মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ১১+১২

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ১১+১২
ফাবিয়াহ্ মমো

মাহতিমের ধূর্ত চালটা কেউ বুঝতে পারলো না সেদিন। সুরাইয়াকে কঠিন শিক্ষা দিয়ে চুপচাপ কেটে পরেছে সেখান থেকে। শেফালীও এই ঘটনার প্রেক্ষিতে তুলকালাম ঝগড়া সৃষ্টি করেছে। কিন্তু হান্নান শেখের ভয়ে ঝগড়াটা আর বাড়তে পারেনি। সুজলা কঠিন গলায় শেফালীকে কড়া ভাষায় কথা শুনিয়ে দমিয়ে দিয়েছে সেদিন। রাতের খাবার শেষে হান্নান শেখ মারজার কাছ থেকে পুরো ঘটনা জানতে পারলেন। সুরাইয়ার ফেসপ্যাকে বিচুতি পাতার অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, আর সেটা ব্যবহারের ফলেই সুরাইয়ার মুখে মারাত্মক চুলকানি শুরু হয়েছে।

মেহনূর নিরব মুখে সবার অবস্থা অবলোকন করলো, শেষমেশ নিজের খাবারটা মায়ের হাতে খেয়ে বিছানায় যেয়ে শুলো। জানালাটা খুলে পুরো পর্দা সরিয়ে অন্ধকার রুমটা স্বল্প আলোয় পরিপূর্ণ করলো। শান্ত নিবির বড়-বড় চোখদুটোর দৃষ্টি আকাশের দিকে ফেললো। মনের মধ্যে জট বাঁধানো প্রশ্নগুলো নানাভাবে নাড়াচাড়া করতে লাগলো। মাহতিমের আচরণ নিয়ে প্রচণ্ড দ্বিধায় ভুগছে মেহনূর। লোকটা কখনো সভ্যতার সাথে কথা বলে, কখনো অসভ্যতার মতো নিজেকে জঘন্য প্রমাণ করে যায়।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

আসলে লোকটা কি চায়, কি নিয়ে এমন দুমুখো আচরণ করে সেটাই কোনোভাবে মাথায় ঢুকছেনা ওর। বাড়িতে অতিথি আসার পর থেকে দাদাভাইয়ের সাথেও আড্ডা দিতে পারছেনা মেহনূর। এদিকে পড়াশোনার দিকেও ধ্যান দেওয়া জরুরী, কিন্তু বারবার ওই অসভ্য লোকটার কথা মনে পরার কারনে বইয়ের পাতা ওল্টাতেও ইচ্ছে করেনা। যখন-তখন, যেখানে-সেখানে ম্যাজিক ম্যানের মতো উপস্থিত হয় লোকটা, আবার অদ্ভুত একটা কাণ্ড ঘটিয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে চলে যায় তৎক্ষণাৎ। বয়সের দিক দিয়ে লোকটা খুব বেশিই বড়, কিন্তু চরিত্রের দিক দিয়ে যেনো সবচেয়ে ছোট। কে জানে আগামী দিনগুলোতে কি কি অপেক্ষা করছে ওর জন্য।

পরদিন সুরাইয়ার অবস্থা বেগতিক হয়ে উঠলো। গালের চামড়া লাল হয়ে কয়েক জায়গায় ছিলে গেলো। কোনোভাবেই চুলকানির আচঁ পুরোপুরি কমলো না ওর। তরুণ কাল সন্ধ্যার দিকে যখন আসলো, সুরাইয়ার এমন অবস্থা দেখলো, তখ সে বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। কিভাবে এমন অবস্থা হলো কেউ সে ব্যাপারে বলতে পারেনা, কিভাবে বিচুতি পাতা ফেসপ্যাকে মিশে গেলো কেউ সেটা জানেনা। নীতি, সৌভিক, সিয়াম, তৌফ সকলের অগোচরে মূখ্য ব্যক্তিকে চিনে ফেলেছিলো ততক্ষণে। কে এই কাজ করেছে, কেনো এই বিচুতি পাতা মিশিয়েছে সবই কাটায়-কাটায় বুঝে গেলো। সাবির, সামিককে এই ঘটনার ব্যাপারে জানানো হলে অবাকে নিবার্ক হয়ে যায় তারা। হান্নান শেখ বাড়িতে না থাকলেও তাঁর আদেশে তৎক্ষণাৎ সুরাইয়াকে ডাক্তারখানায় নিয়ে যায় তরুণ ও শেফালী। সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত হয়ে গেলে নীতি তখন মাহতিমের রুমে যায়। মাহতিম বিছানায় শুয়ে খবরের কাগজ পরছিলো, নীতিকে দেখে চট করে একটা পাতা উলটে পড়তে লাগলো। নীতি এসে বিছানায় বসলে মাহতিমের দিকে তীক্ষ্ম নজরে তাকালো। দৃষ্টি তীক্ষ্ম করে শান্ত গলায় বলে উঠলো,

– ভাইয়া, তুমি সুরাইয়ার ফেসপ্যাকে বিচুতি পাতা মিশিয়েছো কেনো? ওর এই অবস্থা তুমি কেনো করলে? মেয়েটাকে এইভাবে কষ্ট দেওয়ার মানে আছে?
ডার্ক নেভি ব্লু জিন্স, হাঁটু পযর্ন্ত কালো টপস, গলায় কালো রঙের ওড়নাটা একপাক পেঁচিয়ে বুকের দুপাশে ঝুলিয়ে রেখেছে নীতি। চুলটা সম্পূর্ণ পেছনে নিয়ে ডানপাশে একটা ফ্রেন্ঞ্চ বেণি করে রেখেছে সে। বোনদের মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান বোন নীতি হলেও আদরের দিক দিয়েও সবচেয়ে কাছের ও। মাহতিম ওর প্রশ্ন শুনে এমন একটা ভান করলো যেনো কানের মধ্যে কিছুই ঢুকেনি। নীতি তার ভাইয়ের এমন আচরণ দেখে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে ছোঁ মেরে খবরের কাগজটা নিয়ে ফেললো। সেটা তিনভাঁজ করতে থাকলে মাহতিম চোখ রাঙিয়ে রাগ দেখিয়ে বললো,

– এসব কি হচ্ছে? হাত থেকে নিলি কেন? আমিযে এটা পড়ছি সেটা তুই চোখে দেখতে পাচ্ছিস না?
নীতি বিছানা থেকে উঠে ভাঁজ করা কাগজটা নিয়ে টেবিলের উপর রেখে আসলো। পুনরায় ওর পাশে বসে কিছুটা শক্ত কন্ঠে বললো,
– তুমি একজনের দোষে আরেকজনকে কষ্ট দিচ্ছো কেন? তুমি কাল কি করেছো আমি সেটা বুঝিনি ভেবেছো? তুমি সুরাইয়ার ফেসপ্যাকে বিচুতি মিশিয়েছো কেনো?
মাহতিম ওর কথার ভঙ্গি দেখে চোখ ছোট করলো। এটিটিউট স্টাইলে কঠোর ভঙ্গিতে মাথার নিচে দুহাতের তালু রেখে চোখ বন্ধ করলো। ঠোঁট ভেদ করে ছোট্ট নিশ্বাস ছেড়ে বললো,

– বাইরে বিচুতির স্টক বেশি ছিলো। তাই চিন্তা করলাম এগুলো একটু মানবতার কাজে ব্যবহার করলাম।
নীতি এমন উলটা উত্তর মোটেই আশা করেনি। শেষে নিজেই উত্তরের কপাট খুলে তেজালো গলায় বললো,
– তুমি আমাকে একটা সত্য কথা বলবে ভাইয়া? তুমি জাস্ট এই উত্তরটা ঠিকমতো দিবে, তুমি কি মেহনূরকে পছন্দ করো? আমি কোনো মিথ্যা শুনতে চাইনা। আবার জিজ্ঞেস করছি, তুমি কি মেহনূরকে পছন্দ করো?
নীতির এমন ঠাস-ঠাস প্রশ্ন শুনে তৎক্ষণাৎ চোখ খুলে তাকালো মাহতিম। মাথার নিচ থেকে দুহাত সরিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো ধীরগতিতে। কপালে কয়েকটা ভাঁজ ফেলে কিছুক্ষণ নিরব দৃষ্টিতে নিরীক্ষণ করতে লাগলো। এদিকে নীতি যতই সাহস দেখাক না কেনো, মাহতিমের ওমন চুপটি দেখে ভয়ে অবস্থা টাইট হচ্ছিলো। যদি মাহতিম ধুম-ধাম করে চড় মারলো তখন? নীতি আস্তে করে ঢোক গিলতেই মাহতিম হঠাৎ গলা চড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলো,

– তুই কি দিনদিন গাধা হয়ে যাচ্ছিস নীতি? তুই আমাকে কেমন প্রশ্ন করলি এটা? আমি কিনা ওই রামবলদকে পছন্দ করবো? ওর মধ্যে কি আছে যে আমি পছন্দ করবো?
নীতি বাঁ ভ্রুঁ-টা উপরে তুলে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো। মাহতিম ওর ভঙ্গি দেখে কিছুটা অপ্রতিভ হলো, কিন্তু সেটা একটুও বুঝতে না দিয়ে চড়ানো সুরেই বললো,
– ওকে একটা ফ্রক পরিয়ে দিস। তাহলেই বুঝতে পারবি এমন কথা কিজন্য বলছি।
নীতি মুখ শক্ত করে ব্যঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বললো,
– আহা, নিজে যে কত্তো বড় ফন্দিবাজ সেটা তো আমি বুঝে গেছি ভাইজান। আমার সামনে এমন নাটক না করলেই পারো। ওকে যদি ফ্রক পরিয়ে তোমার সামনে আনি তাহলে তো তুমি ঠিক থাকতে পারবেনা সোনা ভাই।
মাহতিম ওর মুখ কুচঁকানো বিরক্তি ভঙ্গির কথা শুনে ফিক করে হেসে দিলো। সশব্দে হাসতে থাকলে নীতি আরো বিরক্ত হয়ে বললো,

– একদম হাসবানা ভাই, একদম হাসাবানা! তুমি খুবই খারাপ! ওকে দেখলে যে তোমার দিল কুড়কুড় করে, সেটা আমি কালকের ঘটনা দিয়েই বুঝে গেছি। ওর মেজো মা ওকে কচুর লতি কাটিয়েছে বলে তুমি এইদিকে মেজো আন্টির মেয়ের উপর শোধ তুলেছো। এটা তুমি ভালো করোনি ভাই। শেফালী আন্টির দোষের জন্য তুমি সুরাইয়াকে ভিক্টিম বানিয়েছো, এটা তুমি একদম ঠিক করোনি।
হঠাৎ হাসি থমকে গেলো মাহতিমের। চেহারার উপর থেকে হাসির আভাসটুকু মুছে গেলে শান্ত-স্থির ভঙ্গিতে মাহতিম বলে উঠে,

– তুই আমাকে শিখাবি আমি কি করবো, না-করবো? শেফালী আন্টির মতো ব্যক্তি আমাদের বাড়িতে চাকরানী হওয়ারও যোগ্যতা রাখেনা। কেমন বজ্জাত ধরনের মহিলা তুই দেখছিস? আমিতো ভাবতেও পারিনা এই মহিলা এতোদিন ধরে বাড়ির প্রতিটা মেয়েকে জ্বালিয়েছে। আচ্ছা মহিলা যে এমন ঘটনা ডেলি-ডেলি করতো সেগুলো কি কারোর চোখে পরেনি?
নীতি হতাশার সাথে নিশ্বাস ছাড়তেই বললো,
– মনে হয়না। কারন, এই মহিলা প্রচুর চালাক। কিভাবে ওদের ভয়ের মধ্যে রেখেছে সেটাতো দেখতেই পাচ্ছো। আর বিশেষ করে মেহনূরকে এই মহিলা সহ্য করতে পারেনা।শি ইজ ফার্স্ট্রেড।
শেষোক্ত কথা শুনে মাহতিম আবার প্রশ্নসূচকে তাকালো। দুচোখের ভেতর কৌতুহল ফুটিয়ে জিজ্ঞাসা সূচকে বললো,
– কেনো ফার্স্ট্রেড? এই মহিলার সমস্যা কি? ওর সাথে এতো ঘেঁষাঘেষি কিসের?
নীতি আবার চোখ ফিরিয়ে মাহতিমের দিকে তাকালো। প্রশ্নবিদ্ধ ভঙ্গিতে কিছু চিন্তা করতেই ফট করে বললো,

– শানাজ বলতে পারবে ভাইয়া। আমি এ ব্যাপারে জানিনা। কিন্তু যতদূর বুঝলাম, হিংসার জন্যই সম্ভবত এমন আচরণ করে। আর মেহনূর তো চাপা স্বভাবের। ওর সাথে টিংটিং করতে মহিলার একটু বেশি মজা লাগে।
মুখ ভার করে কিছু চিন্তা করতে লাগলো মাহতিম। নীতি আর কথা উঠালো না এ বিষয়ে। চুপচাপ রুম থেকে চলে গেলে মাহতিম আবার বিছানায় শুয়ে পরে।

আকাশের তপ্ত সূর্যটা পশ্চিম দিগন্তে চলে এসেছে। আকাশের রঙটা গোলাপী আভায় ছেয়ে গেছে। প্রকৃতির দাপুটে ভাব কমে গিয়ে শান্ত-নির্জনে পরিণত হয়েছে। সবাই চা-নাস্তার জন্য আঙিনায় বসে গল্পগুজব করছে। সৌভিকরা বাইরে এসে ডানদিকের পুকুরঘাটে আড্ডা বসিয়েছে। পুকুরটা হান্নান শেখ নিজের টাকায় পরিবারের জন্য বানিয়েছে। পুকুরের চারপাশে সবুজ ঘাসের পাশাপাশি সারি সারি নারকেল গাছও দাম্ভিকতার সাথে দাড়িয়ে রয়েছে। সঙ্গে সুউচ্চ সুপারি গাছও রয়েছে কয়েকটা।পুকুরের কিনারায় গোল হয়ে ঘাসের উপর বসেছে সৌভিক ও শানাজরা। মাহতিম একটা জরুরী কাজে ঘন্টা আগে শহরে গিয়েছে। তাই বাড়ির আনাচে-কানাচে শান্তিমতো মেহনূর ঘুরতে পারছে। সৌভিক, নীতি, সাবির, প্রীতি, সামিক, সাবা, সুরাইয়া, মাহদি, শানাজ ও ফারিন পরপর একসাথে বসেছে। মাঝখানে তেঁতুল, বড়ই, চালতা, আমের বিভিন্ন আচার সাজানো রয়েছে।

সবাই যখন বিকেলের আড্ডায় বাইরে বসে মত্ত, মেহনূর তখন গোয়ালঘরে চৌকির বিছানায় ‘ শাপমোচন ‘ নিয়ে মগ্ন। তরুণ দুপুরের ঘুম শেষে কলপাড়ে এসে হাত-মুখ ধুতেই দূরে আড্ডারত সাবার দিকে তাকালো। সাবার গায়ে নীল রঙের শাড়ি, সাদা রঙের পাড়, ব্লাউজটা সাদা, চুলগুলো একপাশে বেণী করা। চোখদুটোতে কাজল দেয়া, হাতে সাদা রেশমী চুড়ি, কানে ছোট্ট পাথরের টপ পরা এবং পাদুটো খালি। ব্লাউজের পেছন গলাটা একটু বড় বিধায় খালি পিঠটা দেখা যাচ্ছে। সেটাই চাপকল চেপে পানি তুলার সময় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখছে তরুণ। ওমন উন্মুক্ত পিঠটা দেখে তাল সামলাতে পারছেনা ও।

কেমন ঝিমঝিম করা অস্থিরতা কাজ করছে শরীরে। তরুণের উৎদ্ভট দৃষ্টিটা হঠাৎ তৌফের নজরের পরলো। তৌফ প্রথমে মনের ভ্রম ভাবলেও শেষে ঠিকই আবিষ্কার করলো যে, তরুণ সাবার দিকেই তাকিয়ে আছে। তৌফ সাথে-সাথে সিয়ামকে একটা গুতা মারলো। সিয়াম গুতা খেয়ে তৌফের দিকে তাকালে ওর স্থির দৃষ্টি লক্ষ্য করে জায়গামতো তাকালো। তৌফ ও সিয়াম একসঙ্গে যখন তরুণের অবস্থা দেখছিলো তখন হুট করেই সৎবিৎ ফিরে পেলো তরুণ। তাড়াতাড়ি দৃষ্টি সরিয়ে চুপচাপ পায়ে পানি ঢেলে ভেতরে চলে গেলো ও। সৌভিক আড্ডার মজলিশে হঠাৎ শানাজের উদ্দেশ্যে বললো,

– শানাজ? তোমরা মেহনূরকে একা রেখে এসেছো কেনো?ওকে নিয়ে আসলে কি সমস্যা হতো? আমরা তো বড় ভাই ছাড়া কিছুই না। তাছাড়া আমরা এক হিসেবে রিলেটিভও। যাও তো, ওকে সঙ্গে করে নিয়ে এসো। আমাদের সাথে বসুক, মিশুক, কথা বলুক। ধীরেধীরে ওর জড়তা কেটে যাবে।
শানাজ এমন কথা শুনে কিছু বলতে নেবে হঠাৎ সাবা ওর হাত ধরে মিনতি সুরে বললো,
– বুবু, ওকে নিয়ে আসি চলো। ও শুধু-শুধুই ভাইয়াদের সামনে আসতে চাইছেনা। ভাইয়ারা তো খারাপ মানুষ না। চলো না, ওকে নিয়ে আসি?
শানাজ কিছুক্ষণ চিন্তা করে শেষমেশ সাবার সঙ্গে উঠে দাড়ালো। সৌভিকও ওদের পিছু-পিছু এসে গোয়ালঘরে ঢুকে মেহনূরকে সুন্দরমতো বুঝিয়ে আড্ডায় জয়েন্ট করালো। এই প্রথম আড্ডার মজলিশে বসে মেহনূরের একটু অস্বস্তি হচ্ছিলো, কিন্তু পরক্ষণে সকলের সাথে ধীরেসুস্থে মিশতে গিয়ে হালকা-পাতলা আলাপ হয়ে গেলো। আড্ডার এক পর্যায়ে সুরাইয়া হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো,

– আচ্ছা, মাহতিম ভাইয়া কি করে?
তৌফ যেই কাঠিন্য মুখে উত্তর দিবে তখনই সিয়াম ফট করে উত্তর দিয়ে বলে,
– ঘুমায়, খায়। এখন একটা বউ পেলে কোলবালিশ বানিয়ে শুইতো।
সিয়ামের হাস্যকর উত্তর শুনে একযোগে হেসে দিলো সবাই। শুধু হাসলোনা সুরাইয়া। মুখটা পেচাঁর মতো কুচঁকে আবারও প্রশ্ন গলায় বললো,
– বলো না, সে কি করে? এটুকু বলতে কি সমস্যা?
সবার হাসির রোল তখনো বিরাজ করছে। সুরাইয়া নিরুত্তর ভঙ্গিতে মুখ কালো করে থাকলে হঠাৎ পেছন থেকে শক্ত গলার আওয়াজ আসে,

– আমি কি করি সেটা তোমার জেনে লাভ কি? আমাকে নিয়ে এতো টেনশন কেনো?
ক্যাটক্যাট গলার স্বর শুনতেই কর্পূরের মতো হাসি উড়ে গেলো সবার। সুরাইয়া ভয়-ভয় চাহনিতে মাথা পিছনে ঘুরিয়ে দেখে মাহতিম দুই পকেটে হাত ঢুকিয়ে এদিকেই তাকিয়ে আছে। সবাই যখন মাহতিমের দিকে তাকিয়ে ছিলো, মেহনূর তখন ঘাস ছিঁড়ে সেগুলো টুকরো-টুকরো করছিলো। মেহনূর যে ইচ্ছে করেই ইগনোর করার মতলবে আছে সেটা বুঝে গেছে মাহতিম। তাই আর সেদিকে না এগিয়ে যেখানে ছিলো সেখান থেকেই বলে উঠলো,
– আমি বর্তমানে —
কথার মাঝখানে আকস্মিকভাবে দাড়ি বসালো সিয়াম! ওমনেই ঝড়ের বেগে উত্তর দিয়ে বললো,
– মাহ-মাহতিম আসলে বিজনেস-ম্যান। ও বাবার ব্যবসা দেখে। আঙ্কেলের বড় ব্যবসা তো, তাই সেগুলো এখন মাহতিমই দেখাশুনা করে।

সিয়ামের কথা শুনে মাহতিম তৎক্ষণাৎ তাজ্জব বনে গেলো। নীতি চোয়াল ঝুলিয়ে অবাক হয়ে গেলো, প্রীতি আমের আচারে কামড় দিতে গিয়ে থেমে গেলো, সৌভিক মুখ ঘুরিয়ে সিয়ামের দিকে তাকালো, তৌফ বিস্ফোরণ চাহনিতে তেঁতুল চুষতে ভুলে গেলো, সাবির মিটিমিটি করে হাসতে থাকলো, মাহদি সিওসি খেলা বাদ দিয়ে সবার ওমন আহাম্মক মার্কা চেহারা একে-একে দেখতে লাগলো। সবার চেহারা যখন অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো, তখন সিয়াম সবার দিকে দৃষ্টি দিতেই চাপা কৌতুহলে বললো,

– গাইজ, তোমরা আমাকে সেলিব্রেটির নজরে দেখছো কেনো? আমি এখনো সেলিব্রেটি হইনি।
সিয়ামের কথা শুনে মাহতিম তৎক্ষণাৎ পা থেকে স্যান্ডেল খুললো। ওই দৃশ্য দেখে সিয়াম তোতলানো সুরে বলল,
– দো-দো-দোস্ত, তুই স্যান্ডেল খুলিস কেন? আমি তো মিথ্যা কথা বলিনি। আরে ভাই, পায়ের জুতা পায়েই রাখ, আমারে মারিস না। মাহতিম রে!! ওই সৌভিক, হালা ধরোস না ক্যান!
সিয়ামের ভয়ার্ত অবস্থা দেখে সবাই হো হো করে হেসে দিলো। সবাই যখন তীব্র হাসিতে লুটোপুটি খাচ্ছে তখন তৌফ হাসির ছলে সিয়ামের কানের কাছে মুখ এনে বললো,

– তুই মিথ্যা বললি ক্যান বেটা? ওর হাতে কষানো থাবড়া খাওয়ার ইচ্ছা জাগছে নাকি?
সিয়াম খিচিমিচি করে দাঁত চিবিয়ে নিচু স্বরে বললো,
– পল্ট্রি মুরগী যদি জানে মাহতিম ময়না কি কাজ করে, তাহলে আর বিয়া খাওয়ার স্বপ্ন দেখা লাগবোনা চান্দু।
তৌফ হঠাৎ হাসি থামিয়ে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে,
– মানেটা কি বুঝাইলি? ওর জবের সাথে বিয়ের সম্পর্কটা ক্যামনে হইলো?
সিয়াম গলার স্বর আরো নিচু করে সর্তকতার সঙ্গে বললো,
– পল্ট্রি মুরগী এমনেই ওরে শেয়াল ভাইবা ভয় পায়। আর যদি শুনে মিয়াচান একটা বাঘ, তাইলে বাপু ওর কপালে আর এইটার সাথে বিয়া করা লাগবো না।

সিয়াম ও তৌফ সবার অগোচরে চোরের মতো গোপন আলাপ সারছে। এদিকে সবাই আচার খাওয়া নিয়ে মাহতিমের দিকে ঘুরে হাসাহাসি করে কথা বলছে। শুধু মেহনূর ঘাসের দিকে দৃষ্টি রেখে অসহায়ের মতো কচিপাতা খুঁটছে, হাসির জন্য তৌফ ও সিআমের কথা একচুলও শোনা যাচ্ছেনা। তৌফ সিয়ামের মিথ্যা বলার মর্মটা অনেকক্ষন পর বুঝতে পারলো। অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে ঘাসের দিকে দৃষ্টি দিয়ে ‘ হ্যাঁ ‘ সূচকে মাথা নাড়াতে লাগলো। সেই অন্যমনার ভঙ্গিতে কন্ঠ নামিয়ে বললো,

– তাহলে মাহতিমের পরিচয় গোপন রাখা লাগবো, রাইট? কিন্তু মারজা আন্টি কি এতোদিনে ওর জব নিয়ে কথা উঠায়নি ভাবছোস? যদি আন্টি মেহনূরের মা-কে সব বলে দেয়, তাহলে মেহনূরের জানতে দুই সেকেন্ডও লাগবো না।
সিয়াম সাথে সাথে তৌফের মাথায় চাট্টি মেরে কর্কশকণ্ঠে বললো,
– পজিটিভ ভাবতে পারোস না বা*? আন্টি যদি বইলাই থাকে তাহলে এমন ব্যবস্থা করা লাগবো যেনো মেহনূর জানতে না পারে।

ওদের দুজনের মধ্যে ফুসুর-ফুসুর চললেও মাহতিম একটাবারের জন্যও মেহনূরের মুখ দেখতে পেলো না। মেহনূর ভুলেও পিছু ফিরে মাহতিমের দিকে তাকালোনা। এমন সুক্ষ অবহেলা দেখে মাহতিম রুক্ষ মেজাজে বাড়ির দিকে চলে যেতে লাগলো। সবাই আবার গোল আকারে বসে আড্ডা জমিয়ে দিলে মেহনূর বামে দৃষ্টি ফেলে সর্তকতার সাথে মাহতিমের যাওয়াটা একমনে দেখতে লাগলো। সেই দৃষ্টির মধ্যে ছিলো কিছুটা ভয়, কিছুটা অবহেলা, কিছুটা সংকোচ মনের উৎকন্ঠা। বারবার এই লোকটা এমন কায়দায় হাজির হয়, সেটা আগে থেকে বলা যায়না। কিন্তু চলে গেলে মনেহয় কোথাও যেনো শূন্যতা এসে ভর করেছে। সেই শূন্যতা যেনো হাড়ে-হাড়ে টের পাইয়ে দেয়, তাকে আগলে রাখো, আগলে ধরো, আগলে-আগলে দেখো তাকে। দেখার জন্য বিধিনিষেধ নেই মেহনূর, ছোট্টমনেই দেখো তাকে।

সুনশান রাত। বাইরে ঘুঘুর ডাক শোনা যাচ্ছে।বাড়ির সবাই গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গেছে। কেউ জেগে নেই এমন নিশিপ্রহরে। আকাশটা চাঁদশূন্য হয়ে ঘুট্ঘুটে অন্ধকার হয়ে আছে। কোথাও আলো নেই গ্রামের আনাচে-কানাচে। এমন সময় পানির তেষ্টায় চোখ খুললো মাহতিমের। শয্যা ত্যাগ করতে ভারী বিরক্ত হলো সে। কিন্তু পানির জন্য গলাটা মারাত্মক শুকিয়ে আছে। নিরুপায় হয়ে বিছানা থেকে পানির জন্য নামতে হয়েছে। আজ ভুলবশত এ ঘরে পানি দিয়ে যায়নি। যার বদৌলতে এমন উটকো সময়ে ঘুমঘুম চোখে মাহতিমের উঠতে হয়েছে। দরজার ছিটকিনি খুলে চোখ ডলতে-ডলতে মাহতিম বারান্দা পেরিয়ে যাচ্ছে। অন্যহাতে মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে আলো ধরে রেখেছে। সিড়ি দিয়ে নেমে আঙিনায় পৌঁছাতেই আচমকা অদ্ভুত একটা শব্দ কানে এলো।

শব্দটা স্পষ্টভাবে শোনার জন্য মাহতিম চোখ পিটপিট করে চারপাশে তাকাতে লাগলো। কিন্তু শব্দটা কোথা থেকে আসছে সেটা বুঝতে একটু সময় নিচ্ছে মাহতিম। চাপাকান্নার মতো কান্নাকাটির শব্দ আসছে। মনেহচ্ছে কেউ অত্যধিক অত্যাচারে মুখ চাপা দিয়ে রেখেছে। মূহুর্ত্তের মধ্যেই মাহতিমের অবস্থাটা কৌতুহলপূর্ণ আচ্ছন্ন হলো। মোল্লা বাড়িতে এমন চাপাকান্নার আওয়াজ শোনাটা একদমই দূর্লভ! ভৌতিক বিষয় যদি হয়েই থাকে তাহলে মাহতিমও আজ হাতেনাতে সব দেখে ছাড়বে। চুপ করে ফোনের লাইটটা বন্ধ করে ফেললো মাহতিম। পানি খাওয়ার উৎকন্ঠা ভুলে সহসা কান্নার আওয়াজ নিয়ে এনালাইসিস শুরু করলো সে।

ক্ষণিকের মধ্যে আবিষ্কার করলো বাড়ির সদর দরজা খোলা রয়েছে, আর সেই শব্দটা একনাগাড়ে বাইরে থেকেই আসছে। মাহতিম শান্ত ভঙ্গিতে ঠোঁট ভিজিয়ে দরজার দিকে এগুতে লাগলো। যতই এগুতে লাগলো, ততই মেয়েলি কান্নাটা জোরালো রূপেই শুনতে পাচ্ছিলো। দরজার দুই দ্বারের বাইরে পা ফেললো মাহতিম। অন্ধকার পরিবেশে ডানে-বামে সজাগ দৃষ্টিতে চোখ বুলালো। চোখের দৃষ্টি যখন অন্ধকারের মাঝে সয়ে গেলো তখন দূরের সেই পুকুরপাড়ের দিকে দৃষ্টি যেতেই পা থমকে গেলো ওর! সুপারি গাছের সাথে হেলান দিয়ে কে যেনো দাড়িয়ে আছে। ওইটুকু আবছা অন্ধকারের দৃশ্য দেখে মাহতিম আবারও চটপট ভঙ্গিতে ডানেবামে চোখ বুলিয়ে পেটানোর জন্য কাঙ্ক্ষিত একটা জিনিস খুজঁলো। ঠিক ওইসময়ই দরজার কাছে চার ফুটের একটা বাশঁ পেলে সেটা হাতের বলয়ে আঁকড়ে ধরলো মাহতিম। চোখ তুলে সেদিকে তাকাতেই হতবাক হয়ে গেলো সে! একটু আগে ওখানে কাউকে দেখেছিলো ও, অথচ এখন সেখানে কেউ নেই!

এটা কি করে সম্ভব? মাহতিম হন্যে হয়ে চারদিকে খুঁজতে লাগলো, কিন্তু ব্যর্থ হয়ে শেষমেশ বাশঁ ফেলে বাড়িতে ঢুকতেই আরেকবার আশ্চর্য হয়ে গেলো। সৌভিক কেমন চোরের মতো উত্তর দিকের সিড়ি বেয়ে নিজের রুমের দিকে যাচ্ছে। অন্যদিকে সাবা দক্ষিণ দিকে সিড়ি বেয়ে কান্নাসুরে দ্রুতগতিতে উপরে উঠছে। সৌভিককে ডাক দিতে গিয়ে আর কন্ঠ উঠলো না মাহতিমের। রান্নাঘরের দিকে আড়নজরের দৃষ্টি পরতেই সেখানে মেহনূরকে দেখতে পেলো মাহতিম। মেহনূর একহাতে হারিকেন ধরে অন্যহাতে চায়ের পানিতে চামচ নাড়ছে। জগতের সবকিছু অন্ধকার, ঘুটঘুটে অন্ধকার, শুধু হারিকেনের আলোয় ওই উজ্জ্বলবর্ণের চেহারা যেনো আকর্ষক হচ্ছে। চুম্বকের মতো কঠিনভাবে সেদিকে টানতে চাইছে। দৃষ্টি শান্ত করে স্থির করে দিয়েছে।

মাহতিম অন্যভুবনে পদচারনার মতো ধীরপায়ে রান্নাঘরে এগিয়ে যাচ্ছে। যখন রান্নাঘরের নিকটে এসে পদচারনা থামলো, তখনই মেহনূরের মায়াপূর্ণ বড় বড় চোখের দৃষ্টি দুটো মাহতিমের দিকে পরলো। বুকটা ছ্যাত করে উঠলো মাহতিমের। ওই শান্ত দৃষ্টির কেশবহুল বালিকা পূর্ণদৃষ্টিতে হকচকিয়ে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। চুল খোলা মেহনূরের, সেগুলো হাটুর কাছে এসে জমায়েত হয়েছে। মাহতিম দৃষ্টি তুলে আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখলো ওর। হালকা বেগুনি রঙের শাড়ি পরেছে, কালো ব্লাউজের হাতাদুটো কনুই ছাড়িয়ে কবজির একটু আগে এসে ঢেকেছে। মাহতিম মাথা-থেকে-পা অবধি নির্বিকারে চোখ বুলালো। বাঁকা হেসে রান্নাঘরের ভেতরে পা ফেলে ঢুকলো। মেহনূরের অবস্থা তখন পুরোই কাহিল, দিনশেষে আবারও অপ্রত্যাশিত ভাবে এই লোকটার সাথে দেখা হয়ে গেলো ওর। রাতে উপন্যাসের বই পড়ার সময় চা খাওয়ার অভ্যাস আছে মেহনূরের। তাই নিয়ম মোতাবেক আজও এসেছে চা বানাতে, কিন্তু মাহতিমের এমন আগমন দেখে ভয়ে পালাতে ইচ্ছে করছে। মাহতিম চুলার কাছে এসে দেখলো, ছোট পাতিলে চা বানানো হচ্ছে। চায়ের দিকে দৃষ্টি রেখে শান্ত সুরে বললো মাহতিম,

– এক কাপ চা দেওয়া যাবে? টেস্ট করতাম আরকি।
শীতের পরশ পাওয়ার মতো শিউরে উঠলো মেহনূর। সৎবিৎ ফিরে পেলে আমতা-আমতা করে বললো,
– চা-চা-চা স-সত্যিই খা-বেন?
মাহতিম সরল গলায় বললো,
– হ্যাঁ খেতেই তো চাচ্ছি।
মেহনূর যে ভয়ে কাঁপছে সেটা ওর হাতের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছে মাহতিম। হাতের প্রতিটা আঙুলই ভয়ংকরভাবে কাঁপছে ওর। মাহতিম একবার ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে, আরেকবার ওর হাতের দিকে তাকাচ্ছে সে। মেহনূর কম্পমান হাতেই মাহতিমের দিকে এক কাপ চা এগিয়ে দিলো। মাহতিম চায়ের কাপে চামচ নেড়ে চামচটা চুলার পাশে রেখে দিলো। কাপের হ্যান্ডেলে তর্জনী পেচিঁয়ে ছোট্ট একটা ফু দিয়ে এক চুমুক খেলো। খেতেই মূখের অবস্থা বীভৎস ভাবে কুঁচকে সাথে-সাথে মেহনূরের হাতে ধরিয়ে দিলো। বিরক্তির সাথে বললো,
– কি চা বানিয়েছো এটা? চা-ও তুমি বানাতে পারো না? ছিঃ! খেয়ে দেখো। খেয়ে দেখো কেমন ফালতু চা বানিয়েছো।

এই প্রথম খারাপ মন্তব্য পেলো চায়ের জন্যে। চায়ের মধ্যে কি গলদ করেছে সেটা তাড়াতাড়ি বুঝার জন্য এক চুমুক দিয়ে খেয়ে দেখলো মেহনূর। কিন্তু গলদের কিছুই যখন ধরতে পারলো না, তখন মাহতিমের দিকে উজবুক দৃষ্টিতে তাকালো। কিছু বলার জন্য ঠোঁটে খুলবে তার আগেই মাহতিম ওর হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে নিলো। মেহনূর এমন উদ্ভট কারবার দেখে কপাল কুঁচকে তাকালে মাহতিম বাম পকেটে হাত ঢুকিয়ে চায়ের কাপে ফুঁ দিলো। চোখ বন্ধ করে চায়ের কাপে শান্ত ভঙ্গিতে চুমুক দিলো। এদিকে মেহনূর যে বোকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, সেদিকে বিন্দুমাত্র নজর দিলোনা ও। চুমুক শেষে মাহতিম চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে হঠাৎ পা থামিয়ে মেহনূরের দিকে ঘুরে দাড়ালো। বাম পকেট থেকে হাত বের করে কাপের যেদিকটায় চুমুক দিয়েছিলো,সেদিকটায় দুই আঙ্গুলে টোকা মেরে বাকাঁ হেসে কি যেনো ইশারা করলো। মাহতিমের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতেই চিন্তা করতে লাগলো মেহনূর। আচ্ছা লোকটা চায়ের কাপে টোকা মেরে কি ইশারা করলো?তাও আবার চুমুকের জায়গাটা ইশারা করার মানে কি হলো?

রাতে সেই চুমুক-ঘটিত ঘটনার পর আর কোনো ঝামেলা হয়নি। মাহতিমের কাছ থেকে অনাকাঙ্ক্ষিত ইশারা পেয়ে বুদ্ধির দরজা তখনো খুলেনি। কেনো মাহতিম চায়ের কাপে সেই চুমুক স্থানে আঙ্গুলের টোকা মারলো সেটি নিয়ে পুরো রাত ভেবেছে মেহনূর। কিন্তু আফসোস! সে কিছুই ধরতে পারেনি। সকালটা নির্লিপ্তভাবে কেটে গেলে মহিলারা দুপুরের রান্নায় মনোযোগ দিতে চলে যায়। এদিকে সৌভিকরা এসে আঙিনায় বসে আড্ডার মজলিশ বসায়। দুইদল বিভক্ত হয়ে মোবাইলে লুডু খেলার ভান করে গোপন আলাপ শুরু করে। গোল করে পুরো আট মাথা একসাথে লাগিয়ে মোবাইল স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টি রাখে। সবাই এমন একটা ভঙ্গি ধরলো যেনো লুডু খেলার জন্য সবাই একত্র হয়েছে এখানে। ফারিন ফিসফিসিয়ে সবার উদ্দেশ্য নিচু স্বরে বললো,

– আজকের প্ল্যান বলো জলদি। আর বিগ ব্রোর জন্য কি মেহনূরই ফাইনাল? ওটাই কি ফিক্সড?
ফারিনের উত্তর শুনে সামিক লুডুর লাল গুটিতে ক্লিক মেরে চাল দিয়ে বললো,
– হু, ওই মেয়েই ফাইনাল। ওটাই ডান।
সামিকের জবাব শেষ হতেই নীতি উদ্বিগ্ন সুরে বললো,
– মেয়েটা কি বয়সে বেশি ছোট হয়ে যায় না? শানাজ হলে মেবি পার্ফেক্ট হয়। কি বলো সবাই?
নীতির বেকুব মার্কা কথায় চটে উঠলো তৌফ। ভ্রুঁ কুঁচকে রাগী দৃষ্টিতে তাকালো ওর দিকে। কন্ঠ নিচু করে ক্রুদ্ধভাবে বললো ওকে,

– তোর নাম নীতি না দিয়ে দূর্নীতি দেওয়া উচিত ছিলো! যদি আরেকবার এমন বি-চ মার্কা কথা বলোস, থাপড়ায়া এক্কেবারে কানের চামড়া লাল বানায়া দিমু!
তৌফের উগ্র কথায় বিরক্ত হলো নীতি। নিজেকে সামলে নিয়ে কিন্ঞ্চিৎ পরিমাণে রাগ দেখিয়ে বললো,
– তোমার সমস্যা কি তৌফ ভাই? কথায়-কথায় এমন থাপ্পড় মারার কথা আসে ক্যান? মেহনূর যে বয়সে ছোট সেটা কি তোমরা বুঝতে পারো না? ওই মেয়ে যদি ভাইকে দেখভাল করতে না পারলো তখন তোমরা কি করবা? তাছাড়া মেহনূর যে ভাইয়ার দিকে ওই নজরে তাকায় না সেটা কি খেয়াল করছো?
নীতির কথায় যুক্তি দেখে এবার সৌভিক মুখ খুললো,

– দ্যাখ নীতি, আমরা সবাই জানি মাহতিম কেমন লাইফ লিড করে। ওর জন্য কি ঠিক, কি বেঠিক, এসব নিয়ে আমাদের চিন্তা করে লাভ নেই। আমি নিজেই মাহতিমের সাইড থেকে মেহনূরের জন্য পজিটিভ সাইন দেখেছি। যদিও সাইনটা হেব্বি ছিলোনা, তবুও ফার্স্ট টাইমের জন্য হলেও মাহতিম আনসারীর মধ্যে এমন একটা নেচার দেখাটা বড় সৌভাগ্যের ব্যাপার। তুই নিজেই একবার ভেবে দ্যাখ, একটা ছেলে কি শুধু-শুধুই কারণ ছাড়া একটা মেয়ের জন্য আরেকজনের উপর শোধ তুলবে? সুরাইয়ার যেই হাল করেছে এ্যাটলিস্ট আমরা সবাই বুঝে গেছি, হি ইজ অন দ্যা লাইন। ও বেহুদা কারণে কারোর প্রতি সদয় হতে চায়না। তোদের সাথে কিছু উলটাপালটা করতে নিলে ও যে কি অবস্থা করে সেটা আর বলার প্রয়োজন মনে করলাম না। জাস্ট এটাই মাথায় রাখ, মাহতিম যেনো ভুলেও এখান থেকে যেতে না পারে। ওর পাসপোর্ট কোনোভাবেই ওর হাতে দিবিনা।

সৌভিকের শাসানো বাণী শুনে সবাই সম্মতি জানিয়ে সভা-ভঙ্গ করলো। ফারিন ও প্রীতি পুকুরপাড়ে চলে গেলো, সামিক চলে গেলো নিজের রুমে। এদিকে নীতি কোনোভাবেই ঠান্ডা হতে পারছেনা, বারবার মন বলছে মাহতিমের জন্য মেহনূর হয়তো ঠিক হবেনা। তবুও নিজের মনকে বুঝ দিয়ে যাচ্ছে মাহতিমের জন্য এটাই সম্ভবত বেটার অপশন হবে। মেহনূর ঠিকই আজ-নয়তো-কাল মাহতিমের প্রতি নরম হয়ে যাবে, মনের মধ্যে যতো ভয়জনিত ভীতি থাকবে সেগুলোও একটু-একটু করে দূর হয়ে যাবে ওর। শানাজের সাথে গল্প করার জন্য নীতি ওর রুমের দিকে যেতে থাকলো। নীতি নিজের মনে যখন এসব নিয়ে চিন্তা করছিলো, তখন হঠাৎ ওর দৃষ্টি সাবার রুমের দিকে আটকে গেলো। সাদা শার্ট পড়ুয়া তরুণ সাবার রুমে ঢুকে দ্রুত ভেতর থেকে দরজা আটকে দিচ্ছিলো।

এমন আশ্চর্যজনক দৃশ্য দেখে কয়েক মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলো নীতি। কি দেখলো চোখে? সাবার রুমে তরুণ ঢুকে দরজা আটকে দিচ্ছে? বাড়ির মানুষ যদি এই ঘটনা জানতে পারে তাহলে কি কাণ্ড হতে পারে জানা আছে? নীতি কিছু সময়ের জন্য চিন্তাচেতনা হারিয়ে ফেললো। কিছু না ভেবেই সাবার রুমের দিকে দুমাদুম এগুতে লাগলো। অচিন্তনীয় অবস্থায় ফেঁসে গিয়ে শেষমেশ পা থামিয়ে দাড়িয়ে পরলো নীতি। আর সেদিকে এগুলৌনে সে। শানাজের রুমের দিকে পা ঘুরাতেই শানাজের রুমেও আজগুবি ব্যাপার দেখলো। শানাজও অজানা কারনে ভেতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। নীতি দুদফায় আশ্চর্য হয়ে বুকভর্তি নিশ্বাস নিলো। সেটা নির্লিপ্তে ছেড়ে দিতেই বন্ধ দরজায় তিনবার টোকা মারলো। প্রায় দুইমিনিট পেরিয়ে গেলো, কিন্তু দরজা আর খুললোনা। নীতি যেই দ্বিতীয়বার কড়া মারা জন্য হাত উঠাবে , ঠিক তখনই খট করে দরজা খুলে গেলো শানাজের। শানাজ কেমন অপ্রতিভ মুখে জোরপূর্বক হাসি পেনে নীতির দিকে তাকিয়ে আছে। নীতি সেটা খুঁটিয়ে-খুঁটিয়ে দেখতে থাকলে একপর্যায়ে প্রসন্ন গলায় প্রশ্ন করে,

– তোমার দরজা খুলতে দেরি হলো কেন ?
কথাটা শুনে শানাজের মুখ যেনো অপ্রস্তুত হয়ে উঠলো। নিজেকে যথাসাধ্য ভাবে স্বাভাবিক করে ঠেলেঠুলে হাসি টেনে বললো,
– আসলে কুচি ঠিক করছিলাম তো, এজন্য দরজা লাগিয়েছিলাম।

উত্তরটা সম্পূর্ণ বেখাপ্পা লাগলো নীতির কাছে। যে মেয়ে অন্যসময় দরজা খোলা রেখে শাড়ি বদল করে, সেই মেয়ে সামান্য কুচি ঠিক করার জন্য দরজা লাগিয়ে দিবে এটা কেমন রহস্য-রহস্য লাগলো। তার উপর শানাজের চেহারাও কেমন চোরের মতো কাঁচুমাচু করছিলো। নীতি কিছু বলবে তার আগেই শানাজ ‘ জরুরী কাজের ‘ অজুহাতে মুখের উপর দরজা লাগিয়ে দিলো। দুবোনের রুমের ভেতর কিছু যে কাহিনী রটছিলো সেটা আচঁ করতে পারে নীতি। চুপিসারে সাবার রুমের দিকে এগিয়ে চারপাশে সর্তক দৃষ্টিতে দেখে নিলো। কেউ এই মূহুর্তে ওকে দেখছে কিনা সেটা ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলো। ডানে-বায়ে কাউকে দেখতে না পেয়ে বন্ধ দরজায় কান রাখলো নীতি।

ডানকানের কর্ণকুহরে এমন একটা শব্দ এলো তৎক্ষণাৎ চমকে উঠে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো সে। বুকের উপর হাত রেখে জোরে-জোরে নিল্বাস নিতেই তাড়াতাড়ি দৌড় লাগিয়ে মাহতিমের রুমে এসে পৌছঁলো। মাহতিম তখন খাটের উপর দুহাত এবং ফ্লোরের সাথে পা ঠেকিয়ে ননস্টপ ভঙ্গিতে পুশআপ-ক্ল্যাপ করছিলো। রুমের ভেতর হুড়মুড় করে নীতি ঢুকে পরলে চকিত ভঙ্গিতে কপাল কুঁচকে ওর মুখের দিকে তাকালো মাহতিম। সাথে-সাথে মাহতিম পুশআপ থামিয়ে সোজা হয়ে দাড়িয়ে পরলো। উন্মুক্ত গায়ে দ্রুত টিশার্ট জড়ানোর জন্য খাটের উপর থেকে খুলে রাখা টিশার্টটা নিলো। নীতির হাপানো অবস্থা দেখে কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন ছুড়েঁ বললো,

– কি হয়েছে? হাপাচ্ছিস কেন? পানি খাবি?
নীতি ওই অবস্থায় হাটুতে দুহাত রেখে মেঝের দিকে তাকিয়ে ‘ না ‘ বোধকে ইশারা করলো। মাহতিম টিশার্টটা গায়ে জড়াতেই চুলে ব্যাকব্রাশ করা অবস্থায় নীতির দিকে এগিয়ে গেলো। নীতি তখন হাপানি শেষ করে একটু ধাতস্থ হয়ে সোজা হয়ে দাড়াঁলো। মাহতিমের দিকে আতঙ্কিত দৃষ্টিতে সবকিছু খুলে বললো। সবকিছু শুনতে-শুনতে কপালের ভাঁজ আরো কুঁচকে আসছিলো মাহতিমের। নীতিকে চুপ থাকতে বলে দ্রুত রুম থেকে পাঠিয়ে দিলো ওকে। ঘটনা আরো তলিয়ে দেখার জন্য চিন্তা করতে থাকলো সে। সাবার ঘটনাতে নিশ্চয়ই বিরাট অজানা রহস্য আছে। সাবা কালরাতেও সন্দেহজনক কাজ করেছে। এ বিষয়ে যদিও বাড়ির মানুষ কেউ জানেনা। কিন্তু সবার অগোচরে নির্ঘাত খারাপ কিছু হচ্ছে! কালরাতে কেনো কান্না করলো ও? সাথে কি সৌভিকের সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো?

গ্রাম্য-প্রকৃতি বিকেলের দিকে শান্ত হয়ে গেলো। পাখিদের কলরব গাছের ডালে-ডালে বেড়ে উঠলৌ। আকাশ হয়ে উঠলো রোমাঞ্চকর, চারপাশ হয়ে উঠলো আরো সুন্দর-মনোহর-মনোরম ভঙ্গিতে শীতল। মোল্লা বাড়ির সামনে যেই মেঠো পথের রাস্তা রয়েছে সেখান দিয়ে গ্রামের মানুষ অনাগ্রহ ভঙ্গিতে চলাচল করতে লাগলো তখন। কিছু মানুষ বাজার নিয়ে বাড়ির দিকে ছুটছিলো। বারান্দা থেকে দূরের পুকুরটা তখন স্পষ্টরূপে দেখা যাচ্ছিলো। পুকুরের পানিতে শুভ্র বর্ণের পাতিহাঁসগুলো কোমলচিত্তে সাতাঁর কাটছিলো। দোতলার মস্ত বারান্দায় দাড়িয়ে মাহতিম সে দৃশ্যগুলো শান্ত ভঙ্গিতে দেখছিলো। ঠান্ডা মৃদ্যু বাতাসে গা এলিয়ে মনের সব ক্লান্তি যেনো দূর হয়ে যাচ্ছিলো কাঠের রেলিংয়ে দুহাত ফেলে সেই বাতাসে গা ছেড়ে চোখ বন্ধ করলো মাহতিম।

কানে শোঁ-শোঁ করে বাতাসের প্রতিধ্বনি শোনা গেলেও মনের মধ্যে সুক্ষ আচেঁ দারুণ কিছু মূহুর্ত ভাবতে লাগলো। আনচান করে বুকের মধ্যে, কোথাও যেনো উশখুশ করে উঠলো কিছু তীব্র আকাঙ্ক্ষার প্রতি। চোখের মানসপটে ভেসে উঠলো কেশবতী বালিকার ছবি। কিন্তু সেই ভাবনার রেশ কেটে দিয়ে রুমে প্রবেশ করলো মারজা। পেছন থেকে ‘ মাহতিম ‘ ডাক দিতেই রুমের দিকে ফিরে তাকালো মাহতিম। রেলিং থেকে হাত সরিয়ে চলে গেলো রুমের ভেতরে। মারজা ছেলের বিছানায় এসে নম্রভাবে বসলেন। মাহতিম পা চালিয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বিছানায় উঠে পরলো, মায়ের কোলে মাথা ছেড়ে আলস্য ভঙ্গিতে শুলো। সুন্দর দৃষ্টিজোড়ার চোখদুটো বন্ধ করে নিলো। মারজা আঙ্গুলের ডগায় ছেলের চোখের পাপড়ি বুলিয়ে ওর চুলের মধ্যে আঙ্গুল চালনা করতে লাগলেন, ছেলের মুখের পানে দৃষ্টি দিয়ে মুগ্ধ-নয়নে বিভোর হচ্ছিলেন। ক্লিন শেভ করা গালটায় দুহাত রেখে মাথা নুয়ে টুপ করে ছেলের কপালে স্নেহের এক চুমু বসিয়ে দিলেন। মাহতিম চোখ বন্ধ করা অবস্থায় মায়ের অকস্মাৎ কাজে মৃদ্যু ভঙ্গিতে হেসে দিলো। সেই হাসিটা সুন্দরভাবে বজায় রেখে মায়ের একটা হাত টেনে নিজের গালে চেপে ধরলো । সরল গলায় শান্ত ভঙ্গিতে মায়ের উদ্দেশ্যে বললো,

– বাড়ি কবে যাবে মা? অনেক দিন তো হয়ে গেলো। এবার কি বাড়ি ফেরা উচিত না? আমার যে ছুটি শেষ হয়ে আসছে। বাসায় কিছু সময় কাটানোর সুযোগ না পেলে কাজে মন লাগাতে পারবো না।
মারজা বেশ উদাস ভঙ্গিতে হতাশার নিশ্বাস ছাড়লেন। শ্রান্ত চক্ষুদুটো বিছানাঘেষা জানালার বাইরে ফেলে বিকেলের আকাশে তাকালেন। অনেকক্ষন যাবৎ চুপটি থাকার পর হঠাৎ নিরবতা চ্ছিন্ন করে অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে বললেন,
– তুই কি বিয়ে করবি না মাহতিম? এভাবেই সারাজীবন একা থাকবি? এবার তো নিজের দিকটা দ্যাখ। নিজেকে নিয়ে একটু চিন্তা কর। আর কতো একা থাকবি?

মায়ের উদাস গলার কন্ঠ শুনে চট করে তাকালো মাহতিম। মায়ের মুখটা ভীষণ করুণ দেখালো তখন, দৃষ্টিদুটো কেমন নিগূঢ় বিষণ্ণতায় ছেয়ে ছিলো তাঁর।গালের উপর থেকে মায়ের হাতটা টেনে ঠোঁটের উপর আনলো মাহতিম, চোখ বন্ধ করে হাতের তালুতে নিজের উষ্ণ ওষ্ঠ ছুয়িঁয়ে দিলো। সেই শক্তিহীন, লাবণ্যহীন, কুচঁকানো চামড়ার হাতটা নিজের দুহাতের মাঝে আকঁড়ে ধরলো। নিচু স্বরে আক্ষেপ ভঙ্গিতে মারজার দিকে তাকিয়ে বললো,
– বিয়ে নিয়ে তর্ক করতে চাইনা মা। এই ব্যাপারটার জন্য একদম ফোর্স করো না। তুমি এসব ব্যাপারের জন্য আমাকে একা ছেড়ে দাও। আমি সত্যিই এই মুহুর্তে বিয়ের জন্য আগ্রহী নই।
মারজ ছেলের বিমত ভাব দেখে তৎক্ষণাৎ জানালা থেকে মুখ ফিরিয়ে তাকালেন। মাহতিমের দিকে প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে কপাল কুচঁকে জিজ্ঞাসা করলেন,

– এখানে তোর সমস্যাটা কোথায় মাহতিম? উলটো তোর বউ খোঁজার জন্য তোর মামীকেও কাজে লাগিয়ে দিয়েছি। মাহতিম, তুই একটাবার হ্যাঁ বল, আমি তোর জন্য সব থেকে সুন্দরী, গুণবতী, রূপসী বউ এনে দিবো। তুই শুধু সম্মতি দে মাহতিম। আর একা থাকিস না। অন্তত এইবার বিয়েটা করে আমার জন্য মেয়ে দিয়ে যা। আমার মেয়ে পালার শখটা পূরণ কর মাহতিম। তুই তো ছুটি কাটিয়ে চলেই যাবি, এদিকে আমার দিকটা কি কখনো চিন্তা করেছিস? ভেবেছিস আমি কেমন করে একা বাড়িতে থাকি? মাহদির জন্য পুরো সময়টা ছেড়ে দিলেও আমার মন তো সেই কবে থেকেই মেয়ের প্রতি আটকে আছে। এবার অন্তত হ্যাঁ বলে দে মাহতিম। তুই একবার হ্যাঁ বললেই আমি খবর পাঠিয়ে তোর মামীর সাথে সবকিছু পাকা করে ফেলবো।
মাহতিম কোনো উত্তর দিলো না। হামেশার মতোই চুপ করে রইলো। কিন্তু চুপের রেশ বেশিক্ষণ না যেতেই হঠাৎ বিগলিত কন্ঠে সে বললো,

– মা আমার বউ নিয়ে এতো এক্সাইটেড কেন? আমার বয়স কি চোখে দেখেছো? আমার সাথে যেগুলো পড়তো, সেগুলো পচিঁশের মধ্যেই বিয়ে করে এতোদিনে দুবাচ্চার বাপ পযর্ন্ত হয়ে গেছে। এই তথ্য যদি বাইরে পাচার করি কোনো ভদ্রঘরের মেয়ে কিন্তু আমার জন্য আসবেনা। বাকিটা রইলো আমার স্ট্যাটাস আর ক্লাস, সেগুলো দেখে বিয়ে করার জন্য অবশ্যই মেয়ের কমতি হবেনা। কিন্তু তুমিতো জানো আমি এসবে অভ্যস্ত না। ওইসব মেয়ে দেখলে আমরা মুখ কম, হাত চলবে বেশি। এজন্য বলছি আমাকে এসবের টেনো না। আমি যথেষ্ট ভালো আছি।
মারজা ছেলের কথা শুনে কঠিন কিছু বলবেন অমনেই দরজা দিয়ে হুড়মুড় করে মাহদি এসে ঢুকলো। বিছানার কাছে এসে মায়ের সামনে দাড়িঁয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো,

– মা, মা তুমি কি একটু আসবে? নানাভাই ডাকছে।
মারজা ওর অস্থিরতা দেখে কিছুটা বিচলিত হলেন। প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে চট করে জিজ্ঞাসা করতেই জানতে পারলেন হান্নান শেখ এক আত্মীয়ের বাড়িতে নেওয়ার জন্য মারজাকে ডাকছেন। মারজা চটপট সেই ডাকে সাড়া দিয়ে সুজলার সাথে বাইরে চলে গেলেন। এদিকে মাহমুদাও মেহনূরের খালাকে দেখতে একসাথে বেরিয়ে গেলেন। জানিয়ে এশারের পরপরই বাড়ি ফিরে আসবেন।
বিছানায় শুয়ে চুল ছেড়ে বই পড়ছে মেহনূর। বাইরে আছরের আযানটা শেষ হতেই সুরাইয়া এসে ঢুকলো। মেহনূর বই থেকে চোখ না সরিয়ে সুরাইয়ার উদ্দেশ্যে বললো,

– তোমার কি কিছু লাগবে বুবু?
সুরাইয়া বেণী দুলিয়ে বিছানায় বসে বললো,
– লাগলেও তোর থেকে অনুমতি নেইনা, এটা তুই ভালো করেই জানোস। তুই আবার চুল ছাড়ছোস ক্যান? তোরে না চুল বাইধা রাখতে বলছে?
মেহনূর বই থেকে চোখ সরিয়ে সুরাইয়ার দিকে তাকালো। চুলে হাত দিয়ে চেক করতেই শান্ত সুরে বললো,
– বুবু চুল যে এখনো ভেজা, আমি তো ভেজা চুল বাধতে পারিনা। ভেজিআচুল বাধলে ঠান্ডা লাগে। আম্মা চুল বাধতে না করে দিছে।

সুরাইয়া ছোট্ট সুরে ‘ ওহ্ ‘ বলে মেহনূরকে জোর করে নিচে নিয়ে গেলো। মেহনূর যেতে না চাইলেও জোর খাটিয়ে ডান কবজি ধরে নিয়ে যেতে লাগলো। মেহনূর বারবার জিজ্ঞেস করতে লাগলো কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, এই প্রশ্নের জবাবে একবারও মুখ খুললো না সুরাইয়া। উঠোনের দিকে গোয়ালঘরে গিয়ে মৃদ্যু ধাক্কা মেরে ভেতরে ঢুকিয়ে দিলো ওকে। গোয়ালঘরে ঢুকে ‘ বুবু তুমি এখানে ‘ বলে প্রশ্নটা যেই করবে ওমনেই পেছন থেকে দরজা লাগিয়ে ছুটে পালালো সুরাইয়া। গোয়ালঘরের ভেতর একদম অন্ধকার অবস্থা। মেহনূর দরজায় কয়েকবার সজোরে ধাক্কা দিলো কিন্তু কেউ সেটা শুনলো না। একচালা এই গোয়ালঘরের ভেতর কেবল দুটো জানালা আছে। মেহনূর অন্ধকার ঘুচানোর জন্য যেই জানালার দিকে এগুবে তখনই ফট করে পেছন থেকে আলো জ্বলে উঠলো। কেউ ওর পেছনে দাড়িয়ে আগুনের আলো ধরিয়েছে।

মোমবাতির শিখার মতো সরু লম্বা আলো দপদপ করে জ্বলছে। কিন্তু কে ঢুকেছে এই ঘরে সেটা বুঝতে পারলো না মেহনূর। পেছনে ফিরে যেই তাকালো ওমনেই দুচোখ বিশাল বড় হয়ে আকস্মিক ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো। কন্ঠরোধ হয়ে বুক ধড়াস-ধড়াস করতে লাগলো ওর। পানির তেষ্টায় বুক, গলা শুকিয়ে খাঁ খাঁ করে তোলপাড় শুরু করলো। মেহনূর ছোট থেকেই যার সঙ্গ অপছন্দ করে সেটা ছিলো তরুণ। তরুণের হাব-ভাব কোনোকালেই সঠিক ছিলো না। বিশেষ করে ওর হাত দেওয়ার অভ্যাসটা ভালো না। সুযোগ পেলেই পিঠে হাত রেখে খারাপভাবে চালনা করতে থাকে, পায়ের উপর পা উঠিয়ে সুড়সুড়ি দিতে থাকে, নানাপ্রকার ফাজলামির বাহানায় শরীরের বিভিন্ন জায়গায় টাচ করার চেষ্টা করে।

এসব কথা কাউকে বলা যায়না, সহ্য করা যায়না, স্মৃতি থেকেও মুছেনা। দিনের-পর-দিন খারাপ অভিজ্ঞতা নিয়ে মন গুমরে থাকে। তরুণ লাইটার জ্বালিয়ে মেহনূরের দিকে বিশ্রী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। শরীরের প্রতিটি ভাঁজে-ভাঁজে দূরবীনের মতো দৃষ্টি দিয়ে রেখেছে। মারাত্মক লালসাগ্রস্থ চাহনিতে মেহনূরকে গিলে খাচ্ছে। দাঁত দিয়ে নিচের ঠোঁটটা অপ্রতিভ ভঙ্গিতে কামড়ালো, এরপর জিহবা দিয়ে নিচের ঠোঁটটা বিশ্রী কায়দায় ভিজিয়ে নিলো। সবই যখন মেহনূরের চোখের সামনে ঘটছিলো তখন ভয়জনিত কন্ঠে মেহনূর নিচু স্বরে আওড়ালো,

– আ-পপনি এখানে কেন ভা-ভাইয়া?
তরুণ একটা বিশ্রী হাসি দিয়ে দুপাটি দাঁত বের করলো। লাইটারটা অন-অফ করতেই পা চালিয়ে আসতে লাগলো। মেহনূর ওই অবস্থা দেখে প্রচণ্ড ভয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিলো। কি করা উচিত এখন? চিৎকার দিলেও শব্দ বাইরে যাবেনা। আপাতত বাড়ির কেউই কোনো শব্দ শুনতে পাবেনা। তরুণ ততক্ষণে মেহনূরের একেবারে সামনে এসে হাজির। লাইটারটা ডানহাতে আকঁড়ে মেহনূরের ভয়ার্ত মুখটার দিকে তাকিয়ে হাসছে। মেহনূর সহজে এই নোংরা মানুষটার সামনে পরেনা, কিন্তু যখন পরে তখন এই মানুষটা কিছু না করে ছাড়েনা। তরুণ আবার মেহনূরের আপাদমস্তক দেখে নিলো, চুম্বকের মতো দৃষ্টিটা মেহনূরের গলার সেই তিলের উপর আটঁকে ছিলো। মেহনূরের দিকে বাম হাতটা এগিয়ে ওর কাধে রাখলো তরুণ। হাসি দিয়ে মিথ্যা সৌজন্যতার অভিনয় করে বললো,

– পড়াশোনা কেমন চলছে মেহনূর? সব ঠিকঠাক?
প্রশ্ন করছে ঠিকই কিন্তু মেহনূর এদিকে দাঁত শক্ত করে খিচ মেরে আছে। উত্তরের জন্য কুকঁড়ে গিয়ে বারবার কথা গুলিয়ে ফেলছে। তরুণ ওর কাধের উপর পাঁচ আঙ্গুল দিয়ে দিচ্ছে, বেহায়ার মতো গলার সেই তিলের উপরও আঙ্গুল ছুয়াঁচ্ছে। এমন বীভৎস আচরণে নিজের গলায় ফাঁস লাগাতে ইচ্ছে করছে মেহনূরের। তরুণের অসভ্য হাতের ছোঁয়া লেগে গা যেনো নর্দমার মতো হয়ে যাচ্ছে। তরুণ চুপ থেকে আবার উপদেশ ভঙ্গিতে বললো,
– ছাই কালার শাড়ি পরলে সাদা কালার ব্লাউজ পরবা। কালো কালার ব্লাউজ কিন্তু একটুও মানায় না। সাদা কালার পরলে একদম ফকফকা সুন্দর লাগে। মেহনূর, তুমি না হাতা একটু ছোট করবে কেমন? এই বয়সেই দাদিদের মতো ব্লাউজের হাতা পরা লাগবেনা।

কথাটুকু শেষ করতেই কাধ থেকে হতয় সরালো তরুণ। আটকে রাখা দম যেনো ছাড়তে পারলো মেহনূর। বাইরে থেকে ওকে যতটা শান্ত দেখাচ্ছিলো, ভেতরের অবস্থা ততই করুণ চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাচ্ছে ওর। চোখের বাধ যেকোনো সময় ভাঙার জন্য প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। তবুও নিজেকে যথাসাধ্য সামলে নিয়ে তরুণের আচরণ সহ্য করে যাচ্ছে। তরুণ এবার যেই জায়গায় হাত দিলো পুরো শরীর যেন বিষযুক্ত কাটার মতো ফুটে উঠলো ওর! মাথার ভেতর ঝিমঝিম করে ঝিঁঝি পোকার শব্দের বাজ পরলো! শিরা-উপশিরা টান-টান ভঙ্গিতে সমস্ত শরীর বিদ্যুতের মতো ঝিমিয়ে উঠলো। মেহনূরের পায়ের উপর বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে নাড়াচাড়া করছিলো তরুণ, সেই সাথে নানা কথার মুখরোচক প্রসঙ্গ তুলে পিঠের দিকে হাত রেখে দিয়েছিলো। তরুণের ধূর্ত ইচ্ছা ছিলো ব্লাউজের বোতাম খুলে লালসার প্রবৃত্তি এখুনি মিটিয়ে খেলতে, কিন্তু মেহনূর তখনই চোখ খিচুঁনি মেরে কেদেঁ উঠলো। মেহনূর দুহাতে শাড়ির আচঁলটা মুষ্টিবদ্ধ করে ধরেছিলো, হুহু করে ফুপিয়ে কেদেঁ উঠলে তরুণ বোতাম খোলার ইচ্ছাটা তখনই ত্যাগ করলো। সাথে-সাথে লাইটটারের গ্যাস সাইডটা বন্ধ করে ব্যাটারি লাইট জ্বালালো। জ্বালিয়ে সেটা মেহনূরের পেছনে চৌকির উপর রেখে দিলো। মেহনূরের কান্নার সুযোগ নিয়ে ওর দুগালে নিজের দুহাত রাখলো তরুণ। মেহনূর ওই মূহুর্তে আবারও ওকে বৃথা চেষ্টায় ধাক্কা দিয়ে ওকে সরাতে চাইলো কিন্তু তরুণের থাবার মতো হাতের জন্য পারলো না। তরুণ বিভিন্নভাবে কান্না থামানোর জন্য তোষামোদ করতে লাগলো ওকে,

– কাদঁছো কেন মেহনূর? আমি তো তোমার ভাইয়া হই সোনা । ভাইয়া ধরলে কিচ্ছু হয়না। তুমি না লক্ষ্মী মেয়ে? কান্না বন্ধ করোতো, লোকে শুনলে খুব খারাপ বলবে। চুপ করো সোনা, আমি তোমাকে কতো আদর করি, কতো ভালো মেয়ে তুমি। ভালো মেয়েরা কাঁদে না মেহনূর।
তরুণ নানাভাবে বোঝাতে লাগলো, চুপ করানোর জন্য নানা কথা শোনালো। কিন্তু মেহনূর এদিকে থামলো না। কান্নার জন্য নাক লাল হয়ে র-ক্ত জবার মতো রঙ ধারণ করেছে, ঠোঁটদুটোও ক্রমশ লাল হয়ে উঠেছে ওর। থরথর করে কাপঁছেও ওষ্ঠজোড়া। তরুণ ওর মুখের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ ওর ঠোঁটদুটোর প্রতি উন্মাদ হয়ে উঠলো। ভয়ঙ্করভাবে ছুইঁয়ে দেওয়ার জন্য গাল ধরে এগুতে লাগলো। কিন্তু মেহনূর এবার পাগলের মতো ছুটাছুটি করতে লাগলো ছাড় পাওয়ার জন্য, প্রচণ্ড অস্থিরতায় নাশ হয়ে তরুণকে ধাক্কা মেযে জানালার দিকে ছুটে গেলো। এদিকে তরুণ নাকে ব্যথা পেয়ে মাটিতে পরে গিয়েছিলো, নাকের নিচে ঠোঁটের উপর হাত দিতেই রক্তের উপস্থিতি টের পেলো। মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলো মেহনূর জানালায় বসে দু-পা উঠিয়ে জানালার বাইরে ফেলার চেষ্টা করছিলো। তরুণ যেই চেচিঁয়ে ওকে ডাক দিয়ে উঠবে তখনই মেহনূর জানালার মাধ্যমে বাইরে বেরিয়ে গেলো।তরুণ তাড়াতাড়ি নাকে রুমাল চেপে সেই জানালা টপকে বেরুলো। কিন্তু মেহনূরকে আর নাগালে পেলো না ও। রাগে-ক্ষোভে সুরাইয়াকে ইচ্ছেমতো গালিগালাজ করতে লাগলো। নিজের এই রূপ ঢাকার জন্য দ্রুত বাড়ির বাইরে বাজারে চলে গেলো তরুণ।

মেহনূর তীব্ররূপে হাপাঁতে-হাপাঁতে শেষমেশ কাশতে শুরু করেছে। হাটুঁতে হাত রেখে মাটির দিকে নুয়ে আছে। মুখ হা করে নিশ্বাস নিতেই হঠাৎ ভক করে বমির ঢেকুর উঠলো। অন্যদিকে কলপাড়ে হাত-মুখ ধুতে এসেছিলো মাহতিম। কিন্তু দূর থেকে মেহনূরের ওমন কাহিল অবস্থা দেখে ভ্রুঁ কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। মেহনূর লম্বা শ্বাস টেনে নিজেকে ঠান্ডা করার প্রক্রিয়ায় ছিলো, কিন্তু বারবার হাপানি রোগীর মতো শ্বাসটান উঠলে মাহতিম আর সেই দৃশ্য দেখার জন্য দাড়িয়ে থাকলোনা। দ্রুত বড়-বড় পা ফেলে এগিয়ে গেলো মেহনূরের দিকে। কাছে গিয়ে ওর উদ্দেশ্যে কিছু জিজ্ঞেস করবে তখনই মেহনূর মাথা নুয়ে ভকভক বমি করে দিলো। মাহতিম ওর অবস্থা আশ্চর্য হয়ে গেলো। নাক-মুখ লাল হয়ে শরীর যেনো কনকন শীতের মতো কাঁপছে ওর। মাহতিম প্রশ্ন করতে গিয়েও শেষমেশ গিলে খেলো কথাটা। মেহনূরের জন্য পানি এনে চটপট মুখে পানি দিতে বললো। মেহনূর মুখ ধুয়ে কুলি করতেই চোখ শান্ত মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো। শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে, প্রচণ্ড অসাড়-ক্লান্ত-বিষণ্ণ লাগছে। মাহতিম ওর অবস্থা দেখে কোমল কন্ঠে বললো,

– তোমার কি হয়েছে? হঠাৎ এখানে এসে বমি করলো কেন? জ্বর এসেছে?
মেহনূর ধীরে-ধীরে মাথা তুলে মাহতিমের দিকে ঝাপসা দৃষ্টি রাখলো। মাথাটা ভোঁ ভোঁ করে চরকীর মতো ঘুরপাক খাচ্ছিলো। শরীর গুলিয়ে প্রচণ্ড খারাপ লাগছিলো। একটুও কথা বলার শক্তি পাচ্ছিলোনা, আজ ইচ্ছে করছে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে, এই অসভ্য লোকটাকে সবিস্তারে সব খুলে বলতে, কিন্তু শরীরের সায় যেনো একটুও পেলোনা মেহনূর। আধো-আধো চাহনিতে পলক ঝাপটাতে লাগলো ও। মেহনূরের ওমন অপ্রতিভ অবস্থা দেখে মাহতিম একটু এগিয়ে আসলো। কিন্তু অবাকের বিষয় হলো মেহনূর একদম ভয় পেলোনা, একপা-ও পিছিয়ে গেলো না, ওকে দেখে থরথর করে কাপঁলোনা। কেমন নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলো মাহতিমের দিকে। মাহতিম আরেকটু এগিয়ে ওর মুখের পানে শান্ত দৃষ্টি ফেলে তাকালো। মেহনূর এবারও ওর এগুনো দেখে চমকে উঠলোনা। দানবীয় দেহের সুউচ্চ লম্বার মানুষটা আসলেই খুব লম্বা। তার সামনে দাড়ালে নিজেকে একদম এইটুকুনি লাগে। ওই প্রশস্ত বুকটার দিকে তাকালে মনেহয় আস্তো একটা রাজ্য যেনো গোগ্রাসে রাখতে পারবে। মাহতিম ওই ভঙ্গিতেই ওর উদ্দেশ্যে শান্ত সুরে বললো,

– খারাপ লাগছে? কোলে তুলবো?
মেহনূর এ প্রশ্নের জবাবে ‘ হ্যাঁ ‘, ‘ না ‘ কিছুই বললো না। চোখের পাতা হিংস্রভাবে বন্ধ হয়ে আসছে ওর। চিন্তার চাকাও যেনো কাজ করছেনা। মাহতিম ওর নিরুত্তর অবস্থা দেখে নেভি ব্লু শার্টের স্লিভদুটো কনুইয়ে তুলে ফেললো। ওর ঘাড়ের নিচে হাত ঢুকিয়ে দুহাটুঁর নিচে হাত রেখে কোলে তুলে নিলো। মেহনূর চোখ বন্ধ করে সমস্ত ভর মাহতিমের বাহুর উপর ছেড়ে দিলো। বন্ধ চোখজোড়ার দিকে একপলক তাকালো মাহতিম। প্রচণ্ড উৎকন্ঠায় ওর বুকের ভেতরটা যেনো ধসে এলো। সাথে-সাথে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিজেকে শক্ত করলো সে, মেহনূরের মুখের দিকে একদম যাবেনা। পথিমধ্যে তৌফের সাথে দেখা পেলে তৌফ আশ্চর্যে চক্ষুতারা বিরাট বড় করে তাকিয়ে রইলো। মাহতিম ওকে সংক্ষিপ্ত ঘটনা বলতেই রাস্তা ক্লিন কিনা সেটা দেখতে বললো।

তৌফ সবকিছু চেক করে মাহতিমকে নিশ্চিন্তে যেতে বললো। মাহতিম সোজা আঙিনা পেরিয়ে সিড়ি ধরে মেহনূরের রুমে গিয়ে থামলো। ওকে বিছানায় শুইয়ে দরজাটা ভেতর থেকে খিল তুলে আটঁকালো। পুনরায় ফিরে এসে মেহনূরের কাছে এসে বসলো সে। মেহনূর ততক্ষণে যেনো গভীর নিদ্রায় তলিয়ে গিয়েছে। ওর ম্লান মুখটার দিকে তাকালো মাহতিম। একটু এগিয়ে গেলো ওর মুখের দিকে, চিকন-চিকন আঙ্গুলগুলো ধরার জন্য আবারও মন ব্যকুল হয়ে উঠেছে। নিজেকে কঠোরভাবে সংযত করে ওর মাথায় হাত রাখলো মাহতিম। ধীরে-ধীরে কপাল থেকে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকলো ওর। মেহনূরের মুখের দিকে তাকিয়ে অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে বললো,

– তোমার শরীরে তো জ্বর নেই। কিন্তু বমিটা করলে কেনো? তোমার অবস্থা দেখে মনেহচ্ছে কেউ তোমাকে গলা টিপে ধরেছিলো।
মাহতিমের কন্ঠ শুনেই হোক বা অন্য কোনো কারনে, মেহনূর কিছুক্ষণ পর ঘোরের মধ্যে অনবরত বলতে লাগলো,
– বমি পাচ্ছে, বমি করবো। বমি পাচ্ছে,
মাহতিম ওর কথা অস্থির কন্ঠে বললো,
– বমি করবে? তুমিতো হুঁশে নেই। তুমি চোখ খুলো তো, তুমি কি শুনতে পাচ্ছো?

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৯+১০

মেহনূরের গালে আলতো থাপ্পড় দিয়ে চেতনা ফিরানোর চেষ্টা করছে মাহতিম। মেহনূর এতে চোখটা পযর্ন্ত খুললোনা! একপর্যায়ে মেহনূর আবার বিড়বিড় করে উঠলে মাহতিম ওর গালে মৃদ্যু থাপ্পর দেয়া বন্ধ করলো। ওর ডান গালে গাঢ় করে হাত রেখে মাহতিম ওর মুখের উপর ঝুকঁলো। মেহনূর ঘোরের মধ্যেই বলে উঠলো,
– তরুণ ভাইয়া গায়ে হাত দিও না। বমি পাচ্ছে। আম্মা, বমি পাচ্ছে। আমার বমি পাচ্ছে।

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ১৩+১৪

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here