মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ১৯+২০

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ১৯+২০
ফাবিয়াহ্ মমো

বিশাল রেসোর্টটা গাছপালা দিয়ে আবৃত। রাস্তাগুলো সবুজ ঘাস দ্বারা বিস্তৃত। জায়গাটা সম্পূর্ণ কোলাহলমুক্ত এবং পুরোপুরি জনশূন্য। সবাই যখন ঘুরে-ঘুরে পুরো রেসোর্ট দেখে ফেললো,তখন দুপুরের তপ্তময় সূর্যটা মধ্যগগণে ঠাঁই নিলো। দুপুরের খাবার তৈরিতে ম্যানেজার এসে মেনু নিয়ে গেলো, সেই সঙ্গে গোসলের জন্য সবকিছু দেখিয়ে গেলো। রেসোর্টের ভেতর আটটা কটেজ, প্রতিটি কটেজে দুটো করে রুম আছে। মাঝখানে খোলা সবুজ মাঠ, ডানদিকে সারিবদ্ধ তিনটা কটেজ রয়েছে। ছেলেরা আলাদা ভাবে থাকার জন্য দূরের তিনটা কটেজ পছন্দ করলো। মেয়েরা নিজেদের জন্য অপজিট দিকের পাচঁটা কটেজে চলে গেলো। সবাই নিজেদের রুম গুছিয়ে আলমারিতে কাপড় তুলে গোসলের জন্য বের হলো। মাঠের মাঝখানে দুইপক্ষ উপস্থিত হলে সৌভিক সবার আগে চন্ঞ্চল মুখে বললো,

– তোমরা সাঁতার জানো? চলো পানিতে নামি।
সৌভিকের উত্তেজনায় পানি ঢেলে বাধা দিয়ে বললো মাহতিম,
– একদম না। আজকে জার্নি করেছিস, আজকেই পানিতে নামার কথা উঠাবি না।গোসল সেরে সবাই রুমে যেয়ে রেস্ট নিবি। এটলিস্ট কাল পানিতে নামার চিন্তা করবি।

আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন 

মাহতিমের কথার উপর কেউ স্পর্ধা দেখাতে পারলো না। এখানে বাথরুম সংখ্যা মাত্র দুইটা, তাও দুটো বাথরুম একসাথে সেট করা। কাজেই বাথরমের জন্য ভোগান্তিতে একটু হলেও পরতে হলো। সবাই লাইন ধরে গোসলের জন্য সিরিয়াল লাগিয়ে বসলো। সেই সিরিয়াল মোতাবেক মাহতিমের সিরিয়াল লাস্টে এসে ঠেকলো। মাহতিম খুবই শান্ত মুখে বলে দেয় গোসল নিয়ে তাড়াহুড়ো নেই। কাজেই ঠিকঠাক মতো সবাই যেনো গোসল সেরে নেয়। রুমে এসে বিছানার উপর ক্লান্ত দেহ রাখলো মাহতিম। চোখদুটো বন্ধ করে কপালের উপর কবজি তুলে রাখলো। পিলপিল করে সময় চলে যেতেই গোসলের জন্য মাহদি ওকে ডাকতে এলো। মাহতিমকে ঘুমন্ত অবস্থায় বিছানায় দেখে মাহদি না ডেকেই বাইরে চলে গেলো। বাইরে গিয়ে সাবিরকে বললো, মাহতিম এখন ঘুমাচ্ছে, কেউ যেনো এখন ভাইয়াকে না ডাকে।

তেজীময় সূর্য তেজ হারিয়ে পশ্চিম আকাশে হেলতে লাগলো। চারদিকের তাপদাহ অনেকখানি কমে গেলো। গোলাপী রঙের স্নিগ্ধ পর্দায় পুরো নীল আকাশ ঢেকে গেলো। পাখির কলরবে মুখর হলো রেসোর্টের পরিবেশ, গাছগুলোতে প্রচুর পাখি ডানা ঝাপটানি দিচ্ছে। বিকেলের আযানটা শেষ হতেই সৌভিক-নীতি-শানাজরা নদীতীরে ঘুরতে গেছে। মাহদি নিজমনে ঘুমন্ত মাহতিমের পাশে সিওসি খেলছে। অনেকক্ষনণ পর মাহতিমের ঘুমের রেশ পাতলা হলো। চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে ধীরে-ধীরে চোখের পাতা খুললো, ছোট-ছোট চোখে চারপাশে তাকাতেই আধো অন্ধকারে জানালার পাশে মাহদিকে দেখতে পেলো। সেই ঘুম জড়ানো শান্ত কন্ঠে মাহতিম ওর উদ্দেশ্যে বললো,

– তুই আমার রুমে কি করছিস?
মাহদি পেছন থেকে কন্ঠ শুনে তড়িৎ গতিতে মাথা ঘুরালো। ও পেছনে ঘুরতেই মাহতিম দুহাতের তালুতে ভর দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসলো। মাহদির হাতে নিজের মোবাইল ফোনটা দেখে আবার প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
– তুই ওদের সাথে ঘুরতে যাসনি?
মাহদি ড্যাবড্যাব করে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে থাকলো। মাহতিমের দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে সিওসি খেলা স্টপ করে ফোনটা ওর দিকে এগিয়ে দিলো। স্বাভাবিক সুরে প্রসন্ন ভঙ্গিতে বললো,
– তুমি একা রুমে থাকবে দেখে আমি ওদের সাথে যাইনি। ধরো মোবাইল ধরো। ব্যালেন্স নেই, টাকা ভরে ফোনটা আবার দুইমিনিটের জন্য দিও।
ভ্রুঁ উঁচিয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকালো মাহতিম। ফোনের ব্যালেন্স শেষ করে আবার গেম খেলার জন্য হুকুম করছে। কিন্তু সেই কথাটা দূরে ঠেলে বর্তমানে ওর উদার অবস্থা দেখে বিষ্মিত হলো। দুই চক্ষু দিয়ে ওর আপাদমস্তক বুলিয়ে কৌতুহল গলায় বললো,

– তোর ভেতরে এতো দরদ আসলো কিভাবে?
মাহদি ওর হাতটা টেনে ঘাঁয়ের জায়গাটা দেখিয়ে বললো,
– তুমি হাতের জন্য খাবার খেতে পারো না ভাইয়া। তাই খাইয়ে দেওয়ার জন্য বসে আছি। তোমাকে খাইয়ে দিয়ে আমি ওদের কাছে চলে যাবো।
মাহতিম নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে চুপ হয়ে গেলো। এইটুকুনি মাহদি ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছে, কখন ভাইকে খাইয়ে দিবে সেটার জন্য ঘুরাও বন্ধ রেখেছে। মাহতিম কিছু বললো না, ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে বিছানা থেকে নামতে লাগলো। ফ্লোরে দুপা ফেলে দাঁড়িয়ে যেতেই মাহদির উদ্দেশ্যে বললো,
– তুই ওদের কাছে যা। আমার হাতে কোনো ব্যথা নেই। তাছাড়া এখনো আমি গোসল করিনি। আমি এই মূহুর্তে খাবো না। তুই ওদের কাছে যেয়ে ঘুরাঘুরি কর, যা।
মাহদি অটলভাবে বলে উঠলো,

– আমি যাবো না। তুমি গোসল করো, আমি মেহনূর আপুর কাছে যাচ্ছি। তোমার গোসল শেষ হলেই ম্যানেজার বেটাকে খাবার আনতে বলে দিবো।
মাহতিম ভ্রুঁ কুঁচকানো অবস্থায় মৃদ্যু হাসলো। সেই হাসিতে গোসলের জন্য কাপড় নিয়ে বেরিয়ে গেলো। এদিকে সৌভিকরা নদীরের পাড়ে বসে গোল আড্ডা বসিয়েছে। সুরাইয়াকে নিয়ে শানাজ-সাবা অন্যদিকে বসেছে। এটা নিয়ে প্রথমে দ্বিমত যুদ্ধ চললেও পরে নীতির কথায় দুই দল আলাদা হয়ে বসেছে। এই সুযোগে ফারিন মিলে কটেজের জন্য প্ল্যান বানানোর প্রস্তাব দিলো। সামির এবার নিচু সুরে সবার উদ্দেশ্যে বললো,
– এবারের প্ল্যান কিন্তু ক্রিটিক্যাল হবে। সবাই একটু বেশি সর্তক থাকবে। মাহতিম ভাইয়ের কান যে খরগোশের মতো সজাগ, আর বিড়াল মতো তীক্ষ্ম, এটা সবাই জানো। ভাইয়ের চোখে ধূলো দেওয়াটা চাট্টিখানি ব্যাপার না। যে করেই হোক, মেহনূরকে এবার ভাইয়ের দিকে ঠেলতে হবে। ভাইয়ের অবস্থা দেখে যা বুঝলাম, সে মোটামুটি লাইনে এসে গেছে। এখন শুধু পল্ট্রি-মুরগির ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দিলেই কাজ ফি-নি-শ। এটার জন্য, মেহনূরকে এখন ধাক্কা মেরেই ভাইয়ের কাছে পাঠাতে হবে।
কথার মাঝখানে দাঁড়ি বসিয়ে নীতি প্রশ্ন করে বসলো,

– মাহতিম ভাইকে দুচোখে দেখতে পারেনা মেহনূর। একটাবার চিন্তা কর, মাহতিম ভাইয়ের বডি দেখে সামিকের এক্স পযর্ন্ত বেহায়া হয়ে গেছিলো। কতোদিন ভাইয়ের পিছে ঘুরঘুর করেছে অথচ পাত্তা পায়নি। আর এদিকে সামনা-সামনি ওপেন চেষ্ট দেখার পরও মেহনূরের মধ্যে ফিলিংস আসেনি।
নীতির কথার যুক্তি টেনে তৌফ খুব সিরিয়াস ভঙ্গিতে বললো,

– মেয়েদের পটানোর জন্য লুইচ্চা মার্কা কাণ্ড করতে হইবো। আমি খালি আশ্চর্য হই, এই শা-লা মাহতিম চুতুমরানি এতো ভদ্র সাইজা আছে কেন? শা-লা তো একনাম্বার খাচ্চর। আড্ডায় থাকলে কি দুষ্টু মার্কা কথা বলতো, লজ্জায় আমি নিজেই উইঠা যাইতাম। ওই বান্দা সুন্দরীখানায় একেবারে সাধু সাইজা গেছে, এগ্লা ভাবতেও বুকটা ব্যথা করতাছে ভাই।
তৌফের কথায় চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ালো সৌভিক। অন্যমনস্ক সুরে ভাবুক স্টাইলে বললো,

– মাহতিম তো চরম অসভ্য, কিন্তু ওইরকম উগ্র অসভ্যতামি ও করেনা। এখানে যেই রূপ দেখতেছি এটা আসলেই মানা যায় না। ও কি ট্রাম কার্ড ফেললো নাকি? আমি আসলেই বুঝতে পারছি না। মাহতিম যদি চালাকি করে সিরিয়াসলি সেটা ধরা-বুঝার বাইরে! কোনো সুযোগই সেটা টের পাওয়ার।
হঠাৎ সৌভিকের পিঠে দুম করে কিল মারলো সিয়াম। ভ্রুঁদুটো মারাত্মক কুঁচকে বিরক্ত মুখে বললো,
– কাঠের খড়ম দিয়া যদি তোদের ঘিলুটা পারাইতে পারতাম! তোরা কি এইখানে চুলের প্ল্যানিং করতে বসছোস? মাহতিম কি করতাছে, কি করবো ওগ্লা ভাইবা কাজ আছে? মেইন পয়েন্টে আইসা প্ল্যান বানাইতে পারোস না? শালা খবিশের দল!
সিয়ামের কথা শুনে এবার সবাই ভ্রুঁ কুঁচকে তাকালো। মনে-মনে সবাঈ ক্ষুদ্ধ হয়ে গেলেও সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়ে তৌফ মুখ খুললো,

– আমার প্লাস্টিকের জুতা যদি তোর মেইন পয়েন্টে মারি, জানোস তো কি হইবো? এক্কেবারে গলাকাটা মুরগীর মতো দাপাইতে থাকবি!
সিয়াম সাথে-সাথে বাম ভ্রুঁ উঁচু করে তীক্ষ্ম সুরে বললো,
– বল দিয়া ক্রিকেটের স্ট্যাম্প ফালাইতে পারেনা, হাবলাকান্ত আইসে মেইন পয়েন্টের টার্গেট শিখাইতে! ওরে বা*, মুখটা খারাপ করাইস না। তুইযে পিনিক উঠলে কি করোস, ওইটা আর বাচ্চাগুলার সামনে বললাম না। এখন মাহতিমের হিসাব ধর, ওর ক্যালকুলেশন মিলা।
সিয়ামের কথায় ফুঁসে উঠলেও সৌভিক তৌফকে থামতে বললো। তৌফ চুপ করে প্রীতির দিকে তাকিয়ে জিহবাটা আলতো ভিজিয়ে নিলো। শুষ্ক কন্ঠে ঢোক গিলে স্বাভাবিক সুরে বললো,

– আজকের দিনটা ড্রপ যাক। আপাতত কিছু করিস না। ও একটু এডজাস্ট করুক, কাল দুপুর থেকে কাহিনী শুরু করলে বেস্ট হয়। আমার মাথায় সলিড বুদ্ধি এসেছে, রাতে সবার সাথে আলাপষকরতে বসবো। ঠিক এগারোটার দিকে আমার কটেজের ভেতর চলে আসবি। ঠিকাছে?
তৌফের কথার উপর নিজের বাক্য জুড়ে ফারিন চৈতন্য ভঙ্গিতে বললো,
– তোমাদের কাছে একটা রিকুয়েস্ট, ভাইয়ার কাছে সুরাইয়ার ব্যাপারটা জানতে দিও না। ভাইয়া জানলে হিতাহিত কাহিনী ঘটতে পারে। আপাতত এটা স্কিপ করো, আর শানাজ আপুদের বলে দাও তারাও যেনো ভাইয়ার কাছে গোপন করে।

সবাই একসঙ্গে মাথা দুলিয়ে ‘ হ্যাঁ ‘ জানালো। এরপর অন্য ব্যাপার নিয়ে আলোচনা চলতে থাকলো। এদিকে শানাজ কড়া করে সুরাইয়াকে শালীনতা বুঝিয়ে দিচ্ছে, কিভাবে তিনটা দিন সবার সাথে ভালোভাবে কাটাবে অক্ষরে-অক্ষরে শিখিয়ে দিচ্ছে। শেফালী ওকে যা-যা আবোলতাবোল বুঝিয়েছে, সবকিছু মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু মনে-মনে সুরাইয়া খুবই বিরক্ত হচ্ছে। এসব অহেতুক কথা শুনার চাইতে কটেজে ফিরে শুতে ইচ্ছে করছে। শানাজের কথায় প্রচণ্ড অধৈর্য্য হয়ে শেষমেশ সুরাইয়া অভিনয় করে বললো,

– বুবু আমার মাথা টলছে। আমি একটু ঘুমাতে যাই? তোমরা ওদের সাথে আড্ডা দিতে থাকো, আমি কটেজে ফিরে যাই। ওখানে মেহনূর তো আছে, তাই চিন্তা করতে এসো না। আমি গেলাম হ্যাঁ?
শানাজের কোনো উত্তর না শুনেই ছুটে গেলো সুরাইয়া। ওর কটেজটা সাবার সাথে দ্বিতীয় রুমটায় ফিক্সড করা। সুরাইয়া সেখানে পৌঁছতেই আবার শয়তানি বুদ্ধির জন্য ছেলেদের কটেজের দিকে তাকালো। ফাজলামি করার জন্য দাঁত বের হাসি দিতেই পা টিপে-টিপে ছেলেদের কটেজের দিকে গেলো। ইচ্ছে করে সবার রুমে ঢু মেরে মাহতিমের কটেজ খুঁজতে লাগলো। কিন্তু প্রথম কটেজের প্রথম রুম যে মাহতিমের ছিলো, সেটা একটুও ধরতে পারলো না সুরাইয়া। শেষদিক থেকে চেক দিতে-দিতে মাহতিমের কটেজে চলে আসলো, ওর রুমের দিকে চুপি দিতেই অন্ধকার আবিষ্কার করলো। রুমে যেটুকু আলো দেখা যাচ্ছিলো, সেটুকু অবশ্যই স্পষ্ট দেখার জন্য যথেষ্ট না।

তাছাড়া সূর্যের আলো পশ্চিমে হেলে পরেছে, তাই চারদিকে অন্ধকার আচ্ছন্ন করেছে। সুরাইয়া মাহতিমকে একাকী দেখার জন্য মিটিমিটি হাসি দিয়ে কোমরের কাছে দুইহাত বেধেঁ ভেতরে পা দিলো। অন্ধকার রুমে আরেকটু ঢুকে চারিদিকে সরুচোখে দেখতে লাগলো। কিন্তু তখনই পেছন থেকে রুমের দরজা আটকানোর শব্দ হলো। সুরাইয়া চমকে গিয়ে যেই পেছনে ঘুরে তাকালো ততক্ষণে ও অন্ধকার রুমে বন্দি হয়ে গেলো! বিকট চিৎকার দিয়ে অন্ধকারকে ভয় পেয়ে হাউমাউ করে কাদঁতে লাগলো সুরাইয়া। রেসোর্টের রুমগুলো এতো শক্ত ও মজবুত, সেখান থেকে একটা আওয়াজও অপরপ্রান্তে গেলো না। দরজা থাবাতে-থাবাতে সুরাইয়া আরো চিল্লিয়ে কাঁদতে থাকলো। ওই মূহুর্তেই দরজার বাইরে মাহতিম দাঁড়িয়েছিলো।

পকেটে দুহাত গুঁজে নিষ্ঠুর ভঙ্গিতে প্রতিটা চিৎকার শুনতে লাগলো। কিছুক্ষণ ক্ষোভ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ঘাড়ের ব্যায়াম হিসেবে অদ্ভুত কাজ করলো। মাথাটা ধীরগতিতে একবার ডানে, আরেকবার বামে কাত করলো। সেদিন এভাবেই একটা মেয়েকে রুমে আঁটকে দিয়েছিলো, এভাবেই ওই মেয়েটা দরজা খুলার জন্য অনুনয় করেছিলো, বারবার জঘন্য স্পর্শের কবলে পরে নিজেকে অসহায় ভেবেছিলো। প্রতিটা অশ্রুফোঁটা ঝরঝর করে দুগাল বেয়ে ভিজে যাচ্ছিলো। সে ছাড়া পেয়ে নিস্তেজ শরীর নিয়ে সত্য গোপন করে ফেললো।

সেই জঘন্য সত্য আপন দাদাভাইও জানতে পারলোনা, নিজের নাড়ী ছেড়া মায়েরও দুকানে শোনার সুযোগ হলোনা । আজ একইভাবে মূখ্য অপরাধীকে শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। কিছুটা অন্য কায়দায়, কিছুটা অন্য ভঙ্গিতে। আর সেই দৃশ্যের মতো আজ কিছুটা স্থান চেন্ঞ্জ হয়েছে। সেদিন সুরাইয়া বাইরে দাড়িয়ে উপভোগ করেছে। আজ সেই জায়গায় মাহতিম দাঁড়িয়ে তৃপ্তির শ্বাস টানছে। তরুণের কাছ থেকে প্রতিটা স্বীকারোক্তি পুনরায় স্মরণ করছে, সেই দগ্ধ-পীড়িত বুকের যন্ত্রটা আজও বেকাবু স্পিডেই চলছে। আজ সুরাইয়ার জায়গায় অন্য কোনো ছেলে হলে ব্রেনে দুটো বু-লে-ট ঢুকিয়ে দিতো নি-র্ঘা-ত! এখনো হিসাব বাকি। মাহদির ভাষ্যমতে আরেকটা হিসাব নেওয়া এখনো বাকি।

সুরাইয়ার চিৎকারে রুমের ভেতরটা বিভীষিকা হয়ে উঠলো! সন্ধ্যার আচঁটা আরো গাঢ় হয়ে অন্ধকার হয়ে গেলো! চিৎকার করতে-করতে গলা শুকিয়ে কাঁশতে লাগলো সুরাইয়া। বেগতিক মাত্রায় কাঁশতে-কাঁশতে দুহাতে গলা ধরে ধপ করে ফ্লোরে বসে পরলো। রুম এতোটাই অন্ধকার ছিলো যে, সেখানে একফোঁটা আলো নেই।এদিকে ঘন্টাখানেক চিল্লিয়েও সুরাইয়ার লাভ হয়নি। সুরাইয়া বিবশ অবস্থায় হাঁপাতে-হাঁপাতে ফ্লোরে মাথা লুটিয়ে ফেললো। চোখের পাতা বন্ধ করে সমস্ত দেহ ফ্লোরে ছেড়ে দিলো। কানের মধ্যে ভোঁ ভোঁ শব্দ শুনতে পেলেও শরীর একেবারে শূন্য অনুভব করলো। এরপর কিচ্ছু মনে নেই ওর।

সন্ধ্যার আঁধার নামতেই নির্জন রেসোর্টটা আরো নিস্তেজ হয়ে উঠলো। প্রতিটি কটেজের বাইরে লাইট জ্বললেও ভূতুড়ে পরিবেশ লাগছিলো। চারপাশ ঘিরে এতো গাছপালা ছিলো যেগুলো রাতের অন্ধকারে ভয় দেখানোর জন্য যথেষ্ট। বিশাল লম্বা-লম্বা গাছগুলো কেমন ঝুঁকে আছে কটেজের দিকে। মাথা তুলে লম্বা গাছগুলোর দিকে তাকালে ভয়ে গা ছমছম করে উঠবে। মাগরিবের পর সবাই মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালিয়ে রেসোর্টে ফিরে আসলো। সবাই নিজেদের কটেজে ফিরে গেলেও আশ্চর্য ব্যাপার ঘটলো ছেলেদের কেটেজে। সৌভিক মাহতিমকে দেখতে এসে ওর রুমটা বাইরে থেকে লাগানো দেখে। ও কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে গেলে হঠাৎ পাশ থেকে সিয়াম জিজ্ঞাসু সুরে বলে উঠে,

– তোর ভ্রুঁ কুঁচকাইলো ক্যান? কিছু হইছে?
সিয়াম প্রশ্ন শুনে কিছুক্ষণ নিরুত্তর চেয়ে রইলো সৌভিক। এদিকে ওর চুপটি দেখে সিয়ামের মনেও খটকা লাগতে শুরু করলো। ও কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই সৌভিক চিন্তান্বিত সুরে বললো,
– মাহতিম যদি কিছু লুকাতে শুরু করে তাহলে কিন্তু ঘাপলা। দরজা লাগানো দেখেই আমার মনটা কেমন সাইরেন দিয়ে উঠলো। আচ্ছা চলতো ওদিকে। একটু কাজ আছে।

সৌভিক তর্জনী তুলে মেহনূরের রুমের দিকে ইশারা করলো। সিয়াম ওর ইশারা মোতাবেক ওর পিছু-পিছু কটেজের দিকে পা বাড়ালো। মেহনূরের রুমটার কাছে এসে দরজা ভিড়ানো দেখে দুজনই বাইরে থেকে নক করলো। মেহনূর তখন বিছানায় শুয়ে বুকের নিচের বালিশ রেখে উপন্যাস পড়ছিলো। সেই মনোযোগটা ভঙ্গ করে দিলে মেহনূর বইটা বন্ধ করে বিছানা থেকে নামলো। ছোট্ট সুরে ‘ আসুন ‘ বললে সৌভিক আর সিয়াম দরজা ঠেলে ঢুকলো। সৌভিক একটা হাসি দিয়ে শান্তচিত্তের মেহনূরকে জিজ্ঞেস করলো,

– তুমিতো কটেজের বাইরে যাওনি না? মাহতিমকে দেখেছো? ও কোথায় গিয়েছে জানো?
দুটো প্রশ্ন শুনে মেহনূর ‘ না ‘ সুচকে মাথা নাড়িয়ে দিলো। ওর উত্তর দেখে সৌভিক আরো চিন্তিত হয়ে উঠলো। মাহতিম রেসোর্টের বাইরে গেলে জিপ নিয়ে বেরুবে, আশেপাশে থাকলে ওকে দেখা যাবে, কিন্তু ও যেহেতু এখানেও নেই তার মানে কোথায় গেছে? সৌভিক অন্যমনষ্কে ডুব দিলে আর কোনো প্রশ্ন করলোনা মেহনূরকে। একটা সৌজন্যমূলক হাসি দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পরলো, সিয়ামও বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে কোমরে দুহাত রেখে আশেপাশে তাকাতে লাগলো। সবাই নিজ-নিজ রুমে আছে, মাহদি সামিকের রুমে শুয়ে সিওসি গেম খেলছে, মেহনূর নিজের রুমে শুয়ে উপন্যাস পড়ছে। মাহতিম নিশ্চয়ই কিছু করে হাওয়া হয়ে বসে আছে। সৌভিকের চিন্তান্বিত মুখটা দেখে সিয়াম কৌতুহল সামলাতে না পেরে বললো,

– আচ্ছা তুই কি নিয়ে চিন্তা করোস ওইটা তো ক্লিয়ারলি বলবি? মাহতিম ঘাপলামি যদি করেই থাকে এতে তোর চিন্তা করার কারন কি?
এবার সৌভিক পূর্ণদৃষ্টিতে সিয়ামের দিকে তাকালো। বিরক্তমুখে ওর দিকে শক্ত মেজাজে বললো,
– রেসোর্টের কোথাও সুরাইয়াকে দেখতে পাইছিস?
সিয়াম প্রশ্নটা শুনেই চরম বিষ্ময়ে সঙ্গে-সঙ্গে চর্তুদিকে দৃষ্টি দিলো। কাউকে খুঁজার চেষ্টা করতেই সুরাইয়ার কটেজের দিকে দৃষ্টি থমকে তাকালো। বদ্ধ দরজার দিকে দৃষ্টি রেখে আশ্চর্য কন্ঠে বললো,
– মাহতিম ওরে ই-ন্না-লিল্লা-হ —

সিয়াম কথাটা শেষ করতে যেয়ে থেমে গেলো। চাপা ভয়ার্ত চাহনি নিয়ে সৌভিকের দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে তাকালো। সৌভিক একটা ঢোক গিলে নিচের ঠোঁটটা দাঁতে কামড়ে ওকে সঙ্গে আসার জন্য ইশারা করলো। সিয়াম ওর ইশারাটুকু টের বুঝতে পেরে সৌভিকের পিছু-পিছু পুনরায় চলতে থাকলো। ওরা হাঁটতে-হাঁটতে পুকুরঘাঁটের কাছে আসতেই অকস্মাৎ চমক ভঙ্গিতে সটান দাড়িয়ে পরলো। আধো অন্ধকারে দূরের একটা লাইটের আলোয় পুকুরঘাঁট দেখা যাচ্ছে। সেই ঘাঁটের কিনারা ঘেঁষে পকেটে দুহাত গুঁজে মাহতিম দাড়িয়ে আছে। ওরা মাহতিমের পিছনদিকে দাড়িয়ে আছে বলে মাহতিম ওদের দেখতে পায়নি। চুপচাপ পা চালিয়ে মাহতিমের ডানে সৌভিক এবং বামে সিয়াম এসে দাঁড়ালো। দুজনই মাহতিমদের দিকে দৃষ্টি দিয়ে দেখলো মাহতিম পুকুরের টলটলে পানির দিকে তাকিয়ে আছে। ওরা দুপাশে এসে দাড়িয়ে আছে, সেটা একদম গ্রাহ্য করেনি মাহতিম। নিরবতার প্রহর চলতে থাকলে সৌভিক নিরবতা চ্ছিন্ন করে বললো,

– দোস্ত ওর সাথে কি করছিস?
বাতাসের শোঁ শোঁ ঠান্ডা হাওয়ার আওয়াজ ছাড়া অন্য কোনো উত্তর এলো না তখন। সৌভিক উত্তরের জন্য তখনও মাহতিমের দিকে তাকিয়ে আছে। সিয়াম তাগাদা দেওয়ার জন্য মুখ খুলবে ওমনেই মাহতিম অটল অবস্থায় শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
– রুমে বন্দি।
মাহতিমের উত্তর শুনে কিছুক্ষণ হতভম্ব দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো দুজন। পরক্ষণে সৌভিক কৌতুহলের জোরেই তীব্র উৎকন্ঠায় বললো,
– তুই কি পাগল হয়েছিস? ওরা যদি জানতে পারে তাহলে কি অঘটনটা হবে জানিস? তুই কেন এই কাজ করলি মাহতিম? সুরাইয়ার কি দোষ?
মাহতিম এবার তিরিক্ষি দৃষ্টিতে সৌভিকের দিকে তাকালো। পকেটে দুহাত গুঁজা অবস্থায় ওর দিকে সম্পূর্ণ ঘুরে দাঁড়ালো। সৌভিক স্থির ভাবে ওর অবস্থা বুঝার চেষ্টা করছে, সিয়াম পেছন থেকে মাহতিমের কাধে হাত রেখে শান্তসুরে ঘটনার ব্যাপারে জানতে চাচ্ছে। মাহতিম ওদের দুজনের উদ্দেশ্যেই ঠান্ডা মস্তিষ্কে বললো,

– কি করছি, কেনো করছি, কি কারনে করছি এসব উত্তর এই মূহুর্তে দেওয়াটা প্রয়োজন বোধ করছিনা। তোরা আমাকে আপাতত তিনটা দিনের জন্য একদম একা ছেড়ে দিবি। এই তিনদিনের ভেতর কি করবো, কেনো করবো কিচ্ছু জিজ্ঞেস করতে যাবিনা। আমার রাস্তায় ফুল সাজাতে গিয়ে ফুলের সাথে কাঁটা ফেলে দিস না। নিশ্চয়ই আনসারী গাধামি করার পার্সনালিটি রাখেনি। স্বাভাবিক থাক।

মাহতিমের কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত উত্তর পেয়ে চুপ হয়ে গেলো দুজন। ওদের সামনে দিয়ে দ্রুতপায়ে পুকুরঘাঁট থেকে রেসোর্টের অন্যদিকে ফিরলো মাহতিম। সৌভিক ও সিয়াম নিরুদ্যম ভঙ্গিতে কটেজের দিকে যেতেই হঠাৎ ‘ রুমবন্দি ‘ কথাটা মনে পরলো। সৎবিৎ ফিরে পাওয়ার মতো চেতন হলে দুজনেই নিজেদের দিকে বড়-বড় চোখ করে তাকালো। একসাথে দুজন ঢোক গিলতেই শঙ্কামুখে মাহতিমের বদ্ধ দরজার দিকে তাকালো। ওমনেই ঝড়ের বেগে দৌড় লাগিয়ে ওরা দুজন কটেজে ঢুকে দরজা খুলতে গেলো। তড়িঘড়ি করে দরজা খুলতেই সিয়াম প্রচণ্ড অস্থির হয়ে বললো,

– দোস্ত, ওই সুরাইয়া যেনো ঠিক থাকে। নাইলে কপালে বাশঁ আছে। তাড়াতাড়ি মোবাইলের ফ্ল্যাশ জ্বালা!
সৌভিক তাড়াতাড়ি মোবাইল বের করে ফ্ল্যাশ অন করলো। রুমের ভেতরে আলো ফেলতেই হঠাৎ ফ্লোরের উপর বেহুঁশ অবস্থায় সুরাইয়াকে দেখতে পেলো। দ্রুত দুজন রুমের ভেতরে ঢুকে সুরাইয়াকে ধরে-ধরে বাইরে এনে গলা চড়িয়ে সবাইকে ডাকলো। সৌভিকের গলার কন্ঠ পেয়ে সবগুলো কটেজ থেকে ছুটে এলো । শানাজ-সাবা-মেহনূর দ্রুত রুম থেকে বেরিয়ে মাঠের প্রাঙ্গণটুকু পেরিয়ে ছেলেদের কটেজে উপস্থিত হলো।

মাহতিমের কটেজে যেই পরিস্কার সিড়ির জায়গাটুকু ছিলো সেখানে সুরাইয়াকে বসিয়ে ওর মুখে পানি ছিঁটা দিতে লাগলো। শানাজ ছুটে এসে অস্থির হয়ে তাড়াতাড়ি সুরাইয়ার পাশে এসে বসলো। সুরাইয়ার মাথাটা কাধে নিয়ে বারবার ওর গাল ধরে ডাকতে থাকলো, কিন্তু সুরাইয়া কোনোভাবেই উঠলো না। সুরাইয়ার এমন অবস্থা দেখে সবার যেনো আত্মা শুকিয়ে আছে। মেহনূর দৌড়াতে গিয়ে হাতের বই ফেলে সুরাইয়ার পায়ের কাছে ঠান্ডা তালুতে হাত ঘঁষে দিচ্ছে। সাবা ওর মুখের উপর অনবরত পানি ছিঁটা দিয়ে ডেকেই যাচ্ছে। সুরাইয়ার কোনো হেলদোল না দেখে সাবির ডাক্তার ডাকতে মাইক্রো নিয়ে বেরুলো। নীতি-প্রীতি-ফারিন আশ্চর্যজনক অবস্থায় মুষড়ে পরেছে। সুরাইয়া কিভাবে মাহতিমের রুমে আটকা পরেছে কিছুতেই ওরা বুঝতে পারছেনা। সামিক নীতির পেছন থেকে ওর কানের কাছে মুখ এনে বলল,

– মাহতিম ভাই কি ফারিনের ব্যাপার নিয়ে রিভেন্ঞ্জ নিলো?
নীতি কন্ঠ আরো নিচু করে খুব সাবধানে সামিকের উদ্দেশ্যে বললো,
– ভাইয়াকে ফারিনের ঘটনা বলা হয়নি।
সামিক কান খাড়া করে উত্তরটা শুনে নীতির পেছন থেকে সরে এলো। সিড়ির কাছে গিয়ে মেহনূরের পাশে বসে শানাজের দিকে প্রশ্ন করলো,
– সুরাইয়া কি ভাইয়ার সাথে দেখা করতে এসেছিলো? ও কিভাবে রুমের ভেতর আটকা পরলো শানাজ?
সামিকের যুক্তিপূর্ণ প্রশ্ন শুনে শানাজের শঙ্কিত ভাবটা চিন্তার দুয়ারে কড়া নাড়লো। সুরাইয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই উদ্বেল কন্ঠে বললো,

– ও তো ঘুমানোর জন্য চলে এসেছিলো। এরপর কি হয়েছে জানিনা, কিন্তু আমরা যখন চলে এলাম, তখন সুরাইয়াকে পেলাম না। ফিরে এসেই দেখলাম, মেহনূর নিজের রুমে উপন্যাস পড়ছে। আর কেউ সুরাইয়াকে কটেজে আসতে দেখেনি। এখন কিভাবে মাহতিম ভাইয়ার রুমে আসলো আমি কিছুই জানিনা।
এদিকে সামিকের অযথা জেরা দেখে লাত্থি মারতে ইচ্ছে করলো সৌভিকের। এখন যদি মাহতিমের ফাঁদটা ধরে ফেলে তাহলে কি হবে জানা নেই। সৌভিক তাড়াতাড়ি পুরো ব্যাপারটা ঘুরানোর জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলো। ছটফট ভঙ্গিতে তাড়াহুড়ো কন্ঠে বললো,

– আমি, আমি, আমি ভুল করেছি। আসলে রুমের ভেতর যে সুরাইয়া ছিলো সেটা আমি জানতাম না। দরজা খোলা ছিলো বলে বাইরে থেকে লাগিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু ভেতরে যে সুরাইয়া আঁটকা পরবে কে জানতো? আই এম সরি গাইজ। আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি সুরাইয়ার এরকম অবস্থা হবে। আমি সত্যিই দুঃখিত।
সৌভিক সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা বলে মাহতিমের ঝামেলাটা নিজের কাধে নিলো। এই ব্যাপারটা দেখে সিয়াম শুধু চুপ করে তাকিয়ে রইলো। এখন কিছু বলা মানেই বি-প-দ, আর মাহতিমের কাহিনী জানতে পারলে মহা সাং-ঘা-তিক বি-প-দ! শানাজ ওর কথা শুনে ক্রুদ্ধ ভঙ্গিতে মুখ নামিয়ে নিলো। কেনো মুখটা রাগে ভস্ম হলো সেটা শুধু সৌভিকের কাছেই গোচর রইলো। এদিকে আর দেরি না করে, সবাই মিলে সুরাইয়াকে ধরাধরি করে কটেজের রুমে নিয়ে শুইয়ে দিলো। ডাক্তার এসে চেক করে বললো, ভয় থেকে জ্ঞান হারিয়েছে, খুব শীঘ্রই সেন্স চলে আসবে। কেউ আর সুরাইয়ার রুমে ভিড় করলো না, সবাইকে নিজেদের রুমে যেতে বলে শুধু মেহনূর সুরাইয়ার পাশে রইলো। সুরাইয়ার কপালে হাত বুলিয়ে দিতে-দিতেই সময়ের কাটা রাত আটটায় এসে পৌঁছলো। প্রায় দেড়ঘন্টা পর সুরাইয়া ধীরে-ধীরে চোখ খুললে মেহনূর ওর মুখের দিকে একটু ঝুঁকে বললো,

– বুবু, খারাপ লাগছে? চোখ খুলো বুবু। চোখ বন্ধ করো না।
মেহনূর কথাটুকু বলতেই গ্লাস এনে বিছানায় এসে বসলো। বালিশ থেকে সুরাইয়ার মাথাটা একটু তুলে অন্যহাতে গ্লাস এগিয়ে ঠোঁটের কাছে গ্লাস ঠেকালো। সুরাইয়া খুবই দূর্বল ভঙ্গিতে দুঢোক পানি গিলে আবার বালিশে মাথা রাখলো। দূর্বলমাখা কন্ঠে আস্তে-ধীরে বললো,
– আমি কোথায় আছি রে মেহনূর?
মেহনূর গ্লাসের পানিটুকু নিজের আচঁলের শেষপ্রান্তে ঢেলে শাড়ির আচঁলটা একটু ভিজিয়ে নিলো। হালকা একটু নিংড়ে নিয়ে সুরাইয়ার গালে-কপালে-কানে বুলিয়ে দিতেই বললো,

– তোমাকে কটেজের রুমে শোয়ানো হয়েছে বুবু। তুমি ওদিকটায় কেনো গিয়েছিলে?
সুরাইয়া প্রচণ্ড আরাম বোধে চোখ বন্ধ করে রইলো। মেহনূরের ছোট্ট সেবাটায় আলতো ঠান্ডা স্পর্শ পেয়ে বেশ শান্তি পাচ্ছিলো। কপালে মেহনূরের হাতটার উপর নিজের শক্তিহীন হাতটা রাখতেই মেহনূর একটু ধাক্কা খেলো যেনো। ঠিক তখনই সুরাইয়া আলতো একটা ঢোক গিলে চোখ বন্ধ অবস্থায় বললো,
– আমি রুমে ঢুকেছিলাম। ওখানে কেউ ছিলো না। রুম অন্ধকার ছিলো, আমি রুমের ভেতরে ঢুকলে কে জানি বাইরে থেকে ইচ্ছে করে দরজা লাগিয়ে দিলো। কত চিৎকার করলাম, দরজা ধাক্কালাম, লাইটের সুইচ খুজেঁ ইচ্ছামতো টিপলাম, কিন্তু কিচ্ছু হলো না। কিচ্ছু হলো না।
সুরাইয়া আড়ষ্ট কন্ঠে কথা বলতে-বলতে চুপ হয়ে গেলো। ভেতর থেকে লম্বা একটা নিশ্বাস টেনে সশব্দে ছেড়ে দিলো। চোখ বন্ধ করা অবস্থায় দূর্বল শরীরে শক্ত কন্ঠে বললো,

– এখন এই রুম থেকে চলে যা। আমি একা ঘুমাতে পারবো। যখন তোকে আর সবাইকে ডেকেছি, তখন তো আর আসতে পারিসনি।এখন তোদের দেখানো সেবার দরকার নেই। আর শোন, যাওয়ার আগে দরজা টেনে যাবি।
কথাটা বলতেই মেহনূরের দিকে পিঠ দিয়ে ডানপাশ হয়ে শুলো ও। মেহনূর কথার বিপরীতে সবসময়ের মতো চুপটি থেকে বিছানা থেকে উঠে দাড়ালো। টেবিল থেকে জগ নিয়ে খালি বোতলে পানি ভরে সেটা ওর মাথার কাছে রেখে দিলো। রাতে যদি কারেন্ট না থাকে, তাই সে চিন্তা করে একটা মোমবাতি আর দিয়াশলাইয়ের প্যাকেট টেবিলের উপর রেখে দিলো। মেহনূর দরজা টানার আগে আরেকবার সরল কন্ঠে বললো,
– কিছু দরকার হলে ডাক দিও বুবু। আমি তোমার পাশের কটেজেই আছি। আর সাবা বুবু তোমার বামপাশের রুমে আছে। আমি গেলাম।
সুরাইয়া আরেকবার ওকে তাড়না দিয়ে রুষ্ট গলায় বললো,

– কাহিনী করতে হবেনা। বেরিয়ে যা।
মেহনূর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে দরজা ভালোমতো টেনে দিলো। কটেজের তিনধাপ সিড়ি ধরে নামার সময় আকাশের দিকে তাকালো। কালো আকাশটায় যেনো প্রচুর মেঘ জমে আছে, বিদ্যুপৃষ্ঠের মতো আলোর ঝিলিক মেঘে-মেঘে খেলে যাচ্ছে। বাতাসের তেজও পূর্বের তুলনায় বেশি এখন। বৃষ্টি আসার আগমুর্হূতের মতো ভিজভিজে বাতাস বইছে, গাছগুলো শাখা-প্রশাখা নাড়িয়ে যেনো ভয় দেখাতে চাইছে। মেহনূর মাথা নিচু করে সিঁড়ি পেরিয়ে ঘাসের উপর পা রাখলো। বাদামী চামড়ার চটিজুতার দিকে দৃষ্টি রেখে ছোট ছোট পা ফেলে অনেক কিছু চিন্তা করতে থাকলো। ঠান্ডা-তেজালো হাওয়ার জন্য খোঁপা করা চুলগুলো আলগা হতে লাগলো ওর।

অন্যমনষ্ক মেহনূর খুবই ধীরগতিতে পা ফেলে হাঁটতে থাকলে বাতাসের জন্য খোঁপাটা একদম খুলেই গেলো। বিদ্যুতের বেগে পিঠ ছাড়িয়ে কোমরে মৃদ্যু বাধা পেয়ে একেবারে হাটুর কাছে চুলগুলো পৌঁছলো। রাতের আবছা অন্ধকারে বাতাসের তেজে ওর চুলগুলো উড়তে লাগলো। পড়নে সাদা সুতির শাড়ি এবং পাড়টা গোলাপী রঙের ছিলো। হিম জড়ানো বাতাসের জন্য গোলাপী ব্লাউজটার গোলাপী হাতাটা আরেকটু কনুই থেকে উপরে তুললো। আকাশে এখন গুড়ুম-গুড়ুম শব্দ করে মেঘ ডাকছে। মেঘের থেমে-থেমে ডাক চলতে থাকলে হঠাৎ পুরো চারপাশ আলোকিত হয়ে দিনের মতো উজ্জ্বল হলো, আর সেকেন্ডর মধ্যেই উজ্জ্বলতা নিভে গিয়ে নিকষ কালোতে ফিরে আসলো প্রকৃতি।

মেহনূর আর হাঁটলো না তখন, আকস্মিকভাবে পা থামিয়ে মুখটা তুলে ছেলেদের কটেজের দিকে তাকালো। মনের মধ্যে বিভিন্ন প্রশ্নের আনাগোনা চলতে থাকলে শেষমেশ বাধ্য হয়ে নিজেকে শক্ত করে সেদিকেই পা বাড়িয়ে দিলো। চোখের শান্ত-নরম দৃষ্টি কটেজের দিকে স্থির রেখে কাছে চলে এলো। ঘাস থেকে সাদা টাইলসের সিড়িতে একপা ফেললো। এভাবে পরপর তিনটা সিড়ি অতিক্রম করে কটেজের প্রথম রুমটার দিকে এগুতে লাগলো মেহনূর। কটেজের দ্বিতীয় রুমটা এখন খালি, এখানে সৌভিক আজ ঘুমায়নি, সে তৌফের রুমে চলে গেছে, তাই রুমটা আলো ছাড়া অন্ধকার হয়ে আছে। মেহনূর বারবার দুঠোঁট ভেতরে পুড়ে জিহবা দিয়ে ভিজিয়ে নিচ্ছে। যেই পরিমাণে ভয় হচ্ছে পানির তেষ্টায় বুকটা একদম ছটফট করে উঠছে।

নিজেকে শান্ত-স্থির রাখার জন্য জোরে একটা নিশ্বাস টেনে ঠোঁট গোল করে ছেড়ে দিলো। সাদা টাইলসের জমিনে দৃষ্টি রেখে সামনে এগুনোর জন্য পা বাড়ালো, যতবার একপা করে দরজার কাছে যাচ্ছে, ততবার মনেহচ্ছে কেউ বুকের যন্ত্রটায় পাথর দিয়ে জোরে চাপা দিয়ে রেখেছে। মেহনূর ঠোঁটদুটো একটু ফাঁক করে অনবরত নিশ্বাস ছাড়ছে তখন, নিশ্বাসের তেজটাও বুকের ধুকপুকের সাথে তাল মিলিয়ে বেড়েছে। দরজাটার কাছে এসেই দেখলো দরজাট আধ-ভেজানো, রুমের ভেতরে টেবিল ল্যাম্প জাতীয় লাইট জ্বালানো ছিলো। সেই ল্যাম্পের অল্প আলো দরজার বাইরে একটুখানি এসে পরেছে। মেহনূর সেই আলোটা একপলক দেখে নিয়ে দরজাটা ধীরভাবে ঠেলে ঢুকলো। সাদা টাইলস থেকে দৃষ্টি তুলে কাঙ্ক্ষিত জায়গায় ধীরগতিতে তাকাতে থাকলো।

মাহতিম তখন চেয়ারে বসে টেবিলে কি যেনো একটা করছিলো। মেহনূর দৃষ্টি তুলে মাহতিমের উন্মুক্ত পিঠ, পেশিবহুল হাত, মুখের ডানপাশটা একটুখানি দেখতে পাচ্ছিলো। টেবিলের উপর ডানহাতটা তুমুল স্পিডে চলছে মাহতিমের। মেহনূর ওর দিকে আরেকটু ভালোভাবে খেয়াল করতেই দেখতে পেলো, মাহতিমের হাতে একটা লাল পেন্সিল, আর সেই পেন্সিল দিয়ে সাদা কাগজের উপর মনোযোগের সাথে কি যেনো লিখছে। মেহনূর কিভাবে ব্যাপারটা হ্যান্ডেল করবে সেটাই চিন্তা থাকলে ওখানেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। রুমের দুপাশে বড় দুটো জানালা দিয়ে শোঁ শোঁ করে পর্দা উড়িয়ে বাতাস আসছিলো।

সেই সঙ্গে মেঘের গর্জন যেনো আরো বেগ বাড়িয়ে দিয়েছে। হঠাৎ আকষ্মিকভাবে বিদ্যুৎপৃষ্ঠের বজ্রধ্বনি হলে অস্ফুট শব্দে শিউরে উঠলো মেহনূর। খট করে ডানহাতের পেন্সিল থমকে গেলো মাহতিমের। দুকানের কর্ণপথে যে শব্দটা আসলো তাতে আর চিন্তা না করে তৎক্ষণাৎ পিছু ফিরে তাকালো। টেবিল ল্যাম্পের আলোয় দরজার মুখে যে বালিকা ভয়ে জবুথবু হয়ে দাড়িয়ে ছিলো, তাকে দেখে ভ্রুঁদুটো কুঁচকে নাকের দিকটায় নেমে এলো। মেহনূর ওর বিরক্তিভরা মুখটা দেখে সঙ্গে-সঙ্গে চোখ নামিয়ে বললো,

– জরুরী কথা ছিলো।
কথাটুকু শুনতেই ভ্রুঁদুটো স্বাভাবিক হয়ে বাঁ-ভ্রুটা উপরে উঠালো মাহতিম। ওর দিকে তীক্ষ্মদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই হাতের পেন্সিলটা টেবিলের উপর রাখলো। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতেই পালটা প্রশ্ন করে বললো,
– কি দরকার এখানে?
মেহনূর ভীতু চাহনি দিয়ে আরেকবার মাহতিমের মুখটা দেখে নিলো। এরপর নিচু গলায় নতমুখে বললো,

– আপনি সুরাইয়া বুবুকে কেনো রুমে আটকে দিয়েছেন? যদি বুবুর কিছু হতো, সেটার দায়ভার কি আপনি নিতেন?
প্রশ্ন করেই মনে হলো মস্ত বড় ভুল হয়ে গেছে। কথাটা এভাবে না বলে সুন্দরভাবে বলা উচিত ছিলো। লোকটা যদি রাগের মাথায় ওকেও রুমে আঁটকে দেয়? সুরাইয়াকে কেনো রুমে আটকে দিয়েছে এই প্রশ্ন করাটাও এখন জরুরী ছিলো। আর সবার সামনে প্রশ্ন করলে বিপাকে পরতে হতো। এসব চিন্তায় মশগুল হতেই মাহতিম তখন পা এগিয়ে মেহনূরের দিকে আসতে থাকলো। মেহনূর ফ্লোরের দিকে মাহতিমের লম্বা ছায়াটা দেখে ভয়ে চুপসে যেতে লাগলো।

বুকে আবারও সেই ধুকপুকনিটা হচ্ছে, ঠোঁটদুটো সরু ফাঁক করে একটার-পর-একটা লম্বা নিশ্বাস ছাড়ছে। কি হবে এখন? রেগে গেলো? সত্যি রেগে গেলো? নিশ্বাসের গতি আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে ওর। ছায়াটা কাছে আসতে-আসতে একেবারে ওর শরীরের উপর পরলো। যেই ভয়টা এতোক্ষন ছিলোনা, সেই ভয়ের জন্যই এখন আচমকা পিছাতে লাগলো মেহনূর। কিন্তু পেছনের অবস্থা না দেখে, না বুঝে পিছাতে থাকলে তৎক্ষণাৎ ধড়াস করে দরজায় ধাক্কা খেলো। ওইমুমূহর্তেই দরজাটা ভুলবশত চাপিয়ে ফেললো ও। ওর মন বলছে এই মুহূর্তে খুবই বোকার মতো কাজ করেছে, যার দরুন এখন সমস্ত শরীর একদম মাথা-থেকে-পা পযর্ন্ত মৃদ্যু ভঙ্গিতে কাঁপছে। সেই কম্পমান মাথাটা কোনোমতে পিছনে ঘুরিয়ে দরজাটার দিকে তাকালো। দরজা সম্পূর্ণ পুরোপুরি লেগে গেছে এখন। একটুও ফাঁকি দেবার উপায় নেই যেনো। মাহতিম আরো দুপা এগিয়ে ওর সামনে এসে বললো,
– আমার রুমের আসার আগে চিন্তা করা উচিত ছিলো। আমিতো চরম লেভেলের অসভ্য, এখন তুমি দরজাও বন্ধ করে দিয়েছো। এইমূহুর্তে যদি নন-অকারেন্স কাহিনী করি তাহলে তোমার কি অবস্থা হবে বুঝতে পারছো?
বড় করে ঢোক গিলে মেহনূর ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকালো। ভেতরে-ভেতরে কুকড়ে গেলেও সুরাইয়ার কথা চিন্তা করে সাহস জুগিয়ে বললো,
– আপনি বুবুকে রুমে আটকে দিয়েছেন কেনো?
মাহতিম ওর কথা শুনে ঠোঁটের কোণে হাসি টানলো। সেই হাসির আভাসে বাঁ ভ্রুঁটা উঁচু করে তাচ্ছিল্যের সুরে বললো,
– আচ্ছা তোমার বুবুকে আমি আঁটকাতে যাবো কেন?
মেহনূরের প্রচুর রাগ লাগছিলো কাটা শুনে। তবুও সেই রাগের চেয়ে এখন ভয়ের মাত্রাটাই বেশি। মাহতিমের দিকে তাকিয়ে থাকতেই ওর হাসি-হাসি চোখদুটো থেকে চট করে দৃষ্টি নামিয়ে ফেললো মেহনূর। মাহতিম ব্যাপারটা দেখে প্রচণ্ড মজা পেলেও মুখে হাসির আভাস ফুটালো না। মেহনূর হাতদুটো পেছনে নিয়ে দরজা খোলার জন্য চেষ্টা করছে কিন্তু নব্ অনেকটা উপরে থাকাতে হাত সেখানে পৌঁছাচ্ছে না। বাইরে আরেকবার বাজ পড়লে তৎক্ষণাৎ বিকট শব্দ হলো, সেই শব্দের জন্যে চমকে উঠতেই মেহনূরের ভেতরে অবস্থা টালমাটাল হচ্ছিলো। মাহতিম প্রসন্ন মেজাজে শান্ত-নয়নে মেহনূরের মুখটার দিকে তাকিয়ে আছে।

মনের বিরুদ্ধেই ওর দিকে আরো এগিয়ে গিয়ে কয়েক ইন্ঞ্চির দূরত্ব রেখে দাঁড়ালো সে। এই অবস্থা দেখে মেহনূরের হৃৎযন্ত্রটা ছিঁড়ে আসতে চাইছে, চোখের সামনে পেশিবহুল বুকটার দৃশ্য খুব নিকটে চলে এসেছে। বাধ্য হয়ে চোখদুটো কুঁচকে আরো ব্যগ্ররূপে কাঁপতে লাগলো মেহনূর। ওর ভয়ার্ত অবস্থার আতঙ্কিত ভাব দেখে মাহতিমেরও রাগ হলো। এখানে যখন আসার সাহস হয়েছে তখন ভয় পাওয়া হচ্ছে কেনো? বিনা অনুমতিতে রুমে ঢুকেছে কোন্ সাহসে? কেনো ওকে দেখে ভয়ে পেয়ে খালি পালাতে ইচ্ছে করে? সব প্রশ্নের গুটি পাকিয়ে মাহতিম তরুণের বিবৃতিগুলো মানসপটে চিন্তা করতে থাকলো। সেদিন তরুণ যেভাবে যেই-যেই জায়গায় বেহায়ার মতো স্পর্শ করেছিলো, মাহতিমও সুক্ষ্ম রাগ, অল্প গূঢ়তা নিয়ে ওর দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। কাধের দিকটায় স্পর্শ করার উদ্দেশ্যে ধপ করে দরজার উপর হাত রাখলো। মেহনূর আরেকদফায় শিউরে উঠে মাথাটা সেদিকে ঘুরিয়ে দরজার উপর মাহতিমের হাত দেখলো। ঘন করে ঢোক গিলে মাহতিমের দিকে আতঙ্ক দৃষ্টিতে তাকালোম। মাহতিম ওর অবস্থা দেখে শান্ত মেজাজে বললো,

– তোমার বোন নিজের কটেজে না ঢুকে আমার কটেজের দিকে এসেছিলো।
প্রথম বাক্য শেষ করতেই চট করে মেহনূরের কাধে হাত ফেলে দিলো মাহতিম। মেহনূর মাথা নিচু করে চোখদুটো খিচ মেরে উঠলো তখন। মাহতিম বর্তমানে ওকে বোকা বানানোর যে খেলাটা খেলছে, সেটা অবশ্য ওর অভিনয় দেখে কেউ ধরতে পারবেনা। মাহতিম এবার এটিটিউট দেখিয়ে গমগম সুরে বলতে লাগলো,
– ওকে আমার রুমে একা দেখে মারাত্মক শান্তি লেগেছে বুঝছো।

কথাটা শেষ করতেই মেহনূর চমকিত ভঙ্গিতে চোখ খুলে তাকালো। মাহতিম ওর বিষ্ময় ভরা সরল মুখটার দিকে তাকিয়ে কাধ থেকে হাতটা উঠালো মাহতিম। সেটা ওর খোলা চুলের উপর রেখে শান্ত ভঙ্গিতে বুলাতে লাগলো। মেহনূর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মাহতিমের দিকে, বিষ্ময়ের ভাব এখনো ওর কাটেনি। সুরাইয়াকে একা পেয়ে কিছু করেছে কিনা সেই তুচ্ছ চিন্তা মাথায় আনতেও কষ্ট হচ্ছে ওর । মেহনূরের ওমন স্থির চাহনি দেখে মাহতিম ওর থুতনিটা আরেকটু উপরে তুলে দিলো। ওর দিকে নিজের মুখটা একটু নামিয়ে নিচু স্বরে বললো,
– শাড়িতে ওকে বলিউডের শিল্পা শেঠির মতো লেগেছে।

উদাহরণের অবস্থা দেখে বুকটা সজোড়ে ধ্বক করে উঠলো মেহনূরের। এই লোকটার চেহারা দেখে তো কখনো চরিত্র আন্দাজ সম্ভব না। তরুণের মতো আচরণ এই লোকটার কাছ থেকে কোনোভাবেই আশা করা যায় না। মেহনূরের গালের কাছে অনেকগুলো চুল এসে ঝাপটা খাচ্ছে তখন, সেটা দেখে মাহতিম নিজের ডানহাতটা আবার উপরে তুললো। তর্জনী আঙ্গুলটা কপাল ছুঁইয়ে-ছুঁইয়ে গালের কাছে নামাতেই চুলগুলো কানের দিকে সরাতে থাকলো। মেহনূর প্রতিক্রিয়াহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই চোখদুটো আপনাআপনি চোখ বন্ধ করে নিলো। মাহতিমের একহাত এখনো ওর পিঠের চুলগুলোকে বুলিয়ে যাচ্ছে, অন্যহাতে কানের পেছনে চুল গুঁজে দিচ্ছে। মেহনূর তখন অদ্ভুত ঘ্রাণের মায়ায় ডুবে গিয়ে ঘোর আবেশে আবদ্ধ ছিলো। মাহতিমের শরীর থেকে আসা প্রাণবন্ত ঘ্রাণশক্তি সমস্ত ইন্দ্রিয় দখল করে নিচ্ছিলো। গভীর করে নিশ্বাস নিচ্ছিলো মেহনূর, সেই নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের গভীরতায় ছোট্ট বুকটা ফুলে-ফুলে উঠছিলো ওর। মাহতিম গাঢ় গলায় ঠান্ডা সুরে বললো,

– ওমন ভয়াবহ মেয়েকে একাকী রুমে দেখে অন্য বুদ্ধি চাপে। সেই অন্য বুদ্ধির জন্যই সেদিনের ঘটনা আবার রিপিট করতে চাইলাম। ইতিহাস বারবার পুনরাবৃত্তি হয়, আমিও পুনরাবৃত্তি করে কারোর বীভৎস দিনটা আবার দেখতে চাইলাম।

কথাটুকু চলতে-চলতেই ওর পিঠের চুলগুলো সন্তপর্ণে সরিয়ে ফেললো মাহতিম। আবারও সেই তরুণের ঘটনার মতো ওর পিঠের উপর পাঁচ আঙ্গুল রাখলো সে। বাইরে বাতাসের প্রবলধ্বনি পৈশাচিক ভাবে শোনা যাচ্ছে। মেঘের গর্জন বৃদ্ধি পেয়ে বজ্রকন্ঠের সুর ধরেছে এখন। প্রকৃতির সেই নিবিড় খেলায় মেহনূর আবারও বিশ্রী দিনটার কথা দুচোখের পাতায় কল্পনা করতে লাগলো। তরুণের একপেশে জঘন্য হাসি, লাইটার নিয়ে অন-অফ করা, জবরদস্তি করে পিঠের কাছে ব্লাউজের হুক খোলার চেষ্টা, নানা জায়গায় বিশ্রীভাবে চোখ বুলিয়ে দেখা, সব একে-একে ওর বদ্ধ চোখের অন্ধকার পটে জলজ্যান্ত ভাবে ভেসে উঠলো। মাহতিম আজও সেই পিঠের উপর একইভাবে হাত রাখলো, কিন্তু সেই হাত রাখলো পরম আবেশে আলতো ছোঁয়ায়। প্রশস্ত বিশাল পেশিময় বুকটার মধ্যে উষ্ণতা দিয়ে আঁকড়ে ধরার জন্য শুধু একটুখানি দূরত্ব ছিলো। কিন্তু সেই দূরত্বের মাঝে বিশাল বড় বেড়িবাধ ছিলো, যেটার নাম হলো ‘ অধিকার ‘। আজ মাহতিমের কাছে সেই অধিকার নেই, কোনো বাধ অতিক্রমের জোর নেই। মাহতিম নিজেকে চূড়ান্ত সীমায় নিয়ন্ত্রণ রেখে আবারও মেহনূরের বদ্ধ চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,

– ওই অন্ধকার গোয়ালঘরটায় কেউ বাজে স্পর্শ পেয়ে হাউমাউ করে কেদেঁছিলো। ছাড় পাওয়ার জন্য চেষ্টা করেছিলো প্রচুর। ছুটাছুটি করাও বাদ দেয়নি একদম। কিন্তু আফসোস, কেউ যে তাকে উদ্ধার করতে আসেনি। শেষমূহুর্তে যদি ছাড় পাওয়ার উছিলা না পেতো, তাহলে সে কি এখনো সুস্থ থাকতো?
মাহতিম কথাটা শেষ করতেই মৃদ্যু আভায় অবজ্ঞাপূর্ণে হেসে দিলো। নিয়তির খেলায় অঘটন ঘটতে কতমিনিট লাগতো? কিন্তু দুঃখটার কথা চিন্তা করে ছোট্ট মানুষটার বদ্ধ চোখদুটো থেকে হঠাৎ গাল ছাপিয়ে পানি পরতে লাগলো। বাইরের বড়ো-বড়ো বৃষ্টিফোঁটার মতোই তার অশ্রুফোঁটাগুলো একে-একে ঝরে পরছিলো। মাহতিম ওর দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখে গাঢ় করে নিশ্বাস টেনে নিলো। পিঠ থেকে হাত সরিয়ে ওর ছোট্ট কোমল মুখটা দুহাতের তালুতে নিজের মুখের দিকে উঁচু করে ধরলো। নিচু কন্ঠে আবার বলে উঠলো,
– মেহনূর আফরিন, তোমার কান্না দেখার জন্য যে ব্যক্তি বাইরে দাড়িয়ে সেদিন কুকর্ম করেছিলো, আজ তাকে ভেতরে ঢুকিয়ে কান্নার একছত্র মূল্য বুঝিয়ে দিয়েছি।

দুহাতের তালুতে আবদ্ধ মেহনূরের মুখটা চাপা কান্নার জন্য লাল হয়ে উঠলো। নিঃশব্দে ফুপিয়ে-ফুপিয়ে মাহতিমের দুতালুর মাঝেই অনেকক্ষন কাঁদলো ছোট্ট মানুষটা। অশ্রুমাখা মুখটা দেখে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলো মাহতিম। চোখদুটোর উপর ঠোঁট বসিয়ে সকল কষ্ট দূর করার জন্য ব্যকুল হৃদয়টা খানখান করছিলো যেনো। আজ ওই মুখটা চুপচাপ দেখা ছাড়া আর কোনো অধিকার নেই, একদম নেই। নূন্যতম অধিকারও নেই। মেহনূর কিছুটা শান্ত হলে ফুপানো ভঙ্গিতে চোখের পাতা খুলে ফেললো।

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ১৭+১৮

লাল হয়ে আসা অশ্রুপূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে মাহতিমের দিকে চোখ রাখলো। ওই নাশ-ঘাতক দৃষ্টির দিকে তাকানো সম্ভব না, ওই চওড়া ফোলা বুকের কাছে দাড়ানো সম্ভব না, আর শান্ত ভঙ্গিতৃ দাড়ালেই কিছু-একটা ঘটার প্রবণতা প্রবল। মেহনূর দ্রুত নিজের কান্না থামিয়ে দুগাল থেকে মাহতিমের হাত সরিয়ে দিলো। মাহতিমের দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে দরজাটার নব পেয়ে সেটা দ্রুত মোচড়ে বাইরে চলে গেলো। মাহতিম অপলক চাহনিতে রাতের বাদলধারায় মেহনূরের বৃষ্টিতে ভিজে-ভিজে যাওয়াটা দেখতে লাগলো। আজ আবারও সেই ছোট্ট বালিকা অগ্রাহ্য করে পালিয়ে ছুটলো। খুব কাছে এসে হাতছানি দহন ঘটিয়ে আবার শান্তভাবে পালিয়ে যাচ্ছে।

মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ২১+২২

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here