মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১৩
মুসতারিন মুসাররাত
হ্যাপির প্রশ্নে প্রত্যাশা থতমত খায়। জড়তা নিয়ে বলল,
-” হ-হ্যা চিনি মানে…ওইযে বলেছিলাম না..আপুর দেবর এএসপি। উনিই সে…”
হ্যাপি বিস্ময় আর খুশিতে উত্তেজিত হয়ে বলল,
-” ওয়াও রিয়েলি! উনি তোর বেয়াই হয়? তাহলে এখন ঝটপট ওনাকে বল..আমাদেরকে হেল্প করতে।”
প্রত্যাশা চোখ গরম করে বলল,
-” মাথা খারাপ হয়েছে তোর? পা’গল নাকি যেচে পরিচয় দেই। আর উনি বাসায় আব্বু-আম্মুর কানে খবর দিক…তাদের মেয়ে থানায়। আম্মু জানলে আমাকে শেষ করে ফেলবে।”
হ্যাপির উচ্ছ্বসিত মুখটা ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। ঠোঁট উল্টে বলল,
-” ওও।”
জলদগম্ভীর স্বরে এক মূহুর্তের জন্য চারিপাশ স্তব্ধ হলেও, আবার চাপা ফিসফিসানি শুরু হলো। গুরুত্বপূর্ণ কাজে সদর থানায় এসেছিল নীরব। এসআই এর রুমে বসে কথা বলার শুরুতেই বাইরে থেকে হট্টগোল, হৈচৈয়ের শব্দ আসছিল। এক প্রকার রাগে বেড়িয়ে আসে। ফিসফিসানি থামাতে বজ্রকণ্ঠে রুঢ় স্বরে বলল,
-” ইনাফ! হোয়াট’স গোয়িং অন হিয়ার? ইজ দিস আ পুলিশ স্টেশন অর আ লোকাল সার্কাস? চুপ করুন সবাই! একবারে চুপ!”
সবাই থেমে যায়। একজন থেমে যায় অন্যজনের চোখের দিকে চেয়ে। ওরা পাঁচজন জড়সড় হয়ে দাড়াল। এর মধ্যে কোয়েলের বাবা একটু সাহস নিয়ে এগিয়ে এসে শুরু করলেন অভিযোগের পর্ব,
-” স্যার, আমার মেয়ে ছোট। নাবালিকা। এইসব বখাটে ছেলে আর তার বন্ধুরা ফুঁসলিয়ে, কিডন্যাপ করে কাজি অফিসে নিয়ে গিয়ে বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। আমি না গেলে তো কাজই হয়ে যেত!”
ওপাশ থেকে রোহানের বাবা মুখ শক্ত করে বললেন,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” আরে ভাই, বখাটে কারে বলছেন? আপনার মেয়ে যদি এতই নিষ্পাপ হইতো, তাহলে ছেলেরে নিয়ে পালায় কেন? আমার ছেলেকে ফাঁসায়া এখন আমারে বখাটের বাপ বানাচ্ছেন!”
নীরব কঠিন স্বরে বলল,
-” প্লিজ, স্টপ। ঝগড়া ঝাটি বন্ধ করুন। আর কী হয়েছে ধীরসুস্থে বলুন?”
এসআই মনেমনে একটু স্বস্তি পেল। কই থেকে এতগুলো উজবুক এসেছে। এদের ঝামেলার সুরাহা করতে সারাদিন তো লাগবেই, সাথে মাথা ধরে যাবে নিশ্চিত।
ওদিকে প্রত্যাশা চোরাচোখে বারবার নীরবের দিকে তাকাচ্ছে। মনেমনে প্রে করছে, নীরব যেনো চিনতে না পারে। আর সহিসালামতে যেনো এখান থেকে বেরুতে পারে। একে তো নেকাব পড়ার অভ্যাস নেই। তারপর বাধাও টাইট হয়েছে। যত সময় যাচ্ছে প্রত্যাশার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাতের পার্সটা পাশের চেয়ারে নামাল। হাত দিয়ে নেকাব সামান্য টেনে জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে হ্যাপির দিকে রাগি দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,
-” কী টাইট করে বেঁধে দিয়েছিস, ভাই। মনে হচ্ছে এইবারই যদি নাকটা একেবারে বোচা হয়ে যায়। আমার কোনো মতো চলনসই নাকটা এবারে, চায়নিজদের মতো বোচা হয়ে যাবে দেখছি।”
কোয়েলের বাবা আবার শুরু করলেন তার অভিযোগ। এসআই মেয়ের বয়ান নিতে কোয়েলকে ডাকল। কোয়েল প্রত্যাশাকে বলল–ওর সাথে, কাছাকাছি থাকতে। ভুল বললে সুধরে দিতে। প্রত্যাশা তো গ্যাড়াকলে পড়ল। নীরবের থেকে দশহাত দূরত্বে থেকেই ওর হার্টবিট অস্থিরতায় বেড়ে গিয়েছে। কাছে গেলে কী হবে আল্লাহ মালুম!
কোয়েল ভ’য়ে ভ’য়েই মিনমিনে স্বরে সবটা বলল– বন্ধুরা কেউ জোর করেনি। বাবা বিয়ে ঠিক করেছিলো। রোহানকে পছন্দ করে তাই নিজ ইচ্ছেতেই বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়। এ-ও বলে, আসল বয়স এইট্টিন প্লাস। বার্থ সার্টিফিকেটে কম দেওয়া।
মেয়ের সাহস দেখে কোয়েলের বাবা বিস্মিত! ভাবেননি মেয়ে তার উপর দিয়ে কথা বলবে। থমথমে হয়ে যায় ভদ্রলোকের মুখ। ভদ্রলোককে উদ্দেশ্য করে নীরব গম্ভীর স্বরে বলল,
-” নিজেই মেয়ের বিয়ে দিতে চাচ্ছিলেন। আবার বলছেন নাবালিকা। আর সার্টিফিকেটে বয়স কমিয়ে দেওয়া এটাও তো ঠিক নয়।”
কোয়েলের বাবা কেশে উঠে বললেন,
-” মানে…মানে, ওইটা তো তখনকার একটা…পরিস্থিতি ছিল।”
নীরব হালকা হাসল,
-” তাহলে তো মিথ্যা জন্মনিবন্ধনের দায়ে, তারপর মেয়েকে বিয়ের জন্য জোর করায় আপনাকে আগে গ্রেফতার করা উচিত। আপনি জানেন এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ?”
ভদ্রলোককের মুখে আর ‘রা’ নেই। রোহানের বাবা বললেন,
-” স্যার, আপনি একদম ঠিক বলছেন। কিন্তু আপনি একটা ব্যাপার বুঝুন; ছেলেমেয়েরা হুজুগে পড়ে গেছে। আসলে তারা এতটাও খা’রাপ না।”
নীরব একটু ভারিক্কি সুরে বলল,
-” ছেলেমেয়েরা হুজুগে পড়ে না। অভিভাবকদের উদাসীনতায় পড়ে।”
থেমে নীরব এবার কোয়েল-রোহান আর ওদের বন্ধুদের দিকে তাকাল। বলল,
-” তোমরা সবাই এখনো অনেক ছোটো। এটা আবেগের বয়স, ভুল করা খুব সহজ, কিন্তু সেই ভুল থেকে শিখে না নিলে ভবিষ্যত গড়া কঠিন হয়ে পড়ে। তোমরা কেউ খারাপ না, কিন্তু দায়িত্বজ্ঞান থাকা খুব জরুরি। ভালোবাসা মানেই পালিয়ে যাওয়া নয়, বরং সাহস করে পরিবারকে জানানো। যোগ্যতা গড়ে তোলো, যাতে একদিন সেই ভালোবাসাকে সবাই সম্মান দিতে পারে।”
তারপর বন্ধুবান্ধবদের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আর তোমরা… বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়িয়েছ, বুঝি বন্ধুর বিপদে পাশে থাকাটা বন্ধুত্ব। কিন্তু চোখ বন্ধ করে নয়। বন্ধুর ভুলে সায় দিলে, তোমরাও সেই ভুলের অংশীদার হয়ে যাও। সত্যিকারের বন্ধু সেই, যে সঠিক পথ দেখায়। এমন ভুল সিদ্ধান্তে উৎসাহ দিলে সেটা বন্ধুত্ব নয়, অপরাধে সহযোগিতা। মনে রেখো–বাল্যবিবাহ কোনো রোম্যান্স নয়, এটা এক ধরনের সামাজিক অপরাধ। বন্ধুকে সাপোর্ট দাও, কিন্তু সঠিক পথে।”
প্রত্যাশা আড়ালে মুখ বাঁকাল–আসছে উপদেশ দিতে…আরেএএ নিজে বাল্যবিবাহের রোল মডেল হয়ে বসে আছে। আবার বলে বাল্যবিবাহ অপ…. হুঁ।
কালো বোরখা পরিহিত মেয়েটার দিকে নজর পড়তেই নীরবের কপালে ভাঁজ পড়ল। গাঢ় চোখদুটো ধীরে ধীরে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে স্ক্যান করে বোরখায় মোড়ানো মেয়েটিকে। মেয়েটার বারবার আড়চোখে তাকানো, একবার মুখ ঘুরিয়ে নেওয়া, আবার কিছুটা তাকিয়ে দেখা; সব মিলিয়ে এক অদ্ভুত অস্থিরতা। যা বুদ্ধিদীপ্ত নীরবকে ভাবাচ্ছে।
সবশেষে দুই পক্ষের উদ্দেশ্যে হালকা গলা খাঁকারি দিয়ে নীরব বলল,
-” দেখুন আমার মনেহয়, এটা কোর্ট-কাচারির বিষয় নয়। তাতে সবার সম্মানই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বরং দুই পরিবার মিলে বসুন, শান্তভাবে কথা বলুন। ছেলেমেয়ের কথা শুনুন, তাদের পছন্দটা বোঝার চেষ্টা করুন। সম্মান আর বোঝাপড়া থাকলে সমাধান এমনিতেই বেরিয়ে আসে।”
অফিসারের যুক্তিসম্মত কথায় দুইপক্ষই কিছুটা নরম হলো। উত্তপ্ত পরিবেশটা শীতল হয়ে আসলো। আরো কথাবার্তা শেষে তারা দুই পরিবার বসে কথা বলার সিদ্ধান্ত নেয়।
একেএকে সবাই প্রস্থান করতে থাকে। কোয়েল পরিবারের লোকের সাথে, রোহান বাবার সাথে। নাহিদ আগেভাগেই বেরিয়েছে। প্রত্যাশা আর হ্যাপি ছিলো পিছে। থানার চৌকাঠ পেরোবে, এমন সময়
-” এইযে, বোরখাওয়ালি ম্যাডাম? ওয়েট, ওয়েট…”
প্রত্যাশা যেন হিমালয়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে বরফে জমে গেল। বুকের ভেতর ধুকপুকুনি শুরু হলো। নীরব ডান ভ্রু খানিকটা তুলে ঠান্ডা অথচ হুকুমের সুরে বলল,
-” আপনি কোথায় যাচ্ছেন? একটু এদিকে আসুন তো।”
প্রত্যাশার আত্মা যেন হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল। মনে মনে প্রমাদ গুনল–এইরে এর মতলব কী? সবাই যাচ্ছে। আমাকে বাঁধা দিচ্ছে কেনো? সবাইকে ছেড়ে মাস্টার প্ল্যান করা আমাকে লকাপে পুড়বে না তো! ইয়া আল্লাহ! ইয়া মাবুদ! রক্ষে করো।
নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে, মুখ গম্ভীর করে, যতটা সম্ভব দৃঢ়ভাবে এগিয়ে গেল প্রত্যাশা। বাইরের চেহারায় সাহসের মুখোশ, ভিতরে রীতিমতো ভূমিকম্প। গলার স্বর শুনলেই তো…তাই যথাসাধ্য কণ্ঠটা মোটা ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে করার চেষ্টা করল। চোখ নিচু করে গলা ভারী করে বলল,
-” জ্বী, আমাকে বলছেন?”
নীরব একহাত পকেটে গুজে দাড়াল। চোখে নিখুঁত পর্যবেক্ষকের দৃষ্টি। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
-” জ্বী ম্যাডাম, আপনাকেই বলছি।”
প্রত্যাশা আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে। হাত জোড়া করে কচলাতে কচলাতে থুতনি নামিয়ে দেয় বুকে, দৃষ্টি নামিয়ে রাখে মেঝেতে। শুকনো ঠোঁট জিভ দিয়ে ভিজিয়ে এক গাল কৃত্রিম অনুনয়ের ছায়া মেখে বলে,
-” সবাইকে ছেড়ে আমাকে আলাদা করে ডাকলেন কেন ভাই? বিশেষ খাতির যত্নের কিছু আছে বুঝি? চা-বিস্কুট..মানে নাস্তার অফারটাই কি করতে যাচ্ছেন?”
‘ভাই’ শব্দটা বোরখাওয়ালির মুখে শুনে নীরবের মুখ থমকে যায় মুহূর্তেই। ফর্সা চেহারায় ছায়া নামে। এদিকে প্রত্যাশা নিজের ছন্দেই বলে যাচ্ছে,
-” এরকম কিছু হলে…আগেই বলছি; আজ সময় নেই, অন্যদিন।”
বোরখাওয়ালি ফটর ফটর করছে তবে মুখ তুলে তাকাচ্ছে না। এর উল্টাপাল্টা ফটর ফটরের ধরণ, আর চোরচোর ভাবসাব দেখে নীরবের তীব্র সন্দেহ এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ঠোঁটের কোণে হালকা বাঁকা হাসি টেনে ঠান্ডা গলায় বলল নীরব,
-” ম্যাডাম, কিছু মনে না করলে, কথাগুলো আমার দিকে তাকিয়ে, চোখে চোখ রেখে বললে ভালো হয়… তাই না?”
প্রত্যাশা মনে মনে একগাদা গা’লি বর্ষণ করল। এই ব্যাটা কিছুমিছু টের পেয়ে গেছে নাকি! চোখে চোখ পড়লে এক্কেবারে চিনে ফেলবে তো! কিছু ভেবে গলা খাঁকারি দিয়ে নাটকীয় ভঙ্গিতে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,
-” আস্তাগফিরুল্লাহ! আপনি কী বলছেন? আমি কি দেখতেই পাচ্ছেন না? আমি যথেষ্ট পর্দানশিন। পরপুরুষের চোখে চোখ রেখে কথা বলা তো পাপ, ভাইজান! আমার লেবাস দেখে আপনার বোঝা উচিত ছিলো, আমি কেমন। কোন আক্কেলে এমন একটা কথা বলে ফেললেন আপনি? ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ!”
নীরবের এবার সত্যিই হাঁপিয়ে ওঠার জোগাড়। বউয়ের মুখ থেকে ‘পরপুরুষ’ তারপর ‘ভাইজান’ সম্বোধন শোনার জন্য নীরব মোটেই প্রস্তুত ছিলো না। কোনো রকমে নিজেকে সামলাল। একে এখানে বেশিক্ষণ রাখলে মান সম্মানের ফালুদা করে দিবে। তাই নীরব আর রিস্ক নিল না। তড়িঘড়ি করে ইশারায় টেবিলের দিকে দেখিয়ে বলল,
-” ওটা বোধহয় আপনার। ফেলে যাচ্ছিলেন।”
চেয়ারের উপর রাখা পার্সটা সত্যিই ভুলে গিয়েছিল প্রত্যাশা। তাড়াতাড়ি হাতে তুলে নিল সেটা। এরপর দরজার দিকে এগিয়ে যেতে যেতে হঠাৎ পিছনে ফিরে একবার তাকাল। দু’জনের চোখে চোখ। নীরব শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে, কপালের মাঝখানে একরেখা ভ্রুকুটি। সেই দৃষ্টির মধ্যেও অদ্ভুত এক স্থিরতা। প্রত্যাশার মাথায় দুষ্টুমির ভূ’ত চাপল। হঠাৎ ডান চোখটা টিপ মে’রে একটা দুষ্টু হাসি ঠোঁটে ঝুলিয়ে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল।
নীরব কিছু মুহূর্ত স্থিরভাবে তাকিয়ে রইল সেই দিকে। তারপর নিজের অজান্তেই ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠল এক অনামা হাসি।
দুপুর থেকেই আকাশে মেঘের আনাগোনা চলছে। ঘড়ির কাঁ’টা চারটার ঘর ছুঁইছুঁই। বাসায় ফিরে দেড়-দুই ঘণ্টা বিছানায় গড়াগড়ি করে, ফোনে রিলস দেখে পার করে প্রত্যাশা। আম্মু এসে গালে তুলে খাইয়ে দিয়ে গিয়েছে। আর কতবার করে বলেছে তাড়াতাড়ি গোসল করতে। ফোন হাতে নিলে কোন দিক দিয়ে সময় যায়, বোঝাই যায় না। মাত্র শাওয়ার নিয়ে বেরোল প্রত্যাশা। বাইরের আকাশ ঘন হয়ে আসছে। দমকা হাওয়ায় জানালার পর্দা বারবার উড়ছে। তার ছায়া ঘরের মেঝেয় লেপ্টে পড়ে কেমন এক রহস্যময় ছায়া সৃষ্টি করেছে। প্রত্যাশা তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। গুনগুন করে গান ধরেছিল হালকা গলায়,
-” দিল গালতি কার বেটা হে গালতি কার বেটা হে দিল….বল হাম_____”
হঠাৎই গলার স্বর থেমে গেল। আয়নায় চোখ পড়তেই বুকটা ধ্বক করে উঠল। আয়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে–সোফায় বসে আছেন তিনি। পায়ের উপর পা তুলে, দুই হাত বুকের ওপর ভাঁজ করে বসা, চোখে সেই চিরচেনা স্থির দৃষ্টি। আয়নায় চোখাচোখি হলো। প্রত্যাশা তড়িৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে বুকে থুতু ছিটিয়ে বলল,
-” আ-আপনি?”
নীরবের দৃষ্টি প্রত্যাশার দিকে। ছোট করে বলল,
-” হুম।”
প্রত্যাশার বিস্ময়ের ঘোর কা’টেনি। বলা নেই, কওয়া নেই! এই লোক হুট করে এখানে! ওর কাছে এখনো মনে হচ্ছে চোখের ভ্রম।
প্রত্যাশার বিস্ময় কাটাতে নীরব ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে এল সামনে। প্রত্যাশা এখনো ঠাঁই ওভাবে দাড়িয়ে। নীরব কাছাকাছি আসতেই ওর হুঁশ ফিরল। আচমকা বুকটা কেঁপে উঠল। একহাতে চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করে ভাব নিয়ে বলল নীরব,
-” হুম, ম্যাডাম… আমি। কেনো এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না?”
প্রত্যাশা কথা হারিয়ে ফেলে। এরমধ্যে আচমকা আরেক ধাপ এগিয়ে আসে নীরব। ওর এত কাছে যে প্রত্যাশার নিঃশ্বাস এবার গলায় আটকে এল। নীরবের দৃষ্টিটা হঠাৎ অন্যরকম ঠেকল। নীরব আয়নার দিকে পলকহীন তাকিয়ে। কয়েক মূহুর্ত পর…নীরবের ডান হাতটা প্রত্যাশার পিঠ স্পর্শ করল। প্রত্যাশার শরীর শিরশির করে উঠল। প্রত্যাশা কিছু বুঝে উঠার আগেই; নীরব ধীরে একহাতে ওর টপসের জিপার তুলে দিল। প্রত্যাশা চোখ বন্ধ করে ফেলল, নিঃশ্বাস বন্ধ। জিপারের ‘ঝুপ’ শব্দে বুকের ভিতরটা ছটফট করল। বুকটা রীতিমত দুরুদুরু কাঁপছে। কাঁপাকাঁপা গলায় বলল,
-” আপনি… কখন এলেন? হঠাৎ?”
নীরবের দৃষ্টি সদ্য শাওয়ার নেওয়া স্নিগ্ধ, সতেজ মুখটায়। সেদিকে নিষ্পলক চেয়েই নীরব মৃদুস্বরে বলল,
-” এই তো… কিছুক্ষণ আগে।”
বাইরে ঝুমঝুম করে বৃষ্টি পড়ছে। প্রতিটি ফোঁটার শব্দ যেন এক একটি সুরের রাগিণী। জানালার পর্দা দুলে উঠছে হাওয়ার ছোঁয়ায়, আর সেই ঠান্ডা বাতাস দুজনকে বারবার ছুঁয়ে দিচ্ছে নিঃশব্দে। ঘন মেঘে শহরের আকাশ এমনভাবে ঢেকে গেছে, যেন আগেভাগেই রাত নেমে এসেছে আজ। ঘরের কৃত্রিম সাদা আলোয় প্রত্যাশাকে অপার্থিব সুন্দর লাগছে। চুলের ভেজা ছায়া, চোখের গভীরতা, আর মুখের কোমল আলো; সব মিলিয়ে এক মোহনীয় উপস্থিতি। নীরব চোখ ফেরাতে পারছে না।
-” ওহ্।”
তিরতিরিয়ে কাঁপা ঠোঁট জোড়া নেড়ে এক শব্দ উচ্চারণ করে প্রত্যাশা। প্রত্যাশা কী বুঝতে পারছে? ওর এই কম্পিত ঠোঁটজোড়া সামনের মানুষটার বুকে ঝড় তুলেছে! তাকে সম্মোহিত করছে! এলোমেলো করে তুলছে। নীরব হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙি করে বলে উঠল,
-” তখন কী বলছিলে যেন? আমি পরপুরুষ? আমার চোখের দিকে তাকানো পাপ? তা এখন সেই তো আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছো।”
থেমে, আচমকা একহাতে প্রত্যাশার কোমড় জড়িয়ে কাছে আনে। প্রত্যাশা স্তব্ধ হয়ে যায়। বুকের কম্পন লাগামহীন। নীরব ভ্রু উঁচিয়ে বলে,
-” তাও একদম কাছাকাছি। এখন বলো…”
প্রত্যাশা লজ্জায় মুখ নামিয়ে ফেলল। মিহি স্বরে বলল,
-” আমি তো মজা করেই বলেছিলাম… তবে শেষের দিকে বুঝতে পেরেছিলাম আপনি ধরে ফেলেছেন… আমি।”
থেমে কিছু ভেবে প্রত্যাশার কপালে গাঢ় ভাঁজ পড়ল। প্রশ্ন করে উঠল,
-” আচ্ছা, আপনি আম্মুকে এসব বলে দিতে আসেননি তো আবার?”
নীরব মুখ শক্ত করে বলল,
-” হুম।”
প্রত্যাশা সঙ্গে সঙ্গে নাক-মুখ কুঁচকে তাকাল। চোখ দুটো বড়বড় করে রাগি রাগি দৃষ্টিতে চাইল। নীরব ঠোঁট ছড়িয়ে নিঃশব্দে হেসে উঠল। বুকের পাশে একটা হাত রেখে অ্যাক্টিং করে বলল,
-” উফ্! এভাবে তাকিও না তো।”
নীরবের কণ্ঠে কিছু একটা ছিলো। প্রত্যাশা চোখ নামিয়ে ফেলল। কেমন অস্বস্তি শুরু হলো। নীরব নরম কোমল সুরে ডাকল,
-” প্রত্যাশা?”
-” হুম?”
প্রত্যাশা দৃষ্টি নুইয়ে রেখেই উত্তর দেয়। নীরব প্রগাঢ় স্বরে বলল,
-” এখন যদি আমি কোনো গালতি করি, তুমি কী রাগ করবে?”
প্রত্যাশা মুখ তুলে নির্বোধের মতন শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। কিছু বলার আগেই নীরব মুখটা এগিয়ে আনল ধীরে ধীরে। নীরবের গাল ছুঁয়ে গেল প্রত্যাশার নরম তুলতুলে গালে। নীরবের খোঁচা খোঁচা দাড়ি গালে লাগতেই প্রত্যাশার শরীরে বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হলো যেন। শিরশিরে এক অনুভূতি ছড়িয়ে গেল গাল-গলা পেরিয়ে সারা শরীরে। শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অদ্ভুত শিহরণ বয়ে যায়। নীরবের নিঃশ্বাস ঘন হয়। গরম নিঃশ্বাস প্রত্যাশার গলায় আঁছড়ে পড়ছে। শ্যাম্পু করা চুলের ঘ্রাণ আফিমের মতো মাদ’কতার সৃষ্টি করেছে। প্রত্যাশার গা থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে। নীরব আবেশে চোখ বুজে নেয়। কোমরের পেঁচিয়ে রাখা হাতটা আরেকটু দৃঢ় হলো।
প্রত্যাশা শক্ত হাতে জামা মুঠো করে ধরে। গালে নীরবের দাঁড়ি লাগছে ওর কেমন কেমন লাগছে। প্রত্যাশা হঠাৎ ব্যাঙের মতো নড়ে উঠল। বিরক্ত কণ্ঠে বলল,
-” উফ্! ছাড়ুন তো। সুড়সুড়ি লাগছে…. ছাড়ুন না। আপনার দাঁড়ি খুব জ্বালাচ্ছে। কেমন খোঁচা খোঁচা বিঁধছে।”
অনুভূতিতে টালমাটাল নীরব থমকে যায়। এমন মূহুর্তে…এটা নাকি বউয়ের কথা। ইমম্যাচিউর মেয়ে বিয়ে করলে যা হয় আরকি। এইভেবে নীরব দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। নীরব গম্ভীর মুখে বলল,
-” এই মুহূর্তে এমন ডায়লগ… সত্যিই? তোমার দাঁড়াই পসিবেল।”
প্রত্যাশা খিলখিলিয়ে হেসে উঠে বলল,
-” এই মিষ্টি কিলবিল টাইপ সুড়সুড়ি কোথা থেকে আসে আপনার দাড়িতে!”
এই বলে একহাত রাখল নীরবের গালে। নীরব সেই হাতের দিকে একপল তাকাল তো আবার প্রত্যাশার মুখের দিকে। রোমান্টিক মুডের বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে এই মেয়ে। পিচ্চি বউ নিয়ে ভবিষ্যতে মহা ঝামেলা আছে…তা ঢের অনুমান করল নীরব।
এরমধ্যেই হঠাৎ ফোনে অফিসিয়াল কল আসায় নীরব দ্রুত বেরিয়ে যায়।
একটা প্রোগ্রাম শেষে এদিক দিয়ে বাসায় ফিরছিল নীরব। হঠাৎ কিছু মনে করে থামে। এমনিতেই সবাই বলে বউয়ের খোঁজখবর নেয় না। তাই ভাবল একবার দেখা করে যাওয়া যাক। অধরা লাঞ্চের কথা বলতেই নীরব বলে–একটা প্রোগাম ছিলো, ওখানে লাঞ্চের ব্যবস্থা ছিলো। মাত্র খেয়ে এসেছে। অধরা আর জোর না করে বলেন– প্রত্যাশা রুমেই আছো। ভেতরে যাও বাবা।
শাশুড়ি মা স্পেস দিতেই প্রত্যাশার রুমে আসে নীরব। রুমে পা রাখতেই ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসে। সোফায় অপেক্ষারত ছিলো নীরব। সদ্য শাওয়ার নেওয়া, কিছুটা খোলামেলা প্রত্যাশাকে দেখে নীরব যেনো একটা ঘোরের মধ্যে চলে যায়। সেই ঘোর তার ইমম্যাচিউর বউয়ের ইমম্যাচিউটিতে কে’টে যায়। তারপর তো ফোন আসতেই বিদায় নিতে হলো।
দু-তিনদিন পর,,,
সময়টা সন্ধ্যার পরপর। দুই পাশে আব্বু-আম্মু মাঝে গোমড়া মুখ করে প্রত্যাশা বসে। আব্বু আম্মুর চোখেমুখে উদ্বেগ আর চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। প্রত্যাশার অবশ্য কোনো চিন্তা হচ্ছে না। শুধু মাঝেমাঝে ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে আহ্, উহ করছে। পা স্লিপ কে’টে ওয়াশরুমে পরে হাতটা বারি লেগেছিল দেওয়ালে। কনুই থেকে কব্জি পর্যন্ত চিনচিনে ব্যাথা করছে। একপাশে তো ফুলে র”ক্ত জমাট বেঁধে কালো হয়ে গিয়েছে। বিকেল থেকে ব্যথা বাড়ায় শফিক সাহেব জোর করে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে এলেন। শফিক সাহেব স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন,
-” ও বাড়িতে বলেছো? নীরবকে?”
অধরা কর্কশ গলায় বলল,
-” এতো বড় মেয়ে ধাড়াম করে ওয়াশরুমে পড়ে হাত ভেঙেছে। এটা শ্বশুর বাড়িতে দেবার মতো খবর? শুনলে উল্টো কথা হবে। এতবড় মেয়ে কীভাবে চলাচল করে?”
শফিক সাহেব মুখটা কাঁচুমাচু করে সোজা হয়ে বসলেন। অধরা ক্ষোভ প্রকাশ করলেন,
-” দুপুর বেলা আম গাছে উঠতে চেয়েছিল। আম ভর্তা করে খাবে। উঠতে দেইনি, সেই রাগ নিয়ে গজগজ করতে করতে গোসল করতে ঢুকেছে। অন্য মনস্ক ছিলো..আর অমনি পড়েছে। ওই পড়াই পড়ত গাছ থেকে। আল্লাহ তাও বাঁচিয়েছেন। অল্পের উপর দিয়ে গেছে। গাছ থেকে পড়লে তো পা সহ কোমড় ভাঙত।”
মায়েদের খালি বাড়তি কথা। কিছু হলেই এটার না ওটার দোষ। জ্বর আসলেও ফোনের দোষ। সব কিছুতেই খালি দোষ আর দোষ। প্রত্যাশা কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,
-” আহ্ আম্মু থামবে..”
মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১২
বেশ কয়েকজন রোগির পর ওদের সিরিয়াল আসল। দরজার পাশে বড়সড় নেমপ্লেট,
ডঃ প্রিতম হাসান সার্থক [মেডিসিন বিশেষজ্ঞ]
নিচে আরো ডিগ্রি লেখা আছে। প্রত্যাশা অতোকিছু দেখল না। শুধু নামটা পড়ল। মনেহলো এই নামটা আগে কোথাও দেখেছে। তবে মনে করতে ব্যর্থ হলো। এরমধ্যে শফিক সাহেব কাঁচের দরজা টেনে ইশারায় মেয়েকে আগে ঢুকতে বলল। ভেতরে পা রাখতেই প্রত্যাশার ভ্রু কুঁচকে যায়।