মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫৬

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫৬
মুসতারিন মুসাররাত

সাঁঝ নেমেছে একটু আগেই। দূরের রাস্তা, বড় বড় বিল্ডিংয়ের কাচে সোনালী ঝকমকে আলো ঝলকাচ্ছে। রাস্তায় চলমান গাড়ির হেডলাইট গুলো মিষ্টি মিষ্টি আলোর দৃষ্টির ফাঁক দিয়ে একে অপরকে ছুঁয়ে যাচ্ছে। পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে অফিসার্সদের কারো কারো কক্ষে তালা ঝুলছে, কেউ বা মাত্র বেড়িয়ে যাচ্ছে, সেখানে অফিস সহকারী তালা ঝুলাতে ব্যস্ত। কোনো অফিসার্স আবার অল্প সময়ের জন্য কাজে মগ্ন। নীরবের রুমটা ফকফকা সাদা আলোয় ভেসে যাচ্ছে। রিভলভিং চেয়ারে আধো ঝুঁকে বসে থাকা নীরবের মনোযোগ সামনের ফাইলে।

টেবিলে কেস ফাইলের স্তূপ। আজকের কেস এক হাই-প্রোফাইল অর্থ জালিয়াতি মামলা। যেখানে সাসপেক্ট ব্যাংক ট্রান্সেকশন আর ফেক কোম্পানির আড়ালে বড় টাকা পাচার করছে। নীরব বিস্তারিত রিপোর্ট পড়ছে, সাসপেক্ট এর মোবাইল ট্র্যাকিং, সাক্ষীদের বিবৃতি, ব্যাংক স্টেটমেন্ট চেক করছে। মাঝে মাঝে কলম ঠেসে রেখে ভেবেচিন্তে নোটে দাগ দিচ্ছে তো আবার চোখ ফেরাচ্ছে ফাইলের দিকে। একদম চটকদার মনোযোগ দিয়ে ছোটোখাটো সব তথ্য টুকে নিচ্ছে নীরব।
একটা ফাইল টেনে খোলার পর চোখ বেঁকে কলম দিয়ে নোট নিচ্ছে ঠিক তক্ষুনি দরজায় কড়া নড়ার শব্দ হলো। বিনম্র কণ্ঠস্বর এলো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” স্যার, আসব?”
দৃষ্টি সামনের ফাইলে রেখেই নীরব হালকা মাথা নাড়ল। অফিস সহকারীর হাতে চায়ের ট্রে। নিঃশব্দে টেবিলের একপাশে ফাঁকা জায়গাটুকুতে ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ নামাল। কিছুটা জড়তা নিয়ে ইতস্তত স্বরে বলল,
-” স্যার, বাসায় যাবেন না?”
-” এইতো হাতের কাজটা কমপ্লিট করে যাবো।”
চায়ের কাপটা তুলে ঠোঁট ছুঁয়ে গলাটা ভেজাল নীরব। বলল,
-” তুমি চলে যাও। আমি বেরোনোর সময় আমার রুম লকড করে দেব।”
অফিস সহকারী নীরবের অমায়িক ব্যবহার দেখে মুগ্ধ হয়ে লাজুকভাবে মাথা নাড়ল। কণ্ঠে কৃতজ্ঞতা মিশিয়ে বলল,
-” ঠিক আছে স্যার। আসছি।”

ল্যাপটপে আঙুল চালিয়ে নতুন রিপোর্ট টাইপ করল নীরব। সাসপেক্ট এর লাইন, টাইমলাইন, নোট সবই অ্যানালাইজ করে সাজাল। কাজ শেষ করে ল্যাপটপের শাটার নামিয়ে ফোন হাতে নিয়ে কললিস্টে গিয়ে কলে চাপ দিল। ওপাশ থেকে কাঙ্খিত মিষ্টি কণ্ঠস্বর রিনিঝিনি সুর তুলে এল,
-” এতক্ষণে এএসপি সাহেবের মনে পড়ল?”
ঠোঁটে হালকা হাসি টেনে নরম স্বরে বলল নীরব,
-” এতক্ষণে নয়, সব সময়ই মনে পড়ে। মনে শুধু পড়েই না, মনে গেঁথে থাকে। মন-মস্তিষ্কের দখলদারিত্বও কিন্তু তোমার দখলেই আছে। আমার সব ব্যস্ততার ফাঁক গলে প্রতিটা শ্বাসে জায়গা করে বসে আছো তুমি।”
-” মিথ্যে। আজ সারাদিন একটিবারও ফোন দেননি। ইভেন লাঞ্চেও আসেননি। আমি মেসেজ দিয়েছি ডেলিভার্ড হয়েছে, অথচ সীন পর্যন্ত করেননি। এরপরও বলবেন, মনে পড়ে? তাও আবার শ্বাসে শ্বাসে? অসম্ভব!”
মিছেমিছে অভিমান মিশিয়ে বলে প্রত্যাশা। নীরব শব্দহীন হাসল। বলল,

-” একসাথে এত অভিযোগ? এই নাও স্যরি বলছি। আজ একটু বিজি ছিলাম। কী করছিলে বলো?”
-” এই তো বসে আছি।”
-” সন্ধ্যার নাস্তা করেছো?”
-” হ্যাঁ করেছি। কখন ফিরছেন?”
-” এই তো..”
-” এএসপি সাহেবের অপেক্ষায় আছি।”
-” অপেক্ষার প্রহর শেষ করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই আসছি।”
-” ওকে।”
-” প্রত্যাশা একটা কাজ করো তো।”
-” কী?”
-” তোমার রিসেন্ট প্রেসক্রিপশনের একটা ছবি তুলে হোয়াটসঅ্যাপে সেন্ট করো। একটু ফাস্ট, ওকে?”
-” প্রেসক্রিপশনের ছবি! কিন্তু কেনো?”
-” যা বলছি তাই করো।”
প্রত্যাশা ঠোঁট কামড়ে ধরে ভাবল। গমগমে স্বরে বলল,

-” ঔষধ আছে তো। এখনো বেশ কিছুদিন চলে যাবে। যদি অল্প কিছু লাগেও আব্বুকে বলব আনতে। আর…”
নীরবের কথায় ওর কথা অসম্পূর্ণ রয়ে গেল। নীরব ব্যগ্র কণ্ঠে বলল,
-” বাড়তি কথা না বলে, যা বললাম ফাস্ট করো। নো মোর ওয়ার্ডস।”
অগত্যা প্রত্যাশা প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে পাঠিয়ে দেয়। ফেরার পথে ফার্মেসিতে প্রথমে যায় নীরব। প্রত্যাশার ঔষধ, তারপর বাবার ব্যথার, প্রেশারের‌ ঔষধ নেয়। বাবার গুলো মাঝেমাঝেই নেয়া হয়, ওটা এখন মুখস্থ যেন। বাবা-মায়ের ঔষধ ভাইয়াও এনে রাখে। বাবা-মাকে মুখ ফুটে ঔষধ আনার কথা বলতে হয় না। ঔষধ ঘরে থাকতেই ছেলেরা এনে হাজির করে।

ইচ্ছেকে পড়াচ্ছে প্রত্যাশা। খাতায় অক্ষর তুলে দিয়ে শব্দ লিখতে বলে। ইচ্ছে লক্ষ্মী মেয়ের মতো লিখতে থাকে। ন্যাশনালে ভর্তি হয়েছে প্রত্যাশা। ওর ফ্রেন্ড সার্কেলের মধ্যে হ্যাপিই শুধু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে। বাকিরা ন্যাশনালে। এই মুহূর্তে ক্লাস করা হয় না ওর। নোট কালেক্ট করেছে, বাকিটা বই পড়ে প্রথম ইনকোর্স দিয়েছে। মোটামুটি হয়েছে। সায়েন্সের সাবজেক্ট বাদ দিয়ে চয়েজ দিয়েছিল। বর্তমানে বাংলার ছাত্রী ও। সাহিত্য বইটা সামনে ধরে চোখ বুলাচ্ছে। ইচ্ছে লিখা শেষ করে বলল,

-” মামণি, কমপ্লিট।”
প্রত্যাশা এক গাল হেসে বলল,
-” গুড গার্ল।”
সাইন করে ভেরি গুড লিখে দিল। প্রত্যাশা বই-খাতা গুছিয়ে দিতে দিতে বলল,
-” আজকের মতো পড়া শেষ। এখন খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়বে কেমন?”
ইচ্ছে ঘাড় কাত করে হ্যাঁ সূচক জবাব দেয়। পরপর কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করল,
-” বড় মাম্মা বলেছে বড় মাম্মার কাছে গিয়ে পড়তে। তুমি নাকি আর থাকবে না? কোথায় যাবে গো তুমি?”
-” ওহ্, তাই! ভালো তো। আমি আমাদের বাড়িতে যাবো। সেখানে অনেকদিন থাকব। তুমি কিন্তু বড় মাম্মার কাছে লক্ষ্মী মেয়েটি হয়ে পড়বে? বড় মাম্মা খুব ভালো করে তোমাকে পড়া বুঝিয়ে দিবে। তুমি শুধু গুড গার্ল হয়ে তার কথা শুনবে, কেমন?”

-” আচ্ছা, শুনব।”
-” আচ্ছা মামণি তুমিও কী আমার মাম্মার মতো চলে যাবে?”
-” না তো সোনা। কিছুদিন পরেই আবার আসব। তোমার জন্য দু’টো খেলার সঙ্গী আনব। তুমি তাদেরকে আদর করবে, তাদের সাথে খেলবে।”
ইচ্ছে ঝলমলে চোখে উৎফুল্ল কণ্ঠে বলল,
-” ইয়েএএএ! অনেক মজা হবে।”
ইচ্ছের খুশি দেখে ভালো লাগার পাশাপাশি চোখজোড়া চিকচিক করে উঠল প্রত্যাশার। অবুঝ বাচ্চা মেয়েটা কিছু বোঝে না বলেই হয়তো এতটা প্রাণবন্ত আছে। প্রত্যাশার ভাবনা বিচ্ছিন্ন হলো ইচ্ছের প্রশ্নে। প্রত্যাশার হাত ধরে ঝাঁকিয়ে মায়ায় ডোবানো চাহনিতে কেমন করে তাকিয়ে বলে ওঠে ইচ্ছে,

-” মামণি আমার মাম্মা এখনো আসছে না কেনো গো? আমার মাম্মা কী আর কোনোদিনও আসবে না?”
লহমায় প্রত্যাশার মুখটা ম্লান হয়ে যায়। কিছু বলবে তার আগেই নীরবের গলা পেল।
ফেরার সময় জ্যামে আটকা পড়েছিল নীরব। সেইসময় হকারের ঝলমলে খেলনাগুলো চোখে পড়ে। ছোট্ট ছোট্ট প্লাস্টিকের পাখি, ফল, আর ফুল। সবই রঙিন লাইটিং টয়। হাতে নিলেই নরম স্পঞ্জের মতো লাগে। আর একটু নাড়লেই ভেতর থেকে ঝলমলে আলো বেরিয়ে চারদিকে ঝিকিমিকি ছড়িয়ে যায়। রিমোট কন্ট্রোল হেলিকপ্টার, গাড়িসহ দামিদামি খেলনা তো আছেই। নতুন এই ঝলমলে খেলনা দেখে ইচ্ছে খুশি হবে। তাই ভেবে নেয় নীরব। রুমে ঢুকতেই কানে এল ইচ্ছের প্রশ্ন। নীরব ডেকে উঠল,

-” ইচ্ছে?”
ইচ্ছে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই নীরব মুখে হাসি টেনে বলল,
-” ইচ্ছে আজ দেখো তোমার জন্য কী এনেছি।”
আলো ঝলমল খেলনা দেখে ইচ্ছের চোখ গোল হয়ে গেল। নীরব এগিয়ে এসে ইচ্ছেকে কোলে তুলে নিল। কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে আদর করল।
-” পড়া শেষ সোনামণি?”
-” হ্যাঁ, শেষ।”
-” গুড গার্ল। তাহলে এবার এগুলো নিয়ে খেলবে, কেমন?”
ইচ্ছে উচ্ছ্বসিত হাসি নিয়ে নীরবের গালে চুমু দিয়ে বলল,
-” থ্যাংকিউ পাপা।”
-” মাই প্লেজার কিউটি।”
ইচ্ছেকে বিছানায় দাঁড় করিয়ে বলল,

-” এখান থেকে ডাবল থাকা খেলনাগুলো আনিশাকে দিবে।”
-” ওকে।”
পকেট থেকে চকচকে রঙিন মোড়কে মোড়া দুটো ক্যাটবেরি করে বলে নীরব,
-” এই নাও।”
ইচ্ছে ঝলমলে হাসি মুখে নিয়ে চকোলেট হাতে নিল। কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞেস করল,
-” মামণিরটা? পাপা মামণিরটা কই?”
পকেট হাতড়ে আরেকটা ক্যাটবেরি বের করে প্রত্যাশার দিকে বাড়িয়ে বলল,
-” এই তো সোনা মামণিরটাও আছে। সে-ও তো আরেকটা বাচ্চা, না?”
ইচ্ছে এবারে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল। এদিকে প্রত্যাশা এক চিলতে রাগি দৃষ্টি নীরবের দিকে ছুঁড়ল। চোখের ভাষায় বলছে; আপনি বলতে চাইছেন আমাকে এসব বাচ্চাদের খাবারে ভাগ না দিলে আমি রাগ করবো? তাই তো? বুঝেছি, হুম।

নীরব ঠোঁটে চাপা হাসি নিয়ে চুপ করে রইল। এরমধ্যে নীহারিকা এসে ইচ্ছেকে খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যায়। ইচ্ছে দিদুনের কাছেই রাতে থাকে। ঝলমলে খেলনাগুলো শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে লাফাতে লাফাতে বেরিয়ে যায় ইচ্ছে। আনিশাকে এগুলো দেখাবে এক্ষুনি।
নীরব ঘর্মাক্ত ইউনিফর্ম খুলছিল। আকস্মিক প্রত্যাশা বলে উঠল,
-” ইচ্ছেকে একবার ওর মায়ের সাথে দেখা করানো যায় না?”
-” নো।”
প্রত্যাশা কিছুটা ভয়ে ভয়েই বলল,
-” ও বারবার মায়ের কথা বলে। একবার দেখা করানো গেলে। মানে… মাঝে মাঝে এক আধ বার।”
নীরব স্রেফ বলল,
-” ইচ্ছেকে দেখা করাতে নিলে প্রব্লেম হবে। তখন ও মা’কে দূর থেকে দেখে কান্না করবে। মায়ের কাছে থাকার জন্য জিদও করতে পারে। সবমিলিয়ে তখন বেশি সমস্যা ক্রিয়েট হবে। তাই বলছি, এই চিন্তা বাদ দাও।”

ডিনার করার পর থেকেই গা টা কেমন গুলাচ্ছে প্রত্যাশার। যদিও আগের থেকে বমির সমস্যা এখন অনেকটাই কমেছে। প্রথম চারমাস খুব বেশিই বমি হতো। এখন হয় মাঝেসাঝে। বিছানায় শুতে যাবে নীরব বেডটেবিলে থাকা দুধের গ্লাসের দিকে ইশারা করে দেখিয়ে বলল,
-” গ্লাসটা ফাঁকা করে দেন শুবে।”
-” পেট একদম ভরা। এখন কিছুই খেতে পারব না।”
ব্লাডে হিমোগ্লোবিনের পরিমাণ একটু কম আছে। রক্তের স্যালাইন নিয়েছে। তারপর ডাক্তার পুষ্টিকর খাবার খেতে বলেছেন। নীরব ভেবে বলল,

-” অন্তত অর্ধেক টা খাও।”
নীরব ছাড়বে না বরং না খেলে রাগ করবে, অগত্যা জোর করেই অর্ধেকটা কোনো রকমে গলাধঃকরণ করে প্রত্যাশা। ডিমবাতি জ্বালিয়ে নীরব শুয়ে পরে। প্রত্যাশার হালকা মাথা ব্যথা করছিল। নড়াচড়া দেখে নীরব জিজ্ঞেস করল,
-” কোনো সমস্যা?”
-” উঁহু, একটু হেডেক হচ্ছে।”
বলেই নীরবের বুকের উপর মাথাটা রাখল প্রত্যাশা। নীরব একহাতে আলতো করে জড়িয়ে ধরল। আরেক হাত প্রত্যাশার চুলে বুলিয়ে দিতে লাগল। এরমধ্যে কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই প্রত্যাশা হুড়মুড় করে উঠে বসতে নেয়। একহাতে মুখ চেপে ধরে। তবে ধরায় লাভের লাভ কিছুই হলো না। গলগলিয়ে বমি করতে থাকে। বমি নীরবের গায়ের উপর পড়ল। নীরব ত্রস্ত ওঠে বসল। নিজের টিশার্টয়ের দিকে না তাকিয়ে প্রত্যাশাকে আগলে ধরল। উদ্বেগ নিয়ে বলল,

-” প্রত্যাশা? ঠিক আছো?”
প্রত্যাশা ঘাড় নেড়ে ঝট করে বেড ছেড়ে নামল। সেখানেও হড়বড় করে আরেক দফা বমি করল। নীরব লাইট জ্বালিয়ে পাশে দাঁড়াল। প্রত্যাশার চোখে পানি টলমল করছে। বমি করার সময় মনেহয় ভেতর থেকে আত্মা যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে। প্রত্যাশা হাঁপাতে লাগলো। নীরব ওকে ধরে ওয়াশরুমে নিল। ট্যাপের নব ছেড়ে বলল,
-” কুলি করে চোখেমুখে পানির ছিটা দাও।”
প্রত্যাশার গায়েও বমি লেগেছে। নীরবের টিশার্ট ভিজে বুকের সাথে লেপ্টে আছে। নীরব দুই হাতে টিশার্ট টেনে গায়ের থেকে ফাঁকা করল। রুমটা গন্ধে ছেয়ে যাচ্ছে। নীরব প্রত্যাশার কাপড় এগিয়ে দিয়ে বলল,
-” এখন শাওয়ার নেয়ার দরকার নেই। এসময় ঠাণ্ডা লাগলে প্রব্লেম হবে। শুধু চেঞ্জ করে নাও। তুমি আগে ফ্রেশ হয়ে নাও।”
প্রত্যাশা জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিচ্ছে। কিছু বলতে চাইল। নীরব থামিয়ে বলল,

-” আমি পরে ফ্রেশ হচ্ছি। আর পরীকে ডেকে ক্লিন করতে বলছি।”
পরীকে ডাকতেই হুরমুর করে দৌড়ে এল। দরজায় দাঁড়িয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে বললো,
-” কিছু লাগবো ভাইজান?”
-” ফ্লোরে, বেডে বমি পড়েছে। বেডশিট চেঞ্জ করে তারপর ফ্লোরটা ক্লিন করে দিতে হবে।”
-” আইচ্ছা, আইচ্ছা, এক্ষুনি দিতাছি।”
বলতে বলতে নীরবের টিশার্টে ওর নজর যায়। আর যেতেই পরী দুইহাত গালে ধরে বেকুবের মতোন মুখটা বানাল। অবাক কণ্ঠে আস্তে করে বলে উঠল,
-” ইয়া আল্লাহ, পোয়াতি ছোডো ভাবী। বমি তো তার করার কথা। এতদিন দেখছি যার প্যাডে বাচ্চা সেই বমি করে। বাচ্চার বাপেরাও যে বমি করে এই প্রথম দেখতাছি।”
আস্তে বললেও কথাটা নীরবের কানে যায়। বেকুবের মতোন কথা শুনে নীরবের মেজাজ চটল। বজ্রকণ্ঠে ধ’ম’ক দিয়ে উঠল,

-” একটা থাপ্পর দিয়ে সব দাঁত ফেলে দিবো। আজব চিড়িয়া সব! দেখা নেই শোনা নেই, সব মুখ খুললেই উল্টাপাল্টা বলতেই থাকে।”
পরী ভ’য়ে কেঁপে উঠল। মিনমিনে স্বরে বলল,
-” ইয়ে মানে ছোডো ভাইজান আপনার গেঞ্জিতে বমি ভরা। তাই ভাবছিলাম… থুক্কু থুক্কু বুল অয়া গ্যাছে গা।”
পরী সাথে সাথে জিভে কামড় দিল। অদৃশ্য হাতে মাথায় চাটি মে*রে ভাবল — ছোডো ভাবীর আশেপাশে থাকতে থাকতে তার ছোঁয়া লাগল নাকি? তার মতো কীসব পা*গলের মতো কয়া ফ্যালাইছি। হায় আল্লাহ! ছোডো ভাইজান তো এহন আমারে বেকুব ভাববো।
নীরব কোমড়ে একহাত চেপে জোড়াল শ্বাস ফেলল। এদিকে প্রত্যাশা ফ্রেশ হয়ে বেরোতেই নীরব ওয়াশরুমে যায়। পরী প্রথমে বেডশিট চেঞ্জ করল। তারপর ফ্লোর থেকে বমি মুছে নেয়। অতঃপর একটা বালতিতে পানি এনে ন্যাকড়া দিয়ে ফ্লোর মুছতে থাকে। নীরব ততক্ষণে একটু তাড়াতাড়ি শাওয়ার নিয়ে বেরিয়েছে। ভেজা চুলে আঙুল চালিয়ে ঝেড়ে নিল। পরপর লেমন এয়ার ফ্রেশনার নিয়ে স্প্রে করতে করতে প্রত্যাশাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” শুয়ে পড়ো। তোমাকে ভীষণ উইক দেখাচ্ছে।”
প্রত্যাশা বেডে গিয়ে গা এলিয়ে দিল ক্লান্ত ভঙিতে। কণ্ঠে অপরাধ মিশিয়ে বলল,
-” ইশশ্! আমার জন্য তোমাকে ঘুম ভেঙে এখন এসব করতে হচ্ছে। স্যরি গো।”
পরী একগাল হেসে বলল,
-” আরে ছোডো ভাবি এইডা কোনো কাম হইল। আমার অভ্যেস আছে। আর এই সময় এমন অয়।”
পরীর মনে কৌতুহল জাগল। ফ্লোর মুছতে মুছতে বিড়বিড় করল,
-” বমি কইরা এক্কেবারে বন্যা বইয়া দেছে। তয় কথা হইলো ভাইজানের গায়োত পড়লো ক্যামনে?”

কোনো রকমের জাঁকজমকপূর্ণতা, আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান ছাড়াই সার্থক আর অদ্রিকার বিয়েটা সম্পন্ন হয়েছে। আজ সন্ধ্যায় সার্থকের নামে তিন কবুল পড়ে বিবাহিত জীবনে পদার্পণ করেছে অদ্রিকা আহসান। এমন সময় রাত সাড়ে এগারোটায় হাসপাতাল থেকে ইমার্জেন্সি একটা পেশেন্টের আর্জেন্ট সিজার করতে হবে বলে কল আসে অদ্রিকার কাছে। কোনো ডাক্তারের সিডিউল নেই। রাতে ডক্টর পাওয়া যাচ্ছিল না। উক্ত হাসপাতালের শেয়ারে অদ্রিকা- সার্থক দু’জনেই আছে। মানবিক দিক বিবেচনা করে মা ও শিশুর জীবন রক্ষার্থে অদ্রিকা হাসপাতালে ছোটে। যদিও বিয়েতে সাদামাটা সাজগোজ ছিলো। সেই সাদামাটা সাজগোজ ধুয়ে, শাড়ি পাল্টে স্যালোয়ার স্যুট পরে যায়। সার্থক নিজেই ড্রপ করে দেয়। পেশেন্টের একটা ফুটফুটে কন্যা সন্তান হয়েছে।
সার্থকের সাদা মার্সিডিজ গাড়িটা শহরের রাতের ফাঁকা শুনশান রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। অদ্রিকা গাড়ির হেড রেস্টে মাথাটা এলিয়ে বলল,

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫৫

-” বিয়ের রাতে নতুন বউ বাসর ঘরে না থেকে ও.টিতে। এরকম একটা নিউজ হেডলাইন হলে মন্দ হয় না, ঠিক বলেছি না?”
সার্থকের হাত দুটো স্টিয়ারিংয়ে। সে নিরুত্তর রইল । অদ্রিকা কপালে ভাঁজ ফেলে বলল,
-” এইযে ডাক্তার বাবু, আপনাকে দেখে ইন্টার্নশিপের স্টুডেন্ট মনে হচ্ছে। কোনো কথা নেই, কেমন চুপচাপ। মনে হচ্ছে নতুন জীবনে পদার্পণে আপনি খুবই ভীতু সন্ত্রস্ত। ঠিক ইন্টার্নশিপ নেয়া স্টুডেন্টের মতো।”

মধ্য রাতের চাঁদ পর্ব ৫৭

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here