মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৪০

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৪০
নুজাইফা নূন

”সারজিসের ফ্লাইটের সময় ঘনিয়ে এসেছে।যদি ও মাকে কিছুদিনের জন্য কাছে পেয়ে সারজিস ভেবেছিলো সে কানাডা যাবে না।বাকি জীবন টা সে তার মায়ের আদর ভালোবাসায় কাটিয়ে দিবে। কিন্তু ভাগ্য তার সহায় হয় নি।
মাকে পেয়েও হারিয়ে ফেলছে সারজিস।আর কখনোই যমুনা মির্জা তার কাছে ফিরে আসবে না।সেদিন যমুনা মির্জা কে না পেয়ে সারজিস ছাদে ছুটে এসে দেখে‌ যমুনা মির্জা রক্তাক্ত অবস্থায় ছাদে পড়ে রয়েছে।মাথা ফেটে অনবরত রক্ত ঝরছে।সারজিস এগিয়ে গিয়ে যমুনা মির্জার পাল্স চেইক করে দেখেন তার পাল্স চলছে না।শরীর একদম বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে।সারজিসের আর বুঝতে বাকি রইলো না যে সে আবারো মায়ের আদর ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে গেল।

মায়ের মৃত্যুতে প্রচন্ড ভেঙ্গে পড়ে সারজিস।পেয়েও হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা কুঁরে কুরে খায় সারজিস কে ।একে তো মাকে হারানোর বেদনা এরপর আবার সিজদাকে সাইফানের সাথে দেখা যেন মরার উপর খাড়ার ঘা হয়ে দাঁড়ায় সারজিসের কাছে।আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও সারজিস স্বাভাবিক হতে পারে না। চোখের সামনে রোজ রোজ সিজদা কে দেখা কঠিন হয়ে পড়ে তার। সিজদার মায়া কাটাতে শেষ পর্যন্ত দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় সে।সবাই হাজার বলে কয়েও সারজিসের দেশ ত্যাগ আটকাতে পারে নি।হালিমা বেগম নিজে হাতে সারজিসের পছন্দের সব রান্না করেছেন।ডিনার টাইমে মির্জা পরিবারের সদস্যরা এক জায়গায় হয়েছেন।রামিম কেও ইনভাইট করা হয়েছে।সে প্রথমে আসতে না চাইলেও পরে সারজিসের জোরাজুরি তে আসতে বাধ্য হয়েছে।হালিমা বেগম সারজিসের প্লেটে এটা ওটা তুলে দিচ্ছেন।সারজিস ও তৃপ্তি সহকারে খাচ্ছে। খাওয়ার এক পর্যায়ে সারজিস বললো,

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-” যেহেতু সবাই এখানে উপস্থিত আছে।তাই আমি সবার উদ্দেশ্যে কিছু বলতে চাই।তোমারা হয়তো জানো না সামিরা আর রামিম একে অপরকে ভালোবাসে।রামিম বেশ কয়েক বছর ধরে আমার সাথে কাজ করছে।আমি রামিম কে যতোটুকু চিনেছি রামিম খু‌ব‌ই ভালো ছেলে।এ যুগে রামিমের মতো একটা ভালো ছেলে পাওয়া দুষ্কর।
যেহেতু রামিম সামিরা দুজন দুজনকে ভালোবাসে।তাই আমার মনে হয় নি তাদের সম্পর্ক টা সবার মেনে নেওয়া উচিত।সারজিসের কথা শেষ না হতেই শান্তা মির্জা তেতে উঠে বললো,

-” ইম্পসিবল।এমন একটা ভিখারি ছেলের সাথে আমি কিছুতেই আমার মেয়ের বিয়ে দিবো না।ঐ ছেলের কি আছে? না আছে টাকা পয়সা , ব্যাংক ব্যালেন্স।আর না আছে কোনো দালানকোঠা। আমার মেয়ের জন্য কতো বড় বড় ঘর থেকে বিয়ের সম্বন্ধ আসছে।কতো বড়লোক বাপের ছেলেরা আমার মেয়ের জন্য পাগল।আর আমি কিনা একটা রাস্তার ছেলের সাথে আমার মেয়ের বিয়ের দিবো? এটা তুমি ভাবলে কি করে ?”
-” শুধু টাকা পয়সা ব্যাংক ব্যালেন্স থাকলেই সুখী হ‌ওয়া যায় না আম্মি। ভালোবাসা থাকলে কুঁড়ে ঘরে সুখ থাকে।”
-”সংসার করা এতো সহজ নয়।প্রেমের জীবন আবেগ দিয়ে চললেও বিয়ের পরবর্তী বিয়ের জীবন বিবেক দিয়ে চালাতে হয়।সংসারে যখন অভাব অনটন দেখা দিবে তখন কোন আবেগ ই কাজ করবে না। টাকা না থাকলে ভালোবাসা এমনিতেই জানালা দিয়ে পালিয়ে যাবে।।আমি চাই না আমার মেয়ের সাথে এমন কিছু হোক।”

-” বাবা তোমার কি মতামত? তুমি কি চাও না তোমার মেয়ে সুখে শান্তিতে থাকুক?”
-” এক্ষেত্রে আমি তোর মাকে সাপোর্ট করবো‌।তুই যেটা বলছিস সেটা কখনোই সম্ভব নয়।
আমি সামিরার জন্য অনেক ভালো পাত্র নিয়ে আসবো।খুব সুখে শান্তিতে থাকবে আমার মেয়ে।”
-” এতোক্ষণে সবটাই শুনছিলো সামিরা।রামিম নিজের করে পাওয়ার যে শেষ আশা টুকু ছিলো।সেটাও এক মূহুর্তে শেষ হয়ে গেলো। ফারুক মির্জার কথা শুনে সামিরার গলা দিয়ে ভাত নামে না।সামিরা কাঁদতে কাঁদতে খাবার ছেড়ে এক দৌড়ে নিজের রুমে এসে দরজা বন্ধ করে দেয়।”

-” ডিনার শেষ করে সবাই যার যার মতো শুয়ে পড়ে।সারজিস যখন বুঝতে পারে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে তখন বাড়ির সমস্ত সিসি টিভি ক্যামেরা অফ করে দিয়ে চুপিচুপি সামিরার রুমের দরজায় এসে টোকা দেয়।সামিরা তখনো বিছানার উপর বসে চোখের পানি ফেলছিলো। দরজা খোলার ইচ্ছে নেই তার।সে দরজা না খুলে কান্না করতে থাকে।সামিরা দরজা খুলছে না দেখে সারজিস সামিরা কে মেসেজ দেয়,

-” বোন দরজা খোল।”
-” সারজিসের মেসেজ পেয়ে সামিরা চোখের পানি মুছে তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে দরজা খুলে সারজিস কে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বললো,
-” ভালোবাসা কেন এতো অসহায় ভাইয়া? বিশ্বাস করো ভাইয়া আমার টাকা পয়সা ধনদৌলত কিছুই চাই না।আমার শুধু রামিম কে চাই।রামিম কে ছাড়া আমি বাঁচতে পারবো না ভাইয়া।”

-” সারজিস সামিরার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-” তোর ভাইয়া এখনো বেঁচে আছে সামিরা।ভালোবাসে না পাবার যন্ত্রনা কতোটা কঠিন।আমি বুঝতে পারছি।যে কষ্ট আমি পাচ্ছি সেই কষ্ট তোকে আমি পেতে দিবো না বোন‌। তুই পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোর ব্যাগপত্র গুছিয়ে নে।”
-” কেন ভাইয়া?”
-” নিচে রামিম তোর জন্য অপেক্ষা করছে।”
-” কিন্তু ভাইয়া?”
-” কোনো কিন্তু না।এ ছাড়া রামিম আর তোর এক হবার আর কোনো উপায় নেই।এখন ডিসিশন তোর। তুই কি করবি ভেবে দেখ।সামিরা কোনো কথা না বলে চুপচাপ তার জামাকাপড় গুছিয়ে নেয়।সারজিস সামিরা কে নিয়ে নিচে এসে দেখে রামিম বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।সারজিস সামিরা কে বাইকে বসিয়ে দিয়ে বললো,

-” কোনো টেনশন করিস না বোন।কাল যেহেতু আমার ফ্লাইট।সবাই আমার দিকেই ফোকাস দিবে।এখন‌ই সুযোগ।এই সুযোগে তুই তোর ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে অনেক দূরে চলে যা।তোরা সুখে থাক‌।ভালো থাক।আর রামিম তোমার উপর ভরসা করে আমি বাড়ির সবার বিরুদ্ধে গিয়ে সামিরা কে তোমার হাতে তুলে দিলাম।আমার বোনের চোখ থেকে যদি একফোঁটা ও পানি পড়ে।আমি কিন্তু তোমাকে ছেড়ে কথা বলবো না।তোমার একাউন্টে আমি কিছু টাকা পাঠিয়েছি।আপাতত কিছুদিন শহর ছেড়ে অনেক দূরে চলে যাও।চিন্তার কোনো কারণ নেই।তোমার চাকরির ব‌্যবস্থা করে দিবো আমি।”
-” আমার বড় ভাই ছিলো না।বিধাতা বড় ভাই স্বরুপ আপনাকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন।আপনি এ পর্যন্ত আমার জন্য আমার পরিবারের জন্য যা যা করেছেন।সেটা নিজের লোকেও করে না।আমি আপনার কাছে চির কৃতজ্ঞ থাকবো স্যার।আজকে আপনি আমার জন্য করলেন আমার গায়ের চামড়া দিয়ে যদি আপনাকে জুতা তৈরি করে দেই। তবু ও সেটা কম হয়ে যাবে।”

-” জুতার কোনো প্রয়োজন নেই।আমি আমার অনেক প্রিয় একটা জিনিস তোমার হাতে তুলে দিচ্ছি।তার অযত্ম যেন না হয়।তোমার কাছে কিছুই চাওয়ার নেই আমার।তুমি শুধু আমার বোনের খেয়াল রাখবে। তাতেই আমি খুশি।।”
-” আমি আমার জীবন দিয়ে হলেও চেষ্টা করবো স্যার ‌।সামিরার সব স্বপ্ন পূরণ করার দায়িত্ব আমার।আমি সামিরার কোনো ক্ষতি হতে দিবো না। এইটুকু ভরসা আপনি আমার উপর করতেই পারেন স্যার।”
-” সারজিস সামিরার কপালে চুমু দিয়ে বললো,

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৩৯

-” ছোটবেলা থেকেই তুই যা যা চেয়েছিস সবটা দিয়েছি।তোর এই শেষ চাওয়া পূরন করতে না পারলে আমি কিছুতেই স্থির থাকতে পারছিলাম না। নিজেকে ব্যর্থ ভাই মনে হচ্ছিলো।ভালো থাকিস বোন।”
-” তুমি ও নিজের খেয়াল রেখো ভাইয়া।কানাডা গিয়ে আমার কথা ভুলে যেও না।”
-” আমি প্রতিদিন ফোন দিয়ে তোর খোঁজ খবর নিবো।এখন কথা না বাড়িয়ে যা।কেউ জেগে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে।”
-” সারজিসের থেকে অনুমতি পেয়ে সাইফান বাইক স্টার্ট দেয়।সামিরা তার ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে ছুটে চলে দূর অজানায়।।”

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৪১