড়বে। ইচ্ছে যেহেতু আপনাকে বাবা ভাবছে। আর আপনার সংস্পর্শে থাকলে কথা বলে, হাসে, অনুভূতি প্রকাশ করে। তাই বাচ্চাটিকে আর পাঁচটা বাচ্চার মতো স্বাভাবিক হাসিখুশি রাখতে কিছুদিন ওর সাথে অভিনয় করবেন। এটাও একটা থেরাপি। ধীরে ধীরে ইচ্ছে বড় হবে। যখন স্বাভাবিক হবে। তখন…”
ডক্টর আরো কিছু পরামর্শ দেন। নীরবের ভাবনার ছেদ ঘটে ইচ্ছের ডাকে।

-” পাপা…”
ইচ্ছের জন্য আনা চকলেট বক্স দেয় হাতে। প্রীতি উপর থেকে নেমে আসে মেয়ের পিছুপিছু। সিঙ্গেল সোফায় বসল। ইচ্ছে নীরবের কোলের উপর বসে চকলেট খাচ্ছে। টেবিলের উপর একটা খাম। নীরব সেদিকে তাকিয়ে বলল,
-” ইচ্ছেকে স্কুলে ভর্তির ফরম এনেছি। ফরমটা ফিলাপ করে রাখবে। আমি ফ্রি টাইমে এসে নিয়ে জমা দিবো।”
প্রীতি কিছু না বলে কোন স্কুল, সেসব দেখার জন্য খামটা হাতে নেয়। টেবিল থেকে খামটা তুলতে গিয়ে হঠাৎ একপাশে থাকা অপর একটা প্যাকেট পরে যায় ফ্লোরে। পরার সাথে সাথে একটা ছবি ফ্লোরের উপর জ্বলজ্বল করতে থাকে। নীরবের দৃষ্টি যায় সেদিকে। ছবিটিতে চেনামুখ দেখতেই কপালে ভাঁজ পরে নীরবের। নীরব ঝুঁকে ছবিটা মাটি থেকে তুলল। কোলে বসা ইচ্ছে খুশিতে ঝুমঝুম করে বলে উঠল,

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১০

-” জানো পাপা, মামা বলেছে এটা মামী হবে।”
নীরবের চোখমুখ সেকেন্ডেই শক্ত হয়ে যায়। সাথে হাতের আঙুল আপনাআপনি মুষ্টিবদ্ধ হয়।

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১২