মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ৩+৪
ফাবিয়াহ্ মমো
চিল্লানোর শব্দ ক্রমাগত বেড়ে যাচ্ছে। অনেকগুলো কন্ঠের হৈচৈ নিচ থেকে শোনা যাচ্ছে। এদিকে হতবুদ্ধির মতো রুমে পায়চারি করছে মেহনূর। কি করে ছেলেগুলোর সামনে যাবে? কিভাবে সামলাবে এমন উটকো পরিস্থিতি? অসম্ভব বলে মনে হলেও এই মূহুর্তে কিচ্ছু মাথায় আসছেনা ওর। কান জ্বালা-ফালা হয়ে যাচ্ছে শব্দের জন্য। বারবার দরজার দিকে নজর দিচ্ছে মেহনূর। সেই সঙ্গে পা চালিয়ে অনবরত উত্তর টু দক্ষিণ দিকে ক্রমাগত হাঁটছে সে। যদি বুবু এসে সবটা সামলে ফেলে তাহলে আর নিচে যাওয়ার দরকার নেই।
কিন্তু শব্দের তেজটা বলে দিচ্ছে বুবু এখনো দাদাভাইকে আনতে পারেনি। বাধ্য হয়েই হোক, বা অন্য কোনো কারনে, মেহনূর ঠিকই ঝামেলা মিটানোর জন্য ব্যবস্থা করবে। সাদা পাড়ের গোলাপী আচঁলটা চট করে মাথায় টানলো মেহনূর, নাক পযর্ন্ত আচঁল দিয়ে মুখটা ঢেকে ফেললো। ওমনেই রুম থেকে দ্রুতগতিতে বেরুয় মেহনূর, যেতে-যেতে বারান্দার নিচে দৃষ্টি ফেলে সবটা দেখতে থাকে। আঙিনার ঠিক মাঝখানে লম্বামতো একটা পুরুষ দাড়িয়ে আছে। সুরাইয়াকে পারেনা বেকায়দায় থাপড়াতে আসে।
আরও গল্প পড়তে এখানে ক্লিক করুন
সুরাইয়া মাথা নুয়ে ফুলিয়ে-ফুলিয়ে কাঁদছে, ক্ষণেক্ষণে বজ্রকন্ঠের ধমক শুনে গা কাঁপিয়ে শিউরে উঠছে। বাড়ির সবাই প্রায় উপস্থিত, কিন্তু সামলাতে পারছেনা কেউই। সুরাইয়াকে যেভাবে ধমকাচ্ছে, সেই দৃশ্যটুকু দেখলে ভয়ে গা পযর্ন্ত শিউরে উঠে। এদিকে আর এগুতে পারলো না মেহনূর, পা থামিয়ে দাড়িয়ে গেলো সে। অন্যদিকে আঙিনার এককোণায় তটস্থ অবস্থায় দাড়িয়ে ছিলো সাবা, বারান্দার দিকে দৃষ্টি যেতেই দ্রুত নিচে নামতে ইশারা করলো। মেহনূর সেটা দেখে সঙ্গে-সঙ্গে ভীতু চেহারায় ‘ না ‘ বোধকে মাথা নাড়াতে লাগলো। মেহনূরের এমন ভীরুতা দেখে রাগে কটমট করে উঠলো সাবা। এদিকে মাহতিম চিল্লিয়ে যাচ্ছে,
– ঠাসঠাস দুগালে চড় মারলেও সোজা হওয়ার চান্স আছে? কি সমস্যা তোমার হ্যাঁ! কথা বললে কথা কানে যায় না?? বয়স কতো তোমার? মাত্র আঠারো? এখনই এতো ব্লা ব্লা কাহিনি কিভাবে দেখাচ্ছো? ভংচং করে ঢঙ দেখিয়ে যেভাবে বেরাচ্ছো লজ্জা করেনা? তুমি কি জানো আমি তোমার চেয়ে খুব বেশিই বড়? কিজন্যে এমন ফাজলামি করছো?
ঠোঁট উল্টিয়ে কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বাচ্চাদের মতো করে বললো সুরাইয়া,
–আআমি চিচিঠিটা দেখখিনি সসতত্যি…বড় আআপু চিচিঠিটা আপপনাকে দিতে পাঠিয়েছে।ববলেছে আআপনার হাতে চিঠিটি দিয়ে চলে আসতে…
পকেট থেকে হাত বের করে চুলের ব্যাকব্রাশ করলো মাহতিম। চোখেমুখে রাগী ভাবটা তখন তুমুল আকারে থাকলেও সংযত করার চেষ্টায় ছিলো। পান থেকে চুন খসলেই পাশে থাকা মেয়েটিকে ঠাটিয়ে দুটো চড় মারতে ভুল করবেনা এখন।।কোনোভাবেই ভেবে পাচ্ছেনা এই নাছোড়বান্দা অকালপক্ক গাধী কিভাবে সামনে এসে কথা বলার সাহস দেখাচ্ছে! মাহতিমের ইচ্ছে করছে গলা টিপে ফাজিল মেয়েটাকে একেবারে মেরে ফেলতে!কুটিকুটি করে বস্তায় ভরে পদ্মা-যমুনায় ভাসিয়ে দিতে! কিন্তু বিষভরা আফসোস! এটা কষ্মিনকালেও সম্ভব না। তাই মাহতিম নিজের রাগটা সামলানোর জন্য উপরের দিকে মুখ তুলে চোখ বন্ধ করলো। শব্দ করে নিশ্বাস ছাড়তেই কয়েকসেকেন্ডের মধ্যে চোখের পাতা খুললো।
কিন্তু একমুহূর্ত যেনো ওভাবেই দৃষ্টি আটকে রইলো ওর, পরক্ষনে চোখদুটো বিষ্ময়ে ভষ্ম হলে সাথে-সাথে কপালে ভাঁজ পরলো। মাহতিম যখন উপরের দিকে মুখ তুলে নিশ্বাস ছাড়ছিলো, তখনই মেহনূর উল্টো ঘুরে নিজেকে আড়াল করছিলো। কিন্তু মেহনূরের পেছনদিকটা ঠিকই দেখতে পাচ্ছিলো মাহতিম। মাহতিম সহসা থমকে গেলে মারজা এই সুযোগে ছেলেকে ইচ্ছেমতো বকতে লাগলো। সুজলা চুপচাপ সুরাইয়াকে সেখান থেকে নিয়ে গেলো। ভাগ্যিস সুরাইয়ার মা বাড়িতে ছিলো না, নাহলে কেমন কেলেঙ্কারি হতো সেটা কেউ জানেনা। এদিকে হান্নান শেখ তড়িঘড়ি করে বাড়িতে ঢুকলে মারজা তৎক্ষণাৎ বাবামশাইয়ের কাছে ছুটে গিয়ে সব খোলাসা করতে ব্যস্ত হলো। শানাজ চুপচাপ নতমুখে সিড়ি ধরে উপরে চলে যাচ্ছিলো।
মাহতিমের চুপটি দেখে বন্ধু ও কাজিনরা ঘাবড়ে গেলেও পরক্ষনে নীতির কাছে মূল ব্যাপারটা ঠিকই ধরা পরলো। নীতি একবার ভাইয়ের দিকে তাকালো, আরেকবার তাকালো মেহনূরের দিকে। শানাজ ততক্ষণে বারান্দায় এসে নিচুস্বরে কিছু বলতেই মেহনূর তৎক্ষণাৎ দৌড়ে পালায় রুমের দিকে। কিন্তু পথিমধ্যে মাথা থেকে আচঁল পরে যায় ওর, পেঁচানো খোপা আলগা হয়ে দৌড়ের গতিতে খুলে যায় সেটা। ধাপে-ধাপে চুলের বহর কাধ থেকে পিঠে, পিঠ থেকে কোমরে, কোমর থেকে সোজা হাটুর কাছে আছড়ে পরতেই মেহনূর ডিরেক্ট রুমে ঢুকে। আর দেখতে পেলো না মাহতিম। তখনই সৎবিৎ ফিরে পেয়ে মুখ যেই নিচু করবে, ওমনেই কাজিনদের কৌতুহল দৃষ্টি ওকে অপ্রস্তুত করে দিলো। মাহতিম শূন্য মুখে কয়েক সেকেন্ড চুপ থাকলে নিজেই নিরবতা ছেদন করে বললো,
– আমার মুখে কি সিনেমা চলছে? তোরা সিনেমা দেখছিস? তাকিয়ে আছিস কেন?
পুরো আটজন স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতেই হুট করে পেট-ফাটা হাসিতে সবগুলো মেতে উঠলো। ওদের হাসি দেখে আহাম্মক হয়ে গেলো মাহতিম। লুটোপুটি খেয়ে হাসাহাসি করছে এখন। কি নিয়ে এমন হাসাহাসির কীর্তি হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারলো না ও।নীতির কথায় মাহতিম ক্ষুদ্ধ ভঙ্গিতে চুপচাপ রুমে যেতে বাধ্য হলো। নীতি শুধু এটুকু বলেছিলো, ‘ ভাইয়া মেহনূরকে ডাকি?’। এটুকু প্রশ্ন শুনেই মাহতিম যেনো দারুন লজ্জা এবং উটকো ইয়ার্কির কারণ হিসেবে অধোমুখে বসে রইলো।
সুরাইয়া একটু আগে যে তামাশা করলো, সেটা মনে উঠলেই গা রি-রি করে উঠে ওর। মাহতিম আঙিনায় দাড়িয়ে ফোনে কথা বলছিলো, তখন কোত্থেকে যেনো সুরাইয়া এসে উদয় হলে মাহতিমের সামনে একটা চিঠি বারিয়ে ধরলো। ওর ঠোঁটের কোণে হাসির ছলকটা দেখা যাচ্ছিলো ঠিকই, কিন্তু মাহতিম তখন এতোটাই আশ্চর্য হয়েছিলো, ফোনের ওপাশে জবাব দিতে একদমই ভুলে গিয়েছিলো। সুরাইয়া কিন্তু থেমে নেই, সে বেহায়ার মতোই হোক বা ন্যাকামির জোরে চিঠিটা সুন্দর করে ধরে দাড়িয়ে আছে। এমন একটা ভাব যেনো প্রেমিকের সামনে ভীষণ লজ্জায় হাবুডুবু খেয়ে মরে যাচ্ছে। মাহতিম আর ডানেবায়ে তাকায় না, এমন কন্ঠে চেচিয়ে উঠে তাতে মারাত্মক ভয় পায় সুরাইয়া। এরপর শুরু হয় কুরুক্ষেত্র এবং মাহতিমের বজ্রকন্ঠ।
বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে মাহতিম এসব ভাবছিলো। কিন্তু দরজার কাছে তিনটা টোকা পরতেই চোখ মেলে দরজার দিকে তাকালো। ওমনেই তড়াক করে বিছানায় উঠে হান্নান শেখকে ভেতরে আসার অনুরোধ করলো। হান্নান শেখের গায়ে সাদা লুঙ্গি ও ঘিয়ে রঙের পান্ঞ্জাবী পরিহিত ছিলো। তিনি দরজার দুই দ্বার রুদ্ধ করে পায়ে-পায়ে বিছানার কাছে এসে বসলেন। মাহতিম সহজাত হাসিতে কিছু বলার জন্য চনমনে ভাব প্রকাশ করলে হান্নান শেখ মৃদ্যু হাসির সুরে বললেন,
– দাদু তুমি কি মাফ চাওয়ার জন্য ঠোঁট নাড়াচ্ছো? তাহলে সেটা করো না। আসলে আমার মেজো নাতনীটা একটু সোজা না, সে সবসময় সীমার বাইরে থাকতেই পছন্দ করে। দোষটা আসলে আমাদের মাহতিম দাদু। তোমার না।
বৃদ্ধ হান্নানের নরম আচরণে কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে মাহতিম। বৃদ্ধর পানে তাকিয়ে থেকে অদ্ভুত শ্রদ্ধায় মুগ্ধ হচ্ছিলো সে। নিরবতার জালে ছিদ্র করে মাহতিম শান্ত সুরে বলে,
– দেখুন দাদু, এসব স্ক্রু ঢিলা মেয়েমানুষকে একটু টাইটে রাখবেন। আমি নাহয় আপনার কাছের মানুষ, কিন্তু আমার জায়গায় যদি বাইরের কোনো দুশ্চরিত্র পুরুষ হতো তাহলে কিন্তু ব্যাপারটা খারাপের দিকে চলে যেতো। আপনিও জানেন, আর আমিও জানি একটা মেয়ের জন্য এমন অসভ্যতামি নিশ্চয়ই শোভা পায় না। তাছাড়া একটা ব্যাপার বুঝিয়ে বলুনতো দাদু, আপনার আরো তিনটে নাতনী আছে, তারাতো এরকম করেনা। শানাজ আমার চেয়ে ভালোই ছোট, তবে ও নীতির সমবয়সী। ওর মধ্যে তো এরকম উগ্রপনা দেখিনি, সাবাও যথেষ্ট অমায়িক আচরণ করেছে। মেহনূর তো ছেলেদের সামনেই আসেনা। তাহলে মেজো নাতনীটা এরকম কেনো?
কথাটুকু শুনে হান্নান শেখ চাপা ক্লেশে দৃষ্টি নিচু করলো। ঠোঁটে উনার হাসি জড়ানো থাকলেও কন্ঠ কেমন নিষ্প্রভ ছিলো। মাহতিম বৃদ্ধর অবস্থা যেনো কিছুটা হলেও বুঝতে পারছিলো, কিন্তু মুখে কিছু বললো না। হান্নান বুকভর্তি নিশ্বাস টেনে সেটা সশব্দে ছেড়ে দিয়ে হালকা গলায় বললো,
– ‘ অতি আদরে বাদর হয় ‘- কথাটা শুনেছো?
মাহতিম প্রশ্ন শুনে উত্তরের জন্য ‘ হ্যাঁ ‘ বোধকে মাথা নাড়লো। আড়চোখে উত্তরটা জেনে হান্নান এবার স্পষ্ট করে বললো,
– মেজো বউমা একটু বেশিই আহ্লাদী। নিজের মেয়েকে একটু আলাদা বানাতে গিয়ে চরম অসভ্য বানিয়ে ফেলেছে। আমরা যখন ভুল করি, তখন আমরা বকা খাই, আর সুরাইয়া তখন আদর পেতো। তফাৎটা এবার বুঝেছো? যাইহোক আজকের ঘটনা নিয়ে আমি নিজেই খুব লজ্জিত, লজ্জায় মাথাটা এভাবে কাটা যাবে ভাবতেও পারিনি। তা দাদু তুমি এই বুড়োর মিনতিটুকু সম্মান হিসেবে রেখো। দয়াকরে বাইরে এ কথা ভুলেও সাত-কান করো না। নাহলে নাতনীদের বিয়ে দিতে পারবো না।
মাহতিম আশ্বস্ত সুরে হাসি দিয়ে বললো,
– একজনের জন্য দশজনকে শাস্তি দিয়ে তো লাভ নেই দাদু। আমি এখানে মেহমান হিসেবে এসেছি, মেহমান হিসেবেই চলে যাবো। মাঝের ঘটনাটুকু অবশ্যই ভুলে যাবো। আপনি চিন্তামুক্ত থাকুন।
সুরাইয়ার সেই ঘটনার পর মাহতিম একটু নিস্তার পেলো। কিন্তু স্বস্তি পেলো না একদম। বারবার মনের মধ্যে অলিখিত কথার মতো কিছু অপ্রকাশিত উত্তেজনা যেনো ঘুরঘুর করছে। চোখের সামনে না চাইতেই কিছু অদ্ভুত দৃশ্য ভেসে উঠছে। দুপুরের পর ঠিক বিকেলের দিকে বাইরে বেরুলো সে। রুমের বাইরে গিয়ে জানতে পারলো মাকে নিয়ে সবাই নাকি কাকে যেনো দেখতে গিয়েছে। বাড়িতে একটা কাক-পক্ষিও নেই বটে। মাহতিম বিরক্ত বোধ করছিলো বলে ট্রাউজারের দুই পকেটে হাত গুজিয়ে হাঁটছিলো। বাড়ির প্রতিটি রুম-সহ সবকিছু দেখার জন্য ছোট্ট প্ল্যান করলো। মানুষহীন বাড়িটা বড্ড খাঁ খাঁ করছে এখন, চারপাশটা সুনশান হয়ে উদাস অবস্থা বিরাজ করছে।
সাদা টিশার্ট এবং নেভি ব্লু ট্রাউজার পরে দক্ষিণদিকের সাইডটায় চলে আসলো মাহতিম। সিড়ি দিয়ে উঠতেই শান্ত-নয়নে সবকিছু দেখতে লাগলো। পা চালিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে শূন্য রুমগুলো দেখলো মাহতিম। তখনই সে বুঝতে পারলো এগুলো আসলে মেয়েদের রুম। যেহেতু বাড়িতে কেউ নেই, তাই স্বচ্ছন্দে তাদের রুমে ঢুকে চার দেয়ালের সুক্ষ্ম কারুকাজগুলো দেখছিলো। কিন্তু বিধি যে অন্যকিছুর পরিকল্পনায় মত্ত ছিলো, সেটা কেউ জানতো না। ভাগ্য যে এমন জায়গায় সুতো বেধেঁ দিচ্ছিলো, যেটার জটটা আসলে খুলবেনা। মাহতিম মুগ্ধ দৃষ্টিতে সবকিছু পরোখ করতেই একদম কোণার দিকে দ্বিতীয় রুমটার সামনে চলে আসলো।
দরজা তখন খোলা এবং পর্দা দুপাশে চাপানো ছিলো। সে নিশ্চিন্ত মনে ভেতরে পা রাখতেই চোখদুটো আকস্মিকভাবে স্থির হয়ে গেলো। বুকের ভেতর ভয়ংকর যন্ত্রটা ক্ষিপ্রগতিতে ছুটতে লাগলো। ধুক-পুক-ধুক-পুক করে দুই কানের নরম পর্দায় বুকের চাবুকাঘাত স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলো। কি হচ্ছিলো নিজের সঙ্গে কিছুই টের পাচ্ছিলো না সে। শুধু চোখদুটো চুম্বকের মতো দৃশ্যপটে সেঁটে গেছে। ফুসফুসের ওমন বেগতিক ভাবে ক্রিয়ার জন্য কিছু বলার সাধ্যও ফুরিয়ে গেছে। মাহতিম যে কখন রুমে এসে দাড়িয়েছে খেয়াল করেনি একজন।
সে রুমের ভেতরে সদ্য গোসল সেরে শাড়ি পরার কার্যে লিপ্ত ছিলো। দরজার দিকে পিঠ দেওয়াতে খেয়াল করেনি একদম। আঙ্গুলের ফাঁকে শাড়ির কুচি আবদ্ধ করে মাথা নুয়ে মগ্ন ছিলো। গুছানো কুচিগুলো একত্র করে যেই শাড়ি তুলে পেটের কাছে গুঁজবে একপলকের জন্য আয়নার দিকে তাকায় মেহনূর। সঙ্গে-সঙ্গেই বিস্ফোরণ চাহনিতে স্তব্ধ হয়ে যায় ও। চোয়াল ঝুলিয়ে হা করে তাকালে অজান্তেই হাত ফসকে সাজানো-গুছানো কুচিগুলো পরে যেতে লাগলো।
শাড়ির কুচিগুলো ছেড়ে দিয়ে হতভম্ব হয়ে গেছে মেহনূর। আয়নার পানে দৃষ্টি দিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে আছে। মাহতিম কখন এসে দরজার কাছে দাড়িয়েছে এটুকুও টের পায়নি সে। বুকটা ধড়াস-ধড়াস করে কাঁপছে ওর। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে, চোখের অবস্থাও পলকহীন। হঠাৎ থরথর করে কাপতে লাগলো মেহনূর, এমনভাবে নিশ্বাস নিতে লাগলো গলার কাছে শিরাগুলো স্পষ্টরূপে দেখা যাচ্ছিলো। খুবই অপ্রকৃতিস্থ ভাবে নিশ্বাস টানছিলো। মাহতিম এতোক্ষন থ মেরে দাড়িয়ে থাকলে মেহনূরের ওমন দৃশ্য দেখে আকস্মিকভাবে সৎবৎ ফিরে পেলো। গায়ের প্রতিটি পশম কাটার মতো চিড়চিড় করে ফুটছিলো।
এ কেমন দেখে ফেললো সে? মানে সে কি সত্যিই একটা ভয়ানক কাজ করে ফেলেছে? এই কাজের শাস্তি কি আদৌ আছে? অদ্ভুত একটা অপরাধবোধে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে পালিয়ে এলো মাহতিম। রুমে ঢুকেই দুহাতে ধাম করে দরজা লাগিয়ে রুদ্ধ দরজায় পিঠ লাগিয়ে দিলো। ঠোঁট ভেদ করে শব্দযোগে বুকভর্তি নিশ্বাস ছাড়তে লাগলো। এক মাইল দৌড়ালেও বুঝি এমন করুন অবস্থায় নিশ্বাস ছাড়েনা মাহতিম। কপালের উপর ঘামও রীতিমতো চকচক করতে লাগলো। নিজেকে শান্ত ও স্থির করতে তৎক্ষণাৎ চোখ বন্ধ করে ফেললো। কাটায়-কাটায় দশ মিনিট পর ধীরেসুস্থে বিছানায় এসে বসলো। দৃষ্টি তখন ফ্লোরে রেখে স্তব্ধ ভঙ্গিতে বসে ছিলো।
জীবনে অনেক মেয়েকে সে দেখেছে, যুবতী-নারী, বালিকা-সাবালিকা সবই সে দেখেছে, কিন্তু আজকের মতো অন্যমনষ্কা উদাসিনী আগে কখনো দেখেনি। সেই রূপের কাছে দৃষ্টি আটকে যায়, সেই চোখের মাঝে যেনো দিক হারিয়ে ফেলে, সেই ভঙ্গির মাঝে অভিভূত হতে হয় বারবার। সাদা রঙের মাঝে গোলাপী রঙটা মিশালে যেমন রূপের দেখা মিলতে পারে, তেমনি গায়ের রঙ ছিলো মেহনূরের। চোখের দৃষ্টি ছিলো অতলস্পর্শে গভীরতম, ভ্রুঁ দুটো ছিলো সরু ও খুব সুন্দর। চোখদুটোর পাপড়ি ছিলো ঘন পাপড়িময় পল্লব। পলকের জন্য যখন চোখের পাতা বুজে আসে, তখন দেখা যায় রাজ্যের শ্রীযুক্ত অনন্য সৌন্দর্য্য। কম্পমান ওষ্ঠদুটি কৃষ্ণচূড়া ফুলের মতো রক্তিম-লাল ওর। কৃষ্ণচূড়া ফুলের উপর বাতাসের স্পর্শ লাগলে যেমন হেলেদুলে দুলতে থাকে, ঠিক তেমনি থরথর করে ঠোঁটদুটো কাপছিলো ওর। মাহতিম ওমন ভরা-রূপের সৌন্দর্য্য দেখে তীব্র উৎকন্ঠায় ছটফট করছিলো। আকস্মিক আর্কষনটা ভুলার জন্য তৎক্ষণাৎ সে চোখ বন্ধ করলো।
কিন্তু বেহায়া মনটা মস্তিষ্কের বিপরীতে কল্পনা করতে ব্যস্ত হলো, কোনো কিছুই আর সঠিক কায়দায় ভাবতে পারলো না। চিকন-চিকন আঙ্গুলগুলো সাদাটে শাড়িতে অসংখ্য কুচি করছিলো, পেটের কাছে কুচিগুচ্ছ গুজাতে গিয়ে পেটের কাছটায় শাড়ি তুলেছিলো। তুলেই যখন যথাস্থানে গুঁজবে, তখনই বাকরুদ্ধ হয়ে গেলো মেহনূর। এদিকে মাহতিমের ভেতরটা তুফানের মতো লন্ডভন্ড হয়ে যাচ্ছে, একের-পর-এক জলোচ্ছাসের তীব্র ঝাপটা ভয়ংকর ভাবে মনের উঠোনে আছড়ে পরছে, ঠোঁট ও চোয়াল বরফের মতো শক্ত হয়ে আসছে। নিজেকে স্থির রাখা বড় দায় ছিলো ওর জন্য, তবুও নিজেকে সংযত করে সেখান থেকে পালাতে সক্ষম হয়েছিলো। কিন্তু মেহনূরের অবস্থা যে বেগতিক মাত্রায় খারাপ হয়ে যাচ্ছিলো, সেটা হয়তো মাহতিম জানে না।
বাবা-দাদা-দাদাই ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের সামনে যে মেয়ে আসতো না, আজ এমনভাবে একজন পুরুষের সামনে আসলো সেটা সত্যিই লোমহর্ষক ঘটনার মতোই ছিলো। মেহনূর তখন অবাক-হতবাক-নির্বাক হয়ে গেলো। শাড়িটা পরার মতো মানসিকতা একেবারেই লুপ্ত হয়ে গেছিলো। টিক-টিক করে সময়ের স্রোত অনেকক্ষন পেরিয়ে গেলো। অনুমান করা না গেলেও বাইরে সাঁঝের আধার নেমেছিলো। চর্তুদিক থেকে ‘ আল্লাহু আকবর ‘ ধ্বনিটা নির্জনতা ভেদ করে মূর্ছনার মতো ছড়িয়ে পরছিলো।
আযানের সুরে পুরোপুরি চৈতন্য ফিরে পায় মেহনূর। আবিষ্কার করে রুমের ভেতর ঘুটঘুটে অন্ধকার। লাইট জ্বালানো হয়নি, সেই সঙ্গে বাড়ির আনাচে-কানাচে এখনো কেউ বাতি জ্বালায়নি। তার মানে এখনো কেউ বাড়ি ফিরেনি। অন্ধকারের মধ্যেই আন্দাজের সঙ্গে শাড়ি পরলো মেহনূর। পিঠের উপর আচঁল টেনে জবুথবু হয়ে ঢাকলো নিজেকে। অন্ধকার নিঃশেষ করে লাইট জ্বালিয়ে দিলো সে। আধভেজা দরজার দিকে নজর পরতেই বুকটা কাপড় চিপড়ে ফেলার মতো মুচড়ে এলো ওর। বয়সের গন্ডি ষোল পেরিয়ে সতেরো’র কৌঠায় পা দিলেও ছোট থেকেই অন্তুর্মুখী স্বভাবের মেয়ে ও। চন্ঞ্চলতার স্বভাব মেহনূরের বড্ড অপছন্দ।
একটু বুঝতে শিখার পর থেকেই কম কথা বলে, প্রয়োজনীয় আড্ডাটা দাদাভাইয়ের সাথেই বেশি দেয়। বেশিরভাগ সময় বিভিন্ন লেখকের বই পড়তে-পড়তে চলে যায়, তবে বাকিটুকু সময় পড়াশোনার জন্য খাটায়, আর প্রয়োজনমতো মা ও বড়মার সাথে রান্নাঘরে চলে যায়।
মেহনূর নিজেকে চূড়ান্তভাবে শান্ত করে চুপচাপ বাইরে পা রাখলো। ডানে ও বামে ভালোমতো দেখে নিয়ে সিড়ি ধরে নিচে নামলো। আঙিনায় দাড়িয়ে ওদের ঠিক বিপরীত দিকের দোতলার দিকে তাকালো, কেবল একটা রুমের লাইট জ্বলছে সেখানে, বাকিসব রুম অন্ধকার। মেহনূর পরপর দুটো ঢোক গিলে আঙিনার বাতিটা জ্বালিয়ে দিলো। একইভাবে সিড়ির বাতি, উঠোনের দিকে বাতি, বড় তিনবোনের রুমেও বাতি জ্বালিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে চুলায় চায়ের পানি চড়ালো। দাদাভাই মসজিদ থেকে ফিরেই চায়ের জন্য অপেক্ষা করবে। কিন্তু আজ দাদাভাইয়ের সাথে কিভাবে আড্ডা দিবে? সেই পুরুষোচিত দৃষ্টির কবলটা কিভাবে মুখ ফুটে বলবে? এটা অসম্ভব, বলাই যাবেনা ওর পক্ষে।
রাতের দিকে খাবার পর্ব হলো, কিন্তু মাহতিম খেতে এলো না। অনেকবার ডাকা সত্ত্বেও মাহতিম খাবারের জন্য রাজি হলো না। মেহনূর অতিথির জন্য রুমের ভেতরে খাবার খেয়ে নিতো, কিন্তু আজ যে প্লেটের ভাত পলিথিনে পুড়ে গোয়ালের গরুকে খেতে দিয়েছে সেটা কেউ জানেনা। ভাতের একটা কনাও গলা দিয়ে নামবার জো নেই দুজনের। চোখ বন্ধ করলে এখনো সেই দৃশ্য ভেবে গা শিউরে উঠে। রাতে খুব তাড়াতাড়ি শুয়ে পরলো সে। কিন্তু ঘুম এলো না একটুও। খোলার জানালার বাইরে আবদ্ধ হওয়া চোখদুটো অশ্রুতে টলটল করে বর্ষন হচ্ছিলো। নিরবে-নিভৃতে, আড়ালে-অপ্রকাশে, চুপিচুপি-নিঃশব্দে বাধ ভাঙ্গা কান্নায় মেহনূর ঠোঁট কামড়ে কাঁদছিলো।
নিজেকে কড়া নিয়মে রেখেছে এতোদিন, কঠোরভাবে সেসব নিয়মকানুন মেনেছে, আজ বাতাসের মতো এক ঝটকায় সবকিছু শেষ হয়ে গেছে। অন্যদিকে বুকের ভেতর হাশফাস করছে মাহতিমের। জীবনের এমন পর্যায়ে এসে কখনো পস্তাতে হবে ভাবতেও পারেনি সে। ঘন্টার-পর-ঘন্টার সময় চলে গেলে নীতির রুমে সব কাজিনসহ বন্ধুদল আলোচনায় বসে। কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে মাহতিমের অবস্থা এমন কেনো হয়েছে সেটাই ভেবে পাচ্ছেনা ওরা। নীতি বোনদের মধ্যে বড় হলেও বুদ্ধিতে সবার বড়। সৌভিক বন্ধুদের মধ্যে সবচেয়ে হারামি হলেও কাজের বেলায় ন্যায়নিষ্ঠ। নীতি ও সৌভিকের কাছে ব্যাপারটা উদ্ভট লাগলো এবং তখনই প্ল্যান করলো সোজাসাপ্টা মাহতিমকে জিজ্ঞেস করবে।
সবকিছু ঠিকঠাক মতো ভেবে সবাই মাহিমের রুমে এসে বসে। ঘেরাও করে ধরে মাহতিমকে। সবার প্রথম নীতি প্রশ্নটা করে,
– ভাই তোমার কি হয়েছে বলবা? তুমি যে মুখে তালা লাগানোর মানুষ না, এটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু তোমার যে কিছু একটা হয়েছে এটা অন্তত আমি বুঝে গেছি। বলোনা ভাইয়া, কি নিয়ে টেনশনে আছো?
টিশার্ট পড়ুয়া মাহতিম চুপ করে রইলো। পাশ থেকে সাবির সোজাসুজি প্রশ্ন করলো,
– আমরা যাওয়ার পর নির্ঘাত কিছু হইছে ভাই। আ’ম ড্যাম শিওর! তুমিতো বিন্দাস মুডে ছিলা, আমরা আসতে-না-আসতেই তোমার কি হলো?
সবাই যখন দফায়-দফায় প্রশ্নের জেরায় ফেললো তখন সত্যিই রাগ চলে আসলো ওর। কিন্তু নিজেকে ধাতস্থ করে শান্তরূপে পরিস্থিতি সামাল দিয়ে স্বাভাবিক দৃষ্টিতে বললো,
– আমি যা বলবো মায়ের কাছে লাগিয়ে দিবি নাতো?
সবাই একসাথে বলে উঠলো ‘ একদম না ‘। মাহতিম ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে গলা ভিজিয়ে নিলো। দৃষ্টিটা সবার দিকে নিক্ষেপ করতে-করতে শান্ত সুরে বললো,
– বাড়িতে কেউ ছিলো না। নোট দ্যা পয়েন্ট, ‘ বাড়িতে কেউ ছিলো না ‘। আমি হান্নান নানার বাড়িটা দেখার জন্য একা-একা ঘুরছিলাম। যেহেতু বাড়িতে কেউ নেই, তাই সবার রুমে ঢুকে কারুণিক সজ্জা দেখছিলাম। বিশ্বাস কর, আমি ভাবতেও পারিনি দোতলার রুমটায় মেহনূর ছিলো। ও আমাকে দেখে কেমন ডেন্ঞ্জারাস রিয়েকশন দিয়েছে সেটা আমি ডিস্ক্রাইভ পযর্ন্ত করতে পারবো না, আমিতো নিজেই শকে ছিলাম। ও যে বাড়িতে আছে আমি এইটুকু পযর্ন্ত জানতাম না, জানলে আমি জীবনেও ওর রুমে যেতাম না। সাচ্ লাইক এ্যা ট্যারিফিক লুক! আমার এখনো চোখে ভাসছে।
মাহতিমের কথা শুনে সবাই হা করে নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাইয়ি করলো। সবাই সংকুচিত দৃষ্টিতে ঢোক গিললো। মেহনূরের সাথে প্রথম সাক্ষাৎ হয়ে গেছে ভেবে নীতি খুশী হলেও সেটা মাহতিমের চেহারা দেখে প্রকাশ করলোনা। সাবির চোখের ইশারায় সিয়ামকে ইঙ্গিতপূর্ণ কথাটা বোঝালো। সিয়াম কথাটা বুঝে মাথাটা হ্যাঁ সূচকে ঈষৎ নাড়িয়ে মাহতিমের দিকে দৃষ্টি দিলো। সরল কন্ঠে বললো,
– দোস্ত ইটস নরমাল। তুই এতো টেনশন করছিস ক্যান? তাছাড়া ওই ঘাউরা মেয়ের জন্য তুই এমন আপসেট থাকবি?
মাহতিম দৃষ্টি তীক্ষ্ম করে তাকালো। কপালে ভাঁজ ফেলে প্রশ্ন করলো,
– হু ইজ ঘাউরা? কি বললি তুই?
সিয়াম চট করে কিছু বলতে যাবে ওমনেই মাথায় তড়াক করে চাট্টি খেলো। চাট্টিটা সৌভিক মেরেছিলো। সিয়াম মাথায় হাত বুলাতে-বুলাতে অকথ্য ভাষায় গালি দিতেই সৌভিকের ধমক খেলো। প্রীতি এতোক্ষন চুপ ছিলো, সে হঠাৎ অন্যমনষ্ক ভঙ্গিতে বললো,
– ভাইয়া একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, যদি সত্যি না বলো সোজা কাকীমার কাছে বিচার দিবো।
মাহতিম ক্লান্ত ভঙ্গিতে নিশ্বাস ছেড়ে বললো,
– বলে ফেল। জননীর নামে থ্রেড দিতে যাস না। মা-জননী শুনলে কি কাহিনী করবে আমি চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছি।
সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে টান-টান উত্তেজনা নিয়ে প্রীতির দিকে তাকালো। ফারিন এমনভাবে তাকিয়ে ছিলো যেনো প্রীতির মুখটা চোখ দিয়েই গিলে খাবে। প্রীতি সেদিকে ধ্যান না দিয়ে বললো,
– মেহনূরকে দেখলে কি বুকে ধুকপুক হয়?
মাহতিম এমন উদ্ভট প্রশ্ন শুনে কিছু বলবে ওমনেই মুখের কথা টেনে তৌফ ক্রুদ্বস্বরে বললো,
– বা* হয় বা* ! আরেকবার জিজ্ঞেস করিস, তোরে থাপড়ায়া ধুকপুকনি বুঝামু! বড় ভাইরে এসব প্রশ্ন করে? দুইদিনের মাইয়া ক্যামনে সবার সামনে প্রশ্ন করে! হায়রে কপাল! কি দুনিয়া আসলো! ওই মাহতিম, তুই তোর বোনগুলিরে টাইট দেস না ক্যান? শালা, কেমনে ঠাসঠাস কোয়েশ্চ্যান করতেছে। আমার বোন হইলে থাবাড়ায়া কানশা ফাটাইতাম।
মাহতিম গম্ভীর হয়ে বসে থাকতেই তৌফের কথা শুনে হেসে ফেললো। হাসির ভঙ্গিতে তৌফের পিঠ চাপড়ে বললো,
– আমি ওদের এটাই শিখিয়েছি দোস্ত। কোনো প্রশ্ন আসলে হেস্টিটেট না করে সোজা আমাকে বলে দিতে। পেটে কথা রেখে লাভ কি? তাছাড়া প্রীতি এখন টুয়েন্টি। শুধু-শুধু ধমকাবো কেন?
এবার প্রীতির দিকে তাকিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বললো মাহতিম,
– শোন প্রীতি-সম্ভাষণ, আমি ওকে দেখলে ধুকপুক ফিল করিনা। ও তো আমার চেয়ে অনেক ছোট। ওর মতো পুচকির জন্য আমার হার্টবিট ফার্স্ট হবে? বয়সের হিসেবটা একবার মিলিয়ে দ্যাখ। সি ইজ টু মাচ জুনিয়র। এটা তো চলেনা প্রীতি। তোর ভাইয়ের বয়স কি ভুলে গেলি?
মাহতিমের কথা শুনে সবাই নিরবে তাকিয়ে রইলো। এক হতাশার নিশ্বাস সবার বুক ঠেলে বের হলো তখন। কাজ ও দায়িত্বের চাপে মাহতিম যে ত্রিশের কৌঠা পেরিয়ে ফেলেছে, সেটা সবাই জানতো। মাহতিম হাসির সুরেই বলতে লাগলো,
– তোরা আমার লাইফটা যে সেটেল করতে চাচ্ছিস আমি জানি। আমি এটাও জানি তোরা পুরো ইনফরমেশন কালেক্ট করে এখানে আসার প্ল্যান করেছিস। যেই শুনেছিস এ বাড়িতে চারটা মেয়ে আছে, আর সবাই বেশ সুন্দরী, তখনই তোরা চুপিসারে প্ল্যান বানিয়ে আমাকে টেনে আনলি। মা যেখানে আমার বিয়েরর জন্য প্রেশার দিচ্ছেনা, সেখানে তোরা এমন কাহিনী করবি ভাবা যায়না। আমিতো ভুলেও এখন কোনো গ্রামে আসতাম না। তোরা যদি চাপাচাপি না করতি আমমি সত্যিই আসতাম না। কিন্তু দয়াকরে কাউকে আমার ঘাড়ে চাপাস না। ছুটিটা কাটাতে এসেছি, শান্তিমতো কাটাতে দে। আবার প্রোফেশনাল লাইফে ব্যস্ত হয়ে পরলে কবে আসবো জানা নেই। তোদের সব-কটাকে আমি চিনি। সৌভিক? দ্যাখ বন্ধু, তুই আমার তিন বছরের জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও আমাকে এনাফ বুঝিস। তোর সাথে আন্ডার্সটেন্ডিংটা এজন্যই টিকেছে, কারন তুই আমার উপর কোনো বিষয় নিয়ে ফোর্স করিস না। প্লিজ দোস্ত, তোরা কেউ আমাকে এসব প্রেম-বিয়েতে জোর-জবরদস্তি করিস না। মন থেকে কিছু ফিল করলে এমনেই ওসবে ভিড়তে বাধ্য হবো। কিন্তু মনের বিপক্ষে কিছু করা আমার জন্য পসিবল না।
সৌভিক, তৌফ ও সিয়াম কিছুক্ষণ চুপ থাকলো। মাহতিম ওদের সবার বড়। কিন্তু আচরণের দিক দিয়ে ততোই যেনো ওদের প্রিয়। সৌভিকদের সাথে এক এলাকায় পরিচয় এবং সেই থেকেই ওদের সঙ্গে খাতির। জীবনে আর কোনো ক্লোজ বন্ধু মাহতিম বানায়নি। অনেকগুলো কাজিন থাকা সত্ত্বেও নীতি ও প্রীতি দেশের থাকে। বছরে একবার বাংলাদেশে আসে। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। সাবির, সামিক দুজনই ‘ ভাই ‘ বলতে অজ্ঞান, ফারিন আরো বেশি পাগল। মাহতিমের স্বভাবটা একরোখা হলেও ক্ষেত্রবিশেষে মাঝে-মাঝে রেগে যায়। ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে তুললে যা হয়, মাহতিমের মধ্যে সেটাই দেখা যায়। তবে সহজাত শান্ত স্বভাবের ব্যক্তি মাহতিম। নিজেকে সাধারণ ভাবে রাখতে এবং মানুষের সাথে শান্ত চেহারায় কথা বলতে স্বচ্ছন্দ্য বোধ করে সে। জীবনটা গোছানো হলেও নিজেকে কঠোর বিধি-নিষেধে রাখতে পছন্দ করে। কিছু মানুষের জীবনে সব থাকা সত্ত্বেও অদ্ভুত শূন্যতা যেমন বিরাজ করে, তেমনি মাহতিমও তার গোছানো জীবনে কিছু একটার কমতি অনুভব করে।
সকালের নাস্তাটা সারতে খাবার ঘরে যায় মাহতিম। সেখানে গিয়ে দেখে সবার খাওয়া প্রায় শেষ হয়ে গেছে, শুধু নীতি ও শানাজ একসঙ্গে গল্প করে রুটি-তরকারি খাচ্ছে। মাহতিমকে বসতে দেখে শানাজ তড়িঘড়ি করে উঠে প্লেট এগিয়ে দুটো রুটি ও একটা বাটিতে তরকারির ঝোল বেরে দেয়। মাহতিম পুনরায় টেবিলে বসতেই মাহতিম রুটি ছিড়তে থাকে। ছেড়া রুটিটা ঝোলে চুবাতেই নীতি কথার মাঝে শানাজকে বলে উঠে,
– আচ্ছা, সকাল থেকে যে মেহনূরকে কোত্থাও দেখলাম না। ও কোথায়? ও কি ঘুম থেকে উঠেনি?
খেতে গিয়ে মাত্রাতিরিক্ত হোচট খেলো মাহতিম। ঝোলে ভেজানো রুটিটা আর দাঁতে চিবানোর সাহস পাচ্ছেনা। মেহনূর যে লজ্জায় আর রুম থেকে বেরুচ্ছেনা, স্পষ্টরূপে বুঝে গেছে মাহতিম। নিজেকে প্রচুর গালাগাল করলো সে, কাল কেনো ওদিকটায় গিয়েছিলো? একটা মেয়েকে লজ্জায় ফেলার ইচ্ছা কোনোকালেই ওর ছিলোনা। নীতির প্রশ্ন শুনে শানাজ রুটি ছিড়তে পারলোনা, মন উদাস করে নিচু সুরে বললো,
– ওর শরীর খারাপ, নীতি। ভোররাত থেকে জ্বরে কাঁপছে। ছোট মা ফজরের নামাজ পরে কি মনে করে ওর রুমে গেলো, গিয়েই দেখে জ্বরে কুঁকড়ে কাঁপছে। দাদাভাই এজন্যই তো তাড়াতাড়ি খাওয়া সারলো। ডাক্তার ডাকা ছাড়া উপায় নেই। জলপট্টিতেও কাজে দিচ্ছেনা। সাতটার দিকে একবার গোসল করিয়েছে, কাজ হয়নি। জ্বর একদম কমছেনা।
মন বাড়িয়ে ছুঁই পর্ব ১+২
নীতি কথাগুলো শুনে পদে-পদে চমকে যাচ্ছিলো। অসুস্থ হওয়ার আসল কারনটা অনুমান করতেই তৎক্ষণাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে দ্রুত মাহতিমের দিকে তাকালো! ওমনেই গলা শুকিয়ে এলো ওর! মাহতিম তখন প্লেটের দিকে তাকিয়ে সাংঘাতিক ভাবে রুটিটা মুচড়ে ফেলছিলো। হাতের ভয়ংকর পিষ্টনে রুটিটা টুকরো টুকরো হয়ে ছিড়ে যাচ্ছিলো। নীতি ঠোঁট ভিজিয়ে মাহতিমের দিকে দৃষ্টি রেখে পানির গ্লাসে চুমুক দিলো, গলাটা ভিজানো ভীষণ দরকার।ভীষন দরকার!
