মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪৬

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪৬
মুসতারিন মুসাররাত

প্রত্যাশা থমকে গেল। মনে হলো ভূমিকম্পে সব কেঁপে উঠেছে। গোটা পৃথিবী যেনো ভেঙে পড়ছে। পায়ের তলা ফাঁকা হয়ে যায়। দু’পা পেছাতেই পিঠ দেয়ালে ঠেকল। নীহারিকা একবার প্রত্যাশার দিকে আবার নীলাশার দিকে ভালো করে তাকালেন। কণ্ঠে অবিশ্বাস মিশিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-” নীলাশা এসব কি সত্যি?”
নীলাশা মাথা নিচু করে ফেলতেই চিবুক গিয়ে বুকে ঠেকল। চোখ তুলে তাকানোর সাহস হলো না। রাগের মাথায় বলে ফেললেও এখন যেন হুঁশ ফিরল। প্রত্যাশা চোখে টলমলে অশ্রু নিয়ে আপুর দিকে চেয়ে। অবচেতনে বুকের ভেতর থেকে শুধু একটাই প্রার্থনা উঠে এল–আপু একবার বলো এসব সত্যি নয়। যা বললে সেসব মিথ্যে।
নীলাশাকে চুপ দেখে নীহারিকা এবারে গলা চড়িয়ে বললেন,

-” চুপ করে থেকো না নীলাশা। যা জিজ্ঞেস করছি জবাব দাও। এত বড় কথা কেউ এমনি এমনি মুখ ফস্কে বলে না। সত্যিটা তোমার মুখ থেকেই শুনতে চাই।”
নীলাশার হাত-পা মৃদু কাঁপছে। প্রীতি ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে উঠল,
-” চুপ করে আছো কেনো? সবটা বলো…বলো সত্যিটা। আর একটা কথা সবাই জানে সত্য কখনো চাপা থাকে না। একদিন না একদিন সবাই জানতোই। আমি নিজেও জানি। অথচ তুমি আমাকে বলোনি, তবুও জেনেছি। ভ’য় না পেয়ে যা জানো সবটা বলো।”
নীহারিকা বিস্ময়ে প্রীতির দিকে তাকালেন,
-” তুমি জানো মানে?”
প্রীতি মুখটা ইনোসেন্ট বানিয়ে প্রত্যুত্তরে বলে,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” মা ওদের বিয়ের দিন কথাটা আমার কানে আসে। এক বৃদ্ধা মহিলা প্রত্যাশার মাকে বলছিলেন। তখনই বুঝেছিলাম প্রত্যাশা ওনাদের নিজের মেয়ে নয়। আমি ভেবেছিলাম আপনারা হয়তো জানেন। এত বড় কথা কি আর গোপন রাখা যায়। এতবড় একটা বিষয় আড়াল করে লুকিয়ে-চুরিয়ে বিয়ে দেয় নাকি কেউ। এরকম করা তো প্রতারণা, ঠকানোর শামিল। ওনাদেরকে যথেষ্ট ভদ্রলোক মনে হয়েছে। ভাবলাম সবটা জানিয়েই হয়তো বিয়ে দিচ্ছেন। তাই আর কথাটা তুলিনি। কিন্তু এখন তো দেখছি আপনারা কিছু জানেনই না। মা আপনি যেহেতু জানেন না। আমার মনেহয় নীরবকেও জানানো হয়নি।”

প্রত্যাশার বুক ভেঙে আসছে কান্নায়। ঠোঁট কামড়ে কান্না আঁটকে আছে। নীহারিকা কঠিন গলায় নীলাশাকে বললেন,
-” নীলাশা, এভাবে চুপ থেকে আমার ধৈর্য্যর পরীক্ষা নিও না। সবটা বলো, নইলে আমি এক্ষুনি তোমার আব্বু-আম্মুকে কল করতে বাধ্য হবো।”
নীলাশা শাড়ির আঁচল শক্ত করে মুঠোয় ধরল। মাথা নেড়ে কম্পমান স্বরে বলল,
-” হ-হু… সত্যি।”
প্রত্যাশা মূহুর্তেই পাথর বনে যায়। শুধু চোখ দিয়ে টলটল করে অশ্রু গড়াতে লাগল। অথচ মুখ থেকে একটি শব্দও বেরোলো না। শর্মিলা এগিয়ে প্রত্যাশাকে আগলে নিলেন। কী বলে সান্ত্বনা দিবেন ভেবে পাচ্ছেন না। প্রত্যাশাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলেন,

-” তাহলে প্রত্যাশার আসল পরিচয় কী? ওর বাবা-মা কে? আমার তো মনে হচ্ছে তোমার সব জানা।”
প্রীতির খুব কৌতুহল হচ্ছে। প্রত্যাশার আসল পরিচয় জানতে। সমস্যা এই নীলাশার থেকে তো ধ’ম’ক দিয়ে দিয়ে কথা বের করতে হচ্ছে। এইভেবে প্রীতির খুব বি’র’ক্ত লাগলো। প্রীতির আর তর সইছে না। প্রীতি গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,
-” শুধু শুধু টাইম ওয়েস্ট না করে সবটা বলাই ভালো। এমনিতেও সবাই এখন জানবে। মা আপনি না হয় অধরা আন্টিকে কল করুন। আন্টির থেকেই জেনে নিন।”
নীহারিকা রাগত স্বরে ধমকের সুরে বললেন,
-” তুমি থাম।”
প্রীতির গায়ে লাগল। ফর্সা মুখটায় নিমিষেই অন্ধকার নামল। রেগে ভাবল– এক পা কবরে যাওয়ার অবস্থা হলো, তবুও এখনো একটুও দেখতে পারেন না। এইযে এসেছি অবধি কত সুন্দর আচরণ শো করছি। তবুও মন পাওয়া তো দূর, ভালো মুখে দু’টো কথা পর্যন্ত বলেনি।
নীহারিকা গম্ভীর মুখে বললেন,

-” নীলাশা তুমি নির্ভয়ে সবটা বলো। আমি জানতে চাই সবটা। আশা রাখছি কোনোকিছু না লুকিয়ে, মিথ্যেও না বলে শুধু সত্যিটুকু বলবে। কারন সবশেষে সত্য প্রকাশ হয়ই। এটাই ধ্রুব।”
নীলাশা দৃষ্টিজোড়া ফ্লোরে নিবদ্ধ করে মিহি কণ্ঠস্বরে বলতে লাগল,
-” আমার যখন সাত বছর বয়স সেইসময় আমার মৃ*ত বোন হয়। আম্মু অসুস্থ থাকায় হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়। সেই সময় প্রত্যাশাকে হাসপাতাল থেকে পায়। প্রত্যাশাকে জন্ম দিয়ে ফেলে তারা পালিয়ে যায়। আম্মুর বাচ্চাটাকে দেখে মায়া হয়। আম্মু নিয়ে আসে। আম্মুর এক ফুপু হাসপাতালে সাথে ছিলেন। উনি জানতেন আর আমার দুই মামা এক মামী জানে। এছাড়া আব্বু-আম্মু কাউকে জানতে দেয়নি।”
নীহারিকা জিজ্ঞাসা করলেন,

-” ওর বাবা-মায়ের খোঁজ পাওয়া যায়নি? পুলিশ কেস হয়েছিল না?”
-” পুলিশ কেস হয়েছিল কী না আমি জানি না। তবে জানি হাসপাতালের ডিউটি ডাক্তার আর নার্সদের মাধ্যমে আম্মু বাচ্চাটাকে নিয়ে নেয়। বাচ্চাটা ক্ষুধার্ত ছিলো খুব কাঁদছিল। আম্মু সেচ্ছায় দুধপান করায়। ডিউটির নার্সরাও যেন আম্মুর কাছে দিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। ক্লাস সিক্সে থাকতে আমি এসব জানি। আগে জানা ছিলো না। ছোটো মামী মামার কাছ থেকে একটু শুনেছিলেন। আম্মুকে প্রত্যাশার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। সেদিন আম্মু মামীকে বলছিল। আর অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমি সবটা শুনে ফেলি।”
নীলাশা থামল। নীহারিকা জোরেজোরে নিঃশ্বাস ফেলে ফের শুধালেন,
-” ওর বাবা-মার পরিচয় কী?”
-” আমি জানি না।”
নীহারিকা বজ্র কণ্ঠে বলে উঠলেন,

-” নীলাশা তুমি সব জানো। মিথ্যে বলবে না। একটু আগেই বলেছিলে ‘অন্যের পাপ আমার আব্বু-আম্মু দয়া দেখিয়ে বড় করেছে।’ অতএব না জানার নাটক করবে না। তোমার থেকে এমনটা আশাকরি না।”
নীলাশা জিভ দিয়ে ঠোঁটজোড়া ভিজিয়ে অতীতে ডুব দিলো।

মেয়েটির নাম স্বপ্না। গায়ের রং হালকা চাপা, মুখের কাটিং সুন্দরই ছিলো নাকি। জন্ম দেয়ার সময় মায়ের প্রাণ যায়। ছোট থেকেই নানীর কাছে বেড়ে উঠেছে। বাবা আবার বিয়ে করে সংসার পাতেন। কখনো ফিরেও চায়নি। নানার ছোট্ট চায়ের দোকান। নানীর কাছে অভাব অভিযোগ নিয়েই বড় হওয়া। স্বপ্না পড়াশোনায় মিডিয়াম ছিলো। তবে চা বিক্রেতা নানার কাছে সেটাই অনেক বড় কিছু। কষ্ট করে নাতনিকে কলেজে ভর্তি করান। দ্বিতীয় বর্ষে গিয়ে স্বপ্নার প্রেমের সম্পর্ক হয় বড় লোকের ছেলের সাথে। ছেলেটি সম্পর্কে বোকা স্বপ্না অবগত ছিলো না। ছেলেটির চরিত্র মোটেই ভালো ছিল না। বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে রুমডেট করে। মেয়েটি আবেগের বয়সে পা*পে সায় দিয়ে বসে। যেই পা*পে তার ফুলের মতোন জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। পা*প পা*পই। পা*পের পরিণয় হয় ভয়াবহ। বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া, দাপট নিয়ে চলা ছেলেটি স্বপ্নাকে ছু*ড়ে ফেলে। স্বপ্না বিয়ের কথা তুললেই ছেলেটা অট্টহাসিতে ফেটে পরে —

-” যে মেয়ে একজনের কাছে শরীর দিতে পারে, সে আর কতজনের কাছে দিয়েছে হিসেব আছে নাকি! আর তোমার মতো একটা চা-ওয়ালীর নাতনিকে বিয়ে করব আমি? হাউ ফানি! তোমাকে বড়জোর আমার বাড়ির মেইড বানানো যায়। কত টাকা চাই? একদিন বেডে এসেছো, দশ হাজার চলবে?”
স্বপ্না লজ্জায়, অপমানে মুখ খুলতে পারে না। নিজের উপরই তার ঘেন্না হচ্ছে। তবুও বলে,
-” আমাকে ভালোবাসেন সেসব মিথ্যে ছিল? আপনি নিজেই জোর করেছিলেন। এ-ও বলেছিলেন দু’দিনের মধ্যেই বিয়ে করবেন।”

ছেলেটির অপমানমূলক কথার তোপে টিকতে না পেরে স্বপ্না কাঁদতে কাঁদতে ফেরে। গলায় ফাঁস দিতে যায়। নানী দেখে আঁটকে দেয়। এরপর সেই পা*পের ভার বাড়তে লাগলো। প্রথমে বুঝতে পারেনি। পরে যখন বুঝল তখন অনেকটা দেরি হয়ে যায়। জানতে পারে চার মাসের প্রেগন্যান্ট। এবারে সত্যি সত্যি গলায় দড়ি দিল। রাখে আল্লাহ মা*রে কে? কথাটা ফলে যায়। গলায় ফাঁ’স নিয়ে খানিকটা জিভ বেরোলেও বেঁচে যায়।
স্বপ্না এবারে ট্রমায় চলে যায়। কারো সাথে কোনো কথা বলত না। সারাটা সময় রুমেই থাকত। এরপর ঘনিয়ে এল ডেলিভারি ডেট। নানী কৌশলে সদর হাসপাতালে নেয়। রাতের অন্ধকার আকাশে ঝলমলে চাঁদের আলোর মতো জ্বলজ্বলে একটা চাঁদ মুখের মেয়ে শিশুকে স্বপ্না জন্ম দেয়। নানীর অভাবের সংসার। এখন আবার আপদ আসতে যাচ্ছে। তাও আবার পা*প। বৃদ্ধা নানী প্লান আঁটে। কোনো রকমে বাচ্চাটাকে ফেলে স্বপ্নাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে পালালেন। এই পা*প, আপদ ফেলে যেন হালকা হলেন। কিন্তু সেই হালকা হওয়া বেশিক্ষণ টিকলো না। সেই রাতের শেষ ভাগে অতিরিক্ত র*ক্তক্ষরণে স্বপ্না মৃ*ত্যু*র কোলে ঢোলে পরে।

দুমাস খানেক পর নানী হাসপাতালে আসেন। অনেক কষ্টে হাসপাতালের ঝাড়ুদারের মাধ্যমে সাহায্য নিয়ে বাচ্চাটিকে কে নিয়েছেন তার ঠিকানা বের করেন। আসেন অধরার কাছে। সবটা বলেন। বাচ্চাটা যে অধরার কাছে ভালো থাকবে এতটুকু ঠিক বুঝলেন। নিজের পা*পের জন্য অনুশোচনা আর দুঃখ প্রকাশ করে সব ঘটনা অধরাকে জানায়। অধরা জিজ্ঞাসা করেন,
-” আপনার নাতনি পা”প করেছে। সেও দোষী। তাহলেও সেই ছেলের নামে মামলা কেন করলেন না?”
-” গরীবের আবার মামলা। পুলিশের কাছে গেইলে উল্টা ভ’য় দেখাইয়া চাপে রাখতো। ভয়ে যাই নাইকা। সেই পোলা মেয়র আজিম খানের ছোডো ভাই আবির খান। মামলা করতে গেছি হুনলে পোলাপান লইয়া আইয়া চায়ের দোকান তো ভাঙবোই। ঘরে আ*গুন দিতো। ডরে কিচ্ছু কইতে পারি নাইকা।”

নীহারিকা আঁটকে গেলেন নাম দুটোয়। প্রীতি চমকে তাকাল। মেয়র আজিজ খান তার বড় মামা ছিলেন। আর ছোট মামা আবির। অবাক হলো না প্রীতি। সে জানে ছোট মামার চরিত্র সম্পর্কে। মরহুম হওয়ার পরেও শয়তানটাকে প্রীতি দেখতে পারে না। ওই শয়তানটার জন্য বাবাকে হারাতে হয়েছে, মা পঙ্গু হয়েছে। তানিয়ার বিয়েও খান পরিবারেই হয়। চাচাতো ভাইয়ের সাথে। বেশ কয়েক বছর আগে আবির ড্রাইভিং করছিল গাড়িতে তানিয়া আর ওনার স্বামী ছিলেন। ড্রাঙ্ক অবস্থায় থাকায় এক্সিডেন্ট করে বসে। সেই এক্সিডেন্টে ছোটো মামা, আর বাবা প্রাণ হারায়। তবে মা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যায়। তবে সারাজীবনের জন্য পা হারাতে হয়।

প্রীতি ঘনঘন চোখের পলক ফেলে প্রত্যাশার দিকে তাকাল। সম্পর্ক যেনো নিমিষেই পাল্টে গেল। প্রত্যাশা খিচে চোখ বুঁজে নিল। নিজের র*ক্তে*র উপর ঘেন্না হচ্ছে। নিজেকে শেষ করে দিতে ইচ্ছে করছে। দুই হাতে মুখ চেপে ধরল প্রত্যাশা। গাল ভিজে গলা দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। বোবা কান্নায় মেয়েটা বারবার ফুঁপিয়ে উঠছে।
নীহারিকা বাকশুণ্য, হতভম্ব। বুকের উপর হাত চেপে রেখে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন,
-” ছিঃ ছিঃ এতবড় একটা জঘন্য বিষয় জানায়নি। আর এই দুনিয়ায় কী মেয়ের আকাল পড়েছিল? ঘুরেফিরে আমার শত্রুর পরিবারের মেয়েদেরই এ বাড়ির বউ হতে হয়। যেখানে আমি প্রীতিকেই মেনে নিতে পারিনি। সেখানে এই অ”বৈধ, পা*পকে কী করে সহ্য করব। তাও আবার আমার নীরবের বউ হিসেবে। শফিক সাহেবকে এর জবাবদিহিতা করতে হবে। তোমার আব্বুকে এক্ষুনি ডাকো।”

প্রত্যাশার ম*রে যেতে ইচ্ছে করল। নীহারিকা রুমের দিকে যেতে লাগলেন। শর্মিলা প্রত্যাশার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,
-” প্রত্যাশা আমরা তোমার পাশে আছি। আমি এক্ষুনি নীরবকে ফোন করছি। আমার বিশ্বাস নীরব তোমার পাশে থাকবে।”
প্রত্যাশা মনে মনে তাচ্ছিল্য হেসে ভাবল—এখন আমার কাছে দিনের আলোর মতো সবটা পরিষ্কার। নীরব নিজেই আমার জেনেটিক, র*ক্ত নিয়ে কথা বলেছেন। তারমানে নীরব সবটা জানে। নীরব আমার কু'”ৎ”সিত জন্ম পরিচয় জেনেই দয়া দেখিয়েছেন। দয়া দেখিয়ে বিয়ে করেছেন উনি। যার জন্ম, অতীত এমন নোং/রা সেটা জেনেশুনে বিয়ে করা আসলেই মহান লোকের কাজ। আর নীরব মহান সেজে দয়া করেছেন আমাকে।

প্রত্যাশাকে নিয়ে সোফায় বসান শর্মিলা। প্রত্যাশা বিমূর্ত হয়ে হাঁটুতে কনুই রেখে দুইহাতে মুখ চেপে অঝোরে কাঁদছে।
নীহারিকা ফোন নিয়ে শফিক সাহেবের কাছে কল দিলেন। শর্মিলা বারণ করলেন সেসব শুনলেন না। এদিকে শর্মিলা কী করবেন ঠাওর করতে পারছেন না। ত্রস্ত নীরবের কাছে কল দিলেন। রিং হচ্ছে রিসিভ করছেন না। মাহবুব সাহেব মাগরিবের নামাজ পড়তে মসজিদে গেছেন। ফোনটা রেখে গেছেন। উনি সাধারণত ফেরেন একেবারে এশার নামাজ আদায় করে। শর্মিলা বিরক্ত হয়ে নিজে নিজেই বললেন— বিপদের সময় কাউকে ফোনে পাওয়া যায় না। নীরবকে ফোন দিচ্ছি তুলছেই না। ভাইজানও ফোন রেখে গেছেন দেখছি। ভাবীকে একমাত্র নীরবই সামলাতে পারবে। ওর আসাটা খুব জরুরী।
উপায়ান্তর না পেয়ে নিভানকে ফোন করল।‌ নিভান আসছি বলল। শফিক সাহেব রিসিভ করতেই নীহারিকা রাগ-ক্ষোভ নিয়ে বলেন,

-” কী করে পারলেন এমন একটা…”
এতটুকু বলে থেমে গেলেন। জোরেজোরে শ্বাস নিতে লাগলেন নীহারিকা। শর্মিলা ফোন কেড়ে নিলেন। ভাবী রাগের মাথায় কী না কী বলে ফেলে; এইভেবে শর্মিলা ফোন নিয়ে ধীরেসুস্থে সবটা বলেন। ওদিকে সবটা শুনে অধরা বলে সেও যাবে। মেয়েটা অসুস্থ, এখনই এসব হওয়ার ছিলো। সব রাগ গিয়ে নীলাশার উপর জমে।
মাথায় হাত দিয়ে চেয়ারে বসে নীহারিকা। প্রত্যাশা ওভাবেই বসে কাঁদছে। নীলাশার চোখ ভেজা। সে একপাশে থম মে*রে দাঁড়িয়ে। প্রীতি বুকে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে।
বিশ মিনিট খানেকের মধ্যেই শফিক সাহেব আর অধরা আসেন। শফিক সাহেব হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে ঢুকলেন। সোফায় বসা মেয়েকে দেখেই বুকটা হাহাকার করে উঠলো। ডেকে উঠলেন,

-” প্রত্যাশা মা?”
প্রত্যাশা মাথা তুলে তাকাল। ছুটে বাবার বুকের উপর পড়ল। জড়িয়ে ধরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল। হেঁচকি তুলে কাঁদতে কাঁদতে মুখটা তুলে বাবার মুখের দিকে চাইল। ব্যাকুল স্বরে বলল,
-” আব্বু আপু যা বলছে বলো সব মিথ্যে। আমি তোমার মেয়ে। তোমারাই আমার বাবা-মা। আপু আমাকে দেখতে পারে না জন্যই এমন মিথ্যে বানিয়ে বলছে, তাই না আব্বু? তুমি বলে দাও আমি তোমাদেরই মেয়ে।”
প্রত্যাশার মন মানতে চাইছে না। ওই সত্যিটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। এখনো মনটা চাইছে সব মিথ্যে হোক। এরমধ্যে ঠাসঠাস শব্দে সবাই চমকে উঠল। অধরা মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে কোনো কথা না বলে সোজা চ’ড় দিলেন নীলাশার গালে। নীলাশা অবাক চোখে চেয়ে বলল,

-” আম্মু।”
আরেকটা চ’ড় বসিয়ে অধরা রুষ্ট গলায় বললেন,
-” একদম আমাকে আম্মু ডাকবি না। তোর মতো একটা হিংসুটে মেয়েকে পেটে ধরে আমার লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যাচ্ছে। এতটা হিংসা তোর ভেতর? এখন মা হয়েও আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি; নিজে মা হতে পারবি না জন্যই তোর সহ‌্য হচ্ছিল না প্রত্যাশার সুখ। তাই তো তুই এরকম করলি। তোর ভেতর যদি একটু মনুষ্যত্ব থাকতো তুই এই মূহুর্তে বলতিস না। এটা জানার পর এই মূহুর্তে প্রত্যাশার মানসিক অবস্থা কেমন হতে পারে একবার ভাবতে পারছিস? অথচ এই সময় ওকে হাসিখুশি প্রফুল্ল রাখার কথা।”
নীলাশা ভেজা গলায় বলল,

-” আম্মু..”
অধরা হাত তুলে বললেন,
-” চুপ..”
নীহারিকা বলে উঠলেন,
-” শুধু শুধু ওর উপর কেনো রাগ ঝাড়ছেন? এরকম তো হওয়ারই ছিলো। আপনারাই বা কোন আক্কেলে এমন একটা মেয়েকে আমাদের ঘাড়ে গুঁজে দিলেন? প্রথমত মেয়েটার জন্ম নিয়ে আমার চরম আপত্তি। দ্বিতীয় বিষয় যেই পরিবারের লোক দেখলেই আমার ঘেন্না হয়। অথচ নিয়তির কী খেলা আমার ছেলেদের বউ সেই পরিবারের মেয়েরাই হলো। এই মেয়েকে কী করবেন জানি না। তবে আমার পক্ষে এই মেয়ের সাথে এক ছাদের তলায় থাকা অসম্ভব।”
শফিক সাহেব মুখ খুললেন। অসন্তুষ্ট বদনে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বললেন,
-” আমরা কোনোকিছু লুকাইনি। সবটা মাহবুব সাহেবকে জানানো হয়েছে। উনি যদি আপনাদেরকে না জানান সেখানে আমার নিশ্চয় কিছু করার নেই।”
নীহারিকা ঝটকা খেলেন। শর্মিলাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,
-” আবির কই? আবিরকে বল নিভানের বাবাকে ডেকে আনতে। আমি জানতে চাই, সব জেনেও কেনো আমার থেকে সবটা লুকাল।”

অফিস থেকে ফেরার সময় বনলতাতে ঢোকে নীরব। বলল,
-” টু কিলো রসমালাই দিন।”
মিষ্টির প্যাকেট করে আনতে আনতে নীরব বিল মেটাতে ওপাশে গেল। বিল দিয়ে বাকি টাকা পকেটে রাখতে গিয়ে নজর যায় ফোনের স্ক্রিনে আলো জ্বলে উঠল। ফোন হাতে তুলতেই খেয়াল হয় ফোন সাইলেন্ট আছে। সন্ধ্যার পর একটা মিটিংয়ে এটেন্ড করায় ফোন সাইলেন্ট রেখেছিল। এরপর আর চেক করা হয়নি। ছোটমার বেশ কয়েকটা মিসড কল উঠে আছে। আবার নিভানের কল। ন্যানো সেকেন্ডেই নীরবের মনে প্রশ্ন জাগে— এতগুলো কল। বাড়িতে কোনো সমস্যা হয়নি তো? প্রত্যাশা আবার অসুস্থ হয়নি তো? বাবা ঠিক আছেন? ইদানিং বাবার শরীরটাও তো ভালো যাচ্ছে না।
ভাবতে ভাবতেই ফোন তুলে নীরব। রিসিভ করতেই নিভান সবটা বলে। নীরব অমনেই ছুটে যেতে নেয়। দোকানের সেলস বয় পিছু ডাকল। নীরবের কান অব্দি শব্দগুলো পৌঁছায় না। মিষ্টির প্যাকেট ডেস্কের উপর পরে রইল। সেলস বয় হেসে ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে বলল,
-” মাথা খারাপ নাকি। ফেলেই চলে গেল।”

মাহবুব সাহেব বাড়িতে পা রাখতেই নীহারিকা চেঁচিয়ে বললেন,
-” সব জেনেও কেনো আমার থেকে লুকিয়েছো? দেশে কী মেয়ে কম ছিলো? আমার ছেলের জন্য মেয়ের লাইন পড়ে যেতো। তারপরেও কেনো একটা পা”প, অ”বৈ”ধ ভাবে যার জন্ম। আমার শত্রুর পরিবারের র*ক্ত যার শরীরে সেই মেয়েকে আমার আদরের ছেলের বউ করে আনলে? কেনো? নীরব সব জানে? নাকি তার কাছেও সব গোপন করেছো। এই মেয়েকে নীরবের বউ হিসেবে আমি মানতে পারছি না। এখন কী করবে করো।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪৫

ঠাণ্ডা অথচ দৃঢ় কণ্ঠস্বরে সবাই ঘাড় ঘুরিয়ে পিছুনে তাকাল। নীরব গম্ভীর মুখে সবার দিকে একপল চেয়ে বলল,
-” কাউকে জন্ম দিয়ে মাপা যায় না। জন্ম কারো হাতে থাকে না। বাবা-মায়ের পাপ-পুণ্যের হিসেব সন্তানের গায়ে চাপানো অ’ন্যায়। প্রত্যাশার কোনো দো’ষ নেই। দো’ষ যদি থাকে তবে সেটা তার বাবা-মায়ের। কে কোন ঘরে জন্ম নেবে, কী র*ক্ত তার শরীরে বইবে, সেটা মানুষ বেছে নিতে পারে না। বেছে নেওয়ার ক্ষমতা থাকে শুধু নিজের জীবনকে কেমন করে গড়ে তুলবে সেটার ওপর। প্রত্যাশা কেমন সেটা দিয়ে ওকে জাজ করা। নট ওর বায়োলজিক্যাল বাবা-মাকে দিয়ে।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৪৭