মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ২১+২২
ফাবিয়াহ্ মমো
গতরাতে মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ার জন্য রেসোর্টের এলাকাটা কর্দমাক্ত অবস্থা হয়ে গেছে। কিছু কিছু জায়গায় পানি জমে গর্তমতো হয়ে আছে। গাছের নিচগুলা স্যাতস্যাতে হয়ে পিচ্ছিল হয়ে গেছে। সকালের সোনালি আলোয় সবকিছু প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। ফুলের উপর শিশির জমা পানিগুলো সূর্যের আলো পেয়ে ঝলমল করছে। মেহনূর খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে হাতমুখ ধুয়ে নেয়। শাড়ি বাঁচিয়ে খুব সাবধানে রুমে ফিরে আসে। এলোমেলো চুলগুলো না আঁচড়ে শান্তমনে কটেজ থেকে বেরিয়ে আসে। কটেজ থেকে একটু দূরে ঠিক ডানদিকটায় বসার মতো আরেকটা কটেজ আছে। তবে কটেজ না বলে আড্ডাখানা বললে চলে।
সিনেমায় যেমন দেখায় বিলাসী মানুষগুলো সকাল-বিকাল শান্ত সময়টায় চায়ের পসরা নিয়ে আড্ডা দেয়, ঠিক তেমনি একটা আড্ডার জায়গা সেখানে সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। বড় বড় দুটো গোল-টেবিল দিয়ে আড্ডাখানার অর্ধেকটা সাজানো হয়েছে, বাকি অর্ধেকটা বাগানের সিন-সিনারি দেখার জন্য ডিভানের মতো সিস্টেম করেছে। মেহনূর হাঁটতে-হাঁটতে সেই কটেজটার দিকে চলে গেলো। দুটো নিচু সিড়ি অতিক্রম করে ভেতরে পা রাখলো। আড্ডাখানার কটেজটা একদম খোলামেলা, চর্তুদিকেই দেয়াল ছাড়া। কিন্তু একটার-পর-একটা বিশাল বড় খাম্বা একটু দূরত্ব রেখে রেখে করা হয়েছে। মেহনূর হাতে করে যেই বইটা এনেছিলো সেটা এমন সুন্দর জায়গায় পড়ার জন্য উত্তম। সোজা ডিভানের সাইডটায় চলে গিয়ে সেখানে বই খুলে বসলো।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সামনে তাকাতেই বেশ চমৎকার একটা বাগান, সেখানে রঙ-বেরঙের ফুল ফুটে আছে, ফুলগুলোর মিষ্টি পবিত্র সুভাষে চারপাশটা মৌ মৌ করছে। মেহনূর ডিভানে পিঠ হেলিয়ে পাদুটো বাঁদিকে একত্র রেখে বইয়ের দিকে মন দিলো। কখন যে বইয়ের শব্দমালায় ডুবে গেলো সেই সুক্ষ হুঁশও ওর হলো না। সবাই একে-একে ঘুম থেকে উঠে নিজেদের হাতমুখ ধোয়ার কাজ সেরে ফেললো। সকালের নাস্তার জন্য অপেক্ষা করতেই ম্যানেজার জানালো দূরের কটেজটায় খাবার এসে যাবে। সবাই সেদিকটায় যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে দেখে ডিভানের দিকটায় একাকীভাবে মেহনূর বসে আছে। তৌফ মেহনূরের অবস্থা দেখে সবার দিকে ইশারা করে দিলো, সবাই ওর ইশারা দেখে মেহনূরের উপস্থিতি পেয়ে চুপচাপ গোলটেবিলে চলে গেলো।
শানাজ নিজের রুমে চুলসজ্জা করছে, সাবা নিজের শাড়ি ঠিকঠাক করে মুখে হালকা প্রসাধন লাগাচ্ছে। অন্যদিকে সুরাইয়া গো-মর মুখে দুপুরের জন্য শাড়ি সিলেক্ট করছে। মাহতিম সদ্য ব্যায়াম শেষে জগিং করতে-করতে রেসোর্টের গেটটা দিয়ে ঢুকলো। পড়নে কালো রঙের এক্সার্সাইজ ট্রাউজার, গায়ে ‘GUCCI’ ব্র্যান্ডের মেরুন টিশার্ট, পায়ে কালো কালার স্নিকার পরা ওর, যার সোলটা মূলত সাদা এবং জুতার ফিতাগুলো ডোরাকাটা ছিলো। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে রোদের কিরণে চিকচিক করছে, চুলগুলো ঘামে ভিজে কপালের সাথেই লেপ্টে আছে, পাতলা সুন্দর ঠোঁটদুটো জগিংয়ের জন্য হালকা নিঃশ্বাস ছাড়ছে। গেটের কাছ থেকে কটেজের জন্য বামদিকে পা চালাবে ওমনেই দূরের সেই কটেজটার দিকে চোখ পরে। মাহতিম কিছু খেয়াল করলেও সেদিকে ঠিক করে তাকায় না, সোজা নিজের কটেজের দিকে চলে যায়। নাস্তার জন্য সবকিছু রেডি হয়ে গেলে মাহদির তাড়নায় সেই কটেজটার টেবিলে এসে পরে।
সিয়ামের বাঁপাশে খালি চেয়ার পেয়ে চেয়ারটায় তখন টেনে বসে। পুরো টেবিল জুড়ে নানাপদের ভর্তা সাজানো, একপাশে সালাদের বোল রাখা, খিচুড়ির বিশাল হাড়িটা তখন দুটো ওয়েটার মিলে ধরে আছে। আরেকজন ওয়েটার সবার কাছে গিয়ে প্লেটে-প্লেটে খিচুড়ি বেড়ে দিচ্ছে। গোল-টেবিলের বাঁপাশে ছেলেরা বসেছে, ডানপাশটা নিয়ে মেয়েরা বসেছে। শানাজ এসে চেয়ার টেনে বসতেই মেহনূরের জন্য ডাক পাঠিয়ে টেবিলে আসতে বলে। মেহনূর বইটা বন্ধ করে ওদের টেবিলের দিকে চলে আসে। সবাই যখন খাবারের বিভিন্ন পসরা নিয়ে মেতেছে উঠবে, তখন মেহনূর নীতির পাশে চেয়ার খালি পেয়ে সেটা টেনে চুপচাপ বসে। প্লেটের উপর খিচুড়ির পরিমাণ দেখে মেহনূর ইতস্তত করতে থাকে। ধোয়া উঠা খিচুড়ির উপর আঙ্গুল দিয়ে নাড়তে থাকলে নীতি বিষয়টা লক্ষ করে বলে,
– মেহনূর কোনো সমস্যা? তুমি খাচ্ছো না যে? খিচুড়ি কি বেশি গরম?
নীতির প্রশ্ন শুনে এতোক্ষন পর শানাজ মেহনূরের প্লেটের দিকে নজর দিলো। ওর প্লেটের দিকে তাকাতেই শানাজ নীতির উদ্দেশ্যে হাসি দিয়ে বললো,
– ও তো এতো খিচুড়ি খেতে পারবেনা। ওর প্লেট থেকে কিছু কমাও।
শানাজের হাসিসুলভ কথায় সবাই হাসি না দিয়ে উলটো চোখ বড় করে বিষ্ময়াভূত হলো। মাহতিম একবারের জন্যও মেহনূরের দিকে না তাকালেও, এবার ঠিকই ওর দিকে দৃষ্টি রেখে দেখলো। প্লেটে যেটুকু খিচুড়ি দেওয়া হয়েছে সেটা একদম মাহদির প্লেটের সম-পরিমাণ। যেখানে মাহদি একদম গোগ্রাসে ভর্তা মাখিয়ে খাওয়া শুরু করেছে, সেখানে নাকি মেহনূরের উলটো খিচুড়ি কমাতে হবে। নীতির সাহায্য নিয়ে শানাজ মেহনূরের প্লেটটা থেকে আধা পরিমাণ কমিয়ে ফেললো। বাকি আধা পরিমাণ দিয়ে মেহনূর ধীরেসুস্থে খাওয়া শুরু করলো। মাহতিম ওর সম্পূর্ণ অবস্থা দেখে নিজের খাওয়াটা ঠিকমতো করতে পারছিলোনা। এদিকে কানের কাছে চোরের মতো সিয়াম বলে উঠলো,
– মামা, তোমার মুরগীর তো হেব্বি ফিড দিতে হইবো। তাড়াতাড়ি একটু বুকে টানো। এইভাবে চললে তো তোমারে সামলাইতে পারবো না।
মাহতিম প্লেটের দিকে তাকিয়ে খিচুড়ি মাখানো অবস্থায় ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছাড়লো। এরপর সিয়ামের উদ্দেশ্যে নিচু গলায় শক্ত কন্ঠে বললো,
– খিচুড়ি খাচ্ছিস, সেটার দিকে নজর দে। আশেপাশে কি হচ্ছে সেটার জরিপ এনে আমার কানে ঠুকে দিবিনা।
সিয়াম এই কথা শুনে মুখভর্তি খিচুড়ির লোকমা নিয়ে ফিসফিস নাক দিয়ে শব্দ করে হাসতে লাগলো। সিয়ামের নাকে টাইপ হাসি দেখে চোয়াল নাড়াতে-নাড়াতে ফারিন বলে উঠলো,
– তুমি নাক দিয়ে ভটভটি গাড়ির মতো শব্দ করছো কেন?
ফারিনের ইজ্জত মার্কা কথা শুনে সিয়াম সাথে-সাথে মুখটা কুঁচকে নিলো। তাড়াতাড়ি মুখের খিচুড়ি গিলে ফারিনের জন্য কিছু বলবে, তার আগেই সৌভিক গলা নামিয়ে মাহতিমের জন্য সবার অগোচরে বললো,
– মেহনূরের খাওয়ার অবস্থা দেখ বন্ধু! ও তো কিছুই খায় না। ওর চেয়ে আমাদের মাহদি আলহামদুলিল্লাহ ভালোই খায়। ওর দিকে খেয়াল রাখ মাহতিম। মেয়ে মানুষের এতো কম খাওয়া ঠিক না।
ব্যাপারটা নিয়ে মাহতিম নিজের মনে চিন্তা করছিলো, হঠাৎই সৌভিকের কথায় ভ্রু কুঁচকে কাটকাট সুরে প্রশ্ন করলো,
– আমি খেয়াল রাখবো মানে? ও আমার কে হয় যে খেয়াল রাখতে যাবো?
মাহতিমের ভ্রুঁ কুঁচকানো অবস্থা দেখে সৌভিক একপেশে হাসি দিলো। কোনো উত্তর না দিয়ে খাবারের জন্য তীব্র মনোযোগ দিলে মাহতিম আর কিছুই বললো না। সবাই নিজেদের খাওয়া শেষ করে আজকে কি কি ফূর্তি করা যাবে সেটা নিয়ে শলা-পরামর্শ শুরু করলো। মেহনূর একা-একা আবারও ডিভানে বসে উপন্যাসের বই খুললো। খাওয়ার সময় চুলগুলো খোপা করেছিলো, সে চুলগুলো মেলে দিয়ে পাদুটো আগের মতো উঠিয়ে নিলো। এদিকে কটেজের বাইরে চেয়ার টেনে ছেলেমেয়ে সবাই মিলে বহু বিষয়ে আলোচনা করছে, কালকের ক্লান্তিটা এখধো রয়ে গেছে বিধায় আজও সবাই রেস্ট নিচ্ছে। তবে সবাই মিলে মুভি দেখে আজকের দিনটা রেসোর্টে কাটিয়ে কাল দুপুরে নদীতে নেমে গোসল করবে। বিকেলের দিকে নদীতীরে বসে ছোটখাটো খাবারের আয়োজন করা হবে।
নদীতে গোসলের ব্যাপারে সবাই হৈচৈ সমাগম করে প্রফুল্ল হলেও শানাজ প্রথম দফায় দ্বিমত পোষণ করলো। কিন্তু সকলের চাপাচাপি এবং সাবার জুড়াজুড়িতে বহু বছর পর নদীতে নামার জন্য রাজি হলো। মাহতিম সবার কথায় চুপ করে শুনে যাচ্ছে। নিজ থেকে কোনো বাড়তি কথা এখন পযর্ন্ত বলেনি। হাতে কোকাকোলার ক্যান নিয়ে সবার ব্যস্ত আলোচনার মধ্য থেকে চোখদুটো মেহনূরের দিকে রাখলো। সেদিকে দৃষ্টি রেখে ডানহাতের লাল ক্যানটা ঠোঁটের কাছে ছোঁয়ালো। ছোট্ট এক চুমুক দিয়ে ডিভানে বসা মেহনূরের দিকে তাকিয়ে রইলো। কালরাতে এই মেয়েটা কেমন করে রুমে এসে পরলো, সেটাই এখন চিন্তা করছে মাহতিম। শুধুমাত্র চাচাতো বোনের জন্য চিন্তা করে ওর রুমে কথা শোনাতে এসেছিলো, এটা ভাবলেই ওর ভীষণ হাসি পায়। সেই হাসির জন্যই ঠোঁটের কোণে হাসি ঠেলে আবারও ক্যানে চুমুক দিলো মাহতিম। কিন্তু হুট করে কোত্থেকে মাহদির এসে দাড়ালো, সে এসেই মাহতিমের হাত থেকে ক্যান কেড়ে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে বললো,
– তোমার ফোন কোথায় ভাইয়া? ফোন দাও। তুমি ইচ্ছে করে ফোন লুকিয়ে রেখেছো। আমি তোমার বালিশের নিচে ফোন পাইনি।
মাহতিম ওর আচরণ দেখে প্রথমেই খুব বিরক্ত হয়ে গেলো। হুট করে মুখের ক্যানটা কেড়ে আবার বড় গলায় মোবাইলের জন্য চাচ্ছে! মাহতিম একদফা তুড়ি বাজিয়ে শক্ত গলায় তর্জনী তাগ করে বললো,
– ক্যান ফেরত দে! আর তুই কিসের মোবাইল চাচ্ছিস? ফোনের ব্যালেন্স দুদিনের মধ্যে কত গিলেছিস ধ্যান আছে? তোর কি বয়স হয়েছে মোবাইল ধরার? একটা চ-ড় মেরে দাঁত ফেলে দিবো ফাজিল!
মাহদি ‘ ডোন্ট কেয়ার ‘ ভাব দেখিয়ে ধীরগতিতে পা পিছিয়ে কটেজের দিকে যেতে লাগলো। মাহতিম বারবার বললো ক্যান ফেরত দিয়ে যেতে, কিন্তু মাহদি সেটা দিলো না। মাহতিমের কথাও একদম শুনলো না। মাহদি সোজা পা ঘুরিয়ে কটেজে ঢুকে মেহনূরের দিকে ছুটে গেলো। মেহনূরের পাশে ধপ করে বসলে মেহনূর চমকে গিয়ে বই বন্ধ করে দিলো। মাহদির দিকে আশ্চর্য দৃষ্টিতে তাকাতেই ফিক করে হেষে দিয়ে ওর টুকটুকে গালদুটো ধরে বললো,
– আজকে তোমার কি কি করার প্ল্যান আছে বলোতো। কিভাবে আজকের দিনটা কাটানোর ইচ্ছা আছে?
মাহদি বেশ ভাব দেখিয়ে ডানহাত দিয়ে চুলের ব্যাকব্রাশ করলো। একদম মাহতিমের মতো স্টাইলটা কপি করে ঢঙ দেখিয়ে বললো,
– ওহে সুন্দরী, চলো আমরা পুকুরপাড়ে গিয়ে বসি। আজ যে সবাই মিলে নদীতে গোসল করবো জানো? জানোনা। চলো চলো আমার হাতটা ধরো, তোমাকে নিয়ে সুন্দর রাজ্যটা ঘুরে-ঘুরে দেখে আসি।
মাহদির এমন ঢকের কথা শুনে মেহনূর খিলখিল করে হেসে দিলো। ঠোঁট চওড়া করে সাদা উজ্জ্বল দাঁতগুলো উকি দিয়ে ওর হাসির জৌলুস যেনো বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। মাহতিম এতোক্ষন আলোচনার দিকে মন দিলেও হঠাৎ বাঁ-কান দিয়ে সুরেলা হাসির শব্দ শুনে খানিকটা চমকে গিয়ে তাকালো। যে দৃশ্যটা চোখের সামনে সে দেখতে পেলো, একটুও প্রস্তুত ছিলোনা সেটা দেখার জন্য। মাহতিম অপলক দৃষ্টিতে মেহনূরের হাসির দিকে তাকিয়ে রইলো, ড্যাবড্যাবে তাকিয়ে রইলো। এদিকে বুকের যন্ত্রটা ওর হাসির শব্দ শুনে ধুপধুপ ধুপধুপ করছিলো।
মেহনূর ছোট্ট মাহদির গালদুটো ধরে ওর কপালে ঠোঁট ছুঁয়িয়ে দিলো, চুলগুলোতে নরম-চিকন আঙ্গুল দিয়ে এলোমেলো করে হাসি দিয়েই থাকলো। কিন্তু মাহদির সঙ্গে আর পুকুরঘাঁট দেখতে গেলোনা, মাহদি এ নিয়ে মন একটু খারাপ করলেও পরক্ষণে উদাস অবস্থা কাটিয়ে ফেললো। মেহনূরের পাশে সেই লাল ক্যানটা ওভাবেই রেখে মনের ভুলে চলে গেলো। মাহতিম দূর থেকে সব দেখলেও হঠাৎ সাবার ডাকে সাড়া দিতেই মুখ ঘুরিয়ে ফেললো। এদিকে মেহনূর গলা ভেজানোর ইচ্ছায় যখন বই বন্ধ করে এদিক-ওদিক তাকাতে লাগলো, তখনই তার পাশে একটা লাল ক্যান দেখতে পেলো। মাহদি যে ভুলবশত ক্যান রেখে গেছে সেটা ভালোভাবে বুঝতে পারলো।
মাহতিম সাবার কথাটা মন দিয়ে শুনে নিজের অভিমত প্রকাশ করে আবারও মেহনূরের দিকে তাকানোর জন্য দৃষ্টি রাখলো। কিন্তু চোখের কোটর স্থির হয়ে অবাকের চূড়ান্ত পর্যায়ে ধাপে-ধাপে পৌঁছাতে লাগলো যেনো! অজান্তেই ঠোঁট ফাঁক করতে-করতে চোয়াল ঝুলিয়ে তাকিয়ে রইলো। ক্যানের যেই জায়গাটায় মাহতিম ঠোঁট লাগিয়ে চুমুক দিয়েছিলো, সেই জায়গায় ঠোঁট বসিয়ে একটু-একটু করে কোক খাচ্ছে মেহনূর। ডানহাতে ক্যানটা পাঁচ আঙ্গুলে ধরে বামহাতে বইটা নিয়ে নিবিড়ভাবে পড়ছিলো। মেহনূরের অজ্ঞাতসারে দূরের একটা চেয়ারে বসা মাহতিম অদ্ভুত প্রাপ্তিতে হাসছিলো, সেই মনোরম প্রাপ্তিমূলক হাসিটা দেখলে মেহনূর লজ্জায় লাল টুম্পা হয়ে যেতো।
দুপুরের সেই কাঙ্ক্ষিত মূহুর্ত, কাঙ্ক্ষিত সময়টা চলে এলো। সবাই নিজেদের পোশাক-আশাক বিছানায় রেডি রেখে মাঠে জড়ো হলো। শানাজ এবার জোর-জবরদস্তি করে সুরাইয়াকে ডেকে আনলো। সুরাইয়া এসেই দেমাক দেখিয়ে বললো,
– আমি তোমাদের সাথে ফান করতে আসিনি। আমাকে দুটো ছবি তুলে দিবে তাতেই হবে। আমি একা-একাই নদীতে গোসল করতে পারবো।
ওর কথার ধরনটা কেউ পছন্দ না করলেও কেউ সেটা মুখের আভাসে একটুও প্রকাশ করলো না। সবাই হাসিমুখে নদীতে গোসল করার আনন্দ উদযাপন করতে সেদিকে দলবেঁধে ছুটলো। তৌফরা একদৌড় মেরে আগেই নদীতীরে চলে গেলো। তারপর চললো শানাজদের দল, শানাজদের পেছনে নীতিদের দল এবং সবশেষে ঢিলামির মতো পেছনে পরে গেলো মেহনূর। মেঠোপথটা ঘাস দ্বারা আবৃত, ডানে সারি-সারি বটগাছ সাজানো। বামপাশে একটা পুকুর শেষ হয়ে আরেকটা পুকুর শুরু হচ্ছে। সূয্যিমামা মাথার উপর দারুণ উত্তাপে ফেটে পরছে। সবাই দ্রুত পা চালিয়ে নদীতীরে চলে গেলেও মেহনূর চারপাশে প্রকৃতি দেখতে-দেখতে ধীরভাবে এগুতে লাগলো। গাছের পাতাগলো কালরাতের বৃষ্টির জন্য সতেজ লাগছে, রাস্তাগুলো মাটির সোঁদাগন্ধে আরো প্রাণচাঞ্চল্যে ঘ্রাণ ছড়াচ্ছে। এদিকে শার্ট পড়ুয়া লম্বাটে মানুষটা পেছন-পেছন হেঁটে আসছে সেদিকে খেয়াল নেই ওর।
মেহনূরের থেকে প্রায় সাত-আটহাত দূরে তখন মাহতিম হেঁটে আসছিলো। সাদা শাড়িটা দেহের সাথে মিলেমিশে আছে। সেই শাড়ির গোলাপী মোটা পাড়টা গোলাপের মতো চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। চুলগুলো সম্পূর্ণ বাঁদিকে টেনে সামনে এনে রেখেছে। গোলাপী ব্লাউজটা যেনো ফর্সাটে পিঠটা একদম আবৃত করে দিয়েছে। কোমরের দিকটাও জবুথবু করে ঢেকে রেখেছে। মাহতিম হাঁটতে-হাঁটতে পায়ের গতি একটু বাড়িয়ে মেহনূরের ডানপাশে চলে আসলো। মেহনূর হঠাৎ ডানদিকে কারোর উপস্থিতি পেয়ে তৎক্ষণাৎ চোখ তুলে মাহতিমকে দেখতে পেলো। কিন্তু মুখে কিছু না বলে আবার চোখ নামিয়ে মাটির দিকে দৃষ্টি ফেলে হাঁটতে লাগলো। মাহতিম কথা বলার ইচ্ছাটাকে চেপে না রেখে হালকা একটু কেশে নরম গলায় বললো,
– তোমরা কখন থেকে শাড়ি পরা ধরো? আমার মানে হলো, ঠিক কোন বয়সটা থেকে শাড়ির জন্য প্রেশার আসে?
মেহনূর প্রশ্নটা শুনে ঢোক গিলে নিলো, কিন্তু দৃষ্টি তুলে তাকালো না। নতমুখে ঠান্ডা সুরে শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
– বয়স দশ হলেই শাড়ি পরতে হয়। কিন্তু কেউ চাইলে আরো ছোট থেকে অভ্যাস করতে পারে।
মাহতিম এমন উত্তর শুনে মনের ভেতর খচখচ করা প্রশ্নট ছুড়ে দিলো,
– তুমি কবে থেকে অভ্যাস করেছো তাহলে?
মেহনূর এবার নির্দ্বিধায় ভঙ্গিতে উত্তর দেয়,
– নয়ের মাঝামাঝিতে।
উত্তর শুনে কালো প্যান্টের পকেটে দুহাত পুড়ে দিলো মাহতিম। শব্দ করে নিঃশ্বাস ছেড়ে আরো একটা প্রশ্ন করে বসলো,
– তোমাদের এখানে তাহলে মেয়েদের বিয়ের বয়স কতো? বাল্যবিবাহের প্রথা আছে নাকি?
মেহনূর প্রথম দুটো প্রশ্ন সহজভাবে দিলেও এই প্রশ্ন শুনে মনের ভেতর মারাত্মক একটা কামড় দিলো। একসঙ্গে থেমে-থেমে দুটো ঢোক গিলে হাতদুটো মুচলেকা করতেই বললো,
– আছে।
মাহতিম আবারও তার একপেশে ভঙ্গির তীক্ষ্ম হাসিটা দিলো। এরপর কিছুসময় চুপ থেকে মেহনূরের দিকে দৃষ্টি দিয়ে তাকালো। মেহনূর যে প্রচণ্ড উৎকন্ঠায় কাঁচুমাচু করচে সে ওর মুখ না দেখেও বলা দেওয়া যাচ্ছে। ওকে আরো বিপাকে ফেলতে মাহতিম ইচ্ছে করেই বললো,
– আমার মা তো ছোট বয়সী বউয়ের জন্য ডেসপারেট হয়ে গেছে। ভাবছে এখান থেকেই বউ বানিয়ে নিয়ে যাবে। কিন্তু বুঝছো মেহনূর আফরিন, আমার ছোট বয়সী বউ নিয়ে সংসার করার রুচি নেই। এজন্যই মা পিছিয়ে আছে। নাহলে মা সম্ভবত তোমার বড়জন সাবাকে তুলে নিয়ে যেতো।
মাহতিম কথাটা শেষ করতেই মেহনূরের দিকে তাকালো। কিন্তু মেহনূর সেই যে চোখ-নত করে রেখেছে, সেই চোখ ভুলেও উপরের দিকে উঠলো না। মাহতিম ওর মনের অবস্থা বুঝার জন্য একটুও চেষ্টা করলো না। কালকে যে তিনদিনের শেষদিনটা রাত পোহালেই এসে যাবে, তখন সবকিছু খোলাখুলি ওকে বুঝিয়ে বলবে। আর কালকেই হবে সমস্ত ঘটনার শেষদিন। এরপর হয়তো এখান থেকে প্রস্ফুটিত ফুলটি নিজের বক্ষস্থলে আগলে রেখে আদরে-আদরে সঙ্গে নিয়ে যাবে, নয়তো ক্লেশযুক্ত মনে ভীষণকঠোর হয়ে আজকের এই দিনগুলো হামেশার জন্য মুছে ফেলবে। মাহতিম আনসারী সবই পারবে, শুধু কারোর মনের অধিকার জোরপূর্বক নিজের করে বেধেঁ রাখতে পারবেনা। দুজন হাঁটতে-হাঁটতে নদীতীরে এসে সবার সাথে যুক্ত হলো। মেহনূর শানাজদের সাথে মিলিত হয়ে নদীর অবগাহনে বহু বছর পর গা ভিজালো। ছেলেরা সাঁতারের রেস লাগিয়ে বেশ দূরে চলে গেল।
মেয়েরা কোমর পযর্ন্ত পানিতে নেমে আনন্দ করতে লাগলো। কিন্তু মেহনূর নিজের চিন্তায় বিভোর হয়ে বারবার মুঠোভর্তি পানি তুলে সেই পানির দিকে তাকিয়ে রইলো। উদাস হয়ে যাওয়া মনটা আরো নিকষ কালো অন্ধকারের মতো ঘুটঘুটে ঠেকতে লাগলো। সবাই নদীতে গোসল সেরে রেসোর্টমুখী হলে মেহনূর কেনো জানি সবাইকে ফেলে আগে-আগে চলে গেলো। মাহদির বাঁদরামির জন্য মেহনূরের দিকে খেয়াল রাখতে না পারলেও রেসোর্টে পৌঁছে দেখলো মেহনূর ভেজা শরীরে আচঁলটা দিয়ে গা ঢেকে কটেজের সিড়িতে বসে আছে।
সাবা-শানাজ-সুরাইয়া ওকে ‘ কি হয়েছে ‘ প্রশ্ন করলে মেহনূর জানায় ‘ বাড়ির কথা মনে পরছে, তাই দ্রুত এখান থেকে চলে যেতে চায়। ‘ শানাজ ওর মাথায় হাত বুঝিয়ে দিলো, সাবা ওকে সুন্দর করে বুঝিয়ে বললো আর মাত্র কালকে দিনটাই আছে, তারপর সবাই এখান থেকে চলে যাচ্ছে। তিনবোন একসাথে ভেজা কাপড়ে কটেজে ঢুকলে সবাই নিজ-নিজ রুমে চলে যায়। শানাজরা কটেজে ঢুকে গেলেও মেহনূর পা থামিয়ে একপলকের জন্য পিছু ফিরে তাকালো। মাহতিমের আধ ভেজানো দরজার দিকে তাকিয়ে ছোট বন্ধ করে দৃষ্টি নামিয়ে রোমের দিকে চলে গেলো। কাল সবকিছুর শে-ষ-দি-ন।
রাতেরবেলা কেনো জানি কারেন্ট চলে গেলো। ম্যানেজারকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তারা মিনমিন করে উত্তর দিলো। কারেন্ট না থাকার জন্য পুরো রেসোর্টের পরিবেশ অন্ধকারে ছেয়ে আছে। চারপাশ যেনো মারাত্মক ঘুটঘুটে অবস্থা ধারণ করেছে। রুমের মধ্যে ভ্যাপসা গরমটা ভালোই জ্বালাতন করছে। এটা নিয়ে সবার মধ্যে বেশ উৎকন্ঠা দেখা যাচ্ছে। সন্ধ্যার পর থেকে ভীষণ গরম পরেছে আজ, এই ভ্যাপসা গরমের জন্য রুমের ভেতরটাও খুব অসহনীয় হয়ে উঠেছে। রেসোর্টের চারপাশে প্রচুর গাছগাছালি থাকলেও বাতাসের আনাগোনা তেমন দেখা যাচ্ছেনা। গাছের পাতাও যেনো অনেকক্ষন ধরে নড়ছেনা। রাত তখন আটটা বিশ বাজে। নীতি পুরোপুরি বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে মাঠে ঘুরঘুর করছে। আকাশে একটা গোলকার চাঁদ উঠেছে, সেই চাঁদের চন্দ্রপ্রভায় চারপাশটা উজ্জ্বল হয়ে আছে।
নীতি খোলা আকাশে সময় কাটানোর জন্য চুপচাপ নরম ঘাসে পা ছড়িয়ে বসলো। কালো কূর্তিটা হাঁটুর কাছে টানটান করে ঠিক করতেই ঢোলা হাতাটা কনুইয়ে কাছে তুলে ফেললো। নরম ঘাসগুলো চাঁদের আলোতে টসটসে দেখা যাচ্ছে। ঘাসগুলো যে কতটা সতেজ হয়ে আছে, সেটা ঘাসগুলোর দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। হঠাৎ শোঁ শোঁ করে মৃদ্যু হাওয়ার ঝাপটা বয়ে গেলো। নীতি সেই হাওয়ায় গা এলিয়ে পরম শান্তি অনুভব করলো। চোখদুটো বন্ধ করে ঠান্ডা হাওয়ার পরশ নিতেই হঠাৎ দুজোড়া পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলো। চোখ খুলে শব্দ উৎসের দিকে তাকাতেই কিছুট দূর থেকে শানাজ আর সাবাকে দেখতে পেলো। ওরা দুজন একসাথে কথা বলতে-বলতে নীতির দিকেই আসছিলো। নীতির পাশে দুজন বসতেই জম্পেশ একটা আড্ডা শুরু হলো।
হাসির আমেজ নিস্তেজ রেসোর্টের চারপাশে ছড়িয়ে গেলে সবাই তখন চুম্বকের মতো মাঠে জড়ো হতে লাগলো। মেহনূর নিজের রুমে শুয়ে-শুয়ে মোমবাতির আলোতে বই পড়ছিলো। আজকের উপন্যাসটা মারাত্মক সুন্দর, আর সবচেয়ে বেশি প্রিয়। শরৎচন্দ্রের ‘ চন্দ্রনাথ ‘ উপন্যাসটা মেহনূর কতবার পড়েছে জানা নেই। আজ আবারও যখন গরমের যন্ত্রণা ভুলার জন্য বইটা নিয়ে বসলো, সত্যি-সত্যিই চন্দ্রনাথের লেখনভঙ্গিতে মগ্ন হয়ে সবকিছু ভুলে গেলো। সুরাইয়া তখন বাইরে যাওয়ার জন্য পা বাড়িয়েছিলো, কিন্তু মেহনূরের রুম থেকে মোমবাতির আলো দেখে পা থামিয়ে দাঁড়ালো। ও যে রুমে শুয়ে ফের বই পড়ছে এটা কাটায়-কাটায় বুঝে গেলো। কটেজের সেই রুমবন্দি ঘটনার পর থেকে কোনো কারণ ছাড়াই মেহনূরের উপর জিদ চেপেছে সুরাইয়ার।
কেনো এই জিদ এসে ভর করেছে সেটা ও নিজেও জানেনা। সুরাইয়া চুপচাপ আধ-ভেজানো দরজা দিকে পায়ে-পায়ে এগুতে লাগলো, দরজাটা সড়াৎ করে খুলতেই বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে থাকা মেহনূরকে দেখতে পেলো। বুকের তলায় বালিশ রেখে ফর্সা গালে হাত চেপে একান্তমনে বইয়ে ডুবে আছে মেহনূর। রাশি রাশি কালো চুলগুলো বিছানার ঢাল পেরিয়ে মেঝেতে পরে আছে, পাদুটো অনবরত নাড়াচ্ছে বলে শাড়ি কিছুটা টাখনু থেকে উপরে উঠে গেছে। তাতে ওর ফসার্টে সুন্দর পাদুটো একটুখানি দেখা যাচ্ছে। হালকা বেগুণির শাড়িতে ওই অবস্থায় ওমন মেয়েকে দেখলে যেকারোর দৃষ্টি স্থির হয়ে যেতো। কোনো পুরুষ দেখলে তার মাথায় আগুন ধরতো নির্ঘাত!
এই মেয়ে যে ছোট থেকেই অপরূপ সুন্দরী, মায়ার সবটুকু ব্যাখ্যা নিয়ে জন্মেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। মাথার চুল থেকে শুরু করে পায়ের নখটা পযর্ন্ত নিখুঁতভাবে সুন্দর। সুরাইয়া এসব ভাবতে-ভাবতেই ঈর্ষান্বিত দৃষ্টিতে দরজার নবটা শক্ত করে মোচড়ালো। ওমনেই নব ঘুরানোর শব্দ শুনে মেহনূর তৎক্ষণাৎ দরজার দিকে তাকালো। মেহনূরের শান্ত-নির্মল চাহনি দেখে দাঁত শক্ত করে ভেতরে ঢুকলো সুরাইয়া, হনহন করে ওর কাছে আসতেই বিছানার পাশে এসে অটলভাবে দাঁড়ালো। মেহনূর মুখ তুলে সরল দৃষ্টিতে সুরাইয়ার দিকে তাকাতেই সুরাইয়া শক্ত গলায় টেবিলের দিকে হাত বাড়িয়ে বললো,
– তোর এক্সট্রা মোমটা নিয়ে গেলাম। আমার রুমে মোম ফুরিয়ে গেছে। দিয়াশলাইও পাচ্ছিনা। তা তুই কি পড়ছিস?
মেহনূর যেভাবে শুয়ে ছিলো, সে অবস্থায় থেকে স্বাভাবিক গলায় বললো,
– চন্দ্রনাথ।
মেহনূরের উত্তর শুনে সুরাইয়া একপলকের জন্য ওর দিকে তাকালো। এরপর দৃষ্টি সরিয়ে এক্সট্রা মোমটা নিয়ে জলন্ত মোমটা থেকে সেটা জ্বালিয়ে নিলো। মেহনূর আবার বইয়ের দিকে মনোযোগ দিলে সুরাইয়ার জ্বলজ্বল চোখদুটো টেবিলের উপর ‘ পরিণীতা ‘ বইটার দিকে আটকে গেলো। সাথে-সাথেই চোখেমুখে ছেয়ে গেলো ধূর্ত চিন্তা কষার পরিকল্পনা। চুপ করে টেবিলের উপর আচঁল ফেলে পরিণীতা বইটা চুরি করলো সুরাইয়া। তারপর সেটা আচঁলের ভেতর গছিয়ে জলন্ত মোমবাতি বাঁহাতে নিয়ে রুমের বাইরে যেতে থাকলো।
যাওয়ার আগে আরো একবার মেহনূরের দিকে পিছু ফিরে তাকালো, এরপর দৃষ্টি ঘুরিয়ে বেপরোয়া ভঙ্গিতে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মেহনূর হয়তো কল্পনাও করতে পারলো না ওর সাথে কি হতে চলেছে। এদিকে সুরাইয়া চুরি করা বইটা নিজের রুমে লুকানোর জন্য রুমের দিকে যেতেই হঠাৎ কানে স্পষ্ট শুনতে পেলো, মাঠে সবাই মশা তাড়ানোর জন্য কাগজ পুড়ার চিন্তা করছে। কাগজ পোড়ানোর উৎকট গন্ধ পেয়ে মশারা চলে যাবে। সুরাইয়া কানে এটাও শুনতে পাচ্ছে মাহতিম কাগজের আনার জন্য প্রীতিকে নির্দেশ দিচ্ছে। প্রীতি এদিকে কাগজ আনার জন্য ম্যানেজারের কাছে চলে গেলে ধীরেসুস্থে আচঁলের ভেতর থেকে পরিণীতা বইটা বের করলো সুরাইয়া, জলন্ত মোমবাতির আলোয় সেটা একপলক দেখে নিয়ে মাঠের পানে যেতে লাগলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে পেছন থেকে সুরাইয়া এসে বললো,
– তোমরা এই পুরাতন বইটা পুড়াতে পারো। আমার রুমে ডাস্টবিনের ভেতর এটা ফেলা ছিলো। আমার মনেহলো ডাস্টবিনে না রেখে এটা পুড়িয়ে ফেললেই ভালো হয়। অন্তত মশার উপদ্রব থেকে বাঁচা যাবে। এই নেও।
সুরাইয়ার বই ধরতে-ধরতে হঠাৎ প্রীতি দৌড়ে এলো। প্রীতি অনেকগুলো খবরের কাগজ নিয়ে চলে আসলে মাহদি দৌড়ে গিয়ে সেগুলো স্তুপ করে দিলো। সুরাইয়ার হাত থেকে সামিক বইটা নিয়েছিলো, কিন্তু সে বেখেয়ালি হয়ে প্রীতির কাগজে তাকিয়ে থাকলে বইটার দিকে বিশেষ নজরে তাকালোনা। মাহতিম খবরের কাগজগুলো জড়ো করতেই আগুনের জন্য ম্যাচের কথা উঠালো, আর তখনই সুরাইয়া দ্রুতবেগে নিজের হাতের মোমবাতিটা এগিয়ে দিলো। মাহতিম তীক্ষ্ণ নজরে সুরাইয়ার হাবভাব বুঝার চেষ্টা করছে, এই মেয়ে সারাদিন মুখ কুঁচকে রেখে এখন কেনো সাহায্য করতে এসেছে, সেটাই এখন মাথায় ধরছেনা। মাহতিম ওর হাত থেকে মোমবাতিটা নিয়ে কাগজে আগুন ফেললো, কাজ শেষে মোমবাতি ফেরত দিলে সুরাইয়া বইটার দিকে আবার তাগাদা দিলো। আর দিতেই কিনা চুপচাপ কটেজের দিকে চলে আসলো। সিড়ি দিয়ে কটেজে ঢুকতেই মেহনূরের রুমে উকি মেরে বললো,
– মেহনূর রে, আমাকে একটা সাহায্য করবি?
মেহনূর কথাটা শুনতে পেয়েই চটপট ভঙ্গিতে জবাব দিলো,
– বলো বুবু, কি করতে হবে? আমি এখুনি করে দিচ্ছি।
সুরাইয়া একগাল অদ্ভুত হাসি হেসে মেহনূরের জন্য সরল মুখে বললো,
– তোর সবচেয়ে সুন্দর বইটা আমাকে দে তো। আমি কিন্তু চন্দ্রনাথ পড়বো না, ওটা দিবি না। একটু রোমান্টিক হলে ভালো হয়। পরিণীতা আছেনা? তুই ওটা এনেছিস না? থাকলে দে, তোর বইটা নিয়ে একটু পড়ি। আমার এখানে সময় কাটছেনা।
মেহনূর খুশি হয়ে চওড়া একটা প্রাণখোলা হাসি দিয়ে দ্রুত বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। টেবিলের উপর ব্যাগ থেকে বের করা বইগুলো হাতড়ে-হাতড়ে কাঙ্ক্ষিত বইটা খুঁজতে লাগলো। পাগলের মতো খুঁজতে লাগলো, সব বই উলোট-পালোট করে খুঁজতে থাকলো, কিন্তু কোথাও বইটা খুজেঁ পাচ্ছেনা। অস্থির হয়ে উন্মাদের মতো বিছানার উপর বালিশ উল্টে দেখলো, বিছানার নিচে উঁকি মারলো, টেবিলের চারপাশে হন্যে হয়ে খুঁজলো, কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলোনা। ওর বিবশ অবস্থা দেখে সুরাইয়া তৃপ্তিতে বাক-বাকুম করছিলো, কিন্তু সেটা মুখে প্রকাশ না করে মিথ্যা চিন্তার অভিনয় করে বললো,
– কি হয়েছে রে? কি খুঁজছিস? বইটা কি হারিয়ে গেছে?
মেহনূর তখনো সবকিছু তছনছ করে খুঁজে যাচ্ছে। কোথাও সেটার হদিশ না পেয়ে ওর বুক শুকিয়ে আসছে, প্রচণ্ড কান্না পাচ্ছে, কন্ঠরোধ হয়ে আসছে ওর। তবুও নিজেকে সংযত করে প্রচণ্ড ধরা গলায় বললো,
– আমার পরিণীতা বইটা পাচ্ছিনা বুবু। ওটা কোথায় রাখলাম? আমিতো টেবিলেই রেখেছি বুবু। ওটা না পেলে আমি কি করবো? ওটা দাদীর বই ছিলো, ওটা দাদীর বই। আমি ওটা খুঁজে পাচ্ছিনা বুবু। ওটা কোথায় গেলো?
মেহনূরের অবস্থা একদম নাজেহাল হয়ে গেলো। খুঁজতে-খুঁজতে বিছানার চাদর, বালিশের জায়গা সব উল্টে ফেলেছে। সুরাইয়া মিচকি-মিচকি হাসিতে ফেটে পরলেও খুব কষ্ট করে হাসি আটকে নিলো, হাসিটা এমনভাবে ঢাকা দিলো যেনো মেহনূরের কষ্টে ওরও খুব কষ্ট অনুভব হচ্ছে। সুরাইয়া রুমের ভেতর পা ফেলে ওকে বাইরে আনার চিন্তা করলো। শান্ত হওয়ার জন্য মাথায় হাত বুলিয়ে রুমের বাইরে এনে মাঠে যেতে থাকলো। মেহনূর বারবার বলতে লাগলো বইটা ও টেবিলের উপরেই রেখেছে। স্পষ্ট করে মনে আছে বইটা টেবিলের উপরেই ছিলো।
কিন্তু হুট করে ওটা কোথায় হারিয়ে ফেললো? সুরাইয়া ওর হাতটা ধরে আগুনের কাছে গোলআড্ডায় নিয়ে আসলো। সবাই নিজেদের মধ্যে তুমুল হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে বলে মেহনূর মাথা নিচু করে রইলো। কিন্তু কি ভেবে যে একপলকের জন্য দৃষ্টি তুলে তাকালো ওমনেই মাহতিমের হাতে ওর দৃষ্টি আটকে নিশ্বাস চেপে আসলো। মাহতিম একটানে বইটাকে দুই খন্ড করে সেটা আগুনের দিকে ছুঁড়ে মারলো। মাহতিম মেহনূরের আগমন লক্ষ করলেও চোখ তুলে ইচ্ছে করে তাকায়নি, এদিকে মেহনূর যে ওর দিকে অপলকে তাকিয়ে আছে সেটাও বুঝতে বাকি নেই। মেহনূর বই ছেড়ার দৃশ্য দেখে কয়েক মিনিট ওভাবেই থম মেরে পাথরের মতো দাঁড়িয়ে থাকলো। পাশ থেকে সুরাইয়া চুপিচুপি ওর কাছ থেকে দূর সরে কটেজের দিকে চলে গেলো। মেহনূর স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ সাবার নজরটা ওর দিকে পরলো। সাবা ওর চোখের চাহনি দেখে খানিকটা বিচলিত হয়ে শানাজের কানে ফিসফিসিয়ে কিছু বললো। শানাজও চিকন কপালে ভাঁজ ফেলে বসা থেকে দাঁড়ালো, হাত ঝাড়া দিয়ে মেহনূরের কাছে এসে ওর কাধ ধরে প্রশ্ন করলো,
– তোর কি হয়েছে মেহনূর? তুই এখানে থাম্বার মতো দাড়িয়ে আছিস কেন? আয় আমাদের সাথে বসে পর। আড্ডা দে, মন ভালো হয়ে যাবে। পরশু তো চলেই যাচ্ছি।
মাহতিম কান খাড়া করে সব কথা শুনছিলো। কিন্তু মনের খটকা মেটাতে যেই মেহনূরের দিকে তাকালো, ওমনেই মেহনূরের সজল নয়নের ছলছল দৃষ্টি দেখে আশ্চর্য হয়ে গেলো। মাহতিমের দিকে পূর্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতেই মেহনূরের বড়ো বড়ো চোখ থেকে হঠাৎ বর্ষন শুরু হলো। সেই বর্ষণের জন্য বুক ফুলে উঠতে থাকলে শানাজ চিন্তিত হয়ে তাড়াতাড়ি ওকে নিজের দিকে ঘুরালো, গালে দুহাত চেপে তীব্র উৎকন্ঠায় বলে উঠলো,
– তুই কাঁদছিস কেন? কি হয়েছে? বাড়ির কথা মনে পরছে? মেহনূর তুই চুপ হ তো, কি হয়েছে খুলে বল দেখি।
মেহনূর গাল থেকে দুহাত সরিয়ে আবার মাহতিমের দিকে তাকালো। রাগে-ক্ষোভে-লজ্জায়-ধিক্কারে মাহতিমের দিকে দৃষ্টি রেখে শানাজের উদ্দেশ্যে কান্নাসুরে বললো,
– আমার বই পুড়িয়ে কি আনন্দ পেলো বুবু? ওদের জিজ্ঞেস করো আমার বই কেনো পুড়িয়ে দিলো। আমার বইয়ের কি দোষ ছিলো এখানে? ওটা দাদাভাইয়ের একান্ত বই ছিলো বুবু। আমি দাদাভাইকে কি জবাব দিবো? দাদীর ছোঁয়া ছিলো ওই বইটায়। দাদী ওই বইটা ধরেছিলো। ওরা আমার বই পুড়িয়ে দিলো বুবু। আমার বই পুড়িয়ে ছাই করে ফেলেছে।
কথাটুকু বলতেই সবার সামনে হাউমাউ করে কেদেঁ উঠলো মেহনূর। ঝরঝর করে দুচোখের কোল থেকে অশ্রু নির্গত হচ্ছে। ওর ফুপানো কান্না দেখে সাবা তড়িঘড়ি করে উঠে এসেছে। শানাজ ওর চোখ মুছাতে হাত আগালে মেহনূর রাগ দেখিয়ে সরিয়ে দিলো। মাহতিমের মতো সবাই তখন কি করবে বুঝতে পারছিলো না। মেহনূর এভাবে হাউমাউ করে কেদেঁ উঠবে এটা চিন্তাও করা যাচ্ছিলোনা। মাহতিমের মনে হচ্ছিলো সে বোধহয় জীবনের সবচেয়ে বড় অপরাধটা করে ফেলেছে। কিন্তু এখানে ওর দোষটা আদৌ আছে কিনা সেটা নিয়ে চিন্তা করার অবস্থা পযর্ন্ত নেই। সিয়াম ওর ব্যকুলভাবে কান্না দেখে অপরাধী মুখে বললো,
– মেহনূর তুমি কেঁদো না প্লিজ। আমরা সত্যিই জানতাম না, ওটা যে তোমার বই ছিলো। অতো পুরোনো বই, তার উপর বইয়ের মলোটটাও ছিলো না, এজন্য —
বাক্য শেষ করার আগেই মেহনূর টলটলে চোখে তেজ নিয়ে তাকালো! সিয়ামের দিকে রাগী দৃষ্টি দিয়ে তৎক্ষণাৎ ভয়াবহ ভাবে চেঁচিয়ে উঠলো,
– এজন্য আপনারা পুড়িয়ে ফেলবেন? ওটার কি কোনো মূল্য নেই? ওটা যে আটাশি সনের বই এটা জানেন?
এবার সিয়ামের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে ওই অশ্রুপূর্ণ চোখে মাহতিমের দিকে তাকালো। চোখ থেকে অনবরত টপটপ করে পানি পরতেই চেঁচানো সুরে বললো,
– একবার পেছনের পৃষ্ঠা দেখেছেন? সেখানে যে আমার দাদাভাইয়ের নাম লিখা ছিলো চোখে পরেনি? কেনো পুড়ানোর জন্য আমার রুম থেকে আনলেন? আপনি শুধু অসভ্য না! আপনি একটা জঘন্য চোরও! আপনার মতো জঘন্য মানুষ যেনো আমার সামনে না আসে! আমি কখনোই আপনার চেহারা দেখতে চাইনা!
মেহনূরের প্রতিটি কথা বাজেভাবে আহত করছে মাহতিমকে। বিনা দোষে, বিনা অপরাধে শুধু-শুধুই মেহনূরের কাছে ‘ অসভ্য-চোর-জঘন্য ‘ উপাধি পাচ্ছে। মাহতিম শক্ত হয়ে ছিলো ঠিকই, কিন্তু ভেতরের অবস্থা তুফানের মতো ঝড় তুলে দিচ্ছিলো ওর। এদিকে মেহনূরকে সবাই বুঝাতে চেষ্টা করলে মেহনূর কাঁদতে-কাঁদতে ঘুটঘুটে অন্ধকারের দিকে দৌড়ে পালিয়ে গেলো। এরপর আর চিল্লাচিল্লি হলো না। সৌভিকরা স্তম্ভের মতো স্তম্ভিত হয়ে গেলে কোনো কথাই আর বলতে পারলোনা। মাহতিম বাকরুদ্ধ হয়ে ধীরে-ধীরে মাথা নিচে নামিয়ে ফেললো, ঘাসের দিকে মুখ করে চোখ বন্ধ করে নিশ্বাস ছাড়লো। মেহনূরের কথাগুলো কান দিয়ে ধোয়া ছুটিয়ে দিয়েছে, নিজেকে শান্ত রাখার তীব্র চেষ্টায় মাহতিম একদম নিঃশব্দ হয়ে গেছে। আচানক ভয়ার্ত সুরে চিল্লিয়ে উঠলো তৌফ, ঘুটঘুটে জায়গাটার দিকে অস্থির কন্ঠে সপ্তমে গলা চড়িয়ে বললো,
– সর্বনাশ! মেহনূর এটা কোন রাস্তার দিকে দৌড় লাগালো! ওইটা তো জঙ্গলের রাস্তা ওই জায়গার অবস্থা বহুত খারাপ হয়ে আছে ভাই! এই মাইয়া আবার বিপদে পরে নাকি।
তৌফের কথা শুনে সবাই শিউরে উঠে ‘ হায়হায় ‘ করতে লাগলো। মাহতিম তাড়াতাড়ি বসা থেকে উঠে সবার উদ্দেশ্য বললো,
– কেউ ওই রাস্তায় পা দিও না। আমি ওখানে যেয়ে নিয়ে আসছি। কালকের বৃষ্টির জন্য জায়গাটা কাদা-কাদা হয়ে থাকতে পারে, তোমরা গেলে ব্যথা পেতে পারো। তোমরা টেনশন মুক্ত থাকো। আমি ওকে নিয়ে আসছি।
মাহতিম চটপট ওদের কথা বুঝিয়ে দ্রুত জায়গাটার দিকে হাঁটা দিলো। ওই জায়গাটায় প্রচুর গাছগাছালি ছিলো বিধায় আলো একদম পৌঁছাতে পারেনি। প্রথমবার কেউ খালি নজরে তাকালে ভয়ে তার গা কাঁটা দিয়ে উঠবে। মাহতিম অন্ধকারে তলিয়ে যেতেই দুহাতে ঝোঁপের গাছগুলো সরিয়ে ভেতরে ঢুকলো। চোখ সয়ে দুমিনিটের মতো হাটা দিতেই হঠাৎ চোখের সামনে বিধ্বস্ত অবস্থায় মেহনূরকে দেখতে পেলো। মেহনূর যে জায়গায় ছিলো সেখানটায় চাঁদের ছোট-ছোট আলো পাতার ফাঁক গলে আসছিলো। তাই যতটুকু দেখতে পেলো ওমনেই একদৌড় দিয়ে মেহনূরের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো মাহতিম। কাঁদায় হাত-পা মাখামাখি হয়ে গলায়-গালেও কিছু কাদা লেপ্টে ছিলো। মাহতিম ওর অবস্থা দেখে অট্টহাসিতে ফেটে পরতে নিলে হঠাৎ একটু আগের ঘটনা স্মরণ করে চুপ হয়ে গেলো। কাদা বাঁচিয়ে শুকনো একটা জায়গায় পা ফেলে ওর সামনে এসে হাটু গেড়ে ঝুঁকলো। মেহনূর যে মাথা নিচু করে তখনো ফুপিয়ে কাঁদছে, সেটা ওর পিঠের অবস্থা দেখলেই বুঝা যায়। মাহতিম ওর দিকে হাত এগিয়ে থুতনি উঁচিয়ে মুখ তুললো। নম্র কন্ঠে শান্ত ভঙ্গিতে বললো,
– রাগ দেখিয়ে কার ক্ষতিটা হলো? আমার না তোমার? দৌড়টা এই জঙ্গলের দিকে না দিয়ে আমার দিকেই দিতে। আমিতো রাগ ঝাড়ার জন্য পালটা জবাব দিতাম না।
মাহতিমের দিকে দৃষ্টি তুলে তাকালে অন্ধকারের জন্য স্পষ্ট দেখে পারলো না মেহনূর। শুধু বুঝতে পারলো মাহতিম আবারও ওর দিকে ওর সামনে বিপদের বেলায় হাজির হয়েছে। একটু আগের ঘটনা চিন্তা করতেই মেহনূর সাথে-সাথে ঝটকা মেরে মাহতিমের হাত সরিয়ে দেয়। মাথা নিচু করে কাদাটে জায়গা থেকে উঠতে নিলে আবার ধপ করে পরে যায়। মাহতিম ওর কীর্তিকলাপ দেখে হাসবে-না-দেখবে সেটাই চিন্তা করছিলো। এমন বেকুব মার্কা কাণ্ডজ্ঞান দেখে মাহতিম শেষমেশ আবার বলে উঠলো,
– আমাকে ধরে উঠলে তোমার জন্য ভালো হবে। নয়তো এখান থেকে উঠার চান্স খুবই কম। সামনে একটা পুকুর আছে, চাইলে সেখানে গিয়ে কাদা পরিস্কার করতে পারো।
মেহনূর মুখ তুলে অসহ্য ভঙ্গিতে বললো,
– আপনি এখান থেকে চলে যান।
মাহতিম ওর আকস্মিক রাগের আচরণগুলো খুব মনোযোগ সহকারে দেখেছিলো। এখন যেই আচরণগুলো করছে সেটাও যে রাগের শামিল এটা ওর জানা আছে। তাই মাহতিম বিনম্র সুরে সৌজন্যে ভঙ্গিতে বললো,
– তোমার কি সত্যিই মনেহয় আমি ওই বইটা ইচ্ছা করে পুড়েছি? তাছাড়া আমি তোমার বইটা কিভাবৈ খুজেঁ পেলাম, সেটা কি জিজ্ঞেস করা উচিত না? আমিতো তোমার রুমে যাইনি, তাহলে কি করে তোমার বইটা আমার হাতে চলে এলো? সৌভিকরা তোমার রুমে গিয়েছে কিনা জানিনা, কিন্তু অন্যের মাধ্যমে চোরা কাজ করানোর মতো বিশ্রী স্বভাব আমার নেই। মাঝে-মাঝে চোখে দেখা সত্যও অনেকসময় মিথ্যার মতো হয়।
মেহনূর এবার কথাগুলো শুনে খানিকটা অন্যমনষ্ক হয়ে গেলো। নিজের ভাবনা চিন্তায় মশগুল থেকে কিছুক্ষণ পর বললো,
– আপনি কিভাবে আমার বই পেয়েছেন?
মাহতিম ওর উত্তর শুনে মৃদ্যু ভঙ্গিতে হেসে দিলো। মেহনূরের ড্যাবড্যাবে চাহনির দিকে দৃষ্টি রেখে সরল গলায় বললো,
– বলবো, নিশ্চয়ই বলবো। তার আগে আমার সাথে ওই পুকুরটার কাছে চলো। ওখানে বসে হাত-পা ধুয়ে নাও। কাদাগুলো সরাও, তারপর তোমাকে খুলে বলছি। আসো, হাতটা ধরে উঠে দাড়াও।
মাহতিম উঠে হাত বাড়িয়ে দাঁড়ালে মেহনূর তবুও মাথা নিচু করে থাকে। ওর ব্যাপারটা সম্পূর্ণ বুঝতে না পারলেও সামান্য আঁচ করতে পারলো। সেই অনুমানের সূত্র ধরেই প্রশ্ন করে বললো,
– দৌড়াতে যেয়ে পায়ে ব্যথা পেয়েছো নিশ্চয়ই?
মেহনূর লজ্জার জন্য বলতে পারলো না, পায়ে সে ব্যথা পেয়েছে। দৌড়াতে গিয়ে কাদার মধ্যে পা আটকে ধপ করে পরেছে। অসহায়ের মতো নতমুখে বসে থাকলে হঠাৎ একজোড়া হাত এসে চোখের পলকে কাদা থেকে উপরে তুলে ফেললো। মেহনূর কিছু বুঝে উঠার আগেই পেশিবহুল বাহুদুটো ওকে গুটিশুটি করে কোলে তুলে নিলো। মেহনূর ঘটনার আকস্মিকতার জন্য চোখ খিচে ফেললে কিছুক্ষণ পর হাঁটার গতি অনুভব করলো। হাঁটার জন্য ওর শরীরটাও যে একটু-আধটু নড়ছে, সেটা মেহনূর স্পষ্টরূপে টের পেলো। মেহনূর ধীরে-ধীরে চোখের পাতা খুললে গাছের ফাঁকে-ফাঁকে চাঁদের উঁকিঝুঁকি দেওয়া চন্দ্রালো দেখতে পেলো। মেহনূরের নরম শরীরটা কোলে তুলে মাহতিম সোজা পুকুরঘাঁটের দিকে রওনা দিয়েছে। অন্ধকারে খুব সাবধানে পা ফেলে এগুতে হচ্ছে।
একটুখানি অসর্তক হলে এখুনি মেহনূরকে নিয়ে পরে যেতে হবে। মেহনূর যে মাহতিমের দিকে চুপ করে তাকিয়ে আছে, মাহতিম সেটা আড়চোখে ধরতে পারলো। কিন্তু ওর দিকে পালটা দৃষ্টি ছুড়তে গেলে পা পিছলে এলাহিকাণ্ড ঘটে যাবে। মাহতিম পুরোটা মেঠোপথ নিজেকে শান্ত রেখে শেষমেশ গন্তব্যস্থলে পৌঁছালো। পুকুরঘাঁটের পাকা পাটাতনে মেহনূরেকে বসিয়ে দিলো। হাতের ঘড়িটা খুলে মেহনূরের কোলে রেখে প্যান্ট গুটাতে ব্যস্ত হলো মাহতিম। পুকুরের স্বচ্ছ-পরিস্কার পানিতে নেমে সবার আগে নিজের হাতদুটো ধুয়ে নিলো। মেহনূরকে কোলে তুলার জন্য ওর আকাশী রঙের টিশার্ট ইতিমধ্যে কাদার কারনে নষ্ট হয়ে গেছে। মাহতিম সেদিকে ভ্রুক্ষেপ না করে মেহনূরের দিকে আদেশসূচকে বললো,
– পাদুটো দেখাও।
মেহনূর কথাটা শুনেই কাঁচুমাচু করে পা আরো লুকানোর চেষ্টা করলো। এবার মাহতিম রেগে গিয়ে ভ্রুঁ কুঁচকে বললো,
– এখন কিন্তু কথা না শুনলে সোজা পুকুরে ফেলে দিবো।
মেহনূর একটা কড়া ধমক খেয়ে নির্বোধ হয়ে গেলো। পা এগিয়ে দিতেই মাহতিম ওর পায়ে মুঠোভর্তি পানি ছেড়ে কাদা পরিস্কার করে দিলো। দুইপা একসঙ্গে ধুয়ে দিতেই শাড়ির নিচটা যতটুকু সম্ভব কাদা পরিস্কার করে দিলো। এবার হাতদুটো পরিস্কার করে দেওয়ার জন্য ওর ডানহাতটা ধরলো মাহতিম। নির্লিপ্তে হাতটা পানি দিয়ে ধুয়ে ধুতেই মেহনূর একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো। মেহনূরের চাহনি দেখে মাহতিম আন্দাজ করতে পারলো, এইমূহুর্তে ওর ভেতরে কি কি চিন্তা ঘুরছে। মাহতিম ওর হাত ধুয়ে দিতেই ঠোঁটে হাসি টেনে বললো,
– তোমার জায়গায় যদি সুরাইয়া এখানে থাকতো আমি সুন্দর করে গলাটা টিপে ধরতাম। টানা পাঁচ মিনিট ওভাবে টিপে রেখে গলায় একটা পাথর বেধেঁ দিতাম। তারপর এই পুকুরে ছেড়ে দিয়ে চলে যেতাম। এই কাজটা করতে পারলে আমার জীবনটা ধণ্য লাগতো শিওর।
কথাটা শুনে খু/নি-খু/নি লাগলো মেহনূরের। কিন্তু কেনো সুরাইয়ার ব্যাপারে এমন ফালতু কথা বলছে সেটার জন্য মুখ খুললো মেহনূর। কিন্তু কিছু বলার আগেই মাঝপথে আটকে দিয়ে মাহতিম নিজের আসল কথাটা বলল,
– তোমার বইয়ের ব্যাপারে আমি কিছুই জানতাম না। মশার যন্ত্রণা কমানোর জন্য কাগজ পুড়াতে বলেছিলাম। প্রীতি কিছু নিউজপেপার কালেক্ট করে এনেছিলো, আর ওগুলো দিয়েই আ/গুন জ্বালিয়েছি। কিন্তু হুট করে সুরাইয়া একটা পুরোনো বই নিয়ে আসলো। আর মোস্ট ইন্ট্রেস্টিং পয়েন্ট ইজ, ওই বইটা পুড়ানোর জন্য ও নিজেই কিনা তাগাদা দিয়েছিলো। আমিতো খেয়ালও করিনি বইটা আসলে কিসের ছিলো। বইটা যখন দুফালি করে ছিঁড়ে আগুনে পুড়াতে দিয়েছি তখনই তুমি ওই দৃশ্য দেখে আমার উপর ক্ষেপে গেছো। এটা কি আমার দোষ?
মাহতিম এটুকু কথা সমাপ্ত করে হাতদুটো পরিস্কার করা শেষ করলো। মেহনূর একদম নির্বাক হয়ে তাকিয়েছিলো, ওর দৃষ্টি ঠিক এমন হয়ে আছে যেনো চিন্তা-চেতনা শূন্য হয়ে গেছে। মাহতিম বুঝতে পারলো এটা ঝড় আসার পূর্বমূহুর্ত্তের নিরবতা। তাই সেই নিরবতাকে শক্ত করতে মেহনূরের বাঁগালে হাত রাখলো মাহতিম। গালে চারটা আঙ্গুল বসিয়ে বৃদ্ধাঙ্গুল এগিয়ে কাদার ছিঁটেটা মুছে দিতে লাগলো। ওর নিরব চাহনির দিকে দৃষ্টি রেখে অন্যহাতটা এগিয়ে ওর গলার ডানদিকে রাখলো। সেখানকার ছিটেফোঁটা কাদাটা পরিস্কার করতেই মেহনূরের দিকে মুখটা একটু এগিয়ে নিয়ে বললো,
– পরিণীতার মর্ম বুঝতে পারো। এদিকে আমার যে শেখরের মতো অবস্থা হয়ে আছে, সেটা বুঝতে পারোনা?
ধুকপুক-ধুকপুক করে বুকের পরিচিত কাঁপুনি বেড়ে গেছে। খুবই অস্বাভাবিক ভাবে বেড়েছে। বেতাল হয়ে গেছে, বেসামাল হয়ে গেছে, বেগতিক হারে ছুটছে, ক্রমশ ধুকধুকনি আরো বেড়েই চলছে। নিঃশ্বাসের প্রখরতা ক্রমান্বয়ে ফিসফিসিয়ে হচ্ছে, চারপাশকে সেই ধুকধুকনি অন্য কথা জানিয়ে দিচ্ছে, অসামঞ্জস্য হয়ে বুকের যন্ত্রটা ধড়াস-ধড়াস আবারও বেকায়দা হয়ে গেছে। মাহতিম নিজের মুখটা আরো এগিয়ে নিয়ে গেলো, নরম গালটা থেকে কাদা পরিস্কার করে হাতটা গলার দিকে এগিয়ে নিলো।
মেহনূর স্থির নয়নে তাকিয়ে থাকলেও মাহতিমের উষ্ণ নিশ্বাসগুলো গভীরভাবে ওর মুখের উপর পরছিলো। মেহনূর এবার একদম চোখ বন্ধ করলো না, করলো না একটাই কারন, সে নিজের বাকচিন্তায় ছিলোনা। নিজেকে ওইমূহুর্তে ললিতার জায়গায় মনে হচ্ছিলো। সেই তপ্ত নিশ্বাসের উর্ধ্বশ্বাস ক্ষণেক্ষণে মনের আঙিনায় ছুটে বেড়াচ্ছিলো। মাহতিমের কন্ঠ-স্পর্শ-ঘ্রাণে মেহনূর পুরোপুরি বশবর্তী হয়ে গেছে।
মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ১৯+২০
মাহতিমের গায়ের নিজস্ব ঘ্রাণ তীব্রভাবে টের পাচ্ছে, কানে ওর কোমলমিশ্রিত ঠান্ডা সুর ক্ষণেক্ষণে শুনছে, হিম-শীতল স্পর্শের ভেতর মেহনূর পুরোপুরি জড়িয়ে গিয়ে আচ্ছন্ন হয়ে গেছে। সময় হুরহুর করে পেরিয়ে গেলেও শেখরের মতো ওষ্ঠসিক্ত করলো না মাহতিম। অনেকক্ষণ পেরিয়ে গেলেও ঠোঁটের মাঝে ঠোঁট ডুবিয়ে অধরজোড়া আঁকড়ে ধরলো না। মেহনূরের চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে-থাকতেই আবারও নিচুসুরে ঠান্ডা কন্ঠে বলে উঠলো,
– আমার দেহের উপর ছোট্ট শরীরটা না পাওয়া পযর্ন্ত স্বস্তি পাবো না।
