মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১৭
মুসতারিন মুসাররাত
নীরব শক্ত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,
-” কীভাবে কী হয়েছিল? ডিটেইলস বলো?”
প্রত্যাশা মিহি স্বরে শর্টকাটে সবটা বলে। সবশুনে নীরবের রাগের পারদ বাড়ে। ভেতরের রাগটাকে প্রশমিত করতে চোখ বন্ধ করে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থাকল নীরব। তারপর চোখ খুলে প্রত্যাশার দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ ঠোঁট দুটো দৃঢ়ভাবে চেপে কথাগুলো নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করল। অতঃপর ঠান্ডা কণ্ঠে বলল,
-” তুমি চঞ্চল, ঠিক আছে। আমি সেটা জানতাম। কিন্তু এতটা কেয়ারলেস, এতটা ইরেসপন্সিবল, সেটা জানতাম না।”
একটু থামল। ভেতরে জমে থাকা ক্ষোভ প্রকাশ পেতে থাকল,
-” তুমি একা একা শহর ঘুরে বেড়াও, কাউকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করো না। মনে হলো না, কেউ চিন্তায় পড়তে পারে? বাই চান্স দূর্ঘটনা ঘটতে পারে? এক বারো মনে হয়নি?”
শেষের কথাটা ধ’ম’ক দিয়ে বলে। প্রত্যাশা কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠল। প্রত্যাশা নীরবের চোখে চোখ রাখতে পারল না। দৃষ্টি নত হয়ে গেল, ঠোঁটজোড়া থরথর করে কাঁপছে ওর। নীরব গভীর নিঃশ্বাস ছেড়ে কঠোর স্বরে বলে উঠল,
-” ইউ আর আ গার্ল, গডড্যাম ইট। ডু ইউ ইভেন রিয়ালাইজ দ্যাট? একটা মেয়ের বেসিক কিছু সেন্স থাকে। সে সেন্সটুকু তোমার মধ্যে থাকা উচিত ছিল। বাট তোমার এটুকু বেসিক রিয়েলাইজেশনটাই নাই।”
প্রত্যাশার চোখে টলমল করে জমে থাকা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। শব্দহীন কান্না ভিজিয়ে দিচ্ছে গাল। নীরব কণ্ঠে ধিক্কার নিয়ে বলল,
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
-” তোমার মাঝে মেয়েলি কোনো বৈশিষ্ট্যই নেই। একটা মেয়ের মাঝে যে মিনিমাম সৌম্যতা, শালীনতা, সেন্স অফ সেফটি থাকার কথা। সেসব খুব কমই আছে তোমার মাঝে। পরিবার তোমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে মানে এই নয়, তুমি সেটার মিসইউজ করবে। তোমাকে স্বাধীনতা দিয়েছে, তুমি সেটা মুক্তির লাইসেন্স ভেবে নিয়েছো? স্বাধীনতা আর বেপরোয়া চলাফেরা এক না, প্রত্যাশা। তুমি যেন নিজের এক রেকলেস দুনিয়ায় বাস করছো। যেখানে দায়িত্ব বলে কিছুই নেই। লাইক ইউ আর দ্য সেন্টার অফ ইউর ওউন কেয়স!”
প্রত্যাশার হৃদয়ে প্রতিটি শব্দ ছু”রি হয়ে বিঁধছে। প্রত্যাশা ফুঁপিয়ে উঠল। গলাটা কাঁপতে কাঁপতে ভাঙা স্বরে বলল,
-” আ-আ-সলে… আমি ভাবতে পারিনি এমন কিছু হবে। হঠাৎ রাস্তাটা আ’টকে গেল। দেরি হওয়াতে সন্ধ্যা হ___”
নীরব পুরো কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে আচমকা দু’হাতে প্রত্যাশার কাঁধ ধরে শক্ত করে। গলার স্বর উঁচিয়ে বলল,
-” ভাবতে পারোনি? এত দূর আসার আগে একটিবারও ভাবা উচিত ছিল না? তোমার কী একবারো মনে হয়নি ঘুরতে আসার আগে অ্যাটলিস্ট বাসাতে একবার জানাই? অনুমতির তোয়াক্কা নাই করলে, একবার জানানো প্রয়োজন। তুমি একা নও, তোমার চারপাশে মানুষ আছে। যারা তোমার জন্য ভাবে, যাদের জন্য তুমি চিন্তা না করলেও তারা তোমার জন্য উদ্বিগ্ন হয়। তোমাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। সবার কতটা টেনশন হচ্ছিল, তুমি বুঝতে পারবে সেটা? তোমাকে এসব বলে লাভ কী? তুমি তো তুমিই! নিজের মর্জি মতো চলো। যখন যা ইচ্ছে তাই করো।”
প্রত্যাশা ফুপাতে ফুপাতে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে অসহায়ভাবে ফিসফিস করল,
-” আমি… আমি স্যরি…”
নীরবের রাগ কমল না। নীরব দাঁতে দাঁত চেপে গর্জে উঠে,
-” স্যরি, মাই ফুট।”
বলেই ধা’ক্কা দিয়ে ছেড়ে দিল প্রত্যাশাকে। প্রত্যাশা টাল সামলাতে না পেরে দু’কদম পেছনে হটে গেল। বুকটা চেপে ধরছে কান্নায়, দমবন্ধ হয়ে আসছে ওর। কান্নার শব্দ আটকে যাচ্ছে গলায়। নীরব জোড়াল শ্বাস নিল। প্রত্যাশার চোখের অশ্রু কঠোর মনটাকে একটু মিইয়ে দিল। গলার স্বর রুক্ষ থেকে এবার একটু নরম হলো। মৃদুস্বরে বলল,
-” আমি তোমাকে হার্ট করতে চাইনি। বাট তোমার কার্যকলাপ আমাকে বাধ্য করেছে কথাগুলো বলতে। শুনো, আমি বারবার বলছি তুমি মেয়ে। তুমি মেয়ে; এটা বলে আমি তোমাকে ছোটো করছি না। আর না তো তোমার কোনো দূর্বলতা প্রকাশ করছি। এটা তোমার দূর্বলতা না। তবে এটা বাস্তবতা। মেয়েদের সেফটির জন্য কিছু লিমিট রাখতেই হয়। নিজেকে সেফ রাখার জন্য সমাজের এই বাস্তবতাকে মানতে হয়।”
প্রত্যাশা বো’বা হয়ে আছে। কথা বলার না আছে মুখ, আর না আছে সাহস। শুধু নিঃশব্দে অশ্রু বিসর্জন দিতে থাকে। নীরব আর কিছু বলল না।
প্রত্যাশা বাইকের কাছে মাথা নত করে দাঁড়িয়ে। নীরব একটা মিনারেল ওয়াটার বোতল এনে প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে বলল,
-” চোখে-মুখে পানির ছিটা দিয়ে নাও।”
নীরবের দিকে না তাকিয়ে প্রত্যাশা হাতে নিল। হাত দু’টো কাঁপছিল, বোতলের ক্যাপ ঘুরিয়ে খুলতে সময় লাগছিল। নীরব মুখে কিছুই না বলে একটানে বোতলটা নিজের হাতে নিল। তারপর ক্যাপ খুলে প্রত্যাশার হাতে দিল।
রাত গভীর। প্রত্যাশার দু’চোখের পাতায় ঘুমের ছিটেফোঁটাও নেই। অতিরিক্ত কান্নার ফলে ঘন পাপড়িগুলো একসাথে লেগে আছে। দুইহাতে বালিশ চেপে ধরে মুখ গুঁজে আছে। মাথার নিচের শিমুল তুলোর বালিশের অনেকটাই চোখের নোনতা জলে ভিজে গিয়েছে।
নীরব জরুরী কল এসেছে বলে তখনই চলে যায়। মেয়ের শ্বশুড়-শাশুড়িকে অবশ্য ডিনার না করিয়ে ছাড়েন না শফিক সাহেব। প্রত্যাশা মাথা ব্যথার অজুহাত দিয়ে ডায়নিংয়ে যায়নি। আসলে খুব খা”রাপ লাগছিল। সবার সামনে গেলে সন্দেহ প্রকট হবে। তাই যায়নি।
মেহমান যেতেই অধরা প্রত্যাশার রুমে আসে। একটানে শুয়ে থাকা প্রত্যাশাকে উঠান। প্রত্যাশার চোখ তখনো ভেজা ছিলো। মা’কে দেখে দ্রুত কান্না লুকাতে চাইল। অধরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-” কী হয়েছিল সত্যি করে বল? তোর চোখমুখ অন্যকিছু বলছে? সবার চোখের আড়াল হলেও, আমাকে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। মিথ্যে না বলে…”
মেয়ের চোখমুখ ফোলা। তারপর নীরবেরও মুখাবয়ব স্বাভাবিক ঠেকেনি। ডিনারের জন্য কত করে বললেন, বসলোই না। কাজের কথা বলে তক্ষুনি বেরিয়ে গেল। প্রত্যাশা হাত দু’টো কোলের উপর শক্ত করে, ওড়নার আঁচল মুঠো করে ধরে সবটা বলল। সবটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে নিস্তব্ধ ঘরে হঠাৎ ‘ঠাস’ করে একটা শব্দ ছড়িয়ে পড়ে। অধরার হাত স’জোরে এসে পড়ে প্রত্যাশার গালে। প্রত্যাশা হতভম্ব হয়ে নিজের গালে হাত দিয়ে মায়ের মুখপানে ছলছলে চোখে তাকিয়ে থাকে। অধরা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন,
-” তুই পাঁচ বছরের বাচ্চা মেয়ে নোস। তোকে সবসময় শিখিয়ে পড়িয়ে দিতে হবে এমন নয়। কাউকে না জানিয়ে ড্যাং ড্যাং করে ঘুরতে চলে গেলি। আল্লাহ না করুক যদি আজ কিছু হয়ে যেতো।”
থেমে ফের বললেন,
-” আজ যদি ঠিক সময়ে নীরব না পৌঁছাতো, কী হতো?ভেবেছিস? তুই একা নোস। তোর সাথে আরো দুইটা পরিবারের সম্মান জড়িয়ে আছে।…..”
অধরা বেশ কড়া করে আরো অনেক কিছুই বললেন।
মায়ের থা”প্পড়, ব’কুনির থেকেও নীরবের প্রতিটি কথা প্রত্যাশার মনে বেশি দাগ ফেলেছে। ওই ভারি ভারি ধারালো কথাগুলো ছোট্ট হৃদয়টাকে ক্ষ’তবি’ক্ষ’ত করছে।
রুমজুড়ে অন্ধকার। দূর থেকে বেপরোয়া নেড়ি কু’কুরের ঘেউঘেউ শব্দ আসছে। কাউচে গা এলিয়ে ফোনের অপেক্ষায় থেকে থেকে অবশেষে হাতের ফোনটা অন করল। তারপর ডায়াল করল। রিসিভ হতে সময় লাগল। রিসিভ হতেই জিজ্ঞেস করল,
-” হোয়াট্স দ্য আপডেট? জব ডান?”
-“********।”
ওপাশ থেকে পাওয়া খবরে শরীরটা রাগে কাঁপতে লাগল। রাগে হাতের ফোনটা অমনি ছুঁড়ে দিল। অন্ধকারে ফোনটা গিয়ে জানালার কাঁচে বারি খেল। তক্ষুনি ঝনঝন করে কাঁচ ভাঙার শব্দ ঘরময় ছড়িয়ে পড়তে থাকল। ইচ্ছে করছে সবকিছু জ্বা’লিয়ে দিতে। বড়বড় শ্বাস ফেলে কিছুপল চোখ বুঁজে থেকে পরপর স্বগোতক্তি করে বলল,
-” ভালোবাসা তো শখ নয়… শ্বাসের মতো। আমার ভালোবাসা থামবে মানে তোমার নিঃশ্বাস বন্ধ।”
এক সেকেন্ড থেমে মুখে ডে’ভিল হাসি নিয়ে,
-” পুরো দুনিয়া বলবে…..’আদার্স ওয়ান সাইড লাভ ইট’স ওকে। বাট____ইজ ডিফারেন্ট।’
এই প্রথম একটা সপ্তাহ প্রত্যাশার একটু অন্যরকম গেল। কোনো কিছুই আগের মতো উৎফুল্লতা নিয়ে করে না। প্রথম তিনদিন কলেজ, প্রাইভেট যায়নি। মন খা’রাপ করে রুমেই থেকেছে বেশি। ফোনে বন্ধুদের সাথেও আড্ডা তেমন দেওয়া হয় না। মনটা বড্ড বিষন্ন।
সে রাতের পর নীরব নিজ থেকে আর ফোন দেয়নি। পরেরদিন লোকের মাধ্যমে প্রত্যাশার জন্য ঠিকই নতুন স্মার্টফোন পাঠিয়েছে। তবুও জনাব নিজে আসেননি। প্রত্যাশা রাতে নতুন ফোনে সিম ভরে কল করে। রিসিভ হয়, তবে নীরবের কথা আগের মতো লাগেনি। দায়সারা ভাবে দুএকটা কথা বলে কল কে’টে’ছে। প্রত্যাশার মনটা কেমন কেমন করছে। কিছু একটা মিস করছে। অবচেতন মনটা চাইছে; আগের মতো নীরবের সাথে একটু বেশি সময় নিয়ে আলাপন। নীরবের কথায় হালকা ফাজলামির সুর, আলতো গলায় প্রত্যাশা বলে ডাকা। ইশশ্! প্রত্যাশার মনটা উচাটন করছে।
এরমধ্যে কাল আবার আরেক ঝামেলা পেকেছে। ঝামেলা বলতে যেনোতেনো ঝামেলা নয়। একেবারে মহাঝামেলা। সেদিন সুস্থ অবস্থায়, সম্মান নিয়ে ফেরার ঘটনা বন্ধুদের জানানোর সাথে প্রত্যাশা বিয়ের কথাও জানায়। বিচ্ছু কটা ট্রিট নিতে বাদ রাখেনি। কলেজ ক্যান্টিনে ইচ্ছেমত খেয়েছে, বিল দিয়েছে প্রত্যাশা। গতকাল কলেজে প্রত্যাশাকে মনমরা, অন্যমনস্ক দেখে হ্যাপি আর কোয়েল চেপে ধরে। প্রত্যাশা বলতেই। কোয়েল এ বুদ্ধি সে বুদ্ধি দেয়। কীভাবে বরের রাগ ভাঙাবে নানা ট্রিপস দিতে থাকে। একপর্যায়ে বলে,
-” আরে শোন, আমার আর রোহানের ঝ’গড়া লাগলে। আমরা কথা বলা বন্ধ করে দেই। তবে আমি আবার রেগে বেশিক্ষণ থাকতে পারি না। রোহানটা নিজ থেকে ফোন দেয় না। আমি ফোন দিয়ে মিষ্টি গলায় ডাকতেই, রোহানের রাগ পানি।”
প্রত্যাশা বিরক্ত চোখে তাকিয়ে বলল,
-” তোর ওই মিষ্টি গলা বুঝি ট্যাংক ফুটা করে রস বের করে! রোহান শুনেই গলে পানি! আর আমার অবস্থা এমন যে, আমি ফোনে ‘হ্যালো’ বলতেই এএসপি সাহেবের গলায় যেন হিমালয় থেকে বাতাস এসে ঠান্ডা, নিরুত্তাপ, গম্ভীর করে দেয়।”
থেমে ফের বলল,
-” ধূর বাদ দে তো। উনি এখনো আমার উপর রেগে আছেন। কিচ্ছুতেই মন গলবে না।”
-” আরে তোর মধ্যে রসকষ কিছু আছে নাকি? একটু আদুরে ভঙ্গিতে ডেকেছিস কখনো? এখনকার কাঁপলরা যেভাবে ডাকে আরকি।”
-” মানে?”
কোয়েল নিজের এক্সপিরিয়েন্সের কথা বলে প্রত্যাশাকে বোঝায়। একবার বেইব, বলে ডাকলে তোর এএসপির রাগ কোথায় চলে যাবে। প্রত্যাশা কাটকাট গলায় বলল,
-” এই না না, ওসব বেব-ফেব আমার মোটেই পছন্দ নয়। বি’শ্রী লাগে আমার কাছে। অন্যকিছু বল। আর ওনাকে ওরকম ডাকলে, কষিয়ে ধ’ম’ক দিবে। মাথা খা’রাপ। বাদ দে বোন!”
কোয়েলের সাথে সুর মিলিয়ে হ্যাপিও বলে–একবার দ্যাখই না। বন্ধুদের চাপে, যদি নীরবের মন গলে, এই আশায় প্রত্যাশা কল করল। পাশ থেকে ওরা দু’টো ইশারায় বল..বল করছে। ওপাশ থেকে নীরব হ্যালো বলল। প্রত্যাশা কোনো রকমে জড়তা নিয়েই অস্ফুটে আওড়ায়,
-” হ-হ্যালো নীরব বে-ই-ব।”
চোখ খিচে বন্ধ করে ফেলে প্রত্যাশা। ইয়া আল্লাহ! ধ’ম’ক যেনো না দেয়। এই ভ’য়ে কাঁপতে থাকে। সময় গড়ায় উত্তর আসে না। নীরব কোনো উত্তর না দিয়ে ঠাস করে কল কে’টে দেয়। মুখের উপর কল কাটতেই ওরা তিনটা এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
সকালে তীব্র মন খা’রাপ নিয়ে ঘুম থেকে ওঠে প্রত্যাশা। নতুন করে আর ফোন দেওয়ার সাহস হয়নি। মনটা বলছে, সামনাসামনি গিয়ে স্যরি বললে, এএসপি সাহেব আর রাগ করে থাকতে পারবেন না। রুম থেকে বেরিয়ে বসার রুমে এসে বাবাকে চায়ের কাপ হাতে খবরের কাগজে মুখ ডুবিয়ে থাকতে দেখল। পাশে বসতেই শফিক সাহেব এক গাল হেসে বললেন,
-” শুভ সকাল আমার মা!”
প্রত্যাশা বিরস মুখে বলল,
-” শুভ সকাল।”
-” আমার মায়ের কী মন খা’রাপ? মুখটা ভারি ভারি লাগছে যে? কী হয়েছে সোনা মা আমার।”
বাবার আদরে স্বরে প্রত্যাশা প্রশ্রয় পেল। বাবার কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দিল। ডান হাতের ফাঁক দিয়ে একটা হাত আঁকড়ে ধরল। বলল,
-” উঁহু! কিছু হয়নি তো।”
-” পড়াশোনার কী খবর?”
-” ভালো।”
নীরবের সাথে দেখা করার জন্য ও বাড়ি যাওয়া দরকার। তবে কী করে আব্বু-আম্মুকে বলবে? বলতেও তো লজ্জা লাগছে। প্রত্যাশা তড়িৎ ফন্দি এঁটে নিল। আহ্লাদি গলায় বলল,
-” আব্বু, আপুর কথা খুব মনে পড়ছে। আপুকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”
-” নীলা গিয়েছে এক সপ্তাহও হয়নি। এরমধ্যেই তোর আপুর জন্য মন কেমন করছে?”
অধরা এগিয়ে আসতে আসতে বললেন। মা’কে কী করে সত্যিটা বলবে–আরে না আপুর জন্য নয়, তবে আপুর দেবরের জন্য সত্যিই মনটা কেমন কেমন করছে। ঠিকঠাক কথা বলতে না পেরে, স্বস্তি পাচ্ছি না। প্রত্যাশা আবদারের সুরে বলল,
-” আম্মু, যাইনা আব্বুর সাথে। আব্বুর সাথে সকালে গিয়ে বিকেলেই চলে আসব। আব্বুরও তো আপুকে দেখতে মন চাইছে? তাই না আব্বু?”
প্রশ্নটা শফিক সাহেবের মুখের দিকে তাকিয়ে করে। শফিক সাহেব কিছু বলার আগেই অধরা খেকিয়ে উঠলেন–এখন কোথাও যাওয়া-টাওয়া নেই।
মায়ের রসকষহীন কথা শুনে মনটা আরো খারাপ হয়ে আসল। প্রত্যাশা রুমে এসে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়াল। নীরবের উপর রাগ হলো; ব্যাটা এএসপি সময় একদিন আসবে। সেদিন প্রত্যাশাও এর থেকে কঠোর রাগ, অভিমান পুষে রাখবে। এভাবে কথা না বলে কষ্ট দেওয়া, সেদিন হাড়েহাড়ে টের পাবে। এর দিগুন কষ্ট দিয়ে ছাড়বে, হু। এসব ভেবে ঠোঁট উল্টায় প্রত্যাশা। দুঃখটাকে ফিল করতে মনে হলো একটা স্যাড সং গাওয়া যাক। গলা ছেড়ে গাইল,
-” যদি ভুলতে পারতাম তোরে আমি, কাঁদতে হতো না। আজ মনের ভেতর ক্ষ”ত গুলো, জমতে পারত না।”
গানটা জমল না। চোখ দিয়ে পানি বেরোয়নি। বিকেল বেলা লেবুর রস চোখে লাগিয়ে পুরো ফিলিংসটা নেওয়া যাবে। টেবিলের উপর বাটিতে থাকা খেজুর হাতে তুলে মুখে পুড়ল। শ্বশুর মশাই সেদিন কয়েক রকমের খেজুর এনেছিলেন। মন-মেজাজ ভালো না থাকায় খাওয়াই হয়নি। আব্বুর জন্য জায়নামাজ, কাউন্ট তসবিহ, আরো অনেক কিছুই দিয়েছে। এই দেখে প্রত্যাশা বলছিলো,
-” শ্বশুড় মশাই খুব ভালো। কত সুন্দর আদর করে ডাকে। কখনো রে’গে কথা বলে না। আবার দ্যাখো না, কত কিছু দিয়েছে।”
অধরা সাথে সাথে বলল,
-” হ্যাঁ, কিছু না বললে, তারপর খালি দিলেই সে ভালো। আর উচিত কথা বললেই সে হয় খা’রাপ। যেমন শাশুড়ি উচিত কথা বলে, তাই ভালো নয়। ঠিক বলেছি না?”
প্রত্যাশা জিভ কে’টে ভাবল–এইরে মনের কথা আম্মু বলে দিয়েছে।
দু’দিন পর…সময়টা দুপুর নাগাদ।
প্রত্যাশা মনেমনে বেজায় খুশি। খানিকক্ষণ আগেই আনিশার জন্মদিন উপলক্ষে বাবার সাথে এ বাড়ি এসেছে। যদিও আত্মীয় স্বজন কাউকে বলা হয়নি, নিজেরাই শুধু। তবুও শর্মিলা রাতে ফোন করে শফিক সাহেবের পরিবারকে বলেন। বাড়ির ছোট বউকে আনতে এক প্রকার রিকোয়েস্টের সুরেই বলে।
কিচেনে দুই জা রান্না করছে। নীলা মুখ গম্ভীর করে প্যানে কিছু নাড়ছে। প্রত্যাশা এগিয়ে এসে বলল,
-” আমি কিছু করি?”
প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে নীহারিকা বললেন,
-” থাক। গরমের মধ্যে মাত্রই আসলে। ফ্যানের নিচে গিয়ে বসো।”
নীলা ফোঁসফোঁস করতে থাকে–ওকে ফ্যানের নিচে গিয়ে বসতে বলছে। আর এদিকে আমাকে সেই কখন থেকে আ’গুনের কাছে দাঁড় করিয়ে রেখেছে। যত্তসব! আমার দিকে কারো নজর পড়ে না।
পরী হাতের কাজ সেরে বলল,
-” বড় খালাম্মা, আমার এহানকার কাজ শ্যাষ। কী কী ধোয়া লাগব? দ্যান রোদ থাকতে থাকতে ধুইয়া দেই।”
নীহারিকার হাত জোড়া। প্রত্যাশার দিকে তাকিয়ে বলল,
-” প্রত্যাশা? নীরবের রুমে দ্যাখো সোফায় ওর শার্ট-প্যান্ট আছে। ওগুলো একটু পরীকে এনে দাও তো।”
-” আচ্ছা। আমি এক্ষুনি আনছি।”
প্রত্যাশা মুখে হাসি নিয়ে পা চালাল। হঠাৎ পিছুন থেকে ডাক আসলো,
-” শুনো?”
প্রত্যাশা থেমে গেল। নীহারিকার অনেক বছরের অভিজ্ঞতা। এদিকে প্রত্যাশা ছোট। তাই বলে দিলেন,
-” শার্ট আর প্যান্টের পকেটগুলো চেক করে নিও। দরকারি কাগজ-টাগজ থাকতে পারে। তোমার শ্বশুরের পকেট থেকে তো কাঁচার সময় আগে অফিশিয়াল কাগজ পেতাম। তারপর থেকে আমি ভালো করে দেখে নেই।”
প্রত্যাশা প্যান্টের পকেট চেক করতে থাকে। একটা থেকে কচকচে কটা নোট পেল। পাশে নামিয়ে রাখল। শেষ প্যান্টে হাত ঢোকাতে ভারী ভারী কিছু ঠেকল। বের করল। একটা জুয়েলারি শপের প্যাকেট। হঠাৎ প্রত্যাশার খুলে দেখতে ইচ্ছে করল। প্যাকেটের ভেতর লাল রঙের দুইটা বক্স। একটা বক্সে স্বর্ণের লকেটসহ চেইন। লকেটের উপর ‘P’ লেটার। অন্য বক্সে নুপুর। তবে নূপুরজোড়া বাচ্চাদের। প্রত্যাশা কপালে ভাঁজ ফেলে ভাবতে থাকে, পি-তে এ বাড়িতে কে আছে? কয়েক মূহুর্ত পর মনে হলো–পি ফর তো প্রত্যাশাও হয়। তবে….তবে নুপুরজোড়া কার?
প্রত্যাশা আর না ঘেঁটে ওয়ারড্রবের উপরে রেখে দেয়। দেখা যাক, নীরব এসব কাকে গিফট করে!
এ বাড়িতে এসে জানল। আজ ক’দিন নীরব বাড়িতে বসার ফুসরত পাচ্ছে না। কোনো একটা কেস নিয়ে খুব ব্যস্ত।
আনিশা এসে আবদার জুড়ল। কানামাছি খেলবে। প্রত্যাশার মনটা আবার বাচ্চাদের ক্ষেত্রে খুবই নরম। না করতে না পেরে বলল,
-” চলো তোমার ছোট দাদানের রুমে গিয়ে খেলি।
ড্রয়িংরুমে সবার মাঝে খেললে সবাই বিরক্ত হবে। ভালো দেখায় না। বড়রা সবাই আছে, রুমে চলো।”
নীরবের রুমে প্রত্যাশার চোখ বাঁধা। আনিশা এবার নাক ফুলিয়ে বলল,
-” নতুন ভাবি, নো চিটিং। এবার চিটিং করলে, তোমার সাথে আড়ি।”
-” এই না আর চিটিং হবে না। পাক্কা প্রমিস।”
আনিশা এবারে ব্যালকনিতে লুকাতে যায়। প্রত্যাশা খুঁজতে থাকে। ডাকছে,
-” আনিশা সাড়া দাও। সাড়া না দিলে খেলব না কিন্তু।”
আনিশা কোকিলের সুরে বলল,
-” কু…কু।”
মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ১৬
প্রত্যাশা শব্দটা অনুসরণ করে এগোতেই হঠাৎ ধা’ক্কা লাগে কারো সঙ্গে। আচমকা ধা’ক্কায় টাল সামলাতে না পেরে পরে যেতে নেয়, ঠিক তখনই একজোড়া শক্ত হাত কোমর জড়িয়ে ধরে। শরীরটা থেমে যায় সেই নির্ভর হাতের উপর। ও ত্রস্ত একহাতে চোখের উপরের কাপড় টেনে দেয়। চোখ বাঁধা ছিলো বিধায় ঝাঁপসা দেখছে।কয়েকবার পলক ফেলে স্বচ্ছ করে নেয় দৃষ্টিটা। নীরব ওর দিকে ঝুঁকে। কপাল ঘামে ভেজা, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির ভেতর দিয়ে চিকচিক করছে ঘাম। চোখদুটো আশ্চর্যরকম শান্ত! প্রত্যাশার মুখের দিকে স্থির চেয়ে। ও চোখে চোখ পড়তেই ধ্বক করে উঠল বুক। দু’জনের চোখেচোখ। কয়েক মূহুর্ত গড়াল নিঃশব্দে দু’জন দু’জনের দিকে তাকিয়ে।