মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৬

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৬
নুজাইফা নূন

-” ফজরের আযানের মিষ্টি ধ্বনি কর্ণকুহরে প্রবেশ করতেই ঘুম ভেঙ্গে যায় সিজদার। সিজদা তড়িৎ গতিতে বিছানা ছেড়ে উঠে ওয়াশ রুমে চলে যায়।প্রায় দশ মিনিট পর ওয়াশ রুম থেকে বেরিয়ে দেখে সালেহা বেগম তখনো ঘুমিয়ে রয়েছে।সিজদা সালেহা বেগম কে ডেকে তুলে দিয়ে নিজে জায়নামাজ বিছিয়ে নামাজে দাঁড়িয়ে যায়। ফজরের নামাজ শেষে কিছুক্ষণ কোরআন তেলাওয়াত করা সিজদার রোজকার অভ্যাস।আজ ও তার ব্যতিক্রম হয় নি। কোরআন তেলাওয়াত শেষে জায়নামাজ গুছিয়ে রেখে রুম থেকে বের হবার জন্য পা বাড়াতেই সালেহা বেগম সিজদার হাত ধরে বললো,

-”তুই বিয়ে বাড়িতে যাস নে মা।আমার ভেতর টা কেমন জানি কুঁ ডাক ডাকতাছে।বার বার মনে হয়তাছে তোর লগে খারাপ কিছু হ‌ইবো।সারা রাত দু চোখের পাতা এক করবার পারি নাই।তোর জন্য চিন্তা হচ্ছে খুব।তোর যাওনের দরকার নেই মা।ছোট ম্যাডাম ভালা মানুষ না।এক্কারে মিশকা শয়তান।”
-” তুমি শুধু শুধু টেনশন করতাছো খালা। আমার কিচ্ছু হ‌ইবো না।আপামণি নিজেও একটা মাইয়া।একটা মাইয়া হ‌ইয়া অন্য মাইয়ার লগে খারাপ কেউ কেমনে করতে পারবো ক‌ও? তুমি একদম চিন্তা ক‌ইরো না।”

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

-”চৌদ্দ বছর বয়সে বাপ ম‌ইয়া যায়।বাপ যাওয়ার পর অনেক কষ্ট ক‌ইয়া মা আমার বিয়া দেয়। তহন সংসারের কিচ্ছু বুঝতাম না।দিন রাত শ্বাশুড়ি ননদের দাঁত ঝাড়ি সহ্য করতে হতো।সোয়ামি রোজ রাইতে যৌতুকের টাকার লাইগা গালাগাল করতো, মারতো। তবু ও মাটি কামড়ে প‌ইড়া ছিলাম।বছর ঘুরতে না ঘুরতেই আমি পোয়াতি হয়।পোয়াতি অবস্থায় ও শ্বাশুড়ি ননদ সোয়ামির হাতে মার খাইছি। হুট করেই একদিন প্রসব বেদনা শুরু হয়।আমি গলা কাটা মুরগির মতো ঝটপট করতে ছিলাম।দাই মা আইয়া কিছু করবার পারে না। সোয়ামি রে ক‌ইছিলো সালেহার অবস্থা বেশি ভালা না।

ওরে হাসপাতালে ল‌ইয়া যাও।নাইলে বাচ্চা‌ বাঁচাতে পারবা না।কেউ শুনে নাই সে কথা।আমি মরা মাইয়া জন্ম দেই।তার কয়েকদিন পরেই সোয়ামি ঘরে নতুন ব‌উ ল‌ইয়া আহে।আমারে তালাক দেয়।মার সংসারে বোঝা হতে চাই নি। ভাবছিলাম নিজেরে শ্যাষ ক‌ইরা দিমু। কিন্তু পারি নাই। সেদিন ভাইজান ফেরেশতার মতো আইসা আমারে বাঁচায় লন।আমারে তার লগে নিয়া আহেন এই মস্ত বড় বাড়িতে। এইহানে আইসা আমি তোরে পাই।তোরে আমার নিজের মাইয়ার মতো আদর ভালোবাসা দিয়া বড় করি।তোর মধ্যে আমি আমার মরা মাইয়ারে দেখতে পাই।তোর বিপদ সংকেত আমি টের পাই। সালেহার কথা শুনে সিজদা তাকে জড়িয়ে ধরে বললো,

-” আমার কিচ্ছু হ‌ইবো না।তোমার ভালোবাসার জোর আমার কিচ্ছু হ‌ইতে দিবো না। তুমি চলো তো। অনেক বেলা হ‌ইছে।সব কাজ কর্ম গুছানো হলে আমি তৈরি হবো।”
-” আচ্ছা চল বলে সালেহা সিজদা দুজনেই নিজেদের কাজে লেগে‌ পড়ে। সালেহার হাতে হাতে সিজদা সবকিছু এগিয়ে গুছিয়ে দেয়।সব কাজ কর্ম শেষ হতে না হতেই ঐশ্বর্য সিজদা কে নিজের রুমে ডাকে।সিজদা ডাইনিং টেবিলে খাবার গুছিয়ে রেখে ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে ঐশ্বর্যের রুমে এসে নক দিয়ে বললো,

-” আপামণি ডাকতেছেন?”
-” ঐশ্বর্য তখন খাটের সাথে‌ হেলান দিয়ে বসে ফোন স্ক্রল করছিলো।সিজদা কে দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে আলমারি থেকে কতো গুলো শাড়ি বিছানার উপর রেখে বললো,
-”হ্যাঁ আয়।আর শোন। এখন থেকে আমার রুমে আসতে গেলে তোর নক করা লাগবে না।তোর যখন ইচ্ছা তখন চলে আসবি।নক করার কোনো প্রয়োজন নেই।”
-” ঠিক আছে আপামণি।”

-”আমরা যেহেতু বিয়ে বাড়িতে যাচ্ছি।তাই সবাই মিলে প্ল্যান করেছি শাড়ি পরে যাবো।এখানে অনেক গুলো শাড়ি আছে।তোর যেই শাড়িটা পছন্দ হয়।সেটা নিয়ে যা। তু‌ই ও শাড়ি পরে যাবি।”
-” এসবের কোনো প্রয়োজন নেই।আমার যা আছে আমি তাই পরে যাবো। ঐশ্বর্য সিজদার কথায় কান না দিয়ে সিজদা কে একটা হলুদ শাড়ি পরিয়ে দিয়ে সুন্দর করে সাজিয়ে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে বললো,
-” দেখ তো মেয়েটা কে চিনতে পারিস কিনা ?”

-” আয়নায় নিজেকে দেখে হতবাক হয়ে যায় সিজদা। নিজেকে নিজেই চিনতে পারছে না।গায়ে হলুদ শাড়ি,কানে ফুলের তৈরি দুল , গলায় মালা, কপালে টিকলি, হাতে চুড়ি,চোখে গাড়ো কাজল। ঠোঁটে গাঢ় লাল লিপস্টিক।সিজদার চোখের পাপড়ি বড় বড় ,ঘন হবার কারণে আইলাশ লাগানো প্রয়োজন হয় নি। গাঢ় কাজল , মাশকারাতে চোখ সেজে উঠেছে এক নতুন সাজে।সব মিলিয়ে অপূর্ব সুন্দর লাগছে সিজদা কে।সিজদা কে দেখে ভেতরে ভেতরে হিংসায় জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায় ঐশ্বর্য। ঐশ্বর্য সেটা সিজদার সামনে প্রকাশ না করে বললো,

-” ও মাই গড! কতো সুন্দর লাগছে তোকে!মনে হচ্ছে তুই ই বিয়ের কনে। আমি মেয়ে হয়েই তোর থেকে চোখ ফেরাতে পারছি না।বাই এনি চান্স আজ যদি সারজিস তোকে দেখতে পেতো।আমি নিশ্চিত সারজিস মা’রা পড়তো।সারজিসের কথা শুনে সিজদার দু গাল লজ্জায় রক্তিম বর্ণ ধারণ করলো।যেটা চোখ এড়িয়ে যায় না ঐশ্বর্যের। ঐশ্বর্য মুচকি হেসে বললো,
-” তোর সময় ঘনিয়ে এসেছে সিজদা।যতো পারিস লজ্জা পেয়ে নে।আমি ঐশ্বর্য চোধুরী। ছোটবেলা থেকে যা চেয়েছি তাই পেয়েছি।আর না পেলে সেটা ছিনিয়ে নিয়েছি। হা হা হা হা।”

-”হালিমা মঞ্জিলের প্রত্যেক টা সদস্য কে ড্রয়িং রুমে ডেকেছেন হালিমা বেগম।সবাই চলে ও এসেছে। শুধু মাত্র সারজিসের জন্য অপেক্ষা করছে হালিমা বেগম।সারজিস নামলেই তিনি তার কথা ব্যক্ত করবেন।কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর সারজিস নিচে আসে।সারজিস কে দেখে হালিমা বেগম বললেন,
-” তোমার কি পাঁচ মিনিট সময় হবে?”
-” হ্যাঁ।বলো কি বলবে?”
-” তুমি কি সত্যিই বিয়েটা করবে না?”

-” না দাদু।আমি ভেবে দেখেছি নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়েটা করলে শুধু শুধু দুই টা জীবন নষ্ট হবে।আমি পুরুষ মানুষ।আমি চাইলেই বিয়েটা করে তাকে ভালো না লাগলে অন্য কাউকে বিয়ে করে নিতে পারবো। কিন্তু মেয়েটার যে জীবন নষ্ট হবে।তার দায়ভার কে নিবে?”
-” যেহেতু আমি মেয়েটা কে গয়না পরিয়ে বিয়ের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসেছি। সেহেতু আমি চাইলেও এই বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে পারি না।তাই আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি সাইফানের সাথে সিজদার বিয়েটা হবে।”
-” সাইফান কথাটা শুনে হতবাক হয়ে যায় উপস্থিত সকলে।সারজিস অনেক টা কর্কশ কন্ঠে বললো,
-” সাইফান ?”

-” হ্যাঁ।সাইফান।এই ব্যাপারে আমার রাশেদের সাথে কথা হয়েছে।সাইফানের সাথে ও কথা হয়েছে। সাইফানের এই বিয়েতে কোনো আপত্তি নেই।যাকে এতো দিন আমি তুচ্ছ, তাচ্ছিল্য করেছি।যাকে কখনো নাতির পরিচয় দেই নি।সেই ছেলেটা আজ আমার সম্মান রক্ষা করলো।আমি সাইফানের সাথেই সিজদা বিয়ে দিবো। এবং সাইফান কে হালিমা মঞ্জিলে নিয়ে আসবো।এখন থেকে সাইফান আমাদের সবার সাথে হালিমা মঞ্জিলে থাকবে।”

-” ঐশ্বর্য সিজদা কে নিয়ে গাড়ি করে র‌ওনা হয়েছে। ঐশ্বর্য ড্রাইভ করছে।আর সিজদা তার পাশের সিটে বসে রয়েছে। বাতাসে তার লম্বা চুলগুলো উড়ছে।বড্ড ভালো লাগছে সিজদার।মুক্ত পাখির মতো মনে হচ্ছে।সিজদা কিছুক্ষণ বাইরের দৃশ্য উপভোগ করার পর বললো,
-” আপমণি আপনে যে ক‌ইছিলে… বলতে গিয়েও বললো না সিজদা। ঐশ্বর্য বারবার বলে দিয়েছে বিয়ে বাড়ি গিয়ে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে হবে।সে যেন আগে থেকেই প্র্যাকটিস করে।তাহলে সবার সামনে কথা বলতে বেঁধে যাবে না। ঐশ্বর্যের কথা মনে পড়তেই সিজদা বললো,

-” আপামণি আপনি যে বলছিলেন আপনার ফ্রেন্ডরা আসবে। আমরা সবাই একসাথে এক গাড়িতে যাবো।তারা তো এখনো এলো না।”
-” ঐশ্বর্য কিছু না বলে চুপচাপ ড্রাইভ করতে লাগলো। কয়েক মিনিট অতিবাহিত হওয়ার পর একটা জায়গায় এসে ঐশ্বর্য গাড়ি থামিয়ে দিয়ে বললো,
-” খুব পিপাসা পেয়েছে আমার।গাড়িতে বোধহয় পানি নেই। তুই গাড়িতে একটু অপেক্ষা কর।আমি ভেতরে গিয়ে পানি নিয়ে আসছি।”
-”আমি ও যাই আপনার সাথে?”

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৫

-” না না। তুই এমনিতেই শাড়ি পরে হাঁটতে পারছিস না।দেখা গেল শাড়িতে বেঁধে পড়ে গিয়েছিস।তখন মানসম্মান কিছুই থাকবে না। তুই চুপচাপ গাড়িতে বয়।আমি যাবো আর পানি নিয়ে চলে আসবো।”
-” ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি আইবেন।”
-” ওকে বলে ঐশ্বর্য একটু সাইডে গিয়ে তার ভাড়া করা গুন্ডাদের ফোন দিতেই তারা এসে সিজদার নাকে একটা রুমাল চেপে ধরে। মূহুর্তের মধ্যেই সিজদা সেন্সলেস হয়ে গাড়ির সিটে ঢলে পড়ে।।”

মন দিয়েছি তোমাকে পর্ব ৭